আগস্ট আবছায়া – ১.৫

১.৫

এক সকালে, জানলাম এটা ১৩ আগস্ট সকাল, নিজেকে আমার সুস্থ বোধ হলো অনেক, দেয়ালে ঝোলানো ঘড়িতে দেখলাম ভোর পাঁচটা দশ। আজ বেলা তিনটার দিকে আমাকে বাসায় যেতে দেওয়া হবে। আমি আগে থেকেই হিসাব নিয়েছি আমার বিলের, এক টাকাও পরিশোধ করা হয়নি এ পর্যন্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক (আমার দুই বন্ধু মাসুম হায়াত ও নূর হোসেন) অ্যাপোলো হাসপাতালের মূল মালিকদের একজনকে, শান্তা গ্রুপের মনির সাহেবকে, বলে রেখেছেন যে সব বিল একবারে পেমেন্ট হবে হাসপাতাল ছাড়ার দিনে। মনির সাহেব তাতে রাজিও হয়েছেন বলে আমি জেনেছি। ভালো। 

বিছানা থেকে উঠে এক কাপ চা বানালাম-আর্ল গ্রে, চিনি-দুধ ছাড়া। মনে হলো কত দিন এসপ্রেসো কফি খাই না। সিদ্ধান্ত নিলাম, আজ বিকেলেই বনানী ১১ নম্বর রোডের কোনো একটা ভালো কফিশপে গিয়ে তা খাব। ভালো এসপ্রেসো কফির গন্ধ, জিবে রেখে যাওয়া তার চুকা ভাব এবং মুখের ভেতরে ওপরের তালুতে অ্যাসিডিক ওই অনুভূতির কথা মনে করে পৃথিবীর জন্য ভালোবাসায় আমার শরীর প্রায় শিরশির করে উঠল। আমার বহুদিন পর আবার মনে হলো প্রতিটা মানুষই মারা যায়, মারা যাবে, কিন্তু মানব ইতিহাসে এই প্রথম ও শেষবারের মতো তার একটা ব্যতিক্রম হবে, আর তা আমাকে দিয়েই। 

ছোটবেলায় এ কথা প্রায়ই ভাবতাম আমি। হয়তো আমার মতো অন্য অনেকেও এটা এক বয়স পর্যন্ত নানাভাবে ভাবে যে দুর্ঘটনা অন্য বাসার জিনিস, আমাদের বাসায় হবে না; মৃত্যু পাড়াপড়শির অন্য কারও হয়, এ বাসার লোকেরা মৃত্যুহীন; এবং আমি মরব না কোনো দিন। 

ছোটবেলায়, বারো বছর বয়সে ক্যাডেট কলেজে ঢোকারও অনেক আগে, বরিশালে পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতে যেতে শুনেছিলাম অক্সফোর্ড মিশন রোডের এক জমিদারবাড়িতে-বাড়ির নাম ছিল ‘হক ম্যানশন’, যার ঢোকার মুখে বড় সিঁড়ির দুধারে ছিল দুটো সিমেন্টের সাদা সিংহ—এক বাবা তার ছেলেকে মেরে ফেলেছেন গুলি করে। মনে আছে ভিড় ঠেলে আমি গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম লাশের একদম পাশে, মনে আছে হালকা ধূসররঙা এক বিছানা ছিল সেটা এবং তাতে শুয়ে ছিল ঋষি-দেবতা চেহারার এক মানুষ। তাকে তখনো কোনো কাপড় দিয়ে ঢাকা হয়নি, তখনো তার পরনে একটা খাকিরং হাফপ্যান্ট, গায়ে একটা ধবধবে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি, সেটা ভরে আছে পাকা ডালিমের ভেতরের কালো-লালরং রক্তে। মনে আছে তার চামড়া আমার কাছে লাগছিল মোমে বানানো, মুখ ফরসা, যেমন ফরসা ছিল তার ঠোঁট, আঙুল, পায়ের বুড়ো আঙুল, নখ, তবে তার হাত ও পায়ের রং ছিল নীলমতো, তার চোখ যেন আমার চোখের সামনেই ডুবে যাচ্ছিল মাথার ভেতরের দিকে। 

এর ঘণ্টা পাঁচেক পরে, স্কুল শেষে, আমি বাসায় না ফিরে আমার মেজ ভাইকে নিয়ে আবার সে বাসায় গিয়েছিলাম সেই আশ্চর্য অবিশ্বাস্য জিনিস দেখতে, যার নাম মৃত্যু, মৃতদেহ। মনে আছে কী এক কারণে তারা আমার ভাইকে ভেতরে ঢুকতে দিলেন না, কিন্তু আমাকে দেখেই বললেন, ‘যাও খোকা।” আমি আবার একই ঘরে গিয়ে দাঁড়ালাম একই বিছানার পাশে, শুধু তফাত যে এবার লোকজন অনেক কম, এবার শান্তিমতো দেখা যাচ্ছে মৃত্যুকে। এই দফায় দেখলাম লাশটা টান টান, কাঠ কাঠ, গেঞ্জির রক্ত শুকানো, চটচটে, গায়ের রং কেমন লাল-বেগুনি। বড় হয়ে জেনেছি মৃতদেহের এই ধাপকে বলে রিগর মর্টিস, যখন মৃতদেহ টান টান হয়ে যায় শেষবারের মতো এবং এর ঘণ্টা বিশেক বা এক দিন পরে শরীর চলে যায় ঠিক উল্টো ধাপে – ঢিলাঢালা, গন্ধ বেরোনো, রং সবুজ-নীলের মিশেল এবং চেহারার স্পষ্টতা মুছে যেতে শুরু হওয়ার ধাপ। এভাবে শেষ একবার মানুষ চারপাশের দর্শককে যেন দেখিয়ে যায় যে আমার মাংসপেশিগুলোয় এখনো রাসায়নিক পরিবর্তন সম্ভব, এখনো আমি মারা গেলেও পেশিগুলো জেগে আছে, আর দ্যাখো কেমন ধাপে ধাপে টান টান হচ্ছে একটা করে একটা অঙ্গ, প্রথমে চোখের পাতা, তারপরে ঘাড়, তারপর চোয়াল, মানে এ নিয়ত পরিবর্তনশীল পৃথিবী যার ঋতু বদলায়, যার হাওয়ায় গতি বদলায়, যার রাত ভোর হয়ে আবার সন্ধ্যার ভেতর দিয়ে ঘুরে এসে রাত হয়, এবং যার সমুদ্রের ঢেউ বদলায় মাত্র কয় ঘণ্টা পরপরই, সেই পৃথিবীর নিয়মের মধ্যে দ্যাখো আমি এখনো আছি, আমি এখনো বদলাচ্ছি, মানে এখনো আমি এই পৃথিবীরই কেউ, যদিও হঠাৎ কেন যেন আমি দেশত্যাগী, নিরালম্ব কোনো মাতৃপিতৃস্ত্রীপুত্রভাইবোনহীন অনাথ হয়ে গেছি। 

মনে আছে, ওই রিগর মর্টিসে থাকা দেবদূতসুলভ তরুণের আধবোজা চোখের দিকে তাকিয়ে—পুলিশের লোকজন তখন বড় বড় ক্যামেরায় মরা মানুষটার ছবি তুলছে তো তুলছেই আর আমাকে বারবার বলছে, ‘খোকা, ডানে যাও তো; খোকা, বামে যাও তো; খোকা, পেছনে যাও তো; খোকা, লাশের ওপাশে যাও তো; খোকা, তুমি যাও তো, হয়েছে তোমার দ্যাখা?’—মনে আছে তখন হয় ওই মৃত দেবদূতের মুখ দেখতে দেখতে, না হয় ওভাবে দরজার দিকে যেতে যেতে আমি নিজেকে বলছিলাম, ‘আমি কখনো মরব না, ছি!’

ছি!-টা আমি বলেছিলাম, সেই বয়সেও, মৃতদেহের প্রতি মানুষের অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধার ব্যাপারটা দেখে। মনে আছে তখন বলতে গেলে তার পাশে আমি এবং দু-একজন পুলিশ-ক্যামেরাম্যান ছাড়া আর কেউই ছিল না। লোকটা মারা গেছে, লোকটা গ্লাসে পানি ঢেলে খেতে পারছে না, আর কেউ এসে সেটা করেও দিচ্ছে না তার জন্য। লোকজন এত কম, এত কম তার চারপাশে? তখনই সম্ভবত আমি ইঁচড়ে পাকা কোনো ছেলের মতো অনেক বড় একটা সত্য বুঝে ফেলেছিলাম যার কনফারমেশন পরে পেয়েছি বড় হয়ে-মৃতদেহের সম্মান-মান-মর্যাদার সিঁড়ির ধাপগুলো গড়া কোনো লাশের পাশে লোকজন কত আছে সেই সংখ্যার কম-বেশি দিয়ে। 

এ নিয়মও আমাদের এই আজব কাকতাড়ুয়া পৃথিবীরই বানানো—দাফনের সময় যে কবরের পাশে লোকজন নেই এবং দাফনের আগে যে মৃতদেহের পাশে ফেটে পড়া ভিড় নেই, সেই অবহেলা-অবজ্ঞার চাইতে দুঃখের কোনো কিছু বুঝি এই পৃথিবীতেই নেই, যদিও যে মৃত তার তাতে একবিন্দু কিছুই যায় আসে না, শুধু সমাজে তার বিষয়ে বিরূপ ও করুণামিশ্রিত এক ধারণা তৈরি হওয়া ছাড়া; যদিও যে মৃত তার তাতে একবিন্দু কিছুই যায় আসে না, শুধু তার কাছের লোকজন—স্ত্রী সন্তান ভাই বোন—যারা বেঁচে থাকে, তাদের জন্য পুরো ঘটনাটা একটু অসমীচীন এক নাজুক লজ্জার বিষয় হওয়া ছাড়া; যদিও যে মৃত তার তাতেও একবিন্দু কিছুই যায় আসে না… 

চিন্তার এই দড়িপাকানো মুহূর্তে, সকাল পাঁচটা পঁয়ত্রিশে, পৃথিবীর বিষয়ে কোনো এক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবার আগেই—যেমন নিকুচি করি এই পৃথিবীর; যেমন, জীবন এমনই, এর ভালো-মন্দ বিচারের কিছু নেই; যেমন জীবন এমনই কুয়াশায় ঘেরা এক আস্ফালন—আমি এ রকম কোনো কিছু যেন নিশ্চিতির সঙ্গে ভেবে না ফেলি তাই দ্রুত আমার বেডের পাশের ছোট টেবিল থেকে তুলে নিলাম পথের পাঁচালী—এই পৃথিবীতে লেখা একমাত্র বই, যা বস্তুপৃথিবীর চাপে ও সংঘর্ষে পথ হারিয়ে ফেলা মানুষকে আবার শক্ত এক পথ দেখাতে পারে বিশ্বপ্রকৃতির আবহমান চক্রের মধ্যে তার আসনটা তাকে দেখিয়ে দিয়ে। আমি একটানা, এক মুহূর্তেরও বিরাম না দিয়ে, মোটামুটি পাঁচ ঘণ্টায় শেষ করলাম পুরো বইটা আবার একবার, এবং আমাকে সেই বিরামহীন পড়ার সময়টুকু দিতে নানাভাবে সাহায্য করলেন আমার নার্স, মমতাময়ী লুবনা জাহান। 

‘রাতজাগা পাখিটা একঘেয়ে ডাকিতেছিল, বাহিরের জ্যোৎস্না ক্রমে ক্রমে ম্লান হইয়া আসিতেছে। এক হিসেবে এই রাত্রি তাহার কাছে বড় রহস্যময় ঠেকিতেছিল, সম্মুখে তাহাদের নবজীবনের যে পথ বিস্তীর্ণ ভবিষ্যতে চলিয়া গেছে—আজ রাতটি হইতেই তাহার শুরু। 

…নদীর ধারের অনেকটা জুড়িয়া সেকালের কুঠিটা যেখানে প্রাগৈতিহাসিক যুগের অতিকায় হিংস্র জন্তুর কঙ্কালের মতো পড়িয়া ছিল, গতিশীল কালের প্রতীক নির্জন শীতের অপরাহ্ণ তাহার উপর অল্পে অল্পে তাহার ধূসর উত্তরচ্ছদবিশিষ্ট আস্তরণ বিস্তার করিল। কুঠির হাতার কিছু দূরে কুঠিয়াল লারমার সাহেবের এক শিশুপুত্রের সমাধি পরিত্যক্ত ও জঙ্গলাকীর্ণ অবস্থায় পড়িয়া আছে। বেঙ্গল ইন্ডিগো কসারনের বিশাল হেডকুঠির এইটুকু ছাড়া অন্য কোনো চিহ্ন আর অখণ্ড অবস্থায় মাটির উপর দাঁড়াইয়া নাই। নিকটে গেলে অনেক কালের কালো পাথরের ফলকে এখনো পড়া যায়— 

Here lies Edwin Lermor, 
The only son of John & Mrs. Lermor, 
Born May।3,।853, Died April 27,।860. 

অন্য অন্য গাছপালার মধ্যে একটি বন্য সোঁদাল গাছ তাহার উপর শাখাপত্রে ছায়াবিস্তার করিয়া বাড়িয়া উঠিয়াছে, চৈত্র বৈশাখ মাসে আড়াই বাঁকীর মোহনা হইতে প্রবহমান জোর হাওয়ায় তাহার পীত পুষ্পস্তবক সারা দিনরাত ধরিয়া বিস্মৃত বিদেশী শিশুর ভগ্ন-সমাধির উপর রাশি রাশি পুষ্প ঝরাইয়া দেয়। সকলে ভুলিয়া গেলেও বনের গাছপালা শিশুটিকে এখনো ভোলে নাই। 

.

হাসপাতাল থেকে চেক-আউট করলাম লুবনাকে ভালো টিপস্ দিয়ে, যদিও তিনি নিতে চাইলেন না, বারবার বলতে লাগলেন যে আমাকে তার অন্য রকম ভালো লেগেছে, আমি যেন আমার স্বাস্থ্যের যত্ন নিই, আর ‘আমাকে টিপস দিয়েন না স্যার, শুধু কাউকে দিয়ে আপনার কাফকা গল্পসমগ্র বইয়ের একটা কপি আজকালের মধ্যে পাঠায়ে দিয়েন, তাতেই আমি বেশি খুশি হব। আমি পড়াশোনা কম করা মানুষ, কিন্তু আমার ভাই নাটক-সাহিত্যের লোক, তারে দেব বইটা। আমি তারে বাসায় আপনার নাম বলতেই বলছে, “জিজ্ঞেস করিস তো উনি এই বইটার লেখক কি না?”

।হাতের মুঠো থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ খুলে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন লুবনা, খুব গোছানো হাতে তাতে লেখা ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্র— এই কথাটুকু। তার ভাইয়ের হাতের লেখা, বুঝলাম। 

কেবিন থেকে বের হতে যাব, দেখি নূর হোসেন। আমি তার গাড়ি করেই বাসায় যাচ্ছি। আমরা দুজন নিচতলায় বিল পরিশোধের কাউন্টারে গেলাম, আমাদের পেছন পেছন এলেন লুবনা ও তার নিচের র‍্যাঙ্কের-ক্লিনার গোছের-এক ছেলে। কাউন্টারের ভদ্রলোক, যিনি কথা বলেন তোতলিয়ে, সব চেক করে বললেন, ‘আপনার বিল তো তো তো পুরো দেওয়া হয়ে গেছে। এক ঘণ্টা আগে এক এক এক ম্যাডাম সব টাকা দিয়ে গেছেন।’ 

বাইরে ঝরঝরে একটা দিন, ভালো গরম, তবে ডান-বাম দুদিক থেকেই বাতাস বইছে বলে গুমোট লাগছে না। আমি হাসপাতালের মূল দরজায় অপেক্ষা করছি নূরের গাড়ির। সে নিজেই ড্রাইভার, পার্কিং স্পেসে জায়গা পায়নি, এখন ওই দূরে বাইরে হেঁটে গিয়ে গাড়ি আনতে হচ্ছে তাকে। মেহেরনাজ তার মানে আজ সকালে এখানে এসেছিল, কাজ শেষ করে চলে গেছে। ওটাই মেহের-করিতকর্মা ও কল্যাণকামী এবং বাহ্যিক চরিত্রে প্রবল শক্তির। কিন্তু আজ আমি তার সংগোপনে কাজ সারার নিখুঁত মোডাস অপারেন্ডি ও বুঝলাম—যা সে করতে চায়, তা যেন যতটা সম্ভব অনায়াসে করা যায়, সেই লক্ষ্যে সে জানে কীভাবে এক চামচ সাবধানতার সঙ্গে মেশাতে হয় এক চামচ গোপনীয়তা এবং এক চামচ পাকা হাতের জাদু; তারপর মিশ্রণটা নিয়ে লক্ষ্যের সামনে দাঁড়াও, দেয়ালটা পেরিয়ে যাও সামরিক বাহিনীর কারও মতো করে প্রফেশনালি নয়, বরং মফস্বলের ঋজু, লগবগে দশ বছর বয়সী বাচ্চা ছেলেগুলো যেভাবে আম চুরি করে দেয়াল পার হয়—না, দেয়ালের ওপর দিয়ে উড়ে যায়—সেভাবে। মেহেরনাজ -প্রখর বাটালি দিয়ে শাণানো এক নাম, বালিকাগজ ঘষে ঘষে পেলব করা এক আবলুস কাঠ; মেহেরনাজ – তাম্রপত্রে ঢালা এক অপার্থিব বস্তু, অন্য গ্রহের, তাই এই গ্রহে সে অ্যান্টিম্যাটার, অবস্তু। আমার মন মেহেরকে দেখার জন্য উন্মথিত হয়ে উঠল। 

চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটল এক বড়সড় স্ট্রেচারের কারণে, একটা না, পরপর দুটো। রোগী নামানো হলো অ্যাম্বুলেন্স থেকে, রোগী ওঠানো হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সে, গাড়িতে। আমার হাতের বাঁ দিক থেকে গাড়ি এসে ঢুকছে তো ঢুকছেই, মূল দরজার সামনে থেকে সরে যেতে হয়েছে আমাকে, হাসপাতালের একগাদা কাস্টমার সার্ভিসের লোক শশব্যস্ত, তাদের কেউ আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে নিয়ে গেল এক কোনায়। ভালোই হলো, এ ভ্যানটেজ-পয়েন্ট থেকে আমি নির্বিঘ্নে দেখে যেতে পারছি মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তাগুলোকে। লক্ষ করলাম, প্রতিটা গাড়িতে রোগী একজন তো, সঙ্গে মুখ মলিন করা আত্মীয়-পরিজন-বন্ধু কমপক্ষে দুজন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিন বা চারও। এই কাছের মানুষেরা কোনোভাবেই চলে যেতে দিতে চায় না তাদের মা, বউ, বাবা, পুত্র, ভাই, স্বামী, বোন, কন্যাকে, নিজেদের শিশুসন্তানকে—যাদের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোটা পূরণ হয়ে গেছে তাদের না, এবং যাদের এই কোটা পূরণ করা বাকি তাদের তো নয়ই। 

কেন? যারা বেঁচে থাকছে, তারা হয়তো ভয় পায় দায়িত্ব নিতে। এত দিন পরিবারের যিনি এই চক্রের গতিপথ ধরে বাহন চালিয়ে গেছেন, এখন সেই বাহনের ড্রাইভারের সিটে নিজেই উঠে বসতে সম্ভবত ভয় লাগে তাদের। যা যেমন চলছে, তা তেমন চলাই অধিকাংশ মানুষের কাছে সব থেকে স্বস্তির। আমি হঠাৎ তীক্ষ্ণ এক কান্নার শব্দে চমকে উঠলাম। একটা মাইক্রোবাস থেকে নামানো হচ্ছে এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে। মহিলা কাঁদছেন—নীরবে, এবং তীক্ষ্ণ সব শব্দ তুলে কাঁদছে তার চারপাশের তিন-চারজন। ওরা তার ভাই-বোন হবে, ওদের একজন জোরে বলছে, কাঁদছে আর বলছে, ‘ধাক্কা দিছে রে, জানোয়ারটা আপারে ধাক্কা দিছে।’ আমি দেখলাম নাইটগাউন পরা মহিলার দুই পায়ের নিচে সিমেন্টের মেঝে দ্রুত লাল হয়ে উঠছে রক্তে, কারা যেন চিৎকার করছে, ‘ইমার্জেন্সিতে নেন’, কারা যেন উল্টো চিৎকার তুলে বলছে, ‘ওনার ডাক্তার ভিতরে’, আবার কারা যেন বলছে, ‘এদিক থেকে কেন?’ আবার কারা যেন প্রত্যুত্তর দিচ্ছে, ‘বেয়াদব, গলা টিপে মেরে ফেলব’, আর ভদ্রমহিলা, যার বয়স কোনোভাবেই ত্রিশের ওপরে হবে না, বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে আছেন সিকিউরিটি গেটের দিকে—বোমা ও অস্ত্র নিয়ে ঢুকে এ হাসপাতালকে কেউ যেন কাবুল বা মোগাদিসু বানাতে না পারে, সেই আয়োজনের গেট। আমি বুঝতে পারছি এই দলটার এ মূল দরজায় চলে আসা এক মারাত্মক ভুল হয়েছে এবং বাইরের গেট থেকে ভুল নির্দেশনা দিয়ে ঘটানো হয়েছে এই ভুল। ‘রাতের ঘন্টার ভুল সংকেতে একবার সাড়া দিয়েছে কি, সেই ভুলের মাশুল দেওয়া শেষ হবে না, কোনো দিন।’

অন্তঃসত্ত্বা মহিলার এই করুণ দশা, সম্ভবত তার স্বামীরই হাতে তার গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যাওয়ার এই মর্মান্তিক ঘটনা, আমার পায়ের তলা থেকে মাটি একরকম সরিয়ে নিলেও আমি পড়ে গেলাম না, কারণ চারপাশে অসুস্থ মানুষদের কেন্দ্র করে তাদের আত্মীয়-পরিজনদের এভাবে পাশে দাঁড়িয়ে যাওয়া দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে আছি। অসুস্থতার সময়ে আত্মীয়তার এই বন্ধনগুলো অনুভব করা পৃথিবীর অনেক সামান্য কিছু সুস্থতার লক্ষণের একটা। কারও মৃত্যুর সময় পাশে মানুষ থাকা নিয়ে আমি আমার আজ ভোরের ভাবনাতে ফিরে গেলাম। যে মানুষ মৃত, তার এতে কোনো কিছু নিশ্চিত যায়-আসে না, কিন্তু হাসপাতালে ভিড় করা এই অসংখ্য মানুষের ত্রস্ত-ব্যস্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো মানবসভ্যতার এতে অবশ্যই যায়-আসে। কাল থেকে কল্পনা করা যাক এমন এক পৃথিবীর কথা, যেখানে মৃত্যুশয্যায় রোগীর পাশে তার নিজের কেউ নেই, পরে কোনো এজেন্সির লোকেরা এসে তার ঘর কিংবা হাসপাতালের মর্গ থেকে মৃতদেহ তুলে নিয়ে যাচ্ছে এবং ধর্মীয় আচার মেনে তার দাফন বা দাহ শেষ করে মিউনিসিপ্যালিটি করপোরেশনে কাজের বিলটা জমা দিচ্ছে, যে আইটেমাইজড বিলে লেখা : গাড়ির তেল বাবদ এত টাকা, কাফনের কাপড় ও আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ এত টাকা, গোসল করানোর লোকের মজুরি এত টাকা, সাবান এত টাকা, জানাজার নামাজের হুজুর এত টাকা (নিচে দেখুন), আর নিচে লেখা যে, প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে জানাজা পড়াতে হয়েছে বলে হুজুর রেটের চাইতে ৫০০ টাকা বেশি নিয়েছেন—তেমন এক পৃথিবী, যেখানে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের পাশে থাকার রুটিনটুকু পালন করার দায়িত্ববোধ (মায়া-মমতার কথা বাদই দিলাম) কেউ অনুভব করে না, কিংবা মিথ্যা সহানুভূতি দেখানোর মধ্যে যে সৌন্দর্য আছে, তার কোনো তোয়াক্কাও কেউ করে না, সেটা তো মহিষের পৃথিবী, এশিয়ান ওয়াটার বাফেলোর জগৎ। আমি সেই পৃথিবীর কেন্দ্রে বসা বিশাল ধূসর কালো এক মহিষকে কল্পনা করতে পারি, যে মহিষ গোঁয়ারের মতো কেন্দ্রের চাকা ঘোরাচ্ছে একটু পরপর হাই তুলে, মুখের দুপাশ থেকে ফেনা-গেজ ফেলে ফেলে, চাকার ওপর নিয়মিত অনিয়মিত ছন্দে—যখন ইচ্ছা তখন বাড়ি মেরে মেরে—বোঝা যাচ্ছে এক প্রাত্যহিক, এক সাংবৎসরিক, এক জন্মজন্মান্তরের একই কাজ করে করে সে এমন এক পৌনঃপুনিকতার হাতে নাজেহাল যে তার কাছে জীবন ও মৃত্যু, শুভ ও অশুভ, হত্যা ও জীবন বাঁচানো, বিশ্বাস রক্ষা ও বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যে আর কোনো ফারাক নেই। মহিষ সে, এবং তার মুখের চারপাশের কঠিন পদার্থ হয়ে ওঠা ফেনার রং জিঙ্ক অক্সাইড। না, আমার ভালো লাগল এটুকু ভেবে যে আমি মহিষচালিত এক পৃথিবীর সদস্য নই, আমার পৃথিবীতে এখনো রোগীর চারপাশে ভিড় করে আসে তার কাছের লোকজন, এবং এখনো জানাজায় দাঁড়ানোর মতো মানুষের অভাব হয় না। 

আমার মনে পড়ল ফ্রানৎস কাফকার করুণ মৃত্যুর কথা। তার লেখাগুলোর সাপেক্ষে বিচার করলে এই অনাত্মীয় পৃথিবীতে কাফকার মৃত্যুর সময় তার পাশে কারোরই থাকার কথা ছিল না। কিন্তু তার পাশে ছিলেন নতুন বন্ধু রবার্ট ক্লপস্টক এবং শেষ বান্ধবী ডোরা ডিয়ামান্ট—ঘনিষ্ঠভাবেই তারা পাশে ছিলেন তার, কিয়েরলিংয়ের ওই হাসপাতালে, ভিয়েনার কাছে। ১৯২৪ সালের তেসরা জুন সকালে কাফকাকে দেওয়া হলো ক্যামফর ইনজেকশন, তার গলার ওপর বসানো হলো আইসপ্যাক। কাফকা, কষ্ট থেকে, বারবার মরফিন চাইছিলেন যেন ঘুমিয়ে পড়ে ব্যথা থেকে সাময়িক হলেও মুক্তি পাওয়া যায়। ক্লপস্টক তাকে দুটো ইনজেকশন পুশ করলেন পরপর। কাফকা একটু পরেই বুঝলেন যে, ওগুলো মরফিন ছিল না। অস্থির হয়ে উঠলেন এই চিরশিশু, যিনি কিনা পৃথিবীর খেলা বুঝে ফেলেছেন সব বড়দের চাইতেও স্পষ্ট করে। বললেন, ‘রবার্ট, আমাকে ঠকিয়ো না, তুমি আমাকে স্রেফ সাধারণ ওষুধ দিয়েছ। প্লিজ আমাকে মেরে ফ্যালো, না হলে তুমি খুনি।’ অর্থাৎ তাকে বাঁচিয়ে রাখলেই তিনি বরং ক্লপস্টককে খুনের দায় দেবেন, কারণ বেঁচে থাকা এত কষ্ট! এবার তাকে প্যান্টোপন দেওয়া হলো, কিছুটা খুশি হলেন তিনি, বললেন, ভালো, কিন্তু আরও দাও, কাজ হচ্ছে না ঠিকমতো।’ বলতে বলতে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন কাফকা, ফের যখন জ্ঞান ফিরল, তখন ক্লপস্টক তার মাথা ধরে আছেন। ক্লপস্টক কাছে ঘেঁষে এলেন, বান্ধবী ডোরাও। কাফকা শরীরের সব শক্তি জড়ো করে আইসপ্যাক ছিঁড়ে ফেললেন, ছুড়ে মারলেন হাসপাতালের ওই ছোট রুমজুড়ে, বললেন, ‘আর যন্ত্রণা সহ্য করব না, কেন অযথা লম্বা করছ সবকিছু?’ ক্লপস্টক তখন তার বিছানার পাশ থেকে কী কাজে একটু সরে যাচ্ছিলেন, কাফকা বললেন, ‘যেয়ো না।’ ক্লপস্টক উত্তর দিলেন, ‘যাচ্ছি না।’ কাফকা বললেন, ‘কিন্তু আমি যাচ্ছি।’ 

ক্লপস্টক ও ডোরার ফুঁপিয়ে ওঠা কান্না শুনতে শুনতে চলে গেলেন কাফকা, যেতে যেতে দেখে গেলেন পৃথিবী বন্ধুহীন অবশ্যই, কিন্তু এর সিস্টেমের মধ্যে মহিষের মুখের পাশে গেজিয়ে ওঠা জিঙ্ক অক্সাইড ফেনা ছাড়াও আছে সাগরের তরঙ্গলহরি, আছে কাছের আকাশে ডানা মেলা অনেক বহুবর্ণ লরিকিত, দূরে ক্লস্টারবার্গের দিগন্তে মেশা পাহাড়ে পাহাড়ে পোস্তদানার সুবাস, সেই একই পাহাড়ে আবার আছে অনেক বসনিয়ান পাইন, যারা মাথা তুলে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যে নড়বেই না যেন কোনো দিন, আর হাসপাতালের কাছের ছোট জলাশয়টায় আছে কাকচক্ষু পানি, যে তার মহানুভব ঢেউয়ের ওপরে টেনে ধরে রেখেছে ছোট ছোট সারগানে হাঁসগুলোকে, মায়ার অভিকর্ষ বলে। 

নূর হোসেন আসছেই না। সম্ভবত গাড়ি ঘুরিয়ে হাসপাতালের সামনে দিয়ে ঢুকতে গিয়ে বড় জ্যামে পড়েছে সে। এত রোগী? এত গাড়িভরা এত রোগী? দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার ব্যাক পেইন শুরু হলো। না, ভেতরে গিয়ে বসতে হবে, নূর হোসেন পৌঁছে ফোন দিক, তখন বের হব। আমি স্ক্যানিং গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম, আমার হাতে কিছুই নেই, সব নিয়ে গেছে নূর হোসেন, এমনকি পথের পাঁচালীটাও। এমন কি হতে পারে যে তার দেখা হয়ে গেছে লুনার সঙ্গে? লুনা তাকে জানিয়েছে সে এই হাসপাতালে এসেছে গাইনির ডাক্তার দেখাতে, ‘মনে হচ্ছে আমি প্রেগন্যান্ট, কিন্তু বাচ্চা তোমার না’, তাই তখন নূর হোসেন ভেঙে পড়েছে কান্নায় বা ক্রোধে, গাড়ির বনেটের ওপরে চুপচাপ বসে আছে গত পনেরো-বিশ মিনিট ধরে, ভাবছে কী সুন্দর লাগছে লুনাকে এই রোদের মধ্যে, কী উজ্জ্বল বর্ণ, লাবণ্যপূর্ণ, ভাবছে লুনার কাছে দৌড়ে যাবে সে এবং বলবে লুনাকে সে ক্ষমা করে দিচ্ছে তার এই নতুন আসা বাচ্চাসহ, এবং তখন লুনা হাসবে ও তাকে জানাবে যে, ‘আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইলে তো তুমি ক্ষমা করবা, নাকি?’ আর তখন নূর হোসেন তাকে বলতে গিয়েও বলল না কীভাবে লুনাকে সে খুন করবে একদিন? 

এমন হতে পারে? জানি না আমি। ভেতর দিকে লোকজন বসার ওখানে—আউটপেশেন্টে—গিয়ে বসলাম, ভাবলাম আজ বাসায় গিয়ে ইন্টারনেটে রবার্ট ক্লপস্টক লিখে সার্চ দিতে হবে। এই মানুষটাকে আমার দেখা হয়নি আজও, শুধু জেনেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের তাড়া খেয়ে কাফকার বন্ধু এই ইহুদি ডাক্তার আমেরিকায় পালিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন এবং পরে নিউইয়র্কে এক বিখ্যাত ডাক্তার হয়ে উঠেছিলেন। আরও একটা কাজের কথা মনে হলো— সুরভির ই-মেইলগুলো পড়া, পারলে উত্তরও দেওয়া। তারপর হঠাৎই এই ওয়েটিং রুমে ঝোলানো হাঁটু রিপ্লেসমেন্টের একটা পোস্টারে ‘সিভিয়ার পেইন’ কথাটার ইংরেজি severe শব্দটা চোখে পড়তেই মাথায় এল জোসেফ সেভেরনের নাম, সেভেরন, Severn, কবি জন কিটসের মৃত্যুর সময় রোমে তার পাশে থাকা বন্ধু, পোর্ট্রেট পেইন্টার, যার মৃত্যু-উত্তর খ্যাতি পঁচিশ বছর বয়সের বাবা-মা-হারা এতিম কবিকে ঘরহারা প্রবাসের মাটিতে নির্বান্ধব ও একলা মৃত্যুর লজ্জা থেকে বাঁচানোর জন্য। 

কিটসেরও ছিল যক্ষ্মারোগ, কাফকার মতো, তবে স্বরযন্ত্রে নয়, ফুসফুসে। একই অসুখে অসুস্থ ভাই টমের সেবা করতে গিয়ে তার থেকে রোগটা পেয়েছিলেন কিটস। সম্ভবত ১৮২০ সালের কোনো এক মাসে, দুবার ফুসফুসে রক্তক্ষরণের পর ডাক্তারের উপদেশমতো কিটস তার গলাব্যথা, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, কফ, চুল পড়ে যাওয়া নিয়ে ইংল্যান্ডের স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া থেকে পালিয়ে গেলেন ইতালি, বন্ধু সেভেনের সঙ্গে। মনে আছে ওই বছরই তিনি লিখলেন ‘ওড টু আ নাইটিঙ্গেল’, আর মনে আছে তার কোনো এক বন্ধুকে তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘প্রতি রাত, প্রতিদিন আমি মৃত্যুকে কামনা করি এই ব্যথা কষ্টের হাত থেকে বাঁচতে, আবার পরক্ষণে চাই মৃত্যু না আসুক আমার কাছে। কারণ, তাহলে ব্যথাগুলো চলে যাবে, ব্যথাগুলো থাকা তো কোনো কিছু না থাকার চাইতে ভালো। মাটি ও সমুদ্র, দুর্বলতা ও ক্ষয়-বিরাট সব বিচ্ছিন্নকারী এরা, কিন্তু মৃত্যু চিরদিনই সবচেয়ে শক্তিশালী বিচ্ছেদকারীর নাম। মৃত্যুর পর কি অন্য জীবন আছে? আমি কি জেগে উঠে দেখব যে সবটা স্বপ্ন ছিল? এগুলো স্বপ্ন হতেই হবে বন্ধু, আমাদের সৃষ্টি শুধু এই ব্যথা-কষ্ট-যন্ত্রণা ভোগ করার জন্য হতে পারে না।’ 

রোমে ঘাঁটি গাড়লেন কিটস ও সেভেরন, ব্রিটিশ এক ডাক্তার দেখছেন রোগীকে। এক রাতে, রোমের বড় এক পাবলিক ফোয়ারার সামনে তার ঘরে, সালটা ১৮২১, মাস আমার স্মরণে নেই, কিটস ডাকলেন সেভেরনকে : ‘আমাকে তোলো, আমি মারা যাচ্ছি, আমি সহজে মরতে চাই। তুমি ভয় পেয়ো না, বরং ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দাও যে আমার মৃত্যু এসে গেছে।’ সেভেরন চার্লস ব্রাউনকে পরে চিঠিতে লিখেছিলেন এ রকম কিছু : ‘আমি তাকে দুহাতে তুললাম। তার কফ মনে হচ্ছিল গলার কাছে গলগল করে ফুটছে, তারপর এমনভাবে সে মৃত্যুর মধ্যে ডুবে গেল, এমন চুপচাপ যে আমি তখনো ভাবছি বাচ্চা ছেলেটা বুঝি ঘুমাচ্ছে।’ 

কিটস সেভেরনকে বলে গিয়েছিলেন তার কবরের এপিটাফে যেন এই কথাটা লেখা থাকে : ‘এখানে শুয়ে আছে এমন একজন যার নাম জল দিয়ে লেখা’। 

তা-ই করেছিলেন সেভেরন, তেমনই একটা এপিটাফ বানিয়েছিলেন বন্ধুর কবরের জন্য। কিটসের মৃত্যুশয্যার দিনগুলোয় যক্ষ্মা সংক্রমণের সব ভয় ভুলে তার এতটা (যা আমার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়) যত্ন নেওয়ার জন্য পরে শেলি তার এলিজি অ্যাডোনিস এর মুখবন্ধে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন সেভেরনকে। এর প্রায় ষাট বছর পর সেভেরন মারা গেলে তাকে দাফন করা হলো রোমের একই কবরস্থানে, কিটসের ঠিক পাশে, যে কবরস্থানে কাছেই শুয়ে আছেন শেলিও। 

ওয়েটিং রুমে আমার সামনের চেয়ারে দেখলাম ঝিম ধরে বসে আছে এক আঠারো-বিশ বছরের কিশোর। নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে ছেলেটার, তার মা কিংবা বড় বোন বারবার টিস্যু পেপারে মুছছেন সেই রক্ত, বারবার, এমনভাবে যেন ছেলেটার নাক তারই নাক, এত কাছে ঘেঁষে যেন ছেলেটা আর তিনি একই মানুষ, একই দেহ। 

ফোন বেজে উঠল, নূর হোসেন পৌঁছে গেছে গেটে। আমি ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়ালাম, ভাবছি বাসায় পৌঁছেই সেভেরন ও ক্লপস্টকের ছবি খুঁজে বের করব। দুজনেই বিখ্যাত মানুষ, তাদের বিষয়ে ইন্টারনেট অনেক আর্টিকেল থাকার কথা। আরও ভাবছি, শুধু যদি আমি আজকের সকালটার মতো— পথের পাঁচালী থেকে নিয়ে মেহেরনাজের বিল পরিশোধ থেকে নিয়ে কাফকা-ক্লপস্টক-ডোরা থেকে নিয়ে রোমের প্রোটেস্ট্যান্ট কবরস্থানে শায়িত কিটস-সেভরন-শেলি থেকে নিয়ে এই হাসপাতালে স্তব্ধ, বাজপড়া মুখ করে ঢোকা ওই প্রেগন্যান্ট মহিলা, যার দুই পা বেয়ে রক্ত রাস্তায় পড়ছিল গলগল করে, ভাবছি শুধু যদি আমি এভাবে গভীর মনঃসংযোগ দিয়ে আরও কিছুদিন ভাবতে পারি, পারি মানবজীবনের উপরিতলটা ভেঙে এভাবে ভেতরে ঢুকে যেতে, তাহলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মূল অর্থ ও তাৎপর্য আমার কাছে একদিন সম্ভবত ধরা দেবে। 

গাড়িতে উঠতে নূর হোসেন আমাকে বলল তার গাড়ির চাকা বসে গিয়েছিল, তাকে রিকশায় করে হাসপাতালের বাইরে গিয়ে কারিগর নিয়ে আসতে হয়েছে, কারণ গাড়িতে না আছে স্পেয়ার চাকা, না সে জানে তা কী করে লাগাতে হয়। আমাকে ‘সরি’ বলল নূর। আমি স্মিত হাসলাম। নূর বলল যে আমি মেহেরনাজকে ফোন করলেই তো পারতাম, তাহলে এতক্ষণ হয়তো এভাবে একা বসে থাকতে হতো না আমাকে। আমি নূরকে বললাম না যে এতটা সময় হাসপাতালে রোগীদের আত্মীয়-পরিজন পরিবেষ্টিত হয়ে ঢোকা ও বের হওয়া দেখে আমার কী মনে হয়েছে এই পৃথিবীর স্থিরতা ও সুস্থতার বিষয়ে। এত সহজে আমি তাকে বলে ফেলতে চাই না যে আমি পীর-কামেল এক লোক, যে কিনা বুঝে গেছে এটা একটা সুস্থ পৃথিবী, যখন আমি জানি সে কত ভালোভাবে জানে এর উপরিতলের পরিচ্ছন্ন রূপটাকে এবং তার এক-দু স্তর নিচেই উপরচালাকি ও ফেরেববাজির দুষ্কর্মা চেহারাটাকেও। 

আমাকে চুপচাপ থাকতে দেখে নূর হোসেন বলল, ‘মেহেরকে বিয়ে করো বন্ধু, অন্তত প্রস্তাবটা দিয়ে দ্যাখো।’ হায়, নূর জানে না যে মেহেরনাজ এক ভাববিহ্বল কিন্তু দুঃসাহসী ও চঞ্চলমতি বড় ডানার পাখির নাম, যে পাখির বিরাট ডানা নিচের পৃথিবীর সব মানুষকে পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে—আমি শুধু উড়বই। 

.

বাসায় এসেই আমাদের নিচতলার কেয়ারটেকার মান্নান সাহেবের অ্যাসিস্ট্যান্ট বাবুলকে অ্যাপোলো হাসপাতালে পাঠালাম নার্স লুবনার কাছে, এক কপি ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্র তার ভাইয়ের জন্য একটা বড় খাকি খামে ভরে। তার আগে বইটাতে সুন্দর করে লিখলাম : ‘অচেনা পাঠককে শুভাশিসসহ-[আমার নাম], ১৩ আগস্ট ২০১৫, ঢাকা। 

এরপর ল্যাপটপ খুলে আমি বসে গেলাম সুরভির ই-মেইলগুলো পড়ব এবং পারলে উত্তর দেব, এই পরিকল্পনা নিয়ে। আজ থেকে চার দিন আগে, ৯ তারিখ সকালে, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার রুমে ওগুলোর সাবজেক্ট লাইনে চোখ বুলিয়েছিলাম শুধু। তারপর আজ অবধি আর মেইলগুলো পড়াই হলো না হাসপাতালে যাওয়ার ধাক্কায়, ওখানে একদিন এনজিওগ্রামে এবং পরের পুরো দুদিন বুকব্যথা নিয়ে ঘোর তন্দ্রার মধ্যে হারিয়ে গিয়ে। 

প্রথম মেইলটা খুললাম। বিষয়: ‘ফ্রম ইওর সুরভি হুম ইউ হ্যাভ ফরগটেন।’ 

সুরভি সুন্দর ইংরেজিতে লিখছে : ‘বহুদিন তুমি আমাকে ফোন করো না। এমনকি আমার ফোন পেয়ে কলব্যাকও করো না। কিন্তু তাতে আমার এত দিন আপত্তি ছিল না, কারণ আমি সত্যি ব্যস্ত ছিলাম ইনভিজিবল সিটিজ অনুবাদ নিয়ে। তবে আমার এখন তোমাকে দরকার, তোমার সঙ্গে কথা বলা দরকার। বলছি, কেন? তার আগে তোমাকে কিছু কথা আমার শোনাতেই হবে। আমি তোমার ওপর ক্ষিপ্ত বলেই তোমাকে কথাগুলো শোনাতে চাই। 

‘তোমার কি মনে আছে আমাদের প্রথম পরিচয় এই ইতালো কালভিনো দিয়েই শুরু হয়েছিল? নিশ্চয়ই মনে নেই। কিন্তু আমার সবই মনে আছে, বাংলাদেশি যুবক। তিন বছর আগে, সেই ২০১২ সালের এপ্রিলে তুমি কাঠমান্ডু এসেছিলে ওয়াসফিয়া নাজরীনকে নিয়ে, ওয়াসফিয়া, আমার পর্বতারোহী কয়েকজন বন্ধুর বন্ধু। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে তোমাকে প্রথম দেখার কথা—ওয়াসফিয়ার এভারেস্ট অভিযানের সংবাদ সম্মেলনে, নেপাল ট্যুরিজম বোর্ডের হল রুমটায়। তুমি একটা হালকা নীলরং টি-শার্ট পরা, এমনকি সে কথাও মনে আছে আমার। আর তোমার সঙ্গে প্রথম কথার প্রথম বাক্য শেষেই তুমি আমাকে বলেছিলে, তোমার পর্বতারোহণ নিয়ে বিশেষ আগ্রহ নেই, তুমি স্রেফ এখানে এসেছ তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ওয়াসফিয়ার হাতে দেশের পতাকা তুলে দিতে। ওই আমি জানলাম তুমি ঢাকার এক বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যে বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালি মেয়েটার এভারেস্ট অভিযানের প্রধান স্পনসর। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কী পড়াও তুমি? তুমি বললে, দর্শন, তবে দর্শন পড়ানোর পাশাপাশি তোমার আগ্রহ ফ্রানৎস কাফকা নিয়েও। তুমি বলেছিলে, “আগামী বছরের শুরুতে আমি বাংলায় কাফকা গল্পসমগ্র বের করতে যাচ্ছি”, আর তখনই আমি তোমাকে বলেছিলাম, “ওহ মাই গড়, আমি তো নেপালি ভাষায় অনুবাদ করছি ইতালো কালভিনো।” মনে আছে তোমার? আমি তোমাকে এটাও জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, কালভিনো তোমার পড়া কি না। তখন তুমি এক নিশ্বাসে আমাকে শোনালে কালভিনোর একগাদা বইয়ের নাম, কালভিনোর উপন্যাসগুলোর নাম, কিন্তু একই সঙ্গে এই বলে বিনয়ও দেখালে যে ওগুলোর মধ্যে তুমি মাত্র দুটো উপন্যাস এবং দু-একটা বড় গল্পই পড়েছ, আর এ-ও বললে যে, “ ইনভিজিবল সিটিজ সত্যি আমার প্রিয় বইগুলোর একটা।” তুমি কথা বলে যাচ্ছিলে ঠিক সেই সব বাচ্চা শিশুর মতো করে যাদের বাড়ির অতিথির সামনে বাবা-মা “ছড়া পারো তো বাবা?” জিজ্ঞেস করলেই যারা গড়গড় করে যন্ত্রের মতো বলতে থাকে, “টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল স্টার, হাউ আই ওয়ান্ডার হোয়াট ইউ আর।” হা-হা। আমার মনে আছে আমি সেই ছড়া বলা বাচ্চাকে অবিশ্বাস করেছিলাম। আমি ভাবছিলাম, সে-ও সম্ভবত শিক্ষিত বলে দাবি করা নেপালি ভদ্রলোকদের মতোই মিথ্যাবাদী, যারা কিনা একগাদা বইয়ের নামই শুধু মুখস্থ রেখেছে, ভেতরটা কখনো খুলে পড়েনি। 

‘জেদ চেপে গেল আমার। কেন প্রথম পরিচয়েই আমাকে এক বাংলাদেশি লোক এভাবে কালভিনো পড়া নিয়ে মিথ্যা বলবে? ঠিক যে বইটাই আমি অনুবাদ করছি, পৃথিবীতে এত বই থাকতে, ঠিক সেটাই কেন তার প্রিয় বই হতে যাবে? আমি তখন তোমাকে বুদ্ধি করে জিজ্ঞেস করলাম যে, ইনভিজিবল সিটিজ-এর কোন কোন শহর তোমার বেশি প্রিয় এবং কোন কোন শহর তোমার কাছে মনে হয়েছে কালভিনোর সবচেয়ে তীক্ষ্ণবুদ্ধির সৃষ্টি? তুমি আমার প্রতিটা প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর দিয়েছিলে। তখন আমি জানলাম, না, এই বাংলাদেশি ছোট চুলের লোকটার মধ্যে কিছুটা সাবট্যান্স আছে, অন্তত সে আমাকে মিথ্যা জ্ঞান দেখায়নি। তবে পরে তুমি আমাকে মিথ্যা বলেছ। আমাকে ভালোবাসো বলে যতগুলো কথা তুমি আমার কানের মধ্যে ফিসফিস করে কাঠমান্ডু ও নাগরকোটের হোটেল রুমগুলোয় বলেছ এ পর্যন্ত, তার সবই মিথ্যা ছিল। পুরুষেরা যে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে ওরকম সাজানো-গোছানো মিথ্যা বলতে ভালোবাসে, তা আমার জানা হয়ে গেছে। কিন্তু এই মেইলে আমি তোমাকে সেসব অন্তরঙ্গতার কথা মনে করিয়ে বিব্রত করব না। আমি শুধু বলব, সেই ২০১২ সাল থেকেই, তোমার সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকেই আমার কালভিনো অনুবাদে বারবার বাধা পড়ছে, বারবার। এই সামান্য একটা বইয়ের অনুবাদ আর শেষই হচ্ছে না। ২০১২-এর ডিসেম্বরে মারা গেলেন আমার বাবা, ২০১৩-এর শুরু থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গেল তোমার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে, আমার মাথার কম্পাস হারিয়ে। সেই সেপ্টেম্বরে তুমি কাঠমান্ডু এলে শেষবার, আমাকে বললে এই সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়াই ভালো। আজও আমি জানি না ঠিক কোন কারণে এ রকম নিষ্ঠুর কিছু কথা বলতে এত দূর আসা লাগল তোমার। এরপর ২০১৪-এর অর্ধেকের বেশি আমার কাটল তোমাকে হারানোর শোকে এবং বাকি অর্ধেক সিডনিতে বড় বোনের বাসায়, আর এবার ২০১৫ সালটাই কেঁপে উঠল ভূমিকম্পের ধাক্কায়। এবারেরটাই সবচেয়ে বড় বাধা -বাবাকে হারিয়েছি, আর পাব না; তোমাকে হারিয়েছি, কিন্তু তবু সৌভাগ্য যে তুমি কিনার ধরে কোনোমতে রয়ে গেছ আমার সঙ্গে; আর এবারের এই বিশাল ভূমিকম্পে আমরা নেপালিরা হারিয়েছি সবকিছু — নিজেদের এত দিনকার চেনা শহরের সব রাস্তা, সব দোকানপাট, ঘাট-মাঠ-মন্দির, পরিচিত অনেক অনেক মানুষ নিয়ে আমাদের প্রিয় কাঠমান্ডুর পুরো শহরটাই। হায়, শহরের একটা বড়, অতি বড় অংশই কীভাবে ইনভিজিবল হয়ে গেল চোখের নিমেষে! আর কীভাবে বন্ধ হয়ে গেল আমার ইনভিজিবল সিটিজ-এর অনুবাদের কাজ। 

‘যাক, তোমাকে যা বলতে আমি আসলে এই ই-মেইল লিখছি, তা বলি এখন। শোনো, আমি এখন ব্যস্ত সম্পূর্ণ অন্য এক বিষয় নিয়ে। এক বিশাল ষড়যন্ত্রের গন্ধ টের পাচ্ছি আমি, আমরা কয়েকজন বলতে পারো। তবে সেটা আমি—এ মুহূর্তে ঠিক করলাম—এই মেইলে লিখব না, কারণ তোমার-আমার দুজনেরই তাতে বিপদ হতে পারে। আমার বেপরোয়া হয়ে ওঠার জন্য অপেক্ষা করো, কারণ তখন আমি তোমাকে হঠাৎ লিখে বসতে পারি ষড়যন্ত্রটার বিষয়ে। কিংবা আরও ভালো হয় এই ই-মেইল পড়েই আমাকে তুমি ফোন দাও, আমি ফোনে বলব সব, কারণ তোমার মতো পাথরে গড়া এক মানুষকে এত কিছু লিখতে ভালোও লাগছে না। কিন্তু তুমি কী মনে করো—ফোনে কথা বলা নিরাপদ? জেনে রেখো, আমি যা দিন দিন জানতে পারছি তা সাংঘাতিক বিপজ্জনক, সাংঘাতিক সেনসিটিভ এক ট্রান্সন্যাশনাল কনসপিরেসি। বলব তোমাকে? না, বলব না, কারণ আমরা সত্যি বিপদে পড়তে পারি। 

‘এ মুহূর্তে শুধু এটাই বলে শেষ করি যে, তুমি MEW ব্যান্ডের “Comforting Sound” গানটা অবশ্যই শুনো, আজকেই। ওই গানের কটা লাইন এমন, একদম মন মাতাল করা, না শুনলে তুমি বুঝবেই না যে আমি কী বলছি। ওই লাইনগুলোই লিখলাম এখানে, তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য : 

And probably you know 
All the dirty shows I’ve put on 
Blunted & exhausted like any one 
Honestly I tried to avoid it 
Honestly 
Back when we were kids 
We would always know when to stop 
And now all the good kids are messing up 
Nobody has gained or accomplished 
Anything. 

‘এই লিরিকস তোমাকে লেখার কোনো অর্থ ধরা পড়ল কি তোমার কাছে? ভাবতে থাকো, আর আমাকে কলব্যাক করো। আমি এক্ষুনি ঠিক করলাম, ভয়াবহ ওই ষড়যন্ত্রের কথাটা আমি তোমাকে ফোনেই জানাব। ডোন্ট মেস আপ উইদ মি, গুড কিড।’ 

আমি পড়া শেষ করে হতভম্ব হয়ে ভাবছি যে কিসের কথা বলছে এই নেপালি ধনীর দুলালি, হাইপার-সেনসিটিভ, আধা পাগল সুরভি? কিসের ষড়যন্ত্র? এবং ঠিক সে সময়ে, ই-মেইলটা আবার পড়তে যাব, ঠিক তখন নিচতলার কেয়ারটেকার মান্নান সাহেব আমার বাসায় এসে আমাকে জানালেন যে গত দুদিন সুন্দরবন কুরিয়ারের লোক আমার কাছে টাকা ডেলিভারি দিতে এসে ফিরে গেছে। মান্নান বললেন, ‘এই যে তাদের উত্তরা শাখার ম্যানেজারের ফোন নম্বর’, আমি যেন ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। 

আমি সুন্দরবন কুরিয়ারের শাখা ম্যানেজার আহাদ সাহেবকে ফোন দিলাম, জানতে চাইলাম কবে আসতে হবে। তিনি আমাকে খানিকক্ষণ লাইনে রেখে বললেন, ‘স্যার, আপনাকে আমি অনেকবার কল করেছি, কিন্তু আপনি আমার ফোন ধরেননি। আপনাকে আমি কলব্যাক করছি।’ এই ফাঁকে নিশ্চয়ই তিনি আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে আমার পরিচয় ইত্যাদি বুঝে নিতে চাইছেন। আমার মনে পড়ল যে বড় ভাইয়াকে আমি হাসপাতালের বিল বাবদ কিছু টাকা পাঠাতে বলেছিলাম। কিছু না, বেশ অনেক টাকা—লাখ দেড়েকের মতো, আর পরে সে কথা ভুলেই গিয়েছিলাম মাসুম হায়াত ও নূরের আশ্বাসে, কিন্তু শেষে বিল পরিশোধ করল মেহেরনাজ 

বড় ভাইয়া যে ত্বরিত টাকা পাঠিয়ে বসে আছেন, এটা আমাকে রক্তের সম্পর্কের নিখাদ ব্যাপারটা নিয়ে পুনরায় আশ্বস্ত করল। আজকাল এগুলো ফিকে হয়ে আসছে, কিন্তু আমার বড় ভাই পুরোনো মূল্যবোধের মানুষ, এবং তার চেয়েও বড় কথা তার সামর্থ্য আছে অন্তত ছোট ভাইয়ের হাসপাতালের বিলের টাকা যেভাবেই হোক পরিশোধের। মাইকেল মধুসূদনের কথা মনে পড়ল আমার। আমি বিশ্বাস করি, আর কোনো কবির হাতেই বাংলা ভাষার এতটা সমৃদ্ধি ঘটেনি যতটা ঘটেছিল মাইকেলের হাতে। বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠ কিছু চরণ তার হাত থেকেই বের হয়েছে : ‘উঠিলা রাক্ষসপতি প্রাসাদ শিখরে’, কিংবা ‘প্রমোদ-উদ্যান কাঁদে দানব-নন্দিনী’, কিংবা ‘বিপদে নিঃশ্বাস ছাড়ি, বিদায়ি মায়ারে,/ স্বমন্দিরে গেলা চলি ইন্দিরা সুন্দরী’, বা ‘সপ্ত দিবানিশি লঙ্কা কাঁদিলা বিষাদে’। যতবার আমি তাঁর মেঘনাদবধ কাব্য পড়ি, ততবারই আবার শুরু থেকে পড়তে ইচ্ছা করে। তো, এই মধুসূদনের ইউরোপের দিনগুলো কেটেছিল শুধু দেশের বন্ধু-আত্মীয় এদের কাছে টাকা চেয়ে চেয়ে-দিন কাটানোর টাকা, হাসপাতালের বিলের টাকা, বাড়িভাড়ার টাকা, অন্যের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ শোধ করার টাকা। পড়ন্ত বয়সে নিজের দারিদ্র্যের কথা এতখানি কুণ্ঠাহীনভাবে আর কোনো বিখ্যাত লেখক জানিয়ে গেছেন বলে আমার জানা নেই। আমি মাঝেমধ্যে, অনেক কম অভিঘাত রেখে অবশ্য, একই রকম কাজ করি—আমার দারিদ্র্যের কথা জানিয়ে সাহায্য চাই আমার ইঞ্জিনিয়ার বড় ভাইয়ের কাছে এবং প্রতিবারই দেখি আমার জন্যও একজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বেঁচে আছেন। 

ঘরের মধ্যে আমি পায়চারি করতে লাগলাম আহাদ সাহেবের ফোনের জন্য। একসময় পড়ার রুমে ঢুকে, অনেকটা অটো-সাজেশনের মতো যান্ত্রিকভাবে, হাতে তুলে নিলাম মধুসূদন রচনাবলী, যেটার বেশ কটা পাতা আমার নিজের হাতেই ভাঁজ করা। তারই একটা ভাঁজ খুলে দেখি যে কটা চিঠিতে শৈশব-কৈশোরের ধনী বাবার একমাত্র সন্তান মাইকেল নিজেকে রাস্তায় হাত-পাতা ভিখিরির পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন, তারই একটা চিঠি হাঁ করে আছে আমার দিকে। আমি অনুমান করতে পারলাম, স্যুট-কোট পরা ইংরেজিতে তুখোড় ইউরোপিয়ান বাবু মাইকেলের শখশৌখিনতার যে আড়াল, তার পেছনেই রিক্ততা ও কাঙালপনার কত বড় লজ্জা তাকে চাপা দিয়ে চলতে হয়েছিল এক জীবনে। 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে এই চিঠিতে তিনি আড়ম্বরহীন কিন্তু হাত-পাতার সংবিধানসম্মত কেজো ইংরেজিতে লিখেছেন, লাইনগুলো দেখলাম আমার হাইলাইটার দিয়ে দাগানো, তিনি লিখেছেন : ‘…আমার স্বার্থপরতা ক্ষমা করবেন। আপনি আমার সবচেয়ে বড় হিতকারী বন্ধু, আমার বন্ধুদের মধ্যে মহত্তম, আর আমি কিনা সেই আপনাকে এ রকম একটা সময়ে নিজের প্রয়োজনে জ্বালাচ্ছি যখন আপনার নিজের অবস্থাই ভালো নয়? কিন্তু আপনার নামের মধ্যে আছে যার নাম [ঈশ্বর], তিনি ছাড়া আমাকে সাহায্য করার আর কেউ যে নেই!…আমার পুরোনো বন্ধু ও রক্ষক আপনি, আমাকে কি তা সত্ত্বেও ধ্বংস হয়ে যেতে দেবেন? আপনি যদি একটু রাজীবের সঙ্গে দেখা করতেন [এখানে পৃষ্ঠার নিচে ও পৃষ্ঠা বেড় দিয়ে পেনসিলে আমার হাতে নোট লেখা : ‘রাজীব কাশিমবাজার মহারানী স্বর্ণময়ীর এস্টেটের দেওয়ান ছিলেন। বিদ্যাসাগর নিজে এই রাজীবের মাধ্যমে মহারানির কাছ থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকা বিনা সুদে ঋণ নেন। মাইকেল জানতেন, রাজীব দয়ালু হৃদয় এক মানুষ এবং বিদ্যাসাগরের ঘনিষ্ঠ। নিজের প্রয়োজনে সেই রাজীবের কাছেই বিদ্যাসাগরকে হাত পাততে বলছেন মাইকেল। সূত্র : গোলাম মুরশিদ।] এবং আপনার ঐকান্তিক বাগ্মিতা দিয়ে এই লজ্জা ও কষ্টে নতজানু আমার জন্য তার বুকে রাখা ভালোবাসাটুকু একটু জাগিয়ে তুলতে পারতেন, তাহলে রাজীব আপনার কথা না শুনে পারত না বলেই আমার ধারণা। তার জন্য দুই হাজার টাকা লোন দেওয়া কোনো ব্যাপার? আমার বাড়িওয়ালা আর অপেক্ষা করবেন না, আমার ছোট পাওনাদারেরা সবাই আমার বিরুদ্ধে খেপে উঠেছে। সামান্য দুই হাজার টাকা আমাকে বাঁচিয়ে দিতে পারত, আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে যেতে পারতাম এর চেয়ে ছোট কোনো বাসায় এবং কঠোর কৃচ্ছতার এক নতুন জীবন শুরু করতে পারতাম তাহলে। কাল সন্ধ্যার মধ্যে এই টাকা আমার অবশ্যই চাই, তা না হলে আমার ভাগ্যে থাকবে স্রেফ পালিয়ে যাওয়া কিংবা তার চেয়েও ভয়ংকর কিছু। আমি ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা রাখি যে, আমার ভগ্নহৃদয়ের এই কথাগুলো যেন আপনার কোমল কর্ণকুহরে আর্তির মতো বাজে!’ 

পড়া শেষ করে ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আবার ‘হাহ্!’ শব্দে জোরে শ্বাস ছেড়ে বইটা তুলে রাখতে যাব তখনই বড় ভাইয়ার ফোন এল। তিনি আমার স্বাস্থ্যবিষয়ক মোটামুটি বিস্তারিত বিবরণ শুনলেন মন দিয়ে, প্রশ্ন করে করে, জানলেন যে আমার এক বন্ধু হাসপাতালের পুরো বিল নিজ থেকে দিয়ে দিয়েছে। তারপর বললেন আমি যেন পারলে এখনই উত্তরার কুরিয়ার অফিসে গিয়ে আহাদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করি, যেন আমার একটা আইডি সঙ্গে নিয়ে যাই এবং টাকাটা নিয়ে এসে নিজের কাছে রেখে দিই, কারণ : ‘টাকাটা তোমার পরে আবার লাগতে পারে। রাখো।’ 

ফোন রাখামাত্র বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবির নিঃস্বতার ইতিহাস আমার গলা টিপে ধরল। আমি চেয়ারে বসে পড়লাম। ইতিহাসের এই সব হরর শো থেকে পালানো অসম্ভব, পালানোর কোনো উপায় নেই। এই বিশ্বজগতের বৃত্তাকার ছাঁচ ন্যায়বিচারের দিকে ততখানি ঝুঁকে-বেঁকে আসেনি, যতটা ফের বৃত্ত এঁকে সরে সরে গিয়েছে মূল বৃত্তের বাইরে। এত বড় মহাকাব্যের কবি এত ছোট (মান-মর্যাদা অর্থে) রিক্ত হস্তের এক জীবন পাবেন, এ-ই বিধান। সেই বিধানের দিকে তাকিয়ে কারও হা-হা ঠাট্টা হাসির শব্দ শুনতে পেলাম আমি শেষ বিকেলে মরিচার রং হয়ে আসা আকাশকে জানালার কাচের এ পাশ থেকে, আবছায়া, গ্রিলগুলোর ফাঁক দিয়ে দেখতে দেখতে। 

মানবজীবন, জীবনবিধান, ধর্ম, জীবনের মহত্তর উদ্দেশ্য—এসব প্রয়োজনীয় বিষয়কে মানবের দীর্ঘ ইতিহাস ধরে এ পর্যন্ত, ধাপে ধাপে, কে বা কারা নানা ভাববাচক বিশেষ্য দিয়ে সাজিয়ে রেখেছেন : সত্য, নৈতিকতা, উদারতা, সাধনা, মোক্ষ, উত্তরণ—শুনলে মনে হয় যে শুদ্ধ ও অশুদ্ধ পানির দুই ধারার মাঝখানের দাগটা যেন স্পষ্ট এবং দুদিকের পানিতে দুই পা রেখে রেখে সোনার কাপড় পরা বালক-বালিকারা যেন খেলা করছে কী বিরাট নিশ্চিতির সঙ্গে, আর যেন তাদের সঙ্গে খেলছে সোনায় বানানো হরিণ ও ভেড়ারাও। মানুষের লেখা ও বর্ণনা করা ইতিহাস কত বড় আশা ও নির্বাণের প্রাসাদশিখর বানিয়ে রেখেছে যে পৃথিবীর আসল আখ্যান তালগোল পাকানো এক অরাজকতার আখ্যান হলেও প্রতি মুহূর্তে আমরা নিজেদের কাছে তাকে তুলে ধরছি এক ভারসাম্যপূর্ণ, সুবিন্যস্ত কিছু হিসেবে এবং বিশ্বসংসারের সবাইকে, দল বেঁধে-শিশু, বন্ধু, দলিত, সুপ্রতিষ্ঠিত সবাইকে—বলে যাচ্ছি সেই সুব্যবস্থার কথাই। এক মহাকবির ক্ষুন্নিবৃত্তির করুণতম গল্পও তখন তাই আমাদের কানে শোনাচ্ছে এমন যেন ওটা নিয়ে কষ্ট পাওয়ার কোনো বিষয় নেই। এই সব অ্যাবসট্রাক্ট বিশেষ্যকে আমার আপাতত পেছনে ফেলতে হলো আবার একটা ফোনের রিঙে। আমি কবি মাইকেল মধুসূদনের লন্ডনের শেফার্ডস বুশের দুমড়ে-মুচড়ে-লেপটে যাওয়া অন্ধকার ম্যাপের আয়তনে ফের দেখতে পেলাম যে সোনার পোশাক পরা বালক-বালিকারা সোনার হরিণশাবকদের সঙ্গে, প্রশান্ত মনে, একজোট হয়ে খেলা করছে ওখানে। কুরিয়ার কোম্পানির ম্যানেজার আমাকে জানালেন, তিনি আমার জন্য বসে আছেন। 

গ্যারেজ থেকে আমার পুরোনো, ভাঙাচোরা করোলা টি-এক্স গাড়ি বের করলাম বহুদিন পরে, ওটার সারা গায়ে লেগে থাকা ধুলো সাফও করলাম না। দশবারের বেশি স্টার্ট দেওয়ার পরে চালু হলো গাড়ি। উত্তরা যাওয়ার আগে সোজা চলে গেলাম বসুন্ধরা এফ ব্লকের এক বিরাট জমিদারবাড়ির গেটে। আকাশে তখনো আলো আছে আর আমি জানি এই আলোয় ও বাড়ির সামনে বেড়ে ওঠা ইউরোপিয়ান নানা ফুলের মধ্যে হোর্থনগুলোকে লাগবে অনেক রুচিস্নিগ্ধ, অনেক লাবণ্য-ঢলঢল। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার মধ্যে হোৰ্থন ফুল দেখতে চাইলে এ বাসাই আমার গন্তব্য, আরও ভালো কথা এই বিশাল বাড়ির দারোয়ান মালিরা এত দিনে জেনে গেছেন আমার এই পছন্দের কথা। আমি এ বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেই তারা উত্তেজিত হয়ে পড়েন, নতুন নতুন লাগানো চারা দেখিয়ে আমাকে বলতে থাকেন, ‘স্যার, এগুলা নতুন চারা, কলকাতা থেকে আনা হইছে’, ‘স্যার, এই যে হোর্থন আপেলগাছ, এগুলা সাহেবের বড় ছেলে আনছে লন্ডন থেকে’, ‘স্যার, এগুলোর নাম হো-বেরি, সাহেব বলছেন। 

তারা কথা বলেন এবং আমি তাকিয়ে দেখি ক্রিমসনের ভেতরে তারার আকারের সাদা নিয়ে ফুটে আছে নতুন বিশাল এক ঝাঁক, আর আবার ডান দিকের দেয়ালজুড়ে সাদা, থালার মতো পাপড়ি মেলা হোর্থন ফুলগুলোর মাঝখানে আঠারো-কুড়িটার মতো দাঁড়িয়ে আছে লাল বুদ্বুদসদৃশ পুংকেশর বা পরাগরেণু ধরনের অংশ। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে একদম কিনারার দিকের বেশ কটা গাছ বিরাট বড় হয়ে উঠেছে, উচ্চতায় বিশ ফুটের মতো, তারা চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে হীরার আকারের পাতা নিয়ে। গাছগুলোর নিচে মাটিতে পড়ে আছে লাল দানার হো-ফলগুলো, বৃষ্টি-কাদায় মেখে তারা তাদের চকচকে ক্রিমসন ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে। আমাকে মালি বললেন, ‘এগুলা ওরিয়েন্টাল হোর্থন।’ আমারও ধারণা ছিল তাই–হয় ওরিয়েন্টাল না হয় সাইবেরিয়ান হোর্থনই হবে পাতাসহ দূর থেকে দেখতে কিছুটা উল্টো ইংরেজি ‘ভি’ অক্ষরের মতো এই গাছগুলো। প্রস্তের উপন্যাসের হোর্থন গাছ ছিল আলাদা হোর্থন, শুধু ইউরোপেই দেখা মেলে ওদের। কোনো বিশেষ চেহারা নিয়ে বাড়ে না ওরা, ঝোপঝাড়ের মতো বাড়ে, গাছ বলে মনে হয় না, মনে হয় যেন হেজ বা বেড়া এবং ওদের ছোট শাখা-প্রশাখায় থাকে কাঁটা। বাড়ির মালিক ও তাকে সহায়তা করেন যে নার্সারির লোক, তারা বুঝেশুনেই এখানে লাগিয়েছেন ঠিক ঠিক গাছ। আমি ভাবলাম, কয়েক বছরের মধ্যে এই বিশাল প্রাসাদোপম বাড়ি হোর্থনের দুষ্প্রবেশ্য ঝাঁকড়ার পেছনে ঢাকা পড়ে যাবে, মালিক হয়তো চেয়েছেন সেটাই। মালি জানালেন, ‘এই গাছগুলোয় পরি আসে।’ বুঝলাম, মালিক ইউরোপের হোর্থন-বিষয়ক কুসংস্কারের কথা বলেছেন এদের। 

আমার মন চলে গেল ইন সার্চ অব লস্ট টাইম-এর সুয়ানস ওয়েতে, বইয়ের শুরুর দিকে যেখানে মার্সেল সম্ভবত প্রথমবারের মতো জানাল তার প্রেমে পড়বার কথা, চার্লস সুয়ানের মেয়ে গিলবার্তকে অসম্ভব ভালো লেগেছিল তার। সুয়ানদের বাড়ির পাশের পার্ক থেকে একদিন মার্সেল লালচুলের গিলবার্তকে দেখেছিল খেলছে, লনে। গিলবার্তের প্রেমে পড়েছিল সে সেদিনই, তৎক্ষণাৎ। মার্সেলের এই প্রথম প্রেমে পড়ার স্মৃতির সঙ্গে অনাবিল হয়ে মিলেমিশে আছে চার্লস সুয়ানদের বিরাট জমিদারবাড়ির পাশে বেড়ে ওঠা, ফুলে ফুলে টইটম্বুর হোর্থনের ঝোপগুলো। 

আমি দেখলাম পুরো পথটা হোর্থন ফুলের সৌরভে থিরথির করে কাঁপছে। ঝোপটা দেখতে মনে হলো যেন অনেক কটা চার্চ। চার্চের দেয়ালগুলো আর দেখাই যাচ্ছে না। ফুলের পাহাড়ে ঢাকা পড়ে গেছে ওর বেদিগুলো। একই সঙ্গে সূর্যের আলো ওদের নিচের মাটিতে পড়েছে চেক চেক আকারে, দেখে মনে হয় যেন সেই আলো কোনো কাচের জানালার মাঝখান দিয়ে পার হয়েছে এইমাত্র। ফুলগুলোর পেলব, তেলতেলে সুবাস আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল, সেই সুবাস কোনো সীমানাদেয়াল দিয়ে বাঁধা নয়। আমার মনে হলো যেনবা আমি দাঁড়িয়ে আছি কুমারী মাতার বেদির সামনে, আর সুশোভিত ফুলগুলোর প্রতিটি এক বেখেয়াল চেহারা নিয়ে তার পুংকেশরে ভরা চিকচিকে থোকা মেলে ধরেছে আমার চোখের সোজা। আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম হোর্থনগুলোর সামনে; নিশ্বাসে নিতে লাগলাম ওদের সৌরভ, আমার চিন্তার আয়তনে জায়গা করে দিতে লাগলাম ওদের, তবে আমার সেই চিন্তা যেন জানে না যে কী করতে হবে এই ফুল, এই সৌরভ নিয়ে। 

গিলবার্তকে দেখে হোর্থন ফুলের থোকায় থোকায় ফুটে থাকা মার্সেলের এই সুখানুভূতি পুরো উপন্যাসজুড়েই এসেছে বারবার। এ রকম তীব্র আনন্দের সময়গুলোতেই মার্সেলের মনে হয়েছে পৃথিবীর বিষাদের ঢাকনাটার নিচে জীবনের কোনো একটা সংহতিময় অর্থ অবশ্যই আছে, এবং সেই অর্থের দেখাও সে পাবে যদি স্রেফ ঢাকনাটা প্রবল মনোযোগ দিয়ে খুলে একটু ভেতরটা দেখে নিতে পারে সে একবার। দূর শৈশবে চার্লস সুয়ানদের বাড়ির পাশের রাস্তায় থোকা থোকা হোর্থন ফুলের অপার্থিব সংগীতের সুরের সৌরভ ছড়ানো গন্ধ মনে করে মার্সেল শ্বাস নেয় জোরে, এই উপন্যাসজুড়ে অনেকবার, কারণ সেই শ্বাসে সে খুঁজে পায় গিলবার্তের প্রেমে তার পাগল হয়ে যাওয়া পরাগরেণুদের গন্ধ। জীবন! ভাবলাম আমি। প্রেম কি সত্যিই এত বড় এবং মহান কিছু, যেমনটা বলছেন প্রুস্ত? নাকি এগুলো তার বাড়িয়ে বলা, অনুভূতির অতিরঞ্জন, শব্দের প্রেমে পড়ে ঘটতে থাকা মোহগ্রস্ততা? 

মালি বুঝলেন আমি চলে যাব। তিনি বললেন, ‘স্যার, সাহেব বলছেন, আপনি আসলে আমি যেন আপনারে বাসার ভিতর নিয়া যাই।’ আমি ধন্যবাদ দিলাম মালিকে, বললাম তার সাহেবকেও আমার ধন্যবাদ জানাতে। আরও বললাম এরপরে কোনো একদিন যাব বাড়ির ভেতরে তবে আজ তাড়া আছে, উত্তরা যেতে হবে, অনেক দেরি হয়ে গেছে আমার শেষ বিকেলে এই হোর্থন ফুল দেখার তাড়নার মধ্যে পড়ে। 

রাস্তার দুই ধারে দিন শেষের হালকা লাল আলোয় আমি দেখতে পেলাম গাছে গাছে বনবহ্নি লেগেছে। গাড়ি চালাতে চালাতেই নির্নিমেষ, বাঁকা চাহনি দিয়ে সেই বনে আগুন লাগা দেখতে লাগলাম, কিন্তু বুঝলাম আমার শূন্যদৃষ্টির চোখ আমার মনকেও করে তুলেছে বাহ্যজ্ঞানহীন, বিবশ। বিষাদ হতে পারে মনের এই অবস্থার সঠিক নাম। না, বিষাদ নয়—আমি ব্যাকুলিত, উৎকণ্ঠিত এটাই মনে হলো। ছাতিম, হিজল, রক্তপলাশ ও বেগুনি কৃষ্ণচূড়ার ভিড় পার হয়ে যাচ্ছি, তিন শ ফুটের বড় রাস্তায় পড়ব পড়ব, হঠাৎ বাম চোখের কিনার দিয়ে দেখতে পেলাম সাদা ও পারপলে মেশানো সন্ধ্যার ছোট জারুলের মায়াভরা ফুলগুলো, আর তখন আমি গাড়ির ভেতরেই সশব্দে, মনে মনে নয়, আওড়ালাম মাইকেল মধুসূদনের স্বর্গের বর্ণনা দেওয়া কিছু পঙ্ক্তি, যেখানে তিনি মাইকেল হওয়ার অনেক দিন আগে যশোরের সাগরদাঁড়ির বালক মধুর স্মৃতির মধ্যে খুঁজছেন কপোতাক্ষপাড়ের হারানো স্বর্গটা : 

শাম্মলী, শাল, তাল, অভ্রভেদী
চূড়াধর; নারিকেল যার স্তনচয়
মাতৃদুগ্ধ-সম রসে তোষে তৃষাতুরে!
গুবাক; চালিতা; জাম সুভ্রমরূপী
ফল যার; উর্দ্ধশির তেঁতুল, কাঁঠাল, 
যার ফলে স্বর্ণকণা শোভে শত শত … 

আমার নিজের কণ্ঠের অচেনা আকম্পন আমার শরীরকেই নিশ্চলতার মধ্যে ঠেলে দিল। বাকি পথটুকু গাড়ি চালালাম প্রায় মাটি কামড়ে থেকে। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *