আগস্ট আবছায়া – ২.৪

২.৪

আমি মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় যাবা?’ মেয়ের মা আমার মুখের দিকে তাকালেন, আমাকে বিশ্বাস করতে পারলেন না, মেয়েকে টেনে নিয়ে গেলেন আমার কাছ থেকে। জোরে হাঁটতে লাগলেন, প্রায় দৌড়ের গতিতে, ফার্মগেটের দিকে, তারপর অল্প সামনে, আমি তখন তাদের দেখছি পেছন দিক থেকে, খানিক থেমে ইতস্তত করতে করতে ঢুকে গেলেন বাঁয়ের এক গলিতে। কারা এরা? কোথায় যাচ্ছে? কী খুঁজছে? কিসের বিপদের ছোঁয়া তাদের চোখে-মুখে? কেউ অসুস্থ? কারও মৃত্যুসংবাদ? কেউ হারিয়ে গেছে? টাকা ধার চাইতে যাচ্ছে তারা কোনো আত্মীয়ের কাছে? বাসায় কি রাতে খাওয়ার মতো চাল-ডাল-আলু নেই তাদের? বাড়িওয়ালা বলেছে বাসা থেকে উঠে যেতে? মহিলার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে অন্তর্হিত হয়েছেন? এই মেয়ে কি মাকে সঙ্গে নিয়ে খুঁজছে তার পালিয়ে যাওয়া বাবাকে, কারণ মায়ের চেয়েও বাবার ওপরে তার দাবি বেশি, তাই? কিন্তু মেয়েটার চোখ দেখে আমার মনে হলো না সে অতটা আত্মবিশ্বাসী ও অধিকার আদায়ে দৃঢ়প্রবণ। বরং আমি দেখেছি এক জোড়া ভয়ার্ত চোখ, সেখানে কোনো প্রশ্ন নেই, আশার ও বিশ্বাসের ঝলকও নেই কোনো। আবার আমার মনে পড়ল দুর্গার মৃত্যুতে অপুর অসহায়ত্বের কথা। 

চড়কটা যেন এবার কেমন ফাঁকা ঠেকিতে লাগিল। আর-বছরও চড়কের বাজারে দিদি নতুন পট কিনিয়া কত আনন্দ করিয়াছে। মনে আছে সেদিন সকালে দিদির সহিত তাহার ঝগড়া হইয়াছিল। বৈকালে তাহার দিদি বলিল—পয়সা দেবো অপু, একখানা সীতাহরণের পট দেখি যদি মেলায় পাস? অপু প্রতিশোধ লইবার জন্য বলিল—যত সব পানসে পুতু পুতু পট, তাই তোর কিনতে হবে, আমি পারবো না যা… 

তাহাদের বেড়ার গায়ে রাংচিতা ফুল লাল হইয়া ফুটিলে তাহার মুখ মনে পড়ে, পাখির ডাকে, সদ্যফোটা ওড়কলমির ফুলের দুলুনিতে—দিদির জন্য মন কেমন করে। মনে হয় যাহার কাছে ছুটিয়া গিয়া বলিলে খুশি হইত, সে কোথায় চলিয়া গিয়াছে—কতদূর!…আর কখনো, কখনো—সে এসব লইয়া খেলা করিতে আসিবে না।… 

আমার দুচোখ হালকা ভিজে উঠল টাইফয়েডে সদ্যমৃত নাজমা, নিশ্চিন্দিপুরের গ্রামে ম্যালেরিয়ার মৃত দুর্গা, ক্যানসারে আজ সকালে মৃত বন্ধু মাসুম হায়াত, নিজের ছায়ার সঙ্গে ডুয়েল লড়ে আত্মহত্যার মর্মঘাতী পরিকল্পনা করা বন্ধু ইবরাহিম এবং চা-বাগানে বৃষ্টির মধ্যে নিজেরই শ্রমিকদের দায়ের কোপে নুয়ে পড়া লুনার বাবা—এদের মনে করে। মনে করার আছে আরও কত এ রকম নাম—সেতু থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করা আমার পুরোনো বন্ধু আলমগীর, মুম্বাইয়ে নিঃসহায় ছন্নছাড়া জীবনের কাছে মাথা গুঁজে দেওয়া আইয়ার, কাল রাতে হাসপাতালে যাওয়া কাউছারের ছোট ছেলে মজনু, যার কথা আমি আর কোনো দিন ভাবব না বলে মনস্থ করেছি, বাড়ির নিচতলায় গার্ডরুমে গুলিতে মৃত শেখ কামাল, কোন দূরদেশের কোন জঙ্গলে দুটো পাইনগাছের নিচে শুয়ে থাকা লেনস্কি, রোমের বিদেশি কবরস্থানে চিরদিনের জন্য মাটিতে মিশে যাওয়া জন কিটস ও বন্ধু সেভেরন-নাহ্, রীতিমতো দৌড়ে ফার্মগেটের বিশাল এলাকা পার হলাম আমি, হালকা হাত রেখে দিলাম কোমরের পিস্তলের ওপরে যাতে করে দৌড়াতে গিয়ে ওটা রাস্তায় পড়ে না যায় এবং রাস্তায় ও রকম ঈর্ষণীয় নীল রঙের পিস্তল ঠাং করে পড়ার শব্দ শুনে, ওটার গায়ে ঝলকানো লাইটপোস্টের আলোয় জীবনের হ্রস্বজীবিতাকে প্রত্যক্ষ করে, এতগুলো ব্যস্ত পথিক যেন ভয়ে হাউমাউ করে চিৎকার না দিয়ে ওঠে। 

দূরে দেখা যাচ্ছে বিজয় সরণির মোড়। এভাবে কীভাবে রাত নামল এত ঘন হয়ে? ইবরাহিম তার চোঙা দালানে কী করছে এখন? সে কি মেঝেতে কোনো গোপন গর্ত বানিয়েছে, যখন মন চায় তার ভেতরে ঢুকে লুকাবার জন্য? আমি ইবরাহিমকে ডুয়েলের চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলাম পনেরোই আগস্ট নিয়ে ওর ব্যাখ্যা সহ্য করতে না পেরে, ওকে শাস্তি দিতে চেয়ে। ইবরাহিম জানে আমার সঙ্গে ডুয়েলে সে পারবে না, তার এই ভাঙাচোরা স্বাস্থ্যে তো নয়ই, তাই সে এড়িয়ে গেল আমার চ্যালেঞ্জ, আমাকে বলল সে নকল পুশকিনের নকল ইবরাহিম না। কী মানে তার এই কথার? 

পুশকিনের ইবরাহিমের গল্প আমি বন্ধুদের শুনিয়েছিলাম কয়েকবার, আগে। এখন ঠিকমতো মনেও নেই কিছু, শুধু ভাসা-ভাসা এই এটুকু ছাড়া যে পুশকিন তাঁর সম্রাট পিটার দ্য গ্রেটের মুর উপন্যাসটা শেষ করেননি। 

ওই মুর ছিল এক নিগ্রো, স্পেনের মুসলিম ইবরাহিম, সে ছিল রাশিয়ান সম্রাটের পালিত পুত্র। সম্রাট এই ইবরাহিমকে বিদেশে পাঠালেন, ফ্রান্সে, ভবিষ্যতে ইবরাহিম নতুন রাশিয়াকে গড়তে কাজে আসবে বলে। প্যারিসের মিলিটারি স্কুলে পড়াশোনা করল ইবরাহিম, ক্যাপ্টেন হলো আর্মির, স্প্যানিশ যুদ্ধে লড়ল, নামডাক হলো তার। সম্রাট কখনোই ভুললেন না তাঁর এই পালিত পুত্রের কথা। ইবরাহিমের গড়ে ওঠায় অনেক খুশি হয়ে সম্রাট তাকে মিনতি জানাতে লাগলেন রাশিয়া ঘুরে যেতে, কিন্তু ইবরাহিমের তাতে কোনো তাড়া নেই, নানা অজুহাতে সে পেছাতে লাগল তার রাশিয়ায় ফেরা। সম্রাটকে মানতে হলো ইবরাহিমের কথা, তিনি এবার তাকে অনুনয় করে বলতে লাগলেন, ঠিক আছে, তাহলে তোমার স্বাস্থ্যের যত্ন নিয়ো। আর ওদিকে প্যারিসে ঝড় উঠে গেছে নারীমহলে, জারের নিগ্রোকে নিয়ে ওখানকার হাই সোসাইটির নারী-পুরুষ কারোরই আগ্রহের কমতি নেই। তার চেহারা, তার শিক্ষা, তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা—সব ইবরাহিমকে টেনে নিয়ে গেছে ওই সমাজের প্রতিটা বলনাচ উৎসবে, প্রতিটা অপেরার উদ্বোধনী শোতে, প্রতিটা মেলায়। এক কাউন্টের (নাম কাউন্ট ডি…) স্ত্রী, কাউন্টেস, নাম লেওনোর, প্রেমে পড়ল এই নিগ্রো ইবরাহিমের। ইবরাহিমও প্রেমে পড়ল এই বিবাহিতার। প্যারিসের সমাজ ব্যস্ত হয়ে পড়ল গুঞ্জন ও গুজব রটনায়—কী ভয়ংকর কথা! কাউন্টেসের সঙ্গে স্প্যানিশ-আফ্রিকান কালো ইবরাহিমের প্রেম! একসময় অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ল কাউন্টেস লেওনোর। সেই ভয়ংকর দিনও সমাগত হলো একদিন। ইবরাহিম, গোপনে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়, হঠাৎ ঘরে ঢুকে নিজের কালো শিশুপুত্রকে দেখলও একনজর, কিন্তু সমাজ দেখল অন্য কিছু—কাউন্টেসের শুভাকাঙ্ক্ষীরা, প্যারিস শহরকে এত বড় লজ্জা থেকে বাঁচানোর স্বেচ্ছাসেবকেরা বাচ্চা বদল করল আরেক সাদা বাচ্চার সঙ্গে। কাউন্ট যখন এলেন, তখন তিনি স্ত্রীর ডেলিভারি ভালোভাবে হয়েছে দেখে খুশি। ইবরাহিম বুঝল এভাবে চলতে পারে না। বুঝল যে নিজের সন্তানকে এভাবে ছুড়ে ফেলার গ্লানি থেকে লেওনোর শিগগির একদিন তাকে, সন্তানের আসল বাবাকে, ঘৃণা করা শুরু করবে। 

আমার মনে পড়ল না এর পরের খুঁটিনাটি। ভুলে গেছি। শুধু মনে আছে ইবরাহিম এবার প্যারিস ছাড়ার পরিকল্পনা করে ফেলল, রাশিয়া ফেরার প্রস্তুতি নিল মনে মনে। কিন্তু এভাবে, নিজের প্রেমিকাকে এভাবে বিদেশে ফেলে আধা বর্বর রাশিয়াতে পৌঁছে ইবরাহিমের বুক ভেঙে গেল লেওনোরের জন্য বেদনায়। সে লেওনোরকে একটা চিঠি লিখল, যার বাক্যগুলো ছিল মোটামুটি এ রকম: বিদায়, লেওনোর, বিদায়, প্রিয়া আমার, একমাত্র বন্ধু আমার। তোমাকে ছেড়ে এসে আমি আমার জীবনের প্রথম ও শেষ খুশিকেই ছেড়ে এলাম। দুঃখী রাশিয়ায় ফিরে এসেছি আমি, এখানে এক সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গতাই আমার সঙ্গী। এরকম কিছু লিখেছিল ইবরাহিম। 

না, পুশকিনের ইবরাহিমের এই কাহিনি কষ্ট করে আর মনে করতে চাই না। এখন এর কোনোই মানে হয় না। আমার মনে হলো বিরাট এক শূন্যতার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি—গরমে, ঘামে, খিদে ও পিপাসায় প্রায় নিশ্চেতন, প্রায় মূর্ছিত অবস্থা। কোনো ভালো ডাক্তার আমাকে এখন দেখলে বলতেন, “ইউ সিম টু বি ব্রোকেন ইন ফিজিক্যালি অ্যান্ড ব্রোকেন ডাউন স্পিরিচুয়ালি, সমস্যা কী আপনার?’ 

রাস্তার পাশে একটা মসজিদ, তার একটু উঁচু এক থামের গোল কিনারের সামান্য বেরিয়ে আসা অংশের ওপর আমি বসলাম। ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে কারও সুরা পড়বার। বাইরে এক টিনের বালতি টেনে আমার দিকে আনছে এক যুবক, তার জামার রং লাল, যা আলো-অন্ধকারে দেখাচ্ছে পুড়ে যাওয়া তামাক পাতার মতো, আর তাতেই স্পষ্ট যে এই যুবকের জন্মের কোনো ঠিক নেই, সম্ভবত বেজন্মা সে, ব্রঙ্কাইটিসে ভোগা অসংখ্য ফুঁপিয়ে কাঁদা এতিমদের একজন। তারই পাশ দিয়ে হনহন করে ফার্মগেটের দিকে চলে গেল এক পেট-মোটা প্রবীণ, তার হাতে ময়ূরের পাখনা একখানা, সেটা দিয়ে কান চুলকাচ্ছেন তিনি। আমার নাকে এল বেকারিতে ময়দা পোড়ানোর গন্ধ, সম্ভবত অগ্নিমেশিন বিগড়ে গেছে; কোথাও ড্রাম বেজে উঠল একটা, হতে পারে রান্নার হাঁড়িতে কোনো শিশুর বাড়ি মারার শব্দ। আমি রান্নাঘরটাকে রাস্তার এ পাশে, আমার ডানে ও বামে, খুঁজে পাওয়ার জন্য তাকালাম। উল্টো দিকে তাকিয়ে লাভ নেই, রাস্তার পুরোটা বাস ও মোটরসাইকেল দিয়ে ভর্তি, এ রাস্তার ওপাশ বলে কিছু নেই সেই অর্থে। একটা বাসের জানালায় দেখলাম এক মহিলা তার সেলফোনের দিকে তাকিয়ে হাসছেন, তিনি বমি ও করলেন খানিকটা, তাঁর বমির মধ্যে খেয়াল করলাম দুটো পাটশাকের টুকরো, তারা ঝুলে থাকল বাসের গায়ে, বাস দাঁড়িয়ে গেছে জ্যামে। একটা রেডিও বেজে উঠল জোরে, তাতে শোনা যেতে লাগল সৈনিক ভাইদের গান—’দুর্বার’, আমার চেনা গান, চেনা সুর, কিন্তু যে লোক গান গাইছে, তার নীচতা ও হীনমন, তার দাস মনোবৃত্তি তার কণ্ঠের মধ্যেই স্পষ্ট বেকারির জানালা দিয়ে—মসজিদের পাশ ঘেঁষে ওই জানালা -সরু ধোঁয়া বেরোনো শুরু হলো আর তক্ষুনি একটা পুরো বাসভর্তি লোক দুদ্দাড় করে নামল বাস থেকে। ‘ইঞ্জিন বিগড়াইছে’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠল বাসের কন্ডাক্টর, চিৎকার দিয়েই সে নেমে গেল রাস্তায়, বাসের চারপাশে চক্কর খেতে লাগল আমার শৈশবে বরিশালে দেখা ‘লক্ষ্মণ দাশ সার্কাস’-এর বামন গোলামের মতো করে-গোলাম ছিল তার নাম, তার সঙ্গে কিছুদিনের জন্য, এক সার্কাস মৌসুমের জন্য, বন্ধুত্ব হয়েছিল আমার। মনে পড়ল—কন্ডাক্টরকে বাস ঘিরে নাচতে দেখে—গোলামকে বেতফল কিনে দেওয়ার কথা, সে বেতফল হাতে পেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল : ‘চাখারের?’ তার সে কথার কোনো মানেই বুঝিনি আমি, না-বুঝে হইহই করে বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ চাখারের, ইয়েস চাখারের, হ্যাঁ চাখারের, না চাখারের।’ আজও স্পষ্ট মনে পড়ে গোলামের মুখ, তার বয়স ছিল তখন কুড়ি-বাইশ, কিন্তু উচ্চতা মাত্র তিন-সাড়ে তিন ফুট, হতে পারে বেশি, হতে পারে কম, তবে সে যে বামনই ছিল তাতে সন্দেহ নেই। আমি বেকারির ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে, বাস ভরা লোকের আমার ফুটপাত দখল করে নেওয়াটা অগ্রাহ্য করে, ইবরাহিমের ভেতরকার সব বকধার্মিকতাকে এক মুহূর্তের মধ্যে বুঝে ফেললাম-সে একদিন মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে নিজের কপালে পিস্তল ঠেকাবে? 

অবিশ্বাস্য। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পিস্তল উঁচুতে তুলে ধরে এই মুহূর্তে গুলি করতে উদ্যত হবে সে আয়নার ইবরাহিমের দিকে, আর পরক্ষণে পিস্তলের বাঁট ঘুরিয়ে সেটা নিশানা করবে নিজের মাথা বরাবর? অবিশ্বাস্য। বন্ধু বলেছে বলেই বিয়ে করার ধোঁকাটা বুঝে ফেলে এবং ফ্রান্সে রেখে আসা প্রেমিকা কাউন্টেস লেওনোরের স্মৃতিকে সম্মান জানিয়ে ইবরাহিম ‘না’ বলে দেবে নাতাশাদের মতো উঁচু পরিবারে বিয়ে করে পিটার্সবার্গে জাতে ওঠার আকস্মিক সুযোগটাকেও? অবিশ্বাস্য। 

কত ভুল বোঝে মানুষ সবকিছুকে। নবোকভের মতো জ্ঞানী লোক, চার খণ্ডে ইভগেনি আনেগিন অনুবাদের মতো অসম্ভব শ্রমসাধ্য কাজ শেষ করার পরেও কিনা আসল জিনিসটাই ধরে উঠতে ব্যর্থ হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন না আনেগিনের মতো একজন মানুষ কীভাবে হঠাৎ তার স্বভাবের বাইরে চলে গেল। হাহ্। নবোকভের মতে, এই যে আনেগিন বলনাচের অনুষ্ঠানে লেনস্কির প্রেমিকা ওলগার সঙ্গে আপত্তিজনক মাখামাখি করে বন্ধুকে কষ্ট দিল, তারপর বন্ধু লেনস্কি ক্ষোভের বশে তাকে ডুয়েল লড়বার চ্যালেঞ্জ জানালে আনেগিন বিষয়টার মিটমাট করে ফেলার বদলে বরং ডুয়েলের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করল এবং ডুয়েলের শুরুতেই প্রথম গুলি চালিয়ে বন্ধুকে মেরেই ফেলল, নবোকভ বলেছেন এটা নাকি আনেগিনের ‘পুরো স্বভাববিরুদ্ধ কাজ।’ নবোকভ বুঝে উঠতে পারলেন না যে আনেগিন আসলে কোনো ভালো লোক নয়, সে আদতে নোংরা, বাজে। উপন্যাসের প্রথম স্তবকেই তো তা স্পষ্ট—আনেগিন বিরক্ত তার চাচা ধীরে মরছেন বলে, সে জিজ্ঞাসা করছে, ‘শয়তান তোমাকে কবে তুলে নেবে, বুড়ো?’ ভয়ংকর। ওটাই আনেগিনের স্বভাব। বন্ধুর বাগদত্তার দিকে হাত বাড়ানোর সময় আমরা দেখি আনেগিন ‘গোপনে হাসছে’, দেখি যে সে ‘এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিশোধ তুলবার মুহূর্তের দিকে’। কিসের প্রতিশোধ? আনেগিন সহ্য করতে পারে না যে জার্মান রোমান্টিক সাহিত্য পড়া লেনস্কির জীবনে এত আলো, এত আনন্দ, এত বিশ্বাসী আবেগের আগুন ইত্যাদি থাকুক। তাই ধীরে, না থেমে, ওই আগুনটুকু নিভিয়ে দেওয়ার প্রতিহিংসাপরায়ণ বাসনা থেকে, আগেই পিস্তল উঁচুতে তুলে-যখন এর পরে আরও পাঁচ কদম সামনে এগিয়ে এসেছে তারা, যখন এর পরে লেনস্কি তার বাঁ চোখ সরু করে মাত্র তার নিশানা ঠিক করা শুরু করেছে—তখনই, আগে থেকে পিস্তল উঁচুতে তোলার অন্যায় সুবিধাটুকু নিয়ে, আনেগিন গুলি করল। কোনো কিছুই এখানে আনেগিনের ‘স্বভাববিরুদ্ধ কাজ’ হয়নি। আনেগিন আনেগিনের মতোই কাজ করেছে প্রতিবার। এই লেখায় শয়তানের স্বভাববিরুদ্ধ ভালোমানুষি এবং ভালোমানুষের স্বভাববিরুদ্ধ শয়তানি কোথায়ও নেই। 

হায়, ভাবলাম আমি, নবোকভ ধরতে পারেননি মূল সত্যটা। ওদিকে আমি, প্রায় আকস্মিক, ফার্মগেট ও বিজয় সরণির মাঝখানে মসজিদের সামনের থামে শরীর ঠেকিয়ে বসে নিচের যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়া মানুষ, ধোঁয়ার গন্ধ, বাসের গায়ের ছলচাতুরীপূর্ণ রং, মসজিদের ভেতর থেকে আসা আমাদের প্রতিপালনকারীর কাছে ক্ষমা চেয়ে উচ্চারিত সব সুমধুর আয়াত, এই সব শুনতে শুনতে, দেখতে দেখতে ধরে ফেললাম মূল বিষয়। বুঝে ফেললাম যে অন্যায় হয়েছে লেনস্কির প্রতি, অন্যায় হয়েছে পরে পুশকিনের প্রতিও, অন্যায় হয়েছে আকাশে গুলি ছুড়তে মনস্থ করা লেরমন্তভের প্রতি, আর অন্যায় হয়েছে বঙ্গবন্ধুর এবং তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের প্রতিও—বিরাট অন্যায়। 

শয়তান হঠাৎ ভালো কাজ করতে গিয়ে কিছু করে বসেনি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ৬৭৭ নম্বর বাসায় কিংবা ক্যান্টনমেন্টে বা কোনো দূতাবাসে বসে। শয়তান শয়তানের কাজই করেছে। হুহ্। 

আমি উঠলাম। হেঁটে পৌঁছালাম বিজয় সরণির মোড়ে, দেখলাম আমার ডানে রাস্তায় ভিড় কমে গেছে, দেখলাম দুটো গাড়ি, ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের গাড়ি, তাতে বিদেশি লোকজন ভরা, যাচ্ছে আমার উল্টো দিকে হোটেলের উদ্দেশে, দেখলাম আকাশে যত্রতত্র তুলো তুলো মেঘ এবং সেগুলোর শেপ ও সাইজ এই রাত প্রায় আটটার অন্ধকার আকাশেও প্রায় পরিষ্কার দৃশ্যমান, প্রায় বোঝার যোগ্য রকমের স্পষ্ট—আমি মেঘেদের ওই আকার ও ডিজাইনের মধ্যে তিনটে মহিষের মাথা প্রত্যক্ষ করলাম বিদ্যুল্লতার মতো কাঁপছে থিরথির করে, নিচে থেকে তাদের গায়ে প্রতিফলিত পৃথিবীর ম্লান আলোয়, নিরন্তর ঘাড় বেঁকানো মুখে সাদা ফেনা ওঠানো মহিষ ওরা, এ মুহূর্তে যদিও ওদের মুখের ফেনা দেখা যাচ্ছে না, মেঘের গায়ে মহিষ তিনটের আউটলাইনই কেবল থাকা সম্ভব, ডিটেল নয়, তবে স্রেফ সেই নিরালোক আউটলাইনের মধ্যেও এটুকু সুবোধ্য যে মহিষগুলোর মাথা কুঁচকানো ব্যথায়, তারা অনিয়ন্ত্রণযোগ্য জড়তা ও জাড্য নিয়ে আছড়ে পড়ে আঘাত করতে চাইছে নিচের মানুষ ও মানুষের জীবনের বন্দোবস্তকে। 

আমি মেঘের ওই দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। সুরভি আমাকে জুলিয়ান কাসাব্লাংকাসের একটা গানের লিরিক ও লিঙ্ক পাঠিয়েছিল মাত্র কিছুদিন আগে। সেই গানের কথাগুলো, সুরসহ, মাথায় এল আমার : 

I feel like a tourist out in the country 
Once this whole world was all countryside 
Feel like a tourist in the big city 
Soon I will simply evaporate. 

কীভাবে ইভাপোরেটেড হব আমি? মহিষদের হাতে, তাদের গুঁতোয়, তাদের পা মাড়ানোয়? 

আরেকটা বিদেশিদের গাড়ি গেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের উদ্দেশে। এত বিদেশি কেন ঢাকা শহরে আজ রাতে? আমি জোরে দৌড়ে মোড়টা পার হতে চাইলাম কিন্তু মাত্রাজ্ঞানহীন দৌড়ের হেতু ধাক্কা দিয়ে বসলাম এক চলন্ত মোটরসাইকেলের গায়ে, মোটরসাইকেলটা ছটফট করে নড়ে উঠে পড়ে গেল রাস্তার পাশে, আরোহী তরুণ ওখানেই বসে পড়ল তার ডান পা দুহাতে চেপে ধরে, লোকজন কোত্থেকে ছুটে এল আমার চারপাশে, তারা চিৎকার করে আমাকে অভিযুক্ত করছে এই দুর্ঘটনা ঘটানোর জন্য, একজন আমার বুকের কাছের ভেজা জামা খামচে ধরে বলছে–চোখে দ্যাখেন না, উজবুক। সবাই আমাকে বলছে উজবুক আর ভিড়ের মধ্যে থেকে আমি দেখলাম ভিড়ের ঠিক ওপাশ থেকে দেখলাম আমাকে আমার নাম ধরে ডাকছে পথের পাঁচালীর অপু, সে এখানে এল কোত্থেকে? আমি ভাবলাম, মানুষের অসহনশীল আচরণ উপেক্ষা করে অপুর দিকে এগোনোর জন্য পা বাড়ালাম, কিন্তু আমাকে শোকাচ্ছন্ন করে ভিড়ের মধ্যে কোথায় হারিয়ে গেল অপু, একটা লোক হঠাৎ ‘পনেরোই আগস্ট, পনেরোই আগস্ট, সরে যান, সরে যান’ বলে আর্তচিৎকার দিয়ে দৌড়ে চলে গেল আমাদের দিকে তাকিয়ে বিজয় সরণির মোড় থেকে ক্যান্টনমেন্টের দিকে, আমাকে ঘিরে থাকা লোকগুলো সরে গেল, উধাও হয়ে গেল কোথায়, আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে একা, দেখলাম ১৭-১৮টা কামান এবং ত্রিশটার মতো T-54 ট্যাংক ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হলো দীর্ঘ ড্রাগনের শরীরের, লেজের আকৃতি নিয়ে, ওগুলো যেতে লাগল ক্যান্টনমেন্টের উত্তর প্রান্তে নতুন বিমানবন্দরের বিরান মাঠের দিকে—অনেকগুলো যুদ্ধ মেশিন, অনেক মানুষ এবং তাদের আপাত-মিষ্টভাষী চেহারায় বিদ্রূপাত্মক তর্জনগর্জনের আবছায়া। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *