আগস্ট আবছায়া – ৩.২

৩.২

একটা দিন পার হয়ে গেল ওভাবেই, রাস্তার পাশে পড়ে থেকে ঘুমিয়ে, মশার কামড় খেয়ে, স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন দেখে। ১৬ আগস্ট শনিবার আবার আমি ফার্মগেটের দিকে হাঁটছি, দেখলাম বঙ্গবন্ধুর ডেডবডি নেওয়া হচ্ছে একটা পিকআপে করে—গাড়িতে ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা, গাড়ি যাচ্ছে তেজগাঁও বিমানবন্দরের দিকে, গাড়ির পেছনে একটা আর্মি ট্রাক। মোশতাক হুদাকে এই দায়িত্ব দিয়েছে কেন? সে মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের লোক বলে? রাস্তাঘাট সুনসান, বলতে গেলে মানুষজন কেউই নেই। আমি ওই পিকআপের পেছন পেছন দৌড়ে চলেছি, বুঝতে পারছি না কাল দুপুর থেকে আজকের এই দুপুর পর্যন্ত আমার দিনটা কোথায় চলে গেল, কী খেয়ে, ওই রাস্তার ফুটপাতে পড়ে থেকে নাকি বিভ্রমের মধ্যে হেঁটে ঘুরে ঘুরে এটা মনে করতে করতে যে আমি যেনবা শুয়ে আছি সেখানেই, যেখানে প্রথম পড়ে গিয়েছিলাম। হা-হা করে আমার সামনে কতগুলো লোক তেড়ে গেল একটা কালো গরুর দিকে। গরুটা দৌড়াচ্ছে বড় রাস্তা ধরে, খামারবাড়ির পথে। দেখলাম একটা বড় ট্রাক সোজা গিয়ে পড়ল গরুটার গায়ে, কোত্থেকে হাজির হলো একটা আর্মির জিপ ও একটা গুয়ের ভ্যান। রাস্তায় আবার কেউ নেই, স্রেফ কটা ছোট ব্যস্ত বুলবুলি ছাড়া। 

তেজগাঁও এয়ারপোর্টের ভেতরে দেখলাম ক্যাপ্টেন হুদা লাশ হস্তান্তর করল মেজর কাজী হায়দার আলীর কাছে; হায়দার আলীর পাশে দাঁড়ানো অর্ডন্যান্সের গ্যারিসন ডিউটি অফিসার মেজর মহিউদ্দিন আহমেদ। তাহলে মোট তিনজন মহিউদ্দিন নামের লোক আছে পনেরোই আগস্ট ঘিরে? তিন মেজর মহিউদ্দিন? বাব্বা! হুদা এদের জুনিয়র, যদিও কাঁধে শাপলা পরিয়ে কাল তাকে মেজর বানিয়ে দিয়েছে ফারুক। কিন্তু হুদা ওই শাপলা-টাপলার ধার ধারছে না। সে উদ্ধত ভঙ্গিতে তার দুই সিনিয়র মেজরকে বলে চলেছে, ‘নো ফাক আপ প্লিজ। স্পেশালি লুক ফর মিসক্রিয়েন্টস হু মে ট্রাই টু টেক কন্ট্রোল অব দ্য ডেডবডি। আই অ্যাম ডেলিভারিং দ্য মেসেজ ফ্রম নান আদার দ্যান দ্য নিউ প্রেসিডেন্ট। আন্ডারস্টুড?’ তারাও বলছে, ‘আন্ডারস্টুড।’ হেলিকপ্টারের পাইলট একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নাম শমসের আলী, তার সহকর্মী রয়েছে একজন, এবং আছে দশজন সৈনিক ও এক হাবিলদার। মোট ষোলোজন, বঙ্গবন্ধুর ডেডবডিসহ। মোট সতেরোজন, আমাকেসহ। 

হেলিকপ্টার আকাশে উড়ল। মেজর মহিউদ্দিন যে হেলিকপ্টারে একটা ছোট টেপরেকর্ডার নিয়ে উঠবে, তা আমি ধারণাও করিনি। হেলিকপ্টারের প্রবল আওয়াজের মধ্যে আগস্টের ভয়ানক গরমে কুলকুল করে ঘামতে ঘামতে সবাই গান শুনছে ‘আজকাল তেরে মেরে পেয়ার কা চরচে’ এবং ওটা শেষ হতেই ‘মেরে সপনো কি রানি’। ভালো। আমি তাকিয়ে আছি কফিনটার দিকে। দেখেই মনে হচ্ছে প্রচণ্ড ভারী কফিন, বরফে বরফে ঠাসা, বরফগলা পানিতে পলিথিনের বড় ব্যাগগুলো ভরে টইটম্বুর। তিনি কোনো গান শুনছেন না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তিনি তাঁর গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছেন সেটুকুও যে তিনি জানেন না সে ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত। কী ভাবছি আমি এসব? 

হেলিকপ্টারের আগেই গোপালগঞ্জ পৌঁছে গেলাম আমি। উড়ে যেতে যেতে দেখলাম মধুমতী নদী হয়ে ফোর্স যাচ্ছে টুঙ্গিপাড়ায়, ম্যাজিস্ট্রেট ছুটছে বাঁওড়ের মধ্য দিয়ে স্পিডবোটে করে; কাটাখাল, ভেন্নাবাড়ী খাল ও বাঁওড় জলাশয়ে সরকারি লোকদের এই ছুটে যাওয়া ছাড়া একটা নৌকাও কোথাও নেই। আমার কানে আসছে রেডিওর ঘোষণা, রেডিওতে আবার আজকেও বাজছে গান, তবে আজ হিন্দি গান, উর্দু না। নাকি তারা না বুঝে হিন্দিকে উর্দু ভেবে বাজাচ্ছে গানগুলো? আমার কানে ভেসে এল একটা গানের কলি : ‘গুড়িয়া হামসে রুঠি রাহোগি’। 

আমি টুঙ্গিপাড়া চৌরঙ্গী লঞ্চঘাটের কাছে নেমে বাম দিকে কাপড়ের বাজারের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলাম। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, শহরের প্রধান রাস্তা ও চৌরঙ্গী জনমানবশূন্য, সাইকেল বা রিকশা, কিছু নেই। ঘাটে কোনো লঞ্চ নেই, নৌকা নেই, যাত্রী নেই, যাত্রীর জন্য কোনো হাঁকডাকও নেই। লঞ্চগুলো বিশাল রঙিন পাথরের চাঁই হয়ে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। এবার ব্যাংকপাড়ার দিকে হেঁটে চলেছি আমি। ওখানে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ও পুলিশ লাইনস। দুজন পুলিশকে পাশ কাটালাম, তাঁরা একজন আরেকজনকে বলছেন, ‘নদী-নালা-ডোবার পানিতে নাইম্যা মাথার ওপরে কচুরিপানা রাইখ্যা সবতে লুকাইয়া রইছে, কাণ্ড দ্যাহো।’ অন্যজন বলল, ‘আরে না, বেশির ভাগ লোক পালিয়ে রয়েছে জঙ্গলের আড়ালে।’ তার এত শুদ্ধ বাংলার ‘পালিয়ে এবং ‘রয়েছে’র ছ-এর এত স্পষ্ট উচ্চারণ শুনে আমার মনে হলো কী ব্যাপার, এ লোক কি নদীয়া, মুর্শিদাবাদের কেউ? 

বেলা দেড়টায় হেলিকপ্টার নামল, আমার ওখানে পৌঁছানোর পনেরো-কুড়ি মিনিট পরে। নামার আগে হেলিকপ্টার থেকে মুখ বের করে নিচে দাঁড়ানো পুলিশদের উদ্দেশে চিৎকার করছে দেখলাম মেজর হায়দার আলী। সেই চিৎকার শুনে টুঙ্গিপাড়া থানা ও বাঁশবাড়িয়া ক্যাম্প থেকে আসা পুলিশের দল ভয়ে কাঠ হয়ে গেছে, আগস্টের এ রকম আগুনঝরানো দিনেও—যদিও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন তবু তাপ ও আর্দ্রতার কমতি নেই—তাদের গরম লাগছে না একটু, বরং শীত শীত করছে খুব। 

এবার মেজর মহিউদ্দিনের চিৎকার কানে এল, ‘রিজার্ভ পুলিশ আসতে দেরি কেন? ব্লাডি ম্যান, ইউ গাইজ আর গুড ফর নাথিং। ডোন্ট ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, ইওর সিকিউরিটি ইজ নট ফুল প্রুফ হিয়ার? দিস ডেডবডি কুড বি স্ন্যাচড অ্যানিটাইম।’ পুলিশ ভাইয়েরা সাহস করে তাকে অভয় দিলেন। 

মেজর হায়দার আলী বলছে, ‘থামেন। মিছিল করে লোক এসে লাশ ছিনতাই করলে কোন বালটা করবেন? মুখ খারাপ হয়ে যায়।’ 

পুলিশ তবু থামে না, অতিরিক্ত ভয়-উত্তেজনা মিলিয়ে বলে বসে, ‘লাশ কে ছিনতাই করবে, স্যার? লোকজন সব ভয়ে পানি সাঁতরায়ে টেকেরহাট চলে গেছে।’ 

হায়দার আলী প্রচণ্ড ধমক দেয় পুলিশের লোকটাকে, ‘ফাজলামি করো শালা?’

আমার ভালো লাগে না এসব দেখতে। আমি টুঙ্গিপাড়া, পাটগাতি, গেমাডাঙ্গা ঘুরে বেড়াই—খুঁজে ফিরি কারা ও কতজন ভয়ে কচুরিপানার নিচে মাথা লুকিয়ে, দুই পায়ের মাঝখানে সাপ জড়িয়ে পানিতে দাঁড়িয়ে আছে এ মুহূর্তে। পাটগাতি বাজারে দেখি একদল পুলিশ একটা থানকাপড়ের দোকানের তালা ভাঙছে। দোকানদার বৃদ্ধ কোত্থেকে দৌড়ে এসেছেন ‘করেন কী, করেন কী?’ বলতে বলতে। পুলিশরা তাঁকে বলছেন, ‘আপনারে এতক্ষণ দেখি নাই তাই দোকান ভাঙছি, বঙ্গবন্ধুর কাফনের জন্য কাপড় লাগত।’

আমি দ্রুত ফিরে যাই বঙ্গবন্ধুর কাছে। তখন তাঁর গোসল শুরু হবে হবে। চাপকল থেকে পানি আনার জন্য বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গোয়ালঘরের ভেতরে রাখা গরুর খইল-ভুসি খাওয়ার বালতিটা ব্যবহার করা হচ্ছে। যে এই কাজটা করছে, তার নাম মজনু। সে ভয়ে কাঁদছে এবং বঙ্গবন্ধুর বাড়ির বহুদিনের পুরোনো চাকর বৈকুণ্ঠকে গালি দিচ্ছে এ সবকিছু ফেলে পালিয়ে যাওয়ার জন্য। 

বৈকুণ্ঠ পালিয়ে গেছে কেন? হিন্দু বলে? রেডিওতে পাকিস্তানি উর্দু গান শুনে অভিমানে?

দেখলাম কোনোমতেই বঙ্গবন্ধুর শরীরের পাঞ্জাবি, গেঞ্জি, লুঙ্গি খোলা যাচ্ছে না শরীর থেকে, সেগুলো বরফের পানিতে কী কী যেন ভাবে ভিজে তাঁর গায়ে লেপ্টে আছে এমনভাবে যেন গাঢ় আঠা দিয়ে সাঁটানো। আমার মনে হলো রক্তের ভেতরকার কোনো আঠালো পদার্থের কারণে হয়তো হবে এটা। এটার নাম কী, ওই অ্যাবনরমাল ব্লাড প্রোটিনের? অ্যান্টিফসফোলিপিড অ্যান্টিবডিজ? ভুলে গেছি, মনে পড়ছে না। ব্রিজের পাশের দোকানে ব্লেড খুঁজতে গেল একজন। মাটি থেকে ভাপ উঠছে। এই আমি যে কিনা এখানে নেই, সে-ও এই ভাপে সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছি পিঠার মতো। দূরে একটা ভুবনচিল ডেকে উঠল তীক্ষ্ণ কর্কশ গলায়, ছয়-সাতটা মুরগি তাতে ভয় পেয়ে সোজা এসে হাজির হলো কফিনটার বাম পাশে, একটা তো রীতিমতো ঠোকর দিতে লাগল কফিনের কাঠের গায়ে। একজন দেখলাম দোকান থেকে একটা ব্লেড ও একটা কাপড় কাচার ৫৭০ সাবান নিয়ে এল, বলল, ‘গায়ে মাখার সাবান নাই।’ মেজর মহিউদ্দিন চিৎকার করে উঠল, ‘সাবানের গুষ্টি মারি। সব মিলে দশ মিনিটের এক সেকেন্ড বেশি লাগলে সবগুলারে গুলি করব। দশ মিনিটের তিন মিনিট শেষ।’ ওসি জলিল এ কথা শুনে জিজ্ঞাসা করলেন, জানাজা?’ মেজর মহিউদ্দিন বলল, ‘জানাজা-টানাজা কিচ্ছু জানি না, আমার সোজা কথা, আপনাদের জন্য বরাদ্দ আর আছে সাত মিনিট।’ 

পাঞ্জাবি-গেঞ্জি ব্লেডের টানে লম্বালম্বি বুক-পেটের ওপর দিয়ে কেটে দেওয়ার পরে আমি দেখলাম বঙ্গবন্ধুর ঘাড়ের পেছনের দিকের মাংস একটুও নেই, উড়ে গেছে, হয়তো ত্রিশ ঘণ্টার গরমে পচে খুলে পড়ে গেছে। দেখলাম পিঠের মধ্যে একটা বড় গর্ত, দেখলাম মোট আঠারোটা গুলি তাঁর শরীরে। একজন বলে উঠল ‘আঠারো, আরেকজন বলল ‘আটাশ’, আরেকজন বলল, ‘পায়ের গোড়ালির রগ কাটা ক্যান?’ আরেকজন বলল, ‘য্যান লাশ শক্ত না হয়, তাই’, আরেকজন একটু উঁচু গলায় চিৎকার দিয়ে উঠল এই বলে যে সে বঙ্গবন্ধুর পাঞ্জাবির পকেটে চশমার ভাঙা অংশ ও তামাকের পাইপের একটুখানি পেয়েছে। বাকি সবাই তাকে ধমকে উঠল, ‘চুপ, চুপ।’ 

গোসল শেষ হলো। মেজর মহিউদ্দিন অস্থির গলায় বলল, ‘আর আছে চার মিনিট।’ 

পুলিশের অফিসার গোছের একজন দেখলাম মেজর হায়দার আলীর কাছে গিয়ে অনুনয়-বিনয় করছে, ‘স্যার পাটগাতি বাজার থিকা কাফনের কাপড় নিয়া লোকটা এখনো ফেরে নাই। ভিজা কাপড় কেটে কাফন বানাইতাম কেমনে?’ 

কাফনের কাপড় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে, তখন একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর বলল, ‘শেখ সায়রা খাতুন রেডক্রস হাসপাতালে রিলিফের কিছু সাদা শাড়ি আছে।’ 

মেজর হায়দার আলীকে ওই সাদা শাড়ি আনার প্রস্তাব দিতেই মেজর ক্রোধ ও ধৈর্যচ্যুতি থেকে ফেটে পড়ল, উচ্চ স্বরে বলল, “উই হ্যাভ নো টাইম, নো টাইম। ইউ ক্যান ব্রিং অ্যানিথিং ইউ লাইক, বাট দিস ব্লাডি বেরিয়াল বিজনেস মাস্ট এন্ড নাউ। যেকোনো সময় গোলমাল হতে পারে। সবকিছু এত চুপ ক্যানো? দিস ইজ ব্লাডি ডেঞ্জারাস সাইলেন্স, ম্যান।’ সে ‘ম্যান’ কথাটা বলল অনেকটা ‘মান’-এর মতো, নিশ্চয়ই কোনো সিনেমা-টিনেমা থেকে শিখেছে। 

আমি মেজরের কণ্ঠে পরিষ্কার আতঙ্ক লক্ষ করলাম। রেডক্রস হাসপাতাল থেকে আনা দুটো শাড়ির লাল পাড় কেটে বঙ্গবন্ধুর শরীরের মাপে কাফন তৈরি করে তাঁর মরদেহে পরানো হলো এবার। আবার একটা চিল ডেকে উঠল আগস্টের দুপুরকে খান খান করে দিয়ে। চতুর্দিকের হাজার গাছের মাথায় বসা অন্তত দু-তিন শ পাখি আকাশে উড়াল দিল একসঙ্গে। ঢাকা থেকে আসা দুই মেজর, দশ সৈনিক ও এক হাবিলদার এখন উদ্বেগ-উত্তেজনায় রীতিমতো লাফাচ্ছে। চিলের ডাক ও পাখিদের উড়ে যাওয়ার মধ্যে তারা বোধ হয় তাদের জন্য কোনো অশুভের ইঙ্গিত দেখতে পেয়েছে। মেজর মহিউদ্দিন বলল, ‘দশ মিনিট শেষ। ডান। ডিওএনই—ডান।’ গিমাডাঙ্গা মাদ্রাসা থেকে জানাজার নামাজ পড়াতে আসা আবদুল হালিম ওরফে এজেন মৌলভি এ কথা শুনে খ্যাক করে উঠলেন, ‘জানাজা পড়াব, তারপর যাবেন।’ 

তখনই বাড়ির চারদিকে ঘুরে ঘুরে নিরাপত্তা ডিউটি তদারক করা ইন্সপেক্টর শেখ ইছহাক ফকির দুই মেজরকে বললেন, ‘টুঙ্গিপাড়া ও আশপাশের লোক জানাজায় অংশ নিতে চায়।’ 

মেজর হায়দার আলী বলল, ‘ইমপসিবল। দে মে স্ন্যাচ দ্য ডেডবডি। পুট দ্য ডেডবডি ইন দ্য গ্রেভ রাইট নাউ। ওকে?’ 

সে ওকে বলে শেষ করতেও পারেনি, তখন তারই চার-পাঁচ সৈনিক দৌড়ে এল হাঁপাতে হাঁপাতে, তারা বলছে, ‘স্যার, হাজার হাজার মানুষ আসছে কাছারিপাড়া, চৌরঙ্গী, থানাপাড়া, সাহাপাড়া, বেতগ্রাম, পাচুরিয়া থেকে। নৌকা আসতেছে মিনিমাম এক শ হবে। গুমাইবিলে নৌকা আর নৌকা। ভেন্নাবাড়ি খাল ধরে অনেক লোক, গা ভেজা, এদিকে আসতেছে।’ 

তার কথা শেষ হয়নি, পাইগাতি বাজার থেকে কাফনের কাপড় নিয়ে ফিরল পুলিশের লোকেরা। তারা মেজর দুজনকে বলল, ‘যশোর থেকে এক কোম্পানি আর্মি স্পিডবোট ও লঞ্চে করে ঘাটে পৌঁছে গেছে স্যার, গোপালগঞ্জ থেকেও লঞ্চে করে ফোর্স এসে গেছে, স্যার।’ 

মেজর মহিউদ্দিন অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগল এজেন মৌলভিকে, এখানকার পুলিশের ওসিকে। তার সাফ কথা, দাফন হবে, জানাজা হবে না। সময় নাই। 

অনেক দূর থেকে আমি দীর্ঘ লয়ের চিৎকার শুনলাম, ‘দাফন হবে না।’ সে এক দীর্ঘ দীর্ঘ চিৎকার, মনে হলো অনেক শত কণ্ঠের। হেলিকপ্টারের আওয়াজ বাড়ল, ওটা ওড়ার পাঁয়তারা করছে, পাইলট শমসের আলী তার ওই উঁচু আসন থেকে নিশ্চয়ই দূরে কিছু একটা দেখেছে। কী সেটা? 

মহিউদ্দিন এখন দেখলাম তার রিভলবার তাক করে আছে টুঙ্গিপাড়ার ওসির দিকে। মহিউদ্দিনের হাতে বাড়ি মারল মেজর হায়দার আলী, বলল, ‘ডোন্ট ডু অ্যানিথিং স্টুপিড, দে আর ইন থাউজেন্ডস’। সে বলছে এবং তাকাচ্ছে হেলিকপ্টারটার দিকে, হেলিকপ্টার তখনো মাটিতে, উড়বে উড়বে করছে। 

মেজর হায়দার মেজর মহিউদ্দিনকে চূড়ান্ত আতঙ্ক নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘হেলিকপ্টার চলে যাচ্ছে নাকি? আমাদের ফেলে? কী ব্যাপার?’ 

এজেন মৌলভি উত্তেজনায়, সম্ভবত ওই দূরের শত কণ্ঠের এদিকে আসতে থাকা চিৎকার শুনে, চিল্লিয়ে উঠলেন, ‘ভালোমতো জানাজা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর দাফন হবে না।’ বাড়ির ভেতর থেকে তিনজন যুবক আচমকা দৌড়ে এখানে এল, তারা বলছে, ‘বৈকুণ্ঠ ফিরা আসছে, বৈকুণ্ঠ ফিরা আসছে।’ 

.

আমি টুঙ্গিপাড়া ছাড়লাম। মানুষের এই ন্যায়ানুমোদিত (মানুষের তৈরি আইনে ‘ন্যায়’ নির্ধারিত হয় শক্তি দিয়ে) কিন্তু অসমীচীন পেশিবলের খেলা আবার, আরও একবার, দেখার আমার ইচ্ছা নেই কোনো। কী হবে ওখানে, ওই টুঙ্গিপাড়াতে? তাপ বাড়বে, অনেক দুষ্কর্ম ঘটবে, অনেক কুকর্মকারী অনেক রকম সুবিধা নেবে এবং শেষে কোনো না কোনো মানুষেরই-শিয়াল-কুকুরের নয়, মানুষের—শিরোচ্ছেদন হবে গিলোটিনে যখন কিনা ইউরেনিয়ামের ভান্ডগুলো ফুটতে থাকবে গোপালগঞ্জের আশপাশের জঙ্গলে ও শুকনো প্রান্তরে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশে বিদ্যুতের স্পার্ক ফিনকি দিয়ে উঠবে, বজ্রপতনে পুড়ে যাবে অনেক চিল, অনেক বনের অনেক পাখি, সম্ভবত এমনকি বঙ্গবন্ধুর লাশ বয়ে আনা ওই শয়তানের সাক্ষীবন্ধু হেলিকপ্টারটাও। আমি বস্তু পৃথিবীর দহনযোগ্যতা নিয়ে আফসোস করতে করতে বিজয় সরণির মোড় থেকে হেঁটে হেঁটে—জামার নিচে জাঙ্গিয়ার ভেতরে তখনো আমার ওই পিস্তল ওভাবেই রাখা—পৌঁছে গেলাম বসুন্ধরায়। 

.

রাত নয়টার স্ট্রিট লাইটের আলোয় বসুন্ধরার মেইন রোডের দুই পাশের গাছগুলোকে লাগছে দেখলাম সৃষ্টিছাড়া। যে পথ দিয়ে আমি ঢুকেছি-তিন শ ফিট রাস্তার পথ—সেখানে কেবল সে গাছগুলোই স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে, যারা ভাসছে আঁকাবাঁকা দাঁড়ানো ল্যাম্পপোস্টগুলোর আলোয়। প্রথমে দুটো দেবদারু, তারপর এক ল্যাম্পপোস্টের বাম দিকের প্রতিবেশী অনেকগুলো বিলিম্বি (ফলসহ), আর ডানে হাফ ডজন অরকেরিয়া বা ক্রিসমাস ট্রি। তাদের পেছনে, অন্ধকারেই চেনা যাচ্ছে আম, বকুল ও কাঁঠালগুলোকে। একটা বড় কাঁঠালগাছের নিচে রাফিস পাম, এর পাশে আবার-দেখার জন্য আমাকে যেতে হলো সেখানে — খুবই বিপন্ন দেশি গাছ সাইকাস। একটা ‘আরবান ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্ট’ কোম্পানির বানানো এক বিল্ডিংয়ের দোতলা-তিনতলার রেলিংয়ে দেখলাম পাতাবাহার এবং বারান্দায় —আমাকে অবাক করে দিয়ে—সাইকাস পাম। আরেকটু সামনে এগোতে আমার চেনা শিরীষগাছটাকে পেলাম, সেটার গোড়ার মাটিতে পড়ে আছে একটা আহত পাখি। আমি উবু হয়ে পাখিটাকে দেখলাম, সাধারণ চড়ুই, তার এক পা কোনো বিড়াল কামড়ে ধরে কেটে নিয়ে গেছে। ছোট পাখি, ছোট জান, ছোট পরিমাণ রক্ত তার। আরেক দফা মন খারাপ হলো শুধু। মনে হলো পাখিটাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে পারলে বেঁচে যেতাম, কিন্তু পাশেই দাঁড়ানো পাঁশুটে রঙের এক বকুল বৃক্ষ আমাকে ওরকম কোনো নির্মমতা ঘটানো থেকে বাঁচাল। আমি তখন নিজেকে প্রবোধ দিতেই যেন হাত রাখলাম লুকানো স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন 3914-এ। 

কাকে মারার ইচ্ছা হচ্ছে আমার? চড়ুইকে পঙ্গু করে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়া ওই বিড়ালটাকে? নাকি মৃত্যুযাতনায় ভোগা চড়ুইকে? কাকে মারতে চাই আমি এই পিস্তল দিয়ে? আমাকে বুঝতে না পারা, বহু মানুষের বিছানায় শুয়ে বেড়ানো অতি স্বাধীন মেহেরনাজকে, নাকি ওই দুর্বৃত্ত ইবরাহিমকে যে কিনা ডানপন্থী লোকগুলোর মতো— তীব্র ডান হয়তো না সে, কিন্তু বিষয়টাকে আমি মাত্রার ফারাকের চাইতে বেশি কিছু হিসেবে দেখতে নারাজ — পঁচাত্তরের নিজস্ব ব্যাখ্যার আড়ালে পাকিস্তানের হাতে আমাদের অতীতের ওই নিষ্পেষিত হতে থাকাকেই সমর্থন দিয়ে ফেলছে? 

ঘড়িতে দেখলাম রাত ৯টা ১১ মিনিট ৩৮ সেকেন্ড, ১৪ আগস্ট ২০১৫। টুঙ্গিপাড়ায় একটু আগে যা দেখলাম, তা আসলে কী? আমাকে ঠকাল কি আমারই মন? বঙ্গবন্ধুর লাশের কি দাফন হয়নি? বিদ্রোহ হয়েছিল ওই দিন টুঙ্গিপাড়ায়? কেয়ামত নেমেছিল বাঁধভাঙা অন্যায়কে ন্যায়ের সঙ্গে ব্যালান্স করতে? বিশ্বাত্মা সেখানে গোঁ ধরেছিলেন কি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে, তাঁর বাড়ির চাকর বৈকুণ্ঠের ওপরে সর্বময় ক্ষমতা অর্পণ করে? 

আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাকে আবার একদিন ফিরে যেতেই হবে ওই দিনের টুঙ্গিপাড়ায়, ইতিহাসবেত্তা নয়, একজন ফিকশন লেখক হিসেবে, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পেতে। কিন্তু আজ না, আজ আর না। পনেরোই আগস্ট শুরু হতে এখন ঘড়ির কাঁটার হিসেবে ঘণ্টা তিনেক বাকি, কিন্তু ইতিহাসের কাঁটার মাপে তা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। আমি বুঝলাম, আমি এখন যা করতে পারি তা এই : কাফকা অনুবাদ বাদ দিয়ে পনেরোই আগস্টের রাত ও ১৬ আগস্টের টুঙ্গিপাড়াকে নিয়ে লেখা। বুঝলাম, বাসায় যেতে হবে আমাকে। 

আশ্চর্য। বাসার নিচে দেখা হয়ে গেল আমার সেই প্রতিবেশী ব্রিগেডিয়ার (অব.) মাহমুদ আনসারি সাহেবের সঙ্গে। তাঁর দিকে তাকিয়ে ঠিকভাবে মাথাও নাড়াইনি, কিন্তু তাঁর চোখের শীতলতাকে ঠিকই দেখতে পেয়েছি গ্যারেজঘরের ক্ষীণ আলোয়। তিনি বোধ হয় বিরক্ত যে আবার আমার সঙ্গে পনেরোই আগস্টের ‘মীমাংসিত’ বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে তাঁর। তাঁর সঙ্গে ১৪-১৫ আগস্ট নিয়ে কোনো কথা বলা, সামরিক বাহিনীর কার্যকলাপ নিয়ে কোনো তর্ক-বিতর্কের দাবা খেলার সকল ইচ্ছা আমার তিরোহিত হয়ে গেল একনিমেষে। যার মধ্য দিয়ে আজ আমি হেঁটে এসেছি, তাতে তাঁর কেন, অন্য কারোর কোনো ভাষ্য শোনারই আমার আর প্রয়োজন নেই এ জীবনে। খাকি কাপড়ের আর্টিলারি আমার দেখা হয়ে গেছে, কালো পোশাকের ট্যাংক বাহিনীকে আমি মেপে ফেলেছি, ফরটি সিক্স ব্রিগেডের ক্রিয়াকলাপের পোস্টমর্টেমও আমার করা হয়ে গেছে, সেই সঙ্গে আমি আরও দেখেছি কর্নেল জামিলের লাল গাড়ি, মুহিতুলের পায়ের গুলি, শেখ রাসেলের মাথার মগজ, ধানমন্ডি লেকের ওপারে এক হাউটজার কামান, খুনিদের তাৎক্ষণিক প্রমোশন প্রাপ্তি এবং শেখ রেহানার মাথার চিরুনি চুরি করে এক সৈনিকের পকেটে ঢোকানো। “নাহ্ ব্রিগেডিয়ার সাহেব, আপনার সঙ্গে আমার আর কথা নেই কোনো’, আমি বলে উঠলাম লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে। 

তিনি হা-হা করে উঠলেন, ‘কী বললেন? কী বললেন?’ বলে। 

লিফট চালু হলো, আমি নয়তলায় পৌঁছালাম, ঘরে ঢুকেই গিয়ে দাঁড়ালাম প্রায়ান্ধকার আমার ব্যক্তিগত বারান্দায়। সামনে বসুন্ধরার অনেক আলো জ্বলা রাত দশটার উদ্ভাসিত আকাশ এবং সেই আকাশের মহান সার্কিট বোর্ডে নাচছে অনেক আলোর আভা। আমার কাছে কোথায় যেন গোঁজামিল দেওয়া লাগছে ওই আলোর খেলাকে। 

অনেক প্রশ্ন আমার মনে পনেরোই আগস্ট নিয়ে, সামরিক বাহিনীর, ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের, রক্ষীবাহিনীর, ভারতের, পাকিস্তানের, আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে এবং আমাদের দুই পয়সার আমলা ও চার পয়সার রাজনীতি-রাজনীতি খেলা অনেক মানুষের অনেক কাজকর্ম নিয়ে। কেন জেনারেল জিয়া পনেরোই আগস্ট ভোরে শেভ করতে করতে সিজিএস ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিলের মুখে রাষ্ট্রপতি হত্যার কথা শুনে বলেছিল, ‘প্রেসিডেন্ট ইজ ডেড, সো হোয়াট? ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার। ইউ শুড আপহোল্ড দ্য কনস্টিটিউশন?” এই একই কথা বলাটা দুদিন পরে হয়তো স্বাভাবিক শোনাত, কিন্তু দেশের রাষ্ট্রপতির ভয়ংকর অন্তর্ঘাতে মৃত্যুর মাত্র কিছুক্ষণ পরে দেশের সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় প্রধান কী করে বলতে পারে, ‘সো হোয়াট?’ কেন সে রাতে দেশের গোয়েন্দাপ্রধান ব্রিগেডিয়ার রউফ সোর্স মারফত রাত তিনটায় সৈন্য ও ট্যাংক চলাচলের খবর পেয়েও সরাসরি রাষ্ট্রপতিকে তাঁর বাসার রেড টেলিফোনে ফোন করে সতর্ক করে দেন নাই? এ রকম, এ রকম অন্তত দুই ডজন প্রশ্ন আমার মাথায় আছে তখনকার হর্তা-কর্তা-আমলা-কূটনীতিক-মোড়ল-মৌলভিদের ব্যাপারে। 

নাহ্, লাভ নেই এসব জিজ্ঞেস করে। ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিকের কায়দাটা মঞ্চে দেখিয়ে দিলে সব মাটি হয়ে যায়—সময় ও টিকিটের পয়সা, দুটোই। পৃথিবীর ইতিহাস কী ভয়ানক সব ম্যাজিকে পরিপূর্ণ। আমি ভাবি, মানুষের নানা হাত ও সেসব হাতের নানা সাফাইতে ওই ম্যাজিকগুলো বরং তাদের জগাখিচুড়িভরা আকর্ষণ নিয়েই থাকুক, যাতে করে পৃথিবী ভ্রুক্ষেপহীন ঘুরে ফিরতে পারে তার নিজস্ব পরম্পরার কক্ষপথে। ভালো। 

নিজের অথর্ব-অক্ষম চিন্তা নিয়ে আমার ভেতরে এবার দেখলাম জমে উঠছে ক্রোধ। আমি বারান্দা ছাড়লাম। আমার লেখার টেবিলে গিয়ে বসলাম। সামনে সাদা কাগজে অসংখ্য কাটাকুটি করা কাফকা, আমার নিজেরই হাতে এবং আরও সামনে, মনের বারান্দার দূর সামনে টুঙ্গিপাড়া, স্মৃতি। মানুষের সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য ওঠে ও নামে, মানুষ বদলায়, সময় বদলে দেয় সবকিছু। কিন্তু আজকে আমার দেখা ওই টুঙ্গিপাড়ার প্রায় ঘন অরণ্য এবং ওই মধুমতী নদী, ওই ভেন্নাবাড়ি খালের স্থবির জলস্রোত আমাকে বলে দিল, টুঙ্গিপাড়ার ওই চিৎকার, ওই কান্না, ওই বিদ্রোহে ফেটে পড়তে চাওয়াটা সময়ের বাইরের কোনো ব্যাপার, কেবল মনে ও স্মৃতিতেই সেই বাস্তবতার নির্মাণ ও ধ্বংস সম্ভব, বাস্তবে নয়। আমি স্মৃতির মধ্যে গাঢ় ও শাশ্বত হয়ে থাকা রহস্যময় এই মুহূর্তগুলোর অর্থ কী, তা নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু ভাষা আমাকে সাহায্য করল না কোনো। বস্তু পৃথিবীর বাস্তব পর্দাটার আড়ালে লুকানো দুর্গম ও রহস্যে ভরা গোপন সব সত্য কী করে দেখা সম্ভব, তা নিয়ে ভেবে মাথা কুটে মরে এবং কী ভাষায় টুঙ্গিপাড়া নিয়ে আমার দেখা বিদ্রোহের ‘ভিশন’টাকে ফুটিয়ে তুলব, তা বুঝতে না পেরে নিজের অসহায়ত্বে আফসোস করতে করতে আমি হাতে নিলাম মার্সেল প্রস্ত। পাতা উল্টে যেখানে থামলাম, কোনো প্রাক্-পরিকল্পনা ছাড়াই, তা কুমব্রেতে মার্সেলের শৈশবের এক অধ্যায়। মার্সেল মনে করছে : 

পথগুলোর একটায়ও কোনো পায়ের আওয়াজ নেই। উঁচু এক গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালগুলোকে দুই ভাগ করে দিয়ে এক লুকানো পাখি চেষ্টা করে যাচ্ছে দিনটাকে খাটো বানানোর; সে লম্বা-টানা এক সুরের মাধ্যমে ভালো করে বুঝে নিতে চাইছে এই দিনটাকে ঘিরে থাকা নির্জনতার সার, কিন্তু তার সেই সুরেলী ডাকের উত্তরে সে পেল এমন এক সমস্বর উত্তর, নীরবতা ও নিশ্চলতার এমন এক শক্তিশালী প্রতিধ্বনি যে মনে হবে অনন্তকালের জন্য তার এই ডাকের মধ্যে যেন ধরা পড়ে গেল সেই তারই তাড়াতাড়ি পার করতে চাওয়া মুহূর্তটা। 

এরপর আমি পড়লাম কুমব্রেতে ভিভন নামের ছোট নদীর জলে লিলি ফুল ফুটে থাকার দৃশ্যের কথা, ফুল ধরা হোর্থনগাছগুলো থেকে আসা সুবাসের বিবরণ—সবটা মিলে লাগল এমন কিছু যা শাশ্বত আনন্দের, যেমন আমার কাছে ছিল টুঙ্গিপাড়ার কাটা খালের পাশ দিয়ে চৌরঙ্গী হয়ে বেতগ্রাম পর্যন্ত রাস্তার দুধার, যেখানে প্রকৃতি যেন স্বচ্ছ কোনো কাচের মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছিল তার রূপ ও রশ্মিগুলো নিয়ে। 

টুঙ্গিপাড়ার জন্য আমার বুক হাহাকার করে উঠল। ওই মানুষটা স্বাভাবিক মৃত্যু পাননি, পেলে নিশ্চয়ই তাঁকে বহু বছর ধরে চেনা পাখিদের দল, জলের ছোট সুন্দর মেটে সাপ ও ভেসে থাকা সাদা শাপলা ফুলের থোক তাঁর কাছ থেকে বিদায়ের প্রস্তুতি নেওয়ার সময়টুকু পেত। ‘অতীতের মনে করা সৌন্দর্য ও জীবনের প্রধান সারবত্তার মধ্যে মাতালের মতো ডুবতে গেলে প্রয়োজন কেবল একটা নিরানন্দ হেমন্তের দিন, যখন সূর্য ডুববে কাউকে না জানিয়েই, বৃষ্টির পরে শুকাতে থাকবে রাস্তা এবং শীতের প্রথম ঠান্ডা টের পাওয়া যাবে একটু।’ আমার বিশ্বাস হলো যে সব বদলায়, সময়ের সাথে সাথে সব পালায়-বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, দোকানপাট, গাছের কাণ্ড, খেতের আলোর রেখা, কিন্তু শুধু টুঙ্গিপাড়া বাদে। টুঙ্গিপাড়ার কোনো কিছু বদলাতে পারে না, কারণ, সেটা এক গোছানো, চিরদিনের সবুজ পৃথিবী; ঝড়ের পরেও, লড়াইয়ের শেষেও সে আবার যা তা-ই; কারণ, সেখানকার মাটি এই অনিশ্চিত পৃথিবীতে কাউকে চির-নিরাপদ আশ্রয় দেবার প্রতীক হয়ে রয়েছে আমার কাছে। 

.

প্রুস্ত হাতে নিয়ে মন দেখলাম আরও বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে। সেখানে বৃষ্টির কথা পড়লাম, বৃষ্টির ফোঁটাদের কথা, যারা একসঙ্গে দল বেঁধে উড়াল দেওয়া পরিযায়ী পাখির দলের মতো ঘনবদ্ধ পড়তে থাকে আকাশ থেকে। দেখা যায় কোনো ফোঁটা বিচ্ছিন্ন হয় না অন্যগুলো থেকে, তাদের দ্রুত পতনের কালে তারা কেউ পথ ভুল করে অন্যত্র পড়ে যায় না, প্রতিটা ফোঁটা তার নিজের জায়গা ধরে রাখে এবং নিজের দিকে টেনে আনে তারই পরপর পড়তে থাকা ফোঁটাগুলোকেও, আর ওই বৃষ্টির ফোঁটাদের ভিড়ে কী রকম কালো হয়ে ওঠে আকাশ, চড়ুইদের দল বেঁধে উড়াল দেওয়ার মুহূর্তের চাইতেও বেশি আঁধারকালো। মার্সেল বলছে, ‘প্রেম, চিরকালই অতৃপ্তির এক বোধ এই প্রেম স্রেফ বেঁচে থাকে সেই মুহূর্তগুলোর মধ্যে, যেগুলো এখনো আসেনি। 

আমার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। আমি কী করতে পারি, কী করতে পারি ভাবতে ভাবতে প্রস্ত বন্ধ করে চোখ বুজলাম ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ির সারা সিঁড়িজুড়ে আঁকা আলপনার নকশাগুলো মনে করবার জন্য। কত বড় বিশ্বাসঘাতকতা, কত বড় বেইমানি। ওই খুনিগুলোকে আমার মনে হলো তারা কত বেশি ফাঁপা দর্পে ভরা, প্রতিহিংসাপরায়ণ, উদ্ধত ও অস্বাভাবিক রকমের নিষ্ঠুর লোক, যারা আবার কিনা দেশের ভালো করার ফিনফিনে আদর্শের এক পলিথিন দিয়ে বানিয়েছিল তাদের বাহ্যিক শোভা, আকৃষ্ট করেছিল হাজার-পনেরো শ লোকের এক ডাকাত দলকে। কী সব ভণ্ড ও উন্মাদ! 

মনে পড়ল অ্যালবার্ট পিয়ারের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যত বইপত্র, অ্যালবাম, নথি ঘাঁটি, সবচেয়ে আমাকে আশ্চর্য করে অ্যালবার্ট পিয়ার—হিটলারের চিফ আর্কিটেক্ট ও মিনিস্টার অব আরমামেন্টস। আমি এসএস বাহিনী ও গেস্টাপোর খুনি ডাকাতগুলোকে বুঝতে পারি, গ্যাসচেম্বারে কাজ করা বদ্ধ উন্মাদ নিপীড়ক ডাক্তারগুলোর মতিগতি ধরতে পারি, এমনকি নাৎসি বাহিনীর গোঁড়া জঙ্গি সদস্যদের ক্রিয়াকলাপগুলোও হিসাবের মধ্যে মেলাতে পারি—কারণ, এদের সবার লয়্যালটির গণিত ছিল সরল-সোজা, এদের উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার, এদের যুদ্ধ-পরবর্তী অপরাধবোধ ছিল সাফ সাফ। কিন্তু আমি অ্যালবার্ট পিয়ারের দেবদূতের মতো শিশুমুখ, পরিপাটি পোশাক-আশাক, অভিজাত ঘরানার হাসি ও মুখভঙ্গি, তার ইন্টেলেকচুয়ালিজম, তার পড়াশোনা, এসবের সঙ্গে কখনোই মেলাতে পারি না তার কাজকর্মের ইতিহাস। দেখতে মনে হয় আন্তরিক, হাবভাবে মনে হয় অনেক উন্নত চরিত্রের, আর এখানেই আমি তাকে দেখে ধোঁকা খাই বারবার এবং পরে বুঝতে পারি দুই টাকা মাইনের করপোরাল হিটলারের বিপরীতে এত বড় আর্কিটেক্ট শপিয়ার আমাদের চিরকাল ধোঁকা খাওয়ারই এক সাজানো-গোছানো ফাঁদ। তার চেহারা-সুরত অমন বলেই তার আসল উদ্দেশ্য বোঝা দুরূহ এবং তার আসল উদ্দেশ্য বোঝা দুরূহ বলেই সে স্বচ্ছন্দে আড়ালে আড়ালে চালিয়ে যেতে পেরেছিল তার ভয়াবহ সব বর্বরতা। 

এদের কখনোই বিশ্বাস করা যায় না। এরা কথা বলে সুন্দর করে, ভাষা সুন্দর, বাহ্যিক প্রকাশ ও পরিবেশনা সুন্দর, এদের ভাবের মধ্যে থাকে ভদ্র-শান্ত এক পেলবতা, আর এদের থাকে অন্যকে নিজের যুক্তি বিনয়ের সঙ্গে বোঝাতে পারার এক আকর্ষণীয় গুণ। আমার কাছে নাৎসি জার্মানির সত্যিকারের ক্রিমিনাল এই অ্যালবার্ট শপিয়াররা, যারা দল বেঁধে আবার গোঁয়ার এক মহিষের পিঠে চড়ে বসেছিল ‘৭৫-এর পনেরোই আগস্ট তারিখে এবং নিষ্ঠুর ধোঁকা দিতে পেরেছিল বঙ্গবন্ধুকে ও তাঁর চারপাশে ভিড় করে থাকা আত্মবিশ্বাসে ভরা আহাম্মক সঙ্গীগুলোকে। কী ট্র্যাজিক এই ব্যাপারটা যে এ রকম তথাকথিত শিক্ষিত লোকের ভেতরেই সাক্ষাৎ শয়তান বাস করে, বেড়ে ওঠে, বড় হয় এবং এদের চিন্তার মাপ ও শরীরকে সেই শয়তান একদিন ছাড়িয়েও যায়। আমার ফোন বেজে উঠল। 

মেহেরনাজ। ফোন ধরলাম। মেহের-আমি যা না কিন্তু আমি যা হতে চেয়েছি, তা-ই সে। তাই তার ফোন আমাকে ধরতেই হলো। এর আগের এসএমএস বার্তায় আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কোনো চিহ্নই এখন তার কণ্ঠে নেই। সে আমাদের মধ্যকার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ও সাম্প্রতিক বিচ্ছেদের ধারেকাছে দিয়েও গেল না। সরাসরি জিজ্ঞাসা করল, ‘ইবরাহিম ভাই ফোন করেছিলেন।’ আমি বললাম, ‘তো?’ ‘আপনার পিস্তল লাগবে, তা আমাকে বললেই তো পারতেন’, বলল সে। আমি অবাক হলাম। মেহেরনাজের কাছে পিস্তল থাকে? অবাক কথা। তার যোগাযোগের মাত্রা তাহলে এত দূর? সে তাহলে সব দুর্বৃত্ত ও মাস্তান হাতে রাখে, সব দুষ্টকে ধরে রাখে তার দুই পায়ের মাঝখানে? 

মেহেরনাজ শক্ত গলায় বলল, “ইবরাহিম ভাইয়ের ওখানে ঝগড়াঝাঁটি করার কী মানে? কালকের পনেরোই আগস্ট নিয়ে আপনার প্ল্যানটা কী? ওই পিস্তল দিয়ে কাকে আপনি খুন করেছেন বলে পেপারে দেখব আমি কাল-পরশু?’ আমি চুপ। ‘কাকে মেরে পনেরোই আগস্টের প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছেন? কথা বলেন। হ্যালো। হ্যালো।’ মেহেরনাজ বলে চলেছে, আমি নির্বাক শুনছি। 

মেহেরনাজের গলার স্বর আমার কানে ঝোড়ো বাতাসের মতো বাজছে। সে আবার জানতে চাচ্ছে আমি ইবরাহিমের কাছ থেকে পিস্তল নিয়েছি কেন? সে আরও বলছে, আমার বোঝা উচিত আমি অসুস্থ, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছি এই সেদিন। তার কথা শুনতে শুনতে আমি তার মুখটা মনে করেছি, টুঙ্গিপাড়ায় বানানো তাৎক্ষণিক হেলিপ্যাডটাকে মনে করেছি, মার্সেল প্রস্তের আলবারতিনকে মনে করেছি এবং তখনই দেখেছি, মেহেরনাজের ফোন কেটে দেব দেব করার সময়েই দেখেছি যে আমার লেখার ঘরের জানালায় এসে বসেছে রাত বারোটার এক রঙিন প্রজাপতি। 

পনেরোই আগস্ট নামের শোক দিবস অফিশিয়ালি শুরু হয়ে গেল তাহলে। রাত বারোটার কাটা দাগ পার হলো, আর এই প্রজাপতি, এত রাতে, কোত্থেকে উড়ে এসে জায়গা নিল আমার জানালার গ্রিলে। 

চিরকালই দ্বিপক্ষীয় সিমেট্রির এক বড় উদাহরণ এই প্রজাপতি, কারণ এর মাঝবরাবর তাকালে এক পাশটা দেখা যায় যেন অন্য পাশের নিখুঁত এক মিরর ইমেজ, পাখার মাঝের সব শিরা-উপশিরাসহ। আমি চোখ দিয়ে প্রজাপতিটার গঠনের সিমেট্রি দেখছি, কান দিয়ে শুনছি মেহেরনাজের ‘হ্যালো, হ্যালো’, এবং মনে মনে ভাবছি কীভাবে প্রকৃতির অধিকাংশ প্রাণ ও বস্তুই সিমেট্রিক্যাল—বৃষ্টির শেষে আকাশে ভেসে ওটা বহুবর্ণ রংধনু, যার রঙের দাগগুলো সমানভাবে সমান্তরাল বাঁক নিয়ে বৃত্তাকার, (গ্রিক দার্শনিকেরা বিশ্বাস করতেন যে বৃত্তের চেয়ে নিখুঁত আর কোনো আকার নেই); সাগরসৈকতে ঝাঁপিয়ে আসা ঢেউ, তারা অগণন, কিন্তু সব দেখতে প্রায় একই রকম; বাইসাইকেলের চাকা, বৃত্তাকার এবং বৃত্তের সিমেট্রির কারণেই বাইসাইকেল চলে (ঠিক যেমন চতুর্ভুজাকার চাকার বাইসাইকেলও নিশ্চয়ই রাস্তায় চলত যদি রাস্তা হতো ঢেউয়ের পরে ঢেউখেলানো অন্য সিমেট্রির); স্টারফিশ; ঝিনুকের খোলের জোড়ানো দিকটা; গ্যালাক্সি; মিল্কিওয়ে; তারার আকার; মার্সিডিজ বেঞ্জ ও টয়োটা গাড়ির লোগো; চারপায়া টেবিল; মানুষের শরীরের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত ডান ও বাম পাশ। 

মেহেরনাজের লাইন আকস্মিক কেটে দিয়ে ওই এক সিমেট্রিক্যাল প্রজাপতি নিয়ে আমি থমকে রয়েছি কয়েকটা মুহূর্ত, দূরে মাইকে তখন শোনা যাচ্ছে শোক দিবসের কোনো একটা দলবদ্ধ শোকগানের আওয়াজ, আর তখন, তখনই এই পৃথিবীর সব সিমেট্রি, বিশ্বসংসারের ডিজাইন-বিষয়ক জানা সব সত্য, সব অনুমান, সব অনুমাননির্ভর ভরসা ও আপাত-নিশ্চয়তাকে গুঁড়িয়ে পাউডার-সর্বস্ব করে দিয়ে শোনা গেল বিকট আওয়াজটা 

বুম, না বুম নয়; ভ্ররাত, না ভ্রাত নয়; ঠা-ঠা, না ঠা-ঠা নয়—কিংবা এর তিনটে মিলে যা হয় তা, কিংবা একেবারে অন্য কিছু। 

মাত্র তিন সেকেন্ড, খুব বেশি হলে চার, আর খুব কম হলে দুই—ওটুকুই স্থায়িত্ব ছিল ওই বিকট আওয়াজের, যা বর্ণনা করার জন্য রূপকের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আমি দেখলাম আমার আর অন্য পথ নেই কোনো, কারণ, ওরকম শব্দের যে কোনো অবিকল বা কাছাকাছি প্রতিরূপ এ পৃথিবীতে নেই, কোনো দিন ছিল না বা কোনো দিন থাকতে পারে না, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। আমাদের পুরো বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা এই শব্দের বিশালত্ব ও বিকটত্বের সামনে কেঁপে উঠল অসহায়ের মতো। শব্দের তরঙ্গ এসে ধাক্কা দিল এখানকার সমস্ত বাড়ি, সমস্ত অফিসের জানালায়, সমস্ত গাছ, সমস্ত গাছের পাতায়। এমন কোনো বাড়ি-অফিস-দোকান-গাড়ি নেই, যার কাচে চিড় ধরল না এবং পাতলা যেসব কাচ তারা ভেঙে পড়ল না ঝনঝন করে, আমার নিজের বাসার অনেকগুলো জানালার কাচসহ। আমি এ-ও বুঝলাম যে আজ রাতে এমন কোনো মানুষ এ বসুন্ধরা আবাসিকে নেই যে কিনা চিৎকার করে উঠল না ভয়ার্ত ও বিবর্ণ কণ্ঠে, এমন কোনো কুকুর-বিড়াল-গাছে ঘুমানো পাখি ও গর্তে থাকা ইঁদুর নেই যে এই শব্দের উল্টো আর একটা ছোট ও ভীত শব্দ করল না নিজের গলায়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *