অ্যালেক্স – ৫

অধ্যায় ৫ 

কাঠের বাক্সটা দেখতে খুবই সাধারণ। কাঠের তক্তাগুলো একটা আরেকটা থেকে দশ সেন্টিমিটার দূরে, ভেতরে কী আছে সহজেই দেখা যায়। আপাতত এর ভেতরে কিছু নেই; পুরোটাই খালি। 

অ্যালেক্সের কাঁধে ধরে টেনে হিঁচড়ে বাক্সটার কাছে নিয়ে গেল লোকটা। তাকে পেছনে ফেলে লোকটা হাতে থাকা ইলেকট্রিক স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে বাক্সের উপরের দিক থেকে একে একে কাঠের তক্তা খুলে আনতে লাগলো। রক্তলাল ঘাড় বেয়ে নেমে আসছে ঘামের সরু রেখা…নিয়ান্ডারথাল; ঠিক এই শব্দটাই অ্যালেক্সের মাথায় আসি আসি করে আসছিলো না। 

লোকটার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে অ্যালেক্স। এক হাত দিয়ে আড়াআড়িভাবে নিজের বুক ঢেকে রেখেছে আর অন্য হাত দিয়ে যৌনাঙ্গ। কেননা নগ্ন অবস্থায় তার বেশ লজ্জা লাগছে। যেখানে জীবন বাঁচানোই দায়, এমন অবস্থায় লজ্জা পাওয়াটা পাগলামি। ঠাণ্ডায় পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঠকঠক করে কাঁপছে। এখন সে চাইলে কিছু করতেই পারে। লোকটাকে আঘাত করে দৌড়ে পালাতে পারে। গুদামঘরটা বেশ বড় আর পুরোটাই খালি। পনের মিটার দূরের এক দেয়ালে ফাটল আছে। লোকটা যখন কাঠের তক্তা খুলতে ব্যস্ত, এখান থেকে পালানোর ছক কষছে সে। দৌড়াবে? কশাঘাত করবে? হাতের ড্রিল টা নেয়ার চেষ্টা করবে? তক্তাগুলো খোলার পর কী করবে?’ তোর মরণ আমার চোখের সামনে হবে’ এই কথা দিয়ে সে কী বোঝাতে চেয়েছে? তাকে কীভাবে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছে? কিছুক্ষণের মাঝেই বুঝতে পারলো কয়েক ঘণ্টা আগের ভাবনা, ‘আমি মরতে চাই না’ এখন নতুন মোড় নিয়ে হয়েছে, ‘যত দ্রুত পারো মেরে ফেলো।’ এমনটা যখন ভাবছে তখন তার মাথায় দুটি নতুন চিন্তা ঢুকলো। প্রথমত, তার ভেতরে একটা জিদ কাজ করলো; এভাবে হার মেনে নিয়ো না, ঘুরে দাঁড়াও, লড়াই করো। দ্বিতীয়ত, লোকটা স্ক্রু ডাইভার রেখে তাকে ধরার জন্য হাত বাড়ালো। তখনি নিজের পরবর্তি করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো সে। দেয়ালের সেই ফাটল লক্ষ্য করে দৌড় দিলো। এক লাফে বাক্সটাকে অতিক্রম করে যত দ্রুত সম্ভব দৌড়াতে লাগলো। হঠাৎ এমন দৌড় দেখে লোকটা হতবুদ্ধি হয়ে গেল। কিছু করার সময়ই পেলো না। এদিকে প্রাণপণে ছুটছে সে, তার ভেতরে এখন কোনো ভয়ই নেই, শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেন বলছে, ‘পালাও, পালাও এখান থেকে।’ মেঝে একইসাথে বেশ ঠাণ্ডা, উঁচুনিচু আর পিচ্ছিল। কিন্তু এইসব কোন কিছুই তার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। দু একবার পিচ্ছিল মেঝেতে পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে রক্ষা করে। তবুও এক মুহূর্তের জন্য কোনো থামাথামি নেই, ভিতর থেকে কে যেন অনবরত বলছে, ‘দৌড়াও! দৌড়াও! দৌড়াও।’ তার মনে একটাই চিন্তা কাজ করছে নিজের জীবনটা বাঁচাতে হবে আগে। নিজেই নিজেকে বলছে, ‘আমি তার চেয়ে জোরে দৌড়াতে পারি। আর তা ছাড়া লোকটা বেশ বয়স্ক। কতদূর আর তাড়া করতে পারবে।”

দেয়ালের সেই ফাটল অতিক্রম করার পর গতি একটু কমাতেই দেখতে পেলো তার বাম দিকের দেয়ালে ঠিক তেমনি আরেকটা ফাটল। সব রুম দেখতে এক রকম। বের হওয়ার দরজাটা কোথায়? নগ্ন অবস্থায় রাস্তায় কীভাবে বের হবে এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো। হৃৎপিণ্ড কে যেন হাতুড়িপেটা করছে। লোকটা তার থেকে কত দূরে তা দেখার জন্য চারপাশে তাকালো। এমন সময় আরেকটা রুম দেখতে পেলো। নতুন আশার সঞ্চার হলো তার মনে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মেঝেতে, একটু বাতাসের জন্য ফুসফুস আর্তনাদ করছে। আবারো দৌড়ানো শুরু করলো নতুন উদ্যমে। কষ্টে তার চোখে পানি চলে এলো, একসময় শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেল, যা হয়তো বাইরের দুনিয়ায় নিয়ে যাবে তাকে। 

দরজাটা ইট দিয়ে বাঁধানো। 

লাল ইট দিয়ে বাঁধানো দরজায় সিমেন্ট এখনো ঠিকমতো লাগেনি, তাড়াহুড়োর ছাপ স্পষ্ট। দেয়ালটাও স্যাঁতসেঁতে। আবারো ঠাণ্ডার স্পর্শ পেলো সে। আর কোনো উপায় না দেখে জোরে জোরে দেয়ালের গায়ে আঘাত করছে এই ভেবে যে বাইরে দিয়ে যাওয়া কেউ হয়তো এই শব্দ শুনে সাহায্যে এগিয়ে আসবে আর চিৎকার করতে থাকল, ‘প্লিজ আমাকে এখান থেকে কেউ উদ্ধার করুন।’ ভীষণ অসহায় বোধ করলো সে, ইতিমধ্যে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। দেয়ালের সাথে নিজেকে চেপে ধরলো যেন দেয়ালের সাথে মিশে যেতে চাচ্ছে। মুখ দিয়ে কোন শব্দও বের হচ্ছে না। হুট করেই অদ্ভুত নীরবতায় ডুবে গেল চারপাশ, নিজের পিছনে লোকটার উপস্থিতি অনুভব করলো। ভয়ে দেয়ালের গায়ে বিলবোর্ড পোস্টারের মত সেঁটে যেতে চাইলো। দূর থেকে রুমের দিকে আসার পদশব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। নিজের শ্বাস নেয়ার শব্দও শুনতে পাচ্ছে এখন, আদতে নিজের ভয়টাই অনুভব করছে। 

লোকটা কোন কথাই বলল না। তার নিজস্ব পন্থায় এগুতে লাগলো। চুলের মুঠি ধরে হেঁচকা টান দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিলো তাকে। তীব্র ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলো সে। অ্যালেক্স অনেকটা নিশ্চিত যে তার বেশ কয়েকটা অঙ্গ অবশ হয়ে গেছে, ডুকরে কেঁদে উঠলো। এতেও লোকটার মন ভরলো না, কোমর বরাবর কষে লাথি হাকালো। তাকে নড়বার কোন সুযোগ না দিয়েই নির্মমভাবে আরো লাখি দিয়ে বলল, “মাগি। তুই পালাবি, না?” 

ব্যথায় চিৎকার করে উঠলো সে। জানে, এই দুঃস্বপ্ন থামবার নয়, কুণ্ডলী পাকিয়ে নিজেকে বাঁচানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা করলো। সে জানে যতক্ষণ লোকটার কথা মত না চলবে ততোক্ষণ এই অত্যাচার থামবে না। তার দিকে তেড়ে এসে কিডনী বরাবর শক্ত বুট পড়া পা চালালো। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলো সে। নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো, আর হাত তুলে আত্মসমর্পণ করলো যেন বলতে চাইছে, ‘থামুন। আর না, আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো।’ এলোমেলো ভঙ্গিমায় হাঁটতে শুরু করলো সে। হাঁটার গতি একটু কমে গেলেই পেছন থেকে চলছে তার পৈশাচিক অত্যাচার। অ্যালেক্সের গায়ের নানা জায়গায় ক্ষত, সারা শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। তবুও লোকটার অত্যাচারের ভয়ে হাঁটার গতি আরো বাড়ালো। একসময় সেই রুমে পৌঁছে গেল যেখানে শুরুতে তাকে আটকে রাখা হয়েছিলো। কাঠের বাক্সটা আগের জায়গায়ই আছে। বুকেও আর হাত নেই এখন তার। ভদ্রতার শেষ সুতোটুকু তো অনেক আগেই বিসর্জন দিয়েছে। এখন সে পরাজিত, পশুটার হাতে বন্দী এক পুতুল। সে কী বলেছিলো? তার শেষ কথা যেন কী ছিলো? ‘আমার চোখের সামনে তোর মরণ হবে রে, মাগী। ‘ 

লোকটা বাক্সের দিকে তাকালো। অ্যালেক্সও সেদিকে তাকালো। এইখান থেকে মুক্তির আর কোন পথ নেই। এরপর লোকটা যা করবে, তাই মেনে নিতে হবে তাকে, এটা অপরিবর্তনীয়। ফিরে যাওয়ার কোন রাস্তা নেই তার। ধর্ষণ করবে তাকে? হত্যা করবে? ধর্ষণের আগে নাকি পরে? মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অত্যাচার করবে? সে কী চায়? কী চায় এই নীরব ঘাতক? আর কিছু সময় পর এর উত্তর মিলবে। একমাত্র রহস্যের সমাধান হবে। 

“প্লি…প্লিজ,” অ্যালেক্স হাতজোর করে প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে বলল, “কেন? আমাকেই কেন?” 

লোকটা এমন ভাব করলো যেন অ্যালেক্স অন্য কোন ভাষায় কথা বলছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। 

“আমার সাথেই কেন?” আবারো জিজ্ঞেস করলো সে। 

“কারণ, আমি তোর মরন দেখতে চাই রে, মাগী” উচ্চস্বরে বলে উঠলো সে। তার চোখে মুখে সন্তুষ্টির ভাব স্পষ্ট যেন উত্তর দিতে পেরে বেশ খুশি। অ্যালেক্স চোখ বন্ধ করলো। তার গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। পুরোনো স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করলো, কিন্তু কিছুই মনে পড়লো না। পতন রোধ করার জন্য কাঠের বাক্স ধরে দাঁড়ালো। 

“ভেতরে যা মাগী।” বলল সে। বিনা প্রশ্নে এই আদেশ মেনে নিলো অ্যালেক্স। বাক্সের ভেতরে এখন যে পা রাখছে এ যেন তার নয়, তার শরীরে অন্য কেউ বাস করছে এখন। উবু হয়ে ভেতরে ঢুকলো, হাঁটুর চারপাশে হাত এমনভাবে জড়িয়ে রেখেছে যেন কফিনে নয় কোন পবিত্র স্থানে প্রবেশ করছে। 

সামনে এগিয়ে এসে বাক্সের ভেতরে গাদাগাদি করে থাকা অ্যালেক্সকে দেখলো সে। পতঙ্গবিজ্ঞানীরা বিরল প্রজাতির কিছু দেখলে যেমন খুশি হয়, ঠিক তেমন এক দ্যুতি খেলা করছে তার চোখে। 

অধ্যায় ৬ 

তাদেরকে রেখেই শুতে চলে গেল প্রহরী। ট্রেনের হুইসেল বাজানোর মত নাক ডাকতে শুরু করলো। কফি খাওয়ার জন্য কিছু টাকা রেখে বেরিয়ে পড়লো তারা। লুইস ধন্যবাদ জানিয়ে একটা নোট রেখে গেল। 

রাত তিনটা বাজে। অন্যান্য সব সদস্য বাসায় চলে গেছে। অপহরণের পর ছয় ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও তাদের হাতে প্রমাণাদি খুবই নগন্য। ক্যামিল আর লুইস দুজনেই বাড়ি যাওয়ার জন্য রাস্তায় চলে এলো। সকালে গোসল সেরেই আবারো তারা একত্রিত হবে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতেই একটা ট্যাক্সি এসে থামলো তাদের সামনে। 

“তুমি উঠে পড়ো।” বলল ক্যামিল। লুইসকে গড়িমসি করতে দেখে আবারো বলল, “আরে যাও তুমি। আমি কিছু মনে করবো না, বাকি পথ হেঁটেই যাবো আমি। একটু ব্যায়ামও হয়ে যাবে তারসাথে।” দুজনে আলাদা পথ ধরে এগিয়ে গেল। 

ক্যামিল বারবার মেয়েটার স্কেচ করেই যাচ্ছে। একটা মেয়ে রাস্তা ধরে হেঁটে চলছে, হাত নাড়িয়ে বাস থামাচ্ছে। কিন্তু সব ছবিতেই আইরিনের প্রচ্ছন্ন ছায়া বিদ্যমান, তাই বারবার নতুন করে শুরু করছে। কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলো সে। মেয়েটা ভিন্ন কেউ, এই জিনিসটাই মনের মাঝে গেঁথে নিতে চাইছে। সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো; মেয়েটা এখনো জীবিত। রাস্তা প্রায় খালি। মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ি আসা যাওয়া করছে। 

পুরো বিষয়টা যৌক্তিকভাবে চিন্তা করছে ক্যামিল। এই চিন্তাই তার মাথায় জট পাকাচ্ছে। মানুষ তো আর উদ্দেশ্য ছাড়া অপহরণ করে না; বরং এমন কাউকে অপহরণ করে যাদেরকে তারা চেনে। অন্ততঃপক্ষে কোন কারণ তো অবশ্যই থাকে। তার মানে অপহরণকারী অবশ্যই মেয়েটার বাসার ঠিকানা জানতো। কিন্তু তা জানার পরেও এতো দূরে অপহরণ করার একমাত্র কারণ বাসার কাছ থেকে এইকাজ করা অসম্ভব ছিলো। কেন অসম্ভব ছিল তা ভেবে পাচ্ছে না, কিন্তু অসম্ভব যে ছিল সে ব্যাপারে একদম নিশ্চিত সে। নইলে এতো ঝুঁকি নিয়ে মেইন রোডের পাশ থেকে কেউ অপহরণ করে না, যা অপহরণকারী করেছে। 

হাঁটার গতি দ্বিগুণ করলো ক্যামিল, এর সাথে তার চিন্তাকেও। অপহরণকারীর হাতে দুটো অপশন ছিলো, হয় সে মেয়েটাকে অনুসরণ করেছে অথবা এখানেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছে। ভ্যানে করে মেয়েটাকে অনুসরণ করেছে? এটাও তো সম্ভব না। কেননা সে বাসেই উঠেনি। আর তা ছাড়া তার পেছন পেছন ভ্যান চালিয়ে আসবে আর সে বুঝবে না, এই ব্যাপারটাও বেশ ঘোলাটে। সে অবশ্যই তার জন্য অপেক্ষা করছিলো। 

লোকটা মেয়েটাকে চিনতো, সে কোন পথে যাতায়াত করে তাও জানতো। তাই তার এমন একটা জায়গা দরকার ছিল যেখান থেকে মেয়েটাকে দেখতে পাবে; আসার সাথে সাথেই তাকে ধরে ফেলবে। আর রাস্তাটা যেহেতু একমুখী, তাই সে ঘটনাস্থলে আগে আসতে বাধ্য। মেয়েটা যথাসময়ে আসে, সে তাকে দেখে, আর অপহরণ করে নিয়ে যায়। 

“আমার ধারণা ঘটনাটা এভাবে ঘটেছে।’ বলল ক্যামিল। 

উচ্চস্বরে নিজেকেই বলল সে। তার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছুই না। বিপত্নীক হয়েছে বেশি দিন না হলেও, এরই মাঝে একাকী থাকার অভ্যাস গড়ে নিয়েছে। এ জন্যেই লুইসকে সঙ্গে নেয়নি। একাকী এতোটা সময় পার করে, কারো সঙ্গই ভাল লাগে না তার। নিজেকে নিয়ে অনেক বেশি ভাবে, প্রচুর আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। বর্তমানের ক্যামিলকে সে নিজেও খুব একটা পছন্দ করে না। 

আরো কয়েক মিনিট এইসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে তালগোল পাকিয়ে ফেললো। কিছু খুঁজছে। ক্যামিল সেই ধরণের মানুষ যারা ঘটনার আসল রহস্য সমাধান না করা পর্যন্ত হাল ছাড়ে না। প্রতিটি প্রমাণ যতক্ষণ না পর্যন্ত সঠিক হয়, এরা থামে না। বন্ধুদের ক্ষেত্রে এটা বিরক্তিকর এক অভ্যাস হলেও, একজন পুলিশ অফিসারের ক্ষেত্রে তা শক্তিমত্তার জায়গা। একের পর এক রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার মাথায় কিছুই আসছে না। হুট করে মাথায় একটা চিন্তা খেলা করে গেল, যেন বুদ্ধির বাতি জ্বলে উঠলো। 

সাধারণত কোনো কুঁড়সাক (যে রাস্তা একপ্রান্তে গিয়ে শেষ হয়ে গিয়েছে) ত্রিশ মিটারের বেশি লম্বা না হলেও, দু’প্রান্তে গাড়ি পার্ক করার মত যথেষ্ট জায়গা থাকে। ক্যামিল নিজেকে বলল, ‘আমি অপহরণকারী হলে এখানেই গাড়ি পার্ক করতাম।’ এই ভেবে একটু সামনে এগিয়ে গেল। রাস্তায় কেউ নেই, চারপাশ সুনসান। একটা বিল্ডিং দেখতে পেলো যার নিচ তলায় একটা ফার্মেসি। হুট করে তার চোখে পড়লো একটা দোকানের সামনে দুটো সি.সি.টি.ভি ক্যামেরা। 

*

সাদা ভ্যান দেখা যাচ্ছে এমন ফুটেজ যোগাড় করতে তাদের খুব বেশি সময় লাগলো না। মি. বার্টিনাক আদ্যোপান্ত একজন চাটুকার মানুষ, পুলিশকে যারা কথায় কথায় স্যার বলে অভ্যস্ত, যারা সবসময় ভাবে তারা পুলিশকে তদন্তে সহযোগিতা করছে। এই ধরণের লোকদের ক্যামিল মোটেও পছন্দ করে না, বরং এরা চরমমাত্রায় বিরক্তিকর। দোকানের পেছনের দিকের ডিসপেনসারিতে দাঁড়িয়ে আছে তারা। মি. বার্টিনাক একটা কম্পিউটার মনিটরের পেছনে বসে আছে। তাকে দেখতে কেমিস্ট মনে না হলেও, তার মাঝে এর স্বভাবচারিত বৈশিষ্ট্য বেশ প্রকট। ক্যামিল এক দেখাতেই তা বলে দিতে পারে, কেননা তার বাবাও ছিল কেমিস্ট। অবসরের পরেও তার বাবা কেমিস্টের মতই আচরণ করতো। তার বাবা মারা গেছে প্রায় এক বছর হতে চললো। মি.বার্টিনাক পুলিশকে সাহায্য করার জন্য বেশ উন্মুখ, আর রাত সাড়ে তিনটার দিকে দরজা খুলে ক্যামিলকে পেয়ে যেন খুশিতে আত্মহারা। 

পাঁচবার ডাকাতির শিকার হলেও, মি. বার্টিনাকের মনে এই নিয়ে কোন অসন্তোষ নেই। তবে আশঙ্কাজনক হারে ড্রাগ ডিলারদের ঝোঁক ফার্মেসির দিকে পড়ায়, প্রযুক্তির দিকে হাত বাড়িয়েছে সে। প্রতিবার ডাকাতি হওয়ার পর একটা করে নতুন ক্যামেরা লাগায়। বর্তমানে মোট ক্যামেরা আছে পাঁচটা, বাইরের দিকে দুইটা আর দোকানের ভেতরে বাকিগুলো। ক্যামেরার ফুটেজ প্রতি চব্বিশ ঘণ্টা পরপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুছে যায়। মি. বাৰ্টিনাক তার গ্যাজেটের ব্যাপারে বেশ সন্তুষ্ট। কোন ওয়ারেন্ট ছাড়াই সে ফুটেজগুলো দেখাতে রাজি হয়ে গেল, যেন আদেশ মানতে পেরেই খুশি। ফুটেজ আনতে কয়েক মিনিটের বেশি সময় লাগলো না। আদতে সেখানে দেখার মত কিছু ছিলোও না; গাড়ির চাকা আর নিচের দিকের অংশ বাদে কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। সাদা ভ্যানটা আসে 2।:04 মিনিটে। ড্রাইভার গাড়িটা এমনভাবে পার্ক করে যেন সামনের দিকে রাস্তাটা ভালোমতো দেখা যায়। ক্যামিলের কাছে এইটুকু যথেষ্ট নয় নিজের ধারণা সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করার জন্য। যদিও সে বেশ খুশি, কেননা তার অনুমান অনেকটা মিলে গেছে। আর তা কে না ভালোবাসে। তবে গাড়িটা আরো ভালোমতো দেখতে পেলে সুবিধা হতো তার জন্য। কেননা গাড়িটার নিচের অংশ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না ঠিকমতো। অপহরণের সময়সহ অন্যান্য বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবগত সে, শুধু দরকার ছিল অপহরণকারী সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য। কিন্তু এখানে এসে কোন লাভ হলো না। কিছুই পেলো না তারা। আবারো শুরু থেকে দেখা শুরু করলো সেই ফুটেজ। 

ক্যামিল এখনি উঠতে ইচ্ছুক না। অপহরণকারী চোখের সামনে থাকলেও ক্যামেরার ফোকাস অন্য কোন তুচ্ছ বস্তুর দিকে, ব্যাপারটা তাকে ক্রুদ্ধ করে তুললো। ভ্যানটা ২১:২৭ মিনিটে কুঁডসাক ছেড়ে যায়, আর ঠিক তখনি জিনিসটা তার চোখে পড়ে। 

“ওইতো!!!” 

মি. বার্টিনাক এখন স্টুডিও ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হলেন। ক্যামিলের দেখানো জায়গায় স্পুলটাকে নিয়ে গেলেন। সবাই একদৃষ্টিতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। ক্যামিল জিজ্ঞেস করলো ছবিটা আরো বড় করা যাবে কিনা। মি. বার্টিনাক খেয়ালখুশি মতো কয়েকটা নব ঘুরালো। ভ্যানটা যখনই পার্কিং থেকে বের হয়, ঠিক তখনি ভ্যানের নিচের দিকে হাতে লিখা কিছু অংশ দেখা যায়। যদিও তা পড়া অসম্ভব। লেখাটা বেশ অস্পষ্ট, আর তা ছাড়া ক্যামেরার ফোকাস অন্য দিকে থাকায় লেখাটার উপরের দিকের অনেকাংশ কেটে গেছে। ক্যামিল ফুটেজের এক কপি চাইলে, মি. বাৰ্টিনাক পেন ড্রাইভে করে তা দিয়ে দেয়। সর্বোচ্চ জুম করলে লেখাটা মোটামুটি এমন দাঁড়ায় : 

*******

দেখতে অনেকটা মোর্স কোডের মত। ভ্যানটা অবশ্যই কিছুর সাথে ঘষা খেয়েছে, গায়ে রয়েছে সবুজ রঙের নমুনা। ফরেনসিকদের কাজ আরো বেড়ে গেল। 

*

শেষ পর্যন্ত ক্যামিল বাড়ির পথ ধরলো। আজকের সন্ধ্যাটা বেশ উত্তেজনাকর ছিল তার জন্য। তার বাসা চার তলায়, নিজের মতাদর্শ অনুযায়ী কখনোই লিফট ব্যবহার করে না সে। 

যতটুকু করা সম্ভব তারা করেছে। এরপরের অংশটুকুই সবচেয়ে জঘন্য অংশ। এবার অপেক্ষার পালা। কোন মহিলা অপহৃত হওয়ার রিপোর্টের অপেক্ষা। কতদিন লাগবে তা কেউ জানে না। একদিন লাগতে পারে, দুইদিনও লাগতে পারে, অথবা আরো বেশি। এর মাঝে… আইরিন অপহৃত হওয়ার দশঘণ্টা পর তার লাশ পাওয়া যায়। এই কেসে তার অর্ধেকেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। ফরেনসিক বিভাগ থেকে এখনো কোন খবর আসেনি, যদি তারা কিছু পায় তাহলে সবার আগে সে জানবে। ক্যামিল ফরেনসিক বিভাগের কষ্টের সাথে বেশ ভালোভাবেই পরিচিত, প্রতিটি এভিডেন্স ক্রস চেকিং করা, একবার না মিললে আবারো করা। এমন নানা ধরণের কাজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় চলে যায়। 

সারারাত এইসব চিন্তা ভাবনাতেই পার হয়ে যায়। ক্যামিল এখন ক্লান্ত। গোসল করারও সময় নেই তার, আরো কয়েক কাপ কফি খেয়ে নিলো তন্দ্রাচ্ছন্নতা দূর করার জন্য। 

আইরিনের সাথে যে বাড়িতে থাকতো তা অনেক আগেই বিক্রি করে দিয়েছে সে। ওখানে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো তার জন্য; যেদিকেই তাকাতো স্ত্রীর কথা মনে পড়তো। পুরো ঘর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল তাদের নানা সুখের স্মৃতি। আইরিনের মৃত্যুর পর বেঁচে থাকার ইচ্ছাই হারিয়ে ফেলেছিলো। নতুন করে বাঁচার জন্য যে সাহস লাগে তা ছিল না তার। সে মানতেই পারছিলো না এতোদিন একটা মানুষের সাথে থাকার পর কীভাবে মানুষ একা একা বাঁচতে পারে। বেঁচে থাকাটাও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিলো। তখন তার বাবার কাছে পরামর্শের জন্য গেলে সোজাসাপ্টা উত্তর পায় যা তার মোটেও পছন্দ হয় না। এরপর লুইসকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, “সামনে এগুতে হলে, সব পিছুটান ভুলে যাও।” প্রথমে এই কথার অর্থ বুঝতে পারে না ক্যামিল। “এটা অনেকটা ঈশপের সেই ‘ওক গাছ আর নলখাগড়ার’ গল্পের মত” আবারো বলল লুইস। এইবার কথার মানে বুঝতে পারলো সে। তার পুরোনো বাড়ি বিক্রি করে গত তিন বছর ধরে নতুন বাড়িতে উঠেছে। 

ক্যামিল তার ঘরে পা রাখতেই দুদুশে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে চলে এলো। বাসায় দুদুশেই তার একমাত্র সঙ্গি। দুদুশে কালো ডোরাকাটা বাদামী রঙের ছোট বিড়াল। 

“মধ্যবয়স্ক বিপত্মীক এক লোক, সাথে একটা বিড়াল। ব্যাপারটা একটু গতানুগতিক হয়ে যাচ্ছে না, তুমি কী বলো? নাকি আমি একটু বেশিই ভাবছি এটা নিয়ে?” বলল ক্যামিল। 

“পুরোটাই নির্ভর করে বিড়ালটার উপর, তাই না?” বলেই হাসলো লুইস। 

“তোমার ধারণা বিড়ালটাও আর দশটা সাধারণ বিড়ালের মত না?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল 

ক্যামিলের বিড়ালের সাইজও বেশ ছোট, বয়সের তুলনায় একটু বেশিই ছোট। তার বিড়ালের এমন ছোট আকৃতি এখনো তার সহকর্মীদের কাছে অমীমাংসিত এক রহস্য। এমনিতে দুদুশকে ছোট দেখতে বেশ ভালই লাগে। সে যখনই বাসায় আসুক না কেন, দুদুশে ঠিকই চলে আসবে একটু আদর পাওয়ার জন্য। পিঠে একটু হাত বুলিয়ে দিলেই দুদুশে খুব খুশি হয়, আজও তাই করেছে সে। 

আজ সারাটা দিন তার উপর দিয়ে বেশ ধকল গেছে। প্রথমে মেয়েটার অপহরণ। এরপর লুইসের সাথে পুনরায় দেখা। লা গুয়েন যেন ইচ্ছে করে সব কিছু এমনভাবে সাজিয়েছে…. 

বাস্টার্ড! মনে মনে লা গুয়েনকে গালি দিলো ক্যামিল । 

অধ্যায় ৭ 

মাথা নিচু করে বাক্সে চড়ে বসলো অ্যালেক্স। একটু গাদাগাদিই করে আছে সেখানে। লোকটা আবারো ঢাকনা লাগিয়ে দিলো। এরপর স্ক্রু দিয়ে একেবারে বন্ধ করে দিলো বাক্সের মুখ। কাজ শেষ করে একটু দূরে দাঁড়িয়ে নিজের কাজের প্রশংসা করতে লাগলো। 

অ্যালেক্সের পা থেকে মাথা পর্যন্ত থেতলে গেছে। সারা শরীরে একটু পরপরই খিঁচুনি উঠছে। শুনতে কিছুটা হাস্যকর মনে হলেও, এখানেই সে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে যেন নিরাপদ আশ্রয়স্থল পেয়ে গেছে। লোকটা তার সাথে আর কী করতে পারে, গত কয়েক ঘণ্টা যাবত তাই ভাবছে। অপহরণের পর সে মারধর আর জোরজবরদস্তি ছাড়া আর কিছুই করেনি। আঘাতের রেশ কাটেনি, মাথা এখনো ঘুরছে। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে এখনো সে জীবিত, এই বাক্সের ভেতরে। লোকটা তাকে ধর্ষণ করেনি। হত্যা করেনি। ‘অন্তত এখনো না’ কেউ যেন মৃদু স্বরে বলল। কিন্তু অ্যালেক্স তা পাত্তা দিলো না। তার মূল কথা হলো যতটুকু সময় পেয়েছি, তা পেয়েছিই, আর সামনে যে সময় আসবে, তা আসবেই। প্রতিটি মুহূর্ত তার কাছে মূল্যবান। দীর্ঘশ্বাস নিলো সে। লোকটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। তার পায়ের বুট, ট্রাউজারের নিচের অংশ দেখা যাচ্ছে। ‘আমি তোর মরণ দেখতে চাই,’ বারবার একই কথা বলছিলো সে। তাকে হত্যা করতে চায়? তার মরণ দেখতে চায়? কীভাবে হত্যা করতে চায়? অ্যালেক্স এই নিয়ে আর ভাবে না। এখন সে ভাবে, কীভাবে হত্যা করবে? কখন করবে? 

মেয়েদের এতো ঘৃণা করার কারণ কী? পুরো জিনিসটা এমনভাবে সাজানোর পেছনে কি কারন থাকতে পারে? আর এমন নিষ্ঠুরভাবে মারার কারণই বা কী? পরিবেশ এখন বেশি ঠাণ্ডা না, কিন্তু এতো মার খাওয়ার পর ক্লান্ত শরীর আর তার সাথে যোগ হয়েছে ভয়, অন্ধকার সব মিলে ঠাণ্ডায় জমে গেল সে। একটু নড়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। ভেতরে নড়াচড়ার জায়গা খুব কম। হাঁটু ভাজ করে তার উপর মাথা দিয়ে অনেকটা বাংলা ‘দ’এর মত করে বসে আছে। মাথা হালকা উঁচু করে নড়ার চেষ্টা করতেই চিৎকার বেরিয়ে এল তার মুখ দিয়ে। কাঠের চোখা একটা টুকরা তার হাতে বিঁধে গিয়েছে। দাত দিয়ে সেই টুকরা বের করে আনলো। কাঠের বাক্স যে অদক্ষ হাতে তৈরী তার ছাপ স্পষ্ট, বিভিন্ন জায়গায় কাঠের চোখা টুকরা বেরিয়ে আছে। নিজেকে ঘোরানোর জন্য কী করতে পারে? সমস্ত ভর হাতের উপরে দিয়ে তারপর ঘুরবে? প্রথমে পা একটু নাড়ানোর চেষ্টা করলো। তার মেরুদন্ড বেয়ে ভয়ের এক শীতল স্রোত নেমে গেল। আবারো নিজেকে কাঠের টুকরায় আহত করার ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। ভীষণ অসহায় বোধ করলো সে। কিন্তু তাকে পারতেই হবে। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর আগের অবস্থান থেকে মাত্ৰ কয়েক সেন্টিমিটার সরতে পারলো। আতঙ্ক গ্রাস করে ফেললো তাকে। 

হুট করেই তার সামনে এসে দাঁড়ালো লোকটা। তাকে দেখেই ভয়ে কেঁপে উঠলো, মাথা ঠুকে গেল কাঠের বাক্সে। উপুড় হয়ে বাক্সের ভেতরে থাকা অ্যালেক্সকে দেখলো সে। তার মুখের হিংস্র হাসি যেন তার পাশবিকতারই প্রতিফলন। মিনমিন করে কিছু বলল সে। অ্যালেক্স কিছুই শুনতে পেলো না। তবে তার হাসি যেন বলছে, ‘এখন বুঝতে পারছিস মাগি, তোকে কেন ধরে এনেছি?”

“আপনি…” বলেই থেমে গেল অ্যালেক্স। আর কী বলবে খুঁজে পেলো না যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। 

এই দেখে আবারো সেই ক্যাবলা মার্কা হাসি দিলো সে। অ্যালেক্স মনে মনে ভাবলো লোকটা বদ্ধ উন্মাদ। 

“আপনি একটা পা… পাগল…” 

অ্যালেক্স আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না, লোকটা দূরে চলে গেল। সে হেঁটে চলে যাচ্ছে, এই দেখে ভয়ে আবারো কাঁপতে শুরু করলো। তাকে যখন আর দেখাই গেল না, আতঙ্ক ঘিরে ধরলো অ্যালেক্সকে। কী করছে সে? সারস পাখির মত গলাটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। কিছুই দেখতে পেলো না। কান পেতে শব্দ শোনার চেষ্টা করলো, কেননা এইরকম সুবিশাল ফাঁকা রুমে প্রতিধ্বনি বেশি হয়। আবারো নড়া শুরু করলো সে। বাক্সটা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে হালকা দুলে উঠলো। তার শরীর যথাসম্ভব ঘুরানোর পর, বাক্সের সাথে লাগানো একটা রশি দেখতে পেলো। শরীরটাকে একটু মুচড়িয়ে হাতটা মাথা আর কাঠের টুকরার মাঝে আনতেই স্টিলের শীতল স্পর্শ পেলো। 

হুট করেই বাক্সটা কেঁপে উঠলো, এর সাথে যুক্ত রশি টানটান হয়ে আছে। বাক্সটা হালকা দুলতে দুলতে উপরে উঠতে শুরু করলো। সাত-আট মিটার দূরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে আবারো দেখতে পেলো সে। লোকটা একটা রশি ধরে টানছে যা দুইটা পুলির সাথে যুক্ত। বাক্সটা এখনো দুলছে, যেন যে কোন সময় পড়ে যাবে। বাক্সটা মেঝে থেকে দেড় মিটার উপরে উঠলে সে থামলো। দেয়ালের কাছে রশি বেঁধে অ্যালেক্সের দিকে এগিয়ে আসলো। 

একই উচ্চতায়, মুখোমুখি হয়ে এক অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে তারা। মোবাইল ফোন বের করলো সে। কোন দিক থেকে ছবি তুললে ভাল হবে তাই দেখলো কিছুক্ষণ। একের পর এক ছবি তুললো বিভিন্ন দিক থেকে! এরপর যেগুলো ভাল লাগলো না, সেগুলো ডিলিট করে দিলো। ছবি তোলা শেষ হলে আবারো দেয়ালের দিকে এগিয়ে চললো। বাক্সটা এবার দুই মিটার উপরে উঠে থেমে গেল। 

রশি বাঁধার পর একবার বাক্সের দিকে তাকালো, নিজের কাজে বেশ সন্তুষ্ট মনে হলো তাকে। জ্যাকেটটা পড়ে একবার পকেট হাতড়ে দেখলো কিছু ফেলে গেছে কিনা। যাওয়ার আগে আরেকবার বাক্সের দিকে তাকালো, এমন ভাব করলো যেন বাসা থেকে কাজের জন্য বের হচ্ছে। 

লোকটা চলে যাওয়ার পর এক অদ্ভুত নিস্তব্দতার চাদরে ঢেকে গেল পুরো রুম।

অ্যালেক্স এখন একা। পুরোপুরি নগ্ন। ভয়ংকর ফাঁদে আটকা পড়েছে। এতোক্ষণে বুঝতে পারলো এটা কোন কাঠের বাক্স নয়। এটা তার জন্য বানানো বিশেষ খাঁচা। 

অধ্যায় ৮ 

“শালার বানচোত!” 

“মুখ সামলে কথা বলো। ভুলে যেয়ো না আমি তোমার ঊর্ধ্বতন অফিসার। আমার জায়গায় থাকলে তুমি কী করতে? আর তোমার ভাষা ঠিক করো, তোমার শব্দচয়ন দিনে দিনে আরো খারাপ হচ্ছে।” লা গুয়েন অনেক চেষ্টা করেছে ক্যামিলের ব্যবহার ঠিক করার জন্য। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। ইদানীং লা গুয়েন আগের মত তর্কে যায় না, বরং চুপ করে থাকে। আর এতে করে ক্যামিলও হালে পানি পায়, চুপ করে থাকে। ক্যামিল এখন তার বসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, দুজনেই নিশ্চুপ। কেউ কোন কথা বলছে না; যেন বিবাহিত পুরোনো এক দম্পতি, দুজনে ঝগড়া করে ক্লান্ত, কেউ এগুতে চাচ্ছে না। দুজনের বয়সই পঞ্চাশের কোঠা পার করেছে, দুজনেই একা বাস করে। ক্যামিলের স্ত্রী মারা গেছে বেশ আগে আর লা গুয়েন গত বছরে তার চতুর্থ স্ত্রীকে তালাক দিয়েছে। 

“আমি ভেবে অবাক হই যে কীভাবে তুমি একের পর এক বিয়ে করছো, সর্বশেষ বিয়ের সময় লা গুয়েনকে বলেছিলো ক্যামিল। 

“কী আর করবো বলো?” বলেই লা গুয়েন বুদ্ধিদীপ্ত হাসি ছুঁড়ে দিলো ক্যামিলের দিকে। “স্বভাব যায় না ম’লে। অবাক করার মত বিষয় হলো আমার সব বিয়েতে একমাত্র সাক্ষী-তুমি!!!” 

একে অপরের মনের ভাব বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারে তারা। এই ভেবে লা গুয়েনকে আর এক হাত নিলো না ক্যামিল। এই কেসে লা গুয়েনর সুস্পষ্ট প্রভাবের ব্যাপারটা এখন বুঝতে পারছে, কেননা সে চাইলেই অন্য কাউকে দায়িত্ব দিতে পারতো। কিন্তু লা গুয়েন প্রথম যখন ফোন করে এই কেসের দায়িত্ব তাকে দেয়, তখন সে ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। ক্যামিল ব্যাপারটা নিয়ে কিছুটা চিন্তিত। কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই। তাছাড়া সারারাত না ঘুমিয়ে এখন বেশ ক্লান্ত, শরীরে শক্তিও তেমন অবশিষ্ট নেই, তাই আর আগ বাড়িয়ে লাগতে গেল না তার সাথে। 

সকাল সাতটা বাজে, ঘটনাস্থলে অন্যান্য অফিসারদের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। রাতে প্রশান্তির ঘুম দিয়ে এখন তারা নতুন উদ্যমে কাজ করছে। ক্যামিল সেখানে পৌঁছুঁতেই লুইসও চলে এলো। আজকে বেশ পরিপাটি হয়ে এসেছে। কিন্তু সারারাত না ঘুমানোর ছাপ তার চেহারাতেও স্পষ্ট। 

বহু দিনের পরিচিত সহকর্মীদের মতো হাত মিলালো তারা। গত রাতের পর আর কোন কথা হয়নি তাদের মাঝে। চার বছর পর আবারো দেখা হয়েছে, অথচ এই নিয়ে তাদের মাঝে কোন খেদ নেই। এমন নয় যে ব্যাপারটা রহস্যময়, আদতে তারা বিব্রতবোধ করে। আর তাছাড়া একজনের জীবনের এমন ক্ষত নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে কে চায়? লুইস আর আইরিনের মাঝেও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো। ক্যামিলের ধারণা, আইরিনের মৃত্যুর জন্য লুইসও নিজেকে দোষী ভাবে। সবার সামনে প্রকাশ না করলেও ক্যামিলের মতই মনোবেদনায় ভুগে সে। এমন শোক যা কখনোই ভোলার মতো না। আদতে দুজনেই একই মনস্তাপে ভুগছে এবং একসময় তাদের মাঝে তৈরি হয়েছে এই সীমাহীন দূরত্ব। ব্যাপারটা সবাইকে নাড়া দিলেও, তাদেরকে একরকম ধ্বংস করে দিয়ে গেছে, একে অপরের সাথে কথা বলার ইচ্ছাটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু কেউই এগিয়ে আসেনি, এভাবে চলতে চলতে দেখাসাক্ষাৎও বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো তাদের। 

ফরেনসিক রিপোর্ট খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। ক্যামিল দ্রুতগতিতে পাতা উল্টিয়ে গেল। অপহরণে ব্যবহৃত ভ্যান খুবই সাধারণ, আর দশটা গাড়ির মতই। গাড়ির চাকার ছাপ থেকেও তেমন কিছু পাওয়া যায়নি, এমন চাকা কমপক্ষে আরো পঞ্চাশ লাখ গাড়িতে পাওয়া যাবে। আর ভিক্টিমের শেষ খাবার ছিলো; মিক্সড সালাদ, বিফ, গ্রিন বিনস, হোয়াইট ওয়াইন 

ক্যামিলের অফিস রুমে বসে আছে লুইস। দুজনেই দেয়ালে ঝুলানো প্যারিসের ম্যাপ মনোযোগ দিয়ে দেখছে। এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠলো } 

“হেই গুয়েন, একদম ঠিক সময়ে ফোন করেছো।” বলল ক্যামিল। 

“ওহ। তাই নাকি, শুভ সকাল। তারপর কী খবর তোমার?” লা গুয়েন জিজ্ঞেস করলো। 

“আমার পনেরো জন অফিসার দরকার।” 

“সম্ভব না।” 

“মহিলা অফিসার হলে ভালো হয়। দুই-তিন দিনের জন্য লাগবে। আশা 

করি এর মাঝে মেয়েটাকে খুঁজে পাবো। আর একটা গাড়ি লাগবে। না, দুইটা লাগবে।” 

“শোনো…” 

“আর হ্যা, আরম্যান্ডকেও লাগবে আমার।” 

“এটা আমি করতে পারবো। এখনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।” 

“অনেক ধন্যবাদ, এতো সাহায্য করার জন্য,” বলেই ফোন কেটে দিলো ক্যামিল। 

“তা কী মনে হয় তোমার? কতটুকু সাহায্য পাবে?” জিজ্ঞেস করলো লুইস। 

“যা চেয়েছি তার অর্ধেক তো পাবো,” বলেই হেসে উঠলো সে। 

পুনরায় ম্যাপের দিকে মনোযোগ দিলো ক্যামিল। হাত সম্পূর্ণ প্রসারিত করে শুধুমাত্র ছয় নং অ্যারোদিসেমেন্ট পর্যন্ত নাগাল পায়, কিন্তু নয় নং অ্যারোদিসেমেন্ট পর্যন্ত নাগাল পেতে চেয়ার লাগবে তার। আরেকটা উপায় হচ্ছে পয়েন্টার ব্যবহার করা, কিন্তু পয়েন্টার হাতে নিজেকে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের মত লাগে তার। এছাড়াও আরো বেশ কিছু সমাধান এসেছে তার মাথায়। ম্যাপটা দেয়ালের নিচের দিকে লাগানো, অফিসের মেঝেতে বিছানো, অথবা টুকরো টুকরো করে কেটে পাশাপাশি লাগানো। কিন্তু সহকর্মীদের অসুবিধার কথা চিন্তা করে, এর কোনটাই করা হয়নি। তার অফিসে ছোটখাটো অনেক জিনিসপত্র আছে। ছোট টুল, স্টেপ ল্যাডার এইসবের ক্ষেত্রে সে রীতিমত বিশেষজ্ঞ। অফিসের ফাইলপত্র উপর থেকে নামানোর জন্য ব্যবহার করে অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি স্টেপ ল্যাডার। আর ম্যাপ দেখার জন্য লাইব্রেরী স্টেপ-টুল, যা লকও করা যায়। এই মুহূর্তে গভীর মনোযোগে ম্যাপের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে। অপরাধস্থলের সাথে কোন প্রধান সড়কের সংযোগ আছে তা দেখছে। সে আদেশ দেয়ার সাথে সাথেই টিমের লোকজন কাজে নেমে পড়বে, কিন্তু সমস্যা হলো কতটুকু জায়গা জুড়ে খুঁজবে তা এখনো নির্ধারণ করতে পারেনি। এমনসময় নিচের দিকে তাকিয়ে লুইসকে জিজ্ঞেস করলো, “আমাকে দেখতে অপদার্থ জেনারেলের মত লাগছে, তাই না?” 

“তোমার ডিকশনারীতে এমন শব্দের সম্ভার তো ভালই আছে।” বিদ্রুপ করে বলল লুইস। 

“তবে যাই বলো, গত কয়েকদিনে কোন ভ্যান চুরি হওয়ার রিপোর্ট আসেনি। আর লোকটা যদি একমাস আগেই এমন কিছু করে থাকে তাহলে বলার কিছু নেই। কিন্তু নিজের ভ্যান দিয়ে অপহরণ করা তো অনেক বিপদজনক।” 

“হয়তোবা লোকটা বেশ ধূর্ত।” 

কথাটা শুনেই ক্যামিল আর লুইস ঘুরে গেল। আরম্যান্ড চলে এসেছে। 

“লোকটা যদি ধূর্তই হয়, তাহলে তার সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না। ব্যাপারটা তো তাহলে আরো জটিল হয়ে উঠবে।” বলল ক্যামিল। 

একে অপরের সাথে হাত মিলালো তারা। দশ বছরের কর্মজীবনের নয় বছরই ক্যামিলের অধীনে কাজ করেছে আরম্যান্ড। দেখতে অসম্ভব রকমের রোগা, আর প্রচুর কৃপণ। এমন হাড় কিপটেমি তার জীবনীশক্তি অনেকাংশে ক্ষয় করে দিয়েছে। সারাটা জীবন টাকার পেছনে ছুটেছে সে। ক্যামিলের ধারণা, আরম্যান্ড মৃত্যুকে ভয় পায়। লুইসও এই ব্যাপারে একমত, যার জ্ঞানের পরিধি অসীম। আর তাছাড়া সে এটাও বলেছে এই ব্যাপারটা সাইকোলজির দৃষ্টিতেও বেশ যুক্তিযুক্ত। এই কথা শুনে ক্যামিলও বেশ খুশি, কেননা এমন একটা বিষয়ে সে লুইসের সম্মতি পেয়েছে। আরম্যান্ড অক্লান্ত পরিশ্রম করতে পারে। কোন টেলিফোন ডাইরেক্টরি তার হাতে দিয়ে, একবছর পর ফিরে আসলে দেখা যাবে এর মাঝে সব নাম্বার সে চেক করে ফেলেছে। 

ক্যামিলের জন্য নিখাদ শ্রদ্ধা অনুভব করে সে। ক্যামিলের সাথে কাজ করার শুরুর দিকে যখন জানতে পারলো তার মা চিত্রশিল্পী, তখন থেকে এই শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গিয়েছে। এরপর থেকে ভিন্ন এক নেশায় ধরলো তাকে। ক্যামিলের মা সম্পর্কিত যাবতীয় পেপার কাটিং সংগ্রহ করলো। এক কথায় যা পেলো তাই সংগ্রহ করতে থাকলো। কিন্তু হুট করেই একদিন জানতে পারলো ক্যামিলের মার লাগামহীন ধূমপান ক্যামিলের এই ছোটখাট আকৃতির জন্য দায়ী, সে সময় কিছুটা দ্বিধায় ভুগলো সে। একজন মা কীভাবে এতোটা স্বার্থপর হতে পারে এই ভেবে সিদ্ধান্ত নিলো শুধু চিত্রশিল্পী পরিচয়টাকে সম্মান করবে। যখনই ক্যামিলের মা সম্পর্কিত কোন প্রসঙ্গ ওঠে, তাকে উল্লসিত দেখা যায়। 

“আসলে সে আমার বদলে তোমার মা হলেই ভাল হতো” আরম্যান্ডকে বলল ক্যামিল। । 

“ধুর, এইসব কী বলছেন।”

ক্যামিল যখন ক্লিনিকে ভর্তি, তখন তাকে দেখতে যেতো আরম্যান্ড। এমন নয় যে নিজের পকেটের পয়সা খচর করে যেতো, কেউ ওইদিকে গেলে বিনা পয়সার সেই গাড়িতে চড়ে বসতো। আর কখনোই ক্যামিলের জন্য কিছু নিয়ে যেতো না, বরং একেকবার এক কাহিনী সাজাতো। ক্যামিলের দুঃখ- দুর্দশা তাকেও ছুঁয়ে গিয়েছে, আর ক্যামিলের জন্য তার ভালোবাসায় কোন খাদ নেই। কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে তোমার সহকর্মীর সাথে বছরের পর বছর কাজ করছো, অথচ এক অপরকে তেমন জানাও হয় না। একটা দুর্ঘটনা, একটা মৃত্যু, শারীরিক অসুস্থতা, অথবা ভয়াবহ কোন বিপদে পড়লে দেখা যায়, সহকর্মীর সম্পর্কে জানা তথ্যগুলো কতটা তুচ্ছ। শুনতে কিছুটা অদ্ভুত লাগলেও, সে বেশ উদার। অবশ্য টাকা কিংবা টাকা খরচ হয় এমন কোন বিষয়ে উদারহস্ত না হলেও, তার মনটা ভাল। যদিওবা স্কোয়াডের অন্য কাউকে এই কথা বললে তারা হেসে কুটিকুটি হবে। 

*

ক্লিনিকে থাকাকালীন সময়ে প্রায়ই ক্যামিল তাকে কফি কিংবা পেপার আনার জন্য টাকা দিতো। ভাংতি টাকা সে নিজের কাছেই রেখে দিতো। আর যখন চলে যেতো ক্যামিল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতো, দেখা যেতো সে কোন লোকের সাথে আলাপ করছে, হয়তো লোকটা তাকে কাছাকাছি কোথাও নামিয়ে দেবে, যেখান থেকে বাকি পথ হেঁটেই যেতে পারবে। তবুও গাঁটের একটা পয়সা খরচ করবে না। 

চার বছর পর আবারো টিমের সদস্যদের ফিরে পাওয়ায় ক্যামিল কিছুটা আবেগতাড়িত। আগের সেই টিমের মাত্র একজন সদস্য অনুপস্থিত, ম্যালেভাল। তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিলো। কিছুদিন রিমান্ডেও ছিলো। এখন আর কোন খোঁজ নেই। তবে ক্যামিলের ধারণা লুইস আর আরম্যান্ড এখনো তার সাথে দেখা করে। 

“লুইস তুমি ঘটনাস্থলে চলে যাও। ওখানে গিয়ে আবারো চিরুনি অভিযান চালাও,” বলেই আরম্যান্ডের দিকে ঘুরে আরো বলল, “শোনো অপহরণকারী খুবই সাদামাটা একটা ভ্যান ব্যবহার করেছে, চাকাও আলাদা করার মত কিছু না। আর ভিক্টিমের শেষ খাবার থেকেও কিছু বের করা যায়নি। তুমি কাজে লেগে পড়ো।” 

আর মাত্র একটা দিন। এরপরেই মোরেল চলে আসবে। এই ভেবেই খুশি হয়ে গেল ক্যামিল। 

অধ্যায় ৯ 

প্রথমবারের মত লোকটা ফিরে এলে ভয়ে হৃৎপিণ্ড গলায় উঠে এসেছিলো 

অ্যালেক্সের। তার পদশব্দ শুনতে পারলেও, তাকে দেখার জো নেই। কেননা সে ঘুরতে পারছে না মোটেও। লোকটা চলে যাওয়ার পর প্রতিটি ঘণ্টা এইসব ভেবেই পার করেছে, কল্পনা করেছে সে এসে তাকে আবারো মারছে, ধর্ষণ করছে। আরো ভেবেছে সে এসে প্রথমেই বাক্সটা নামাচ্ছে, হাড়ে ধরে তাকে বের করছে, ইচ্ছামত থাপড়াচ্ছে, গালিগালাজ করছে, মারছে, ধর্ষণ করছে। তীব্র যন্ত্রণায় সে চিৎকার করছে, আর লোকটা বলছে, “আমি তোর মরণ দেখবো রে, মাগি।” 

যদিও এমন কিছুই এখনো তার সাথে হয়নি। লোকটা তাকে এমনভাবে স্পর্শই করেনি; কিছু একটার অপেক্ষায় আছে সে। তাকে এমনভাবে খাঁচায় ভরার পেছনে আছে আলাদা উদ্দেশ্য- দিনে দিনে যাতে অ্যালেক্স মানুষ থেকে পশুতে পরিণত হয়, মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে, আর তাকে প্রভু বলে মেনে নেয়। এ কারণেই এমন বেধড়ক মারধোর করে। এমনসব চিন্তা ছাড়াও আরো হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খায় তার মাথায়, কেননা মৃত্যু কোন উপভোগ্য কিছু নয়। কিন্তু মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা… 

সে কখন আসে, কখন যায়, অ্যালেক্স মনে মনে সময় ঠিক করে নেয়ার চেষ্টা করতো, কিন্তু এখন সব কিছুই ঝাপসা হয়ে গেছে। কেননা সকাল, বিকাল, রাত সবই এক লাগে তার কাছে, আলাদা কিছু মনে হয় না। 

প্রতিবার আসার পর সে খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, হাতদুটো থাকে পকেটে, আর চোখ থাকে তার দিকে। লেদারের জ্যাকেটটা খুলে মেঝেতে রাখে, কিছুক্ষণ পর খাঁচাটা চোখ বরাবর নামিয়ে আনে, আবারো কিছু ছবি তোলে। এরমাঝে একবারের জন্যেও টু শব্দ করে না। এরপর একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়, যেখানে কয়েকটা পুরোনো বোতল, প্লাস্টিকের ব্যাগ পড়ে আছে। ঠিক এর পাশেই অ্যালেক্সের কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, চোখের সামনে থাকলেও তার কিছুই করার নেই। এরপর কিছু সময় বসে থাকবে, আর এমনভাবে তাকিয়ে থাকবে যেন কোন কিছুর অপেক্ষায় আছে। 

তারপর হুট করেই সে উঠে দাঁড়ায়। কী কারণে এমন হয় অ্যালেক্স জানে না, তবে কিছু একটা তাকে উঠতে বাধ্য করে। আরেকবার বাক্সটার দিকে তাকিয়ে দ্রুতগতিতে সেখান থেকে চলে যায়। 

লোকটা একটা কথাও বলে না কখনো। অ্যালেক্স প্রায়ই নানা ধরণের প্রশ্ন করে, কিন্তু সে বরাবরের মতই নিশ্চুপ। তবে প্রশ্ন করার সময় আরেকটি বিষয়ও মাথায় রাখতে হয়, সে যেন রেগে না যায়। তবে শুধু একটা উত্তরই দেয় সে আর তা শুনতে শুনতে তার মুখস্থ হয়ে গেছে। ভয়ংকর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি তোর মরণ দেখবো।” 

পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে পড়েছে তার জন্য। দাঁড়ানো অসম্ভব, কেননা বাক্সটা যথেষ্ট উঁচু না। লম্বায় কম হওয়ার কারণে শুয়ে থাকাও সম্ভব না। আর সে যে বসে থাকবে, ওই সুযোগও নেই বাক্সের উচ্চতার কারণে। এমন অবস্থায় তাকে বাক্সের ভেতরে বলের মত কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকতে হয়। ক্রমেই অসহ্য ব্যথা তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। মাংস পেশীতে খিঁচুনি ধরে গেছে, অস্থিসন্ধির অবস্থাও খুব একটা সুবিধার নয়, সারাশরীর অবশ হয়ে হাত পা যেন জমে বরফ হয়ে গেছে, নাড়াতে পারছে না। আর এদিকে রক্ত সঞ্চালন কমে যাওয়ায় যোগ হয়েছে বাড়তি ব্যথা। এককথায় নারকীয় যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সে। তার মনে পড়ছে নার্সিং ট্রেনিং এর সময়কার কথা, তখন এইসব সমস্যা, তার কারণ আর প্রতিকারের কত শত ডায়াগ্রাম দেখেছে। নিজের সামনেই নিজের শরীরের এই শেষ হয়ে যাওয়া দেখছে যেন সে কোন রেডিওলজিস্ট। এই শরীরকে আর নিজের শরীর বলে মনে হয় না তার। নিজের মনটাও যেন দুই ভাগ হয়ে গিয়েছে। একভাগ থাকে এই শরীরে, আরেকাংশ থাকে অনেক দূরে কোথাও যার ঠিকানা সে নিজেও জানে না। এছাড়াও আরো নানা উদ্ভট চিন্তা আসে মাথায়। একসময় নিজেই উপলব্ধি করে এই অমানবিক অত্যাচার আর সীমাহীন কষ্ট তাকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছে। 

অনেক সময় ধরে কাঁদলো সে, কিন্তু একসময় খেয়াল করলো তার চোখে আর পানি অবশিষ্ট নেই। খুব কমই ঘুমায় সে, টানা বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারে না মাংস পেশীর খিঁচুনির কারণে। তার পা ধনুষ্টংকার রোগীর মত বেঁকে যাওয়ায় গত রাতেই সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলো। কোন উপায় না দেখে বাক্সের দেয়ালে নিজের পা বাড়ি মারতে থাকলো। একসময় তা থেমে গেলেও, সে জানে এই জ্বালা আবারো ফিরে আসবে। বাক্সটা এখন দুলছে তার লাথির কারণে, স্থিতিশীল হতে বেশ সময় লাগছে। আবারো মাংস পেশীর সেই খিঁচুনি ফিরে আসার অপেক্ষায় রইলো সে। নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে যতই ভাবে, ব্যথা যেন ততই বাড়ে। 

মাঝে মাঝে যখন সে ঘুমায়, তখন প্রায়ই স্বপ্নে দেখে সে জেলে বন্দী, তাকে জিন্দা কবর দেয়া হচ্ছে অথবা ডুবে মারা যাচ্ছে। আর যখন মাংস পেশীর খিঁচুনি থাকে না তখন এইসব দুঃস্বপ্ন, ভয় আর তীব্র ঠাণ্ডা তার ঘুম ভাঙ্গানোর কাজ নিষ্ঠার সাথে পালন করে। গত বিশ ত্রিশ ঘণ্টা ধরে একইভাবে থাকার কারণে মাংসপেশী যেন ছিঁড়ে বেরিয়ে যেতে চাচ্ছে। এর উপর আর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই তার। এখান থেকে বের হওয়ার জন্য সে নিজের জীবনটাও দিতে রাজি, শুধু একটা ঘণ্টার জন্য এখান থেকে মুক্তি চায়। 

লোকটা এর মাঝে একবার এসে বাক্সের উপরের দিকে আরেকটা রশি দিয়ে একটা ঝুড়ি ঝুলিয়ে দিয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ দোলার পর ঝুড়িটা থামে। ঝুড়িটা বেশ কাছে ঝুলানো থাকলেও, নিজের অবশিষ্ট সমস্ত শক্তি ব্যবহার করে ঝুড়িটা ধরে অ্যালেক্স। ঝুড়ির ভেতরে এক বোতল পানি আর কিছু শুকনো খাবার যা কুকুরকে খাওয়ানো হয়। ডগ ফুড দেয়ার কারণ ধরতে পারলো না সে। হুট করেই কাঁপতে লাগলো, কিন্তু এই কাঁপুনির কারণ কি ভয়, নাকি ঠাণ্ডা, নাকি ক্লান্তি, নিজেও তা জানে না। ডগ ফুড তার খিদে তো মেটায়ই না, বরং আরো তৃষ্ণার্ত করে তোলে। ক্ষুধায় একদম টিকতে না পারলেই এই খাবার স্পর্শ করে সে। আরেকটা গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রসাব সহ আরো যাবতীয় কাজ করতে হয় তার। শুরুর দিকে খুবই লজ্জা লাগতো, কিন্তু এছাড়া আর উপায়ও তো নেই। তাই এখন আর লজ্জা লাগে না, নিজের জীবনেরই যেখানে ঠিক নেই সেখানে লজ্জা দিয়ে আর কী হবে। 

আর কতদিন লাগবে এভাবে মারা যেতে? 

প্রথম প্রথম লোকটার কাছে নিজের জীবন ভিক্ষা চাইতো। কিন্তু তার কাছ থেকে কোন সারা পায়নি বরাবরের মত। এমন তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে একদিন মুখ ফস্কে বলেই ফেলে, “আমাকে মেরে ফেলো।” দিনে দিনে ক্ষুধা আরো বেড়ে যাচ্ছে। ক্ষুধার জ্বালায় ডগ ফুড চিবিয়ে ফেলে দেয়, তার সারা শরীরে বমি আর প্রসাবের বিকট গন্ধ। একে তো নড়তে পারছে না, এর সাথে ক্ষুধার জ্বালা, সব মিলিয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছে ও। নিজের মৃত্যু কামনা করলো। কিন্তু পরক্ষণেই আবার এর জন্য অনুতপ্ত বোধ করলো কেননা নিজের মৃত্যু তো এভাবে চায়নি সে। তার আরো অনেক কাজ বাকি আছে, কাজ শেষ না করে শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে চায় না। এখন অবশ্য এইসব ভেবে কোন লাভও নেই, কেননা লোকটা ভালমন্দ কিছুই বলে না। 

কিন্তু একদিন এর ব্যতিক্রম ঘটে। অ্যালেক্স সবসময়ের মত কাতর অবস্থায় পড়ে ছিলো। লোকটা ছবি তোলার জন্য নিচু হতেই অ্যালেক্স জিজ্ঞেস করলো, “আমার সাথেই কেন এমন করছেন?” সে মুখ তুলে এমনভাবে তাকালো যেন অ্যালেক্স ভিনগ্রহের কোন ভাষায় কথা বলছে। তাদের মাঝে মাত্র কয়েক সেন্টিমিটারের ব্যবধান। এরপরে যা ঘটলো তার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। 

লোকটা বলল, “কারণ তুই সে যাকে আমি খুঁজছি।” 

এই কথাগুলো বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত শোনালো তার কানে। কিছু সময়ের জন্য সবকিছু থেমে গেল। বিধাতা যেন কোন সুইচ টিপে সময়কে থামিয়ে দিয়েছেন। এই মুহূর্তে কোন ব্যথা, ভয় কিংবা খিঁচুনি কিছুই অনুভব করলো না। তাকে আবারো জিজ্ঞেস করলো,”আপনি কে?” 

কোন উত্তর না দিয়ে প্রচ্ছন্ন হাসি দিলো সে। যা আবারো তার মনে ভয় ধরালো। নিজের জ্যাকেটটা কাঁধে নিয়ে বের হয়ে গেল রুম থেকে। একবারের জন্যও পিছনে তাকালো না। অ্যালেক্স ভাবলো সে বেশি কথা বলে অভ্যস্ত না, বরং যা আশা করেছিলো তার চেয়ে বেশিই বলে ফেলেছে। 

যাওয়ার আগে সেই ঝুড়িতে পানির বোতল আর ডগ ফুড রেখে গেল। ডগ ফুড স্পর্শ না করে পানির বোতল নিয়ে রাখলো ভবিষ্যতের জন্য। লোকটার কথা নিয়ে ভাবার চেষ্টা করলো, কিন্তু সারা শরীরে এমন ব্যথা নিয়ে স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করাটাও অসম্ভব। 

টানা কয়েকদিনের বিরামহীন যন্ত্রণায় অ্যালেক্স অনেকটা কোমায় চলে গেল। কোন কিছুতেই মনস্থির করতে পারছিলো না। শরীরের মাংসগুলো যেন সব বিদ্রোহ করেছে তার বিরুদ্ধে, শুধু হাড়ের অস্তিত্ব টের পাচ্ছিলো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত খিঁচুনি শুরু হলো, নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলো না ও। অবশ্য এর আগে নিজের হাত পা সচল রাখার জন্য নিজে নিজেই ব্যায়াম করেছে। 

কিন্তু এখন নিজেই মনে করতে পারছে না, আসলেই ব্যায়াম করেছে নাকি স্বপ্নে দেখেছে। নিজের গোঙানিতে জেগে উঠলো। প্রথমে ভেবেছিলো অন্য কেউ গোঙাচ্ছে, কিন্তু পরে দেখলো তার ভিতর থেকেই আসছে এই শব্দ। নিজের কাছে খুব অচেনা মনে হলো এই শব্দ 

জেগে থাকলেও এই গোঙানির উপর তার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, এই ভেবেই সে অবাক হয়ে গেল। 

তবে এইটুকু বুঝতে পারলো তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *