অ্যালেক্স – ১

অধ্যায় ১ 

খুশিতে আত্মহারা অ্যালেক্স। এক ঘন্টার বেশি সময় যাবত উইগ নিয়েই ব্যস্ত। এটা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছে সে। কখনো মাথায় দিচ্ছে, কখনো বা খুলে ফেলছে। সারা বিকাল এভাবেই পার করতে পারবে। 

স্ট্রাসবুর্গের রাস্তার ধারের এই দোকানের সামনে তিন-চার বছর আগে হোঁচট খেয়েছিলো সে। কৌতুহল দমন করতে না পেরে ভেতরে প্রবেশ করলো। নিজের আকস্মিক পরিবর্তনে কিছুটা বিস্মিত। এখন তার মাথায় লালচুলো এক উইগ, যা এই দোকান থেকেই কেনা। 

সে এতোটাই সুন্দর যে তাকে এখন যে কোন কিছুতেই মানিয়ে যায়। কিন্তু ছোট থেকেই যে এমন ছিল তা নয়। তার পরিবর্তন শুরু হয় মূলত কৈশোরে পা রাখার পর থেকে। এর আগে দেখতে সুন্দর তো ছিলোই না বরং হাড় জিরজিরে ছিলো। কিন্তু হুট করেই তার এই পরিবর্তন যেন সমুদ্রের উন্মত্ত এক জলোচ্ছ্বাসের মত, দ্রুতগতিতে চলা কম্পিউটার অ্যানিমেশন প্রোগ্রাম মর্ফ-এর মতো এক ছবি থেকে অন্য ছবিতে বদলে যাওয়ার মতোই ছিল সেটা। কয়েকমাসের মধ্যেই অসাধারন হয়ে ওঠে সে। নিজেকে নিয়ে কখনোই এতোটা আশাবাদি ছিল না। 

অ্যালেক্স কখনো ভাবতেই পারেনি লাল উইগে তাকে এতোটা মানিয়ে যাবে। এ যেন তার ভিন্ন এক রূপের উন্মোচন। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। প্রথমবার উইগ পরার মুহূর্তটা বর্ণনাতীত, তার মনে হচ্ছিল যেন পুরো জীবনটাই বদলে গেছে। 

যদিও এই উইগ পরবর্তিতে খুব বেশি আর পরতো না। বাসায় যেয়েই তা ছুঁড়ে ফেলেছিলো তার ড্রেসারের নিচের ড্রয়ারে। প্রায়ই উইগটি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতো। যদিওবা পুরনো জরাজীর্ণ উইগ পরে থাকাটা অসহ্যকর কিন্তু এর মাঝেই অ্যালেক্স আশার সেই আলো দেখতে পেতো যা তাকে বেঁচে থাকতে অনুপ্রেরণা জোগায়। তাই বারবার ওই দোকানে ফিরে যেতো আর ভালমানের উইগগুলো নেড়েচেড়ে দেখতো যা ছিল তার মত সাধারণ কোন নার্সের সামর্থ্যের বাইরে। 

শুরুতে ব্যাপারটা এতো সহজ ছিল না। এটা এখনো যে সহজ তা-ও নয়। এর জন্য সাহসের প্রয়োজন। অ্যালেক্সের মত লাজুক মেয়ের জন্য তা সঞ্চয় করতেই অর্ধেক দিন চলে যায়। ঠিকমতো মেকাপ করা, জামার সাথে মিলিয়ে পরার জন্য জুতো, হ্যান্ডব্যাগ খোঁজা (আলমারি তন্ন তন্ন করে খোঁজা যা মোটামুটি মানিয়ে যায় তার জামার সাথে)। কেননা প্রতিটি জামার সাথে মিলিয়ে পরার জন্য নতুন নতুন জিনিস কেনার সামর্থ্য তার নেই। এরপর আসে সেই মুহূর্ত যখন সে বাইরে গিয়ে সম্পূর্ন ভিন্ন এক মানুষে পরিণত হয়। পুরোপুরি না-হলেও প্রায় অনেকটাই। এভাবেই সময় চলে যায় খুব সাদামাটাভাবে, জীবনের কাছে যখন খুব বেশি চাওয়া পাওয়া থাকে না তোমার। 

অ্যালেক্স সেই ধরণের উইগ পছন্দ করে যা একটি নির্দিষ্ট অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। কিছু উইগ যেমন বলে : আমি জানি তুমি কি ভাবছো। অথবা আমি শুধু সুন্দরিই না, ম্যাথ জিনিয়াসও বটে। আজকে সে যেটা পরে আছে তা বলছে, আমাকে ফেসবুক-এ পাবে না। 

“আরবার শক’ নামের উইগটি হাতে নিতেই দোকানের জানালা দিয়ে তাকিয়ে লোকটাকে দেখলো সে। লোতটার ভাবখানা এমন যেন কারো জন্য অপেক্ষা করছে। গত দু-ঘণ্টায় এই নিয়ে তৃতীয়বার তাকে দেখলো অ্যালেক্স। লোকটা তাকে অনুসরণ করছে। প্রথমেই তার মনে হলো-আমার পেছনেই কেন লেগেছে? একজন পুরুষ কোন নারীকে অনুসরণ করতেই পারে, কিন্তু অবশ্যই তাকে নয়। এমন নয় যে, তার দিকে কোন পুরুষ তাকায় না। বাসে, রাস্তাঘাটে তার দিকেও সব বয়সের পুরুষ তাকায়। ত্রিশ বছর বয়সিদের এই এক সুবিধা। যদিও প্রত্যেকবার অবাক হয় সে, কেননা পথেঘাটে তার চেয়েও অনেক সুন্দরি মেয়ে দেখা যায়। ছোটবেলা থেকেই অ্যালেক্স অনিরাপদ, সহেন্দবাতিকগ্রস্ত। কৈশোরে সে ভয়াবহ রকম তোতলাতো। এখনও নার্ভাস হয়ে গেলে এমনটা করে। 

লোকটাকে সে চেনে না। আগেও কখনো দেখেনি। এমন ষণ্ডামার্কা কাউকে দেখলে ভোলার কথা নয়। সে কিছুটা অবাক হলো, কেননা পঞ্চাশোর্ধ এক লোক ত্রিশ বছর বয়সি এক মেয়েকে অনুসরণ করছে। এমন নয় যে তার বয়স খুব বেশি, তবুও সে কিছুটা বিস্মিত। 

অ্যালেক্স উইগ দেখতে দেখতে দোকানের অন্যপাশে চলে গেল। সেখান থেকে রাস্তাটা পরিষ্কার দেখা যায়। লোকটার কাপড়চোপড় দেখে অনায়াসেই বলা যায়, সে সাবেক অ্যাথলেট। লোকটার সাথে প্রথম কোথায় দেখা হয়েছিল এই চিন্তায় ডুবে গেল অ্যালেক্স। কিছুক্ষণ পর তার মনে পড়লো মেট্রো’তে ক্ষণিক সময়ের জন্য তার সাথে লোকটার চোখাচোখি হয়েছিল। অবশ্য এই ক্ষণিক সময়ের মাঝে সে অ্যালেক্সের দিকে তাকিয়ে বিজয়ির ভঙ্গিতে হেসেছিল। কিন্তু তার চোখের অদ্ভুত বিষণ্নতা, তার পাতলা ঠোঁট (যার অস্তিত্ব প্রায় বিলীন) অ্যালেক্সকে অস্বস্তিতে ফেলে দিলো। ওর গভীর সন্দেহ হলো এমন পাতলা ঠোঁটের মানুষ সবসময় কিছু না কিছু লুকোয়, কিছু অব্যক্ত সত্য, কিছু ভয়াবহ অপরাধ। মানুষের চোখ দেখে অ্যালেক্স তাদের যাচাই করে। কেননা চোখ কখনো মিথ্যা বলে না। দুর্ভাগ্যবশত তার চোখ পরখ করার সময় অ্যালেক্স পায়নি। অবশ্য একজন অচেনা লোকের জন্য দেরি করার কোন ইচ্ছেও তার ছিল না। 

ইচ্ছেকৃতভাবে উলটো দিকে ঘুরলো অ্যালেক্স। তার ব্যাগ থেকে আইপডটা খুঁজে বের করে নো বডি’স চাইল্ড গানটা ছাড়লো। ভাবলো, এই লোককেই কি গতকাল তার বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছিলো, অথবা দু-দিন আগে? কিন্তু স্মৃতি অস্পষ্ট হওয়ায় নিশ্চিত হতে পারলো না। আরেকবার তাকে দেখতে পারলে নিশ্চিত হতে পারতো। কিন্তু তাকে আর কোন সুযোগ দিতে চায় না। তবে সে এতোটুকু নিশ্চিত, মেট্রো’তে দেখা হওয়ার ঠিক দু- ঘণ্টা পর আবারো স্ট্রাসবুর্গের সেই দোকানের পাশে দেখা হয় লোকটার সাথে। হুট করেই সিদ্ধান্ত নিলো আবার ওই দোকানে যাবে। দোকানে গিয়ে লালচে বাদামি রঙের ঝালরযুক্ত একটা উইগ দেখার সময়ই একটু দূরে আবার দেখলো সেই লোকটাকে। তাকে দেখেই লোকটা হতভম্ব হয়ে পাশের এক দোকানের জানালার দিকে তাকানোর ভান করলো। কিন্তু এই ভান করার কোন মানেই হয় না। 

অ্যালেক্স উইগটা রেখে দিয়ে লক্ষ্য করলো তার হাত কাঁপছে। লোকটা তাকে পছন্দ করে, তাই হয়তো একটা সুযোগের অপেক্ষায় তার পিছে পিছে ঘুরছে। লোকটা তাকে মোটেও রাস্তায় আক্রমণ করবে না-এমনটাই ভাবলো সে। মাথা দুলিয়ে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলো, রাস্তার দিকে তাকিয়ে 

দেখলো লোকটি নেই। এবার নিশ্চিত হওয়ার জন্য সামনে ঝুঁকে চারপাশে তাকালো কিন্তু কোথাও নেই সেই রহস্যময় লোক। পুরোপুরি স্বস্তি পাচ্ছে না। 

“আমিই বোকার মত সাতপাঁচ ভাবছিলাম,” আস্তে আস্তে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করে নিজেকে বলল সে। দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকালো। লোকটার অনুপস্থিতি আরো উদ্বিগ্ন করে তুললো তাকে। 

অ্যালেক্স ঘড়ি দেখে আকাশের দিকে তাকালো। দিনের আলো আছে আরো প্রায় এক ঘণ্টা। এখনই বাসায় যাওয়ার তাড়া নেই তার। দোকান থেকে কিছু খাবার কিনতে হবে। সে মনে করার চেষ্টা করছে ফ্রিজে কী কী রাখা আছে। বাজার-সদাই করার ব্যাপারে বরাবরই উদাসীন সে। সকল শক্তি আর মনোযোগ নিজের কাজ, ইচ্ছে (অ্যালেক্স অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারে ভুগছে) আর তার কাপড়চোপড় এবং জুতোর পেছনে (যদিও অ্যালেক্স তা স্বীকার করতে চায় না) ব্যয় করে। এর সাথে হ্যান্ডব্যাগ আর উইগও থাকে। ভালোবাসা খুবই স্পর্শকাতর বিষয়; তার ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা একটু অন্যরকমভাবে ঘটবে এই আশাই করতো সে। আশায় বুক বেঁধে একসময় হাল ছেড়ে দিলো। এখন এই ব্যাপার নিয়ে যত কম ভাবা যায় ততই ভালো। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, দুঃখ ভোলানোর জন্য দিনরাত ঘরে বসে থেকে খেয়ে খেয়ে তার ওজন বাড়াবে। যদিও সে একা তবে কখনো একাকিত্ব অনুভব করে না। তাকে গুরুত্বপুর্ণ প্রচুর কাজ করতে হয়, আর কাজের মাঝেই ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করে। একাকি থাকা সত্ত্বেও একটা স্বাভাবিক জীবন যাপন করার চেষ্টা চালায়। ছোট ছোট আনন্দের মুহূর্তগুলো পুরোপুরি উপভোগ করে। নিজের ইচ্ছেগুলো নিজেই পূরণ করার চেষ্টা করে সে। যেমন আজ ডিনার করবে ভঁজিরাড রোডের মন্ট টোনেরে’তে। 

একটু তাড়াতাড়িই সেখানে পৌছে গেল অ্যালেক্স। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার এখানে এসেছে। প্রথম এসেছিলো এক সপ্তাহ আগে। লালচুলো এক মেয়ের একা একা খাবার খাওয়ার ব্যাপারটাই তার প্রতি সবাইকে মনোযোগ কাড়তে বাধ্য করেছে। তাকে দেখেই ওয়েটারদের মাঝে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেল কে আগে সার্ভ করবে। ওয়েটারদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো সে। আগের বারের জায়গাটাই চাইলো, বারান্দাকে পিছনে রেখে, রুমের দিকে মুখ করে, হাফ বোতল অ্যালসেশান আইস ওয়াইন অর্ডার করলো। অ্যালেক্স খেতে পছন্দ করে, এতোটাই পছন্দ করে যে তাকে সতর্ক থাকতে হয়। তার ওজন প্রায়ই ওঠানামা করে, তবে এর উপর নিয়ন্ত্রণ করা শিখেছে সে। কখনো তার ওজন হয়তো পনেরো কেজি বেড়ে গেল, তখন তাকে চেনাই যায় না। আবার দুই মাস পরেই দেখা যায় আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। 

অ্যালেক্স তার বইটি বের করে একটা চামচ চাইলো। খাওয়ার সময়ও যাতে বই খুলে রেখে পড়া যায়। হালকা বাদামী চুলের এক ছেলে তার সামনে বসে আছে। গত সপ্তাহেও ছেলেটি ছিল। ছেলেটা তার বন্ধুদের সাথে ডিনার করছে। যদিও এখন মাত্র দু-জনই আছে তবে তাদের কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে বাকিরা খুব শীঘ্রই চলে আসবে। সে যখনই এখানে এসেছে ছেলেটি তখন থেকেই তাকে খেয়াল করছে। যদিও দেখেও না দেখার ভান করছে অ্যালেক্স। ছেলেটি সারারাত তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। এমনকি যখন তার বন্ধুরা মেয়েদের নিয়ে নানান রসালো কথাবার্তায় আড্ডা জমিয়ে তুলবে তখনো তার দিকেই তাকিয়ে থাকবে ছেলেটি। ছেলেটি দেখতে মন্দ না, বেশ সুদর্শন, বয়স চল্লিশ-পয়তাল্লিশের কাছাকাছি। যদিওবা তার চেহারা দেখেই বোঝা যায় একটু বেশিই পান করে। এই মুখটাই অ্যালেক্সের ভেতরে একটা আলোড়ন তুললো। 

কফি শেষ করে বের হয়ে গেল অ্যালেক্স। বের হয়ে যাওয়ার সময় ছেলেটার দিকে একবার আবেদনময়ীর দৃষ্টিতে তাকালো। খুব অল্প সময়ের জন্য দৃষ্টি বিনিমিয় আর এই কাজটা সে ভালমতোই পারে। ছেলেটির চোখে তাকে পাওয়ার তীব্র কামনা দেখেই এক অদ্ভুত বিষণ্নতায় ছেয়ে গেল তার মন। নিজের অনুভূতি কখনোই প্রকাশ পেতে দেয় না সে। তার জীবন যেন কয়েকটা স্থির ছবির সমন্বয়, প্রোজেক্টরে আটকে যাওয়া ফিল্মের কোন স্কুল যেখান থেকে চাইলেও পেছনে ফিরে যেতে পারবে না, নতুন করে জীবনটা সাজানোরও কোন সুযোগ নেই। কে জানে পরবর্তীতে হয়তো সেই ছেলে আবার তার জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে। অ্যালেক্স ভালমতোই জানে এরপরে কী হবে। সবসময়ই একই ঘটনা ঘটে। পুরুষদের সাথে তার ক্ষণস্থায়ী এমন সম্পর্ক কখনোই ভালোবাসায় রূপ নেয় না, বরং এটা তার ফিল্মের সেই অংশ যা তার সাথে বারবারই ঘটে। 

বাইরে এখন পুরোপুরি অন্ধকার, পরিবেশও কিছুটা উষ্ণ। কেবলই একটা বাস ব্রেক কষে থামলো। অ্যালেক্সকে দ্রুতগতিতে হাঁটতে দেখে বাস ড্রাইভার অপেক্ষা করতে লাগলো। যখনই বাসে উঠতে যাবে তখনই সিদ্ধান্ত বদলে কিছুটা পথ হেঁটে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো অ্যালেক্স। হাত নেড়ে বাস ড্রাইভারকে চলে যেতে বললেও লোকটা বাসের দরজা খুলে দিলো। 

“এরপর আর কোন বাস নেই। এটাই শেষ ট্রিপ,” বলল ড্রাইভার। 

অ্যালেক্স তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় জানালো। এইটুকু পথ হেঁটেই যাবে। গত তিনমাস যাবত ভ্যানভেস রেলস্টেশনের কাছাকাছি থাকে সে। ঘনঘনই নিজের বাসা পরিবর্তন করে। এর আগে লিগানকোর্ট স্টেশনের কাছে থাকতো। মানুষ যদিও ঘনঘন বাসা বদলাতে অপছন্দ করে তবুও তার কাছে খারাপ লাগে না। বরং সে ইতিবাচকভাবেই নেয় ব্যাপারটা। উইগ বদলের সাথে যেমন তার জীবন বদলে যায়, আর এই বাসা বদলানো যেন একই সুতোয় গাঁথা। এভাবেই একদিন নিজের জীবন সত্যিই বদলে ফেলবে। 

অ্যালেক্স একটু সামনে এগুতেই ফুটপাতের পাশে একটা সাদা ভ্যান এসে থামলো। ভ্যানটাকে পাশ কাটাতে পাশের বিল্ডিং আর ভ্যানের মাঝখান দিয়ে যেতে হবে তাকে। হঠাৎ করেই কোনো লোকের উপস্থিতি অনুভব করলো সে। কিছু বুঝে উঠার আগেই তার কাঁধে তীব্র এক ঘুসি পড়লো। কিছুক্ষণের জন্য নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো তার। ভারসাম্য হারিয়ে সামনের দিকে পড়ে গেল। ভয়াবহভাবে ভ্যানের গায়ে গিয়ে কপাল ঠুকলো তার। হাতে থাকা সবকিছু পড়ে গেল। কোন কিছু আঁকড়ে ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো। কিছুই পেলো না। লোকটা তার চুলের মুঠি ধরার চেষ্টা করতেই মাথায় থাকা উইগটি খুলে এলো। বিশ্রি ভাষায় তাকে গালি দিলো লোকটা যার কিছুই সে বুঝতে পারলো না। এবার তার আসল চুল ধরে হ্যাঁচকা টান দিলো আর পেটে বসিয়ে দিলো বিষম এক ঘুসি যা খেপা ষাঁড়কেও অজ্ঞান করে ফেলবে। চিৎকারের কোন সুযোগ পেলো না সে বরং বমি করে দিলো। লোকটা যে যথেষ্ট শক্তিশালী তা ইতিমধ্যেই বুঝে ফেলেছে। কেননা লোকটা তাকে কাগজের টুকরোর মত ছুঁড়ে ফেলছে। কোমরে হাত পেঁচিয়ে তাকে তুলে ধরলো সে। মুখে গুজে দিলো টিস্যু পেপার যাতে কোন শব্দ করতে না পারে। লোকটাকে এক নজর দেখেই চিনে ফেললো সে। এই সেই লোক; দোকানের সামনে, রাস্তায় যে তাকে ছায়ার মত অনুসরণ করেছে। হাত পা নাড়ানোর চেষ্টা করেও কোনো লাভ হলো না। লোকটা তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। তাকে ভ্যানের ভেতরে ছুঁড়ে মারলো। হামাগুড়ি দিয়ে ভ্যানের ভেতরে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজলো অ্যালেক্স। লোকটা পিছে পিছে উঠে, জোরপূর্বক তার মুখে প্রচণ্ড জোরে ঘুসি মারতে শুরু করলো। লোকটার চোখে মুখের তীব্র আক্রোশ আর ঘুসির জোর দেখেই অ্যালেক্স বুঝতে পারলো সে আসলেই তাকে মেরে ফেলতে চায়। খুলির পেছনের দিকটা বেশ কয়েকবার ঠুকে গেল মেঝেতে। তখনো তার মনে একটা কথাই বাজছে, আমি মরতে চাই না, এভাবে মরতে চাই না, এখনি মরতে চাই না। গুটিশুটি মেরে পড়ে আছে সে, মুখভর্তি বমি। তখন অনুভব করলো তার হাত পিছমোড়া করে বাঁধা, পায়ের গোড়ালিও। 

আমি এখনি মরতে চাই না, মনে মনে বলল অ্যালেক্স। 

ভ্যানের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ পেলো, সেই সাথে ভ্যানের চাকার কর্কশ আর্তনাদেরও। 

আমি এখনি মরতে চাই না, ভাবনাটা আবারো খেলে গেল তার মনে। 

এখনো বুঝতে পারছে না তার সাথে কী হতে হচ্ছে। এমন কিছু যে ঘটবে তা কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি। সে কাঁদছে আর ভাবছে-আমার সাথে কেন এমনটা হচ্ছে? আমার সাথেই কেন? 

আমি এখনি মরতে চাই না। 

অধ্যায় ২ 

ডিভিশন্যাঁর লা গুয়েন তার জন্য অন্য কোন অপশনই রাখলো না। 

“তোমার দ্বিধাবোধের ধার ধারি না আমি, ক্যামিল, এদিকে আমার বারোটা বাজছে। আর এখন অন্য কেউ নেই যে, তাকে পাঠাবো। আমি এক্ষুণি গাড়ি পাঠাচ্ছি…তুমি অবশ্যই যাচ্ছো।” কিছুক্ষণ পর আবারো বলল, “শোনো গোদের উপর বিষফোঁড়া হওয়া বন্ধ করো।” 

এই বলে ফোন রেখে দিলো। এভাবেই কথা বলে সে। একটু আবেগতাড়িত লোক। ক্যামিল তাকে ভালোভাবেই চেনে। তার ব্যবহারে কিছুই মনে করে না। সে জানে, কীভাবে তাকে সামলাতে হয়। 

কিন্তু এবারের ঘটনা আলাদা। এবারের কেস হলো অপহরণের। ক্যামিল এই ব্যাপারে কিছুই করতে চায় না। অনেক আগেই তার অবস্থান পরিস্কার করেছে। সে অল্প কিছু কেসে হাত দিতে চায় না তার মধ্যে অপহরণ অন্যতম। আইরিন মারা যাওয়ার পর থেকে তো আরো নয়। তার আট মাসের অন্তসত্ত্বা স্ত্রী রাস্তায়ই লুটিতে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়; সেখান থেকেই অপহৃত হয় সে। এরপর আর কখনোই তাকে দেখা যায়নি। এই ঘটনা বিধ্বস্ত করে দেয় ক্যামিলকে। তার দুর্দশার কথা বর্ণনাতীত, মানসিক ভারসাম্য হারায় সে। হ্যালুসিনেশন হয় তার। মানসিক হাসপাতাল থেকে তাকে কনভাল্যাসেন্ট হোমে নিয়ে যাওয়া হলে কেউই আশা করেনি আবার বেঁচে ফিরে আসবে সে। সহকর্মীরা কেউ ভাবেনি তাকে আবার পুরোনো কর্মস্থলে দেখতে পাবে। কিন্তু সে ফিরে আসে। সবাই এটা দেখে অবাক হয় সে একদম আগের মতই আছে শুধু তার বয়সটা আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। ফিরে আসার পর ছোটখাট কেস নিতো; এই যেমন সহকর্মীদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, প্রতিবেশীদের মাঝে হত্যাকাণ্ড। সেই ধরনের কেস যেখানে মৃতদেহ সামনে নয় বরং পেছনে থাকে। অপহরণের কেস তো ভুলেও না। সে চায় মৃতদেহগুলো যেন তাকে তাড়া করে না বেড়ায়। 

“থামো এবার। আর কতো? এভাবে তুমি জীবনকে এড়িয়ে চলতে পারো না। কোন ভবিষ্যৎ নেই এতে,” বলল লা গুয়েন। 

“কিন্তু…জীবনটা তো এমনই,” ক্যামিল বলল। 

তাদের মধ্যকার সম্পর্ক বিশ বছরের, তারা একে অপরকে বেশ পছন্দ করে। দু-জন যেন হরিহর আত্মা। ক্ষমতার অংশটুকু বাদ দিলে ক্যামিলাই লা গুয়েন আর রাস্তায় ঘোরাঘুরির অংশটুকু বাদ দিলে লা গুয়েনই ক্যামিল। তাদের মধ্যে মূল পার্থক্য তাদের পদের মাঝে আর বায়ান্ন পাউণ্ডের। এছাড়াও আরো রয়েছে এগারো ইঞ্চির পার্থক্য। শুনতে কিছুটা অসম্ভব মনে হলেও এটাই সত্যি। তারা যখন পাশাপাশি দাঁড়ায় মনে হয় কার্টুনের দুই চরিত্র উঠে এসেছে। খুব অল্প বয়সেই ক্যামিলের বৃদ্ধি থেমে যায়। পৃথিবীকে সে তেরো বছর বয়সির দৃষ্টিতে দেখে। এই গুণটা পেয়েছে মা মঁদ ভেরহোভেনের কাছ থেকে। তার মা পেশায় একজন চিত্রশিল্পী। দেশে বিদেশের বিভিন্ন জাদুঘরে তার আঁকা ছবি রয়েছে। একজন ইন্সপায়ার্ড আর্টিস্ট হওয়ার সাথে সাথে একজন চেইন স্মোকারও ছিল সে। ধোয়া ভর্তি রুম ছাড়া তাকে কল্পনাই করা যেতো না। যতক্ষণ বাসায় থাকতো সাদা ধোঁয়া তাকে আচ্ছন্ন করে রাখতো। দুটি স্বত্রন্ত্র বৈশিষ্টের জন্য মায়ের কাছে ঋণী সে। আঁকাআঁকির এক অসাধারণ ক্ষমতা পেয়েছে মায়ের আর্টিস্ট সত্তা থেকে। একইসাথে লাগামহীন ধূমপানের কারণে শিকার হয়েছে ফিটাল হাইপোট্রপির যার কারণে উচ্চতা ঠেকে গেছে চার ফুট এগারো ইঞ্চিতে। 

নিজের থেকে খাটো মানুষ খুব কমই পেয়েছে ক্যামিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাকেই ঘাড় উঁচু করে কথা বলতে হয়। এটা তার জীবনে অপূর্ণতার চেয়েও বেশি কিছু। বিশে যা তার জন্য চূড়ান্ত অপমানের কারণ, ত্রিশে তা অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। আদতে এটাই তার ভাগ্য। 

আইরিন যখন পাশে ছিল তখন উচ্চতা ছিল তার শক্তির জায়গা। আইরিন কখনো তাকে এই ব্যাপারে হীনমন্যতায় ভুগতে দেয়নি বরং নানাভাবে সাহস জুগিয়েছে, প্রেরণা দিয়েছে। আইরিনকে ছাড়া তার জীবন যেন শব্দহীন এক কবিতা। 

অপরদিকে লা গুয়েন প্রকাণ্ড সাইজের। তার আসল ওজন কেউ জানে না। কেউ কেউ বলে তার ওজন ১২০ কেজি, আবার কারো ধারণা তা কমপক্ষে ১৩০। কিছু লোক তো এর চেয়েও বেশি বলে বেড়ায়। ধেড়ে ইঁদুরের মত গাল তার, হাতির মত বিশাল দেহ। কিন্তু তার চোখে বুদ্ধির ঝিলিক সুস্পষ্ট। পুরুষেরা তা স্বীকার করতে না চাইলেও, মহিলারা ঠিকই মেনে নেয়। 

লা গুয়েন এর বদমেজাজি স্বভাবের সাথে ক্যামিল বেশ ভালোভাবেই পরিচিত, কিন্তু তার নাটকে অভিনয় মোটেও ভাল লাগে ক্যামিলের। যেহেতু তারা উভয়কে বহু দিন ধরে চিনে তাই ক্যামিল আবারো তাকে ফোন করলো। 

“শোনো, আপাতত আমি এই কেস নিচ্ছি। কিন্তু যখনই তোমার ওই বালের অফিসার ফেরত আসবে, তাকে এর ভার দিয়ে আমি বিদায়। কারণ…’ এই বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। নিজেকে শান্ত করে আবার বলল, “আমি এই কেস নিচ্ছি না!” 

ক্যামিল ভেরহোভেন সচরাচর চিৎকার করে না। হতে পারে সে খাটো, টাক, হাড় জিরজিরে কিন্তু দায়িত্বের ব্যাপারে একচুলও ছাড় দেয় না। নিজের কাজের ব্যাপারে খুবই সচেতন। এই কথা লা গুয়েনও বেশ ভালমতো জানে। তাই তাকে নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করে না সে। তার একরোখা স্বভাবের কারণে সহকর্মীরা তাকে নিয়ে নানা ধরণের বিদ্বেষপূর্ণ কথাবার্তা ছড়ায়। 

“ফাক!” 

এই ছিল তার কপালে। এমন নয় যে মেক্সিকো সিটির মত এখানে অহরহ অপহরণের ঘটনা ঘটে। কিন্তু আজকেই কেন, অন্য কোন দিন ঘটতে পারতো যখন সে অন্য কোন কেসে ব্যস্ত, অথবা ছুটিতে, অথবা অন্যকোথাও। রাগ সামলাতে না পেরে টেবিলে ঘুসি মারলো ক্যামিল। খুব জোরেও না কেননা সে কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন লোক। আর তা ছাড়া মাত্রাতিরিক্ত কোনো কিছুই তার পছন্দ না। 

সময় খুব অল্প। তাই দ্রুত নিজের কোট আর হ্যাট নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলো ক্যামিল। এখন খুব দৃঢ় পদক্ষেপে হাঁটে সে। কিন্তু একসময় খুব দ্রুত হাঁটতো। তার স্ত্রী বলতো “তুমি তো পাখির মতো উড়ে যাচ্ছো। সবসময় ভয়ে থাকি এই বুঝি উড়ে চলে যাবে।” স্ত্রী মারা গেছে প্রায় চার বছর আগে। 

সামনে এসে একটা গাড়ি থামলো। ক্যামিল তাতে উঠে বসলো। “তোমার নামটা যেন কী?” 

“আলেকজাণ্ড্রা… বস।” 

কথাটা বলেই জিভে কামড় দিলো ড্রাইভার। কেন না সে জানে “বস” ডাকটা মোটেও পছন্দ করে না ক্যামিল। তার ভাষ্যমতে, এটা অনেকটা টিভি সিরিয়ালে দেখানো পুলিশদের মতো লাগে। সে এমনিতেই খুবই শান্তিপ্রিয় মানুষ। সব সময়ই একটু অন্যরকম ছিল কিন্তু বয়স আর নিজের স্ত্রী হারানোর শোক তাকে আরো সংবেদনশীল এবং বিরক্তিকর করে তুলেছে। এমনিতে সে কিছুটা বদরাগী স্বভাবের। তার স্ত্রী জিজ্ঞেস করতো “ডার্লিং, তুমি সবসময় এমন মুখ গোমরা করে থাকো কেন?” প্রথম দেখাতে কেউই তাকে পছন্দ করে না বরং বিরক্তই হয়। এর অন্যতম কারণ সে খুব একটা হাসিখুশি না। নিজেকেই খুব একটা পছন্দ নয় তার। 

পুনরায় কাজে যোগদান করার পরেই সে ইন্টার্নদের দায়িত্ব নেয়। তাদের ভাল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। নিজের সাথে ঘটা দূর্ঘটনা তার ভেতরে তীব্র দাগ কাটে। তাই সে একটা বিশ্বস্ত দল গঠনের কাজে নেমেছে। 

আলেকজান্ড্রার দিকে তাকালো সে। কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা তার চেয়ে দুই ফুটেরও বেশি লম্বা। ক্যামিলের অর্ডারের অপেক্ষা না করে গাড়ি স্টার্ট দিলো সে। 

আলেক্সান্ড্রা পাগলের মত গাড়ি চালানো শুরু করলো। গাড়ি চালানো তার নেশা। জি.পি.এস সিস্টেমও তার সাথে পাল্লা দিয়ে পেরে উঠছিলো না। সে কতটা ভাল ড্রাইভার তা বোঝানোর জন্য আরো গতিতে চালাতে লাগলো। ক্যামিলের পা বিশ সেন্টিমিটার উঁচুতে উঠে যাওয়ার সাথে সাথেই ডান হাত দিয়ে সিট বেল্ট আঁকড়ে ধরলো। পনেরো মিনিটেরও কম সময়ে তারা অপরাধ স্থলে পৌঁছে গেল। সকাল নয়টা পঞ্চাশ বাজে। প্যারিসবাসী এখনো শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। শহরটা এমনই, এখানে অপহরণের ঘটনা খুব কম ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীর মতে একজন নারী অপহরণের শিকার হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী ঘটনার আকস্মিকতায় শকে চলে গিয়েছে আর বলছে, “আমার চোখের সামনে মহিলাকে তুলে নিয়ে গিয়েছে।” এমন ঘটনা তো আর সচরাচর ঘটে না। 

“আমাকে এখানেই নামিয়ে দাও,” ক্যামিল বলল। 

গাড়ি থেকে নেমে নিজের হ্যাটটা ঠিক করলো ক্যামিল। ড্রাইভার তাকে ঘটনাস্থল থেকে প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। বাকি পথটুকু হেঁটেই যাবে। হাতে যখন সময় থাকে তখন কিছুটা দূর থেকেই পর্যবেক্ষণ করতে ভালোবাসে সে। প্রথমবারের দেখাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ, তাই দৃষ্টি যতটা প্রসারিত করা যায় ততোই ভালো। কেননা একবার ঘটনাস্থলে গেলে নানা ধরণের তথ্য, নানা ধরণের অনুমান এইসবের মাঝে তার চিন্তাধারাকে প্রথমেই আবদ্ধ করতে চায় না। ঘটনাস্থল থেকে দূরে নামার এই তার অফিসিয়াল কারণ। আদতে মানুষজনের ভিড় অপছন্দ তার। 

পুলিশের গাড়ির পাশ দিয়ে এগুতে লাগলো সে। গাড়ির লাইটগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। কেউ যেন হাতুড়ি পেটা করছে তার হৃৎপিণ্ড। পুরো ব্যাপারটা মোটেও ভাল লাগছে না তার। গত দশটা বছর ধরে সব ছেড়ে অন্য কোথাও পালানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু নিয়তি তাকে এখানেই বেঁধে ফেলেছে। হাঁটতে হাঁটতে পৌছে গেল সে। 

চার বছর আগের ঘটনা কমবেশি এমনই ছিলো, অনেকটা এমনই ছিলো তার বাড়ির আশপাশটা। আইরিন সেখানে ছিল না। কিছুদিন পরেই তাদের ঘর আলো করে এক ছেলে সন্তান আসার কথা ছিল। আইরিনের থাকার কথা ছিল ম্যাটার্নিটি ইউনিটে। ওইরাতে এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আইরিনকে খোঁজেনি সে। সারারাত পাগলের মত খুঁজে বেড়িয়েছে তার স্ত্রীকে। কিন্তু পাওয়া যায়নি। যখন পাওয়া গেল তখন তার স্ত্রী মৃত। 

এমনই এক মুহূর্তে তার জীবনের ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন শুরু হয়েছিলো। তার হৃৎপিণ্ড আরো দ্রুতগতিতে ছুটলো, কান গরম হয়ে উঠল। তার ভেতরের ঘুমন্ত অপরাধবোধ আবার জেগে উঠলো। ভিতর থেকে একজন বলে উঠলো, পালাও এখান থেকে!।” আরেক কণ্ঠ বলল, “না। এখানেই থাকো আর পরিস্থিতি মোকাবেলা করো।” সবকিছু দূরে ঠেলে বেষ্টনী সরিয়ে অপরাধস্থলে প্রবেশ করলো ক্যামিল। তাকে দেখে হাত নাড়লো একটু দূরে থাকা ডিউটি অফিসার। কেউ তাকে ব্যক্তিগত ভাবে না চিনলেও তার চেহারা সবাই চিনে এমন নয় যে সে কোন জীবন্ত কিংবদন্তী। উচ্চতার কারণেই সবাই তাকে আলাদা করে মনে রাখে। আর তার অতীত…… 

“ওহ। তুমি।” 

“আপনি বোধহয় হতাশ আমাকে দেখে,” বিক্ষুব্ধ লুইসের চোখেমুখে উদ্বেগের ছাপ। 

“না-না, মোটেও না।” 

হেসে ফেললো ক্যামিল। লুইসকে রাগানোর ব্যাপারে সে বেশ পটু। লুইস ম্যারিয়ানি দীর্ঘ সময় ধরে তার সহকারী। লুইসকে এতোটাই ভাল বুঝে ক্যামিল যেন তার নিজের হাতে গড়া কেউ। 

আইরিন মারা যাওয়ার পর যখন সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে হাসপাতালে ভর্তি, তখন প্রায়ই তাকে দেখতে যেতো লুইস। ক্যামিল খুব বেশি কথাবার্তা বলতো না। সারাক্ষন স্কেচিং করতো, যা শুরুর দিকে তার শখ থাকলেও একসময় প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায়। সারাঘর জুড়ে তার আঁকা ছবি, স্কেচ এইসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো। এরই মাঝে জায়গা করে নিয়ে বসতো লুইস। একজন তাকিয়ে থাকতো গাছের দিকে আরেকজন তার পায়ের দিকে। দুজনেই নীরব থাকতো। এই নীরবতার মাঝেই তারা ভাবের আদান প্রদান চালিয়ে যেতো। কেউই খুব একটা স্বাছন্দ্য বোধ করতো না এমন আলাপচারিতায়। একদিন কোন পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই ক্যামিল বলে উঠলো সে একা থাকতেই পছন্দ করে। তার কষ্টের ভাগ সে লুইসকে দিতে চায় না। “এজকন দুর্দশাগ্রস্ত পুলিশ মোটেও কোন আনন্দদায়ক সঙ্গি নয়” বলল ক্যামিল। আলাদা হওয়াটা তাদের দুজনের জন্যই বেশ কষ্টদায়ক ছিলো। কিন্তু সময় ঠিকই তার আপন নিয়মে চলেছে আর তাদের সম্পর্কের মাঝে তুলে দিয়েছে শূন্যতার দেয়াল। 

এখন তাদের দেখা সাক্ষাৎ খুব কমই হয়। হয়তো একজন আরেকজনের কোন মিটিং অথবা ব্রিফিং এ যাচ্ছে এইটুকুই। লুইসের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। একশ বছর বয়সে মারা গেলেও তাকে এমনি দেখাবে, সে যেন চিরনবীন। সমসময় ফিটফাট থাকতে পছন্দ করে সে। একবার ক্যামিল তাকে বলেছিলো, “আমি যদি বিয়ের পোশাক পরেও তোমার পাশে দাঁড়াই তা-ও আমাকে ভবঘুরের মতই লাগবে।” আদতে লুইস বেশ ধনী। তার ভাগ্য যেন লা গুয়েনের ওজনের মতই সুপ্রসন্ন। তার কত টাকা আছে তা কেউ জানে না। শুধু জানে তা অনেক বেশি আর দিনে দিনে আরো বাড়ছে। এখন তার যে পরিমাণ সম্পদ আছে তা দিয়ে ভবিষ্যতের চার-পাঁচ প্রজন্ম বসে খেতে পারবে। তবুও সে হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। এমন অনেক ডিগ্রি আছে তার যা কোন কাজেও লাগে না। কিন্তু তার জ্ঞানের পরিধি এতোটাই বিশাল যে, ক্যামিলও হার মানে। সে যে গভীর জলের মাছ তা সবাই একবাক্যে স্বীকার করে। 

হাসলো সে। এভাবে ক্যামিলের আগমন কিছুটা অদ্ভুত ঠেকলো তার কাছে। 

“ঘটনা ওখানে ঘটেছে।” বলে একটু দূরে পুলিশ টেপ দিতে ঘেরা একটা জায়গা দেখালো। 

ক্যামিল তাকে অনুসরণ করার সাথে সাথে তার বয়স অনুমান করার চেষ্টা করলো। 

“তোমার বয়স এখন কতো, লুইস?” 

এই প্রশ্ন শুনে লুইস ঘুরলো। 

“চৌত্রিশ। কেন?” 

“না। এমনি জানতে ইচ্ছে করলো তাই।” 

জায়গাটা দেখেই ক্যামিল বুঝতে পারলো বোর্ডেলে জাদুঘর এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। আর ওই জাদুঘরের কথা মনে পড়তেই তার চোখে ভেসে উঠলো ‘হারকিউলিস দ্য আর্চার’-এর মুখখানি। দানবদের পরাজিত করে তার বিজয়োল্লাস। ক্যামিল কখনো ভাস্কর্য বানায়নি। অনেকদিন যাবত আঁকাআঁকিও বন্ধ। তাই বলে কখনো স্কেচিং ছাড়েনি। এটা যেন তার জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। 

“তুমি কি কখনো বোর্ডেলে জাদুঘরে ‘হারকিউলিস দ্য আর্চার’ দেখেছো?”

“হ্যা। অবশ্যই,” বলল লুইস, দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি নিশ্চিত এটা অন্য জাদুঘরে নয়?” 

“তুমি এখনো সেই ফাজিলই আছো,” বলেই হাসলো ক্যামিল। 

আইরিনের মৃত্যুর পর তাদের খুব কমই একসাথে দেখা গেছে। অপরাধস্থলে একইসাথে কাজ করেছে অনেক আগে। ক্যামিল তাই নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো। 

“আপাতত মোরেলের জায়গায় আমি কাজ করবো। লা গুয়েন আর কাউকে পায়নি তার জায়গা পুরণের জন্য। তাই সাময়িক সময়ের জন্য আমাকে এই কেসের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।” 

শ্রাগ করলো লুইস যেন সে বুঝেছে ব্যাপারটা। কিন্তু কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেন কারো শূন্যস্থান পূরণ করতে এসেছেন ব্যাপারটা অকল্পনীয়। 

“লা গুয়েনকে কল করো। আমি এক্ষুণি ফরেনসিকদেরকে চাই। যত দেরি হবে আলামত পাওয়ার সম্ভাবনা তত কমবে। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে,” বলল ক্যামিল। 

লুইস তার সাথে একমত। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করলো সে। যে কোন ক্রাইম-সিন দু-ভাবে দেখা যায়-অপরাধির দৃষ্টিকোণ থেকে কিংবা ভিক্টিমের দৃষ্টিকোণ থেকে। আমাদের এই অপহরণকারি হয়তো এখন দূরে, কিন্তু ভিক্টিম আশেপাশেই থাকতে পারে, হয়তো বাসার সামনে থেকেই অপহরণের শিকার হয়েছে সে। কিন্তু আইরিনের ক্ষেত্রে এমন কিছুই হয়নি। 

“ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মাত্র একজন,” বলল লুইস, নিজের ফোনটা অফ করে রাখলো সে। “ফরেনসিক টিমের সদস্যরা পথেই আছে, তারা যে কোন সময় এখানে চলে আসবে।” 

ফরেনসিক টিম চলেও এসেছে ইতিমধ্যে। লুইস তাদেরকে বেষ্টনি সরিয়ে ভেতরে আসার রাস্তা দেখালো। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে ভ্যান থেকে নেমে এগুতে লাগলো চারজন লোক। 

“কোথায় সে?” বলল ক্যামিল। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখানে মোটেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না। এমন সময় তার ফোনটা বেজে উঠলো তার উর্ধতন কর্মকর্তার কল এসেছে। 

“ফিফটিন অ্যারোডিসেমেন্ট যতক্ষণে আমাদের জানায় ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। রাস্তা ব্লক করা সম্ভব ছিল না।” উর্ধতন কর্মকর্তার সাথে এমন চাঁচাছোলা,উদ্ধত সুরে কথা বলার সাহস সবার হয় না। লুইস নিরাপদ দূরত্বে সরে দাড়ালো। ক্যামিলের হতাশার কারণ সে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। ছোট কোন বাচ্চা হলে এখনি হুলস্থুল পড়ে যেতো। কিন্তু ভিক্টিম যেহেতু প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা, তাই নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরকেই করতে হবে। 

“আপনি যা চাইছেন তা সম্ভব নয় স্যার,” বলল ক্যামিল। ক্যামিল খুব নিচুস্বরে এবং ধীরে ধীরে কথা বলতে শুরু করলো। যারা ক্যামিলকে চেনে তারা এর মর্মার্থ বুঝতে পারবে। 

“ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করুন, স্যার, আমি এখন আপনার সাথে কথা বলছি আর…” বলেই উপরে তাকালো সে “আর শত শত কৌতূহলী লোকজন এখনি উঁকিঝুঁকি মারা শুরু করেছে। জায়গাটার সুরক্ষার জন্য এখানে নিয়োজিত থাকা লোকজন আরো বাড়াতে হবে। আর আপনি অবশ্যই জানেন এই খবর কীভাবে গোপন রাখা যায় সংবাদ মাধ্যম থেকে।” 

একা একাই হাসলো লুইস। এ যেন ক্ল্যাসিক ভেরহোভেন। অপরিবর্তনীয় ক্যামিলকে দেখে লুইসের মন আনন্দে ভরে উঠলো। বয়স চার বছর বাড়লেও এখনো যেন সেই আগের ভেরহোভেনই আছে। যদিও তার জুনিয়ররা এখনো তাকে দেখে ভয় পায়। 

“অবশ্যই স্যার।” 

গলার স্বরেই বোঝা যাচ্ছে যে প্রতিজ্ঞা সে কেবল করলো তা রাখার কোন ইচ্ছাই তার নেই। ফোন রাখলো সে। কিন্তু দীর্ঘ এই আলাপচারিতা তার মন- মেজাজে কোন প্রভাবই ফেললো না। 

“তোমার পার্টনার বালের মোরেল কই? এখানে নেই কেন? কই সে?” 

লুইস কিছুটা বিস্মিত। অবশ্য ক্যামিলের ব্যাপারটাও সে বুঝে। তাকে এমন একটা কেস দেয়া হয়েছে যার ব্যাপারে তার অতীত অভিজ্ঞতা খুব তিক্ত। 

“সে এখন লায়ন্সে। ইউরোপিয়ান সম্মেলনে যোগ দিয়েছে। পরশু ফিরে আসবে।” এই বলে তারা প্রত্যক্ষদর্শীর দিকে হাঁটতে লাগলো। 

“ফাকিং ক্রাইস্ট,” বলল ক্যামিল। 

লুইস চুপ করে থাকলো। ক্যামিল থেমে গেল। 

“আমি দুঃখিত লুইস।” 

লুইস কিছু বলতে চাইলো। কিন্তু কোন ভাষা খুঁজে পেলো না। আর বলেই কী লাভ। তাই চুপ করে থাকলো। ক্যামিল ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “আমরা কি আবার আগের মতো হতে…” 

লুইস কপালের সামনে এসে থাকা চুলগুলো ডান হাত দিয়ে সরিয়ে নিলো। সে যেন এর মাধ্যমেই ক্যামিলের কথায় সম্মতি জানালো। যেন বলতে চাইলো, “অবশ্যই। কেন নয়।” 

*

লোকটার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। সে তার কুকুর নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছিলো, বর্তমানে যা মনিবের পায়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ক্যামিল আর কুকুরের মাঝে ক্ষণিকের দৃষ্টি বিনিময় হলো, উভয়ই তাদের ঘৃণা প্রকাশ করলো। কুকুরটি গরগর করতে করতে তার মালিকের কাছে ছুটে গেল আর তার পায়ের কাছে গিয়ে ঘোরাঘুরি করতে থাকলো। কিন্তু লোকটা ক্যামিলকে দেখে বিস্মিত। এতো খাটো লোকও যে পুলিশ অফিসার হতে পারে তা সে কখনোই ভাবেনি। 

“কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেন,” বলল ক্যামিল। “ওয়ারেন্ট কার্ড দেখতে চান নাকি আমার মুখের কথায় হবে?” 

লুইস মুচকি হাসলো। সে জানে এরপর কী হবে। এখন প্ৰত্যক্ষদৰ্শী বলবে, 

“না না। ঠিক আছে। আমি শুধু… 

“শুধু কী?” ক্যামিল বাঁধা দিয়ে বলবে। 

প্রত্যক্ষদর্শী এরপর আরো ভীত হয়ে বলবে,

“আমি আসলে ভাবিনি এমন কোন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে।” 

ঠিক এই মুহূর্তে দুই ধরণের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা আছে। হয় প্রত্যক্ষদর্শী যতক্ষণ না মাফ চাইবে ততোক্ষণ তার উপর চাপ বাড়াতেই থাকবে। মাঝে মাঝে ক্যামিল খুব নিষ্ঠুর হয়ে যায়। অথবা কিছুই করবে না। এখন সে দ্বিতীয় পথেই চললো। কেননা কেসটা খুব সিরিয়াস। 

তাহলে ঘটনা এই দাঁড়ালো যে প্রত্যক্ষদর্শী তার কুকুর নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছিলো এবং চোখের সামনে মহিলাটিকে অপহৃত হতে দেখেছে। 

“ঠিক নয়টার দিকেই। আপনি নিশ্চিত তো?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।

অন্যান্য সব প্রত্যক্ষদর্শীর মতো এই লোকও নিজের উপর পূর্ণ আস্থাশীল এবং আসল কথা বাদ দিয়ে নিজের সাফাই গায়। 

“অবশ্যই নিশ্চিত। কেননা বাড়ি ফিরে আমি ‘নো লিমিট’ অনুষ্ঠানে কার ক্র্যাশ দেখি। তাই সবসময় এর আগেই কুকুরকে নিয়ে বের হই।” 

অপরাধীর শারীরিক বর্ণনা জানতে চাওয়া হলে সে বলে, 

“আমি শুধু পাশ থেকে দেখেছি। তবে লোকটি বেশ বড়সড়।”

প্রত্যক্ষদর্শীর ধারণা তার তথ্যগুলো খুব সাহায্য করছে। কিন্তু এদিকে ক্যামিল ক্লান্ত হয়ে পড়লো। এই দেখে লুইস প্রশ্ন করার দায়িত্ব নিলো। লোকটি দেখতে কেমন ছিলো? তার চুল? বয়স? 

“আসলে তেমন কিছুই বলতে পারবো না। আমি খেয়াল করি নাই।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু যে গাড়িতে নিয়ে গেছে সেইটা তো দেখেছেন নাকি?” বলল লুইস 

“হ্যা হ্যা। একটা সাদা কালারের ভ্যান। দোকানদাররা যেগুলো ব্যবহার করে।” 

“কী ধরণের দোকানদার?” ক্যামিল জিজ্ঞেস করলো।

“তা আমি জানি না। শুধু জানি একজন ব্যবসায়ী…”

“আপনি কীভাবে বুঝলেন লোকটি ব্যবসায়ীই ছিলো?” 

ক্যামিল তাকে ধরার চেষ্টা করছে। কথার মারপ্যাঁচে আসল কথা বের করে আনার প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে। 

“দেখুন ব্যবসায়ীরা সবাই সাদা ভ্যান ব্যবহার করে। তাই নয় কি?” 

“হ্যা তা করে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ভ্যানের গায়ে তাদের কোম্পানীর নাম, ঠিকানা আর ফোন নাম্বার লেখা থাকে। ফ্রি তে বিজ্ঞাপন করে। তা আপনার এই ব্যবসায়ীর ভ্যানে কী লেখা ছিলো?” 

“এই ব্যাপারটাই তো আমাকে অবাক করেছে। ভ্যানের গায়ে কিছুই লেখা ছিল না। একদম সাদা ছিলো।” 

ক্যামিল তার নোটবুক বের করলো। 

“আচ্ছা তাহলে ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে যে একজন অপরিচিত মহিলা একজন অপরিচিত ব্যবসায়ীর দ্বারা অপহৃত হয়েছে। যে গাড়িতে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সে গাড়িও চেনার কোন উপায় নেই। আমি কি কোন কিছু বাদ দিলাম?” ক্যামিল বলল। 

কুকুরের মালিক আতঙ্কিত হয়ে পড়লো। তার ঠোঁট কাপছে। সে লুইসের দিকে তাকালো। তার দৃষ্টি যেন আকুতি জানাচ্ছে, “ভাই আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করো, প্লিজ।” 

ক্যামিল নোটবুক বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়ালো। প্রশ্ন করার ভার লুইস নিয়ে নিলো। প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য খুব একটা কাজের না, তবুও এর মাঝে থেকেই কিছু বের করতে হবে। ক্যামিল চুপ করে তাদের কথাবার্তা শুনলো। 

“গাড়িটা কোন কোম্পানীর?” 

“মনে হয় ফোর্ডের। তবে আমি নিশ্চিত না। গাড়ি সম্পর্কে আমার জানাশোনা খুব কম।” 

“ভিক্টিম একজন মহিলাই তো?” 

“হ্যা অবশ্যই।” 

কিন্তু অপরাধীর ব্যাপারে তারা আঁধারেই রইলো। 

“সে খুব চিৎকার করছিল। তখনি লোকটি তার পেটে ঘুসি মারে প্রচণ্ড জোরে। লোকটি থামছিলো না। ঠিক তখনি আমি চিৎকার করি, লোকটিকে ঘাবড়ে দেয়ার জন্য।” 

প্রতিটি তথ্য যেন ছুরির মত বিধছে ক্যামিলের বুকে। প্রতিটি শব্দ যেন তাকে ইঙ্গিত করে বলা। ঠিক এমনি ঘটেছিলো আইরিনের ক্ষেত্রে। তার স্ত্রীকে যখন তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তখন একজন দোকানদার দেখেছিলো। কিন্তু বিস্তারিত কিছুই বলতে পারেনি এখনকার প্রত্যক্ষদর্শীর মতো। 

“আপনি কোথায় দাঁড়িয়ে ছিলেন?” 

“ঐতো ওখানে।” 

লোকটি যেদিকে ইশারা করেছে লুইস তা দেখার চেষ্টা করলো। 

“দেখাও আমাকে।” 

লুইস চোখ বন্ধ করলো। সে জানে এখন ক্যামিল কী ভাবছে। লোকটি তাদেরকে সেই জায়গায় নিয়ে গেল। 

“এইতো এখানেই হবে,” বলেই পিছনে তাকালো সে। কিন্তু ক্যামিল চায় শতভাগ নিশ্চয়তা। 

“এখানেই? আশাপাশে না তো?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।

“না। না। এখানেই।” কণ্ঠে আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়া তার। 

“লোকটি তাকে লাথিও মারছিলো।” আবারো বলল সে। 

“আচ্ছা। এইবার আমি সব বুঝতে পারছি। আপনি তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কত দূর হবে? চল্লিশ মিটারের মতো?” বলল ক্যামিল। 

ক্যামিলের অনুমানে লোকটিকে বেশ খুশিই মনে হলো। 

“আপনার চোখের সামনে একটা মহিলাকে অত্যাচার করা হলো, তাকে অপহরণ করা হলো আর আপনি একজন পুরুষ হয়ে কাপুরুষরের মত চিৎকার করলেন!!!” 

ক্যামিল একটু অন্যরকম অনুভব করলো। তার এই অনুভূতি ব্যাখ্যা করার জন্য কোন উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পেলো না। আইরিনের জন্য আবারো তার মনটা হুহু করে কেঁদে উঠলো। তদন্তের কাজ এখন ঠিক পথেই আছে। প্রত্যেকটি ধাপ সে ঠিকমতো অনুসরণ করেছে। কিন্তু কোন ফলাফল নেই। ঘুরে একবার শূন্য রাস্তার দিকে তাকালো। তার মনে হলো একঘণ্টা আগেও চিত্র এমন ছিল না। একজন নিরীহ মানুষকে বেদম প্রহার করা হয়েছে এখানে। তারপর সাদা ভ্যানে করে সেই মানুষটাকে অপহরণ করা হয়েছে। এখন হয়তো সে অপরাধীর হাতে বন্দী। তাকে কোথাও বন্দী করে রাখা হয়েছে। 

ক্যামিলের মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। সে একহাত দিয়ে গাড়িতে ভর দিলো আর আরেকহাত দিয়ে টাইয়ের নট ঢিলে করলো। এমন সময় লুইস ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলো, “ঠিক আছো তো?” 

শ্রাগ করলো ক্যামিল আর তিন মিটার দূরে থাকা ফরেনসিকদেরকে জিজ্ঞেস করলো, “কী অবস্থা? কী কী পেলে?” 

গলা পরিস্কার করে তাদের দিকে গেল সে। রাস্তার মাঝে কোন অপরাধ হলে প্রধান সমস্যা হলো আপনাকে সব সূত্রই সংগ্রহ করতে হবে। এরপর এর মাঝ থেকে কেসের সাথে সম্পর্কযুক্ত গুলো আলাদা করে নিতে হবে। 

একজন মাথা তুলে দাঁড়ালো তাদের মাঝ থেকে আর বলল, “কিছু আধপোড়া সিগারেটের টুকরো, একটা কয়েন…” ব্রিফকেসে পড়ে থাকা এভিডেন্স ব্যাগের দিকে ইঙ্গিত করে আরেকজন বলল, “একটা টিকেট, আর যদি আরেকটু বিস্তারিত জানতে চান তাহলে ব্যবহার করা ক্লিনেক্স টিস্যু, বলপয়েন্ট কলমের পাস্টিকের ক্যাপও এর সাথে যোগ করে নিতে পারেন।” ক্যামিল টিকেট রাখা এভিডেন্স ব্যাগ একটু উঁচুতে তুলে ধরে ভালমতো দেখলো। 

“আর হ্যা ভিক্টিম বেশ ভালরকমেরই মার খেয়েছে,” বলেই চললো লোকটি। 

রাস্তা থেকে বমির নমুনা স্টেরাইল স্পুন দ্বারা সংগ্রহ করছে তারই এক সহকর্মী। 

ক্যামিল ঘটনাস্থলে উপস্থিত অফিসারদের দেখতে লাগলো। আদতে সে তাদের মাথা গুনছে। সে দেখলো লা গুয়েন পাঁচজনকে পাঠিয়েছে। 

লুইস জানে এরপর কী করতে হবে। মোট তিনটা দলে ভাগ হয়ে যাবে তারা। তদন্তের ব্যাপারে তাদেরকে প্রাথমিক ধারণা দিতে হবে। এরপর একটা দল আশেপাশে ঘিরে ফেলবে আর নজর রাখবে। লুইস তার সাথে একজনকে নিয়ে বাড়ি বাড়ি যেয়ে লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। 

*

রাত এগারোটার একটু আগে লুইস অনেকটা জাদুঘরের মত একটা বাড়ি খুঁজে বের করলো যে বাড়িতে প্রহরী আছে। প্যারিসে আজকাল এমন দৃশ্য বিরল। লুইসের সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ মহিলা প্রহরী তাদেরকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিলো। ক্যামিলের দিকে তাকিয়ে তার বুকটা ব্যথায় টনটন করে উঠলো। ক্যামিলের এই ত্রুটি তাকেও স্পর্শ করে গেল। সে হাত দিয়ে তার মুখ ঢেকে বলতে থাকলো-মাই গড, মাই গড। সে ক্যামিলের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো যেন ক্যামিলের গায়ে কোন দগদগে ক্ষত আর সেই ব্যথা সে অনুভব করছে। 

“তোমার বসের জন্য একটা চেয়ার আনবো নাকি?” নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করলো প্রহরী। 

“না। ঠিক আছে, লাগবে না। আমরা এমনিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ম্যাডাম” বলল লুইস। 

লুইস উজ্জ্বল হাসি ছুঁড়ে দিলো তার দিকে। এই হাসিতে মুগ্ধ হয়ে প্রহরী তাদের জন্য কফি নিয়ে এলো। সে ক্যামিলের কাপে এক চামচ মোচা (একজাতীয় উৎকৃষ্ট কফি) ঢেলে দিলো। লুইস আর ক্যামিল দুজনেই বেশ পরিশ্রমী। তারা আবার চিন্তায় ডুবে গেল। প্রহরী এখনো ক্যামিলের দিকে সহানুভূতিশীল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লুইস এখনো ভাবছে। সে বেশ বুদ্ধিমান। পুরো ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা করছে সে। 

“কারণটা কী হতে পারে? টাকা…?” নিজেকে প্রশ্ন করলো লুইস।

“সেক্স…পাগলামী….” বলল ক্যামিল। 

*

পুরো এলাকা জুড়ে তারা চিরুনি অভিযান চালিয়েছে। প্রতিবেশীদের ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করেছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে নানা ধরণের তথ্যও পেয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। ভিক্টিম বা অপরাধী সম্পর্কে তেমন কোন গুরুত্বপূর্ন তথ্য পাওয়া যায়নি। 

অপহৃত মহিলা এই এলাকার বাসিন্দাই না। আর হলেও অপহরণের নিকট অতীতে এখানে থাকতো না। কেননা কেউই তাকে চেনে না। তারা যাদের কথা বলে তাদের কেউ কেউ ছুটিতে ঘুরতে গেছে অথবা ব্যবসার কাজে বাইরে। কিন্তু এসব কোন তথ্যই ক্যামিলের মনে ধরছে না। সে কিঞ্চিত বিরক্ত। 

অধ্যায় ৩ 

ঠাণ্ডায় জেগে উঠলো সে। হাত পা বাঁধা অবস্থায় সারারাস্তা ভ্যানের দেয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে শরীরে কালসিটে পড়ে গিয়েছে। অসহনীয় মুহূর্ত পার হওয়ার পর ভ্যান থামলো একসময়। লোকটা দরজা খুলে তাকে সাদা প্লাস্টিকে মুড়িয়ে ফেললো। ছোট্ট পোটলার মত তাকে কাঁধে তুলে নিলো। জলজ্যান্ত মানুষ হয়েও ছোট্ট পোটলায় পরিণত হওয়া যেমন ভয়াবহ তার চেয়ে বেশি ভয়াবহ তুমি এমন একটা মানুষের হাতে আছ যে তোমাকে অনায়াসে কাঁধে তুলে নিতে পারে। সে যে আরো কত কী করতে পারে তা ভেবে শিউরে উঠলো অ্যালেক্স। 

অ্যালেক্সের চুলের মুঠি ধরে তাকে মাটিতে ফেলে দিলো সে। এরপর পাথরের সিঁড়িতে তাকে ছেঁচড়িয়ে উপরে উঠাতে লাগলো। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে পাঁজরের হাড় বাড়ি খাচ্ছে, মাথা বাঁচানোও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো তার জন্য। চিৎকার করতে থাকলো। এই ব্যাপারে লোকটার কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। দ্বিতীয়বার যখন মাথায় লাগলো সে বেহুশ হয়ে পড়লো। 

কতক্ষণ অজ্ঞান ছিল তা জানা অসম্ভব। কিন্তু যখন জেগে উঠলো চারপাশ একদম নিশ্চুপ। মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল এক স্রোত নেম গেল। কাঁধ আর হাতে ঠাণ্ডা অনুভব করলো। পা যেন ঠাণ্ডায় জমে গেছে। হাত পা নাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো কেননা সারা শরীর প্লাস্টিকে মোড়ানো। চোখ খোলার চেষ্টা করলো, কিন্তু বাম চোখও আটকে আছে। মুখও খুলতে পারলো না। পুরু ডাক্ট টেপে মোড়ানো। কিন্তু এটার কথা সে মনে করতে পারছে না। হয়তো অচেতন অবস্থায় লাগানো হয়েছে। 

হাত পিছমোড়া করে বাঁধা, পা-ও শক্ত করে বাঁধা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে অ্যালেক্স। সারা শরীরের ওজন বহন করছে তার কোমর। কোমা রোগির মত আস্তে আস্তে চেতনা ফিরে পাচ্ছে। সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা, যেন কোন ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছে। নিজের বর্তমান অবস্থান আন্দাজ করার জন্য নিজেকে ঘোরালো। আবারো ব্যথা টের পেলো কাঁধে। অবশেষে বাম চোখ খুলতে পারলো সে, কিন্তু ওই চোখে কিছুই দেখতে না পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়লো। কিছু সময় পর দূর আলোকবর্ষ হতে আসা ঝাপসা আলোর অস্তিত্ব অনুভব করলো যেন। 

জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো অ্যালেক্স। মন থেকে সব ঝেড়ে ফেলে যুক্তিযুক্তভাবে চিন্তা করার চেষ্টা করলো। চারপাশে তাকিয়ে পুরো ঘরটা দেখলো যেখানে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। আকৃতি দেখে মনে হচ্ছে কোন গুদামঘর অথবা স্টোররুম। ঘরটা বিশাল হলেও একদম ফাঁকা। কোন এক ছিদ্র দিয়ে আলো চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। মেঝেটা শক্ত এবং স্যাঁতসেঁতে। এছাড়াও মেঝেতে বৃষ্টির পানির শুকিয়ে যাওয়া দাগ সুস্পষ্ট। 

তার স্মৃতিপটে প্রথমে ভেসে উঠে একজন লোক ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে অত্যাচার করছে। লোকটার শরীরে ঘামের কটু গন্ধ অনেকটা পশুর শরীর থেকে আসা দুর্গন্ধের মত ছিল। ভীতিকর মুহূর্তে যে জিনিসগুলো মনে থাকে তা প্রায় অপ্রয়োজনীয়। ভয়ের সময়ে গুরুত্বপুর্ণ জিনিসগুলো মানুষ ভুলে যায়। এই যেমন এখন তার মনে পড়ছে লোকটি তার চুল টেনে টেনে ছিড়ছিলো। নিজেকে টেকো অবস্থায় কল্পনা করলো সে, তার সব চুল লোকটার হাতের মুঠিতে। এই ভেবে ডুকরে কেঁদে উঠলো। তার সব গ্লানি, ব্যথা, কষ্ট তার কান্নাকে আরো বাড়িয়ে দিলো যেন। সমস্ত মুখ টেপ দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় কাঁদা আরো কষ্টকর। খুক খুক করে কেশে উঠলো, কাশতে কাশতে দম বন্ধ হয়ে এলো তার। এমন অবর্ণনীয় কষ্টে তার চোখে পানি টলটল করছে। আবারো তার বমি বমি ভাব হলো। কিন্তু এমন অবস্থায় বমি করা অসম্ভব। তাই মুখে চলে আসা বমি গিলে নিতে বাধ্য হলো সে। ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠলো তার। 

শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে অ্যালেক্সের। তার সাথে কি হচ্ছে তাও সে বুঝতে পারছে না। এমন উন্মত্ত অবস্থায় নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। শুধু শান্ত থাকলেই যে সব সমাধান হবে তা নয়, কিন্তু শান্ত না থাকতে পারলে আপনি শেষ। শরীরটাকে একটু ঢিলে করে দিলো সে, হার্টবিট আস্তে আস্তে স্বাভাবিকে নেমে এলো। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো, সে এখানে কেন, এখানে কী করছে। 

এই মুহূর্তে ব্যথা ছাড়াও আরেকটা জিনিস তাকে বিরক্ত করছে। তার মূত্রথলি এখন পূর্ণ এবং ক্রমশই চাপ বাড়ছে। সে কখনোই এই চাপ বেশি সময় নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। বিশ সেকেণ্ডেরও কম সময়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো; একটু সময় নিয়ে প্রসাব করলো। এই নিয়ন্ত্রণ হারানো তার জন্য পরাজয় নয় কেননা সিদ্ধান্তটা ভেবে চিন্তেই নেয়া। এই কাজ না করলে হয়তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকে নিদারুণ কষ্টের মাঝ দিয়ে যেতে হতো,সারাক্ষণ শরীরের মাঝে অস্বস্তি দানা পাকিয়ে থাকতো, এবং শেষমেশ এমনটাই হতো। তাই কষ্ট ভোগ করে করার চেয়ে আগে করে ফেলাটাই শ্রেয় মনে হলো তার কাছে। আর তা ছাড়া এই বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর চেয়ে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নিয়ে ভাবতে হবে তাকে, প্রসাবের ব্যাপারটা তো ছোটখাট একটা অপ্রয়োজনীয় বাঁধা। কয়েক মিনিট পর আরো বেশি শীতলতা অনুভব করলো যা সে কল্পনাও করেনি। ঠকঠক করে কাঁপছে। যদিও সে জানে না এই কাঁপুনি কি ভয়ের নাকি ঠাণ্ডার। তার চোখে এখন দুটি জিনিস ভাসছে। রাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই লোক আর তার বেদম মার। ভ্যানে উঠানোর সময় মারাত্মক ব্যথা পেয়েছিলো সে। 

হঠাৎ ধাতব দরজা খোলার মৃদু আওয়াজ পেয়ে অ্যালেক্স কান্না বন্ধ করলো। তার ভিতর থেকে কেউ যেন সতর্ক করে দিচ্ছে। হতাশায় শরীরের শক্তি আরো কমে গেল। পিছনে ভর দিয়ে উঠে বসে নিজেকে প্রস্তুত করলো মার খাওয়ার জন্য। কেননা সে জানে তাকে অপহরণই করা হয়েছে এর জন্য। ধীর আর সুচিন্তিত পদক্ষেপে আগত লোকটার পদশব্দ শুনতে পেলো। একসময় এসে থামলো তার সামনে। চকচকে ঝকঝকে তার জুতো। অ্যালেক্সের সামনে একটু ঝুঁকলো কিন্তু কিছুই বললো, না যেন তার ঘুম দেখছে। শেষ পর্যন্ত চোখ খুলে লোকটার দিকে তাকালো সে, তার মনোভাব বোঝার চেষ্টা করলো। তার চোখের ভ্রু বেশ ঘন যা তার চোখের অনেকাংশ ঢেকে ফেলেছে। মুখের তুলনায় কপালটা বেশ বেখাপ্পা রকমের বড়। এই বড় রকমের কপালটা তার মাঝে আদিম, মন্দ আর শূকরের একটা ভাব এনেছে। বর্ণনা করার উপযুক্ত শব্দ মনে করার চেষ্টা করেও পারলো না সে। 

অ্যালেক্স কিছু বলতে চাইলো। কিন্তু মুখে টেপ থাকার কারণে কিছুই বলতে পারলো না। যদি কথা বলা সম্ভব হতো তাহলে বলতো, “প্লিজ, আমি হাতজোড় করে অনুরোধ করছি…” তার মাথায় চিন্তার ঝড় বয়ে গেল যদি লোকটা তার বাঁধন খুলে দেয় তাহলে কী বলবে। কী বললে লোকটা তার আকুল মিনতি বুঝতে পারবে। কিন্তু বিধাতার কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। তার মাথা কাজ করছে না যেন জমে গেছে। লোকটা তাকে অপহরণ করেছে, বেঁধে এখানে এনেছে, বেদম প্রহার করেছে, আর কী করতে পারে তাই ভেবে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। 

অ্যালেক্স অঝোরে কাঁদছে। নিজেকে থামাতেই পারছে না। লোকটা কোন কথা না বলেই রুমের এক কোণায় চলে গেল। সেখানে গিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে একটা তেরপল ধরে টান দিলো। তেরপল দিয়ে কী ঢাকা ছিল তা বলা অসম্ভব। তার মনে আবারো বেজে উঠলো সে জাদুমন্ত্র, “প্লিজ, আমাকে মেরো না…” 

অ্যালেক্সের উলটো দিকে ঘুরে আগের চেয়ে দ্বিগুন বেঁকে গেল সে। দুহাতে ভারী কিছু টানছে-একটা বাক্স? কংক্রিটের মেঝেতে ঘষা খেয়ে কৰ্কশ আর্তনাদ করছে। পরণে ধূরসবর্ণের ট্রাউজার আর ডোরাকাটা জাম্পার। জাম্পারটা বেশ ঢিলেঢালা আর সাইজেও বড়, দেখেই মনে হয় উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি!!! 

পিছনের দিকে আরো কয়েক মিটার আসার পর সে থামলো, সিলিঙের দিকে এমনভাবে তাকালো যেন কোন হিসাব কষছে। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে কোনটা সবচেয়ে ভাল পন্থা হবে সামনে এগোনোর। শেষ পর্যন্ত ঘুরে অ্যালেক্সের দিকে তাকালো, তার দিকে এগিয়ে গেল, হাঁটু গেড়ে সামনে বসে এক ঝটকায় পায়ের গোড়ালি থেকে টেপ খুলে ফেললো। এরপর তার মোটা লোমশ হাত দিয়ে মুখের একপাশ থেকে টান দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে মুখের টেপটুকুও খুলে ফেললো। তীব্র ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলো অ্যালেক্স। কোনমতে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকলো সে। মাথায় রক্তের প্রবাহ বেড়ে গেল, মাথা ঘোরা শুরু করলো। লোকটা তার কাঁধ ধরে ঘুরিয়ে ফেললো। আর কিছু বুঝে উঠার আগেই কবজিতে বাঁধা টেপ কেটে ফেললো। 

নিজের সমস্ত সাহস একসাথে জড়ো করে সে বলল। 

“প্লিজ, আমি আপনা…আপনা…কাছে হাতজোড়…” 

নিজের কণ্ঠস্বর শুনে অবাক হয়ে গেল সে। খুব অপরিচিত ঠেকছে নিজের কাছেই। সে তোতলাচ্ছে, সেই ছোটবেলার মত। 

একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তারা। সত্যের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত অ্যালেক্স। লোকটা কী করতে পারে এই ভেবে ভীষণ আতঙ্কিত বোধ করলো সে। হুট করেই তার ইচ্ছে হলো মারা যেতে, ঠিক এই মুহূর্তে, সে চায় লোকটা তাকে এখনি হত্যা করুক। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করাকেই বেশি ভয় পাচ্ছে সে, কেননা এই সময়টা নানান বীভৎস চিন্তা তার মাথায় ঘুরতে থাকে। চোখ বন্ধ করে নিজেকে কল্পনা করলো। এই শরীরকে আর নিজের অংশ মনে হলো না। তার শরীর যেন আর নিজের শরীর নেই, এটা এখন বিকৃত, অঝোরে রক্ত ঝরছে, অসহ্য ব্যথা সেখানে। কল্পনায় এটা তার নিজের মনে না হলেও, এই শরীর তারই। কল্পনায় নিজের মৃত শরীর দেখতে পেলো। 

“খুলে ফেল,” বলল লোকটা। 

ভরাট কণ্ঠে সুস্থির ভাব স্পষ্ট। আদেশও বেশ কড়া। অ্যালেক্স মুখ খুললো কিছু বলার জন্য, কিন্তু কিছু বলার আগেই লোকটার শক্ত চড়ে নিজের ভারসাম্য হারালো। আরেকটি চড়ে মেঝেতে পড়ে মাথা থেতলে গেল তার। লোকটি ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে চুলের মুঠি ধরলো। অসহ্য ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো সে। চুলের মুঠি ধরে তাকে দাঁড়া করালো। 

অ্যালেক্সের মনে হচ্ছে তার খুলি থেকে কেউ চুল ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে, দুহাত দিয়ে লোকটার মুষ্টি ধরলো সে। আস্তে আস্তে নিজের পায়ে বল ফিরে পাচ্ছে। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই আরেকটি চড়ের আঘাত, শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো তার। অসহনীয় ব্যথায় অন্যান্য সব অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে। 

“আমি বলছি খুলে ফেল,” লোকটা আবারো বলল। “সব খুলে ফেল।”

তাকে ছেড়ে দিলো লোকটা। হতবুদ্ধিকর অবস্থায় এক পা সামনে এগুলো। দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো সে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো এবার। তার দিকে এসে নিচু হয়ে বলল, “বুঝিস না আমার কথা?” 

উত্তরের অপেক্ষা না করে হাত তুলে আঙুলগুলো প্রসারিত করলো সে। এই দেখে অ্যালেক্স আরো ভয় পেয়ে গেল। “হ্যাঁ,” বারবার বলতে থাকলো, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ।” মুহূর্তের মাঝেই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল, যে কোন কিছু করতে প্রস্তুত। শুধু তার একটাই চাওয়া লোকটা যেন আর না মারে। দ্রুততার সাথে নিজের টি-শার্ট, ব্রা খুলে ফেললো সে যেন তাকে বোঝাতে চায় তার যে কোন আদেশ নির্দ্বিধায় মানতে প্রস্তুত এখন। জিন্সের প্যান্টের বোতাম এমনভাবে খুলতে লাগলো যেন তার জামায় আগুন লেগেছে, যত দ্রুত নগ্ন হওয়া যায় ততোই কল্যাণকর। ভয় আর অস্বস্তি দলা পাকিয়ে এক বিচিত্র অনুভূতি জন্ম নিলো তার মনে, নিজের শরীরে থাকা সর্বশেষ সুতোটুকুও ফেলে দিলো। বুকটা দুহাত দিয়ে ঢেকে উঠে দাঁড়ালো, তখনি বুঝতে পারলো তার সব শেষ আর কখনো তা ফিরে পাবে না। দ্রুততার সাথে নগ্ন হয়ে সবই মেনে নিয়েছে সে- তার পরাজয় নিশ্চিত। এক অর্থে, অ্যালেক্স এখন মৃত। তার অনুভূতিও এখন কিছুটা স্পষ্ট যেন এখন সে নিজের শরীরের বাইরে ভিন্ন এক স্বত্তা। এই ভিন্ন স্বত্তাই যেন তাকে সাহস জোগালো লোকটাকে প্রশ্ন করতে, 

“আপ…আপনি কী চান?” 

“আমাকে দেয়ার মত তোর কী আছে রে, মাগি?” বলেই হাসলো লোকটা। আদৌও সেটা হাসি কিনা বোঝা মুশকিল। কেননা তার ঠোঁট এতোটাই পাতলা যে, তার অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। লোকটার কণ্ঠে কামুক ভাব সুস্পষ্ট যেন তাকে পটাতে চাইছে। অ্যালেক্স বেশ ভালমতোই বুঝতে পারলো কথার মর্ম। যে কোন মেয়েই এই কথার মানে বুঝবে। বড় ঢোক গিলে ভাবলো, লোকটা আমাকে মেরে ফেলবে না। সব বাঁধা বিপত্তি সত্ত্বেও তার চিন্তাধারা এর মাঝেই ঘুরপাক খেতে লাগলো। কিন্তু তার ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠলো- আজ হোক কাল হোক সে তোমাকে হত্যা করবে। মনকে আরো দৃঢ় করলো সে। 

“আপনি চাইলে আমাকে ফা-ফা-ফাক করতে পারেন।” কিন্তু এই কথাটা তার নিজের কাছেই মনঃপুত হলো না। “আপনি চাইলে আমাকে ধর্ষণ করতে পারেন। আপনার যা খুশি করতে পারেন।” আবারো বলল অ্যালেক্স। 

লোকটার হাসি থেমে গেল। ফিরে চাইলো তার দিকে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে নিলো। বুক থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিলো অ্যালেক্স; যেন লোকটাকে বোঝাতে চাইছে তার ইচ্ছার প্রতি পূর্ণ সমর্থন রয়েছে তার। নিজের ইচ্ছা পরিত্যাগ করে, তার হাতে নিজেকে সপে দিতে প্রস্তুত সে, যাতে বাঁচার জন্য আরো কিছু সময় পাওয়া যায়। এই পরিস্থিতিতে সময়ের অপর নাম জীবন। 

অ্যালেক্সের মাথা থেকে ধীরে ধীরে প্রতিটি অঙ্গ নিগূঢ় দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো সে, সবশেষে যৌনাঙ্গে গিয়ে থামলো তার চোখ। নিজের জায়গায় যেন জমে গেছে অ্যালেক্স, একচুলও নড়লো না। সন্দিহান দৃষ্টিতে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে গেল লোকটা। অন্যের সামনে নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করায় খুব লজ্জাবোধ করছে সে। যদি লোকটা তাকে না পছন্দ করে? তার এই নিবেদন যদি যথেষ্ট না মনে হয়, তাহলে সে কী করবে? এই ভেবে অস্থির বোধ করলো। লোকটার মাথা নাড়ানোর ভঙ্গিতে বোঝা গেল খুব একটা সন্তুষ্ট নয় সে। তা প্রমাণ করার জন্যই কিনা অ্যালেক্সের ডান নিপল বৃদ্ধাঙ্গুলি আর তর্জনীর মাঝে নিয়ে এমন জোরে মুচড়ে দিলো যে চিৎকার করে উঠলো সে। 

লোকটা ছেড়ে দিতেই অ্যালেক্স তার স্তন ধরে বসে পড়লো, চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে, ব্যথায় প্রায় অন্ধ হবার মত অবস্থা। অশ্রুসজল চোখে জিজ্ঞেস করলো : “আপনি আমাকে নিয়ে কী করতে চান?” 

“আমি তোর মরণ দেখতে চাই, মাগি, “ হেসে হেসে বলল সে। অভিনেতার মত নিপুণ দক্ষতায় একপাশে সরে গেল তারপর 

অ্যালেক্স তার পেছনে দেখতে পেলো একটা ড্রিল মেশিনের পাশেই আছে মানবদেহের সমান কাঠের বাক্স। 

অধ্যায় ৪ 

নিচু হয়ে একাগ্রচিত্তে প্যারিসের ম্যাপ দেখছে ক্যামিল। প্রহরীর বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে একজন অফিসার আর তার সহায়তায় আছে স্থানীয় প্রশাসন। প্রতিবেশী, অতি-উৎসাহী লোকজনদেরকে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে তারা। অপহরণের কথা শুনে তারা দ্বিগুণ উৎসাহী হয়ে উঠেছে। ‘অপহরণ’-যেন মজার কোন কিছু, যেন মুভির কোন দৃশ্য। থ্রিলিং সবই আছে শুধু যেন নায়কটাই নেই! কিন্তু এতে তাদের থোরাই কেয়ার, মুভিতে থাকাটাই যেন বিশাল কিছু! রাত যত গভীর হলো, অপহরণের খবর দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়লো। মানুষজন বিশ্বাসই করতে পারছে না। তাদের মাঝে নানা ধরণের প্রশ্ন, নানা ধরণের মতামত। খারাপ খবর যেন বাতাসেরও আগে ছুটে বেড়ায়, যে বাচ্চাদের এখন বিছানায় থাকার কথা তারাও এসে এই ব্যাপারে খবরাখবর নিয়ে যাচ্ছে; প্রতিবেশীরা এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনায় বেশ রোমাঞ্চিত। কেউ কেউ আবার দায়িত্বরত অফিসারদের বারবার জিজ্ঞেস করছে তাদেরকে টিভিতে দেখানো হবে কী না! তারা কেন এসেছে বা কিসের জন্য অপেক্ষা করছে নিজেরাও জানে না, শেষ পর্যন্ত যদি কিছু হয়, শুধু এই ভেবে ভীড় করে আছে। আদতে কিছুই হয় না, সময় তার নিজস্ব নিয়মে গড়িয়ে যায়, একসময়ের উৎসাহ রূপ নেয় বিরক্তিতে। 

লুইস বরাবরের মতই নির্বিকার। নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত সে। ঘটনাস্থলের আশেপাশের প্রধান সড়কগুলো চিহ্নিত করেছে। সম্ভাব্য চারটা পথই আছে যা অপহৃত মহিলা ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পূর্বে ব্যবহার করে থাকতে পারে। হয়তো সে বাসে করে এসেছে- ৮৮ অথবা ৯৫ এর যে কোন একটা। আশেপাশের মেট্রো স্টেশনগুলোও ঘটনাস্থল থেকে বেশ দূরে, কিন্তু তা এখনি বাদ দেয়া হচ্ছে না। 

যদি তারা এর মাঝেও কিছু না পায়, তাহলে সার্চ এরিয়া আরো বিস্তৃত করা হবে আগামীকাল। সাঁড়াশি অভিযান আরো বাড়ানো হবে যাতে করে পাওয়া যায় কোন মূল্যবান সূত্র, আর তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আগামীকাল পর্যন্ত। কিন্তু এদিকে সময়ও তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছে। 

অন্যান্য সব অপরাধের তুলনায় অপহরণ একটু আলাদা। হত্যাকাণ্ডে যেমন ভিক্টিম চোখের সামনেই থাকে, এই ক্ষেত্রে তা হয় না; বরং কল্পনা করে নিতে হয়। ঠিক এই মুহূর্তে ক্যামিল তাই করছে। রাস্তায় হেঁটে যাওয়া কোন মহিলার স্কেচ করছে। সমালোচকের দৃষ্টিতে নিজের ছবিকে বিচার করলো সে; খুব মার্জিত এবং সামাজিক একজন মহিলা। কিন্তু এই ছবি তার মনে ধরলো না। একটানে কেটে দিয়ে নতুন আরেকটা শুরু করলো। এমন সময়ে তার মাথায় খেলা করলো নতুন এক চিন্তা। অপহরণ কি শুধু কম বয়সি মেয়েরাই হয়? বৃদ্ধারাও কি অপহরণের শিকার হয়? প্রথমবারের মত ভিক্টিমকে একজন মহিলা হিসেবে না দেখে একজন তরুণী হিসেবে দেখলো। ভিক্টিম হিসেবে একজন তরুণীকে কল্পনা করে আবার স্কেচিং এ মনোযোগ দিলো। জিন্স পড়া, ছোট করে কাটা চুল, কাঁধ বেয়ে নেমে আসছে একটা ব্যাগ। না, এটা তার পছন্দ হলো না। আরেকটা স্কেচ করলো; এখানে পেন্সিল স্কার্ট পড়া, বিশাল বক্ষা এক মেয়ের ছবি দেখা গেল। এটাও পছন্দ হলো না। বিরক্ত হয়ে কেটে দিলো আবারো। যখনই সে কোন তরুণীর স্কেচ করে, আদতে তা হয়ে যায় তার স্ত্রী আইরিনের। 

ক্যামিলের জীবনে অন্য কোনো নারীর আগমন ঘটেনি। মাঝে মাঝে সুযোগ তার এসেছে, কিন্তু তার জৈবিক তাড়না নানান জটিলতার কারণে আশার আলো দেখতে পায়নি- স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা, অপরাধবোধ, আত্মগ্লানি, নারীদের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখার ভয় এসব তার মধ্যে অন্যতম। অবশ্য এই কথাটাও পুরোপুরি সত্য নয়। তার জীবনেও ব্যতিক্রমী আরেকটি অধ্যায় আছে। একবার নিজের এক সহকর্মীকে খুব কঠিন এক ঝামেলা থেকে উদ্ধার করে সে। এরপরই তার সাথে আর কোন যোগাযোগ ছিল না। হুট করে একদিন রাস্তায় দেখা হয়। একসাথে চলে যায় কোনো এক বারে, সেখান থেকে ডিনার, তারপর রাত করে বাড়ি ফেরা, নাইট ক্যাম্পের জন্য ফ্ল্যাটে যাওয়া, এরপর… সাধারণত, তার মতো এমন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, মার্জিত ব্যবহারের লোকের কাছ থেকে এমন আচরণ প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু সেই মেয়েটি ছিল বেশ আকর্ষণীয়, স্বাধীনচেতা এবং কৃতজ্ঞতাবোধ প্রকাশের জন্য উন্মুখ। অন্ততপক্ষে নিজের অপরাধবোধ কমানোর জন্য এমন কিছু কারণই দেখিয়েছিলো ক্যামিল। প্রায় দুই বছরেরও বেশি সময় আগে সর্বশেষ সে কোন নারীকে স্পর্শ করেছিলো। ওই রাতের কথা আলাদা। ওই রাতের অনৈতিক কাজের জন্য এখনও সে অনুতপ্ত। মেয়েটা তার অন্যান্য সব সহকর্মীর মত জানতো যে ভেরহোভেনের স্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। এরপরেও তাদের সম্পর্ক অনেক দিন টিকে ছিলো। পাশের রুমেই মেয়েটা নগ্ন হয়ে তার জন্য অপেক্ষা করতো। ক্যামিল প্রচুর চেষ্টা করেও নিজেকে থামাতে পারে নি। একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে তারা। প্রায়ই তারা মিলিত হতো। মেয়েটা তার বাসার খুব কাছেই থাকতো। কিন্তু কখনো তার বাসায় রাত কাটাতো না। এই সময়টুকু সে একাকী থেকে নিজের ভেতরে জমে থাকা কষ্টগুলোকে দূরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করতো। এরপর যখন তাদের কর্মস্থলে দেখা হতো তখন তারা এমন ভাব করতো যেন কিছুই হয়নি। হুট করে তার কথা কেন ভাবছে সে? তার মত মেয়েদেরকেই কি অপহরন করা হয়? 

ক্যামিল তার সমস্ত মনোযোগ অপরাধীর দিকে সন্নিবেশিত করলো। নানা উপায়ে, নানা কারণে হত্যা করা সম্ভব, কিন্তু সব অপহরণ একই রকম। অপহরণ করার জন্য অবশ্যই সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা লাগে। অবশ্য তাড়নার বশে কিংবা রাগের মাথায়ও হুট করে করা সম্ভব, কিন্তু এমন ক্ষেত্রে ব্যর্থতার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় অপরাধী নিখুঁত পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামে। অপহরণের পরের কয়েক ঘণ্টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সময় যত গড়ায় ভিক্টিমকে জীবিত পাওয়ার সম্ভবনা ততই কমতে থাকে। কেননা যে কোন জিম্মিই একটা বাড়তি চিন্তা অপরাধীর কাছে, তাই যত তাড়াতাড়ি পারা যায় তাকে শেষ করে ফেলাটাই শ্রেয়। 

প্রথম সূত্রটা লুইসের হাতেই পড়লো। গতরাতে ১৯:০০ থেকে ২১:০০ সময়ের মাঝে যে যে ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছিলো তাদের সবাইকে টেলিফোন করেছে। রাতেই বেলায় তাদেরকে বিছানা ছাড়তে বাধ্য করছে। 

“৮৮ এর বাস চালকের সাথে কথা হলো। সে বলল রাত নয়টার দিকে একটা মেয়ে বাস ধরতে চেয়েও পরবর্তিতে তার মন পরিবর্তন করে।” 

ক্যামিল তার পেন্সিল রেখে মুখ তুলে তাকালো। 

“কোন স্টপেজে?” 

“পাস্তুর ইন্সটিটিউট।” 

“মেয়েটার কথাই আলাদা করে কেন মনে আছে তার?” 

“দেখতে নাকি সুন্দর ছিলো। বেশ সুন্দর।” 

“ওহ্…..” 

“আর সময়ের ব্যাপারে সে পুরোপুরি নিশ্চিত। মেয়েটাকে দেখে হাত নাড়িয়েছিলো সে, আর মেয়েটাও নাকি তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসেছিলো। আর মেয়েটাকে এটাও বলেছিলো যে তার বাসটাই ওই রাতের শেষ বাস। তবুও মেয়েটা পায়ে হেঁটেই রওনা দেয়।” 

“কোন দিকে?” 

“হাতের ডান দিকে। 

মেয়েটার ব্যাপারে আর কোন বর্ণনা?” 

“না। তেমন কিছু না। খুবই অস্পষ্ট।” 

সুন্দরি মেয়েদের নিয়ে এই এক সমস্যা, তারা তোমার নিঃশ্বাস কেড়ে 

নেবে, বিস্তারিত দেখার আর সুযোগ কই! আপনি হয়তো তার চোখ, তার ঠোঁট, তার পশ্চাৎদেশ খেয়াল করবেন অথবা তিনটাই, কিন্তু সে কি পড়েছিলো তার সম্পর্কে আপনার কোন ধারণাই নেই। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই এক সমস্যা, কিন্তু মেয়েরা এই ব্যাপারে বেশ খুঁতখুঁতে। প্রতিটি জিনিস তারা খেয়াল করে। 

ক্যামিল সারারাত এমন সব চিন্তায় ডুবে রইলো। 

*

রাত ২:৩০-এর মাঝেই যতটুকু করা সম্ভব তার সবটুকু করলো তারা। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই, আশায় বুক বাঁধতে হবে কিছু ঘটার জন্য যা তাদেরকে সামনে এগুনোর পথ দেখাবে। হয়তো মুক্তিপণ চেয়ে কোন কল আসবে, যা তদন্তের জন্য খুলে দিবে নতুন দুয়ার। অথবা খুঁজে পাওয়া যাবে মৃতদেহ, যা এক নিমিষেই অন্য সব সম্ভাবনা শেষ করে দিবে। পুলিশ হেড কোয়ার্টার থেকে জানানো হয়েছে এখন পর্যন্ত অপহরণের কোন মামলা দায়ের হয়নি যা ভিক্টিমের সাথে মিলে যায়। 

অপহরণের পর ছয় ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও এখনো ভিক্টিমের কোন খোঁজ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *