অধ্যায় ৪০
“বেশ ভাল মেয়ে,” বলল আরব মুদি দোকানদার।
দোকানদারের সাথে কথা বলার দায়িত্ব পেয়েছে আরম্যান্ড। এই দায়িত্ব পেলে বেশ খুশিই হয় সে, এমন সুযোগ তো আর প্রতিদিন আসে না। এদের সাথে কথা বলার সময় একটু রাগান্বিত ভাব নিয়ে থাকে আরম্যান্ড, আর নিজের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে। এরই মাঝে এক প্যাকেট চুইংগাম, দুই ক্যান কোন সাবাড় করে ফেলেছে প্রশ্ন করার সময়। আর দোকানদারের চোখ এড়িয়ে চকলেটের বার, কয়েক ব্যাগ মিষ্টি বিস্কিট, স্ন্যাক্স বার পকেটে পুরলো। দোকানদারের কাছ থেকে তেমন তথ্য না পেলেও একের পর এক প্রশ্ন করে চলছে। মেয়েটার নাম কী? নগদ টাকা দিতো নাকি চেক? এখানে প্রায়ই আসতো? কেমন জামা পরে আসতো? শেষ কবে এসেছিলো? পকেট ভর্তি হওয়ার ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলো। গাড়িতে উঠেই নিজের ব্যাগে জিনিসপত্র ভরতে শুরু করলো। এমন পরিস্থিতির জন্য সবসময় একটা ব্যাগ তার গাড়িতে থাকে।
*
মিস গুনাডেকে খুঁজে বের করার কৃতিত্ব ক্যামিলের। ষাট বছর বয়সি বৃদ্ধা, ক্লিপ দিয়ে চুল বেঁধে রেখেছে। মুখের মেকআপের কারণে কসাইয়ের স্ত্রীর মত লাগছে অনেকটা। শুরু থেকেই উসখুস করছে বৃদ্ধা যেন স্কুলের দেরি করে আসা কোন মেয়ে ক্লাসে ঢোকার অনুমতি চাচ্ছে। এই ধরণের মহিলাদের দেখলেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে ক্যামিল। কেননা এরা টুকটাক বিষয়েও পুলিশকে বিরক্ত করে থাকে। বৃদ্ধা বলল, “মেয়েটা শুধু আমার প্রতিবেশীই ছিল না, বরং…”মেয়েটাকে চিনতেন আপনি? হ্যা অথবা না বলুন? বৃদ্ধার উত্তরের আগামাথা কিছুই বুঝতে না পেরে, আরো রাগ উঠে গেল ক্যামিলের।
স্বামী মারা যাওয়ার পর ঘর ভাড়ার টাকা দিতেই সংসার চলে মিস গুনাডের। অপহরণের দিন কোথায় ছিল জিজ্ঞেস করতেই, মিস গুনাড়ে বলল, “আমার বোনের বাড়িতে ছিলাম ওইদিন।” ফিরে আসার পর যখন দেখলো পুলিশ একটা মেয়েকে খুঁজছে, যে দেখতে তারই এক ভাড়াটিয়ার মত, তখনও পুলিশকে কিছুই জানায়নি। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলল, “আমি আসলে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম না। মানে, আমি যদি জানতাম…”
“শীঘ্রই আপনাকে জেলের ভাত খাওয়ানোর ব্যবস্থা করছি আমি।” উত্তেজত কণ্ঠে বলল সে।
ভয়ে তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। হুমকি কাজে লেগেছে দেখে, দ্বিগুণ উৎসাহে সে বলল, “আশা করি ওই মেয়ের কাছ থেকে পাওয়া ভাড়া দিয়ে জেলের ক্যান্টিন থেকে কিছু কিনে খেতে পারবেন।”
মিস গুনাডের কাছে নিজেকে এমা বলেই পরিচয় দিয়েছিলো মেয়েটা। নাটালি, লি, লরার পর যে কোন কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিল ক্যামিল। ই-ফিট দেখানোর আগে বসার কথা বললেও দাঁড়িয়ে রইলো মিস গুনাডে। ছবি দেখার সাথে সাথে তার হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। “হ্যা। এটাই তো এমা। আমার ভাড়াটিয়া…” নিজের বুক ধরে বসে পড়লো, ক্যামিলের মনে হলো এখনি হয়তো নিজের স্বর্গীয় স্বামীর কাছে চলে যাবে এই বৃদ্ধা। এমা তিনমাসের জন্য এখানে ছিলো, কেউ তার কাছে আসতো না, এমাও খুব একটা বাইরে যেতো না। গত সপ্তাহে কোন জরুরী কাজে শহরের বাইরে যায়। ফিরে আসার পর ঘাড়ে, হাতে, পায়ে সহ আরো বিভিন্ন জায়গায় দগদগে ক্ষত ছিল তার। আসার পরেই পরিবারের কোন এক প্রয়োজনের কথা বলে, ফ্রান্সের দক্ষিণে কোন এক জায়গায় চলে যায়। দুই মাসের ভাড়াও দিয়ে গিয়েছিলো। এর বাইরে আর কিছু বলার মত খুঁজে পেলো না মিস গুনাডে। ক্যামিলকে ঘুষ দেয়ার মত সাহসও তার নেই। এমন অগোছালো তথ্যের মাঝ থেকেই নিজের প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো সাজিয়ে নিলো সে। কোন ঠিকানা রেখে গেছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই, সামনে থাকা কেবিনেটের ড্রয়ারের দিকে আঙুল তাক করলো মিস গুনাডে। নীল কাগজে লেখা ঠিকানা
“এটা কি ওর হাতের লেখা?”
“না। আমারই।”
“ঠিক যেমন ভেবেছিলাম,” বলল ক্যামিল।
দ্রুতগতিতে ফোনে কাউকে ঠিকানা জানিয়ে দিলো। ক্যাবিনেটের পাশে ঝোলানো একটা হরিণের ছবির দিকে ইঙ্গিত করলো সে।
“ছবিটা তো খুবই বাজে হয়েছে।”
“আমার মেয়ে এঁকেছে।”
“আপনি আসলেই…”
মাথায় চিন্তার ঝড় বইছে মিস গুনাডের। এমা একটা বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করতো, মনে পড়ছে না কোন ব্যাংক…একটা বেসরকারি ব্যাংক।
তার দেয়া ঠিকানা চেক করে দেখা গেল, ওই ঠিকানার কোন অস্তিত্ব নেই। ক্যামিল আগে থেকেই জানতো। এই মেয়ে যাই হোক নিজের আসল ঠিকানা দিবে না।
দুইজন ফরেনসিক অফিসারকে সাথে নিয়ে বাড়ির সামনে আসলো লুইস। মিস গুনাডেকে পথ দেখাতে বলল, শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে অপারগতা প্রকাশ করল। এমার অ্যাপার্টমেন্টে কী পাওয়া যাবে তা বেশ ভালোমতোই জানে ক্যামিল : লি’র ফিঙ্গারপ্রিন্ট, লরার ডি.এন.এ আর নাটালির জিনিসপত্র। “ওহ, একটা কথা তো ভুলেই গেছি। আপনাকেও কিন্তু হত্যাকারীর সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত করা হবে।” মিস গুনাডেকে উদ্দেশ্য করে বলল সে।
“অ্যাই দাঁড়ান, দাঁড়ান। একটা কথা মনে পড়েছে। মালপত্র ডেলিভারী করা লোকটা আমার পরিচিত।” চিৎকার করে বলল মিস গুনাড়ে।
তাড়াতাড়ি ওই কোম্পানীর নাম্বার নিয়ে তাদের সাথে যোগাযোগ করলো ক্যামিল। কিন্তু ওদিক থেকে খুব একটা সাহায্য এলো না। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া সেক্রেটারি কোনরকম তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানালো। এই কথা শোনার পর রাগে গা জ্বলে গেল তার।
“আচ্ছা ঠিক আছে, আমি অনুমতি নিয়েই আসছি। কিন্তু এটা ভুলবেন না আমি আসার পর ট্যাক্স ফাঁকির দায়ে এক বছরের জন্য কোম্পানী বন্ধ করে দিবো। আর আপনারও জেলের ভাত খাওয়া নিশ্চিত করবো। আপনার সন্তানাদির দেখাশোনার ব্যবস্থা করার জন্য আজকাল অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আছে। তাই এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।”
এমন হাস্যকর ধাপ্পাবাজিতেও কাজ হলো। সেক্রেটারি সাথে সাথেই ঠিকানা দিয়ে দিলো আর নাম বলল–এমা জেকেলি।
“এস দিয়ে শুরু, তাই না?”
এখনি একটা টিম রেডি করো, লুইস।
দ্রুতগতিতে সিঁড়ি দিয়ে নামলো ক্যামিল।
অধ্যায় ৪১
সরাসরি পার্কিং এরিয়ায় না ঢুকে, সিঁড়ি ব্যবহার করলো অ্যালেক্স। তার প্রিয় ক্লিও বিনা বাঁধায় স্টার্ট নিলো। রিয়ার ভিউ মিররে নিজেকে দেখলো। খুবই ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। তবুও নিজেকে একটা হাসি উপহার দিলো, একসময় যা ভেংচিতে রূপ নিলো।
বিপদ এখনো পুরোপুরি কাটেনি। রাস্তার মোড় ঘুরতেই দেখলো একজন পুলিশ হাত নেড়ে থাকে থামতে বলছে। সাথে সাথে ব্রেক কষলো। বেশ কয়েকটা গাড়ি তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
পাশের গাড়িতে টাক মাথাওয়ালা এক লোক বসে আছে। গাড়িটা কালো কাঁচে ঘেরা, অনেকটা প্রেসিডেন্টের গাড়ির মত। হঠাৎ একটু নড়ার ফলে গাড়ির বুট থেকে ঝনঝন শব্দ ভেসে এল। তাকে বিন্দুমাত্র চিন্তিত মনে হলো না। কেননা বুটে বেশ নিরাপদ ভাবেই রাখা আছে ‘ব্যক্তিগত’ লেবেল সাঁটা এসিডের বোতল।
অধ্যায় ৪২
রাত দশটা বেজে গেছে। এখনো ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে সবাই। ক্যামিল অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করেছে।
মেয়েটার ভাড়া করা লকআপ খোলার সময়, সবার হৃৎপিণ্ড যেন একটা বিট মিস করলো। চোখের সামনে টেপে মোড়ানো দশটা বাক্স পড়ে আছে, সবগুলোতে মেয়েটার জিনিসপত্র। সবাই যেন ঝাঁপিয়ে পড়লো বাক্সগুলোর উপর। ক্যামিল তখনি বাক্সগুলো খুলে দেখতে চাইলো। কিন্তু কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বাক্স খুলতে চাইলো না ওখানের কর্মচারি। সাথে সাথে ম্যাজিস্ট্রেটকে ফোন দিয়ে ব্যবস্থা করলো। এরপর সবকিছু নিয়ে রওনা হলো হেডকোয়ার্টারের দিকে। মেয়েটার ব্যক্তিগত সবকিছু তাদের সাথে। এবার হয়তো মেয়েটার সত্যিকারের পরিচয় পাওয়া যাবে, এমন আশায় বুক বাঁধলো সবাই। সত্যের দারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে তারা।
সি.সি.টি.ভি ক্যামেরা থেকে কিছু পাওয়ার আশা থাকলেও, তা ধূলোয় মিশে গেছে। তারা কতদিনের রেকর্ড সংরক্ষণ করে সেটা না হয় বাদই দিলাম, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ক্যামেরাগুলোই ডামি।
“গুগুলো শুধু দেখানোর জন্য লাগানো হয়েছে,” হাসতে হাসতে বলল সুপাইভাইজার, যেন মজার কোন জোকস বলছে।
*
নমুনা সংগ্রহ করতে প্রায় সারারাত লেগে গেল ফরেনসিক বিভাগের। প্রথমে ফার্নিচার, বুকসেলফ, বিছানা, ম্যাট্রেস, কিচেন টেবিল থেকে নমুনা সংগ্ৰহ করলো। এরপর আলাদা আলাদা ক্যাটাগরিতে জিনিসপত্র ভাগ করে রাখলো। স্পোর্টসওয়্যার, বিচওয়্যার, গরমের জামাকাপড়, শীতের জামাকাপড়
“এই সব জিনিসপত্র পৃথিবীর যে কোন চেইনস্টোর থেকে কেনা যায়,” বলল লুইস।
প্রায় দুই বাক্স ভর্তি বই, সবগুলোই পেপারব্যাক–ক্লিনি, প্রাউস্ট, গিডি, দস্তয়েভস্কি, রিমব্যোড। ক্যামিল তাকিয়ে দেখলো কী কী বই আছে এখানে–জার্নি টু দ্য এণ্ড অফ দ্য নাইট, সোয়ান ইন লাভ, দ্য কাউন্টারলিফটারস লুইসকে বেশ চিন্তামগ্ন দেখা গেল।
“কী সমস্যা, লুইস?” জিজ্ঞেস করলো সে।
“এটা তো কোন স্কুল পড়ুরা মেয়ের রিডিং লিস্ট বলে মনে হচ্ছে।”
সবাই এই বিষয়ে একমত পোষণ করলো। সবগুলো বই বেশ কয়েকবার করে পড়া। কিছু বইয়ের তো পেজও ছিড়ে গেছে এখানে ওখানে। সব বইয়ের প্যাসেজ আণ্ডারলাইন করা, কিছু বইয়ের তো একদম শেষতক আণ্ডারলাইন করা আছে। কিছু প্যাসেজের পাশে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেয়া, এসব ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে নীল কালির বলপয়েন্ট কলম।
“যা পড়তে ইচ্ছে করতো, মেয়েটা তাই পড়তো। হয়তোবা মা বাবার লক্ষী মেয়ে হয়ে থাকার চেষ্টায় ছিলো। কিন্তু এর কারণ কী হতে পারে, ইমোশনালি ইমম্যাচিউর?” নিজের মতামত জানালো ক্যামিল।
“আমি জানি না। সম্ভবত, রিগ্রেশন?”
মাঝে মাঝে লুইসের কথা বুঝতে পারে না ক্যামিল। তবে কথার সারমর্ম ঠিকই ধরে ফেললো।
“মেয়েটা বোধহয় ইটালিয়ান আর ইংলিশও পারতো হালকাপাতলা। বেশ কিছু ক্লাসিক বই দেখা যাচ্ছে ওই ভাষার। অর্ধেক করে পড়া আছে বইগুলো।”
অ্যালিস ইন ওয়াণ্ডারল্যাণ্ড, দ্য পোর্ট্রেট অফ ডোরিয়ান গ্রে, পোর্ট্রেট অফ এ লেডি, এমা; কোন বই নজর এড়ানো না ক্যামিলের ।
“আচ্ছা ম্যাকিয়াক হত্যার সন্দেহভাজন যে মেয়ে… কে যেন বলেছিলো খুনি বিদেশী ভাষায় কথা বলছিলো, তাই না?”
“মেয়েটা মোটেও বোকা না- বেশ ভালোমতোই নিজের পরিকল্পনা সাজিয়ে নিতো। সাবলীল না হলেও, অন্যান্য ভাষায় কথা বলতে পারতো। তার মানে অবশ্যই সে অন্যান্য ভাষার কোর্স করেছে।”
“প্যাসকেলের সাথে ওর ছবির কথা মনে আছে?”
“অথবা ম্যাকিয়াককে প্রলুব্ধ করার কথা?”
“অথবা জ্যাকলিন জানেত্তিকে আঘাত করার কথা?”
দ্রুতগতিতে নোট করে চলছে লুইস। এখন অবধি প্রাপ্ত তথ্য দিয়ে, হয়তো মেয়েটার সম্ভাব্য ভ্রমণপথ বের করা যাবে, আজকাল বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সি ভ্রমণের তারিখ সহ বিস্তারিত সংরক্ষণ করে। কিন্তু মেয়েটার আসল নাম বের করার ধারেকাছেও যেতে পারেনি তারা। মেয়েটাকে খুঁজে বের করার মত কোন ট্রেসও পাওয়া যায় নি। এতো ছোট পরিসরে একটা মেয়ে কীভাবে জীবনযাপন করতো?
রাত শেষে কানাগলিতেই পড়ে রইলো সবাই।
“মেয়েটা কোন ট্রেস রাখেনি নিজের। পুলিশ খুঁজে বের করতে পারে এমন কোন কিছুই রাখেনি।”
দু’জনেই উঠে দাঁড়ালো। ক্যামিল জ্যাকেট হাতে নিলো, লুইসকে কিছুটা দ্বিধান্বিত দেখা গেল।
“চলো, লুইস। মেয়েটার কোন মানসিক সমস্যা আছে। আমার ধারণা মেয়েটা তার নতুন শিকারের পিছনে ছুটছে।”
*
লা গুয়েনেরও একই মত।
শনিবারের এক স্নিগ্ধ সকাল।
ভোর বেলায় ক্যামিলকে ফোন করে লা মেরিনে চলে আসতে বলল লা গুয়েন। দুজনের সামনাসামনি বসে আছে। দুই গ্লাস হোয়াইট ওয়াইন অর্ডার করলো। অফিসের বাইরে কথা বলার জন্য এমন জায়গা ব্যবহার করে তারা। গত কয়েকমিনিট যাবত সে একনাগাড়ে কথা বলে চললো।
ক্যামিলের মাথায় আগামীকালের নিলামের চিন্তা ঘুরছে। তার কথায় মনোযোগ দিতে পারছে না।
“সব বিক্রি করে দিচ্ছো?”
“হ্যা। সবই বিক্রি করে দিচ্ছি। সবই দান করে দিচ্ছি।”
“আমি ভাবলাম তুমি বিক্রি করে দিচ্ছো?”
“হ্যা, বিক্রি করে দিচ্ছি। আর টাকাগুলো দিয়ে দিচ্ছি।”
“কাকে?”
এই ব্যাপারে এখনো কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি ক্যামিল।
অধ্যায় ৪৩
“ঘটনাটা কি আসলেই এতো দ্রুত ঘটছে নাকি সবই আমার কল্পনা?”
“না। আসলে ঘটনা এমনই। এতে অভ্যস্ত হতে একটু সময় লাগবে।” দৃঢ়তার সাথে বলল ক্যামিল।
খুব সহজভাবে বললেও ঘটনা যে খারাপ দিকে মোড় নিচ্ছে তা বেশ ভালোমতোই বুঝতে পারছে ক্যামিল। নিজের অ্যাপার্টমেন্টে লাশ পাওয়া গেছে ফেলিক্স ম্যানিয়ের। একটা ‘গুরুত্বপূর্ণ মিটিং’ এ অনুপস্থিত থাকার পর সহকর্মীরা তার খোঁজ করে। এরপরই তার লাশ পাওয়া যায়। মাথাটা ঘাড় থেকে ঝুলে ছিলো, পুরো গলা সালফিউরিক এসিডের কারণে গলে গিয়েছে। সাথে সাথে এই কেস ভেরহোভেনের কাছে পাঠানো হয়। এই ঘটনা পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সক্ষমতাকে আরেকবার প্রশ্নবিদ্ধ করলো।
খুব দ্রুতই কাজে নেমে পড়লো সবাই। ভিক্টিমের কল লিস্ট চেক করে দেখলো, সর্বশেষ হোটেল থেকে ফোন করা হয়েছিল গত রাতে। আরো গভীরে যেয়ে জানা গেল মেয়েটা তুলুজ থেকে এই হোটেলে উঠেছিলো কিছুদিন আগে। ভিক্টিমের এক সহকর্মীর কাছ থেকে জানা গেল ওই মেয়ের সাথে ডিনারের প্ল্যান ছিলো। এর জন্য আগেভাগেই অফিস থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো সেদিন।
চুল আর চোখের রঙ না মিললেও, ই-ফিট দেখে মেয়েটাকে শনাক্ত করলো হোটেলের রিসিপশনিস্ট। পরেরদিন সকালেই সে হোটেল ছেড়ে চলে যায়। টাকাও পরিশোধ করেছে ক্যাশের মাধ্যমে আর চেক ইন করেছিলো অন্য এক নামে।
“কে এই লোক, ফেলিক্স?” উত্তরের অপেক্ষা না করে ক্যামিলের হাত থেকে রিপোর্ট নিয়ে দেখলো লা গুয়েন, “চুয়াল্লিশ…”
“ঠিক তাই,” বলে নিশ্চিত করলো ক্যামিল, “একটা কম্পিউটার কোম্পানিতে কর্মরত ফেলিক্স, অনেক আগেই স্ত্রীর কাছ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলো। আর প্রচুর মদপান করতো।”
লা গুয়েন কিছুই বলল না, চুপচাপ রিপোর্টে চোখ বুলাতে লাগলো।
“এই ল্যাপটপের কাহিনী কী ক্যামিল?”
“খোয়া গেছে। তবে আমি এতোটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি খুনি ল্যাপটপের জন্য এমন বিভৎসভাবে হত্যা করেনি।”
“ওই মেয়েটাই?”
“নিসন্দেহে। হয়তো ই-মেইলে যোগাযোগ হয়েছিল ভিক্টিমের সাথে। এর জন্যেই হয়তো ল্যাপটপ নিয়ে গেছে, যাতে করে আমরা পিছু নিতে না পারি।”
“আচ্ছা। এরপর?”
বর্তমান অবস্থার কারণে বেশ বিরক্ত লা গুয়েন। মিডিয়া কোন ভাবে এই খবর পেয়ে, তা ছেপে দিয়েছে। আর পুলিশ ডিপার্টমেন্টের দায়ত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ধুয়ে দিয়েছে লা গুয়েনকে।
এদিকে আবার ম্যাজিস্ট্রেট ফোন করে একদফা ঝেড়েছে তাকে, এই ঘটনার জন্য। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অনবরত চাপ দিচ্ছে তাকে, কেস সুরাহা করার জন্য। পুরো কেসটা মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার জন্য।
“উপর থেকে খুব চাপ দিচ্ছে নাকি আপনাকে?”
এই প্রশ্ন শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো লা গুয়েন। “ক্যামিল, কী কারণে তোমার এমন মনে হলো…”
এই তাদের এক গুণ, একে অপরের মনের কথা বুঝতে পারে।
“দেখুন, প্রথমত একটা মেয়েকে দিনেদুপুরে অপহরণ করা হয়, এরপর ওই কিডন্যাপার ফ্লাইওভার থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে…”
এমন ঘটনা, এর আগে কমপক্ষে আরো পঞ্চাশ বার দেখেছে তারা।
“… আমরা খুঁজে পাওয়ার আগেই ওই মেয়ে পালিয়ে যায়। এরপরই কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ বের হয়ে আসে। দেখা যায়, মেয়েটা তিনটা খুনের সন্দেহভাজন আসামী।”
লা গুয়েন এখনো নিশ্চুপ।
ক্যামিল বলে চললো। …যতক্ষণে আমরা কেস ফাইল হাতে পাই, ততক্ষণে তুলুজে একটা খুন করে প্যারিসে চলে আসে খুনি…” একটু বিরতি নিলো সে।
“… এখানে এসে আরেকজনকে তার ফাঁদে ফেলে হত্যা করে। “আর আপনি জিজ্ঞেস করছেন আমি কীভাবে…”
“…এতোকিছুর পরেও আপনার উপর কোন চাপ আসবে না?”
এরপর আর দেরি করলো না ক্যামিল। জ্যাকেট হাতে নিয়ে দরজার কাছে চলে গেল।
“কোথায় যাচ্ছো?” প্রায় চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলো লা গুয়েন।
“আমি যাচ্ছি দাঙ্গা আইন সম্পর্কে জানতে। ম্যাজিস্টেট ভিডার্ড থাকলে ভাল হতো।”
“তাই নাকি! তোমার রুচিবোধ তো দিন দিন আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে…”
অধ্যায় ৪৪
তিনটা লরিকে সামনে দিয়ে যেতে দিলো অ্যালেক্স। একটু দূরে গাড়ি পার্ক করে দাঁড়িয়ে আছে, যেখান থেকে আর্টিকুলেটেড লরির দীর্ঘ সারি দেখা যাচ্ছে। ফর্ক-লিফট অপারেটররা একের পর মালপত্র দিয়ে ভরে তুলছে লরিগুলোকে।
গতরাতেই এখানে একবার এসেছিলো, আশপাশ ভালমত দেখে নেয়ার জন্য। দেয়ালটা কতটুকু উঁচু হতে পারে সে সম্পর্কে ধারণা ছিল না তার। তাই দেয়ালের পাশে গাড়ি রেখে, গাড়ির ছাদে পা দিয়ে দেয়ালে উঠতে হয়েছে। এরপরেও বিপদ বিন্দুমাত্র কমেনি। একবার দায়িত্বরত কারো চোখে পড়লে, সব পরিকল্পনাই ভেস্তে যেতো তার। ভাগ্যদেবী পাশে থাকার কারণে কোন সমস্যাই হয়নি। প্রতিটি লরির গায়ে গন্তব্যস্থল সহ ছাড়ার বিস্তারিত সময় কাগজে সেঁটে দেয়া আছে। সবগুলোর গন্তব্যস্থল জার্মানী- ক্লোন, ফ্রাংফুর্ট, হ্যানোভার, ব্রেমেন, ডর্টমুণ্ড। কিন্তু তার দরকার মিউনিখগামী গাড়ি। দ্রুতই তা খুঁজে বের করে লাইসেন্স নাম্বার সহ যাবতীয় তথ্য টুকে নিলো একটা কাগজে। অবশ্য লরির সামনের অংশ দেখেই, এটাকে সনাক্ত করা সম্ভব, কেননা উইগুস্ক্রিনে বড় করে লেখা আছে ‘ববি’। ওয়াল থেকে নামার সাথে সাথেই ঘেউ ঘেউ আওয়াজ কানে আসলো তার। পাহারারত কুকুর অনাকাঙ্খিত অতিথির উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে।
আধাঘণ্টা আগেই ড্রাইভারকে দেখেছে সে। লরিতে উঠে নিজের কাগজপত্র গোছাচ্ছে লোকটা। লম্বা দেহের অধিকারী ড্রাইভার, শরীরে একফোঁটা মেদ নেই, মাথায় চুলের অস্তিত্ব না থাকলেও গোঁফ একদম রাজকীয়। ড্রাইভারের চেহারায় কিছু যায় আসে না তার, সাহায্য পেলেই হলো। সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে, রাতটা নিজের গাড়িতেই পার করেছে সে। সকাল থেকেই ড্রাইভারের উপর নজর রাখছে। এছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই তার সামনে। অন্য কোন পরিকল্পনা না থাকার কারণে কিছুটা নার্ভাস বোধ করছে। আর কী বা করার আছে তার, হোটেল রুমে বসে পুলিশের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া?
শেষমেশ, ছয়টার একটু আগে ড্রাইভার লরির কাছে আসে। প্রায় পনেরো মিনিট ধরে কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করে। ফর্ক-লিফট অপারেটর আর অন্য এক ড্রাইভারের সাথে কিছুক্ষণ দুষ্টামি করার পর গাড়িতে চড়ে বসে। ঠিক এমন সময়ে নিজের গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায় সে। তাড়াতাড়ি গাড়ির পেছনের বুট খুলে, নিজের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নেয়।
*
“আমি না কখনো বিনা পয়সায় ভ্রমণ করিনি, খুবই ভয় লাগে আমার।”
নড করলো ববি। একটা মেয়ের এমন না করাটাই ভাল। মেয়েটার বিবেকবোধ মুগ্ধ করলো তাকে; রাস্তায় হাত নেড়ে গাড়ি না থামিয়ে, এখানেই এসে পড়েছে।
“কিন্তু তোমাদের এতো এতো লরি ড্রাইভারের মাঝে, অবশ্যই কাউকে পাবো যে এই অসহায়ের সাহায্যে এগিয়ে আসবে।”
অ্যালেক্সের এই কূটনীতিক চালে কিছুটা বিস্মিত ববি। যদিও তার কাছে অ্যালেক্স নামে না, বরং ক্লোই নামেই পরিচিত।
“আমি রবার্ট। যদিও সবাই আমাকে ববি নামেই ডাকে,” বলে লরিতে লাগানো স্টিকারের দিকে আঙুল তাক করলো সে।
এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না, মেয়েটা তার সাথে যেতে চাইছে।
“প্লেনের টিকেট তো এখন বেশ সস্তা। অনলাইনে চল্লিশ ইউরো দিয়েই পাওয়া যায়। আর সময়ও তো কম লাগে।”
“আমি আসলে যাতায়াতে এতো খরচ না করে, ওখানে যেয়ে খরচ করতে চাই। আর তা ছাড়া এমন জার্নি মানে তো নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া, ঠিক বলেছি না?”
*
ববি বেশ সাধারণ আর মিশুক টাইপের ছেলে- অ্যালেক্সকে দেখার পর থেকেই তাকে নিয়ে যাবার ব্যাপারে কোন দ্বিধা ছিল না তার মনে। ববির প্রতিক্রিয়ার দিকে খেয়াল না রাখলেও, মুখভঙ্গির দিকে ঠিকই নজর ছিল তার। চোখে ছিল কামনার তীব্র আকুতি, এই জিনিসটাই একটু ভয় ধরিয়ে দিলো অ্যালেক্সের মনে। তবে এমন ছেলেদের সাথে কী করতে হয় তা বেশ ভালমতোই জানে সে। লরির রিয়ার ভিউ মিররের কাছে মাতা মেরির একটা মূর্তি দোল খাচ্ছে। এছাড়াও ড্যাশবোর্ডের কাছে রয়েছে ছোট একটা গ্যাজেট; ডিজিটাল ফটো ফ্রেম। একের পর এক ছবি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেল সে। আর এদিকে ববি একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে। ফটো ফ্রেমটা মিউনিখ থেকে কিনেছে ত্রিশ ইউরো দিয়ে। এরপরেই তার পরিবার, বাড়ি, কুকুর আর সন্তানের গল্প শুরু করলো।
“আমার দুই ছেলে আর এক মেয়ে- গিয়োম, রোমেন, ম্যারিয়ন। গিয়োমের বয়স নয় বছর, রোমেনের সাত আর ম্যারিয়নের চার
যে কোন ব্যাপারে বিস্তারিত আর নির্ভুলভাবে বলা তার অভ্যাস। এতোক্ষণ ধরে চলা আলাপচারিতায় নিজের পরিবারের বাইরে একটা কথাও বলেনি সে।
“আমার পরিবারের কথা বলে আপনাকে বিরক্ত করছি, তাই না?”
“না। না। মোটেও না। বরং আমার ভালোই…”
“আপনার এমন আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে।”
এরইমাঝে সন্ধ্যা নেমে এলো। উষ্ণ পরিবেশ উপভোগ করছে দুজনেই। “আপনি চাইলে একটু ঘুমিয়ে নিতে পারেন। পেছনেই স্লিপিং বার্থ আছে। আমার তো চালিয়ে যেতে হবে, কিন্তু আপনি চাইলে…”
এই অফার সানন্দে গ্রহণ করলো অ্যালেক্স। একঘণ্টা ঘুমানোর পর জেগে উঠলো।
“আমরা এখন কোথায় আছি?” চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে জিজ্ঞেস করলো সে।
“ওহ, আপনি উঠে গেছেন। ঘুম ভাল হয়েছে তো? আমরা সেন্ট মেনেহুল এ চলে এসেছি।”
এতোটা আশা করেনি অ্যালেক্স। এমন অগ্রগতিতে বেশ খুশি হলো। তবে ঘুমটা একদম ভালো হয়নি। বোর্ডারের দিকে এই যাত্রা, এক নতুন দিগন্ত খুলে দিবে তার জীবনে, নতুন উদ্যমে সম্পন্ন করবে অসমাপ্ত কাজটুকু।
*
একসময় এই আলাপচারিতা থেমে গেল। দু-জনেই কান পাতলো রেডিওতে। তবে যাত্রা বিরতির সময় বেশ সতর্ক অবস্থানে চলে যায় অ্যালেক্স। টানা গাড়ি চালানোর ক্লান্তি দূর করতে মাঝে মাঝেই কফি পানের জন্য থামছে ববি কোন লোকজন সে দেখলেই আড়ালে চলে যায়, পারতপক্ষে নিচেই নামে না। তবে সার্ভিস স্টেশনে ঝুঁকি কম থাকায় নিচে নেমে বুকভরে মুক্ত বাতাস নেয়। এরইমাঝে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
“ওখানে কি পড়ালেখার জন্য যাচ্ছো?”
এমন বোকার মত প্রশ্ন করে ফেলায় কিছুটা বিব্রতবোধ করলো ববি। নিজেও বুঝতে পারছে, মেয়েটার বয়স কম করে হলেও ত্রিশ হবে। মুচকি হেসে পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করলো অ্যালেক্স।
“আরে, না, না। আমি পেশায় একজন নার্স। ওখানে যাচ্ছি কাজের খোঁজে।”
“যদি কিছু মনে না করো, একটা প্রশ্ন করি। জার্মানিই কেন?”
“কারণ আমি জার্মান ভাষায় কথা বলতে পারি না,” নিজের সবটুকু আত্মবিশ্বাস জড়ো করে বলল সে।
মুখ চেপে হেসে উঠলো ববি; কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারে নি। “তাইলে তো তুমি চীনেও যেতে পারতে। চাইনিজ ভাষাও তো মনে হয় পারো না, তাই না?”
“আসল কারণ হলো, আমার বয়ফ্রেণ্ড মিউনিখে থাকে।”
“ওহ…
ববি এমনভাবে মাথা ঝাঁকালো যেন সব বুঝতে পেরেছে। “তা তোমার বয়ফ্রেণ্ড কী করে?”
“ও জার্মানিতে একটা আই.টি ফার্মে চাকরি করে।”
“জার্মান নাকি?”
নড করলো অ্যালেক্স। ববির কথার পালে একটু হাওয়া দিতেই যেভাবে এগুচ্ছে, তা মোটেও ভাল লাগছে না তার।
“তোমার স্ত্রী সম্পর্কে কিছু বলো?”
কফির কাপ ময়লার বিন এ ছুঁড়ে দিলো ববি। স্ত্রীর প্রসঙ্গ উঠতেই কিছুটা মনক্ষুণ্ণ মনে হলো তাকে। ফটো ফ্রেমের স্লাইড শো তে তার স্ত্রীর ছবি ভেসে উঠলো। চল্লিশোর্ধ্ব মহিলাকে দেখেই অসুস্থ মনে হলো।
“মাল্টিপল স্কেরোসিস,” নিচুস্বরে বলল সে। “ভাবতে পারো ব্যাপারটা? আমার তিনটা ছেলেমেয়ে, এদেরকে কে দেখবে? এখন ওই ওপরওয়ালার উপর ভরসা করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই।”
রিয়ার ভিউ মিররের কাছে দুলতে থাকা মাতা মেরির মূর্তির দিকে শ্রদ্ধাভরা দৃষ্টিতে তাকালো ববি।
“তোমার মনে হয় উনি তোমাকে সাহায্য করার জন্য বসে আছে?”
এই কথা শোনার পরপরই অ্যালেক্সের দিকে ঘুরে গেল ববি। ধর্মের ব্যাপারটা কখনোই বুঝে উঠতে পারে না অ্যালেক্স। এতো বাঁধাধরা নিয়ম তার ভাল লাগে না। তার মানে এই না যে, ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা নেই তার।
“তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো না, তাই না?” হেসে হেসে বলল ববি। অ্যালেক্স কিছুই বলল না।
“আসলে কী জানো, যদি আমার কোন ধর্ম না থাকতো…”
“তোমার এই ঈশ্বরই তো তোমাকে এই বিপদে ফেলেছে। তারপরেও ভক্তি কমে না?”
“তুমি ভুল বুঝলে। আসলে ঈশ্বর আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন।”
“আচ্ছা। এই ব্যাপারে আমিও দ্বিমত পোষণ করবো না…”
এরপরেই হুট করে দু’জনেই থেমে গেল।
“এখানে আমি সবসময় এক ঘণ্টার জন্য বিরতি নেই।”
শহর থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে রয়েছে তারা।
গাড়ি থেকে নেমে নিজের হাত পা প্রসারিত করলো সে। এতোক্ষণ টানা গাড়ি চালানোর ফলে হাত পা জমে গিয়েছিলো। এখন একটু ঠিকঠাক করে নিচ্ছে। আজকে যেন একটু বেশি সময় নিচ্ছে, ব্যাপারটা অ্যালেক্সের চোখ এড়ালো না। সবসময়ই কি এমন করে? একটু পরেই গাড়ির কাছে চলে আসলো ববি
“শোনো আমি এখন এক ঘণ্টা ঘুমাবো। চিন্তার কিছু নেই। আমার অ্যালার্ম দেয়া আছে, আমি ঠিক সময়ে উঠে পড়বো।”
“ঠিক আছে। তুমি ঘুমাও, আর আমি এর মাঝে একটু হাঁটাহাঁটি করে আসি। একটা ফোনও করতে হবে।”
“আচ্ছা যাও তুমি। আর তোমার বয়ফ্রেণ্ডকে আমার শুভেচ্ছা দিও।”
*
পার্কিং এরিয়ায় ঘোরাঘুরি করছে অ্যালেক্স। অগণিত সারিবদ্ধ গাড়ির মাঝ দিয়ে হাঁটছে আর কিছু একটা ভাবছে। গভীর রাতে একা একা হাঁটার কারণে, একটা শিহরণ বয়ে গেল তার শরীরে!
এখানে তার উপস্থিতিই প্রমাণ করছে লক্ষ্যপূরণের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। যদিও ভাবখানা এমন যেন আর কোন চাওয়া পাওয়া নেই তার, আদতে এখনো নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তামগ্ন হয়ে আছে। খুব শীঘ্রই আসছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ…
নিচুস্বরে কাঁদতে শুরু করলো। তার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দেয়ার মত কেউ নেই। আশেপাশের লরিগুলো যেন তার কান্নায় সম্মতি জানিয়ে নিশ্চুপ হয়ে আছে। একটা কথা বারবার মনে পড়লো তার- পাপ কখনো বাপকে ছাড়ে না। জীবন থেকে কেউ কখনো পালাতে পারে না।
*
রাস্তার দুই পাশেই রয়েছে সার্ভিস এরিয়া। রাস্তার উপরে পথচারী পারাপার হওয়ার জন্য ওভারব্রিজ, যার একপাশে কিছু ছোট ছোট দোকান। আর অন্য পাশে প্যারিসগামী রাস্তা। খুব সাবধানে লরিতে চড়ে বসলো সে, যাতে করে ববির ঘুম না ভাঙ্গে। খুটখাট শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠলেও, সাথে সাথে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় ববি
নিজের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে চেক করলো কিছু রেখে গেল কিনা। ড্যাশবোর্ডের নিচেও ভালমত দেখলো, পকেট থেকে কিছু পড়েছে কি না। এখানে তার উপস্থিতির কোন প্রমাণ রাখতে চায় না।
গাড়ির সিটে হাঁটু গেড়ে বসলো অ্যালেক্স।
“ববি….” কানের কাছে ফিসফিস করে বলল।
ববিকে চমকে দিতে চায় না। এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ববি। গ্লোভ কম্পার্টমেন্ট খুলে দেখলো-কিছুই নেই সেখানে। নিজের সিটের নিচে খুঁজেও কিছু পেলো না। অবশেষে ড্রাইভারের সিটের নিচে একটা প্লাস্টিকের বক্স পেয়ে টেনে বের করলো ওটা।
“ববি?” উবু হয়ে আবারো ডাকলো। এবার কিছুটা সাফল্য অর্জন করলো।
“কী?”
এখনো পুরোপুরি জেগে ওঠেনি ববি। ঘুমন্ত অবস্থাতেই প্রশ্ন করেছে। এমন সুযোগের অপেক্ষায় ছিল সে। স্ক্রু ড্রাইভারটা এমনভাবে ধরেছে যেন কোন ড্যাগার ধরে আছে, কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই ডান চোখে গেঁথে দিলো ওটা। একদম জায়গামত আঘাত করেছে। একজন পেশাদার নার্সের কাছ থেকে এমন আশা করাই যায়। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আঘাত করার ফলে, খুলির একদম ভেতরে চলে গিয়েছে স্ক্রু ড্রাইভার, যেন মগজ অবধি পৌছে গিয়েছে। ববি উঠে বসার চেষ্টায় হাত পা ঝাড়া দিচ্ছে। কিন্তু অ্যালেক্স চেপে ধরে আছে তাকে। উপায় না দেখে সে চিৎকার শুরু করলো। অন্যহাতে থাকা আরেকটা স্ক্রু ড্রাইভার চালিয়ে দিলো গলা বরাবর। এবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি, কেননা লক্ষ্যভেদ করার জন্য যথেষ্ট সময় ছিল তার হাতে। কণ্ঠাস্থির ঠিক নিচে গেঁথে দিয়েছে দ্বিতীয় স্ক্রু ড্রাইভার। হুট করেই চিৎকার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নিচুস্বরের কিছু অস্পষ্ট আওয়াজ শোনা গেল। একটু উবু হয়ে ববির আরো কাছে চলে এলো। ভ্রুকুটি করে বলল, “আমি তোমার কোন কথাই বুঝতে পারছি না।”
কোন দ্বিধায় না ভুগে নিজের পরিকল্পনামত এগিয়ে গেল অ্যালেক্স। গলা থেকে স্ক্রু ড্রাইভার বের করে হাড়ে ঢুকিয়ে দিলো। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো। নিচে নেমে ব্যাগ থেকে এসিডের বোতল বের করলো। ববি অর্ধমৃত অবস্থায় পড়ে আছে, প্রতিরোধের কোন শক্তিই নেই তার মাঝে। কিন্তু এর মুখ খোলার জন্য একটা হাতুড়ি দরকার তার। টুলবক্স থেকে একটা ছোট হাতুড়ি নিয়ে নিলো। টুলবক্সের এই এক সুবিধা, দরকারি প্রায় সবকিছুই থাকে এখানে। হাতুড়ি দিয়ে উপরের আর নিচের পাটির কয়েকটা দাঁত ভাঙ্গলো। এসিড ঢালার মত যথেষ্ট জায়গা হওয়ার পর থামলো সে। এসিড ঢালার পর ববির অনুভূতি কেমন হবে? এই প্রশ্ন একবার তার মাথায় উঁকি দিলো। তবে এসব নিয়ে না ভেবে, সাথে থাকা এসিডের পুরোটুকু ঢেলে দিলো ববির গলা দিয়ে।
জামায় রক্ত লেগে গেছে তার। এই অবস্থায় বের হওয়া সম্ভব না। ব্যাগ থেকে একটা টি-শার্ট বের করে গায়ে চড়ালো। হাতে লেগে থাকা রক্ত পানি দিয়ে ধুয়ে রক্ত লেগে থাকা জামায় হাত মুছে নিলো। জামাটা গাড়ির সিটে ছুঁড়ে ফেলে প্যারিসের দিকে রওনা দিলো ।
নষ্ট করার মত সময় নেই তার। তাই, দ্রুতগতিতে আসা একটা গাড়ির দিকে হাত নাড়লো। তাকে অবাক করে দিয়ে গাড়ি থেমে গেল। গাড়ি সম্পর্কে খুব একটা ধারণা নেই তার, তবে গতি দেখেই বুঝতে পেরেছে, দ্রুত প্যারিসে পৌঁছুতে এর চেয়ে ভাল কিছু পাবে না। চালকের আসনে বসে আছে ত্রিশোর্ধ্ব এক মহিলা, ঘন কালো চুলের অধিকারী। অ্যালেক্স আকুতি করার সাথে সাথেই রাজি হয়ে যায়। পিছনের সিটে ব্যাগ রেখে মহিলার পাশে বসে পড়লো সে।
“যাওয়া যাক, তাহলে?”
“হ্যালো, আমার নাম অ্যলেক্স।”