অ্যালেক্স – ১৫

অধ্যায় ১৫ 

যদি তুমি কখনো একটা ইঁদুর দেখো তাহলে ধরে রাখো আশেপাশে কমপক্ষে আরো নয়টা ইঁদুর আছে-সে মনে করার চেষ্টা করলো, এমন কথা কোথায় শুনেছিলো। এখন পর্যন্ত সাতটার দেখা পেয়েছে। বেশিরভাগ সময়ে ইঁদুরগুলো রশি বেয়ে ওঠানাম করে, মাঝেমাঝে ঝুড়িতেও যায়। সবচেয়ে বড় ইঁদুরটা আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছে, তাছাড়া দেখতেও এটাকে পেটুক মনে হয় না। বরং তার ধারণা, এই ইঁদুর দক্ষ, কখন শিকার করতে হবে তা ভালমতোই জানে। ইঁদুরগুলো বাক্সের উপরের দিকেই থাকে। তার সবচেয়ে বেশি ভয় লাগে যখন ইঁদুরগুলো গুটি গুটি পায়ে এসে গন্ধ শুঁকতে শুরু করে। এরইমাঝে আবার কিছু কিছু ইঁদুর আছে যেগুলো মাঝেমধ্যে নাছোড়বান্দা হয়ে ওঠে, যেন সেগুলো আঁচ করতে পেরেছে প্রতিরোধ করার কোন সামর্থ্যই নেই বন্দীর ইঁদুরগুলো দিনে দিনে আরো সাহসী হয়ে উঠছে। আজকে সকালেই একটা মাঝারি সাইজের ইঁদুর অন্যদের টেক্কা দিয়ে তার শরীরে এসে পড়ে, ঘেন্নায় গা গুলিয়ে ওঠে তার, চিৎকার দেয় সে। তার চিৎকারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ইঁদুর দৌড়ানো শুরু করে। আর ছোট একটা ইঁদুর আছে, যেটাকে দেখলেই অতিশয় লোভী মনে হয়। প্রায়ই তার কাছে এসে গন্ধ শুঁকে, সে সরে গেলে আরো কাছে চলে আসে। আর চিৎকার শুরু হলে, কিছুটা পিছ পা হয়। 

ট্র্যারিক্স আসে না অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, কমপক্ষে একদিন, দুইদিনও হতে পারে। আরেকটা দিন প্রায় শেষের পথে। যদি সে জানতে পারতো আজ কী বার? অথবা কয়টা বাজে…সে কিছুটা বিস্মিত কেননা ট্র্যারিক্স এখনো আসেনি, এমন তো হয় না। আরেকটা ব্যাপার তাকে ভাবিয়ে তুললো। ট্র্যারিক্স তো পানি নিয়ে আসতো, যা খেয়ে সে বেঁচে আছে। ট্র্যারিক্স নেই মানে, পানির সাপ্লাইও বন্ধ। আর মাত্র আধবোতল পানি আছে। গতরাতে একটু পানি খেয়ে থেকেছে। আর তাছাড়া ইঁদুরগুলোকে খাবার দিলে একটু কম বিরক্ত করে, খাবার না পেলে ওগুলো অধৈর্য হয়ে ওঠে। 

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, অ্যালেক্স এখন বেশি চিন্তিত ট্র্যারিক্স তাকে পরিত্যাগ করলো কিনা এই ভেবে। তাকে খাবার, পানির অভাবে এখানে ধুঁকে ধুঁকে মরতে রেখে গেল কিনা। আর ইঁদুরগুলো এখনি যেমন করে, সময় গড়ালে আরো ভয়াবহ রূপ নেবে সেগুলো। 

অধ্যায় ১৬ 

সকাল সাতটা বাজে। 

“শোনো, আমি চাই তুমি সব ঝামেলা এড়িয়ে চলো,” ক্যামিলকে একপাশে নিয়ে গিয়ে বলল লা গুয়েন। 

কিন্তু সে এসবের ধার ধারে না। 

“যাক, শুরুটা ভালই হলো তাহলে…” হাসিমুখে বলল লা গুয়েন। 

ভিডার্ড আসার সাথে সাথেই দরজা খুলে দিলো ক্যামিল। দেয়ালে গেঁথে রাখা ছবির দিকে আঙুল তুলে বলল, “আপনি তো ভিক্টিমকে নিয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন, আশা করি এই ছবি দেখে আপনি খুশি হবেন। ভিক্টিম তো খুব ভাল অবস্থায় আছে।” 

ছবিগুলো বড় করে দেয়ালে লাগানো হয়েছে, দেখে মনে হচ্ছে কোন পর্ণ মুভির পোস্টার। তবে ছবিগুলো দেখলেই গা শিউরে ওঠে। একটা ছবিতে ফোকাস করা হয়েছে মেয়েটার মুখে। তার চোখে মুখে ভয় আর অজানা শংকার কালো ছায়া, ছোট জায়গায় কুঁকড়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে সে। আরেকটা ছবিতে ফোকাস করা হয়েছে হাতের দিকে। যেখানে দেখা যাচ্ছে তার নখের নিচে রক্ত জমাট বাঁধা, বোঝা যাচ্ছে যে বাক্সের দেয়ালে প্রচুর আঁচর কেটেছে বাঁচার জন্য। এমনি আরেক ছবিতে দেখা যাচ্ছে এক হাতে পানির বোতল, কিন্তু বোতল থেকে পানি খাওয়ার মত যথেষ্ট জায়গা নেই, তাই হাতের তালুতে করে পানি খাচ্ছে। সারা পায়ে বিষ্ঠা সহ আরো নোংরা জিনিসের ছড়াছড়ি, এতে বোঝা যাচ্ছে বাক্স থেকে মেয়েটা এক মুহূর্তের জন্যও নড়াচড়ার সুযোগ পায় না। জীবিত থাকার কারণে ছবিটা আরো বীভৎস লাগছে। তার ভাগ্যে কী আছে, তা ভাবতেও অবাক লাগে। 

ক্যামিলের খোঁচা সহ্য করে ছবিগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো ম্যাজিস্ট্রেট, এরই মাঝে চোখে চশমা পড়ে নিয়ে নিয়েছে। সবাই যেন নীরব দর্শক হয়ে গেল। সবাই বলতে আরম্যান্ড, লুইস, লা গুয়েন, আর টিমের বাকি ছয় গোয়েন্দা। 

ম্যাজিস্ট্রেট গভীর চিন্তায় ডুবে আছে, ছবিগুলো তাকেও হতবিহ্বল করে ফেলেছে। এদিকে ক্যামিল ভাবছে, লোকটা বলদ হতে পারে, কিন্তু কাপুরুষ নয়। 

“ভেরহোভেন, আমি জানি ট্র্যারিক্সের বাসায় ওই অভিযানের সিদ্ধান্তের কারণে তুমি আমার উপর নারাজ; কিন্তু তুমি শুরু থেকে যেভাবে তদন্ত পরিচালনা করেছো তাতে আমিও খুশি না,” বলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ম্যাজিস্ট্রেট। 

ক্যামিল কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই, হাত তুলে তাকে থামার নির্দেশ দিলো ম্যাজিস্ট্রেট। 

“তোমার মতের সাথে আমার মত কখনোই মিলবে না। আমরা পরে কোন এক সময় এই বিষয়টা সমাধান করবো। এখন আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিৎ দ্রুততার সাথে ভিক্টিমের অবস্থান শনাক্ত করা।” 

“লোকটা আসলেই একটা বাস্টার্ড, তাও আবার যেনতেন ধরনের না, একদম খাঁটি, ধূর্ত প্রকৃতির” মনে মলে বলল ক্যামিল। লা গুয়েন প্রমাদ গুণছে, কখন এই অবস্থার পরিবর্তন হবে, হালকা করে কাশলো সে। 

“আর হ্যা লা গুয়েন, অল্প সূত্র নিয়ে এতো তাড়াতাড়ি অপরাধীর খোঁজ বের করার জন্য, তোমার টিমকে জানাই সাধুবাদ। সত্যিই দারুণ দেখিয়েছো তোমরা।” 

ক্যামিল আর সহ্য করতে পারলো না। 

“আপনি কি নির্বাচনে দাঁড়াবেন নাকি? নাকি আপনি এভাবেই কথা বলে অভ্যস্ত?” জিজ্ঞেস করলো সে। 

আরেকদফা নীরবতায় ডুবে গেল লা গুয়েন। সানন্দে জিভ দিয়ে একবার নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো লুইস। আরম্যান্ড নিচের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। 

“ভেরহোভেন, কাজের প্রতি তোমার যে ত্যাগ তা আমি জানি। আর আমি তোমার ব্যক্তিগত জীবন কীভাবে কাজের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিলো তাও কিন্তু ভালমতই জানি।”

এই কথা শুনে লুইস আর আরম্যান্ড দুজনেই হাসি থামিয়ে দিলো। ক্যামিল আর লা গুয়েন সর্বোচ্চ সতর্ক হয়ে গেল। ম্যাজিস্ট্রেট আরেকটু সামনে এগিয়ে এলো। 

“হ্যা আমি জানি এই কেস নিয়ে তোমার আলাদা একটা তাড়না কাজ করে। কিন্তু এভাবে চললে তো…তোমার ব্যক্তিজীবনের কোন ঘটনার সাথে একে জড়িয়ে ফেললে…” 

তার কথায় হুমকিটা স্পষ্ট। ক্যামিল আর লা গুয়েনসহ বাকিরাও বুঝতে পারলো। 

“অবশ্য এই ব্যাপারে আমি কিছুই করবো না। কিন্তু আমি আশা করবো লা গুয়েন ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্তই নিবে, এইটুকু বিশ্বাস তার উপর আছে আমার।” 

ক্যামিল এখন একটা ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত; ম্যাজিস্ট্রেট উচ্চ শ্রেণির বোকাচোদা। 

ক্যামিল তার দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জানে, এই ধরণের খুনিরা কেমন অনুভব করে, কোন কারণ ছাড়াই যারা মানুষকে হত্যা করেঅন্ধ আক্রোশের বশবর্তী হয়ে। স্বামী তার স্ত্রীর শ্বাসরোধ করে, স্ত্রী স্বামীকে ছুরিকাঘাত করে, সন্তান তার পিতাকে ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়, বন্ধু বন্ধুকে গুলি করে, এক প্রতিবেশী তার আরেক প্রতিবেশীর সন্তানকে অপহরণ করে। ঠিক এই মুহূর্তে তার একটা কেসের কথা মনে পড়ছে যেখানে এক কমান্ডিং অফিসার ম্যাজিস্ট্রেটকে গুলি করে হত্যা করে। সে কিছুই বলল না। ম্যাজিস্ট্রেট পরোক্ষভাবে আইরিনের কথা তোলার পরেও উপযুক্ত জবাব দেওয়া থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করার জন্য বেশ কষ্ট করতে হলো তার। অবশ্য এই শক্তিও তাকে দিয়েছে তার মৃত স্ত্রী আইরিন। এখন সে বুঝতে পারছে ম্যাজিস্ট্রেট ইচ্ছে করেই তার স্ত্রীর প্রসঙ্গ তুলেছে, তাকে তাতিয়ে দেয়ার জন্য। আর এই মেয়েটাকে জীবিত উদ্ধার করার ব্যাপারে আগেই শপথ নিয়েছে ক্যামিল। 

ক্যামিল একদিন তাকে সত্যি সত্যিই খুন করবে, খালি হাতেই করবে।

“আর লা গুয়েন, কেসের অগ্রগতির ব্যাপারে আমাকে প্রতিনিয়িত জানাবেন,” বলেই চলে গেল ম্যাজিস্ট্রেট। 

*

“দুটি বিষয়ের প্রতি আমাদের এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমত, ট্র্যারিক্স-এর সম্পর্কে যা যা জানা সম্ভব, তার সব জোগাড় করতে হবে। মোটকথা তার জীবনের খুঁটিনাটি সব খুঁজে বের করতে হবে। মেয়েটার সাথে তার কোন না কোন সম্পর্ক আছে, সেটাই বের করতে হবে। কেননা আমরা এখনো মেয়েটার সম্পর্কে কিছুই জানি না, মেয়েটা কে কিংবা তাকে কেন অপহরণ করা হয়েছে। প্রথমকাজে সফল হওয়ার জন্য আমাদের হাতে আছে ট্র্যারিক্সের মোবাইল ফোন আর বাসার কম্পিউটার থেকে পাওয়া কন্ট্রাক্ট লিস্ট। খুব কম সূত্র থাকলেও, এই নিয়েই আমাদের কাজ করতে হবে,” টিমের বাকি সদস্যদের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলল ক্যামিল।

কাজ করার জন্য হাতে থাকা সূত্রগুলো খুবই নগণ্য। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা তাদের সবার মনে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে। কেননা একমাত্র ট্র্যারিক্সই জানতো মেয়েটাকে কী উদ্দেশ্যে অপহরণ করেছিলো, এখন সে মৃত, আর ওদিকে মেয়েটা মৃত্যুর প্রহর গুণছে। ক্ষুধা, পিপাসায় মেয়েটা ধীরে ধীরে মারা যাবে। ইঁদুরের কথা না হয় বাদই দিলো। ভেরহোভেনের টিম আর ফরেনসিক বিভাগের মাঝে যোগাযোগের জন্য লিয়াজোঁ হিসেবে মার্সান কে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। 

“আমরা যদি তাকে জীবিত খুঁজেও পাই, তাতেও বিপদ কম নয়। কেননা, পানিশূন্যতার কারণে কিছু স্নায়ুতান্ত্রিক জটিলতা দেখা দেয়। আমরা খুঁজে পেতে পেতে হয়তো দেখা যাবে, নিজের মানসিক ভারসাম্যটাই খুইয়ে বসবে মেয়েটা,” বলল মার্সান। 

“ভ্যান থেকে আর কিছু পাওয়া যায়নি?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল। 

“ফরেনসিক বিভাগ ভ্যানে একবার চিরুনি অভিযান চালিয়েছে। কিছু চুল আর রক্ত ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়নি। আমরা সেখান থেকে ডি.এন.এ প্রোফাইলও তৈরি করেছি, কিন্তু আমাদের ডাটাবেজে এমন কারো তথ্য নেই। তাই, আমরা এখনো জানি না ভিক্টিম আদতে কে,” বলল সে। 

“আর ই-ফিট এর কী খবর?” 

ট্র্যারিক্স এর পকেট থেকে তার ছেলের একটা ছবি পাওয়া গেছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে তার ছেলে অন্য একটা মেয়ের সাথে মেলায় গেছে, ছেলেটার কাঁধে মেয়েটা হাত দিয়ে রেখেছে। ছবির মেয়েটা একটু মোটা, তাই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না এই মেয়ে আর ভিক্টিম একই কিনা 

“আশার খবর হচ্ছে আমাদের হাতে ভাল কিছু ক্লু এসেছে। ভিক্টিমের কয়েকটা ছবি পাওয়া গেছে ট্র্যারিক্সের ফোন থেকে। বিভিন্ন দিক থেকে তোলা হয়েছিলো ছবিগুলো, যা আমাদের দরকার ছিলো। আজ বিকেলের মধ্যেই কিছু পেয়ে যাবেন।” 

মেয়েটার অবস্থান বের করাটা এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, প্রত্যেকটা ছবিই খুব কাছ থেকে তোলা হয়েছে, তাই জায়গাটা সম্পর্কে তথ্য পাওয়াটা খুব কষ্টসাধ্য। তবে এই ব্যাপারে এখনো কাজ চলছে। 

“বিল্ডিং এর সম্পর্কে বিস্তারিত এখনো জানা যায় নি। তবে রুমে আসা আলো থেকে এতোটুকু বোঝা যাচ্ছে যে রুমটা উত্তর-পূর্ব মুখী। এটা খুবই সাধারণ। আর ছবিতে যেহেতু রুম খুব কমই দেখা যাচ্ছে, তাই রুমের মাপ বের করা অসম্ভব। তবে আলো উপর থেকে আসছিলো, তার মানে সিলিং কমপক্ষে চৌদ্দ ফিট উপরে। সবগুলো ছবিই তোলা হয়েছে দিনের আলোতে, হয়তো সেখানে ইলেক্ট্রিসিটি নাই। আর অপহরণকারীর ব্যবহার করা জিনিসও খুবই সাধারণ। বাক্স তৈরির এমন কাঠ প্রায় সবখানেই পাওয়া যায়, রশিতেও তেমন কোন বিশেষত্ব নেই। তবে ইঁদুরগুলোকে আলাদা করে বড় করা হয়নি। তার মানে আমাদের এমন একটা বিল্ডিং খুঁজতে হবে যেটা পরিত্যক্ত। 

“ট্র্যারিক্স দিনে দুইবার মেয়েটাকে দেখতে যেতো, তার মানে জায়গাটা প্যারিসের আশেপাশেই হবে,” বলল ক্যামিল। 

ক্যামিলের সাথে সবাই একমত পোষণ করলো। তার মনে হলো এই ব্যাপারটা সবাই আগে থেকেই জানতো। নিজেকে আবারো অপদার্থ মনে হলো তার। মোরেল চলে আসার পরপরই কেসটা ছেঁড়ে দেওয়া উচিৎ ছিলো, নিজেকে এই বলে ধিক্কার দিলো। 

আরম্যান্ডের উপর দায়িত্ব পড়লো বর্ণনার সাথে মিলে এমন জায়গা খুঁজে বের করার। সানন্দে নিজের কাজ শুরু করলো সে। তবে তথ্যগুলো এতোটাই সাধারণ যে প্রতি পাঁচটা বিল্ডিং এর মাঝে তিনটার সাথেই মিলে যায় এর বর্ণনা। পুলিশ স্টেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্ৰায় চৌষট্টিটা সাইট আছে যেগুলো ‘শিল্পকারখানার পতিত জমি’ হিসেবে চিহ্নিত। এছাড়া আরো শত শত জায়গা খালি পড়ে আছে। 

“মিডিয়া থেকে কিছু পাওয়া গেছে নাকি?” লা গুয়েনকে জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল। 

“পাগল হয়েছো?” 

*

মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছিল লুইস, কী মনে করে আবারো ফিরে আসলো। 

“একটা ব্যাপার আমার খুব খটকা লাগছে। ট্র্যারিক্স এর মতো একটা মানুষ ‘ফিলেটে’ তৈরি করেছে, জিনিসটা ঠিক তার সাথে যায় না,” বলল লুইস। 

“না। আমার এমন মনে হয় না। তুমি ট্র্যারিক্সকে যেমন ভাবছো, আদতে সে এতো চালাকও না। সে ‘ফিলেটে’ বানায় নি, শব্দটা তুমি ব্যবহার করেছো। সে এমন একটা খাঁচা বানিয়েছে, যেটা খুব ছোট।” 

*

চোখ বন্ধ করে, নিজের চেয়ারে বসে ক্যামিলের কথা শুনছে লা গুয়েন। দেখে মনে হবে সে ঘুমাচ্ছে, আদতে এইভাবেই সে মনোযোগ দেয়। 

“জ্যঁ পিয়েরে ট্র্যারিক্স, বয়স তেপ্পান্নো, জন্ম ১৯৫৭ সালের ১১ই অক্টোবর। বেশ দক্ষ মেটালওয়ার্কার, অভিজ্ঞতা প্রায় সাতাশ বছরের। প্রথম কাজ করে ১৯৭০ সালে সুড এভিয়েশন কোম্পানীতে। দুবছর পর চাকরি হারায়। এরপর আবারো একটা হাসপাতালে রক্ষণাবেক্ষণ এর কাজ নেয়, সেখানেও দুই বছরের বেশি টিকতে পারেনি। বেশ কিছুদিন বেকার থাকার পর, এই বিল্ডিং সাইটে সিকিউরিটি গার্ড এর চাকরি পায়। নিজের বাসা ছেড়ে এখানেই থাকতো বেশিরভাগ সময়,”একটানা বলে নিঃশ্বাস নিলো ক্যামিল। 

“উগ্র নাকি?” 

“পাশবিক। ব্যক্তিগত জীবনে প্রচুর মারামারির রেকর্ড আছে, আর বেশ রগচটা; তার স্ত্রী রোজেলিনের মতে। ১৯৭০ সালে তাদের বিয়ে হয়। তাদের একটা ছেলে ছিলো। প্যাসকেল। এখানেই একটা মোড় আছে। এবার ছেলের প্রসঙ্গে পরে আসি।” 

“না। আমি এখনি শুনতে চাই।” 

“গত বছরের জুলাই থেকে ছেলেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।” 

“বলতে থাকো।” 

“আমি আর কিছু তথ্য পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। তবে স্কুল, কলেজ, ইন্টার্নশিপ, চাকরি কোন জায়গাতেই টিকতে পারেনি প্যাসকেল; সবখানেই একটা ভজগট পাকিয়ে এসেছে। ব্যর্থতার ষোলকলাই পূর্ণ তার। ২০০০ সালের দিকে তার বাবা হাসপাতালে একটা কাজ করে দেয়। তারা একে অপরের সহকর্মী। যখন প্যাসকেলের চাকরি চলে গেল, তখন তার বাবাও চাকরি ছেড়ে দিলো। একে অপরের সুখ-দুঃখের সাথী তারা। আবার যখন সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি নেয়, তখন তার বাবার সাথে থাকতে শুরু করে। একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, প্যাসকেলের বয়স কিন্তু ছত্রিশ! কিন্তু স্বভাবে তার প্রমাণ নাই। কেননা তার রুমে পাওয়া গেমস, এক্স-বক্স, পর্ণ সাইটের ঠিকানা এই সব দেখে আপনি তাকে টিনএজার ভাববেন, যতক্ষণ না বিছানার নিচে বিয়ারের কয়েকটা বোতল পাবেন। কিন্তু ২০০৬ সাল থেকে ছেলেটা নিখোঁজ।” 

“কোন তদন্ত হয়নি?” 

“হয়েছে এক রকম। বাবা বেশ উদ্বিগ্ন ছিলো, প্রায় প্রতিদিনই পুলিশ স্টেশনে গিয়ে বসে থাকতো। কিন্তু পুলিশ এক কথায় সব শেষ করে দিয়েছে। নিজের জামাকাপড়, ব্যক্তিগত জিনিসপত্র আর ছয়শ তেইশ ইউরো নিয়ে বের হয়েছে- তার মানে কোন মেয়ের সাথে ভেগেছে। এরপর পুলিশ তাকে ‘মিসিং পারসনস ইউনিট’ এ পাঠায়। সেখান থেকে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে, পুরো প্যারিস জুড়ে খুঁজেছে, তাও পাওয়া যায়নি। কিন্তু ট্র্যারিক্স দমে না গিয়ে এর বিচার চাইলো। কয়েকমাস পর তার বাসায় একটা চিঠি আসলো পুলিশের কাছ থেকে ‘আপনার ছেলেকে খুঁজে পাওয়ার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।’ আমার ধারণা ছেলেটা এখন দেখা দিবে, যেহেতু তার বাবা মারা গেছে।” 

“আর মায়ের কী খবর?” 

“১৯৮৪ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। আদতে মহিলাই তার স্বামীকে ছেড়ে দেয়; নিষ্ঠুরতা, বেদম প্রহার, বাজে ব্যবহার, অতিরিক্ত মদ্যপান এসব কারণে। প্যাসকেল তার বাবার সাথেই রয়ে গেল, যেন একই বৃন্তে দুটি ফুল। এরপর ওই মহিলা আবারো বিয়ে করে, এখন অন্য এক জায়গায় থাকে। তার নাম…থাক, বাদ দেন। আমি লোক পাঠিয়েছি তাকে তুলে আনতে।”

“আর কিছু?” 

“হ্যা। ট্র্যারিক্সের ফোনটা তার নিজের না। তার মালিক তাকে দিয়েছিলো যোগাযোগ করার জন্য। এমনিতে মালিক ছাড়া অন্য কাউকে ফোন দিতো না। টুকটাক যা দিতো তাও নিজের কাজের লোকজনকেই। কিন্তু হুট করেই একটা পরিবর্তন দেখা যায়। কল লিস্টে প্রায় দশ বারোটা নাম্বার পাওয়া যায় যাদের সাথে সে যোগাযোগ করে। একবার, দুইবার, তিনবার…” 

“তো?” 

“তার এই পরিবর্তন শুরু হয় পুলিশের তরফ থেকে আসা ‘ব্যর্থতার’ সেই চিঠি পাবার দুই সপ্তাহ পর থেকে আর শেষ হয় অপহরণের তিন সপ্তাহ আগে।” 

লা গুয়েন নির্বাক হয়ে গেল। 

“ট্র্যারিক্সের ধারণা পুলিশ এতোদিন ধরে বাল ছিড়েছে। তাই নিজেই তদন্ত শুরু করে দিয়েছিলো।” 

“তোমার ধারণা ভিক্টিম মেয়েটার সাথেই ভেগেছিলো ওই ছেলে?”

“হ্যা। আমার তাই মনে হয়।” 

“কিন্তু আমার যদ্দুর মনে পড়ে তুমি বলেছিলো ছবির ওই মেয়েটা মোটা ছিলো। কিন্তু ভিক্টিম তো মোটা না।” 

“আপনি মোটা বলতে কতটুকু বুঝেছেন কে জানে। হতে পারে মেয়েটা একটু শুকিয়ে গিয়েছে। আমি শুধু এতোটুকুই মানি ভিক্টিম আর ওই মেয়ে একই।” 

অধ্যায় ১৭ 

শুরু থেকেই ঠাণ্ডায় কষ্ট করছে অ্যালেক্স, যদিও সেপ্টেম্বরের তুলনায় ঠাণ্ডা তেমন একটা পড়েনি। শরীর এখন আগের চেয়ে বেশি দূর্বল, একটুও নড়তে পারছে না, তার উপর যোগ হয়েছে পুষ্টির অভাবজনিত সমস্যা। পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে, কয়েক ঘণ্টার মাঝেই আবহাওয়া পরিবর্তন হয়ে গেছে। সারা আকাশ কালো মেঘে ঢেকে আছে, ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। তাপমাত্রা অনেক কমে গেছে, ফাঁক ফোকর দিয়ে বাতাস ঢুকছে, ঠাণ্ডায় কাঁপছে সে। শুরুর দিয়ে এই কাঁপুনির কারণ ছিল ভয়। 

ইঁদুরগুলো নিজেদের কান খাড়া করে রেখেছে। হঠাৎ করেই গুড়গুড় শব্দে মেঘ ডাকতে শুরু করলো, কিছুক্ষণ পরেই ওবৃষ্টি নামলো আকাশ ভেঙ্গে। বিল্ডিং এ যেন পানির ঢল নেমেছে। ইদুরগুলো পানির খোঁজে উপর থেকে নিচের দিকে নামতে শুরু করলো। অ্যালেক্স গুণে দেখলো, এখন মোট নয়টা ইঁদুরই আছে। এদের মধ্যে বিচিত্র রঙের একটা ইঁদুর এসেছে ইদানিং। সব ইঁদুর নিচে নামলেও, নিজের জায়গা থেকে নড়লো না এই ইঁদুর। 

শুকনো ইঁদুরের চেয়ে ভেজাগুলো দেখতে আরো বিশ্রী লাগে; সারা গা আরো নোংরা, চোখ আরো জ্বলজ্বল করে যেন সাক্ষাৎ শয়তান। লেজটা ভেজা অবস্থায় আরেকটু চুপসে যায় একদম সাপের লেজের মত। 

বৃষ্টি থামার পর শুরু হলো ঝড়, আর তার সাথে প্রবল বাতাস। ঠাণ্ডায় জমে শক্ত হয়ে গেছে অ্যালেক্স, কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে। একটু পরেই সারা শরীরে অসহ্য রকমের খিঁচুনি শুরু হলো। দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। বাতাসের গতি এতোটাই বেশি যে তা কাঠের বাক্সটাকেও দোলাতে লাগলো। 

ইঁদুরগুলো আবার আগের জায়গায় ফিরে এলো। তাকে দেখছে দূর থেকে। এমন সময় এক বজ্রপাতে পুরো ঘর আলোকিত হয়ে উঠলো। ভয়ে ইঁদুরগুলো ছুটতে শুরু করল যে যেদিকে পারে। 

শুধু একটা মাত্র ইঁদুর তার জায়গা থেকে নড়লো না, সেই বিচিত্র রঙের ইঁদুরটা। বরং মাথা নিচু করে এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে যেন সুযোগের অপেক্ষায় আছে কখন শিকারকে হাতে পাবে। অ্যালেক্সও বেশ সতর্ক অবস্থানে, নিচ থেকে ইঁদুরটার পেট দেখা যাচ্ছে, যা দেখে ঘেন্নায় বমি আসছে তার। 

ইঁদুরগুলো বেশ চালাক। কেননা তারা বেশ ভালমতোই বুঝতে পারছে তাদের শিকার ক্ষুধা, তৃষ্ণায় এমনিতেই দুর্বল হয়ে গেছে, এর সাথে যোগ করতে হবে একটু ভয়। তাই নানা ধরনের শব্দ করার চেষ্টা করছে। এতে তার কোন সমস্যা হচ্ছে না। বরফ শীতল বাতাসে একটু পর পর কেঁপে উঠছে সে। শুরুর দিকে ভাবছিলো মৃত্যুই তাকে মুক্তি দেবে। কিন্তু জীবিত অবস্থায় ইঁদুরের খাবার হয়ে মরতে হবে, এটা ভাবনায় ছিল না। 

মানুষের শরীর ইঁদুরের কয়দিনের খাবার উৎস হতে পারবে? 

এই ভেবে চিৎকার করে উঠলো অ্যালেক্স। 

প্রথমবারের মত খেয়াল করলো তার গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। 

অধ্যায় ১৮ 

লা গুয়েন অফিসের চারপাশে একটু হাঁটাহাটি করে ফিরে আসার পর ক্যামিল রিপোর্টের বাকি অংশ পড়ে শোনালো। এমন সময় খেয়াল করলো লা গুয়েন তার মুখে সূক্ষ্ম হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করছে। দিনে দুই তিনবার এমন করে সে, কখনো কখনো চারবারও হয়। ট্রেনিং এর সময় কড়া শাসনে থেকে এমন অভ্যাস হয়ে গেছে তার। 

“কন্ট্রাক্ট লিস্ট থেকে সাত-আট জনের নাম পেয়েছি। এদের সবাইকেই ট্র্যারিক্স কল করেছে। সবার কাছে প্রশ্ন ছিল প্রায় একইরকম। তার ছেলেকে নিখোঁজ হওয়ার আগে কেউ দেখেছে কিনা তাই জানতে চেয়েছে। আমাদের হাতে থাকা ওই ছবিটাই সবাইকে দেখিয়ে জানতে চেয়েছে মেলায় তার ছেলের সাথে থাকা ওই মেয়েটাকে কেউ চেনে কিনা।” 

মাত্র দুজন সাক্ষীর সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথা হয়েছে ক্যামিলের। বাকিদের সাথে কথা বলেছে লুইস আর আরম্যান্ড। লা গুয়েনের অফিসে শুধু তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কেই জানাতে আসেনি, আরেকটা কাজ আছে তার। ট্র্যারিক্সের সাবেক স্ত্রীর আসার কথা এখানে। ডিপার্টমেন্টের গাড়ি পাঠানো হয়েছে তাকে আনতে। 

“ট্র্যারিক্স সম্ভবত তার ছেলের ই-মেইল থেকে এই নাম্বারগুলো পেয়েছে। নানা ধরনের লোকজন আছে এই লিস্টে।” 

“ভ্যালেরি ট্যুকে, বয়স পয়ত্রিশ, প্যাসকেলের ক্লাসমেট, টানা পনেরো বছর তাকে ফুঁসলিয়ে বিছানায় নেয়ার চেষ্টা করেছে প্যাসকেল।” 

“বাহ। ছেলে তো বেশ ধারাবাহিক আর ধৈর্যশীল।” 

“প্যাসকেলের বাবা তাকে বেশ কয়েকবার ফোন করে জানতে চেয়েছে তার ছেলেকে দেখেছে কিনা। মেয়েটার মতে, প্যাসকেল একটু অদ্ভুত প্রকৃতির। একটু পাগলাটে স্বভাবের। কিছুক্ষণ চুপ থাকলে মেয়েটা আরো বলে, ‘ও তো একটা ফালতু টাইপের ছেলে। সারাদিন মেয়েদের পিছনে ঘোরাঘুরি করতো, উদ্ভট গল্প বলে মেয়েদের পটানোর চেষ্টা করতো। আদতে ও ছিল একটা বেকুব।’ যাই হোক, এই ব্যাপারে মেয়েটা কিছুই জানতো না।” 

“প্যাট্রিক জুপিয়েন, একটা লণ্ড্রী কোম্পানীর ডেলিভারি বয়, এর আগে অন্য এক জায়গায় কাজের সময় প্যাসকেলের সাথে পরিচয়। প্যাসকেলের সাথে অনেকদিন দেখা হয় না বলেই জানিয়েছে। মেয়েটাকেও চিনতে পারেনি। এছাড়া টমাস ভ্যাসোর নামে আরেকজন বন্ধু ছিলো, সেও কোন খবর দিতে পারেনি। আর ছিল ডিডিয়ের কোটার্ড, যার সাথে একটা মেইল ডেলিভারি কোম্পানীতে কাজ করেছে। সবার কাছ থেকেই প্রায় একই রকম উত্তর পাওয়া গেছে। কেউই প্যাসকেলের কোন খবর দিতে পারেনি। শুধুমাত্র একজন বলেছিলো প্যাসলেকের গার্লফেণ্ড থাকতে পারে। এই প্রসঙ্গ উঠতেই তার বন্ধু ভ্যাসোর বলল, ‘ওটা তো সারাজীবনে একবারই হয়েছে ওর সাথে।’ আর প্যাট্রিকের কাছ থেকে জানতে পেরেছি এক সপ্তাহের মত নাটালি নামের একটা মেয়ের পিছনে ঘুরেছিলো প্যাসকেল। কিন্তু কোন লাভ নাকি হয়নি।” 

“আচ্ছা। ভালো একটা সূত্র পেয়ে গেছো মনে হচ্ছে…” 

“না। মোটেও না। জুনের মাঝামাঝি সময়ে মেয়েটার সাথে পরিচয় প্যাসকেলের আর ঠিক একমাস পরেই মেয়েটার সাথে পালিয়ে যায়। বন্ধুদের সাথে পরিচয় করানোর মত সময় পায় নি।” 

দুজন মানুষ একে অপরের মুখোমুখি বসে আছে। ক্যামিল নিজের নোটবুকে কিছু একটা লিখছে আর একটু পর পর বাইরে তাকাচ্ছে যেন কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেরাচ্ছে। লা গুয়েন ব্যাপারটা খেয়াল করলো। একটু সময় দিলো ক্যামিলকে, তারপর বলল, “তো যা বলছিলে, চালিয়ে যাও।” 

“সত্যি বলতে কী…মেয়েটার ব্যাপারে একটা জিনিস আমার খুব অস্বাভাবিক লাগছে…” 

বলেই দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললো ক্যামিল । 

“দেখো, আমি জানি। আমি জানি যে মেয়েটা ভিক্টিম। আর ভিক্টিমকে জীবিত উদ্ধার করাটাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু, তুমি জিজ্ঞেস করলে আমি কী ভাবছি তাই বললাম।” 

লা গুয়েন উঠে বসলো। দু হাত সামনের ডেস্কের উপর রাখা। 

“এই কথাটা আমি তোমার কাছ থেকে আশা করি নি, ক্যামিল।”

“আমি জানি।” 

“গত সপ্তাহ থেকে মেয়েটা মেঝে থেকে দুইফিট উপরে থাকা একটা বাক্সে ঝুলছে আর তুমি কিনা…” 

“আমি বললাম তো আমি জানি। তবুও…”

“…শুধু ছবির দিকে তাকালেই তো বোঝা যায় মেয়েটা মারা যাচ্ছে।”

“হ্যা। তা ঠিক।” 

“আর যে পশুটা মেয়েটাকে অপহরণ করেছে, সে খুবই হিংস্র, পাড় মাতাল, আর অশিক্ষিত।”

ক্যামিল শুধু মাথা নেড়ে স্বীকার করে গেল। 

“এভাবে যে একটা মেয়েকে অত্যাচার করতে পারে, সেই লোক অবশ্যই মানুষের কাতারে পড়ে না।” 

এখনো চুপ করে আছে ক্যামিল। 

“…আর ওই পশুটা মেয়েটার খোঁজ দেয়ার চেয়ে ফ্লাইওভার থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের জীবন দেয়াটাকে শ্রেয় মনে করে।” 

ক্যামিল এমনভাবে চোখ বন্ধ করলো, যেন নিজের করা ক্ষতির বর্ণনা আর শুনতে চাইছে না। 

“আর তোমার মনে হয়, “মেয়েটার ব্যাপারে কিছু একটা অস্বাভাবিক?’ এই কথা তুমি অন্য কাউকে বলেছো?” 

কিন্তু সে যখন চুপ থাকে, তখন ঘটনা ভিন্ন। লা গুয়েন জানে, ক্যামিল কিছু ভাবছে গভীর মনোযোগ দিয়ে। 

“কিন্তু একটা জিনিস আমি মানতে পারছি না। মেয়েটার নিখোঁজ হওয়ার পরে কেউ কোন রিপোর্ট করেনি।” 

“ঈশ্বরের দোহাই লাগে ক্যামিল, এমন হাজারো নারী…” 

“…নিখোঁজ হয়। হ্যা, আমি সেটা জানি। এমন অনেকেই নিখোঁজ হয় যাদের খোঁজ করতে কেউ আসে না। কিন্তু এই যে লোকটা, ট্র্যারিক্স, সে যে নির্বোধ, এই ব্যাপারে তুমি একমত তো আমার সাথে?” 

“হ্যা, একমত।” 

“এই লোক তো খুব বেশি বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন না, তাই না?” 

“হ্যা, তাও মানি আমি।” 

“তাহলে আমাকে বলো এই মেয়েটার প্রতি এতো ক্রোধ কেন তার? আর এইভাবেই বা করার কী দরকার ছিলো?” 

লা গুয়েন কিছুই বুঝলো না। 

“দেখো, পুলিশ যখন পারেনি তখন লোকটা নিজেই নিজের ছেলেকে খুঁজতে বের হয়। একদিন কিছু কাঠ কিনে আনে, একটা বাক্স বানায়, মেয়েটাকে ধরে এনে এখানে আটকে রাখে। মেয়েটাকে ধীরে ধীরে কষ্ট দিয়ে মারার জন্য ফেলে রাখে। এরপর এসে ছবি তুলে পরখ করে ঠিক পথে এগুচ্ছে কিনা। আর তুমি বলতে চাইছো, এটা কোন রকম পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া আবেগের বশে করে ফেলেছে?” 

“এমনটা আমি কখনো বলিনি।” 

“হয়তোবা বলোনি। কিন্তু তোমার কথাতে তো তাই বোঝা যাচ্ছে। হুট করেই লোকটার মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। ওই সিকিউরিটি গার্ড ভাবে, আরে আমার ছেলে যে মেয়ের সাথে ভেগে গিয়েছে তাকে আমি কেন খুঁজে বের করছি না? খুঁজে বের করে তাকে বাক্সে বন্দী করে রাখি। এই ভেবে মেয়েটার খোঁজ বের করে, আর তাকে ধরে এনে খাঁচায় পুরে দেয়। ওর মত একটা নির্বোধ চাইলো আর মেয়েটাকে খুঁজে বের করলো, অথচ আমরা এখনো মেয়েটার সম্পর্কে কিছুই জানি না। লোকটাই তো আমাদের চেয়ে বেশি কাজ করেছে!!!” 

অধ্যায় ১৯ 

অ্যালেক্স এখন প্রায় ঘুমোয় না বললেই চলে। আসলে ঘুমোতে পারে না ভয়ের কারণে। এই খাঁচায় আর টিকতে পারছে না। যেদিন থেকে এখানে বন্দী সেদিন থেকেই ঠিকমতো খাওয়া, ঘুম কিছুই হয়নি তার। নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গও ঠিকমতো নাড়াচাড়া করতে পারেনি। এভাবে আর কয়দিন, ভাবলো সে। তার মনও তার সঙ্গ ছেড়ে দিয়েছে। এখন কিছুই ঠিকমতো দেখতে পায় না, সবকিছু কেমন জানি ঝাপসা লাগে। আর শব্দও যেন ঠিকমতো শুনতে পায় না, প্রতিটি শব্দ প্রতিধ্বনি মনে হয় তার কাছে। নিজের কণ্ঠস্বর শুনে নিজেই অবাক হয়। হতাশা আর ভয়ে ভেতর থেকে শুধু চাপা গোঙানি বের হয়ে আসে। 

হুট করেই তার মনে হয়, লোকটা আর ফিরে আসবে না। তার ভিতর কে যেন বলে উঠলো কথাটা। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সবকিছু বলে দেবে তাকে। শুধু সে আসুক, আমি তাকে সব বলবো। যা যা জানতে চায়, সবকিছুই বলবো। নিজেকে এই কথাগুলো বলতে থাকলো। এই অত্যাচার আর সহ্য হচ্ছে না তার। লোকটা আসলে সে মুক্তি চাইবে। এই মুক্তি জীবন অথবা মরন, যে রূপেই আসুক না কেন, তাতে কোন সমস্যা নেই। তার শুধু দরকার মুক্তি। 

ইঁদুরগুলো দিনে দিনে আরো অধৈর্য হয়ে উঠেছে। সকালবেলা সবগুলো মার্চ করতে করতে নিচে নেমে আসে, এখন তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের সামনে শিকার রেখে আর অপেক্ষা করতে চাইছে না। একে অপরের সাথে মারামারি করছে আর শিকার পুরোপুরি নিস্তেজ হওয়ার অপেক্ষা করছে। ওরা কীভাবে বুঝবে কখন শিকার তাদের জন্য তৈরি? কখন আক্রমণ করবে? 

সবচেয়ে বড় ইঁদুরটা এখন মাথার উপরে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু পর পর গন্ধ শুকছে। একটা বুদ্ধি আসলো তার মাথায়। একটা কাঠের টুকরা অনেকক্ষণ ধরে তাকে খোঁচাচ্ছে। একটু নড়লেই খোঁচা লাগছে কোমরের দিকে। নিজের হাতটা কোমরের কাছে নিয়ে, টুকরোটা উঠিয়ে আনার চেষ্টা করতে থাকলো। নিজের সবটুকু শক্তি ঢেলে দিলো এর পেছনে। একটু টানাটানি করতেই উঠে এলো টুকরোটা, প্রায় পনেরো সেন্টিমিটার লম্বা, আর একটা পাশ বেশ চোখা। ইঁদুরটাকে লক্ষ্য করে, চোখা মুখটা কাঠের বাক্সের মাঝ দিয়ে ঠেলে দিলো। হঠাৎ করে আসা এই ধাক্কা সহ্য করতে পারলো না ইঁদুরটা। প্রায় দুই মিটার নিচে পড়ে গেল। কোন কিছু না ভেবেই, এরপর নিজের হাতেই সে টুকরোটা ঢুকিয়ে দিলো অ্যালেক্স। 

সাথে সাথে অঝোরে রক্ত বইতে শুরু করলো। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *