অ্যালেক্স – ১০

অধ্যায় ১০ 

চারদিন। চারদিন পার হয়ে গেলেও তদন্তে এখনো কোন অগ্রগতি নেই। ফরেনসিক বিভাগ থেকেও তেমন কিছু পাওয়া যায়নি, আর সাক্ষীদের অবস্থাও বেশ করুণ। কেউ হয়তো কোন একজায়গায় সাদা ভ্যান দেখেছিলো, অন্য কোথাও তা হয়ে যায় নীল। আরো এক জায়গায় একজন তার নারী প্রতিবেশী হারানোর খবর দেয়, খোঁজ নিয়ে দেখা যায় সে অফিসের কাজে ব্যস্ত। আবার আরেক লোক তার স্ত্রীকে খুঁজে পাচ্ছে না, পরবর্তিতে দেখা যায় সে তার বোনের বাসায় গিয়েছিলো, অথচ তার স্ত্রীর বোন আছে স্বামী জানতোই না!! 

এই কেসে নতুন এক অফিসারকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। টগবটে এক যুবক যেন তারুণ্যের প্রতিনিধিত্ব করছে। মিডিয়াতে এই খবর ছাপিয়েছে, কিন্তু অন্যান্য খবরের আড়ালে তা চাপা পড়ে গেল। তারা অপহরণকারীকে তো ধরতেই পারেনি, তার উপর যোগ হয়েছে ভিক্টিমকে এখনো চিহ্নিত করতে না পারার ব্যর্থতা। ঘটনাস্থলের আশেপাশে নিখোঁজ প্রতিটি মানুষের তথ্য নেয়া হয়েছে, যার কোনোটাই ভিক্টিমের সাথে খাপ খায় না। ক্যামিল আস্তে আস্তে সার্চ এড়িয়া বাড়িয়ে একসময় পুরো প্যারিস শহরে খোঁজ লাগিয়েছে, কিন্তু তাতেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। গত কয়েকদিন থেকে শুরু করে গত কয়েক সপ্তাহ এমনকি গত কয়েক মাস আগে নিখোঁজ মহিলা সম্পর্কে খবর নিয়েছে, কিন্তু ফলাফল ওই শূন্যই। 

“তার মানে দেখা যাচ্ছে মেয়েটাকে কেউ চেনে না। চারদিন হয়ে গেল অথচ কেউ রিপোর্ট করলো না। তাকে নিয়ে চিন্তা করার মত কেউ নেই নাকি?” 

এখন প্রায় দশটা বাজে। তিনজন একটা খালের সামনে বসে আছে। ইন্টার্ণ এক ছেলেকে অফিসের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে ক্যামিল। ডিনার করার তাগিদা অনুভব করছে তারা। কিন্তু কোন রেস্টুরেন্টে যাবে তা ঠিক করতে পারছে না ক্যামিল। আদতে তার নাম মনে নেই, রেস্টুরেন্টের নাম মনে রাখার চেয়ে নিজের দাঁত টেনে তোলা অধিকতর সহজ কাজ মনে হয় তার কাছে। আর লুইসকে যে বলবে তাও সম্ভব না, কেননা সে এমন কোনো রেস্টুরেন্টে যাবার কথা বলবে যা তার সাধ্যের বাইরে। আরম্যান্ডের কথা আর কী বা বলার আছে, সর্বশেষ সে কবে খেয়ে গিয়েছিলো কে জানে? তবে একটা ব্যাপারে সবাই নিশ্চিত যে অন্য কারো টাকায় খেয়েছে সে। তাই এতো না ভেবে ক্যামিল সিদ্ধান্ত নিলো লা মেরিন এ যাবে। 

একটা সময় ছিলো যখন তারা একে অপরের সাথে প্রচুর সময় কাটাতো। অনেক কথাবার্তা হতো, আর কাজ শেষে একসাথে ডিনার করতে যেতো। বিল দেয়ার কাজটা ক্যামিলই করতো। আরম্যান্ডকে নিয়ে যাওয়া মানেই, তার বিল দেয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে যাওয়া। আর লুইসকে দিয়ে বিল দিতে গেলে আরেক ঝামেলা, কেননা সে একজন পুলিশ অফিসার, তার কাছে এতো টাকা শোভা পায় না। 

তিনদিন আগেও যা ভাবেনি আজ তাই হয়েছে, পুরোনো টিম ফিরে পেয়ে ক্যামিল বেশ খুশি। ডিনার শেষ করে তারা অফিসে ফিরছে। 

“আমি ঠিক বুঝলাম না। তাই বলে কেউ তাকে খুঁজবে না? তার বাসায়? অফিসে? তার হাজব্যাণ্ড? বন্ধুবান্ধব? কেউই না? এমনও কি সম্ভব? অবশ্য এমন বড় শহরে কে কার খোঁজ রাখে।” হতাশা জড়ানো কণ্ঠে বলল ক্যামিল। 

একেকজন কথা বলার পর নেমে আসছে অদ্ভুত নীরবতা, এটা নতুন কিছু নয়, তাদের সব আলাপালোচনাই এমন হয়ে থাকে। সবাই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে মূর্তমান–কেউ চিন্তাশীল, কেউ অন্তর্মুখী আবার কেউ ক্ষুরধার বুদ্ধিমান। 

“তুমি কি প্রতিদিন তোমার বাবাকে দেখতে যেতে?” 

না। মোটেও না, মাঝে মাঝে দু’সপ্তাহেও একবার যাওয়া হতো না ক্যামিলের। তার বাবা নিজের বাসায় মৃত অবস্থায় পড়ে ছিল এক সপ্তাহ। তার বাবার একটা গার্লফ্রেণ্ডও ছিলো, যে তার লাশ প্রথম আবিষ্কার করে এবং বাকিদেরকে জানায়। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দুইদিন আগে ক্যামিল তাকে প্রথমবার দেখে। সবসময় তার বাবা মহিলাকে নিছক পরিচিত বলে পরিচয় দিলেও, মেয়েটা যাওয়ার সময় বাসা থেকে এতো পরিমাণ জিনিস নিয়ে যায়, যা নিতে গাড়ির তিন ট্রিপ লাগে। আকৃতিতে ছোট আর গোলাপী গালওয়ালা মহিলা দেখতে অনেকটা কুঁচকে যাওয়া আপেলের মত। তার শরীরে ল্যাভেন্ডারের গন্ধ। এই মহিলাই যে তার বাবার বিছানায় মায়ের স্থান দখল করেছে, তা সে কল্পনাই করতে পারে না। দুজ’নে সম্পূর্ণ আলাদা। দু’জনেই ভিন্ন পৃথিবীর, সম্ভবত ভিন্ন গ্রহেরও। সে এখনো এই ভেবে অবাক হয় যে তার মা আর বাবার মাঝে মিলটা কোথায় ছিলো? কোথাও না। তার মা ছিল একজন চিত্রশিল্পী আর বাবা একজন কেমিস্ট। মা বাবার সম্পর্ক আদতে কি ছিল তা এখনো তার কাছে অমীমাংসিত এক রহস্য। কিছুদিন পর ক্যামিল খবর পেলো সেই কুঁচকে যাওয়া আপেল তার বাবার সম্পত্তির এক বিশাল অংশ নিয়ে ভেগেছে। এরপরে আর কখনোই তাকে দেখা যায়নি। 

“আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু আলাদা। আমার বাবা একাই একটা বাসায় থাকতো। কেউ যদি না চায় তাহলে তো আর তাকে জোর করে আনা সম্ভব না। এভাবেই একদিন একা একাই মারা যায়, কিছুদিন পর পাওয়া যায় শুধু নিথর দেহ,” বলল আরম্যান্ড। 

এই চিন্তা ধাঁধাঁয় ফেলে দিলো ক্যামিলকে। সে কোন এক জায়গায় পড়া এক গল্প বলা শুরু করলো। জর্জ নামের এক লোক-যে অনেকটা পরিস্থিতির শিকার হয়ে এক নির্মম ঘটনার জন্ম দেয়। পাঁচ বছর ধরে সে নিখোঁজ ছিলো। তার প্রতিবেশীদের ধারণা সে হাসপাতালে ভর্তি, বাড়ির প্রহরীও তাই জানতো। তার বাড়ির গ্যাস, বিদ্যুত, পানি সবকিছুর লাইন কেটে দেয়া হয়। পাঁচ বছর পরে ২০০১ সালে, তার ফ্ল্যাটে ঢুকে পাওয়া যায় তার কঙ্কাল। 

“আমি এই লেখাটা পড়েছিলাম…” বলে শিরোনাম মনে করার চেষ্টা করলো ক্যামিল। 

“এডগার মরিন এর লেখা, এতোটুকু মনে আছে আমার।” 

“টুওয়ার্ডস এ পলিটিকস অফ সিভিলাইজেশন,” আত্মবিশ্বাসের সুরে বলল লুইস। বাম হাত দিয়ে নিজের চুলগুলো পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে ক্যামিলকে জিজ্ঞেস করলো, “কী যেন বলছিলে?” 

প্রশ্ন শুনেই সে হেসে বলল, “আবারো একত্রিত হতে পেরে বেশ ভালই লাগছে, কি বলো?” 

“এই কেস দেখে আমার অ্যালিসের কথা মনে পড়ছে,” বলল আরম্যান্ড। 

কেসটা একটু অদ্ভুতই ছিল বটে। মেয়েটার নাম ছিল অ্যালিস হেজেস, একটা খালের পাশে তার লাশ পাওয়া যায়। কিন্তু লাশ পাওয়ার পর তিন বছর পেরিয়ে গেলেও তার কোন হদিস বের করা যায়নি। এক সময় সবাই এই কেস নিয়ে আশা ছেড়ে দেয়। কিন্তু এভাবে কোন পরিচয় ছাড়াই মেয়েটা হারিয়ে যাবে এটাও তো মেনে নেয়া যায় না। মনে সবসময় খচখচ করতে থাকে এ ধরনের কেসগুলো। হয়তো কোন দিন সেন্ট-মার্টিনের সবুজাভ পানির দিকে তাকিয়ে মনে পড়বে মেয়েটার কথা। এভাবে চাইলেই কাউকে ভোলা যায় না। তার জীবন যেন সমুদ্রের এক ফোঁটা পানির মত। 

যে কেস নিয়ে দুইদিন আগেও চরমবিরক্ত ছিল ক্যামিল, এখনো সেই কেস নিয়েই আছে, কেউ তাকে এ ব্যাপারে কিছু বলছেও না। লা গুয়েন ফোন করে ক্যামিলকে জানিয়েছে মোরেল চলে এসেছে। এই কথা শুনে রেগে গেল ক্যামিল আর বলল, “ওই বালের মোরেলের নাম আমার সামনে উচ্চারণ করবেন না।” 

ক্যামিল শুরু থেকেই জানতো একবার কোন কেসে ঢুকে গেলে তা শেষ করেই ছাড়বে। তাই একপ্রকার জোর করেই লা গুয়েন তাকে এই কেসের দায়িত্ব দেয়। এর জন্য তাকে ধন্যবাদ দিবে কিনা তাই ভাবলো সে। আর তাছাড়া, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মতে এই কেসের গুরত্বও এখন অনেকটা কমে গেছে। অপহরণকারীকে এখনো শনাক্ত করা যায়নি, আর ভিক্টিমের ব্যাপারেও তেমন কোন তথ্য নেই। শুধু প্রত্যক্ষদর্শীর কথা থেকে এইটুকু জানা গেছে অপহরণের কাজে ব্যবহৃত ভ্যানটা সাদা, আর ভিক্টিমের বমি থেকে জানা গেছে তার খাওয়া সর্বশেষ খাদ্য তালিকা। তা তদন্ত কাজ আগানোর জন্য খুব একটা সহায়ক নয়। এখনো কোন লাশ পাওয়া যায়নি। এর জন্যেই লুইস আর আরম্যান্ডকে সাথে নিয়ে মাঠে নেমেছে ক্যামিল। লা গুয়েন এই ভেবে খুশি যে ক্যামিল আবারো কাজে ফিরেছে, তার পুরোনো টিম নিয়ে, এই কেস সমাধান না হলেও তার সমস্যা নেই। আসল কাজ তো ক্যামিলকে মাঠে ফিরিয়ে আনা। 

ডিনারের পর হাঁটা শুরু করলো তারা। খালের পাশের একটা বেঞ্চে বসলো তিনজন আর আশেপাশের লোকজন দেখতে লাগলো- এখানে প্রেমিক যুগল যেমন আছে, তেমনি আছে বয়স্ক লোকজন যারা কুকুর নিয়ে হাঁটছে। 

ক্যামিল ভেবে দেখলো তার টিমটা বেশ অদ্ভুত। একদিকে আছে ক্রিসাসের (লিডিয়া রাজ্যের রাজা) মতো ধনী লোক, অন্যদিকে আছে কৃপনতার জন্য ক্রুজ ম্যাকডাক (কার্টুন চরিত্র) হওয়ার যোগ্য একজন। অবশ্য আমি নিজেও এখন টাকা-পয়সার নাগাল পাচ্ছি, এই ভেবে হাসলো সে। কয়েকদিন আগে তার হাতে এক খাম আসে, কিছু লোক তার মায়ের আঁকা ছবিগুলো নিলামে তুলতে চায়। কিন্তু সে এখনো খামটা খোলেনি। 

“আচ্ছা। তার মানে তুমি জিনিসগুলো নিলামে দিচ্ছো না। আমার ধারণা এটাই ভাল হবে।” 

“ওহ তাই নাকি। তুমি আমার জায়গায় হলে তো সবই রেখে দিতে, তাই না?” 

“আমি কি তা বলেছি নাকি? শুধু ছবিগুলো রেখে দিলে ভাল হতো।” একটু নিচুস্বরে বলল আরম্যান্ড। 

“তুমি এমনভাবে বলছো, এটা যেন রাজার ধন-দৌলত!!!” 

“তা না হলেও, পারবারিক সম্পদ তো।” 

কখনো কোন ব্যক্তিগত আলাপে অংশ নেয় না লুইস। বরাবরের মত সেখান থেকে উঠে চলে গেল। ক্যামিল আবার অপহরণ প্রসঙ্গে ফিরে এলো।

“ভ্যানের মালিক সম্পর্কে কোনো তথ্য পেয়েছো?” জিজ্ঞেস করলো সে। 

“এক ছিঁটেফোঁটাও না,” নিরাশ ভঙ্গিতে জবাব দিলো আরম্যান্ড। 

তাদের হাতে থাকা একমাত্র সূত্র ভ্যানের একটা ছবি। মি.বার্টিনাক এর সি.সি.টি.ভি. ফুটেজ থেকে পাওয়া সেই ছবি বিশ্লেষণ করে তারা ভ্যানের মডেল আর প্রস্তুতকারকের নাম বের করতে পেরেছে। এমন গাড়ি আছে প্রায় দশহাজার। ফরেনসিন বিভাগ ছবির নামের সাথে মিলে এমন তিনশ চল্লিশটা কম্বিনেশন খুঁজে পেয়েছে। লুইস আর আরম্যান্ড এই নামগুলোই ক্রস চেক করে দেখছে। 

তাদের ঝামেলা আরো বেড়ে গেছে এরই মাঝে। কেননা এই ধরনের ভ্যান প্রায়ই কেনাবেচা হয়। এই সীমাহীন চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে তারা, কেননা প্রত্যেকটা লোককে খুঁজে বের করা, তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা, এককথায় অসহ্য…তবে একজন একটু আলাদা। কাজ যত বেশি, খুঁজে পাওয়া যত কঠিন ঠিক ততোটাই ‘খুশি’ আরম্যান্ড। অবশ্য এই মুহূর্তে যে আনন্দ নিয়ে সে কাজ করছে, ‘খুশি’ শব্দটাও তার মনের ভাব বোঝানোর জন্য যথেষ্ট নয়। 

“এভাবে কাজ করলে তো এক সপ্তাহ লেগে যাবে ভ্যান মালিককে খুঁজে বের করতে,” বলল ক্যামিল। 

এমন সময় তার ফোন বেজে উঠলো। সেই ইন্টার্ণ ফোন করেছে, সে এতোটাই উত্তেজিত যে তোতলাচ্ছে এবং ক্যামিলের কড়া নির্দেশও ভুলে গেছে। 

“বস? অপহরণকারীকে খুঁজে পাওয়া গেছে, তার নাম ট্র্যারিক্স। আমরা এক্ষুণি তার অবস্থান জানতে পেরেছি। আপনি দ্রুত চলে আসুন।” 

অধ্যায় ১১ 

খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে অ্যালেক্স। শরীর দুর্বল, মানসিক অবস্থাও খুব একটা সুবিধার না। খাঁচায় আবদ্ধ শরীর আর মনটা যেন বহুদূরে কোথাও চলে গেছে। এমন জায়গায় এক ঘণ্টা থাকা মানেই মৃত্যু। তবুও সে বেঁচে আছে, যদিও বেঁচে থাকার ইচ্ছা ক্রমশই কমে যাচ্ছে। এমন আবদ্ধ জায়গায় থেকে পাগলপ্রায় অবস্থা তার। কতদিন ধরে এখানে আটকা পড়ে আছে তাও জানে না। 

ভেতর থাকা আসা গোঙানিকেও এখন পাত্তা দেয় না সে। নিচুস্বরে কাঁদে, অবশ্য এখন কাঁদারও শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। বাক্সের দেয়ালে নিজের মাথা নিজেই বাড়ি দেয়, মাথা ফেটে রক্ত ঝরে, বিলাপ করে কাঁদে, তবুও থামে না। এভাবে বেঁচে থাকা অসহনীয় হয়ে উঠেছে, এর চেয়ে মৃত্যুই সহজ সমাধান তার কাছে। 

লোকটা যখন আসে তখন গোঙানি থামিয়ে দেয় অ্যালেক্স। একের পর এক প্রশ্ন করে তাকে, যদিও জানে যে তার কাছ থেকে প্রশ্নের উত্তর পাবে না। আদতে সে চলে গেলে ভীষণ একলা বোধ হয় তার। এখন সে বুঝতে পারে, জিম্মিদের কতটা কষ্ট করে দিন পার করতে হয়। একাকী থাকার ভয় দূর করার জন্য মাঝে মাঝে তার ইচ্ছে করে লোকটাকে থাকতে বলবে, ভাবটা এমন যেন সে উপস্থিত থাকলে তাকে কেউ মারতে পারবে না। 

আদতে ঘটনা তার উল্টো। স্বেচ্ছায় নিজেকে আঘাত করছে অ্যালেক্স। কেউ তাকে উদ্ধার করতে আসবে না, এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত। তাই, ধুকে ধুকে মরার চেয়ে একবারেই সব শেষ হয়ে যাক। এই শরীরের উপর নিজের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই তার। সারা শরীর প্রসাব আর বমিতে ভর্তি, বিকট গন্ধ বের হচ্ছে, যা নিজেই সহ্য করতে পারছে না। বাক্সের অমসৃণ অংশে নিজের পা ঘষতে শুরু করলো, নিজের শরীরের উপর ঘেন্না ধরে গেছে। এই শরীর নিয়ে বাঁচতে চায় না, তাই ব্যথা যত বাড়লো তত জোরে নিজের পা ঘষতে লাগলো। সরু কাঠের টুকরা তার পায়ে ঢুকে গেল, তবুও থামলো না। সারা শরীরে ব্যথার আলোড়ন যেন নিজেকে শেষ করে দেয়ার উৎসবে হাওয়া দেয়। ক্ষত থেকে রক্ত বের না হওয়া পর্যন্ত নিজের উপর অত্যাচার চালিয়ে গেল। 

এই পৃথিবীতে সে একা। কেউ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে না। 

মারা যেতে আর কতক্ষণ? মরদেহ খুঁজে পেতে কত সময় লাগবে? লোকটা কি লাশ গুম করে ফেলবে? কোন জায়গায় পুঁতে ফেলবে? করলেও কোথায় করবে? এইসব ভাবনায় ডুবে গেল অ্যালেক্স। প্রায়ই নানান দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠে; প্লাস্টিকে মোড়ানো নিজের দেহ, গহিন এক বন, নিশুতি রাত, কেউ একজন তার দেহ ছুঁড়ে ফেলে দিলো। নিজের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে ভয়ে শিউরে ওঠে সে। 

নিজের ভাইয়ের কথা মনে পড়লো তার। ভাইয়ের সাথে কেমন সম্পর্ক ছিল তা মনে করার চেষ্টা করলো। ভাইয়ের কাছে সবসময়ই ঘৃণার পাত্র ছিল সে। তাকে একদমই সহ্য করতে পারতো না। সাত বছরের বড় ভাইয়ের কাছ থেকে কখনোই আদর পায়নি, বরং কথায় কথায় অপমানের শিকার হতে হয়েছে। প্রায়ই ভাইয়ের হাতে মার খেতে হতো তাকে। একদিন ঘুমের ঔষুধ খাওয়ার সময় তার ভাই দেখে ফেললে হাত থেকে কেড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এটা কী?” 

ভাবটা এমন যেন সে তার ভাই না, তার পিতা, তার বস, অথবা এমন কেউ যার হাতে নিজের জীবন সঁপে দিয়েছে অ্যালেক্স। 

“এটা কী খাচ্ছিলে তুমি?” রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো তার ভাই। 

তার চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে। ছোট থেকেই এমন রগচটা স্বভাব তার। অবস্থা বেগতিক দেখে অ্যালেক্স তার ভাইয়ের চুলে আলতো করে হাত বুলাতে লাগলো। কিন্তু বিধিবাম, অ্যালেক্সের হাতে থাকা আংটিতে তার চুল আটকে যায়, চুলে টান লাগতেই যেন আরো তেঁতে ওঠে সে। তার গালে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দেয়। অ্যালেক্স তা নীরবে সয়ে নেয়। 

অ্যালেক্স হারিয়ে গেলে তার ভাই…তার ভাই কিছুটা মানসিক শান্তিই পাবে। বিন্দুমাত্র খোঁজ করবে না তার জন্য, বরং তিন চার মাস পর সামান্য বিস্মিত হলেও হতে পারে। 

আর তার মায়ের কথা না বললেই নয়। মায়ের সাথেও তার সম্পর্ক উষ্ণ নয়। তিন চার মাস পর সে কল করলে তাদের মাঝে কথা হয় নতুবা হয় না। তার মা ভুলেও কল করে না। 

আর বাবা…বাবা থাকলে হয়তো ভালই হতো। বাবা থাকলে হয়তো তার নিখোঁজ হওয়ার পর পাগলের মত খুঁজতো, তাকে বাঁচাতে আসতো। সে নিজেও জানে না তার বাবা থাকলে কী হতো। এই নিয়ে আর ভাবতেও চায় না। 

অ্যালেক্স তার কাজের কথা ভাবলো। তার চাকরী অস্থায়ী, কেবলই একটা অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে কিছুদিন ছুটি কাটাচ্ছিলো। দুই তিন মাস আরাম আয়েসে কাটানোর মত টাকা জমানো ছিল তার। তাই সব ব্যস্ততা দূরে ঠেলে জীবনটাকে একটু অন্যভাবে গোছাচ্ছিলো, নিজের কিছু স্বপ্ন পূরণের তাগিদ অনুভব করছিলো। কিন্তু নতুন কাজ পাওয়ার আগেই তাকে অপহরণের শিকার হতে হলো। কাজে থাকলে হয়তো কোন সহকর্মী তার খবর নিতো, কিন্তু এখন সেই সুযোগও নেই। 

তার কোন প্রেমিক নেই, কোন স্বামী নেই। কেউই নেই। 

অ্যালেক্সের মাথায় এখন কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে; মৃত্যুর আগে আর কয়দিন সময় পাবে? মৃত্যুর স্বাদ কেমন? স্বর্গ আর পৃথিবীর মাঝে কীভাবে পরিত্যক্ত মরদেহে পচন ধরে? 

হুট করেই তার মাথায় যেন কিছু একটা বিস্ফোরিত হলো, কিছু খুঁজে পাওয়ার আনন্দে চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। মাথায় ঘুরপাক খাওয়া একটা প্রশ্নের পোকা, কেবলি তাকে মুক্তি দিলো। এখন লোকটাকে চিনতে পেরে, শরীরে আলাদা একটা শিহরণ অনুভব করলো সে। 

লোকটা প্যাসকেল ট্র্যারিক্স এর বাবা। 

তাকে দেখার পর থেকেই অ্যালেক্সের মাথায় বিষয়টা আসি আসি করেও আসছিলো না। এমন নয় বাপ বেটা দেখতে একই রকম, বরং এদের মাঝে এতোটাই পার্থক্য বিদ্যমান যে, কেউ এই কথা বিশ্বাসই করবে না। তবুও অ্যালেক্স তাকে চিনতে পেরেছে, তার নাকের সাথে প্যাসকেলের নাকের মিল আছে। আর এই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই তার মাঝে নতুন এক ভয় জেঁকে বসলো। কেননা সে আসলেই তার মরণ দেখতে চায়, আর এর পিছনে যথেষ্ট কারণ আছে, এটা ভালভাবেই বুঝতে পারছে অ্যালেক্স। 

তার নিঃশব্দ আগমন অ্যালেক্সকে আরো ভীত করে তুললো। সারস পাখির মত গলা উঁচু করে তাকে দেখার চেষ্টা করলো, তবে তার আগেই কাঠের বাক্স দুলতে শুরু করলো। বাক্সটা নিচে নামতে নামতে একসময় থেমে গেল। এমন সময় তাকে এক নজর দেখতে পেলো সে। লোকটা দেয়ালের দিকে পিঠে দিয়ে তার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রশিটা দেয়ালের কাছে বেঁধে তার দিকে এগিয়ে গেল। অ্যালেক্স একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে, এইবার তার চোখে অন্যকিছু দেখতে পেলো। সে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে, আর এমনভাবে হাঁটছে যেন মেঝেতে ল্যান্ডমাইন পোঁতা আছে। একেবারে চোখের সামনে আসার পর প্যাসকেলের মত তার চোখেমুখেও সেই একগুঁয়ে ভঙ্গিমা দেখতে পেলো অ্যালেক্স। 

বাক্স থেকে দুই মিটার দূরে থেমে গেল সে। অ্যালেক্স তার দিকে তাকিয়ে আছে; সে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করলো, এমন সময় মাথার উপরের দিকে খচখচ শব্দ শুনতে পেলো। ঘুরে দেখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। এমন চেষ্টা হাজার বার করেও সফলতা পায়নি সে। 

হাতছোঁয়া দূরত্বে ফোনটা ধরে রেখে, তার দিকে তাকিয়ে হাসলো লোকটা। এমন হাসির মানে সে জানে, অশুভ কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য। এমন সময় ছবি তোলার ক্লিক ক্লিক শব্দে আবারো ঘুরে তাকানোর চেষ্টা করলো সে। হুট করেই সামনে থাকা ঝুড়িটা তার মনোযোগ কেড়ে নিলো ঝুড়িটা এমনভাবে নাড়াচাড়া করছে যেন ওটা জীবিত কোন কিছু। 

দ্রুতই সে বুঝতে পারলো ঝুড়ির ভিতর আর যাই থাকুক, ডগ ফুড নেই। তার ধারণাকে সত্যি প্রমাণ করার জন্যেই কিনা একটা ইঁদুর বেরিয়ে এলো ঝুড়ির ভেতর থেকে। একটু পরেই দেখা গেল দুটি ছায়া এগিয়ে আসছে তার দিকে। এবার সে বুঝতে পারলো একটু আগে কিসের শব্দ হচ্ছিলো। ইঁদুর দুটো কাঠের টুকরোর মাঝ দিয়ে উঁকি দিলো। বড় বড়, কালো চোখ ইঁদুরগুলোর। 

এখন সব বুঝতে পারলো অ্যালেক্স। 

তার খাওয়ার জন্য না, বরং ইঁদুরগুলোকে আকর্ষণ করার জন্যেই ডগ ফুড রেখে যেতো ওই লোক। 

সে তাকে মারবে না। মারবে এই ইঁদুরগুলো। 

অধ্যায় ১২ 

রাস্তার ধারেই একটা ক্লিনিক, যা একসময় বহির্বিভাগের রোগী দেখার জন্য ব্যবহৃত হতো। উনিশ শতকে তৈরি এই বিল্ডিং সুবিশাল দেয়ালে ঘেরা, অনেক দিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলো। এটাকেই ঘষামাজা করে ব্যবহার করছে একটা নার্সিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। 

প্রায় দুই বছর ধরে খালি পড়ে আছে জায়গাটা; শিল্প-কারখানার জন্য বরাদ্দকৃত পতিত জমি। কাজ শুরুর আগ পর্যন্ত কোম্পানী একজন সিকিউরিটি গার্ড রেখেছে, যাতে করে গৃহহীন, ছিন্নমূল আর অবৈধ অধিবাসীরা আশ্রয় গড়তে না পারে। বিল্ডিং এর নিচ তলায় সিকিউরিটি গার্ডের থাকার জন্য ছোট একটা রুম আছে। কাজ শুরু হতে আর চার মাস বাকি, এর মাঝের সময়টুকু দেখভালের দায়িত্ব তার। 

তেপ্পান্নো বছর বয়সি জ্যঁ পিয়েরে ট্রারিক্স, ক্লিনিকের সাবেক পরিচ্ছন্নকর্মী। ডিভোর্সড। পূর্বে কোন অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ নেই। 

ফরেনসিক বিভাগ থেকে সরবরাহ করা নামগুলোকে ঘেটে ভ্যান মালিকের খোঁজ বের করেছে আরম্যান্ড। লাগরাঞ্জ, আগে চুক্তিতে পি.ভি.সি জানালা লাগানোর কাজ করতো, দুই বছর আগে অবসর নিয়েছে। আর তখনি নিজের যাবতীয় জিনিসপত্র বিক্রি করে দিয়েছে। ভ্যানটা কিনে নিয়েছিলো ট্র্যারিক্স। লাগরাঞ্জের নামটা স্প্রে দিয়ে ঢেকে ভ্যানটা ব্যবহার করছিলো সে। আরম্যান্ড স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে জানায় ব্যাপারটা, আর তাদেরকে মিলিয়ে দেখতে বলে। নিজের ডিউটি শেষ করে বাসায় ফিরছিলো সার্জেন্ট সায়মন, জীবনে প্রথমবারের মত মোবাইল ফোন না থাকার জন্য আফসোসে পুড়লো। পুনরায় পুলিশ স্টেশনে গিয়ে জানালো যে ক্লিনিকের সামনে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা ভ্যান, সি.সি.টি.ভি ফুটেজ এর সাথে মিলে গেছে। কিন্তু ক্যামিল এতেও সন্তুষ্ট না, যুদ্ধ শুরুর আগে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চায়। আরেকজন অফিসারকে পাঠালো ওই এলাকায়। ছবি তোলার মতো যথেষ্ট আলো ছিল না, কিন্তু সমস্যা হলো ভ্যানটাই সেখানে নেই। বরাবরের মত ট্র্যারিক্স বাসায় ছিল না। ঘরে কোন আলোও নেই, মনে হচ্ছে ভূতের বাড়ি। 

ফাঁদ তৈরি, লোকটা আসবে আর ওমনি খপ করে তাকে ধরে ফেলা হবে। সাদা পোশাকে অফিসাররা চারপাশ ঘিরে রেখেছে। পালানোর কোন সুযোগ নাই। সবকিছু ঠিকঠাক মতো এগুচ্ছিলো, এমন সময় সেখানে হাজির হলো লা গুয়েন আর তার সাথে তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেট। 

মেইন গেট থেকে প্রায় একশ মিটার দূরে মিটিং সারলো তারা। ত্রিশোর্ধ্ব ম্যাজিস্ট্রেটের নাম ভিডার্ড। হালকা পাতলা গড়ন, মুখে বিষণ্নতার ছাপ, গায়ে পিনস্ট্রিপড স্যুট, বোতামগুলো স্বর্ণের। সর্বোপরি আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। এদের দেখে মনে হয় এরা স্যুট, টাই পড়ে জন্ম নিয়েছে। এমনিতে বেশ সুদর্শন, চেহায়ার একটা প্লে-বয় ভাব আছে- তবে এখন দেখতে মনে হচ্ছে কোন ইনস্যুরেন্স কোম্পানীর সেলসম্যান, যে একইসাথে রাজনীতিবিদ হওয়ার স্বপ্ন দেখে। তার ভবিষ্যৎ যেন আরেকজন লোথারিওর কথা মনে করিয়ে দেয়। 

আইরিন যখনই এমন পুরুষ দেখতো, তখন হেসে হেসে ক্যামিলকে বলতো, “বাহ। লোকটা তো বেশ হ্যান্ডসাম। আমি যে কেন এমন একজন হাজব্যাণ্ড পেলাম না?” 

তার উপর লোকটা একটা ঘটিরাম, সম্ভবত উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত গুণ, ক্যামিলের তাই ধারণা। তার যেন প্রচুর তাড়া, জায়গাটাকে তছনছ করে ফেলতে চায় এখনি। এই মুহূর্তে ট্র্যারিক্স এর উপর আক্রমণ করতে চায়, নিশ্চয়ই তার বংশে কোন তিন তারকা বিশিষ্ট জেনারেল আছে। 

“এটা সম্পূর্ণ হাস্যকর। আমরা মোটেও তা করতে পারি না।”

এমন একজন লোকের সামনে শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ক্যামিলের আরেকটু সতর্ক হওয়া দরকার ছিলো। ম্যাজিস্ট্রেটকে আরেকটু সম্মান দেখানো উচিৎ ছিলো। কিন্তু এই বালের ম্যজিস্ট্রেট, পাঁচ দিন ধরে বন্দী এক জিম্মির জীবনের কোন মূল্যই নেই তার কাছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে লা গুয়েন এগিয়ে এলো, “আপনি যেমনটা দেখছেন স্যার, কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেন মাঝে মাঝে মেজাজ হারিয়ে ফেলে। আপনি কিছু মনে করবেন না। তবে আমার মনে হয় কি এখনি আক্রমণ না করে অপরাধীর জন্য অপেক্ষা করাটাই উত্তম।” 

এসব কথায় কোন কাজ হলো না। ম্যাজিস্ট্রেট নিজেকে ভয়ডরহীন আর এক কথার মানুষ হিসেবে প্রমাণ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সে বলল, “আমার মতে এখনি আমরা বিল্ডিং ঘেরাও করে ভিক্টিমকে মুক্ত করি, এরপর অপরাধীর জন্য ফাঁদ পেতে রাখবো।” নিজের কথায় বেশ সন্তুষ্ট মনে হলো তাকে। সবার নীরবতা তাকে আরো উৎসাহিত করে তুললো, তাই আবারো বলল, “এভাবেই সে ফাঁদে পড়ে যাবে।” 

“আপনি কীভাবে জানলেন যে ভিক্টিম ভেতরেই আছে?” বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল 

“তুমি কীভাবে জানলে যে এই লোকই অপহরণকারী?” প্রত্যুত্তরে বলল ভিডার্ড 

“কারণ আমরা মিলিয়ে দেখেছি অপহরণের সময় এই ভ্যান ঘটনাস্থলে ছিলো।” 

“আচ্ছা তার মানে এই লোকই অপহরণকারী।” 

লা গুয়েন পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করার জন্য কী বলবে তাই ভাবছে। এরই মাঝে ভিডার্ড আবারো বলে উঠলো, “আমি তোমার অবস্থান বুঝতে পারছি ভেরহোভেন, কিন্তু দিনকাল অনেক পরিবর্তন হয়েছে।” 

“ওহ, আচ্ছা তাই নাকি? বলুন দেখি শুনি?” 

“এমন কাঠখোট্টাভাবে বলার জন্য আমি দুঃখিত, কিন্তু আমরা এখন আর অপরাধীর দিকে নজর দেই না, ভিক্টিমের জীবনটাই মুখ্য।” 

বিজয়ির ভঙ্গিমায় সবার দিকে তাকিয়ে সে আবারো বলল, “অপরাধীকে খুঁজে বের করা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো ভিক্টিমকে জীবিত উদ্ধার করা, কেননা তাদের কারণেই আমাদের সৃষ্টি।” 

ক্যামিল বলার জন্য মুখ খুললেও, কিছু বলার আগেই ম্যজিস্ট্রেট গাড়িতে চড়ে বসলো। হাতে থাকা মোবাইল ফোন দেখিয়ে লা গুয়েনকে বলল, “আমি এক্ষুণি আর.এ.আই.ডি কে ফোন করছি।” 

এই লোক তো গণ্ডমুর্খ,” লা গুয়েনকে বলল ক্যামিল। 

ম্যাজিস্ট্রেট তখনো লা গুয়েনের পিছনেই, এই কথাগুলোও তার কানে গেল। কিন্তু শুনেও না শোনার ভান করে কথাটা এড়িয়ে গেল। আর এদিকে লা গুয়েন ব্যাকআপ টিমকে জানিয়ে রাখলো। কেননা তারা যখন ভিক্টিমকে বাঁচানোর জন্য ভেতরে অবস্থান করবে, তখন যদি ট্র্যারিক্স চলে আসে। এক ঘণ্টার মাঝে সব কিছুর ব্যবস্থা হয়ে গেল। 

*

রাত ১:৩০ 

ক্যামিলের নির্দেশে বিল্ডিং এর চাবি যোগাড় করা হলো খুব দ্রুত, কেননা জরুরী প্রয়োজনে লাগতে পারে এই চাবি। আর.এ.আই.ডি স্কোয়াডের কমিশ্যাঁর নোবার্টও এখন উপস্থিত সেখানে, যদিও ক্যামিল তাকে চেনে না। লোকটার ব্যক্তিত্বের কারণে কেউ তাকে কখনো পুরো নাম জিজ্ঞেস করার সাহস পায়নি। তার মনে হলো এই লোক এমন পরিস্থিতি হাজারবার মোকাবেলা করেছে। 

ছবি আর ম্যাপ দেখে নোবার্ট তার স্কোয়াডের সদস্যদেরকে চারভাগ করে গুরুত্বপূর্ণ চারটি পয়েন্টে পাঠিয়ে দিয়েছে। একটা ইউনিট অবস্থান নিয়েছে ছাদে, আরেকটা বিল্ডিং এর মেইন গেটে, আর বাকি দুই ইউনিট বাইরে ‘ক্রিমিনাল ব্রিগেড’ বিল্ডিং এর চারপাশ ঘিরে রেখেছে। ক্যামিল একটা টিমকে পাঠিয়েছে বিল্ডিং এর অন্যান্য তিনটা প্রবেশপথে। আর চতুর্থ টিম বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে যাওয়া ড্রেন গুলোর ওইদিকে নজর রাখছে। 

কমিশ্যাঁর নোবার্ট এখন বেশ সতর্ক। তার নিজের দক্ষতা সম্পর্কে বেশ ভালভাবেই জ্ঞাত সে, তাই ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বিন্দুমাত্র ভড়কে যায় নি। ম্যজিস্টেট যখন তাকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি বিল্ডিং থেকে ভিক্টিমকে মুক্ত করে আনতে পারবে?” বেশ কিছুক্ষণ বিল্ডিং এর ম্যাপ ঘেটে সে বলল, “হ্যা। অবশ্যই পারবো।” লোকটার দায়িত্বশীল আর স্পষ্টবাদী ভূমিকা, ক্যামিলের বেশ পছন্দ হলো। লোকটাকে মনে ধরে গেল তার। 

ভিক্টিম যখন ভেতরে বন্দী, তখন ট্র্যারিক্সের জন্য অপেক্ষা করাটা বেশ হতাশাজনক। তবুও ক্যামিলের মনে হলো এটাই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। নোবার্ট এক পা পিছিয়ে গেল, আর ম্যাজিস্ট্রেট এক পা এগিয়ে এলো। 

“অপেক্ষা করলে কী ক্ষতিটা হচ্ছে?” ক্যামিল জিজ্ঞেস করলো। 

“ সময়।” 

“পুরো ব্যাপারটা সতর্কতার সাথে সমাধান করলে কী ক্ষতি হবে?”

“হয়তো কারো জীবন।” 

লা গুয়েনও এখন ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে একমত। হঠাৎ করে ভীষণ অসহায় বোধ করলো ক্যামিল, তার পাশে কেউ নেই। এখনই সবাই বিল্ডিং এ প্রবেশ করবে। বিল্ডিংয়ের চারপাশ ঘিরে রাখা এক সদস্যের সাথে যোগাযোগ করলো সে। 

“কী দেখতে পাচ্ছো তুমি?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল। 

সে সদস্য কী বলবে তাই খুঁজে পেলো না। কোন উত্তর না পেয়ে বিরক্ত ক্যামিল তাকে আবারো একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো। 

“আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না, তবে কিছু সাইট মেশিনারী, বিল্ডিং তৈরির রড, কয়েকটা ডেমোলিউশন মেশিন। আর হ্যা, একটা খননকারী মেশিন।” 

এই খননকারী মেশিনের ব্যাপারটা ক্যামিলকে ভাবিয়ে তুললো। 

এদিকে অপারেশন শুরু হয়ে গিয়েছে, লা গুয়েনও তাদের পিছু নিয়েছে। ক্যামিল নিচেই থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো। এখনো ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছে সে। লাইটের ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠলো, তার মানে বিল্ডিং এর ভেতরে প্রবেশ করেছে তারা। অপারেশন শুরু হলো ঠিক ১:৫৭ মিনিটে। 

“তার মানে প্রতিনিয়ত মানুষের আসা যাওয়া আছে এখানে।” একা একাই বলে উঠলো ক্যামিল। পাশে থাকা লুইস জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করলো। 

“বিল্ডিং এর কাজ শুরু করার পূর্বে এইসব যন্ত্রপাতি আনা হয়। এখানে শ্রমির, 

ইঞ্জিনিয়ার সহ আরো নানা ধরণের লোক কাজ করবে। কাজের তদারকি করতে মালিকপক্ষ আসবে। মোট কথা মানুষের আনাগোনা এখানে বেশি। তার মানে…” 

“তার মানে ট্র্যারিক্স এখানে ভিক্টিমকে আটকে রাখবে না।” 

ক্যামিল কিছু বলার সুযোগ পেলো না, কেননা ট্র্যারিক্সের সাদা ভ্যান ততক্ষণে চলে এসেছে। 

এরপরে সবকিছুই অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ঘটলো। লুইস গাড়ি স্টার্ট দিলো, ক্যামিল তাতে চড়ে বসলো। ট্র্যারিক্সের পিছু ধাওয়া করতে করতে রেডিওর মাধ্যমে অন্যান্য টিমকেও অপরাধীর অবস্থান জানিয়ে দিলো ধারাভাষ্যকারের মত একের পর এক টিমকে জানাতে লাগলো সে। অপরাধীর ভ্যানটা বেশ পুরোনো মডেলের- তা থেকে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে, এটাকে বাতিল মালই বলা চলে। এক্সিলারেটর চেপেও এই ধোঁয়ার কারখানা ঘণ্টায় সত্তুর মাইলের বেশি বেগে ছুটতে পারবে না। আর তা ছাড়া সে কোন ফর্মুলা ওয়ান ড্রাইভারও না। নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে একটু দ্বিধান্বিত থাকায় মুল্যবান কিছু সময় নষ্ট করলো ট্র্যারিক্স, আর এই সুযোগে তাদের গাড়ি আরো কাছে চলে আসলো। পিছনে থেকেও লুইস বেশ খুশি, কেননা সে জানে অপরাধীকে ঘিরে ধরতে আর কিছু মুহূর্তের অপেক্ষা বাকি শুধু। ইতিমধ্যে স্কোয়াডের বড় গাড়ি গুলো রওনা হয়ে গিয়েছে। এরইমাঝে একটা গাড়ি ডানে, আরেকটা গাড়ি বামে থেকে সাদা ভ্যানের পাশাপাশি চলছে। পালাবার কোন পথ নেই। অপেক্ষা শুধু সঠিক সময়ের। 

এমনসময় লা গুয়েন ক্যামিলকে ফোন করলো, “তাকে ধরতে পেরেছো?” 

“প্রায়,” উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল, “আর তোমার ওইদিকের কী অবস্থা?” 

“যেভাবেই হোক একে পালাতে দেয়া যাবে না ক্যামিল। আমরা এখানে কিছুই পায়নি।” 

“আমি জানতাম।”

“মানে?” 

“না। কিছু না।” 

“আমি আবারো বলছি আমরা ভেতরে কিছুই পাইনি, তুমি শুনতে পাচ্ছো? আমরা একদম খালি হাতে ফিরেছি।” 

আজকের রাতের ঘটনাগুলোকে কয়েক অংশে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম ঘটনাটা অনেকটা এমন, ফ্লাইওভারের উপরেও তারা অপরাধীর পিছু ছুটছে। হুট করেই কর্কশ আর্তনাদ করে ভ্যানটা থেমে গেল। ক্যামিল সহ বাকিরা গাড়ি থামিয়ে সুবিধাজনক পজিশন নিলো। ক্যামিল পিস্তল বের করে তৈরি, অপরাধী ভ্যান থেকে নেমে পালাতে গেলে কী বলবে তাও ঠিক করে রেখেছে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ট্র্যারিক্স ভ্যান থেকে নেমে রেলিং এ বসলো, তার মুখের ভাবটা এমন যেন তাদেরকে সামনে এগুতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। 

এরপরে কী ঘটবে তা সবারই জানা। রেলিং এ বসে পা ঝুলিয়ে দিলো সে। দৃঢ়পায়ে আগত পুলিশ অফিসারদের দিকে তাকিয়ে আছে, তার দিকে অস্ত্র তাক করা। মুহূর্তের মাঝে রেলিং এ দাঁড়িয়ে নিজের হাত দুটো ছড়িয়ে দিলো। একবার পিছনে তাকিয়েই শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়লো। 

তারা রেলিং এর কাছে পৌছানোর রাস্তায় ভারী কিছু পতনের শব্দ, ট্রাকের আঘাতের শব্দ, সময়মত থামতে না পারা গাড়িগুলোর ধাতব শব্দ পাওয়া গেল। 

ক্যামিল নিচে তাকিয়ে দেখলো রাস্তায় জ্যাম লেগে গিয়েছে। গাড়িগুলোর হেডলাইট জ্বলছে, আর এর সাথে যোগ হয়েছে হর্ণের বিকট শব্দ। দ্রুতগতিতে ফ্লাইওভার থেকে নেমে ঘটনাস্থলে গেল ক্যামিল। আর্টিকুলেটেড লরির নিচে চাপা পড়েছিলো ট্র্যারিক্স। শরীরের অর্ধেকাংশ দেখতে পেলো ক্যামিল, খুলি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে, রাস্তায় পিচ জুড়ে রক্ত ছড়িয়ে আছে। 

দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটলো ঠিক বিশ মিনিট পর। পুরো রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বেষ্টনী দ্বারা। এরইমাঝে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছে পুলিশ, ফরেনসিক বিভাগের সদস্য, অগ্নি নির্বাপণ কর্মীসহ আরো অনেকে। ক্যামিল আর তার সহকর্মীরা এখন ফ্লাইওভারের উপরে। লুইস অপরাধীর ভ্যান চেক করছে, আরম্যান্ড তাকে অপরাধী সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য জানাচ্ছে। আর এদিকে ক্যামিল ট্র্যারিক্সের ফোন চেক করছে, যা কোনরকমে লরির চাকা এড়িয়ে গেছে। 

ফোন ঘেটে ছয়টা ছবি পাওয়া গেল। একটা কাঠের বাক্স যার প্রতিটি কাঠের টুকরো সমদূরত্বে অবস্থিত, বাক্সটা মেঝে থেকে কয়েক মিটার উপরে ঝুলানো। এর ভেতরে বন্দী একজন নারী, সম্পূর্ণ নগ্ন, বয়স কম, ত্রিশের কাছাকাছি। তার চুল তেল চিটচিটে, ময়লা। ছোট একটা জায়গায় গাদাগাদি করে আছে, কেননা বাক্সটা তার জন্য যথেষ্ট নয় দেখেই বোঝা যাচ্ছে। প্রতিটি ছবিতেই ফটোগ্রাফারের দিকে তাকিয়ে আছে সে। চোখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট, চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। তার চোখ যেন জ্বলজ্বল করছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই মেয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় দেখতে বেশ, কিন্তু এখন তাকে ভয়াবহ দেখাচ্ছে। আর এই সুন্দরী মেয়েটাই ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে শীঘ্রই। 

“ফিলেটে” লুইস বলল। 

“কী? কী বললে?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল। 

“খাঁচাটা দেখছো না? এটা ‘ফিলেটে’।” ক্যামিলকে দ্বিধান্বিত দেখে সে আরো যোগ করলো, “এটাতে বসাও যায় না, শোয়াও যায় না। এটা মূলত একাদশ লুইসের সময়ে ভার্দুনের বিশপকে অত্যাচারের জন্য তৈরি করা হয়। তাকে দশ বছর বন্দী করে রাখা হয়েছিলো। বেশ কাজে দেয় এই পদ্ধতি। মাংসপেশীতে খিঁচুনি ধরা সহ আরো নানা জটিলতায় ভুগে একসময় পাগল হয়ে যায় বন্দী।” 

মেয়েটার এই অবস্থা দেখে যে কারো মাথা ঘুরে যাবে। আর সর্বশেষ ছবিতে মেয়েটার মুখের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। এছাড়াও বাক্সের উপরে তিনটে ইঁদুরও চোখে পড়েছে ক্যামিলের। 

লুইসের দিকে ফোনটা এমনভাবে ছুঁড়ে দিলো যেন তার হাত পুড়ে যাচ্ছে। 

“ছবিগুলো কখন আর কবে তোলা হয়েছে চেক করো।” 

প্রযুক্তির ব্যাপারে ক্যামিল একটু পিছিয়ে। লুইসের মাত্র চার সেকেন্ড লাগলো খুঁজে বের করতে। 

“শেষ ছবি তিনঘণ্টা আগে তোলা হয়েছিলো।” 

“কললিস্ট চেক করো।” 

“শেষ কল করা হয়েছিলো দশ দিন আগে।” 

তার মানে মেয়েটাকে অপহরণ করার পর একটা কলও করা হয়নি।

পিনপতন নীরবতা নেমে এলো তাদের মাঝে। 

কেউ জানে না মেয়েটাকে কোথায় আটকে রাখা হয়েছে। যে জানতো সে একটু আগেই লরির নিচে চাপা পড়ে মারা গেছে। 

ট্র্যারিক্সের মোবাইল থেকে দুটো ছবি সিলেক্ট করলো ক্যামিল, যার মাঝে ইঁদুর থাকা ছবিটাও আছে। একটা মেসেজ লিখে ম্যাজিস্ট্রেট আর লা গুয়েনকে পাঠালো, “অপরাধী তো মারা গেছে। এখন আমরা কীভাবে ভিক্টিমকে খুঁজে পাবো? আপনিই পথ দেখান পারলে!!!” 

অধ্যায় ১৩ 

চোখ খুলেই অ্যালেক্স দেখতে পেলো তার মুখ থেকে কয়েক সেন্টিমিটার দূরে একটা ইঁদুর, তাকিয়ে আছে তার দিকে। এতো কাছে থাকার কারণে ইঁদুরটাকে স্বাভাবিকের চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বড় দেখাচ্ছে। 

চিৎকার করে উঠলো সে, এই শুনে ভয়ে বাক্স থেকে বেরিয়ে প্ৰথমে ঝুড়িতে গেল ইঁদুরটা, এরপরে একদম রশিতে উঠে গেল। নিজের গোঁফ ঝাকি দিলো যেন পরিস্থিতি আঁচ করতে চাইছে, আর এখান থেকে কী পাবে তাই ভাবছে। আরো জোরে চিৎকার করলো সে, কিন্তু কোন লাভ হলো না। ইঁদুরটা সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে আছে। গোলাপী নাক, দ্যুতিময় চোখ, মসৃণ শরীর, সাদা লম্বা গোঁফ আর লেজ যার শেষ সীমা দেখা যাচ্ছে না। অ্যালেক্সের সারা শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে, শ্বাসও ঠিকমতো নিতে পারছে না। আরো চিৎকারের চেষ্টা করলো, কিন্তু ক্রমেই শক্তি হারানো একসময় তাও করতে পারলো না। অনেকক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো। 

তার থেকে চল্লিশ সেন্টিমিটার উপরে দুলতে লাগলো ইঁদুরটি। হুট করেই ঝুড়ির কাছে গিয়ে নিজের খাবার খাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে তাকে দেখছে। দৃশপট থেকে কিছু সময়ের জন্য উধাও হয়ে আবারো তার সামনে এলো। প্ৰায় ত্রিশ সেন্টিমিটার লম্বা ইঁদুরটা প্রাপ্তবয়স্ক, ভাব-ভঙ্গিমায় বোঝা যাচ্ছে বেশ ক্ষুধার্ত। খাবার শেষ করে তার দিকে এগুতে লাগলো, যেন বুঝতে পেরেছে সে কোন বাঁধা দিতে পারবে না। ইঁদুরকে এগুতে দেখে আরো কুকড়ে গেল সে, নিজের দুর্গতির কথা ভেবে চোখ বন্ধ করে ফেললো। কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো তার চোখ থেকে। কিছুক্ষণ পর কোন সারাশব্দ না পেয়ে চোখ খুললো, দেখতে পেলো কোন ইঁদুর নেই। যা ক্ষণিকের জন্য হলেও তাকে স্বস্তি দিলো। 

*

প্যাসকেল ট্র্যারিক্সের বাবা। লোকটা কীভাবে তাকে খুঁজে পেলো? অ্যালেক্সের ব্রেন ঠিকমতো কাজ করলে হয়তো এর উত্তর খুঁজে পেতো, কিন্তু এখন তার মাথায় যা আছে তার সবই যেন কিছু স্থির চিত্র, কেমন একটা খাপছাড়া ভাব, কিছুই মিলছে না। আর তা ছাড়া এখন এইসব ভেবেই কী লাভ? বাঁচতে হলে লোকটার সাথে সমঝোতা করতে হবে। বিশ্বাসযোগ্য কোন গল্প ফাঁদতে হবে, যাতে লোকটা ছেড়ে দেয় তাকে। আগে এখান থেকে বের তো হোক, তারপর অন্য কিছু ভাবা যাবে। নিজের মাথায় থাকা যাবতীয় তথ্য একাট্টা করার চেষ্টা করলো, কিন্তু তখনি থেমে যেতে হলো। আরেকটা ইঁদুর চলে এসেছে। 

এটা আগেরটার চেয়ে আরো বড়। সম্ভবত সবচেয়ে বড় সাইজের। কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে সরাসরি অ্যালেক্সের মাথার কাছে এসে থামলো। অ্যালেক্সের চিৎকারেও কোন ভ্রুক্ষেপ করল না। এটার লেজ এতোটাই বড় যে কাঠের টুকরার মাঝ দিয়ে তার ঘাড়ের কাছে চলে এসেছে। 

সে আবারো চিৎকার করে উঠলো। ইঁদুরটা তিন-চারবার বাক্সের এপাশ থেকে ওপাশে দৌড়াতে লাগলো। অ্যালেক্স ইঁদুরের প্রতিটি পদক্ষেপের উপর সতর্ক নজর রাখছে, হার্টবিট বেড়ে গেছে, ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। 

তার শরীর দিয়ে প্রসাব, পায়খানা আর বমির গন্ধ বের হচ্ছে। অনেকটা পঁচা মাংসের গন্ধের মতন। 

ইঁদুরটা নাক দিয়ে তাই শুঁকছে। 

উপরের দিকে তাকালো সে। আরো দুইটা ইঁদুর নেমে আসছে উপর থেকে। 

অধ্যায় ১৪ 

বিল্ডিংয়ের বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ফিল্মের ক্রুরা দখল করে নিয়েছে। আর.এ.আই.ডি স্কোয়াডের সব সদস্য চলে গেছে, ফরেনসিক সদস্যরা তাদের উপস্থিতির প্রমাণ দিতে এখানে ওখানে নানা জিনিস ফেলে রেখেছে। বিল্ডিং এর পুরো চত্বর আলোয় ঝলমল করছে, এখন যে মধ্যরাত তা বোঝার কোন উপায় নাই, বিন্দুমাত্র ছায়া দেখা যাচ্ছে না কোথাও। হাঁটাচলা করার জন্য সাদা আর লাল রঙের টেপ দিয়ে আলাদা জায়গা করে দেয়া হয়েছে, যাতে করে কোন প্রমাণই নষ্ট না হয়। 

অপহরণের পর মেয়েটাকে এখানে আনা হয়েছিলো কিনা, সেই ব্যাপারটাই খতিয়ে দেখছে তারা। 

ঘটনাস্থলের আশেপাশে লোকজন জমা হয়ে গিয়েছে, আরম্যান্ডের বেশ পছন্দ এই ধরনের জটলা। এমন জটলা তার সিগারেটের উৎস। অন্যান্য অফিসার এসে লোকজনকে সরানোর আগেই, দু নম্বরি করে সে আগামী চার দিনের রসদ যোগাড় করে ফেলেছে। 

বিল্ডিং এর চত্বরে দাঁড়িয়ে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে আরম্যান্ড, সিগারেট পুড়তে পুড়তে এখন তার হাতে তাপ লাগছে। এতে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, দার্শনিক ভঙ্গিতে একদিকে তাকিয়ে আছে। 

“আচ্ছা। আমার ধারণা ম্যাজিস্ট্রেটকে এখন আর পাওয়া যাবে না,” ব্যঙ্গ করে বলল ক্যামিল। 

আরম্যান্ড কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেল, এখনো দার্শনিক ভঙ্গিমায় অবিচল আছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিশ্চুপ থাকার এক অদ্ভুত গুণ আছে তার। 

“আসলে বেচারার ভাগ্যই খারাপ। প্রতিদিন তো আর অপরাধীরা লরির নিচে চাপা পড়ে না। হুট করেই উদয় হয়ে, পরিস্থিতি আঁচ না করে নায়ক সাজতে চেয়েছিলো শালা ম্যাজিস্ট্রেট,” বলে থামলো ক্যামিল। 

ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের ঘড়ির দিকে তাকালো সে। আরম্যান্ড এখনো নিশ্চুপ, জুতার ফিতের দিকে তাকিয়ে আছে। লুইসকে কোন একটা বিষয় নিয়ে চিন্তিত দেখা যাচ্ছে। 

“হয়তো ব্যাটা এখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আর তা ছাড়া সারাদিন এমন বালের কাজ করলে, কার না ঘুম পাবে।” 

সিগারেটের শেষাংশ ফেলে দিলো আরম্যান্ড। 

“আচ্ছা, তাহলে আমি যেন কী বলছিলাম?” ক্যামিল জিজ্ঞেস করলো।

“না। কিছু না। আমরা কি এখন হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবো? কাজে নামবো না?” আরম্যান্ড প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো বাকি দুই সহকর্মীর দিকে। 

ক্যামিল তাকে জানালো যে তারা এখন ট্র্যারিক্সের বাসায় যাবে। ছোটখাট বাসা, রুমগুলো গোছানো, ক্রোকারিজগুলোও বেশ গুছিয়ে রাখা, যন্ত্রপাতি গুলো হার্ডওয়ার দোকানের মত করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বিয়ারের মজুদের কথা না বললেই নয়, পুরো নিকারাগুয়া শহরকে ভাসিয়ে দেয়া যাবে। এছাড়া আর তেমন কিছু নেই, কোন কাগজপত্র নেই, কোন বই নেই, একটা নোটপ্যাডও নেই। 

কৌতুহল জাগানিয়া একটা জিনিস অবশ্য পাওয়া গেছে: একটা টিনএজারের বেডরুম। 

“ট্র্যারিক্সের ছেলে প্যাসকেলের রুম এটা,” লুইস বলল। 

বাসার অন্যান্য রুম থেকে এই রুম কিছুটা আলাদা। ধূলার আস্তরণ দেখেই বোঝা যায়, অনেকদিন ধরে পরিস্কার করা হয় না। এক কোণায় পড়ে আছে ওয়্যারলেস সুবিধাযুক্ত একটা এক্স-বক্স ৩৬০, আর পুরোনো মডেলের একটা কম্পিউটার। কোন অদক্ষ হাতে মনিটরের কিছু অংশ যে মোছা হয়েছিলো, তার ছাপ সুস্পষ্ট। ইতিমধ্যে একজন হার্ড-ড্রাইভ চেক করা শুরু করে দিয়েছে। 

“গেমস, গেমস আর গেমস। সাথে অবশ্য ইন্টারনেট সংযোগও আছে,” হার্ড ড্রাইভ পরীক্ষা করা টেকনিশিয়ান বলল। 

ক্যামিল শুনছে আর আলমারি থেকে বের করা কিছু ছবি দেখছে। 

“পর্ণ সাইট…শুধু ভিডিও গেমস আর পর্ণ সাইটই পাওয়া গেল। আমার ছেলেও অবশ্য এমন,” আবারো বলল টেকনিশিয়ান। 

“ছত্রিশ…” 

কথাটা শুনেই সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে লুইসের দিকে তাকালো।

“ট্র্যারিক্সের ছেলের বয়স ছত্রিশ,” বলল লুইস। 

“ঠিক আছে। তাহলে তো ঘটনা একটু ভিন্ন,” একটু বিস্মিত দেখা গেল টেকনিশিয়ানকে। 

“আর কিছু পাওয়া গেল?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল। 

“কিছু মেইল পাওয়া গেছে। কিন্তু মেইলের ভাষা…” 

“তোমার ছেলেও কি এমন?” 

একটু বিরক্ত হতে দেখা গেল টেকনিশিয়ানকে, বারবার একই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। 

মনিটরের দিকে তাকালো ক্যামিল। লোকটা বেশ ভালো একটা জিনিস খেয়াল করেছে। মেইলের ভাষা খুবই সংযত এবং বানানও একদম শুদ্ধ। 

লুইসের কাছ থেকে গ্লাভস নিয়ে পড়লো সে। ড্রয়ার থেকে পাওয়া বাপ- বেটার একটা ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েকমাস আগে তোলা একটা ছবি। ছেলেটা দেখতে অতোটা সুদর্শন নয়, লম্বা নাক, উচ্চতা বেশ ভাল, রোগা-লিকলিকে শরীর, চেহারায় বখে যাওয়া ভাব স্পষ্ট। বাক্সে আটকা পড়া মেয়েটার কথা মনে পড়লো তার। এই ছেলেকে মোটেও ওই মেয়ের সাথে মানায় না, কেননা মেয়েটা বেশ সুন্দরী। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *