অ্যালেক্স – ৪৫

অধ্যায় ৪৫ 

প্যারিসে ফিরেই নিজের গাড়ি নিয়ে রসি এয়ারপোর্টে চলে গেল অ্যালেক্স। নিজের পরবর্তী গন্তব্য নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবলো। দক্ষিণ আমেরিকা যাওয়ার সামর্থ্য তার নেই, আর আমেরিকা মানেই সেখানে পুলিশের ঝামেলা। তাই আমেরিকার চিন্তা বাদ দিলো। সবদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিলো তার জন্য উপযুক্ত জায়গা হবে ইউরোপ মহাদেশ, বিশেষ করে সুইজারল্যাণ্ড। নিজের পরিচয় লুকিয়ে থাকার জন্য সর্বোত্তম জায়গা, নানা ধরনের মানুষের আনাগোনা এখানে। মানি লন্ডারিং এর আসামী, যুদ্ধাপরাধী, খুনিদের জন্য সবসময় নিজেদের দুয়ার খোলা রাখে সুইজারল্যাণ্ড। তাই আর দেরি না করে জুরিখগামী প্লেনের টিকেট কেটে ফেললো। পরেরদিন সকাল আটটা চল্লিশ এ ফ্লাইট। কিন্তু তার অনেক আগেই এয়ারপোর্টে এসে নিজের জন্য একটা সুটকেস কেনার ইচ্ছা পোষণ করলো। এর আগে কখনোই দামি কিছু কিনেনি নিজের জন্য। দোকানে ঢুকে বেশ কয়েকটা সুটকেস নেড়ে দেখলেও শেষমেশ একটা মনোগ্রামড ট্রাভেল ব্যাগ কিনলো। ডিউটি ফ্রি শপ থেকে এক বোতল বোমোর কিনে নিলো নিজের জন্য। পেমেন্ট করলো ক্রেডিট কার্ড দিয়ে। 

কেনাকাটা শেষ হয়ে গেলে চলে গেল হোটেল ভলুবিলিসে। হোটেলের বাইরে জ্বলজ্বল করছে ‘আরাম এবং গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দেয়া হয়। একশ রুম আর একশ পার্কিং স্পেস যেন আরামের প্রতিনিধিত্ব করছে। তবে সব রুমের জন্যেই অ্যাডভান্স পেমেন্ট করতে হয়, অ্যালেক্সও তাই করলো। এবারও নিজের ক্রেডিট কার্ড কাজে লাগালো। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে হোটেলের রিসিপশনিস্টকে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, এখান থেকে এয়ারপোর্ট যেতে কতক্ষণ লাগবে?” কিছুক্ষণ ভেবে রিসিপশনিস্ট উত্তর দিলো, “বড়জোর পঁচিশ মিনিট।” সকাল সাতটার দিকে একটা ক্যাবের জন্য বুকিং দিয়ে রাখলো সে। 

লিফটের আয়নার নিজেকে দেখলো- ক্লান্ত বিধ্বস্ত কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। 

রাত আটটা বাজে, এটা জানার জন্য অবশ্য ঘড়ি দেখতে হলো না তার- কেননা পাশের রুম থেকে রাত আটটার খবরের শব্দ ভেসে আসছে। গোসলে যাওয়ার আগে নিজের উইগ খুলে বিছানায় রাখলো সে, এরপর কন্ট্রাক্ট লেন্স খুলে টয়লেটে ফ্লাশ করে দিলো। ব্যাগি জিনস আর সোয়েটার গায়ে চাপিয়ে, খালি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো এবার। তবে লিফটের বদলে সিঁড়ি ব্যবহার করে নিচে নামলো। নিচে নেমে এক কোণায় লুকিয়ে রিসিপশন ডেস্কের দিকে চোখ রাখলো সে। রিসিপশনিস্ট চলে যাওয়ার সাথে সাথে পার্কিং এরিয়ার দিকে চলে গেল। 

বেশ কয়েকটা বিন লাইনার কিনে রেখেছিলো সে। গাড়ির বুট খুলে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। চোখ গড়িয়ে পানি নেমে এলো। গাড়ির বুটে তিনটা বাক্স যার গায়ে ‘ব্যক্তিগত’ স্টিকার সাঁটা, নিজেকে অন্যকিছু ভাবার সময় না দিয়ে, বাক্সে থাকা জিনিসপত্র বিন ব্যাগে ভরতে শুরু করলো। ভেতর থেকে উঠে আসা চাপা গোঙানিকে অগ্রাহ্য করে, নিজের প্রিয় জিনিসগুলোকে একত্রিত করলো : কপিবুক, চিঠি, ব্যক্তিগত ডায়েরী, মেক্সিকান কয়েন। এতোদিন ধরে জমানো জিনিসগুলোর প্রতি আলাদা মায়া জন্মেছিলো তার। কস্টিউম জুয়েলারি, কিছু ছবি, ছোটবেলায় কেনা একটা উইগ, আর ড্যানিয়েলের দেয়া হার্ট শেপড চাবির রিং। ড্যানিয়েল ছিল তার জীবনের প্রথম ভালোবাসা। এতো সব স্মৃতি একসাথে উঠে আসায়, তার পক্ষে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে উঠলো। সোয়েটারের হাতায় একটু পর পর চোখ মুছতে লাগলো। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করলো, কিন্তু এখন সেই শক্তিটুকুও পেলো না। গাড়ির বুটে বসে পড়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। প্রতিটি জিনিস আলাদা আলাদা করে তিনটা বিন ব্যাগে ভরে ফেললো। প্রতিটা জিনিস ব্যাগে ভরার সময়, স্মৃতিগুলো যেন চিৎকার করে তাকে ডাকতে লাগলো। এমন সময় পার্কিং এরিয়ায় একটা গাড়ি আসার শব্দ পাওয়া গেল। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে গাড়ির একপাশে চলে আসলো। 

গাড়ির বুট লক করে বিন ব্যাগ তিনটা হাতে নিয়ে পার্কিং এরিয়ার স্লাইডিং গেটের সামনে চলে এলো। গেট দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেকদিন ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। দুএকটা গাড়ি ছাড়া রাস্তা এখন পুরোপুরি খালি। রাস্তায় বেরিয়ে বেশ কয়েকটা ডাস্টবিন চোখে পড়লো তার। হোটেলের এতো কাছেই বিন ব্যাগ ফেলতে চাইলো না। সামনের দিকে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর, একটা ডাস্টবিন চোখে পড়লো। পরিত্যক্ত ডাস্টবিনে বিন ব্যাগগুলো ছুঁড়ে দিলো, এর সাথে কাঁধে থাকা ব্যাগটাও। ঢাকনা লাগিয়ে হোটেলের পথ ধরলো। নিজেকে অনেক হালকা লাগছে তার। আর কোন পিছুটান রইলো না। অসমাপ্ত কাজটুকু আরো আগেই শেষ করে এসেছে। হোটেলে ফিরে দেখলো রিসিপশনিস্ট বসে বসে টিভি দেখছে। তাকে পাশ কাটিয়ে রুমে চলে গেল। জামা কাপড় ছেড়ে বাথটাবের উষ্ণ পানিতে নিজেকে সঁপে দিলো। 

অধ্যায় ৪৬ 

মাঝে মাঝে কিছু সিদ্ধান্তের মাঝে রহস্য লুকিয়ে থাকে। এই যেমন, ক্যামিল একটু আগে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার পেছনের কারণ সে নিজেও ব্যাখ্যা করতে পারবে না। 

আজ সন্ধ্যা থেকেই এই কেস নিয়ে অনেকক্ষণ ভেবেছে। মেয়েটাকে ধরার আগে আর কত মানুষকে যে হত্যা করবে তাই ভাবছে এতোক্ষণ ধরে। তবে মেয়েটার দিকে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করে, আরেকটা স্কেচ করেছে একটু আগে। তাকে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি জীবন্ত মনে হচ্ছে। এতোদিনে নিজের ভুলটা ধরতে পেরেছে সে। এই মেয়ের সাথে আইরিনের কোন মিল নেই। কিন্তু বারবার আইরিন আর মেয়েটাকে গুলিয়ে ফেলছিল। মিল বলতে শুধু এতটুকুই যে দুজনেই অপহরণের শিকার। আর এই কেস আবারও তাকে সেই পুরোনো স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়, আবারও সেই অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করে সে। ঠিক একারণেই কোন গোয়েন্দাকে তার ব্যক্তিজীবন সম্পর্কিত কোন কেস দেয়া হয় না। কিন্তু তাকে এই পরিস্থিতিতে ফেলা হয়েছে। লা গুয়েন ইচ্ছে করেই এই কেসের সাথে তাকে জড়িয়ে ফেলেছে, যাতে করে নিজের ভয়ের মুখোমুখি হয়ে, সেটাকে জয় করতে পারে। 

জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে, জুতা পড়ে, চাবি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ক্যামিল। ঘুমন্ত শহরকে উপভোগ করার জন্য ধীরে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছে। 

পঞ্চাশ মিটার সামনেই বিল্ডিংটা দেখা গেল। জানালায় হেডলাইটের আলোর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। গাড়ি থামিয়ে, হেডলাইট জ্বালিয়ে রাখলো। 

কিছুক্ষণ পর হেডলাইট বন্ধ করে, গাড়ি থেকে নেমে, বাড়িটার দিকে হাঁটা শুরু করলো। প্যারিসের চেয়ে এখানে ঠাণ্ডা কিছুটা কম। এমন পরিবেশ বেশ ভাল লাগে তার। ওইদিনের স্মৃতি আবারো মনে পড়ে গেল। হুট করেই যেন আকাশ থেকে নেমে আসছিলো হেলিকপ্টার। হেলিকপ্টারের গর্জন আর তীব্র বাতাসের বিরুদ্ধে দৌড়াতে শুরু করলো। এতোটুকুই মনে পড়ছে তার। পুরোনো স্মৃতি মনে করা বেশ কষ্টসাধ্য। 

বিল্ডিংটা একতলা। অনেক আগে একজন কেয়ারটেকার ছিলো, কিন্তু এখন কেউ থাকে না। দূর থেকে দেখতে একটা কুড়েঘরের মত লাগে, যার সামনে খোলা বারান্দা। ছোট বেলায় এই পথ ধরে কতবার হেঁটেছে ক্যামিল, তার ইয়ত্তা নেই। মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তো সেই সময়। কিন্তু আস্তে আস্তে যতই বয়স বেড়েছে, ততই নিজেকে ঘরের মাঝে আবদ্ধ করে ফেলেছে। বাইরে কারো সাথে মিশতো না। কেননা প্রতিদিনই হাস্যরসের খোরাক হওয়াটা তার কাছে অসহণীয় হয়ে উঠেছিলো। এরজন্য কোন বন্ধুও বানানো হয়নি। আর বাড়ির পাশের বন সবসময় তার কাছে এক ভীতির নাম। এখনো এই বনে ঢুকতে ভয় লাগে তার। তবে এই পরিত্যক্ত জায়গায় প্রায়ই এসে সময় কাটায় সে। কেননা এখানেই তার মা কাজ করতো, আর এখানেই আইরিন মারা যায়। 

অধ্যায় ৪৭ 

বুকের উপর আড়াআড়ি করে হাত দিয়ে হোটেল রুমে বসে আছে অ্যালেক্স। একটু পরেই তার ভাইকে ফোন করবে। তার ভাই ফোন ধরার সাথে সাথেই বলবে, “ওহ, তুমি…। বলো কী চাও এইবার?” শুরু থেকে একদম শেষতক এমন রাগান্বিত কণ্ঠেই কথা বলে যাবে। হোটেলের টেলিফোন দিয়ে ভাইকে কল করার জন্য আগে শুণ্য চাপতে হলো। এরইমাঝে হোটেলের আশেপাশে দেখা করার জন্য একটা জায়গা বেছে নিয়ে, ঠিকানা লিখে রাখলো। ফোন দেয়ার পর কিছুটা অবাক হলো, কেননা তার ভাইয়ের ফোন কখনো বন্ধ থাকে না। এমনকি রাতেও না। হয়তো কোন টানেলের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে? অথবা কোথাও ফেলে গেছে, কে জানে? এইসব না ভেবে একটা ভয়েসমেইল দিয়ে রাখলো। “হাই, অ্যালেক্স বলছি। তোমার সাথে দেখা করাটা খুব জরুরী। আজকে রাত সাড়ে এগারোটায় ১৩৭, বোলেভার্ড জুভেনাল, উলনে তে উপস্থিত থাকবে। যদি আমার দেরি হয় তো অপেক্ষা করবে।” 

ফোন রাখার আগে আরেকটা কথা মনে পড়লো তারঃ “কিন্তু আমার যেন অপেক্ষা করতে না হয়।” 

বিছানায় শোয়ার পর টি.ভি’র শব্দে বিরক্তবোধ করলো। শুয়ে শুয়ে দিবাস্বপ্ন দেখছে সে নানান বিষয়ে, অবশ্য তার উদ্ভট দিবাস্বপ্নগুলোর পেছনে কারণও আছে। পাশের রুম থেকে এখনো শব্দ আসছে, অনেক মানুষই বোঝে না তারা কত সাউন্ড দিয়ে টি.ভি দেখছে। চাইলেই এই সাউন্ডের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পারে সে। পাশের রুমের দরজায় নক করবে, দরজা খোলার পর দেখা যাবে তার শিকারের মতই কোন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে- কয়জন হয়েছে এতোদিনে? পাঁচ, ছয়, নাকি আরো বেশি? মিষ্টি হেসে তাকে বলবে, “হাই, আমি আপনার পাশের রুমেই থাকি। আমি কি ভেতরে আসতে পারি?” তার মতো সুন্দরী নারীর এমন আহ্বান কোন পুরুষের পক্ষেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না। এরপর বিস্ময়ের ঘোর না কাটতেই আবারো বলবে, “আমাকে নগ্ন দেখতে চান?” অথবা একটু ভদ্র ভাষায় বলবে, “রুমের পর্দাটা টেনে দিন।” এই কথা শোনার পর যে লোকটার চোয়াল ঝুলে মেঝেতে পড়ে যাবে, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই অ্যালেক্সের। কেননা অনেক পুরুষের সাথেই মেলামেশার কারণে সবাইকে চেনা আছে তার। আর যদি নিজের ধারা বজায় রাখে তাহলে লোকটাকে বলবে, “দয়া করে টি.ভি’র ভলিউমটা কমিয়ে দিন।” এরপর লোকটা তার কাছে ক্ষমা চেয়ে ভলিউম কমাতে গিয়ে যখনি নিচু হবে, তখনি আক্রমণ করে বসবে। মাথায় লাগাতার কয়েকটা আঘাত যে কাউকে নির্লিপ্ত করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এরপর বেঁধে শুধু এসিড ঢেলে দেয়া বাকি। ব্যস, কাজ শেষ। এরপর আর টি.ভি’র সাউন্ড বাড়ানোর কেউ থাকবে না। রাতে একটা শান্তির ঘুম হবে তার। 

বিছানায় শুয়ে শুয়ে এসব চিন্তাই সে করে। পুরোনো স্মৃতিগুলো তার দরজায় এসে কড়া নাড়ছে। যে কোন উপায়েই এই লোকগুলোকে হত্যা করতেই হতো। কষ্ট পেতে পেতে এরা মারা যাচ্ছে, হাতজোড় করে প্রাণ ভিক্ষা করছে, তবুও বিন্দুমাত্র অনুশোচনা বোধ হয়নি তার। কেননা, এমন মৃত্যই তাদের প্রাপ্য ছিলো। 

হুট করেই কিনে আনা বোতলের কথা মনে পড়ে তৃষ্ণা লাগলো তার। ছোট একটা গ্লাসে বোমোর ঢেলে নিলো, কিন্তু সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলো পরক্ষণেই। গ্লাস ফেলে দিয়ে বোতল থেকেই ঢক ঢক করে গিলতে শুরু করলো। একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করলো, কিন্তু আসার সময় কিনে আনা হয়নি। সিগারেট না আনার আফসোসে পুড়লো এখন। পনেরো বছর আগে খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। অবশ্য সিগারেটের প্রতি তীব্র নেশা কখনোই ছিল না তার। যুগের সাথে তাল মেলানোর জন্যেই সিগারেট ধরেছিলো সে। তার বয়সি মেয়েরা যা যা করে, সবই করার চেষ্টা করেছে সেই সময়। আর হুইস্কির প্রতিও কোন টান কখনোই ছিল না, বরং একটু খেলেই মাতাল হয়ে পড়ে। তাই খুব বেশি খায় না। গুনগুন করে গান গাইছে আর নতুন কেনা ব্যাগে জিনিসপত্র গোছাচ্ছে। সবসময় পরিপাটি আর গোছানো থাকতেই পছন্দ করে সে। যে বাসাতেই থাকুক না কেন, ঘরটাকে নিজের মত করে গুছিয়ে নেয়। 

হালকা মাথা ঘুরছে, এরইমাঝে ব্যাগ গোছানো শেষ করলো। আরেকদফা গলা ভিজিয়ে নিলো উষ্ণ তরলে। নিজের অতীত নিয়ে ভাবতে ভাবতে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লো। ছোটবেলায় যে কেউ তাকে দেখলেই বলতো, “বাহ। মেয়েটা কত শান্ত!দেখতে কত মিষ্টি।” কিন্তু বড় হয়ে, সেই মেয়েই এমন নিষ্ঠুর কাজ করতে পারে, তা কেউ কখনো ভাবতেও পারেনি। এমনকি সে নিজেও তা ভাবেনি। 

এসব ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। 

চুমুকের পর চুমুক দিতে দিতে একসময় বোতল খালি হয়ে গেল। একা একাই অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করলো অ্যালেক্স। এতো দুঃখ যে তার ভেতর জমা হয়ে আছে, তা নিজেও জানতো না। চোখের জল এখনো তার ভেতরে অবশিষ্ট আছে দেখে, নিজেই খানিকটা অবাক হলো। 

পুরোনো দিনের কথা আরেকবার মনে পড়লো তার। আজ রাতটা একাকী জীবনের আরেকটি দুঃসহ রাত। 

অধ্যায় ৪৮ 

কাঠের সিঁড়িতে পা দিতেই ভেঙ্গে পড়লো। অনেক কষ্টে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করলো ক্যামিল। কিন্তু ডান পা আটকে গেছে কাঠের সিঁড়িতে। পা ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই বেশ ব্যথা পেলো পায়ে, উপায় না দেখে বসে পড়লো। স্টুডিওর দিকে পিঠ দিয়ে বসে আছে সে, হেডলাইট তার সামনে জ্বলজ্বল করছে। ওইদিন ইমার্জেন্সী সার্ভিস আসার আগে ঠিক ওখানেই ছিলো। আস্তে আস্তে পুরোনো দিনের স্মৃতি সব মনে পড়তে লাগলো। 

এইসব মনে করে কী লাভ? বরং সময় নষ্ট ।

দরজার দিকে ঘুরতেই দেখলো, সিলগালা করে দেয়া। কিন্তু, চিন্তার কিছুই নেই। একপাশের জানালার একটা গ্লাসও নেই, কে যেন ভেঙে ফেলেছে। ওদিক দিয়েই ভেতরে ঢোকার সিদ্ধান্ত নিলো। কিছুক্ষণ পর নিজেকে আবিষ্কার করলো বহু পরিচিত লাল টাইলসের মেঝের উপর। অন্ধকারে চোখ সয়ে যেতে কিছু সময় লাগলো। 

সাদা দেয়ালে এমন কোন জায়গা বাকি নেই, যেখানে গ্রাফিটি নেই। একটু সামনে এগুতেই চোখে পড়লো একটা ছেঁড়া ম্যাট্রেস। ছেড়া কাগজ, পোড়া মোমবাতি, খালি বোতল আর ক্যান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মেঝেতে। ছাদের একপাশ হেলে পড়েছে, যেখান দিয়ে বনও দেখা যাচ্ছে। 

হুট করেই একটা ছবি ভেসে উঠলো তার মনে। 

আইরিন আর তার সন্তানের মৃতদেহ। 

হাঁটু গেঁড়ে বসে, কান্নায় ভেঙে পড়লো ক্যামিল ।

অধ্যায় ৪৯ 

নগ্ন হয়ে হোটেলের বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে অ্যালেক্স। আজ তার মন আনন্দে পূর্ণ। নিজের টি-শার্ট হাতে নিয়ে ঘুরাচ্ছে, আর এদিকে স্মৃতিগুলো তার চোখের সামনে এসে ভিড় করছে। টি-শার্টটা যেন তার পতাকা হয়ে উঠেছে। প্রথমেই ভেসে উঠলো ক্যাফে মালিকের কথা, তার মেদবহুল শরীর আর কোটর থেকে বেরিয়ে আসা চোখের কথা। আরো মনে পড়লে ববির কথা। এর নাম মনে থাকার কারণে কিছুটা খুশি মনে হলো তাকে। ববির কথা মনে পড়তেই টি-শার্টই হয়ে উঠলো তার অস্ত্র। কাল্পনিক ভ্রু ড্রাইভার আরেকবার ববির চোখে গেঁথে দিলো। তবে এবার যেন আরো বেশি গভীরে চলে গেল স্ক্রু ড্রাইভার। মনের আনন্দে সে এখন নাচছে। সারা ঘর জুড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে আর স্মৃতিগুলোও যেন তার পিছুপিছু ছুটছে। একে একে সব শিকারকে আরেকবার হত্যা করার পরেই থামলো তার নাচ। এখন বেশ ক্লান্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসে আছে। 

নিজের ট-শার্ট বাতাসে ছুঁড়ে দিলো যেন তাতে রক্ত লেগে আছে। 

রাত গভীর হওয়ার পর, পাশের রুম থেকে শব্দ আসাও বন্ধ হয়ে গেল। লোকটা হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু পাশের রুমে তার জন্য যে আজরাইল অপেক্ষা করেছিলো, তা সে কখনোই জানবে না। 

রুমে থাকা আয়নার সামনে দাঁড়ালো। নগ্ন অবস্থায় নিজেকে দেখছে, এমন সে প্রায়ই করে। অনেকক্ষণ ধরে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকলো, শুধু তাকিয়েই থাকলো। 

নিজেকে যতবারই এমন আয়নার সামনে দেখেছে, ততবারই কেঁদেছে। এই কান্নার উপর কখনোই নিয়ন্ত্রণ ছিল না তার। 

কেউ যেন ভেতর থেকে তাকে পরিহাস করছে। 

হুট করে একটু নিচু হয়ে, নির্দ্বিধায় বেসিনের এক কোণায় মাথা ঠুকতে শুরু করলো। নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে পরপর ছয়বার একই কাজ করলো এবং একই জায়গায়। আঘাতের কারণে ঠং ঠং করে আওয়াজ হতে লাগলো। শেষ আঘাতের সময় মাথাটা একটু ঘুরে উঠলো, চোখগুলো যেন বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো। সাথে সাথে বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিলো সে। রক্তে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। বাম হাতটা বাড়িয়ে বার্বিচুরেটের বোতল নিয়ে নিলো। পেটের উপর বোতল রেখে আরেকহাতে সবগুলো পিল নিয়ে মুখে পুড়লো। এরপরে বিছানায় থাকা হুইস্কির বোতলটা নিয়ে ঢক ঢক করে গিলতে লাগলো। যতক্ষণ শ্বাস রইলো, ততক্ষণই পান করলো হুইস্কি। বোতলটা হাত থেকে যখন পড়ে গেল, তখন অর্ধেক খালি হয়ে গিয়েছে। মেঝেতে বোতল গড়িয়ে যাওয়ার শব্দও এলো তার কানে। 

অনেক কষ্টে বমি করার তীব্র ইচ্ছাকে দমন করলো। 

চোখ গড়িয়ে পানি নেমে এলো, কিন্তু কিছুই বুঝলো না। 

শরীর এখানে থাকলেও, মন অন্য কোথাও চলে গেছে। 

আস্তে আস্তে শরীরও নিস্তেজ হয়ে গেছে, শরীরের উপরেও নিয়ন্ত্ৰণ হারালো সে। এখান থেকে ফেরার কোন পথ নেই। তার মন এখন অন্য জগতে চলে গেছে। 

যদি অন্যজগত বলে কিছু থাকে তো। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *