অ্যালেক্স – ৩৫

অধ্যায় ৩৫ 

কোন কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না তারা- ক্যামিল, লুইস, লা গুয়েন, ম্যাজিস্ট্রেট। কোন দিক থেকেই সুবিধা করতে পারছে না। আর সবখানেই রহস্যজনক উপস্থিতি যে মেয়ের, তার সম্পর্কেও কোন তথ্য নেই হাতে। নিজের রিপোর্ট শেষ করলো সে। এখনো অফিসে অবস্থান করছে। বাসায় যাওয়ার কোন তাড়া নেই। দুদুশে না থাকলে, কখনোই হয়তো বাসায় যেতে ইচ্ছে করতো না তার। 

দিনে প্রায় দশ ঘণ্টা করে কাজ করেছে তারা। আরো অনেক লোককে জেরা করেছে, পুরোনো ফাইল ঘেটেছে, কয়েকটা পুরোনো কেসের চার্জশিট দেখেছে। কিন্তু কিছুতেই কোন ফল পাওয়া যায়নি। শূন্যহাতেই ফিরতে হয়েছে। এই ব্যাপারটাই সবাইকে অবাক করে দিলো। 

দরজায় উঁকি দিলো লুইস, সবাইকে এমন অবস্থায় দেখে ভেতরে ঢুকে পড়লো। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য কাগজপত্র। তার মাঝে বেশিরভাগই ওই মেয়ের। জুডিসিয়ারি বিভাগ থেকে তৈরি পোর্ট্রেটও আছে এখানে, কিন্তু তাতে জীবন নেই। কিন্তু নিজের আঁকা পোর্ট্রেটগুলোতে যেন প্রাণ দিয়ে দিয়েছে ক্যামিল। একদম জীবন্ত মনে হচ্ছে মেয়েটাকে। তার প্রায় ত্রিশটা পোট্রেট করেছে সে, যেন তার বহুদিনের চেনা। একটাতে দেখা যাচ্ছে, মেয়েটা গালে হাত দিয়ে বসে আছে, হয়তো কোন রেস্টুরেন্টের টেবিলে, গভীর মনোযোগ দিয়ে কোন গল্প শুনছে। আরেকটাতে দেখা যাচ্ছে, দর্শকের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে, ঠোঁট অনবরত কাপছে, এমন দৃশ্য যা হৃদয়কে দোলা দেয়। আর একটাতে, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হুট করে পেছন ফিরে তাকিয়ে আছে, কিছু একটা দেখে বিস্মিত, দোকানের গ্লাসে যার স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। 

এমন ভাল জিনিসের প্রশংসা করতে মন চাইলো লুইসের। কিন্তু, তাকে কিছুই বলল না। কেননা সে জানে, ক্যামিল এমন পরম মমতা তার স্ত্রী আইরিনের পোর্ট্রেট করতো। ফোনে কথা বলতে বলতে হাজারো পোট্রেট আঁকা হয়ে যেতো। 

ক্যামিলের সাথে কিছুক্ষণ গল্প করলো। এরপর তাকে জানালো হাতের কিছু কাজ গোছানো বাকি বলে। ক্যামিল আর অপেক্ষা না করে, নিজের হ্যাট আর কোট নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। 

যাওয়ার পথে আরম্যান্ডের সাথেও দেখা করে। আরম্যান্ডের কাজ শেষ হওয়ার কারণে দুইজনে একসাথে রওনা দিলো। ক্যামিল আর লুইস শুধুমাত্র সকালেই শুভেচ্ছা বিনিময় করে, সন্ধ্যায় না। আর এদিকে আরম্যান্ডের সাথে শুধু সন্ধ্যায়। 

নিজস্ব নিয়মের বাইরে এক পা ফেলে না সে। এই কথা তাকে কেউ বলার সাহসও পায় না, বরং অন্যদেরকেও তার নিয়মের মাঝেই থাকতে হয়। আর এই নিয়মগুলো তার কাছে শুধু নিয়ম না, যেন অবশ্য পালনীয় পবিত্র কোন অনুষ্ঠান। জীবনটা তার কাছে অবিরাম এক উৎসবের নাম। 

একসাথে কিছুদূর আসার পর আরম্যান্ড নিজের বাসার দিকে চলে গেল। আর ক্যামিল নিজের বাসার দিকে পা বাড়ালো। বাসায় তার আদরের জন্য অপেক্ষা একমাত্র সঙ্গি দুদুশে। এর কারণেই ঘরে ফিরতে হয় তাকে। 

ক্যামিল কোন এক জায়গায় পড়েছিলো, মানুষ যখন একদমই আশা ছেড়ে দেয়, তখন হুট করে আসা কোন ইশারা হয়তো তাকে বাঁচাতেও পারে। ঠিক এই মুহূর্তে এমনটাই ঘটলো তার সাথে। বজ্রঝড়, একটু আগেও যা থেমে যাবে বলে মনে হচ্ছিল, এখন আবারো ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। বাতাসের ঝাপটায় মাথায় হ্যাট প্রায় উড়ে যাচ্ছিলো। ট্যাক্সির জন্য ছুটলো। দুইজন পথচারীকে দেখলো ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ, হয়তো ট্রেন লেট করছে। ট্যাক্সির জন্য দাঁড়িয়ে থাকার সময় মনে হলো, এতোদিন ধরে খুঁজতে থাকা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে। কীভাবে পেলো তা জিজ্ঞেস না করলেও চলবে। মেয়েটা কীভাবে পালিয়েছিলো তার জবাব পেয়ে গেছে। বাসে পালানো সম্ভব ছিল না, কেননা এতো এতো সি.সি.টি.ভি ক্যামেরার মাঝে নিজের পরিচয় লুকানো সম্ভব হত না তার। সবার নজর এড়িয়ে যাওয়ার একমাত্র উপায় ট্যাক্সি। 

এভাবেই মেয়েটা পালিয়ে গেছে ওই দিন। আর বেশিক্ষণ দাঁড়ানো গেল না। একটা ট্যাক্সি এসে থামলো তার সামনে। 

“ক্যুই দ্য ভালমি যাবে?” 

“পনেরো ইউরো,” বলল ট্যাক্সি ড্রাইভার। 

কথা শুনেই বুঝতে পারলো পূর্ব ইউরোপিয়ান, কিন্তু কোন দেশের…? এসব ক্ষেত্রে ক্যামিল খুব একটা পারদর্শী নয়। তাই আর দেরি না করে ট্যাক্সিতে চড়ে বসলো। ড্রাইভার যেন বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। 

“আমি আর ওইদিকে যাবো না। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছি, আমাকে আগের জায়গায় নামিয়ে দিয়ে আসুন।”

রিয়ার ভিউ মিররে তাকে দেখার চেষ্টা করলো ড্রাইভার। ক্যামিল ভেরহোভেনের ওয়্যারেন্ট কার্ড দেখতো পেলো সে। 

*

নিজের কোট হাতে নিয়ে কেবলই বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো লুইস, এমন সময় ক্যামিল এসে হাজির, সাথে একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার। চলে যাওয়ার পর তার পুনরায় আগমনে কিছুটা বিস্মিত হলো সে। 

“একটু সময় হবে তোমার?” লুইসকে জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলো না। ড্রাইভারকে নিয়ে ইন্টারোগেশন রুমে চলে গেল। খুব বেশি সময় লাগবে না বলে তাকে আশ্বস্ত করলো। 

“আমরা-পুলিশের লোক তোমাদের জীবনকে নরক বানিয়ে ছাড়তে পারি। আজকে রাতের মধ্যেই সব ট্রেন স্টেশনের আশেপাশের জিপসি ক্যাব ড্রাইভারদের দুই-তৃতীয়াংশকে তুলে আনা হবে, বাকিরাও ক্যাব চালাতে পারবে না। আর যাদের ধরে আনবো, ওদের কাগজপত্র চেক করবো। যাদের কাগজপত্র নেই, নকল কাগজ ব্যবহার করছে, কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ কাগজ দিয়ে চলছে, সবগুলোকে জরিমানা করা হবে। ক্যাবের দামের সমপরিমাণ টাকা জরিমানা দিতে হবে, আর ক্যাবও বাজেয়াপ্ত করবো। দেখো, আমি দুঃখিত। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। আইন তো মানতেই হবে, তাই না? যখন এইসব শেষ হবে, এরপর অর্ধেক ফিরে যাবে বেলগ্রেডে, আর বাকি অর্ধেক জেলখানায়। এখন বলো কী করবে?” 

লিথুনিয়ান ড্রাইভার ফ্রেঞ্চ খুব একটা ভাল বুঝে না। কিন্তু ক্যামিলের কথার ঝাঁঝ ঠিকই টের পেয়েছে, আর কী বোঝাতে চেয়েছে তাও বুঝেছে। এই কথা শোনার পর তার আত্মা কেঁপে উঠলো। আর এদিকে ক্যামিল তার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে এমনভাবে ঘষছে যেন ময়লা পরিস্কার করছে। 

“আমাদের এই মধুর সাক্ষাতের নিদর্শন পূর্বক এটা আমি স্যুভেনিয়র হিসেবে রেখে দিচ্ছি। তবে, এটা ফেরত পেতে পারো।”

ক্যামিলের হাতে তার ফোন। হুট করেই তার মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেল। এখন আর সে আগের হাসিখুশি মুডে নেই। টেবিলের উপর ফোন ছুঁড়ে দিলো। 

“এখনই তুই তোর সঙ্গিসাথী ড্রাইভারদেরকে ফোন করবি। ওদেরকে জিজ্ঞেস করবি মঙ্গলবার রাত এগারোটার দিকে চার্চ আর প্যান্টিনের মাঝামাঝি জায়গা থেকে কে একটা মেয়েকে নিয়ে গিয়েছে। মেয়ের বয়স পয়ত্রিশ, দেখতে বেশ সুন্দরী। কিন্তু ওইদিন বেশ নোংরা আর ছিন্নভিন্ন অবস্থায় ছিলো। তোকে চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিলাম। এর মাঝে বের করতে না পারলে…” 

অধ্যায় ৩৬ 

বাক্সে বন্দী জীবন তার উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। আঘাত পরবর্তী ধকল কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় লাগছে। ওই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখনো কেঁদে ওঠে তার মন, হাত পা নাড়াতে পারে না, এমনকি দাঁড়িয়েও থাকতে পারে না। রাতের বেলা ভয়ে শরীর কুঁকড়ে যায়, সারা শরীরে খিঁচুনি ওঠে, অসহ্য ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি পেশিতে। এই ব্যথা এখনো পিছু ছাড়েনি। মাঝরাতে হুট করে ঘুম ভেঙ্গে গেল তার। নিজেকে ট্রেনের কামরায় আবিষ্কার করলো। মানুষকে টিকিয়ে রাখার জন্য মস্তিষ্ক বাজে স্মৃতিগুলোকে দমিয়ে রাখে, আর ভালগুলোকে সযত্নে লালন করে। কিন্তু তার ক্ষেত্রে এমনটা ঘটছে না। হয়তো আরো কিছু সময় লাগবে। চোখ বন্ধ করলেই ইঁদুরগুলো চলে আসে তার চোখের সামনে। 

ট্রেন স্টেশনে যখন থামলো, তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। শেষমেশ গতরাতে ট্রেনে একটু ঘুম হয়েছে তার। প্যারিসের এক ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে হাঁটছে, এটাকেও যেন স্বপ্নের অংশ মনে হচ্ছে। 

খোলা আকাশের নিচে হেঁটে আজকে অন্যরকম আনন্দ লাগছে তার। সুটকেস হাতে নিয়ে একটা হোটেলে উঠলো। রুমে একটামাত্র জানালা, সিগারেটের কটু গন্ধ এসে নাকে লাগলো তার। সুটকেস রেখে আর একমুহূর্ত দেরি না করে গোসলে ঢুকে গেল। বেশ সময় নিয়ে গোসল করে সে। হোটেলের এক সস্তা তোয়ালে পেঁচিয়ে বের হয়ে এলো, তারপর ভেঁজা চুল নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তোয়ালে খুলে ফেললো। আয়নার প্রায়ই নিজেকে দেখার সাধ জাগে তার। নিজের শরীরের একটা জিনিসই তার খুব পছন্দ- ব্রেস্ট। চুল শুকানোর সময়ও ব্রেস্টের দিকে তাকিয়ে রইলো। আদতে তার এই কুঁড়ি ফুটতে বেশ সময় লেগেছে। একসময় তো এমন আশাই ছেড়ে দিয়েছিলো। বান্ধবীরা তাকে “প্যানকেকের মত সমতল বুকওয়ালী” বলে খোটা দিতো। হুট করেই একদিন তার মাঝে এই উত্থান শুরু হয়, বয়স তখন তেরো কি চৌদ্দ। 

আস্তে আস্তে বাকি অংশগুলো সুগঠিত হয়। পনেরো বছরে পা দিতেই, তার নারীসুলভ সব বৈশিষ্ট্য দেখা দিলো; টানাটানা চোখ, আকর্ষণীয় ফিগার, মাখনের মত নরম স্তন, উদ্ধত পাছা, আর কোমরের দুলুনি। কিন্তু এর আগে, ভদ্রভাবে বলতে গেলে ‘অনাকর্ষণীয় দেহসৌষ্ঠব’ বলতে যা বোঝায় তাই ছিলো। তার শরীর যেন বুঝে উঠতে পারছিলো না কোন দিকে যাবে। শুধু নামমাত্র মেয়ে ছিলো, কোন লক্ষণ ছিল না। নিজের মা যেন ব্যাপারটা বুঝতে পারতো, তাই ‘আমার অভাগী মেয়েটা’ বলে ডাকতো। মায়ের এই কথার মর্ম ঠিকই বুঝতে পারতো সে। সবকিছু কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিলো তার জীবনে। একদিন মেকআপ করে মায়ের সামনে যেতেই, উচ্চস্বরে হেসে উঠলো তার মা। এক মুহূর্ত দেরি না করে ওয়াশরুমে গিয়ে সবকিছু মুছে ফেলে, আয়নায় নিজের দিকে তাকায়, এমন অপমানে একা একা অনেকক্ষণ কাঁদে। ফিরে আসার পর তাকে দেখে মা কিছুই বলে না। কিন্তু এই অপমানের কথা এখনো ভুলতে পারেনি সে। কিন্তু একসময় শরীরে যখন পরিবর্তন আসা শুরু করলো, তার মা দেখেও না দেখার ভান করে রইলো। 

সবকিছুই সুদূর অতীতের ঘটনা। এমন শত শত স্মৃতি পেছনে ফেলে রেখে এসেছে। 

ব্রা আর পেন্টি পরে সুটকেসে কিছু একটা খুঁজতে শুরু করলো। কোথায় রেখেছে তা মনে করার চেষ্টা করেও লাভ হলো না। সুটকেসের পকেটেও খুঁজলো, না পেয়ে সুটকেসের সব জিনিসপত্র বিছানায় ঢেলে দিলো। কাপড়ের মাঝে উঁকি দিলো তার আকাঙ্খিত জিনিস। 

“এই তো পেয়ে গেছি।” 

মুখে বিজয়ের হাসি ফুটে উঠলো। 

“এখন তুমি মুক্ত স্বাধীন মানবী,” নিজেকেই বলল।

“হ্যালো, ফেলিক্স ম্যনিয়ে?” 

“কে বলছেন?” 

“হাই, আমি…” 

ফেলিক্সের কাছে নিজের নাম কী বলেছিলো তাও ভুলে গেছে সে। “জুলিয়া? জুলিয়া বলছো?” 

স্বস্তির নিঃশাস ফেললো সে। প্রায় চিৎকার করে বলল, “হ্যা।”

“মনে হচ্ছে তুমি গাড়ি চালাচ্ছো। সময়টা রোমান্টিক না?” 

“হ্যা, মানে না…” 

উত্তেজনায় ভাষা হারিয়ে ফেলেছে ফেলিক্স। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। 

“আমি কি হ্যা ধরে নিবো নাকি না?” 

“তোমার জন্য সবসময়ই তৈরি আমি।” 

“তুমি আসলেই অনেক লক্ষী।” 

“কোথায় তুমি? বাসায়?” 

চেয়ারে বসে কথা চালিয়ে গেল অ্যালেক্স। 

“হ্যা। আর তুমি?” 

“আমি তো কাজে।” 

কিছুসময়ের জন্য নীরবতা নেমে এলো। দুজনেই যেন নাচতে ইচ্ছুক, কিন্তু কেউ হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে না, দুজনেই চাচ্ছে অন্যজন হাত বাড়িয়ে দিক। নিজের পদ্ধতির উপর পূর্ণ আস্থা আছে তার, তাই চুপ করে রইলো। 

“তুমি বিশ্বাস করবে না জুলিয়া, তুমি ফোন করাতে আমি কত খুশি হয়েছি।” 

“তা তুমি কী কাজ করছো?” 

কথাটা বলেই বিছানায় শুয়ে পড়লো সে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। 

“আগামী এক সপ্তাহের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছি। আগামীকাল থেকে আমার ছুটি তো, তাই নিজে যদি চেক না করে যাই, তাহলে ফিরে এসে দেখা যাবে সবকিছু হযবরল অবস্থায় পড়ে আছে। তুমি তো বুঝো…”

কাজের চাপ দেখাচ্ছে ফেলিক্স। অ্যালেক্স মুচকি হাসলো। কেননা চোখের পাতা ফেলে ফেলিক্সকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আছে তার। আর সামনাসামনি থাকলে তো একটা হাসিই যথেষ্ট। আবারো চুপ করে রইলো সে, সাথে সাথে ফেলিক্স নিজের কথা থামিয়ে দিলো। কথাগুলো বলা উচিৎ হয়নি তা বুঝতে 

পারলো কেবল। 

“যাই হোক, বাদ দাও। এটা তেমন গুরুত্বপুর্ণ কিছু না? তোমার কী খবর, বলো? কী করছো এখন?” 

“আমি আমার বিছানায় শুয়ে আছি আর…”

পুরুষদের কীভাবে কাবু করতে হয় তা বেশ ভালভাবেই জানা আছে তার। রেস্টুরেন্টে দেখা হওয়ার পর থেকেই ফেলিক্সকে নিজের মত করে চালাচ্ছে। ওইদিনই বুঝতে পেরেছে, ফেলিক্স তার সাথে বিছানায় যেতে উন্মুখ হয়ে আছে। তাই খুব বেশি কষ্ট করতে হচ্ছে না। 

“তোমার বিছানায়…” 

অ্যালেক্স হাসছে। স্পষ্ট শুনতে পেলো ফেলিক্স। “তুমি হাসছো কেন?” 

“তোমার কথাবার্তা শুনে, ফেলিক্স।” 

এই প্রথমবারের মত সে নাম উচ্চারণ করলো। খুশিতে গদগদ হয়ে গেল ফেলিক্স। 

“ওহ।” 

“আজ রাতের প্ল্যান কী তোমার? 

“কিছুই না।”

“আমাকে ডিনারের দাওয়াত দিবে নাকি আজ?” 

“আজকে?” 

“ওহ। আমি দুঃখিত। এমন অসময়ে ফোন করার জন্য….” 

নিজের ঘড়ির দিকে তাকালো অ্যালেক্স। এখন সাড়ে সাতটা বাজে।

“আটটা বাজে?” 

“হ্যা। অবশ্যই।” 

“কোথায়?” 

কিছুসময় নিয়ে ফেলিক্স একটা রেস্টুরেন্টের নাম বলল। কাগজে ঠিকানা টুকে নিলো অ্যালেক্স। 

“জায়গাটা বেশ সুন্দর। আশা করি তোমার ভাল লাগবে। আর না লাগলে আমরা অন্য কোথাও যাবো।” 

“জায়গাটা যদি সত্যিই সুন্দর হয়, তাহলে অন্য কোথাও কেন যাবো?”

“আসলে…সবার রুচি তো আর এক না। তাই আর কী….” 

তোমার রুচি কেমন সেটাই তো আমি জানতে চাই।” 

এই বলে ফোন রেখে দিলো সে। 

অধ্যায় ৩৭ 

আজকে সবার উপস্থিত থাকার ব্যাপারে ম্যাজিস্ট্রেটের কড়া নির্দেশ রয়েছে। লা গুয়েন, ক্যামিল, লুইস, আরম্যান্ড সবার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কেননা শেষমেশ তাদের হাতে কাজে লাগার মত কিছু এসেছে, বড় কিছু এসেছে, যা কেস সমাধানের পথে নিয়ে যাবে। ক্যামিল অফিসে পা রাখার সাথে সাথেই কড়া চোখে তাকালো লা গুয়েন, যেন বলতে চাইছে ‘আজকে আর লাগতে যেয়ো না’। এখনই উত্তেজনা টের পেতে শুরু করেছে সে। ম্যাজিস্ট্রেট ঢোকার সাথে সাথেই নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করে নিলো। সবার অলক্ষ্যে দু হাত পেছনে নিয়ে এমনভাবে ঘষছে যেন বড় কিছু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ম্যাজিস্ট্রেট শুরু থেকেই এই কেসে সুস্পষ্ট প্রভাব রাখতে চেয়েছে। নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। আজকেও তার ব্যতিক্রম করবে না বলেই মনে হলো তার। 

দুই ঘণ্টা আগে পাওয়া এক খবর হতবাক করে দিয়েছে সবাইকে। তুলুজে জ্যাকলিন জানেত্তি নামে এক হোটেল মালিক খুন হয়েছে। মাথায় অনেকগুলো আঘাত করা হয়েছে, এরপর বেঁধে ঘন সালফিউরিক এসিড ঢেলে দেয়া হয়েছে মুখে। 

খবর শোনার সাথে সাথেই ডেলাভিগ্নেকে কল করে ক্যামিল। শুরুর দিকে তুলুজে দুইজন একসাথে কাজ করেছে। দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব অনেকদিনের। চার ঘণ্টায় আটবার ফোন করতো একে অপরকে। 

“খুনি যে একজনই এই ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। খুনের ধরণ এবং অন্যান্য লক্ষণ দেখেই বোঝা যাচ্ছে একই খুনির কাজ এটা। রিপোর্ট অনুসারে শুক্রবার সকালে খুন হয়েছেন মিসেস জানেত্তি।”

“পুলিশ ফাইলে এই হোটেলের নাম আছে। হোটেলের আড়ালে এটাকে মূলত ‘ব্রোথেল’ হিসেবে ব্যবহার করা হত। আর মেয়েটা মঙ্গলবার এই শহরে পৌঁছে অ্যাস্ট্রিড বার্মা নামে অন্য একটি হোটেলে উঠে। পরেরদিন মিসেস জানেত্তির ওখানে উঠে লরা ব্লচ নামে। আর বৃহস্পতিবারে টেলফোন দিয়ে আঘাত করে মুখ থেতলে দেয় মিস জানেত্তির, এরপর বাকি কাজ সারে এসিড ঢেলে।” 

“পরিচয় লুকানোতে জুড়ি নেই তার। এই কৃতিত্ব তাকে দিতেই হবে।”

“না। মোটেও না।”

“আমরা এখনো জানি না এখানে কীভাবে এসেছে। গাড়ি করে নাকি ট্রেন দিয়ে? আমরা আমাদের টিম পাঠিয়ে দিয়েছি খোঁজ নেয়ার জন্য।” 

*

“অনেক জায়গায় মেয়েটার আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। যে রুমে উঠেছিলো সেখানে, মিসেস জানেত্তির রুমে। তার মানে সে ভালোমতোই জানে পুলিশ রেকর্ডে তার নাম নেই। তাই তার এইসব চিন্তা করারও কোন কারণ নেই। আমাদের সক্ষমতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একের পর এক খুন করে চলছে।” 

*

“আর কিছু?” 

“ঘটনার দিন সন্ধ্যায় মিসেস জানেত্তি মেয়েটাকে সাথে নিয়ে একটা ডান্স হলে গিয়েছিলো।” 

“কী কারণে?” 

“একাকীত্বে ভোগা মানুষগুলোর জন্য এই জায়গা যেন স্বর্গরাজ্য। এছাড়াও অনেক দম্পতি এখানে এসে পুরোনো প্রেম ঝালাই করে নেয়। মোটকথা নানা ধরনের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় এই জায়গা।” 

“আচ্ছা। আমি কল্পনা করতে পারছি।” 

“ভুলেও এই কাজ করতে যেও না।” 

কেন? কী সমস্যা?” 

“নিজের আবেগ রুখতে পারবে তো?” বলেই হেসে দিলো ডেলাভিগ্নে।

“আলবার্ট!” 

“কী? বলো?” 

“এসব কী শুরু করলে? এখন একটু থামাও এইসব।” 

“আচ্ছা, থামলাম।”

“ধন্যবাদ। আচ্ছা ডান্স হলে যাওয়ার সাথে খুনের কোন সম্পর্ক আছে?”

“না। ওখানে কোন ঝামেলা হয়নি যার কারণে এমন কিছু হতে পারে। আমরা ওখানে উপস্থিত কয়েকজনের সাথে কথা বলেছি। তাদের কারো মতে সন্ধ্যাটা ছিল ‘অসাধারণ’, কারো মতে ‘উপভোগ্য’, কারো মতে ‘স্মরণীয়’। বিশেষণ যাই হোক না কেন, কোন ঝামেলা সেদিন হয়নি। তাই এই সম্ভাবনা পুরোপুরি নাকচ করে দেয়া যায়।” 

“একে অপরের পরিচিত ছিলো?” 

“মিসেস জানেত্তি মেয়েটাকে তার ভাগ্নী বলে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। কিন্তু একটু পরেই সবাই আবিষ্কার করে আদতে মিসেস জানেত্তির কোন ভাই, বোন কিংবা আত্মীয়স্বজন বলতে কেউ নেই। তাই তার ভাগ্নী থাকা আর ‘ব্রোথেলে’ কুমারী মেয়ে থাকা একই কথা। 

“কুমারীদের খবর দেখি ভালোই রাখো তুমি?” 

“এই যে ভুল বুঝলে। তুলুজের দালালরা এই ব্যাপারে সবই জানে।” 

*

“আমি জানি তোমার অনেক সোর্স আছে। কিন্তু এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না…” শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে বলল ম্যাজিস্ট্রেট। 

“আপনি তো দেখছি মহাজ্ঞানী। বাকিটুকু বলে ফেলুন,” মনে মনে বলল ক্যামিল। 

“আমাদের হাতে আসা তথ্য অনুসারে, এতোদিন খুনির শিকার ছিল শুধু প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। কিন্তু এই মহিলার খুন তো তোমার অনুমানকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিলো! আমি ভেরহোভেনের সেক্সুয়াল থিয়োরির কথা বলছি।” 

“এই থিয়োরিতে তো আপনারও সম্মতি ছিলো, মঁসিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট” লা গুয়েনও কিছুটা বিরক্তি সহকারে বলল। 

দেখো, কার থিয়োরি ছিল এটা নিয়ে কোন তর্কে যেতে চাই না আমি। আমরা সবাই একই ভুল করেছি।” 

“এটা মোটেও ভুল কিছু না,” প্রতিবাদ করে উঠলো ক্যামিল।

সবার দৃষ্টি এখন তার দিকে। 

“যাই হোক। ডান্স হলে মেয়েটাকে অনেকেই দেখে। আমি ভিক্টিমের বন্ধুবান্ধব আর ওইদিন উপস্থিত লোকজনদেরকে তোমার পাঠানো ই-ফিট দেখিয়েছি, তারা সবাই মেয়েটাকে সনাক্ত করেছে। দেখতে সুন্দর, আকর্ষণীয় ফিগার, সবুজ চোখ, পিঙ্গল বর্ণের চুল। তবে, এদের মাঝে দুইজন দৃঢ়তার সাথে বলেছে, মেয়েটা উইগ পড়ে ছিলো।” 

“হতে পারে। এই তথ্য একদম উড়িয়ে দেয়া যায় না।”

“তো তারা সারা সন্ধ্যা ওখানেই কাটায়। রাত তিনটার সময় হোটেলে ফিরে আসে। এর কাছাকছি কোন এক সময়ে খুনি তার কাজ করে। আমরা এখনো সঠিক সময় জানি না। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট হাতে পেলেই তা জানা যাবে। তবে করোনার (শব পরীক্ষক) কাছ থেকে যতদূর জানতে পেরেছি সাড়ে তিনটার কাছাকাছি সময়েই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হয়।” 

“আর কিছু?” 

“কিন্তু সালফিউরিক এসিড ঢালার সময় তো বাঁধার মুখে পড়ার কথা খুনির। আর তা ছাড়া ভিক্টিমেরও তো গগনবিদারী চিৎকার করার কথা।”

“কেউ কিছু শোনেনি?” 

“দু;খজনক হলেও সত্যি, কেউ শোনেনি। আর তুমি কী আশা করো? রাত তিনটা বাজে সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন, চিৎকার শোনার জন্য কে জেগে থাকবে? আর ব্যাকেলাইট ফোনের কয়েকটা আঘাতে তেমন শব্দও হওয়ার কথা না।” 

“মহিলা কি একাই থাকতো?” 

“যতদূর জেনেছি মহিলা মাঝে অনেকের সাথেই থেকেছে। কিন্তু ঘটনার কয়েক মাস আগে থেকে একাকীই ছিলো।” 

*

“থিয়োরি বাদ দাও ক্যামিল। তোমার সব কথা ধরে বসে থাকলে, এই কেস একফোঁটাও সামনে এগুবে না, আমরা সমাধানও করতে পারবো না। আর এদিকে খুনি নির্বিচারে একের পর এক খুন করে চলছে, আমরা তার টিকিটারও নাগাল পাচ্ছি না। তার সম্পর্কে তেমন কিছুই এখনো জানি না। আমার একটাই প্রশ্নঃ খুনিকে ধরার জন্য তোমার পরিকল্পনা কী?” 

অধ্যায় ৩৮ 

“আচ্ছা, আমি শুধু এক ঘণ্টার জন্য আসবো…কিন্তু তার আগে বলো তুমি আমাকে বাসায় পৌঁছে দিবে তো?” 

এমন সময়ে ফেলিক্স যে কোন শর্ত নির্দ্বিধায় মেনে নিবে। কেননা তার মনে হচ্ছিলো, জুলিয়ার কাছে নিজেকে ঠিকমতো তুলে ধরতে পারেনি, আজকের কথাবার্তাও জুলিয়ার মত আকর্ষণীয় মেয়ের মন পাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না। শুরুর দিন থেকেই তার এমন মনে হচ্ছে। প্রথম যেদিন রেস্টুরেন্টের বাইরে দেখা হয়, সেদিনও নিজের অগ্রগতি নিয়ে হতাশ ছিল সে। বারবার মনে হচ্ছিলো জুলিয়া আর কখনোই তার সাথে যোগাযোগ করবে না। হয়তো তাকে ভুলেই গেছে। কিন্তু আজকে সেই জুলিয়া তাকে ফোন করেছে, নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস হচ্ছে না। আজ রাতে আবার ডিনারও করতে চেয়েছে, যা তার প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গেছে। আজ রাতেই… 

শুরু থেকেই ফেলিক্সকে নানাভাবে উত্তেজিত করার চেষ্টা করলো অ্যালেক্স। আজকে তার পরণে এমন এক ড্রেস, যা যে কোন পুরুষের নজর কাড়তে সক্ষম। এই ড্রেস পুরুষদের মনে কী প্রভাব ফেলে তা বেশ ভালোমতোই জানে সে। আজকেও তা ব্যর্থ হয় নি- তাকে দেখেই মুখ হা হয়ে গেল ফেলিক্সের, চোয়াল ঝুলে যেন মেঝেতে পড়ে যাচ্ছে। প্রথমেই অনেকটা কুপোকাত করে ফেললো তাকে। এরপর কাঁধে হাত রেখে, আলতো করে গাল ছুঁয়ে দিলো তার। ওখানেই গলে যাওয়ার দশা হলো তার। এই কাজগুলো সে নিপুণ দক্ষতার সাথে করে। 

কাজের ব্যাপারে কথা শুরু করে অ্যালেক্স। কাজ কেমন চলে? প্রমোশনের সম্ভাবনা আছে কিনা? গতমাসের বেতনের কী অবস্থা? এইসব বলে পরিবেশ একটু হালকা করার চেষ্টা করলো। আর এদিকে ফেলিক্সের ধারণা আস্তে আস্তে খেলায় ফিরে আসছে সে। 

ফেলিক্সের চোখে মুখে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা, কিছুটা চিন্তায় ফেলে দিলো তাকে। অবশ্য এই আকাঙ্খাকে কাজে লাগানোর জন্যই আজ এখানে সে। ফেলিক্সকে দেখেই বুঝতে পারছে, বিছানায় তাকে নেয়ার জন্য কতটা মরিয়া হয়ে আছে। তার উত্তেজনাকে বিস্ফোরিত করার জন্য দরকার কামনার ছোট এক স্ফুলিঙ্গ। যতবার ফেলিক্সের দিকে তাকিয়ে হাসি দিচ্ছে সে, এই ক্ষুধা যেন আরো বেড়ে যাচ্ছে।  

দু’জনেই গাড়িতে চড়ে বসলো। অ্যালেক্স স্কার্টটা একটু উপরে তুলে রাখলো। নিজেকে আর রুখতে পারলো না ফেলিক্স। দশ মিনিট ধরে গাড়ি চালানোর পর অ্যালেক্সের উরুতে হাত রাখলো। কোন বাঁধা দিলো না সে, বরং মুচকি হাসলো। চোখ বন্ধ করে ভাবলো, তার পরিকল্পনা মতই সব এগুচ্ছে। চোখ খোলার পর দেখলো উত্তেজনায় পাগল হয়ে যাচ্ছে ফেলিক্স, যেন এখনি এই রাস্তাতেই…রাস্তা ক্রস হওয়ার সময় খেয়াল করলো, এই রাস্তাতেই ট্র্যারিক্স লরির নিচে চাপা পড়েছিলো। আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লো সে। ফেলিক্সের হাত আরেকটু উপরে উঠতেই, তাকে থামিয়ে দিলো ইঙ্গিত করলো- শান্ত হও, প্রিয়তম- আরেকটু অপেক্ষা করো। গাড়ির ভেতরের পরিবেশ বেশ উষ্ণ আর উত্তেজনাকর। নীরবতা তাদের মাঝে বিস্ফোরকের উপর আগুন থাকার মতই ঝুলে আছে। দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাচ্ছে ফেলিক্স। কিছুক্ষণ পর জনমানব শূন্য, বিশাল একটা টাওয়ার ব্লক তার চোখে পড়লো। ওখানেই গাড়ি থামিয়ে দিলো সে। আর সহ্য করতে পারছে না এই উত্তেজনা। রাস্তার এক কোণে গাড়ি পার্কিং করে পাশে তাকাতেই দেখলো, অ্যালেক্স নেই সেখানে। এর আগেই গাড়ি থেকে নেমে, নিজের জামা ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ফেলিক্সের ট্রাউজার এখন স্বাভাবিকের চেয়ে স্ফীত হয়ে আছে, এই অবস্থাতেই এগিয়ে গেলো। দেখেও না দেখার ভাল করলো অ্যালেক্স। টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে ধারণা করলো কমপক্ষে বিশ তলা হবে। 

“বারো তলা,” বলল ফেলিক্স, যেন তার মনের কথা বুঝতে পেরেছে। টাওয়ারের দেয়াল বেশ জরাজীর্ণ। এখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অশ্লীল বাক্যে ভরা দেয়াল। হোটেলের পরিবর্তে এমন নোংরা জায়গায় আনার কারণে কিছুটা বিব্রত বোধ করলো ফেলিক্স। কিন্তু রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার পরপরই কাউকে হোটেলে নেয়ার কথা বলা আর ‘আই ওয়ান্ট টু ফাক ইউ’ বলা একই কথা। তাই এই প্রস্তাবও করা সম্ভব হয়নি। লজ্জিত বোধ করলো সে। ফেলিক্সের এই অবস্থা দেখে এগিয়ে এলো অ্যালেক্স। মৃদু হেসে তার কাঁধে হাত রাখলো। গলার ডান দিকে একটা চুমু দিয়ে ফেলিক্সের উত্তেজনা আবারো জাগ্রত করলো। গাড়ির দরজা লক করতে করতে অ্যালেক্সকে বলল “তুমি যাও। আমি আসছি।” 

বেডরুম দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখানে ব্যাচেলর অথবা বিপত্নীক কেউ থাকে। জ্যাকেট আর স্কার্ফ খুলে সোফায় রাখলো অ্যালেক্স। বাতাসের বেগে বেডরুমে ঢুকলো ফেলিক্স। বিছানা এখনো অগোছালো। বিছানা গোছাতে শুরু করলো সে। তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলো অ্যালেক্স। আরো দ্রুততার সাথে রুমের জিনিসপত্র ঠিকঠাক করা শুরু করলো। কোন নারীর ছোয়া ছাড়া রুমটা কেমন যেন আত্মাছাড়া দেহের মত লাগছে। বিছানার চাদর উল্টে আছে, এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে কাপড়চোপড়, পুরোনো কম্পিউটার, অ্যান্টিক ব্রিককেস, একটা ফুটবল ট্রফি। নিচু হয়ে বিছানার চাদর ঠিক করছে ফেলিক্স। এমন সময় ফুটবল ট্রফিটা হাতে নিয়ে সজোরে তার মাথার উপর নামিয়ে আনলো অ্যালেক্স। মার্বেল পাথরের চোখা অংশ খুলির ভিতর প্রায় দুই ইঞ্চি ঢুকে গেল। সাথে সাথে মেঝেতে পড়ে গেল সে। চাপা একটা গোঙানি বেরিয়ে এলো মুখ থেকে। অ্যালেক্স নিজেও কিছুটা টলে গেল তার জায়গা থেকে। ভারসাম্য ফিরে পেয়ে, আরো নিখুঁত কোণ থেকে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আরেকটা আঘাত করলো। অক্সিপিটাল হাড় গুড়ো গুড়ো হয়ে গেল এই আঘাতের কারণে। পেটে ভর দিয়ে একটু দূরে সরার চেষ্টা করলো সে। খুব বেশিদূর যেতে পারবে না জেনে কোন বাধা দিলো না অ্যালেক্স। কয়েকটা খিঁচুনি ওঠার পর আর নড়লো না ফেলিক্স। 

হয়তো মারা গেছে। অটোমেটিক নার্ভাস সিস্টেমের ক্রিয়ার কারণে এমন খিঁচুনি হচ্ছে। 

তার কাছে এসে, নিচু হয়ে তাকে দেখতে লাগলো অ্যালেক্স। না এখনো পুরোপুরি মরেনি। অজ্ঞান হয়ে গেছে। এখন শ্বাস নিচ্ছে, আর গোঙাচ্ছে। চোখের পাতা অনবরত কাঁপছে। রিফ্লেক্সের কারণেই এমন হচ্ছে। প্রায় অর্ধমৃত অবস্থা তার। 

তার মানে এখনো পুরোপুরি মারা যায়নি। 

“তবে কাজ আরো সহজ হয়ে গিয়েছে,” স্বগতোক্তি করলো অ্যালেক্স। প্রতিরোধ করার ক্ষমতা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে সে। বেল্ট আর টাই দেখে খুশিতে মন ভরে উঠলো তার। হাত পা বাঁধার জন্য যা যা দরকার তার সবই হাতের কাছে পেয়ে গেছে। দুই এক মিনিটে বেঁধে ফেলতে পারবে ফেলিক্সকে। 

রান্নাঘর থেকে ফেরার পথে নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে বেডরুমে ঢুকলো অ্যালেক্স। ব্যাগে থাকা ছোট বোতল বের করলো। ল্যাম্প দিয়ে ফেলিক্সের মুখে বাড়ি দিয়ে বেশ কয়েকটা দাত ভেঙ্গে ফেললো। প্লাস্টিকের চামচ ভেঙ্গে দুই চোয়ালের মাঝে বসিয়ে দিলো, মুখ যাতে খোলা থাকে। একটু দূরে সরে গিয়ে, প্রায় আধা লিটার সালফিউরিক এসিড ঢেলে দিলো গলা দিয়ে।

হুট করে যেন জেগে উঠলো ফেলিক্স।

একটা কাঁপুনি দিয়ে আবার থেমে গেল। 

বারো তলা থেকে শান্ত নিস্তব্ধ প্রকৃতি বেশ উপভোগ্য লাগছে অ্যালেক্সের কাছে। অনেকদিন এমন করে রাত উপভোগ করা হয়নি তার। আরো কিছুক্ষণ থাকতে ইচ্ছে করলেও তা ত্যাগ করে পালানোর পথ খুঁজতে শুরু করলো। রাত হওয়ার কারণে পথঘাট চিনতে অসুবিধা হলো। কিন্তু বেশিসময় লাগলো না খুঁজে বের করতে। 

ঘরবাড়ি অগোছালো হলেও ল্যাপটপ বেশ যত্ন করেই রাখতো ফেলিক্স। ল্যাপটপ, পাওয়ার ক্যাবল, ফাইলপত্র, কলম রাখার জন্য আলাদা আলাদা কম্পার্টমেন্ট আছে ব্যাগে। ল্যাপটপ বের করে ব্রাউজার ওপেন করলো সে। হিস্টোরি ঘেটে বেশ মজা লাগলো তার- পর্ণ ওয়েবসাইট, অনলাইন গেমস। ব্রাউজারে নিজের নাম টাইপ করল, এখনও কোন তথ্য পাওয়া গেল না। তার মানে পুলিশ এখনো তার সম্পর্কে কিছুই জানে না। খুশিতে মন ভরে উঠলো তার। তখনি হুট করে আরেকটা জিনিস মাথায় আসে, ব্রাউজারে ‘পুলিশের ওয়ান্টেড লিস্ট’ লিখে সার্চ দিলো। প্রথম পেজের নিচের দিকে একটা ছবি তার নজর কাড়লো। ই-ফিট এ তার নিজের ছবি আঁকা, পাশে লেখা ‘বিপদজনক’। কয়েকটা খুনের জন্য সন্দেহভাজন হিসেবে পুলিশ তাকে খুঁজছে। ই-ফিট বেশ ভাল হয়েছে। সম্ভবত ট্র্যারিক্সের তোলা ছবি ব্যবহার করে এটা এঁকেছে, মনে মনে ই-ফিটের প্রশংসা না করে পারলো না। তবে ছবিটাতে প্রাণ নেই, মৃত মানুষের মত শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চুলের আর চোখের রঙ পরিবর্তন করলেই সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষে পরিণত হওয়া যায়। ঠিক এই ব্যাপারটাই তার মাথায় ঘুরছে। ল্যাপটপ বন্ধ করে রেখে দিলো। 

 ফেলিক্সের লাশ পড়ে আছে মেঝেতে। পিছন ফিরে না তাকিয়ে জ্যাকেট হাতড়ে চাবি খুঁজে বের করলো। চাবি পেয়েই নিচে নেমে গেল বিন্দুমাত্র দেরি না করে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নিলো কেউ আছে কিনা। কারো উপস্থিতি নেই নিশ্চিত হয়ে গাড়িতে চড়ে বসলো। গাড়ি স্টার্ট করার পর, সিগারেটের কটু গন্ধ এসে নাকে লাগলো তার। জানালা একটু নামিয়ে দিলো। 

প্যারিসে পৌঁছানোর একটু আগে বাঁক নিয়ে গাড়িটা থামালো একটা খালের ধারে। ফেলিক্সের ল্যাপটপ হাতে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে খালের মাঝে ছুঁড়ে ফেলে দিলো ওটা। আবার গাড়িতে চড়ে বসলো। 

অধ্যায় ৩৯ 

ছত্রিশ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগলো সেই জিপসি ক্যাব খুঁজে বের করতে, যেটাতে করে মেয়েটা পালিয়েছে। ক্যামিলের ধারণা ছিল বারো ঘণ্টার মাঝেই বের করা সম্ভব হবে। সেটা না হলেও, বের করা সম্ভব হয়েছে, আর এতেই খুশি সবাই। 

“ওই রাতের কোন কিছু কি আমরা মিস করেছি?” 

“না। মোটেও না।” 

তবুও… 

ট্যাক্সি ড্রাইভার স্লোভাকিয়ান। বয়স ত্রিশের কোটায়, মাথায় কোন চুল নেই, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মত লাগে দেখতে। ই-ফিট দেখে মেয়েটাকে সনাক্ত করেছে। কিন্তু চোখের মণি নাকি নীল রঙের ছিলো। মেয়েটা যে নানা রঙের কন্ট্রাক্ট লেন্স ব্যবহার করে, এই ব্যাপারে নিশ্চিত হলো ক্যামিল। কিন্তু বাদবাকি সবকিছু ই-ফিটের মেয়েটার সাথে মিলে গেছে বলে নিশ্চিত করেছে ট্যাক্সি ড্রাইভার। 

খুব সতর্কতার সাথে অত্যন্ত ধীরগতিতে গাড়ি চালাচ্ছে স্লোভাকিয়ান ড্রাইভার। লুইস কিছু বলতে চাইলো। তার আগেই ক্যামিল সামনের দিকে ঝুঁকে বলল, “যত পারো জোরে চালাও তুমি। আজকে মাত্রাতিরিক্ত স্পিডের জন্য কেউ তোমাকে জরিমানা করবে না।”

স্লোভাকিয়ানকে দ্বিতীয়বার বলতে হলো না। সাথে সাথেই অ্যাক্সিলারেটরে পা দাবালো, সাই করে ছুটলো গাড়ি। ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে, উল্টে পড়ে গেল ক্যামিল। ড্রাইভার আবারো গতি কমিয়ে দিয়ে এমনভাবে তাকালো, যেন বলতে চাইছে, ‘এই অপরাধের জন্য আমার একমাসের বেতন, আমার বাড়ি আর আমার স্ত্রীকেও আপনাকে দিয়ে দিবো, তবুও আপনি কিছু মনে করবেন না দয়া করে।’ ক্যামিলের মুখের ভঙ্গিমা দেখেই সতর্ক হয়ে উঠলো লুইস। কিছু বলার আগেই তার হাত চেপে ধরলো লুইস, যেন বলতে চাইছে, ‘যা হবার হয়ে গেছে। আজকের মত ছেড়ে দিক ওকে। অন্য কোন একদিন ওকে ধরবো আমরা।”

ড্রাইভার বিস্তারিত বলা শুরু করলো। ভাড়া ঠিক হয়েছিলো পঁচিশ ইউরো। প্যান্টিনের কাছাকাছি আসার পর মেয়েটা হাত নেড়ে ট্যাক্সি থামায়। দরজা খুলে পিছনের সিটে চুপচাপ বসে থাকে। তবে বারবার মাথা এমনভাবে ঝাঁকাচ্ছিলো, মনে হচ্ছে যেন ঘুম তাড়াতে চাইছে। ব্যাপারটা তার কাছে সন্দেহজনক লেগেছে। মাদকাসক্ত ছিল মেয়েটা? কিছুদূর যাওয়ার পর ড্রাইভার পিছনে তাকিয়ে দেখে মেয়েটা জানালা দিয়ে শূন্যদৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। একটুপর আবারো তাকালে, মেয়েটাও তার দিকে এমনভাবে তাকায় যেন কিছু হারিয়ে গেছে তার। সামনের একটা জায়গার দিকে আঙুল তাক করে বলল, “এখানে একটু দাঁড়ান। আমার জন্য অপেক্ষা করুন, বেশি সময় লাগবে না আমার।” 

এই কথা শোনার পর ড্রাইভার কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। অপেক্ষা করার মত সময় নেই বলে তাকে জানায়। কেননা এর আগেও কয়েকবার ডাকাতির শিকার হয়েছে, একটা মেয়ের কারণে আবার সেই ভোগান্তি পোহাতে চাচ্ছে না। এমন সময় মেয়েটা খুবই সাধারণ ভঙ্গিতে বলে, “আমাকে এসব বলতে আসবেন না। হয় এখানে অপেক্ষা করুন, নইলে আমি চলে যাচ্ছি।” 

“আর কোন ভাড়াও পাবেন না,” মেয়েটা এই কথা না বললেও, ড্রাইভার তা ঠিকই বুঝে নিলো। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। দুজনেই সমান অবস্থানে। অগত্যা বাধ্য হয়েই অপেক্ষা করতে হলো তার। রাস্তার দিকে মুখ করে গাড়ি পার্ক করতে বলেছিলো মেয়েটা। গাড়ি থেকে নেমে একটু উপরের দিকে তাকিয়ে ছিলো। ড্রাইভার আঙুল দিয়ে দেখালে লুইস আর ক্যামিল দু’জনেই ওদিকে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলো না। মেয়েটা কিসের দিকে তাকিয়ে ছিল তা জানা সম্ভব হলো না। কারো জন্য কি অপেক্ষা করছিলো? কেউ আসার কথা ছিল এখানে? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ক্যামিলের মনে। ড্রাইভারের তা মনে হয় না। মেয়েটা মোটেও বিপদজনক মনে হয়নি তার, বরং বেশ উদ্বিগ্ন ছিলো। মেয়েটা দেখতেও সুন্দরী ছিল বলে জানালো সে। কিন্তু একদম বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিলো। 

ওখানে অনেকক্ষণ ছিল বলে জানালো ড্রাইভার। মেয়েটাকেও বেশ সতর্ক দেখা গেছে। ক্যামিল বেশ ভালোমতোই জানে, মেয়েটা ট্র্যারিক্সের জন্য সতর্ক অবস্থানে ছিলো। হয়তো ভয় পাচ্ছিলো ট্র্যারিক্স রাস্তায় ওত পেতে বসে আছে তার জন্য। 

কিছুক্ষণ পর, তিনটা দশ ইউরোর নোট দিয়ে, গাড়ি থেকে নেমে যায় মেয়েটা। এরপর কোথায় গেল, তা দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি ড্রাইভার। তার প্রাপ্য টাকার চেয়ে বেশি পেয়ে, আপনমনে আবারো গাড়ি চালাতে শুরু করে। গাড়ি থেকে নামলো ক্যামিল। অপহরণের দিন এদিকেও অভিযান চলেছে, কিন্তু কিছু পাওয়া যায় নি। 

তার দেখাদেখি অন্যরাও গাড়ি থেকে নামলো। সামনের এক বিল্ডিং এর দিকে আঙুল তাক করলো সে। 

“মেয়েটা যে বাড়িতে থাকে, সেই বিল্ডিং এর মেইন গেট দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। তাড়াতাড়ি ব্যাকআপ টিম রেডি করো, লুইস।” 

সবাইকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলো সে। এরইমাঝে নিজ নিজ অবস্থানে যেতে ছুটাছুটি শুরু হয়ে গেছে। ট্যাক্সির দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। 

“আমি কি এখন যেতে পারি, স্যার?” ফিসফিসিয়ে বলল ড্রাইভার, কণ্ঠে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। 

“আরে নাহ! তুমি এখন থেকে আমার সাথেই থাকবে।” 

এই কথা শোনার পর ভয়ে মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল ড্রাইভারের। তার দিকে তাকিয়ে হাসলো ক্যামিল। 

“আরে বোকা, তোমার প্রমোশন হয়েছে। আজ থেকে তুমি পুলিশ কমান্ড্যান্ট এর ব্যক্তিগত ড্রাইভার।” 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *