অ্যালেক্স – ২০

অধ্যায় ২০ 

সাবেক স্বামীর ব্যাপারে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নাই রোজেলিন ব্রুনোর। এক বছর ধরে নিখোঁজ ছেলের সংবাদেই তার আগ্রহ। 

“জুলাই এর ১৪ তারিখে আমার ছেলে নিখোঁজ হয়,” উদ্বেগ জড়ানো সুরে বলল রোজেলিন। 

ক্যামিল চেয়ার নিয়ে তার সামনে এসে বসলো। 

আগে অফিসে দুইটা চেয়ার থাকতো। একটা ছিল একটু উচু, আরেকটা নিচু। ইচ্ছা করেই চেয়ার গুলো বানিয়েছিলো সে। অপরাধীদের মাঝে মাঝে মানসিক পরীক্ষায় ফেলার জন্য। কিন্তু এই জিনিসটা আইরিন মোটেও পছন্দ করতো না। তাই চেয়ারগুলো অযত্নে অনেকদিন পড়ে ছিল অফিসেরই এক কোণায়। হুট করে একদিন দেখা যায়, চেয়ারগুলো জায়গামত নেই। তার ধারণা, আরম্যান্ড চেয়ারগুলো বাসায় নিয়ে গেছে। আরম্যান্ড উঁচু চেয়ারে আর তার স্ত্রী নিচু চেয়ারে বসে গল্প করছে, এমন দৃশ্য কল্পনা করে একা একাই হাসতো ক্যামিল। 

রোজেলিন ব্রুনোকে দেখে, ওই চেয়ারগুলোর কথা মনে পড়ে গেল তার, কেননা সহানুভূতিশীল মনোভাব প্রকাশের জন্য চেয়ারগুলো ব্যবহার করতো সে। দ্রুতই নিজের মনোযোগ আবারো ইন্টারভিউয়ের দিকে ফিরিয়ে আনলো। মেয়েটার কথা ভাবলো, কেননা তার কথা ভাবলেই তার স্মৃতিপটে ভেসে উঠে একটা ছবি, সেই ছবি আলোড়ন তোলে তার মস্তিষ্কে, নিজেকে ছিন্নভিন্ন হতে দেখে সে। 

ক্যামিল আর রোজেলিন এর মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা এক নয়। ছোটখাটো গড়নের একজন মহিলা, শরীরও বেশ শুকনো, হয়তো স্বাভাবিক অবস্থায় বেশ প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা একজন মানুষ, কিন্তু এখন তাকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। তার ধারণা, পুলিশ আজকে তাকে ছেলের মৃত্যুসংবাদ দিয়েই দিবে। যখনই পুলিশের গাড়িতে করে তাকে আনা হয়েছে, তখন থেকেই এই চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। 

“আপনার স্বামী গতকাল আত্মহত্যা করেছে, ম্যাডাম ব্রুনো” বলল ক্যামিল। 

বিশ বছর ধরে আলাদা থাকার পরেও এই সংবাদ কিছুটা প্রভাব ফেললো তার উপর। ক্যামিলের দিকে তাকালো সে। মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝা যাচ্ছে দুই ধরনের অনুভূতি কাজ করছে তার মাঝে, তিক্ততা (আশা করি, মরার আগে কষ্টে ভুগেছে), আর বিদ্রুপ (এটা তেমন কোন ক্ষতি নয়), তবে সবচেয়ে বেশি কাজ করছে উদ্বেগ। শুরুতে কিছুই বলল না। এদিকে ক্যামিলের কাছে তাকে পাখির মত মনে হলো, পাখির ঠোঁটের মত চোখা নাক, তীক্ষ্ণ চোখ, উঁচু বুক। মনে মনে তার স্কেচ করে ফেললো সে। 

“কীভাবে মারা গেল?” অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলো সে। 

ডিভোর্সের কাগজপত্র ঘেটে ক্যামিলের ধারণা হয়েছিলো, স্বামীর মৃত্যুতে সে কোন আফসোসই করবে না। নিজের সন্তানের ব্যাপারেই কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। যেহেতু জিজ্ঞেস করেই ফেলেছে, তার মানে অবশ্যই এর পেছনে কোন কারণ আছে। 

 ”দুর্ঘটনায় মারা গেছে। একটা পুলিশ কেস এ জড়িত ছিল সে,” বলল সে।

নিজের স্বামী কেমন কিংবা কতটা খারাপ হতে পারে তা বেশ ভালমতোই জানে রোজেলিন ব্রুনো, কিন্তু সে তো আর কোন অপরাধীকে বিয়ে করেনি । ‘পুলিশ কেস এ জড়িত ছিলো’ কথাটা শোনার পর তার কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া আশা করছিলো ক্যামিল, কিন্তু চোখের পাতাও নড়লো না তার। 

“ম্যাডাম ব্রুনো…আমাদের বিশ্বাস আপনার ছেলের নিখোঁজ হওয়া আর আপনার স্বামীর আত্মহত্যার মাঝে একটা সম্পর্ক আছে। আসলে, আমরা মোটামুটি নিশ্চিতও এই ব্যাপারে। তাই আপনি যত দ্রুত আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিবেন, আপনার ছেলেকে ফিরে পাবার সম্ভাবনা তত বাড়বে।” 

তার এই পদক্ষেপকে ‘অসৎ’ ছাড়া আর অন্য কোন শব্দ দ্বারা ব্যাখ্যা করা যাবে না। কেননা সে নিজেও অনেকটা নিশ্চিত যে ছেলেটা আর বেঁচে নেই। তবুও সে এই কাজ করেছে, জেনে বুঝেই করেছে। সন্তানের কথা বলে মাকে প্রতারিত করাটা নৈতিকতা বিবর্জিত হলেও, এতে করে যদি আরেকটা প্রাণ বাঁচানো যায়, তাতে ক্ষতি কী? 

“ম্যাডাম, কিছুদিন আগে আপনার স্বামী একটা মেয়েকে অপহরণ করে। অপহরণের পর তাকে কোন এক জায়গায় বন্দী করে রাখে, কিন্তু আমাদের বলার আগেই সে আত্মহত্যা করে। মেয়েটার অবস্থা খুব শোচনীয়। আমরা যদি তাকে খুঁজে বের করতে না পারি, তাহলে সে মারা যাবে।” 

এই বলে রোজেলিনের চোখের দিকে তাকালো সে। ‘আমার ছেলের নিখোঁজ হওয়ার সাথে এই মেয়ের কী সম্পর্ক’ এই প্রশ্নই তার করা উচিৎ। কিন্তু যদি না করে, তার মানে এর উত্তর সে জানে। 

“আপনি যা যা জানেন তার সব বলুন আমাকে। একটা কথাও বাদ দিবেন না। … দাঁড়ান, দাঁড়ান, এক মিনিট…ম্যাডাম ব্রুনো, আপনি এখন বলবেন কিছুই জানেন না। কসম কেটে বলছি, এটা করা মোটেও উচিৎ হবে না, ভাল চান তো সব খুলে বলুন। দরকার হলে ভাবার জন্য কিছু সময় নিন, কিন্তু বলতে আপনাকে হবেই। আপনার তথ্যের উপর একটা মেয়ের জীবন নির্ভর করছে।” 

“ও আমাকে ফোন করেছিলো….”

পুরোপুরি জয় না হলেও, এটা একটা অর্জন তার জন্য, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ক্যামিল। 

“কবে?” 

“আমার ঠিক মনে নেই, একমাস হবে হয়তো।” 

“তারপর?” 

মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে রোজেলিন। ধীরে ধীরে বলতে লাগলো। পুলিশ অপারগতা প্রকাশ করে চিঠি দেয়ার পর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ট্র্যারিক্স। পুলিশের ধারণা তার ছেলে পালিয়ে গেছে মেয়েটার সাথে, তাই এই কেস ওখানেই শেষ করে দিয়েছিলো তারা। পুলিশ যেহেতু আর তদন্ত করবে না, তাই সে নিজেই ছেলেকে খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নেয়। 

“ওই মাগীটাই…” 

“মাগী?” 

“প্যাসকেলের গার্লফ্রেন্ডকে এই নামেই ডাকতো ট্র্যারিক্স।” 

“মেয়েটাকে নিয়ে ভাল কিছু ভাবতে পারতো না সে?” 

“আসলে হয়েছে কী প্যাসকেল একটু আলাদা ধরণের ছিলো। আপনি কি 

বুঝতে পারছেন আমি কী বলতে চাইছি?” 

“হ্যা, তা পারছি। আপনি বলুন।” 

“আমার ছেলের মাঝে খারাপ কিছু ছিল না, খুবই সাধারণ ছিল ও। ওর বাবার সাথে আমি থাকতে চাইতাম না, কারণ ওই মাতালটা সবসময় আমাকে অত্যাচার করতো, মানুষের সাথে মারামারি করতো। আমার ছেলে বাবার মাঝে কী পেয়েছিলো আমি জানি না, কিন্তু বাবাকে খুব ভালবাসতো। একদিন হুট করেই মেয়েটার সাথে দেখা, দ্রুতই হাতে হাত রেখে পথ চলতে শুরু করে দু’জন। আর করবেই না কেন, খুব বেশি মানুষ তো ওর সাথে মিশতো না। তাই মেয়েটার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে।” 

“মেয়েটার নাম কী? কখনো দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে?” 

“নাটালি সম্ভবত? না। একবারও না। শুধু নামটাই জানতাম। প্যাসকেল ফোন দিয়ে সারাক্ষণ ওর কথাই বলতো।” 

“আপনার সাথে পরিচয় করায় নি? অথবা ওর বাবার সাথে?” 

“না, ও প্রায়ই বলতো আমার কাছে নিয়ে আসবে মেয়েটাকে। আমি নাকি মেয়েটাকে অপছন্দ করতেই পারবো না। 

“তাদের ভালোবাসা একটা ঘূর্ণিঝড়ের মত ছিলো। জুন মাসে প্ৰথম দেখা হয় ওদের, আর জুলাই মাসেই তারা পালিয়ে যায়। কোথায় গেল, কীভাবে গেল কেউই জানে না। 

“শুরুর দিকে আমার অতোটা চিন্তা হয়নি। আমার ধারণা ছিল মেয়েটা একদিন ওকে ছেড়ে দিবে, আমার ছেলে আবারো তার বাবার কাছে ফিরে যাবে। সব আবার আগের মত হবে। কিন্তু ওর বাবা এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না। লোকটা স্বামী হিসেবে জঘন্য হলেও, বাবা হিসেবে আদর্শ ছিলো।” 

নিজের মন্তব্যে কিছুটা বিচলিত মনে হলো তাকে। এতোদিন ধরে নিজের মনের কোণে থাকা একটা বিশ্বাস, যা এতোদিন পর উপলব্ধি করলো। আবারো মেঝের দিকে তাকালো রোজেলিন। 

“কিন্তু যখন আমি জানতে পারলাম প্যাসকেল তার বাবার একাউন্ট থেকে সব টাকা তুলে নিয়েছে, তখন আমিও ওর বাবার মত ভাবতে শুরু করলাম, মেয়েটাই যত নষ্টের গোড়া। কেননা, আমার ছেলেকে আমি চিনি। বাবার একাউন্ট থেকে টাকা চুরি করার মত ছেলে ও না।” 

বলেই নিজের মাথা নাড়লো রোজেলিন, এই ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত সে।

“শেষমেশ আপনার স্বামী মেয়েটাকে খুঁজে বের করলো?” 

“আমি সেটা কীভাবে জানবো? আমাকে শুধু বলেছে আজ হোক কাল হোক মেয়েটাকে খুঁজে বের করবে, তার ছেলে কোথায় জিজ্ঞেস করবে…ছেলের সাথে কী করেছে তাও জিজ্ঞেস করবে।” 

“ছেলেকে কী করেছে মানে?” 

“আমি আপনাকে কীভাবে বুঝাবো, আমি জানি না। কিন্তু বাবাকে ছেড়ে এতোদিন থাকতে পারে না সে।” 

কথাটা বলেই ক্যামিলের দিকে তাকালো সে, বুঝতে পারছে কথাগুলো আঘাত করেছে তাকে। মনে মনে এর জন্য ক্ষমাও চাইলো। 

“যেমনটা আমি বলেছি, আমার ছেলে খুবই সহজ সরল। বেশি লোকের সাথে তার মেলামেশাও নেই; বাবার খুব ভক্ত। স্বেচ্ছায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কোন রকম যোগাযোগ ছাড়া থাকতে পারবে না। তার মানে, অবশ্যই ওর সাথে কিছু একটা হয়েছে।” 

“আপনার স্বামী ঠিক কী বলেছিলো? মেয়েটাকে কীভাবে খুঁজে বের করতে চাচ্ছে সে সম্পর্কে কিছু বলেছিলো? অথবা অন্য কিছু…?” 

“না, খুব বেশিক্ষণ তার সাথে কথা হয়নি। যখন হাতে একটা বোতল থাকে, আর কিছু লাগে না তার। পুরো পৃথিবীকে নিজের শত্রু ভাবে। আমাকে শুধু বলেছে মেয়েটাকে যে কোন মূল্যেই খুঁজে বের করতে চায়।” 

“আর আপনার প্রতিক্রিয়া কী ছিলো?” 

সাধারণত, বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে মিথ্যা বলার জন্য আলাদা যোগ্যতা থাকা লাগে; এর জন্য দরকার যথেষ্ট শক্তি, প্রখর স্মৃতিশক্তি, আত্মপ্রত্যয় আর সাহস। আর পুলিশের লোকজনের সাথে এমন কাজ করাটা আরো কঠিন, কেননা এই সব কিছু থাকতে হবে অনেক বেশি পরিমানে। রোজেলিন ব্রুনোর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তার এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় কিছুটা হতাশ সে। ক্যামিল এখন তাকে বইয়ের মত পড়তে পারছে। 

“এরপর তাকে কী বলেছেন? আপনি অবশ্যই তার সাথে, তখন মোলায়েম গলায় ভালোবাসার কথা বলেননি!!! আমার ধারণা, আপনি তার সম্পর্কে যা ভাবেন, তাই বলেছেন তাকে- আমি কি ভুল বললাম?” 

এই প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যা’ অথবা ‘না’ বোধক হওয়া উচিৎ। অন্য কোন উত্তর দেয়া মানেই, উত্তরদাতা আসল কথা বলতে চায় না, কিছু লুকাচ্ছে। 

“আমি জানি না।” 

“আপনি জানেন, ম্যাডাম ব্রুনো, আপনি বেশ ভালোমতোই জানেন আমি কী বলতে চাইছি। আপনার মনে যা যা ছিলো, তার সব বলেছেন তাকে। আপনি বলেছেন, পুলিশ যেখানে কিছু করতে পারেনি, সেখানে তুমি নিজের একটা চুলও ছিড়তে পারবে না। আপনি আরো বলছেন, আমি সঠিক বলতে পারবো না কী কী বলছেন, তবে কী বলতে পারেন তা ধারণা করতে পারি। ‘তুই একটা অসভ্য, জ্যঁ পিয়েরে, তুই একটা পাড় মাতাল, তোর তো বিচিই নাই, তুই কী করবি রে!!!” 

কিছু বলার জন্য রোজেলিন মুখ খুললো, কিন্তু তাকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না ক্যামিল। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রীতিমত চিৎকার শুরু করলো সে, কেননা এতোক্ষণ অনেক সহ্য করেছে। 

“আপনার ফোনের মেসেজ চেক করলে, আমি কী পাবো, ম্যাডাম ব্রুনো?” 

একচুলও নড়লো না সে। মাটির দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে যেন মনে মনে বলছে, ধরণী দ্বিধা হও, তোমার মাঝে আশ্রয় দাও আমাকে। 

“আমিই বলছি কী পাওয়া যাবে। আপনার স্বামীর পাঠানো কিছু ছবি পাওয়া যাবে। এর এটা অস্বীকার করতে যাবেন না, কেননা আপনার স্বামীর ফোন আমরা চেক করেছি। আর ছবিতে কী আছে আমি তাও বলতে পারবো, ছবিতে বাক্স বন্দী একটা মেয়েকে দেখতে পাবো। আপনি জানতেন আপনার স্বামীর পৌরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুললে, সে অবশ্যই কিছু করবে। আর যখন আপনি দেখলেন, আপনার স্বামী মেয়েটার এই অবস্থা করেছে, তখন আপনার মনে ভয় ঢুকে গেল। আপনার স্বামী ধরা পড়লে, আপনিও ফেঁসে যাবেন, এই ভয়ে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।” 

ক্যামিলের কিছু একটা সন্দেহ হলো। 

“যতক্ষণ না…”

রোজলিনের দিকে এগিয়ে গেল। নিচু হয়ে তার মুখের দিকে তাকালো। এখনও নড়ছে না সে। 

“শিট!!!” দাঁড়িয়ে বলল ক্যামিল। 

মাঝে মাঝে পুলিশের লোকজন অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। 

“আচ্ছা, এই কারণেই আপনি পুলিশকে কিছু জানান নি, তাই না? আপনি ধরা পড়ার ভয়ে ছিলেন না। বরং আপনার স্বামীর মতো আপনিও মনে করেন সবকিছুর জন্য এই মেয়েই দায়ী। আপনি কিছু জানাননি, কেননা আপনি ভাবছিলেন মেয়েটা তার উচিৎ শিক্ষা পাচ্ছে, তাই না?” 

দীর্ঘশ্বাস ফেললো ক্যামিল। নিজেকে বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে তার। 

“দোয়া করেন যাতে মেয়েটাকে জীবিত খুঁজে পাই। নইলে আপনার খবর আছে। নইলে আপনাকে অত্যাচারে প্ররোচিত করা আর হত্যাকান্ডে সহযোগিতা করার জন্য গ্রেফতার করবো। এছাড়াও আরো কোনো অভিযোগ আনা গেলে, আমি তাও আনবো আপনার বিরুদ্ধে।” 

প্রচণ্ড হতাশায় অফিস থেকে বের হয়ে গেল সে। সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। 

“আমাদের হাতে এখন কী কী তথ্য আছে যা মেয়েটার কাছে নিয়ে যাবে,” নিজেকে প্রশ্ন করলো ক্যামিল। 

কিছুই নেই। এইসব চিন্তা পাগল করে তুলছে তাকে। 

অধ্যায় ২১ 

বিচিত্র রঙের ইঁদুরের চেয়ে ধূসর বর্ণের ইঁদুরটা বেশী লোভী। সবসময় অ্যালেক্সের আশেপাশে ছোক ছোক করে। একটু খাবারের জন্য অন্যান্য ইঁদুরগুলোর সাথে মারামারিও করে। ইঁদুরটা যেমন বেপরোয়া তেমনি লোভী। 

গত কয়েক ঘণ্টার প্রতিটি মিনিট একরকম যুদ্ধ করেই কাটিয়েছে সে। এরই মাঝে দুইটা ইঁদুরকে মেরে বাকিগুলোর প্রতি একটা সতর্ক বার্তা পাঠিয়ে দিয়েছে। নিস্তেজ শিকারের এই আকস্মিক আক্রমণে ইঁদুরগুলোকে বেশ উত্তেজিত আর ভীত মনে হচ্ছে। 

হাতে থাকা কাঠের টুকরো দিয়েই প্রথমবারে মেরেছে অ্যালেক্স। কাঠের টুকরো দিয়ে গেঁথে ফেলে তারপর পায়ের নিচে পিষিয়ে ফেলেছে। ইঁদুরটা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করলে আরো জোরে ওটাকে পিষতে থাকে। একসময় নড়াচড়া বন্ধ করে ওটা, চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে, মুখটা হালকা কাঁপছে। একটু পর লাথি দিয়ে নিচে ফেলে দিলো হার মানা ইঁদুরটাকে। 

এরপরেই ইঁদুরগুলো বুঝতে পারলো, শিকারের নাগাল পেতে যুদ্ধ করতে হবে। 

দ্বিতীয় ইঁদুরটাকে মারার জন্য নতুন কৌশল অবলম্বন করলো সে। এটাকে লোভের ফাঁদে ফেললো। শুরুতে এগুতে না চাইলেও একসময় ঠিকই তার হাতের নাগালে পড়ে যায়, আর প্রথমটার মত একই পরিণতি বরণ করতে হয়। 

তার হাতে এখন কোন অস্ত্র নেই। ইঁদুরগুলো জানে না বলে ভয় পাচ্ছে। জমানো বাকি পানিটুকু দিয়ে নিজের হাতের ক্ষত পরিস্কার করলো সে। এরপর মাথার কাছে হাত নিয়ে রশিটাকে একটু ভিজিয়ে দিলো। যেহেতু এখন আর তার কাছে পানি নেই, তাই আপাতত রক্ত দিয়েই কাজ চালাতে হচ্ছে। রক্তপাত বন্ধ হওয়ার পর, আরেকটা কাঠের টুকরা দিয়ে শরীরের অন্য জায়গায় আঘাত করলো। রক্তের গন্ধ ইঁদুরগুলোকে খুশি করে তুললো। 

আবারো রক্ত পড়তে শুরু করলে, হাতের তালুতে জমাতে থাকলো সে। একটু জমা হলে, রশির উপর লেপে দিলো ওই রক্ত। 

সবগুলো ইঁদুর বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এখনই আক্রমণ করবে কিনা ভাবছে। রশিতে লেগে থাকা তাজা রক্তের ঘ্রাণ উদ্বেলিত করে তুললো ওদের। 

ইঁদুরগুলো এখন রক্তের স্বাদ পেয়ে গেছে। অ্যালেক্স নিজেই এই ব্যবস্থা করেছে। কিছুই আর ওদেরকে থামাতে পারবে না। 

রক্তের গন্ধ পাগল করে তুলেছে ইঁদুরগুলোকে। 

অধ্যায় ২২ 

নদীর ধারে লাল ইটের একটা দালান। মেয়েটাকে অপহরণ করার পূর্বে এই বাড়িরই কাউকে ফোন করা হয়েছিলো। 

স্যানড্রিন বোনটেম্পস। 

মহিলা নাস্তা সেরে কাজের জন্য যখন বেরুবে ঠিক তখনই সেখানে উপস্থিত হলো লুইস। অফিসে ফোন করে জানাতে হয়েছে যে আজকে তার আসতে দেরি হবে, কেননা একটা পুলিশ কেসের তদন্ত কাজে তার সহযোগিতা লাগবে। আজকের দিনে সবকিছু কেমন জানি দ্রুতগতিতে ঘটছে। 

দেখতে বেশ পরিপাটি, শালীন ভঙ্গিতেই আছে সে। বয়স পঁচিশ অথা ছাব্বিশ। সোফার এক পাশে যখন পাছা উঁচু করে বসলো, তখনই ক্যামিল কল্পনা করে ফেললো, বিশ-ত্রিশ বছর পর তাকে দেখতে কেমন লাগবে। 

“এই লোকটা… ট্র্যারিক্স। সে তো একটা নাছোড়বান্দা। আমি ফোনে বারবার একই কথা বলার পরেও ফোন করেই যেতো। একদিন হুট করে বাসায় উপস্থিত হয়ে আমাকে ঘাবড়ে দেয়।” 

আর এখন, পুলিশ তাকে ঘাবড়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে টাক মাথাওয়ালা ওই বামনটা। অন্যান্য সহকর্মী আসার প্রায় বিশ মিনিট পরে সে উপস্থিত হয়। কিন্তু এখন তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে কিছু শুনছে না, এক রুম থেকে অন্য রুমে যাচ্ছে, কিছু একটা খুঁজছে। একবার উপরে যাচ্ছে তো আরেকবার নিচে। মাঝে মাঝে রান্নাঘর থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে তার দিকে। শুরুতেই বামনটা বলে দিয়েছে, “নষ্ট করার মত সময় আমাদের হাতে নেই।” স্যানড্রিন এখনও বুঝতে পারছে না এসবের মানে কী। নিজেকে একটু সামাল দেয়ার চেষ্টা করেও পারছে না, কেননা চারিদিক থেকে তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হচ্ছে। 

“এটাই কি ওই মেয়ে?” 

বামনটা তার দিকে একটা স্কেচ বাড়িয়ে দিলো, একটা মেয়ের মুখ দেখা যাচ্ছে। ছবিটা দেখেই সে চিনতে পারলো- এ তো নাটালি। কিন্তু সে যে নাটালিকে চেনে, সে তো এমন না। স্কেচ এ নাটালিকে বাস্তব জীবনের চেয়ে আরো সুন্দর লাগছে, আর একদমই মোটা লাগছে না। আর তাছাড়া চুলটা ও তো এমন না, চোখও তো অন্য রকম। স্যানড্রিন যখন দেখেছিলো, তখন নাটালির চোখ ছিল নীল। যদিও সে জানে না স্কেচ এ নীল রঙ কেমন দেখাবে। একবার তার মনে হলো এটাই নাটালি, আবার মনে হলো এটা না। কিন্তু তার সামনের লোকজন হ্যাঁ অথবা না শুনতে চায়, এর মাঝামাঝি কোন কিছু নয়। স্যানড্রিন বলল, এটাই ওই মেয়ে। 

নাটালি গ্রেঞ্জার। 

অফিসাররা একে অপরের দিকে তাকালো। “গ্রেঞ্জার…” সন্দেহমাখা কণ্ঠে বলল বামনটা। আর অপেক্ষাকৃত তরুণ অফিসার বাইরে গেল একটা ফোন করতে। ফিরে আসার পর বামনটার সাথে ইশারায় কী যেন বলল। 

নাটালি কোন ল্যাবরেটরিতে কাজ করতো তা বলে দিলো স্যানড্রিন। তরুণ অফিসার তখনি চলে গেল। স্যানড্রিন এখন বামনটার সাথে একা। লোকটাকে বেশ বিরক্তিকর মনে হলো তার। লোকটা নিজেও জানে যে সে বিরক্তিকর, তবুও যেন গায়েই লাগায় না। তরুণ অফিসারের অনুপস্থিতিতে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকলো বামনটা। 

“ওর চুল সবসময়ই ময়লা থাকতো।” 

কিছু কথা থাকে যা মানুষকে বলা যায় না, পুলিশকেও না। কিন্তু, নাটালি আসলেই বেশ অপরিস্কার ছিলো। রুমটা কখনোই পরিচ্ছন্ন থাকতো না, টেবিলটাও আমোছা থাকতো, আর যেখানে সেখানে পড়ে থাকা ট্যাম্পুনগুলোর কথা না হয় বাদই দেয়া হলো। খুব বেশিদিন যে তারা একসাথে ছিল তা না, কিন্তু স্যানড্রিন এরইমাঝে হাপিয়ে উঠেছিলো। 

“নাটালির সাথে আমি আর বেশি দিন টিকতে পারতাম না।” 

স্যানড্রিন রুমমেট চেয়ে বিজ্ঞাপন দেয়ার পর নাটালি এসে হাজির হয়। শুরুতে তাকে দেখে এতোটা অগোছালো মনে হয় নি। বরং চিলেকোঠার রুম আর বাগান দেখে বেশ খুশি হয়েছিলো সে। কিন্তু স্যানড্রিন তাকে একটা কথা বলেনি, চিলেকোঠার এই রুমটা গ্রীষ্মকালে উত্তপ্ত কড়াই হয়ে উঠে। 

“দেখুন, এমনিতে আমাদের মাঝে কোন ঝগড়া ছিল না…” 

বামনটা তার দিকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। 

“নাটালি অগ্রিম ভাড়া দিয়ে দিতো।” 

“জুনের শুরুর দিকের কথা, আমার বয়ফ্রেন্ড আমাকে ছেড়ে চলে যায়। তাই খুব দ্রুই একজন রুমমেট দরকার ছিল আমার।” 

স্যানড্রিনের ব্যক্তিগত জীবনের কথাবার্তা বামনটাকে বিরক্ত করে তুলছে। বয়ফ্রেন্ড তার বাসায় আসে, তারপর হুট করেই একদিন চলে যায়, বাধ্য হয়ে রুমমেট খুঁজতে হয় তাকে। একসময় রুমমেটও তাকে ছেড়ে চলে যায়। মানুষের পরিত্যাগের শিকার হওয়ার জন্যেই যেন তার জন্ম; প্রথমে বয়ফ্রেন্ড, এরপর রুমমেট। 

জুলাইয়ের ১৪ তারিখে তার রুমমেট চলে যায় বলে সে নিশ্চিত করে। “এখানে উঠার পর পরই একটা ছেলের সাথে ওর পরিচয় হয়। তাই, অবশ্যই ও…” 

“অবশ্যই কী?” বিরক্তির সাথে জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল 

“ওই ছেলের সাথে আলাদা থাকতে চাইতো। একসাথে অন্য কোথাও বাসা নিতে চাইতো।” 

“ওহ…” 

ক্যামিলের এই উত্তরে অবিশ্বাসের সুর, যেন বলতে চাইছে ‘এইটুকুই?’। এই লোকটা যে মেয়েটা সম্পর্কে কিছুই জানে না, তা কথাবার্তা শুনেই বোঝা যায়। এরই মাঝে তরুণ অফিসার ল্যাবরেটরি থেকে চলে এসেছে, দূর থেকে পায়ের আওয়াজ শুনেছে স্যানড্রিন। লোকটার মাঝে কিছু একটা আছে যা তার দৃষ্টি কেড়ে নিলো। পরণের স্যুটটা দামি কোন ব্র্যান্ডের, লোগো দেখেই তা বুঝতে পারলো স্যানড্রিন। আর পায়ের জুতার দাম যে তার মাসিক বেতনের দ্বিগুণ, এই ব্যাপারে কোন সন্দেহই রইলো না তার। পুলিশ অফিসারদের সম্পর্কে এক নতুন সত্য উদ্ঘাটন করলো স্যানড্রিন, টিভিতে যেমন দেখা যায় আদতে সবাই তেমন নয়। 

অফিসারদের মাঝে কিছু কথাবার্তা চলছে। স্যানড্রিনের কানে বিচ্ছিন্ন কিছু শব্দ আসছে : “আর কখনোই দেখা যায় নি…” আর .হ্যা, ওই ছেলেও সাথে ছিলো…” 

“ও যখন চলে যায়, তখন আমি বাসায় ছিলাম না। কারণ, গ্রীষ্মকালে আমি আমার আন্টির বাসায় উঠি।” 

অপেক্ষাকৃত বয়স্ক অফিসারটিকে একটু রাগান্বিত দেখা গেল। সে যেভাবে চাচ্ছে জিজ্ঞাসাবাদ সেই ভাবে এগুচ্ছে না, এতে তো আর তার দোষ নেই। রাগান্বিত অফিসার এমনভাবে হাত নাড়লো যেন মাছি তাড়াচ্ছে। তার সহকর্মীরা সহানুভূতিশীল দৃষ্টিতে স্যানড্রিনের দিকে তাকালো, যেন বলতে চাইছে ‘সে এমনই। আপনি কিছু মনে করবেন না। শুধু আপনার কাছে যা জানতে চাইছে বলে দিন।’ এদের মাঝে একজন তাকে একটা ছবি দেখালো। 

“আরে, এটাই তো। এটাই তো নাটালির বয়ফ্রেন্ড, প্যাসকেল।” 

এই ব্যাপারে তার কোন সন্দেহ নেই। কোন এক মেলায় নাটালি আর প্যাসকেল পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক এই ছবিটা নিয়েই একমাস আগে প্যাসকেলের বাবা তার কাছে আসার পর নাটালির অফিসের ঠিকানা দিয়েছিলো। এরপর আর কখনোই লোকটার সাথে তার দেখা হয় নি। 

শুধুমাত্র ছবি দেখলেই বোঝা যায়, প্যাসকেল কারো জন্যই প্ৰথম পছন্দ হতে পারে না। দেখতেও খুব একটা সুদর্শন নয়। আর তার জামার কথা না বললেই নয়, এমন উদ্ভট পছন্দ দুনিয়ার কারো থাকতে পারে, তা প্যাসকেলকে না দেখলে বোঝা যাবে না। এটা ঠিক যে নাটালি একটু মোটা, কিন্তু দেখতে অতোটা খারাপ না। কিন্তু প্যাসকেল…ওর চেহারা বর্ণনা করাও কিছুটা কষ্টসাধ্য। 

“সত্যি কথা বলতে, প্যাসকেলের মানসিক বিকাশ পুরোপুরি হয় নি।” 

আদতে সে বলতে চেয়েছে, প্যাসকেল মোটেও বুদ্ধিমান ছিল না। ও নাটালিকে পূজনীয় মনে করতো। নাটালি ওকে দুই তিনবার বাসায় আনলেও, রাতে থাকতো না। তারা একসাথে শুয়েছে কিনা, এই ব্যাপারেই সন্দেহ আছে স্যানড্রিনের। তবে প্যাসকেল যখন আসতো, বেশ উত্তেজিত থাকতো, হাবভাব এমন যেন এখনি ঝাপিয়ে পড়বে নাটালির উপর। 

“তবে একবার এর ব্যতিক্রম ঘটেছিলো। প্যাসকেল একরাত আমাদের বাসায় ছিলো। আমার এখনো মনে আছে, জুলাইয়ের দিকের ঘটনা।”

কিন্তু সে কিছুই শুনতে পায় নি সেদিন। 

“অবাক করার মত বিষয় হলো, আমার রুম ঠিক ওর নিচেই।” 

বলেই নিজের ঠোঁটে কামড় দিলো, তার আড়িপাতার ব্যাপারটা ফাস হয়ে গেল কেবল। আর কিছু বলল না সে। যা বোঝার তা বুঝে নিয়েছে অফিসাররা। সে কিছু শুনতে পায় নি, কিন্তু তার চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না। হয়তো নাটালি আর প্যাসকেল… দাঁড়িয়ে করেছে। অথবা নাটালি এসবের জন্য প্রস্তুতই ছিল না। 

“ওর জায়গায় যদি আমি হতাম…” 

দু’মাসের ভাড়া আর বিল বাবদ যা টাকা লাগবে, তা কিচেনে রেখে নাটালি আর প্যাসকেল চলে যায় অন্যকোথাও। নিজের জিনিসপত্রও রেখে যায়। কিছুই নেয়নি সাথে। 

“জিনিসপত্র, কিসের জিনিসপত্র?” তৎক্ষণাৎ জানতে চাইলো ক্যামিল। 

একটু সতর্ক হয়ে গেল সে। নাটালি তার চেয়ে দুই সাইজ বড় জামাকাপড় পড়তো, তাই ওগুলো রাখার প্রশ্নই আসে না। তবে বাথরুমে নাটালির একটা আয়না ছিলো, সেটার কথা পুলিশকে জানালো না। এটা এখন নিজের কাজে ব্যবহার করে। এছাড়া নাটালির রেখে যাওয়া কফি মেকার, টি পট, রেইনওয়াটার ট্যাংক আর মার্গারিট দ্যুরার কিছু বই এর কথা পুলিশকে জানালো সে। 

“নাটালি গ্রেঞ্জার…এটা তো দ্যুরার সৃষ্ট একটা চরিত্র, তাই না?” তরুণ অফিসার হুট করে বলে উঠলো। 

“তাই নাকি? কোন উপন্যাসের কথা বলছো?” আরেকজন জিজ্ঞেস করলো। 

“উম…একটা মুভি আছে ‘নাটালি গ্রেঞ্জার’ নামে, ওখান থেকে নেয়া…” ক্যামিলকে বেশ খুশি দেখা গেল এই কথা শুনে। 

রেইনওয়াটার ট্যাংকও যাওয়ার আগে কিনেছিলো। আমি আন্টির বাসা থেকে আসার পর ওটা দেখতে পাই। হুট করে চলে যাওয়ার জন্য ক্ষমা চেয়ে আমার জন্য একটা চিঠি রেখে যায় নাটালি। আমার ধারণা ক্ষতিপূরণ হিসেবে ওটা দিয়ে যায় নাটালি, সারপ্রাইজ গিফট হিসেবে।” 

“সারপ্রাইজ গিফট!!!” বামনটা যেন হাস্যকর কিছু খুঁজে পেলো এর মাঝে। 

জানলার কাছে চলে গেল বামনটা। জানলার পর্দাটা সরানো, বাইরে তাকিয়ে আছে সে। গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে। হুট করেই পকেট থেকে ফোন বের করলো। 

“গুয়েন, মনে হয় ট্র্যারিক্সের ছেলেকে আমরা পেয়ে গেছি।” 

*

অনেক সময় পার হয়ে গেছে- বসকে ফোন করা দরকার, এরইমাঝে তরুণ অফিসার তার সাথে কথা বলা শুরু করলো। এখন আর জিজ্ঞাসাবাদ চলছে না, শুধু হালকা কথাবার্তা। অফিসারকে জানালো, একটা ল্যাবরেটরিতে কাজ করে সে, নাটালির মত। দু’জনেই বায়োলজিস্ট হিসেবে কাজ করতো, কিন্তু কাজের ব্যাপারে নাটালি কখনো কথা বলতো না। কাজের কথা জিজ্ঞেস করলে বলতো, “যেহেতু এখন বাসায়, তাই কাজের ব্যাপারে কোন কথা নয়।”

বিশ মিনিট পর, আসল কাজে নেমে পড়লো সবাই। ফরেনসিক টিমের সদস্যরা তাদের অ্যাস্ট্রোনট স্যুট পরে তৈরি, পুরো বাগানে তাদের জিনিসপত্র এনে জড়ো করেছে। রেইনওয়াটার ট্যাংক খালি করার জন্য অদ্ভুত কিছু সতর্কতা অবলম্বন করছে তারা। একফোঁটা পানিও যাতে মাটিতে না পড়ে সেদিকে মনোযোগ দিয়েছে। 

“আমি জানি তারা কী খুঁজে পাবে। এই ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত। যাই, আমি একটু ঘুমিয়ে নেই।” বলল বামনটা। 

নাটালির বেডরুমটা কোথায় তা স্যানড্রিনের কাছ থেকে জেনে নিলো, আর ওই অবস্থাতেই শুয়ে পড়লো বিছানাতে। সে যে জুতাটাও খুলেনি এই ব্যাপারে নিশ্চিত স্যানড্রিন। 

তরুণ অফিসার বাগানেই রয়ে গেছে। 

সে আসলেই দেখতে বেশ সুদর্শন। তার জামাকাপড়, জুতা, তার ব্যবহার দেখলেই বোঝা যায়, আগাগোড়া স্মার্ট একজন পুরুষ। স্যানড্রিন খুব চেষ্টা করেছে তার সাথে ভাব জমাতে। একটা মেয়ে বাসায় একা থাকে, এই ধরনের কথাবার্তা বলেও পটানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু কোন লাভ হয় নি। 

স্যানড্রিন নিশ্চিত অফিসারটা সমকামী। 

রেইনওয়াটার ট্যাংক খালি করার পর, সেটা সরিয়ে খুঁড়তে শুরু করলো ফরেনসিক বিভাগের লোকজন। বেশিদূর খুঁড়তে হলো না, এরইমাঝে প্লাস্টিকে মোড়ানো একটা লাশ খুঁজে পেলো তারা। 

এই দেখে স্যানড্রিনের মাথা ঘুরে উঠলো। পুলিশ সদস্যরা তাকে দূরে নিয়ে গিয়ে বলল, ম্যাডাম আপনার এখানে থাকা ঠিক হবে না। আপনি বরং রুমে যান। রুমে গিয়ে নিজের জানালা দিয়ে বাকি ঘটনা দেখতে থাকলো সে। লাশটা দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়লো, কেননা লাশটা তার পরিচিত একজনের, প্যাসকেলের লাশ। 

প্লাস্টিক পুরোপুরি খোলার পর, একজন ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা দেখে বাকি সবাইকে ডাক দিলো। কিন্তু লোকজনের কারণে স্যানড্রিন কিছু দেখতে পেলো না। তাই কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলো। 

একজন অফিসার বলল, “আরে না। ওটা এইরকম বিভৎস অবস্থা করতে পারবে না।” 

এমন সময় বামনটা ঘটনাস্থলে আসলো। 

লাশটা একটু সময় নিয়ে দেখলো। লাশ দেখার পর কিছুটা বিস্মিত মনে হলো তাকে। 

“আমি ওর সাথে একমত। এমন অবস্থা শুধুমাত্র এসিডের মাধ্যমেই করা সম্ভব।” আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল সে। 

অধ্যায় ২৩ 

রশিটা বেশ পুরোনো আর মোটা, শণ দিয়ে তৈরি, সাধারণত নৌকায় ব্যবহার করা হয়। এমন একটা বাক্সকে ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট। 

ইঁদুরের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন বারোতে দাঁড়িয়েছে। অ্যালেক্স পুরোনোগুলোকে ভালমতোই চিনে, তাই নতুনগুলোকে আলাদা করতে পেরেছে। সে জানে না এগুলো কোথা থেকে আসছে কিংবা কীভাবে আসছে। সবগুলো মিলে যেন কোন আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। 

তিন চারটা ইঁদুর বাক্সের শেষ প্রান্তে অবস্থান নিয়েছে। আরো তিন চারটা বাক্সের কোণায়। আক্রমণের জন্য পূর্ণ প্রস্তুত ইঁদুরগুলো, কিন্তু কিছু একটা এদেরকে বাঁধা দিচ্ছে; অ্যালেক্সের শক্তি। সে ক্রমাগত চিৎকার করে ইঁদুরগুলোকে ভয় দেখিয়ে কাছে ভিড়তে দিচ্ছে না। তারা বুঝতে পারছে, তাদের শিকার এখনো জীবিত। শিকার যে সহজে হাতে আসবে না, তা বেশ ভালমতোই বুঝতে পারছে ইঁদুরগুলো। আর যুদ্ধে আগাতে সাহস পাচ্ছে না, কেননা তাদের দুই সদস্য মৃত অবস্থায় পড়ে আছে মেঝেতে। 

সে এসব গ্রাহ্য করছে না। আবারো পায়ের কাছে একটা ক্ষত তৈরি করেছে কাঠের টুকরা দিয়ে। এবার আগের চেয়ে বেশি রক্ত পড়ছে। রক্ত হাতে নিয়ে রশিতে মাখানো বেশ কষ্টসাধ্য কাজ, কেননা তখন ইঁদুরগুলো রক্তের ঘ্রাণে পাগল হয়ে যায়। 

রশিটা অর্ধেক খেয়ে ফেলেছে ইঁদুরগুলো। এখন অ্যালেক্স আর রশিটার মাঝে এক অলিখিত প্রতিযোগিতা চলছে, কে আগে হাল ছাড়ে। 

বাক্সটাকে নাড়াতে শুরু করলো সে। এতে করে দুটি সুবিধা। ইঁদুরগুলোও কাছে আসতে পারবে না, আবার রশিটাও আরো দূর্বল হয়ে পড়বে। আরেকটি বিষয় এখন তার মাথায় কাজ করছে, বাক্সটাকে এমনভাবে নাড়াতে হবে যাতে করে দেয়ালে লেগে বাক্সটা ভেঙ্গে যায়। লাগাতার এমন পরিশ্রমে অনেক দূর্বল হয়ে পড়েছে সে। এমনিতেই ক্ষুধা আর তৃষ্ণা কাবু করে রেখেছে তাকে। আর কিছুদিন আগের হয়ে যাওয়া ঝড়ের পরে আসা ঠাণ্ডা বাতাস তার শরীরের অনেকাংশ অবশ করে ফেলেছে। 

ধূসর রঙের মোটা ইঁদুরটা অধৈর্য হয়ে উঠেছে। 

একটু পর পর এসে গন্ধ শুঁকে যাচ্ছে। রশির উপর লেগে থাকা রক্তে আর আগ্রহী না, সরাসরি শিকারকে হাতে পেতে চায়। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে ইঁদুরগুলোর সাহস। এখন আর তার চিৎকারে ওগুলো ভয় পায় না। বাক্সটা দুলতে থাকলে কোন রকমে বাক্সের গায়ে সেঁটে থাকে। 

কাঠের টুকরার মাঝ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি ইঁদুরটা।

অ্যালেক্সও পলক না ফেলে তাকিয়ে আছে। 

যেন দুই প্রেমিক প্রেমিকা কোন এক গোধূলি বেলায় একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। 

অধ্যায় ২৪ 

নাটালির রুমে আসতেই এক বিচিত্র অনুভূতি হলো তার। কাজটা সে কেন করেছে, নিজেও জানে না। চিলে কোঠার এই রুমটায় তাপমাত্রা অনেক বেশি। সারা বছর বন্ধ থাকা গেস্ট রুমটা গ্রীষ্মের শুরুতে খুলে দেয়া হয়। 

এখন এটা পুরোনো জিনিস রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়। দেয়ালে কিছু ছবি লাগানো, একটা পায়াবিহীন ওয়ারড্রোব বইপত্রে ঠাসা। বিছানাটা মার্শম্যালোর মত নরম, একবার শুয়ে পড়লে আর উঠতে ইচ্ছে করবে না। ক্যামিল বিছানায় পা উঠিয়ে, হেলান দিয়ে বসলো। নিজের নোটপ্যাড আর পেন্সিল বের করে স্কেচিং শুরু করলো। আদতে নিজের পোর্ট্রেট করছে। আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে, নিজের অনেক পোর্ট্রেট করেছে। তার মা এই ব্যাপারে বেশ উৎসাহও দিতো। মা সবসময় বলতো, এইভাবে আঁকতে আঁকতে একদিন নিজেকে চিনতে পারবে। তার মা নিজেই নিজের শত শত পোর্ট্রেট করেছে। এরমাঝে তেলরং দিয়ে করা একটা পোর্ট্রেট তার বেশ পছন্দ। কিন্তু নিজেকে কখনোই চিনতে পারেনি। তার নিজের আসল প্রতিচ্ছবিও আঁকা হয়নি। তাই এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছে। নোটপ্যাডে আঁকা মুখটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, লোকটা নিয়তির করুণ পরিহাসের শিকার 

রুমের সিলিং ক্রমশই নিচু হয়েছে। তাই স্বাভাবিক উচ্চতার যে কোন মানুষকে একটু বেঁকে চলতে হবে। কিন্তু ক্যামিলের কোন সমস্যা হচ্ছে না। এখনো স্কেচিং করেই চলছে। কিন্তু এতে তার মন নেই, হালকা অসুস্থ বোধ করছে। এই কেস শেষ করে সব কিছু থেকে মুক্তি চায় ক্যামিল। 

নিজের আঁকা নাটালি গ্রেঞ্জারের পোর্ট্রেট আর ছবিতে প্যাসকেলের পাশে থাকা মেয়ে, দুটোই দেখে মেয়েটাকে সাধারণ ভিক্টিম ছাড়া আর কিছুই মনে হয় নি তার। অপহরণের আরেকটা কেস হিসেবেই কাজ শুরু করেছিলো। কিন্তু ঘটনা এক ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে। ছবি, চোখের সামনে উপস্থিত এক বাস্তবতা। কিন্তু একটা আঁকা ছবি, তোমার নিজের বাস্তবতা, তুমি যেভাবে চাও সেভাবেই সাজাতে পারো, নানা রঙ এ রঙ্গিন করতে পারো। স্যানড্রিনকে ছবিটা দেখানোর পর তার চোখেমুখে যে পরিবর্তন, তা বেশ ভালমতোই খেয়াল করেছে সে। নাটালিই কি খুন করেছে প্যাসকেল ট্র্যরিক্সকে? এই নিয়ে আর ভাবছে না। মেয়েটার ছবি দেখে একটা মায়া জন্মে গেছে তার। একটা মেয়ে বাক্সে বন্দী হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণছে, আর মেয়েটাকে রক্ষা করার দায়িত্ব তার। কিন্তু এখনো তা পারেনি। আইরিনকেও বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছিলো। এখন কী করবে? এই মেয়েটাও কি তার ব্যর্থতার কারণে মারা যাবে? 

নিজের ভেতরের এই অনুভূতিগুলোকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেয়নি ক্যামিল। কেননা সে জানে, এই অনুভূতিগুলো তার যুক্তিকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করবে। আর নিজের ভেতরে চলা এই যুদ্ধ একবার শুরু হলে, নিজেকে আর রক্ষা করতে পারবে না। এই যুদ্ধে পরাজিত হলে আবার ফিরে যেতে হবে সেই ক্লিনিকে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *