অ্যালেক্স – ৫৫

অধ্যায় ৫৫ 

অনেক হিসাব করে ক্যামিল বের করেছে, টমাস যখন অ্যালেক্সের বেডরুমে প্রথম প্রবেশ করে, তখন অ্যালেক্সের বয়স এগারোও পার হয়নি, আর টমাসের বয়স সতেরো। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার আগে বিস্তর গবেষণা করতে হয়েছে তার। কিন্তু এখনও ভেবে পাচ্ছে না, এটা কীভাবে সম্ভব। বর্বরতার এ কেমন নিদর্শন। মনে মনে বলল, আর মানুষ বলে আমি নাকি নিষ্ঠুর। 

আবারো অ্যালেক্সের ফাইল ঘাটতে শুরু করলো ক্যামিল। তার ছবিগুলো দেখছে কিন্তু কোনটাতেই তারিখ নেই, তাই ছবির ব্যাকগ্রাউণ্ড দেখেই সময় অনুমান করতে হচ্ছে। প্রতিটি ছবিতেই তার সরব উপস্থিতি। 

অ্যালেক্সের পরিবার নিয়ে আরেকবার ভাবলো ক্যামিল। ক্যারোল প্যিভো, নার্সিং অ্যাসিস্টেন্ট, ১৯৬৯ সালে ফ্র্যাংক ভ্যাসোর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ঐ বছরেই তাদের ঘর আলো করে জন্ম নেয় থমাস ভ্যাসো। ফ্র্যাংক ভ্যাসো ১৯৭৪ সালে মারা যায়, টমাসের বয়স তখন পাঁচ হয়নি পুরোপুরি, হয়তো বাবার কোন স্মৃতিই নেই তার। আর অ্যালেক্সের জন্ম ১৯৭৬ সালে। 

বাবা কে, তা জানা যায়নি। 

তার ছোটবেলার ছবিতে দেখা যাচ্ছে, রোগা পাতলা একটা মেয়ে যার চোখেমুখে অজানা ভীতির ছাপ স্পষ্ট। চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে, ঠোঁটগুলো একদম পাতলা আর কোন প্রাণ নেই সেখানে। আর দাঁড়ানোর ভঙ্গিমাও একটু উদ্ভট, মনে হচ্ছে কেউ যেন তাকে জোর করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ছবি তোলার জন্য। একটা ছবিতে অ্যালেক্স আর টমাস কোন সমুদ্রের সামনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। ছবির অ্যালেক্সের বয়স সর্বোচ্চ দশ বছর আর টমাসের সতেরো। তার কাঁধে এক হাত দিয়ে রেখেছে টমাস। পরণে টু- পিস সুইমস্যুট, যদিও বিকিনির উপরের অংশ তার জন্য পরা আর না পরা সমান কথা। হাতগুলো এতো চিকন যে দুই আঙুল দিয়েই তার বেড় পাওয়া যাবে। মোটকথা, তার এই ছবি দেখলে যে কেউ শিহরিত হয়ে উঠবে। 

ঠিক এমন সময়েই তার রুমে যাওয়া শুরু হয় টমাসের। কিছুটা আগে পরে হতে পারে, তবে সেটা কোন গুরুত্বপুর্ণ বিষয় না। কেননা এর পরবর্তী ছবিগুলো খুব একটা আশাবক মনে হলো না ক্যামিলের। পরের এক ছবিতে দেখা যায়, কোন এক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে পুরো পরিবারসহ গিয়েছিলেন মিসেস প্যিভো। ডানপাশে অ্যালেক্স আর বামপাশে টমাস দাঁড়িয়ে আছে। এই ছবিতে অ্যালেক্স আগের চেয়ে একটু বেড়েছে, তবে শুধু উচ্চতায়। এখনও আগের মতই রোগাই আছে। তাকে দেখলে যে কারো মনে মায়া জন্মাবে। 

*

“রবার্ট প্র্যাডেরি।”

নতুন নোটবুক হাতে নিয়ে বসেছে আরম্যান্ড। আজকে তার উপর এক গুরু দায়িত্ব পড়েছে। 

“এই নাম কখনোই শুনিনি। অ্যালেক্সের নতুন কোন ভিক্টিম নাকি?” 

“জ্বি, হ্যা। পেশায় লরি ড্রাইভার, জার্মান বর্ডারের কাছে একটা ক্যাবে তার লাশ পাওয়া যায়। চোখে আর গলায় স্ক্রু ড্রাইভার ঢুকিয়ে খুন করে অ্যালেক্স। আর এরপর গলায় ঢেলে দেয় এসিড।” 

টমাস চিন্তায় পড়ে গেল। 

“অ্যালেক্স অবশ্য ছোটবেলা থেকেই একটু রগচটা স্বভাবের…”

“সেই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই আর।”

“নারী জাতি তো…” 

“তো যাই হোক, রবার্ট প্র্যারেডিকে আপনি চেনেন না?” 

“না। মোটেও না।”

আরম্যান্ড কোন কথা বলল না। ফাইলে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো।

“আর বার্নাড গ্যাটেনগো?” 

“আপনি কি একে একে সবার নাম বলবেন নাকি?” 

“সমস্যা নেই, বেশি সময় লাগবে না। মাত্র ছয়জনই তো।” 

“এদের সাথে আমার কী সম্পর্ক?” 

“আছে। আছে। কারণ আপনি বার্নাড গ্যাটেনগোকে চিনতেন।” 

“তাই নাকি!! কীভাবে?” 

“চিনতেন!! একটু মনে করার চেষ্টা করুন। চলুন একটু অতীত রোমন্থন করে আসি। গ্যাটেনগো টেমসের এক গ্যারেজের মালিক ছিলেন। আর আপনি সেখান থেকে একটা মোটর বাইকও কিনেছিলেন। সালটা দেখে নিই…১৯৮৮।” 

“হয়তো। তবে এটা তো অনেক আগের কথা। ১৯৮৮ সালে আমার বয়স ছিল উনিশ। ওই সময়ের কথা মনে থাকবে কী করে?” 

“আর তাছাড়া…”

ঝড়ের বেগে আবারো ফাইলে কিছু একটা খুঁজতে শুরু করলো আর ম্যান্ড। “এইতো পেয়ে গেছি। গ্যাটেনগোর এক বন্ধুর সাক্ষ্যমতে, তিনি আপনাকে ভালোভাবেই চিনতেন। মোটর বাইক বলতে পাগলপ্রায় ছিলেন আপনারা দুজন। একসাথে অনেক ঘুরেও বেড়িয়েছেন।” 

“কবে?” 

“১৯৮৮-৮৯ সালের দিকে।” 

“আমার ধারণা ১৯৮৮ সালের সব লোকের কথা এখনও মনে আছে আপনার?” 

“এখানে প্রশ্নের উত্তর আমি দিচ্ছি না। আপনি দিবেন।” 

“আচ্ছা, মানলাম। হয়তো সেই সময় আমি এই লোকের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছি। তো?” 

“তাহলেই তো মিলটা খুঁজে পাওয়া যায়। আপনি রবার্ট প্র্যাডেরিকে চিনতেন না, কিন্তু বার্নার্ড গ্যাটেনগোকে চিনতেন। আর প্র্যাডেরি, গ্যাটেনগোর পরিচিত ছিলো।” 

“এমন দুইজন মানুষ যারা কোনভাবেই একে অপরের সাথে সম্পর্কিত না।” 

এই কথার মোক্ষম জবাব খুঁজে পেলো না আরম্যান্ড। লুইস এগিয়ে এলো। 

“ফ্রিজেস করিস্থির সিক্স ডিগ্রি অফ সেপারেশন? এই থিয়োরি আমরা জানি। কিন্তু আপনি এইসব বলে মূল বিষয় থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।” কড়া কণ্ঠে বলল লুইস। 

*

ম্যাদমোজেল টুবিয়ানা ছত্রিশ বছর বয়সি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী নারী। নিজের ‘চিরকুমারী’ পদবী নিয়ে বেশ গর্বিত। দুইদিন আগে তার সাথে দেখা করেছে ক্যামিল। স্থানীয় সুইমিং পুল থেকে গোসল সেরে আসার পর একটা ক্যাফেতে বসে দুজন। বয়স হওয়ার কারণে নিজের অনেক পুরোনো ছাত্রছাত্রীদেরকে গুলিয়ে ফেলেন তিনি। তবে, অ্যালেক্সের নাম বলতেই তাকে চিনে ফেললো। এরপর ছবি দেখে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়। 

“খুব লক্ষী মেয়ে, প্রায়ই আমার অফিসে যাওয়া আসা করতো। ব্ৰেক টাইমে আমার এখানে চলে আসতো। 

“খুব বেশি কথা না বললেও, তার বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধব ছিলো। হুট করে কোন কারণ ছাড়াই উত্তেজিত হয়ে পড়তো। একটু পরেই দেখা যাচ্ছে আবার সব কিছু স্বাভাবিক। মনে হয়, কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে যেতো অন্য কোথাও। আর যখন কোন ঝামেলায় পড়তো, তখন হালকা তোতলানোর স্বভাব ছিল ওর। 

“প্রথম দিকে এমন ছিল না। কেননা এসব বিষয়ে আমি তীক্ষ্ণ নজর রাখি।” 

“কবে থেকে এমন শুরু হয়?” 

“স্কুলের মাঝামাঝি সময়ে সম্ভবত।” 

“আপনার কী মনে হয়? কী কারণ থাকতে পারে এর পিছনে?” 

ডানে বামে মাথা নেড়ে জানালো, এই ব্যাপারে সে কিছু জানে না। 

“এই ব্যাপারে অ্যালেক্সের মাকে কিছু জানান নি?” 

“না। আমি ভেবেছিলাম, বড় হলেই ঠিক হয়ে যাবে।” 

সামনে বসে থাকা মানুষটাকে বোঝার চেষ্টা করলো ক্যামিল। কিছু একটা যেন মিলছে না। মিথ্যার সুর বেজে উঠছে, কিন্তু সে ধরতে পারছে না।

“ওর ভাই, টমাস, অ্যালেক্সকে নিতে কি ওর ভাই আসতো?” 

“হ্যা, সবসময়ই।” 

“আচ্ছা। অ্যালেক্স কি এতে খুশি ছিলো?” 

“না, মোটেও না। এই বয়সি মেয়েরা চায় স্কুলের পর একটু ঘুরতে, বন্ধুবান্ধবের সাথে খেলাধূলা করতে। কিন্তু ওর ভাই সবসময় আগে এসে বসে থাকতো।” 

ক্যামিল এতোক্ষণ ধরে যে কথা বলার অপেক্ষায় ছিলো, এখন তা ছুঁড়ে দিলো টুবিয়ানার দিকে। 

“অ্যালেক্সকে ওর ভাই ধর্ষণ করতো। আর এটা শুরু হয়েছে আপনার ক্লাসে থাকাকালীন সময়ে।” 

টুবিয়ানা কিছুই বলল না। আশেপাশে এমনভাবে তাকালো যেন কারো অপেক্ষায় আছে। 

“এই ব্যাপারে অ্যালেক্স কখনো আপনার সাথে কথা বলেছে?” 

“হয়তো বলছিলো। কিন্তু, বাচ্চারা তো অনেককিছুই বলে। আর তাছাড়া এটা তাদের পারিবারিক বিষয়। আমার কিছু করার ছিল না।” 

*

“তাহলে ট্র্যারিক্স, গ্যাটেনগো, প্র্যাডেরি…”

আরম্যান্ডকে বেশ সন্তুষ্ট মনে হলো। 

“ভাল…” 

আবারো ফাইল ঘাটতে শুরু করলো সে। 

“আহ, স্টেফান ম্যাকিয়াক। আমার ধারণা ইনিও আপনার পরিচিত না?”

ভ্যাসো কিছুই বলল না। আরো কিছু শোনার অপেক্ষায় আছে। 

“ম্যাকিয়াক একটা ক্যাফের মালিক ছিলো।” 

“তো? এর সাথে আবার আমার কী সম্পর্ক?” 

“বলছি তো আস্তে আস্তে। এতো অধৈর্য হলে তো চলবে না। আপনার কর্মচারীদের মতে, ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল অবধি আপনার ওদিক দিয়েই যেতো সে। এমনকি দুইটা পিনবল মেশিনও ইজারা দিয়েছিলেন আপনি।” 

“হতে পারে।” 

“হতে পারে না, মি.ভ্যাসো। এটাই হয়েছিলো। আমরা শতভাগ নিশ্চিত এ ব্যাপারে।” 

একটু নড়েচড়ে বসলো ভ্যাসো। হাত ঘড়ি দেখে কিছু একটা গণনা করলো। 

“আপনারা আসলে কী জানতে চাচ্ছেন তা স্পষ্ট করে বলুন। আশা করি আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারবো।”

*

ছবির সূত্র ধরে অ্যালেক্সের এক পুরোনো বান্ধবীর খোঁজ পায় ক্যামিল। দ্রুত মেয়েটার ঠিকানা বের করে, তার সাথে যোগাযোগ করে। 

মেয়েটার নাম রেনেটে। অ্যালেক্সের ছোটবেলার এক ছবিতে দুজনকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে। তার বাড়িতে কোন এক ছুটির দিনে তোলা হয় ছবিটা। উচ্ছল দুই তরুণীকে দেখেই যে কেউ বলবে এরা প্রাণের বান্ধবী। 

“হায় আল্লাহ, আমরা তখন দেখতে কেমন ছিলাম…” বলল ছবি দেখে উচ্ছ্বসিত রেনেট্টে। 

“আমাদেরকে এক মুহূর্তের জন্য আলাদা করা যেতো না, হরিহর আত্মা বলতে যা বোঝায়, তাই ছিলাম আমরা দুজন। স্কুলেতো একসাথে থাকতামই, বাসায় ফিরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেলিফোনে কাটাতাম। আমাদের বাবা মা বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলো আমাদের এমন আচরণে।” 

“আর টমাস সম্পর্কে কতটুকু জানো?” 

হুট করে নীরবতা নেমে এলো পুরো ঘর জুড়ে। একই কথা বলতে বলতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এরকম জঘন্য একটা ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতেই তার ঘৃণা লাগছে। 

“নিজের বোনকে ধর্ষণ শুরু করে ১৯৮৬ সাল থেকে,” বলল ক্যামিল। রেনেটে সিগারেট ধরালো। 

“তখন তোমরা দুজন খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিলে। ও কিছু বলেনি তোমাকে?” 

“হ্যা।” 

“হ্যা… কী বলেছে?” 

“হ্যা, কী মানে? আপনি কি আশা করেন? পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা প্রয়োজন ছিলো? পনেরো বছর বয়সে?” 

“ও তোমাকে ঠিক কী বলেছিলো?” 

“টমাস ওকে ব্যথা দিতো।” 

“আচ্ছা তোমরা দু’জন আসলে কতটা ঘনিষ্ঠ ছিলে?” 

হাসলো রেনেটে। 

“আপনি জানতে চাচ্ছেন আমাদের শারীরিক সম্পর্ক ছিল কিনা? তেরো বছর বয়সে?” 

“অ্যালেক্স তেরো ছিলো, কিন্তু তোমার তো পনেরো।” 

“আচ্ছা বুঝেছি। হ্যা, ছিলো। তাদের মতে, আমিই নাকি প্ররোচণা দিয়েছিলাম।” 

“কতদিন ছিল এই সম্পর্ক?” 

“আমার ঠিক মনে নেই। তবে, অ্যালেক্স এই ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী ছিল না…আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন আমি কী বলতে চাইছি।” 

“না, পারছি না।” 

“এই ব্যাপারটা নাকি ওকে বিভ্রান্ত করছিলো।”

“মানে?” 

“এই সম্পর্ক ওর ভালো লাগছিলো না।” 

“কিন্তু তুমি ঠিকই ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে এমন সম্পর্কে টেনে এনেছিলে?”

“না, মোটেও না। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতো অ্যালেক্স।” উত্তেজিত 

কণ্ঠে বলল রেনেটে। 

তেরো বছর বয়সে? আর ওমন একটা ভাই থাকার পরেও?” 

*

“ঠিক তাই। আমরাও ঠিক এটাই চাচ্ছিলাম যে আপনি একটু সহযোগিতা করুন।” 

একটু উন্মনা মনে হলো তাকে। 

“ছোট একটা তথ্য জানিয়ে রাখি আপনাকে। আপনি একটু আগে বলেছেন আপনি স্টেফান ম্যাকিয়াককে চেনেন না। কিন্তু আমাদের তথ্য অনুসারে,গত চার বছরে আপনি সাতবার ম্যাকিয়াকের সাথে দেখা করেছেন।” 

“অবশ্যই। অনেক ক্লায়েন্টের সাথে দেখা হয় আমার…” 

*

সিগারেট ফেলে দিলো রেনেটে। 

“আমি জানি না ঠিক কী হয়েছিল। হুট করেই একদিন গায়েব হয়ে যায় অ্যালেক্স। বেশ কিছুদিন পর ফিরে আসে, কিন্তু আমার সাথে কোন কথাই বলে না। এরপর আমরাও একসময় অন্য জায়গায় চলে যাই। আর কখনো দেখাই হয়নি ওর সাথে।” 

“এটা ঠিক কবের ঘটনা?” 

“আমার মনে নেই। অনেক আগের কথা, তবে ১৯৮৯ সালের শেষের দিকে হবে হয়তো… আমি নিশ্চিত নই।” 

অধ্যায় ৫৬ 

রেনেট্রেকে বিদায় দিয়ে অফিসের পথ ধরলো ক্যামিল। এখনও অ্যালেক্সের চিন্তায় ডুবে আছে। তেরো বছর বয়সি অ্যালেক্সের স্কেচ করছে মনে মনে। ছবিতে হাসিমুখ মেয়েটার সাথে হোটেল রুমে পড়ে থাকা মেয়েটাকে কোন ভাবেই মিলাতে পারছে না। 

“আচ্ছা। এবার জ্যাকলিন জানেত্তির কথায় আসি। একেও কি চিনতেন না আপনি?” 

কোন উত্তর দিলো না ভ্যাসো। লুইসকে বেশ খুশি খুশি মনে হলো, কেননা ভ্যাসোকে শক্ত করে ধরার জন্য আস্তে আস্তে জাল গুটিয়ে আনছে সে। 

“তো, বলুন, আপনি কত সাল থেকে ডিস্ট্রিফেয়ারে কাজ শুরু করেছেন?” 

“১৯৮৭ সাল থেকে। তবে, আমি আপনাদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছি, যদি আমার কোন কর্মচারীর সাথে দেখা করেন…” 

“কী?” রুমে ঢোকার সময় জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।

ক্যামিলকে দেখেই মুখটা পাংশু বর্ণ হয়ে গেল টমাসের। 

“যদি আপনার কোন কর্মচারীর সাথে দেখা করি…তাহলে কী করবেন? কথাটা আমার কাছে হুমকিস্বরূপ মনে হলো। যাই হোক, আমি মুগ্ধ। আপনি বলে যান।” 

“আপনার বয়স কত ছিল তখন?” জিজ্ঞেস করলো লুইস। 

“আঠারো।” 

“আচ্ছা, আমাকে একটা জিনিস বলুন তো…” আরেকবার লুইসকে থামিয়ে দিলো ক্যামিল। 

“কী জানতে চান?” 

“ওই সময়ে আপনার আর অ্যালেক্সের সম্পর্ক কেমন ছিলো?” 

“ওর সাথে সবসময়ই ভাল সম্পর্ক ছিলো, কমিশনার।” 

“কম্যান্ড্যান্ট,” ভুল ধরিয়ে দিলো ক্যামিল। 

“কমিশনার, কম্যান্ড্যান্ট, ক্যাপ্টেন সবই এক আমার কাছে।” 

“কোম্পানি আপনাকে ট্রেনিংয়ের জন্য একবার বাইরে পাঠায়। সম্ভবত ১৯৮৮ সালে এবং…” আবারো হাল ধরলো লুইস। 

“আচ্ছা, ঠিক আছে। স্বীকার করলাম, আমি জানেত্তিকে চিনি। ওর সাথে একবার প্রণয়লীলায় মত্ত হয়ে গিয়েছিলাম, এটা তো বড় করে দেখার মত কিছু না।” 

“তুলুজে আপনি তিনবার গিয়েছিলেন ভিন্ন ভিন্ন কারণে। আর প্রতিবারই কমপক্ষে এক সপ্তাহের জন্য… 

“আচ্ছা, তাও মানলাম। আমি তিনবারই গিয়েছিলাম! তো?” 

“আপনার মেজাজ সংবরণ করুন,” বলল ক্যামিল। 

“আপনাদের তিনজনের হাবভাব দেখে মন হচ্ছে, কোন কমেডি অনুষ্ঠানে চলে এসেছি। সোনালী বালক তো ফাইল নিয়েই পড়ে আছে, সুদর্শন লোকটা আমাকে প্রশ্ন করছে, আর ওই বামনটা দূরে বসে কী যেন আঁকছে।” 

এই কথা শোনার পর রাগে লাল হয়ে ক্যামিল। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ভ্যাসোর দিকে ছুটে গেল। ভ্যাসোর কাছে পৌঁছানোর আগেই লুইস মাঝে গিয়ে দাঁড়ালো। ক্যামিলকে শান্ত হয়ে বসতে বলল। এমন পরিস্থিতিতে ক্যামিলকে কীভাবে থামাতে হয়, তা তার চেয়ে ভাল কে জানে। 

“আরে এই, বামনের ঘরের বামন, ‘হ্যা, দশ বছর বয়স থেকেই আমি ওকে ধর্ষণ শুরু করেছি।’ তাতে তোর কী? তুই আমার কিছুই করতে পারবি না।” 

“আ…আমি এমন কিছুই বলিনি। আপনারাই আমাকে বাধ্য করেছেন এমন বলতে।” উত্তজনার বশে কত বড় ভুল করে ফেলেছে, তা বুঝতে পেরে সাফাই গাইতে শুরু করলো। 

“আমি আসলে বলতে চেয়েছিলাম আমি আমার বোনকে অনেক ভালোবাসতাম। এতে তো কোন সমস্যা থাকার কথা না। নাকি আপনাদের আইনে ‘বোনের প্রতি ভাইয়ের ভালবাসা” কোন অপরাধ?” 

*

এই ছবিতে একটা তারিখ দেখা যাচ্ছে। মিসেস প্যিভো ছবির পিছনে লিখে রেখেছেঃ টমাস, ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৮৯। 

টমাস ওইদিন বিশে পা দিয়েছে। তার বাড়ির বাইরে কোথাও তোলা হয়েছিলো ছবিটা। 

ছবিতে দেখা যাচ্ছে গাড়িতে ওঠার জন্য উবু হয়ে আছে টমাস, পাশেই দাঁড়িয়ে আছে অ্যালেক্স। তার কাঁধে হাত দিয়ে রেখেছে টমাস, ভাই বোনের কাঁধে হাত রাখাটা অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু যখন এমন কিছু জানা যায়, তখন এই স্বাভাবিক ভঙ্গিকেও খুব অস্বাভাবিক লাগে। 

“টমাস আর অ্যালেক্সের মাঝে সম্পর্ক কেমন ছিলো?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল। 

“ভাল। খুবই ভালো। টমাস সবসময় ওর বোনের খেয়াল রাখতো, “ বলল মিসেস প্যিভো। 

*

নিজের ঘড়ির দিকে অসন্তুষ্ট ভঙ্গিতে তাকালো ভ্যাসো। 

“আপনার তিন সন্তান, তাই না?” 

“হ্যা, তিনজন।” 

“আর মেয়েও আছে তাই না? দুইজন?” 

একটু ঝুঁকে লুইসের সামনে থাকা ফাইলে চোখ বুলালো ক্যামিল। 

“আর ছোট্ট মামুণিদের বয়স কত হয়েছে?” 

কিছুই বলল না টমাস, রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে লাগলো। লুইস পরিস্থিতি আঁচ করে, প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফেললো। 

“তো, জ্যাকলিন জানেত্তি…,” বাক্যটা শেষ করতে পারলোন না লুইস।

“নয় এবং এগারো,” বলে উঠলো ক্যামিল 

বিজয়ির ভঙ্গিতে কেস ফাইল নাড়াচাড়া করতে লাগলো। মুহূর্তের মাঝেই মুখ থেকে হাসি মুছে গেল। টমাসের দিকে ঘুরলো। 

“তো, মঁসিয়ে ভ্যাসো, আপনার মেয়েদেরকে ভালবাসেন আপনি? আর আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি পিতৃস্নেহ অবৈধ কিছু না।” 

আরো জোরে দাঁত কিড়মিড় করতে শুরু করলো টমাস। বাইরে থেকে চোয়াল স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। 

“ওরাও কি খুব অস্থির? ওদের ডিসিপ্লিন শেখানোর দরকার আছে? অবশ্য ছোট বাচ্চাদের ডিসিপ্লিন শেখানোর জন্য ভালোবাসা আর আদর প্রয়োজন।” 

টমাস অনেকক্ষণ ক্যামিলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। একটু পর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। 

“আপনি আসলেই মানসিকভাবে অসুস্থ, কম্যান্ড্যান্ট। আপনার মত মানুষের কাছ থেকে এমনটা আশা করা যায় না। আপনার কী মনে হয় আমি ফাঁদে পা দিবো। আপনি এসব বলে আমাকে উত্তেজিত করবেন আর আমি আপনার মুখে একটা ঘুষি…” 

“আপনি এই পদে থাকার যোগ্যতাই রাখেন না।” 

এই বলে উঠে দাঁড়ালো টমাস। 

“আর এক কদম নড়লে…” হুমকির স্বরে বলল ক্যামিল। 

কী হচ্ছে কেউ বুঝে উঠতে পারলো না। পরিস্থিতি গরম হয়ে উঠেছে। সবাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে লাগলো লুইস। 

“আপনি যখন হোটেলে ছিলেন, তখন জ্যাকলিন জানেত্তির সাথে ফেলিক্স ম্যানিয়ের সম্পর্ক ছিলো। প্রায়ই তারা মেলামেশা করতো, যদিও তাদের মাঝে বয়সের ব্যবধান ছিল প্রায় বারো বছর। তখন বোধহয় আপনার বয়স বিশ কি ঊনিশ?” 

“কথা প্যাঁচাতে হবে না। জ্যাকলিন একটা বুড়ো মাগী ছিলো। কম বয়স্ক পুরুষদের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়াটাই ওর একমাত্র নেশা ছিলো। হোটেলের কমপক্ষে অর্ধেক গেস্টদের সাথে ও এমন করেছে। আমি হোটেলের দরজায় পা রাখার সাথে সাথেই আমাকে ফুসলানো শুরু করে।” 

“তাহলে, দেখা যাচ্ছে। সম্পর্কের শিকলটা আরেকটু বড় হলো। বার্নাড গ্যাটেনগোকে আপনি চিনতেন, আর গ্যাটেনগো চিনতো প্র্যাডেরিকে, যাকে আপনি চিনেন না। আবার জ্যাকলিন জানেত্তি আপনার পরিচিত ছিল কিন্তু ফেলিক্স ম্যানিয়েকে আপনি চিনতেন না। তবে জানেত্তির পরিচিত ছিল সে।” ইতি টানলো লুইস। 

“আশা করি, আমি কিছু বাদ দেইনি।” ক্যামিলের দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল লুইস। 

“উহু, আমার তা মনে হচ্ছে না,” বলল ক্যামিল। 

ভ্যাসোর দিকে ঘুরলো লুইস। 

“প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে, আপনার বোনের দ্বারা খুনের শিকার সবাইকেই চিনতেন আপনি,” বলল লুইস। 

“এবার ঠিক আছে, বস?” আবারো ক্যামিলের দিকে তাকিয়ে বলল লুইস। 

“সরি, লুইস, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এখনো তুমি ঝেড়ে কাশি দাওনি।”

“আপনার তাই মনে হয়?” 

“হ্যা।” 

“আপনিই বলে দিন তাহলে।” এই বলে একটু সরে দাঁড়ালো লুইস।

“তো, মঁসিয়ে ভ্যাসো, আপনার বোন অ্যালেক্স…” 

“হ্যা, বলুন?” 

“ঠিক কতজনের কাছে আপনার বোনকে বিক্রি করেছিলেন?” 

পুরো রুম জুড়ে নীরবতা নেমে এলো। 

“দেখি; গ্যাটেনগো, প্র্যাডেরি, ম্যানিয়ে… আমাদের কাছে তো পুরো লিস্ট নেই। এইক্ষেত্রে আপনার সহযোগিতা আমাদের একান্ত কাম্য। আপনিই তো জানেন কার কার কাছে ভাড়া দিয়েছিনেন নিজের বোনকে।” 

রাগে ফেটে পড়লো ভ্যাসো। 

“আপনি কি আমার বোনকে বেশ্যা বললেন? একজন মৃত মানুষের প্রতি আপনার ন্যূনতম সম্মানবোধ নেই?” 

পরক্ষণেই হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে। 

“তো, ভাইজানেরা, আপনারা এইসব কীভাবে প্রমাণ করবেন, শুনি? আমি আবারো বলছি, অ্যালেক্সের সাক্ষ্য নিবেন নাকি?” 

নিজের রসবোধের পরিচয় দিলো টমাস। 

“আপনারা কি খদ্দেরদের কোর্টে হাজির করাবেন? এটা খুব একটা সহজ কাজ হবে বলে মনে হয় না। তাদের শারীরিক অবস্থাও তো খুব একটা ভাল না।” 

*

কপিবুক হোক আর নোটবুক, অ্যালেক্স কখনো তারিখ দেয়নি। আর লেখাগুলোও কেমন জানি অস্পষ্ট যেন একা একা থাকাকালীন সময়টাও ভয়েই কেটেছে তার। মনের কথাগুলো গুছিয়ে লেখার সাহস হয়নি তার। যেন ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলো না। 

“বৃহস্পতিবার, টমাস আজকে ওর এক বন্ধুকে নিয়ে এসেছে। প্যাসকেল, টমাসের স্কুলজীবনের বন্ধু। হাঁদারামটা সারাক্ষণ মুখ চেপে হেসেছে। টমাস আমাকে বাধ্য করেছে ওর সামনে দাড়াতে। কিছুক্ষণ পর আমাকে আর ওই হাঁদারামকে রুমে রেখে চলে যায়, তখনও খিলখিল করে হাসছিলো ও। আমাকে ব্যথা দেয়ার সময়ও হাঁদারাম প্যাসকেল হাসি থামায়নি। আমার বুক ফেটে কান্না এলেও আমি তা চেপে রাখি, ওর সামনে কাঁদতেও ইচ্ছে হয়নি আমার।”

“বাহ, বেশ সুন্দর,” নিজের ঊরুতে হাত রেখে বলল টমাস, “আপনাদের কাহিনী যদি শেষ হয়ে থাকে, আমি কি এখন যেতে পারি?” 

“একটু বসুন। ছোটখাটো আর দু একটি বিষয়।”

ঘড়ির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে লুইসের প্রস্তাবে সম্মতি জানালো সে।

“তবে একটু তাড়াতাড়ি করুন। বাসার লোকজন আবার চিন্তায় পড়ে যাবে।” 

“আমি আসলে আমাদের থিয়োরির বাকি অংশটুকু শোনাতে চাচ্ছি।”

“ভাল। ব্যক্তিগতভাবে, আমি এটাই চাই।” 

“আপনি অ্যালেক্সকে ধর্ষণ শুরু করেছেন যখন তার বয়স ছিল দশ আর আপনার সতেরো।”

“এই ব্যাপারে তো আমরা আরো আগেই একমত হয়েছি।” 

চিন্তিত ভঙ্গিতে ক্যামিলের দিকে তাকালো টমাস। 

“ঠিক তাই, মঁসিয়ে ভ্যাসো। কিন্তু, এই ব্যাপারে আপনার কোন মন্তব্য শুনতে আমরা ইচ্ছুক না। কেননা তার মাঝে কতটুকু সত্য আর কতটুকু মিথ্যা থাকবে, তা কে জানে… 

“আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি বলে যান…” 

“প্রথমত, আপনি একজন নাবালিকাকে ধর্ষণ করেছেন। আর্টিকেল ২২২ অনুযায়ী আপনি অপরাধ করেছেন, আর এর সাজা বিশ বছরের জেল।” 

নিজের হাত তুলে লুইসকে থামিয়ে দিলো ভ্যাসো। 

“যদি কেউ মামলা করে, আর যদি তা প্রমাণিত হয়, শুধু তাহলে…”

“অবশ্যই। এটা তো নিছক অনুমান।” 

ভ্যাসোকে দেখে বেশ সন্তুষ্ট মনে হলো। 

“আর আমাদের দ্বিতীয় অনুমান হচ্ছে, আপনি আপনার বোনকে ভাড়া দিয়েছেন। অবশ্য একে বিক্রিও বলা যায়। আর পেনাল কোর্টের ২২৫ ধারা মোতাবেক, এর সাজা দশ বছরের জেল।” 

“এক মিনিট আপনি বললেন আমি ভাড়া দিয়েছি। একটু আগেই আপনাদের এক অফিসার বলেছিলো বিক্রি করেছি।” ক্যামিলের দিকে ইঙ্গিত করে বলল সে। 

“আমি ‘ভাড়া’ শব্দটা ব্যবহার করবো তাহলে।” 

“আচ্ছা। ঠিক আছে, এটা মেনে নিলাম।” 

“অন্যদের কাছে ভাড়া দিয়েছেন। প্রথমে আপনার স্কুল জীবনের পুরোনো বন্ধু প্যাসকেল, এরপর আপনার কাস্টমার (অবশ্য তা দুইদিক থেকেই) গ্যাটেনগো। গ্যাটেনগো আবার তার বন্ধু মঁসিয়ে প্র্যাডেরিকে আপনার সেবা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছিলো। আর ম্যাডাম জানেত্তির সাথে তো আপনার ভাল খাতির ছিলো। তাই তার কাছ থেকেও অনেক কাস্টমার পেয়েছেন আপনি, যার মাঝে ফেলিক্স ম্যানিয়েও ছিলো।” 

“এটা তো কোন থিয়োরি হলো না, পুরো ঘটনাই তো আপনি সাজিয়েছেন।” 

“এর কোন ভিত্তি নেই?” 

“না। একফোঁটাও না। তবে আপনার কল্পনাশক্তি আর যুক্তির প্রশংসা করতেই হয়। অ্যালেক্স বেঁচে থাকলে বোধহয় মুগ্ধ হয়ে যেতো।” 

“কিসে মুগ্ধ হত?” 

এই যে একজন মৃত মানুষের জন্য আপনি কত কী করছেন।”

“ওহ, তাই নাকি!” 

“দেখেন, ভাইজানেরা, আপনারা যত অভিযোগ এনেছেন, তার সবই আপনাদের কল্পনা। কোন প্রমাণ নেই আপনাদের কাছে। আর এরকম বিনা প্রমাণে কাউকে হয়রানি করাটাও কিন্তু আইনত দণ্ডনীয়।” 

*

টমাস বলল, আমার নাকি ছেলেটাকে পছন্দ হবে, কেননা ওর নাম নাকি ফেলিক্স, আর স্বভাবও বিড়ালের মত। ফেলিক্সের মা তাকে টাকা দিয়েছে এখানে আসার জন্য। সারাটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে ছিল সে, কিছুই বলে নি। কিন্তু মুখে লেগে ছিল উদ্ভট এক হাসি যেন আমার মাথা খেয়ে ফেলতে চায়। 

এরপর আর ফেলিক্সের ব্যাপারে কিছু লেখা নেই ডায়েরিতে। তবে আরেক জায়গায় খুব সংক্ষিপ্ত একটা লেখা পাওয়া গেল তার ব্যাপারে। 

বিড়ালটা আবারো এসেছিলো। অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো, আর এমনভাবে হাসছিলো যেন প্রথমবার করছে। কিছুক্ষণ পর আমাকে অন্যভাবে দাঁড় করায় আর খুব ব্যথা দেয়। আমি অনেক কান্না করেছি আজকে। ফেলিক্স আর টমাস আজকে খুব নারাজ হয়েছে আমার উপর। 

অ্যালেক্সের বয়স বারো, আর ফেলিক্সের ছাব্বিশ। 

*

অনেকক্ষণ ধরে এক অদ্ভুত নীরবতা তাদেরকে গ্রাস করে রইলো। 

“তো যাই হোক, আমাদের এই অনুমানের আর ছোট একটা অংশ বাকি আছে।” 

“আচ্ছা। তাহলে বলে ফেলুন। 

“এই লোকগুলোকে অ্যালেক্স কীভাবে খুঁজে বের করলো? কেননা ওর সাথে এই পাশবিক অত্যাচার হয়েছে প্রায় বিশ বছর আগে। এতোদিনে সবাই বদলেছে, আর তার পক্ষে তা মনে রাখাও সম্ভব না। প্রতিটি খুনের জন্য তার আলাদা পরিকল্পনা ছিলো, একেক জায়গায় একেক ছদ্মনাম ব্যবহার করেছে। প্রতিটি আক্রমণের সময় বেশ নিয়মানুযায়ী এগিয়েছে সে, আর সবার কাছে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করেছে। প্যাসকেলের কাছে সম্ভ্রান্ত ঘরের এক মেয়ে, আবার ফেলিক্সের কাছে আকর্ষণীয় হিসেবে। কিন্তু প্রশ্ন হলোঃ অ্যালেক্স এদের ঠিকানা কোথায় পেলো?” 

“আপনারা বলতে চাচ্ছেন যে…এই ব্যাপারে আপনাদের কোন থিয়োরি নেই?” 

“আসলে, আপনি ভুল বুঝছেন। এখানেও আমাদের থিয়োরি আছে একটা।”

“বাহ, বলে ফেলুন। আমি শুনতে আগ্রহী।” 

“আমাদের যেমনটা সন্দেহ যে আপনিই ট্র্যারিক্সের বাবাকে অ্যালেক্সের ঠিকানা দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনই অ্যালেক্সকেও বাকিদের ঠিকানা দিয়েছেন।” 

“বিশ বছর পর ওদেরকে কোথায় খুঁজে পেতে হবে, তা আমি কী করে জানবো?” 

“প্রথমত, অনেকেই তাদের আগের জায়গায় থাকে। আর কিছুক্ষেত্রে আপনি শুধু নাম দিয়ে দিয়েছেন, আর বাকি কাজ অ্যালেক্স নিজেই করেছে।”

“আর আমি এমনটা কেন করবো?” 

অধ্যায় ৫৭ 

মিসেস প্যিভো বিশ্বকে জানিয়ে দিতে চায় দারিদ্র্যকে ভয় পান না তিনি। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম হয়নি তার, তবে কষ্ট করতে জানেন। একা হাতে নিজের দুই সন্তানকে গড়ে তুলেছেন। তাই সহজে ধরা দেবার পাত্রী তিনি নন। 

সোমবার, বিকাল চারটা। 

তার ছেলের বাসায় আসার কথা পাঁচটায়। ক্যামিল অনেক ভেবেচিন্তেই সময় ভাগ করেছে, যাতে করে মা ছেলের মাঝে দেখা না হয়, কোন কথা বলা কিংবা পরামর্শের সুযোগ না পায়। 

প্রথমবার যখন তাকে মেয়ের লাশ সনাক্ত করার জন্য মর্গে আসতে বলা হয়েছিলো, তখন তিনি আসেননি। নিজের মেয়ের মৃত মুখ দেখার মত নাৰ্ভ নেই বলে অপারগতা প্রকাশ করেন। নিজের জীবনের চারপাশে এক দুর্ভেদ্য দেয়াল তুলে রেখেছেন তিনি। ভেতরে জমা হয়ে আছে সারাজীবনের দুঃখ কষ্ট। তবে আজকে তাকে আসতেই হলো। লাশ দেখার পর তার মাঝে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। ব্যাপারটা ভাবিয়ে তুললো ক্যামিলকে, যে এখন তার সামনে বসে আছে। 

“টমাস আর অ্যালেক্সের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে আপনি আসলে কী জানতেন?” 

তাকে কিছুটা বিস্মিত মনে হলো। ভাই আর বোনের মাঝে আবার কী সম্পর্ক থাকতে পারে। তবে তারা উভয়েই সত্যটা জানে। এক জন আরেকজনের মুখ থেকে শোনার অপেক্ষায় আছে। অনেকক্ষণ কিছু না বলার কারণে, ক্যামিল বিরক্ত হয়ে উঠলো। 

“কখন থেকে আপনার ছেলে অ্যালেক্সকে ধর্ষণ শুরু করে?” 

এই কথা শোনার পর হৈ চৈ শুরু করে দিলো মিসেস প্যিভো। 

দেখুন ম্যাডাম, আপনি শান্ত হোন। হৈ চৈ করে কোন ফায়দা নেই, আমাকে বোকা ভাববেন না। তার চেয়ে বরং সত্যি কথাটা বলুন, নইলে আপনার ছেলের বাকি জীবন যাতে জেলে কাটে সে ব্যবস্থা আমি করবো।” 

ছেলের ব্যাপারে হুমকিটা বেশ কাজে লাগলো। তার যা কিছু হোক, কিন্তু ছেলের গায়ে যেন একটা আঁচড়ও না পড়ে। 

“যদি এই অপরাধ সম্পর্কে আপনি অবগত থাকেন এবং জেনেও কোন ব্যবস্থা না নিয়ে থাকেন, তাহলে এই ঘৃণ্য অপরাধের সহযোগী হিসেবে আপনাকেও জেলে পুরবো আমি।” 

“টমাস কখনোই তার বোনকে স্পর্শ করেনি।” 

“আপনি কীভাবে জানলেন?” 

“আমি আমার ছেলেকে চিনি।” 

হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ক্যামিল। 

টমাস প্রতিদিন রাতে আমার বেডরুমে আসে। মামণিও জানে। 

“আর আপনার মেয়ে? ওর সম্পর্কে কতটুকু জানেন?” 

“আরো আট দশটা মা যেমন জানে তেমন।” 

“বেশ আশাব্যঞ্জক।” 

“বুঝলাম না…”

“না। কিছু না।” 

ক্যামিল কেস ফাইলটা হাতে নিলো। 

“এই যে এটা অটোপসি রিপোর্ট। মেয়ের সাথে যেহেতু আপনার সম্পর্ক ভালই ছিলো, তাহলে তো ওর ভেতরের খবরও আপনি জানতেন?” 

এখানে আসার পর থেকে একবারও চোখের পাতা ফেলেনি মিসেস প্যিভো। চেয়ারে একদম শক্ত হয়ে বসে আছে। বড় আঘাতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে। 

“ওর অবস্থা তো ভয়াবহ ছিলো, তাই না?” 

সামনের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। 

“প্যাথলজিস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী, আপনার মেয়ের যৌনাঙ্গ এবং আশেপাশের অংশে এসিড বার্নের চিহ্ন রয়েছে। সম্ভবত সালফিউরিক এসিড। ক্ষতটা বেশ গভীর আর বিস্তৃত। ক্লিটোরিস পুরোপুরি নাই হয়ে গেছে যেন খৎনা করা হয়েছিলো তার। এসিড ল্যাবিয়া মেজোরা আর ল্যাবিয়া মাইনরা গলিয়ে একদম ভ্যাজাইনা অবধি চলে গিয়েছিলো। এসিড সরাসরি ভ্যাজাইনাতে এতো পরিমাণে ঢালা হয়েছিলো যে, তা প্রায় সবকিছু শেষ করে দিয়েছে। মিউকাস মেমব্রেনগুলো একদম নষ্ট হয়ে গিয়েছে। মোটকথা, মাংসই বিলীন হয়ে গিয়ে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, এখন একটা পিশুর মত দেখা যায়।” 

ক্যামিল মিস প্যিভোর দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো। 

“প্যাথলজিস্ট এই শব্দটাই ব্যবহার করেছেঃ ‘মাংসের পিণ্ড’। আর এই সব কিছুই ঘটেছে ছোটবেলায়। এখন কিছু মনে পড়ে আপনার?” 

মিসেস প্যিভোর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে।

“আপনার মেয়ে এই ব্যাপারে কিছু বলেনি?”

“না। কখনোই না!” 

“ওহ আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আপনার মেয়ে আপনাকে বিরক্ত করতে পছন্দ করতো না। তাহলে হয়তো এমন হবে যে কেউ তার ভ্যাজাইনাতে এসিড ঢেলে দিয়েছে, আর সে লক্ষী মেয়ের মত বাসায় চলে এসেছে। কাউকে কিছুই বলেনি। বিচক্ষণতার এক অনন্য নিদর্শন।” 

“আমি কিছু জানি না।”

তার অভিব্যক্তি, মুখভঙ্গি কিছুই পরিবর্তন হলো না, শুধু কণ্ঠ ম্লান হয়ে এলো। 

“প্যাথলজিস্ট আরো একটা কৌতুহলোদ্দীপক তথ্য দিয়েছে… আপনার মেয়ের যৌনাঙ্গ বেশ ভালোভাবে আক্রান্ত হয়েছিলো। ছিদ্রটা একদম বিলীন হয়ে গিয়েছে। মোট কথা, স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক করা অসম্ভব ছিল তার জন্য। তো যা বলছিলাম, কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার… 

ক্যামিল থেমে গেল। চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রেখে, সরাসরি মিসেস প্যিভোর দিকে তাকালো। 

“…বিষয়টা হলো যে, তখন সাময়িকভাবে তার প্রস্রাবের নালীও বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এমন পরিস্থিতিতে জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়। প্যাথলজিস্টের মত পরবর্তীতে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে, মিটাস দিয়ে ক্যানুলা করে প্রস্রাবের ব্যবস্থা করা হয়।” 

নীরবতায় ছেয়ে গেল পুরো রুম। 

“এটা অবাক করার মত কিছু ছিল না। বরং কসাইয়ের মত কাজটা করেছে কেউ।” 

ঢোক গেলায় চেষ্টা করলো মিসেস প্যিভো, কিন্তু তার গলা শুকিয়ে এসেছে। 

“তো যাই হোক, প্যাথলজিস্টের কাজ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তা জানানো। আর পুলিশ অফিসারদের কাজ হচ্ছে তার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। আমার ধারণা এই কাজটা অত্যন্ত দ্রুত করা হয়েছিলো, নতুবা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হতো। আর হাসপাতালে নেয়া মানেই নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া। কে করল? কীভাবে করলো? তবে আমার মনে হয় এটা কোন পুরুষের কাজ। কেননা ক্ষতের গভীরতা এতো বেশি যে অনায়াসে বলে দেয়া যায় এটা কোণ দুর্ঘটনা ছিল না বরং কোন পশুর স্বেচ্ছায় করা অত্যাচার।” 

এখনও নিশ্চুপ হয়ে আছে মিসেস প্যিভো। 

“নার্সিং অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে আপনি কতদিন কাজ করেছেন?” 

*

টমাস ভ্যাসো মাথা নিচু করে আছে। অটোপসি রিপোর্টে পড়ে শোনানোর পুরোটা সময় নিশ্চুপ হয়ে ছিলো। এখন লুইসের দিকে তাকিয়ে আছে। 

“কিছু বলার আছে আপনার?” 

“ব্যাপারটা আসলে বেশ দুঃখজনক।”

“তার মানে আপনি সবকিছু জানতেন?” 

“ভাইয়ের কাছ থেকে কিছুই লুকাতো না অ্যালেক্স।” মুচকি হেসে বলল টমাস। 

“সেই ক্ষেত্রে তো আপনি বলতে পারবেন, কীভাবে ঘটলো এইসব?” 

“না। ও আমাকে শুধু এইটুকুই বলছিলো। এটা ওর গোপন বিষয়… আর তা ছাড়া ও বেশ ছলনাময়ীও ছিলো।” 

“তার মানে আপনি আর কিছুই বলতে পারবেন না?” 

“আমি দুঃখিত।” 

“কোন বিশেষ কিছু…?” 

“না।” 

“কিছুই না?” 

“না। তবে কেউ হয়তো ওর উপর বেশি রেগে গিয়েছিলো।” 

“কে সে? আপনি চেনেন?” 

আবারও হাসলো ভ্যাসো। 

“না। তাও জানি না।”

“তো আপনি বললেন ‘কেউ’ রাগান্বিত হয়ে গিয়েছিলো। কী কারণে হয়েছিলো?” 

“আমি তা বলতে পারবো না। আমার তাই মনে হলো।” 

এতোক্ষণ ধরে পুলিশ অফিসারদেরকে যেন পরীক্ষা করছিলো টমাস। তার বিরুদ্ধে যে শক্ত কোন প্রমাণ নেই তা বুঝতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। 

“জানেন…অ্যালেক্স মাঝে মাঝে অসহ্যকর হয়ে উঠতো।” 

“কী রকম?” 

“ও যে কতটা একগুয়ে আর বদমেজাজি তার প্রমাণ তো পেয়েই গেছেন।” 

কেউ কোন প্রতিক্রিয়া না দেখানোয় ব্যাপারটা খোলাসা করার চেষ্টা করলো সে। 

“মানে আমি বলতে চাচ্ছি, ওর মত একটা মেয়ের কিছু ব্যবহারে আপনি রাগ করতে বাধ্য হবেন। হয়তো বাবার শাসন না পাওয়ার কারণে ও এমন হয়েছিলো। একবার ‘না’ বললে, ওকে দিয়ে আর কিছুই করানো যেতো না।” 

পুরো ঘটনাটা যেন ছবির মত জীবন্ত হয়ে ভ্যাসোর সামনে চলে এসেছে। “ও এমনই ছিলো। হুট করে, বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত গোঁ ধরে বসে থাকতো।” 

“তাহলে কী এমন কিছুই ঘটেছিলো?” নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করলো লুইস।

“আমি কিছু জানি না। আমি সেখানে ছিলাম না।”

অফিসারদের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে উঠলো। 

“ওর মত জেদি মেয়েদের সাথে এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। একবার জিদ করলে, আর কিছুই মানতো না। …শেষমেশ যে কেউ ধৈর্য হারিয়ে ফেলবে।” 

গত কয়েক ঘণ্টা যাবত চুপ করে থাকা আরম্যান্ড দৃশ্যপটে হাজির হলো।

“…আমরা এখানে টুকটাক চুমুর ব্যাপারে কথা বলছি না মঁসিয়ে ভ্যাসো। আমরা পনেরো বছর বয়সি এক মেয়ের উপর বর্বর, পাশবিক অত্যাচারের ব্যাপারে কথা বলছি। যাকে মানুষরূপী পশুদের হাতে তুলে দেয়া হতো।” 

আরম্যান্ড এই ঘটনায় কতটা বিমর্ষ তা উপলদ্ধি করতে পেরেছে ক্যামিল। কথাগুলো বলার সময় তার গলা কাঁপছিল। কিন্তু, ভ্যাসো বরাবরের মতই বেশ ধীরস্থির। 

“যদি আপনাদের ‘পতিতাবৃত্তি’ থিয়োরি মেনে নিই, তাহলে আমি এটাকে ‘পেশাগত ঝুঁকি’ হিসেবে চিহ্নিত করবো।” 

“আর আপনার মা জানতো এই ব্যাপারে?”

“কোন ব্যাপারে? ওহ-আচ্ছা। না। না। অ্যালেক্স মাকে কিছুই বলেনি। নিজের ছোটখাটো সমস্যা নিয়ে মাকে বিরক্ত করতো না। এমনিতেই মা হাজারো সমস্যা জর্জরিত থাকতো।” 

“আহারে। যেহেতু আপনার মা একজন নার্স, তাই তাকে জানানো উচিৎ ছিলো। জরুরী কোন পদক্ষেপ নিতে পারতেন উনি,” বলল ক্যামিল। 

“আপনারই বা কী করার আছে? ইতিহাস তো আর নতুন করে লেখা যায় না।” ক্যামিলের দিকে তাকিয়ে বিদ্রূপাত্মক ভঙ্গিতে বলল ভ্যাসো। 

“কিন্তু যখন আপনি এইসব জানতে পারলেন, কোন মামলা করেননি?”

“কিন্তু…কার বিপক্ষে?” 

ক্যামিল শুনতে পেলো, “কিন্তু…কেন?” 

অধ্যায় ৫৮ 

সাতটা বেজে গেছে। অন্ধকার কোন দিক থেকে লুকিয়ে এসেছে তা কেউ টের পায়নি। সবকিছু কেমন জানি অবাস্তব মনে হচ্ছে। 

টমাস ভ্যাসোও এখন বেশ ক্লান্ত। নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে পারছে না যেন সারারাত ভরে জুয়া খেলেছে। আরম্যান্ড এখনো ফাইলে কী যেন খুঁজছে। লুইস ধীরস্থির হয়ে বসে আছে। ক্যামিলে উঠে দরজার কাছে গিয়ে আবার ফিরে আসলো। 

“আপনার বোন আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করতো। ওখান থেকে আলোচনা শুরু করি, কি বলেন?” 

“না। আমি দুঃখিত।” ভাবখানা এমন যে ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও করতে পারছে না। এখন তার পক্ষে সম্ভব নয়। শার্টের হাতা গুটানো শুরু করলো। “অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। আমার এখন বাসায় যেতে হবে।”

“বাসায় ফোন করে বলে দিন…”

ভ্যাসো এমনভাবে হাত নাড়ালো যেন এখানে আর এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছুক না সে। 

“দেখুন, সত্যিই আমাকে যেতে হবে…” 

“আপনার সামনে এখন দুটি পথ খোলা, মঁসিয়ে ভ্যাসো। হয় আপনি এখানে বসে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিবেন, যাতে এক থেকে দুই ঘণ্টা লাগবে অথবা…”

“অথবা…..?” জিজ্ঞেস করলো ভ্যাসো। 

“অথবা আমি আপনাকে গ্রেফতার করবো, এতে করে কমপক্ষে চব্বিশ ঘণ্টা আটকে রাখতে পারবো। সেটা আটচল্লিশ ঘণ্টাও হতে পারে, কেননা আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট আবার ভিক্টিমদের খুব পছন্দ করে।” 

চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো ভ্যাসো। 

“গ্রেফতার করবেন…কোন অভিযোগে?” 

“এটা কোন সমস্যাই না- জোরপূর্বক ধর্ষণ, অত্যাচার, অন্যায় কাজে বাধ্য করা, বর্বরতা, আরো অনেক- যেটা আপনার পছন্দ। ব্যক্তিগতভাবে আমি টস করতে পছন্দ করি না। কিন্তু আপনি চাইলে…”

“কিন্তু আপনার কাছে কোন প্রমাণ নেই। কিছুই নেই!” 

হুট করেই উত্তেজিত হয়ে পড়লো টমাস। আর সহ্য করতে পারলো না। পুলিশের লোকজন নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। 

“ফাক ইউ অল।” 

এরপর সবকিছু অত্যন্ত দ্রুত ঘটলো। নিজের জ্যাকেটটা হাতে নিয়ে কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই বের হয়ে গেল টমাস। তবে দরজায় ইউনিফর্ম পড়ে থাকা দুই পুলিশ সদস্য তাকে পথ আটকে দাঁড়ালো। 

“আমার মনে হয় আপনাকে গ্রেফতার করাটাই ভাল হবে। কী মনে হয়?” বলল ক্যামিল। 

“আমার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণই নেই আপনার হাতে। শুধু শুধু আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন, তাই না?” 

“আপনার কোন এক আত্মীয়কে ফোন করার অধিকার আছে। আর যদি অসুস্থ হন, তাহলে ডাক্তারকে।” 

“না। আমি আইনজীবীর কাছে ফোন করবো।” দৃঢ়কণ্ঠে বলল টমাস। 

অধ্যায় ৫৯ 

গ্রেফতার সম্পর্কে ম্যাজিস্ট্রেটকে জানিয়ে দিলো লা গুয়েন। আর এদিকে বাকি সব দেখার দায়িত্ব পড়লো আরম্যান্ডের কাঁধে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে হবে তাদেরকে, কেননা হাতে সময় আছে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা। 

ভ্যাসো কোন প্রতিবাদ জানালো না। এর শেষ দেখে ছাড়তে চায়। এরপর আবার নিজের স্ত্রীকেও সামাল দিতে হবে, সব দোষ এই পুলিশ কর্মকর্তাদের ঘাড়ে ফেলতে হবে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেয়ার জন্য নিজের বেল্ট আর জুতার ফিতা বিনা বাধায় খুলে দিলো টমাস। তবে আইনজীবী আসার আগে কোন কথা বলবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

স্ত্রীকেও ফোন করলো। 

“একটা জরুরী কাজ পড়ে যাওয়ার আমি আজকে আসতে পারছি না। তুমি কোন চিন্তা করো না। আমি কালই চলে আসবো।” 

কিন্তু ওপাশ থেকে মানতে না পারার সুর ভেসে এলো। 

“আমি তোমাকে বললাম না এখন আমার পক্ষে আসা সম্ভব না। যেতে হলে তুমি একাই যাও।” চিৎকার করে বলল টমাস। 

শালা হয়তো নিজের স্ত্রীকেও অত্যাচার করে, মনে মনে বলল ক্যামিল। “একবার বললাম তো, আমি কালকেই চলে আসবো।” 

ঠিক কখন যাবে তা বলল না। 

“আচ্ছা। আমি এখন রাখলাম। পরে কথা হবে।” 

ভ্যাসোর আইনজীবী আসতে আসতে এগারটা বেজে গেল। তরুণ আইনজীবী যে নিজের পেশায় বেশ দক্ষ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আধা ঘণ্টার মাঝেই ক্লায়েন্টের সাথে পরামর্শ করা, সবক্ষেত্রে বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়া সহ আরো বিভিন্ন উপদেশ দিলো, কেননা কেস ফাইল দেখা ছাড়া আর কোন কাজও নেই। 

বাসায় যেয়ে গোসল করার সিদ্ধান্ত নিলো ক্যামিল। কিছুক্ষণ পর অফিস থেকে বের হয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে নিলো। আজকে তার এতোটাই ক্লান্ত লাগছে যে, সিঁড়ি বেয়ে উঠলো না আর। 

দরজার বাইরে বাদামী কাগজে মোড়ানো একটা প্যাকেট পড়ে আছে। সে বেশ ভালোমতোই জানে এর ভেতরে কী আছে। প্যাকেট হাতে নিয়ে বাসায় ঢুকে গেল। 

মায়ের আঁকা পোর্ট্রেট দেখে কিছুটা অবাক হয়ে গেল। দাম আঠারো হাজার ইউরো। 

এটা অবশ্যই লুইসের কাজ। কেননা সকাল থেকে দুপুর দুইটা অবধি অফিসে ছিল না সে। আর আঠারো হাজার ইউরো তার কাছে কোন ব্যাপারই না। তবুও সে অস্বস্তি বোধ করছে, কেননা এমন পরিস্থিতিতে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। রেখে দিবে নাকি ফেরত দিয়ে দিবে? গোসলে যাওয়ার পরেও মাথা থেকে এই চিন্তা দূর করতে পারলো না। 

তবে, যত যাই ভাবুক না কেন মায়ের আঁকা এই ছবি ফিরে পেয়ে বেশ খুশি ক্যামিল। মায়ের অন্যান্য সবগুলো কাজের চেয়ে এটা বেশি পছন্দ ছিল তার। মায়ের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্ম বলে স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না কেউ ।

গোসল শেষে আবারো হেডকোয়ার্টারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো ক্যামিল। যাওয়ার আগে দুদুশের জন্য খাবার রেখে গেল। 

*

ক্যামিল গিয়ে দেখলো, তরুণ আইনজীবী নিজের কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছে। টমাস ভ্যাসো এখনো মেইন অফিসেই বসে আছে। বাতাস চলাচলের জন্য জানালা খুলে দিয়েছে আরম্যান্ড। 

যে কোন মানুষের সাথে প্রথমবার সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা, পুরো সম্পর্কের উপর প্রভাব বিস্তার করে। টমাস ভ্যাসোর সাথে যখন প্রথম দেখা হয়েছিলো, সেদিন থেকেই তার প্রতি ঘৃণা জন্মেছে ক্যামিলের। এই কেসের উপরেও তার সুস্পষ্ট প্রভাব বয়েছে, আর ব্যাপারটা ভিডার্ডও জানে। 

লা গুয়েন ক্যামিলকে আশ্বস্ত করলো যে ম্যাজিস্ট্রেট তার এই পদ্ধতিকে স্বাগত জানিয়েছে। ব্যাপারটা বেশ অবাক করলো তাকে। তবে এখন এক মিশ্র অনুভূতি খেলা করছে তার মাঝে। কেননা ম্যাজিস্ট্রেট যেহেতু মেনে নিয়েছে, তাই নতুন করে পরিকল্পনা সাজাতে হবে। 

আবারো জেরা শুরু করার জন্য প্রস্তুত সে। 

“শুরু করার আগে একটা কথা, আপনাদের ওই বালের থিয়োরি আর কপচাবেন না।” শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে বলল টমাস। 

সাথে সাথে নিজের কৌশল পরিবর্তন করলো ক্যামিল।

“তো, অ্যালেক্স আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করছিলো?”

কণ্ঠে চিন্তার ছাপ, যেন অন্যকিছু নিয়ে ভাবছে। 

“বলতে থাকুন,” বলল ভ্যাসো। 

“২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১৫ তারিখ আপনি অফিস থেকে লোন নেন। বাড়ি অনেক আগেই বন্ধক রেখেছেন, তাই ব্যাংক থেকে লোন পাননি। বাধ্য হয়ে নিজের বসের কাছ যান। আর মাসিক বেতন থেকে একটা অংশ কেটে রাখা হয় আপনার।”

“তো?” 

“ব্যাংক থেকে আমরা জানতে পারি আপনি ফেব্রুয়ারীর আঠারো তারিখে বিশ হাজার ইউরো ক্যাশ উত্তোলন করেন।” 

ক্যামিল চোখ বন্ধ করে নীরবতাকে উপভোগ করলো। 

“আপনার হুট করে এতো টাকার দরকার কেন হলো?”

“জুয়া খেলায় হেরে গিয়েছিলাম।” 

“আপনার বোনকে বাজি রেখে হেরে গেছেন, তাই না?” 

“না। মোটেও না। এর সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। বরং অন্য কেউ…” 

“অন্য কেউটা কে?” 

শ্বাস নেয়াটাও কষ্টকর হয়ে পড়লো ভ্যাসোর জন্য। 

“চলুন, একটু সময় বাঁচানো যাক। ওই টাকাটা অ্যালেক্সের জন্য তুলেছিলেন। কেননা হোটেল রুমে আমরা প্রায় বারো হাজার ইউরো পেয়েছি। আর এখানে সেখানে আপনার আঙুলের ছাপও পাওয়া গেছে। তাই আশা করি এই ব্যাপার অস্বীকার করে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না।”

তারা এতোদূর চলে গেছে। আর কতটুকু বাকি আছে? আর কী কী জানে? আদতে চায় কী? মনে মনে বলল ভ্যাসো। 

“আচ্ছা, মানলাম। কিন্তু আমি আবার বোনকে টাকা ধার দিয়েছি। এটা কি অবৈধ?” 

এই কথা শুনে হেসে উঠলো ক্যামিল। 

“আপনি নিজেও ভালমতো জানেন এটা অবৈধ না, তবে মিথ্যা কেন বললেন?” 

“এটা আপনার দেখার বিষয় না।” 

“আপনি এখন যে পরিস্থিতিতে আছেন, সবই আমাদের দেখার বিষয়।”

*

লা গুয়েন ফোন করেছে। ক্যামিল একটু দূরে সরে গিয়ে ফোন রিসিভ করলে কেসের অগ্রগতি কদ্দুর তা জানতে চাইলো। 

“খারাপ না। ঠিকপথেই এগুচ্ছি।” 

লা গুয়েন কোন জবাব দিলো না। 

“আর আপনার ওদিকের কী অবস্থা?” 

“আটকে রাখার সময়টা বাড়ানো খুব কষ্ট হবে। তবে কোন একটা ব্যবস্থা করে ফেলবো।” 

“তাই করুন। আর আমি এদিকটা গুছিয়ে আনছি।” 

*

“তো, আপনার বোন…”

“সৎ বোন,” শুধরে দিলো ভ্যাসো। 

“আচ্ছা, আপনার সৎ বোন। কিন্তু, এতে কী আসে যায়?” 

“অবশ্যই। দু’টো মোটেও এক বিষয় না। 

“সেই ক্ষেত্রে অ্যালেক্স বলেই ডাকি। তো যাই হোক, অ্যালেক্স আত্মহত্যা করেছে, ব্যাপারটা ঠিক মেনে নিতে পারছি না আমরা।” 

“আপনারা পারেন আর না পারেন, সেটা তো গুরুত্বপূর্ণ না। সে তাই করেছে।” 

“তা ঠিক। কিন্তু আপনি তো তাকে বেশ ভালোমতো চিনতেন। যদি সে আত্মহত্যাই করবে, তাহলে দেশ ছেড়ে পালাবে কেন?” 

ভ্যাসো কিছুই বুঝতে পারলো না। 

“আপনার বোন…ওহ সরি। মারা যাওয়ার রাতে নিজের নামে জুরিখগামী একটা প্লেনের টিকেট বুক করে সে। এমনকি একটা ট্র্যাভেল ব্যাগ কিনে তা গুছিয়েও রাখে পরের দিনের জন্য।”

“ওহ…এটা তো জানতাম না। হয়তো হুট করে নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে। জানেনই তো, ও একটু…” 

“এয়ারপোর্টের কাছেই একটা হোটেলে উঠে অ্যালেক্স। এমনকি পরের দিন সকালের জন্য একটা ট্যাক্সিও বুকিং করে রাখে, যদিও পার্কিং এ তার গাড়ি পড়ে ছিলো। এয়ারপোর্টে কোন বাড়তি ঝামেলায় না পড়ার জন্য নিজের গাড়িও নিতে চায়নি। তার একমাত্র লক্ষ্যই ছিল যত দ্রুত দেশ ছেড়ে যাওয়া যায়। নিজের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, যা অনেকদিন ধরে বয়ে বেড়িয়েছে, তাও ফেলে দিয়েছিলো যাওয়ার আগে। কোন পিছুটান রাখতে চায়নি। হয়তো জীবনটা নতুন করে শুরু করার ইচ্ছা ছিল তার। তাই ফ্রান্স ছেড়ে পালাচ্ছিলো।” 

“আপনি কী বলতে চাচ্ছেন? ওর হয়ে আমি উত্তর দিতে পারবো না। আসলে কেউই পারবে না।” 

“মানলাম, অ্যালেক্সের হয়ে আপনি জবাব দিতে পারবেন না। কিন্তু নিজের কাজের জবাব তো দিতে পারবেন।” 

“যদি আমি পারতাম…”

“অবশ্যই পারবেন। ৫ই অক্টোবর, যে রাতে অ্যালেক্স মারা যায়, সে রাতে আপনি কোথায় ছিলেন? রাত আটটা থেকে মাঝরাতের সময়টা যদি ধরি?” 

ভ্যাসো দ্বিধায় পড়ে গেল। ক্যামিল এগিয়ে এলো। 

“আমরা আপনাকে সাহায্য করবো…আরম্যান্ড?” 

“রাত ৮:৩৪ মিনিটে আপনার ফোনে একটা কল আসে এবং আপনি তখন বাসায় ছিলেন। এরপর আপনার স্ত্রীর ভাষ্যমতে, ‘টমাসের ফোনে একটা ভয়েসমেইল আসে। আমি জিজ্ঞেস করতেই বলে অফিস থেকে কল এসেছিল। কী নাকি জরুরী কাজ এখনি বের হতে হবে। তবে এমন সময় কখনোই অফিস থেকে ফোন আসে না। কিন্তু ওকে অনেক উত্তেজিত মনে হলো ফোনে কথা বলার পর।’ আপনি আনুমানিক দশটার দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে যান, আর বাসায় ফিরেন মাঝরাতের পর। আপনার স্ত্রী ঠিক সময় বলতে না পারলেও, মাঝরাতের আগে যে আসেননি এতোটুকু নিশ্চিত করেছে।” উচ্চস্বরে বলল আরম্যান্ড। 

একসাথে অনেক কিছু হজম করতে হলো ভ্যাসোকে। তার স্ত্রীকেও যে জেরা করা হয়েছে, এটা সে জানতো না, এমনকি ভাবতেও পারেনি। 

“যাই হোক, আমরা জানি, এসব কিছুই সত্যি ছিল না,” বলল আরম্যান্ড।

“এমনটা কেন বলছো, আরম্যান্ড?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল। 

“কারণ, মঁসিয়ে ভ্যাসোকে তখন ফোন করেছিলো আলেক্স। কল লিস্ট চেক করে মিলিয়েছি, ফোনটা এসেছিলো একটা হোটেল থেকে, আর ওই হোটেলেই ছিল অ্যালেক্স। এছাড়াও তার বসের সাথে যোগাযোগ করা হলে, তিনিও জানান ওই রাতে জরুরী কোন কাজই ছিল না। তিনি আরও বলেছেন যে, ‘আমরা অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালাই না যে, মাঝরাতে জরুরী কাজ পড়বে।” 

“খুবই গুরুত্বপূর্ন পয়েন্ট…” ভ্যাসোর দিকে তাকিয়ে বলল ক্যামিল। 

“অ্যালেক্সই আমাকে ভয়েসমেইল পাঠিয়েছিলো। সাড়ে এগারটায় আমাকে দেখা করতে বলে।” 

“তো, আপনি কী করলেন?” 

“আমি গেলাম দেখা করতে।” 

“এমন কি প্রায়ই দেখা করতেন?” 

“না। মোটেও না! “ 

“ও কী চাচ্ছিলো?” 

“আমাকে একটা ঠিকানা দিয়ে দেখা করতে বলেছিলো মাত্র এক ঘণ্টার জন্য।” 

“তো, আপনার কী মনে হয়, অ্যালেক্স কি চাচ্ছিলো?” 

“আমি জানি না।” 

“আসলেই? আপনি জানেন না?” 

“না। এই ব্যাপারে আমার কোন ধারণা নেই।” 

“আপনাকে মনে করিয়ে দেই, গত বছর আপনার কাছ থেকে বিশ হাজার ইউরো আদায় করে সে। নইলে তাকে যে ধর্ষণ আর পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করেছেন, তা আপনার স্ত্রী সন্তানকে বলে দেবার হুমকি দেয়।” 

“আপনাদের কাছে কোন প্রমাণ নেই!” 

ক্যামিল হাসলো। ভ্যাসো মেজাজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো। 

“শান্ত হয়ে বসুন। আরে এটা তো আমাদের থিয়োরি, আর আমি জানি আপনি আমাদের থিয়োরি কতটা ভালবাসেন।” 

“মেসেজে ও টাকার ব্যাপারে কোন কথা বলেনি। আর মাঝরাতে আমি টাকাই বা পাবো কোথায়?” 

“আমাদের ধারণা অ্যালেক্স বিদেশ যাওয়ার আগে আপনাকে টাকার ব্যবস্থা করতে বলে। তখনি ব্ল্যাকমেইল থেকে চিরতরে মুক্তির পথ খুঁজতে শুরু করেন আপনি। আমরা এই প্রসঙ্গে আবারো ফিরে আসবো। আপাতত আরেকটা বিষয়ে মনোযোগ দেই, তো আপনি মাঝরাতে বাসা থেকে বের হলেন। এরপর…” 

“ওর দেয়া ঠিকানা মত আমি যাই।” 

“কোন ঠিকানা?” 

“১৩৭, বোলেভার্ড জুভেনাল।” 

“আর এই ১৩৭, বোলেভার্ড জুভেনালে কী আছে?”

“কিছুই নেই।” 

“মানে?” 

“মানে আবার কী? আমি জানি না। ওখানে কিছুই নেই।” 

এরইমাঝে লুইস কম্পিউটারের সামনে বসে পড়েছে। ঠিকানাটা টাইপ করলো সার্চ ইঞ্জিনে। 

“আচ্ছা, আচ্ছা, আপনি ঠিকই বলেছেন; ১৩৫ এ কয়েকটা অফিস আর ১৩৯ এ একটা ড্রাই ক্লিনার্স, ১৩৭ এ বিক্রির জন্য একটা পরিত্যক্ত দোকান আছে। অ্যালেক্স কী দোকান কেনার পরিকল্পনা করছিলো নাকি?” 

“অবশ্যই না। তবে আমি জানি না ও কী চাচ্ছিলো, কেননা ওইরাতে আর আসেইনি।” 

“ওকে ফোন করার চেষ্টা করেননি?” 

“ফোন বন্ধ ছিলো।” 

“এটা সত্য কথা। কেননা সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য, নিজের ফোন আরো তিনদিন আগেই বন্ধ করে ফেলে সে। তো আপনি ওই দোকানের সামনে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন?” 

“মাঝরাত অবধি।” 

“বাহ, আপনি তো বেশ ধৈর্যশীল মানুষ। কেউ কি দেখেছিলো আপনাকে?” 

“আমার তো মনে হয় না।” 

“আহারে, বেচারা, কী দুর্ভাগ্য।” 

“সম্ভবত আপনাদের জন্য, কেননা প্রমাণ করার দায়িত্ব আপনাদের, আমার না।” 

“এটা আমার জন্য হোক আর আপনার জন্য, মোটকথা এটা দুর্ভাগ্যজনক। কেননা এর ফলে সন্দেহ আরো বাড়ে এবং পুরোটাই আপনার সাজানো বলে মনে হয়। কিছু মনে করবেন না। তো, আপনার বোন না আসার কারণে আপনি সোজা বাড়ি চলে যান।” 

ভ্যাসো কোন জবাব দিলো না। 

“বাড়ি চলে গিয়েছিলেন আপনি?” 

অনেক চিন্তা করেও বিকল্প কোন সমাধান খুঁজে পেলো না ভ্যাসো।

“না। আমি হোটেলে গিয়েছিলাম।” 

আঘাতের মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া করলো না ক্যামিল। 

“ওহ, আচ্ছা, তার মানে আপনি জানতেন অ্যালেক্স কোন হোটেলে ছিলো?” 

“না। ও আমাকে যে নাম্বার থেকে ফোন করেছিলো, সেখানে ফোন করে জেনে নিয়েছিলাম।” 

“বাহ, বেশ বুদ্ধি তো আপনার…আর?”

“তখনও কোন উত্তর পাইনি।” 

“আর তাই আপনি বাড়ির পথ ধরলেন?” 

“না। যেমনটা আমি বললাম, হোটেলে গিয়েছিলাম। দেখি সেখানে কোন রিসিপশনিস্ট নেই।”

“লুইস?” নিজের সহকর্মীর দিকে ঘুরলো ক্যামিল। 

“রিসিপশন ডেস্ক সাড়ে দশটা নাগাদ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ঢুকতে গেলে একটা কোড লাগে। আর হোটেলের গেস্টদেরকে তা দিয়ে দেয়া হয়।” 

“তার মানে, আপনি বাসায় চলে গেলেন তখন?” 

“জ্বি।” 

পাশে বসে থাকা মানুষটার দিকে তাকালো। 

“ভালো, ভালো…আরম্যান্ড, তোমাকে অসন্তুষ্ট মনে হচ্ছে? 

“মঁসিয়ে ল্যাবোল্যাংগার আর ম্যাডাম ফারিদার কিছু সাক্ষ্য আছে অবশ্য।” 

“তুমি নিশ্চিত তো?” 

“ওহ, স্যার। একটু ভুল হয়েছে, ফারিদা নামের প্রথম অংশ। পুরো নাম ফারিদা সার্তোই।” 

“মাফ করবেন, আমার সহকর্মীর আবার বিদেশিদের নাম উচ্চারণে একটু সমস্যা হয়। এই মানুষ দু’জন…” 

“…হোটেলে ছিলো। তারা সোয়া বারোটায় হোটেলে ফিরে আসে,” বলল আরম্যান্ড। 

“আচ্ছা, আচ্ছা, মানলাম,” চিৎকার কিরে বলল ভ্যাসো। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *