অধ্যায় ৩০
তার শরীর যেন আবারো প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। ক্ষতগুলো এখন অনেকটা শুকিয়ে গিয়েছে, কালশিটে দাগগুলোও দূর হচ্ছে।
মিস গুনাডের সন্দেহ দূর করার জন্য তার বাসায় গিয়ে বলে এসেছে, “আসলে হুট করেই মা অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলো তো। আর আপনি তো জানেন আমি আমার পরিবারের সবাইকে কত ভালোবাসি। আমার বয়স কম হতে পারে, কিন্তু দায়িত্ববোধ আমার ঠিকই আছে।”
“এতসব তো আমি জানি না। দেখি কী করা যায়…”
টাকার মর্ম বেশ ভালোমতোই বোঝে মিস গুনাডে। আগে দোকানদারী করতো। অ্যালেক্স যখন দু’মাসের ভাড়া অগ্রিম দিতে চাইলো, তখন কিছুটা নরম হয়ে মিস গুনাড়ে বলল, “না, ঠিক আছে। ব্যাপারটা আমি বুঝতে পেরেছি। এর আগে যদি কোন ভাড়াটিয়া আসে, তাহলে তোমার টাকা আমি ফেরত দিয়ে দিবো।”
অগ্রিম ভাড়া আর একটা ভুয়া ঠিকানা দিলো অ্যালেক্স। যদি কখনো তাকে না পেয়ে চিঠি লিখে মিস গুনাডে, সে ব্যবস্থাও করে রেখেছে সে। কেননা চিঠির সাথে একটা চেক পেলে, চিঠির কথা আর মনেই থাকবে না তার। টাকা হাতে পাওয়াটাই তার মূল উদ্দেশ্য, তা জানা আছে তার।
“আর আমার জিনিসপত্র।”
“ওসব নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আশা করি সব ঠিকঠাক মতই আছে,” বলে অ্যালেক্সকে আশ্বস্ত করলো মিস গুনাডে। কেননা সে বেশ ভালোমতোই জানে, এই ভাড়াটিয়া টাকা নিয়ে কোন ঝামেলা দিবে না।
আর নিজের গাড়িটাও আরেক জায়গায় রাখে সে। ছয় বছর পুরোনো একটা রেনো ক্লিও গাড়ি, খুব শখ করে কিনেছিলো।
জিনিসপত্র গুছিয়ে বাক্সে ভরে বেসমেন্ট এ নিয়ে আসলো। বারোটার মত বাক্স লেগেছে জিনিসপত্র নিতে; একটা খাবার টেবিল, তিনটা বুককেস আর বিছানা। সে নিজেও জানে না কেন এই জিনিসগুলোর প্রতি মায়া কাটে না তার, এগুলো ফেলে দিয়ে নতুন কিছু কিনতেও পারে না। তবে নিজের বিছানার প্রতি একটা আলাদা মায়া জন্মানোর কারণ আছে। ছোটবেলা থেকেই এই বিছানায় ঘুমিয়েছে সে, কত শত স্মৃতি একে ঘিরে। ছোট একটা রুমে দুই ঘন মিটার জায়গায় আবদ্ধ ছিল তার জীবন। তাই এই বিছানাকে ছাড়তে পারে না। যদিও মালপত্র সরাতে আসা লোকদের মতে এই আয়তন তিন ঘনমিটার। তবে, এতে তার কিছু যায় আসে না। একটা সাদা ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে বাইরে, জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য। তার সাথে দরদাম মিটিয়ে নিলো তারা। কোন পিছুটান না রেখে, এখান থেকে চলে যেতে চায় সে। তার মা সবসময় বলতো, “তোর উচিৎ সব কাজ আগের দিন করে রাখা। কেননা তুই সময়মত কাজ গোছাতে পারিস না।” যখন তার মুড ভাল থাকে তখন বলে, “আর তোর ভাইয়ের কথা আর কী বলবো…” এইসব ক্ষেত্রে ভাইয়ের কাছে সে অনেকটাই মলিন।
শত ক্লান্তি উপেক্ষা করে, প্যাকিং শেষ করলো। প্যাকিং এর সময় অনেক জিনিস ফেলেও দিয়েছে। স্থান পরিবর্তনের সময় কিছু বই ফেলে দেয় সে। এর আগের জায়গা থেকে আসার সময় ক্যারেন রিক্সেন আর ই.এম.ফস্টার এর সব বই রেখে এসেছিলো। তার আগে স্টেফান উইগ আর পিরানডেল্লোর বই। একজন লেখকের কোন বই পছন্দ হলে, সেই লেখকের সব বই যোগাড় করে পড়া তার অভ্যাস। কিন্তু একবার পড়া শেষ হয়ে গেলে, তা ফেলে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না।
বাক্স ঘাটাঘাটি শেষ হলে, বাকিটা সময় মেঝেতে ম্যাট্রেস বিছানো অবস্থায় শুয়ে কাটায়। দুইটা বাক্সের উপর বড় করে লেখা ‘ব্যক্তিগত’। এর ভেতরে থাকা জিনিসগুলো খুব হাস্যকর আর অদরকারী মনে হলেও, এই জিনিসগুলোর মূল্য তার কাছে অসীম। তাইতো, কাউকে ধরতে দেয় না এই বাক্সগুলো। বাক্সের ভেতর আছে একটা এক্সারসাইজ বুক, রিপোর্ট কার্ড, চিঠি, পোস্টকার্ড আর একটা ডায়েরি। খুব বেশিদিন ধরে ডাইরি লেখার অভ্যাস নেই তার। বারো তেরো বছর সময়ে যখন একা কাটাতে হতো, তখন ডায়েরি লিখেই সময় পার করতো। নিজের লেখা পড়ে মনের অজান্তেই হেসে ওঠে সে। কত দুষ্টুমিতে ভরপুর ছিল এই জীবন। এছাড়াও আছে পুরাতন জুয়েলারী, শুকিয়ে যাওয়া ফাউন্টেন পেন, চুলের ক্লিপ আর মা-ভাইয়ের সঙ্গে তোলা ছবি। পুরোনো মুভি টিকেট, বইয়ের ছেঁড়া পাতা, এইসব জিনিসও যে একজন মানুষ সংগ্রহে রাখতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস হবে না। একদিন হয়তো সবই ফেলে দিবে…কিন্তু আপাতত এক সাইডে রেখে দিলো।
সবকিছু গোছানোর পর অ্যালেক্স মুভি দেখতে বের হলো। এরপর ডিনার সেরে, এসিড কিনতে চলে গেল। এসিড নিয়ে কাজ করার সময় একটা মাস্ক আর প্রটেকটিভ গগলস পড়ে নেয় সে। এছাড়াও ফ্যানটা ছেড়ে, জানালা পুরোপুরি খুলে দেয় যাতে করে ধোঁয়া জমতে না পারে। এসিডের ঘনমাত্রা আশি শতাংশ করার জন্য প্রথমে হালকা তাপ দিতে হবে, যতক্ষণ না দ্রবণ থেকে ধোঁয়া বের হয়। এরপর আধা লিটার করে মোট বারোটা বোতলে জমা করে রাখলো এই এসিড। বোতলগুলো মরিচা এবং ক্ষয়রোধী প্লাস্টিকে তৈরি, যা আগেই কিনে রেখেছিলো। দুটো নিজের কাছে রেখে বাকিগুলো একটা ব্যাগে ভরে রাখে।
রাতে আবারো তার পায়ে খিঁচুনি উঠলে একটা ঝাঁকি দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো, যেন কেবলই একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছে। আজকাল এমন প্রায়ই হচ্ছে- কিছু স্বপ্নে দেখে ইঁদুরগুলো তাকে জীবিত অবস্থায় খেয়ে ফেলছে, আবার ট্র্যারিক্স তার মাথায় ইলেকট্রিক ড্রিল দিয়ে ফুটো করছে। ট্র্যারিক্সের ছেলের স্মৃতিও তাকে তাড়া করে বেড়ায়। প্যাসকেলের মুখ দিয়ে ইঁদুর বেরিয়ে আসছে, এমন নানা ধরনের দুঃস্বপ্ন। মাঝে মাঝে কিছু বাস্তব দৃশ্যও চলে আসে- প্যাসকেল ট্র্যারিক্স বাগানে একটা চেয়ারে বসে আছে। আস্তে আস্তে করে প্যাসকেলের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে শাবলটা উঁচু করতেই বুকে টান লাগে। এরপর শাবলটা নামানোর আগেই প্যাসকেলের চোখ চলে যায় তার স্তনের দিকে। কিছুক্ষণের মাঝে হাত দিয়ে দলাইমলাই শুরু করে এবং একসময় জামার ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে দেয়। অ্যালেক্স কোনো বাঁধা দেয় না। উত্তেজনায় যখন জোরে চাপ দিতে শুরু করে, তখন কষে একটা থাপ্পর মারে স্কুল টিচারের মত। কিন্তু বাস্তবে নিজের সবটুকু শক্তি ব্যবহার করে শাবল দিয়ে আঘাত করেছিলো মাথার পেছন দিকে। আঘাতের শব্দ স্বপ্নে যতটা হয়েছে, বাস্তবে তার চেয়ে কম হয়নি। হাত থেকে কাঁধের দিকে একটা শিহরণ বয়ে গেল তার। বাড়ি খাওয়ার পর বিস্মিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিল অর্ধচেতন প্যাসকেল, যেন বিশ্বাসই হতে চাইছিলো না। বিস্ময় আরো বাড়ানোর জন্য পরপর সাতটা আঘাত করলো অ্যালেক্স, ফলে মাটিতে পড়ে গেল সে। পরের দৃশ্যটুকু আর স্বপ্নে আসে না। এরপর তাকে শক্ত করে বেঁধে গলা দিয়ে এসিড ঢেলে দেয় সে, কিন্তু প্যাসকেলের মরণ চিৎকারে সব প্রতিবেশি জেগে ওঠার দশা হয়। তাই নিজেকে বাঁচাতে শাবল দিয়ে মুখে আরো আঘাত করতে থাকে, যতক্ষণ না জ্ঞান হারায় প্যাসকেল। অতঃপর বাকি এসিড টুকুও ঢেলে দেয় তার মুখে। এভাবেই শেষ হয় প্যাসকেল ট্র্যারক্সের জীবন।
*
শেষমেশ মালপত্র সরানোর কাজে নিয়োজিত লোক এলো। দেখতে বেশ বড়সড়, তবে নিজের ঢোল নিজে পেটানো ধরনের লোক। তার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করল, কিন্তু কোন লাভ হলো না। এদেরকে বেশ ভালমতোই চেনে সে।
নিজের পছন্দের রেস্টুরেন্টে যাবার জন্য মনস্থির করলো অ্যালেক্স। ট্রেনের টিকেট কেটে তাতে চড়ে বসলো। আজকে গেলে হয়তো ওই ছেলেকে পাওয়া যাবে। প্রতি সপ্তাহে ওরা আড্ডাবাজি করতে বের হয়। যদিও সবসময় একই রেস্টুরেন্টে বসবে এটা আশা করা মোটেও ঠিক না।
কিন্তু দেখা গেল, ভাগ্যদেবী তার প্রতি বেশ সদয়। আজকেও একই জায়গায় আছে ওই ছেলে। বরং ওইদিনের চেয়ে আজকে আরো বেশি বন্ধুবান্ধব দিয়ে ঘিরে আছে। মালিককে দেখে খুব একটা খুশি মনে হলো না, কেননা সাতজন মিলে এতো শব্দ করছে, যা অন্যান্য লোকজনের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লালচুলো অ্যালেক্সকে দেখে ওয়েটার আর মালিক দু’জনকেই বেশ খুশি মনে হলো। নিজের টেবিল থেকে ওই ছেলেটাকে দেখা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে তার জন্য। তবুও নিজের জায়গা পরিবর্তন করে না সে, বরং তাদের মাঝে দৃষ্টি বিনিময় হয় একবার। মুচকি একটা হাসি দেয় সে। বেশ কয়েকটা খাবারের অর্ডার করে বসে থাকে। এরইমাঝে অত্যধিক শব্দের জন্য মালিক তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করল। এমনকি একটা ড্রিংক্সও অফার করল তাকে। ভদ্রতার সাথে ধন্যবাদ জানিয়ে তাকে মানা করে দিলো। কিছুসময় বসে থেকে উঠে গেল ওখান থেকে। নিজের বই রেখে গেল টেবিলের উপরে। আবার তা নিতে আসার সময় দেখলো, ছেলেটা আর এখন তার বন্ধুদের সাথে নেই। এদিকেই এগিয়ে আসছে। বন্ধুর হঠাৎ উঠে যাওয়ার ঘটনায় বাকিরা এই ব্যাপার নিয়ে হাসাহাসি করতে থাকলো। ছেলেটা এখন ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে, এখন তার পাছার দিকে ছেলেটার দৃষ্টি নিবদ্ধ। একটু হাঁটার পরেই ছেলেটা তার পাশাপাশি চলে এলো।
“হাই,” বলল ছেলেটা। ছেলেটার চোখেমুখে কিছু একটা আছে যা তার দৃষ্টি কাড়লো।
“ফেলিক্স,” নিজের পুরো নাম বলল না। ছেলেটার হাতের দিকে তাকাতেই দেখলো হাতে কোন ওয়েডিং রিং নেই। তবে আঙ্গুলে সাদা দাগ পড়ে গিয়েছে। হয়তো কিছুদিন আগেই খুলে ফেলেছে।
“আপনার নাম কী?”
“জুলিয়া,” বলল অ্যালেক্স।
“বাহ, বেশ সুন্দর নাম তো।”
এই কৌশলগুলোর সাথে বেশ ভালোমতোই পরিচিত সে। তাই কিছু না বলে, মুচকি হাসি দিলো।
বারের দিকে আঙুল তাক করে ছেলেটা বলল, “আমরা একটু বেশিই হৈ চৈ করছিলাম তখন…
“হ্যা, একটু বেশি…”
“আসলে অনেকদিন পর সবাই একসাথে হয়েছি তো তাই আর কী…
অ্যালেক্স কোন জবাব দিলো না, এভাবে কথা বলতে বলতে একসময় একাই থেমে যাবে ছেলেটা তা বেশ ভালোমতোই জানে। পরিচিত একটা বারে ড্রিংক করার অফার করলো তাকে।
“ধন্যবাদ। কিন্তু আমার এখন সময় হবে না,” হেসে বলল সে।
আবার একসাথে হাঁটছে তারা। ইচ্ছা করেই একটু আস্তে আস্তে হাঁটছে সে, ছেলেটাকে আরো ভালোমতো দেখার জন্য। গায়ে সস্তাদরের জামাকাপড়, আর বোতামগুলো যেন ছিঁড়ে আসতে চাইছে, তার যে আরো এক সাইজ বড় জামা পড়া উচিৎ তা বলার মত কেউ নেই। অথবা ডায়েট কন্ট্রোল করে নিজের স্বাস্থ্য আরেকটু কমানো দরকার।
“প্লিজ, চলুন না। বিশ মিনিটের বেশি এক মিনিটও লাগবে না।” আকুতি করে বলল ছেলেটা।
সে আরো বলল জায়গাটা খুব কাছেই, যেতে বেশি সময় লাগবো না। কিন্তু আবারও না করে দিলো অ্যালেক্স। আজকে মুড নেই বলে সাফ জানিয়ে দিলো। ছেলেটার গাড়ির কাছে পৌঁছে গেল তারা, একটা অডি গাড়ি, নানা ধরনের জিনিসপরে ভরা।
“আপনি কী কাজ করেন?” জিজ্ঞেস করলো অ্যালেক্স।
“টেকনিক্যাল মেইনটেনেন্স অপারেটিভ”
“মেরামতের কাজ করেন।”
“স্ক্যানার, প্রিন্টার, হার্ড ড্রাইভ…” ব্যাখ্যা করলো সে। নিজের কাজের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করলো। “আসলে আমাদের একটা গ্রুপ আছে…”
একটু পরেই বুঝতে পারলো বোকার মত একটা কাজ করে ফেলেছে। এইসব কথাবার্তায় মেয়েরা বিরক্ত ছাড়া আর কিছুই হয় না।
গাড়ির দরজা খোলার সাথে সাথেই সিগারেটের ধোঁয়ার তীব্র গন্ধ নাকে গেল তার।
“আপনি স্মোক করেন?”
এটাই তার কৌশল। একদম নরম জায়গায় আঘাত করে সে।
“মাঝে মাঝে…” একটু বিব্রত হয়ে বলল ছেলেটা।
ছেলেটা লম্বায় ছয় ফুট, চওড়া কাধ, হালকা বাদামী চুল, কালো চোখের মণি। পাশাপাশি হাটার সময় খেয়াল করলো ছেলেটার পা অস্বাভাবিক রকমের মোটা।
“আসলে বন্ধুদের সাথে বের হলে টুকটাক স্মোক করি,” ভদ্র সাজার চেষ্টা করলো সে।
আদতে সিগারেটের জন্য এখন যে কোন ত্যাগ করতে প্রস্তুত সে। অ্যালেক্সের প্রতি আলাদা আকর্ষণ বোধ করছে, এক মুহূর্তের জন্য চোখ সরাতে পারছে না। তীব্র যৌনক্ষুধার কারণে একবারও তার বুক আর পাছা ছাড়া অন্য কিছুর দিকে তাকায়নি। সে কী পরে আছে তাও বলতে পারবে না। তার ভাবভঙ্গিমা এমন যে, সে যদি তার সাথে বিছানায় না যায়, তাহলে এক্ষুণি বাসায় গিয়ে, হান্টিং রাইফেল দিয়ে পরিবারের সবাইকে খুন করবে।
“আপনি কি বিবাহিত?”
“না। ডিভোর্সড। আসলে আমরা আলাদা থাকি।”
“আর আপনি?”
“আমি অবিবাহিত।”
সত্য কথার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তাতে আত্মবিশ্বাসের সুর স্পষ্ট থাকে।
এই কথা শোনার পর চোখ নামিয়ে নিলো ছেলেটা। বিব্রতবোধ করে কিংবা ভদ্রতার খাতিরে নয়- আসলে এখন স্তনের দিকে তাকিয়ে আছে সে। অ্যালেক্স যাই পড়ে থাকুক না কেন, সবার চোখ আগে ওই সুডৌল স্তনের দিকেই যায়।
মুচকি হেসে ছেলেটার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় বলল, “অন্য কোন দিন…”
এই কথা শোনার পর যেন নতুন করে আশার সঞ্চার হল ছেলেটার মনে, উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কবে? কবে?”
কোন জবাব দিলো না অ্যালেক্স। এমন সময় একটা ট্যাক্সিকে আসতে দেখে ডাক দিলো। তার সামনে এসে থামলো। দরজা খুলে ভেতরে ঢোকার পর, ভিজিটিং কার্ড বাড়িয়ে দিলো ছেলেটা। ভিজিটিং কার্ডটা বেশ পুরোনো আর দুমড়েমুচড়ে আছে। ব্যাগের এক কোণায় ঠেলে দিলো কার্ডটা! ট্যাক্সি ছাড়ার পর রিয়ার ভিউ মিররে দেখলো, সে এখন রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে।
অধ্যায় ৩১
“আপনি থাকলেই বরং ভাল হবে। আপনি থাকুন,” বলল ক্যামিল।
জাতীয় পুলিশ ফোর্স আর জঁদামেরির স্থানীয় পুলিশের মাঝে সম্পর্কটা সবসময়ই একটু শীতল। এদের মাঝে সমন্বয়ের খুব অভাব। কিন্তু এই ক্ষেত্রে ক্যামিল একটু আলাদা। স্থানীয় পুলিশদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়। আর এ জন্যে তারাও বেশ আন্তরিক ক্যামিলের প্রতি। তারা সবসময় নিজেদের প্রাপ্য সম্মানটুকু চায়, কাজের স্বীকৃতি চায়। তদন্তের ক্ষেত্রে তারাও যে কম যায় না, এটা প্রমাণের জন্য দুর্বল সূত্র নিয়েও কাজ করতে প্রস্তুত। তার এই ধরণের স্তুতিতে একদম গলে গেল চিফ সার্জেন্ট। চল্লিশ বছর বয়সি মানুষটার গোঁফ যেন পেন্সিল দিয়ে আঁকা। নিজের পদবী এবং কাজ সম্পর্কে বেশ সচেতন। এক দেখাতেই তাকে বুদ্ধিমান বলে মনে হলো ক্যামিলের কাছে।
রাস্তার পাশেই গাড়ি পার্ক করলো চিফ ল্যাংলয়। একইসাথে নেমে পড়লো ক্যামিল।
বারে ঢোকার সাথে সাথেই স্যুপ, ওয়াইন আর ডিটারজেন্টের গন্ধ বাড়ি খেল নাকে। গন্ধ নিয়ে হাইপারসেনসেটিভ হয়ে উঠলো কিনা এই নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেল সে। এর আগেও মিসেস জরিস এর গা থেকে ভ্যানিলার গন্ধ…
স্টেফান ম্যাকিয়াক মারা যায় ২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে। কিছুদিনের মাঝেই আরেকজন কিনে নেয় এই বার।
“আসলে আমি জানুয়ারি মাসে এর মালিকানা পাই।”
লোকটা নিজেও তেমন কিছু জানে না ম্যাকিয়াক এর ব্যাপারে, যা জানে তা আশেপাশের লোকজনের কাছে শোনা। ম্যাকিয়াক মারা যাওয়ার পর এই বারের মালিকানা নিবে কিনা এই নিয়েও কিছুটা দ্বিধায় ছিলো। কেননা ম্যাকিয়াকের মৃত্যুর ঘটনা বেশ সারা ফেলে এই এলাকায়। চুরি, ছিনতাই, অপহরণ কিংবা হত্যা এমন ঘটনা এখানে প্রায়ই ঘটে, কিন্তু তার মতো বিভৎসতার শিকার কেউই হয়নি। আসলে ক্যামিল এখানে শুনতে আসেনি । আসার মূল উদ্দেশ্য হলো জায়গাটা দেখা, ঘটনা কীভাবে ঘটেছিলো সে সম্পর্কে ধারণা নেয়া, নিজের ধারণাগুলোকে ঝালাই করা। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল সাতান্ন, ব্যবহারও খারাপ ছিল না। আকারে বেশ বড় হলেও, প্রচুর মদপান করতো। জীবনটা বেশ এলোমেলো ছিলো। কাজের বাইরে তার জীবন সম্পর্কে তেমন কিছু কেউ জানে না। আর সেক্সের কথায় আসলে, পাশেই থাকা জার্মেইন ম্যালিনিয়ার আর তার মেয়েদের ওখানে যেতো, যারা ‘ফোর চিকস’ নামে পরিচিত। তবে ওখানেও কোন ঝামেলা করার রেকর্ড নেই তার।
“টাকা পয়সাও সব ঠিকঠাক মতো ছিলো।”
“ঘটনাটা নভেম্বরের এক রাতের…” বলা শুরু করলো চিফ ল্যাংলয়। এরইমাঝে নতুন মালিকের অফার করা বিয়ার প্রত্যাখান করে তারা বাইরে চলে এসেছে। হাঁটার সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ স্মরণে নির্মিত এক মেমোরিয়ালের পাশ দিয়ে গেল। “নভেম্বরের আটাশ তারিখ। রাত দশটার দিকে বার বন্ধ করে, শাটার নামিয়ে দেয়। এরপর বাসায় গিয়ে নিজের জন্য কিছু খাবার বানাতে শুরু করে কিচেনে, হয়তো টিভি দেখতে দেখতে খাবে বলে ঠিক করেছিলো। কিন্তু সেই রাতে আর খাওয়া হয় নি তার, আদতে সুযোগ পায়নি। খাবার তৈরি হচ্ছে এমন সময় কেউ এসেছিলো বলে আমাদের ধারণা। পেছনের দরজা খুলে কাউকে নিয়ে আসে, বাকি সময় একা ছিল না। কেউ জানে না কে এসেছিলো কিংবা কী হয়েছিলো সেদিন। তবে ফরেনসিক বিভাগের রিপোর্ট অনুসারে, তার মাথায় পেছনে হাতুড়ি দিয়ে অনেক জোরে আঘাত করা হয়েছিলো। মারাত্মক জখমের কারণে প্রায় অর্ধচেতন হয়ে পড়া ম্যাকিয়াককে টাওয়াল দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হয়। এরপর গ্যারেজে থাকা তার ভ্যানের ব্যাটারির এসিড এনে মুখে ঢেলে দেয় অজ্ঞাত খুনি। এরপরেই সব শেষ হয়ে যায়। সে বিদায় নেয় এই পৃথিবী থেকে। পকেটে থাকা সাতাশ ইউরো আর সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে দুইহাজার ইউরো নিয়ে ভাগে ঐ খুনি। এরপর যেন ভোজবাজির মত গায়েব হয়ে যায়। কেউ তাকে দেখেনি, এমনকি হাতের ছাপ যাতে না পাওয়া যায় এর জন্য এসিডের কন্টেইনারও সাথে নিয়ে যায় খুনি।
“কোন মহিলার সম্পৃক্ততা আছে?”
“একজনের কথা আমরা শুনেছি, কিন্তু এই কেসে জড়িত কিনা তা এখনো জানি না।”
“আচ্ছা, আপনার কী মনে হয়, কীভাবে ঘটতে পারে? দশটার সময় বার বন্ধ করে দিয়ে…”
“আসলে সময়টা নয়টা পয়তাল্লিশ,” ক্যামিলকে শুধরে দিলো ল্যাংলয়।
“এতে খুব বেশি কিছু পরিবর্তন হবে না।”
চিফ ল্যাংলয়ের মুখের ভাবখানা এমন যেন সবকিছুই উল্টে যাবে এর জন্য।
“আশা করি আপনি ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। বার মালিকেরা তো চাইবেন অনুমোদিত সময়ের বাইরে একটু বেশি রাত অবধি খোলা রাখতে। কিন্তু সে তা করেনি। আগেভাগে বন্ধ করে দেয়াটা একটু অস্বাভাবিক।”
তবে ঘটনা এখানে একটু মোড় নিবে। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় একটা মেয়ে আসে ওই বারে। আগে কেউ দেখেনি তাকে। তবে যারা ওখানে ছিল তাদের বেশিরভাগই দুপুর থেকে ওই বারে অবস্থান করছিলো, আর আকণ্ঠ মদ পান করে নেশার বুদ হয়ে ছিলো। মদের নেশা যে কতটুকু ছিলো, তা তাদের কথাবার্তাতে প্রমাণিত হয়, কেউ কেউ বলেছে মেয়েটা বয়সে তরুণী ছিলো, কেউ বলেছে বয়স্ক, আবার কেউ বলছে মোটা, কেউ বলেছে খাটো ছিলো। এমন আরো নানা ধরনের মতামত। তবে কেউই চেহারা দেখেনি। বারে আসার পর থেকেই মেয়েটা নাকি বেশ ভাব জমিয়ে ফেলে ম্যাকিয়াকের সাথে। আর ওইদিনই সে ক্লান্তির কথা বলে আগেভাগেই বন্ধ করে দেয় বার। এরপর আর কেউ দেখেনি মেয়েটাকে, তার কোন খোঁজও পাওয়া যায় নি।
“সার্চ এড়িয়া আরো বাড়ানো উচিৎ ছিল আমাদের,” লোকবলের অভাবের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠলো তার কথায়।
এতোটুকু নিশ্চিত যে ওইদিন একটা নতুন মেয়ের আগমন ঘটেছিলো। কিন্তু এর বাইরে…
“আপনি কিছু বলতে চাচ্ছেন, চিফ?”
“দেখুন…”
এই কথা শোনার পরেই ক্যামিল ঘুরে দাড়াল। ল্যাংলয়ের জবাবের অপেক্ষায় আছে।
“দেখুন, এসিড ঢেলে মুখের কথা বের করার ব্যাপারটায় আমার একটু খটকা লাগছে। যদি চিরজীবনের জন্য মুখ বন্ধ করতে চাইতো তাহলে আলাদা কথা, কিন্তু কথা বলানোর জন্য এসিড ঢালা…”
“ব্যাপারটা আমিও ভেবেছি। আপাত দৃষ্টিতে এটাকে কোন ছিঁচকে চোরের কাজ বলে মনে হয়। কিন্তু, ম্যাকিয়াক যেহেতু পেছনের দরজা খুলে দিয়েছে-তার মানে মানুষটা তার পরিচিত হওয়ার সম্ভাবনা কম–বড় জোর মানুষটা তাকে দরজা খুলতে মানাতে পারে, কিন্তু এটাও ঘটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তার মানে অবশ্যই এটা কোন ছিঁচকে চোরের কাজ। ম্যাকিয়াক যখনই দরজা খুলে দেয়, তখনি তার মাথায় আঘাত করে অর্ধচেতন করে ফেলে। এরপর বেঁধে গলা দিয়ে এসিড ঢেলে দেয়। আর এটাই পুলিশের রিপোর্টের সাথে মিলে যায়।
“কিন্তু যেহেতু আপনি বিশ্বাস করেন না, টাকা পয়সা কোথায় লুকানো আছে, এই কথা বের করার জন্য মুখে এসিড ঢালা হয়েছে, তখন এই থিয়োরি সম্পূর্ণ বদলে যায়…”
মেমোরিয়ালের ওখান থেকে আবারো হাঁটা শুরু করলো তারা। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা গায়ে লাগার সাথে সাথেই ক্যামিল নিজের হ্যাট একটু নিচু করে দিলো, আর কোটের বোতামগুলো লাগিয়ে দিলো।
“আমার মাথায় আরেকটা চিন্তা এসেছে। আমি জানি না কেন এসিড ঢালা হলো, তবে আমার মনে হয় এর সাথে চুরির কোন সম্পর্ক নেই। যখন চোরেরা খুন করে, তখন তারা এতো ঝামেলায় যায় না। প্রথমে হত্যা করে, এরপর জিনিসপত্র নিয়ে ভেগে যায়-একদম সোজাসাপ্টা পথ। আর কিছু দুর্বৃত্ত আছে যারা অত্যাচার করলেও প্রচলিত পদ্ধতি অনুসরণ করে। কিন্তু এসিড…
“তাহলে আপনার কী মনে হয়, এসিড কেন ব্যবহার করা হয়েছিলো?” ল্যাংলয়কে কিছুটা চিন্তিত মনে হলো। একটু পরেই নিজের সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেল সে।
“আমার মনে হয় এটা কোন ধরনের রিচুয়াল। মানে আমি বলতে চাচ্ছি…”
ক্যামিল ভালোমতোই জানে সে কি বলতে চাচ্ছে।
“কোন ধরনের রিচুয়াল?”
“সেক্সুয়াল।”
পাশাপাশি দুজন বসে আছে। তুমুল বৃষ্টিতে সবকিছু ভেসে যাচ্ছে। ক্যামিল তাকে বাকি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে অবগত করলোঃ বার্নাড গ্যাটেনগো, ১৩ মার্চ, ২০০৫; ম্যাকিয়াক, ২৮ নভেম্বর, ২০০৫; প্যাসকেল ট্র্যারিক্স, ১৪ জুলাই, ২০০৬।
নড করলো ল্যাংলয়।
“এদের সবার মাঝে একমাত্র মিল হলো সবাই পুরুষ।”
এটা ক্যামিল আরো আগেই ভেবেছে। খুনের পেছনে একটা রিচুয়াল কাজ করছে। মেয়েটা পুরুষদের ধোঁকা দেয়, তাদেরকে প্রলুব্ধ করে, নিজের শরীরের প্রতি তাদের কামনা জাগায়। আর নিজের শিকারি বেছে বেছে পছন্দ করে। এরপর একদিন সুযোগ বুঝে তাদের গলায় এসিড ঢেলে দেয়। কিন্তু এসিডই কেন তা এখনো জানে না সে, হত্যাকারীকে ধরার পর তা জানা যাবে।
“প্রতি ছয়মাসে একজনকে হত্যা করে খুনি। কিন্তু খুনের এলাকা তো অনেক দূরে দূরে,” বলল ল্যাংলয়।
ক্যামিলও এই ব্যাপারে একমত তার সাথে। কিন্তু কোন ভিক্টিমের মাঝেই নূন্যতম সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় মিঃ গ্যাটেনগো, টেমসের এক গ্যারেজ মালিক; ম্যাকিয়াক, একটা বারের মালিক; প্যাসকেল ট্র্যারিক্স, প্যারিসের এক বেকার যুবক। কিন্তু সবাইকে একই উপায়ে হত্যা করা হয়েছে।
“আমরা এখনো জানি না মেয়েটা কে। তবে এতোটুকু ঠিকই বোঝা যাচ্ছে, কোন পুরুষের উচিৎ না তার পথ মাড়ানো।” ক্যামিলের কণ্ঠে উদ্বেগের সুর।
অধ্যায় ৩২
পৌঁছানোর পর চোখের সামনে পড়া প্রথম হোটেলে ঢুকে পড়লো অ্যালেক্স। সারারাত একফোঁটা ঘুম হয়নি তার। ট্রেনের কোলাহল একসময় থামলেও, দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়া করে বেরিয়েছে। কালো, মোটা ইঁদুরটা তার মুখের উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে, একটু পর পর গন্ধ শুঁকছে। মুখ থেকে লালা পড়ছে, ধারালো দাঁতও দেখা যাচ্ছে। এই ছিল তার শেষ স্বপ্ন
পরেরদিন সকালে, নিজের পছন্দসই জায়গা খুঁজে পেলো সে। তার পছন্দের একটা হোটেল। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো ওখানে রুম খালি আছে আর ভাড়াও তার সাধ্যের মাঝে। হোটেল বেশ সুন্দর, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, আর শহর থেকে বেশি দূরে নয়। শহরটা বেশ পছন্দ তার, তাই হাঁটতে বের হলো।
নিজের পছন্দের হোটেলে চেক ইন করার পরেই হোটেলের মালিকের সাথে বেশ ভাল খাতির হয়ে যায় তার।
“সবাই আমাকে জ্যাকুলিন বলেই ডাকে,” বলল হোটেল মালিক মিসেস জানেত্তি।
“আর তোমার নাম কী?” অ্যালেক্সের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো মিসেস জানেত্তি।
“লরা,” হুট করেই এই নাম বলে দিলো অ্যালেক্স।
“লরা?” কিছুটা বিস্মিত মিসেস জানেত্তি আবারো বলল, “আমার ভাগ্নীর নামও তো লরা।”
এর মাঝে অবাক হওয়ার মত কী আছে তা বুঝতে পারলো না অ্যালেক্স। নামের মিল থাকতেই পারে, কিন্তু মিসেস জানেত্তিকে এই ব্যাপারে একটু বেশিই উল্লসিত মনে হলো। এই কারণেই মহিলাকে শুরুতেই অপছন্দ হলো তার- এই ধরনের মানুষগুলোর ভাবখানা এমন যেন জগতের সবার সাথেই তাদের সম্পর্ক আছে আর তা প্রমাণ করার জন্য সব চেষ্টাই করে। এই ধরনের মানুষদেরকে সবসময় এড়িয়ে চলে সে। পৃথিবীর অর্ধেকের বন্ধু, আর বাকি অর্ধেকের মা হিসেবে নিজেকে প্রমাণে ব্যতিব্যস্ত এরা।
হয়তোবা একসময় দেখতে বেশ সুন্দরী ছিল মিসেস জানেত্তি, কিন্তু তা ধরে রাখার চেষ্টাই সর্বনাশ ডেকে এনেছে তার জন্য। প্লাস্টিক সার্জারি করার পরেও বয়স লুকাতে পারেনি। তার চেহারার কোন অংশ যে ঠিক মত আছে তা বলা মুশকিল। কপালটা সবসময় টানটান থাকার কারণে ভ্রু কুঁচকে গেছে, গালটা এমনভাবে ঝুলে গেছে যেন সাইডবার্নের শিকার, ঠোঁটের চারপাশে বলিরেখা স্পষ্ট, সাপের চোখের মত চোখ কোটরে বসে পড়েছে। রিসেপশন ডেস্কের পিছনে প্রথমবার দেখার পর অ্যালেক্সের মনে হয়েছিলো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সাক্ষাৎ ডাইনী। এমন জায়গায় এক রাতের বেশি থাকার ইচ্ছা হারিয়ে ফেললো। তাই সিদ্ধান্ত নিলো পরেরদিন সকালেই এই হোটেল ছেড়ে দিবে। কিন্তু ওই রাতেই মিসেস জানেত্তি ড্রিংক করার আমন্ত্রণ জানিয়ে তাকে ডেকে পাঠালো।
“আরে এসো, আমার সাথে একটু গল্পগুজব করবে না?”
হুইস্কি শেষ হওয়ার পর এক বোতল বোর্দো খুলে দিলো মিসেস জানেত্তি । “আমি জানি না ফ্রিজে কী আছে, তবে তুমি ডিনার করে গেলে আমি খুব খুশি হবো,” বলল মিসেস জানেত্তি। অ্যালেক্স মানা করলো না। সন্ধ্যাটা বেশ সুন্দর কাটলো তার। যতটা সময় ওখানে ছিল হাজারো প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয়েছে, আর প্রত্যেকটা প্রশ্নেরই মিথ্যা জবাব দিয়েছে। এই ধরনের উদ্দেশ্যহীন কথাবার্তায় অনায়াসে মিথ্যা বলা যায়। নিজের রুমে যাওয়ার জন্য যখন সোফা থেকে উঠলো, তখন রাত একটার বেশি বাজে। একে অপরের গালে চুমু খেলো, আর সন্ধ্যাটা যে অসাধারণ কেটেছে তা জানালো, যা একইসাথে সত্য এবং মিথ্যা। সময় কোন দিক দিয়ে পার হয়ে গেছে টেরই পায়নি সে। বিছানায় যেতে অনেক দেরি হয়ে গেল, একদম ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। রাজ্যের ঘুম তার চোখ, ওদিকে আবার দুঃস্বপ্ন তাকে বরণ করে নিতে মুখিয়ে আছে।
পরেরদিন সকালে একবারের জন্য একটা বইয়ের দোকানে ঘুরে আসে, আর বাকিটা সময় ঘুমিয়ে কাটায়।
জ্যাকুলিন জানেত্তির ভাষ্য মতে, এই হোটেলে গেস্ট রুম আছে চব্বিশটা। চার বছর আগে একবার পুরো হোটেল সংস্কার করা হয়, আগের চেয়ে উন্নত সুবিধা যুক্ত করা হয়। কিন্তু অ্যালেক্স এখনো নিজের রুমে থাকাকালীন সময়ে আশেপাশে মানুষ চলাচলের শব্দ পায়, হয়তোবা সাউন্ডপ্রুফ করার জন্য কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সন্ধ্যা হওয়ার আগে পাশ কাটানোর জন্য বেরুতে চাইলেও তাতে সফল হয় না সে। ড্রিংক করার অফার চাইলেও প্রত্যাখান করা যায় না। এরপরে গল্পগুজব করতে করতে রাত দশটা বেজে যায়। তখন আরো অভিনব পরিকল্পনার কথা জানায় মিসেস জানেত্তি।
“চলো না কোথাও গিয়ে নেচে আসি একসাথে?”
“না। এটা সম্ভব না।” সরাসরি না করে দিলো সে।
কিন্তু মিসেস জানেত্তি নাছোড়বান্দা। নানা উপায়ে তাকে রাজি করানোর চেষ্টা করতে লাগলো। ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও, শেষমেশ রাজি হলো। মহিলার কণ্ঠের আকুতি তাকে বাধ্য করেছে যাবার জন্য।
“তুমি গেলেই দেখবে, জায়গাটার তুলনা হয় না,” খুশিতে গদগদ হয়ে বলল মিসেস জানেত্তি।
ডান্স ফ্লোরের কথা ভাবলেই আনন্দে মন নেচে ওঠে তার।
“আর ওখানের কিছু লোকের সাথেও তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিবো।”
ক্ল্যারেটে (এক জাতীয় লাল ফরাসী মদ) এক চুমুক দিলো অ্যালেক্স। কখন খেতে বসেছে নিজেও জানে না, কিন্তু এখন দশটার বেশি বাজে, তার যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে।
অধ্যায় ৩৩
প্যাসকেল ট্র্যারিক্সের সাথে স্টেফান ম্যাকিয়াকের কোন সংযোগ পাওয়া যায়নি। আর এদের সাথে বার্নার্ড গ্যাটেনগোর কখনোই দেখা হয়নি। পুলিশ রেকর্ড ঘেটে এই তথ্য জানালো ক্যামিল।
সেইন্ট ফিয়্যাকে জন্ম নেয়া গ্যাটেনগো পিথাইভিয়ারসের একটা টেকনিক্যাল কলেজে পড়াশোনা শেষ করে, সেখান থেকেই ইন্টার্ণশীপ করে। ছয়বছর পর টেমসে নিজের গ্যারেজ খুলে বসে।
ক্রিমিনাল বিগ্রেডের অফিসে সবাই উপস্থিত। ম্যাজিস্ট্রেটও চলে এসেছে তার কথাকথিত ‘রিপোর্ট নেয়ার জন্য, যদিওবা শব্দটা তার মুখে কিছুটা হাস্যকর শোনায়। পরণে আকাশী নীল রঙের টাই, তার পোশাকের রুচিবোধ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয়।
“জন্ম থেকে মৃত্যুর দিন অবধি আশেপাশের ত্রিশ কিলোমিটারের মধ্যেই ছিল তার পদচারণা। স্ত্রী আর তিন সন্তান নিয়ে সুখেই কাটছিলো জীবন। কিন্তু এরপরেই মুহূর্তের এক ঝড়ে সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। এই ঝড়েই তার জীবনে নেমে আসে সর্বনাশ। প্যাসকেলের সাথে কোন সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।”
ম্যাজিস্ট্রেট এখনো নিশ্চুপ। লা গুয়েনও কিছু বলল না। দুজনেই সতর্ক অবস্থানে রইলো। কেননা ক্যামিল ভেরহোভেন কখন কোন কথা বলে ফেলে তার ঠিকঠিকানা নেই।
“১৯৪৯ সালে পোল্যান্ডের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া স্টেফান ম্যাকিয়াক, ফ্রান্সের সামাজিক সমন্বয় আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।”
এই তথ্য সবারই জানা। বারবার একই তথ্য কপচানো যে কারো জন্যেই বিরক্তিকর, ক্যামিলও ধৈর্য হারাচ্ছে। লা গুয়েন এমনভাবে চোখ বন্ধ করলো যেন টেলপ্যাথির মাধ্যমে ক্যামিলের সাথে যোগাযোগ করতে চাইছে। লুইসও একই কাজ করলো। এমনিতে সে উগ্র স্বভাবের না হলেও মাঝে মাঝে অশান্ত হয়ে ওঠে।
“স্টেফান ম্যাকিয়াক একসময় প্রচণ্ড রকম মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। একজন আদর্শ ফরাসি নাগরিকের মত আকণ্ঠ মদ পান করতো। ফ্রান্সের ঐতিহ্য রক্ষায় নিবেদিত এক প্রাণ। বিস্ট্রোতে কাজ শুরু করে। প্রথমদিকে প্লেট ধোয়া মোছার কাজ করতো, এরপর ওয়েটার হিসেবে কাজ করেছে কিছুদিন। খুব দ্রুতই প্রমোশন পেয়ে হেড ওয়েটারের পদ পায়। তার জীবনের গ্রাফ যেন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটেছে। ফ্রান্সে কঠোর পরিশ্রমীরাই জীবনে কিছু করতে পারে। মদ গেলার হার বাড়ার সাথে সাথে তার জীবনও উন্নত হতে থাকে। বত্রিশ বছর বয়সে নিজের ক্যাফে খুলে বসে ম্যাকিয়াক। আট বছর এখানে ক্যাফে চালানোর পর হঠাৎ একদিন নিয়তির খড়গ নেমে আসে তার উপর। এক পথচারী তার বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার সাথে দেখা করতে যায়। এরপর ম্যাকিয়াক নিজেকে আবিষ্কার করে মেঝেতে, আর ওই পথচারী দুই হাজার তিনশ সাইত্রিশ ইউরো নিয়ে ভেগে যায়।
এভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটে এক নাটকীয় জীবনের।”
“তোমার মতে ভিক্টিমদের মাঝে কোন সংযোগ নেই। আমাদের খুনি কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই ইচ্ছামত খুন করছে,” সবশেষে বলল ম্যাজিস্ট্রেট।
“কোন পরিকল্পনা ছিল কি না ছিল তা আমি জানি না, তবে এতোটুকু বলতে পারি ভিক্টিমরা একে অপরের পরিচিত ছিল না।”
“হত্যাই যদি করতে পারে, খুনি কেন তার পরিচয় পরিবর্তন করে?”
“হত্যা করার জন্য নিজের পরিচয় পরিবর্তন করে না বরং হত্যা করার পরে করে।”
ক্যামিলের কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারলো না সে। ক্যামিল ব্যাখ্যা শুরু করলো।
“খুনি আসলে নিজের পরিচয় পরিবর্তন করে না, নিজের নামটা বদলে নেয়। দুইটা এক জিনিস না। কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে কখনো বলে নাটালি, কখনো লি। বেশ কয়েকজনকে খুন করার কারণে নিজের নাম একেক জায়গায় একেকটা বলে। আমাদের জানা মতে তিনজনকে হত্যা করেছে সে, যদিওবা আসল সংখ্যা আমরা জানি না। নিজের পথ পরিস্কার রাখার জন্য যতটুকু সম্ভব তাই করছে।”
“নিজের কাজ তাহলে বেশ ভালোমতোই করছে সে।”
“এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।”
“মোটিভ কী হতে পারে? টাকাপয়সা বলে তো মনে হয় না,” বলল ম্যাজিস্ট্রেট।
“এই ব্যাপারে আমিও একমত। কেননা খুনের পর খোয়া যাওয়া টাকার পরিমাণ খুবই নগণ্য। টাকার জন্য খুন করলে আরো সতর্ক থাকতো। ধনী লোক টার্গেট করতো। প্যাসকেল ছয়শো তেইশ ইউরো নিয়ে ভেগেছিলো, স্টেফানের একদিনের ইনকাম ছিল পকেটে, আর গ্যাটেনগোর ক্রেডিট কার্ডে থাকা টাকা ব্যবহার করেছে খুনি।”
“তার মানে টাকার ব্যাপারটা শুধু একটা ধোঁকা?”
“সম্ভবত তাই। আমার ধারণা আমাদের বিভ্রান্ত করার জন্য এমনটা করা হয়েছে। ডাকাতি করার সময় ঘটনাক্রমে হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে, খুনি এমনটাই বোঝাতে চেয়েছে আমাদের।”
“তাহলে কী?”
“সেক্সুয়াল কোন কারণ থাকতে পারে পারে এর পিছনে।”
“ভিক্টিমের গলায় এসিড ঢেলে দেয় আমাদের খুনি। কিন্তু সেক্সুয়াল কিছু হলে অন্য কোথাও ঢালার কথা ছিলো। তাই না?” জিজ্ঞেস করলো ম্যাজিস্ট্রেট।
“আরেকটু স্পষ্ট করে বলবেন, আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?”
“দেখো…”
একটু দ্বিধান্বিত বোধ করলো সে। ক্যামিল জিজ্ঞেস করলো, “হ্যা, বলুন।”
“দেখো, এসিড তো…এসিড তো ঢালতো…”
“…তার জননাঙ্গে?”
“উমম…”
“অথবা বিচিতে? নাকি দুই জায়গাতেই?”
“আমিও এটাই ভাবছিলাম।”
“তার মানে তোমার মনে হয় মেয়েটা ধর্ষিত হয়েছিলো। এটাই বলতে চাও তুমি, ভেরহোভেন?”
“হ্যা। আমার ধারণা তাই। মেয়েটা এখন তার ধর্ষকদের শায়েস্তা করছে।”
“আর গলা দিয়ে এসিড ঢেলে দেয়ার ব্যাপারটা…”
“আমার ধারণা ব্লো জব দেয়া নিয়ে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে তার জীবনে। আপনি তো জানেন আজকাল…
“অবশ্যই। তোমাদের সবার চেয়ে বেশিই জানি। ভাগ্য ভাল যে এই কাজ করতে করতে সবাই সিরিয়াল কিলার হয়ে উঠে না।”
বিস্ময়কর হলেও সত্য, ম্যাজিস্ট্রেট এখন হাসছে। ক্যামিলকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেখাচ্ছে।
“যাই হোক, আসল কারণ আমরা না জানলেও, খুনি এই কাজটাই করে।”
ম্যাজিস্ট্রেট এখনো হাসছে। হাসি থামিয়ে কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিতে দেখা গেল তাকে।
“কারণ যাই হোক, কিছু একটা তো আছে যা মেয়েটা হজম করতে পারছে না।”
এই কথা শোনার পর সবাই বিস্মিত হয়ে গেল। ক্যামিলকে একটু বেশিই হতবিহ্ববল মনে হলো।
অধ্যায় ৩৪
গা বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করলো অ্যালেক্স।
“আমি ওখানে যাওয়ার জন্য তৈরি না। এই জামাকাপড় পড়ে আমি যাবো না, আমি আর জামাকাপড়ও নিয়ে আসিনি।”
“তোমাকে একদম পারফেক্ট লাগছে।”
লিভিং রুমে দু’জন মুখোমুখি বসে আছে। অ্যালেক্সের সবুজ চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিসেস জানেত্তি। চোখের দিকে তাকিয়ে যেন নিজের যৌবনকালের কথা মনে পড়লো তার, সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লো। নিজের হারানো যৌবনে ফিরে যেতে পারলে কত কী হতো তা ভাবতে ভাবতে ট্যাক্সি চলে এলো। সে আর কিছুই বলার সুযোগ পেলো না। কিছুক্ষণ পর নিজেকে আবিষ্কার করলো ডান্স হলে। জায়গাটা মোটেও পছন্দ হলো না তার, বরং সার্কাস, চিড়িয়াখানার মত লাগলো। প্রায় আটশ লোকের ধারণক্ষমতার ফ্লোরে, লোকজন আছে মোটে দেড়শ জন। এক পাশে ব্যাণ্ডদল গান করছে, তাদেরকেও হতাশ মনে হচ্ছে এতো কম লোক সমাগমে। ডান্স ফ্লোরের চারপাশে গোল করে চেয়ার পাতা রয়েছে, কয়েকজন উৎসুক দম্পত্তি এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করছে।
জ্যাকলিনের কাছে পুরো আবহ উৎসবমুখর মনে হচ্ছে। তার চোখে মুখের আনন্দ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এখানে আসতে পেরে কতটা খুশি সে। সবার সাথে অ্যালেক্সকে পরিচিয় করিয়ে দিচ্ছে, “এই হলো লরা, আমার ভাগ্নী।” এখানে আসা প্রায় সবারই বয়স চল্লিশের উপরে। ত্রিশ বছর বয়সি অ্যালেক্সকে দেখে সবাই কিছুটা বিস্মিত। এমন বয়সি কোন মেয়েকে এখানে মনে হয় এতিম, আর ছেলেদের দিকে সবাই সন্দেহপ্রবণ দৃষ্টিতে তাকায়। প্রায় এক ডজন দম্পত্তি দেখা গেল যারা রংবেরঙের জামা কাপড় পড়ে এসেছে। মেকআপেরও কমতি নেই তাদের মুখে। সবাই তাকে এমনভাবে বুকে জড়িয়ে ধরছিলো যেন অনন্তকাল অপেক্ষার পর পেয়েছে তাকে
এখানে আসার আসল উদ্দেশ্য তাকে বলেনি জ্যাকলিন। নাচতে আসার ব্যাপারটা একটু অজুহাত মাত্র, আসল কারণ মারিও। ত্রিশ বছর বয়সি মারিও, শরীর অনেকটা বিল্ডিং এ কাজ করা শ্রমিকদের মতো, কথা একটু বেশি বলে, তবে চেহারায় পুরুষালি ভাব সুস্পষ্ট। আরেকজন রয়েছে মিশেল নামে, দেখতে কোম্পানির ডিরেক্টরের মত লাগে। কিন্তু পোষাকের রুচি অত্যন্ত নিম্নমানের। দুজন পাশাপাশি দাঁড়ালে, জ্যাকলিন মারিওকেই বেছে নিবে। কেননা মারিওর তুলনার মিশেল বেশ বয়স্ক। কিন্তু, মিশেলকেও ছেড়ে দিতে পারে না জ্যাকলিন।
রুমের এক কোণায় একটা মিনি বার। আদতে এটাকে রিফ্রেসমেন্ট রুম বলা চলে। মানুষজন এখানে এসে হালকা পাতলা কথাবার্তা বলে। কেউ কেউ তার সঙ্গিকে নিয়ে এসে চুমু খায়। একটা সময় মানুষের জটলা লেগে যায় এখানে।
রাত ২ টা বাজে। আস্তে আস্তে মানুষজন কমতে শুরু করেছে। যার যার মতো বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।
মারিওকে পাওয়া গেল না। মিশেল তাদেরকে এগিয়ে দিয়ে আসতে চাইলো। কিন্তু জ্যাকলিন ট্যাক্সি করে ফিরবে বলে, তাকে না করে দিলো। বিদায়ের আগে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো আর আজকের সন্ধ্যাটা কত ভাল কেটেছে তা জানালো।
“তুমি বিরক্তবোধ করছিলে, তাই না?”
“না। না। একদমই না, বরং মজা পেয়েছি।” হেসে জবাব দিলো অ্যালেক্স।
কিন্তু কাল সকালেই যে চলে যাবে, মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। যদিওবা টিকেট বুক করা নেই, তবুও আর থাকতে চায় না এখানে। এই অত্যাচার তার পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব না।
হোটেলে পৌছে গেল তারা। একটু হেলে দুলে হাঁটছে জ্যাকলিন পরস্পর চুমু খেয়ে, শুভ রাত্রি জানিয়ে যার যার রুমে চলে গেল। “কাল আবার দেখা হবে,” যেতে যেতে বলল জ্যাকলিন। নিজের রুমে গিয়ে আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না অ্যালেক্স। সুটকেসে কাপড় গুছিয়ে নিচে নামলো, রিসিপশন ডেস্কের সামনে রেখে দিয়ে আবারো উপরে উঠলো। এখন শুধু হ্যান্ডব্যাগ নেয়া বাকি।
*
জামাকাপড় আর জুতা খুলে প্রায় এক গ্লাস হুইস্কি ঢেলে নিলো নিজের জন্য।
অ্যালেক্সকে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “কিছু ফেলে গিয়েছো নাকি?” বাক্যটা পুরোপুরি শেষ করার আগেই টেলিফোন রিসিভার দিয়ে কপালের ডানপাশে আঘাত করলো সে। এমন আকস্মিক আঘাতে স্তব্ধ হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল জ্যাকলিন। হাতে থাকা গ্লাস ছুটে গিয়ে দূরে পড়লো। মুখ তুলে তাকালেই, আবারো মুখের উপর নেমে এলো ব্যাকেলাইট টেলিফোনের আঘাত। এবার দু’হাত দিয়ে পূর্ণশক্তিতে আঘাত করছে। পরপর পাঁচবার নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে আঘাত করলো সে। মুখের আকৃতিই পাল্টে গেল জ্যাকলিনের। এখনো পুরোপুরি মরেনি। মাথায় আঘাত করার এই এক সুবিধা, পুরোপুরি মারা যাবে না, আবার প্রতিরোধ করার ক্ষমতাও থাকবে না। আরো দুইবার একই কায়দায় আঘাত করলো অ্যালেক্স। সারা মুখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। নাক ভেঙ্গে গেছে। দাঁতের পাটি আলগা হয়ে গেছে, কয়েকটা দাঁত ভেঙ্গে বাইরে পড়ে আছে। একটু পিছনে সরে গিয়ে দাঁড়ালো অ্যালেক্স। টেলিফোনের তার দিয়ে জ্যাকলিনের হাত পা বেঁধে নিলো।
নিজের নাক আর মুখকে রক্ষার জন্য সবসময় সতর্ক থাকে সে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে বাকি কাজটুকু করলো। হাত দিয়ে শিকারের চুলের মুঠি ধরে নেয়। কেননা অ্যাক্রাইলিন রেজিন আর সালফিউরিক এসিড মেশানোর সময় প্রচুর পরিমাণে বুদবুদ উৎপন্ন হয়।
এসিড যখন জিহ্ববা, গলা আর ঘাড়কে গলিয়ে দেয়, তখন হোটেল মালিকের মুখ থেকে এক জান্তব চিৎকার বেরিয়ে আসে, পেট ফুলে একদম হিলিয়াম ভরা বেলুনের মত হয়ে যায়।
রুমের সব জানালা খুলে দিলো, যাতে করে বাতাস চলাচল করতে পারে। হুইস্কির বোতল খুঁজে পেলো না। একজায়গায় ভদকার বোতল দেখে তা নিয়েই সোফায় বসে পড়লো। মেঝেতে এক চোখা একটা লাশ পড়ে আছে। লাশের অবস্থা বীভৎস। এসিডে গলে যাওয়া মাংসের দুর্গন্ধ আসছে।
অ্যালেক্স ক্লান্ত।
ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে ক্রসওয়ার্ড পাজল মেলাতে শুরু করলো।