নয়
পাদরীর ছবি কাগজে দেখে গাড়ি নিয়ে রবার্ট সোজা ছুটল লওনের দিকে। মাথার মধ্যে চিন্তার ঝড় বইছে। ক্যাথি সত্যিই গর্ভবতী ধর্মযাজক তাহলে ঠিকই বলেছিল। এখন আর ট্যাসোনের কথাগুলো উড়িয়ে দিতে পারছে না সে। পার্কে পাদরী তাকে কি কি বলেছিল মনে করার চেষ্টা করল রবার্ট। কোথায় যেন তাকে যেতে বলেছিল সে কিন্তু নাম ঠিকানা কিছুই মনে করতে পারছে না। নিজেকে শান্ত আর সংযত করার চেষ্টা করল রবার্ট। কে ফোন করে তাকে আজকের কাগজটা পড়তে বলল? গলাটা চেনাচেনা মনে হলেও ঠিক ধরতে পারছে না সে। প্রীস্টের সাথে তার সম্পর্ক আছে একথা সে জানল কেমন করে? কে হতে পারে? ফটোগ্রাফার? ঠিক ওরই গলা ছিল ওটা—হেবার জেনিংস।
অফিসে পৌঁছে নিজেকে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখল রবার্ট। ইন্টারকমে হেবার জেনিংসকে ফোনে ধরার নির্দেশ দিল সে। চেষ্টা করল সেক্রেটারি, কিন্তু হেবারকে পাওয়া গেল না, কেবল টেপরেকর্ড করা জবাব পাওয়া গেল তার নিজস্ব গলায়, ‘হেবার জেনিংস বাড়িতে নেই।’ থর্নকে একথা জানাতেই সে সেক্রেটারির কাছ থেকে ওর নাম্বারটা চেয়ে নিয়ে নিজেই ডায়াল করল। না, আর কোন সন্দেহ নেই আজ সকালে হেবারই ফোনে কাগজ পড়ে দেখতে বলেছিল তাকে। কিন্তু নিজের পরিচয় সে দিল না কেন? এ কেমন ধারা খেলা খেলছে হেবার তার সাথে?
ক্যাথি ফোন করতে বলেছে জেনেও ফোন করল না রবার্ট। কারণ ফোন করলেই অ্যাবর্শনের কথা জিজ্ঞেস করবে কি উত্তর দেবে এখনও স্থির করে উঠতে পারেনি সে। একমাত্র সে-ই জানে যে ডেমিয়েন তার নিজের ছেলে নয়।
‘সে হত্যা করবে বাচ্চাটাকে,’ বলেছিল ট্যাসোন। ‘ভূণ অবস্থাতেই সে হত্যা করবে তাকে।’
তাড়াতাড়ি ডাক্তার গ্রীয়ারের ফোন নাম্বার বের করে তাকে জানাল একটা বিশেষ জরুরি ব্যাপারে আলাপ করার উদ্দেশ্যে তার সাথে দেখা করতে আসছে।
.
থর্ন যে শিগগিরই তার সাথে আলাপ করতে আসবে একথা জানত ডাক্তার গ্রীয়ার। তাই সে অবাক হয়নি মোটেও। ইদানীং ক্যাথির মানসিক অবস্থার অবনতি সে বেশ লক্ষ্য করেছে। উৎকণ্ঠা আর বেপরোয়া ভাবের মধ্যে খুব সূক্ষ্ম একটা ভেদ রয়েছে। এই দুইয়ের টানাপোড়েনে দুলছে ক্যাথি। ভীতি যদি মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তবে ডাক্তার জানে ক্যাথি আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারে।
‘কেউ বলতে পারে না এই ধরনের ভয় আসলে কত গভীর…’ নিজের অফিসে বসে থর্নকে বলছিল গ্রীয়ার। ‘সত্যি কথা বলতে কি, স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে,
উনি খুব মারাত্মক মানসিক বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
শক্ত চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে থর্ন আড়ষ্ট ভাবে শুনেছে ডাক্তারের কথা। উঠে পায়চারি করতে করতে ঘনঘন পাইপ টেনে ওটার নিভে যাওয়া ঠেকাতে চেষ্টা করছে কমবয়সী ডাক্তার।
‘আমি আগেও অনেক দেখেছি এসব,’ বলে চলল সে। ‘মালগাড়ির মত চোখের সামনে দেখা যায় কিভাবে ধীরে ধীরে এর গতি বেড়ে ওঠে।
‘তাহলে অবনতি ঘটেছে ক্যাথির?’ কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল রবার্ট।
‘বলা যায় দানা বাঁধতে আরম্ভ করেছে।‘
‘আপনার করার কিছু নেই?’
‘আমি সপ্তাহে দুবার দেখি তাঁকে, কিন্তু তাঁর আরও অনেক বেশি যত্নের প্রয়োজন।
‘আপনি কি বলছেন তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’
‘বলা যায় তিনি কল্পনার রাজ্যে বিরাজ করছেন। সেই রাজ্যে অনেক ভয়। এই ভীতিটাই কাজ করছে তাঁর ওপর।‘
‘কি ধরনের ভয়?’ জানতে চাইল থর্ন।
একটু দম নিয়ে গ্রীয়ার ভেবে নিচ্ছে ব্যাখ্যা দেবে কিনা। আবার নিজের চেয়ারে বসে সে রবার্টের শঙ্কিত চোখের দিকে চেয়ে দেখল।
‘তাঁর কল্পরাজ্যের একটা কথা হচ্ছে তিনি বিশ্বাস করেন না ছেলেটা সত্যি তাঁর নিজের।
কথাটা বজ্রাঘাতের মতই আঘাত করল রবার্টকে। অসাড় হয়ে বসে রইল সে—মুখ দিয়ে কথা সরছে না।
আমার বিশ্লেষণে এটা আসলে তাঁর ভয় নয়—এটা তাঁর অবচেতন মনের একটা ইচ্ছা। মনে মনে তিনি সন্তানহীন থাকতে চান।’
মাথা ঘুরছে রবার্টের—কোন জবাবই জোগাল না তার মুখে।
‘আমি এমন ইঙ্গিত দিচ্ছি না যে ছেলেটার গুরুত্ব তাঁর কাছে কম,’ বলে চলল গ্রীয়ার। ‘বরং ঠিক উল্টো, একক ভাবে এটাই তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে এটাই তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় হুমকি। আমি ঠিক জানি না ভয়টা তাঁর মাতৃত্বকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, নাকি নিছক নিজে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। নিজেকে অযোগ্য বলে মনে করেই হয়ত তাঁর এই মানসিক বিকার।
‘…কিন্তু সে তো নিজেই সন্তান চেয়েছিল?’ চেষ্টা করে কথা কয়টা বলল রবার্ট।
‘আপনার জন্যে।’
‘না…’
অবচেতনভাবে। তিনি মনে করেছিলেন নিজেকে আপনার যোগ্য প্রমাণ করতে হলে আপনার সন্তান পেটে ধারণ করাই সবচেয়ে ভাল উপায়।’
সামনের দিকে চেয়ে রইল রবার্ট, তার চোখে হতাশা।
‘এখন তিনি আর সইতে পারছেন না, তাই নিজের স্বপক্ষে কারণ খুঁজে নিয়েছেন যেন নিজেকে আর অযোগ্য বলে মনে না হয়। তাই তিনি কল্পনা করে নিয়েছেন যে বাচ্চাটা তাঁর নয়, সে অনিষ্টকর ও অমঙ্গলজনক। ‘
‘কি…?’
‘প্রাণ থেকে ভালবাসতে না পেরে একটা ছুতো বের করে নিয়েছেন আর কি।’ ….সে কি সত্যিই মনে করে যে ছেলেটা অশুভ?’ ভীষণ ভাবে নাড়া খেয়েছে রবার্ট। মুখটা শক্ত হয়ে গেছে তার ভয়ে।
‘এই মুহূর্তে তাঁর অনুভূতি নিয়েই থাকতে দিতে হবে তাঁকে,’ বুঝিয়ে বলল গ্রীয়ার। ‘কিন্তু আসল কথা হচ্ছে এই সময়ে আর একটা বাচ্চা বিপর্যয় ডেকে আনবে।’
‘কিন্তু…’ নিজেকে অসুস্থ দুর্বল মনে হচ্ছে রবার্টের।
‘চিন্তার কোন কারণ নেই, সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘ডক্টর…’
‘বলুন?’
কিন্তু থর্ন কিছুই বলতে পারল না দুজনে নীরবে মুখোমুখি একে অন্যের দিকে চেয়ে বসে রইল।
ডাক্তারের মুখে চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার সামনে বসা লোকটার কিছু বলার আছে—কিন্তু ভয়ে বলতে পারছে না।
‘মিস্টার থর্ন, খারাপ বোধ করছেন নাকি আপনি?’
‘না, খুব ভয় পেয়েছি।’
‘অবশ্যই সেটাই তো স্বাভাবিক।’
‘একটা…দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছে।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনারা দুজনেই দুর্যোগ কাটিয়ে বেরিয়ে আসবেন।’
‘আপনি বুঝতে পারছেন না।’
‘পারছি।’
‘না।‘
‘বিশ্বাস করুন, আমি বুঝি।’
চোখ ফেটে কান্না আসছে রবার্টের। মাথা নিচু করে দু’হাতে মুখ ঢাকল সে।
‘দুশ্চিন্তার চাপের মধ্যে রয়েছেন আপনি, মিস্টার থর্ন। আপনি নিজেও জানেন না কতখানি মানসিক চাপ সহ্য করছেন আপনি।’
‘আমি বুঝতে পারছি না আমার কি করা উচিত,’ কাতরোক্তি করল রবার্ট।
‘আপনার প্রথম কাজ হবে অ্যাবর্শনে রাজি হওয়া।’
চোখ তুলে সরাসরি রবার্ট চাইল গ্রীয়ারের দিকে।
‘না,’ জবাব দিল সে। জবাব শুনে ভীষণ অবাক হল ডাক্তার।
‘ধর্মীয় কারণে যদি আপনার আপত্তি…’
‘না।’
‘আপনি নিশ্চয়ই এর প্রয়োজন উপলব্ধি করতে পারছেন?’
‘না, এতে মত দেব না আমি,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল রবার্ট।
‘কিন্তু আপনার স্ত্রীর ভালর জন্যেই আপনার করতে হবে এটা।’
‘না।’
চেয়ারে হেলান দিয়ে অ্যামবাসেডরকে অবিশ্বাস ভরা চোখে দেখতে লাগল ডাক্তার।
ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে বাচ্চাটা মারা পড়বে,’ বলল রবার্ট। ‘আমি চেষ্টা করে দেখতে চাই ওকে রক্ষা করা যায় কিনা।’
বিস্মিত ডাক্তার হাঁ করে চেয়ে রইল রবার্টের দিকে। উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠছে সে।
‘আমি জানি কথাটা কেমন শোনাচ্ছে,’ বলল থর্ন। ‘হতে পারে…আমার মাথাও হয়ত খারাপ হয়েছে?’
‘ওকথা বলছেন কেন?’
থর্ন কঠিন দৃষ্টিতে চাইল ডাক্তারের দিকে।
‘কারণ এই গর্ভের বাচ্চাটার ওপরই নির্ভর করছে আমি কি বিশ্বাস করব।’
‘অর্থাৎ?’
‘আমিও আমার স্ত্রীর মত বর্তমান বাচ্চাটাকে…’
গলায় কথা ঠেকে গেল রবার্টের, কথা শেষ না করেই ব্যস্ত ভাবে উঠে দাঁড়াল থর্ন। একটা অশুভ আশঙ্কা ছেয়ে ফেলেছে ওর মন। তার কেবলই ভয় হচ্ছে কি যেন একটা বিপদ ঘনিয়ে আসছে।
‘মিস্টার থর্ন!’
‘মাফ করবেন…’
‘দয়া করে একটু বসুন।’
মাথা নেড়ে জবাব দিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে নেমে এল সে সিঁড়ি দিয়ে। কাঁপা হাতে চাবি বের করে গাড়ি স্টার্ট দিল রবার্ট। কিছু একটা ঘটেছে, তার এখনই বাড়ি ফেরা দরকার। চাকায় শব্দ তুলে ইউ টার্ন নিয়ে অ্যাকসেলারেটর ফ্লোরের সাথে চেপে ধরল সে। গাড়িতে পেরিফোর্ড পৌঁছুতে তার মাত্র আধঘন্টা লাগবে—কিন্তু তবু কেন যেন তার বারবারই মনে হচ্ছে সময় মত পৌঁছতে পারবে না, দেরি হয়ে গেছে তার। লণ্ডনের দুপুর বেলার যানবাহনের ভিড়ে হর্ন বাজিয়ে পাগলের মত গাড়ি চালাচ্ছে রবার্ট। ট্রাফিক লাইটও মানছে না সে উৎকণ্ঠায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ও। তার মাথায় একটাই চিন্তা, যত শিগগির সম্ভব তাকে বাড়ি পৌছুতে হবে।
পেরিফোর্ড হাউসে ক্যাথিও উৎকণ্ঠিত। যে ভয় তার ভিতরটাকে কুরে কুরে খাচ্ছে, সেটা ভুলে থাকার জন্যে নানান ঘরোয়া কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করছে সে। তিনতলার বারান্দায় পানির পাত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে ক্যাথি ভাবছিল ব্যালকনি থেকে ঝুলানো গাছের টবগুলোতে কি করে পানি দেয়া যায়। ওগুলোতে পানি দেয়া দরকার, কিন্তু ঠিকমত ঢালতে না পারলে নিচে টালি করা মেঝেতে পানি পড়ার ভয় রয়েছে। ডেমিয়েন তার খেলার ঘরে চাকাওয়ালা খেলনা দিয়ে ট্রেন-ট্রেন খেলছে আর মুখ দিয়ে মালগাড়ির শব্দ করছে। ট্রেনের গতির সাথে মুখ দিয়ে শব্দ করার জোর বাড়ছে। ক্যাথির দৃষ্টির আড়ালে বাচ্চার খেলার ঘরে মিসেস বেল্ক দাঁড়িয়ে আছে ঘরের পিছন দিককার দেয়াল ঘেঁষে। তার চোখ দুটো বন্ধ—যেন প্রার্থনা করছে।
হাইওয়েতে রবার্টের গাড়ি চাকার ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ তুলে এম-৪০ রাস্তায় উঠে এল। গাড়ির ভিতর অস্থিরচিত্তে বসে আছে রবার্ট। স্টিয়ারিং শক্ত করে খামচে ধরেছে সে, গাড়ির নিচে রাস্তা ঝাপসা হয়ে ছুটে চলে যাচ্ছে পিছন দিকে। উল্কার বেগে ছুটে রাস্তার অন্যান্য গাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে চলেছে। মনে হচ্ছে অন্য গাড়িগুলো যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘামছে থর্ন, সামনের প্রত্যেকটা গাড়িকেই তার ওভারটেক করা চাই-ই। হর্ন বাজিয়ে জায়গা করে নিয়ে বুলেটের মত বেরিয়ে যাচ্ছে সে গাড়িগুলোর পাশ দিয়ে। হঠাৎ পুলিশের কথা মনে হতেই রীয়ার-ভিউ মিররের দিকে চাইল রবার্ট। একটা অমঙ্গলসূচক আকৃতি দেখল সে আয়নায়, পিছন থেকে এগিয়ে আসছে তার দিকে। আর একটা গাড়ি। কালো আর বিশাল মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যাবার গাড়ি ওটা। ওদের মাঝে দূরত্ব কমে আসছে, মনে হচ্ছে রবার্টকে ধরে ফেলবে গাড়িটা। ভয়ে ওর মুখটা একেবারে সাদা হয়ে গেছে।
পেরিফোর্ডে ডেমিয়েনের খেলনা নিয়ে ছুটোছুটি আরও বেড়েছে। এখন সে খেলনার ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে ঘোড়া চালাচ্ছে। বারান্দায় একটা টুলের উপর দাঁড়িয়ে গাছের টবে পানি দেয়ার চেষ্টা করছে ক্যাথি। ডেমিয়েনের ঘরে মিসেস বেল্ক একদৃষ্টে ওর দিকে চেয়ে রয়েছে—নীরব নির্দেশ দিচ্ছে যেন ওকে আরও জোরে ছোটার। ডেমিয়েনের গতি বাড়ল, চোখে একটা বন্যভাব, মুখটা সাময়িক উত্তেজনায় কঠিন হয়ে উঠেছে।
গাড়ির ভিতরে রবার্ট তার অ্যাকসেলারেটর আবার পুরো টিপে ধরল। তবু পিছনের গাড়িটা এগিয়েই আসছে। ড্রাইভারের মুখটা এখন রবার্ট বেশ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। ঠাণ্ডা প্রাণহীন চোখে তার দিকেই চেয়ে আছে লোকটা। থর্নের গাড়ির গতির কাঁটা নব্বই-এ ছিল, বেড়ে সেটা একশো দশ মাইলে গিয়ে স্থির হল। কিন্তু পিছনের গাড়িটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে এখনও। জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে থর্নের, যুক্তি-বুদ্ধি সব হারিয়ে ফেলেছে সে। তার মাথায় একটাই চিন্তা-কিছুতেই পিছনের গাড়িটাকে ওভারটেক করতে দেয়া যাবে না। গর্জন করছে থর্নের গাড়ির ইঞ্জিন। কিন্তু এগিয়েই আসছে ওই গাড়ি প্রায় পাশাপাশি চলে এসেছে গাড়ি দুটো।
‘না,’ প্রতিবাদ বেরিয়ে এল রবার্টের গলা থেকে, ‘না—!’
দুটো গাড়ি পাশাপাশি প্রায় উড়ে চলেছে, ধীরে আরও এগিয়ে যাচ্ছে কালো গাড়িটা। স্টিয়ারিং হুইলের ওপর কিল মারছে থর্ন, গাড়িটা কেন আরও জোরে চলছে না! খেপে উঠেছে সে। ওভারটেক করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়িটা—পিছনে রাখা কফিনটা রবার্টের পাশ দিয়েই সামনে এগিয়ে গেল।
ওদিকে থর্নের বাসায় ডেমিয়েন উন্মত্ত আনন্দে চিৎকার করে খেলছে ঘরের মধ্যে। ক্যাথি সামনের টবে পানি দেয়া শেষ করে ভয়ে ভয়ে আরও ঝুঁকে পড়ে পিছনের টবে পানি ঢালছে।
হাইওয়েতে শবযানটা রবার্টকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেল। থর্নের গলা থেকে একটা রক্ত হিম করা চিৎকার বেরিয়ে এল। ঠিক এই সময়েই নিজের খেলার ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে তার খেলনা দিয়ে প্রচণ্ড ধাক্কা দিল ডেমিয়েন ক্যাথির টুলে। ছিটকে শূন্যে উঠে গেল ক্যাথি, দু’হাতে বাতাসে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করল সে। ডিগবাজি খেয়ে নিচের দিকে রওনা হবার সময়ে চিৎকার করে ব্যালকনি ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করল। তার হাত লেগে একটা গোল সোনালী মাছ রাখার পাত্র উল্টে গেল। নিচে পড়ার শব্দের সাথে সাথেই তার চিৎকার থেমে গেল। পরক্ষণেই মাছের পাত্রটাও সশব্দে তার পাশে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল। নীরবে স্থির হয়ে পড়ে আছে ক্যাথি। একটা সোনালী মাছ পানির অভাবে ক্যাথির পাশেই ঠাণ্ডা টাইলের ওপর লাফাচ্ছে।
.
থর্ন যখন হাসপাতালে পৌঁছল তার আগেই কাগজের রিপোর্টাররা সবাই পৌঁছে গেছে সেখানে। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ বালব চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে তার। চিৎকার করে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে রিপোর্টাররা। মরিয়া হয়ে ‘ইনটেনসিভ কেয়ার’ লেখা দরজাটার দিকে এগুবার চেষ্টা করছে রবার্ট। বাড়ি ফিরে মিসেস বেলুকের কাছে সে জেনেছে ক্যাথি তিনতলা থেকে নিচে পড়েছে, অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে সিটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
‘মিস্টার থর্ন, আপনার স্ত্রীর বর্তমান অবস্থা কি?’ চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল একজন রিপোর্টার।
‘পথ ছাড়।’
‘শুনলাম পড়ে গেছেন তিনি?’
‘যেতে দাও।’
‘উনি বাঁচবেন তো?’
দরজা দিয়ে ঢুকেই লম্বা হল ধরে ছুটল সে, রিপোর্টারদের গলার শব্দ পিছনে মিলিয়ে গেল।
‘অ্যামবাসেডর থর্ন?’
‘হ্যাঁ।’
ডাক্তার দ্রুত এগিয়ে এল রবার্টের দিকে।
আমার নাম বেকার,’ বলল ডাক্তার।
‘আমার স্ত্রী কেমন আছে?’ ব্যস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল রবার্ট।
‘জীবনের আশঙ্কা নেই। বেশ আঘাত পেয়েছেন তিনি—মাথায় লেগেছে, একটা কলার বোন ভেঙেছে আর দেহের ভিতরে কিছু রক্তপাতও হয়েছে।’
‘গর্ভবতী ছিল সে।’
‘দুঃখিত, এখন আর তিনি গর্ভবতী নন।’
‘গর্ভপাত হয়েছে তাহলে?’ মুখ দিয়ে শ্বাস নিল রবার্ট।
‘যেখানে পড়েছিলেন সেখানেই। আমি পরীক্ষার জন্যে ওটা নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু জানলাম আমরা পৌঁছবার আগেই আপনার কাজের মেয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে ফেলেছে।‘
শিউরে উঠল থর্নের সারা দেহ। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল সে।
‘আমরা অবশ্যই ঘটনার খুঁটিনাটি গোপন রাখব,’ বলে চলল ডাক্তার। ‘লোকে যত কম জানে ততই মঙ্গল।’
থর্নের তাকানোর ভঙ্গি দেখেই ডাক্তার বুঝল কথাটার পুরো তাৎপর্য সে বোঝেনি।
‘আপনি জানেন তো আপনার স্ত্রী তিনতলা থেকে লাফিয়ে পড়েছেন?
‘… লাফিয়ে?’
‘হ্যাঁ, আপনার ন্যানির কথামত আপনার ছেলে আর তার চোখের সামনেই ঘটনাটা ঘটে।’
শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ডাক্তারের মুখের দিকে চেয়ে থেকে দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল রবার্ট। কাঁধ আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া দেখে ডাক্তার আন্দাজ করে নিল কাঁদছে সে।
‘এই ধরনের পতনে সাধারণত মাথাটাই আগে নিচে পড়ে। সুতরাং সেদিক থেকে বলা যায় আপনার কপাল ভাল।’
চোখের জল ঠেকাবার চেষ্টা করতে করতে মাথা ঝাঁকাল রবার্ট।
‘এত শোকের কোন কারণই ঘটেনি আপনার। কৃতজ্ঞ থাকুন যে আপনার স্ত্রী বাঁচবেন। তেমন যত্ন নেয়া হলে ভবিষ্যতে হয়ত এমন আত্মহত্যার চেষ্টাও আর করবেন না,’ বলে চলল ডাক্তার। ‘আমার এক শালীরও এমন আত্মহত্যার প্রবণতা ছিল। স্নান করতে গিয়ে বাথটাবে ইলেকট্রিক টোস্টার নিয়ে গেছিল। টোস্টারের হ্যাণ্ডেল টিপে নামিয়ে দিতেই প্রচণ্ড শক্ খায় সে।’
ডাক্তারের দিকে ফিরে তাকাল থর্ন।
‘কথা হচ্ছে, মারা যায়নি সে, বেঁচেছিল। এরপরে আর সে এমন চেষ্টা করেনি।’
‘কোথায় আছে সে?’ জিজ্ঞেস করল রবার্ট 1
‘এখন সুইজারল্যাণ্ডের…।’
‘আমার স্ত্রী।’
‘রূম ৪-এ। শিগগিরই তাঁর জ্ঞান ফেরার কথা।’
ক্যাথির ঘরটা চুপচাপ আর ঈষৎ অন্ধকার। একটা নার্স কেবিনে বসে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছে। ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল রবার্ট। একি চেহারা হয়েছে ক্যাথির? মুখটা ভীষণ ফুলে গেছে, একেবারে রক্তশূন্য দেখাচ্ছে ওকে। হাতে একটা টিউব লাগানো রয়েছে, প্লাজমা দেয়া হচ্ছে। হাতে একটা প্লাস্টার লাগানো। এখনও অজ্ঞান অবস্থায় আছে সে-মুখটা প্রায় প্রাণহীন।
‘ঘুমাচ্ছেন উনি,’ নার্স বলে উঠল। আড়ষ্ট পায়ে ধীরে ধীরে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল থর্ন। বিছানার পাশে দাঁড়াতেই তার উপস্থিতি টের পেয়েই যেন অস্ফুট একটা কাতরোক্তি করে মাথাটা এপাশে ফেরাল ক্যাথি।
‘ওর কি খুব যন্ত্রণা হচ্ছে?’ দুর্বল কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল রবার্ট।
‘সোডিয়াম পেন্টাথল দেয়া হচ্ছে ওনাকে,’ জবাব দিল নার্স। ‘ক্লাউড নাইন।’ বিছানার পাশে বসল রবার্ট। নার্স বেরিয়ে যেতেই বিছানার ধারে মাথা রাখল সে। তার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল নামতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পরে মাথায় হাতের স্পর্শ পেয়ে মাথা তুলে তাকাল সে।
‘রবার্ট.…’ ফিসফিস করে ডাকল ক্যাথি। ফোলা চোখ দুটো খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে।
‘ক্যাথি…’ অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে জবাব দিল রবার্ট।
‘আমাকে খুন করতে দিয়ো না ওকে।’ চোখ বুজে আবার ঘুমিয়ে পড়ল ক্যাথি।
রাত বারোটার পরে বাড়ি ফিরল রবার্ট। নিচের বারান্দায় অনেকক্ষণ চুপচাপ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ক্যাথি যেখানে পড়েছিল সেখানের ধুয়ে ফেলা আবছা রক্তের দাগের দিকে চেয়ে রইল। অবশ হয়ে গেছে তার দেহ, ক্লান্তিতে একেবারে বিধ্বস্ত ঘুম দরকার তার, আজ সারাদিন যা ঘটেছে তা কোনমতে ভুলে থাকা দরকার। যেন কোন এক অভিশাপে জীবনটাই এখন বদলে গেছে তার, আগের জীবন আর কোনদিন ফিরে পাবে না সে।
নিচের বাতি নিভিয়ে দিয়ে উপরে উঠে এল রবার্ট। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ক্যাথি যেখানে থেকে লাফিয়ে পড়েছে সেদিকে চেয়ে দৃশ্যটা কল্পনা করার চেষ্টা করল সে। যদি সে আত্মহত্যাই করতে চেয়েছিল তবে ছাতে না গিয়ে তিনতলা থেকে লাফ দিল কেন? বাসায় ওষুধের বড়ি ছিল, ক্ষুর ছিল, আরও অনেক উপায় ছিল যাতে নিজের নিশ্চিত মৃত্যু ঘটাতে পারত সে। তবে এই পন্থা কেন বেছে নিল? আর তাই যদি নিল তবে ডেমিয়েন আর মিসেস বেলুকের সামনে কেন? বুঝতে পারছে না রবার্ট।
পাদরীর সতর্ক বাণী মনে পড়ল তার, ‘সে বাচ্চাটাকে ভ্রূণ অবস্থাতেই হত্যা করবে-এরপর হত্যা করবে আপনার স্ত্রীকে-তারপর সে যখন নিশ্চিন্ত হবে আপনার সব সম্পত্তি…’ চোখ বুঝল সে। মাথা থেকে ওই চিন্তাটা দূর করার চেষ্টা করল। এখন তার ধীরস্থির হয়ে ভাবনা চিন্তা করে কাজ করার সময় এসেছে।
নিজের ঘরের দরজা খুলতে গিয়েও আবার ঘুরে দাঁড়াল থর্ন। ডেমিয়েনের ঘরের দিকে চাইল সে। দরজার তলা দিয়ে ভিতরে জ্বালানো রাতের কোমল আলো কিছুটা বাইরে এসে পড়েছে। ছেলের ঘুমন্ত মুখটা কল্পনা করে তাকে একবার দূর থেকে দেখার লোভ সম্বরণ করতে পারল না রবার্ট। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সে ডেমিয়েনের ঘরের দিকে। দরজাটা একটু ফাঁক করে ভিতরে উঁকি দিয়েই একেবারে বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেল। ছেলেটা ঘুমাচ্ছে-কিন্তু একা নেই সে। তার বিছানার একপাশে একটা চেয়ারে হাত মুড়ে বসে একদৃষ্টে উপরের দিকে চেয়ে আছে মিসেস বেল্ল্ক। অন্যপাশে বসে আছে কয়েকদিন আগে দেখা সেই বিশাল কালো কুকুরটা। তার ছেলেকেই যেন পাহারা দিচ্ছে। নীরবে দরজাটা বন্ধ করে সরে এল থর্ন। ঘনঘন শ্বাস পড়ছে তার। এক-পা এক-পা করে পিছিয়ে নিজের ঘর পর্যন্ত পৌঁছল সে। ওখানে দাঁড়িয়েই নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল থর্ন—স্পষ্ট বুঝতে পারছে উত্তেজনায় সারা শরীর কাঁপছে তার। হঠাৎ ঝনঝন শব্দে তার ঘরে টেলিফোনটা বেজে উঠল। ছুটে এসে বিছানার পাশ থেকে টেলিফোন রিসিভারটা তুলে নিল সে।
‘হ্যালো?’
‘জেনিংস বলছি,’ ওধার থেকে জবাব এল। ‘আপনি যার ক্যামেরা ভেঙেছিলেন আমি সেই লোক।’
‘হ্যাঁ, বল?’
‘আমি চেলসি থেকে বলছি—আপনি এখনি একবার আমার সাথে দেখা করলে ভাল হয়।’
‘কি চাও তুমি?’
‘একটা কিছু ঘটছে মিস্টার থর্ন। আমার মনে হয় ব্যাপারটা আপনার জানা দরকার।’
.
হেবার জেনিংসের ফ্ল্যাটটা ঘিঞ্জির মধ্যে বেশ খানিক খোঁজাখুঁজির পর রবার্ট ঠিকানা খুঁজে পেল। ছয়তলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠতে দম ফুরিয়ে এল তার। সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেয়ে থর্ন দরজায় নক করার আগেই তাকে দরজা খুলে অভ্যর্থনা জানাল হেবার।
‘আমার কাছে ব্র্যাণ্ডি আছে, দেব?’
‘ধন্যবাদ।’
‘আপনার রুচিমত হয়ত হবে না।’ দরজা বন্ধ করে ছোট্ট ডার্করূমটায় ঢুকল হেবার। অন্ধকার ঘরটার চারদিকে চেয়ে দেখল রবার্ট। কোন বাতি জ্বলছে না এ ঘরে। পাশের ডার্করুম থেকে একটা লালচে আলো এসে কিছুটা আলোকিত করেছে ঘরটা। দেয়ালের সবখানেই এনলার্জ করা ছবি।
‘এই যে,’ একটা বোতল আর দুটো গ্লাস নিয়ে ফিরে এল হেবার। ‘এটার কিছুটা খেলে পরে বাঘ-ভাল্লুকের সামনে দাঁড়াতেও আপনার ভয় লাগবে না!’
বাড়ানো গ্লাসটা হাতে নিল থর্ন। ব্র্যাণ্ডি ঢালল হেবার। তারপর রবার্টে একটা নড়বড়ে চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে নিজে বিছানার ওপরই বসল।
চীয়ার্স, সিগারেট চলবে?’ জিজ্ঞেস করল হেবার।
মাথা নেড়ে চেয়ারটায় বসল থর্ন। এমন অপ্রত্যাশিত হালকা ব্যবহারে একটু বিরক্তিই বোধ করছে সে।
‘তুমি বলেছিলে কিছু একটা ঘটছে।’
‘ঠিক।’
‘তার মানে? কি ঘটছে?’
রবার্টের মুখটা কিছুক্ষণ পরখ করে দেখল হেবার।
‘কেন, আপনি জানেন না?’
‘না, কিছুই জানি না।’
‘তবে এখানে কেন এসেছেন?’
‘তুমি ফোনে কোন ব্যাখ্যা দাওনি তাই।’
মাথা ঝাঁকিয়ে গ্লাস নামিয়ে রাখল হেবার।
‘আমি ফোনে ব্যাখ্যা দিতে পারিনি কারণ এটা এমন একটা জিনিস যা না দেখলে বোঝা যাবে না।‘
‘কি সেটা?’
‘ছবি,’ উঠে দাঁড়িয়ে থর্নকে অনুসরণ করতে বলে ডার্করূমে ঢুকল হেবার।
‘খুব ক্লান্ত আমি আজ।’
‘ছবিগুলো দেখার পর আপনার সব ক্লান্তি ঘুচে যাবে।’
একটা ছোট বাতি জ্বেলে দিল হেবার। কয়েকটা ছবির ওপর স্পটলাইটের মত আলো পড়ল। ভিতরে ঢুকে হেবারের পাশের টুলে বসল রবার্ট।
‘এই ছবিগুলো চিনতে পারেন?’
‘হ্যাঁ,’ জবাব দিল থর্ন। তারই বাসায় পার্টিতে তোলা ছবি ওগুলো।
‘এই ছবিটা একটু দেখুন।‘
উপরের দিক থেকে কয়েকটা ছবি তুলে নিল হেবার। যেটা সে রবার্টের হাতে দিল সেটা হচ্ছে ডেমিয়েনের প্রথম ন্যানির ছবি। বাড়ির সামনে তার সঙ সাজা জামা পরে একা দাঁড়িয়ে।
‘অস্বাভাবিক কিছু নজরে পড়ছে?’ জিজ্ঞেস করল হেবার।
‘নাহ্।’
হেবার ছবির ওপর আঙুল দিয়ে গলা আর মাথার চারপাশের অস্পষ্ট আলোর চাকতিটা দেখাল।
‘প্রথমে আমি ভেবেছিলাম ওটা বুঝি ছবির দোষ,’ বলল হেবার। ‘কিন্তু দেখুন পরেরটাতেও কিভাবে একই জিনিস উঠেছে।
চেসার ছাদ থেকে ঝোলার ছবিটা বের করে রবার্টের হাতে দিল সে।
‘কিছুতেই বুঝতে পারছি না আমি,’ বলল থর্ন।
‘ধৈর্য ধরুন—সবই বুঝবেন।‘
ছবিগুলো রেখে আরও কতগুলো ছবি বের করল সে। উপরের ছবিটাই ট্যাসোনের— পায়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে এমব্যাসি থেকে।
‘এইটা দেখুন।’
ছবিটা হাতে নিয়ে বোকার মত চেয়ে রইল রবার্ট।
‘এইটা কোথায় পেলে তুমি?’
‘তুলেছি,’ ছোট্ট জবাব দিল হেবার।
‘আমি তো জানতাম সে তোমার আত্মীয়, তুমি খুঁজছ ওকে।’
‘মিথ্যে কথা বলেছিলাম আমি। ছবিটা দেখুন!’
আঙুল দিয়ে এটারও মাথার কাছে রিঙটা দেখাল সে।
‘….ওই ছায়াটার কথা বলছ?’ জিজ্ঞেস করল থর্ন।
‘হ্যাঁ। এরপরে এইটা দেখুন, ওটার প্রায় দশদিন পরে তোলা এটা।’
একটা বড় করে এনলার্জ করা ছবি দেখাল হেবার। একটা হলের পিছন দিকের কয়েকজন দর্শককে দেখা যাচ্ছে ছবিতে। ট্যাসোনের মুখ দেখা যাচ্ছে না
একটা আলখাল্লা আর মাথার ওপর ওই রিঙটা দেখা যাচ্ছে।
‘আমার ধারণা এটাও আগের ছবির লোকটাই। মুখ দেখা যাচ্ছে না বটে কিন্তু মাথার ওপর রিঙটা নিশ্চয়ই চিনতে পারছেন?’
ছবিটা খুঁটিয়ে দেখল থর্ন—চোখে মুখে বিভ্রান্তি ফুটে উঠেছে তার।
‘আপনি যদি ওর মুখের আকারটা মনে মনে কল্পনা করেন তবে দেখবেন রিঙটা এই ছবিটাতে ট্যাসোনের মাথা ছুঁয়েছে। অর্থাৎ দশ দিনে রিঙটা কিছুটা নিচে নেমে এসেছে। ওটা যা-ই হোক—আরও কাছে এসেছে।
হতভম্বের মত ছবিটার দিকে চেয়ে রইল রবার্ট। ওর হাত থেকে ছবিটা নিয়ে তার বদলে আজকের কাগজে যে ছবিটা বেরিয়েছে সেটার একটা কপি ধরিয়ে দিল থর্নের হাতে।
‘যোগাযোগটা বুঝতে পারছেন?’ প্রশ্ন করল জেনিংস
রবার্ট স্থাণুর মত বসে রইল। অটোমেটিক টাইমারটা বেজে উঠতেই আর একটা বাতি জ্বেলে দিয়ে হেবার ঘুরে রবার্টের বিস্মিত চোখে চোখ রাখল।
‘ব্যাপারটা আমিও ঠিক বুঝতে পারিনি, এই কারণেই এর পিছনে লাগি আমি।’
চিমটা দিয়ে ট্রে থেকে এনলার্জ করা একটা ছবি তুলে নিল সে। একটু ঝাঁকিয়ে বাড়তি পানি ঝরিয়ে লাইটের সামনে ধরল ছবিটা।
‘আমার কিছু বন্ধুবান্ধব আছে পুলিশ বিভাগে। তারা আমাকে কিছু নিগেটিভ দিয়েছিল, সেগুলো থেকে এনলার্জমেন্ট তৈরি করেছি আমি। করোনারের রিপোর্টে দেখা গেছে অনেকদিন থেকেই ক্যানসারে ভুগছিল ট্যাসোন। দেহে অনেক মরফিন পাওয়া গেছে, দিনে দু’তিনবার সে মরফিন ইনজেকশন নিত।
ছবিগুলোর দিকে চেয়ে মুখ বিকৃত হয়ে গেল রবার্টের। তিন ভাগে পাদরীর দিগম্বর দেহের ছবি তোলা হয়েছে।
‘বাইরে থেকে তার দেহ ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক,’ বলতে লাগল হেরার। ‘কেবল তার বাম উরুতে একটা দাগ একটু অস্বাভাবিক।’
একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস এগিয়ে দিল হেবার। থর্ন খুঁটিয়ে দেখল ওই দাগটা। তার কাছে ওটা একটা ট্যাটুর মতই মনে হল।
‘ওটা কি?’ প্রশ্ন করল রবার্ট।
‘তিনটা ছয়। ছয়শো ছেষট্টি।’
‘….কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের নাম্বার?’
‘প্রথমে আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিছু মেডিক্যাল পরীক্ষায় জানা গেছে যে কেটে দাগটা তার দেহে বসানো হয়েছে। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ওরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করত না। আমার ধারণা দাগটা নিজেই কেটে সৃষ্টি করেছিল সে।’
দৃষ্টি বিনিময় হল ওদের। কিছুই বুঝতে পারছে না রবার্ট।
‘আর একটু ধৈর্য ধরুন,’ বলে হেবার আর একটা ছবি তুলে আনল ট্রে থেকে। এই ফ্ল্যাটটাতেই ট্যাসোন থাকত। কলে কেবল ঠাণ্ডা পানি আসে সোহোতে এমন একটা ফ্ল্যাট। আমরা যখন ঢুকি ইঁদুরে বোঝাই ছিল ঘরটা। একটা আধখাওয়া লোনা গরুর মাংসের টুকরো টেবিলে ফেলে গেছিল সে।’
ছবিটা দেখল রবার্ট। একটা ছোট্ট কামরা, আসবাব বলতে একটা বিছানা একটা ছোট টেবিল আর একটা টুল। দেয়ালে ওয়ালপেপারের বদলে সাঁটানো হয়েছে এক ধরনের কাগজ। এছাড়া ঘরটা ঝুলন্ত ক্রসে ভর্তি।
‘পুরো ঘরটাই এমনি। ঘরের সব দেয়াল, ছাদ, এমন কি দরজা জানালাও ওই রকম বাইবেলের পাতায় মোড়া। মনে হয় যেন একটা কিছুর ভয়ে সে নিজের চারদিকে দুর্গ তৈরি করে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিল।’
অদ্ভুত ছবিটার দিকে চেয়ে রইল থর্ন।
‘কেবল দরজার ওপরই চল্লিশটা ক্রস পেরেক দিয়ে লাগানো ছিল।’
‘সম্ভবত…ওর মাথায় দোষ ছিল…?’ প্রবোধ খুঁজছে রবার্ট।
সরাসরি তার চোখেচোখে চাইল হেবার।
‘আপনিই ভাল বলতে পারবেন সে সত্যিই অপ্রকৃতিস্থ ছিল কিনা!’
ড্রয়ার থেকে একটা দুমড়ানো ফোল্ডার বের করল হেবার।
‘পুলিশ ঘটনাটার বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। ঘরে বাকি যা ছিল তা থেকে আমার যা দরকার দিয়ে দিতে আপত্তি করেনি তারা। এইভাবেই এটা আমার হাতে এসেছে।’ উঠে বড় ঘরটায় চলে এল হেবার, পিছন পিছন রবার্টও। ফোল্ডার খুলে উত্তরের জিনিস সব টেবিলের ওপর ঢালল হেবার।
একটা ডায়েরী ওর ভিতর থেকে তুলে নিয়ে বলল, ‘এটা ওর ডায়েরী। কিন্তু এতে ওর নিজের কোন কথাই লেখা নেই। এতে আছে কেবল আপনার কথা। আপনি কয়টায় অফিসে যান, কখন বাড়ি ফেরেন, আর আপনার কোথায় কবে কোন্ মীটিং আছে সবই লেখা আছে এতে।’
‘কই দেখি?’
ডায়েরীটা বাড়িয়ে দিল হেবার। পাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখল রবার্ট।
‘এর শেষ পাতায় লেখা আছে আপনি ওর সাথে কিউ গার্ডেনে দেখা করবেন। কথাটা পুলিশ জানলে হয়ত আরও একটু বেশি মাথা ঘামাত এই ব্যাপারে।’
মুখ তুলে হেবারের চোখে চোখ রাখল রবার্ট।
‘ওর মাথা খারাপ ছিল,’ মন্তব্য করল রবার্ট।
‘তাই কি? সত্যিই আপনি তাই বিশ্বাস করেন?’ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে চাইল সে রবার্টের দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে কুঁকড়ে গেল সে।
‘কি চাও তুমি?’ প্রশ্ন করল রবার্ট।
‘আপনি দেখা করেছিলেন ওর সাথে?’
‘না।’
‘মিস্টার অ্যামব্যাসেডর, অনেক কথাই আমার বলার আছে-কিন্তু কোন কথাই আমি বলব না আপনি যদি সত্যি কথা না বলেন।’
‘এতে তোমার স্বার্থ কি?
‘বলতে পারেন বন্ধু। সাহায্য করতে চাই।’
চোখে চোখে চেয়ে রইল রবার্ট। বোঝার চেষ্টা করছে সে।
‘আপনি কি মন খুলে কথা বলবেন আমার সাথে, নাকি এখানেই কথার ইতি টানতে চাইছেন?’
দাঁতে দাঁত ঘষল রবার্ট।
‘কি জানতে চাও তুমি?’
‘পার্কে দেখা করেছিলেন আপনি ওর সাথে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কি বলল সে?’
‘আমাকে সাবধান করে দিয়েছিল।’
‘কি বিষয়ে?’
‘বলেছিল আমার জীবন বিপন্ন।’
‘কি রকম?’
‘…. পরিষ্কার কিছু বলেনি সে।’
‘গুল মারবেন না।’
‘মিথ্যা বলছি না আমি। ওর কথার মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝিনি আমি।’
একটু পিছিয়ে গিয়ে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে রবার্টের দিকে চেয়ে রইল হেবার।
‘বাইবেলের কথা…একটা কবিতা বলেছিল সে…ঠিক মনে নেই আমার। সত্যি বলছি কিছু বুঝিনি আমি।’
অবিশ্বাস ভরা চোখে চেয়ে আছে জেনিংস। ওই দৃষ্টির সামনে বিব্রত বোধ করছে রবার্ট।
আমাকে বিশ্বাস করে সব কথা বলতে পারেন।’
‘তুমি বলেছিলে আরও কথা আছে তোমার।
‘আপনি সব খুলে না বললে আমিও কিছু বলব না।‘
‘সবই বলেছি আমি—আমার আর কিছু বলার নেই।’
মাথা ঝাঁকিয়ে রবার্টের কথা মেনে নিয়ে মাথার উপরের বাল্বটা জ্বেলে দিল হেবার। টেবিলের ওপর থেকে একটা কাগজ বের করে রবার্টের হাতে দিল সে।
‘একটা মাসিক অ্যাস্ট্রোলজার পত্রিকা থেকে কাটা। একজন অ্যাস্ট্রোলজার ঘটনাটাকে ‘অস্বাভাবিক ঘটনা’ বলে অভিহিত করেছেন। একটা ধূমকেতু উজ্জ্বল তারার আকার ধারণ করেছিল। দু’হাজার বছর আগেকার বেথলেহ্যামের তারার মত।’
প্রবন্ধটা পড়ে দেখল রবার্ট। উপরের ঠোঁটে জমে ওঠা ঘাম মুছে সে হেবারের দিকে চাইল।
‘কিন্তু এই ঘটনাটা ঘটে পৃথিবীর অন্য একটা জায়গায়। ইউরোপে-ঠিক সাড়ে চার বছর আগে, ৬ জুন। তারিখটা পরিচিত মনে হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ,’ গম্ভীর গলায় জবাব দিল থর্ন।
তাহলে দ্বিতীয় কাগজটাও পরিচিত লাগবে আপনার কাছে।’ কাগজগুলোর মধ্য থেকে একটা বের করে রবার্ট-এর হাতে দিল হেবার। ‘এটা রোমের একটা কাগজের পিছনের পাতা থেকে নেয়া হয়েছে।’
হাতে নিয়েই চিনতে পারল রবার্ট। বাসায় ক্যাথির কাছেও আছে ওই কাটিং।
‘আপনার ছেলের জন্মের খবর। সেদিনটাও ছিল ৬ জুন সাড়ে চার বৎসর আগে। অদ্ভুত যোগাযোগ—তাই না?’
থরথর করে হাত কাঁপছে রবার্টের। হাতে ধরা কাগজটাও কাঁপছে সেই সাথে-পড়তে পারছে না সে একটা অক্ষরও।
‘আপনার ছেলে কি সকাল ছটায় জন্মেছিল?’
থর্ন বেদনার্ত চোখে চাইল হেবারের দিকে।
‘আমি পাদরীর ঊরুর দাগটা বোঝার চেষ্টা করছি। আমার মনে হয় আপনার ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে ওই সংখ্যাটার। ছয় নম্বর মাসে ছয় দিনের দিন…’
‘আমার ছেলে মারা গেছে,’ বলে উঠল রবার্ট। ‘আমার ছেলে মৃত, আমি জানি না কার ছেলেকে মানুষ করছি আমি।‘
দুহাতে মাথা ধরে অন্ধকারের দিকে ফিরল রবার্ট।
‘আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবে আপনাকে সাহায্য করতে চাই আমি।’
‘না,’ তাড়াতাড়ি বলে উঠল সে। আমার নিজস্ব সমস্যা এটা।’
‘আপনি ভুল করছেন।’ …নিচু গলায় বলল জেনিংস। ‘এখন সমস্যাটা আমারও।’
ডার্করূমে ঢুকে একটা ভিজে ছবি হাতে বেরিয়ে এল হেবার। রবার্টের দিকে সে এগিয়ে দিল ছবিটা।
‘পাদরীর ঘরের এক দিকে ছোট্ট একটা আয়না ছিল। ছবি তুলতে তুলতে আয়নায় প্রতিফলিত আমার নিজের একটা ছবিও উঠেছে।’
ছবিটার দিকে চেয়ে হতভম্ব হয়ে গেল রবার্ট।
‘অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না?’ প্রশ্ন করল হেবার
ছবিতে আয়নায় দেখা যাচ্ছে মুখের সামনে ক্যামেরা ধরে ছবি তুলছে হেবার। তার মাথার ওপর আলোর ঝাপসা একটা রিঙ।