অশুভ সংকেত – ১৩

তেরো

দুঃসংবাদটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল সারা লণ্ডনে—সেখান থেকে সারা বিশ্বে। ঘটনাটা পরিষ্কার নয়—নানা জনে নানা কথা বলছে। সাংবাদিকেরা সিটি হাসপাতালের ওয়েটিং রূমে ভিড় জমিয়েছে। ডাক্তারদের প্রশ্ন করে তারা আসল ঘটনা জেনে নেয়ার চেষ্টা করছে। ঘটনার দ্বিতীয় দিন সকালে হাসপাতালের একদল মুখপাত্র বসার ঘরটায় ঢুকল। টেলিভিশন ক্যামেরা আর সাংবাদিকেরা ব্যস্ত হয়ে উঠল যার যার কাজে। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন থেকে প্লেনে করে নিয়ে আসা হয়েছে এই ডাক্তারকে বিশেষ ধরনের অস্ত্রোপচার করার জন্যে। ঘোষণাটা তিনিই করলেন।

‘আমি ঘোষণা করছি যে আজ সকাল সাড়ে আটটায় আহত রোগীর জীবনের অবসান ঘটেছে। তাঁকে বাঁচাবার জন্য সব রকম চেষ্টাই করা হয়েছিল, কিন্তু ক্ষতটা এমনই মারাত্মক যে কিছুতেই কিছু করা গেল না।

সাংবাদিকদের মধ্যে একটা মৃদু গুঞ্জন উঠল। সেটা না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন ডাক্তার।

‘এই মুহূর্তে আর কোন বিবৃতি দেয়া হবে না। যেখানে ঘটনাটা ঘটে সেই অল সেইন্ট চার্চেই মৃতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।‘

.

কালো মৃতদেহ বইবার গাড়িটাতে দুটো কফিন পাশাপাশি শোয়ানো। সামনে দু’দিকে দু’জন পুলিশ মটর সাইকেলে করে পথ দেখিয়ে গাড়িটাকে নিয়ে যাচ্ছে হাইওয়ের পাশে কবরখানায়। প্রচুর লোকের ভিড় ওখানে। সিকিউরিটি গার্ড সব লোকজনকে ঠেকিয়ে রেখেছে। যারা কবর দেবে তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হল পাশাপাশি দুটো সদ্য খোঁড়া কবরের কাছে। ধবধবে সাদা আলখাল্লা পরা পাদরী অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জন্যে আমেরিকান পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। স্ট্র্যাপের ওপর বসানো হল কফিন দুটো। কবরস্থানের একজন কাজের লোক কফিন দুটোকে সামান্য একটু নিচে নামিয়ে কফিন নামানোর মেশিন ঠিকমত কাজ করছে কিনা পরীক্ষা করে দেখে নিল। অনুষ্ঠান আরম্ভ হল।

‘আমরা আজ ব্যথিত মনে জমায়েত হয়েছি এখানে,’ আরম্ভ করলেন তিনি। ‘আমাদের মাঝে থেকে দুজন অকালেই যাত্রা করেছেন অসীমের উদ্দেশ্যে। যারা চির বিশ্রাম নিতে গেছেন তাঁদের জন্যে দুঃখ করব না আমরা—করব যারা তাঁদের হারিয়ে মনে কষ্ট পাচ্ছেন তাদের জন্যে। জীবন যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, জীবন সম্পূর্ণ। তাঁরা যে কটা দিন আমাদের সাথে কাটিয়ে গেলেন সে জন্যে আমরা কৃতজ্ঞ।’

সবাই নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কেউ কাঁদছে, অন্যেরা সূর্যের আলো ঢাকছে হাত তুলে।

‘একজন মহান লোকের সন্তানকে আমরা বিদায় জানাচ্ছি আজ… ধনসম্পদ আর নিরাপত্তা নিয়ে জন্মেছিল সে…একটা মানুষের যা পার্থিব কামনা থাকতে পারে সবই পেয়েছে সে। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ধনসম্পদই সব নয়।‘

গেটের বাইরে থেকে সাংবাদিকেরা টেলিফটো লেন্স লাগিয়ে ছবি তুলছে। ওদের মধ্যে একটা ছোট দল একটু আলাদা দাঁড়িয়ে আলাপ করছে এই অদ্ভুত ঘটনামালা নিয়ে।

‘অকল্পনীয় ঘটনা—তাই না?’

‘আশ্চর্য হবার কি আছে? রাস্তায় মানুষ খুন হওয়াটা নতুন কিছু নয়।‘

‘যে লোকটা ওদের সিঁড়ির ওপর ধস্তাধস্তি করতে দেখেছিল… পুলিশে খবর দিয়েছিল তার কি হল?’

‘লোকটা মাতাল ছিল। রক্ত পরীক্ষা করে দেখা গেছে প্রচুর মদ গিলেছিল সে।’

‘আমি বুঝি না,’ তৃতীয় ব্যক্তি বলে উঠল। ‘ওরা ওই সময়ে চার্চে কি করতে গিয়েছিল?’

‘লোকটার বৌ মারা গেছে। হয়ত প্রার্থনা করতে এসেছিল ওরা।‘

মাথায় দোষ না থাকলে কেউ গির্জার সিঁড়িতে মানুষ খুন করতে যায়?’

‘বিশ্বাস কর এমন প্রচুর লোক আছে দুনিয়ায়।’

‘মনে হয় যেন কিছু চেপে যাচ্ছে ওরা।’

‘এমন চেপে যাওয়ার ঘটনা আজ প্রথম নয়।’

‘আর এটা শেষও না।’

কফিন দুটো কবরে নামানো হল। দুহাত আকাশের দিকে তুললেন পাদরী। শোকাচ্ছন্ন লোকের ভিতর একটা দম্পতি একটু আলাদা দাঁড়িয়েছে। সম্ভ্রান্ত চেহারা ভদ্রলোকের— পাশেই তার স্ত্রী কালো স্কার্ফ মাথায় দিয়ে দাঁড়ানো। একটা সাড়ে চার বছরের বাচ্চার হাত ধরে আছে মহিলা। ছেলেটার একটা হাত গলার সাথে স্লিঙ দিয়ে ঝুলানো।

আমরা রবার্ট আর ক্যাথেরিনকে তাদের চির বিশ্রামের জন্যে শুইয়ে দিলাম…’ বলে চললেন ফাদার, ‘এই মহান পরিবারের একমাত্র জীবিত ব্যক্তি হচ্ছে তাঁদের ছেলে ডেমিয়েন। এখন সে আর এক পরিবারে যাচ্ছে মানুষ হতে। বড় হয়ে সে তার বাবার মতই বিচক্ষণ আর মহান নেতা হবে, এই কামনাই করি।’

কবরের পাশে দাঁড়িয়ে শক্তভাবে মহিলার হাত আঁকড়ে ধরে কফিন দুটো কবরে নামানো দেখল ডেমিয়েন।

‘আমার কথা শেষ করার আগে আমি তোমাকে বলছি ডেমিয়েন থর্ন,’ আবার দুহাত আকাশের দিকে তুললেন পাদরী। ….ঈশ্বর তোমাকে আশীর্বাদ করুন, যীশু তোমাকে দিন তাঁর অনন্ত ভালবাসা।

পরিষ্কার মেঘবিহীন আকাশে দূর থেকে ভেসে আসছে মেঘের গুড় গুড় ডাক। ধীরে ধীরে লোকজন ফিরে যেতে আরম্ভ করল। সবার শেষে ধীর পায়ে তার নতুন বাবা-মা’র সাথে গিয়ে লিমোসিনে উঠে বসল ছেলেটা।

চারটে মোটর সাইকেলে করে রিপোর্টারদের পাশ দিয়ে লিমোসিনটাকে এসকোর্ট করে নিয়ে চলল পুলিশ। পটাপট ছবি তুলতে লেগে গেল ওরা। গাড়ির পিছন দিকের কাঁচের ভিতর দিয়ে বাচ্চাটা ঘাড় ফিরিয়ে চাইল। ওর সব কয়টা ছবিতেই আবছা একটা আলোর বৃত্ত দেখা যাবে মাথার ওপর।

কিন্তু লক্ষ্য করবে কি কেউ?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *