অশুভ সংকেত – ৪

চার

জুলাই মাসেই ইংলিশ গ্রামাঞ্চল ফুলে ফলে ভরে উঠল। লম্বা একটানা বৃষ্টির ফলে থেমস নদীর শাখা-প্রশাখা ভরে উপচে উঠেছে। অনেক শক্ত বীজও জলের সিক্ত ছোঁয়ায় অঙ্কুরিত হয়ে উঠেছে। পেরিফোর্ডের মাঠে ঘাটেও ফুটে উঠেছে হাজারও ফুল আর সবুজের সমারোহ। সেই সাথে জীব জীবনেও প্রাণ-প্রাচুর্য এসেছে। হর্টনের ভয় জঙ্গলের সব খরগোশ গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে টিউলিপ ফুল সব খেয়ে শেষ করবে। তাই জঙ্গলে অনেক ফাঁদ পেতে রেখে এসেছে সে। ফাঁদে পড়া জন্তুগুলোর বুকফাটা চিৎকার রাতের নৈঃশব্দ ভেঙে খান খান করে দেয়। কিন্তু ফাঁদ পাতা বন্ধ করতে হয়েছে হর্টনকে। থর্ন গিন্নীর মানা। জঙ্গলে ঢুকে জন্তুর অবশিষ্টাংশ সাফ করার সময়ে তার কেবলই মনে হয়েছে কেউ যেন চোখ রাখছে ওর ওপর। তার এই অনুভূতির কথা স্ত্রীকেও বলেছে সে। তবে কথা হেসে উড়িয়ে দিয়ে ঠাট্টা করে বৌ জবাব দিয়েছেঃ হয়ত রাজা পঞ্চম হেনরির ভূত নজর রাখছে তোমার ওপর। কিন্তু হাসতে পারেনি হর্টন—জঙ্গলে যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছে সে।

এই কারণেই নতুন ন্যানিকে প্রায়ই ডেমিয়েনকে সাথে নিয়ে জঙ্গলে যেতে দেখে স্বভাবতই সে বেশ চিন্তিত আর সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছে। ঘন্টার পর ঘন্টা যে ওরা জঙ্গলে কি নিয়ে কাটায় কিছুতেই মাথায় আসে না তার। স্ত্রীকে লট্রির কাপড় গুছাতে সাহায্য করতে গিয়ে হর্টন আবিষ্কার করেছে যে, ডেমিয়েনের জামা কাপড়ে প্রচুর কালো কালো লোম লেগে থাকে। মনে হয় জঙ্গলে সে কোন জন্তুর সাথে খেলা করে। অনেক ভেবেও এর কোন সুরাহা করতে না পেরে সে এটাও পেরিফোর্ড প্রাসাদের বহু দুর্বোধ্য রহস্যের মধ্যে একটা বলেই ধরে নিয়েছে।

ক্যাথি আর এখন ডেমিয়েনের সাথে সময় কাটানর সুযোগ পায় না। ভাল ন্যানি মিসেস বেল্‌ক। কিন্তু কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগে তার নিজের মায়ের চেয়েও ছেলেটা বেল্‌কের সান্নিধ্য বেশি পছন্দ করে। বাড়ির আর সব কর্মচারীরও চোখে পড়েছে এটা। ওদের মধ্যে এ নিয়ে কিছু আলাপ আলোচনাও হয়েছে। মায়ের ভালবাসা অন্য একজন কেড়ে নিচ্ছে বলে কেউ কেউ দুঃখও প্রকাশ করেছে। ওই মেয়েটা চলে গেলেই আবার শাস্তি আর স্বস্তি ফিরে পায় ওরা। কিন্তু ওদের আশার গুড়ে বালি দিয়ে দিন দিন নিজের জায়গাটা আরও প্রতিষ্ঠিত করে নিচ্ছে মিসেস বেল্‌ক।

ক্যাথি নিজেও অনুভব করছে এটা। কিন্তু নিজেকে বড় অসহায় মনে হয় তার। চেসার মৃত্যুর পরে ঈর্ষা করলে আবার একটা অনর্থ ঘটতে পারে এই ভয়ে সে কুঁকড়ে থাকে। দ্বিতীয় সপ্তাহে মিসেস বেলুক যখন নিজের নিচের তলার ঘরটা বদলে তিনতলায় ডেমিয়েনের উল্টো দিকের ঘরে থাকার অনুমতি চাইল—আপত্তি করেনি ক্যাথি। হয়ত বড় লোকদের মধ্যে এটাই রীতি। ক্যাথি নিজে যে পরিবেশে মানুষ হয়েছে সেখানে সবসময়েই মা’কে নিজেই নিজের ছেলেমেয়ের দেখাশোনা করতে দেখেছে সে। কিন্তু এখানে সে অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারের গৃহিণী—সেরকম উপযুক্ত আচার-ব্যবহারও তার করা উচিত।

তার এই বাড়তি সময়টাকে সে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে সচেষ্ট হল। এতে স্বামীরও আন্তরিক সমর্থন পাচ্ছে সে। সকালটা সামাজিক কল্যাণের কাজে, আর বিকেলটা কূটনৈতিক চায়ের আসরে কাটে তার। এখন সে আর সেই ঘরে আবদ্ধ কোমল বৌটি নেই, সবসময়েই যেন নিজের ভিতর থেকে শক্তি আর সাহস পাচ্ছে সে। মনে মনে রবার্ট ঠিক এমন স্ত্রীই কামনা করেছিল তার মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে। ক্যাথির হঠাৎ এই পরিবর্তনে একটু অবাক হলেও পরিবর্তনটাকে খুশি মনেই স্বাগত জানাল সে। তাদের ভালবাসাও এখন আরও গভীর হয়েছে। এমনকি এখন যেন রাতে বিছানাতেও ক্যাথি তাকে নতুন রূপে নতুন উদ্যমে ভালবাসা দিয়ে উন্মত্ত করে তোলে। সে জানে না, ক্যাথির এই পরিবর্তনের মূলে কাজ করছে সুখকে একবার হাতের মুঠোয় পেয়ে হারানোর ভয়। সে চায় সেটাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে।

রবার্টের ব্যস্ততার দিন চলছে এখন। লণ্ডনের এই কাজটায় তার কাঁধে একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পড়েছে। প্রেসিডেন্ট তেল সঙ্কট সংক্রান্ত খবরাখবরের জন্যে ধীরে ধীরে রবার্টের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। রবার্ট সব খবর সংগ্রহ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন শেখের সাথে ঘরোয়া বৈঠকে। কিছুদিনের মধ্যেই রবার্টকে যেতে হবে ইরানে-একা। বৌ নিয়ে ট্যুরে যাওয়াটা তেলের মালিক শেখদের চোখে দুর্বল চিত্ত পুরুষের লক্ষণ।

‘এর পেছনে কি যুক্তি ঠিক বুঝতে পারলাম না আমি,’ রবার্টের কাছে সব শুনে বলে উঠল ক্যাথি।

‘এটা একটা কৃষ্টির ব্যাপার,’ জবাব দিল রবার্ট। আমি ওদের দেশে যাচ্ছি, আমাকে ওদের দেশের সংস্কৃতিকে মেনে চলতে হবে বৈকি!’

আমাদের দেশের কৃষ্টি আর সভ্যতাকেও কি ওদের সম্মান দেখানো উচিত নয়?’

‘অবশ্যই তারা…’

‘আমি কি আমাদের সংস্কৃতির বাইরে?’

‘ক্যাথি…’

‘শেখদের দেখেছি আমি, দেখেছি ওদের মেয়ে কিনতে। ওরা যেখানেই যায় ওদের ঘিরে থাকে একদল বেশ্যা। তোমাকে দিয়েও কি তাই করাতে চায় ওরা?’

‘সত্যি কথা বলতে কি, ঠিক জানি না আমি।

রাত হয়েছে বেশ——শোবার ঘরেই কথা হচ্ছে ওদের। এটা কোন লম্বা যুক্তি—তর্কে নামার উপযুক্ত সময় মোটেই নয়।

‘জানো না, তার মানে?’ শান্ত স্বরেই জিজ্ঞেস করল ক্যাথি।

‘বোঝ না কেন, ক্যাথি? এটা একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার।‘

‘ওরা যদি চায় তুমি ওইসব একটা মেয়ের সাথে রাত কাটাবে?’

‘ওরা চাইলে তাই করতে হবে আমাকে—স্বার্থ জড়িয়ে আছে এর সাথে।

বেশ কতক্ষণ মুখে কথা জোগাল না ক্যাথির। কথার রূঢ় ঝাপটাটা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠে ক্ষীণ গলায় সে জিজ্ঞেস করল, ‘এসবের মধ্যে আমার জায়গা কোথায়?’

‘এখানেই,’ জবাব দিল রবার্ট। ‘তোমার এখানকার যা কাজ সেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

‘থাক, আর তোয়াজ করে ভোলাতে হবে না আমাকে।’

‘না, তা না, তোমাকে আমি বোঝাতে চেষ্টা করছি…’

‘যে ওদের কথামত চলে পৃথিবী উদ্ধার করবে তুমি?’

‘ব্যাপারটা অনেকটা তাই।‘

এভাবে এর আগে আর কোনদিন তার দিকে চায়নি ক্যাথি। কঠিন ঘৃণাভরা দৃষ্টি। ওই দৃষ্টির সামনে বিব্রত হল রবার্ট।

‘হয়ত আমরা সবাই বেশ্যা, রবার্ট। তুমি ওদের, আর আমি তোমার। চল এবার ঘুমোতে যাই।’

অনেকক্ষণ সময় কাটাল রবার্ট বাথরূমে, ইচ্ছে করেই। ভেবেছিল বেরিয়ে দেখবে ঘুমিয়ে পড়েছে ক্যাথি। কিন্তু ভুল ভাঙল তার, ক্যাথি জেগে বসে আছে তারই প্রতীক্ষায়। বাতাসে মৃদু সুবাসের গন্ধ টের পেল রবার্ট। বিছানার ধারে এসে বসল সে। অপলক চোখে ক্যাথিকে দেখছে। মিষ্টি করে হাসল ক্যাথি

‘ভুল বুঝো না,’ বলল সে। ‘আমি অবুঝ না।’

দু’হাতে রবার্টের মাথা ধরে নিজের বুকে টেনে নিল সে। শ্বাস ভারি হয়ে আসছে ক্যাথির। রবার্টকে জাপটে ধরে রেখেছে ও। আজ ওর স্বর সাড়া দিলেও দেহ সাড়া দিচ্ছে না মোটেও—কিন্তু রবার্টকে ছাড়ছেও না সে। এমন আচরণ আগে কোনদিন করেনি ক্যাথি। কোনমতে দায় সারল রবার্ট-ক্যাথিও ছেড়ে দিল ওকে। উঠে বসে ব্যথিত অভিমানে চাইল সে ক্যাথির দিকে

‘যাও, এবার পৃথিবী উদ্ধার কর গিয়ে,’ ফিসফিস করে বলল ক্যাথি। ‘যাও, ওরা যা বলে তাই কর গিয়ে।’

সেই রাতে আর ঘুম এল না রবার্টের। চওড়া দরজাটার সামনে চেয়ার নিয়ে চাঁদের আলোয় বনের দিকে চেয়ে বসে রইল সে। নিশ্চল নিশ্চুপ ঘুমিয়ে আছে জঙ্গলটা।

চেয়ে থাকতে থাকতে কেন যেন বারবার তার মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে নেই ও—চোখ মেলে তারই দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। উঠে পাখি দেখার দূরবীনটা নিয়ে এল রবার্ট। ওটা চোখে দিয়েও আবছা অন্ধকার ছাড়া কিছুই নজরে পড়ল না তার। তারপরই সে দেখল দুটো হলদেটে ছোট জিনিস জ্বলজ্বল করছে চাঁদের আলোয়। কাছাকাছি বসানো হলুদ চোখদুটো একদৃষ্টে চেয়ে আছে এই বাড়িটার দিকে। নিজের অজান্তেই শিউরে উঠল সে। তাড়াতাড়ি ঘরের ভিতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল রবার্ট। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কি ভেবে নিচে নেমে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এল সে। চারদিক একেবারে নিঝুম ঝিঁঝি পোকাও আর ডাকছে না। একটু ইতস্তত করে এগিয়ে চলল সে জঙ্গলের দিকে এক অজানা টানে। জঙ্গলের ধারে এসে থামল। চাঁদের অস্পষ্ট আলোয় গভীর মনোযোগের সাথে লক্ষ্য করছে রবার্ট বনের ভিতরটা কোথাও কিছু নেই। সেই জ্বলন্ত চোখ দুটো উধাও হয়েছে। খালি পায়েই বেরিয়ে এসেছিল সে। ঘুরে বাড়ির দিকে রওনা হতেই পায়ের তলায় নরম আর ভিজে কি যেন পড়ল। রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে পড়ল রবার্ট। একটা খরগোশ। গা-টা এখনও গরম। মাথাটা যেখানে ছিল তার পাশেই ঘাস ভিজে আছে তাজা রক্তে।

পরদিন সকালেই সে হর্টনকে ডেকে জিজ্ঞেস করল সে এখনও বনে ফাঁদ পাতে কিনা। জবাব শুনে তাকে গতরাতের সেই জায়গায় নিয়ে গেল রবার্ট। তখনও ওখানে খরগোশটার অবশিষ্টাংশ পড়ে রয়েছে। মাছি ভনভন করছে ওটার গায়ে। জুতো দিয়ে মাছি সরিয়ে হর্টন ওটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল আরও ভাল করে পরীক্ষা করে দেখার জন্যে।

‘কি মনে হয় তোমার?’ প্রশ্ন করল রবার্ট। ‘বনে কোন শিকারী-টিকারী আছে?’

‘বলতে পারব না, স্যার। তবে আমার যতদূর বিশ্বাস নেই। শক্ত হয়ে যাওয়া দেহটা একটু উঁচিয়ে ধরে হর্টন আঙুল দিয়ে নির্দেশ করল, ‘শিকারী হলে মাথাটাই ফেলে যেত। কিন্তু দেখুন এর মাথাটাই কেবল খোয়া গেছে। যেই মারুক, নিছক একটা মজার খেলা হিসেবেই হত্যা করেছে ওকে।’

হর্টনকে এই ব্যাপারে বাসার কাউকে কিছু না জানানোর নির্দেশ দিয়ে রবার্ট বলল সে যেন ওটার ঝটপট একটা কিছু ব্যবস্থা করে ফেলে। বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েই পিছু ডাক শুনে আবার থামল রবার্ট

‘বন-জঙ্গল আমার খুব পছন্দ নয়, স্যার, আর আপনার ছেলে ডেমিয়েনকে মিসেস বেল্‌কের রোজ এখানে বেড়াতে নিয়ে আসাটাও আমি খুব ভাল চোখে দেখি না।’

‘মানা করে দিয়ো,’ জবাব দিল সে। ‘এখানে চারপাশের খোলা জায়গায়ই অনেক খেলা যায়।’

দুপুরে হর্টন তার নির্দেশ অনুযায়ী মিসেস বেল্‌ককে কর্তার হুকুম জানিয়ে দিল। সেদিনই রবার্ট টের পেল বাড়িতে কেমন যেন বিশৃঙ্খলা চলেছে। সন্ধ্যার পরে মিসেস বেল্‌ক বৈঠকখানায় এসে অসন্তোষের সাথে জানাল যে সে মনিবের আদেশ আর একজন কর্মচারী মারফত পাওয়া পছন্দ করে না।

‘আদেশ আমি নিশ্চয়ই মেনে চলব,’ বলল বেল্‌ক। ‘কিন্তু সেটা আমি আপনার কাছ থেকে সরাসরি পেতে চাই।’

‘আমি তো কোন তফাৎ দেখি না,’ জবাব দিল রবার্ট। মহিলার চোখের দিকে চেয়ে ভীষণ অবাক হল সে রাগে আগুন ঝরাচ্ছে ওর চোখ দুটো।

তফাতটা কুলীন আর সাধারণ বাড়ির, থর্ন সাহেব। মনে হয় যেন এই বাড়িতে নির্দিষ্ট কোন মনিব নেই।’ জবাবের অপেক্ষা না করে ঝট্ করে ঘুরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।

রবার্ট চিন্তামগ্ন হল। কি বোঝাতে চায় এই মহিলা? তার ধারণা তার অবর্তমানে ক্যাথিই কর্ত্রী। কিন্তু…কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে এর ধারণা ভিন্ন।

.

চেলসির ঘিঞ্জি ফ্ল্যাটে হেবার জেনিংস তার নিজস্ব ছোট্ট ডার্করুমে ঝুলানো থর্ন পরিবারের ছবিগুলো পরীক্ষা করছে। গোরস্থানে তোলা ছবিগুলোও রয়েছে অসংখ্য ছবির মধ্যে। স্মৃতিফলকের ফাঁকে কুকুর, ডেমিয়েনের ক্লোসআপ, সেই সাথে জন্মদিনের তোলা ছবিগুলোও। ক্যাথি ন্যানির দিকে চেয়ে আছে, সঙের সাজে ন্যানির একা তোলা ছবি—এই পরের ছবিটাই বিশেষ করে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। কেমিক্যালের কোন ত্রুটির জন্যেই হয়ত ছবিটা যেন কেমন ঝাপসা এসেছে, গলা আর মাথার চারধারে একটা আলোর আংটার মত একটা কিসের ছাপ দেখা যাচ্ছে। ছবিতে কোন ত্রুটি থাকলেই হেবার সেটা ফেলে দেয়—কিন্তু এটা রাখতে হবে। এই ছবিটা তোলার অল্প পরেই যা ঘটেছে তাতে ওই আলোর রিং এই ছবিটাকে যেন আধ্যাত্মিকতার স্পর্শ দিয়ে অর্থপূর্ণ করে তুলেছে! শেষ ছবিটাতে চেসার দেহ দড়িতে ঝুলছে। নাটকের শেষ অঙ্ক!

থর্ন পরিবারের পিছনে আদা-জল খেয়েই লেগেছে হেবার। ইতিমধ্যেই সে আমেরিকায় পরিচিত একজনের কাছে লিখে ওদের পূর্বপুরুষের খবরাখবর নিয়েছে। ক্যাথির বাপ-মা রাশান রিফিউজি। মিনাপোলিস অফিসের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে তার বাবা আত্মহত্যা করে। তার একমাস পরেই ক্যাথির জন্ম। এক বছরের মধ্যেই ক্যাথির মা আবার বিয়ে করে। বাচ্চার নামকরণও সে-ই করে। আজ পর্যন্ত অনেক সাক্ষাৎকারই দিয়েছে ক্যাথি কিন্তু কোনদিনও তাকে সৎবাপের কথা উল্লেখ করতে শোনা যায়নি। হেবারের ধারণা, হয়ত সে নিজেই জানে না। এটা এমন কিছু তথ্য নয়, তবু সে খুব উৎসাহিত বোধ করছে। তার মনে হচ্ছে কিছুটা যেন ভিতরে ঢুকতে পেরেছে সে।

একটা ছবি তোলা তার বাকি রয়ে গেছে, সেটা হচ্ছে স্বয়ং রবার্টের। হেবার মনে মনে ঠিক করে রেখেছে আগামীকাল ‘অল সেইন্টস চার্চে’ যে রাজকীয় বিয়ে হবে সেখানেই রবার্টের ছবি তুলবে সে। ওই বিয়েতে থর্ন পরিবার উপস্থিত থাকবেই।

বিয়ের আগের দিন শনিবার রবার্ট তার অফিসের টুকিটাকি কাজ জলদি সেরে ক্যাথিকে নিয়ে বেড়াতে বেরুল গাড়িতে। সেই রাতের বচসা আর পরে বিছানায় ক্যাথির অদ্ভুত আচরণ রবার্টকে খুব নাড়া দিয়েছে। কিছুটা সময় ওর সাথে একা কাটিয়ে রবার্ট নিজেদের ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতে চায়। ঠিক এটাই দরকার ছিল। কয়েক মাসের মধ্যে আজই প্রথম ক্যাথিকে স্বাভাবিক আর উৎফুল্ল মনে হচ্ছে। রবার্টের হাতে হাত রেখে পুরোপুরি উপভোগ করছে সে আজকের এই বেড়ানো। দুপুর নাগাদ ওরা পৌঁছে গেল স্ট্র্যাটফোর্ড-অন-এভনে। দুপুরে ‘কিংলিয়ার’ দেখল ওরা ম্যাটিনি শো’তে। নাটক দেখে অভিভূত হয়ে অঝোরে কাঁদল ক্যাথি। ‘একটা কুকুরের, ইঁদুরেরও শ্বাস স্বাভাবিক ভাবেই চলছে.. কিন্তু তোমার শ্বাস কেন রুদ্ধ?’ নাটকের এই কথাটা ক্যাথির মনের গভীরে ভীষণ আলোড়ন তুলেছে। নাটকের মাঝে, এমন কি নাটক শেষ হবার পরেও অনেকক্ষণ নানান ভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তবে শেষ পর্যন্ত ক্যাথিকে শান্ত করতে পেরেছে রবার্ট।

গাড়িতে উঠে বসতেই গাড়ি ছেড়ে দিল। পরস্পরের হাত ধরে ওরা পিছনের সিটে বসেছে নিবিড় হয়ে। অনেকদিন তারা, এমন আপন করে পায়নি একে অন্যকে। অত্যন্ত ভাবপ্রবণ হয়ে উঠেছে এখন ক্যাথি। একটা ছোট্ট ঝর্নার ধারে গাড়ি থামাতেই আবার তার চোখ সজল হয়ে উঠল। ডেমিয়েনকে হারাবার ভয়েই সে সবচেয়ে বেশি বিচলিত। বলল ওকে হারালে আর সে বাঁচবে না।

‘ডেমিয়েনকে হারাবার ভয় হচ্ছে কেন, ক্যাথি?’ শান্ত সুরে বলল রবার্ট। ‘জীবন আমাদের প্রতি এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে না।’

বিশাল ওকের ছায়ায় ঘাসের ওপর বসল ওরা। জলের ধারার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে ক্যাথি।

‘খুব ভয় লাগে আমার… খুবই ভয় লাগে সবসময়…’

আসলে কিন্তু ভয়ের কিছুই নেই।’

‘তবু আমার সব কিছুতেই ভয় লাগে।‘

‘ভয়ের কি আছে, বল?’

‘ভয়ের কী নেই?’

ওর দিকে চেয়ে সে আরও কিছু বলবে বুঝে অপেক্ষা করতে লাগল রবার্ট।

‘ভালকে আমার ভয়, কারণ ভাল বেশিদিন থাকবে না…মন্দকে আমার ভয় কারণ আমি দুর্বল, আঘাত সইতে পারব না আমি। সাফল্যকে আমার ভয়, আবার ব্যর্থতাকেও ভয়। আমার মনে হয় এর কোনটাতেই আমার করণীয় কিছুই নেই। আমার ভয়, তুমি একদিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবে…কিন্তু তোমার পাশে থাকতে হবে আমাকে, যোগ্যতাহীন স্ত্রী!

‘এতদিন তুমি চমৎকার চালিয়ে এসেছ,’ আশ্বাস দিল রবার্ট।

‘কিন্তু প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে দুর্বিষহ ঠেকেছে।’

খোলাখুলি সহজ সরল স্বীকৃতি। কিন্তু এর আগে কোনদিন সে এমন কোন আভাস দেয়নি। এতে তার মন কিছুটা হাল্কা হল।

‘খুব আঘাত পেলে, না?’

‘কিছুটা,’ জবাব দিল রবার্ট।

‘আমি সবচেয়ে বেশি কি চাই জানো?’

রবার্ট মাথা নাড়ল।

‘সবাই মিলে বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করে আমার।’

গাছের নিচে ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে উপরে গাছের পাতাগুলোর দিকে চেয়ে রইল রবার্ট।

‘এর চেয়ে বেশি আর কিছুই চাই না আমি। একটা যেন নিরাপত্তা আছে ওখানে যা অন্য কোথাও পাই না। ওই পরিচিত পরিবেশে সব কিছুকেই আপন বলে মনে হয় আমার।’

অনেকটা সময় নীরবে কাটল। ক্যাথিও রবার্টের পাশে গা ঘেঁষে ওর বুকের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ল।

‘এখানটাও নিরাপদ,’ মৃদুস্বরে বলল ক্যাথি। ‘তোমার বুকের মধ্যে!’

চোখ বুজে ক্যাথির পিঠে একটা হাত রেখে চুপচাপ শুয়ে রইল রবার্ট।

‘এটা তো নিউ জার্সি, তাই না?’ নিচু গলায় বলল ক্যাথি।—ওই যে পাহাড়টা, ওটার ওপাশেই তো আমরা অবসর নেয়ার পর যেখানে থাকব সেই ফার্ম?’

‘পাহাড়টা অনেক উঁচু, ক্যাথি।

‘জানি, জানি। আমরা কোনদিনই ওই পাহাড় পেরোতে পারব না।’

বাতাসটা একটু জোরাল হল। উপরে গাছের পাতাগুলো সরসর শব্দ করছে। পাতার ফাঁক দিয়ে গলে আসা রোদ ওদের গায়ে নেচে নেচে খেলে বেড়াচ্ছে।

‘হয়ত ডেমিয়েন পারবে,’ অনেকটা স্বগতোক্তির মতই বলল রবার্ট। ‘কে জানে, ওর ভিতরে হয়ত নবীন কৃষক হওয়ার ইচ্ছে ঘুমিয়ে আছে?’

‘তেমন কোন সম্ভাবনা নেই। তোমারই একটা খুদে সংস্করণ হয়েছে ও।’ একথার কোন জবাব দিল না রবার্ট। পাতাগুলোর দিকে চুপ করে চেয়ে রইল।

‘ঠিকই তাই—আমার কণামাত্রও ওর মধ্যে খুঁজে পাই না আমি। যেন পেটেই ধরিনি আমি।’

রবার্ট কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে মাথা উঁচু করে পাশ ফিরে ক্যাথির বিষণ্ণ মুখটা লক্ষ্য করতে লাগল।

‘এমন বলছ কেন?’ প্রশ্ন করল সে।

কাঁধ ঝাঁকাল ক্যাথি। নিজেকে প্রকাশ করার কথা খুঁজে পাচ্ছে না সে।

‘সবসময় আপন মনেই থাকে ডেমিয়েন। যেন কাউকেউ ওর কোন প্রয়োজন নেই।

‘ওকে বাইরে থেকে দেখে হয়ত এমন মনে হয়।

মায়ের সাথে ছেলের যেমন নাড়ির যোগ থাকে, মনে হয় যেন ওর সাথে তা নেই আমার। মা’কে ভালবাসতে তুমি?’

‘হ্যাঁ।’

‘আর বৌকে?’

ক্যাথির চোখে চোখ রেখে আদর করে ওর গালে হাত বুলিয়ে দিল রবার্ট জবাবে ওর হাতে চুমো খেল ক্যাথি।

‘এইভাবে এইখানে যদি সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারতাম, আমি আর কিছুই চাইতাম না।’ মুখ তুলে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ক্যাথির ঠোঁট রবার্টের ঠোট ছুঁল।

তুমি তো জানো, ক্যাথি,’ অনেকক্ষণ নীরব থাকার পরে মুখ খুলল রবার্ট। ‘তোমার সাথে প্রথম দেখায় আমার মনে হয়েছিল তুমিই পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা সুন্দরী।’

পুরানো কথা ভেবে একটু হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল সে।

‘এখনও আমি তাই ভাবি,’ গলায় সবটা দরদ ঢেলে বলল রবার্ট। সত্যিই

তাই। আমার ধারণা একটুও বদলায়নি।’

ক্যাথির ঠোঁট দুটো পরস্পরের ওপর চেপে বসল। চোখের বন্ধ পাতা দুটোর ভাঁজ সামান্য ভিজে উঠেছে।

আর কথা বলে আমার আবেশটা নষ্ট করে দিয়ো না,’ ফিসফিস করে রবার্টকে অনুরোধ জানাল ক্যাথি। ‘তোমার বলা কথা কয়টা আমি চিরজীবনের সম্পদ করে ধরে রাখতে চাই।’

চোখ বুজে চুপচাপ পড়ে রইল ক্যাথি। শেষ পর্যন্ত যখন সে চোখ খুলল তখন ওদের চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে।

.

পরদিন সকালেই আবার রোদের দেখা পাওয়া গেল। সুন্দর ঝলমলে উজ্জ্বল দিন। ন’টার মধ্যেই বিয়েতে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে নিচে নামল রবার্ট।

‘ক্যাথি?’ হাঁক ছেড়ে ডাকল সে।

‘এই যে, আর একটু,’ উপর থেকে ক্যাথির জবাব এল।

‘পৌছতে দেরি হয়ে যাবে আমাদের।‘

‘এই যে, হয়ে গেছে আমার।’

‘হয়ত ওরা আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে, আমাদের সাধ্যমত তাড়াতাড়ি পৌঁছবার চেষ্টা করা দরকার।’

‘সে চেষ্টাই তো করছি।

‘ডেমিয়েন তৈরি তো?’

‘আশা তো করি।’

আর দেরি করা যায় না।’

‘মিসেস হর্টনকে আমাদের জন্যে কিছু রুটি টোস্ট করতে বল।’

‘টোস্ট আর খাব না আমি এখন।’

‘আমি খাব।’

‘ঠিক আছে, জলদি কর।’

ইতিমধ্যেই হর্টন বাড়ির সামনে গাড়ি বারান্দায় লিমোসিনটা এনে জায়গামত দাঁড় করিয়েছে। রবার্ট দরজা থেকে এক পা বেরিয়ে ওকে একটু অপেক্ষা করতে ইশারা করেই রান্নারঘরের দিকে গেল হন্তদন্ত হয়ে।

ক্যাথি তার সাদা জামার ফিতেটা বাঁধতে বাঁধতে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে ডেমিয়েনের ঘরের দিকে যেতে যেতে ডাকল।

‘ডেমিয়েন, চল। আমরা সবাই তৈরি।’

ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়াল সে-ঘরে কেউ নেই। বাথরূম থেকে পানির শব্দ আসছে! তাড়াতাড়ি বাথরূমের দিকে এগোল ক্যাথি। ভিতরের দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল সে। ডেমিয়েন বাথটবে বসে খেলছে আর মিসেস বেল্‌ক নিশ্চিন্ত মনে ধীরে-সুস্থে ওকে গোসল করাচ্ছে।

‘মিসেস বেল্ক!’ গর্জে উঠল ক্যাথি। ‘আমি তোমাকে বলেছিলাম ওকে গোসল করিয়ে তৈরি…’

কিছু মনে করবেন না, ম্যাডাম, আমার মনে হয় বিয়ের চেয়ে ওর পার্কে যেতেই বেশি ভাল লাগবে।’

‘তোমাকে বলেছি আমরা চার্চে নিয়ে যাব ওকে।

‘ছোট বাচ্চা তো…এমন সুন্দর একটা দিনে গির্জায় যাবে কোন্ দুঃখে?’ হাসছে মেয়েটা, যেন দোষের কিছুই হয়নি।

কিন্তু ওকে আমাদের সাথে আজ চার্চে যেতেই হবে।

‘এত ছোট মানুষ চার্চে নিয়ে গেলে ও কেবল ঝামেলাই বাধাবে।’

মেয়েটার কথায় এমন সরাসরি অবাধ্যতা যে রাগে দাঁত কিড়মিড় করে উঠল ক্যাথির। ঠাণ্ডা কঠিন গলায় সে বলল, ‘বুঝতে পারছ না তুমি আমি চাই ডেমিয়েন আমাদের সাথে গির্জায় যাবে।’

ক্যাথির গলার সুর শুনে একটু আড়ষ্ট হয়ে গেল মিসেস বেল্‌ল্ক। ডেমিয়েনও কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছে। সে ন্যানির কাছে আর একটু ঘেঁষে বসল। মাটিতে বসেই মুখ তুলে ক্যাথির দিকে চাইল বেল্‌ল্ক।

‘আগে কোনদিন গির্জায় গেছে ও?’ জিজ্ঞেস করল সে।

‘তার সাথে এর কি সম্পর্ক আছে তা আমি…’

‘ক্যাথি?’ নিচ থেকে রবার্টের গলা শোনা গেল।

‘এক মিনিট!’ চেঁচিয়ে জবাব দিল ক্যাথি।

কঠিন দৃষ্টিতে চাইল ক্যাথি বেলুকের দিকে। উত্তরে সে শাস্ত চোখেই চেয়ে রইল ক্যাথির দিকে।

‘এক্ষুনি কাপড় জামা পরিয়ে তৈরি করে দাও ওকে,’ আদেশ দিল ক্যাথি।

সরল ভাবে মনের কথা বলে ফেলার জন্যে আমি দুঃখিত, কিন্তু আপনি কি মনে করেন ক্যাথলিক বিয়ের ওই সব দুর্বোধ্য আনুষ্ঠানিকতা দেখতে একটা চার বছরের বাচ্চা ছেলের ভাল লাগবে?’

লম্বা করে একটা শ্বাস নিল ক্যাথি।

‘আমি একজন ক্যাথলিক, মিসেস বেল্‌ক। আমার স্বামীও তাই।’ চিবিয়ে চিবিয়ে কথা কয়টা বলল ক্যাথি।

‘হ্যাঁ, কাউকে তো ক্যাথলিক হতেই হবে,’ কটকট করে জবাব দিল মোটা মেয়েটা। এমন মুখের ওপর জবাব দেয়া দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেছে ক্যাথি।

আমার ছেলেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমি গাড়িতে তৈরি অবস্থায় দেখতে চাই আর তা না হলে এখন থেকেই অন্য চাকরির চেষ্টা করতে হবে তোমাকে।

‘হয়ত তাই আমি করব।‘

‘তোমার খুশি।

‘ভেবে দেখি।

‘ভাল করে ভেব।’

নিচে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল ক্যাথি। অস্বস্তিকর একটা পরিস্থিতি।

‘গির্জায় যাওয়ার ব্যাপারে…’ আরম্ভ করল বেল্ক।

‘কি বলবে বল?’

‘ওকে নিয়ে গেলে পরে পস্তাবেন।‘

জবাব না দিয়ে ক্যাথি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই জামা কাপড় পরে তৈরি হয়ে গাড়ির দিকে আসতে দেখা গেল ডেমিয়েনকে।

নতুন হাইওয়ে তৈরি হচ্ছে শেপারটনের কাছে ট্র্যাফিক জ্যামের মধ্যে পড়ল ওরা। গাড়ির ভিতরকার নীরবতা আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠল।

‘কি হয়েছে?’ ক্যাথির মুখের ভাব লক্ষ্য করে জানতে চাইল রবার্ট।

‘এমন কিছু না।’ এড়িয়ে যেতে চাইল সে।

‘মুখ দেখে মনে হচ্ছে রেগে আছ তুমি?’

‘স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করছিলাম।’

‘ঘটনা কি?’

‘এমন কিছু না।

‘বল, চেপে রেখ না, মনটা হাল্কা হবে।

‘মিসেস বেল্‌ক…’ ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল ক্যাথি।

‘ওর কি হয়েছে আবার?’

আমাদের একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে।’

‘কি নিয়ে?’

‘ও ডেমিয়েনকে পার্কে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।‘

তাতে দোষের কি হল?’

‘আজকে চার্চের বদলে পার্কে নিতে চেয়েছিল।’

‘বাচ্চার জন্যে হয়ত সেটাই বেশি উপভোগ্য হত।’

‘ওর যেন আজ চার্চে আসা না হয় সেজন্যে সব রকম চেষ্টা করেছে। ‘ডেমিয়েনকে ছাড়া হয়ত ওর একা একা লাগে।’

‘সেটা কি ভাল?’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে বাইরে সারি সারি গাড়ির দিকে চাইল রবার্ট। ইঞ্চি ইঞ্চি করে আগে বাড়ছে সব গাড়ি।

‘ঘুরে এসব কাটিয়ে এগিয়ে যাবার কোন উপায় নেই, হর্টন?’

‘না, স্যার,’ জবাব দিল সে। ‘যদি আপনি কিছু মনে না করেন তবে মিসেস বেল্ক সম্পর্কে আমার বক্তব্য আমি বলতে পারি।’

রবার্ট আর ক্যাথির দৃষ্টি বিনিময় হল হর্টনের এই অদ্ভুত কথায়।

‘বল, কি বলার আছে তোমার?’

‘মাস্টার থনের সামনে বলতে বাধছে আমার।’

চট করে ক্যাথি একবার ডেমিয়েনের দিকে চেয়ে দেখল নিজের নতুন জুতোর ফিতে নিয়ে খেলায় মগ্ন সে, কোন কথা ওর কানে গেছে বলে মনে হল না।

‘কিছু হবে না, বলতে পার তুমি,’ অনুমতি দিল ক্যাথি।

‘মেয়েটা খারাপ প্রভাব ছড়াচ্ছে,’ আরম্ভ করল হর্টন। ‘বাড়ির নিয়ম—কানুনের প্রতি তার কোন শ্রদ্ধা নেই।’

‘কেমন নিয়ম?’ প্রশ্ন করল রবাট।

‘খুঁটিনাটির মধ্যে যেতে চাই না আমি, স্যার।

‘তবু?’

‘আপনি যখন জানতে চাইছেন তখন বলতেই হয় আমরা, আপনার কর্ম—চারীরা, সবাই একসাথেই খাওয়াদাওয়া করি আর একজন করে পালা করে এক একদিন থালাবাসন ধুই।

রবার্ট ক্যাথির দিকে চাইল একবার। ওর কাছে এটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে হচ্ছে না।

মিসেস বেল্‌ক কোনদিনই আমাদের সাথে খায় না। আমাদের সবার খাওয়া শেষ হলে সে নিচে এসে একা একাই তার খাবার খায়।

‘তাই নাকি?’ খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শুনছে এমন ভাব দেখাল রবার্ট।

‘আর সে প্লেটগুলো জমিয়ে রেখে দেয় সকালের কাজের মেয়েটার ধোওয়ার জন্যে।’

‘আমরা ওকে মানা করে দেব।’

‘সবাই আশা করে যে, রাতে বাড়ির আলো নিভিয়ে দেয়ার পরে কোন কর্মচারী বাড়ির বাইরে যাবে না,’ বলে চলল হর্টন। কিন্তু আমি কয়েকবারই তাকে দেখেছি গভীর রাতে জঙ্গলের দিকে যেতে; তা-ও আবার পা টিপে টিপে, যেন কেউ টের না পায়।

‘অদ্ভুত কথা…’ বিড়বিড় করে বলল রবার্ট।

‘পরের অংশটা একটু স্কুল, তাই আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমরা লক্ষ্য করেছি সে টয়লেট পেপার ব্যবহার করে না। সে আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত আর নতুন টয়লেট পেপার দিতে হয়নি তার টয়লেটে।’

পিছনের সিটে রবার্ট আর ক্যাথি আবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। অভাবনীয় দিকে মোড় নিচ্ছে কথা

দুয়ে দুয়ে চার করে মনে হয় সে টয়লেটের কাজ সারতেই জঙ্গলে যায়। আমার মতে এটা একটা অসহ্য বর্বর অভ্যাস।

গাড়ির ভিতর সবাই চুপ হয়ে বসে রইল। রবার্ট আর ক্যাথি দুজনেই একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছে।

‘আর একটা কথা, স্যার। খুব আশ্চর্য ঘটনা— প্রায়ই টেলিফোনে রোমে কার সাথে যেন কথা বলে মিসেস বেলুক।’

কথা শেষ করে গাড়ি চালানোর দিকে পুরোপুরি মনোযোগ দিল হর্টন। হঠাৎ একটা ফাঁক পেয়ে শাঁ করে অন্য গাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল সে। কিছুক্ষণ নীরবে কাটার পর এক সময়ে রবার্ট আর ক্যাথির চার চোখ এক হল।

‘আজ খোলাখুলি ভাবে অবাধ্য আচরণ করেছে বেল্‌ক।’

‘ওকে বিদায় করে দিতে বল?’

‘বুঝি না, তোমার কি ইচ্ছে?’

কাঁধ ঝাঁকাল রবার্ট।

‘ডেমিয়েন তো ওকে বেশ পছন্দ করে বলেই মনে হয়।

‘জানি।‘

‘সেদিকটাও আমাদের ভাবতে হবে।’

‘হুঁ, তা ঠিক।’

‘অবশ্য তুমি চাইলে ওকে বিদায় করে দিতে পার।‘

গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল ক্যাথি।

‘হয়ত সে নিজে থেকেই চলে যাবে।‘

ওদের মাঝখানে বসে ডেমিয়েন গাড়ির মেঝের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। গাড়ি ছুটে চলল শহরের দিকে।

বিশাল ক্যাথিড্রাল ‘অল সেইন্টস্ চার্চ। সতেরোশো খ্রিস্টাব্দের স্থাপত্য শিল্পকর্মের সাথে আঠারো, উনিশ এবং বিংশ শতাব্দীর শিল্প কর্মেরও প্রভাব পড়েছে এর ওপর। নির্মাণকাজ আজও যেন শেষ হয়নি বৃহদাকার সদর দরজা দুটো সব সময়েই খোলা থাকে। সিঁড়ির দু’পাশে ফতুয়া পরা দুই সারি অভ্যর্থনাকারী মাঝখান দিয়ে সম্মানিত রয়াল অতিথিদের ভিতরে ঢোকার নির্দিষ্ট পথ করে দাঁড়িয়েছে। আয়োজন আর আড়ম্বর দেখে অনেক পথচারীই ভিড় জমিয়েছে। পিকাডিলির কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলন ভাঙার পর প্ল্যাকার্ড হাতে তাদেরও অনেক তামাশা দেখতে দাঁড়িয়েছে রাস্তার ধারে। গাড়িগুলো সারি বেঁধে এগুচ্ছে খুব ধীরে ধীরে। সদর দরজায় পৌঁছে এক একটা গাড়ি থামছে, আর সম্মানীয় অতিথিরা নেমে ভিতরে ঢুকেছে। খালি গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে, পরেরটা এসে থামছে সেই জায়গায়।

লোকের জটলার চাপ বাড়ছে ক্রমেই। নিরাপত্তা-রক্ষীরা ওদের সামলাতে পারছে না। বিশৃঙ্খলাও বাড়ছে। রবার্টের গাড়ি লাইনের পিছন দিকে এসে দাঁড়িয়েছে। রক্ষীর সংখ্যা এই পিছনের দিকে অনেক কম। ধাক্কাধাক্কি করে এগিয়ে এসেছে জনতা। বিকট চেহারার একজন লোক ক্যাথির দিকে কাঁচ তোলা জানালায় ধাক্কা দিতে শুরু করল। ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে যেন। ওর দিকে চেয়ে ভয়ে কুঁকড়ে গেল ক্যাথি। তাই দেখে কুৎসিত ভাবে হেসে উঠল লোকটা।

‘এ আবার কোন্ ঝামেলায় পড়লাম?’ বলে উঠল ক্যাথি।

‘পুরো রাস্তাটাই এমন জ্যাম হয়ে রয়েছে,’ জবাব দিল হর্টন।

‘কোনভাবে ঘুরে যাওয়া যায় না?’

সামনে পিছনে দুদিকেই একেবারে গায়ে গায়ে লাগা গাড়িতে ঠাসা বরুনোর কোন উপায় নেই।’

জানালার ওপর ধাক্কার শব্দ বেড়েই চলেছে। চোখ বুজে শব্দটাকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করল ক্যাথি। অন্যেরাও মজা পেয়ে বাকি জানালাগুলোর ওপর ধাক্কাতে আরম্ভ করেছে

নিষ্ফল ভাবে হর্টন জনতার উদ্দেশে সমানে বকাবকি করছে

‘এখান থেকে বেরুনো যায় না?’ ক্যাথির গলায় আকুতি।

ভয় পেয়েছে ডেমিয়েনও। মায়ের হাত খামচে ধরেছে সে।

‘ভয়ের কিছু নেই…ভয় পেয়ো না…’ ছেলের চোখেমুখে ভয়ের চিহ্ন দেখে রবার্ট তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করল। ‘ওরা আমাদের কোন ক্ষতি করবে না—ভেতরে কে আছে তাই দেখছে ওরা।

বাচ্চার চোখ আরও বিস্ফারিত হয়ে উঠল। কিন্তু জনতার দিকে দেখছে না ও। ওর চোখ লোকজনের মাথার উপর দিয়ে গির্জার মাথায় বসানো ক্রসটার ওপর আটকে রয়েছে।

‘ভয়ের কিছু নেই, ডেমিয়েন,’ বলল রবার্ট। আমরা গির্জায় যাচ্ছি। ওই তো এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে

কিন্তু গাড়িটা একটু একটু করে যতই এগিয়ে যাচ্ছে ডেমিয়েনের চোখের ভয়ের চিহ্ন ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে

‘ডেমিয়েন…’

ক্যাথির দিকে চেয়ে চোখের ইশারায় ছেলের দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল রবার্ট। মুখটা ফ্যাকাসে পাথরের মত হয়ে গেছে ওর। জনতাকে পিছনে ফেলে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। বিশাল গির্জাটা এখন পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে।

‘ভয়ের কিছু নেই, ডেমিয়েন,’ ছেলেকে প্রবোধ দিল ক্যাথি। ‘লোকজন সব চলে গেছে এখন আর ভয় নেই।’

কিন্তু ভয় বেড়েই চলেছে ওর। চোখ দুটো আঠার মত আটকে রয়েছে গির্জার ওপর। শরীর আড়ষ্ট শক্ত হয়ে উঠেছে।

‘কি হয়েছে ওর?’ শঙ্কিতভাবে জিজ্ঞেস করল রবার্ট।

‘জানি না।’

‘কি হয়েছে, ডেমিয়েন?’

‘ভয়ে একেবারে মরে যাচ্ছে ও!’

ছেলের হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে মৃদু চাপ দিয়ে সাহস দেয়ার চেষ্টা করল ক্যাথি। ‘ওটা একটা চার্চ, সোনামণি।’

ফিরে তাকাল ডেমিয়েন। ঠোঁট দুটো একেবারে শুকনো হয়ে গেছে, আতঙ্কে হাঁপাচ্ছে, মুখ থেকে সব রক্ত সরে গিয়ে কাগজের মত সাদা দেখাচ্ছে।

‘হায়, যীশু!’

‘ও কি অসুস্থ হয়ে পড়েছে?’

ঠাণ্ডা একেবারে বরফের মত ঠাণ্ডা ওর শরীর।

লিমোসিনটা হঠাৎ থেমে দাঁড়াল গির্জার দরজায়। গাড়ির দরজা খুলে গেল। অভ্যর্থনাকারীদের একজন হাত বাড়াল ডেমিয়েনকে ধরে নামাবার জন্যে। আতঙ্কিত ডেমিয়েন ক্যাথির জামা খামচে ধরল। শক্ত করে ধরে ভয়ে ফোঁপাতে শুরু করেছে ও।

‘ডেমিয়েন!’ ধমকের সুরে ডাকল ক্যাথি। ‘ডেমিয়েন!’

জামা ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল সে, কিন্তু আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল ডেমিয়েন। ধস্তাধস্তিতে আরও মরিয়া হয়ে উঠেছে ডেমিয়েন

‘রবার্ট!’ স্বামীর সাহায্য চাইল ক্যাথি। ‘ডেমিয়েন,’ গর্জে উঠল রবার্ট।

‘আমার জামা ছিঁড়ে ফেলছে ও!’

হাত বাড়িয়ে জোর করে ওকে ছাড়িয়ে নিতে গেল রবার্ট। জামা ছেড়ে এবারে ক্যাথির মুখ খামচে দিয়ে চুল মুঠো করে ধরল সে।

‘উঃ, কিছু একটা কর!’

‘ডেমিয়েন!’ ছাড়াবার বৃথা চেষ্টা করতে করতে চিৎকার করল রবার্ট। ‘ছেড়ে দাও, ডেমিয়েন, শিগগির ছাড়!’

ভয়ে তার স্বরে চিৎকার জুড়ে দিল ডেমিয়েন। আশেপাশে লোক জড়ো হয়ে গেছে। ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে হর্টন ছুটে এল সাহায্য করতে। ডেমিয়েনকে ধরে দরজা দিয়ে বের করে আনার জন্যে টান দিল সে। কিন্তু ছেলেটা এখন বন্য জন্তুর মত হয়ে উঠেছে। চড়া গলায় চিৎকার করে ক্যাথির মুখ আরও জোরে খামচে ধরল এক হাতে অন্য হাতে একমুঠো চুল ছিঁড়ে চলে এসেছে ক্যাথির মাথা থেকে।

‘জলদি ছাড়িয়ে নাও ওকে,’ বলে উঠল সে।

আতঙ্কিত ক্যাথি চোখের পাশে ডেমিয়েনের বসে যাওয়া আঙুল ছাড়াবার চেষ্টা করছে। এক ঝটকায় রবার্ট ক্যাথির থেকে ছাড়িয়ে নিল ডেমিয়েনকে। দু’হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে হাত দুটো ঠেসে ধরে রাখল।

‘গাড়ি ছাড়,’ হাঁপাতে হাঁপাতে আদেশ দিল সে হর্টনকে। ‘জলদি বেরোও এখান থেকে।’

গাড়ির পিছনের দরজা সজোরে বন্ধ করে ছুটে গিয়ে নিজের আসনে বসে গাড়ি ছাড়ল হর্টন। ডেমিয়েন তখনও ছাড়া পাবার জন্যে জোরাজুরি করছে। লাফিয়ে দ্রুত ছুটে এগিয়ে গেল ওদের লিমোসিন।

যীশু.…’ দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল ক্যাথি। ‘ওহ্…ঈশ্বর…’

গাড়িটা দূরে চলে আসতেই আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে আসতে লাগল ডেমিয়েন। অত্যধিক ক্লান্তিতে মাথা পিছন দিকে হেলিয়ে সিটে ঠেকিয়েছে সে। হাইওয়েতে উঠল হর্টন মোড় ঘুরে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সব চুপচাপ হয়ে গেল। চকচকে চোখে ভয়ে ভয়ে সামনের দিকে চেয়ে বসে আছে ডেমিয়েন। মুখটা এখনও ঘামে ভেজা। রবার্ট এখনও ধরে রয়েছে ওকে। ক্যাথির আলুথালু অবস্থা—এলোমেলো চুল, খামচি খেয়ে একটা চোখ প্রায় বুজে এসেছে। নীরবে বাড়ি ফিরে চলেছে ওরা কেউ কোন কথা বলছে না।

পেরিফোর্ডে পৌছে ডেমিয়েনকে ওরা তার ঘরে নিয়ে গেল। দুজনেই বসল ওর সাথে। নীরবে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে বসে রইল ডেমিয়েন। ওর কপাল ঠাণ্ডাই ডাক্তার ডাকার দরকার নেই। ডেমিয়েন একবারও ওদের দিকে চাইছে না। এমন কাণ্ড বাধাবার জন্যে বোধহয় ভয়ে কুঁকড়ে রয়েছে সে।

‘আমি ওর দেখাশোনা করছি,’ নিঃশব্দে ঘরে ঢুকেছে মিসেস বেল্ক।

ডেমিয়েন ঘুরে চাইল তার দিকে। সঙ্গে সঙ্গেই ওর মুখ থেকে শঙ্কার ভাবটা কেটে গেল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যেন ডেমিয়েন 1

‘খুব ভয় পেয়েছে,’ বেল্‌ককে বলল ক্যাথি।

গির্জা ওর পছন্দ না,’ জবাব দিল মেয়েটা। তাই পার্কে যেতে চেয়েছিল ও। ‘ও একেবারে বুনো হয়ে উঠেছিল,’ রবার্ট মন্তব্য করল।

‘রাগ করেছিল ও,’ বলে এগিয়ে গিয়ে দু’হাতে ওকে কোলে তুলে নিল বেল্‌ক। শিশুরা মায়ের কোলে যেমন নিশ্চিন্তে লেপটে সেঁটে থাকে ঠিক তেমনি সেঁটে রইল ডেমিয়েন। নীরবে কিছুক্ষণ ওকে লক্ষ্য করে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে এল স্বামী-স্ত্রী।

‘কোথাও গোলমাল আছে কিছু,’ স্ত্রীকে বলল হর্টন!

রাতের বেলা রান্নাঘরে কথা হচ্ছে ওদের। সেদিনের ঘটনার পুরো বর্ণনা শুনেছে তার স্ত্রী।

‘মিসেস বেলুকের মধ্যেই রয়েছে গোলমাল,’ বলে চলল হর্টন, ‘ওই ছেলের মধ্যেও আছে গোলমাল আর গোলমাল আছে এই বাড়িতে।

‘তিলকে তাল করছ তুমি,’ জবাব দিল গিন্নী।

‘নিজের চোখে দেখলে তুমি বুঝতে আমি কেন একথা বলছি।’

‘বাচ্চাদের জেদ।‘

বাচ্চার না, পশুর জেদ বল।‘

‘ছেলেটা একটু অন্যরকম, স্বীকার করি, কিন্তু…’

মাথা নেড়ে হর্টনের কথা বাতিল করে দিয়ে রেফ্রিজারেটার থেকে একগাদা সব্জি বের করে কুটতে আরম্ভ করল মিসেস হর্টন!

‘ওর চোখের দিকে চেয়ে দেখেছ কোনদিন?’

‘জিজ্ঞেস করল হর্টন। ‘ঠিক পশুর চোখের মতই। ওগুলো কেবল চেয়ে দেখে অপেক্ষা করে। ওরা এমন অনেক কিছু জানে যা তুমি আমি জানব না। যে-সব তুমি কোনদিন দেখনি ওই চোখ সেই সব দেখেছে।

‘তোমার যত আজগুবি কথা।’

‘ঠিক আছে, অপেক্ষা কর, তুমি নিজেই দেখতে পাবে। খারাপ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে এখানে বলে দিলাম আমি। তুমি দেখে নিয়ো।’

‘খারাপ ঘটনা তো সব জায়গাতেই ঘটছে কিছু না কিছু।’

‘আমার এসব ভাল ঠেকছে না,’ গভীরভাবে বলল হর্টন। ‘আমি ভাবছি, এখান থেকে আমাদের সময় থাকতে চলে যাওয়াই ঠিক হবে।

ওই সময়েই থর্ন দম্পতি মুখোমুখি বসে আছে তাদের ঘরে। রাত হয়েছে, ডেমিয়েন ঘুমিয়ে পড়েছে। বাড়িটা নিঝুম আঁধারে ঘেরা। ফোনোগ্রাফ থেকে কোমল সুরে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ভেসে আসছে। কেউ কথা বলছে না। ক্যাথির মুখ কয়েক জায়গায় ছড়ে গিয়ে ফুলে উঠেছে। একটা ছোট কাপড় এপসম সল্টের পানিতে ভিজিয়ে নিজের চোখের সেবা করছে ক্যাথি। ঘটনার পর থেকেই ওদের মধ্যে আর কোন কথার আদান-প্রদান হয়নি। কেবল পরস্পরের সান্নিধ্যে বসে আছে সারাক্ষণ। মনে ভয়, তাদের ছেলে ঠিক স্বাভাবিক নয়। নীরবতায় ওদের সন্দেহ আরও দানা বেঁধে উঠেছে কিন্তু এ নিয়ে আলোচনা করতেও ভয় পাচ্ছে ওরা।

ক্যাথি গামলায় হাত ডুবিয়ে দেখল পানি প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। কাপড়টা চিপে পানি বের করে ঠেলে সরিয়ে রাখল গামলা। নড়াচড়ায় রবার্টের চোখ পড়ল ওর ওপর। একটু পরেই ক্যাথি টের পেল রবার্ট চেয়ে আছে তার দিকে।

….সত্যিই কি তুমি ডাক্তার ডাকতে চাইছ না?’ মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল রবার্ট।

মাথা নাড়ল ক্যাথি। ‘কয়েকটা আঁচড় লেগেছে মাত্র।’

‘তা না…আমি বলছিলাম ডেমিয়েনের জন্যে।

নিরুপায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল ক্যাথি। ‘ডাক্তারকে কি বলব আমরা?’

‘আমাদের কিছু বলার দরকার নেই, ডাক্তার নিজেই ওকে পরীক্ষা করে দেখে বুঝুক ওর কি হয়েছে।‘

‘গতমাসেই তো ওকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করানো হল? কিচ্ছু হয়নি ওর। আজ পর্যন্ত তো একদিনের জন্যেও অসুস্থ হয়নি সে?’

চিন্তামগ্নভাবে মাথা ঝাঁকাল রবার্ট।

সত্যিই তো…কখনও অসুখ করেনি ওর, তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

‘অবাক কাণ্ড না?’

‘তাই কি?’

‘আমার তো তাই মনে হয়।‘

গলার অদ্ভুত স্বরে চমকে মুখ তুলে তাকাল ক্যাথি। আরও কিছু বলবে সেই অপেক্ষায় রবার্টের মুখের দিকে চেয়ে রইল সে।

‘মানে…হাম না, মামস না… জল-বসন্তও না। এমন কি নাক দিয়ে জল গড়ানো, সর্দি, কাশি কিছুই না!’

‘তাতে কি?’

‘কিছু না… আমার মনে হয় এটা অস্বাভাবিক।’

‘আমি তা মনে করি না,’ ঘোষণা করল ক্যাথি। ‘আমি করি।‘

‘সুস্থ সবল পরিবারের সন্তান ও।’

হোঁচট খেল থর্ন। পেটের ভিতর নাড়িতে একটা গিঁট পড়ল যেন। কথাটা এখনও তার পেটে গোপনেই রয়ে গেছে। এত বছরেও সে কাউকে ঘুণাক্ষরেও বলেনি ওকথা। শঠতা করার জন্যে তার মনে একটু অপরাধবোধ থাকলেও অনেক সুখ শান্তি এসেছে তার জীবনে ওই একটু ছলনার বিনিময়ে। সুসময়ে কথাটা ভুলে চেপে থাকা খুব সহজ। কিন্তু আজ হঠাৎ কথাটার গুরুত্ব বেড়ে উঠেছে। ঠেলে উপরে উঠে এসে দলা পাকিয়ে তার গলা ঠেসে বন্ধ করে দিতে চাইছে।

‘তোমার বা আমার যদি তেমন কোন মানসিক বিকার বা সাইকোসিসে ভোগার নজির থাকত তবে আজকের ঘটনা নিয়ে মাথা ঘামাতাম আমি। কিন্তু তা যখন নেই আমাদের ভাবনা কিসের?’

ক্যাথির দিকে চট করে একবার চেয়েই আবার চোখ নামিয়ে নিল রবার্ট।

‘…কিন্তু এ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি,’ বলে চলল ক্যাথি। ‘আমি জানি সব ঠিকই আছে। চমৎকার সুস্থ ছেলে ডেমিয়েন। তোমার আর আমার বংশের সবাই চমৎকার স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিল।

চোখে চোখে চাইতে না পেরে নিচের দিকে চেয়েই ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকাল রবার্ট।

‘হঠাৎ ভয় পেয়ে গেছিল ও,’ বলল ক্যাথি। ‘সব বাচ্চাই কোন না কোন সময়ে অমন মিছেমিছি একটু আধটু ভয় পায়।

আবার মাথা ঝাঁকাল রবার্ট। অপরিসীম ক্লান্তিতে কপালে হাত ঘষল সে। ভিতরে ভিতরে কথাটা লুকিয়ে না রেখে ক্যাথিকে বলে দিতে খুব ইচ্ছে করছে ওর। কিন্তু না, অনেক দেরি হয়ে গেছে। অনেকদিন চলেছে ছলনা এখন আর বলা যায় না ওকে। এখন বললে হয়ত সে স্বামীকে ঘৃণা করতে আরম্ভ করবে কিংবা ছেলেটাই হয়ে দাঁড়াবে ওর দুচোখের বিষ। সময় পার হয়ে গেছে অনেক কোনদিন আর জানানো যাবে না ওকে সব কথা।

‘মিসেস বেল্‌ক সম্পর্কে চিন্তা করছিলাম আমি,’ বলল ক্যাথি।

‘হ্যাঁ, বল?’

‘আমি ভাবছি ওকে রাখাটাই আমাদের ঠিক হবে।‘

‘আজকে তো সে খুব সুন্দর সামলাল ডেমিয়েনকে।’

‘হয়ত গাড়িতে আমাদের কথাবার্তা শুনে উদ্বিগ্ন হয়েই আজকে অমন ব্যবহার করেছে ছেলেটা।’

‘হতে পারে।‘

যুক্তি আছে এ কথার। এইজন্যেই গাড়িতে ডেমিয়েন ভয় পেয়ে থাকতে পারে। ওরা মনে করেছিল কিছুই শুনছে না ও এখন বোঝা যাচ্ছে সবকিছু‍ই মনোযোগ দিয়ে শুনেছে সে। মিসেস বেল্‌ককে হারাবার ভয়েই খেপে উঠেছিল। মনটা অনেকটা হালকা হয়ে গেল রবার্টের।

‘এখন থেকে ওকে আমি কিছু অন্য কাজও দেব,’ বলল ক্যাথি। সারাক্ষণ ও বাসায় না থাকলে আমি ডেমিয়েনের সাথে আরও বেশি সময় কাটাবার সুযোগ পাব। হ্যাঁ, বিকেলের কেনাকাটার ভারটা দেয়া যায় ওর ওপর

‘এখন সেটা কে করে?’

‘মিসেস হর্টন।‘

‘সে কিছু মনে করবে না তো আবার?’

‘জানি না। তবে ডেমিয়েনের সাথে আমার আরও বেশি সময় কাটানো দরকার।‘

‘আমার মনে হয় সেটা খুব বুদ্ধিমতীর কাজ হবে।‘

ওরা দুজনেই চুপ করল। ক্যাথি অন্যদিকে ফিরল হবে।

‘আমার মনে হয় খুব ভাল হবে সেটা,’ পুনরাবৃত্তি করল রবার্ট। কাজের কাজ সেই মুহূর্তে রবার্টের সত্যিই মনে হচ্ছিল যেন সব কিছু আবার আগের মতই ঠিক হয়ে যাবে। এমন সময়ে হঠাৎ লক্ষ্য করল, ক্যাথি কাঁদছে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল ওর সব আশা। অসহায় ভাবে বসে দেখতে লাগল সে ক্যাথিকে। সান্ত্বনা দেয়ারও ভাষা জোগাচ্ছে না ওর মুখে।

‘তোমার কথাই ঠিক, ক্যাথি,’ মৃদু স্বরে বলল রবার্ট। ‘ওকে বরখাস্ত করার কথা শুনেই আজ এমন ব্যবহার করেছে ডেমিয়েন আর কিছু না।‘

‘সেই প্রার্থনাই করছি আমি,’ কাঁপা গলায় জবাব দিল সে।

‘প্রার্থনা মানে? এটাই ঠিক।‘

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল ক্যাথি।

‘অশুভ দিন যত তাড়াতাড়ি শেষ করা যায় ততই ভাল। আমি শুতে চললাম।’

‘আর একটু বসি আমি এখানে খানিক পরে আসছি।‘

ক্যাথির পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। একা বসে চিন্তায় ডুবে গেল রবার্ট।

আনমনে অন্ধকারে বাইরের জঙ্গলের দিকে চাইল রবার্ট থর্ন। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল রোমের হাসপাতাল। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে নিজেকে জানালাটার পাশে দাঁড়িয়ে বাচ্চাটাকে নিতে রাজি হল সে। ওর মায়ের সম্পর্কে কেন সে আরও খোঁজ নেয়নি? কে ছিল সে? কোথা থেকে এসেছিল? ওর বাবা কে? কেন সে সেদিন ওখানে ছিল না? গত বছর কয়েক সে মন গড়া কিছু জবাব তৈরি করে নিয়ে নিজেকে বুঝ দিয়েছে। হয়ত ডেমিয়েনের আসল মা একজন গ্রাম্য ধর্মভীরু মেয়ে ছিল। ওই হাসপাতালে চিকিৎসা করানো যথেষ্ট খরচের ব্যাপার তেমন জানাশোনা কেউ না থাকলে মেয়েটার এখানে ভর্তি হবার কথা নয়। হয়ত মেয়েটা ছিল এতিম সন্তানটাও হয়ত বৈধ নয়, এই কারণেই সম্ভবত সন্তানের বাপ উপস্থিত ছিল না সেখানে। আর কি জানার ছিল তার? কি আসে যায় তাতে? ছেলেটা সুস্থ আর সুন্দর এটাই কি যথেষ্ট নয়?

নিজের ওপর আস্থা হারাতে অভ্যস্ত নয় রবার্ট। মনে মনে নিজেকে দোষী ভাবতেও তার বাধে। তাই তার মন আকুল হয়ে তার স্বপক্ষে যুক্তি খুঁজে ফেরে। নিজেকে বোঝায় যে সে যা করেছে তা ঠিকই করেছে। কিন্তু মনের খুব বিশৃঙ্খল অবস্থা ছিল তার তখন সহজেই ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারত সে। তবে কি সে ভুলই করেছে? আরও কিছু কি তার জেনে নেয়া উচিত ছিল?

কিন্তু এসব প্রশ্নের জবাব কোনদিনই পাবে না রবার্ট। মাত্র কয়েকজন জানত ব্যাপারটা। হয়ত এখন পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তারা। সিস্টার টিরেসা, ফাদার স্পিল্লেট্টো আর ফাদার ট্যাসোন কেবল তাঁরাই জানতেন। তাঁদের বিবেল্‌কের ওপরই নির্ভর করছে সব।

সেই লম্বা রাতে তারা নীরবে কাজ করে গেছে। এ কাজের জন্যে তাদের বাছাই করা হয়েছে, সেই উত্তেজনা আর সম্মানে। পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগে মাত্র দু’বার এর চেষ্টা করা হয়েছিল, তারা জানে। এবার বিফল হওয়া চলবে না। সব কিছুই নির্ভর করছে এখন ওদের তিনজনের ওপর। ঘড়ির কাঁটার মত নিখুঁত ভাবে কাজ এগিয়ে গেছে, বাইরের কেউ জানতেও পারেনি। জন্মের পরে সিস্টার টিরেসা ছদ্মবেশী শয়তানকে তৈরি করেছিল নিজের হাতে। ওর হাতের আর কপালের লোম ওষুধ দিয়ে তুলে ফেলে পাউডার দিয়ে দেহ শুকনো করে দিয়েছিল, যাতে থর্ন ওকে দেখার সময়ে সুন্দর লাগে ওকে দেখতে। বাচ্চাটার মাথার চুল খুব ঘন হয়েছে—এটাই চেয়েছিল ওরা। হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে ফাঁপিয়ে দিয়েছিল মাথার চুল জন্মদাগটা ঢাকার জন্যে। থর্ন কোনদিনই আর সিস্টার টিরেসার দেখা পাবে না। ক্ষুদ্রাকৃতি ফাদার ট্যাসোনেরও দেখা পাবে না সে। সেদিন ব্যস্ত ছিল সে মাটির তলার একটা ঘরে দুটো দেহ বাক্সে ভরার কাজে। প্রথমটা ছিল থর্নের ছেলের দেহ। জন্মের পর কেঁদে ওটার আগেই নীরব করে দেয়া হয়েছে ওকে। আর দ্বিতীয় দেহটা একটা জন্তুর—জীবিত ছেলেটার জন্মদাত্রীমা সে। বাইরে একটা ট্রাক অপেক্ষা করছে ওগুলো সারভেটেরিতে নিয়ে যাবার জন্যে। সেখানে গ্রিপ ডি স্যান্ট অ্যাঞ্জেলোতে কবর খুঁড়ে লোক অপেক্ষা করছে ওগুলোর জন্যে।

গোপন আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই এ জঘন্য ষড়যন্ত্রের জন্ম। এর হোতা ছিল স্পিল্লেট্টো। অত্যন্ত হিসাব করে সাবধানে বেছে নিয়েছিল সে তার সহচর দুজনকে। টিরেসার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ছিল সে কিন্তু একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে ট্যাসোন সম্পর্কে একটু সন্দিহান হয়ে পড়েছিল। ছোট্টখাট্ট লোকটা নিষ্ঠাবান ছিল বটে, কিন্তু ভয় ছিল তার বিশ্বাসের ভিত্তি। শেষ দিকে তার দৃঢ়তার একটু অভাব লক্ষ্য করে থমকে গেছিল স্পিল্পেটো। আগ্রহ ছিল ট্যাসোনের কিন্তু এই আগ্রহ আত্মকেন্দ্রিক, নিজের বাহাদুরি প্রমাণ করার আগ্রহ। সম্পূর্ণ প্ল্যানটার গুরুত্ব উপলব্ধি না করে কেবল তার নিজের অংশটুকুর ওপরই জোর দিচ্ছিল বেশি। তাই তাকে একবার কাজ থেকে সরিয়ে নেয়ার কথাও চিন্তা করেছে স্পিল্লেটো। ওদের একজন একটু ভুল করলেই তিনজনকেই দায়ী করা হবে। সবচেয়ে বড় কথা যে ওরা বিফল হলে এক হাজার বছরের আগে এই চেষ্টা আর করা যাবে না।

শেষ পর্যন্ত ট্যাসোন নির্ভুল ভাবেই তার কাজ শেষ করেছে। বাক্স দুটো ট্রাকে তোলার সময়ে ভিতর থেকে বাচ্চার গলা শুনল সে মরেনি তখনও। বাক্সটা আবার হাসপাতালে মাটির তলার কামরায় নিয়ে নিজের হাতে চিরদিনের মত নীরব করেছে সে বাচ্চাটাকে। এই ঘটনা তার ভিতরটাকে ভীষণভাবে নাড়া দিলেও কাজ শেষ করেছে সে—সেটাই বড় কথা।

ওদের চারপাশে হাসপাতালের কাজ স্বাভাবিক ভাবেই এগিয়ে গেল। ডাক্তার, নার্স সবাই নিজের নিজের কাজ করে যাচ্ছে রুটিন মত। থর্ন তো নয়ই, অন্যেরাও কেউ একটুও টের পেল না ভিতরে ভিতরে কি ঘটে গেল।

অন্ধকারে চেয়ারে বসে বাইরের দিকে চেয়ে আছে রবার্ট। আজকে আর তার কাছে পেরিফোর্ড জঙ্গলটাকে ভীতিকর মনে হচ্ছে না। জঙ্গলের ভিতর থেকে কেউ তার দিকে চেয়ে রয়েছে এমনও মনে হচ্ছে না আর। কেবল ঝিঁঝি পোকা আর ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছে। একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে চারদিকে। আবার যেন সব কিছু সহজ স্বাভাবিক নিয়মে চলছে। উঠে দাঁড়াল রবার্ট ডেমিয়েনের জানালার দিকে চেয়ে রাতের কোমল আলো লক্ষ্য করল সে। ডেমিয়েনের শান্ত সুন্দর ঘুমন্ত মুখটা একবার কল্পনা করার চেষ্টা করল। হ্যাঁ, ওই মুখখানা একবার দেখে আজকের দিনের সমাপ্তি ঘটাবে রবার্ট। আলো নিভিয়ে দিয়ে অন্ধকারের মধ্যে সিঁড়ির দিকে এগোল সে।

বাসার ভিতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। হাতড়ে লাইটের সুইচ খুঁজে না পেয়ে অগত্যা অন্ধকারেই উপরে উঠতে লাগল সে। সিঁড়ির মাথায় এসে দেয়াল ধরে এগোল রবার্ট একটা সুইচ হাতে ঠেকতেই সুইচ টিপে দিল সে। আলো জ্বলল না নষ্ট। চারপাশে ভারি শ্বাস টানার শব্দ শুনতে পাচ্ছে ও। আরও এগিয়ে বারান্দায় বাঁক নিয়েই ডেমিয়েনের ঘরটা চোখে পড়ল। ক্ষীণ আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে দরজার তলা দিয়ে হঠাৎ আড়ষ্ট হয়ে জমে দাঁড়িয়ে গেল রবার্ট। কিসের একটা শব্দ এল তার কানে নিচু কাঁপা শব্দ, গরগর একটা আওয়াজ। কিন্তু কিসের শব্দ বুঝে ওঠার আগেই থেমে গেল ওটা। আগে বাড়ার জন্যে তৈরি হতেই আবার শব্দটা কানে এল। এবার আরও জোরে। ওর বুকের ভিতরটা ধক্ করে লাফিয়ে উঠল। একটু সামনে চেয়ে দুটো চোখ দেখতে পেল সে এবার। আঁতকে উঠে দেয়ালের সাথে সেঁটে গেল রবার্ট। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে কুকুরটা ডেমিয়েনের দরজার সামনে দাঁড়াল। ভয়ে কাঠ হয়ে গেছে রবার্ট। কুকুরের গলার ভিতর থেকে আসা শব্দটা বেড়েই চলেছে একদৃষ্টে তার দিকে চেয়ে আছে জন্তুটা।

‘যাহ্…হ্যাশ…’ ওকে তাড়াবার বৃথা চেষ্টা করল রবার্ট। কিন্তু তাতে কুকুরটা একটু নিচু হয়ে গুটি মেরে লাফ দেবার জন্যে তৈরি হল।

‘অ্যাই চুপ?’ নিজের কামরা থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে কুকুরটাকে ধমক দিল মিসেস বেল্‌ক। বাড়ির কর্তা ইনি, চিনে রাখ।

কুকুরটা সাথেসাথেই চুপ হয়ে গেল, নাটক শেষ। বেল্‌ক একটা সুইচ টিপে দিতেই আলোয় ভরে গেল জায়গাটা। দম বন্ধ করে কুকুরটার দিকে চেয়ে রইল রবার্ট।

‘কি…কি ওটা?’ তোতলাচ্ছে সে।

‘জ্বী?’ যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে জিজ্ঞেস করল বেলুক।

‘এই কুকুরটা?’

‘মনে হয় ওটা একটা জার্মান শেপহার্ড। সুন্দর না কুকুরটা? আমরা জঙ্গলে পেয়েছি ওকে।‘

নিশ্চিন্তে বেল্‌কের পায়ের কাছে বসে হাই তুলছে জন্তুটা।

‘কে অনুমতি দিয়েছে—?’

‘আমি ভাবলাম একটা কুকুর থাকলে পাহারা দেয়ার জন্যে খুব ভাল হবে। তাছাড়া ডেমিয়েনেরও ওকে খুব পছন্দ।’

এখনও পুরোপুরি ধাতস্থ হয়ে উঠতে পারেনি রবার্ট। দেয়ালে হেলান দিয়ে আড়ষ্ট ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে সে। একটু টিপ্পনী কাটল বেল্‌ক।

‘আপনাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল নাকি ও?’

‘হ্যাঁ।’

‘দেখেছেন কেমন লক্ষ্মী হয়ে বসে আছে? আপনার অনুপস্থিতিতে চমৎকার বাড়ি পাহারা দিতে পারবে ও।‘

‘আমার অনুপস্থিতিতে… মানে?’

‘আপনি অফিসের কাজে ইরান যাচ্ছেন না?’

‘তুমি কি করে জানলে সে কথা?’

কাঁধ ঝাঁকাল সে। ‘কথাটা যে গোপনীয়, জানতাম না।’

‘আমি তো এখানে কাউকে বলিনি আমার যাওয়ার কথা?’

‘মিসেস হর্টন বলেছে আমাকে।’

মাথা ঝাঁকাল রবার্ট—তার চোখ ঘুরে ফিরে আবার কুকুরটার উপর গিয়ে পড়ল।

‘ওকে নিয়ে কোন ঝামেলাই হবে না,’ আশ্বাস দিল বেল্‌ক। ‘যে সব খাবার ফেলে দেয়া হয় তা-ই খাবে ও…।’

‘আমি চাই না ওটা এখানে থাকুক, দৃঢ় স্বরে বলল রবার্ট।

অবাক হয়ে চোখ তুলে তার দিকে চাইল বেল্ক। ‘কুকুর পছন্দ করেন না আপনি?’

‘কুকুরের যখন দরকার হবে আমার তখন আমি নিজেই একটা বেছে নিয়ে আসব আমার পছন্দ মত।‘

‘আপনার ছেলে কিন্তু ওকে ভীষণ পছন্দ করে, ডেমিয়েনের জন্যেই ওর থাকা প্রয়োজন।‘

‘ওর কখন কুকুরের দরকার সে সিদ্ধান্তও আমিই নেব।‘

‘ছেলেপেলেরা জন্তু-জানোয়ারের জন্যে একেবারে পাগল হয়, স্যার। তা সে যে জন্তুই হোক না কেন।‘

মেয়েটা এমন চোখে চাইল রবার্টের দিকে যেন তার কথার গূঢ় কোন অর্থ আছে।

‘তুমি কি… আমাকে কিছু বোঝাতে চেষ্টা করছ?’

‘সে-ধৃষ্টতা আমার নেই, স্যার।‘

কিন্তু চাহনি দিয়েই সে বুঝিয়ে দিল কিছু বলার আছে তার।

‘তোমার যদি কিছু বক্তব্য থাকে বলতে পার।‘

‘বলা উচিত হবে না, স্যার। এমনিতেই আপনি অনেক সমস্যা নিয়ে বিব্রত আছেন।‘

‘বললাম তো, কিছু বলার থাকলে বলে ফেল।‘

‘বলছিলাম যে ছেলেটা খুব নিঃসঙ্গ।‘

‘কেন, নিঃসঙ্গ হতে যাবে কেন?’

‘ওর মা ওকে সহজ ভাবে গ্রহণ করতে পারছেন না।’ বেলুকের মন্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ পেল রবার্টের চেহারায়। ‘জানতাম,’ বলল সে। ‘বলাটা আমার উচিত হয়নি।’

‘গ্রহণ করতে পারছে না কি রকম?’

‘মনে হয় যেন ডেমিয়েনকে পছন্দ করেন না উনি—সে-ও বোঝে সেটা।’

একেবারে বোবা হয়ে গেছে রবার্ট কোন কথাই তার মুখে জোগাল না।

‘মাঝে মাঝে মনে হয় যেন আমি ছাড়া ওর আর কেউ নেই,’ যোগ করল বেল্‌ক।

‘আমার মনে হয় তুমি ভুল বুঝেছ।‘

‘এখন ওর আর একটা সাথী হয়েছে এই কুকুরটা। ডেমিয়েনের খুব প্রিয় ও। ছেলের মুখ চেয়ে অন্তত কুকুরটা রাখেন?’

বিশাল কুকুরটার দিকে চেয়ে মাথা নাড়ল রবার্ট।

‘এই কুকুরটা আমার পছন্দ না,’ বলল সে। ‘কালই ওটাকে খোঁয়াড়ে দিয়ে এসো।’

‘খোঁয়াড়ে? ওখানে তো ইনজেকশন দিয়ে ওকে মেরে ফেলবে ওরা!

‘তা হলে যা খুশি কর আগামীকাল ওকে আর আমি এই বাড়িতে দেখতে চাই না।’

কঠিন। গম্ভীর হয়ে গেল বেলুকের মুখ। নিজের ঘরের দিকে চলে গেল রবার্ট। রবার্টকে যতক্ষণ দেখা গেল ওদের চারটে চোখ একদৃষ্টে চেয়ে রইল। চোখে ওদের রাজ্যের পুঞ্জীভূত ঘৃণা আর বিদ্বেষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *