অশুভ সংকেত – ৭

সাত

ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে হোটেল মেফেয়ারে। সাতটা বাজতেই হল-ঘর একেবারে ভরে গেছে লোকের ভিড়ে। রবার্ট তার সহকারীদের জানিয়েছিল, প্রেস কভারেজ চাই তার। তারা কাগজে একটা ছোট্ট খবর ছাপিয়ে দেয়ায় এত লোক হয়েছে যে এখন লোকজনকে দরজা থেকেই ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। যাদের রবার্ট আশা করেছিল তারা তো এসেছেই, সেই সাথে আরও এসেছে একদল বাইরের লোক আর রিপোর্টারের দল। বাইরের লোকেদের পিছন দিকে দাঁড়াবার জায়গা করে দেয়া হয়েছে। কিমিউনিস্ট পার্টির নজর পড়েছে থর্নের ওপর। দু’বার তারা লোক পাঠিয়ে মীটিঙে গোলমাল বাধাবার চেষ্টা ইতিমধ্যেই করেছে। রবার্ট মনেপ্রাণে চাইছিল ওরা যেন আজ না আসে, কিন্তু বিধি বাম।

মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাবার সময়ে রবার্ট লক্ষ্য করল ফটোগ্রাফারদের মধ্যে যার ক্যামেরা সে ভেঙে দিয়েছিল, সে-ও আছে। রবার্টের সাথে চোখাচোখি হতেই হেবার হেসে তার নতুন কেনা ক্যামেরাটা উঁচু করে দেখাল। উত্তরে রবার্টও হাসল একটু—লোকটার শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস বেশ ভাল লাগল তার। মঞ্চে পৌঁছে একটু অপেক্ষা করে শ্রোতাদের নীরব হবার সুযোগ দিয়ে বক্তৃতা আরম্ভ করল সে। প্রথমেই বলল পৃথিবীর অর্থনৈতিক কাঠামো আর কমন মার্কেটের কথা। যে-কোন সমাজেই লেনদেনের জায়গাই সব সময়ে সম্পদ আর কৃষ্টির সমতা রাখতে সহায়তা করেছে। যখনই একজনের কোন কিছু কেনার দরকার পড়েছে আর অন্যজন বেচতে অস্বীকার করেছে তখনই যুদ্ধের দিকে প্রথম পদক্ষেপের সূচনা হয়েছে। মানুষ যে সবাই ভাই-ভাই আর আমরা যে পৃথিবীতে বাস করছি তার সম্পদ আমাদের সবার, আর তা ভাগ করে ভোগ করা উচিত আমাদের, বেশ জোর দিয়েই কথাটা বলল রবার্ট।

হেনরি বেস্টনের বলা কথারই পুনরাবৃত্তি করল থর্ন, ‘জীবন আর সময়ের জালে আমরা সবাই একসাথে ধরা পড়েছি। পৃথিবীর চটক আর যন্ত্রণার হাতে আমরা সকলেই বন্দি।’

চমৎকার বক্তৃতা দিচ্ছে রবার্ট। মন্ত্রমুগ্ধের মত সবাই হাঁ করে গিলছে ওর কথা। রাজনৈতিক টানাপোড়েন কেমন করে অর্থনীতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে সেই বিষয় নিয়ে এবার বলতে আরম্ভ করল সে। শ্রোতাদের মাঝখান থেকে আরবী মুখগুলো বেছে নিয়ে তাদের দিকে চেয়ে কথাগুলো বলছে রবার্ট।

‘আমরা সবই বুঝি, দারিদ্র্যের কারণেই আন্দোলন হয়,’ বলে চলল রবার্ট, ‘আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে অনেক সভ্যতাই বিলুপ্ত হয়েছে তারা অতিরিক্ত বিলাস আর দারিদ্র্যের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে পারেনি বলেই।’

পুরোদমে বক্তৃতা দিয়ে চলেছে রবার্ট। মঞ্চের ঠিক নিচে থেকেই একটার পর একটা ক্লোজ-আপ ছবি তুলছে হেবার।

‘এটা সত্যিই নির্মম আর দুঃখজনক যে আজ থেকে অনেক দিন আগে…ইজিপ্টের রাজা সলোমনের সময়ে…যারা ধন-সম্পদ আর প্রতিষ্ঠার মধ্যে জনেছিল…’

‘এই বিষয়ে তোমারই ভাল জানার কথা!’ পিছন দিক থেকে কেউ চিৎকার করে বলে উঠল। কথা থামিয়ে রবার্ট পিছন দিকের অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গা থেকে কথাটা কে বলল দেখার চেষ্টা করেও পারল না। একটু অপেক্ষা করল রবার্ট কিন্তু বক্তা আর কিছু বলল না। আবার আরম্ভ করল থর্ন।

‘এমনকি ইজিপ্টের ফারাওদের আমলেও আমরা দেখতে পাই যারা প্রাচুর্যের মধ্যে জন্মেছিল…’

‘বল, বল, আমরা শুনতে চাই প্রাচুর্য সম্পর্কে,’ আবার সেই কণ্ঠ চিৎকার করে উঠল পিছন থেকে। এবারে শ্রোতাদের মধ্যেও বিরক্তি দেখা দিল। রবার্ট আবার তাকে পিছনের ভিড়ে খুঁজে বার করার চেষ্টা করল। একজন ছাত্র। মুখভরা দাড়ি—নীল জীন্‌স্‌ পরা—সম্ভবত কমিউনিস্টদেরই একজন হবে। তুমি দারিদ্র্যের কি বোঝ, থর্ন?’ শ্লেষের সাথে বলল সে। জীবনে একদিনও কাজ করেছ তুমি কখনও?’

‘দুয়ো, দুয়ো,’ করে উঠল সব শ্রোতারা। কিন্তু রবার্ট হাত তুলে তাদের থামিয়ে দিল

মনে হচ্ছে এই যুবকের কিছু বক্তব্য আছে,’ বলল রবার্ট। ‘শোনা যাক ওর কি বলার আছে।’

যুবক একটু এগিয়ে এল উৎসাহ পেয়ে। চুপ করে থেকে থর্ন তাকে কথা বলে নিজেকে রিক্ত করার সুযোগ দিল।

‘ভাগাভাগিতে যদি তুমি এতই আগ্রহী তবে নিজের ঐশ্বর্য ভাগাভাগি করে ভোগ করছ না কেন তুমি?’ চিৎকার করে বলল ছেলেটা। ‘কত মিলিয়ন আছে তোমার? তুমি জানো কতজন না খেয়ে আছে? তুমি জানো তোমার পকেটে ভাঙতি পয়সা যা আছে তাতে কতজনের কত উপকার হতে পারে? তুমি জানো যে তোমার শোফারকে তুমি যা বেতন দাও তাতে ভারতে কতজনের অন্ন সংস্থান হতে পারে? তোমার চল্লিশ একর উঠানের ঘাস একটা ছোটখাট দেশের অর্ধেক লোকের খাদ্য সংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে, তুমি জানো? তোমার ছেলের জনাদিনে যে টাকা তুমি খরচ করেছ তাতে এইখানেই লণ্ডনের সাউথ এণ্ডে একটা ক্লিনিক খোলা সম্ভব হত, জানো? অন্যকে তাদের ধন-সম্পদ বিলিয়ে দেয়ার অনুরোধ করার আগে তুমি নিজে কেন তেমন কিছু করছ না? আমরা দেখে শিখতাম? ওখানে দাঁড়িয়ে চারশো ডলার দামের সুট পরে দারিদ্র্য কি, তা আমাদের শেখাতে এসো না!’

অকাট্য যুক্তি। ঠিক জায়গায়ই আঘাত করেছে ছেলেটা। শ্রোতাদের কাছ থেকে মৃদু হাততালিও শোনা গেল। এবার রবার্টের জবাব দেয়ার পালা।

‘তোমার কথা শেষ হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল রবার্ট।

‘কত টাকা আছে তোমার, থর্ন?’ বলে উঠল যুবক। ‘রকফেলারের সমান?’

‘ধারে কাছেও না।’

রকারফেলারকে যখন ভাইস প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করা হয়েছিল তখন কাগজে তার বার্ষিক লাভের হিসেব দিতে গিয়ে বলেছিল তিনশো মিলিয়নের চেয়ে সামান্য বেশি। কিন্তু তুমি জানো সেই সামান্য বেশির পরিমাণ কত? তেত্রিশ মিলিয়ন! এটা গোনার মধ্যেই ধরার যোগ্য না! ওটা ছিল তার পকেটের খুচরো পয়সা। ওদিকে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ আধপেটা খেয়ে আছে। এর মধ্যে কি অশ্লীল কিছু নজরে পড়ছে না কারও? একটা মানুষের জন্যে এত টাকার কি দরকার?’

‘আমি রকারফেলার নই…’

‘বিশ্বাস করি না!’ চিৎকার করে বলল যুবক।

‘আমার জবাবটা শেষ করতে দাও দয়া করে।’

‘একটা বাচ্চা। একটা বুভুক্ষু বাচ্চার জন্যেও যদি কিছু কর, তবু বুঝব। তোমাকে বিশ্বাস করব। কোন উদ্দেশ্য নিয়ে না, নিঃস্বার্থ ভাবে কোন অভুক্ত ছেলেকে সাহায্য করলে তবে বুঝতাম। কিন্তু তোমাদের সব কিছুতেই জড়িয়ে থাকে স্বার্থ।’

‘এমন তো হতে পারে, হয়ত আমি কোন বাচ্চাকে সাহায্য করেছি, কিন্তু প্রচার চাইনি।’

‘কোথায় সে?’ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল যুবক। ‘ছেলেটা কে? কাকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছ তুমি, থর্ন?’

‘আমাদের কারও কারও দায়িত্ব কেবল একটা বাচ্চায় সীমিত নয়—আমাদের সবার জন্যে, অর্থাৎ আরও বড় আকারের সাহায্যের চিন্তা করতে হয়।’

‘যদি একটা ক্ষুধার্ত বাচ্চাকেও সাহায্যের জন্যে হাত বাড়াতে না পার তবে কোনদিনই আশা করতে পার না যে তুমি সমস্ত পৃথিবীর ক্ষুধার্ত জনগণের মঙ্গল করবে।… অসম্ভব!’

শ্রোতারা সব এখন বিপক্ষে চলে গেছে। বেশ জোর করতালি পড়ল ছেলেটার সমর্থনে।

‘একটু বেকায়দার মধ্যে কথা বলতে হচ্ছে আমাকে, অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে বাক্যবাণ ছুঁড়ছ তুমি…’

‘তবে লাইট জ্বেলে দেয়া হোক—আরও জোরে বাক্যবাণ ছুঁড়ব আমি।’

শ্রোতারা সবাই হেসে উঠল ওর কথায়। পটাপট হলঘরের লাইটগুলো জ্বেলে দেয়া হল। রিপোর্টার আর ফটোগ্রাফারেরা উঠে দাঁড়িয়ে পিছনের দিকে নজর দিল। হেবার মনে মনে নিজেকে গাল দিল টেলি লেন্স না আনার জন্যে। ছেলেটাকে মাঝে রেখে ক্যামেরা ফোকাস করল সে।

স্টেজে সংযত আত্মবিশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে রবার্ট। কিন্তু লাইট জ্বলে ওঠার পরেই হঠাৎ করে ভাবের পরিবর্তন দেখা দিল তার। ছেলেটার দিকে চোখ নেই রবার্টের—তার দৃষ্টি আটকে রয়েছে আর একজনের ওপর। ছেলেটার বেশ খানিকটা পিছনে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোটখাট আকৃতির মানুষ সেই পাদরী লোকটা! এতদূর থেকে চেহারা চিনতে পারছে না বটে কিন্তু রবার্ট জানে ওই লোক ট্যাসোন ছাড়া আর কেউ নয়। একেবারে জমে পাথর হয়ে গেছে রবার্ট ওকে দেখে।

‘কি হল, থর্ন,’ ব্যঙ্গ করে বলল ছেলেটা। ‘জবাব দেয়ার কিছু নেই নাকি তোমার?’

ফ্যাকাসে হয়ে গেছে রবার্টের মুখ। একদৃষ্টে ভীত চোখে চেয়ে আছে সে ওই মূর্তিটার দিকে। পরিবর্তনটা লক্ষ্য করে হেবার চট করে ক্যামেরা ঘুরিয়ে রবার্ট যেদিকে চেয়ে আছে সেদিককার বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিল।

‘কি হল, থর্ন,’ আবার চিৎকার করে উঠল ছেলেটা। ‘এখন তো আমাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছ—এখন মুখে আঠা লেগে গেল কেন?’

…’অকাট্য জোরালো যুক্তি আছে তোমার কথায়,’ আমতা আমতা করে জবাব দিল রবার্ট। ‘আমাদের সবারই উচিত ভাগ করে ভোগ করা। ভবিষ্যতে আমি আরও বেশি করে তাই করতে চেষ্টা করব।

শূন্য দৃষ্টিতে পিছন দিকে চেয়ে রইল রবার্ট। ওর চোখের সামনে পাদরীর আলখাল্লা ভাসছে। কেউ চিৎকার করে লাইটগুলো নিভিয়ে দিতে বলল। কোনমতে কয়েকটা কথা বলে মীটিং শেষ করে দিল রবার্ট।

.

রাত করে ফিরে হেবার ফিল্ম ডেভেলপ করায় লেগে গেল। অ্যামব্যাসেডর আগের মতই আজও তাকে অবাক করেছে। ক্যামেরার ভিউ ফাইণ্ডারের ভিতর দিয়ে স্পষ্ট লক্ষ্য করেছে সে রবার্টের ভীত চেহারা। অজানা ভয় নয়-কিছু একটা দেখেই ভয় পেয়েছিল সে তা বেশ বুঝতে পারছে হেবার। যদিও লাইট যথেষ্ট ছিল না, তবু রবার্ট যেদিকে চেয়ে ভয় পেয়েছিল সেদিককার বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিয়েছে বলা যায় না হয়ত ছবিগুলো ডেভেলপ করে কিছু পেয়েও যেতে পারে হেবার। ছবিগুলো ডেভেলপ হবার অপেক্ষায় থাকতে থাকতেই সে টের পেল বেশ খিদে পেয়েছে তার। প্যাকেট ছিঁড়ে ফেরার পথে হোটেল থেকে কেনা বারবেকিউ করা মুরগী আর রুট বিয়ারের বড় বোতলটা বের করল। মুরগীটার মাথা আর পা দুটো কেবল কাটা—এছাড়া আস্তই। বোতলের গায়ে ঠেকিয়ে ওটাকে সিধে করে বসাল হেবার। মাথা ছাড়াই গলা উঁচিয়ে যেন ওর দিকেই চেয়ে আছে মনে হচ্ছে। ভুল করেছে—এখন আর ওকে খেতে মন চাইছে না তার। দুহাত বাড়িয়ে মুরগীর বারবেকিউ করা ডানা দুটো ধরে ঝাপটা দিল—একটু শব্দ করে উঠল, যেন কথা বলছে ওর সাথে। একটিন সারভিন মাছ খুলে নীরবে খেয়ে নিল হেবার তার মূক সঙ্গীর সাথে বসে।

টাইমার বেজে উঠতেই ডার্করূমে ঢুকল সে। ট্রে থেকে প্রুফশীটগুলো তুলে নিল সে। যা দেখল তাতে খুশিতে চিৎকার করে উঠল হেবার। উজ্জ্বল বাতি জ্বেলে দিয়ে ম্যাগনিফাইং গ্লাস নিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল সে ছবিগুলো। হলের পিছন দিকের এই ছবিগুলোই তুলেছিল ও। একজনেরও মুখ চেনা যাচ্ছে না অন্ধকারে—কেবল সাদা ধোঁয়ার মত রিঙ দেখা যাচ্ছে একটা।

‘ধ্যাৎ,’ বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠল হেবার। একটা মোটা লোক সিগার ফুঁকছে—সুতরাং ওই রিঙটা ধোঁয়াও হতে পারে। বেছে তিনটে নেগেটিভ নিয়ে এনলারজারে ঢুকল সে। পনেরো মিনিট অস্থিরভাবে অপেক্ষা করতে হল ছবি তৈরি হবার ফাঁকে। না, ধোঁয়া না। রঙ আর গঠন দুটোই ভিন্ন ধরনের। ভূতুড়ে রিঙটা যেন মোটা লোকটার অনেক পিছন দিকে, প্রায় শেষ মাথার দেয়ালের কাছে। এনলার্জমেন্টটা ম্যাগনিফাইং গ্লাসের নিচে ধরল জেনিংস। অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে পাদরীর আলখেল্লা চিনতে পেরে আবার উল্লাসে চিৎকার করে উঠল হেবার। সেই ছোটখাট চেহারার পাদরী। রবার্ট থর্নের সাথে কিছু একটা সম্পর্ক নিশ্চয়ই আছে এই লোকটার।

খুশি মনে নিজের সাফল্যের পুরস্কার হিসেবে আবার ডিনার টেবিলে ফিরে এসে মুরগীর ডানা ছিঁড়ে নিয়ে খাওয়া আরম্ভ করল সে।

ওই ব্যাটাকে খুঁজে বের করতে হবে এখন। মনে মনে হেসে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল সে। ‘গরু খোঁজা করে খুঁজে বের করব আমি ওই পাদরীকে।’

পরদিন সকালে উঠেই এমব্যাসির বাইরে তোলা পাদরীর এক কপি ছবি নিয়ে চার্চে চার্চে ঘুরে খোঁজ নিল হেবার। শেষে লণ্ডন প্যারিসের স্থানীয় অফিসে গিয়ে হাজির হল সে। কিন্তু কেউ ওকে কোন খবর দিতে পারল না—ছবি দেখেও কেউ চিনতে পারল না পাদরীকে। ওরা বলল, আশেপাশে কোথাও নিযুক্ত থাকলে ওরা নিশ্চয়ই চিনতে পারত। হয়ত বাইরের কোন শহর থেকে এসেছে সে। কিছু একটা আন্দাজ করে সোজা স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে চলে গেল হেবার। কিন্তু ওদের সব ছবি আর ফাইলপত্র ঘেঁটেও কিছু পাওয়া গেল না। এমব্যাসিতে প্রথম দেখেছিল সে ওই পাদরীকে— এমব্যাসির কেউ হয়ত তাকে চিনতে পারে ভেবে এমব্যাসিতে গেল সে।

এমব্যাসির ভিতরে ঢোকা কঠিন হল। সিকিউরিটি গার্ড তার পরিচয়পত্র ইত্যাদি সব পরীক্ষা করেও ওকে সামনের ডেস্কেই আটকে রাখল।

‘অ্যামবাসেডর সাহেবের সাথে আমার দেখা করতে হবে,’ বোঝাতে চেষ্টা করল হেবার। ‘উনি আমার ভাঙা ক্যামেরার ক্ষতিপূরণ দেবেন বলে প্ৰতিশ্ৰুতি দিয়েছিলেন।‘

উপরে টেলিফোন করে হেবারকে লবির টেলিফোনের ধারে অপেক্ষা করতে বলল ওরা। জানাল, উপর থেকে অ্যামব্যাসেডরের সেক্রেটারি যোগাযোগ করবে তার সাথে টেলিফোনে। এক মিনিটের মধ্যেই টেলিফোন এল—সেক্রেটারি জানতে চাইল বিল কত টাকা হয়েছে আর টাকাটা কোন ঠিকানায় পাঠাতে হবে।

আমি নিজে তাঁর সাথে দেখা করে ব্যাখ্যা করতে চাই,’ বলল হেবার। ‘আমি তাঁকে দেখাতে চাই কি কিনেছি আমি।

কিন্তু কোন কথাই শুনতে চায় না সেক্রেটারি। সে বলল অ্যামব্যাসেডর এখন মীটিঙে আছেন, দেখা হওয়া অসম্ভব। অগত্যা অন্য পথে চেষ্টা চালাল হেবার।

সত্যি কথা বলতে কি আমি একটা ব্যক্তিগত ব্যাপারে তাঁর সাহায্য চাই। হয়ত তুমিই পারবে আমাকে সাহায্য করতে—আমি একজন পাদরীর খোঁজ করছি, আমার আত্মীয়। এখানে কোন কাজে এসেছিল সে। হয়ত এখানকার কেউ চিনতে পারবে তাকে।’

আশ্চর্য ধরনের এই অনুরোধ শুনে ইতস্তত করতে লাগল সক্রেটারি।

‘বেশ ছোট্টখাট্ট এই পাদরী লোকটা।’

‘সে কি ইটালীয়ান?’ জিজ্ঞেস করল মেয়েটা।

‘মনে হয় বেশ কিছুকাল সে ইটালীতে ছিল,’ ধরা না দিয়ে যতটা খবর বের করা যায় সেই চেষ্টায় ব্যস্ত রইল হেবার।

‘তার নাম কি ট্যাসোন?’

‘আসলে ঠিক জানি না। আমি আমার এক হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়ের খোঁজ করছি আমি। আমার মা আর তার ভাই-এর ছোটকালেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, তারপর সে তার নাম বদলে ফেলে। আমার মা মৃত্যুশয্যায়—সে দেখতে চায় তার ভাইকে শেষবারের মত। একটা আবছা চেহারার বিবরণ ছাড়া আর কিছুই জানা নেই আমার। এটুকু জানি সে আমার মতই ছোটখাট দেখতে, আর সে পাদরী হয়ে গেছে। আমার এক বন্ধু তাকে এখান থেকে বেরোতে দেখেছে সপ্তাহ খানেক আগে। আমার বন্ধু বলল এই পাদরী একেবারে আমার মা’র মত দেখতে।’

‘একজন পাদরী এখানে এসেছিল বটে,’ জবাব দিল সেক্রেটারি। ‘সে, বলেছিল রোম থেকে এসেছে। আমার বিশ্বাস তাঁর নাম ছিল ট্যাসোন।’

‘সে কোথায় থাকে জানো?’

‘না।’

‘অ্যামব্যাসেডরের সাথে কোন কাজ ছিল তার?’

‘….আমার তো তাই বিশ্বাস।’

‘তাহলে উনি হয়ত তার ঠিকানা জানতে পারেন?’

‘জানি না আমি—তবে মনে হয় না।’

‘তাঁকে জিজ্ঞেস করা যায় না?’

‘জিজ্ঞেস করে দেখতে পারি আমি।’

কখন জিজ্ঞেস করতে পারবে?’

‘এখন হবে না—পরে।‘

‘আমার মা খুবই অসুস্থ। হসপিটালে আছেন। সময় সত্যিই খুব কম।‘

কাজ হল, ইন্টারকম বেজে উঠল থর্নের অফিসে। সেক্রেটারির গলার প্রশ্ন এল দু’সপ্তাহ আগে যে পাদরী দেখা করতে এসেছিল তার ঠিকানা তাঁর জানা আছে কিনা। কাজের মধ্যেই থমকে গেল রবার্ট—মুখের ভাব কঠিন হয়ে উঠল তার।

‘কে জানতে চায়?’ প্রশ্ন করল রবার্ট।

আপনি যে লোকের ক্যামেরা ভেঙেছিলেন সে বলছে পাদরী নাকি তার আত্মীয়–বা তার ধারণা সে আত্মীয় হতে পারে।’

এক মুহূর্ত নীরবতার পর থর্ন বলল, ‘ওকে উপরে আসতে বল, আমি দেখা করব ওর সাথে।‘

রবার্টের কামরা খুঁজে পেতে কোন বেগ পেতে হল না হেবারের। লম্বা হলঘরের শেষে কামরাটা। দেয়ালে লণ্ডনে যতজন দূত এর আগে কাজ করেছে তাদের ছবি সার বেঁধে ঝুলানো। হেবার লক্ষ্য করল জেমস মানরো আর জন কুইনটন প্রেসিডেন্ট হবার ঠিক আগে আগেই লণ্ডনের দূত হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। হয়ত এর পরে থর্নের পালা?

‘ভিতরে এসো,’ হাসি মুখে বলল রবার্ট। ‘বসো।’

‘এইভাবে বিরক্ত করার জন্যে আমি সত্যিই দুঃখিত…’

‘কিচ্ছু ভেব না।’ অ্যামব্যাসেডর হাতের ইশারায় একটা চেয়ার দেখিয়ে দিল ধপ করে তাতে বসে পড়ল হেবার। তার লম্বা চাকরি জীবনে এই প্রথম সে একেবারে একা সামানাসামনি হল এত সম্মানীয় একজন ব্যক্তিত্বের সামনে। গালচালাকি করে ভিতরে ঢুকতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি হেবারের, কিন্তু ঢুকে পড়ে এখন সে খুব নার্ভাস বোধ করছে। বুকটা লাফাচ্ছে আর হাঁটুতে মনে হচ্ছে কোন জোরই নেই।

‘ক্যামেরাটার ব্যাপারে আমি সত্যিই খুব দুঃখিত,’ বলল রবার্ট।

‘ওটা এমনিতেই অনেক পুরানো ছিল…’

‘আমি ওটার জন্যে ক্ষতিপূরণ দিতে চাই।’

‘না, না…’

‘আমার খুব ইচ্ছা, তোমার ক্ষতি পুষিয়ে দিতে চাই আমি।’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সম্মতি জানাল হেবার।

‘সবচেয়ে ভাল কি ক্যামেরা আছে বল, আমি কাউকে দিয়ে সংগ্রহ করিয়ে পাঠিয়ে দেব তোমার কাছে।’

‘আপনার অসীম দয়া।‘

‘সবচেয়ে ভাল ক্যামেরার নামটা জানিয়ে দাও আমাকে।’

‘জার্মানীর তৈরি পোস্টাফ্লেক্স–তিনশো; আমার মতে ওটাই আমার জন্যে ভাল হবে।’

‘ঠিক আছে। আমার সেক্রেটারিকে তোমার ঠিকানাটা দিয়ে দিয়ো।

মাথা ঝাঁকাল হেবার। দুজনেই নীরবে একে অন্যকে লক্ষ্য করছে। খুঁটিয়ে সব কিছু চুলচেরা বিচার করে দেখছে রবার্ট।

‘তোমাকে এদিক সেদিকে দেখেছি মাঝেমধ্যে।

‘আনাচে কানাচেই থাকতে পছন্দ করি আমি।’

‘অধ্যবসায় আছে তোমার।’

‘ধন্যবাদ।

ডেস্কের পিছন থেকে উঠে এল রবার্ট। এক বোতল ব্র্যাপ্তি বের করে কর্ক খুলে দুটো গ্লাসে ঢালল সে। ধন্যবাদ জানিয়ে গ্লাসটা গ্রহণ করল হেবার।

‘…সেদিন ছেলেটাকে খুব সুন্দর ভাবে…’

‘সে কথা থাক, তুমি তোমার আত্মীয়ের খোঁজ করছ শুনলাম?’

‘জ্বি, স্যার।‘

‘সে কি ট্যাসোন নামের একজন পাদরী?’

‘সে একজন ধর্মযাজক—কিন্তু নাম জানা নেই আমার। মায়ের ভাই, তারা ছোটকালেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।’

থর্ন চাইল জেনিংসের দিকে। হেবারের মনে হল রবার্ট যেন একটু মনঃক্ষুণ্ণ হল।

‘তবে আসলে তুমি নিজে চেন না তাকে?’

‘না, স্যার, আমি তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।‘

বিকৃত মুখভঙ্গি করে ধপ করে নিজের চেয়ারে বসে পড়ল রবার্ট।‘

‘যদি জানতাম… মানে কি বিষয়ে আপনার সাথে…’

‘একটা হাসপাতালের ব্যাপার-চাঁদা চাইতে এসেছিল সে।‘

‘কোন্ হাসপাতাল?’

‘ঠিক জানি না—রোমের কোন হাসপাতাল।’

‘আপনাকে ঠিকানা দেয়নি সে?’

‘না, একটা চেক পাঠাতে চেয়েছিলাম আমি কিন্তু ঠিকানা নেই বলে পাঠাতে পারছি না।

মাথা ঝাঁকাল হেবার। ‘আমরা তবে একই নৌকায় আছি দেখা যাচ্ছে।’

‘তাই।’

‘এসেই চলে গেছিল সে—তাই কি?’

‘হ্যাঁ।’

‘তার সাথে আর দেখা হয়নি আপনার?’

চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল রবার্টের। হেবারের চোখ এড়াল না সেটা কিছু একটা লুকোতে চেষ্টা করছে অ্যামব্যাসেডর।

‘না, আর কখনও দেখা হয়নি।’

‘…ভাবছিলাম…হয়ত আপনার কোন বক্তৃতায় উপস্থিত হয়ে থাকতে পারে সে।’

চোখাচোখি হল ওদের। থর্ন স্পষ্ট অনুভব করছে তাকে নিয়ে খেলছে এই ক্যামেরাম্যান সাংবাদিক।

‘কি নাম তোমার?’

‘জেনিংস, হেবার জেনিংস।‘

‘মি. জেনিংস…’

‘হেবার বলুন।’

‘হেবার।’

ওর মুখটা একবার ভাল করে দেখে নিয়ে চোখ সরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে চাইল রবার্ট।

‘স্যার?’

‘…এই লোকটাকে খুঁজে বের করা আমার জন্যে খুব জরুরি হয়ে উঠেছে। পাদরী এখানে এসেছিল—একটু রূঢ় ব্যবহারই করেছি আমি তার সাথে—শুধরাতে চাই।’

‘রূঢ়, কি রকম?’

‘ওকে তাড়াতাড়ি বের করে দিয়েছিলাম, তার কি বলার ছিল আসলে শোনাই হয়নি।’

‘সে নিশ্চয়ই এমন ব্যবহারে অভ্যস্ত। অর্থাৎ চাঁদা চেয়ে ঘুরে বেড়ালে…’

‘আমি ওকে খুঁজে পেতে চাই। আমার কাছে ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ।’

থর্নের মুখ দেখেই বুঝতে পারছে কিছু একটা বড় জিনিসের সন্ধান পেয়েছে সে, কিন্তু জিনিসটা যে ঠিক কি আন্দাজ করতে পারছে না হেবার।

‘আমি তার খোঁজ পেলে অবশ্যই জানাব আপনাকে।’

‘সত্যি জানাবে তো?’

‘অবশ্যই!’ উঠে দাঁড়াল জেনিংস। এগিয়ে এসে বিদায় নেয়ার আগে হাত মেলাল সে রবার্টের সাথে। ‘আপনাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে, মিস্টার অ্যামব্যাসেডর-মহাপ্রলয় ঘনিয়ে আসেনি তো?’

‘আরে না,’ হেসে জবাব দিল থর্ন

‘আমি আপনার একজন ভক্ত, তাই আপনার পিছু পিছু সবখানেই যাই আমি।’

‘ধন্যবাদ।’

দরজার দিকে এগোল হেবার। থর্নের ডাকে আবার থেমে দাঁড়াল।

‘হেবার?’

‘স্যার?’

‘ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়া দরকার আমার…তুমি আসলে সত্যিই ওই পাদরীকে নিজে দেখনি কখনও?’

‘না।’

তুমি মন্তব্য করেছিলে আমার বক্তৃতায় হয়ত সে এসে থাকতে পারে। আমি ভাবলাম…’

‘না।’

‘ভাল কথা…ঠিক আছে।’

একটু অস্বস্তিকর নীরবতার পরে হেবার আবার দরজার দিকে এগোল। ওর দিকে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে বসে রইল রবার্ট। লোকটা বলছে না বটে কিন্তু ও যে কিছু একটা জানে তা বুঝতে পারছে থর্ন। কিন্তু পাদরী সম্পর্কে এমন কি জানতে পারে সে? তবে কি ওর এখানে ট্যাসোনের খোঁজ করতে আসাটা নেহাৎই ঘটনাচক্র? ইদানীং যে সব ঘটনা তার জীবনে ঘটেছে তাতে মনে হয় যেন কিছু একটা পাকিয়ে উঠছে। অনেক ভেবেও কোন কূলকিনারা করতে পারল না রবার্ট

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *