এগারো
ট্যাক্সি ড্রাইভার ওদের একটা হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে মালপত্র নামিয়ে রেখে ভেগে গেছে। থর্নের হতভম্ব অবস্থা, তাই জেনিংসকেই সব প্রশ্নের জবাব দিতে হল। নিজেদের মিথ্যা পরিচয় দিয়ে হাসপাতালের কর্মকর্তাদের সন্তুষ্টির জন্য বানিয়ে গল্প শোনাল একটা। বলল ওরা দুজনেই মাতাল হয়ে পড়েছিল। ঘুরতে ঘুরতে কখন যে ওরা প্রবেশ নিষেধ, পাহারায় কুকুর আছে’ সাইনবোর্ড দেয়া ব্যক্তিগত এলাকায় ঢুকে পড়েছিল নিজেরাই টের পায়নি। জায়গাটা রোমের উপকণ্ঠে, কিন্তু সে ঠিক মনে করতে পারছে না কোথায়। কেবল এটুকু মনে আছে উঁচু বেড়ায় লোহার কাঁটা বসানো আছে ওখানে। ওই কাঁটা গেঁথে জখম হয়েছে তার বন্ধু। জখমগুলো ধুয়ে মুছে ব্যাণ্ডেজ করে অ্যান্টিটিটেনাস ইনজেকশন দেয়া হল ওদের। বলা হল ওরা যেন এক সপ্তাহ পরে আবার দেখা করে রক্ত পরীক্ষা করিয়ে নেয়। হাসপাতালেই জামাকাপড় বদলে নিয়ে ওরা মিথ্যা নামে সই করে একটা ছোট হোটেলে উঠল। ওদের থেকে অগ্রিম টাকা আদায় করে নিয়ে তবে ওদের হাতে চাবি দিল ডেস্ক ক্লার্ক।
রূমে বসে রবার্ট ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে ক্যাথির সাথে। সারা ঘর-ময় পায়চারি করে বেড়াচ্ছে হেবার।
‘ওরা আপনাকে অনায়াসেই শেষ করতে পারত,’ ভীত উত্তেজিত স্বরে বলল হেবার। ‘কিন্তু ওরা করেনি, ওদের আসল উদ্দেশ্য ছিল আমাকে খতম করা। বারবার আমার গলা কামড়ে ধরার চেষ্টা করছিল ওরা।’
রবার্ট হাত তুলে হেবারকে থামতে ইশারা করল। রক্তের কালচে একটা দাগ দেখা গেল ওর শার্টে—বগলের কাছে।
‘আমি কি বলছি শুনছেন? ওরা আমার গলা কামড়ে ধরতে চাচ্ছিল!’
‘এটা কি হাসপাতাল?’ ফোনে জিজ্ঞেস করল রবার্ট। ‘হ্যাঁ, উনি রুম 4A-তে আছেন।’
‘এই ক্যামেরা…’ বলেই চলেছে হেবার। কেউ শুনছে কি না শুনছে, সেদিকে খেয়াল নেই ওর। ‘এই ক্যামেরা গলায় পেঁচিয়ে না থাকলে কি যে হত…মাই গড়…’
ঠিক আছে আমি ধরছি।’
‘কিছু একটা করতেই হবে আমাদের। শুনছেন আমার কথা?’
জেনিংসের দিকে চাইল রবার্ট। ওর গলায় স্ট্র্যাপের দাগগুলো লক্ষ্য করল সে।
‘মেগ্গাইডো শহর খুঁজে বের কর,’ নরম গলায় উপদেশ দিল রবার্ট।
‘সে কি করে সম্ভব? আমি…’
‘জানি না, কোন লাইব্রেরি অথবা…’
‘লাইব্রেরি! ওহ্, যীশু!’
‘হ্যালো?’ ফোনে কথা বলল রবার্ট। ‘কে, ক্যাথি?’
স্বামীর গলার স্বরে কিসের যেন আভাস পেয়ে হাসপাতালের বিছানায় সিধে হয়ে বসল ক্যাথি।
‘কথা বলছ না কেন, ভাল আছ তো তুমি?’ উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল রবার্ট। ‘হ্যাঁ। আর তুমি?’
‘আমিও। আমি নিশ্চিন্ত হতে চাইছিলাম যে…
‘কোথায় আছ তুমি?’
‘রোমে। হোটেলের নাম রিগলি।’
‘কি হয়েছে?’
‘কই, কিছু না।’
‘অসুখ করেছে তোমার?’
‘না, দুশ্চিন্তায় ছিলাম আমি—’ফিরে এসো, রবার্ট।
‘এখনই আসতে পারছি না।’
‘আমার ভয় করছে।
‘ভয়ের কিছুই নেই।’
‘বাসায় টেলিফোন করে কোন জবাব পাচ্ছি না আমি।’
জেনিংসের দিকে চাইল রবার্ট। দেখল শার্ট বদলাচ্ছে সে; বাইরে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে।
‘রবার্ট! আমার মনে হয় বাসায় ফিরে যাওয়াই ঠিক হবে আমার।’
তুমি যেখানে আছ সেখানেই থাক,’ দৃঢ় স্বরে বলল রবার্ট।
‘ডেমিয়েনের জন্যে দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার।’
‘বাড়ির ধারে কাছেও যেও না তুমি।’
‘আমাকে যেতেই…’
‘আমার কথা শোন, ক্যাথি, ওই বাড়ির ত্রিসীমানায় যাবে না তুমি।’ রবার্টের গলার স্বরে থমকে থেমে গেল ক্যাথি। একটু ভয়ই পেল।
আমি বোকার মত কিছু করে বসব মনে করে ভয় পাচ্ছ তো? ভয়ের কিছু নেই, আমাকে ডক্টর গ্রীয়ার পরীক্ষা করেছেন। এখন আমার চিন্তাধারা পরিষ্কার হয়ে গেছে–ডেমিয়েন আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে না, ওটা নিছক আমার কল্পনা।‘
‘ক্যাথি…
আমার কথা শোন, আমি একটা ড্রাগ খাচ্ছি এখন, নাম-লিথিয়াম। ওষুধটা খুব ভাল কাজ করছে। আমি বাড়ি ফিরে যেতে চাই আর আমি চাই তুমিও ফিরে এসো।’ একটু থামল সে, গলার স্বর ভারি হয়ে এল তার, ‘আর আমি চাই সবকিছুই আবার ঠিক হয়ে যাক।’
‘তোমাকে ড্রাগ কে দিয়েছে?’ প্রশ্ন করল থর্ন
‘ডক্টর গ্রীয়ার।‘
‘ক্যাথি, আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত হাসপাতালেই থাক। ফিরে আমি তোমাকে বাসায় নিয়ে যাব।’
‘কিন্তু আমি এখনই বাড়ি যেতে চাই, রবার্ট।
‘যীশুর দোহাই…’
‘আমি ভাল হয়ে গেছি তো!’
‘ভাল হওনি তুমি।’
‘চিন্তা কর না…।’
‘ক্যাথি…!’
‘আমি বাড়ি যাচ্ছি, রবার্ট।‘
‘না! আমিই ফিরে আসছি।‘
‘কবে?’
‘সকালেই।’
‘কিন্তু বাসায় যদি কিছু হয়ে থাকে? আমি টেলিফোন করে…’
‘আসলেই গোলমাল আছে বাসায়, ক্যাথি।
কথাগুলোর ধাক্কায় কিছুক্ষণ চুপ করে রইল ক্যাথি।
‘রবার্ট,’ শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল সে, ‘কি হয়েছে?’
‘ফোনে বলা যাবে না।’
‘কিছুই বুঝছি না আমি; কি হয়েছে বল; কি হয়েছে বাসায়?’
‘ওখানেই আমার জন্যে অপেক্ষা কর, সকালে আমি এসে সব তোমাকে খুলে বলব।’
‘আমার সাথে এমন কর না, রবার্ট।’
‘এটা তোমার দোষ নয়, ক্যাথি। এর সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই।‘
‘কি বলছ তুমি?’
হেবার রবার্টের দিকে ফিরে তাকাল, তারপর গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। ‘রবার্ট!’
‘…সে আমাদের ছেলে নয়, ক্যাথি। ডেমিয়েন অন্য কারও ছেলে।’
‘…কি!’
‘বাসায় যেয়ো না।’ সাবধান করে দিল রবার্ট। ‘হাসপাতালেই আমার জন্যে অপেক্ষা কর।‘
ফোন ছেড়ে দিল রবার্ট। নিথর হয়ে বসে রইল ক্যাথি। রিসিভারটা কানে বাজতে আরম্ভ করলে সংবিৎ ফিরল তার। ওটা যথাস্থানে নামিয়ে রেখে দেয়ালের ওপর ছায়ার খেলা দেখতে লাগল। একটা বিশাল গাছ মৃদু মৃদু দুলছে বাতাসে। ভয় করছে তার, কিন্তু আগে যেমন ভয়ের সাথে সাথে আতঙ্ক ঘিরে ধরত তাকে, এখন আর তেমন হয় না। লিথিয়াম কাজ করছে, মাথা এখন বেশ পরিষ্কার থাকে তার। ফোনটা আবার তুলে নিয়ে বাসায় ফোন করল সে-কিন্তু এবারেও কোন জবাব পেল না। এবার তার বিছানার পাশে রাখা ইন্টারকমের বোতামটা টিপে দিল, সে।
‘জ্বী, বলুন?’ একটা গলা শোনা গেল।
‘আমার হাসপাতাল ছেড়ে বাইরে যাওয়া দরকার। কার সাথে কথা বলতে হবে?’
‘আপনার ডাক্তারের অনুমতি লাগবে।’
‘ওনার সাথে আমার একটু যোগাযোগ করিয়ে দেবেন? আমার খুব উপকার হয়।’
‘দেখি, আমি চেষ্টা করছি।’
সুইচ অফ করে দিয়ে চুপচাপ বসে রইল ক্যাথি। একটা নার্স তার লাঞ্চ নিয়ে এল, কিন্তু খিদে নেই ওর। ট্রের ওপর একটা ছোট প্লেটে জেল্লো (মিষ্টি) ছিল। ছুঁয়ে দেখল বেশ ঠাণ্ডা। অন্যমনস্কভাবে আঙুল দিয়ে সে ওটা ছানতে লাগল।
তার থেকে কয়েকশো মাইল দূরে, সারভেতেরি কবরস্থানে চারদিক চুপচাপ। কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ। অত্যন্ত ক্ষীণ মাটি খোঁড়ার শব্দ নীরবতা ভঙ্গ করছে। খোঁড়া কবর দুটোর কাছে দুটো কুকুর পা দিয়ে মাটি ভরছে কবরে। তাদের পা চলছে যন্ত্রচালিতের মত। কবর দুটো মাটি দিয়ে ভরে দিচ্ছে ওরা। ওদের অনেক পেছনে বেড়ার ওপর আঁতুড়ি বের হওয়া কুকুরটার দেহের অবশিষ্টাংশ অসাড় ভাবে ঝুলছে। একটা কুকুর মাথা উঁচু করে ‘উ…উ…উ…উ’ করে লম্বা ডাক দিল। একে একে অন্য কুকুরগুলোও যোগ দিল ওর সাথে। কোরাসে গেয়ে চলল ওরা অমোঘ নিয়তির বেসুরো গান।
হাসপাতালে ক্যাথি তার ঘরের ইন্টারকম সুইচের দিকে হাত বাড়াল। তার ভঙ্গিতে অধৈর্যের ছাপ।
‘কেউ আছেন ওখানে?’ প্রশ্ন করল ক্যাথি।
‘বলুন?’ প্রায় সাথে সাথেই জবাব এল।
‘আমি আমার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে চাই জানিয়েছিলাম।
অস্থিরতায় মুখটা টানটান হয়ে রয়েছে ক্যাথির।
তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না. সম্ভবত তিনি অপারেশন থিয়েটারে আছেন।’
‘আপনি নিজে একটু সাহায্য করতে পারেন আমাকে?’
‘কাউকে পাঠাবার ব্যবস্থা করছি আমি।’
‘একটু জলদি করবেন।’
‘যথাসাধ্য চেষ্টা করব আমি।’
বিছানা থেকে কষ্টেসৃষ্টে নামল ক্যাথি। ওয়ার্ডরোব থেকে নিজের জামাটা নামিয়ে নিল। ঢিলেঢালা জামা-ক্যাথির পক্ষে পরা মোটামুটি সহজই হবে। কিন্তু যে নাইট-গাউনটা আছে তার পরনে সেটার গলার বোতাম অনেক উপর দিকে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে আর ভাবছে হাতের বাঁকা কাস্ট (প্লাস্টার অভ প্যারিস) সহ কি করে ওটা খোলা যায়। বোতামে টান দিল সে-কিন্তু এক হাতে কিছুতেই বোতামটা খুলতে পারছে না সে। জোর করতেই বোতামটা ছিঁড়ে পড়ে গেল। মাথার ওপর দিয়ে গাউন খোলার জন্যে কসরত করতে আরম্ভ করল সে। কিছুদূর গিয়েই আটকে গেল নাইট-গাউন। গলায় পেঁচিয়ে গেছে তার বেগুনী রঙের গাউনটা। যতই চেষ্টা করছে ততই আরও শক্তভাবে পেঁচিয়ে যাচ্ছে। চোখে ঝাপসা বেগুনী রঙ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ক্যাথি। ভীষণ ভয় করছে ওর।
গ্রিপ ডি সান্ট অ্যাঞ্জেলোর কবরখানায় বাতাসে উঠেছে ক্রুদ্ধ তাণ্ডব। হাসপাতালে গাউন নিয়ে টানাটানি করতে করতে আতঙ্কিত বোধ করছে ক্যাথি জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে তার। দরজা খোলার শব্দে আশ্বস্ত হল ক্যাথি—সাহায্য আসছে।
কবরখানার বাতাসে কুকুরের একটানা কান্নার শব্দ আরও জোরাল হয়ে উঠেছে।
‘হ্যালো?’ ক্যাথি দেখার চেষ্টা করছে কে এল।
কিন্তু কোন জবাব নেই। জালের মত গাউনটার ভিতর দিয়ে ঘরের চারদিক দেখার বৃথা চেষ্টা করল সে।
‘কে ঘরে?’ বলেই ক্যাথির চোখ পড়ল ওর ওপর।
মিসেস বেল্ক! মুখটা পাউডারে একেবার সাদা, লিপস্টিকমাখা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসছে সে। হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল ক্যাথি। মহিলা তার পাশ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে জানালা খুলে উঁকি দিয়ে ছয়তলার থেকে নিচে রাস্তার দিকে দেখল।
‘একটু সাহায্য করবে…?’ প্রশ্ন করল ক্যাথি। ‘এই গাউনটা এমনভাবে পেঁচিয়ে গেছে…কিছুতেই খুলতে পারছি না।
কোন জবাব না দিয়ে আবার দাঁত বের করে হাসল সে। ওর মুখের দিকে চেয়ে আরও দুর্বল বোধ করছে ক্যাথি।
‘আজকের দিনটা খুব সুন্দর, ক্যাথি,’ বলে উঠল মহিলা। ‘এমন দিনে আকাশে উড়ে বেড়াতে মন চায়।’ এগিয়ে এসে শক্ত করে সে নাইট গাউনটা ধরল হাতের মুঠোয়।
‘প্লীজ,’ ফুঁপিয়ে উঠল ক্যাথি।
শেষবারের মত ওরা চোখে চোখে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ।
‘সুন্দর লাগছে তোমাকে,’ হিসহিসিয়ে বলে উঠল সে। ‘একটা চুমো দাও।’
ঝুঁকে এগিয়ে এল বেল্ক-সভয়ে পিছাল ক্যাথি। ওকে কঠিন হাতে ঘুরিয়ে জোর করে জানালার দিকে নিয়ে চলল বেল্ক।
চাকায় ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ তুলে দ্রুত একটা অ্যাম্বুলেন্স ঢুকল হাসপাতালে। মাথার ওপর লাল নীল বাতিটা ঘুরছে। ওদিকে ছয়তলার জানালা থেকে মুখে বেগুনী নাইট গাউন পেঁচানো একটা মেয়ে বাতাসে ভর দিয়ে আকাশে উড়ল ধীরে ঘুরে বাতাসে নকশা কেটে দেহটা নিচে নামছে। অ্যাম্বুলেন্সের ছাদে পড়ার আগে তাকে কেউ লক্ষ্য করেনি। ধাক্কা খেয়ে লাফিয়ে উঠে মৃতদেহটা শেষবারের মত আরও কিছুটা উড়ে স্থির হল ইমারজেন্সি প্রবেশ পথের রাস্তাটার ওপর।
এখন নীরবতা নেমে এসেছে সারভেতেরিতে। কবর মাটি চাপা দেয়া হয়ে গেছে, কুকুরগুলো অদৃশ্য হয়েছে ঝোপের আড়ালে।
ক্লান্তিতে বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল থর্ন। টেলিফোনের শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকার হয়ে গেছে এখন, হেবার বাইরে কোথায় যেন গেছে।
‘হ্যাঁ, হ্যালো?’ ঘুম জড়ানো স্বরে বলল রবার্ট।
ডাক্তার বেকারের গলা, গলার স্বর শুনেই বোঝা যাচ্ছে দুঃসংবাদ আছে।
‘আপনাকে পেয়ে ভালই হল,’ বলল সে। ‘হোটেলের নামটা আপনার স্ত্রীর টেবিল-প্যাডে লেখা ছিল, কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করে শেষে…’
‘কি হয়েছে?’ উৎকণ্ঠিত প্রশ্ন বেরিয়ে এল রবার্টের গলা দিয়ে।
‘মিসেস থর্ন তার ছয়তলার জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়েছেন।‘
‘…কি…?’ দম বন্ধ হয়ে আসছে রবার্টের।
‘মারা গেছেন তিনি, মিস্টার থর্ন। আমাদের আর করার কিছুই ছিল না।’
মনে হচ্ছে যেন গলায় কিছু ঠেকেছে, কথা বলতে পারছে না রবার্ট।
‘কি যে ঘটেছিল তা আমরা ঠিক জানি না, উনি হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিলেন, তারপরই ওনাকে পাই আমরা বাইরে।’
‘… ক্যাথি আর নেই…?’ ফুঁপিয়ে উঠল থর্ন।
‘তৎক্ষণাৎ মারা যান তিনি। মাথাটা একেবারে চুর হয়ে গেছে।’
রিসিভারটা বুকে চেপে ফোঁপাচ্ছে সে।
‘মিস্টার থর্ন?’ ডাকল ডাক্তার।
লাইন কেটে দেয়ার শব্দ এল ডাক্তারের কানে। অন্ধকার ঘরে বসে কেঁপে কেঁপে কাঁদছে থর্ন। তার কান্নার শব্দ বাইরের কড়িডোর থেকে শোনা যাচ্ছে। নাইট পোর্টার এগিয়ে এসে তার দরজায় নক করার আগেই ভিতরে সব একেবার নিশ্চুপ হয়ে গেল তখন।
মাঝরাতে ফিরে এল হেবার। তার হালকা পাতলা দেহটা ক্লান্তিতে কুঁজো হয়ে গেছে। ঘরে ঢুকে রবার্টের বিছানায় শোয়া নিথর দেহের দিকে চাইল সে।
‘মিস্টার থর্ন?’
‘হুম,’ মুখ না খুলেই জবাব দিল রবার্ট।
‘অনেক ঘুরেছি আজ—লাইব্রেরি, অটো ক্লাব, রয়াল জিওগ্রাফিক সোসাইটি, সব।’ ধপ করে রবার্টের বিছানার উল্টো ধারে নিজের বিছানায় বসল সে।
কোন জবাব দিল না রবার্ট। হেবার দেখল রবার্টের শার্টে রক্তের দাগটা আরও বড় হয়েছে। বগলের নিচে অনেকখানি জায়গা ভিজে উঠেছে।
‘মেগ্গাইডো শহর সম্বন্ধে জানতে পেরেছি আমি। শব্দটা ‘আর্মেগ্গেডন’ শব্দ থেকে এসেছে। এর মানে হচ্ছে মহাপ্রলয়।’
‘জায়গাটা কোথায়?’ ভাবলেশহীন স্বরে প্রশ্ন করল রবার্ট।
‘প্রায় পঞ্চাশ ফুট মাটির নিচে, জেরুযালেম শহরের ধারেই। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ চলছে ওখানে কোন্ একটা আমেরিকান ইউনিভার্সিটি কাজটা চালাচ্ছে।’
কোন সাড়া না পেয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে ক্লান্ত দেহটাকে এলিয়ে দিল হেবার।
‘আমি যাব সেখানে,’ স্বগতোক্তি করল রবার্ট।
‘ওখানে গিয়ে কি করবেন? আপনি তো ওই বুড়োর নামই মনে করতে পারছেন না।’
‘বুগেনহাগেন।’
আড়চোখে হেবার চাইল রবার্টের দিকে। চোখ দেখা যাচ্ছে না। ‘বুগেনহাগেন?’
‘হ্যাঁ। সেই কবিতাটাও এখন আমার পুরো মনে পড়ছে।’
বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল হেবার।
‘যার সাথে দেখা করতে হবে তার নাম বুগেনহাগেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘সতেরো শতাব্দীর নামকরা ভূতের ওঝা ছিল বুগেনহাগেন। আমাদের কাছে যে সব বই আছে তাতে লেখা আছে ওই নাম।
কোন কথা না বলে রবার্ট কবিতাটা বিড়বিড় করে পুরো আবৃত্তি করল। এতক্ষণে হেবারের মনে হল থর্ন যেন কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে।
‘কি হয়েছে, মিস্টার থর্ন?’ জিজ্ঞেস করল সে।
‘ক্যাথি মারা গেছে,’ কোন আবেগ প্রকাশ পেল না রবার্টের গলায়। ‘আমি চাই, এবার ছেলেটা মরুক।’
চুপ করে শুয়ে রইল দুজনেই। কারও চোখেই আর রাতে ঘুম এল না। সকাল আটটায় হেবার ট্রাভেল এজেন্সিতে ফোন করে ইসরাইলের দুটো টিকিট বুক করল।
.
অনেক দেশ ঘুরেছে রবার্ট কিন্তু কোনদিন ইসরাইলে আসেনি। ইসরাইল সম্বন্ধে তার যা জ্ঞান তা খবরের কাগজ আর বইয়ের পাতা থেকে সংগ্রহ করা। নিজের চোখে ইসরাইল দেখে সত্যিই অবাক হল সে। অত্যন্ত আধুনিক ছাঁদে গড়া শহরের দালানগুলো আকাশচুম্বী। চারদিকেই গড়া হচ্ছে আরও নতুন দালান, হোটেল, অফিস ব্লক আরও কত কি। ক্রেন আর বুলডোজার চারদিকে কাজে ব্যস্ত।
হিলটন হোটেলে উঠল ওরা। শহরটা বেশ গরম। ঘামে ভিজে গেছে থর্নের ব্যাণ্ডেজ। জ্বালা করছে ওর ক্ষত। জামা বদলাবার সময়ে হেবার মন্তব্য করল ওর ডাক্তার দেখানো উচিত। কথাটাকে পাত্তা না দিয়ে সে বলল বুগেনহাগেন নামের লোকটাকে খুঁজে পাওয়ার আগে সে আর অন্য কিছুই করতে রাজি নয়।
দু’দিন তেল আবিবে আর দু’দিন জেরুযালেমে গরু খোঁজা করেও কোন ফল হল না। বুগেনহাগেনের কোন হদিসই মিলল না। সেদিন দুপুরে সারা সকাল খোঁজাখুঁজি করে ক্লান্ত দেহে বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিতে নিতে ওদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক চলছিল যে আসলেই বুগেনহাগেন বলে কেউ আছে কিনা। ঠিক এই সময়ে দরজায় করাঘাতের শব্দ শোনা গেল। জেনিংস উঠে দরজা খুলল। একজন ভিখারি আরব দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। দরজা খুলতেই মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান জানাল সে হেবারকে।
‘কি চাও তুমি?’ প্রশ্ন করল হেবার।
‘আপনারা বুড়োকে খুঁজছেন?’
চট করে একবার রবার্টের সাথে চোখাচোখি করে নিল হেবার।
‘কোন্ বুড়ো?’ সাবধানে প্রশ্ন করল হেবার।
‘বাজারে শুনলাম আপনারা বুড়োকে খুঁজছেন।
‘আমরা একজন লোককে খুঁজছি একথা ঠিক।‘
‘আমি নিয়ে যেতে পারি আপনাদের সেই বুড়োর কাছে।‘
আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রবার্ট।
‘তাড়াতাড়ি করুন বুড়ো আমাকে এক্ষুনি নিয়ে যেতে বলেছে আপনাদের।‘
পায়ে হেঁটে চলেছে ওরা। জেরুযালেমের অলিগলির ভিতর দিয়ে দ্রুত পায়ে নীরবে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে আরব লোকটা। বয়স আন্দাজে অত্যন্ত জোরে হাঁটছে সে। ওর সাথে সমান তালে চলতে হেবার আর রবার্টের বেশ অসুবিধেই হচ্ছে। বাজারের ভিতর লোকের ভিড়ের মধ্যে একবার প্রায় হারিয়েই ফেলেছিল ওকে রবার্ট আর হেবার। ওদের বারবার পিছিয়ে পড়তে দেখে বেশ মজাই পাচ্ছে লোকটা। সব সময় বিশ গজ আগে আগে চলছে সে। বেশ কয়েকটা সরু অলিগলির ভিতর দিয়ে এঁকে বেঁকে চলার পরে হঠাৎ করে থেমে দাঁড়াল সে। ওরা দুজন হাঁপাতে হাঁপাতে এগিয়ে এসে লোকটাকে ধরে ফেলল। কিন্তু সামনেই ইঁটের দেয়াল—পথ শেষ। কোন কুমতলবে চালাকি করে ওদের এখানে নিয়ে আসেনি তো লোকটা? দুজনেই সন্দিহান হয়ে উঠল।
একটা লোহার ঝাঁজরি খুলে লোকটা বলল, ‘ভিতরে।’ হাতের ইশারায় জানাল নিচে নামতে হবে ওদের।
‘ঘটনাটা কি?’ প্রশ্ন করল হেবার।
‘জলদি, জলদি,’ মুচকি হেসে তাড়া দিল আরব লোকটা।
হেবার থর্নের দিকে একবার অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে অগত্যা নিচের দিকে রওনা হল লোকটার নির্দেশ মত। ওরা দুজন ঢুকে যাবার পর লোকটা নিজেও ভিতরে ঢুকে ঝাঁজরি বন্ধ করে দিল। ভিতরটা অন্ধকার। লোকটা একটা টর্চ জ্বেলে দ্রুত নেমে চলল। সামান্য আলোতে বোঝা গেল একটা পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে। রাস্তার পানিতে শ্যাওলা আর ছাতা পড়েছে সিঁড়ির গায়ে, দুর্গন্ধ আসছে—আবার পিছলে পড়ার ভয়ও রয়েছে। নিচে সমান জায়গায় নেমেই লোকটা ওদের অবাক করে দিয়ে ছুট দিল। ওরাও দৌড়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু পিচ্ছিল পাথরের ওপর দিয়ে দৌড়ানো সম্ভব হল না ওদের। অল্পক্ষণেই লোকটার টর্চের বাতি দূরে একটা বিন্দুর মত দেখাতে লাগল। প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন সরু টানেল, অনেকটা বড় নর্দমার মত শক্ত পাথরের তৈরি সবটাই অন্ধকার ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলেছে ওদের, হাতড়ে হাতড়ে অন্ধের মতই পথ চলছে রবার্ট আর হেবার। টর্চ হাতে লোকটা সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়েছে এখন। ওদের চলার গতি আরও কমে এল। একে অন্যকে দেখতে পাচ্ছে না ওরা, কেবল ভারি শ্বাস আর পায়ের শব্দে টের পাচ্ছে যে কাছাকাছিই রয়েছে ওরা।
‘হেবার…’ অন্ধকারে ভয় পেয়ে ডাকল রবার্ট।
‘এই যে আমি।
‘কিছুই দেখতে পাচ্ছি না…’
‘লোকটা একটা হারামজাদা…
‘আমার জন্যে একটু দাঁড়াও।‘
‘উপায় নেই, দাঁড়াতেই হবে, কানা গলি এটা!’ জবাব দিল হেবার।
হাতড়ে আগে বেড়ে হেবারকে ধরল রবার্ট। পরে সামনের দেয়ালটাও ছুঁয়ে দেখল সে। সব পথ বন্ধ। আরব লোকটা অদৃশ্য হয়েছে।
‘লোকটা আমাদের পাশ কাটিয়ে উল্টো দিকে যায়নি, এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত,’ বলে উঠল হেবার।
ম্যাচের কাঠি জ্বালাল জেনিংস। ওদের আশেপাশের কিছুটা জায়গা আলো—কিত হল। একটা গম্বুজের মত জায়গা। ছাদের পাথরগুলো কিছুটা নিচের দিকে নেমে এসেছে। ফাটলগুলো ভেজা—অনেক তেলাপোকা ঘুরে বেড়াচ্ছে ফাটলের ধারে।
‘এটা কি মাটির তলার নর্দমা?’ জিজ্ঞেস করল রবার্ট।
‘ভিজে দেখাচ্ছে,’ মন্তব্য করল হেবার। কিন্তু ভেজার কারণ কি?’
ম্যাচের কাঠি নিভে গেল। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল ওরা।
শুকনো মরুভূমি এলাকা এটা। এখানে পানি কোথা থেকে আসছে?’ আবার প্রশ্ন করল হেবার।
….নিশ্চয়ই মাটির নিচের প্রস্রবণ…’ একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাবার চেষ্টা করল রবার্ট!
‘অথবা এমনও হতে পারে যে এটাই সেই রাজা সলোমনের মাটির তলার কোয়ারি। সমুদ্রের তলায় ডুবে যায় সেই বহুমাইল বিস্তৃত কোয়ারি। শামুক জাতীয় সামুদ্রিক প্রাণীর ফসিলও নাকি কিছু জায়গায় পাওয়া গেছে। হতে পারে সমুদ্রের কিছু পানি আটকা পড়ে আছে এখানে এখনও।
চুপ করে রইল থর্ন। ভারি শ্বাস পড়ছে তার।
‘চল যাওয়া যাক,’ বলল সে।
‘দেয়াল ফুটো করে?’
‘না ফিরতি পথে।’
হাতড়ে ফিরে চলল ওরা। ভেজা দেয়ালে হাত রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্ধকারে ওদের অগ্রগতি খুব ধীর, এক এক গজ এক এক মাইলের সমান মনে হচ্ছে ওদের কাছে। হঠাৎ দেয়ালের ফাঁকে হেবারের হাত ঢুকে গেল প্রথমে চমকে উঠলেও পরক্ষণেই বুঝতে পারল এটার সাথে নব্বই ডিগ্রী কোণ করে আর একটা টানেল ওদিকে গেছে।
রবার্টের হাত ধরে তাকে থামাল হেবার। যাবার সময় এটা তাদের চোখ এড়িয়ে গেছে। কারণ দুজনেই উল্টো দিকের দেয়াল ধরে এগুচ্ছিল।
‘ওদিকে একটা আলো দেখা যাচ্ছে,’ ফিসফিস করে বলল হেবার।
‘সম্ভবত আমাদের গাইড ওদিকেই গেছে।’
ওদিকেই রওনা হল ওরা। এটা অন্য টানেলটার মত নয়, অনেকটা গুহার মত। এবড়োখেবড়ো দেয়াল থেকে বড় বড় পাথর বেরিয়ে রয়েছে। আলোর কাছাকাছি পৌঁছে ওরা দেখল কেবল একটা টর্চ নয় বরং একটা আলোকিত বড় গুহা থেকে আলোটা আসছিল। ভিতরে দুজন মানুষ—একজন সেই আরব, আর অন্যজন বেশ বয়স্ক মানুষ। খাকি হাফপ্যান্ট আর হাফহাতা শার্ট তাঁর পরনে। মুখটা গম্ভীর। তাঁর পেছনে একটা কাঠের টেবিল, বিভিন্ন কাগজপত্র ছড়িয়ে রয়েছে তার ওপর। কাগজে নানান ধরনের আঁকিবুকি টানা।
উঁচুনিচু পাথরের চৌকাঠ পেরিয়ে রবার্ট আর হেবার ঢুকল প্রশস্ত গুহার মত জায়গায়।
‘দুইশো দ্রাখমা,’ বলে হাত বাড়িয়ে দিল আরব লোকটা।
‘টাকাটা দিয়ে দিতে পারেন,’ বললেন থাকি প্যান্ট পরা বৃদ্ধ।
‘আপনি কি.…’ কথা শেষ হবার আগেই মাথা ঝাঁকালেন ভদ্রলোক। ‘তাহলে আপনিই বুগেনহাগেন?’
‘হ্যাঁ।’
সন্দিগ্ধ চোখে চাইল হেবার।
‘বুগেনহাগেন ছিলেন সতেরো শতাব্দির একজন ধর্মীয় ওঝা।’
‘সেটা নয় পুরুষ আগের কথা।’
‘কিন্তু আপনি—’
‘আমি ওই তাঁদেরই শেষ অযোগ্য বংশধর।‘
ঘুরে টেবিলের পিছনে রাখা চেয়ারটাতে গিয়ে বসলেন বুগেনহাগেন। গুহায় ঝুলানো অসংখ্য লণ্ঠনের উজ্জ্বল আলোয় তাঁর পাণ্ডুর মুখটাকে স্বচ্ছ মনে হচ্ছে। তাঁর কপালে আর মাথার সামনে দিয়ে পাতলা হয়ে আসা চুলের ভিতর চামড়ার নিচের নীল রগগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
‘এই জায়গাটা কি?’ প্রশ্ন করল রবার্ট Į
জ্যাযরিল, মহাপ্রলয়ের শহর। এখানেই খ্রিস্টানত্বের জন্ম,’ ভাবলেশহীন মুখে জবাব দিলেন তিনি। আমার কারাগার।
‘অর্থাৎ?’ থর্ন জিজ্ঞেস করল।
‘ভৌগলিক ভাবে এটাই খ্রিস্টান ধর্মের কেন্দ্র। সুতরাং আমি যতক্ষণ এখানে আছি কেউ আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
একটু থেমে ওদের দুজনের ভাব লক্ষ্য করলেন বুগেনহাগেন। কথাটা কতখানি বিশ্বাসযোগ্য ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারছে না ওরা।
‘দয়া করে ওর টাকাটা ওকে দিয়ে দিন,’ বললেন তিনি।
পকেট থেকে টাকা বের করে ওর পাওনা মিটিয়ে দিল থর্ন। সাথে সাথেই তিনজনকে নীরবে মুখোমুখি রেখে লোকটা যেদিক দিয়ে এসেছিল সেই পথে অদৃশ্য হল। নীরবতা ভাঙলেন বুগেনহাগেন।
‘সেই পাদরী সে কি মারা গেছে?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
ট্যাসোনের কথা জিজ্ঞেস করা হচ্ছে বুঝতে পেরে সচকিত হয়ে তাকাল থর্ন বুগেনহাগেনের দিকে।
‘হ্যাঁ,’ জবাব দিল সে।
‘তাহলে বসুন। কাজে লেগে যাই আমরা।’
ইতস্তত করে নিজের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল সে। জেনিংসের দিকে চোখ পড়ল এবার বুগেনহাগেনের।
‘ক্ষমা করবেন, এটা কেবল মিস্টার থর্ন আর আমার ব্যাপার।’
‘আমিও আছি এতে তাঁর সাথে,’ জবাব দিল হেবার।
‘ভুল ধারণা।’
‘আমিই তাকে এখানে এনেছি।’
‘সে জন্যে মিস্টার থর্ন অবশ্যই কৃতজ্ঞ।’
‘মিস্টার থর্ন…?’
উনি যা বলছেন তাই কর,’ জবাব দিল রবার্ট।
অপমানে আড়ষ্ট হয়ে গেল হেবার।
‘এখানে কোন্ চুলোয় যাব আমি?’
‘দেয়াল থেকে একটা লণ্ঠন নিয়ে যান।‘
অনিচ্ছা সত্ত্বেও যা বলা হল তাই করল হেবার। যাবার আগে একবার রবার্টের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চাইল সে তারপর লণ্ঠন হাতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
কয়েকটা অস্বস্তিকর নীরব মুহূর্ত পার হল। বৃদ্ধ তাঁর ডেস্কের পিছন থেকে উঠে দাঁড়ালেন। হেবার জেনিংসের পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতেই মুখ খুললেন তিনি।
আপনি কি বিশ্বাস করেন আপনার সঙ্গীকে?’ প্রশ্ন করলেন তিনি।
‘হ্যাঁ।’
‘কাউকে বিশ্বাস করবেন না।‘
ঘুরে পাথর কেটে বানানো একটা কার্বার্ডের ভিতর থেকে খুঁজে পেতে একটা কাপড়ে মোড়া পুঁটুলী বের করে আনলেন বৃদ্ধ।
‘আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি তো?’ জিজ্ঞেস করল থর্ন।
তার কথার কোন জবাব না দিয়ে নিজের টেবিলে ফিরে এসে পুঁটুলীটা খুলতে আরম্ভ করলেন বুগেনহাগেন। ভিতর থেকে সাতটা শিক কাবাবের সিকের মত চকচকে কাঁটা আলো পড়ে ঝিলিক দিয়ে উঠল। প্রত্যেকটা কাঁটার হাতলেই হাতীর দাঁতে বাঁধানো যীশুর ক্রুশ বিদ্ধ প্রতিকৃতি খোদাই করা রয়েছে।
‘এগুলোতে বিশ্বাস রাখুন,’ বললেন তিনি। এখন একমাত্র এগুলোই আপনাকে বাঁচাতে পারে।’ স্টিলেটোগুলো হাতে নিয়ে একে একে টেবিলের ওপর খাড়া ভাবে গাঁথলেন বুগেনহাগেন। সাতটা মিলে একটা ক্রস চিহ্ন হল।
‘কাজটা পবিত্র স্থানে সম্পন্ন করতে হবে,’ নিচু স্বরে বলে চললেন তিনি ‘গির্জার ভিতর। তার রক্ত দিয়ে সিক্ত করতে হবে ঈশ্বরের বেদী। থেমে থেমে প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট করে উচ্চারণ করলেন বৃদ্ধ, যেন রবার্টের বুঝতে কোন অসুবিধে বা ভুল না হয়। ‘প্রত্যেকটা কাঁটাই গোড়া পর্যন্ত বেঁধাতে হবে, ঠিক হাতলের ওপর যীশুর পা পর্যন্ত। এই ভাবে ক্রসের আকারে গাঁথতে হবে সবগুলো।’ তাঁর শুকনো হাত বাড়িয়ে টেবিলে গাঁথা মাঝের কাঁটাটা খুলে নিলেন বুগেনহাগেন। ‘এই মাঝের কাঁটাটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটা তার জীবন নাশ করবে, তাই এটাই হচ্ছে ক্রসের কেন্দ্র। পরেরগুলো নষ্ট করবে তার সব আধ্যাত্মিক শক্তি। কেন্দ্র থেকে ধীরে ধীরে ক্রসের আকারে বেঁধাতে হবে কাটাগুলো…’
একটু থামলেন তিনি। খুঁটিয়ে লক্ষ্য করছেন থর্নের মনোভাব।
‘মন থেকে দয়ামায়া পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলতে হবে,’ বলে চললেন তিনি মনে রাখতে হবে ওটা মানব সন্তান নয়।’
প্রথম চেষ্টাতে কিছুই বলতে পারল না রবার্ট—গলা দিয়ে কোন স্বরই বের হল না তার। যখন বেরুল তখন তার নিজের কাছেই নিজের স্বর অপরিচিত মনে হল।
‘যদি আপনি ভুল করে থাকেন?’ জিজ্ঞেস করল রবার্ট। যদি সে সত্যিই মানব সন্তান…’
‘ভুল করবেন না।’
‘নিশ্চয়ই কোন না কোন প্রমাণ…’
‘তার দেহে জন্মদাগ আছে। তিনটে ছয়।’
রবার্টের শ্বাস দ্রুত হল।
‘নেই।‘
‘বাইবেল বলে শয়তানের পাঠানো সবার দেহে ওই দাগ থাকতেই হবে।’
‘ওর তা নেই।’
‘থাকতেই হবে।’
‘আমি স্নান করিয়েছি তাকে—তার দেহের প্রতিটি ইঞ্চি আমার জানা।’
যদি বাইরে থেকে দেখা না যায় তবে বুঝতে হবে চুলের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে ওটা। জন্মের সময়ে কি ওর মাথায় অনেক চুল ছিল?’
রবার্টের মনে পড়ল ওকে প্রথম যেদিন দেখে সেদিনের কথা। ওর বড় বড় ঘন চুল রবার্টকে আকৃষ্ট করেছিল। মাথা ঝাঁকাল সে।
চুল কামিয়ে ফেললেই আপনি দাগটা খুঁজে পাবেন।’
চোখ বুজে দুহাতে মুখ ঢাকল রবার্ট।
‘একবার কাজ আরম্ভ করে পিছপা হবেন না।’
মাথা নাড়ল থর্ন। কিছুতেই কথাটা মনে প্রাণে মেনে নিতে পারছে না সে। ‘আপনি কি আমাকে অবিশ্বাস করছেন?’ প্রশ্ন করলেন বুগেনহাগেন। ‘জানি না আমি,’ মুখ না তুলেই জবাব দিল রবার্ট।
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রবার্টকে খুঁটিয়ে দেখলেন বুগেনহাগেন।
‘যেমন ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল—আপনার অনাগত সন্তান মৃত, আপনার স্ত্রীও মতা…’
‘কিন্তু ও যে একটা শিশু…’
‘আপনি আরও প্রমাণ চান?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে অপেক্ষা করুন,’ বললেন বৃদ্ধ। ‘আপনার যা করণীয় সে সম্বন্ধে আপনি আগে নিঃসন্দেহ হয়ে নিন। নইলে কাজটা সুসম্পন্ন হবে না। আপনার মনে কোন রকম সংশয় থাকলে ওরা পরাস্ত করবে আপনাকে।
‘ওরা…?’
‘আপনি বলেছিলেন এক মহিলা আপনার ছেলের দেখাশোনা করে।
‘মিসেস বেল্ক…’
সমঝদারের মত মাথা ঝাঁকালেন বৃদ্ধ।
‘তার আসল নাম হচ্ছে বাআলক। মহিলা শয়তানের স্বধর্মী—সে তার জীবন থাকতে এটা হতে দেবে না।’
চুপ হয়ে গেলেন বৃদ্ধ। পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। একটু পরেই লণ্ঠন হাতে হেবারকে দেখা গেল। তার চোখে মুখে উত্তেজনা আর বিস্ময়।
‘… হাজার হাজার কঙ্কাল…’ ফিসফিস করে বলল সে।
‘সাত হাজার,’ জবাব দিলেন বৃদ্ধ।
‘কি হয়েছিল?’
‘আরমেগেডন–মহাপ্রলয়—পৃথিবীর ধ্বংস।‘
এগিয়ে এল হেবার। এতগুলো কঙ্কাল দেখে তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
‘আপনি বলেছেন… ‘মহাপ্রলয়’ ঘটে গেছে?’
‘অবশ্যই,’ জবাব দিলেন তিনি। ‘ঘটেছে এবং আরও অনেকবার এটা ঘটবে। টেবিলের ওপর থেকে কাঁটাগুলো খুলে কাপড়ে মুড়ে রবার্টের হাতে গুঁজে দিলেন বৃদ্ধ। নিতে অস্বীকার করতে চেয়েছিল রবার্ট, কিন্তু তার সুযোগ পেল না সে। বৃদ্ধের চোখে চোখ রেখে উঠে দাঁড়াল থর্ন।
দীর্ঘ জীবন উপভোগ করেছি আমি,’ কাঁপা আবেগরুদ্ধ স্বরে বললেন বৃদ্ধ। ‘আমার একটাই প্রার্থনা—আমার বেঁচে থাকাটা যেন অর্থহীন না হয়।’
থর্ন ঘুরে দাঁড়িয়ে হেবারের সাথে এগিয়ে গেল সেই অন্ধকার গলিটার দিকে নীরবেই এগিয়ে গেল রবার্ট। ওখান থেকে বেরিয়ে যাবার মুখে একবার কেবল ফিরে চাইল—জায়গাটাকে শেষবারের মত একবার দেখে নিল রবার্ট।
জেরুযালেমের রাস্তায় ওরা দু’জনে পাশাপাশি হেঁটে চলেছে—কেউই কোন কথা বলছে না। রবার্টের হাতে কাপড়ের পুঁটুলীটা শক্ত মুঠোয় ধরা। তার মুখটা সাংঘাতিক রকম গম্ভীর। যন্ত্রচালিতের মতই এগিয়ে চলেছে সে। শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে চেয়ে আছে রবার্ট। কয়েকবার তাকে প্রশ্ন করেও কোন উত্তর পায়নি হেবার। একটা সরু রাস্তায় ঢুকল ওরা, দু’পাশেই পুরোদমে নির্মাণ কাজ চলেছে। রবার্টের সাথে সমান তালে চলতে গিয়ে প্রায় ছুটতে হচ্ছে হেবারকে চারপাশের নির্মাণ কাজের শব্দের মধ্যে তার কথা রবার্ট শুনতে পাচ্ছে না বলে বেশ অস্থির বোধ করছে হেবার!
‘বুড়ো কি বলল সেটা জানতে চাই আমি,’ চিৎকার করে বলল হেবার। জানার অধিকার যে আমার আছে সেটা নিশ্চয়ই অস্বীকার করবেন না?’
জবাব না দিয়ে চলার গতি আরও বাড়িয়ে দিল রবার্ট—যেন ওর কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়াই তার একমাত্র উদ্দেশ্য।
‘থর্ন, আমি জানতে চাই ও কি বলল!’
এগিয়ে এসে রবার্টের হাত চেপে ধরল হেবার।
‘এই যে মশাই, আমি এতে কেবলমাত্র দর্শক নই। আমিই খুঁজে বের করেছিলাম আরমেগেড্ডন আর ওই বুড়োকে।’
থেমে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত চোখে ওর দিকে চাইল রবার্ট।
‘ঠিক! প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত এই সবই তোমার খুঁজে বের করা।’
‘তার মানে?’
‘তুমিই সেই প্রথম থেকে এর মধ্যে রহস্যের সন্ধান খুঁজে পেয়েছ, তুমি বলে বলে আমার মাথায় এসব ঢুকিয়েছ…।’
‘শোনেন, এক মিনিট…’
‘তুমিই না তুলেছিলে সেই ছবিগুলো…’
‘হল কি আপনার? কি…’
‘আমি ভাল করে জানিও না তুমি কে!’
হেবারের কবল থেকে জোর করে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল রবার্ট। সাথে সাথেই হেবার আবার তাকে ধরে ফেলল।
‘থর্ন! এই জন্যেই বোধহয় তোমাদের মত বড়লোককে সাধারণ লোকে হারামজাদা বলে। শোন, আমার যা বলার আছে তা তোমাকে শুনতেই হবে। ‘
‘আজ পর্যন্ত অনেক শুনেছি আমি—আর দরকার নেই আমার।’
‘আমি তোমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি…’
‘যথেষ্ট হয়েছে আর সাহায্য দরকার নেই আমার!’
দু’জনে দু’জনের চোখের দিকে চেয়ে রইল। রাগে কাঁপছে রবার্ট।
‘এখন ভাবতেও হাসি পাচ্ছে যে আমি এসব কথায় কান দিয়েছিলাম, বিশ্বাস করেছিলাম!’
‘থর্ন।’
‘কে জানে? হয়ত এটা ওই বুগেনহাগেন লোকটার ছুরি বিক্রি করার একটা ফন্দি!’
‘কি বলছ কি তুমি?’
কম্পিত হাতে পুঁটুলীটা তুলে ধরল রবার্ট।
‘এগুলো ছুরি, অস্ত্র! ও চায় আমি এগুলো দিয়ে ছেলেটাকে খুন করি।‘
‘ওটা ছেলে নয়।‘
‘অবশ্যই একটা ছেলে ও!’
‘ঈশ্বরের দোহাই, আর কি প্রমাণ চাও তুমি?’
‘আমাকে কি ভাব তুমি?’
‘একটু ঠাণ্ডা হও…’
‘না!’ চিৎকার করে উঠল রবার্ট। ‘আমি এ কাজ করতে পারব না। এসবে কোন অংশ নিতে চাই না আমি। একটা বাচ্চাকে খুন করব? আমাকে পেয়েছ কি তোমরা?’
রাগের চোটে পুঁটুলীটা সামনের দিকে ছুঁড়ে মারল রবার্ট। দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে একটা গলির ভিতর গিয়ে পড়ল ওটা।
‘তুমি করবে না?’ খেঁকিয়ে উঠল হেবার। তবে কাজটা আমিই শেষ করব।’
ওটা ফেরত আনার জন্যে হেবার রওনা হতেই রবার্ট বাধা দিল তাকে।
‘জেনিংস।’
‘স্যার!’ তিক্ত কণ্ঠে জবাব দিল হেবার।
‘তোমার মুখ আর কোনদিন আমি দেখতে চাই না। এই সব কিছুর থেকেই আমি নিজেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছি।’
ঠোঁট উল্টে পুঁটুলীটার সন্ধানে হেবার দ্রুত গলির মধ্যে ঢুকল। জায়গাটা আবর্জনায় ভর্তি। একটা আবর্জনা ভর্তি গাড়ি ঠিক পুঁটুলীটার ওপরই আবর্জনা ফেলতে যাচ্ছে দেখে ছুটে গেল হেবার। নিচু হয়ে ওটা হাতে তুলে নেয়ার সময়ে সে লক্ষ্য করল না আর একটা ক্রেনের বিশাল বাহু অন্যদিক থেকে ঠিক তার মাথার ওপরই আবর্জনা ফেলার জোগাড় করেছে। উপর দিকে চেয়েই ছুট দিল সে। সব আবর্জনা প্রবল বেগে একসাথে নিচে নেমে আসছে। বিপদের আওতার বাইরে চলে এসেছে হেবার। কিন্তু হঠাৎ একটা বিশাল ভাঙা কাঁচের টুকরা বাতাস কেটে ঘুরে ছুটে এল ওর দিকে। হেবারের ঘাড়ের ওপর পড়ে ওকে দুটুকরো করে ফেলল। মাটিতে আছড়ে পড়ে সহস্র টুকরো হয়ে তারপর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
থর্ন প্রথমে শব্দটা শুনল তারপরেই দেখল রাস্তার লোকজন সব চিৎকার করে ছুটে যাচ্ছে হেবার যে গলিতে ঢুকেছে সেদিকে। ওদের পিছন পিছন গেল রবার্ট। ধাক্কাধাক্কি করে সামনে এগিয়ে দেখল হেবার দু’-টুকরো হয়ে পড়ে রয়েছে মাটিতে। দুর্বল দমকে তখনও রক্ত বের হচ্ছে যেন হার্ট এখনও কাজ করে চলেছে। হেবারের প্রাণহীন দেহটার কাছেই পড়ে আছে কাপড়ের পুঁটুলীটা। ধীর পায়ে এগিয়ে ওটা তুলে নিয়ে হোটেলের পথ ধরল রবার্ট। তার চোখ দুটো চকচক করছে একটা প্রচণ্ড আক্রোশে।