অশুভ সংকেত – ২

দুই

রবার্ট আর ক্যাথি দুজনেই জন্ম-ক্যাথলিক। কিন্তু দুজনের কেউই খুব ধর্মপ্রাণ নয়! ক্যাথি মাঝে মধ্যে চার্চে যায়—বিশেষ করে বড়দিনে আর ঈস্টারে,—তবে সেটা ধর্মের টানে নয় নেহায়েত সামাজিকতা রক্ষা করার জন্যেই। ডেমিয়েনের যে আনুষ্ঠানিকভাবে গির্জায় অবগাহন করা হয়নি, এটা রবার্টের চেয়ে ক্যাথিকেই পীড়া দেয় বেশি। এমন না যে তাদের চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল। জন্মের পরপরই যথারীতি ডেমিয়েনকে তারা গির্জায় নিয়ে যায়। কিন্তু ক্যাথিড্রাবল ঢোকার সাথে সাথেই ডেমিয়েন এমন আশ্চর্য রকম ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে বাধ্য হয়ে অনুষ্ঠান শেষ করার আগেই তাদের বেরিয়ে আসতে হয়। ধর্মযাজক ওদের পিছু পিছু রাস্তা পর্যন্ত এসেছিলেন আঁজলা ভরা পবিত্র পানি হাতে। বারবার তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে অবগাহন না হলে সেই শিশু কোনদিনই স্বর্গরাজ্যে প্রবেশাধিকার পাবে না। কিন্তু বাচ্চার অবস্থা দেখে রবার্ট আর কিছুতেই আর এক মুহূর্তও গির্জায় থাকতে রাজি হয়নি। ক্যাথির সন্তুষ্টির জন্যে অবশ্য বাসায় একটা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিল সে—কিন্তু ক্যাথির মন তৃপ্ত হয়নি তাতে। পরে আবার একদিন গির্জায় গিয়ে যথারীতি কাজটা সম্পন্ন করিয়ে নেয়ার ইচ্ছাটা তার অপূর্ণই থেকে গেছে।

সেদিনটা আর কোনদিনই এল না। এটা সেটা নানান কাজের ঝামেলার ভিড়ে অবগাহন করানো আর হয়ে ওঠেনি। অর্থনৈতিক কনফারেন্স শেষ হওয়ার পর তারা ওয়াশিংটনে ফিরে আসে। রবার্ট থর্ন প্রেসিডেন্সিয়াল উপদেষ্টা হিসেবে কাজে যোগ দিয়ে রাজনীতির মধ্যে জড়িয়ে পড়ে। তার ভার্জিনিয়ার ম্যাকলিনের বিশাল জায়গাজোড়া প্রাসাদ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মিলন-কেন্দ্র হয়েছে। নিউ ইয়র্ক থেকে ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত সব পত্র-পত্রিকা আর ম্যাগাজিনেই তাদের কিছু না কিছু খবর অবশ্যই থাকে। ওদের চেহারা চমৎকার আসে ছবিতে। রবার্ট বড়লোক, উন্নতির সোপান বেয়ে দ্রুত উপরে উঠছে সে। অনেক সময় তাদের কাটাতে হয় প্রেসিডেন্টের সাথে। তাকে যে মেজে ঘসে কিজন্যে তৈরি করা হচ্ছে এটা অনেকেই আন্দাজ করে নিয়েছে। তাই সে যখন সেন্ট জেমস কোর্টের দূত নিযুক্ত হল বিস্মিত হয়নি কেউ।

লণ্ডনে রবার্টকে পেরিফোর্ডের সতেরো শতকে নির্মিত প্রাসাদে জায়গা দেয়া হল থাকার। জীবনটা স্বপ্নের মত সুন্দর হয়ে উঠল ওদের। বিশেষ করে ক্যাথির জন্যে এই জীবন একেবারে নিখুঁত—প্রায় ভীতিকরভাবে সুন্দর। গ্রামের পরিবেশের বিশাল প্রাসাদে সে নিজের ইচ্ছেমত প্রাণ ঢেলে মাতৃ স্নেহে ভরিয়ে দেয় তার আদরের ছেলেকে। আবার যখন খুশি স্বামীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে কূটনৈতিক পার্টি আর নাচের আসরে আদর্শ হোস্টেসের কাজ করে। অনেক প্রতীক্ষার পর ছেলে, পেয়েছে সে—জীবন তার পরিপূর্ণ। স্বামীর গভীর ভালবাসাও সে জয় করে নিয়েছে। ফুলের মতই কোমল আর সুদর হয়ে উঠেছে ক্যাথি সবার মাঝে ঘুরে ফিরে হালকা নির্মল আনন্দ ছড়ায় সে প্রজাপতির মত।

পেরিফোর্ড অট্টালিকাটা সত্যিই সুন্দর। ইতিহাসের অনেক ঘটনাই জড়িয়ে আছে এর সাথে। মাটির তলায় ঘর আছে এখানে-ওই ঘরেই নির্বাসিত ডিউক লুকিয়ে ছিলেন তাঁকে ধরে নিয়ে হত্যা করার আগে পর্যন্ত। চারপাশে নির্জন ঘন জঙ্গলে ভরা— এখানে পঞ্চম হেনরি বন্য বরাক শিকার করতেন। গুপ্ত সুড়ঙ্গ আর পলিতে ভরা এই প্রাসাদ।

দৈনন্দিন কাজ করার জন্যে আছে কয়েকজন লোক। প্রত্যেকদিন দিনের কাজ করে দিয়ে যায় ওরা। এছাড়া স্থায়ীভাবে আছেন হর্টন দম্পতি। রান্নার আর শোফারের কাজের ভার রয়েছে ওদের ওপর। ইংরেজ উন্নাসিকতা পুরোমাত্রায় রয়েছে ওদের মধ্যে। ক্যাথি যখন অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকে তখন ডেমিয়েনকে দেখাশুনা করার জন্যে রয়েছে একজন শিশুসুলভ স্বভাবের ইংরেজ স্বাস্থ্যবতী মেয়ে চেসা। হাসিখুশির মধ্যে সারাদিন সে সবাইকে বেশ মাতিয়ে রাখে। ডেমিয়েনকেও সে নিজের ছেলের মতই আদর যত্ন করে। ঘন্টার পর ঘন্টা ওরা একসাথে কাটায় পুকুর পাড়ে ফড়িঙ আর বেঙাচি ধরে। পরে সেগুলো আবার কাঁচের পাত্রে ভরে নিয়ে আসে ঘরে।

জন্মের তিন বছরের মধ্যেই ডেমিয়েন শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মত নিখুঁত মানুষ হয়ে উঠেছে। চমৎকার তার স্বাস্থ্য আর বয়সের তুলনায় সে অন্যদের চেয়ে অবিশ্বাস্য রকম বেশি শক্তি রাখে। একটা অদ্ভুত সংযত ভাব রয়েছে তার মধ্যে এমন পরিতৃপ্ত ভাব সাধারণত ছোট ছেলেদের মধ্যে দেখা যায় না। অতিথিরা প্রায়ই তার চাহনির সামনে চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য হয়। একাগ্রতা কার কত বেশি তা যদি বুদ্ধির মাপকাঠি বলে ধরা যায় তাহলে বলতে হয় ডেমিয়েন একটা প্রতিভা। প্রায়ই তাকে দেখা যায় আপেল গাছের নিচে কাঁচা লোহার বেঞ্চে একা একা চুপচাপ বসে একদৃষ্টে চেয়ে দেখছে কে আসে আর কে যায়। প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি যেন সে নিজের মনের ভিতরে গেঁথে নিচ্ছে।

শোফার হর্টন মাঝে মধ্যে ওকে গাড়িতে নিয়ে বেড়াতে বের হয়। সে খুব অবাকই হয় ছেলেটাকে বাইরে কি ঘটছে তা দুচোখ দিয়ে অসাধারণ কৌতূহলের সাথে গ্রাস করতে দেখে।

‘ছেলেটাকে দেখে মনে হয় যেন মঙ্গল গ্রহের ছোট্ট একটা মানুষ,’ একদিন কথায় কথায় স্ত্রীর কাছে মন্তব্য করেছিল হর্টন। ‘মনে হয় পৃথিবীর মানুষের আচার ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করতেই ওকে পাঠানো হয়েছে এখানে।’

‘ডেমিয়েন তার মায়ের চোখের মণি,’ জবাব দিয়েছিল তার স্ত্রী। ‘এমন মন্তব্য তাঁর কানে গেলে খুব ভাল হবে না।’

‘না, আমি ছেলেটার কোন দোষ দিচ্ছি না—বলছিলাম, এটা আমার কাছে খুব অস্বাভাবিক ঠেকে, এই যা।’

ডেমিয়েনের আর একটা অস্বাভাবিক দিক হচ্ছে কথা সে খুব কম বলে। ধরতে গেলে কণ্ঠস্বর সে ব্যবহার করেই না। খুশি হলে নিঃশব্দে গালে টোল ফেলে হাসে আর দুঃখ পেলে নীরবেই ফোঁটা ফোঁটা চোখের জল ফেলে। ক্যাথি এই ব্যাপারে একবার ডাক্তারের সাথে আলাপ করেছিলেন। ডাক্তার তাকে অভয় দিয়ে আরেকটা বাচ্চার গল্প শুনিয়েছিলেন। ছেলেটা আট বছর বয়স পর্যন্ত একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। হঠাৎ একদিন তাকে আলুভর্তা খেতে দেয়ায় সে স্পষ্ট স্বরে জানিয়ে দিল আলুভর্তা তার পছন্দ নয়। মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কথা বলতে পারিস তো এতদিন বলিসনি কেন?’ শান্ত স্বরে ছেলে জবাব দিয়েছিল, এর আগে তাকে কোনদিন আলুভর্তা খেতে দেয়া হয়নি—তাই!

গল্প শুনে হেসে আশ্বস্ত হয়েছিল ক্যাথি। ওর বয়স সাড়ে তিন বছর মাত্র অ্যালবার্ট আইনস্টাইনও তো চার বছর বয়সের আগে কথা বলেননি? সবদিক থেকেই নিখুঁত তার ছেলে। তাদের জীবন স্বার্থক করে কোলে এসেছে ডেমিয়েন ভাগ্যবান ওরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *