অশুভ সংকেত – ৬

ছয়

সেদিন বেশ রাত করেই বাড়ি ফিরল ক্যাথি। গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিল ছেলেটা। চিড়িয়াখানা থেকে বেরিয়ে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে গাড়িতে ঘুরে বেড়িয়েছে ওরা। আহত অভিমানে ডেমিয়েন চুপচাপ ক্যাথির পাশে নীরবে বসে ছিল। সে বুঝতে পারছে না অন্যায়টা সে কি করল। সকালে চিড়িয়াখানায় যাবার পথে ক্যাথি ওকে যে সব ছড়া শুনিয়েছিল সেগুলো একবার আবৃত্তি করার চেষ্টা করল ডেমিয়েন—কিন্তু মায়ের কাছ থেকে সাড়াই পেল না সে। শূন্য চোখে সামনের দিকে চেয়ে বসে আছে ক্যাথি। অন্ধকার হয়ে আসতে ডেমিয়েন জানাল তার খিদে পেয়েছে—মায়ের কাছ থেকে এবারেও কোন সাড়া না পেয়ে একটা কম্বল টেনে নিয়ে সে পিছনের সিটে কুঁকড়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

নির্দিষ্ট কোন গন্তব্যস্থল ছাড়াই দ্রুতবেগে অনেকক্ষণ গাড়ি ড্রাইভ করল ক্যাথি। একটা ভয় পিছু ধাওয়া করছে–ডেমিয়েন বা মিসেস বেলকের ভয় নয়—তার কেবলই মনে হচ্ছে সে পাগল হয়ে যাচ্ছে।

পেরিফোর্ডের বাসায় রবার্ট অপেক্ষা করছিল ক্যাথির জন্যে। সে আশা করেছিল সারাদিন ঘুরে বেরিয়ে উৎফুল্ল থাকবে ক্যাথি। ওরা ফিরে এলেই দুজনে একসাথে বসে খাবে বলে রাতের খাবার ক্যাথি ফিরে এলেই সার্ভ করার নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল রবার্ট। ছোট টেবিলটায় একসাথে খেতে বসে রবার্ট আশাহত মনে লক্ষ্য করল কেমন চুপচাপ আড়ষ্ট ভঙ্গিতে খাচ্ছে ক্যাথি।

শরীর খারাপ লাগছে তোমার?’ কথা বলে পরিবেশটা হালকা করার চেষ্টা করল রবার্ট।

‘না।’

‘তবে এত চুপচাপ আর মনমরা হয়ে রয়েছ কেন?’

‘কিছু না, একটু ক্লান্ত বোধ করছি।’

‘খুব ঘুরেছ বুঝি?’

‘হ্যাঁ।’ কাটা কাটা জবাব দিচ্ছে ক্যাথি-বোঝাই যাচ্ছে কথা বলতে ভাল লাগছে না তার।

‘সময়টা ভাল কেটেছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘তোমাকে কেমন যেন অস্থির মনে হচ্ছে?’

‘তাই নাকি?’

‘তোমার হয়েছেটা কি বল তো?’

‘কি আবার হবে?’

‘জানি না, তবে তোমাকে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে।’

‘ও কিছু না, ক্লান্ত আমি, ঘুমুলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’

একটু মেকী হাসি দিল ক্যাথি। কিন্তু রবার্টের দুশ্চিন্তা তাতে দূর হল না। ‘ডেমিয়েনের শরীর ভাল তো?’ জিজ্ঞেস করল রবার্ট।

‘হ্যাঁ।’

‘ঠিক জানো?’

‘হ্যাঁ।’

ক্যাথির দিকে চেয়ে আছে থর্ন। তার চোখ এড়াবার জন্যেই চোখ তুলে চাইছে না ক্যাথি।

‘যদি ডেমিয়েনের কিছু হয়ে থাকে… নিশ্চয়ই আমাকে লুকোবে না তুমি…তাই না?’

‘ডেমিয়েনের? কেন, ওর আবার কি হবে, রবার্ট? আমাদের ছেলের কি হতে পারে? আমরা তো যীশুর আশীর্বাদ প্রাপ্ত—তাই না?’

চোখাচোখি হল ওদের। ক্যাথির চোখ দুটো একটু যেন হেসে উঠল, কিন্তু আনন্দের চিহ্ন মাত্র নেই সে চোখে।

‘অর্থাৎ, থর্ন পরিবারে কোনদিন অশুভ কিছু ঘটতে পারে না। বিপদের কালো মেঘ সব সময়ে দূরে দূরেই থাকে-তাই না?’

‘কিছু একটা ঘটেছে বুঝতে পারছি। কি হয়েছে, ক্যাথি?’ নরম গলায় জিজ্ঞেস করল রবার্ট।

মাথা নিচু করে নিজের দু’হাতে মাথার ভর রেখে প্লেটের দিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইল ক্যাথি।

‘ক্যাথি…’ আবেদন জানাল রবার্ট। ‘কি হয়েছে, বল?’

‘আমার মনে হয়…’ কণ্ঠের আবেগ সামলাবার চেষ্টা করল ক্যাথি। … আমার ডাক্তার দেখানো দরকার।’ দুটো ব্যথিত করুণ চোখ তুলে চাইল সে রবার্টের দিকে। ‘আমার ভয় হয়…স্বাভাবিক সাধারণ মানুষের এমন ভয় হবার কথা নয়।’

‘ক্যাথি…’ ফিসফিস করে বলল রবার্ট। ‘খুলে বল, কি ধরনের ভয়?’ বললে আমাকে তালা বন্ধ করে আটকে রাখবে তুমি।’

‘কি যে বল…’ আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল রবার্ট। আমি তোমাকে ভালবাসি, ক্যাথি।’

‘তবে বাঁচাও আমাকে…একটা ডাক্তার জোগাড় করে দাও!’ ক্যাথির হাত দুটো নিজের হাতে টেনে নিল রবার্ট। ক্যাথির দু’চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।

‘কিছু ভেব না তুমি, ক্যাথি, আমি সব ব্যবস্থা করব।’

চোখ দিয়ে সমানে জল গড়িয়েই চলল ক্যাথির। আজকের দিনের ঘটনাগুলো তার মনের ওপর পাথরের মত ভারি হয়ে চেপে বসেছে।

আমেরিকায় যেমন মনস্তত্ত্ববিদের ছড়াছড়ি, ইংল্যাণ্ডে তেমন নয়। অনেক অনুসন্ধানের পরে রবার্ট মোটামুটি পছন্দসই আর বিশ্বাসযোগ্য একজনকে খুঁজে বের করল। লোকটা আমেরিকান, বয়স আর একটু বেশি হলে রবার্ট আর একটু স্বস্তি পেত, কিন্তু এর ডিগ্রি আর অভিজ্ঞতার বাহার সত্যিই চমকপ্রদ। আমেরিকার জর্জ টাউনেও বেশ কিছুদিন কাটিয়েছে সে এবং সেই সময়ে বেশ কয়েকজন সেনেটরের স্ত্রীর সে সফল চিকিৎসা করেছে।

‘রাজনীতিবিদদের স্ত্রীরা সাধারণত অত্যধিক মদের আসক্তিতে ভোগেন, ‘ প্রথম দিনের সাক্ষাতে মন্তব্য করেছিল গ্রীয়ার। ‘আমার মনে হয় একাকিত্ব থেকেই এটা হয়। সেই সাথে থাকে একটা আলাদা সত্তার অভাব আর ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স।’

‘এক্ষেত্রে আপনি নিশ্চয়ই গোপনীয়তার গুরুত্ব কতখানি তা ঠিক অনুমান করে নিতে পারছেন?’

‘বলতে গেলে আমাদের পেশার সবচেয়ে বড় অঙ্গ ওটা। মানুষ আমাকে বিশ্বাস করে অনেক কথাই বলে। অন্য কারও সাথে তারা তাদের সঙ্কট নিয়ে আলোচনা করে না, কারণ তা ফাঁস হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু আমার কাছে তারা সম্পূর্ণ নিরাপদ, কারণ তাদের কোন উপকার আমি করতে পারি বা না পারি, এখান থেকে কোন কথাই ফাঁস হবে না, সে বিষয়ে গ্যারান্টি আছে।

‘আমি কি ওকে টেলিফোনে আপনার সাথে যোগাযোগ করতে বলব?’

‘কোন দরকার নেই, কেবল আমার টেলিফোন নাম্বারটা তাঁকে দিয়ে রাখলেই চলবে। বাধ্যবাধকতার কোন প্রয়োজন নেই।’

‘না, এটা সে নিজেও চায়…সে-ই আমাকে বলেছে।’

‘তাহলে তো খুব ভাল কথা।’

একটু অস্বস্তিভরে উঠে দাঁড়াল থর্ন। তাকে একটা মধুর বিদায়ী হাসি দিল ডাক্তার।

‘আপনি কি ওকে দেখার পর আমার সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করবেন?’ তার দরকার হবে বলে আমার মনে হয় না।’

‘যদি আপনার…মানে…আমাকে বলার কিছু থাকে?’

‘আমার যা বলার আমি তাঁকেই বলব।’

‘মানে… যদি কোন কারণে আপনি কোন শঙ্কার কারণ অনুভব করেন, সেই কারণেই বলছিলাম।’

কেন তাঁর কি কোন আত্মঘাতী প্রবণতা আছে?’

‘…ন্‌…না।’

‘তবে চিন্তার কিছুই নেই। আপনি ব্যাপারটাকে যত গুরুত্ব দিচ্ছেন, আসলে ততখানি গুরুত্বপূর্ণ নয় এটা।’

আশ্বস্ত হয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে দরজার দিকে এগুলো রবার্ট।

‘মিস্টার থর্ন?’

‘বলুন।’

‘আপনি কেন এসেছিলেন আজ?’

আপনার সাথে দেখা করতে।

‘কিন্তু কি কারণে?’

জবাব না পেয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে রবার্ট জবাব দিল, ‘হয়ত আপনি কেমন, একটু যাচাই করে দেখার জন্যেই।’

‘আপনার কি বিশেষ কিছু বলার ছিল আমাকে?’

একটু ইতস্তত করল রবার্ট। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সে জানাল—না, তেমন কিছু নয়। জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার কি ধারণা আমারও একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিত?’

‘আপনার কি মনে হয়?’ পাল্টা প্রশ্ন করল গ্রীয়ার।

‘আমাকে দেখে কি তাই মনে হচ্ছে আপনার?’

‘আমাকে দেখে আপনার কি মনে হয় আমার দরকার?’

‘না,’ জবাব দিল রবার্ট।

‘কিন্তু আমার একজন আছেন। এই লাইনের কাজে সেটা না থাকলে বিপদ।’

অস্বস্তিকর আলোচনা, নিজের অফিসে ফিরেও সে এই ভাবনা থেকে রেহাই পেল না। সারাদিনই চিন্তাটা মাথায় ঘুরল তার। গ্রীয়ারের কাছে কাউকে কোনদিন যা বলেনি তাই বলে নিজেকে হালকা করে নেয়ার একটা অদম্য স্পৃহা এসেছিল তার মনে। কিন্তু কি লাভ হত তাতে? এই মিথ্যা নিয়েই বাঁচতে হবে তাকে সারাজীবন। কাউকে জানানোর জন্যে তার মন আঁকুপাকু করলেও উপায় নেই— কাকে জানাবে?

দিনটা ব্যস্ত ভাবে কাটল একটা বিশেষ কাজে। আগামীতে একটা মীটিঙে একদল বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আর আরব দেশের তেল কোম্পানীর কিছু সদস্যও হয়ত উপস্থিত থাকতে পারে, এমন আন্দাজ করেই রবার্ট তার বক্তৃতা একটু ভিন্নধর্মী করার উদ্দেশ্যে বাইবেলের সাহায্য নিল। আরব আর ইসরাইলীদের মধ্যে যে বিরোধ সেটা আদি কালের। আজকের কথা নয়, এটা ঐতিহাসিক সত্য।

একটা নয় তিন তিনটে বাইবেল নিয়ে দরজায় খিল দিয়ে বসল সে। বাইবেলের আধুনিক ব্যাখ্যার বইও রাখল সে হাতের কাছেই। সেই ছেলেবেলার পরে এই প্রথম সে আবার বাইবেল নিয়ে বসেছে।

পড়তে পড়তে জেনে অবাক হল সে মধ্যপ্রাচ্যকে আজ পর্যন্ত কত ঝড়—ঝাপটাই না ওলটপালট করে গেছে। ইসরাইলী জু আব্রাহামকে ঈশ্বর আশ্বাস দিয়েছিলেন যে তারা তাদের নিজস্ব পবিত্র ভূমি পাবে। জিনেসিস আর জসুয়ার বইয়ে পরিষ্কার লেখা আছে নির্দিষ্ট জায়গাটার কথা-মিশরের নদী থেকে লেবানন আর ইউফ্রেট্স্ পর্যন্ত। তবে কি আজ এই কারণেই ইসরাইলীরা দেশের সীমানা বাড়িয়ে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর হয়েছে? কিন্তু ঈশ্বর আশ্বাস দিয়েও তা পূর্ণ করলেন না কেন?

“তোমরা আমার ওপর বিশ্বাস রেখে আমার নির্দেশ মত চল। পরিবর্তে তোমরা পাবে এই উর্বর ভূমি আর ধর্মপ্রাণ মানুষের এক সুন্দর রাজত্ব।”

হয়ত এই কথার মধ্যেই ওই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে। জু’রা তাদের বিশ্বাস ভঙ্গ করেছিল—তারাই যীশুখ্রিস্টকে হত্যা করেছিল বলে বর্ণনা করা হয়েছে ‘ডিউটারোনমি’ পুস্তকে। প্রভু যীশুর মৃত্যুর পরে জু’দের জানিয়ে দেয়া হয়েছিল:

“তোমাদের সারা পৃথিবীময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়া হবে। সব দেশেই তোমরাই নির্যাতন আর নিপীড়নের শিকার হবে। অনেক পায়ের তলে দলিত হবে জেরুযালেম বারবার। তারপর এক সময়ে অন্যদের দিন শেষ হলে জেরুযালেমের দুর্দশার সমাপ্তি ঘটবে।”

বিশ্লেষণ বইয়ে জু’দের উপর ঈশ্বরের কোপের প্রচুর প্রমাণ দেখতে পেল রবার্ট। ইসরাইল থেকে প্রথম রাজা সলোমন তাড়িয়ে দিয়েছিল ওদের-পালাতে গিয়ে ক্রুসেডারদের হাতে কচুকাটা হয় তারা। এক হাজার খ্রিস্টাব্দে বারো হাজার জু’কে হত্যা করা হয় বলে লেখা আছে। বারো শতাব্দীতে ইংল্যাণ্ডে যারা আশ্রয় নিয়েছিল তাদের অনেককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়, আর বাকি সবাইকে বের করে দেয়া হয় দেশ থেকে। ১২৯৮ সালে এক লাখ জু’কে মেরে খতম করা হয় ফ্র্যাঙ্কোনিয়া, বাভারিয়া আর অস্ট্রিয়ায়। ১৩০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আরও একলাখ জু’কে ফ্রান্স থেকে মৃত্যুর হুমকি দেখিয়ে বহিষ্কার করা হয়। ১৩৪৮ সালে জু’রা মারাত্মক প্লেগ রোগ ছড়াচ্ছে এই সন্দেহে বিভিন্ন দেশে খুঁজে খুঁজে প্রায় দশ লাখ জু’কে হত্যা করা হয়। ১৪৯২ সালের আগস্ট মাসে রোমান ক্যাথলিক ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে স্পেন থেকে পাঁচ লাখ জু’কে তাড়িয়ে দেয়া হয় আর পাঁচ লাখকে দেয়া হয় মৃত্যুদণ্ড। এইভাবে চলতে চলতে হিটলারের সময়ে ষাট লাখকে হত্যা আর এগারো লাখকে দরিদ্র গৃহহারা এতিম করে ছেড়ে দেয়া হয় নিষ্ঠুর পৃথিবীতে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার জন্যে। এতদিন এত অত্যাচার সহ্য করার পর ওদের আজ এভাবে জীবন-মরণপণ করে তাদের নিজেদের জন্যে একটা ঠাঁই খুঁজে নেয়ার এই চেষ্টাকে কতটা দোষ দেয়া যায়? প্রতিটি সংগ্রামই ওরা এটাই ওদের টিকে থাকার শেষ অবলম্বন মনে করে লড়েছে।

ঈশ্বর জু’দের তিনটে সমান গুরুত্বপূর্ণ আশীর্বাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন। নিজস্ব দেশ; সমৃদ্ধি আর তাঁর বিশেষ শুভ দৃষ্টি, অর্থাৎ ত্রাণকর্তা যীশুর প্রত্যাবর্তন। জু’দের জাইয়নে ফিরে যাওয়ার পরেই যীশুর পুনরাবির্ভাব হবে। তাই যদি হয় তবে কি সেই সময় এখন উপস্থিত? যীশু কি এই মুহূর্তে পৃথিবীতেই কোথাও বিচরণ করছেন? কি পোশাক আছে এখন তাঁর পরনে? আগের সেই আলখাল্লা আর কাঁটাগাছের তৈরি মুকুট—নাকি সুট আর টাই বা পাজামা-পাঞ্জাবী? তিনি কি জন্ম নিয়েছেন? যদি জন্মে থাকেন তাহলে চুপচাপ আছেন কেন এখনও? বিশৃঙ্খলার চরমে কি এখনও পৌঁছেনি পৃথিবী?

এইসব নানান চিন্তার জট মাথায় নিয়ে বইগুলো সাথে নিয়েই বাড়ি ফিরে এল রবার্ট। ক্যাথি ঘুমোতে চলে যাওয়ার পর নিজের স্টাডিতে গিয়ে আবার সে বইগুলো খুলে বসল। যীশুর প্রত্যাবর্তনই এখনও মাথায় ঘুরছে তার। বইয়ে এই বিষষে পড়তে গিয়ে রবার্টের চিন্তাধারা একটা হোঁচট খেল। ভবিষ্যৎবাণীতে বলা হয়েছে প্রত্যাবর্তনের পরই যীশুকে প্রচণ্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হবে। শয়তানের ছেলে, তার চ্যালাচামুণ্ডা আর ঈশ্বরে অবিশ্বাসী লোকজনের মোকাবেলা করতে হবে তাঁকে। পৃথিবী তোলপাড় হয়ে যাবে এই যুদ্ধে-এ হবে স্বর্গ আর নরকের যুদ্ধ—সব জাতির মধ্যে শেষ একটা বিশ্ব মহাযুদ্ধ। সত্যের উদ্ঘাটন হবে—সেই সাথে হবে পৃথিবীর ধ্বংস।

উপর থেকে ঘুমের ঘোরে কাতরোক্তির শব্দ রবার্টের কানে এল। দুবার হয়েই আবার স্তব্ধ হয়ে গেল। নিঃশব্দে ওপরে উঠে এসে দরজা ঠেলে ক্যাথির দিকে চাইল সে। ঘুমাচ্ছে ক্যাথি—কিন্তু ঘুমের মধ্যেই অস্থির ভাবে মাথা এপাশ-ওপাশ করছে বারবার। মুখটা ঘামে ভিজে উঠেছে। ক্যাথি সুস্থির না হওয়া পর্যন্ত দরজার গোড়াতেই অপেক্ষা করল রবার্ট। তার শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসলেই সে আবার অন্ধকার করিডোর ধরে নিচের দিকে রওয়ানা হল। মিসেস বেলুকের ঘরের সামনে দিয়ে পার হওয়ার সময়ে লক্ষ্য করল দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে রয়েছে। বিশাল পাহাড়ের মত দেহটা বিছানার ওপর গভীর ঘুমে অচেতন। জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে ঘরের ভিতরটা আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে। এগিয়ে যেতে গিয়েও হঠাৎ বেলুকের মুখের দিকে চোখ পড়তেই নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল রবার্ট। পাউডারে মুখটা একেবারে সাদা, ঠোঁটে ধাবড়া করে লাগানো হয়েছে লিপস্টিক—মনে হয় যেন নেশায় আচ্ছন্ন অবস্থায় লাগানো। দৃশ্যটা একেবারে হতবুদ্ধি করে দিল রবার্টকে-এর কোন মাথামুণ্ডুই ভেবে পাচ্ছে না সে। নিজের কামরায় একান্তে মেয়েটা বেশ্যার মত করে সেজেছে কেন!

দরজা বন্ধ করে নিচে ফিরে এল রবার্ট। খোলা বইয়ের পাতার দিকে চেয়ে বসে রইল সে। কেবলই চেয়ে দেখছে, পড়ছে না এক অক্ষরও। ডেস্ক হাতড়ে একটা সিগারেট ধরাল রবার্ট। উঠে গিয়ে গ্লাসে কিছুটা মদও ঢেলে নিল। ঘরময় পায়চারি করে মনটাকে বইয়ের পাতায় ফিরিয়ে এনে উপরে দেখা দৃশ্যটাকে মন থেকে তাড়াতে চেষ্টা করল সে। জুরা যখন জাইয়ন গিরিতে ফিরে যাবে, যীশু তখন আবার আসবেন পৃথিবীতে। একই সময়ে শয়তানও জন্ম হবে পৃথিবীতে। দুজন দুইখানে বড় হবে শেষ যুদ্ধে মুখোমুখি হবে দুজনে।

ঈশ্বরের প্রচণ্ড ক্রোধের আগুনে পৃথিবী পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। তারপর আবার মানুষ সৃষ্টি করবেন তিনি…সেই মানুষ হবে সোনার বালির চেয়েও দামি…ওফিরের সোনার চেয়েও খাঁটি।

এই পর্যন্ত পড়ে জেকারিয়ার বই খুলে বসল রবার্ট। সেখানেও একই কথা লেখা রয়েছে ভিন্ন ভাষায়:

“দেখ কি প্রচণ্ড আঘাত হানবেন প্রভু-যারা পবিত্র জেরুযালেমের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবে তাদের দেহের মাংস মাটিতে দাঁড়ানো অবস্থাতেই পচে খসে পড়বে। কোটরেই তাদের চোখ পচবে আর মুখের ভিতরেই পচে গলে যাবে জিভ।”

রবার্ট ভাল করেই জানে আজ সারা পৃথিবী ইসরাইলের বিরোধী হয়ে উঠেছে; আর আরবদের হাতে রয়েছে তেল-অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে তারা। ঈশ্বরের কোপানল যদি জেরুযালেমের বিরুদ্ধে যারা তাদের ওপর পড়ে, তবে কেউ রেহাই পাবে না। ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে ইসরাইলের আঙিনাতে যুদ্ধ হবে, আর প্রভু যীশু থাকবেন তাঁর ভক্তদের সাথে জেরুযালমের উল্টো দিকে পুবের পাহাড় ‘মাউন্ট অভ ওলিস্‌’-এর উপর—আর শয়তানের দল থাকবে তাঁর উল্টো দিকে

বই বন্ধ করে টেবিল ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিল রবার্ট। একা একা অনেকক্ষণ অন্ধকারে চুপ করে বসে রইল সে। গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে ও–ভাবছে, এই বইগুলো আসলে কি? কে লিখেছে এসব? আর কেনই বা লিখেছে? ওগুলো বিশ্বাস করে কেন সে? বিশ্বাস করে তবু মন কেন মেনে নিতে চায় না? সেটা কি নিজেকে খুব তুচ্ছ আর নগণ্য মনে হয় ওসব মেনে নিলে—গোটা পৃথিবীর মানুষকে মনে হয় খেলার সামগ্রী, ভাল আর মন্দের খেলার মাঝে আমরা সবাই উপর আর নিচ থেকে দড়িতে বাঁধা পাপেট-তাই? উপর থেকে ভাল আর নিচের থেকে মন্দ আমাদের পুতুল নাচ নাচাচ্ছে? সত্যিই কি স্বর্গ আর নরক আছে? অবশ্য রবার্ট জানে এসব কিশোর বয়সের প্রশ্ন। তবু নতুন করে এখন আবার ওসব না ভেবে পারছে না সে। ইদানীং বেশ কিছু বৃহৎ শক্তির অস্তিত্ব অনুভব করেছে সে যা তার আয়ত্তের বাইরে। সেই সব শক্তি এলোপাতাড়ি ভাবে কাজ করছে না-বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নিয়েই করছে। এসব শক্তির কাছে তার নিজেকে বড় দুর্বল আর নশ্বর বলে মনে হয়। না, তার চেয়েও বেশি নিজেকে নিতান্ত অসহায় বোধ হয়। শুধু সে একাই নয়—সবাই অসহায়। মানুষ নিজে কেউ কোনদিন জন্ম নিতে চায়নি, বা মরতেও চায়নি; সবই জোর করে চাপানো হয়েছে মানুষের ঘাড়ে। জন্ম আর মৃত্যুর মাঝে এত দুঃখ-কষ্ট কেন পেতে হয় মানুষকে। হয়ত বৃহৎ শক্তির কাছে এই ভাবেই মানুষ বেশি আনন্দদায়ক-সঙ সেজে আমোদ জোগাচ্ছি আমরা।

একটা কোচের ওপরই শুয়ে পড়ল রবার্ট। সারা রাত দুঃস্বপ্ন দেখে এপাশ—ওপাশ করেই ভোর হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *