অশুভ সংকেত – ৫

পাঁচ

সারারাত ঘুম এল না রবার্টের। ব্যালকনিতে একটা চেয়ার পেতে বসে একটার পর একটা সিগারেট ফুঁকেই রাতটা কাটিয়ে দিল সে।

সকালে যখন ক্যাথি ঘুম থেকে উঠল তখন তার আধবোজা চোখটা পুরোই বুজে গেছে। অফিসে যাওয়ার আগে ক্যাথিকে ডাক্তার দেখানোর উপদেশ দিয়ে গেল রবার্ট। সারা সকালে আর কোন কথা হয়নি ওদের দুজনের। ক্যাথি চুপচাপ ছিল, রবার্টও সারাদিন অফিসে আজ কি কি করবে সেই চিন্তায় মগ্ন ছিল। ইরান যাবার আগে আজই তার সমস্ত প্রস্তুতি শেষ করে ফেলতে হবে। মন বলছে যাওয়াটা ঠিক হবে না তার। একটা অজানা আশঙ্কায় মন দুলছে ওর। ক্যাথির জন্যে, ডেমিয়েনের জন্যে, এমন কি নিজের জন্যেও কেন এমন শঙ্কা বোধ করছে, তা সে নিজেও জানে না। মৃত্যু নিয়ে সে আগে কখনও ভাবেনি—মৃত্যুকে সবসময়েই তার অনেক দূরের ব্যাপার মনে হত, কিন্তু আজ সেটাই অনেক কাছের বলে মনে হচ্ছে। হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যাবে। জীবনকে খুব ক্ষণস্থায়ী আর বিপন্ন বলে ভয় হচ্ছে তার!

এমব্যাসি যাওয়ার পথে লিমোসিনে বসে উদাসীন ভাবে সে কিছু নির্দেশ লিখে রাখল কাগজে। তার মৃত্যুর পরে ইনসিওরেন্স আর ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে কোথায় কি করণীয় সবই লিখল সে। একেবারে আবেগহীন ভাবেই কাজটা শেষ করল সে, এসব করার কথা আগে কোনদিনই মনে স্থান পায়নি তার। যে-কোন মুহূর্তেই একটা কিছু ঘটে যেতে পারে এমন একটা দুশ্চিন্তা নিয়ে বসে রইল রবার্ট। এমব্যাসির দিকে এগিয়ে চলল গাড়িটা।

গাড়ি থামতেই আড়ষ্ট ভাবে নেমে দাঁড়াল রবার্ট। নির্দিষ্ট জায়গায় পার্ক করার জন্যে হর্টন এগিয়ে গেল গাড়ি নিয়ে। ঠিক এই সময়ে রবার্টের চোখ পড়ল ওদের ওপর। দ্রুত তার দিকে ছুটে আসছে দুজন লোক। একজন একটার পর একটা ছবি তুলে যাচ্ছে, আর অন্য জনের মুখে প্রশ্নের খৈ ফুটছে। রবার্ট এমব্যাসির দিকে এগুল–কিন্তু পথ আটকে দাঁড়াল ওরা। প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়তে নাড়তে ওদের পাশ কাটাতে চেষ্টা করল থর্ন-ফল হল না।

‘আজকের রিপোর্টার পত্রিকাটা আপনি পড়েছেন, মিস্টার থর্ন?’

‘না…আমি…’

‘একটা আর্টিকেল বেরিয়েছে ওতে, আপনার ন্যানি, যে লাফিয়ে পড়েছিল….’

‘বললাম তো আমি পড়িনি ওটা।’

‘ওরা লিখেছে আত্মহত্যার আগে একটা চিঠি লিখে রেখেছিল ও।’

‘বাজে কথা…’

‘একটু এদিকে তাকাবেন দয়া করে?’ হেবার তার ক্যামেরায় ছবি তুলতে তুলতে বলে উঠল।

‘পথ ছাড়,’ হেবার পথ আটকে দাঁড়াতেই বলল রবার্ট।

‘এটা কি ঠিক যে সে ড্রাগে অভ্যস্ত ছিল?’ অন্যজন প্রশ্ন করল।।

‘অবশ্যই না!’

‘কিন্তু পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলা হয়েছে তার রক্তে ড্রাগ পাওয়া গেছে।‘

‘ওটা অ্যালার্জির ড্রাগ,’ দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দিল রবার্ট। ‘অ্যালার্জি ছিল ওর।‘

‘ওদের মতে পরিমাণে অনেক বেশি ছিল ড্রাগ।’

ঠিক এই ভাবে একটু দাঁড়ান,’ বলে উঠল হেবার ‘তোমরা আমার পথ ছাড়বে কিনা?’ গর্জে উঠল রবার্ট।

চাকরির খাতিরেই করছি, স্যার।

আবার পাশ কাটাতে চেষ্টা করল রবার্ট—কিন্তু আবারও ওরা পথ আটকাল।

‘সে কি ড্রাগে অভ্যস্ত ছিল, স্যার?’

‘বলেছি তো…’

‘কিন্তু আর্টিকেলে লিখেছে…’

‘কাগজে কি লিখেছে তার তোয়াক্কা করি না আমি।’

‘চমৎকার,’ হেবার বলে উঠল। ‘এক সেকেণ্ড ওই ভাবে থাকুন।’

ক্যামেরাটা খুব কাছে এনে ছবি তুলছিল হেবার, ধাক্কা দিয়ে ওটা একপাশে সরিয়ে দিল রবার্ট। ধাক্কার বেগে ক্যামেরাটা হেবারের হাত ফসকে সজোরে শক্ত সিমেন্টে পড়ল। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই নীরব।

‘তোমাদের কি মানুষের প্রতি কোন সম্মান বোধ নেই?’ মুখে রাগের সাথে একথা বললেও নিজের আচরণে লজ্জা পেয়েছে রবার্ট।

হাঁটু গেড়ে বসে ভাঙা ক্যামেরাটা তুলে নিয়ে অসহায় ভাবে রবার্টের দিকে চাইল হেবার জেনিংস।

‘আমি দুঃখিত,’ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল রবার্ট। ‘ক্ষতির বিলটা পাঠিয়ে দিয়ো আমার কাছে।

ক্যামেরা হাতে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল হেবার। ‘ঠিক আছে, মিস্টার থর্ন, ওটা…’

অস্বস্তিভরে সামান্য মাথা ঝাঁকিয়ে ওকে কথা শেষ করার সুযোগ না দিয়েই এমব্যাসির ভিতরে ঢুকে গেল রবার্ট। এতক্ষণে কোথা থেকে আমেরিকান এমব্যাসির একজন মেরিন গার্ড ছুটে এল পরিস্থিতি সামলাতে।

‘তোমাদের অ্যামব্যাসেডর আমার ক্যামেরা ভেঙে দিয়েছে,’ গার্ডের কাছে কৈফিয়ত দিল হেবার।

কিছুক্ষণ তিনজনই বোকার মত দাঁড়িয়ে থেকে যে যার পথ ধরল।

থর্নের অফিসে সেদিন ওলট-পালট অবস্থা। ইরান যাত্রা বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড় হয়েছে। রবার্ট কোন যুক্তি না দেখিয়েই ঘোষণা দিয়েছে সে যেতে পারবে না। এই ট্রিপটার খুঁটিনাটি প্ল্যান করতে তার সব স্টাফ প্রায় দু’সপ্তাহ অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে। বিশেষ করে রবার্টের সহকারী দুজন খুব খেপেছে। তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না তাদের এত খাটুনি সব বৃথা যাবে।

‘এভাবে সব বাতিল করতে পারেন না আপনি,’ আপত্তি জানাল একজন। ‘এত সব আয়োজনের পরে আমাদের ডেকে বলে দিলেন সব ক্যানসেন্ড্–এ কেমন কথা?’

‘ক্যানসেল করিনি,’ জবাব দিল রবার্ট, ‘স্থগিত রাখলাম।’

‘ওরা অবশ্যই এতে অপামানিত বোধ করবে।‘

‘উপায় নেই।’

‘কিন্তু কেন?’

‘আপাতত আমার বিদেশ ভ্রমণের ইচ্ছে নেই, সময়টা ভাল না,’ বলল রবার্ট।

‘এতে কি পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে সেটা নিশ্চয়ই অজানা নেই আপনার?’

‘রাজনৈতিক চাল।’

‘কিন্তু…’ কিছু বলতে আরম্ভ করেছিল দ্বিতীয় সহকারী।

তাকে থামিয়ে দিয়ে রবার্ট বলল, ‘ওদের হাতে রয়েছে তেল, ওদের হাতেই সব ক্ষমতা। এটাকে কেউ বদলাতে পারবে না।’

‘সেজন্যেই তো…’

‘অন্য কাউকে পাঠাব আমি।’

‘প্রেসিডেন্ট আশা করছেন আপনি নিজে যাবেন।’

‘তাঁর সাথে আলাপ করে তাঁকে বুঝিয়ে বলব আমি।’

‘হা ঈশ্বর! এতদিনের প্ল্যান!’

‘আবার নতুন করে প্ল্যান কর!’ চিৎকার করে চড়া গলায় ধমকে উঠল রবার্ট হঠাৎ এভাবে ফেটে পড়ায় সবাই চুপ হয়ে গেল। ইন্টারকম বেজে উঠল সুইচ টিপে সাড়া দিল রবার্ট, ‘বল?’

‘ফাদার ট্যাসোন বলে একজন আপনার সাথে দেখা করতে চান, স্যার,’ ওদিক থেকে রবার্টের সেক্রেটারির গলা শোনা গেল।

‘কে?’ একটু বিরক্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল রবার্ট।

‘রোমের ফাদার ট্যাসোন। বলেছেন জরুরি ব্যক্তিগত ব্যাপারে আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে চান।‘

‘ওর নামও কোনদিন শুনিনি আমি—চিনি না।’

‘উনি বলেছেন এক মিনিটের বেশি সময় নেবেন না,’ জবাব এল। কোন হাসপাতালের ব্যাপারে কথা বলবেন।‘

‘হয়ত চাঁদা-টাদা চাইবে,’ বিড়বিড় করে সহকারীর উদ্দেশ্যে বলল রবার্ট।

‘কিংবা শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে বলবে,’ ফোড়ন কাটল অন্যজন।

‘ঠিক আছে—পাঠিয়ে দাও।’

‘আপনাকে এত নরম কল্পনা করিনি কোনদিন,’ মন্তব্য করল একজন সহকারী।

‘জনসংযোগ,’ জবাব দিল রবার্ট।

‘স্যার, দয়া করে ইরান সম্বন্ধে কোন সিদ্ধান্ত আজ আর নেবেন না। আজ আপনার মনের অবস্থা ভাল নেই-কিছুটা সময় যেতে দিন।’

‘সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে,’ ক্লান্ত অবসন্ন গলায় জবাব দিল রবার্ট। হয় আর কেউ যাবে, নয়ত আপাতত স্থগিত থাকবে।’

‘কতদিনের জন্যে?’

‘যতদিন আমি যাবার জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত না হচ্ছি, ততদিন।’

দরজা খুলে গেল। বিশাল গম্বুজের মতো আকৃতির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোটখাট মানুষ। ধর্মযাজক। অসংযত আলখাল্লা, ভাবভঙ্গিতে আর চেহারায় উৎকণ্ঠা প্রকাশ পাচ্ছে। সরকারী দুজন অপ্রস্তুত ভাবে দৃষ্টি বিনিময় করল। ওরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না থাকবে কি চলে যাবে।

‘যদি কিছু মনে না করেন…আপনার সাথে একা একটু কথা বলতে পারি কি আমি? ইটালিয়ান অ্যাকসেন্টে জিজ্ঞেস করল ধর্মযাজক।

‘কি বিষয়ে…হসপিটাল?’

‘সি, সিনর।’

মাথা ঝাঁকাল রবার্ট। সহকারী দুজন কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ওরা চলে যেতেই ধর্মযাজক দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। তার চেহারা বেদনায় ভরা।

‘বলুন?’ লোকটা কি ধরনের কথা বলবে আঁচ করার চেষ্টা করছে রবার্ট।

‘আমাদের বেশি সময় নেই।’

‘… কি?’

‘আমি যা বলব তা শুনতে হবে আপনার।

ধর্মযাজক দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছে। ওখান থেকে তার নড়ার কোন ইচ্ছে দেখা গেল না।

‘তা সেটা কি?’ জিজ্ঞেস করল রবার্ট।

‘যীশুকে ত্রাণকর্তা হিসেবে মেনে নিতে হবে আপনার-আর, তা এখনই।’

কয়েকটা মুহূর্ত নীরবে কাটল। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না রবার্ট।

‘জনাব, দয়া করে…’ আবার আরম্ভ করল ট্যাসোন।

‘মাফ করবেন,’ বাধা দিল রবার্ট। ‘আপনি না জরুরি ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন?’

‘প্রভুর ভোজে যোগ দিতে হবে আপনাকে,’ হিসহিসিয়ে বলে উঠল সে। যীশুর রক্ত পান আর মাংস আহার করতে হবে আপনাকে। প্রভু আপনার ভিতরে থাকলে তবেই আপনি শয়তানের সন্তানকে পরাস্ত করতে পারবেন।’

অস্বস্তিকর উত্তেজনাময় পরিবেশ। ইন্টারকমের দিকে হাত বাড়াল রবার্ট।

‘ইতিমধ্যেই একটা হত্যা করেছে সে,’ বলে চলল ধর্মযাজক, ‘আরও হত্যা করবে সে। যতদিন না আপনার সবকিছু তার হচ্ছে একটার পর একটা হত্যা করে যাবে সে।’

‘আপনি…একটু যদি বাইরে অপেক্ষা করেন…’

এগিয়ে আসতে আরম্ভ করল ধর্মযাজক গলার স্বরও চড়ে গেল।

‘একমাত্র যীশুর মাধ্যমেই আপনার পক্ষে তাকে ঠেকানো সম্ভব হবে।’

আর দেরি না করে ইন্টারকমের সুইচ অন করে দিল রবার্ট।

‘দরজাটা আমি লক করে দিয়েছি, মিস্টার থর্ন।

ইয়েস, স্যার?’ সেক্রেটারির গলা শোনা গেল ইন্টারকমে।

‘সিকিউরিটি গার্ড ডাকো।’

‘কি বললেন, স্যার?’ বুঝতে পারছে না সেক্রেটারি।

‘আমি একান্ত অনুরোধ করছি, স্যার, কথা শুনুন আমার।’ অনুনয় করে বলল ধর্মযাজক।

ইউ এস মেরিন পাঠাও, জলদি।’ সেক্রেটারির কথার জবাব দিল রবার্ট।

‘জ্বী, স্যার?’ পরিস্থিতিটা এখনও বুঝে উঠতে পারছে না সেক্রেটারি।

‘মিস্টার থর্ন, যে রাতে আপনার ছেলের জন্ম হয় সেই রাতে আমি হাসপাতালে উপস্থিত ছিলাম।’

চমকে উঠল রবার্ট। তার দেহ আড়ষ্ট হয়ে চেয়ারের সাথে সেঁটে গেল।

‘আমি…পুরুষ নার্স ছিলাম,’ বাধো বাধো ভাবে বলল পাদরী। ‘আমার সামনেই জন্মেছে ছেলেটা।’

আবার সেক্রেটারির উৎকণ্ঠিত গলা শোনা গেল ইন্টারকমে। মিস্টার থর্ন? আমি দুঃখিত-আপনার নির্দেশ ঠিক বুঝতে পারিনি আমি।’

‘ঠিক আছে,’ জবাব দিল রবার্ট। ‘দরকার হলে পরে আবার ডাকব তোমাকে।’

বোতাম ছেড়ে দিয়ে ভয়ে ভয়ে ফাদারের দিকে চাইল রবার্ট।

‘আমি… আমি…’ চোখের পানি ঠেকাতে গিয়ে কথা বন্ধ হয়ে গেল ট্যাসোনের।

‘কি চান আপনি?’

‘আমি আপনাকে বাঁচাতে চাই, মিস্টার থর্ন, নইলে যীশুর ক্ষমা আমি পাব না।’

‘আমার ছেলে সম্পর্কে কি জানেন আপনি?’

‘সব।’

‘কি জানেন বলুন।’

থরথর করে কাঁপছে ট্যাসোনের দেহ। গলার স্বর ভাবাবেগে ভারি হয়ে এসেছে।

‘আমি ওর মা’কে দেখেছি,’ জবাব দিল সে।

‘আমার স্ত্রীকে দেখেছেন আপনি?’

‘না, আমি ওর মা’র কথা বলছি।’

‘একই কথা হল না?’

‘না, মিস্টার থর্ন!’

রবার্টের মুখের ভাব কঠিন হল। সরাসরি লোকটার দিকে চাইল সে।

‘আপনি কি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে এসেছেন?’ শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল রবার্ট।

‘না, স্যার।’

‘তাহলে কি চান আপনি?’

‘সত্যি কথাটা আপনাকে জানাতে চাই আমি।’

‘কি কথা?’

‘ওর মায়ের কথা….’

‘ও, আচ্ছা, বলুন?’

‘ওর মা, ওর মা একটা শিয়াল!’ ফুঁপিয়ে উঠল ট্যাসোন। ‘শিয়ালের পেটে ওর জন্ম! আমি নিজের চোখে দেখেছি!’

সশব্দে দরজার পাট দুটো খুলে গেল। একজন মেরিন গার্ড ঢুকল ঘরে—পিছনে রবার্টের সহকারী দুজনের সাথে সেক্রেটারি, রবার্টের মুখ ছাইয়ের মত সাদা হয়ে গেছে। ট্যাসোনের গাল ভেজা চোখের পানিতে।

‘কি হয়েছে, স্যার?’ গার্ড প্রশ্ন করল।

‘আপনার কথাবার্তা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল,’ বলে উঠল সেক্রেটারি। আর তাছাড়া দরজাটাও লক করা দেখলাম।’

‘আমি চাই এই লোকটাকে পথ দেখিয়ে কেউ বাইরে পৌঁছে দিক। আর হ্যাঁ, ও যদি কখনও আবার ফিরে আসে, তবে ওকে যেন পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়।’

ঘরের কেউ নড়ল না। মেরিন গার্ডও পাদরীর গায়ে হাত দিতে ইতস্তত করছে। ধীর গতিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগুলো ট্যাসোন। দরজার কাছে গিয়ে থেমে ফিরে তাকাল সে রবার্টের দিকে।

‘যীশুকে গ্রহণ করুন,’ ফিসফিস করে বিষণ্ণ ভাবে বলল ট্যাসোন। প্রতিদিন তাঁর রক্ত পান করুন।

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। মেরিন গার্ড তাকে অনুসরণ করল। বাকি সবাই বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ।

‘কি চাইছিল লোকটা?’ একজন সহকারী জিজ্ঞেস করল।

‘জানি না,’ দরজার দিকে চেয়ে থেকে অন্যমনস্ক ভাবে জবাব দিল রবার্ট। ‘লোকটা পাগল।’

এমব্যাসির বাইরেই রাস্তার ধারে একটা গাড়িতে হেলান দিয়ে তার বাড়তি ক্যামেরাটা চেক করে দেখছিল হেবার জেনিংস। ভাঙা ক্যামেরাটা রেখে দিয়েছে সে। হঠাৎ তার চোখে পড়ল একজন মেরিন ধর্মযাজকের পোশাক পরা কাউকে সাথে নিয়ে এমব্যাসি থেকে বের হচ্ছে। ঝটপট কয়েকটা ছবি তুলে নিল হেবার।

পাদরীকে বিদায় করে হেবারের দিকে এগিয়ে এল মেরিন গার্ড।

‘একদিনের জন্যে ওটার ওপর দিয়ে কি যথেষ্ট ঝামেলা যায়নি? আর কেন?’ হেবারের ক্যামেরা দেখিয়ে প্রশ্ন করল গার্ড।

‘ঝামেলা?’ হাসল হেবার। ‘আমাদের কাজে ঝামেলা বলে কিছু নেই!‘

একেবারে ওর মুখের সামনে ক্যামেরা ধরে মেরিনটারই আরও দুটো ছবি তুলে নিল সে। জ্বলন্ত চোখে ওর দিকে একটু চেয়ে থেকে আবার ফিরে গেল গার্ড। এবার পাদরীকে ফোকাসে এনে দূর থেকে আরও একটা ছবি তুলল হেবার।

সেদিনই অনেক রাতে ডার্করূমে বসে বিভ্রান্ত চোখে অনেকগুলো ছবি বিছিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছিল হেবার। তার বাড়তি ক্যামেরাটা ঠিক মত কাজ করছে কিনা দেখার জন্যে পুরো রোল ছবিই তুলেছে সে-সবগুলোই ভাল এসেছে, কেবল মাত্র তিনটে ছবিতে খুঁত দেখা যাচ্ছে। ঠিক ওই একই রকম খুঁত ছিল তার তোলা থর্নের ন্যানির সবক’টা ছবিতে। এবারে তা ঘটেছে পাদরীর ছবিগুলোতে। মনে হচ্ছে যেন ওই মাথার কাছে আলোর বৃত্তটা আসলেই আছে ওখানে।

একটা গাঁজা ভরা সিগারেট তুলে নিয়ে সে ভাবতে বসল। ফটোগ্রাফিক জার্নালে একটা আর্টিকেলে সে পড়েছিল যে ফিল্ম লাইটে যেমন, তাপেও ঠিক একই রকম ব্যবহার করে। প্রবন্ধটা ইংল্যাণ্ডের একটা প্রসিদ্ধ ভূতুড়ে বাড়িতে তোলা ছবি নিয়ে লেখা। লেখক ফটোগ্রাফি বিজ্ঞানে একজন বিশেষজ্ঞ। তাপের তারতম্য যে নাইট্রেটের ওপর প্রভাব ফেলে, তা আন্দাজ করে ল্যাবরেটরিতে অনেক পরীক্ষার পরে তিনি প্রমাণ করেন প্রচণ্ড তাপও ঠিক আলোর মতই কাজ করে ফিল্মের ওপর। তাপই শক্তি আর শক্তিও তাপ। কেউ কেউ এই মতবাদে বিশ্বাসী যে ভূত বা আত্মা হচ্ছে মৃত্যুর পরে মানুষেরই অবশিষ্ট শক্তি। তাই যদি হয় তবে অনুকূল পারিপার্শ্বিক অবস্থায় তার আকৃতি ফিল্মে ধরা সম্ভব। কিন্তু সেই প্রবন্ধে আলোচিত শক্তির সাথে জীবিত মানুষের কোন সম্পর্ক ছিল না। তাহলে জীবন্ত মানুষের মাথার ওপর যে শক্তির সমাবেশ দেখা যাচ্ছে, এর মানে কি? এটা কি নিছক প্রকৃতির খেয়াল, নাকি এর বিশেষ কোন অর্থ আছে? এটা কি বাইরের কোন প্রভাবে তৈরি হয়, নাকি মানুষের ভিতরকার অসন্তোষ, দুশ্চিন্তা আর বিফলতা থেকে এর জন্ম?

দুশ্চিন্তা থেকেও শক্তির সৃষ্টি হয় একথা অনেক আগেই প্রমাণিত হয়েছে। এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন ‘পলিগ্রাফ’, মিথ্যে কথা ধরে ফেলার যন্ত্র। এই জাতীয় শক্তি বিদ্যুৎ প্রকৃতির হলেও বিদ্যুৎও তো তাপ?

এই চিন্তাধারাটা জেনিংসকে উৎসাহিত করল। পরদিনই সে চব্বিশ রোল ট্রাই এক্স-৬০০ ফিল্ম কিনল। অত্যন্ত সেনজিটিভ এই ফিল্ম। মোমের আলোতেও এর সাহায্যে পরিষ্কার অ্যাকশন ছবি তোলা সম্ভব। যেমন আলো তেমনি তাপে সেনজিটিভ এই ফিল্ম। এই ফিল্মটা ব্যবহার করে আলো সে ইচ্ছে মত কমাতে পারবে—অথচ তাপ ঠিকই ফিল্টারের ভিতর দিয়ে বিনা বাধায় প্রবেশ করবে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত লোক হিসেবে সে বেছে নিল হাসপাতালের যেসব রোগীকে ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে সেইসব লোক। কিন্তু দশ রোল ছবি তুলেও তাতে কোন আলোর বৃত্ত বা অন্য কোন ত্রুটি নজরে পড়ল না তার।

নিরাশ হলেও দমল না হেবার জিনিংস। তার ভিতর ভবিতব্য বুঝতে পারার একটা অদ্ভুত সহজাত ক্ষমতা থেকেই সে স্পষ্ট টের পাচ্ছে অত্যন্ত রহস্যজনক কিছুর পিছনে কাজে নেমেছে সে।

পুরো এক সপ্তাহ সে ওই ছবি কয়টা নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা করে কাটাল তারপর আবার থর্নের ওপর নজর রাখা আরম্ভ করল।

অনেকগুলো বক্তৃতা দেয়ার একটা প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে রবার্ট। তাই তার ধারে কাছে ঘেঁষতে মোটেও অসুবিধে হল না হেবারের। ইউনিভার্সিটি, মিল, ফ্যাক্টরি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঘুরে ঘুরে বক্তৃতা দিচ্ছে রবার্ট। সুচারু বক্তা সে। তার বক্তৃতা বিশেষ করে নিম্নশ্রেণীর খেটে-খাওয়া লোকদের মধ্যেই বেশি সাড়া জাগাল।

কিন্তু আসলে জনসেবার কাজের আড়ালে নিজের কাছ থেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছে রবার্ট। একটা অশুভ ভয়ের অনুভূতি তাকে সব জায়গাতেই ছায়ার মত অনুসরণ করছে। সমাবেশে বক্তৃতা দেয়ার সময়ে জনতার ভিতর কয়েকবারই ধর্মযাজকের আলখাল্লা তার চোখে পড়েছে। তার মনে হচ্ছে ওই ক্ষুদ্রাকৃতি পাদরী সব সময়ে তার ওপর অলক্ষ্যে নজর রাখছে। কাউকে বলেনি সে একথা ভেবেছে এটা তার মনের কল্পনা। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ওই পাদরীটা তাকে ততই বেশি করে ভাবিয়ে তুলছে। এখন বক্তৃতা দিতে গেলেই তার চোখ ভিড়ের মধ্যে ওকে খোঁজে। ট্যাসোনের কথাগুলো সে পাগলের প্রলাপ বলেই ধরে নিয়েছে। তার ছেলের ব্যাপারে সবকথা সে জানে বলেছে। লোকটা ধর্মান্ধ—হয়ত নিছক ঘটনাচক্রেই সে ডেমিয়েনের কথা তুলেছে? কথাগুলো যত আজগুবিই হোক কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারছে না রবার্ট। নিজেকে তার মনে হচ্ছে বিশাল মাঠের মধ্যে একটা ইঁদুরের মত নিরুপায় আর অসহায়-অনেক উপরে আকাশে একটা শিকারী বাজ চক্কর দিচ্ছে। যে কোন সময় অমোঘ মৃত্যুর মত নেমে এসে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাবে তাকে।

বাইরে থেকে পেরিফোর্ড ঠাণ্ডা, শান্ত। কিন্তু ভিতরে ভিতরে গভীরে দাউ-দাউ করে জ্বলছে দুশ্চিন্তার আগুন। রবার্ট আর ক্যাথির ইদানীং দেখাই হচ্ছে না প্রায়। বাইরের কাজ আর বক্তৃতা নিয়েই বেশিরভাগ সময় কাটে রবার্টের। যখন বাসায় ফেরে তখন হালকা দুটো একটা কথা হয়। মানসিক কষ্ট পেতে হতে পারে এমন কোন আলোচনার মধ্যেই যায় না ওরা। নিজের সঙ্কল্পমত ক্যাথি ডেমিয়েনের সাথে এখন অনেকখানি সময় কাটায়, কিন্তু এতে ওদের দুজনের মধ্যেকার দূরত্ব বেড়েছে বই কমেনি। মনমরা ভাবে ডেমিয়েন সময়টা কাটায় তার সাথে, যেন কোনমতে দায় সারছে—উপভোগ করছে না মোটেও।

মিসেস বেল্ক ফিরে এলেই খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে ডেমিয়েন। ওর সাথে মহা আনন্দে খেলায় মেতে থাকলেও ক্যাথির সাহচর্যে সে নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নেয়। দুজনের মধ্যেকার ব্যবধান দূর করার জন্যে মনের ক্ষোভ চেপে ক্যাথি দিনের পর দিন নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে চলেছে। রঙ করার বই, পেইন্ট সেট, ব্লক, চাকাওয়ালা খেলনা, সবই ওকে কিনে দিয়েছে সে। কিন্তু ডেমিয়েনের দিক থেকে কোন সাড়াই জাগেনি। একদিন জবীজন্তুতে তার আগ্রহ প্রকাশ পেল একটা ছবির বই থেকে। ক্যাথি মনে মনে ঠিক করল ওকে চিড়িয়াখানা দেখাতে নিয়ে যাবে।

গাড়িতে সারাদিন বাইরে কাটাবার জন্যে প্রয়োজন মত সরঞ্জাম সাথে নিল ক্যাথি। গাড়িতে বসে জু’র পথে যেতে যেতে মনে হল সাধারণ মানুষের থেকে কতই না ভিন্ন তাদের জীবন যাত্রা। তার ছেলের বয়স এখন প্রায় সাড়ে চার, অথচ আজ পর্যন্ত সে চিড়িয়াখানা দেখেনি! অ্যামব্যাসেডর পরিবারের সদস্য হিসেবে সবকিছুই তাদের দোরগোড়ায় হাজির করা হয়েছে সব সময়েই। তাদের খুঁজতে হয়নি। হয়ত এই ছেলেবেলার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার অভাবই ডেমিয়েনের আনন্দের অনুভূতিগুলোকে এমন ভোঁতা করে দিয়েছে? কিন্তু আজ সমস্ত চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ডেমিয়েনের। পাশেই বসা ক্যাথি ওর এই পরিবর্তন দেখে অনেকটা আশ্বস্ত হল। অন্তত আজকের এই চিড়িয়াখানায় যাবার সিদ্ধান্তটা তার ঠিক হয়েছে। আজ সে কথাও বলেছে! বেশি না, কিন্তু সাধারণত যা বলে তার চেয়ে অনেক বেশি। ‘হিপোপটেমাস’ শব্দটা বেশ কয়েকবার উচ্চারণ করার বিফল চেষ্টার পরে শেষ পর্যন্ত পেরে খুশিতে খিলখিল করে হেসে উঠল ডেমিয়েন। হাঁ করে মায়ের মুখে সে বিভিন্ন জীবজন্তু কোনটা কেমন দেখতে, কার স্বভাব কেমন সব ছড়ার আকারে শুনল। সারাটা পথ হাসি খুশির মধ্যেই ওরা দুজন পৌঁছল জু’তে।

চমৎকার রোদ ঝলমলে শীতের রবিবার। প্রচুর লোক হয়েছে আজ। জীবজন্তুগুলোও যেন সুন্দর দিনটাকে পুরোপুরি উপভোগ করছে। চিড়িয়াখানার গেট থেকেই ওদের হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। গেটে ক্যাথি দুই পাউণ্ড দিয়ে একটা হুইল চেয়ার ভাড়া করে নিল। পায়ে হাঁটার ক্লান্তিতে ডেমিয়েনের আনন্দ মাটি হতে দেবে না সে।

প্রথমে ওরা থামল রাজহাঁসগুলোর কাছে। একদল ছেলেমেয়ে ঝিলের ধারে ওদের রুটি খাওয়াচ্ছে। ওরাও ঝাঁক বেঁধে এসে মহা-আনন্দে তাই খাচ্ছে। একটু ভাল করে দেখার জন্যে ভিড় ঠেলে ওরা একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল। কিন্তু ওরা সামনে এসে পৌঁছতেই রাজহাঁসগুলোর যেন খিদে মিটে গেল। ঘুরে ধীর গতিতে সাঁতার কেটে ওরা গভীর জলে চলে গেল। সেখান থেকে রাজকীয় ভঙ্গিতে পিছনে ফিরে দেখতে লাগল। ছেলেমেয়ের দল অনেক অনুনয় করল, রুটি ছুঁড়ে দিল কেউ কেউ—কিন্তু ওদের খাওয়ার আর কোন ইচ্ছাই দেখা গেল না। এগিয়ে গেল মা আর ছেলে। ক্যাথি লক্ষ্য করল সে আর ডেমিয়েন সরে যেতেই ওরা আবার ফিরে এসে খেতে আরম্ভ করেছে।

দুপুর হয়ে এসেছে। এখন ভিড় আরও বেড়েছে। লোকের গাদাগাদি কম এমন একটা খাঁচা খুঁজে পেয়ে ‘প্রেয়ারি কুকুর’ লেখা খাঁচার দিকেই এগিয়ে গেল ক্যাথি। মরুভূমিতে গর্ত করে বাসা বানিয়ে বাস করে ওরা। খুব মিশুক স্বভাব। আমেরিকানরা অনেকেই ওদের ধরে নিয়ে গেছে পোষার জন্যে। ওই কুকুর সম্পর্কে ডেমিয়েনকে বিভিন্ন তথ্য জানাতে জানাতে এগিয়ে গেল ক্যাথি। এখানেও অনেক লোক। অনেক কষ্টে সামনে পৌঁছল ওরা। ক্যাথি মাত্র এক ঝলক দেখতে পেল ওদের। একটা বড় গর্তের ভিতর ছিল ওরা-হঠাৎ ঝড়ের বেগে নিজের নিজের গর্তে অদৃশ্য হল। নিরাশ হয়ে লোকজন সরে যেতে আরম্ভ করল। গলা বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করল ডেমিয়েন, কিছুই দেখতে না পেয়ে বোকা হয়ে মায়ের দিকে চাইল।

‘ওরা লাঞ্চ খেতে গেছে বলেই মনে হচ্ছে,’ কাঁধ ঝাঁকাল, ক্যাথি।

সামনে এগিয়ে ‘হটডগ’ কিনে ঘাসের ওপর বসে খেয়ে নিল ওরা।

‘এবার আমরা বাঁদর দেখতে যাব। ভাল লাগবে না তোমার?’ জিজ্ঞেস করল ক্যাথি।

বাঁদরের খাঁচার কাছে সহজে পৌঁছানর সুবিধের জন্যে বিভিন্ন জায়গায় সাইনবোর্ড টাঙিয়ে পরিষ্কার নির্দেশ দেয়া আছে। নির্দেশ মত এগিয়ে গেল ওরা এক সারি খাঁচার পাশ দিয়ে। ডেমিয়েনের চোখে মুখে উত্তেজনা। প্রথম খাঁচায় গতানুগতিক ভাবে পায়চারি করছিল একটা ভালুক। খাঁচার বাইরে দাঁড়ানো লোকজন নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করছে ওকে দেখে, কিন্তু সেদিকে মোটেও খেয়াল নেই ওর। ডেমিয়েন এগিয়ে যেতেই থেমে দাঁড়াল ভালুকটা-একদৃষ্টে চেয়ে থাকল সে। ওরা পাশ দিয়ে এগিয়ে যাবার সময়ে দেখা গেল ভালুকটার ঘাড়ের পিছন দিককার লোম সবকটা দাঁড়িয়ে উঠেছে। পাশের খাঁচার বাঘটাও চলতে চলতে ডেমিয়েনকে দেখে থমকে দাঁড়াল। ওর হলুদ চোখ দুটো ছেলেটার ওপর আটকে গেছে। পাশ দিয়ে যাবার সময়ে যতক্ষণ দেখা গেল একদৃষ্টে চেয়েই রইল বাঘটা। ডেমিয়েনের দিকে ওদের চোখ। সে-ও কিছুটা অনুভব করতে পারছে ব্যাপারটা।

‘তোমাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে বলেই অমন করে চেয়ে চেয়ে দেখছে ওরা,’ হেসে মন্তব্য করল ক্যাথি।

অন্য পথ ধরে এগিয়ে খাঁচাগুলো এড়িয়ে বাঁদরের ঘরের কাছে এসে পৌঁছল ওরা। চিড়িয়াখানার ভিতরে এই ঘরটাই বাচ্চাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। হুইল চেয়ারটা একপাশে ভাঁজ করে রেখে ডেমিয়েনকে কোলে তুলে নিয়ে লাইনে দাঁড়াল ক্যাথি।

ভিতরের আবহাওয়াটা একটু ভ্যাপসা গরম। বাচ্চাদের উত্তেজিত চিৎকার আর উত্তেজিত কথাবার্তা ছোট জায়গার মধ্যে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে আরও জোরাল হয়ে কানে আসছে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে দূরে খাঁচাটার সামনেই ভিড় বেশি ভিতরে বানরগুলো ডিগবাজি খেয়ে লাফালাফি করছে। খাঁচা ভর্তি ‘স্পাইডার বানর’। ডেমিয়েনকে কোলে নিয়েই ভিড় ঠেলে ওদিকে এগুলো ক্যাথি। আনন্দেই আছে ওরা-টায়ার ধরে ঝুলতে ঝুলতে একেকটা একেকদিকে লাফ দিচ্ছে। নানান কৌশল দেখিয়ে আনন্দ দিচ্ছে ওরা লোকজনকে। এতক্ষণ দর্শকদের দিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল না দিয়েই আপন মনে খেলছিল ওরা, ক্যাথি আর ডেমিয়েন এগিয়ে যেতেই খাঁচার ভিতরের পরিবেশটা সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। খেলা বাদ দিয়ে একে একে সবাই ফিরে তাকাল লোকের জটলাটার দিকে। খুদে চোখগুলো ভয়ে ভয়ে খাঁচার সামনে লোকের জটলা খুঁটিয়ে দেখছে। জনতাও ওদের হঠাৎ এমন করে থেমে যাওয়ায় নিশ্চুপ হয়ে গেল। আবার খেলা শুরু হওয়ার অপেক্ষায় আশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। যেন যেমন থেমেছিল তেমনি আবার হঠাৎ করেই ওদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে। এলও তাই-কিন্তু এমনটা কেউ আশা করেনি। খাঁচার ভিতর ভয়ার্ত চিৎকার আর কিচির-মিচির আরম্ভ হয়ে গেল। দিশেহারার মত বন্ধ খাঁচা ভেঙে বেরুবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে ওরা। খাঁচার বিপরীত দিকে গিয়ে জড়ো হয়েছে ওরা। সবাই তারের জালের জানালা ছিঁড়ে বেরিয়ে পালাতে চেষ্টা করছে। এমন আতঙ্কিত যে মনে হয় স্বয়ং যমকে ওদের খাঁচার ভিতর ছেড়ে দিয়েছে কেউ। তাড়াহুড়ো করে একে অন্যকে খামচে রক্তাক্ত হয়ে উঠল ওরা-হাত আর দাঁত দিয়ে পাগলের মত তারের জাল খামচে কামড়ে ছিঁড়ে বেরুতে চেষ্টা করছে সবাই। নীরব বিস্ময়ে সবাই লক্ষ্য করছে বানরগুলোর কাণ্ড। একমাত্র ডেমিয়েন হাসছে খিলখিল করে উপভোগ করছে সে। ভিতরে ওদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েই চলেছে, একটা বড়সড় বানর খাঁচার ছাদের তারের ভিতর দিয়ে মাথা গলিয়ে দিয়ে গলা পর্যন্ত বেরিয়ে ওই অবস্থাতেই ঝুলতে থাকল। ঝুলন্ত দেহটা খিঁচানি দিতে দিতে নিঃসাড় হয়ে এল। দর্শকদের দু’একজন এই বীভৎস দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে উঠল—কেউ কেউ দরজার দিকে পা বাড়াল। হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মত পালাবার বৃথা চেষ্টায় বানরগুলো দেয়ালের সাথে বাড়ি খাচ্ছে। একটা বাঁদর দিশেহারা হয়ে কংক্রিটের ওপরই ঝাঁপিয়ে পড়ল-মুখ আর মাথা রক্তাক্ত অবস্থায় মুখ থুবড়ে নিচে পড়ল ও। আশেপাশের দর্শকদের মধ্যে এখান থেকে বেরিয়ে পড়ার তাগিদ দেখা দিল। ধাক্কাধাক্কির মধ্যেও কেমন করে যেন ক্যাথি তার জায়গাতেই রয়ে গেল—নড়াচড়া করতেও ভুলে গেছে সে। পাশেই ডেমিয়েন তখনও আনন্দে বিভোর। হাসছে সে এখনও। আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে আর হাসছে। যেন এই আত্মহত্যাযজ্ঞ তার ইচ্ছা অনুযায়ীই ঘটছে। ওকেই ভয় পাচ্ছে বাঁদরগুলো—তার কারণেই এই অবস্থা। তারস্বরে চিৎকার করে উঠল ক্যাথি। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে সে-ও!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *