অশুভ সংকেত – ৮

আট

এডগারডো ট্যাসোনের জন্যে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা ঠিক নরক বাসেরই সামিল। এই কারণেই সে এবং আরও অনেকে রোমের কভেনে যোগ দিয়েছিল। জন্মগত ভাবে সে পর্তুগীজ। তার বাবা ছিল জেলে। নিউফাউণ্ডল্যাণ্ডের সমুদ্রে কড়মাছ ধরতে গিয়ে মারা যায় তার বাবা। মাছের আঁশটে গন্ধই ট্যাসোনের একমাত্র শৈশব স্মৃতি। তার মায়ের শরীরেও মাছের গন্ধ ঠিক শাড়ির মতই জড়িয়ে থাকত। মায়ের মৃত্যুর কারণও ছিল মাছই। শক্তিতে কুলোয় না বলে আর কাঠের জোগাড় করতে পারত না সে–কাঁচা মাছই খেত। কাঁচা মাছের দেহে বাস করা জীবাণুর আক্রমণে মারা যায় সে। আট বছর বয়সেই এতিম অবস্থায় তাকে একটা ধর্মীয় মঠে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে নির্মম ভাবে মারধর করে পাপ স্বীকার করানোর পরে পরিত্রাণ দেয়া হয়। মাত্র দশ বছর বয়সে প্রভু যীশু যেন তার মনে দাগ কাটে সে ব্যবস্থা নেয়া হয়-তাতে তার পিঠের দাগগুলোও কিছু কম গভীর হয়নি।

ধর্মভয়টা ট্যাসোনের ভিতর পিটিয়ে ঢুকানো হলেও সে গির্জার কাজেই নিজেকে নিয়োজিত করল। পরবর্তী আট বছর দিনরাত বাইবেল পড়ে মুখস্থ করে ফেলল সে। পড়াশোনা করে ঈশ্বরের কৃপা আর কোপ সম্পর্কে অনেক কিছুই শিখল ও, তারপর পঁচিশ বছর বয়সে পৃথিবীর মানুষকে নরকের আগুন থেকে রক্ষা করার ব্রত নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ধর্মযাজক হয়ে ঈশ্বরের বাণী প্রচার আরম্ভ করল সে স্পেন আর মরক্কোতে। মরক্কো থেকে আফ্রিকার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে গেল। সেখানে অনেককেই সে ধর্মে দীক্ষিত করল। নিজে যেভাবে শিখেছিল, এদেরও সে একই পদ্ধতিতে শিক্ষা দিল। আফ্রিকান দীক্ষিত কিশোরদের মধ্যে একজন তার খুব অনুগত আর ভক্ত হয়ে উঠেছিল। অবৈধ একটা সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল ওদের মধ্যে। ছেলেটার নাম টোবু, কিকুয় উপজাতীয়। ঘটনা জানাজানি হয়ে যাবার পর টোবুকে ধরে ঘটা করে তার দেহের প্রতিটি ইঞ্চি ছুরি দিয়ে ফালাফালা করে চেরা হয়, তারপর তার নিজের অণ্ডকোষ কেটে বের করে জোর করে তাকে খাওয়ানো হয়েছিল। ট্যাসোনকেও হন্যে হয়ে ওরা খুঁজেছিল কিন্তু সোমালিয়ায় পালিয়ে যেতে পেরেছিল সে। সোমালিয়ায় বসেই সে খবর পেয়েছিল তাকে না পেয়ে কিকুয়ুরা তার বদলে একজন ফ্রান্সিসকান ধর্মপ্রচারককে ধরে জীবন্ত অবস্থাতেই তার দেহের ছাল ছিলে নিয়ে না মরা পর্যন্ত মরুভূমির মধ্যে হাঁটতে বাধ্য করেছিল।

সোমালিয়া থেকে ট্যাসোন জিবৌটি, এডেন, জাকার্তা হয়ে পালায়। ঈশ্বরের কোপদৃষ্টি পড়েছে তার ওপর এটা সে বেশ অনুভব করতে পারে। সে যেখানেই যায় আশেপাশে সব কিছু ছারখার হয়ে যায়—লোকজন মারা পড়ে। তার সব—সময়েই ভয়, এরপরেই বুঝি তার পালা। বাইবেল থেকেই সে জানে একবার ঈশ্বরের বিরাগভাজন হলে কারও রক্ষা থাকে না। আতঙ্কিত অবস্থায় এখানে ওখানে পালিয়ে বেড়াতে থাকে ট্যাসোন একটু আশ্বাস, একটু আশ্রয়ের আশায় নাইরোবিতে সে সৌম্যমূর্তি ফাদার স্পিল্লেট্রোর দেখা পেয়ে তার কাছেই নিজের সব পাপের কথা স্বীকার করল ফাদার স্পিল্লেট্টো তাকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রোমে নিয়ে এল। রোমেই শয়তানের শিষ্যত্বে দীক্ষা দেয়া হয় ট্যাসোনকে। ওই আস্তানায় কেবল মাত্র শয়তানের আর ভোগের পূজা করা হয়। এখানকার বেশির ভাগ লোকই খেটে খাওয়া মজুর শ্রেণীর মানুষ। কিন্তু কিছু পেশাদারি আর সমাজের শীর্ষস্থানীয় লোকজনও আছে এতে। বাইরে এরা সম্মানীয় ভাবে জীবন যাপ করে—কিন্তু ভিতরে ভিতরে এই আস্তানার সবারই একটা উদ্দেশ্য, সেটা হচ্ছে স সময়ে সব জায়গায় বিরোধ আর হানাহানি লাগিয়ে বেড়ানো। তাদের প্রভু শয়তানের আবির্ভাব না হওয়া পর্যন্ত এইভাবেই তারা চালিয়ে যাবে। দরকার মত ছোট ছোট দল পাঠানো হয় এখান থেকে বিভিন্ন দেশে গোলমাল পাকাবার জন্যে। এখান থেকেই লোক পাঠিয়ে আয়ারল্যাণ্ডে রোমান ক্যাথলিক আর প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে ধর্মীয় বিরোধ জিইয়ে রাখা হয়েছে। দুজন আইরিশ নান, এই আস্তানায় ওরা বা ‘আলক আর বা’আলাম বলে পরিচিত, এরা দুজনই আয়ারল্যাণ্ডে বোমাবাজির কাজে নিয়োজিত ছিল। বা’আলাম মার্কেট প্লেসে বোমা মারতে গিয়ে নিজেও মারা পড়ে। তার দেহ পাওয়া যায় ধ্বংসস্তূপের নিচে ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায়। রোমে নিয়ে এসে তার দেহের অবিশিষ্টাংশ প্রাচীন এট্টুসকান কবরখানার পবিত্র ভূমিতে সমাহিত করা হয়। এর বর্তমান নাম এখন গ্রিপ ডি সান্ট অ্যাঞ্জেলো’। জায়গাটা রোমের উপকণ্ঠে অবস্থিত। বা’আলামের গুরুর প্রতি নিষ্ঠার জন্যে শ্রাইন অভ টেকুলকার নিচে তাকে কবর দেয়া হয়। এট্টুসকান পিশাচ দেবতার নিজস্ব এলাকা ওটা। প্রায় পাঁচ হাজার পিশাচ সাধক এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিল। ট্যাসোনের মনে খুব নাড়া দিয়েছিল এসব আনুষ্ঠানিকতা। এরপর থেকেই সে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্যে উঠে পড়ে লেগে যায়।

১৯৬৮ সালে আর একজন পাদরীর সাথে তাকে পাঠানো হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। এখানে তার কাজ ছিল কমিউনিস্ট ক্যামবোডিয়া থেকে একটা ভাড়াটে খুনীর দল নিয়ে ভিয়েতনামে ঢুকে সেখানকার যুদ্ধ-বিরতি চুক্তি বানচাল করা। ট্যাসোনের প্রবেশ করার কয়েকদিনের মধ্যেই উত্তর-দক্ষিণকে, আর দক্ষিণ—উত্তরকে দোষারোপ করতে আরম্ভ করল শান্তি ভঙ্গের দায়ে। এই ঘটনার পরপরই উত্তর ভিয়েতনামের লি ডক থো শান্তি চুক্তিতে তাঁর অবদানের জন্যে তাঁকে যে নোবেল প্রাইজ দেয়া হয়েছিল তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন প্রকৃত অর্থে শান্তি কোনদিনই আসেনি। তবে ওই পুরস্কার হেনরি কিসিঞ্জার ঠিকই গ্রহণ করেন। তাঁর নিজের ব্যর্থতার প্রতি অন্ধ অবজ্ঞা মুক্তি আর গণতন্ত্রকে আরও দূরে ঠেলে দিতে সাহায্য করল। সফল হল ট্যাসোনদের উদ্দেশ্যই।

অনেক আনন্দ করা হল আস্তানায়। ট্যাসোন দেখল সে এরই মধ্যে লীডার হয়ে উঠেছে। আফ্রিকায় গোলমাল আর অসন্তোষ বেশ পাকিয়ে উঠেছে, ট্যাসোনের ওই দেশ সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা আছে বলে তাকেই সেখানে পাঠাল স্পিল্লেট্টো। ট্যাসোনের সাহায্যে আন্দোলনের মাধ্যমে পাগলা ইদি আমিন ক্ষমতায় এল। এক বছর সে ইদি আমিনের সাথেই থাকল। সাদা বলে তাকে আমিন খুব একটা বিশ্বাস করত না, তবু নানান ফন্দি করে পরিস্থিতি বেশ খানিকটা ঘোলা করে দিয়ে ফিরে এল ট্যাসোন!

এসব সফল কাজের ফলেই পৃথিবী জোড়া সব শয়তানের উপাসক রোমকেই তাদের হেড অফিস বলে স্বীকার করে নিল। চারদিক থেকে টাকা-পয়সা আসতে আরম্ভ করল। রোম—ক্যাথলিক বিশ্বাসের গোড়া; রোম—পশ্চিমী কমিউনিজমের কেন্দ্র; আর রোমই শয়তানের শিষ্যদের পীঠস্থান। উত্তেজনাপূর্ণ একটা পরিস্থিতি।

এই রকম সময়েই, যখন পৃথিবী জোড়া আন্দোলন, যুদ্ধ আর গোলমাল চলছে, যখন পাপী বিধর্মীর দল অত্যন্ত শক্তিশালী, ঠিক তখনই বাইবেলের বক্তব্য অনুযায়ী পৃথিবীর ইতিহাস হঠাৎ বদলে যাবে। এই সময়েই পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত তৃতীয় বারের মত ধুরন্ধর শয়তানের আবির্ভাব হবে। এর আগে দুবার সে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ধর্মপ্রাণ সতর্ক মানুষেরা ঠিকই খুঁজে বের করে তাকে হত্যা করে তার অপচেষ্টা বানচাল করে দেয়। কিন্তু এবারে বিফল হবে না সে সময়টাও উপযুক্ত, আর তাছাড়া ভাল করে আঁট-ঘাট বেঁধেই নামবে সে এবার।

সঙ্গত কারণেই ফাদার স্পিল্লেট্টো তার বিশাল যুগান্তকারী দুরভিসন্ধিকে কার্যকর করার জন্যে ট্যাসোনকে তিনজনের একজন হিসাবে বেছে নিয়েছিল। অত্যন্ত ভক্তি আর নিষ্ঠার সাথে লোকটা আজ পর্যন্ত তার সব আদেশ পালন করে এসেছে। আদেশ পালনের খাতিরে নিরপরাধ লোককে খুন করতেও তার হৃদয় বিন্দুমাত্র বিচলিত হয়নি।

একটা পরিবার নির্বাচন আর বাচ্চা বদলের ভার নিয়েছিল স্পিল্লেট্টো নিজে সিস্টার মারিয়া টিরেসার (বা’আলকের সেই সময়ে ব্যবহৃত নাম) ওপর গর্ভধারণ করিয়ে বাচ্চার জন্ম নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করানোর ভার পড়েছিল। আর ট্যাসোনের ওপর ভার পড়েছিল সব প্রমাণ নষ্ট করে দেহগুলোকে কবর দেয়ার।

পুরো উদ্যমে কাজে নেমেছিল ট্যাসোন। তার বয়স যে বাড়ছে এটা সে বেশ উপলব্ধি করতে পারে আজকাল। হয়ত এটাই তার শেষ সুযোগ, ভাল কাজ দেখাতে পারলে সে স্মরণীয় আর শ্রদ্ধেয় হয়ে থাকবে চিরদিনের পাপী জগতে। একদিনের সেই অবহেলিত এতিম ট্যাসোন আজ নির্বাচিতদের একজন! শয়তান স্বয়ং হয়েছে তার বন্ধু—দোসর। কিন্তু পরের দিকে কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়তে লাগল সে। পিঠের দাগগুলোতে অসহ্য ব্যথা হয় রাতে। সরারাত ঘুম হয় না—আর যেদিন ঘুম হয় দুঃস্বপ্ন দেখে সে।

স্বপ্নে প্রায়ই সে দেখে সেই কিকুয়ু ছেলে টোর করুণ মিনতি জানাচ্ছে তাকে—তার সাহায্য চাইছে ছেলেটা। আরও দেখে চামড়া ছাড়া একটা লোক। চামড়া ছিলে ফেলা মুখে বসানো দুটো ভাসাভাসা চোখ। মরুভূমিতে হাঁটতে হাঁটতে লোকটা ঠোঁট বিহীন মুখের গর্ত দিয়ে চিৎকার করে তাকে দয়া করতে বলছে। আরও দেখে সে শৈশবের দৃশ্য-বীচে সে বসে রয়েছে তার বাবার ফিরে আসার অপেক্ষায়। আর তার মা’কে দেখে মরণাপন্ন অবস্থায় বিছানায় শুয়ে ক্ষমা চাইছে এভাবে এত ছোট বয়সে ট্যাসোনকে একা ফেলে তার মরে যেতে হচ্ছে বলে। সেই রাতে জেগে উঠে দু’হাতে মুখ ঢেকে অনেকক্ষণ কাঁদল সে। ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাইল বারবার। আবার যখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল তখন স্বপ্নে দেখল যীশু তার খাটের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ট্যাসোনের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে তিনি তাকে অভয় বাণী শোনালেন। বললেন এখনও সময় আছে। সে যদি সত্যিই অনুতপ্ত হয়, তবে স্বর্গের দরজা তার জন্যে খোলাই থাকবে।

স্বপ্নগুলো ভীষণ ভাবে নাড়া দিল ট্যাসোনকে। কিছু একটা আন্দাজ করে স্পিল্লেট্টো সরাসরি তাকে নিজের অফিসে ডেকে পাঠাল। ট্যাসোন জানে সে ভালমতই জড়িয়ে গেছে এর সাথে—এখন সরে দাঁড়াতে চাইলে তার জীবন বিপন্ন হবে। তাই সে আশ্বাস দিল কাজ ঠিক মতই সম্পন্ন করবে সে। তবে তার অসুবিধা যা সেটা হচ্ছে তার শারীরিক যন্ত্রণা। পিঠে ব্যথার কথা উল্লেখ করল সে। ট্যাসোনকে একগাদা খাবার বড়ি দিল স্পিল্লেট্টো। এরপর থেকে ওষুধ খেয়ে ঝিম মেরে থাকত বলে কোনরকম দুঃস্বপ্নই আর তাকে বিব্রত করেনি।

অবশেষে এল জুনের সেই রাত। ৬-৬-৬, অর্থাৎ জুন মাসের ছয় তারিখে সকাল ছয়টা। ঘটনাগুলো ট্যাসোনের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মনে থাকবে। প্রসব বেদনায় মা-টা ককিয়ে উঠছে বারবার। মিস্টার মারিয়া টিরেসা তাকে ঈথার প্রয়োগ করে চুপ করাল। জরায়ু ছিঁড়ে বেরিয়ে এল তার বিরাট আকৃতির সন্তান। স্পিল্লেট্রোর দেয়া পাথরটা নিয়ে কাজ শেষ করল ট্যাসোন। পাথর দিয়ে জন্তুর মাথাটা সে ছেঁচে ছাতু করে দিল। মানুষের সন্তান নিয়ে যা করতে হবে এতে তার একটু মহড়াও হয়ে গেল। কিন্তু যখন নবজাত শিশুটাকে তার কাছে নিয়ে আসা হল, ইতস্তত করতে লাল সে—অপূর্ব সুন্দর দেখতে বাচ্চাটা। পাশাপাশি শোয়া দুটো বাচ্চার দিকে চাইল সে। একটা রক্ত মাথা, মাথায় অস্বাভাবিক রকম ঘন চুল; অন্যটা কোমল, শুভ্র, সুন্দর—পরিপূর্ণ বিশ্বাসে নীল চোখে তারই দিকে চেয়ে রয়েছে বাচ্চাটা। কি করতে হবে জানাই ছিল তার, তাই করল সে। কিন্তু ভাল মত শেষ করতে পারেনি, তাই কাজটা আবার করতে হল তাকে। কাঠের বাক্সটা খুলে থর্নের ছেলের মাথায় আবার আঘাত করার সময় ফুঁপিয়ে উঠল সে। মুহূর্তের আবেগে তার একবার ইচ্ছা হয়েছিল বাচ্চাকে কোলে তুলে নিয়ে ছুটে অনেক দূরে নিরাপদ কোন জায়গায় পালিয়ে যায়, কিন্তু দেখল ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে। এখন আর বাচ্চাটার সুস্থ হবার কোন আশাই নেই—হাতের পাথরটা এল সজোরে নেমে বাচ্চার মাথার ওপর আবার, আবারও। নিথর হয়ে গেল শিশু 1

ট্যাসোনের গাল বেয়ে যে জলের ধারা নেমেছিল তা রাতের আঁধারে কারও চোখে পড়েনি। সেই রাতের পর থেকে আস্তানার কেউ আর ট্যাসোনকে দেখেনি সকালেই পালিয়ে যায় সে রোম ছেড়ে। চার বৎসর এভাবে কাটে ওর। বেলজিয়ামে সে একটা ওষুধের দোকানে কাজ নেয়। তার পিঠের ব্যথার জন্যে তো বটেই, সে কি করে এসেছে সেটা ভোলার জন্যে তার ড্রাগের প্রয়োজন ছিল। একাই বাস করত সে, কারও সাথে কোন কথা বলত না। শেষে পিঠের ব্যথা এমন পর্যায়ে চলে গেল যে বাধ্য হয়ে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হল। হাসপাতাল থেকে ওরা জানাল সাংঘাতিক ধরনের টিউমার হয়েছে তার। ওষুধে সারবে না, আর অপারেশনও করা যাবে না কারণ একেবারে মেরুদণ্ডের ওপরই হয়েছে টিউমারটা।

মরণ ঘনিয়ে এসেছে ট্যাসোনের। অনুতাপ আর অনুশোচনায় ভরে উঠল তার মন। প্রভু ক্ষমাশীল। সে ঠিক করল সে যে ক্ষমার যোগ্য এটা প্রমাণ করার জন্যে যা করেছে তার প্রতিকার করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। সক্ষম হলে হয়ত প্রভুর ক্ষমা পাবে সে।

তার যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট আছে সব একত্রিত করে সে ইসরাইলের পথে রওনা হল। বুগেনহাগেনকে তার খুঁজে বের করতেই হবে। সৃষ্টির প্রথম থেকেই একটা সম্পর্ক আছে শয়তানের সাথে ওই নামের। এই বুগেনহাগেন পরিবারেরই একজন ১০৯২ খ্রিস্টাব্দে শয়তানের প্রথম সন্তানকে খুঁজে পেয়ে হত্যা করেছিল। আবারও ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে একজন বুগেনহাগেনই দ্বিতীয় বারের মত শয়তানের সন্তানকে খুঁজে পেয়ে তাকে অলৌকিক শক্তির সাহায্যে ধ্বংস করে। এই বংশের সবাই ধর্মপ্রাণ আর অলৌকিক শক্তির অধিকারী। শয়তান যেন পৃথিবীর বুকে বিচরণ করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা এই পরিবারের একটা নৈতিক দায়িত্বের মত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বুগেনহাগেনের শেষ বংশধরকে খুঁজে বের করতে সাত মাস সময় লেগে গেল ট্যাসোনের। মাটির তলায় এক দুর্গের মত আস্তানায় অজ্ঞাতবাসে দিন কাটাচ্ছে সে। ওখানে ট্যাসোনের মত সে-ও মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছে। বার্ধক্যের জরা আর নিজের বিফলতা তাকে জর্জরিত করছে মানসিক দিক থেকে। সে জানে সময় ঘনিয়ে এসেছে কিন্তু শয়তানের পুত্রকে সে বাধা দিতে অক্ষম।

পুরো ছয়ঘন্টা সময় কাটাল সে বুগেনহাগেনের সাথে, সব কথাই তাকে খুলে বলল ট্যাসোন। সে নিজে এতে কি অংশ নিয়েছিল সে কথাও বাদ দিল না। সব শুনে হতাশায় মাথা নিচু করে বসে রইল বুড়ো বুগেনহাগেন। ট্যাসোন বারবার তাকে অনুরোধ করতে লাগল একটা কিছু করার জন্যে। কিন্তু বুগেনহাগেন জানাল তার পক্ষে এই দুর্গ ছেড়ে বাইরে কোথাও যাওয়া অসম্ভব। ছেলেটার সাথে সরাসরি যোগাযোগ আছে এমন কাউকে তার কাছে নিয়ে আসতে পারলে তবেই সে সাহায্য করতে পারবে।

নিজের দিন ঘনিয়ে আসছে বুঝতে পেরে ট্যাসোন সোজা লণ্ডনে চলে আসে। ইচ্ছা, যদি কোনভাবে রবার্ট থর্নের সাথে দেখা করে তাকে বুঝিয়ে ইসরাইলে নিয়ে যাওয়া যায়। ট্যাসোন অহরহ প্রার্থনা করে ঈশ্বরের কাছে যেন তিনি তার প্রতি একটু কৃপা দৃষ্টি রাখেন। অবশ্য সে এটাও জানে যে শয়তানের নজর পুরোপুরিই আছে তার ওপর। তাই থর্নকে খুঁজে বের করে তার কাজ শেষ করতে না পারা পর্যন্ত নিজেকে জীবিত রাখার জন্যে সব রকম সাবধানতা সে অবলম্বন করেছে। কাজ শেষ করতে পারার আগেই যদি সে শয়তানের হাতে মারা পড়ে তবে তার আর স্বর্গে যাবার কোন সম্ভাবনা থাকরে না।

সোহোতে তার ভাড়া করা ফ্ল্যাটটাকে একেবারে গির্জার মতই পবিত্ৰ দুৰ্গ বানিয়ে ফেলেছে ট্যাসোন। আত্মরক্ষার জন্যে ব্যবহার করেছে সে বাইবেলের বাণী। দেয়ালের প্রতিটি ইঞ্চি, এমন কি দরজা জানালা পর্যন্ত সব সে সম্পূর্ণ মুড়ে দিয়েছে বাইবেলের পাতা দিয়ে। পুরোটা ঢাকতে সত্তরটা বাইবেল দরকার হয়েছে তার। সারা ঘরে অসংখ্য ক্রস ঝুলিয়েছে নানান অ্যাঙ্গেলে। তার নিজের গলায় ঝুলানো ক্রসে বসানো আয়নার টুকরোগুলো যতক্ষণ সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে, মাত্র ততক্ষণই সে সাহস করে বাইরে থাকে।

রবার্টের সাথে প্রথম সাক্ষাতে বিফল হয়ে হন্যে হয়ে সে সবখানেই তার পিছু নেয়া আরম্ভ করেছে—যদি কোনমতে একটু কথা বলার সুযোগ মিলে যায় এই আশায়। সেদিন চেলসীতে অপেক্ষাকৃত গরীব বাসিন্দাদের জন্যে নতুন বাড়ি-ঘর তৈরি করার একটা প্রকল্পের উদ্বোধন শেষ করে সাধারণ মানুষের মন জয় করার জন্যে তারের বেড়ার কাছে এগিয়ে এসে রবার্ট সবার সাথে হাত মেলাচ্ছে। অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে তারের বেড়ার ওপাশে। হঠাৎ চমকে উঠল রবার্ট। একটা হাত তার টাই আর শার্টের সামনের দিক শক্ত করে খামচে ধরে তাকে টেনে নিয়ে এল একেবারে বেড়ার ধারে।

‘আগামীকাল,’ অ্যামব্যাসেডরের ভয়ে বিস্ফারিত চোখের দিকে চেয়ে বলল ট্যাসোন। ‘একটায়, কিউ গার্ডেনে…’ হাঁপাচ্ছে সে।

‘শার্ট ছাড়।’

‘মাত্র পাঁচ মিনিট, এরপরে আর কোনদিন দেখবেন না আমাকে।’

‘হাত সরাও বলছি…

‘আপনার স্ত্রী বিপদে আছেন। আপনি না এলে মারা পড়বেন তিনি।’

জোর করে শার্ট ছাড়িয়ে নিয়ে একটু পিছিয়ে গেল রবার্ট। পাদরীকে আর কোথাও দেখা গেল না আশেপাশে। হতভম্ব ভাবে বেড়ার ওপরে দাঁড়ানো অপরিচিত মুখগুলোর দিকে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। ক্যামেরার ফ্ল্যাশবাল্বগুলো চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে তার। মনে মনে অনেক ভেবেছে রবার্ট ওই পাদরীর ব্যাপারে। সে না গিয়ে পুলিশে খবর দিয়ে ওকে গ্রেপ্তার করাতে পারে, কিন্তু তাতে রবার্টকে বাদী হিসেবে কোর্টে হাজির হতে হবে। ব্যাপারটা জানাজানি হবে। খবরের কাগজগুলোতে একটা পাগলের প্রলাপ নিয়ে ফেনিয়ে ফাঁপিয়ে রসিয়ে লেখার ধুম পড়ে যাবে। রবার্ট সেটা কখনই হতে দিতে পারে না। লোকটা যে কি বলবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তবে তার কথাবার্তা সব ডেমিয়েনের জন্ম সম্পর্কিত। আর ওখানেই রবার্টের লুকোবার কিছু রয়েছে। লোক পাঠিয়ে টাকা দিয়ে বিদায় করা যায় ওকে কিন্তু তাতে আবার বাইরের একজনকে জড়াতে হবে।

ফটোগ্রাফার হেবার জেনিংসের কথা ভাবল সে একবার। হেবার যার খোঁজ করছে রবার্ট তার খোঁজ পেয়েছে—কথাটা টেলিফোন করে জানাতে গিয়েও আবার নিজেকে সংযত করল সে। কাগজের লোককে জড়ানোর চেয়ে বিপদজনক আর কিছু হতে পারে না। কারও সাথে কথা বলে মনটা একটু হালকা করতে পারলে ভাল হত। আসল কথা পাদরী কি বলবে শুনতে ভয় পাচ্ছে সে।

সকালে নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে বাসা থেকে বের হল রবার্ট। কোথায় লাঞ্চ করবে—এমনি সব অবাঞ্ছিত প্রশ্ন এড়াবার জন্যে সকালে অফিসেই গেল না সে। ঠিক সাড়ে বারটায় কিউ গার্ডেনে পৌঁছে গাড়ি পার্ক করে অপেক্ষা করতে লাগল সে। একটা বাজতেই গাড়ি থেকে নেমে পার্কে ঢুকল রবার্ট। তাকে যেন কেউ চিনতে না পারে এজন্যে গায়ে রেইন কোট চাপিয়েছে, আর চোখে কালো গগল্‌স্‌। অল্প খুঁজেই দেখতে পেল সে পাদরীকে। একা একটা বেঞ্চের ওপর বসে আছে। একবার ভাবল ফিরে যায়—কিন্তু আবার ভাবল লোকটা বলেছে দেখা না করলে ক্যাথির মৃত্যু হবে। যদিও সেটা একেবারেই অসম্ভব, তবু। মনস্থির করে ঘুরে সামনের দিক থেকে এগিয়ে গেল সে ধর্মযাজকের দিকে।

হঠাৎ রবার্টকে আসতে দেখে চমকে উঠল ট্যাসোন। ঘামে ভিজে উঠেছে ওর মুখ-চেহারা দেখে মনে হয় যেন অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে তার। সামনে এসে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল রবার্ট।

‘পুলিশ নিয়ে আসাটাই আমার উচিত ছিল,’ রূঢ় ভাবে বলল সে।

‘ওদের সাহায্যে কাজ হবে না আপনার।‘

‘সে যাক—কি বলার আছে বল।’ ট্যাসোনের চোখ দ্রুত মিটমিট করল কয়েকবার, হাত দুটো থরথর করে কাঁপছে। অসহ্য ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করছে সে।

‘যখন জু’রা ফিরবে জায়নে…’ ফিসফিস করে বলল পাদরী।

‘কি?’

‘যখন জু’রা ফিরবে জায়নে, সারা আকাশ জুড়ে দেখা দেবে একটা ধূমকেতু, আর পবিত্র রোম যখন জাগবে—তখনই আপনাকে আমাকে—সবাইকে মরতে হবে।‘

ধক্ করে উঠল রবার্টের বুকের ভিতরটা। লোকটা বদ্ধ পাগল। একটা কবিতা থেকে আবৃত্তি করছে সে। সম্মোহিত ভাব তার মুখে—গলাটা অস্বাভাবিক চড়া।

‘অনন্ত সাগর থেকে উঠবে সে। দুই তীরে থাকবে সৈনিক যোদ্ধার দল। ভাইয়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে ভাই—মানুষের আর অস্তিত্ব থাকবে না এর পরে।’

পাদরীর দেহের প্রতিটি অঙ্গ থরথর করে কাঁপতে আরম্ভ করল।

‘এ সবই তো বাইবেলের ব্যাখ্যার বইয়ে লেখা আছে।’ ঝাঁঝের সাথে বলল রবার্ট।

‘আমি এখানে ধর্মীয় বক্তৃতা দিতে আসিনি।’

‘তুমি বলেছিলে আমার স্ত্রী বিপদে আছে।’

‘মেগ্‌গাইডোর শহরে যান,’ বলে উঠল ট্যাসোন। ‘জেস্রীল শহরে গিয়ে বুগেনহাগেনের খোঁজ করুন। একমাত্র সেই বলতে পারবে বাচ্চাটাকে কিভাবে ধ্বংস করা সম্ভব হবে।’

‘শোন…’

‘যে বাঁচার জন্যে ভেড়ার (যীশুর প্রতীক) আশ্রয় না নেবে, তাকেই ছিড়ে ছিন্ন—ছিন্ন করবে পশু (শয়তান)।’

‘চুপ কর!’ ধমক দিল রবার্ট।

চুপ করল ট্যাসোন। কাঁপা হাতে ভুরুর ঘাম মুছল সে।

‘তুমি বলেছিলে আমার স্ত্রী বিপদে আছে, সেইজন্যেই এসেছি আমি,’ বলল থর্ন।

‘দিব্যদৃষ্টিতে একটা দৃশ্য আমি…

‘আমার স্ত্রী …’

‘তিনি গর্ভবতী।’

থমকে গেল রবার্ট হতবুদ্ধি হয়ে গেছে সে। ‘ভুল করছ তুমি।’

‘আমার বিশ্বাস তাঁর পেটে বাচ্চা এসেছে।’

‘অসম্ভব! এমন হলে আমি জানতাম।

‘সে বাচ্চাটাকে জন্মাতে দেবে না। পেটে থাকতেই তাকে মেরে ফেলবে ও।’

ব্যথায় ককিয়ে উঠল পাদরী—অসহ্য ব্যথা হচ্ছে তার পিঠে।

‘কি, বলছ কি তুমি?’ দম বন্ধ করে জিজ্ঞেস করল রবার্ট।

‘আপনার ছেলে মিস্টার থর্ন, শয়তানের সন্তান সে। গর্ভে থাকতেই সে বাচ্চাটাকে হত্যা করবে, তারপর হত্যা করবে আপনার স্ত্রীকে। অবশেষে যখন সে নিশ্চিত হবে যে আপনার সব কিছু উত্তরাধিকার সূত্রে সে পাবে তখন আপনাকেও হত্যা করবে!’

‘থাম, যথেষ্ট হয়েছে।’

‘….আপনার সম্পদ আর শক্তি নিয়েই সে পৃথিবীতে মিথ্যার রাজত্ব বিস্তার করবে। তার প্রতিটি নির্দেশ আসবে সরাসরি শয়তানের কাছ থেকে…’

‘মাথা খারাপ তোমার,’ ধমকে উঠল রবার্ট।

‘ওকে মারতেই হবে, মিস্টার থর্ন!’

হাঁ করে শ্বাস নিল পাদরী—এক ফোঁটা জল বেরিয়ে এল তার চোখ দিয়ে, থর্ন চেয়ে রয়েছে ওর দিকে— নিথর হয়ে গেছে সে।

‘মিস্টার থর্ন, দয়া করে…’ কেঁদে ফেলল লোকটা।

‘তুমি পাঁচ মিনিটের কথা বলেছিলে…’ মনে করিয়ে দিল রবার্ট।

‘মেগ্‌গাইডোর শহরে যান,’ অনুনয় করে বলল ট্যাসোন। ‘সময় থাকতে বুগেনহাগেনের সাথে দেখা করুন।‘

মাথা নাড়ল থর্ন। ট্যাসোনের মুখের সামনে আঙুল তুলে বলল, ‘তোমার যা কথা ছিল সব শুনেছি আমি, এবার তুমি শোন। যদি আর কোনদিন তোমাকে দেখি তবে তোমাকে পুলিশে দেব আমি।’

ঘুরে গটমট করে হাঁটা ধরল রবার্ট। কান্নাজড়িত স্বরে তাকে পিছু ডাকল ট্যাসোন।

‘আপনার সাথে নরকে দেখা হবে আমার, মিস্টার থর্ন, সেখানেই আমরা একসাথে আমাদের শাস্তি ভোগ করব।’

চলে গেল রবার্ট। দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রইল পাদরী—কান্না সামলাবার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু থামছে না তার কান্না। সব শেষ হয়ে গেল—ব্যর্থ হয়েছে সে। স্বর্গে যাবার সব পথ তার রুদ্ধ হয়ে গেল।

ধীরে ধীরে দাঁড়াল ট্যাসোন। চারদিকে চেয়ে দেখল পার্ক একেবারে জনশূন্য। চারদিকে কেমন যেন একটা অশুভ স্তব্ধতা বিরাজ করছে। ক্ষীণ একটা শব্দ কানে এল তার–আস্তে আস্তে জোরাল হচ্ছে সেটা। স্বর্গীয় গানের (OHM) শব্দ ওটা। শব্দ আরও বেড়ে উঠতেই দুহাতে গলায় ঝুলানো ক্রসটা খামচে ধরে ভীত ভাবে এদিক ওদিক চাইল সে। আকাশটা দ্রুত অন্ধকার হয়ে আসছে, বাতাসের বেগ ও বাড়ছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়ায় গাছের কাণ্ডগুলো বাঁকা হয়ে শাসাতে লাগল ট্যাসোনকে।

এগিয়ে চলল সে। রাস্তায় উঠে নিরাপদ বোধ করতে চাইছে। হঠাৎ ঘূর্ণি বাতাস ঘিরে ধরল তাকে। কাগজ, পাতা আর ধুলো তার পায়ের কাছে ঘুরতে শুরু করল। ধুলো বালির আঘাতে তার চোখ দুটো ছোট হয়ে গেছে— হাঁপাচ্ছে সে। জোরাল বাতাস ঝাপটা দিচ্ছে তার চোখে মুখে। রাস্তার ওধারে একটা গির্জা চোখে পড়ল ট্যাসোনের। ফুটপাথ থেকে রাস্তায় নেমে ওদিকে এগোতেই উল্টো দিক থেকে ঝড়ের প্রচণ্ড ঝাপটা বাধা দিল তাকে। ঝুঁকে পড়ে বাতাস ঠেলে এগিয়ে চলল সে। ওমের শব্দ এখনও তার কানে বাজছে, সাথে বাতাসের আর্তনাদও যোগ দিয়েছে। ধুলোর মেঘ আর বাতাসের শব্দের মাঝে ছুটন্ত ট্রাকটার উপস্থিতি টেরই পেল না ট্যাসোন। টের পেল যখন ওটা রাস্তায় চাকার ঘর্ষণের প্রচণ্ড শব্দ তুলে তার থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূর দিয়ে ঘুরে গিয়ে একটা পার্ক করা গাড়িকে চ্যাপ্টা করে ল্যাম্প পোস্টে ধাক্কা খেয়ে কাত হয়ে স্থির হল।

হঠাৎ করেই থেমে গেল বাতাস। লোকজন চিৎকার করতে করতে ছুটে গেল ট্রাকের দিকে। ট্রাক-ড্রাইভারের মাথাটা সামনের দিকে ঝুলে পড়েছে, ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে জানালার ওপর। মেঘ গুড়গুড় করছে আকাশে—মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্যাসোন ফুঁপিয়ে উঠল ভয়ে। চারদিক আলো করে গির্জাটার পিছন দিকে একটা বাজ পড়ল। ঘুরে এক ছুটে আবার পার্কে ফিরে এল সে। আর একটা বাজ পড়ার শব্দের সাথে সাথে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। দিশেহারা হয়ে ছুটতে আরম্ভ করল সে, কড়-কড়-কড়াৎ শব্দে বাজ পড়ছে তার আশেপাশে। বাজের আঘাতে একটা গাছ ফেটে চৌচির হয়ে পড়ল তার পাশেই। ভয়ে কাদায় পিছলে পড়ে গেল সে। আকাশ থেকে বিদ্যুতের লকলকে ছোবলগুলো যেন বারবার তাকে ছোঁয়ার জন্যে নেমে আসছে। চেষ্টা করে উঠে দাঁড়াল ট্যাসোন। আবার বাজ পড়ল। এবার ওটা পড়ল পার্কের একটা বেঞ্চের ওপর। বেঞ্চটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে ম্যাচের কাঠির মত জ্বলতে লাগল তার বাম পাশে। একটা ফুল গাছের সারি মাড়িয়ে ডানদিকে ছুটল সে। আবার আঘাত হানল বাজ। সামনের একটা ডাকবাক্সের ওপর পড়ল সেটা। বাক্সটা লাফিয়ে উঠল শূন্যে; সারডিনের খোলা টিনের মত চিরে উল্টে গেছে বাক্সের লোহার পাত।

সজল চোখে ক্রুদ্ধ আকাশের দিকে চেয়ে টলতে টলতে এগিয়ে গেল ট্যাসোন। জোর-বৃষ্টি নেমেছে, ফোঁটাগুলো তার মুখে বিধছে। ভিজে চোখে জলের পর্দা ভেদ করে শহরটা ঝাপসা দেখতে পাচ্ছে ও। লণ্ডনের রাস্তার সব লোকজন বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্যে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে। বাড়ি ঘরের জানালা টপাটপ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একজন মহিলা শিক্ষয়িত্রী পুরানো আমলের জানালা বন্ধ করার পোল নিয়ে জানালা বন্ধ করার চেষ্টা করছে; ক্লাসের ছোট ছোট ছাত্র-ছাত্রীরা চেয়ে দেখছে। মহিলা ট্যাসোনের নামও শোনেনি কোনদিন—সে জানত না অদৃষ্ট তাদের এমন একটা যোগাযোগ ঘটাবে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে ট্যাসোন তাঁর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল। হাঁ করে শ্বাস নিতে নিতে উদ্দেশ্য-বিহীন ভাবে ছুটছিল ট্যাসোন। বজ্রপাতের ভয় আর এখানে নেই—সেসব পিছনে ফেলে এসেছে সে। একটা মোড় ঘুরে ওই দালানের ঠিক নিচেই দাঁড়াল ও একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্যে। আর চলছে না তার দেহ, বুকের ভিতরটায় কে যেন ছুরি দিয়ে খোঁচাচ্ছে। হঠাৎ উপর থেকে হাত ফসকে পোলটা নিচে নেমে এল জেভেলিনের মাটিতে নেমে আসার ভঙ্গিতে ট্যাসোনকে এফোঁড় ওফোঁড় করে ঘাসের মধ্যে মাটিতে গেঁথে গেল ওটা। একটু পিছন দিকে হেলে মৃতদেহটা দাঁড়িয়েই রইল; পোলটা ঠেকা দিয়ে রেখেছে ওকে।

হঠাৎ করেই বৃষ্টি থেমে গেল। স্কুলের চারতলার ওপর থেকে জানালা দিয়ে নিচে উঁকি দিয়েই শিক্ষয়িত্রী গলা চেরা চিৎকার দিয়ে উঠল। পার্কের অন্যধারে রাস্তার লোকজন ধরাধরি করে ট্রাক ড্রাইভারের মৃতদেহটা নিচে নামাল। স্টিয়ারিং—এর ধাক্কায় কপালে রক্ত জমাট বেঁধে দাগ হয়ে রয়েছে।

মেঘ সরে গিয়ে সূর্যের আলো বেরিয়ে এল শান্তি নিয়ে। পাদরীর চারপাশে কয়েকজন লোক জড়ো হয়ে অবাক চোখে পোলে গাঁথা ট্যাসোনকে দেখছে। একটা বড় মাছি তার হাঁ করা মুখটার ওপর বারবার গিয়ে বসছে।

.

পরদিন সকালে নাস্তা খেতে বসেছে ক্যাথি আর রবার্ট। হর্টন এসে খবরের কাগজটা দিয়ে গেল। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময়ে হর্টন লক্ষ্য করল কর্ত্রীর মুখ গোমড়া। মানসিক ডাক্তারকে দেখাতে আরম্ভ করার পর থেকে যতই দিন যাচ্ছে তার মুখ ততই গম্ভীর হচ্ছে। বেশ একটা মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছে সে, তা বেশ পরিষ্কার বোঝা যায়। আরও পরিতাপের বিষয় এই যে ছেলেটা এখন তার সান্নিধ্য চায়। দিনের পর দিন অক্লান্ত চেষ্টার ফল। কিন্তু এখন ক্যাথিই পালিয়ে বেড়ায়, যখন ডেমিয়েন তার খোঁজ করে, আশেপাশে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না তাকে।

ক্যাথির নিজের জন্যে ডাক্তারের কাছে যাওয়াটা হয়ত ভুলই হয়েছে। থিরাপি নেয়ার পরে এখন সে আরও বিব্রত আর অসহায় বোধ করছে। আগে সে জানত সে কি ছিল—কিন্তু এখন সে আর নিজেকে চিনতে পারে না। সামনে কোন ভবিষ্যৎ সে আর দেখতে পায় না এখন। সামান্য কিছুতেই ভয়ে একেবারে কুঁকড়ে যায়। টেলিফোন বেজে ওঠা, টাইমার বেজে ওঠা, কেতলীর হুইসেল সবই যেন কিছু দাবি করছে ওর কাছে। সহ্যের প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে ক্যাথি।

আজ তার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। ডেমিয়েন আজকাল সবসময়ে ক্যাথির আশেপাশেই ঘুরঘুর করে আর এটা ওটা করে তার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। এই মুহূর্তে সে একটা চাকাওয়ালা খেলনা নিয়ে ট্রেন চালাচ্ছে আর মুখ দিয়ে ট্রেনের শব্দ তুলে ক্যাথির চেয়ারে ধাক্কা লাগাচ্ছে বারবার।

‘মিসেস বেলক?!’ হাঁক দিল ক্যাথি।

রবার্ট তার উল্টোদিকের চেয়ারে বসে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিল। ক্যাথির কণ্ঠস্বরে রাগের ভাব লক্ষ্য করে চমকে মুখ তুলে চাইল সে।

‘কি হয়েছে?’ উদ্বিগ্ন ভাবে জানতে চাইল রবার্ট।

‘ডেমিয়েন বেশি শব্দ করছে—অসহ্য লাগছে আমার।’

‘এমন কিছু গোলমাল তো…’

‘মিসেস বেল্‌ক।’ আবার ডাকল ক্যাথি।

প্রায় দৌড়ে প্রবেশ করল বিশাল-আকৃতি মহিলা।

‘জ্বী?’

‘ওকে এখান থেকে নিয়ে যাও,’ আদেশ দিল ক্যাথি।

‘খেলছে খেলুক না?’ আপত্তি জানাল রবার্ট।

‘আমি বলছি ওকে নিয়ে যাও!’ চিৎকার করল ক্যাথি।

‘জ্বী, মেম সাহের।’

হাত ধরে ডেমিয়েনকে বাইরে নিয়ে গেল মিসে বেল্ক। রবার্টের চোখে পড়ল যাবার আগে ছেলেটা ঘুরে একবার তার মায়ের দিকে চেয়ে দেখল আহত চোখে। ক্যাথির দিকে হতাশ চোখে চাইল রবার্ট। মাথা নিচু করে খাওয়ায় মন দিয়ে চোখাচোখি হওয়া এড়িয়ে গেল ক্যাথি।

‘তুমি সন্তান কেন চেয়েছিলে, ক্যাথি?’

‘লোকের চোখে ভাল দেখাবে, তাই।’

‘কি?’

‘হ্যাঁ, কেউ কোনদিন এমন কথা শুনেছে যে একটা সুন্দর পরিবারে একটা সুন্দর বাচ্চা নেই? সেই জন্যে আমাদের একটা বাচ্চার দরকার ছিল।’

নীরবেই কথাটা হজম করল রবার্ট। ভিতরে ভিতরে মস্ত হোঁচট খেয়েছে সে।

‘ক্যাথি…’

‘কথাটা সত্যি কিনা? আমরা কোনদিনই ভাবিনি ছেলেকে মানুষ করার কাজটা কেমন হবে। কেবল ভেবেছি খবরের কাগজে খবরটা কেমন চমক আনবে।’

বোকার মত চোখ তুলে ক্যাথির দিকে চাইল রবার্ট। এবার সে-ও তার চোখেচোখে চেয়ে রইল।

ঠিক কিনা বল?’ জিজ্ঞেস করল থর্ন-গিন্নী।

‘তোমার ডাক্তার কি এসব শেখাচ্ছে তোমাকে?’

‘হ্যাঁ।’

‘ওর সাথে তাহলে আমার একটু কথা বলা দরকার।’ খুব কঠিন স্বরে কথা কয়টা বলল রবার্ট।

‘হ্যাঁ, তারও তোমাকে বলার কিছু কথা আছে।’

তার গলার স্বরে রবার্ট টের পেল এর পরে আরও কিছু আসছে।

‘কি ব্যাপারে আলাপ করতে চান তিনি?’ জিজ্ঞেস করল রবার্ট। ‘আমাদের একটা সমস্যা আছে, রবার্ট।’

‘…কি, বল?’

‘আমি আর সন্তান চাই না, কোনদিনও না।’

আরও কিছু শোনার আশায় ক্যাথির মুখের দিকে চেয়ে রইল রবার্ট।

‘তোমার কোন আপত্তি নেই তো?’

‘তুমি যদি চাও তবে তাই হবে।’

‘তাহলে অ্যাবর্শনে তোমার আপত্তি নেই?’

বরফের মত জমে গেল রবার্ট। অবাক বিস্ময়ে তার মুখ হাঁ হয়ে গেল।

‘আমি গর্ভবতী, রবার্ট, মাত্র গতকাল জেনেছি আমি।‘

নীরবতা নেমে এল কিছুক্ষণের জন্যে। রবার্টের মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।

‘আমার কথা শুনছ তুমি?’ জিজ্ঞেস করল ক্যাথি।

‘হ্যাঁ, কিন্তু তা কি করে সম্ভব?’

‘ওটা কয়েলের ব্যাপার—কোন কোন সময়ে ওটা ঠিকমত কাজ করে না।’

‘তাহলে তুমি সত্যিই অন্তঃসত্ত্বা?’

‘বেশি দিন হয়নি।’

ছাইয়ের মত সাদা হয়ে গেছে রবার্ট। হাত দুটো কাঁপছে তার টেবিলের দিকে চেয়ে বসে আছে সে।

‘কাউকে বলেছ তুমি?’

‘একমাত্র ডাক্তার গ্রীয়ার জানে।‘

‘তুমি ঠিক জানো?’

‘আমি আর একটা বাচ্চা চাই কিনা?’

‘তা না, সত্যিই তোমার পেটে বাচ্চা এসেছে?’

‘হ্যাঁ।’

নিথর হয়ে বসে রইল বরার্ট। শূন্য দৃষ্টি। পাশের টেলিফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। যন্ত্রচালিতের মতই রিসিভার তুলে নিল রবার্ট।

‘হ্যাঁ, বলুন?’ গলা চিনতে না পেরে বলল সে। টেলিফোনে কথা শুনতে শুনতে বিব্রত ভাবে ক্যাথির দিকে একবার চাইল ও, ‘কি? কে বলছেন? হ্যালো, হ্যালো?’ কিন্তু ততক্ষণে রেখে দিয়েছে লোকটা।

‘কি বলল?’ জিজ্ঞেস করল ক্যাথি।

‘বলল আজকের কাগজ পড়তে…’

‘কেন, কাগজে কি আছে?’

‘জানি না, কেউ টেলিফোন করে কেবল বলল আজকের কাগজটা যেন ভাল করে পড়ি।

কাগজের ভাঁজ খুলে আবার দেখতে আরম্ভ করল রবার্ট। প্রথম পাতার ছবিটার দিকে নজর পড়ল তার। ছবিটা ভাল করে লক্ষ্য করেই একেবারে পাথর হয়ে গেল সে।

‘কি হল? বল…বল?’ অস্থির ভাবে জিজ্ঞেস করল ক্যাথি। কোন জবাব না পেয়ে রবার্টের হাত থেকে কাগজটা টেনে নিয়ে ছবিটা দেখল সে। একজন পাদরীর ছবি—জানালা বন্ধ করার পোলে গাঁথা। নিচে লেখাঃ ধর্মযাজকের দুঃখ—জনক অপঘাতে মৃত্যু।

রবার্টের দিকে চেয়ে সে দেখল তার স্বামী রীতিমত কাঁপছে। কিছুই বুঝতে না পেরে সে তার হাত ধরল। একেবারে ঠাণ্ডা।

‘রবার্ট!’

চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার দিকে রওনা হল রবার্ট।

‘তুমি চেন ওকে?’

কোন জবাব না দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল রবার্ট। আবার ছবিটার দিকে তাকাল ক্যাথি। বিবরণটা পড়তে পড়তেই থর্নের গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে যাবার শব্দ শুনতে পেল সে। পুরোটা পড়েও আগা মাথা কিছুই বুঝল না ও। রবার্টের অফিসে ফোন করে সে বলে রাখল রবার্ট অফিসে এলেই যেন তাকে ফোন করে। দুপুরের পরও যখন রবার্ট তাকে ফোন করল না তখন বোঝা গেল অফিসেই যায়নি সে। ফোন করে ডাক্তার গ্রীয়ারকেও পেল না ক্যাথি—তার সেক্রেটারি জানাল অত্যন্ত ব্যস্ত আছেন ডাক্তার, এখন ফোন ধরতে পারবেন না। ক্যাথি পরের ফোনটা করল হাসপাতালে, অ্যাবর্শনের সব ব্যবস্থা ঠিক করে ফেলল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *