অনেকের কাছে বাঙলা প্রচলনের সমস্যাটি পরিভাষা ও মুদ্রাক্ষর যন্ত্রের সমস্যা: যেনো বড়ো বড়ো পরিভাষাগ্রন্থ আর অজস্র মুনীর অপটিমা পাওয়া গেলে বাঙলাদেশের সমস্ত শীততাপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে, সরকারি প্রাসাদে, পরিদপ্তরে, বিচারালয়ে, করপোরেশনে বাঙলার বন্যা ব’য়ে যেতো। পরিভাষার সমস্যা আছে, মুদ্রাক্ষর যন্ত্র আমরা তৈরি করতে পারি না, এ-সবই সত্য; কিন্তু আসল সত্য লুকিয়ে আছে রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতিতে। ইংরেজি আমাদের শক্তিমানদের স্বার্থ রক্ষা করে, এবং বাঙলা রক্ষা করতে চায়, এবং ব্যর্থ হয়, শক্তিহীনদের স্বার্থ। তাই বাঙলাদেশের রাজনীতি (ও সমাজ-ও অর্থ-নীতি) যদি পুরোপুরি শক্তিহীনদের পক্ষে না যায়, তবে বাঙলা সর্বস্তরে প্রচলিত হবে না। ইংরেজি ভালো জানলে ও মোটামুটি সাধারণ জ্ঞান থাকলে বাঙলাদেশে সাধারণত চমৎকার চাকুরিতে ঢোকা যায় এবং উন্নতি করা যায় দ্রুত। পাকিস্তানকালে সাধারণ সমকালীন জ্ঞান ও ভালো ইংরেজিসম্পন্নরা ঢুকে যেতেন উচ্চতম চাকুরিতে; তাই উচ্চাভিলাষীরা ইংরেজি আয়ত্তের চেষ্টা করতেন মরিয়া হয়ে। ওই শ্রেণীটি এখনো নিজেদের সুযোগসুবিধা টিকিয়ে রাখার জন্যে ইংরেজি অবলম্বন ক’রে আছেন, এবং রোধ করছেন বাঙলাকে। যদি এখন উৎকৃষ্ট বাঙলা ও মোটামুটি বিষয়-ও বিশ্ব-জ্ঞান নিয়ে পাওয়া যেতো ভালো চাকুরি, তাহলে বাঙলা প্রচলিত হতো দ্রুতগতিতে। দেশের যে-সব শক্তিকেন্দ্র চাকুরি দেয়ার দায়িত্বে আছে, এখনো সে-সবের অধিকাংশ চাকুরির পরীক্ষা হয় ইংরেজিতে : বাঙলাদেশ ব্যাংক, রপ্তানি উন্নয়ন সংস্থা, বিভিন্ন করপোরেশনের চাকুরির পরীক্ষা ইংরেজিতেই হয়। বাঙলা এখানে কোনোই উপকারে আসে না। তাই উৎসাহীরাও বাঙলা আয়ত্তের উৎসাহ হারাচ্ছেন। অর্থাৎ অর্থনীতিই আমাদের ইংরেজিতে উৎসাহী ও বাঙলায় অনাসক্ত ক’রে তুলছে। অর্থনীতিই নিয়ন্ত্রণ করে সমাজনীতির ব্যাকরণ;- অর্থশালীরাই সমাজের শির, তাঁরা ইংরেজির ভক্ত; তাই সমাজে ইংরেজির মর্যাদা আছে, বাঙলার নেই। তা-ই সব সময় মর্যাদাবান, যা মূল্যবান। আর্থনীতিক ও সামাজিক সুবিধা পাওয়ার সব এলাকায় বাঙলা নিষিদ্ধ; সিদ্ধ শুধু ইংরেজি। রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে সব কিছু- অর্থ ও সমাজ; তাই রাজনীতি যদি ব্যাপক জনমণ্ডলির স্বার্থের পক্ষে না যায়, তবে বাঙলা ভাষাও মূল্য-মর্যাদা পাবে না। আমাদের রাজনীতির ধারা বাঙলা ও ব্যাপক জনমণ্ডলির বিপক্ষে।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বাঙলা প্রচলনে উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিলো : ছাত্ররা ভেবেছিলো বাঙলা শিখলে চাকুরির রুদ্ধদ্বার খুলবে, নিন্মপদস্থরা ভেবেছিলেন যুক্তাক্ষরগুলোকে বশ করতে পারলে উন্নতি হবে;- পাওয়া যাবে সামাজিক আর্থনীতিক স্বীকৃতি। তাই বাঙলা শেখার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিলো চতুর্দিকে। কিন্তু পঁচাত্তরের পর স্রোত বিপরীতমুখি হয়ে ওঠে— উগ্র হয়ে ওঠে প্রতিক্রিয়াশীলতা- “বাঙলাদেশ বেতার’, ‘চালনা বন্দর’, ‘পৌরসভা’, ‘রাষ্ট্রপতি প্রভৃতি ‘রেডিও বাঙলাদেশ’, ‘পোর্ট অব চালনা’,’ মিউনিসিপাল করপোরেশন’, ‘প্রেসিডেন্ট’ হয়ে উঠতে থাকে। বাঙলার মর্যাদা হ্রাস পায়, তার আর্থমূল্য ক্রমশ কমতে থাকে; এবং উৎসাহীরাও পুনরায় ইংরেজিমুখি হয়ে ওঠেন। আর্থনীতিক সামাজিক সূত্রই ভাষাপ্রবণতার নিয়ন্ত্রক, ভাষাতাত্ত্বিক সূত্রের কোনো প্রভাব এতে নেই। মধ্যযুগে ভারতচন্দ্র ফারসির বদলে বাঙলা শিখেছিলেন ব’লে বিতাড়িত হয়েছিলেন বাড়ি থেকে, কেননা পুণ্য সংস্কৃত স্বর্গের দরোজা খুলে দিতে পারলেও সামাজিক-আর্থনীতিক চাবি তাঁর হাতে তুলে দিতে সক্ষম ছিলো না। ১৮৩৫ সালে ফারসির বদলে ইংরেজি প্ৰচলনে হঠাৎ অশিক্ষিত অসহায় হয়ে পড়েছিলেন একটি বড়ো শ্রেণী; যাঁরা এতো দিন ছিলেন গণ্যমান্যপ্রতিপত্তিশালী। এই অসহায় অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় এমনভাবে :
কয়েকদিন পরেই গবর্ণমেণ্ট গেজেটে প্রকাশ হইল যে এদেশের সমস্ত রাজকার্য দেশীয় ভাষায় চলিবেক। বাঙ্গালীর পক্ষে পারস্য একরূপ অকর্মণ্য হইল, এবং ইহার আদর এককালে উঠিয়া গেল। বহু যত্নের ও শ্রমের ধন অপহৃত হইলে, অথবা উপার্জনক্ষম পূত্র হারাইলে যেরূপ দুঃখ হয়, সেইরূপ দুঃখ ওই সংবাদে আমাদের মনে উপস্থিত হইল। অনেক পরিশ্রমপূর্বক যে-কিছু শিখিয়াছিলাম, তাহা মিথ্যা হইল, এবং বিদ্বান বলিয়া যে খ্যাতি লাভের আশা ছিল, তাহা নির্মূল হইয়া গেল।
ইংরেজি এখন আমাদের বিদ্যা-শক্তি-ধনশালীদের উপার্জনক্ষম পূত্র শুধু নয়, ইংরেজি তাঁদের কমেধেনু, যার কোনো বাঁট থেকে উৎসারিত হয় ধন, কোনোটি থেকে প্রতাপ, কোনোটি থেকে খ্যাতিসম্মান। তাঁরা এমন ধেনুকে হারাতে চান না ব’লেই রোধ করেন বাঙলাকে। আর্থ কারণেই মানুষেরা সাধারণত কোনো ভাষা ভালোভাবে শেখে। এর চমৎকার উদাহরণ আরবি ভাষা : ইসলাম তো এ-দেশে আছে অনেক শতাব্দী ধ’রেই, কিন্তু আরবি শিখতে চেষ্টা করেছেন ক-জন? ধর্ম খুব কম মানুষকেই আরবি শেখায় উৎসাহিত করেছে; কিন্তু এখন অপর্যাপ্ত ডলারের লোভে আরবি শিখছেন দরিদ্র বাঙালি থেকে ধনী আমেরিকানও। বিলেতে এখন অনেক পথনারীও আরবি জানে, তাতে তার ব্যবসায়ে সুবিধা হয়।