শত্রুমিত্রতার ইতিকথা

শত্রুমিত্রতার ইতিকথা

বাঙলা ভাষার সাথে বাঙালি মুসলমানের শত্রুমিত্রতার ইতিহাস বেশ দীর্ঘ, যদিও অত্যন্ত সরল। বাঙালি মুসলমান কয়েক শো বছর ভুগেছে স্বরূপশনাক্তি ও আপন ভাষাশনাক্তির সমস্যায় বা রোগে। ফারসি-ইংরেজি যুগে শাসকসম্প্রদায়, সাধারণত, বাঙলার সাথে শত্রুতা করে নি, বরং মিত্রের মুখোশ পরেছে অনেক সময়, কিন্তু পাকিস্তানকালে বাঙলা ভাষা অর্জন করে সামন্ত শাসকদের শত্রুতা। মধ্যযুগেই বাঙালি মুসলমান ভাষাপ্রশ্নে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গিয়েছিলো : একগোত্রে ছিল গুটিকয় সুবিধাবাদী সুবিধাভোগী, যাদের স্বপ্নে ছিলো ইরানতুরান, আরবিফারসি; অন্য গোত্রে ছিলো বিশাল বাঙালি মুসলমান শ্রেণী, বাঙলাদেশ ও বাঙলাই ছিলো যাদের বাস্তব ও স্বপ্ন। সতেরো শতকে এক শ্রেণীর বাঙালি বাঙলার সাথে শত্রুতা ক’রে যাচ্ছিলো সম্ভবত প্রচণ্ডভাবেই, যার প্রতিক্রিয়ায় কবি আবদুল হাকিমের বুক থেকে উৎসারিত হয়েছিলো ছন্দোবদ্ধ অবিনশ্বর ক্রোধ :

যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি॥
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ ত্যাগি কেন বিদেশ ন যায়।
মাতাপিতামহক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মান হিত অতি॥

বাঙলার কোমল কবিসমাজের একজন তিনশো বছর আগেই কেনো এমন তীব্র আগুনে পরিণত হয়েছিলেন, তা বোঝা কঠিন নয়। আঠারো-উনিশ শতকেও একদল বিরুদ্ধতা ক’রে যাচ্ছিলো বাঙলা ভাষার সাথে : কেউ কেউ প্রাণপণে আঁকড়ে ধরতে চাইছিলো ফারসিকে, কেউ নতজানু হচ্ছিলো ইংরেজির শুভ্র পদতলে। আবদুল লতিফ সরকারকে জানিয়েছিলো মুসলমানের ভাষা উর্দু, বাঙলা নয়। উনিশশতকে স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে অনেক হিন্দুও বাঙলার সাথে শত্রুতা করছিলো, যা দেখে হাহাকার ক’রে উঠেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত : ‘হায় হায় পরিতাপে পরিপূর্ণ দেশ। দেশের ভাষার প্রতি সকলের দ্বেষ।’ কিন্তু ওই শত্রুতাও দ্রোহীসুন্দর ভাষাকে ধ্বংস করতে পারে নি; বরং তা দশকেদশকে অধিকতর শক্তিশোভা অর্জন করেছে।

আবদুল লতিফের মতো সুবিধাবাদী সমাজবিলগ্নরাই উনিশ-বিশ শতকে সৃষ্টি করে উর্দু-বাঙলাকলহ। সমাজবিলগ্নরা দাবি করতে থাকে যে উর্দুই মুসলমানের ভাষা : এক আহামরি ভাষা, যার পদ্যেপদ্যে ইসলামি সুগন্ধ আর পেশিতে ইসলামি জোশ! অন্যদিকে বাঙলা অমুসলমানের ভাষা- ভীরু ও পৌত্তলিক। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ-ও সমাজ-লগ্ন অংশটি নিজেদের স্বরূপ ও স্বদেশ ও ভাষা শনাক্তিতে ভুল করে নি। বাঙলাই যে তাদের মাতৃভূমি, তারা যে বাঙালি, বাঙলা যে তাদের মাতৃভাষা— এ তিন ধ্রুব সত্যকে চিনেছে তারা অনায়াসে। স্বার্থহীন মানুষ সত্যকে পায় অবলীলায়। কিন্তু তাদের প্রচুর শক্তি ব্যয় করতে হয়েছিলো সুবিধাবাদীদের সাথে সংগ্রামে, যা আরো গঠনমূলক কাজে- বাঙলা ভাষার বিকাশসাধনে- নিয়োজিত হ’তে পারলে অনেক উপকার হতো। বাঙলা-উর্দুকলহে বাঙলাপন্থিরা যে-সব যুক্তি দিয়েছিলেন, তার কিছু নিম্নরূপ :

[ক] আমাদের বঙ্গীয় মুসলমানের কোনও ভাষা নাই। শরিফ সন্তানেরা এবং তাঁহাদের খেদমৎকারগণ উর্দু বলেন, বাঙ্গালা ভাষা ঘৃণা করেন; কিন্তু সেই উর্দু জবানে মনের ভাব প্রকাশ করা দূরে থাকুক, পশ্চিমা লোকের গিলিত চর্বিত শব্দগুলিও অনেকে যথাস্থানে শুদ্ধ আকারে যথার্থ অর্থে প্রয়োগ করিতেও অপারগ। অথচ বাঙ্গালায় মনের ভাব প্রকাশ করিবার সুবিধা হইলেও ঘৃণা করিয়া তাহা হইতে বিরত হন।…সতেজ স্বাভাবিক বাঙ্গালা ভাষা স্বাধীনতা পাইলে, তৎসঙ্গে পল্লীবাসী মোসলমান সমাজের উন্নতির যুগান্তর উপস্থিত হইবে।-(নূর-অল-ইমান, ১ : ৩, ১৩০৭)

[খ] আমাদের পূর্ব পুরুষগণ আরব, পারস্য, আফগানিস্থান অথবা তাতারের অধিবাসীই হউন আর এতদ্দেশবাসী হিন্দুই হউন, আমরা এক্ষণে বাঙ্গালী, আমাদের মাতৃভাষা বাঙ্গালা।…তাঁহারা (বাঙলা ভাষার শত্রুরা) বাঙ্গালার বাঁশবন ও আম্রকাননের মধ্যস্থিত পর্ণকুটিরে নিদ্রা যাইয়াও এখনও বোগদাদ, বোখারা, কাবুল, কান্দাহারের স্বপ্ন দেখিয়া থাকেন। কেহ কেহ আবার বাঙ্গালার পরিবর্তে উর্দুকে মাতৃভাষা করিবার মোহে বিভোর। দুর্বল ব্যক্তিরা যেমন অলৌকিক স্বপ্ন দর্শন করে, অধঃপতিত জাতিও তেমনি অস্বাভাবিক খেয়াল আঁটিয়া থাকে।- (হামেদ আলী, বাসনা, ২ : ১, ১৩১৬)

[গ] বাঙ্গালী মুসলমানের মাতৃভাষা বাঙ্গালা, ইহা দিনের আলোর মত সত্য। ভারতব্যাপী জাতীয়তা সৃষ্টির অনুরোধে বঙ্গদেশে উর্দু চালাইবার প্রয়োজন যতই অভিপ্রেত হউক না কেন, সে চেষ্টা আকাশে ঘর বাঁধিবার ন্যায় নিষ্ফল।- (মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী, কোহিনুর, মাঘ, ১৩২২)

[ঘ] উর্দু-ভাষীরা যে বাংলাদেশের মুসলমানদিগের মধ্যে বাংলার পরিবর্তে উর্দু ভাষা চালাইবার চেষ্টা করেন এইটা তাঁহাদের বড় অন্যায়;- অনধিকার চর্চাও বটে। এইরূপ অন্যায় চেষ্টা যাঁহারা করিয়া থাকেন, তাঁহাদের সঙ্গে আবার এক দল ‘ফেউ’ আছেন। এই ‘ফেউ’রা প্রায়ই খাঁটি বাঙ্গালী। ইঁহারা কলিকাতায় পশ্চিমা নারীর পাণি গ্রহণ করিয়া স্ত্রীর খাতিরে মা’কে ছাড়িয়া শাশুড়ীকে মা বলিয়া ডাকেন। আর একদল আছে, যাহারা বক্রাক্ষর দেখিলেই আত্মহারা হইয়া যায়। (মোজাফফর আহমদ, আল-এসলাম, ৩ : ৪, ১৩২৪)

[ঙ] কেহ কেহ উর্দুর স্বপ্নে বিভোর হইলেও বাঙ্গালী মুসলমানের মাতৃভাষা যে বাঙ্গালা এ বিষয়ে কোন মতদ্বৈধ থাকা উচিত নহে।…আমার স্বজাতীয় ভাইয়েরা কেবল এই কথাই মনে রাখিবেন যে বর্তমান বাঙ্গালা ভাষা সংস্কৃতমূলকই হউক কি আর যাহাই হউক, উহা আমাদেরই মাতৃভাষা।— (সৈয়দ এমদাদ আলী, বঙ্গীয়-মুসলমান-সাহিত্য-পত্রিকা, ১ : ২, ১৩২৫)

ওপরের উদ্ধৃতিগুলো স্পষ্টভাবে জানাচ্ছে যে তাঁরা কয়েকটি মিথ্যাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে ত্যাগ করেছিলেন : উর্দু-আরবি-ফারসি, ইরান-তুরান-মরুভূমি ত্যাগ ক’রে বাঙলা ও বাঙলাদেশে দীর্ঘ শেকড় প্রোথিত করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু তাঁরা যে কলহে অংশ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তা নির্দেশ করে যে ভাষা-আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছিলো অনেক আগেই, বায়ান্নোতে ঘটে তার বিস্ফোরণ। বাঙলা ভাষার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, সম্ভবত, পৃথিবীর দীর্ঘতম সংগ্ৰাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *