বিচারালয় ও বাঙলা
ঢাকা শহরের প্রধান বিচারালয়ের কোনো কক্ষে শুনানি শোনার জন্যে কেউ যদি ঢুকে পড়ে, এবং সৌভাগ্যবশত কোনো ‘অ্যাডভোকেট’ (বহুলপ্রচলিত ‘উকিল’ শব্দটি এখন আর সম্মানসূচক নয়) যদি তখন বক্তব্য পেশরত থাকেন, তাহলে ঢুকে-পড়া শ্রোতার মনে হবে যে সে আঞ্চলিক বাঙলা শুনছে। কিন্তু কিছুক্ষণ কাটার পরে শ্রোতা বুঝতে পারবে এতোক্ষণ সে যা শুনছিলো তা আঞ্চলিক বাঙলা নয়, আঞ্চলিক ইংরেজি। এমন আঞ্চলিক ইংরেজির একচেটে অধিকার বাঙলাদেশের বিচারালয়গুলোতে। বাঙলা-প্রচলন-সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশগুলোতে ‘অফিস-আদালত’ শব্দ দুটি যুগলবন্দী সমাসবদ্ধ থাকে, এতে মনে হয় বিচারালয়ে বাঙলা প্রতিষ্ঠা করা সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। কিন্তু বিচারালয়ে বাঙলার স্থান প্রায় শূন্য। জেলা-বিচারালয়গুলোতে শুনানি ও রায়ে কখনো কখনো বাঙলা ব্যবহৃত হয়, কিন্তু দেশের উচ্চ বিদ্যালয়গুলোতে বাঙলার কোনো অধিকার নেই। আইনের ভাষা ইংরেজি, উকিল-বিচারকের ভাষাও ইংরেজি। বিচারালয়গুলোতে এক সময় ফারসির প্রাধান্য ছিলো, তবু আঠারো-উনিশ শতকে অনেক শুনানি ও রায়ে বাঙলা ব্যবহৃত হয়েছে। বাঙলা ভাষায় আইনগ্রন্থও লেখা হয়েছে দু-শো বছর আগে। বাঙলা গদ্যের সূচনাই হয়েছিল আইনগ্রন্থ অনুবাদের মাধ্যমে। ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে জোনাথান ডানকান রেগুলেশন্স ফর দি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ জাষ্টিস ইন দি কোর্টস অফ দেওয়ানি আদালত-এর বাঙলা অনুবাদ প্রকাশ করেন; এর পর প্রকাশিত হয় বেনজামিন এডমোনষ্টোনের বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় প্রচলিত ফৌজদারী আদালতের কার্যবিধির (১৭৯১) ও পিটস ফরষ্টারের কর্ণওয়ালিশ কোড-এর (১৭৯৩) বাঙলা অনুবাদ। তাঁরা যে বাঙলা লিখেছিলেন, তা খুব দুস্থ ছিল না; বাঙলাদেশের জজব্যারিস্টাররা ওই মানের বাঙলা লিখতে পারবেন না।
বিচারালয়গুলোতে ইংরেজির প্রাধান্যের কারণ বাঙলাদেশের সমস্ত আইন ইংরেজিতে প্রণীত। বিচারকার্যে যে-পরিমাণ আইন ব্যবহৃত হয়, তার পরিমাণ বেশি নয়, কয়েক শো পৃষ্ঠা মাত্র। আইন মন্ত্রণালয়ের নিষ্ক্রিয়তার জন্যেই এক দশকেও এ-সামান্য পরিমাণ আইনও বাঙলারূপ পায় নি। আইনজীবীদের সাথে আলোচনা ক’রে জানা গেছে তাঁদের অনেকেই বাঙলা ব্যবহারে উৎসাহী, কিন্তু উচ্চ বিচারালয়গুলোতে যেহেতু ইংরেজি ব্যবহারই রীতি, তাই কোনো আইনজীবীর পক্ষে হঠাৎ বাঙলা ব্যবহার হঠকারি বিপ্লবের পর্যায়ে পড়তে পারে। তাঁর বাঙলা ব্যবহারে রুষ্ট হ’তে পারেন বিচারপতি, আতঙ্কিত বোধ করতে পারেন বাদী। কিন্তু বিচারপতিদের স্বাধীনতা আছে, তাঁরা যদি রায় দিতে থাকেন বাঙলায়, তবে তাঁদের সামনে অবিলম্বে বাঙলায় বক্তব্য পেশ করতে শুরু করবেন আইনজীবীরা। গত এক দশকে বেশ কিছু আইনগ্রন্থ প্রণীত হয়েছে বাঙলা ভাষার। আইন-মহাবিদ্যালয়গুলোতে ওই বইগুলো জনপ্রিয়, যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ইংরেজিতেই পাঠ দেয়া হয়। আইন-মহাবিদ্যালয়গুলো থেকে যাঁরা উত্তীর্ন হন, ইংরেজি তাঁদের অনেকের কাছেই বিভীষিকার মতো। তাই তাঁরা ছড়িয়ে পড়ছেন মহকুমা ও জেলা শহরগুলোতে, এবং বিচারালয়ে বাঙলার প্রতিষ্ঠার পথ রচনা করছেন। কিন্তু আইন-মন্ত্রণালয়ের সক্রিয়তা ছাড়া উচ্চতম বিচারালয়ে বাঙলার প্রতিষ্ঠা হ’তে বিশশতক কেটে যাবে।