পরিশিষ্ট : দুই – ভাষা-আন্দোলন ১৯৮২

পরিশিষ্ট : দুই – ভাষা-আন্দোলন ১৯৮২

বাঙলা ভাষা আমাদের অনির্বাণ অগ্নি; ওই শিখা থেকে আগুন সংগ্রহ করতে হয় আমাদের সব সময়। এ-দেশের সমস্ত প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথেই প্রত্যক্ষপরোক্ষভাবে জড়িত থাকে বাঙলা ভাষা ও একুশ;— ওই চিরঞ্জীব মশাল থেকে আগুন নিয়েই জ্বালিয়ে দিতে হয় প্রতিক্রিয়াশীলতার সমস্ত দুর্গ। স্বাধীনতার পরে বাঙলাদেশে দেখা দেয় ছদ্মপ্রগতিশীলতা; এবং অনতিপরেই ওই ছদ্মপ্রগতিশীলতাকেও গ্রাস করে আপাদমস্তক প্রতিক্রিয়াশীলতা। ১৯৮২ মার্চে বাঙলাদেশ পুনরায় ফিরে পায় সামরিক শাসন, ও তার সমস্ত আশীৰ্বাদ অভিসম্পাত : স্তব্ধ হয় সমস্ত প্রগতিশীল আন্দোলন। এবারও এগিয়ে আসে বাঙলা ভাষা; বাঙলাকে নির্ভর করেই ১৯৮২র সামরিক শাসনের মধ্যেও দেখা দেয় আন্দোলন— ১৯৮২র ভাষা-আন্দোলন- যাকে এখন সামান্য ঘটনা ব’লে মনে হচ্ছে; কিন্তু ভবিষ্যতে এ-ঘটনাই অসামান্য রূপ নেবে। এ-আন্দোলনে ‘প্রেরণা’ যোগান সামরিক সরকারের শিক্ষামন্ত্রী, ভাষানীতি সংক্রান্ত একটি মন্তব্য ক’রে। ‘প্রথম শ্রেণীতে ধর্ম ও তৃতীয় শ্রেণীতে ইংরেজী বাধ্যতামূলক করা হবে’ শিরোনামে ১০ জুলাই ১৯৮২ : ২৫ আষাঢ় ১৩৮৯ (শনিবার)-এর সংবাদ-এ প্রকাশিত হয় এ-সংবাদটি : ‘…বলেন যে সরকারী নীতিমালার অধীন সব বিদ্যালয়ে যথাক্রমে প্রথম ও তৃতীয় শ্রেণীতে আরবী বর্ণমালা ও মূল ইংরেজী শিক্ষা সম্পর্কে শিক্ষাদান অবশ্যই নিশ্চিত করা হবে। আগামী জানুয়ারী থেকে এই নিয়ম কার্যকর হবে।’ শিক্ষামন্ত্রীর উক্তি থেকে বোঝা যায় যে আরবি ও ইংরেজি নিয়ে তিনি বেশ চিন্তিত, বাঙলা তাঁর চিন্তায় ঢোকে নি। তাঁর উক্তি সমাজের প্রগতিশীল শ্রেণীকে ক্ষুব্ধ করে, কিন্তু তবু তাঁরা নীরব নির্বাক থাকেন। ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮২ : ২৮ ভাদ্র ১৩৮৯ (মঙ্গলবার)-এর সংবাদ-এ শিক্ষামন্ত্রীর ভাষানীতি সম্পর্কে পুনরায় বেরোয় একটি সংবাদ——১ম শ্রেণী থেকে ধর্মীয় ভাষা, ইংরেজী ২য় শ্রেণী হতে’ শিরোনামে। সংবাদটির অংশবিশেষ এমন : ‘আগামী শিক্ষা বছর হতে দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে ইংরেজী এবং প্রথম শ্রেণী থেকে আরবী শিক্ষা দানের ব্যবস্থা চালু করা হবে। বর্তমানে তৃতীয় শ্রেণী থেকেই ইংরেজী ও আরবী পড়ানো হয়।’ এ-সংবাদ প্রকাশের পর, সামরিক শাসনের মধ্যেও, প্রগতিশীল শ্রেণী- বুদ্ধিজীবী-শিক্ষক-ছাত্র প্রমুখ— আর নির্বাক থাকেন নি; তাঁরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন, যার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁদের বিভিন্ন বিবৃতিতে। ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮২ (শনিবার)-এর সংবাদ- এ ‘প্রাথমিক স্তরে বিদেশী ভাষা বাধ্যতামূলক করার বিষয় পুনর্বিবেচনার আহবান’ শিরোনামে বেশ কিছু বিবৃতি প্রকাশ পায়; এবং এর পরের দিনের পর দিন প্রকাশ পায় শিক্ষামন্ত্রীর ভাষানীতির বিরুদ্ধে বিবৃতি। বিবৃতিদাতারা বেশ সংযত ভাষা ব্যবহারের চেষ্টা করেন; কিন্তু তাতেও একটি বিরোধী আন্দোলনের স্পষ্ট আভাস লক্ষ্য করা যায়। এর পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা নিয়মিতভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে;- বাঙলা ভাষা আশ্রয় ক’রে জন্ম দেয়ার চেষ্টা করে একটি আন্দোলন। এ-আন্দোলন প্রতিরোধ করার জন্যেই কলাভবনে পুলিশ আক্রমণ চালায়। ১৯৮২র ভাষা-আন্দোলন এখনো ছোটো শিখারূপে আছে, কিন্তু তার দাউদাউ জ্বলে ওঠার সম্ভাবনা আকাশে বাতাসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *