বিশ্ববিদ্যালয় ও বাঙলা
ইংরেজির সাথে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাড়ি বেশ শক্তভাবে বাঁধা। আমাদের শিক্ষার মাধ্যম নিয়ে দেড়শো বছর ধ’রে বিতর্ক চলছে; দেড় শতাব্দী ধ’রে আন্দোলন চলছে বাঙলায় শিক্ষা দেয়ার জন্যে, তবু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইংরেজিকে আঁকড়ে আছে নিষ্ঠার সাথে। উনিশ শতকের শুরুতে একজন ইংরেজ পণ্ডিত, উইলসন, বলেছিলেন : ‘জ্ঞানবিদ্যার চর্চা যদি কেবল বিদেশি ভাষার গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়, তাহলে সেটা সমাজের একদল মুষ্টিমেয়, যাদের অর্থ ও অবসর দুই-ই আছে, তাদেরই বিলাসের বিষয় হ’য়ে ওঠে। একথাও পরিষ্কার বোঝা যায় যে প্রত্যেক ভারতীয় ভাষার সঙ্গে ইংরেজি ভাষার মৌলিক পার্থক্য এতো বেশি যে ইংরেজি কখনই এ-দেশের শিক্ষার প্রধান বাহন হ’তে পারে না।’ উইলসনের উক্তির প্রথমাংশকে সত্য আর দ্বিতীয়াংশকে অসত্য প্রমাণ ক’র ইংরেজি এখনো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ী শিক্ষার প্রধান বাহন। তবে স্বাধীনতার পরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চালক-পরিচালকদের প্রতিরোধ সত্ত্বেও, প্রবল বেগে বাঙলা প্রবেশ করে। শিক্ষকেরা বাঙলায়, বা বাঙলা-ইংরেজি-আঞ্চলিকের মিশ্রভাষায় পড়াতে শুরু করেন; কেননা ছাত্রদের কাছে এ-ভাষাই বোধ্য। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই বাঙলা প্রচলনের প্রত্যক্ষ উদ্যোগ নেয় নি, ইংরেজিকে টিকিয়ে রাখার নানা কৌশল অবলম্বন করেছে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়; এবং অনেক এলাকা থেকে বাঙলাকে নির্বাসিত করেছে (যেমন বিজ্ঞান ও ব্যবসাশাস্ত্রের ছাত্রদের আগে বাঙলা পড়তে হতো, এখন হয় না)। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন বাঙলা চলছে শিক্ষক-ছাত্রদের উৎসাহে ও ইংরেজিতে অক্ষমতাবশত। তবে বাঙলার প্রচলন কলা ও সমাজবিদ্যায় যতোটা হয়েছে, বিজ্ঞানের শাখাগুলোতে ততোটা হয় নি। আবার কলা ও সমাজবিদ্যার যে-বিভাগগুলো ধনী শ্রেণীর ছাত্রদের প্রিয়, সেখানেও ইংরেজির প্রাধান্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের অধিকাংশ গবেষণাসন্দর্ভ রচিত হয় ইংরেজিতে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ইংরেজির প্রতিই বেশি আকৃষ্ট। ইংরেজি শেখানোর জন্যে কমিশন বিদেশি শিক্ষক পালন করে; কিন্তু বাঙলা শিক্ষাদানের কথা কমিশনের কখনো মনে পড়ে না।
তবু সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাঙলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক স্থান আছে; কিন্তু প্রকৌশল কৃষি প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে, চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে বাঙলার কোনো স্থান নেই; সেখানে ইংরেজিই রাষ্ট্রভাষা। ওই শিক্ষায়তনগুলোর ইংরেজিনিষ্ঠা দেখে মনে হয় সরকারি ও জনগণের বাঙলা বাস্তবায়নের উদ্যোগ ও আন্দোলনের ক্ষীণতম ঢেউও সেখানে পৌঁছোয় নি। প্রকৌশল-চিকিৎসা-কৃষি এমন শাস্ত্র নয়, যা বাঙলায় অর্জন করা অসম্ভব। সম্ভবত আমাদের এ-শ্রেণীটির সমাজবিচ্ছিন্নতাই তাঁদের ইংরেজিনিষ্ঠ ক’রে রেখেছে।