ফেব্রুয়ারি : উৎসব ও স্নিগ্ধ ছলনার মাস

ফেব্রুয়ারি : উৎসব ও স্নিগ্ধ ছলনার মাস

বিদ্রোহ বিপ্লবের ফাল্গুন ফেব্রুয়ারি এখন রূপান্তরিত হয়েছে উৎসব ও স্নিগ্ধ ছলনার মাসে : এ-মাসে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মনোরমভাবে নাড়াচাড়া করা হয় বায়ান্নোর স্মৃতি, দেশের অসংখ্য শহীদ মিনারের শরীর থেকে পাখির মল পরিষ্কার ক’রে বেদীতে বিন্যস্ত করা হয় ফুল-মালা, পদাধিকারী অতিথিদের উপস্থিতিতে গাওয়া হয় বাঙলা ও বায়ান্নোর বীরদের প্রশস্তিগাথা; এবং সরকারি প্রশাসনযন্ত্র যান্ত্রিকভাবে প্রচার করে সর্বস্তরে বাঙলা প্রচলনের সংকল্প ও নির্দেশ। বছরের কনিষ্ঠতম মাসটি কেটে যায়, শহীদ মিনারের বেদীর ফুল শুষ্ক হয়, পুনরায় সেখানে ভিড় জমায় উদ্বাস্তু পক্ষীপশুরা; এবং বাঙলা ভাষা ও তার কুশলকামীরা আরেক বছরের জন্যে গাঢ় নিদ্রায় বিভোর হয়। জহির রায়হান একটি গল্পে প্রথম ও বর্তমান পর্যায়ের একুশের মাসের বৈপরীত্যের মর্মস্পর্শী ছবি এঁকেছিলেন। উনত্রিশ-ত্রিশ বছর আগে, জহির জানাচ্ছেন, শোনা যেতো এমন সংলাপ :

ভাইসব! আমরা কি চেয়েছিলাম। কি পেয়েছি। আমরা চেয়েছিলাম একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। যেখানে সুখ থাকবে। শান্তি থাকবে। কিন্তু আমরা কি পেয়েছি। কিছু না। কিছু না কিছু না। ওরা আমাদের সুখ কেড়ে নিয়েছে। আমাদের ভাইদের ধরে ধরে জেলখানায় পুরেছে। জেল খানার ভেতরে গুলি ক’রে দেশপ্রেমিকদের হত্যা করেছে ওরা। …ওরা একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি করেছে। হরতাল হবে না। মিছিল বের করতে পারবে না। না। না। বেআইনী আইনকে আমরা মানি না। একশো চোয়াল্লিশ ধারা ভাঙবো। ভাঙবো। ভাঙবো।

এ-দ্রোহী সংলাপ-শপথের সম্পূর্ণ বিপরীত সাম্প্রতিক মেরুদণ্ডহীন সংলাপ ও স্বার্থচিন্তা :

নাহ্। তোমাদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না। ওরা নামজাদা সব গায়কগায়িকাদের বুক ক’রে ব’সে আছে। আর তোমরা সব আলসের হদ্দ চুপ ক’রে ঘরে ব’সে গরুর গোস্ত খাচ্ছো?- চিন্তা করবেন না স্যার। আয়োজন আমরাও কম করি নি। ওদের চেয়ে আমাদের ফাংশন আপনি দেখবেন অনেক ভালো হবে।— ভালো হবে কি। ভালো হতেই হবে। এর সঙ্গে আমার মানসম্মান জড়িয়ে আছে। বুঝলে না, আমি হলাম তোমাদের প্রেসিডেণ্ট।

একুশের উৎসব এখন এ ধরনের কর্মী ও সভাপতিদের উৎসব, যারা একুশের চেতনাকে অসুস্থ ক’রে তুলেছে।

ফেব্রুয়ারি এলেই দরদীদের বুকে বাঙলার জন্যে ব্যথা শুরু হয়; এবং সরকার রটাতে থাকে বাঙলার প্রচলনের অজস্র সিদ্ধান্ত শপথ নির্দেশ। দেশের প্রধান কর্মকর্তা ও তাঁর সহকারীরা উচ্চারণ করেন বাঙলার পক্ষে বিস্তর সুন্দর সুন্দর কথা। পাকিস্তানকালের সুবচনাবলিকে আমি বাদ দিচ্ছি, বাহাত্তর থেকে এ-বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের দৈনিক পত্রিকাগুলোর পাতা ওল্টালে আমরা মুখোমুখি হই বহু সুন্দর উক্তি সিদ্ধান্ত শপথ নির্দেশ আগ্রহ কাতরতার। তার কিছু নমুনা :

[ক] দৈনিক বাংলা (মঙ্গলবার, ১৮ মাঘ ১৩৭৮ : ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২) ‘বাংলায় সব কাজ হচ্ছে : বলেছেন রাষ্ট্রপতি’ শিরোনামে পরিবেশন করেছে নিচের সংবাদ : ‘রাষ্ট্রের উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত যাবতীয় সরকারী নথিপত্র ও অন্যান্য কাজকর্ম বাংলা ভাষায় শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রপ্রধান ও জাতির পিতা স্বয়ং নথিপত্র ও চিঠি ইত্যাদি সব কাজ বাংলায় করছেন। রাষ্ট্রপতি…গতকাল সন্ধ্যায় দৈনিক বাংলার এই প্রতিনিধির সাথে এক সাক্ষাৎকারে এ তথ্য প্রকাশ করেন। ‘ এ-উল্লাসজনক সংবাদ পরিবেশনের মাত্র বিশ দিন পরে দৈনিক বাংলাই (৮ ফাল্গুন ১৩৭৮ : ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২) মর্মান্তিক তথ্য প্রকাশ করেছে যে ‘কার্যক্ষেত্রে বাংলা কমই চালু হয়েছে।’

[খ] দৈনিক বাংলা (৭ই ফাল্গুন ১৩৭৯ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩) এক বছর পর, একুশের দু-দিন আগে, ‘সরকারী পর্যায়ে বাংলা প্রচলন কমিটি গঠিত’ শীর্ষক এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে জানায় : ‘বঙ্গবন্ধুর কাছে কোন ফাইল পেশ করতে হলে তা বাংলায় লিখতে হবে : জানা গেছে বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে অফিসের নথি ও অন্যান্য কাগজপত্র বাংলায় না লেখা হলে তাঁর কাছে উপস্থাপিত করা যাবে না। সুতরাং যাবতীয় সরকারী নথিপত্রাদি বাংলায় লেখার জন্য ক্যাবিনেট ডিভিশন এক পরিপত্রে সকল মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছেন। আরো জানা গেছে যে বঙ্গবন্ধু সরকারী কাগজপত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহার করার জন্য কয়েকবার নির্দেশ দেয়া সত্ত্বেও সরকারী নথিপত্র, ফরম ইত্যাদিতে পুরোপুরি বাংলা ব্যবহারের বাস্তব উদ্যোগ নেয়া হয় নি বলে উক্ত পরিপত্রে অভিযোগ করা হয়েছে।’

বাঙলা প্রচলন কমিটি গঠন সম্পর্কে পত্রিকাটি জানিয়েছে : ‘বাংলা ভাষাকে সরকারী ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার পথে বিভিন্ন অন্তরায়গুলি জরুরি ভিত্তিতে দূর করার লক্ষ্য নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীকে সভাপতি করে একটি ১৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেছে যে কমিটির দায়িত্ব হচ্ছে যে: (ক) সরকারী ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে যথাযথ প্রয়োগের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প তৈরী করা ও অনুমোদন করা, এবং (খ) অনুমোদিত প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বাংলা ভাষা চালুর জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থার পর্যালোচনা করা। এ-দুটো দায়িত্ব পালনের জন্য কমিটি বর্তমানে সরকারী অফিসে কর্মরত মুদ্রাক্ষরিক (টাইপিস্ট) ও সাঁটলিপিকারদের (স্টেনোগ্রাফার) অবিলম্বে বাংলা পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনবোধে মুদ্রাক্ষরিকযন্ত্র (টাইপরাইটার) আমদানী বা উৎপাদন, দেশের বিভিন্ন স্থানে বাংলা মুদ্রাক্ষরিক ও সাঁটলিপি প্রশিক্ষণের সুযোগ, প্রচলিত বিভিন্ন ফরম বাংলা ভাষায় মুদ্রণ, কার্যোপযোগী ও সহজবোধ্য পরিভাষা জরুরি ভিত্তিতে প্রণয়ন ও প্রচলিত নিয়মকানুন ও আইনগ্রন্থের বঙ্গানুবাদের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’

প্রতিবেদনে যে-সমস্ত উদ্যোগের বিবরণ আছে, সেগুলো চমৎকার; কিন্তু ওই অশুভ তেরোর কমিটি কোনো দিন বসে নি, প্রস্তাবগুলোও বাস্তবায়িত হয় নি।

[গ] এর দু-বছর কেটে যাওয়ার পর বাঙলা প্রচলনের ‘অগ্রগতি’র পরিচয় পাওয়া যায় দৈনিক বাংলার (৬ ফাল্গুন ১৩৮১ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫) একটি সংবাদে। ‘বাংলাকে অবশ্যই শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হবে’ শিরোনামে সংবাদটিতে পাওয়া যায় ভবিষ্যৎ সংকল্পের কথা; স্বাধীনতা-উত্তর তিন বছরে কি হয়েছে, তার কোনো বিবরণ নেই। সংবাদটির সারাংশ এক পংক্তির : ‘শিক্ষামন্ত্রী… গতকাল বলেছেন, সরকার অবশ্যই শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’ অর্থাৎ বাঙলা প্রচলনে বিশেষ অগ্রগতি হয় নি, সব কিছুই বিরূপ ভবিষ্যতের হাতে।

[ঘ] এর দু-বছর পর দৈনিক বাংলায় (৯ ফাল্গুন ১৩৮৩ : ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭) বাঙলা প্রচলন সম্পর্কে যে-নতুন সংবাদ প্রকাশিত হয়, তা অতীতেরই পুনরাবৃত্তি। ‘বাংলা চালু করতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’ শিরোনামে পাওয়া যায় এমন সংবাদ : ‘সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক গতকাল ঢাকায় বলেন যে রাষ্ট্র, সমাজ ও অপরাপর ক্ষেত্রে পূর্ণ মর্যাদায় বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শহীদ দিবস উপলক্ষে এক বাণীতে জেনারেল দৃঢ় আস্থা ব্যক্ত করেন যে জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি, বুদ্ধিজীবী, ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায় সমাজের সকল স্তরে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা ত্বরান্বিত হবে।’

১৯৭৫-এর সরকার বাঙলা প্রচলনে ছিলো ‘দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’; ১৯৭৭-এর সরকার ‘প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’। উভয়ের লক্ষ্যই বিমূর্ত।

[ঙ] এর এক বছর পর শহীদ সপ্তাহে শিক্ষা-উপদেষ্টা তত্ত্বাশ্রয়ী হয়ে বলেন, ‘মাতৃভাষা বাদ দিয়ে বিদেশী ভাষার প্রতি আগ্রহ শুভ নয়’ (দৈনিক বাংলা, ৪ ফাল্গুন ১৩৮৪ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮)। তখন দেশে ওই অশুভ আগ্রহ বেশ গতি লাভ করেছে। এর এক বছর পর প্রকাশিত হয় এ-সংবাদটি (দৈনিক বাংলা, ১৯ মাঘ ১৩৮৫ : ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯) : ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় গত ২৮শে ডিসেম্বর বিভিন্ন ব্যাংকে এক নির্দেশ জারি করেছে। নির্দেশটি এরকম : ‘এখন থেকে দেশের ভেতরে সমস্ত লিখিত কাজকর্ম বাংলায় হবে।’ যে সমস্ত অফিস এই নিৰ্দেশ পেয়েছে তারা অফিসের বিভিন্ন বিভাগে এই নির্দেশ বিলি করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকারী অফিসের সমস্ত কাজকর্ম বাংলা ভাষায় হচ্ছে এমন নয়। যদিও স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষা প্রচলনের যে জোয়ার এসেছিলো তার প্রভাবে বহু সরকারী চিঠিপত্র, ফাইলে মন্তব্য লেখা, বিজ্ঞপ্তি প্রচার ইত্যাদিতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। এই উদ্যোগের পাশাপাশি নির্বিকারভাবে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে অনেককেই অবিচল দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ ১৯৭২-১৯৭৯-র মধ্যে বড়ো বড়ো অনেক ঘটনা ঘটলেও বাঙলা প্রচলনে বিশেষ অগ্রগতি হয় নি।

[চ] এক বছর পর দৈনিক বাংলায় (১০ ফাল্গুন ১৩৮৬ : ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৮০) প্রকাশিত হয় ‘সরকারী কাজকর্মে বাংলা প্রচলনের নিশ্চয়তা চাই’ শিরোনামে একটি দাবি। সংবাদটি এমন : ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল একুশের মহান দিনে প্রেসিডেন্ট জিয়ার নিরক্ষরতা দূর করার বৈপ্লবিক আহবানকে সফল করার এবং আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার শপথ ঘোষণা করেছে। … দলের সেক্রেটারি জেনারেল সরকারী কাজকর্মে বাংলা প্রচলনের নিশ্চয়তা বিধানের সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ণের জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান।’ সরকারের একজন শক্তিমান ব্যক্তি বাঙলা প্রচলনের নিশ্চয়তাবিধানের জন্যে দাবি জানাচ্ছেন সরকারের প্রতি;- এ-ই প্রমাণ করে যে বাঙলা প্রচলনের কোনো সুশৃঙ্খল দৃঢ় নীতি গ্রহণ করা হয় নি।

ওপরে যে-সব শপথ সংকল্প আশ্বাস দাবি সংকলিত হয়েছে, তা-ই সব নয়; এমন অজস্র শপথ সংকল্প আশ্বাস দাবিতে গত একযুগের ফেব্রুয়ারি মাসের বিবর্ণ পৃষ্ঠাগুলো উজ্বল হয়ে আছে। এগুলো একুশের স্নিগ্ধ ছলনার ফুলদল, যা ছড়ানো হয় বাঙলা ভাষার মিনারে মিনারে; এবং সপ্তাহ খানেক সুগন্ধ বিলিয়ে অবশেষে আবর্জনায় পরিণত হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *