ইংরেজি : পশ্চিমের জানালা- কার জন্যে খোলা থাকা দরকার?

ইংরেজি : পশ্চিমের জানালা-কার জন্যে খোলা থাকা দরকার?

আমাদের অচলায়তনে একটিই, পশ্চিমমুখো, জানালা আছে; জানালাটির নাম ইংরেজি। আমাদের সমাজের একশ্রেণীর মতে, ওই জানালা দিয়েই রুদ্ধ অচলায়তনে প্রবেশ করে বিশ্বের যতো মুক্ত আলোবাতাস : জ্ঞানবিদ্যা, তাই জানালাটিকে সব সময়, সকলের জন্যে, খোলা রাখা দরকার। তাঁরা এমন ধারণা সৃষ্টি করেন যেনো বাঙলার কৃষক শ্রমিক তস্কর দারোগা হাকিম মুন্সেফ প্রশাসক কেরানি উপ ও অন্যান্য সচিব সহ-উপ-মহা-পরিচালক পকেটমার পতিতা উকিল বিচারপতি ফেরিঅলা আদার ব্যাপারী বিভিন্ন মানের মন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি প্রতিমুহূর্তে বিশ্বের সমস্ত জ্ঞান ব্যগ্রভাবে আহরণ করছেন, এবং অষ্টপ্রহর বিভিন্ন প্রশ্নে মতবিনিময় ক’রে যাচ্ছেন বিদেশিদের সাথে ইংরেজি ভাষায়। এটি একটি সুশ্রী প্রতারণা। ইংরেজি উল্লেখিত ব্যক্তিদের দরকার খুবই সামান্য; যেটুকু দরকার তা অনুবাদক ও ভাষ্যকারদের দিয়ে সহজেই চালানো যায়। কে কোন দিন বিদেশে যাবে, সুযোগ পাবে বিদেশিদের সাথে ইংরেজিতে কথা বলার, এ-প্রত্যাশায় যদি সবাই ইংরেজি শিখতে থাকি, তবে অপচয়িত হবে বিপুল পরিমাণ শ্রম ও অর্থ। বাঙলার দারোগার সাথে বিলেতের দারোগার যোগাযোগ জীবনে কবার ঘটে, কবার জেলাপ্রশাসকের সাথে মতবিনিময় হয় বিদেশি জেলাপ্রশাসকের? এ ছাড়া পৃথিবীর সব দেশে ইংরেজি সুলভ নয়। দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায় যে বাঙলাদেশের কোনো কর্মকর্তার- নিম্নতম কর্মকর্তা থেকে দেশের উচ্চতম অধিকর্তার- ইংরেজির কোন প্রয়োজন নেই। যতোটুকু দরকার, তা ভাষ্যকার অনুবাদকদের দিয়েই, অনেক কম অর্থে ও শ্রমে, সমাধা করা সম্ভব। এর বিপরীত মত যাঁরা পোষণ করেন, তাঁরা আত্মস্বার্থেই তা করেন।

তবে ইংরেজি অথবা একটি দুটি মহৎ বিদেশি ভাষা অনেকের জানা দরকার; সকলের নয়। এক মুঠো লোক পাওয়া যাবে, ব্যক্তিগত প্রয়োজনে যাঁদের ইংরেজি বা অন্য কোনো বিদেশি ভাষা শেখা দরকার। এটা তাঁদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন, রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় প্রয়োজন নয়। তাঁদের প্রয়োজন মেটানোর জন্যে কিছু ভাষাপ্রশিক্ষণ বিদ্যালয় থাকতে পারে, যে-বিদ্যালয় থেকে তাঁরা কিনে নিতে পারেন প্রয়োজনীয় বিদেশি ভাষাটি। ইংরেজি বা অন্য কোনো মহৎ ভাষা অত্যন্ত দরকার কবিসাহিত্যিকদের, ও অতি উচ্চজ্ঞানার্থীদের। উনিশ শতকের দিকে তাকালে এখন স্পষ্ট চোখে পড়ে যে কোনো বিচারপতি ম্যাজিস্ট্রেট কর্মকর্তার ইংরেজি দরকার ছিলো না; দরকার ছিলো মধুসূদন দত্তের, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। মধুসূদন রবীন্দ্রনাথের মতো প্রতিভারা অবশ্য সরকারি সাহায্যের অপেক্ষায় থাকেন না; নিজেদের পরিশ্রমেই প্রয়োজনীয় ভাষাটি আয়ত্ত করেন। মধুসূদন অনেকগুলো বিদেশি ভাষা শিখেছিলেন- নিজের শ্রমে ও অর্থে। আজো কবিসাহিত্যিকেরা নিজেদের চেষ্টায়ই বিদেশি ভাষা শেখেন,– কোনো সরকারই তাঁদের উপকার করার জন্য অর্থ ব্যয় করে না। বাকি থাকে জ্ঞান ও বিদ্যার এলাকাটি, যেখানে ইংরেজি অথবা অন্য কোনো বিদেশি ভাষা দরকার। জ্ঞানের ক্ষেত্রে দেখা যায় শুধু অত্যুচ্চ জ্ঞানার্থীদেরই বিদেশি ভাষা— ইংরেজি, ফরাশি, রুশি, জর্মান বা জাপানি- দরকার। আমাদের জ্ঞানীবিজ্ঞানীসমাজ এমন নন যে তাঁরা পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তের সমস্ত জ্ঞানগ্রন্থ ও রচনা পড়েন; বিপুল জ্ঞানের খুব সামান্য অংশই তাঁদের আয়ত্তে। তাই জ্ঞান-এলাকার মৌলিক গ্রন্থসমূহ যদি পাওয়া যায় বাঙলা ভাষায়, প্রতি দশকের গুরুত্বপূর্ণ, আলোড়নজাগানো রচনারাশিকে বাঙলায় অনুবাদের যদি ব্যবস্থা থাকে, তবে জ্ঞান-এলাকায়ও বিদেশি ভাষার ভূমিকা হ্রাস পায়। পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র প্রভৃতি পড়লেই কেউ বিজ্ঞানী হয়ে যান না; বিভিন্ন বিদেশি ভাষায় প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ রচনাসমূহ পাঠের প্রয়োজন বোধ করেন না। যাঁরা করেন, তাঁরা সংখ্যায় খুবই অল্প; তাঁদের জন্যে বিদেশি ভাষার ব্যবস্থা রাখা দরকার। আর ব্যবস্থা যদি না থাকে, তবে তাঁরা, প্রতিভারা, আপন চেষ্টায়ই প্রয়োজনীয় ভাষাটি শিখে নেবেন। বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে আগে থেকেই সকলের বিদেশি ভাষা আয়ত্তের কোনো দরকার নেই। কেননা সবাই উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে যান না; যাঁরা যান, তারা উচ্চশিক্ষা অর্জনের উপযোগী বিদেশি ভাষা আয়ত্ত করতে পারেন বিদেশেই। অর্থাৎ ইংরেজি ভাষার পশ্চিমের জানালা খোলা রাখা দরকার খুব কমসংখ্যক লোকের জন্যে : শুধু প্রতিভাদের জন্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *