অবতরণিকা
বিশশতক যেনো ভাষার শতক : এ-শতকের আটটি, ও উনিশশতকের শেষ কয়েকটি, দশকে ভাষা বিস্ময়কর ভূমিকা পালন করে শিল্প সাহিত্য জীবন রাজনীতিতে। এর আগে ভাষা এমন ব্যাপকগভীরভাবে আলোড়িত করে নি মানুষের স্বপ্ন ও বাস্তবকে। বিশ শতকের শিল্পকলায় বিষয়ের চেয়ে বড়ো হয়ে ওঠে ভাষা, এবং জীবন ও রাজনীতির বিভিন্ন এলাকাকে তীব্র ঝাঁকুনি দেয় মানুষের বাকযন্ত্র থেকে উৎসারিত ধ্বনিপুঞ্জ। মানুষ, দেশেদেশে, নতুনভাবে আবিষ্কার করে আপন ভাষার সাথে নিজের সম্পর্ক;- বুঝতে পারে তার ভাষা শুধু তার কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত নিষ্প্রাণ ধ্বনিপুঞ্জ নয়; তা তার অস্তিত্বের একটি অত্যন্ত বড়ো অংশ। সে জন্মসূত্রে পাওয়া ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করে, ভাষাও নিয়ন্ত্রণ করে তাকে, ভাষা কখনো তাকে স্বাধীনতার স্বাদ দেয় কখনো পরাধীনতার, কখনো তাকে ক’রে তোলে পর্যুদস্ত কখনো দ্রোহী। এ-শতকে অনেক দেশে বিপ্লবের প্রথম রক্ত বেরোয় ভাষার শরীর থেকে; এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে রক্তাক্ত পতাকা তুলে জন্ম নেয় ভাষাপ্রদেশ ও ভাষারাষ্ট্র। বাঙলাদেশ সে-সব রক্তরাঙা দেশের একটি, যাদের উদ্ভবের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে ভাষা। আটচল্লিশ-বায়ান্নোর ভাষা-আন্দোলনেরই পরিণতি বাঙলাদেশ। পাকিস্তান নামক অপরাষ্ট্রটির জন্মলগ্নেই বাঙলা ভাষা আক্রান্ত হয়েছিলো তার শত্রুদের দ্বারা, রাস্তায় ঝ’রে পড়েছিল রক্ত; আর সে-রক্তস্রোত ধ’রে একাত্তরে উত্থান ঘটে বাঙলাদেশের। এর পর এক দশকেরও বেশি সময় কেটে গেছে, কিন্তু বাঙলা ভাষা প্রতিষ্ঠা পায় নি বাঙলাদেশে। আজো বাঙলা ভাষা নিজ বাসভূমে পরবাসী, উদ্বাস্তু— দ্বিতীয় ভাষা।
কেনো প্রতিষ্ঠা পায় নি বাঙলা ভাষা;- এমন কি বাধা আছে, যা এক দশকেও সরানো যায় নি? না কি আমরা ভুলে গেছি বাঙলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে, বা কোনো গোপন কারণে বাঙলার প্রতিষ্ঠা চাই না, যদিও সুযোগ পেলেই স্তব করি বাঙলা ভাষার, ও তার নিহত বীরদের? শত্রু কি র’য়ে গেছে আমাদের মধ্যেই, যারা সুশ্রী কৌশলে বানচাল ক’রে দিচ্ছে সর্বস্তরে বাঙলা বাস্তবায়নের সমস্ত উদ্যোগ আর আন্তরিক প্রচেষ্টা? পাকিস্তানকালে বিষয়টি স্পষ্ট ছিলো : সকলেরই জানা ছিলো যে পাকিস্তানি রাষ্ট্র-ও সেনা-পতিরা, ও তাদের সহযোগীরা বাঙালি ও বাঙলার শত্রু। তাই এক রকম নঞার্থক উৎসাহ আমাদের চালিত করতো বাঙলা প্রবর্তনে। এখন কোনো স্পষ্ট প্রকাশ্য শত্রু নেই, সবাই বাঙলা চায়- প্রকাশ্যে, তবু বাঙলা ভাষা স্বদেশ নির্বাসিত, দ্বিতীয় ভাষা, হয়ে থাকছে। এ কি কোনো সুচারু শত্রুতারই ফল?
প্রকাশ্য না হ’লেও সংগোপন শত্রু, নানা বেশে-রূপে, আছে আমাদের মধ্যেই। তাদের আমরা এতোদিন শনাক্ত করি নি, কিন্তু এখন শনাক্ত করা দরকার। সে-শত্রু আছে ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা দলরূপে; আছে সংঘ, প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক শ্রেণীরূপে, আছে আমাদের আন্তর মানসিকতারূপে। যে, ও যা, যে-কোনো উপায়ে সর্বস্তরে বাঙলা প্রতিষ্ঠায় বাধা দেয়, তাকেই শনাক্ত করতে পারি বাঙলার শত্রুরূপে। বাঙলা ভাষার সাথে শত্রুতা বৃহৎ জনমণ্ডলির সাথে বহুমুখি শত্রুতারই একটি উদাহরণ। ওই স্বাধিকারহীন জনমণ্ডলির প্রতিষ্ঠার জন্যেই দরকার বাঙলার প্রতিষ্ঠা। একুশের সপ্তাহে যদি রচিত হয় অজস্র অজর অমর কবিতা, তাতেও ততোটা উপকার হবে না, যতোটা উপকার হবে আগামী এক বছরে বাঙলাদেশের যতো নথিপত্র, পরীক্ষার খাতা, ব্যাংকের হিশেবনিকেশ, আদালতের সব কাজ, চাকুরি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র, পাঠ্যবই বাঙলায় লেখা হ’লে।
এখন পর্যবেক্ষণ করা দরকার পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আমাদের শক্তিকেন্দ্রগুলো ও শক্তিমানদের, যাদের দ্বারা প্রত্যক্ষপরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত পদেপদে পদস্খলিত এ-দেশটি; কেননা তাদের উৎসাহ উদ্যোগের ওপর নির্ভর করে বাঙলা প্রচলন। তারা বাঙলা ব্যবহারে উদ্যোগী বা বাধ্য না হ’লে কখনোই বাঙলা ভাষা প্রতিষ্ঠা পাবে না। আমাদের শক্তিকেন্দ্রগুলোতে শক্তিমানরূপে অবস্থান করেন যাঁরা, তাঁদের প্রধান বৈশিষ্ট্য জনবিচ্ছিন্নতা;— তাঁদের জীবনপদ্ধতি, মানসিকতা, ক্রিয়াকলাপ সাধারণ মানুষ ও বাঙলা ভাষার সাথে শত্রুতার পর্যায়ে পড়ে। যাঁরা বাঙলা ভাষার মিত্র, আপন দলের মানুষ, তাঁদের শক্তি শুধু লাল রক্তে, যা রাস্তায় না ঝরলে শক্তিকেন্দ্রগুলোর টনক নড়ে না। বাঙলা ভাষার সাথে আমাদের শক্তিকেন্দ্রগুলো ও তাদের শক্তিমানেরা কী-রকম শত্রুতার সম্পর্কে জড়িত, তার সূত্র উদঘাটন করা বিশেষ দরকার, এবং পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলোতে আমি তারই উদ্যোগ নেবো।