ভাষা-পরিকল্পনার সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য

ভাষা-পরিকল্পনার সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য

চার্লস এ ফার্গুসন ও আনোয়ার এস দিল (১৯৭৯) জাতীয় উন্নতি ও ভাষা ব্যবহারের সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে চৌদ্দটি গুরুত্বপূর্ণ ও অর্ন্তদৃষ্টিসম্পন্ন ‘প্রকল্প’ রচনা করেছেন। জাতীয় উন্নতিতে ভাষার ভূমিকা ও অবস্থান অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন তাঁরা নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে এবং তাঁদের সিদ্ধান্ত প্রকল্পরূপে পেশ করেছেন। রাজনীতি-সমাজনীতিকে এড়িয়ে গেছেন তাঁরা; দেশের উন্নতিতে যে-শ্রেণীসমূহ অংশ নেন, তাঁদের ব্যক্তি-ও শ্রেণী-স্বার্থ কেমনভাবে জাতীয় উন্নতির সমস্ত স্তরকে নিয়ন্ত্রণ করে, তা ফার্গুসন ও দিল বিবেচনার মধ্যে আনেন নি। কিন্তু তাঁরা যে প্রকল্পসমূহ রচনা করেছেন, তার সাহায্যে বাঙলা ভাষার অবস্থা ও অবস্থান এবং বাঙলাদেশের উন্নতি-অগ্রগতির বিপর্যস্ত অবস্থা চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। তাঁদের সবগুলো প্রকল্প এখানে প্রাসঙ্গিক নয়; কিন্তু প্রকল্প-১, ২, ৫, ৭ খুবই প্রাসঙ্গিক।

ফার্গুসন ও দিলের প্রকল্প-১ এমন : ‘উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় এক বা একাধিক উন্নয়নের ভাষার দরকার পড়ে।’ যে-কোনো কাজেই ভাষার দরকার হয়, উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় তো বটেই। জাতীয় উন্নয়নের এলাকার মধ্যে পড়ে ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তিগত বিষয়, সরকারি কাজকর্ম, শিক্ষা প্রভৃতি। অনেক দেশেই দেখা যায় উন্নয়নের কেন্দ্রে অর্থাৎ যেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সেখানে ব্যবহৃত হয় এক ভাষা, আর নিম্নস্তরে ব্যবহৃত হয় অন্য ভাষা। বাঙলাদেশে উন্নয়নের ভাষারূপে ব্যবহৃত হচ্ছে দুটি ভাষা- ইংরেজি ও বাঙলা। এর মধ্যে সিদ্ধান্ত নেয়ার ও কেন্দ্রের ভাষা প্রধানত ইংরেজি, আর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অর্থাৎ নিম্ন পর্যায়ের ভাষা বাঙলা (সাধু, চলতি, আঞ্চলিক ইত্যাদি)। এ-প্রক্রিয়ায় বাঙলাদেশে দেখা যায় যে ইংরেজি শক্তির ভাষা, বাঙলা আদেশপালনের ভাষা। সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার, আদেশ প্রদানের অধিকার মানুষকে শ্রদ্ধেয় সম্মানিত করে, আর এই শ্রদ্ধেয় সম্মানিত মানুষ যে-ভাষা ব্যবহার করেন, সে-ভাষাও অর্জন করে শ্রদ্ধা সম্মান। বাঙলাদেশের উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় ইংরেজি মার্যাদার ভাষা, তাই নিম্নতম শ্রমিকও দু-চারটি ইংরেজি শব্দ উচ্চারণের চেষ্টা করে, কিন্তু বাঙলা যেহেতু শ্রদ্ধেয় ভাষা নয়, তাই তার শুদ্ধরূপ ব্যবহারে কেউ যত্ন নেয় না- সাধু-চলতি-আঞ্চলিক-ইংরেজির মিশ্রণ ঘটিয়ে কাজ চালানো হয়।

ফার্গুসন ও দিলের প্রকল্প-২ এমন : ‘উন্নয়নপ্রক্রিয়ার প্রবণতা হচ্ছে উন্নয়নের ভাষারূপে মাত্র একটি ভাষার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা।’ উন্নয়ন কাজে একাধিক ভাষার ব্যবহার নানারকম বিঘ্ন ঘটায়, তাই কোনো দেশ যখন উন্নতির দিকে অগ্রসর হ’তে থাকে, তখন ক্রমশ মাত্র একটি ভাষাই উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হ’তে শুরু করে এবং একসময় প্রাধান্য পায়। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় একাধিক ভাষার ব্যবহার উন্নয়নের গতি রোধ করে, এক ভাষার ব্যবহার উন্নয়নে বেগ সঞ্চার করে। বাঙলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় ইংরেজি ও বাঙলা উভয়ই ব্যবহৃত হয়, তবে কোনোটিই প্রাধান্য অর্জন করতে পারে নি। সিদ্ধান্তগ্রহণকারীদের একটি বড়ো অংশ ইংরেজিকে প্রাধান্য দিতে চান, কিন্তু রাজনীতিক কারণে রাষ্ট্রচালকেরা বাঙলা ভাষার প্রাধান্য মেনে নিতে বাধ্য হন; তাই বাঙলাদেশের উন্নয়নপ্রক্রিয়া ভাষাদ্বন্দ্বে ব্যাহত হচ্ছে। এতে উন্নয়ন ও ভাষা দুয়েরই ক্ষতি হচ্ছে : উন্নয়নপ্রক্রিয়ার পথেপথে দেখা দিচ্ছে ব্যৰ্থতা, বাঙলা ভাষারও কোনো উন্নতি হচ্ছে না। যদি শুধু বাঙলাকেই উন্নয়নের ভাষারূপে ব্যবহার করা হতো, তবে বাঙলা ভাষা দ্রুত মানরূপ পেতো— নতুন নতুন শব্দ গঠিত হতো, পারিভাষিক শব্দের উদ্ভব ঘটতো, বানান সুশৃঙ্খল হতো, বাক্যসংগঠন শৃঙ্খলা অর্জন করতো। এর বদলে এখন দেখতে পাই ইংরেজি-বাঙলার সংঘর্ষ ও উন্নয়নপ্রক্রিয়ার সর্বস্তরে বিশৃঙ্খলা ও ব্যর্থতা।

ফার্গুসন ও দিলের প্রকল্প-৫ এমন : ‘যে ভাষা প্রযুক্তি-প্রকৌশলগত উদ্ভাবন ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত প্রণয়নের প্রধান বাহনরূপে ব্যবহৃত হয়, সে-ভাষাই উন্নয়নের প্রধান ভাষার স্থান অধিকার করে।’ এ-প্রকল্পটির তাৎপর্য হচ্ছে যদি প্রযুক্তিতে/ব্যবস্থাপনায় একটি বিশেষ ভাষা ব্যবহৃত হয়, এবং দৈনন্দিন জীবনে অন্য ভাষা ব্যবহৃত হয়, তবে প্রযুক্তি/ব্যবস্থাপনার ভাষা উন্নয়নের সমস্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে, ও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হ’তে থাকে। বাঙলাদেশে প্রযুক্তি-ব্যবস্থাপনার ভাষা ইংরেজি, বাঙলা দৈনন্দিন জীবনের ভাষা। উন্নয়নের সমস্ত পর্যায়েই ইংরেজির বিস্তার ঘটছে বাঙলাদেশে, ব্যাপকভাবে ব্যবহৃতও হচ্ছে, যদিও কখনোকখনো তা বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। ইংরেজিকে রোধ করতে হ’লে আমাদের প্রযুক্তিবিদ ও ব্যবস্থাপকদের মধ্যে বাঙলার প্রচলন ঘটাতে হবে। যেমন হাঙ্গেরিতে ঊনিশ ও বিশশতকে প্রতিরোধ করা হয়েছিলো জর্মান ভাষাকে- হাঙ্গেরীয় জনগণের দেশাত্মবোধ ও আপন ভাষা-সচেতনতা দিয়ে জার্মান ভাষাকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ করা যায় নি। তখনি জর্মান ভাষাকে হটানো সম্ভব হয়, যখন হাঙ্গেরীয় প্রযুক্তিবিদ ও ব্যবস্থাপকেরা একান্তভাবেই হাঙ্গেরীয়ভাষী হয়ে ওঠেন। বাঙলাদেশে প্রযুক্তি- ব্যবস্থাপনা শিক্ষার ভাষা ইংরেজি, তাই প্রযুক্তিবিদেরা-ব্যবস্থাপকেরা কার্যক্ষেত্রেও ইংরেজি প্রয়োগ করেন। দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ, রাজনীতিক চাপ তাঁদের অনেক সময় বাঙলা প্রয়োগে বাধ্য করে; কিন্তু ইংরেজি ভাষা ব্যবহারেই তাঁদের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষিত হয় ব’লে ইংরেজি ব্যবহারেই তাঁরা বেশি উৎসাহ বোধ করেন।

ফার্গুসন ও দিলের প্রকল্প-৭ এমন : ‘উন্নয়নকেন্দ্রের প্রধান ভাষা জাতীয় যোগাযোগের প্রধান অফিসীয় ভাষার স্থান লাভ করে।’ বাঙলাদেশের রাষ্ট্রভাষা যদিও বাঙলা, তবুও উন্নয়নকেন্দ্রের (মন্ত্রী, সচিব, প্রযুক্তিবিদ, ব্যবস্থাপক প্রভৃতির) প্রধান ভাষা ইংরেজি। তাই অফিসীয় যোগযোগের ভাষাও ইংরেজি সরকার যদিও মাঝেমাঝে নথিপত্রে, সরকারি চিঠিতে ও সর্বত্র বাঙলা ব্যবহারের জন্যে নির্দেশ জারি করে, এবং সামান্য পরিমাণে নির্দেশ প্রতিপালিতও হয়, তবুও ইংরেজিই সরকারি যোগাযোগের ভাষারূপে ব্যবহৃত হয়। এটা শুধু বাঙলা টাইপরাইটার যন্ত্রের অভাবে নয়, এমন ঘটে শক্তিকেন্দ্রের ভাষা ইংরেজি ব’লেই। টাইপরাইটারই যদি সমস্যা হতো, তবে জাপানে ইংরেজি অথবা রোমান লিপি ব্যবহৃত হতো। জাপানি লিপি বেশ জটিল ও পরিমাণে প্রচুর ব’লে টাইপরাইটার কোনো উপকারে আসে না, সেখানে সমস্ত সরকারি-বেসরকারি যোগাযোগ হাতে লেখা চিঠির মাধ্যমে সাধিত হয়। এতে জাপানের উন্নয়ন ব্যাহত হয় নি, বরং দ্রুততর হয়েছে। বাঙাদেশে শক্তিশালীদের ও শক্তিকেন্দ্রের ভাষা যেহেতু ইংরেজি, তাই স্বাধীনতার পরে এক দশকেরও বেশি সময় কেটে গেছে, কিন্তু বাঙলা প্রতিষ্ঠিত হয় নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *