নিঃসঙ্গতার একশ বছর – ৬

কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া বত্রিশটি সশস্ত্র বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয় আর পরাজিত হয় সব কটিতেই। সতেরোজন ভিন্ন রমণীর গর্ভে জন্ম দেয় সতেরোজন পুত্রসন্তানের আর পুত্রদের মধ্যে সবচেয়ে বড়জনের পঁয়ত্রিশ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে এক রাতেই একের পর এক মেরে ফেলা হয় তাদের। পালিয়ে বাঁচে প্রাণের ওপর চৌদ্দটি হামলা, তেষট্টিটা অ্যামবুশ আর একটি ফায়ারিং স্কোয়াড থেকে। একটি ঘোড়াকে মেরে ফেলার পরিমাণ স্ট্রিকনাইন (বিষ) মিশিয়ে দেওয়া কফি পান করেও বেঁচে যায় সে। প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টের প্রদত্ত অর্ডার অব মেরিট প্রত্যাখ্যান করে এক সীমান্ত হতে অন্য সীমান্ত পর্যন্ত বৈধ কর্তৃত্ব বজায় রেখে, সরকারের চোখে সবচেয়ে বিপজ্জনক লোক হিসেবে গণ্য হয়ে বিদ্রোহী বাহিনীর সেনাপ্রধানের পদ পেলেও সে কখনো তার ছবি তোলার অনুমতি দেয় না। যুদ্ধের পরে প্রস্তাবিত আমরণ পেনশন নিতে অস্বীকার করে আর বেঁচে থাকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত মাকন্দে, নিজের কর্মশালায় সোনার ছোট ছোট মাছ বানিয়ে। যদিও সে সব সময় সম্মুখভাগে যুদ্ধ করত তবু একমাত্র যে আঘাতটা পায়, সেটা বিশ বছরের গৃহযুদ্ধের ইতি টানানো নিরলান্দিয়ার চুক্তি স্বাক্ষরের পরে, যেটা করেছিল সে নিজের হাতেই। এক পিস্তল দিয়ে নিজের বুকে গুলি করে সে আর বুলেট বেরিয়ে যায় বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যক কোনো অঙ্গের ক্ষতি না করেই। এত কিছু অর্জনের পরেও একমাত্র যা বেঁচে থাকে তা হচ্ছে, মাকন্দে তার নামে নামকরণ করা এক রাস্তা। যদিও বার্ধক্যজনিত মৃত্যুর অল্প কয়েক বছর আগে তার কথা অনুযায়ী জানা যায় যে সেই সকালে, যখন সে একুশজন ছেলে নিয়ে রওনা হয় জেনারেল ভিক্তর মেদিনার বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে, তখন সে এটুকুও প্রত্যাশা করে নি।

‘তোর হাতে রেখে গেলাম মাকন্দকে’–যাওয়ার আগে এটাই ছিল আর্কাদিওকে বলা তার সব কথা, ‘ভালো অবস্থায়ই রেখে যাচ্ছি। চেষ্টা করিস যাতে ফিরে এসে আরও ভালো অবস্থায় পাই।’

আর্কাদিও তার এই নির্দেশকে নিতান্তই নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করে। মেলকিয়াদেসের এক বইয়ের পাতায় দেখা ছবির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে শোভাবর্ধক বুনুনি ও মার্শালদের স্কন্ধভূষণ দিয়ে এক ইউনিফর্ম বানায় সে। আর নিহত ক্যাপ্টেনের সোনার ঝালরবিশিষ্ট তরবারি কোমরবন্ধনীর সঙ্গে ঝুলিয়ে কামান দুটো বসায় গাঁয়ের প্রবেশপথে। ইউনিফর্ম পরায় সাবেক ছাত্রদের আর আগুন ঝরানো ঘোষণায় খেঁপিয়ে তুলে অস্ত্রসহ নামিয়ে দেয় তাদের রাস্তায় যাতে বাইরের লোকজন বুঝতে পারে যে শহরটা দুর্ভেদ্য। ধোঁকাটা দুই রকম ফল নিয়ে আসে ওদের জন্য। কারণ দশ মাস ধরে সরকার প্লাজা আক্রমণের সাহস করে না। কিন্তু যখন করে, তখন ওদের তুলনায় এতই বড় এক বাহিনী পাঠায় যে আধঘণ্টার মধ্যে ধ্বংস করে ফেলে প্রতিরোধটা। কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকেই আদেশ করার প্রতি টান দেখা যায় আর্কাদিওর ভেতরে। মাথার মধ্যে কোনো আদেশের চিন্তা খেলে গেলে দিনে চারবার করে পড়ে শোনাত সেটা। আঠারো বছর বয়সের বেশি বয়স্ক লোকদের জন্য সামরিক বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়, সন্ধ্যা ছয়টার পর রাস্তায় জীবজন্তু ঘুরে বেড়ালে সেটাকে জনসাধারণের সম্পত্তি বলে গণ্য হবে বলে জানায় আর বৃদ্ধদের বাধ্য করে বাহুতে লাল ফিতা বাঁধতে। মৃত্যুদণ্ডের ভয় দেখিয়ে ফাদার নিকানোরকে পাদরিদের ঘর থেকে বের হতে, আর কোনো রকমের উপদেশ দেওয়া নিষিদ্ধ করে। অবৈধ করা হয় উদারপন্থীদের বিজয় উৎসব ছাড়া অন্য কোনো কারণে গির্জার ঘণ্টা বাজানোও। যাতে কারও মনে তার আদেশের গুরুত্ব নিয়ে সন্দেহ না জাগে সে ফায়ারিং স্কোয়াডের সৈন্যদের আদেশ করে প্লাজায় এক কাকতাড়ুয়া বানিয়ে ওতে গুলি করার জন্য। প্রথম দিকে কেউ ওর আদেশের তেমন গুরুত্ব দেয় না। ওরা ভাবছিল, আসলে এরা হচ্ছে স্কুলের বাচ্চা, বড়দের খেলা খেলছে। কিন্তু এক রাতে আর্কাদিও কাতরিনার দোকানে ঢোকার সময় ঢোলবাদক আনুষ্ঠানিক বাজনা বাজিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানালে খরিদ্দারদের মধ্যে হাসির রোল ওঠে, আর কর্তৃপক্ষের প্রতি অসম্মান দেখানোর অপরাধে আর্কাদিওর আদেশে গুলি করে মেরে ফেলা হয় তাকে। যারা এর প্রতিবাদ করে তাদের গোড়ালিতে বেড়ি পরিয়ে রুটি আর পানি দিয়ে স্কুলের এক কামরায় আটক করা হয়। ‘তুই এক খুনি’, উরসুলা চেঁচাত যখন নতুন কোনো বিচারের কথা তার কানে যেত, ‘যখন আউরেলিয়ানো জানতে পারবে, তখন তোকে গুলি করে মারবে আর তাতে সবার আগে আমিই খুশি হব।’ কিন্তু এসব কিছুই বৃথা যায়। আর্কাদিও অকারণেই শাসনযন্ত্রের সব ক্রুকে এমনভাবে টাইট করতে থাকে যে সে হয়ে ওঠে মাকন্দের শাসকদের মধ্যে নিষ্ঠুরতম। ‘এখন উপভোগ কর তফাতটা’—দন আপলিনার মসকতে এক সময় বলে। ‘এই হচ্ছে উদারপন্থীদের স্বর্গ।’ আর্কাদিও জানতে পারে কথাটা। পাহারাদারদের সামনেই হামলা চালায় দন আপলিনারের বাড়িতে। ধ্বংস করে সব আসবাব। মেয়েদের ধরে পেটায় আর টানাহেঁচড়া দাগ রেখে যায় দন আপলিনার মসকতের শরীরে। যখন আর্কাদিও নিজে দাঁড়িয়ে ফায়ারিং স্কোয়াডকে গুলির হুকুম দিচ্ছে, তখন লজ্জায় কাঁদতে কাঁদতে আর ক্রোধে গালাগালি করতে করতে হাতে পিচ মাখানো চাবুক নিয়ে পুরো গ্রাম পার হয়ে ব্যারাকের উঠানে ফেটে পড়ে উরসুলা। ‘গুলির হুকুম কর, দেখি তোর কত সাহস, বেজন্মা’, চিৎকার করে।

আর্কাদিওর কোনো প্রতিক্রিয়ার আগেই প্রথম চাবুক গিয়ে পড়ে ওর ওপর। ‘সাহস করে দেখ, খুনি’, চিৎকার করে, ‘আর আমাকেও মেরে ফেল্, নষ্টা মায়ের ছেলে, মেরে ফেল্ আমাকে, যাতে এমন এক দানবকে লালন করে বড় করার লজ্জায় কাঁদার চোখ না থাকে’ দয়াহীনভাবে চাবুক মেরে তাকে, অনুসরণ করে উঠানের শেষ মাথা পর্যন্ত, যেখানে আর্কাদিও গুটিয়ে যায় এক শামুকের মতো। দন আপলিনার মসকতে জ্ঞানশূন্য হয়ে আটকানো ছিল এক খুঁটির সঙ্গে, যেখানে বাঁধা ছিল ফায়ারিং স্কোয়াডের প্রশিক্ষণের সময়ে গুলি করে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলা কাকতাড়ুয়াটা। উরসুলা ওদের ওপরও রাগ ঢেলে দেবে এই ভয়ে ফায়ারিং স্কোয়াডের ছেলেগুলো উধাও হয়ে যায়। কিন্তু উরসুলা ওদের দিকে ফিরেও তাকায় না। ছেঁড়া ইউনিফর্ম, ব্যথা আর ক্রোধে গোঙানো আর্কাদিওকে রেখে দন আপলিনার মসকতের বাঁধন খুলে দেয় বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য। ব্যারাক পরিত্যাগের আগেই ব্যারাকের অন্যান্য বন্দীদেরও মুক্তি দেয় সে।

সেই সময় থেকে সে-ই ছিল, যে গ্রামটাকে চালাত। রোববারের ধর্মোপাসনা আবার প্রতিষ্ঠিত হলো, বাজুতে লাল ফিতা বাঁধার নিয়ম তুলে ফেলা হলো, আর পরিহার করা হলো খামখেয়ালিপূর্ণ আদেশগুলো। কিন্তু তার এই শক্তিমত্তা সত্ত্বেও খারাপ নিয়তির কারণে কাঁদত সব সময়ই। সে এতই নিঃসঙ্গ বোধ করত যে চেস্টনাটের সঙ্গে বাঁধা সবার ভুলে যাওয়া স্বামীর কাছে নিষ্ফল সান্নিধ্য খুঁজে বেড়াত। ‘দেখো আমাদের কী অবস্থা হয়েছে’-স্বামীকে বলে যখন জুন মাসের বৃষ্টিপাত ছাউনিটাকে ধ্বংস করার হুমকি দিচ্ছে। ‘শূন্য বাড়িটা দেখো, ছেলেমেয়েরা ছড়িয়ে পড়েছে দুনিয়াজুড়ে আর আমরা দুজন আবার একা হয়ে গেছি সেই প্রথম দিককার মতো।’ চেতনাহীন গভীরে ডুবে থাকা হোসে আর্কাদিওর কানে এই বিলাপের কিছুই পৌঁছাত না। সে তার পাগলামির প্রথম দিকে হঠাৎ উচ্চারিত লাতিন শব্দে নিত্য জরুরি প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসের কথা জানাত। সাময়িকভাবে উদ্‌ভ্রান্তিমুক্ত অবস্থায় যখন আমারান্তা খাবার নিয়ে আসত, তখন তাকে জানাত সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক মনস্তাপের কথা আর পরে সুবোধ ছেলের মতো তাকে সরষের পুলটিশ মাখাতে আর শোষণ পাম্পের সাহায্যে পরিচর্যার সুযোগ দিত। কিন্তু উরসুলা যখন তার কাছে বিলাপ করার জন্য গিয়েছে, সে তখন বাস্তবের সঙ্গে সব সংসর্গ হারিয়ে ফেলেছে। উরসুলা তাকে গোসল করাত টুলের ওপর বসিয়ে দেহের এক-একটা অংশ আলাদা করে ধোয়ার মাধ্যমে। ‘চার মাসের বেশি হলো আউরেলিয়ানো যুদ্ধে গিয়েছে। আর এখনো ওর ব্যাপারে আমরা আর কিছুই জানতে পারিনি। বলত সাবান মাখানো এক ছোবা দিয়ে পিঠ ডলতে ডলতে। ‘হোসে আর্কাদিও ফিরে এসেছে, তোর চেয়ে লম্বা এক পুরুষ হয়ে, তার সারা দেহ উলকি দিয়ে ঢাকা, কিন্তু শুধুই এসেছে বাড়ির জন্য লজ্জা বয়ে আনতে।’ তার মনে হয় খারাপ সংবাদ শুনে তার স্বামী বিষণ্ন বোধ করে। সুতরাং সে মিথ্যা বলে, ‘আমার কথা বিশ্বাস কোরো না’—আর এগুলো বলতে বলতে কোদাল দিয়ে তুলে ফেলে স্বামীর বিষ্ঠা ছাইচাপা দেয়। ‘ঈশ্বর চেয়েছেন যে হোসে আর্কাদিওর আর রেবেকার বিয়ে হোক, এখন তারা খুব সুখী –এতই অকৃত্রিমতার সঙ্গে সে এই প্রবঞ্চনাগুলো করতে থাকে যে শেষ পর্যন্ত নিজেই নিজেকে এই মিথ্যার মাধ্যমে সান্ত্বনা দিত। ‘আর্কাদিও এখন খুব নিষ্ঠাবান, আর সাহসী। তলোয়ার আর ইউনিফর্মসহ তাকে খুব সুপুরুষ দেখায়।’ এগুলো ছিল এক মৃতকে কথা বলার মতো। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তখন সব ধরনের উৎকণ্ঠার নাগালের বাইরে ছিল। কিন্তু উরসুলা অনড় থাকে আর তার সঙ্গে কথা বলেই চলে। তাকে এতই শাশ্বত, সবকিছু সম্বন্ধে এতই নিরাসক্ত মনে হতো যে উরসুলা বাঁধন খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সে এমনকি টুল থেকে নড়েও না। রোদ আর বৃষ্টি থেকে অরক্ষিত অবস্থায় বসে থাকে যেন দড়িগুলোর কোনো প্রয়োজনই ছিল না। কারণ দৃশ্যমান যেকোনো বাঁধনের থেকেও এক অমোঘ কর্তৃত্ব যেন তাকে বেঁধে দিয়েছে চেস্টনাটগাছের সঙ্গে। আগস্ট মাসের দিকে শীত চিরস্থায়ী হতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত উরসুলা ওকে এক খবর দিতে পারে, যেটাকে মনে হয় বিশ্বাস্য। ‘দেখো, সৌভাগ্য এখনো আমাদের সঙ্গে আছে’, বলে, ‘আমারান্তা আর পিয়ানোলার ইতালীয় বিয়ে করতে যাচ্ছে।’

সত্যিই উরসুলার ছত্রচ্ছায়ায় পিয়েত্র ক্রেসপি আর আমারান্তার বন্ধুত্বের গভীরত্ব বেড়েছে, আর এখন সে আর সাক্ষাতের সময় পাহারার প্রয়োজন মনে করে না। এটা ছিল গোধূলিবেলার মিলন। ইতালীয় চলে আসত বিকেলে, বাটনহোলে এক গার্ডেনিয়া নিয়ে। আর আমারাস্তা পেত্রার্কের সনেটের অনুবাদ করত। অরেগানো (একধরনের সুগন্ধিযুক্ত রান্নায় ব্যবহৃত পাতা) আর গোলাপের দমবন্ধ করা বারান্দায় বসে পিয়েত্র বই পড়ত, আর আমারান্তা উল বুনে চলত যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য এবং খারাপ খবরে বিচলিত না হয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত না মশারা বাধ্য করত বসার ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিতে। আমারান্তার সংবেদনশীলতা, তার গোপন কিন্তু বাঁধনে জড়ানোর কোমলতা প্রেমিককে ঘিরে ফেলত এক অদৃশ্য মাকড়সার জাল দিয়ে আর প্রায় আক্ষরিক অর্থেই সেই জাল পাণ্ডুর আংটিবিহীন হাত দিয়ে সরিয়ে আটটার সময় বাড়ি ত্যাগ করতে হতো ইতালীয়কে। ইতালি থেকে যেসব পোস্টকার্ড পিয়েত্র ক্রেসপি পেত, সেগুলো দিয়ে সে তৈরি করেছিল চমৎকার এক অ্যালবাম। ওগুলো ছিল নির্জন পার্কে দয়িতা যুগলের ছবি, তীরবিদ্ধ আঁকা হৃদয় আর কবুতরের ঠোঁটে ঝোলা সোনালি ফিতা। ‘আমি ফ্লোরেন্সের এই পার্কে গিয়েছি’—পোস্টকার্ডের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলত পিয়েত্র ক্রেসপি। ‘যে-কেউ হাত বাড়িয়ে দিলেই পাখিরা নেমে আসে খাবার খেতে।’ মাঝে মাঝে ভেনিসের এক জলরঙা ছবির সামনে স্মৃতিকাতরতা বদলে দিত কাদা আর পচা সামুদ্রিক মাছের গন্ধকে এক কোমল ফুলের সুবাসে। আমারান্তা দীর্ঘশ্বাস ফেলত, হাসত আর স্বপ্ন দেখত সুন্দর সব নর-নারীর, দ্বিতীয় জন্মভূমির, যেখানে সবাই শিশুর মতো কথা বলে আর স্বপ্ন দেখত প্রাচীন শহরের, যে শহরের প্রাচীন বিপুলতার মধ্যে অবশিষ্ট আছে ধ্বংসস্তূপের মাঝে শুধু কিছু বিড়াল। মহাসাগর পেরিয়ে রেবেকার তীব্র আবেগমথিত হাতের আদরে বিভ্রান্ত পিয়ে ক্রেসপি খুঁজে পায় সত্যিকার ভালোবাসা। ভালোবাসা নিয়ে আসে সমৃদ্ধিকে তার সঙ্গে করে। তার গুদামঘরের আয়তন ছিল প্রায় এক ব্লক আর সেটা যেন ছিল উদ্ভট উদ্ভাবনার গ্রীনহাউস। সেখানে ছিল ফ্লোরেন্সের ঘণ্টা ঘরের প্রতিরূপ, যেটায় প্রতি ঘণ্টায় বাজে কি-বোর্ডের ঐকতান, সরেন্টোর মিউজিক্যাল বাক্স, চায়নিজ পাউডারের বাক্স, যার ঢাকনা খুললেই পাঁচটি স্বরের বাজনা বেজে ওঠে। কল্পনা করা যায় এমন সব বাদ্যযন্ত্র, যা প্যাঁচ দিয়ে চালানো যায়। জোগাড় করা যায় এমন সব যান্ত্রিক জিনিসপত্রে ভরা ছিল সেটা। ছোট ভাই ব্রুনো ক্রেসপি বসত গুদামঘরে, কারণ গানের স্কুলটাকে দেখাশোনা করার পর সে আর সময় করে উঠতে পারত না। ওর বদৌলতেই তুর্কদের রাস্তাটা আর্কাদিওর স্বেচ্ছাচারিতা আর যুদ্ধের দূরবর্তী দুঃস্বপ্ন ভুলে গিয়ে রূপান্তরিত হয় এক চোখধাঁধানো নানা জিনিসের প্রদর্শনী আর শান্ত সুরেলা জায়গায়। উরসুলা যখন রোববারের উপাসনাকে পুনর্বার আরম্ভ করে, পিয়েত্র ক্রেসপি তখন গির্জায় দান করে জার্মানির তৈরি এক হারমোনিয়াম। গড়ে তোলে শিশুদের দিয়ে এক কোরাসের দল, আয়োজন করে এক গ্রেগরিয়ান রেপাটরি (গির্জায় ব্যবহৃত সাধারণ সুরের গান) যেটার সুর ফাদার নিকানোরের নীরস ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এনে দেয় উজ্জ্বলতা। আমারান্তা যে এক সুখী স্ত্রী হবে, এ ব্যাপারে কারোরই কোনো সন্দেহ থাকে না। আবেগকে তাড়া না দিয়ে হৃদয়ের স্বাভাবিক স্রোতে যেতে যেতে ওরা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে শুধু বিয়ের দিনটা স্থির করা বাকি থাকে। কোনো বাধারই সম্মুখীন হয় না তারা। উরসুলা গোপনে নিজেকে দোষী ভাবত বারবার রেবেকার বিয়ে বিলম্বিত করে ওর নিয়তিকে বিগড়ে দেওয়ার জন্য। আর তাই নিজের অনুশোচনাকে সে আর বাড়াতে চায় না। যুদ্ধের নিগ্রহ, আউরেলিয়ানোর অনুপস্থিতি, আর্কাদিওর বর্বরতা, হোসে আর্কাদিও আর রেবেকার বিতাড়ন এ সবই রেমেদিওসের মৃত্যুশোককে এক গৌণ অবস্থানে সরিয়ে দেয়। বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসার সম্ভাবনায় পিয়েত্র ক্রেসপি নিজেই আভাস দেয় যে আউরেলিয়ানো হোসেকে, যার প্রতি তার পিতৃসুলভ ভালোবাসা জন্মেছে, তাকে নিজের বড় সন্তানরূপে গণ্য করবে। সবকিছুই আমারান্তার জীবনে এক বাধাহীন সুখের নির্দেশনা দেয়। রেবেকার চেয়ে আমারান্তা হচ্ছে একেবারেই উল্টো। সে বিয়ের ব্যাপারে কোনো উৎকণ্ঠাই দেখায় না। যে রকম ধৈর্যসহকারে সে টেবিল ক্লথে রং ছাপাত, করত লেসের কাজ বা এমব্রয়ডারি করত ময়ূরের, ঠিক একই ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করে সেই মুহূর্তের জন্য যখন পিয়েত্র ক্রেসপি তার হৃদয়ের তীব্র আবেগ আর সহ্য করতে পারবে না। সেই মুহূর্ত এল অক্টোবরের কুলক্ষুনে বৃষ্টির সঙ্গে। পিয়ে ক্রেসপি কোল থেকে সেলাইয়ের ঝুড়িটা সরিয়ে দিয়ে আমারাত্তার হাত নিজের হাতে নিয়ে চাপ দেয়। ‘এই অপেক্ষা আর সহ্য করতে পারছি না’, ওকে বলে, ‘আমরা আসছে মাসেই বিয়ে করছি’—আমারান্তা ওর বরফ শীতল হাতের স্পর্শে কেঁপে ওঠে না। এক পলায়নপর জন্তুর মতো হাতটা সরিয়ে নেয় আর আবার যা করছিল তা আরম্ভ করে। ‘ছেলেমানুষি কোরো না ক্রেসপি’, হাসে সে, ‘মরে গেলেও আমি তোমাকে বিয়ে করছি না।’

পিয়েত্র ক্রেসপি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। কাঁদে লজ্জাহীনভাবে, আঙুলগুলোকে প্রায় ভেঙে ফেলে হতাশায়, কিন্তু তার সিদ্ধান্তে ভাঙন ধরাতে পারে না। ‘সময় নষ্ট কোরো না’—এটাই ছিল আমারান্তার বলা সব কথা, ‘সত্যিই যদি আমাকে এতই ভালোবাসো, তাহলে এ বাড়িতে আর পা ফেলো না।’ উরসুলার মনে হচ্ছিল লজ্জায় সে মরে যাবে। পিয়েত্র ক্রেসপি মিনতির ঝুড়ি খালি করে ফেলে। অপমানিতের চরম পর্যায়ে পৌঁছায় সে পরে যার কোলে মাথা রেখে সারা বিকেল কেঁদে কাটায়, সে হচ্ছে উরসুলা। উরসুলা যদি প্রাণটা বিক্রি করে হলেও তাকে সান্ত্বনা দিতে পারত, তাহলে তা-ই করত। বৃষ্টির রাতগুলোতে তাকে দেখা যেত সিল্কের ছাতা মাথায় বাড়ির চারদিকে ঘুরতে, আমারান্তার শোবার ঘরে জ্বলে ওঠা আলোয় আশ্চর্য হওয়ার অপেক্ষায়। তখনকার মতো এত সুন্দর পোশাক সে কখনোই পরে নি। ওর রাজসিক সম্রাটের মাথা, যন্ত্রণার ভারে অর্জন করে এক নতুন ধরনের মহিমা। বিরক্ত করে আমারান্তা বান্ধবীদের, যারা আমারাস্তার সঙ্গে এমব্রয়ডারি করত তাদের, যাতে তারা ওকে রাজি করানোর চেষ্টা করে। ব্যবসায় মনে দেয় না, সারা দিন কাটিয়ে দিত দোকানের পেছনে বসে, প্রলাপে ভরা চিরকুট লিখে আমারান্তার কাছে পাঠিয়ে দিত শুকনো ফুলের পাপড়ি আর প্রজাপতির পাখা ভরে, আর আমারান্তা ওগুলো ফেরত দিত না খুলেই। ঘরবন্দী হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেতার বাজাতে। এক রাতে সে গান গায়। মাকন্দ জেগে ওঠে বিস্ময়াহত হয়ে, স্বর্গীয় এই সেতারের বাজনা এই পৃথিবীর হতে পারে না আর এমন ভালোবাসার কন্ঠ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি থাকতে পারে না। তখন আমারান্তার জানালা ছাড়া গ্রামের সব জানালাতেই আলো দেখতে পায় পিয়েত্র। নভেম্বরের ২ তারিখ, মৃতদের দিন। ওর ভাই গুদামঘর খোলে, আর দেখতে পায় সবগুলো বাতি রয়েছে জ্বালানো, সবগুলো মিউজিক বাক্স রয়েছে খোলা, ঘড়িগুলো বেজে চলেছে এক অন্তহীন সময়ের জানান দিয়ে, আর সেই উন্মত্ত ঐকতানের মাঝে দোকানের পেছন দিকের ডেস্কে পিয়েত্র ক্রেসপিকে পেল ছুরি দিয়ে হাতকাটা অবস্থায়। তার দুটো হাতই বেনজিন ভরা গামলায় ডোবানো।

উরসুলা প্রস্তাব করে বাড়িতেই শোকরাত্রি পালন করার। ধর্মীয় অনুষ্ঠানপর্ব আর পবিত্র ভূমিতে লাশ দাফনের বিরোধিতা করে ফাদার নিকানোর। উরসুলা তার মুখোমুখি হয়ে মোকাবিলা করে। ‘কোনোভাবেই না আমি, না আপনি ওকে বুঝতে পারব। লোকটা ছিল এক সন্ত’, বলে উরসুলা, ‘কাজেই ওকে কবর দিচ্ছি আমরা মেলকিয়াদেসের কবরের পাশে আপনার মতের বিরুদ্ধেই’, আর সেটা করে সে গ্রামের সবার সমর্থন নিয়ে এক জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। আমারাস্তা বিছানা ত্যাগ করে না। নিজের শোবার ঘর থেকে শুনতে পায় উরসুলার আরতি, বাড়ি ভেঙে পড়া মানুষের ফিসফিসানি, ভাড়াটে শবানুগামীদের আর্তনাদ আর পরে পায়ে দলিত ফুলের মাঝে এক গভীর নীরবতা। দীর্ঘদিন ধরে সন্ধ্যাবেলায় পিয়েত্র ক্রেসপির ল্যাভেন্ডারের সুগন্ধিযুক্ত নিশ্বাস অনুভব করে সে, কিন্তু অপ্রকৃতিস্থতায় ডুবে না যাওয়ার জন্য শক্তি থাকে তার। উরসুলা বর্জন করে তাকে। সে বিকেলে রান্নাঘরে ঢুকে কয়লার আগুনে হাত ঢুকিয়ে অপেক্ষা করে যতক্ষণ পর্যন্ত না ক্রমেই প্রচণ্ড ব্যথা পেতে পেতে আর কোনো ব্যথা অনুভব করে না বরং পায় নিজের হাতের পোড়া গন্ধ, উরসুলা এমনকি সেদিনও মুখ তুলে তাকায় না ওর দিকে। সেটা ছিল ওর অনুতাপ নিরাময়ের এক নির্বোধ প্রচেষ্টা। এর পরে অনেক দিন পর্যন্ত এক হাত গামলায় ভর্তি ডিমের সাদা অংশে ডুবিয়ে বাড়িময় ঘুরে বেড়ায়। আর যখন পোড়া ক্ষত সেরে ওঠে, মনে হয় যেন ডিমের সাদা অংশ তার হৃদয়ের আলসারটাকেও সারিয়ে তুলেছে। এই দুঃখজনক ঘটনা একমাত্র যে বাহ্যিক চিহ্ন রেখে যায় তা হচ্ছে, পুড়ে যাওয়া হাতটার ওপরের কালো ব্যান্ডেজ যেটাকে সে আমৃত্যু পরে থাকবে।

আর্কাদিও দেখায় উদারতার এক দুর্লভ দৃষ্টান্ত। পিয়েত্র ক্রেসপির মৃত্যুতে সরকারি শোক দিবস ঘোষণা করে। উরসুলার কাছে এটাকে মনে হয় পথহারা মেষশাবকের ঘরে ফেরার মতো ব্যাপার। কিন্তু সে ভুল করে। আর্কাদিওকে হারিয়ে ফেলেছে যেদিন সে সামরিক পোশাক পরেছে সেদিন নয়, বরং চিরদিনই সে পথ হারানো ছিল। রেবেকাকে যেমন মানুষ করেছে ভেবেছিল তেমনই করেছে আর্কাদিওকেও, অন্য ছেলেমেয়েদের চেয়ে কম সুবিধা দিয়ে বা বৈষম্য সৃষ্টি করে নয়। কিন্তু অনিদ্রা রোগের সময়, উরসুলার পরহিতকারিতার আতিশয্যের সময়, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার বিকারের সময়, আউরেলিয়ানো যখন সবকিছুই গোপন রাখত, আর যখন রেবেকা আর আমারান্তার মধ্যে ছিল মরণপণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা, আর্কাদিও তখন ছিল এক নিঃসঙ্গ ভীত শিশু। আউরেলিয়ানো ওকে লিখতে আর পড়তে শিখিয়েছে নিজের রক্তের কেউ মনে করে নয়, বরং সে যেমনটি শেখাত অজ্ঞাত অন্য কাউকেও। ওকে জামাকাপড় উপহার দিত যাতে ভিসিতাসিওন ছোট করে দেয় যখন সেগুলোকে ফেলে দেওয়ার সময় হয়েছে। বড় সাইজের জুতো নিয়ে, তালি দেওয়া পাতলুন নিয়ে আর মেয়েদের মতো নিতম্ব নিয়ে আর্কাদিও সব সময়ই ভুগত। কারও সঙ্গেই ভালোভাবে ভাব বিনিময় করতে পারে নি সে, যেমনটি পেরেছিল ভিসিতাসিওন ও কাতরিনার সঙ্গে ওদের নিজস্ব ভাষায়। একমাত্র মেলকিয়াদেসই সত্যিকার অর্থে তার ভার নিয়ে আর্কাদিওকে তার দুর্বোধ্য লেখা শুনতে বাধ্য করত আর দাগেরোটাইপ শিল্পের ব্যাপারে জ্ঞানদান করত। কেউ ভাবতেও পারবে না মেলকিয়াদেসের মৃত্যুতে সে গোপনে কত কেঁদেছে, আর মরিয়া হয়ে ওর অকেজো কাগজপত্র পড়ে তাকে পুনর্জীবিত করার চেষ্টা করেছে। স্কুলে সবাই তার প্রতি মনোযোগ দিত, তাকে সম্মান করত। আর পরে মহিমাময় ইউনিফর্ম আর তার কঠোর আদেশগুলো তাকে এনে দেয় ক্ষমতা। আর এগুলোই তাকে তার পুরাতন তিক্ততা থেকে মুক্তি দেয়। এক রাতে কাতরিনার দোকানে এক লোক দুঃসাহস করে বলে, ‘যে পদবি তুমি ব্যবহার করছ, তার যোগ্য তুমি নও।’ সবাই যার জন্য অপেক্ষা করছিল তা হলো না। লোকটাকে গুলি করার আদেশ দেয় না আর্কাদিও। বরং সে বলে, ‘এটাই হচ্ছে সম্মানকর’, বলে, ‘যে আমি বুয়েন্দিয়া নই।’

যারা ওর জন্মের গুপ্তরহস্য জানত, তারা ভাবে যে এই উত্তরের অর্থ হচ্ছে সে ব্যাপারটা সম্বন্ধে অবগত কিন্তু আসলে সে কখনোই তা জানতে পারে নি। ওর মা পিলার তেরনেরা দাগেরোটাইপের ঘরে ওর রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল, যেটা ছিল এক অপ্রতিরোধ্য আচ্ছন্নতা। যেমনটি হয়েছিল প্রথমে হোসে আর্কাদিওর মধ্যে, আর পড়ে আউরেলিয়ানোতে। যদিও সে তার লাবণ্য আর হাসির জৌলুশ হারিয়ে ফেলেছিল, তবু আর্কাদিও খুঁজে বেড়াত আর পেয়েও যেত তার ধোঁয়ার গন্ধ। যুদ্ধের কিছুদিন আগে এক দুপুরে পিলার তেরনেরা তার ছোট ছেলেকে খুঁজতে স্কুলে আসে বরাবরের চেয়ে একটু দেরি করে। আর্কাদিও ওর জন্য অপেক্ষা করছিল সিয়েস্তার (দিবানিদ্রা) ঘরটাতে, যে ঘরটাতে পরে লোকজনের পায়ে বেড়ি পরিয়েছিল সে। যখন বাচ্চাটা উঠানে খেলছিল উৎকণ্ঠার সঙ্গে দোলবিছানায় অপেক্ষা করছিল আর্কাদিও। জানত যে পিলার তেরনেরাকে ওখান দিয়েই যেতে হবে। আসে পিলার, আর্কাদিও তার হাতের কবজি ধরে আর টেনে তুলতে চেষ্টা করে দোলবিছানায়। ‘পারব না, পারব না’ আতঙ্কের সঙ্গে বলে পিলার তেরনেরা। ‘তুই চিন্তাও করতে পারবি না, তোকে খুশি করতে পারলে আনার কত ভালো লাগত, কিন্তু ঈশ্বর সাক্ষী আমি তা পারব না। আর্কাদিও তাকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে কোমর ধরে, আর আর্কাদিওর মনে হয় পৃথিবীটা উধাও হয়ে যাচ্ছে ওর গায়ের ত্বকের স্পর্শে। ‘সতীপনা দেখাসনে’, বলে, ‘সবাই তো জানে তুই বেশ্যা।’ পিলার তেরনেরা ওর জঘন্য নিয়তির ফলে, এসে ফেলা বমি কোনোভাবে ঠেকায়। ‘বাচ্চারা জেনে যাবে’, ফিসিফিসিয়ে বলে, ‘তার চেয়ে ভালো হয় যদি আজ রাতে দরজার হুড়কোটা আলগা করে রাখিস।’

সেই রাতে জ্বরগ্রস্ত রোগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে দোলবিছানায় অপেক্ষা করে আর্কাদিও। অপেক্ষা করে নিদ্রাহীন, অন্তহীন ভোররাতের কামোদ্দীপ্ত ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনতে শুনতে, অপেক্ষা করে কাদাখোঁচা পাখিগুলোর সঙ্গে অবিশ্রান্ত প্রহর গুনতে গুনতে, আর প্রতি মুহূর্তেই আরও নিশ্চিত হয় যে তাকে ঠকানো হয়েছে। এই সময় যখন উৎকণ্ঠা পচে গিয়ে ক্রোধে রূপ নিচ্ছে, দরজাটা খুলে যায়। কয়েক মাস পর ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে আর্কাদিওর মনে পড়ে যাবে ক্লাসরুমে হারিয়ে ফেলা পদক্ষেপগুলোর কথা, বেঞ্চের সঙ্গে হোঁচট খাওয়ার কথা, আর শেষ পর্যন্ত ঘরের অন্ধকারে এবং শরীরের ঘনত্বের কথা আর এক বাতাসের চাবুকের কথা যে বাতাস পাম্প করা হয়েছে তার নয় এমন এক হৃৎপিণ্ড থেকে। হাতটা বাড়িয়ে দেয় সে আর নাগাল পায় একই আঙুলে দুটো আংটি পরা এক হাতের, যে হাতটা আরেকটু হলেই অন্ধকারে ডুবে মরতে যাচ্ছিল। অনুভব করে শিরার গঠনপ্রকৃতি, দুর্ভাগ্যভরা নাড়ির গতি, আর অনুভব করে ভেজা এক তালু যে তালুর জীবনরেখাটাকে বুড়ো আঙুলের গোড়া থেকেই কেটে দিয়েছে মৃত্যুর থাবা। তখন বুঝতে পারে এ সে নয়, যার জন্য সে অপেক্ষা করছে। কারণ এর গায়ে ধোঁয়ার গন্ধ নেই, আছে ফুলের মতো গন্ধ ভরা চুলের ক্রিমের সুবাস। এর বুক দুটো ফোলানো, আর বুকের বোঁটা দুটো পুরুষদের মতো, অন্ধের চোখের মতো ভেতর দিকে দাবানো, পাথরের মতো গোলাকার যোনির মেয়েটা থেকে বেরোচ্ছিল অনভিজ্ঞতার বিশৃঙ্খল উদ্দীপিত পেলবতা। মেয়েটা কুমারী ছিল আর তার নাম ছিল বিশ্বাসের অযোগ্য—সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ। পিলার তেরনেরা ওকে দিয়েছে সারা জীবনের সঞ্চয়ের অর্ধেকটা: পঞ্চাশ পেসো। যা সে করছে এখন, এই কাজটা করার জন্য। আর্কাদিও ওকে বহুবার দেখেছে তার বাবার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকানে সাহায্য করতে কিন্তু কখনোই ভালো করে তাকায়নি কারণ সব সময়ে অদৃশ্য থেকে উপযুক্ত সময়ে উপস্থিত হওয়ার এক বিরল গুণ ছিল ওর মধ্যে। কিন্তু সেই দিন থেকে মেয়েটা আর্কাদিওর বগলতলার লোমের মধ্যে বিড়ালের মতো গুটি পাকিয়ে রইল। পিলার তেরনেরা ওর বাবা-মাকে তার সঞ্চয়ের বাকি অর্ধেক দিয়ে দেওয়ায় তাদের মত নিয়ে মেয়েটা সিয়েস্তার সময়ে স্কুলে যেত, আরও পরে যখন সরকারি বাহিনী স্কুলটাকে তাদের প্রয়োজনে খালি করে ফেলে, তখন তারা মিলিত হতো চর্বিভরা ক্যানের বা ভুট্টার বস্তার মাঝের খালি জায়গায়, দোকানটার পেছনে। যখন আর্কাদিওকে সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃত্ব বলে ঘোষণা করা হয় ওই সময়ের দিকে তাদের এক মেয়ে জন্মায়।

আত্মীয়স্বজনের মধ্যে ব্যাপারটা জানত শুধু হোসে আর্কাদিও আর রেবেকা। আর্কাদিও ওদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রাখত আত্মীয়তার কারণে নয় বরং দুষ্কর্মে পরস্পরের যোগসাজশের কারণে। তত দিনে হোসে আর্কাদিওর ঘাড় বাঁকিয়ে দিয়েছে সংসারের জোয়াল। রেবেকার দৃঢ় চরিত্র, তার জঠরের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা, তার প্রচণ্ড উচ্চাশা, শুষে ফেলে তার স্বামীর অসাধারণ শক্তি, ফলে অলস মেয়েপাগল লোকটা পরিণত হয়েছে এক প্ৰকাণ্ড কর্মী জন্তুতে। পরিষ্কার এবং সাজানো এক বাড়ি ছিল ওদের। ভোরবেলা রেবেকা হাট করে খুলে দিত দরজা-জানালাগুলো আর গোরস্থানের কবর থেকে আসা বাতাস জানালা দিয়ে ঢুকে উঠানের দরজা দিয়ে বের হয়ে যেত। আর চুনকাম করা দেয়াল ও আসবাবগুলোকে তামাটে করে দিত মৃতদের সোরা। তার মাটির খিদে, বাবা-মায়ের হাড়ের ক্লক ক্লক শব্দ; পিয়েত্র ক্রেসপির নিষ্ক্রিয়তার সামনে তার রক্তের উন্মাদনা, এসবই ঠাঁই নিয়েছে স্মৃতির চিলেকোঠায়। যুদ্ধের আশঙ্কা দূরে রেখে সারা দিন এমব্রয়ডারি করত জানালার পাশে বসে যতক্ষণ না আলমারির সিরামিক পটগুলো কাঁপতে শুরু করত, আর সে উঠে পড়ত খাবার গরম করতে, কৃশ শিকারি কুকুরগুলো হাজির হওয়ার অনেক আগে। তারপর হাজির হতো দোনলা বন্দুক হাতে, মাঝে মাঝে কাঁধে হরিণ ঝুলিয়ে আর প্রায় সব সময়ই দড়িতে ঝোলানো খরগোশ আর বুনো হাঁসসহ লম্বা মোজা আর নাল লাগানো বুট পরা বিশালাকার মানুষটা। একবার শাসনামলের গোড়ার দিকে আর্কাদিও অসময়ে গিয়ে উপস্থিত হয় ওদের বাড়িতে। বিয়ে করে বাড়ি ত্যাগের পর আর্কাদিওর আর ওদের দেখা হয় নি। কিন্তু ওদের কাছে আর্কাদিওকে এতই আপন আর আদরের বলে মনে হয় যে তাকে ওরা একসঙ্গে খাবারের আমন্ত্রণ জানায়। যখন ওরা কফি নিয়ে বসে একমাত্র তখনই আর্কাদিও তার আগমনের কারণটা জানায়; হোসের বিরুদ্ধে এক অভিযোগ তার কাছে এসেছে—সে নিজের জমি চাষ করতে করতে বলদগুলোর সাহায্যে সোজা প্রতিবেশীর বেড়া ভেঙে সবচেয়ে ভালো জমিগুলো জবরদখল করে নিয়েছে, আর যেসব জমির ওপর তার কোনো উৎসাহ নেই, তাদের মালিকদের সম্পত্তি থেকে বিতাড়ন করে নি, তাদের ওপর এক চাঁদা ধরা হয়েছে আর প্রতি শনিবার শিকারি কুকুর আর দোনলা শটগান নিয়ে সে সেই চাঁদা আদায় করে। হোসে আর্কাদিও অস্বীকার করে না। কারণ দেখায় যে মাকন্দ পত্তনের সময়ে যেসব জমি আসলে তার পরিবারের সদস্যদের প্রাপ্য ছিল, সেগুলো অন্যদের দিয়ে দেয় বিধায় হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তখন থেকেই পাগল ছিল আর সেই কারণেই আর্কাদিওর জমিগুলোর ওপর অধিকার আছে। ওটা ছিল এক অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক কারণ আর্কাদিও সুবিচার করতে আসে নি। একটা রেজিস্ট্রি অফিস স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করে সে, যাতে আর্কাদিও দখল করা জমিগুলোর দলিল বৈধ করে নেয় আর খাজনা আদায়ের ভার অর্পণ করে স্থানীয় সরকারে ওপর। ওরা একমত হয় এ ব্যাপারে। কয়েক বছর পর যখন কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া দলিলগুলোর স্বত্ব পরীক্ষা করে দেখতে পায় যে হোসে আর্কাদিওর বাড়ির উঠান থেকে দিগন্ত পর্যন্ত সব জমি তার নামে রেজিস্ট্রি করা আর এগারো মাস ধরে আর্কাদিও শুধু খাজনার টাকাই নেয় নি, বরং গ্রামের লোকদের কাছ থেকে আর্কাদিওর মালিকানাধীন গোরস্থানে মৃতদের কবর দেওয়ার জন্য খাজনা আদায় করে আত্মসাৎও করেছে।

জনগণের দলিল-সম্পর্কিত ব্যাপারগুলো জানতে উরসুলার দেরি হয় কয়েক মাস কারণ ওর ভোগান্তি যাতে না বাড়ে, তার জন্য সবাই এসব তার থেকে লুকিয়ে রাখত। উরসুলা সন্দেহ করতে শুরু করে। স্বামীর মুখে তোতুমোর (চাল কুমড়ার আকৃতির একধরনের ফল) সিরাপ ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে কৃত্রিম অহংকারের সঙ্গে বলে, ‘আর্কাদিও একটা বাড়ি বানাচ্ছে’, কিন্তু নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে যোগ করে—’কিন্তু জানি না কেন যেন এসব কিছুর মধ্যেই বদ গন্ধ পাচ্ছি আমি।’ পরে যখন জানতে পারে যে আর্কাদিও শুধু বাড়িই শেষ করে নি, সে ভেনেসীয় আসবাবেরও অর্ডার করেছে, তখন সে সন্দেহমুক্ত হয় যে আর্কাদিও জনগণের অর্থ খরচ করেছে। ‘তুই আমাদের পদবির কলঙ্ক’, মিসার (গির্জার ধর্মোপদেশ) পরে এক রোববারে চিৎকার করে উরসুলা, যখন দেখে আর্কাদিও নতুন বাড়িতে তার অফিসারদের সঙ্গে তাস খেলছে। আর্কাদিও মনোযোগ দেয় না তার দিকে। একমাত্র তখনই উরসুলা জানতে পারে যে তাদের ছয় মাস বয়সী এক মেয়ে আছে আর সে বিয়ে ছাড়াই বাস করছে, সান্ত মারিয়া দে সোলেদাদের সঙ্গে যে নাকি আবার পোয়াতি। যেখানেই থাকুক না কেন, আউরেলিয়ানোকে চিঠি লিখে বর্তমান অবস্থার সব জানানোর সিদ্ধান্ত নেয় উরসুলা। কিন্তু দ্রুত ঘটে যাওয়া তখনকার ঘটনাগুলো শুধু তার এই পরিকল্পনায় বাদ সাধে তা-ই নয়, বরং পরে এই কথা ভাবার জন্য অনুতপ্ত হয়। যুদ্ধ নামক যে শব্দটা তখন পর্যন্ত বোঝাত একটা দূরবর্তী অবস্থার পরিস্থিতিকে আর সেটাই হয়ে উঠল এক নাটকীয় বাস্তবতা। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ঝাড়বোঝাই এক গাধার পিঠে চড়ে হাজির হয় এক পাণ্ডুর চেহারার বৃদ্ধা। তার চেহারা এতই নিরীহদর্শন ছিল যে গ্রাম পাহারার দায়িত্বশীল সেনারা জলাভূমির গ্রামগুলো থেকে আসা যেকোনো ফেরিওয়ালার একজন মনে করে কিছু জিজ্ঞেস না করেই ঢুকতে দেয় তাকে। সোজা সৈন্যশিবিরে হাজির হয় সে। আর্কাদিও তাকে অভ্যর্থনা জানায় ক্লাসরুমে যেটা এখন পরিণত হয়েছে এক সৈন্যশিবিরে। যেখানে আংটা থেকে ঝুলছে গোটানো দোলবিছানা, কোনায় মেঝেতে স্তূপ করা আছে মাদুর, রাইফেল, কারবাইন এমনকি শিকারের শটগানও। পরিচয় দেওয়ার আগে বৃদ্ধা এক সামরিক কায়দায় স্যালুট দিয়ে বলে, ‘আমি কর্নেল গ্রেগরিও স্টিভেনসন।’

খারাপ খবর নিয়ে এসেছে সে। তার কথানুযায়ী উদারপন্থীদের শেষ প্রতিরোধগুলো ধসে পড়ছে। রিওয়াচার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যুদ্ধরত পিছু হটতে থাকা কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার কাছ থেকে আর্কাদিওর সঙ্গে কথা বলার মিশন নিয়ে এসেছে সে। ‘কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই উদারপন্থীদের জানমালের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে’, এই শর্তে রক্ষণশীলদের হাতে প্লাজা ছেড়ে দিতে হবে। পলাতক দাদির মতো চেহারার বার্তাবাহককে আর্কাদিও করুণা মাখানো দৃষ্টি দিয়ে পরখ করে।

‘তুমি নিশ্চয়ই লিখিত কিছু এনেছ’, বলে।

‘অবশ্যই’, উত্তর দেয়, ‘কিছুই লিখিত আনিনি। এটা খুবই সহজবোধ্য যে এখনকার বিপজ্জনক অবস্থার কারণে কোনো প্রমাণই বহন করা সম্ভব নয়।’

কথা বলতে বলতে অন্তর্বাসের ভেতর থেকে সোনার এক ছোট মাছ বের করে টেবিলের ওপর রাখে। ‘মনে হয় এটাই প্রমাণের জন্য যথেষ্ট’, বলে। আর্কাদিও বুঝতে পারে এটা হচ্ছে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার বানানো সোনার মাছগুলোর একটা। কিন্তু কেউ একজন যুদ্ধের আগেই মাছটা কিনে থাকতে পারে অথবা চুরি করতে পারে আর সে জন্য প্রমাণ হিসেবে এটা গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করে সে। নিজের পরিচয় প্রমাণ করতে বার্তাবাহক যুদ্ধের গোপন কথা ফাঁস করার চূড়ান্তে পৌঁছায়। জানায় যে কুরাসাও থেকে সব নির্বাসিতকে রিক্রুট করে যথেষ্ট পরিমাণে অস্ত্র আর রসদ কিনে বছরের শেষ দিকে এক আক্রমণের মিশন দিয়ে যাচ্ছে সে। এই পরিকল্পনার ওপর আস্থা রেখেই কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া এখন লোকবল নষ্ট করতে চাইছে না। কিন্তু আর্কাদিও অটল থাকে। তার পরিচয়ের প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত বার্তাবাহককে বন্দী করে আর প্লাজা প্রতিরোধের আমৃত্যু সিদ্ধান্ত নেয়।

বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয় না তাকে। উদারপন্থীদের পরাজয়ের সংবাদ ক্রমেই আরও দৃঢ় হতে থাকে। মার্চের শেষের দিকে এক অকাল বৃষ্টির মধ্যে ভোরের কিছু আগে, সপ্তাহগুলোর উৎকণ্ঠায় ভরা শান্ত অবস্থাটা হঠাৎ করেই ভেঙে পড়ে এক অনাকাঙ্ক্ষিত রণনিনাদে আর তার পশ্চাদ্ধাবন করে এক কামানের গোলা, যা ভেঙে দেয় গির্জার চূড়াটা। সত্যিকার অর্থে আর্কাদিওর প্রতিরোধের ইচ্ছাটা ছিল এক পাগলামি। অপ্রতুল অস্ত্রসহ তার ছিল সাকুল্যে পঞ্চাশজন লোক, যাদের একেকজনের কাছে বিশটির বেশি কার্তুজ ছিল না। কিন্তু ওই সব প্রাক্তন ছাত্র তার উত্তেজনাকর বক্তৃতায় উত্তেজিত হয়ে এক নিশ্চিত হেরে যাওয়া লক্ষ্যের উদ্দেশ্যে প্রাণ বলি দেওয়ার সংকল্প নেয়। বুটের ঘন ঘন আওয়াজ, বৈপরীত্যে ভরা আদেশ, মাটি কাঁপানো কামানের গোলা, লক্ষ্যহীন গোলাগুলি আর উদ্দেশ্যবিহীন রণশিঙার আওয়াজের মধ্যে তথাকথিত কর্নেল স্টিভেনসন আর্কাদিওর সঙ্গে কথা বলতে সক্ষম হয়। ‘এভাবে পায়ে বেড়ি বাঁধা আর মেয়ে মানুষের কাপড় পরা অবস্থায় অপমানকর মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তি দাও’, বলে সে, ‘মরতেই যদি হয় লড়াই করে মরব।’ আর আর্কাদিওকে রাজি করাতে সক্ষম হয়। আর্কাদিও আদেশ দেয় ওকে বিশটি কার্তুজসহ একটি অস্ত্র আর পাঁচজন লোক দিতে, যাতে সে ঘাঁটিটা প্রতিরোধ করতে পারে আর যাতে আর্কাদিও চলে যেতে পারে তার নিজস্ব আদেশ প্রদানকারীর অবস্থানে, সমরভাগের সামনের শ্রেণিতে। জলাভূমির রাস্তাটা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না সে। ততক্ষণে ব্যারিকেডগুলো গুঁড়িয়ে গেছে, আর প্রতিরোধকারীরা অরক্ষিত অবস্থায় রাস্তার ওপর যুদ্ধ করছে। যতক্ষণ পর্যন্ত গুলি আছে, ততক্ষণ গুলি করে, পরে পিস্তল দিয়ে রাইফেলের বিরুদ্ধে, আর সর্বশেষে হাতাহাতি করে। এই অত্যাসন্ন পরাজয়ের মধ্যে কিছু কিছু মহিলা হাতে লাঠি আর রান্নার ছুরি নিয়ে রাস্তায় নামে। সেই বিশৃঙ্খলার মাঝে রাতপোশাক গায়ে, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার পুরোনো পিস্তল হাতে উন্মাদিনীর মতো তাকে খুঁজতে থাকা আমারান্তাকে দেখতে পায় আর্কাদিও। হাতাহাতির সময় অস্ত্র খোয়া যাওয়া এক অফিসারের হাতে নিজের রাইফেলটা ধরিয়ে দিয়ে আমারান্তাসহ ঢুকে পড়ে পার্শ্ববর্তী গলির মধ্যে, আমারান্তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য। প্রতিবেশীর বাড়ির সামনের দেয়ালে কামান দিয়ে করা গর্তের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করেই দরজায় অপেক্ষা করছিল উরসুলা। বৃষ্টি ধরে এসেছিল কিন্তু রাস্তাগুলো ছিল গলা সাবানের মতো পিচ্ছিল, ভেজা আর অন্ধকারের মাঝে দূরত্বটা আন্দাজ করে নিতে হতো। আমারান্তাকে উরসুলার কাছে রেখে কোনা থেকে গুলি চালিয়ে যাওয়া দুই সৈনিকের মোকাবিলার চেষ্টা করে আর্কাদিও। কিন্তু অনেক বছর পোশাকের আলমারিতে পড়ে থাকা প্রাচীন পিস্তল কাজ করে না। নিজের শরীর দিয়ে আর্কাদিওকে আড়াল করে তাকে বাড়িতে টানার চেষ্টা করে উরসুলা, ‘ঈশ্বরের দোহাই ভেতরে আয়, চিৎকার করে ‘পাগলামি অনেক হয়েছে।’

সৈন্যরা অস্ত্র তাক করে ওদের দিকে।

‘লোকটাকে ছেড়ে দিন সেনঞরা, এক সৈন্য চিৎকার করে, ‘নইলে কিন্তু আমরা দায়ী হব না।’

আর্কাদিও উরসুলাকে বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেকে সমর্পণ করে। কিছুক্ষণ পর গোলাগুলি থেমে যায় আর ঘণ্টা বাজতে শুরু করে। আধঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে সব প্রতিরোধ ধসে পড়ে। আর্কাদিওর লোকদের মধ্যে একজনও বেঁচে থাকতে পারে না, কিন্তু মৃত্যুর আগে নিয়ে যায় তিন শ সৈন্যকে ওদের সঙ্গে করে। শেষ প্রতিরোধটা ছিল সেনাছাউনি। আক্রান্ত হওয়ার আগে তথাকথিত কর্নেল গ্রেগরীয় স্টিভেনসন বন্দীদের মুক্ত করে আদেশ দেয় রাস্তায় বেরিয়ে যুদ্ধ করতে। অসাধারণ গতি আর বিভিন্ন জানালা দিয়ে ছোড়া বিশটা কার্তুজের নিখুঁত টিপের জন্য মনে হচ্ছিল সেনাছাউনিটা খুব ভালোভাবে সুরক্ষিত আর ফলে আক্রমণকারীরা পুড়িয়ে দেয় সেটা কামানের গোলা ছুড়ে। যে ক্যাপ্টেন দায়িত্বে ছিল, সে ধ্বংসস্তূপটার মধ্যে জাঙ্গিয়া পরা বাহু থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া এক হাতে গুলিহীন রাইফেল ধরা, মৃত মাত্র একজন লোক দেখে অবাক হয়ে যায়। তার মাথায় ছিল খোঁপা করে বাঁধা, চিরুনি গোঁজা মেয়েদের চুল, আর গলায় ছিল সোনার ছোট মাছের একটা হার। মুখ দেখার জন্য বুটের ডগা দিয়ে শরীরটা ওল্টাতে ক্যাপ্টেন চলৎ-শক্তিহীন হয়ে পরে। ‘খাইছে’—অবাক কণ্ঠে বলে, অন্য অফিসাররা এগিয়ে আসে দেখতে। ‘দেখো কোথায় উদয় হতে এসেছে লোকটা’, ক্যাপ্টেন ওদের বলে, ‘এ হচ্ছে গ্রেগরীয় স্টিভেনসন।’

ভোরবেলা, এক সংক্ষিপ্ত কোর্ট মার্শালের পর সমাধিস্থলের দেয়ালে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয় আর্কাদিওকে। জীবনের শেষ দুই ঘণ্টায় সে বুঝতে পারে না কী করে শৈশব থেকে জ্বালিয়ে মারা ভয়টা যেন উধাও হয়ে গেছে। বোধশূন্য, এমনকি তার সাম্প্রতিক সাহসিকতার জন্য উদ্বেগহীনভাবে সে শুনে তার প্রতি আনীত অশেষ অভিযোগগুলো। সে ভাবছিল উরসুলার কথা, এই সময়ে চেস্টনাটের নিচে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার সঙ্গে তার চা খাওয়ার কথা। ভাবছিল তার আট মাসের ছোট মেয়েটার কথা, যার এখনো নাম নেই, আর সেই সন্তানটার কথা যে আগস্ট মাসে জন্মাবে। ভাবছিল সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদের কথা, যাকে গত রাতে দেখেছিল শনিবার দুপুরে খাওয়ার জন্য হরিণের মাংসে লবণ মাখাতে। যার হাঁটু পর্যন্ত নেমে আসা চুলগুলো আর মেকি মনে হওয়া চোখের পাপড়িগুলোর জন্য শূন্যতা বোধ করবে সে। ভাবছিল আবেগহীনভাবে জীবনের নির্মম হিসেব-নিকেশের সময় তার লোকজনদের কথা, আর বুঝতে শুরু করে-যাদের সে ঘৃণা করে ভেবেছিল, বাস্তবে কি ভালোই না বাসে তাদের। দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেছে, সেটা আর্কাদিওর বুঝে ওঠার আগেই কোর্ট মার্শালের বিচারকর্তা তার চরম বক্তৃতা আরম্ভ করে। ‘যদিও প্রমাণিত অভিযোগগুলো তার মৃত্যুদণ্ডের জন্য যথেষ্ট নয়’, বলে চলে বিচারকর্তা, তার পরও যে দায়িত্বজ্ঞানহীন ও অপরাধজনকভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তি, তার অধস্তনদের ঠেলে দিয়েছে এক অর্থহীন মৃত্যুর দিকে, তাতে মৃত্যুদণ্ডই তার যথার্থ পাওনা।’ যেখানে প্রথমবারের মতো শ্রম, অকারণে পাওয়া নিরাপত্তার স্বাদ আর যেখানে প্রথমবারের মতো ভালোবাসার অনিশ্চয়তার আস্বাদ পায় সে, সেই স্কুলের কয়েক মিটার দূরে তার মৃত্যুর এই আনুষ্ঠানিকতা আর্কাদিওর কাছে ছিল হাস্যকর। সত্যিকার অর্থে মৃত্যু তার কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল না। গুরুত্বপূর্ণ ছিল জীবন। ফলে যখন তার শাস্তি উচ্চারণ করা হয়, তখন তার ভয়ের অনুভূতি ছিল না, ছিল স্মৃতিকাতরতার। শেষ ইচ্ছার কথা জিজ্ঞেস না করা পর্যন্ত কোনো কথা বলে না সে।

‘আমার স্ত্রীকে বলো’, গম্ভীর গলায় বলে, ‘মেয়ের নাম যেন উরসুলা রাখে’, একটু বিরতি টেনে নিশ্চিত করে; ‘উরসুলা, দাদির মতন এবং বলো যার জন্ম হতে যাচ্ছে সে যদি ছেলে হয়, তার নাম যেন রাখে হোসে আর্কাদিও, কিন্তু কাকার জন্য নয় বরং দাদার জন্য।’

দেয়ালের গায়ে ওকে দাঁড় করানোর আগে ফাদার নিকানোর সাহায্য করার চেষ্টা করে। অনুতাপ করার মতো কিছুই নেই আমার’, বলে আর্কাদিও আর এক কাপ কালো কফি পানের পরে নিজেকে ফায়ারিং স্কোয়াডের কাছে সমর্পণ করে। ফায়ারিং স্কোয়াডের নেতা যে সংক্ষিপ্ত বিচারে মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে ছিল দক্ষ তার নামটা ছিল কাকতালীয়র চেয়েও বেশি: ক্যাপ্টেন রোকে কার্নিসেরো (স্প্যানিশে কার্নিসেরো শব্দের অর্থ হচ্ছে কসাই)। গোরস্থানের পথে একটানা গুঁড়ি বৃষ্টির ভেতর দিয়ে আর্কাদিও দেখতে পেল দিগন্তরেখায় এক উজ্জ্বল বুধবারের ভোরের আগমন। কুয়াশার সঙ্গে সঙ্গে বিদায় নেয় ওর স্মৃতিকারতাও, আর রেখে যায় তার বদলে প্রবল কৌতূহল। শুধু ওরা যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াতে বলে, তখনই দেখতে পায় ভেজা চুলে রেবেকাকে, গোলাপি রঙের ফুল ছাপানো জামা পরে বাড়ির দরজা-জানালা খুলছে হাট করে। সে চেষ্টা করে যাতে রেবেকা তাকে চিনতে পারে। তখন কোনো কারণ ছাড়াই রেবেকা দেয়ালের দিকে তাকায়, আর বিস্ময়ে নিশ্চল হয়ে কোনোরকমে হাত নেড়ে বিদায় জানায় আর্কাদিওকে। একইভাবে আর্কাদিও-ও বিদায় জানায় ওকে। সেই সময়ে ধোঁয়া ওঠা রাইফেলগুলো তাক করা হয় ওর দিকে, আর সে শুনতে পায় অক্ষরে অক্ষরে মেলকিয়াদেসের সুর করে পড়া ধর্মীয় চিঠি, অনুভব করে ক্লাসঘরে কুমারী সান্তা সোফিয়া দেলা পিয়েদাদের পথ হারানো পদক্ষেপ, অনুভব করে ওর নিজের নাকে একই কাঠিন্য, যে রকম কাঠিন্য তার মনোযোগ কেড়েছিল মৃত রেমেদিওসের নাকের ফুটোয়। ‘আহ, কী বোকা’, ভাবার সময় পেল, ‘ভুলেই গেছি বলতে যে যদি মেয়ে হয়, তাহলে যেন ওর নাম রাখা হয় রেমেদিওস।’ সেই সময়ে জড়ো হওয়া আর জীবনব্যাপী জ্বালিয়ে মারা প্রচণ্ড আতঙ্কের থাবা ফিরে আসে ওর কাছে। ক্যাপ্টেন গুলির আদেশ দেয়। আর্কাদিও কোনো রকমে সময় পায় বুক ফুলিয়ে, মাথা উঁচু করার। সে বুঝতেই পারে না কোত্থেকে আসে গরম তরল পদার্থ, যাতে জ্বলে যাচ্ছে তার ঊরু। ‘হারামজাদারা’, চিৎকার করে, ‘উদারপন্থী দল, জিন্দাবাদ!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *