নিঃসঙ্গতার একশ বছর – ২০

২০

পিলার তেরনেরা মারা যায় বেতের দোলচেয়ারে এক উৎসবের রাতে স্বর্গের দরজা পাহারা দেওয়ার সময়। তার শেষ ইচ্ছানুয়ায়ী কফিনে নয়, দোলচেয়ারে বসা অবস্থায় নাচের জায়গার কেন্দ্রে বিশাল এক গর্ত খুঁড়ে আটজন লোক দড়ি ধরে নামিয়ে দেয় সেটা। কালো পোশাক পরিহিত কাঁদতে কাঁদতে পাংশু হয়ে পরা মুলাতা মেয়েরা ইস্টারের সময়ের জপমালা জপতে জপতে খুলে, নাম বা তারিখবিহীন ফলক বসিয়ে গর্তটাকে বন্ধ করার আগে কানের দুল ব্রোচ ও আংটি খুলে গর্তে ছুড়ে ফেলে আর পরে সেটা ঢেকে দেয় আমাজনীয় ক্যামেলিয়া ফুলের স্তূপ দিয়ে। পরে জীবজন্তুগুলোকে বিষ খাইয়ে মেরে দরজা- জানালাগুলো ইট আর চুন-সুড়কি দিয়ে বন্ধ করে। ভেতর দিকে সাধুসন্তদের ছাপ মারা কাঠের তোরঙ্গে বিভিন্ন সাময়িকী থেকে দেওয়া ছবি, অনেক দূরের উদ্ভট পুরোনো দয়িতদের ছবি দিয়ে ভরে ছড়িয়ে পরে পৃথিবীজুড়ে আর সেসব দয়িতার কারোর মলের সঙ্গে হিরে বের হয়, কেউ কেউ ছিল মানুখেকো বা কেউ ছিল গভীর সমুদ্রের তাসের মুকুট পরা রাজা।

ওটাই ছিল সর্বশেষ। পিলার তেরনেরার গোরের মধ্যে বারোয়ারি মেয়েদের প্রার্থনাসংগীত ও সস্তা অলংকারের মধ্যে পচতে থাকবে অতীতের সব ধ্বংসাবশেষ, যেগুলো অবশিষ্ট ছিল বিজ্ঞ কাতালিয়নোর এক দীর্ঘস্থায়ী বসন্তের স্মৃতিকাতরতার কাছে পরাজিত হয়ে নিলামে বইয়ের দোকান বিক্রি করে ভূমধ্যসাগরীয় জন্মস্থানে ফিরে যাওয়ার পর কেউই ওর এই সিদ্ধান্তের কথা অনুমান করতে পারে নি।

সে মাকন্দে এসেছিল কলা কোম্পানির জৌলুশের সময়ে অসংখ্য যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আর ইনকিউনিবুলা (১৫০০ শতকের পূর্বে লেখা বই) ও বিভিন্ন ভাষার বইয়ের প্রথম সংস্করণ দিয়ে একটা বইয়ের দোকান দেওয়ার চেয়ে ভালো কোনো বুদ্ধি তার মাথায় আসে নি, যেখানে তার পরিকল্পনা ছিল সামনের দোকানে লাইনে দাঁড়িয়ে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শোনার ফাঁকে ফাঁকে সাময়িক খদ্দেররা দোকানে এসে বইয়ের পাতায় চোখ বুলোবে, যেন ওগুলো কোনো মামুলি বই। অর্ধেক জীবন সে কাটিয়ে দেয় সেই ভ্যাপসা গরম দোকানের পেছনটায় স্কুলের খাতা থেকে ছিঁড়ে নেওয়া পাতায় বেগুনি কালি দিয়ে লেখা হিজিবিজি লিখে, আর কেউ জানত না সে কী লিখছে। যখন আউরেলিয়ানোর সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে, তখন বহুবর্ণের সেই পাতায় ভর্তি ছিল দুটি বাক্স, যা নাকি তাকে মনে করিয়ে দিত মেলকিয়াদেসের পার্চমেন্টের কথা আর সেই সময় থেকে মাকন্দ ত্যাগ করা পর্যন্ত ভরে ফেলেছিল আর একটি বাক্স, ফলে মনে হতো মাকন্দে থাকাকালীন সে লেখা ছাড়া আর কিছু করে নি। ওর সঙ্গে একমাত্র যাদের সম্পর্ক তৈরি হয়, তারা ছিল সেই চার বন্ধু, যাদের লাটিম ও ঘুড়ির বদলে বই দিত আর যাদের প্রাইমারি স্কুল পার হওয়ার আগেই পড়তে দিয়েছিল সেনেক ও ওভিদ। ক্ল্যাসিক লেখকদের ব্যাপারে সে এমনভাবে কথা বলত যেন তাদের সঙ্গে তার পরিচিতি হচ্ছে বাড়ির লোকজনের মতো আর এত সব কিছু জানত, যা তার জানার কথা ছিল না, যেমন অভ্যেসবশত সেন্ট আগুস্তিন এক পশমের জামা পরতেন, যেটা উনি চৌদ্দ বছর খোলেন নি। এক বৃশ্চিকের কামড় খেয়ে আরনালদো দে ভিলানোভা নামক জাদুকর ছোটবেলা থেকেই নপুংসক হয়ে গিয়েছিল, লিখিত শব্দের প্রতি তার আকুলতা ছিল বিকারগ্রস্ত সমীহ ও শ্রদ্ধাহীন চটুলতার মিশ্রণ। এই দ্বৈত অবস্থা থেকে এমনকি তার নিজের পাণ্ডুলিপিও রেহাই পায় নি। আলফনস একবার ওগুলো অনুবাদ করার জন্য কাতালিয়নো শিখে এক রোল কাগজ নিজের পকেটে ঢোকায়। যার পকেটে সাধারণত থাকত শুধুই খবরের কাগজের কাটা অংশ ও অদ্ভুত সব নির্দেশিকা, তার কাছ থেকে এক রাতে সেগুলো হারিয়ে যায় ক্ষুধার জন্য বিছানায় যাওয়া মেয়েদের বাড়িতে। সেই বৃদ্ধ জ্ঞানী যখন তা জানতে পারে, চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় করার বদলে হেসে গড়াগড়ি যেতে যেতে মন্তব্য করে যে সাহিত্যের এটাই হচ্ছে স্বাভাবিক পরিণতি। অন্যদিকে নিজ গ্রামে ফিরে যাওয়ার সময় যখন বাক্স তিনটি সঙ্গে নেওয়ার জন্য গোঁ ধরে, তখন তাকে নিবৃত্ত করার সাধ্য কোনো মানুষের ছিল না আর রেলের ইন্সপেক্টর ওগুলোকে মাল হিসেবে পাঠানোর চেষ্টা করলে যতক্ষণ না তার সঙ্গে যাত্রী কামরায় সেগুলো নেওয়ার অনুমতি না দেওয়া হয়, ততক্ষণ সে তাদের বিরুদ্ধে অপমানকর প্রাচীন কারতাজিনিয়ান শব্দ ছুড়তে থাকে। ‘সারা পৃথিবী পাছামারা খেয়ে ধ্বংস হবে’, বলে তখন, ‘যেদিন মানুষ ভ্রমণ করবে প্রথম শ্রেণিতে আর সাহিত্য তৃতীয় শ্রেণিতে।’ ওটাই ছিল ওর কাছ থেকে শোনা শেষ কথা। বিশ্রী এক হপ্তা পার হয়ে যায় যাত্রার সম্পূর্ণ প্রস্তুতিতে। কারণ সময় যত ঘনিয়ে আসছিল, তার মেজাজ ততই ভেঙে পড়ছিল, আর ফের্নান্দার বামন ভূতগুলোর জ্বালায় পড়ে সে জিনিসপত্র রাখছিল এক জায়গায় আর সেগুলো উদয় হচ্ছিল অন্য জায়গায়।

‘চুতিয়া’, খিস্তি করত, ‘লন্ডনের ২৭ নম্বর অনুশাসনের ওপর আমি হাগি।’

হেরমান ও আউরেলিয়ানো ওর ভার নেয়। ওকে সাহায্য করে এক বাচ্চা ছেলের মতো। ওর টিকিট ও ইমিগ্রেশন কাগজপত্র পকেটগুলোতে ভরে দুধমার মতো মমতা নিয়ে, সেগুলোকে সেফটিপিন দিয়ে আটকে দেয়। মাকন্দ থেকে বের হয়ে বার্সেলোনা পর্যন্ত গিয়ে ট্রেন থেকে নামা পর্যন্ত করণীয় কাজগুলোর বিস্তারিত ফর্দ করে, কিন্তু তার পরও বেখেয়ালে অর্ধেক টাকাপয়সা রাখা এক পাতলুন সে ফেলে দেয়ে আবর্জনায়। যাত্রার আগের রাতে যে তোরঙ্গ নিয়ে মাকন্দে এসেছিল, সেই একই তোরঙ্গে কাপড়চোপড় ভরে ও বাক্সগুলোতে পেরেক মারা শেষ করে ঝিনুকের খোলসের মতো পাপড়িওলা চোখ কুচকে একধরনের উদ্ধত ঔদার্য নিয়ে যে বইগুলো ওর নির্বাসন কাটানোতে সাহায্য করেছে, সেই বইয়ের স্তূপ উদ্দেশ্য করে বন্ধুদের বলে:

‘ওখানেই রেখে যাচ্ছি সব বিষ্ঠা। ‘

তিন মাস পর ওরা বড়সড় এক খামে উনত্রিশটি চিঠি ও পঞ্চাশটির বেশি ছবি পায়, যেগুলো গভীর সমুদ্রে কর্মহীন সময়ে জমা হয়েছিল কাতালিয়নোর কাছে। যদিও সে কোনো দিন-তারিখের উল্লেখ করত না, তবু ক্রমানুবর্তিতা স্পষ্ট ছিল চিঠিগুলোতে। গোড়ার দিকে তার সহজাত দুষ্টুমি নিয়ে বর্ণনা করেছে সমুদ্রযাত্রার বিভিন্ন ঘটনা, বাক্স তিনটে তার সঙ্গে কেবিনে ঢোকাতে না দেওয়ার জন্য জাহাজের হোস্টেসকে রেলিং টপকে পানিতে ফেলে দেওয়ার ইচ্ছার কথা, কুসংস্কারবশত নয়, বরং ১৩ সংখ্যাটার সমাপ্তি নেই এই বিশ্বাসের এক মহিলার মূর্খতার কথা, প্রথম রাতের খাবার টেবিলের পানিতে লেরিদার ঝরনায় জন্মানো বিটের স্বাদ শনাক্ত করে বাজিতে জেতার কথা। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য জাহাজের বাস্তবতার গুরুত্ব কমে যেতে থাকে তার কাছে, এমনকি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোও হয়ে ওঠে স্মৃতিকাতরতার যোগ্য, কারণ জাহাজ যতই দূরে সরে যেতে থাকে, ততই তার স্মৃতি হয়ে উঠছিল বিষণ্ণ। স্মৃতিকাতরতার ক্রমবর্ধনশীলতার এই প্রক্রিয়াটা তার ছবির মধ্যেও স্পষ্ট। প্রথম দিককার ফটোগুলোতে পপলিনের শার্ট গায়ের তার তুষারশুভ্র চুলসহ অক্টোবরের ফেনিল ক্যারিবীয় সাগরের সামনে তার ছিল এক সুখী চেহারা। শেষ দিকেরগুলোতে গায়ে ছিল কালো জ্যাকেট, গলায় সিল্কের মাফলার আর হেমন্তের সাগরে নিশাচরের মতো এগিয়ে চলা এক শোকার্ত জাহাজের ডেকে পা না দেওয়ার কারণে পাণ্ডুর চেহারায় ছিল এক মৌনতা। হেরমান ও আউরেলিয়ানো উত্তর দিত চিঠিগুলোর। প্রথম দিকে এত চিঠি লিখত যে ওকে মাকন্দে যখন ছিল, তার চেয়েও কাছের বলে মনে হতো আর চলে যাওয়ার সময়ে তার যে রাগ ছিল, তার কোনো চিহ্নই পাওয়া যেত না আর প্রথম দিকে বলত যে সবই আগের মতোই আছে, যে বাড়িতে জন্ম নিয়েছিল, তখনো ওখানে গোলাপি শামুক ছিল, হেরিং মাছের স্বাদ ঝলসানো রুটির সঙ্গে আগের মতোই লাগে, সাঁঝের বেলা আগের মতোই সুবাস ছড়ায় গাঁয়ের ঝরনাটা। পুনরায় স্কুলের খাতার পাতা ছিঁড়ে বেগুনি কালি দিয়ে হিজিবিজি লেখা ছিল চিঠিগুলো, যেগুলোর একটি করে বিশেষ অনুচ্ছেদ উৎসর্গ করত ওদের প্রতিজনকে। অবশ্য তারপর যদিও সে নিজেও ব্যাপারটা খেয়াল করে নি, সে সেই পুনরুদ্ধার করার উদ্দীপনা ভরা চিঠিগুলো আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হতে থাকে মোহভঙ্গের যাজকীয় পদ্ধতিতে। শীতের রাতগুলোতে চিমনির ওপর যখন স্যুপ গরম হতো, তখন সেই দোকানটার পেছনের উত্তাপের জন্য ধূলিধূসর আলমন্ড গাছের ওপর সূর্যালোকের গুনগুনানির জন্য সিয়েস্তার সময়ের ভ্যাপসা গরমের মধ্যে ট্রেনের সিটির জন্য মনটা আনচান করত, ঠিক যেমনটি মাকন্দে থাকাকালীন মনটা কেঁদে উঠত চিমনির ওপর গরম হওয়া স্যুপের জন্য, কফিবিক্রেতার ডাক আর বসন্তে পলায়মান ভরত পাখিগুলোর জন্য। দুই আয়নার প্রতিচ্ছবির মতো দুই স্মৃতিকাতরতার পাল্লায় পড়ে সে তার অসাধারণ অবাস্তববোধ খুইয়ে ফেলে যতক্ষণ পর্যন্ত না সে সবাইকে মাকন্দ থেকে চলে যেতে উপদেশ দেয়, বলে দুনিয়া মানবিক হৃদয় সম্বন্ধে যা শিখিয়েছে, সেসব ভুলে যেতে, অরাসিওর (বিখ্যাত রোমান কবি। Borace) ওপর যেন হাগে আর যেখানেই থাকুক না কেন, মন যেন রাখে যে অতীত হচ্ছে মিথ্যে, স্মৃতির ফিরে আসার কোনো রাস্তা নেই, যত বসন্ত পার হয়ে গেছে, তা অনুদ্ধারণীয়, আর সবচেয়ে উত্তাল সবচেয়ে একনিষ্ঠ প্রেমও হচ্ছে শেষাব্দি এক ক্ষণস্থায়ী বাস্তবতা।

আলভারোই হচ্ছে প্রথম, যে মাকন্দ ছাড়ার পরামর্শ গ্রহণ করে। সবকিছু বিক্রি করে সে, এমনকি পোষা বাঘটা পর্যন্ত, যেটা দিয়ে সে বাড়ির উঠানের পাশ দিয়ে যাওয়া লোকজনদের উত্ত্যক্ত করত আর এমন এক অসীম ট্রেনের টিকিট কাটে, যেটার যাত্রা কখনোই শেষ হবে না। যাত্রাপথের স্টেশনগুলো থেকে যে পোস্টকার্ডগুলো পাঠাত, সেগুলোতে ওয়াগনের জানালা দিয়ে মুহূর্তের জন্য দেখা প্রতিচ্ছবির সোল্লাস বর্ণনা থাকত। আর ওগুলো সে এমনভাবে বর্ণনা করত মনে হতো যেন এক দীর্ঘ অপস্রিয়মাণ কবিতাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিচ্ছে বিস্তৃতির তলে; লুসিয়ানার তুলোখেতের বিশালাকায় নিগ্রো, কেন্টাকির নীল ঘাসের মধ্যে ডানাওলা ঘোড়া, আরিজোনার উত্তপ্ত সূর্যাস্তে গ্রিসের প্রেমিক-প্রেমিকা, মিশিগানের হ্রদের পাড়ে জলছবি আঁকায় মগ্ন লাল সোয়েটার পরা মেয়ে যে তার উদ্দেশে তুলি নাড়ায় বিদায় জানাতে নয়, বরং অপেক্ষা করতে, কারণ মেয়েটা জানত না যে ট্রেনটি দেখছে, সেটা কখনোই ফিরবে না। পরে এক শনিবারে চলে যায় আলফনস ও হেরমান, যাদের ধারণা ছিল সোমবারেই ফিরে আসবে আর কখনোই ওদের ব্যাপারে আর কিছু জানা যায় নি। বিজ্ঞ কাতালোনিয়ো মাকন্দ ত্যাগের এক বছর পর মার্কন্দে থাকে কেবল গাব্রিয়েল, পড়ে থাকে খেয়ালি দাক্ষিণ্যের ভরসায়, যখন সে দিয়ে যাচ্ছিল ফ্রান্সের এক সাময়িকী প্রতিযোগিতার সব প্রশ্নের উত্তর, যে প্রতিযোগিতার প্রথম পুরস্কার ছিল একবার প্যারিস ভ্রমণ। আউরেলিয়ানো, যার নামে পত্রিকাটি আসত, সে সাহায্য করত উত্তর দিতে, মাঝেমধ্যে তার বাড়িতে আর বেশির ভাগ সময়ই সিরামিকের বোতল আর মাকন্দে টিকে থাকা একমাত্র ওষুধের সব আরোগ্যের দোকানে, যেখানে বাস করত গাব্রিয়েলের গোপন প্রেমিকা মেরসেসে। দোকানটা ছিল অতীতের এক অবশিষ্টাংশ, যার নির্মূলীকরণ শেষ হচ্ছিল না, কারণ সীমাহীনভাবে তা গ্রাস করে চলছিল, গ্রাস করে চলছিল নিজেরই নিজের ভেতরে, শেষ করে চলছিল প্রতি মুহূর্তে, কিন্তু এই শেষ করার প্রক্রিয়া কখনোই আর শেষ হবে না। গ্রামটা চূড়ান্ত নিষ্ক্রিয়তার এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে যখন গাব্রিয়েল প্ৰতিযোগিতায় জিতে প্যারিসে যায়, সঙ্গে ছিল দুই প্রস্থ কাপড়, এক জোড়া জুতো আর র‍্যা বেলের রচনাসমগ্র আর ট্রেনের ইঞ্জিনিয়ারকে হাত তুলে ইশারা করতে হয় ওকে তুলে নিতে। তুর্কিদের পুরোনো সড়কটা ছিল তখন এক পরিত্যক্ত কোনা, যেখানে আরবরা হাজার বছরের রীতি মেনে মৃত্যুর কাছে নিজেদের সঁপে দেওয়ার জন্য বসে থাকত দরজায়, যদিও অনেক বছর আগে তারা বিক্রি করেছিল শেষ গজ কাপড় আর শুধু ছায়াচ্ছন্ন শোকেসে ছিল মুন্ডুহীন কাপড় সাজানোর মানবমূর্তিগুলো। কলা কোম্পানির শহরটা যেটাকে হয়তোবা প্যাত্রিসিয়া ব্রাউন সিরকার মধ্যে শসার শহর গ্ল্যাটভিল আলাবামায় নাতি- নাতনিদের শান্ত করতে মনে করতে পারত, সেই শহরটা পরিণত হয়েছিল বন্য গাছপালাভরা এক সমতল ভূমিতে। ফাদার আনহেলের পরিবর্তে আসা বৃদ্ধ পাদরি, যার নাম জিজ্ঞেস করার কষ্টটুকুও কেউ করতে চায় নি, সে বাতের কষ্টে ও সন্দেহজনক অনিদ্রায় ভুগে দোলবিছানায় শুয়ে ঈশ্বরের কৃপালাভের জন্য অপেক্ষা করত, আর অন্যদিকে গিরগিটি ও ইঁদুরের দল গির্জার উত্তরাধিকার দখলের জন্য বাগড়া করত। এমনকি পাখিদের কাছেও ভুলে যাওয়া সেই মাকন্দ, যেখানে ধুলো ও গরমের দৌরাত্ম্যে শ্বাস নেওয়াও কষ্টকর, সেখানে লাল পিঁপড়ের ঝগড়াঝাঁটির আওয়াজে ঘুমানো অসম্ভব, এমন এক বাড়িতে নিঃসঙ্গতা ও ভালোবাসার দ্বারা আর ভালোবাসার নিঃসঙ্গতার বন্ধনে বন্দী আউরেলিয়ানো ও আমারান্তা উরসুলাই ছিল একমাত্র সুখী আর ওরা এমনকি সারা দুনিয়ার মধ্যেও ছিল সবচেয়ে সুখী।

গাস্তন ফিরে গেছে ব্রাসেলসে। বিমানের জন্য অপেক্ষা করতে করতে একদিন সে এক সুটকেসে ভরে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আর ওর চিঠিপত্রের ফাইল এই ভেবে যে একদল জার্মান পাইলটের পেশ করা ওর প্রকল্পের চেয়েও আরও উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রস্তাব প্রাদেশিক সরকার পাইলটদের দিয়ে দেওয়ার আগেই সে বিমানযোগে ফিরে আসবে। প্রথমবারের মিলনের পর আউরেলিয়ানো ও আমারান্তা উরসুলা মাঝেমধ্যে স্বামীর অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে তীব্র কামনার আগুনের তাপে শব্দ রোধ করতে গলা চেপে যে ঝুঁকি নিত প্রতিবারই, তাতে বাঁধা পড়ত তার অপ্রত্যাশিত ফিরে আসায়। কিন্তু নিজেদের খালি বাড়িতে একা পেয়ে এত দিনের খিদে পুষিয়ে নিতে তারা উন্মত্ততার মধ্যে ঢুকে পড়ে। ওদের এই উন্মত্ত, লাগামছাড়া কামাবেগ কবরের মধ্যের ফের্নান্দার হাড়গোড়গুলোকে করে তুলত আশঙ্কিত, আর ওদের রাখত এক সার্বক্ষণিক উত্তেজনার মাঝে। আমারান্তা উরসুলার শীৎকার ওর প্রায় দমবন্ধ করে দেওয়া সংগীত যেমন ফেটে পড়ত দুপুরবেলা খাবারের টেবিলে, তেমনি ফেটে পড়ত ভাঁড়ার ঘরে সকাল দুইটায়। ‘আমার সবচেয়ে কষ্ট লাগে’, বলত, ‘কত সময় নষ্ট করেছি আমরা’, কামের সেই হতবিহ্বলতার মধ্যে সে দেখে লাল পিঁপড়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে বাগান, বাড়ির কাঠগুলো দিয়ে মিটিয়ে নিচ্ছে ওদের প্রাগৈতিহাসিক ক্ষুধা, দেখতে পায় বারান্দা দখল করছে জীবন্ত শুয়ো পোকার স্রোত, কিন্তু একমাত্র তখনই সে ওগুলোর ব্যাপারে মাথা ঘামায়, যখন ওগুলো ঢোকে তার শোবার ঘরে। আউরেলিয়ানো ত্যাগ করে পার্চমেন্টগুলো, বন্দী হয়ে পড়ে আবার বাড়ির ভেতর আর যেনতেনভাবে উত্তর দিত বিজ্ঞ কাতালিয়নোর চিঠিগুলোর। বাস্তবতা, সময়জ্ঞান, দৈনন্দিন জীবনের ছন্দ সব হারিয়ে ফেলে আর ফের বন্ধ করে দেয় দরজা-জানালাগুলো, যাতে কাপড় খোলার দেরিটুকুও সহ্য না করতে হয়, আর বাড়িময় ঘুরে বেড়াত যেমনটি চেয়েছিল রেমেদিওস লা বেইয়্যা আর ওরা সংগম করত উঠানের কাদার মধ্যে। আর এক বিকেলে প্রায় মরতে বসেছিল, যখন তারা ভালোবাসছিল চৌবাচ্চার মধ্যে। অল্প কদিনের মধ্যেই লাল পিঁপড়ের চেয়েও বাড়িটা ধ্বংসের ঢের বেশি কারণ হয় বসে ওরা, বৈঠকখানার সোফা সেট তছনছ করে, যে দোলবিছানাটা সহ্য করেছিল কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার বিষণ্ণ অস্থায়ী ভালোবাসার ধকল উন্মত্ততায় ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলে ওটাকে ওরা। তোশকের নাড়িভুঁড়ি বের করে মেঝেতে সেটাকে খালি করলে তুলোর কারণে দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয় ওদের। যদিও আউরেলিয়ানো ছিল ওর প্রতিপক্ষের মতোই হিংস্র প্রেমিক, তবু সর্বনাশের স্বর্গে আমারান্তা উরসুলাই আদেশ করত তার নিত্যনতুন পাগলামি নিয়ে ও সুরমণ্ডিত ক্ষুধা নিয়ে, যেন ওর ভেতরে ঘনীভূত হয়েছে সেই অজেয় শক্তি, যা দিয়ে ওর প্রপিতামহীর মা আরম্ভ করেছিল মিছরির খুদে জীবজন্তু বানানো। শুধু তা-ই নয়, ও যখন আনন্দে গান গাইত, নিজের নিত্যনতুন উদ্ভাবনে হেসে একাকার হতো, অন্যদিকে তখন আউরেলিয়ানো ক্রমশই আরও আত্মমগ্ন আর মৌন হচ্ছিল, কারণ ওর কামাবেগ ছিল আত্মকেন্দ্রিক ও জ্বলন্ত। প্রণয়ের অবসরের সময়ের মধ্যে অনাবিষ্কৃত যেসব সম্ভাবনা রয়ে গেছে, যা নাকি কামনার থেকেও অনেক বেশি আনন্দের, তা উদ্ভাবন করতে ব্যস্ত হতো ওরা, দেহপূজায় নিবেদন করত নিজেদের, যখন আউরেলিয়ানো উরসুলার উন্নত স্তন দুটিকে ডিমের সাদা অংশ দিয়ে ছানত বা নারিকেলের জমা তেলের মাখন দিয়ে তার পেলব কোমল ঊরুযুগল ও পিচ ফলের মতো পেটকে আরও কোমল করে তুলত, উরসুলা তখন আউরেলিয়ানোর বিশালাকায় শিশুটি (পুরুষাঙ্গ অর্থে ব্যবহৃত) নিয়ে পুতুল খেলত, লিপস্টিক দিয়ে ওটার মাথায় সার্কাসের সঙের চোখ ও ভুরু আঁকার পেনসিল দিয়ে তুর্কিদের মতো গোঁফ একে অরগ্যাঞ্জ বো-টাই লাগিয়ে পরাত রুপালি কাগজের টুপি। এক রাতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পিচের জ্যাম মাখায় ওরা, একে অপরকে চাটে কুত্তার মতো, পরে উন্মত্তের মতো সংগম করে বারান্দায় আর মানুষখেকো পিঁপড়ের স্রোতের মধ্যে জেগে ওঠে, যেগুলো ওদের খেয়ে ফেলার উপক্রম করেছিল।

এসব উন্মত্তার বিরতির সময় আমারান্তা উরসুলা গাস্তনের চিঠির উত্তর দিত। তাকে ওর এতই দূরের ও ব্যস্ত মনে হতো যে মনে হতো তার ফিরে আসাটা ছিল এক অসম্ভব ব্যাপার। প্রথম দিককার এক চিঠিতে গাস্তন জানায় যে তার অংশীদাররা আসলেই বিমানটা পাঠিয়েছিল কিন্তু ব্রাসেলসের এক শিপিং এজেন্সির ভুলে সেটাকে তাঞ্জানিয়ার এক ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে আর মাকন্দ নামের এক উপজাতির কাছে ওটাকে ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে। এই বিভ্রান্তি এমন এক সময় অপচয়ের অবস্থা তৈরি করেছে যে শুধু বিমানটা ফিরে পেতেই লেগে যাবে দুবছর। কাজেই হঠাৎ করে তার ফিরে আসার সম্ভাবনা নাকচ করে দেয় আমারান্তা উরসুলা। অন্যদিকে বিজ্ঞ কাতালিয়নোর চিঠি ছাড়া পৃথিবীর আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না আউরেলিয়ানোর, তার সঙ্গে শুধু গাব্রিয়েলের খবর পেত নীরব ফার্মাসিস্ট মের্সেদেস থেকে। গোড়ার দিকে যোগাযোগটা ছিল বাস্তব। ফেরত আসার টিকিট বদলে টাকা নিয়ে নেয় গাব্রিয়েল প্যারিসে থেকে যাবে বলে আর জীবিকা নির্বাহ করতে সে বিক্রি করত দক্ষিন রাস্তার এক অন্ধকার হোটেলের পরিচারিকাদের ফেলে দেওয়া পুরোনো খবরের কাগজ ও খালি বোতল। আউরেলিয়ানো তখন ওকে কল্পনা করতে পারত গলা উঁচু এক সোয়েটার পরনে, যেটাকে সে শুধু খুলত যখন মন্তপারনাসের বারান্দাগুলো ভরে উঠত বসন্তকালীন কপোত-কপোতীতে আর খিদেকে ধাপ্পা দিতে সে ঘুমাত দিনে আর লেখালেখি করত রাতে, সেই ঘরে, যে ফুলকপি সেদ্ধর ফেনার গন্ধে ভরা ঘরে মারা যাবে, রকামাদোউর। যদিও ওর সম্পর্কিত খবরগুলো ক্রমশ এতই অনিশ্চিত হয়ে ওঠে, আর তেমনি বিজ্ঞের চিঠিপত্রগুলো এতই অনিয়মিত ও বিষণ্ণ হয়ে ওঠে যে আউরেলিয়ানোও ওদের কথা ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, যেমনটি আমারান্তা উরসুলা ভাবত স্বামীর কথা আর দুজনেই ভাসতে থাকে এক শূন্য জগতে, যেখানে একমাত্র দৈনন্দিন ও নিরন্তর বাস্তবতা ছিল শুধু প্রণয়।

হঠাৎ করেই সেই অসচেতন আনন্দঘন জগতে এক ঝড়ের মতো আসে গাস্তনের ফিরে আসার খবর। আউরেলিয়ানো ও আমারান্তা উরসুলার বোধোদয় হয়, নিজেদের হৃদয়ের ভেতর গর্ত খুঁড়ে বুকে হাত রেখে একে অপরের মুখের দিকে তাকায় আর উপলব্ধি করে যে তারা এতই পরস্পরের সঙ্গে মিশে গেছে যে বিচ্ছেদের চাইতে মরণকেই তারা ভালো মনে করে। ফলে আমারান্ত উরসুলা পরস্পরবিরোধী বাস্তবতাভরা এক চিঠি লিখে স্বামীকে, যেটাতে স্বামীকে ভালোবাসার কথা স্পষ্ট করে জানায় সে উন্মুখ হয়ে আছে তাকে দেখার জন্য আর একই সঙ্গে স্বীকার করে যে নিয়তির অমোঘ ষড়যন্ত্রের বলি হিসেবে আউরেলিয়ানো ব্যতিরেকে তার বেঁচে থাকা অসম্ভব। ওরা দুজনে যা ভেবেছিল, ঘটে তার উল্টো, গাস্তন ওদের এক শান্ত, প্রায় পিতৃসুলভ উত্তর পাঠায়, যেটা সম্পূর্ণ দুপৃষ্ঠাজুড়ে কামাবেগের ক্ষণস্থায়িত্বের ব্যাপারে সতর্কতা দিয়ে ভরা, আর শেষ অনুচ্ছেদে তাদের সুখ কামনা করে যেমনটি সে সুখী হয়েছিল তার সংক্ষিপ্ত বৈবাহিক জীবনে। এটা এমনই এক অভাবনীয় আচরণ যে স্বামী তাকে নিয়তির হাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য এক অজুহাত তৈরি করেছে বলে বোধ করে আমারান্তা উরসুলার ক্রোধ আরও বাড়ে ছমাস পর, যখন গাস্তন লিওপাল্ডভিল থেকে, যেখানে শেষ পর্যন্ত বিমানটাকে পেয়েছে, সেখান থেকে আবার লিখে তার ভেলসিপেদোটা পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য, কারণ মাকন্দে রেখে যাওয়া জিনিসপত্রের মধ্যে একমাত্র যে জিনিসটার সঙ্গে তার আবেগজনিত মূল্য আছে, সেটি হচ্ছে ভেলসিপেদোটি। আমারান্তা উরসুলার সমস্ত রাগ আউরেলিয়ানো ধৈর্যসহকারে এড়িয়ে চলে। সে চেষ্টা করে প্রমাণ করতে যে সুখের সময়ের মতোই দুঃখের সময়ও ভালো স্বামী হওয়ার যোগ্যতা আছে তার আর গাস্তনের দেওয়া শেষ পয়সাটাও যখন শেষ হয়ে যায়, তখন দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়টা তাদের মধ্যে এমন এক একতার বন্ধন তৈরি করে, যা কামাবেগের মতো চোখধাঁধানো ও হঠকারী নয়, বরং এটা তাদের ঠেলে দেয় কামোন্মাদনা ও হট্টগোলে ভরা দিনগুলোর মতোই আবার প্রচণ্ড মিলনের দিকে। যখন পিলার তেরনেরার মৃত্যু হয়, তখন ওরা একটি বাচ্চার অপেক্ষায় রয়েছে।

গর্ভাবস্থার অবসর সময়ে আমারান্তা উরসুলা মাছের মেরুদণ্ডের অস্থি দিয়ে গলার হাড় তৈরির এক ব্যবসা দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু একমাত্র হাড় ক্রেতা মের্সেসে ছাড়া সে আর কাউকে পায় না ওগুলো বিক্রি করার জন্য। প্রথমবারের মতো আউরেলিয়ানোর জ্ঞানোদয় হয় যে তার বিভিন্ন ভাষার ব্যাপারে তার প্রতিভা, বিশ্বকোষের মতো অগাধ জ্ঞান, নিজ চোখে না দেখেও দূরের ও অতীতের বিভিন্ন কার্যকলাপ মনে রাখার বিরল গুণ, এ সবই তার স্ত্রীর বিভিন্ন দামি পাথরের বাক্সের মতোই কার্যকর, যা মাকন্দে অবশিষ্ট বাসিন্দাদের সমস্ত টাকাপয়সা একসঙ্গে করলে যা হয়, তার থেকেও বেশি মূল্যবান। ওরা বেঁচেছিল অলৌকিকভাবে। আমারান্তা উরসুলা তার রসবোধ বা যৌনোত্তেজক দুষ্টুমির আবিষ্কারের ক্ষমতা না হারালেও দুপুরের খাবারের পর বারান্দায় বসার অভ্যাস জন্মে, যেটা ছিল একধরনের জাগ্রত সিয়েস্তা ও একরকমের চিন্তার সময়ের মিশ্রণ। আউরেলিয়ানো ওকে সঙ্গ দিত। মাঝেমধ্যে চুপচাপ বসে থাকত ওরা ভোর পর্যন্ত পরস্পরের দিকে মুখ করে, একে অপরের চোখের দিকে চেয়ে নীরবতার মাঝে ভালোবেসে, যেমনটি ভালোবাসত তারা তাদের উন্মত্ততা ভরা দিনগুলোতে। ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা ওদের বাধ্য করে অতীতের দিকে ফিরে তাকাতে, নিজেদের দেখতে পায় ওরা হারিয়ে যাওয়া মহাপ্লাবনের স্বর্গে, উঠানের জলকাদায় দাপাদাপি করছে, উরসুলার গায়ে ঝোলানোর জন্য গিরগিটি মারছে, তাকে জ্যান্ত কবরের খেলা খেলছে আর এই সব স্মৃতিচারণা ওদের সামনে উন্মোচন করে বাস্তবতা; স্মৃতির প্রথম দিন থেকেই ওরা একই সঙ্গে সুখী। অতীতের আরও গভীরে গিয়ে আমারান্তা উরসুলার মনে পড়ে সেই বিকেলের কথা, যেদিন রৌপ্যশালায় ঢুকলে ওর মা ওকে বলে আউরেলিয়ানো কারোরই সন্তান ছিল না, কারণ তাকে পাওয়া গেছে এক ভাসমান ঝুড়ির মধ্যে। যদিও এই ভাষ্য অসম্ভাব্য বলে মনে হয়, তবু তথ্যের অভাবে সেটার বদলে সত্য প্রতিস্থাপিত করা সম্ভব হয় না ওদের পক্ষে। সব সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার পর একমাত্র যে ব্যাপারে ওরা নিশ্চিত হয় তা হচ্ছে, ফের্নান্দা আউরেলিয়ানোর মা ছিল না। আমারান্তা উরসুলার কাছে বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় যে সে হচ্ছে পেত্রা কতেসের ছেলে, যার সম্বন্ধে শুধু বদনামই মনে করতে পারে আর এই অনুমান তার প্রাণের মধ্যে সৃষ্টি করে এক আতঙ্কের মোচড়।

সে তার বউয়ের ভাই, এই নিশ্চয়তার যন্ত্রণায় আউরেলিয়ানো নিজের জন্মসূত্র সন্ধানে ছাতাধরা, পোকাকাটা কাগজ ঘাঁটতে যাজকের বাড়ি যায়। ব্যাপটাইজ-সংক্রান্ত সবচেয়ে পুরোনো যে কাগজ সে পায়, সেটা ছিল আমারান্তা বুয়েন্দিয়ার, যাকে বয়ঃসন্ধিকালে দীক্ষা দিয়েছিল ফাদার নিকানোর রেইনা যখন তাকে চকলেটের জাদুর কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছিল ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য। একসময় তার মনে আশা জাগে, সতেরো জন আউরেলিয়ানোর একজন হওয়ার সম্ভাবনায়, কিন্তু ওদের জন্মের কাগজপত্র চার ভলিউমের ভেতর থেকে বের করে, যখন দেখে তাদের ব্যাপারটি জন্মের সময়গুলো তার বয়সের থেকে অনেক পুরোনো, তখন সেই আশা মরীচিকায় পরিণত হয়। কাতর পাদরি দোলবিছানায় শুয়ে রক্তের অনিশ্চয়তার গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাওয়া আউরেলিয়ানোকে তার নাম জিজ্ঞেস করে। ‘আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া’, সে উত্তর দেয়।

‘তাহলে আর খুঁজে মরিস না’, ফলাফল দেওয়ার তীব্র সুরে পাদরি বলে, ‘অনেক বছর আগে এখানে এক রাস্তা ছিল এই নামে আর ফলে সেই নামে ছেলেদের নাম রাখতে লোকজন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। রাগে কাঁপতে থাকে আউরেলিয়ানো।

‘আ!’ বলে ‘আপনিও তাহলে বিশ্বাস করেন না।’

‘কী বিশ্বাস করি না।’

কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া বত্রিশটি গৃহযুদ্ধে লড়েছিলেন আর সব কটিতেই হেরেছেন।’ উত্তর দেয় আউরেলিয়ানো, ‘সৈন্যরা ঘিরে ধরে আর মেশিনগান দিয়ে তিন হাজার শ্রমিক হত্যা করে, যাদের দেহ দুই শ ওয়াগনের ট্রেনে করে নিয়ে যায় সাগরে ভাসিয়ে দিতে।’ পাদরি ওকে এক করুণার দৃষ্টি দিয়ে মাপে।

‘বাছা, আমার’, দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘আমি যদি তোর আর আমার অস্তিত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারতাম, তাহলেই সেটাই ছিল যথেষ্ট।’

কাজেই আউরেলিয়ানো ও আমারান্তা উরসুলা ঝুড়ির গল্পটাকেই মেনে নেয় এই কারণে নয় যে ওরা বিশ্বাস করেছে, বরং গল্পটা তাদের আতঙ্কের হাত থেকে রেহাই দিয়েছে বলে। গর্ভাবস্থা যতই এগোতে থাকে, ততই ওরা পরিণত হতে থাকে একই সত্তায়; যে বাড়িটাকে ধ্বংস করার জন্য শুধু শেষ ফুঁয়ের প্রয়োজন ছিল, সেই বাড়িতে প্রতিক্ষণেই ওরা একাত্ম হতে থাকে। শুধু প্রয়োজনীয় জায়গাটুকুতে নিজেদের সীমাবদ্ধ করে ওরা নিজেদের; যে ঘর থেকে নিশ্চল প্রণয়ের আনন্দ দেখা যেত, সেই ফের্নান্দার শোবার ঘর থেকে শুরু করে যেখানে আমারান্তা উরসুলা বসত আগমনপ্রায় শিশুটির জন্য ছোট জুতো ও ছোট টুপি বুনতে আর আউরেলিয়ানো মাঝেমধ্যে বসত জ্ঞানী কাতালিয়নোর চিঠির উত্তর দিতে সেই জায়গাটা পর্যন্ত, যেটা ছিল বারান্দার শুরু। বাকি জায়গাটা হার মানে ধ্বংসের নাছোড় আগ্রাসনের কাছে। রৌপ্যশালা মেলকিয়াদেসের কামরা, সান্তা মারিয়া দেলা পিয়েদাদের আদিম, নীরব রাজত্ব—সবই চলে যায় গার্হস্থ্য জঙ্গলের তলায়, যেগুলোর জট খোলার সাহস কারও হয় না। প্রকৃতির হিংস্রতাবেষ্টিত আউরেলিয়ানো ও আমারান্তা উরসুলা চাষ করে যেতে থাকে আরেগোনা ও বেগোনিয়া আর নিজেদের জগৎকে ওরা রক্ষা করত চুন দিয়ে সীমানা একে আর মানুষ ও পিঁপড়ের মধ্যকার প্রাচীন যুদ্ধের শেষ পরিখাগুলো খুঁড়ে। অযত্নে থাকা লম্বা চুল, সকালে মুখে জেগে ওঠা কালো ছোপ ফুলে ওঠা পা, আগেকার বেজির মতো প্রণয় পটীয়সী শরীরের পরিবর্তন ঘটাতে পারলেও দুর্ভাগা ক্যানারিগুলো ও বন্দী স্বামী নিয়ে আসা তারুণ্যে ভরপুর আমারান্তা উরসুলার প্রাণোচ্ছলতায় কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না। ‘যত সব’, হাসত, ‘কে ভাবতে পেরেছিল যে শেষ পর্যন্ত বাস করব মানুষখেকোদের মতো।’ পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কের শেষ সুতোটা ছিঁড়ে যায় যখন গর্ভাবস্থার ছমাসের সময় এক চিঠি আসে, যেটা নিশ্চিতভাবেই জ্ঞানী কাতালিয়নোর নয়। ওটা ছাড়া হয়েছিল বার্সেলোনা থেকে কিন্তু খামের ওপর নীল কালি দিয়ে মামুলি দাপ্তরিক অক্ষরে লেখাটার গোবেচারা* নৈর্ব্যক্তিক চেহারাই বলে দেয় ওটার ভেতরের দুঃসংবাদ। আউরেলিয়ানো খুলতে যাওয়ার সময় আমারান্তা উরসুলার হাত থেকে কেড়ে নেয় খামটা।

‘এটা না’, ওকে বলে, ‘এটার ভেতর কী লেখা আছে, তা জানতে চাই না।’

ও যা আশঙ্কা করেছিল, তা-ই ঘটে, জ্ঞানী কাতালান আর কখনো চিঠি লিখে না। সেই অজ্ঞাতনামা লোকের চিঠি, যেটাকে কেউ পড়েনি, পড়ে রইল মথদের করুণার ওপর, ফের্নান্দা কোনো কোনো সময় ভুলে যাওয়া বিয়ের আংটি রাখা তাকের ওপর আর ওখানেই পড়ে থেকে নিজের ভেতরের দুঃসংবাদের কারণে নিজেই শেষ হয়ে যেতে যেতে, ওদিকে নিঃসঙ্গ প্রণয়জুটি হাল ধরত শেষ পর্বের স্রোতের দিনগুলোর উল্টো দিকে, অনুতাপহীন, কুলক্ষুনে যে দিনগুলো ওদের মোহভঙ্গ ও বিস্মৃতির মরুভূমির দিকে ভাসিয়ে নিতে বিফল চেষ্টা করে, সেই দিনগুলোর বিপরীতে। সেই হুমকি টের পেয়ে শেষের ক’মাস আউরেলিয়ানো ও আমারাস্তা উরসুলা কাটাত হাত-ধরাধরি করে, অবৈধ, উন্মত্ত মিলনের ফলে সৃষ্ট শিশুটির প্রতি বিশ্বস্ত মিলনে। রাতে জড়াজড়ি করে বিছানায় শুয়ে থাকার সময় চাঁদের আলোয় পিঁপড়াদের মাটি ভাঙার শব্দ ওদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করত না, এমনকি মথদের গুঞ্জন বা পাশের ঘরের আগাছা বেড়ে ওঠার নিরন্তর শিসও নয়। অনেকবারই ওরা জেগে ওঠে মৃতদের চলাচলে। শুনতে পায় উরসুলা লড়ে চলছে সৃষ্টির আইনের বিরুদ্ধে বংশরক্ষার খাতিরে, আর হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া খুঁজে চলছে মহৎ আবিষ্কারের পৌরাণিক সত্য, ফের্নান্দা করছে প্রার্থনা, কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া যুদ্ধে প্রতিনিয়তই হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে ছোট ছোট সোনার মাছ বানাচ্ছে, আর আউরেলিয়ানো সেগুন্দো পানোৎসবের হট্টগোলের মধ্যেও খাবি খাচ্ছে নিঃসঙ্গতায়, আর তখনই ওরা শেখে যে প্রবল আচ্ছন্নতা মৃত্যুর বিরুদ্ধেও টিকে থাকে আর ফলে অন্যান্য ভবিষ্যৎ প্রজাতির প্রাণী যে দুর্দশার স্বর্গটা মানুষ থেকে পোকামাকড়েরা কেড়ে নিতে যাচ্ছে, সেটা পোকামাকড়দের হাত থেকে কেড়ে নেওয়ার পরও প্রাকৃতিকভাবেই ভূত হয়ে ওরা নিজেদের ভালোবেসে যাবে, এই নিশ্চয়তায় ওরা আবার সুখী হয়ে ওঠে।

এক রোববার বেলা ছটার সময় আমারান্তা উরসুলার প্রসববেদনা শুরু হয়। পেটের দায়ে বিছানায় যাওয়া মেয়েদের খালাস করার হাসিখুশি দাই খাবার টেবিলে উঠিয়ে ওর পেটের ওপর বসে আনাড়ি ঘোড়া চালকের মতো এমনভাবে চাপ দিয়ে চলে, যতক্ষণ পর্যন্ত না এক দুর্দান্ত বাচ্চা ছেলের কান্নায় চাপা পড়ে যায় আমারান্তা উরসুলার আর্তচিৎকার। অশ্রুজলের মধ্য দিয়ে আমারান্তা উরসুলা দেখতে পায় এক বুয়েন্দিয়াকে, বিশাল শক্ত- সমর্থ, বড় বড় খোলা চোখে হোসে আর্কাদিওর মতোই জেদি, আউরেলিয়ানোর মতো অতীন্দ্রিয় শক্তিসম্পন্ন আর বংশটাকে আবার গোড়ার থেকে দোষত্রুটি ও নিঃসঙ্গতা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, কারণ এক শতাব্দীর মধ্যে একমাত্র তারই জন্ম হয়েছে ভালোবাসা দিয়ে।

‘এ হচ্ছে সত্যিকারের এক মানুষখেকো’, বলে, ‘ওর নাম হবে রদ্রিগো।’

‘না’, ‘প্রতিবাদ করে ওর স্বামী, ‘ওর নাম হবে আউরেলিয়ানো আর ও জয় করবে বত্রিশটি যুদ্ধ।’

নাড়ি কাটার পর আউরেলিয়ানোর উঁচু করে ধরা বাতির আলোয় দাই ওর শরীর থেকে এক ন্যাকড়া দিয়ে শরীরে লেগে থাকা নীল আঠালো বস্তু মুছতে শুরু করে, শুধু যখন বাচ্চাটাকে উপুড় করা হয়, কেবল তখনই ওরা দেখতে পায় যে অন্য সব পুরুষের চেয়ে বাড়তি একটা জিনিস আছে তার আর ওরা ঝুঁকে পড়ে জিনিসটা পরীক্ষা করার জন্য। ওটা ছিল শুয়োরের লেজ।

বিচলিত হয় না ওরা। আউরেলিয়ানো ও আমারান্তা উরসুলা পরিবারের অতীত জানত না আর উরসুলার ভয়ংকর হুমিয়ারের কথাও ওদের স্মরণে আসে না আর দাই মনে করে সেই অপ্রয়োজনীয় লেজটা শিশুর স্থায়ী দাঁত ওঠার পর কেটে ফেলা যাবে আর সে এই কথা বলে ওদের আশ্বস্ত করে। এরপর আর এ নিয়ে চিন্তা করার কোনো অবকাশ থাকে না, কারণ আমারাত্তা উরসুলার রক্তপাত হয়ে পুকুর সৃষ্টি করছিল, যা থামানো যাচ্ছিল না। মাকসাড় জাল ও ছাই মিশিয়ে গোলা তৈরি করে রক্তপাত থামানোর চেষ্টা করা হয়, কিন্তু সেটা ছিল হাত দিয়ে ঝরনাধারা বন্ধের মতো। প্রথম ঘণ্টাগুলোতে আমারান্তা উরসুলা চেষ্টা করে ওর ভালো মেজাজ বজায় রাখতে। সে শঙ্কিত আউরেলিয়ানোর হাত ধরে অনুনয় করত দুশ্চিন্তা না করতে আর বলত, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মরার জন্য ওর মতো মানুষ তৈরি হয় নি আর দাইয়ের ভয়ংকর রকমের চিকিৎসাপদ্ধতি দেখে হেসে ফেটে পড়ত। কিন্তু যতই আউরেলিয়ানো আশা ছেড়ে দিতে থাকে, ততই সে নিস্তেজ হতে থাকে, যেন তার ওপর থেকে আলো মুছে ফেলা হচ্ছে, আর তারপর সে ডুবে যায় তন্দ্রাচ্ছন্নতায়। সোমবার ভোরে ওরা নিয়ে আসে এক মহিলাকে, যে বিছানার পাশে আওড়ায় মানুষ ও পশুপাখির দুই জাতের জন্যই অব্যর্থ প্রার্থনাবাক্য, কিন্তু আমারান্তা উরসুলার তীব্র আবেগসম্পন্ন রক্ত ছিল ওসবের প্রতি সংবেদনশূন্য, যা ছিল একমাত্র ভালোবাসার প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল। দুপুরবেলা, চব্বিশ ঘণ্টার নৈরাশ্যের পর ওরা জানতে পারে সে মারা গেছে, কারণ কোনো চেষ্টা ছাড়াই রক্তপাত বন্ধ হয়ে যায়। মুখের ধারালো চোখাভাব ফিরে আসে, ছোপ ছোপ দাগ মিলিয়ে যায়, এক উষার প্রায় স্বচ্ছ জিপসামের আলোতে আর ফিরে আসে হাসি।

বন্ধুদের যে আউরেলিয়ানো কতটা ভালোবাসত, তাদের অভাব কতটুকু, সেই মুহূর্তে ওদের সঙ্গ পাওয়ার বদলে সে কতটা দিতে পারত, সেই কথা আগে সে বুঝতে পারে নি। শিশুর মায়ের বানানো ঝুড়িতে সে ওকে শোয়ায় একটা চাদর দিয়ে, মৃতদেহের মুখটা ঢেকে দেয়, আর অতীতের দিকে চলে গেছে এমন এক পথের খোঁজে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে গ্রামজুড়ে। ওষুধের দোকানের দরজায় টোকা দেয় যে দোকানে অনেক দিন তার যাতায়াত ছিল না আর পায় এক ছুতোরের দোকান। যে প্রাচীন মহিলা এক হাতে বাতি ধরে দরজা খোলে, সে ওর বিকারগ্রস্ত অবস্থা দেখে করুণাবোধ করলেও জোর দিয়ে বলে, ওখানে কখনোই ফার্মেসি ছিল না আর এমনকি মেসেদেস নামের চিকন গলা ও ঘুম ঘুম চোখের কোনো মেয়ের সঙ্গে তার পরিচয়ও হয় নি। সাবে জ্ঞানী কাতালিয়নোর দোকানের দরজায় কপাল ঠেক দিয়ে কাঁদে সে আর জানত যে এটা হচ্ছে এক মৃতের জন্য বিলম্বিত কান্না, যেটা সময়মতো সে কাঁদতে চায় নি, যাতে তার ভালোবাসার ঘোর না কাটে। ‘স্বর্ণশিশু’র সিমেন্টের দেয়ালে ঘুষি মেরে কবজি ভাঙে সে পিলার তেরনারকে ডেকে ডেকে, আর ওই সময় আকাশ পাড়ি দেওয়া উজ্জ্বল কমলা রঙের চাকতিগুলোর দিকে ফিরেও তাকায় না, যেগুলোর কথা সে বহুবার ভেবেছে ছুটির রাতে শিশুসুলভ কৌতূহলবশত কাদাখোঁচা পাখি ঘুরে বেড়ানো আঙিনা থেকে। ভেঙে ছত্রচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া নিষিদ্ধপাড়ার শেষ খোলা স্যালুন, যেখানে একদল অ্যাকর্ডিয়ান বাদক বাজাচ্ছিল রাফায়েল এসকালোনার গান, যে ছিল বিশপের ভাগনে ও ফ্রান্সিসকো এল অমব্রের গুপ্তবিদ্যার উত্তরাধিকারী। বারের পরিচারক, যার এক হাত ছিল শুকনো নিজের মায়ের ওপর হাত তুলেছিল বলে, সে আউরেলিয়ানোকে আমন্ত্রণ জানায় এক বোতল আগুয়া আর্দিয়েন্তে (জ্বলন্ত পানি—আখের রসের তৈরি মদ) পানের জন্য আর আউরেলিয়ানো আমন্ত্রণ করে আরেক বোতলের, পরিচারক তাকে হাতের দুর্ভাগ্যের কথা জানায়, যেটাকে সে বোনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করায় শুকিয়ে কুঁচকে গিয়েছে আর আউরেলিয়ানো তাকে জানায় হৃদয়ের দুর্ভাগ্যের কথা, দুজনে একসঙ্গে কাঁদে শেষ পর্যন্ত আর আউরেলিয়ানোর মুহূর্তের জন্য মনে হয় যে তার ব্যথা সেরে গেছে। কিন্তু যখন মাকন্দের শেষ উষায়, যখন সে আবার একাকী হয়ে পড়ে, তখন প্লাজার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুই বাহু ছড়িয়ে প্রস্তুত হয় সারা পৃথিবীকে জাগিয়ে তুলতে আর প্রাণ খুলে চিৎকার করে

‘বন্ধুরা সব খানকি মাগির পুত।’

এক পুকুর বমি ও চোখের পানির মধ্য থেকে ওকে উদ্ধার করে নিগ্রোমান্তা। নিজের ঘরে নিয়ে যায় পরিষ্কার করে বাধ্য করে এক বাটি স্যুপ পান করতে। কিছুটা সান্ত্বনা পাবে মনে করে কয়লার এক দাগ দিয়ে আউরেলিয়ানোর সমস্ত অগুনতি মিলনের ঋণ মুছে ফেলে আর তার সবচেয়ে নিঃসঙ্গতার দুঃখের কাহিনি আপনা থেকেই বলে যায়, যাতে করে ওর একাকী কাঁদতে না হয়। ভোরে এক ভোঁতা ও সংক্ষিপ্ত ঘুম দিয়ে পুনরায় তার মাথাব্যথার ব্যাপারে সচেতন হয়। চোখ মেলে তার মনে পড়ে বাচ্চাটার কথা।

ওকে খুঁজে পায় না ঝুড়ির মধ্যে। প্রথম ধাক্কায়, আমারান্তা উরসুলা মরণ থেকে জেগে ওঠে শিশুর ভার নিয়েছে মনে করে সে আনন্দে আপ্লুত হয়। কিন্তু চাদরের নিচে শবদেহটা তখনো পাথরের স্তূপের মতো পড়ে ছিল। যখন তার মনে হলো যে বাড়িতে ঢোকার সময় দরজা খোলা ছিল, তখন সে আবেগানোর প্রভাতি দীর্ঘশ্বাসভর্তি বারান্দা পার হয় আর উঁকি মারে খাবার ঘরে, যেখানে তখনো প্রসবের আবর্জনা পড়ে ছিল। ছিল বিরাট পাতিল, রক্তমাখা চাদরের স্তূপ, ছাইয়ের পাত্র, আর খোলা ডায়াপারে কেঁচি ও বড়শির সুতোর পাশে বাচ্চার পেঁচানো নাড়ি। রাতে দাই বাচ্চাটার কাছে ফিরে এসেছে এই চিন্তা করার জন্য একটু শান্ত হয়ে থামে সে। দোলচেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে, সেই একই দোলচেয়ারে, যেখানে বসে রেবেকা বাড়ির ভালো অবস্থায় এমব্রয়ডারি শেখাত, যেখানে বসে আমারান্তা চেকার খেলত কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসের সঙ্গে, যেখানে আমারান্তা উরসুলা বাচ্চাটার জন্য ছোট ছোট জামাকাপড় বানাত, আর বিদ্যুচ্চমকের মতো আসা সুস্থতায় সে বুঝতে পারে তার আত্মার ওপর অতীতের এত দমবন্ধকর ভার সে সহ্য করতে পারবে না। নিজস্ব ও অন্যদের স্মৃতিকাতরতার মারাত্মক বর্ণাঘাতে আহত হয়ে উপভোগ করে মৃত গোলাপঝাড়ের ওপর মাকড়সার সাহসিকতা, রাই ঘাসের ক্রমাগত চেষ্টা ফেব্রুয়ারির জ্বলন্ত ভোরে বাতাসের ধৈর্য। আর তখনই দেখতে পায় বাচ্চাকে। সেটা ছিল এক ফুলে ওঠা শুকিয়ে যাওয়া চামড়া, যেটাকে দুনিয়ার তাবৎ পিঁপড়া প্রচণ্ড কষ্ট করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওদের বাসার দিকে বাগানের পাথর দিয়ে বানানো পথ ধরে। আউরেলিয়ানো নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এই কারণে নয় যে আতঙ্কে তার শরীর অবশ হয়ে গেছে, বরং এই কারণে যে সেই মুহূর্তে বিস্ময়করভাবে মেলকিয়াদেসের রহস্যের চূড়ান্ত উন্মোচন ঘটে আর চোখের সামনে ভেসে ওঠে পার্চমেন্টগুলোর উদ্ধৃতি সঠিকভাবে ক্রমানুসারে সময় ও কালের সঙ্গে মেলানো: বংশের প্রথমজন গাছের সঙ্গে বাঁধা থাকছে আর শেষজনকে পিপীলিকায় খাচ্ছে।

জীবনের কোনো সময়ই আউরেলিয়ানো এত সজ্ঞান ছিল না, যখন সে ভুলে যায় মৃতদের আর মৃতদের জন্য বেদনা আর আবার বন্ধ করে দরজা-জানালা ফের্নান্দার কাঠের তক্তা দিয়ে, পেরেক ঠুকে, যাতে পৃথিবীর কোনো প্রলোভনই তাকে বিরক্ত না করতে পারে, কারণ তখন সে জানত মেলকিয়াদেসের পার্চমেন্টে লেখা আছে ওর নিজের নিয়তি ওগুলোকে পায় সে অস্পৃষ্ট অবস্থায়, প্রাগৈতিহাসিক গাছপালার মাঝে, ভেজা বাষ্প ওঠা ডোবার মাঝে, পৃথিবী থেকে মানুষ বসবাসের সমস্ত নিদর্শন ঘরটা থেকে মুছে ফেলার জন্য দায়ী উজ্জ্বল পোকামাকড়ের মধ্যে, আর সেগুলোকে আলোতে আনার মতো প্রশান্তি তখন তার মধ্যে নেই, বরং সে ওখানেই দাঁড়িয়ে কোনো রকমের কষ্ট ছাড়াই, যেন ওগুলো লেখা আছে স্প্যানিঞল ভাষায় আর দেখা যাচ্ছে মধ্যদুপুরের উজ্জ্বলতায়; সে উঁচুগলায় ওগুলোর অর্থোদ্ধার করতে শুরু করে।

ওগুলো ছিল পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনাসমেত মেলকিয়াদেসের লেখা পারিবারিক ইতিহাস আর লেখা ছিল একশত বছর আগে। লেখা ছিল সংস্কৃতিতে, যেটা ছিল তার মাতৃভাষা আর জোড় বাক্যগুলো সম্রাট আগস্তের ব্যক্তিগত সংকেতলিপিতে আর বেজোড় বাক্যগুলো লাসেদেসেনিয়ার সামরিক সংকেতলিপিতে। আর আরও ভালোভাবে সুরক্ষার জন্য মেলকিয়াদেস ওগুলোকে মানুষের গতানুগতিক কাল অনুসারে সাজায় নি, বরং একসঙ্গে জড়ো করেছে এক শ বছরের সমস্ত উপাখ্যান এমনভাবে, যেন ওগুলো ঘটেছে এক মুহূর্তে আর যেটা আউরেলিয়ানো আঁচ করতে শুরু করেছিল, যখন সে আমারান্তা উরসুলার প্রণয়ের বিভ্রান্তিতে মেতেছিল। আবিষ্কারের উত্তেজনায় আউরেলিয়ানো এমনকি সেই চিঠিটাও বাদ না দিয়ে জোরে জোরে পড়ে যায় যেটা মেলকিয়াদেস নিজেই আর্কাদিওকে শুনতে বাধ্য করেছিল আর যেটাতে লেখা ছিল তার নিজের মৃত্যুদণ্ডের ভবিষ্যদ্বাণী আর যেখানে লেখা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী রমণীর সশরীরে, সআত্মায় স্বর্গে উত্তোলনের কথা, জানতে পারে পিতার মৃত্যুর পর জন্ম নেওয়া দুই যমজের জন্মপরিচয়, যারা পার্চমেন্টের অর্থোদ্ধারে ক্ষান্ত দিয়েছিল এই কারণে নয় যে তাদের যোগ্যতা বা উদ্যম ছিল না, বরং এই কারণেও যে ওদের চেষ্টা ছিল অসময়োচিত। এই জায়গাটাতে এসে, নিজের জন্মপরিচয় জানা অধীরতায় আউরেলিয়ানো কিছু অংশ বাদ দেয়। ফলে শুরু হয় বাতাস; উষ্ণ, সদ্য-সৃষ্ট, অতীতের কণ্ঠস্বর প্রাচীন জেরানিয়াম গাছের গুনগুনানি, আর প্রচণ্ড একগুঁয়ে মোহভঙ্গের স্মৃতিকাতরতার দীর্ঘশ্বাসে পরিপূর্ণ। ব্যাপারটা সে খেয়াল করে না, কারণ সেই মুহূর্তে সে আবিষ্কার করছে তার নিজের সত্তার প্রথম ইঙ্গিত এক কামুক পিতামহের মধ্যে, যে নিজেকে টেনে নিতে দিয়েছে এক মায়াময় মালভূমির ওপর দিয়ে এক সুন্দরী নারীর খোঁজে, যে তাকে সুখী করবে না। আউরেলিয়ানো ওকে চিনে ফেলে, অনুসরণ করে ওকে উত্তর প্রজন্মের গুপ্ত পথ ধরে, আর আবিষ্কার করে নিজের ভ্রূণ তৈরি হওয়ার মুহূর্তটি কাঁকড়া- বিছে ও হলুদ প্রজাপতির মাঝে এক সূর্যান্তের স্নানঘরে, যেখানে এক মেকানিক তার লালসা মেটাচ্ছিল এমন এক নারীর সঙ্গে, যে নিজেকে অর্পণ করছিল দুর্বিনীতা হওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। সে ছিল এতই নিবিষ্ট যে বাতাসের দ্বিতীয় ঝাপটাটাও অনুভব করে না যেটার ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি দরজা-জানালা খুলে ফেলে, হলঘরের পুবদিকের ছাদ উপড়ে দেয় আর তুলে ফেলে বাড়ির সিমেন্টের ভিত। শুধু তখনই সে আবিষ্কার করে যে আমারান্তা উরসুলা তার বোন ছিল না, ছিল তার খালা, আর ফ্রান্সিস দ্রেক রিওয়াচা আক্রমণ করেছিল শুধু এই কারণে, যাতে তারা নিজেদের রক্তসম্পর্কের গোলকধাঁধায় খুঁজে বেড়াতে পারে যত দিন না জন্ম নেবে সেই পৌরাণিক জন্তু, যেটা বংশটার ইতি টেনে দেবে। মাকন্দ তখন বাইবেলে বর্ণিত হারিকেনের কবলে পড়ে পরিণত হয়েছে এক ভয়ংকর ধূলি ও আবর্জনার ঘূর্ণিঝড়ে, যখন আউরেলিয়ানো যে সময়গুলো ভালো করেই জেনে ফেলেছে আর সেগুলো পুনরাবৃত্তি করে সময় নষ্ট না করার জন্য এগারো পাতা বাদ দেয় আর অর্থোদ্ধার করতে থাকে বর্তমানের যে সময়টার, যেখানে সে বাস করছিল পার্চমেন্টের শেষ পাতায় আর নিজেই নিজের ভবিষ্যদ্বাণী করতে করতে, যেন সে এক কথাবলা আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর সে আবার কিছু পাতা বাদ দেয় নিজের মৃত্যুতারিখ ও মৃতাবস্থার ভবিষ্যদ্বাণী জেনে নিতে। অবশ্য শেষ স্তবকে পৌঁছানোর আগেই সে বুঝে যায় যে কখনোই ঘরটা থেকে সে বের হবে না, কারণ আগেই বুঝে ফেলেছে যে আরশিনগরটা (বা মরীচিকাগুলো) বাতাসের টানে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে আর যখন আউরেলিয়ানো ব্যাবিলনিয়া পার্চমেন্টের পাঠোদ্ধার শেষ করবে, তখনই বাতাস টেনে বের করে মানুষের স্মৃতি থেকে, নির্বাসিত করবে শহরটাকে, আর গুগুলোর মধ্যের লেখাগুলো হবে অপুনরাবৃত্তিযোগ্য সেই আদিকাল থেকেই আর শাশ্বত কালের জন্য, কারণ শতবর্ষের নিঃসঙ্গতায় শাস্তি পাওয়া বংশগুলোর জন্য এ পৃথিবীর বুকে কখনোই দ্বিতীয়বারের সুযোগ ছিল না।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *