নিঃসঙ্গতার একশ বছর – ১৯

১৯

পালতোলা জাহাজে অনুকূল হাওয়ায় ডিসেম্বরের প্রথম দেবদূতদের সঙ্গে গলায় রেশমের রশি বেঁধে টেনে স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফেরে আমারান্তা উরসুলা। কোনো আগাম ঘোষণা ছাড়াই হাতির দাঁতের রঙের কোট পরে, গলায় প্রায় হাঁটু পর্যন্ত লম্বা মুক্তার ছড়া, হাতে পান্না ও পোখরাজের আংটি পরে, আর লম্বা সোজা চুল কান পর্যন্ত তুলে খোঁপা বেঁধে তাতে সোয়ালো পাখির পুচ্ছ লাগিয়ে উদয় হয় সে। ছয় মাস আগে সে যাকে বিয়ে করেছে, সে এক পরিণত বয়সের হালকা-পাতলা ফ্লামেংকো (স্পেনের এক অঞ্চলের মানুষ), যার চেহারা অনেকটা নাবিকদের মতো। বৈঠকখানার দরজা ঠেলা দিতেই সে বুঝতে পারে যে তার অনুপস্থিতি যতটা ভেবেছিল, তার চেয়েও ঢের বেশি লম্বা সময় ও তত দিনে অনেক কিছু নষ্ট হয়ে গেছে।

‘হায় খোদা’, উঁচু গলায় খুশি হওয়ার বদলে শঙ্কিত হয়ে বলে, ‘বোঝা যাচ্ছে যে বাড়িতে কোনো মেয়েমানুষ নেই।’

বারান্দায় মালপত্র আঁটছিল না। সঙ্গে করে স্কুলে যাওয়ার ফের্নান্দার দেওয়া তোরঙ্গ ছাড়াও দুটি খাড়া পোশাক রাখার আলমারি, চারটে বড় সুটকেস, ছাতা রাখার কাপড়ের ব্যাগ, আট বাক্স টুপি, পঞ্চাশটি ক্যানারি পাখিসমেত এক বিশাল খাঁচা ছাড়াও সে এনেছে ভাঁজ করে বিশেষভাবে বানানো বাক্সে ভাঁজ করে ঢোকানো স্বামীর ভেলোসিপিড (আদি বাইসাইকেল), যাতে করে চেলোর মতো সেটাকে বয়ে নেওয়া যায়। এই দীর্ঘ ভ্রমণের পর সে এক দিনের জন্যও শরীরটাকে বিশ্রাম দেয় না। স্বামীর অন্যান্য পোশাকের সঙ্গে নেওয়া এক পুরোনো ডেনিমের ওভার অল গায়ে চড়িয়ে সে লেগে যায় বাড়ির নতুন সংস্কার সাধনে। বারান্দা দখল করা লাল পিঁপড়েগুলোকে ছত্রভঙ্গ করে সে, প্রাণ ফিরিয়ে আনে গোলাপ ঝাড়গুলোতে, শিকড়সুদ্ধ তুলে ফেলে আগাছা আর নতুন করে ফার্ন, আরগানো ও বেগোনিয়া লাগায় রেলিংয়ে ঝোলানো টবে। একদল ছুতোর, তালা মিস্ত্রি ও রাজমিস্ত্রি লাগিয়ে মেঝের ফাটল সারায়, জানালা-দরজা ঠিকমতো কবজায় বসায়, আসবাবপত্র মেরামত করায়, চুনকাম করায় দেয়ালের ভেতর-বাহির আর এতে করে ফেরার তিন মাসের মধ্যে বাড়িটা ফিরে পায় পিয়ানোলার সময়কার তারুণ্য ও উৎসবের পরিবেশ। যেকোনো পরিস্থিতিতেই ওর মতো খোশমেজাজি কাউকে কখনোই দেখা যায় নি এ বাড়িতে। কাউকে দেখা যায় নি গান গাওয়ার ও নাচের জন্য এমন উন্মুখ আর কারও মধ্যে দেখা যায় নি অতীতের সবকিছু, সমস্ত সংস্কার আবর্জনার স্তূপে ছুড়ে ফেলার জন্য এত আগ্রহ। ঝাড়ুর এক ধাক্কায় শেষ করে দেয় সব অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার স্মৃতিচিহ্ন, সব অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের স্তূপ, বাড়ির কোনায় কোনায় জমা কুসংস্কারবশত রাখা সব জিনিসপত্র আর শুধু উরসুলার প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত বৈঠকখানায় রেখে দেয় রেমেদিওসের দাগেরোটাইপ। ‘দেখো কি ভাগ্যবতী আমি’, হাসতে হাসতে মরে যেতে যেতে চিৎকার করে, ‘চৌদ্দ বছর বয়সী পরদাদি।’ যখন এক রাজমিস্ত্রি বলে ওঠে যে বাড়ি ছেয়ে গেছে ভূত-প্রেতে আর ওদের তাড়ানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে মাটিতে পুঁতে রাখা গুপ্তধন খোঁজা, সে তখন উচ্চ হাসির সঙ্গে উত্তর দেয় যে সে পুরুষমানুষের কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না। সে এমনই স্বতঃস্ফূর্ত, এতটাই বাঁধনছাড়া, এতই মুক্ত ও আধুনিক মনের ছিল যে আউরেলিয়ানো ওকে আসতে দেখে ভেবে পায় না সে নিজেকে নিয়ে কী করবে। ‘কী অবাক কাণ্ড’, আনন্দে দুই বাহু ছড়িয়ে চিৎকার করে। ‘দেখো কত বড় হয়েছে আমার প্রাণীবিদ।’ আউরেলিয়ানো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া এক বহনযোগ্য গ্রামোফোনে রেকর্ড চাপিয়ে দেয় আর চেষ্টা করে হাল সময়ের নাচ শেখানোর। ওকে বাধ্য করে উত্তরাধিকারসূত্রে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার কাছ থেকে পাওয়া নোংরা প্যান্ট বদলাতে আর দেয় যুবকদের জামা ও দুই রঙের জুতো আর মেলকিয়াদেসের ঘরে অনেকক্ষণ কাটালে তাকে প্রায় জোর করে পাঠিয়ে দিত রাস্তায়।

উরসুলার মতোই কর্মঠ, ছোটখাটো অনমনীয় ছিল সে আর প্রায় রেমেদিওস লা বেইয়্যার মতোই ছিল সুন্দরী ও আকর্ষণীয় আর ফ্যাশন চালু হওয়ার আগেই তা অনুমান করার মতো এক বিরল গুণ ছিল তার। ডাকযোগে আসা হালফ্যাশনের ছবি দেখে সেগুলো শুধু আমারান্তার মান্ধাতা আমলের হাতে চালানো সেলাই মেশিন চালিয়ে কাপড় বানাত, সেগুলো যে হালফ্যাশন অনুযায়ী হয়েছে, সেটা প্রমাণ করা ছাড়া অন্য কোনো কাজে লাগত না। ইউরোপের অনেকগুলো ফ্যাশনের সাময়িকীর শিল্পকলাবিষয়ক প্রকাশনার ও সংগীতবিষয়ক পত্রিকার ক্রেতা সদস্যা ছিল সে, আরগুলোতে শুধু একবার চোখ বুলিয়েই সে বুঝতে পারত পৃথিবী সেভাবেই চলছে, যেভাবে সে অনুমান করছিল। তার মতো মানসিকতার অধিকারী এক মহিলা ধুলোবালি ও গরমে আক্রান্ত এক মৃত শহরে কেন ফিরে এসেছে, তা বোধের অতীত ছিল তা-ও আবার এমন এক স্বামীর সঙ্গে, যার কিনা পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় থাকার মতো প্রচুর টাকাপয়সা ছিল আর তাকে এত ভালোবাসত যে যেচেই নিজেকে বউয়ের কাছে সমর্পণ করেছে তাকে সিল্কের রশি দিয়ে টেনে বেড়াতে। তা সত্ত্বেও যতই সময় গড়াতে থাকে, ততই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার থেকে যাওয়ার ইচ্ছাটা স্থায়ী কিনা। কারণ সে এমন কোনো পরিকল্পনা হাতে নেয় না যা শেষ করতে প্রচুর সময় লাগবে, একই সঙ্গে এমন কিছু করত না যার পেছনে মাকন্দে আরামদায়ক ও শান্তিপূর্ণ শেষ বয়সটা কাটানোর লক্ষ্য থাকত না। ক্যানারিওর খাঁচা দেখেই বোঝা যায় যে এই সব উদ্দেশ্য আগে থেকেই ঠিক করা ছিল না। মার চিঠি থেকে জানতে পারা পক্ষীনিধনের কথা মনে রেখে মাসের পর মাস যাত্রা স্থগিত রাখে, যত দিন পর্যন্ত না সৌভাগ্যবানদের দ্বীপপুঞ্জ ছুঁয়ে আসা এক জাহাজ পাওয়া যায় আর সেখানেই মাকন্দের আকাশ ভরে দিতে সে বাছাই করে পঁচিশ জোড়া সবচেয়ে সুন্দর ক্যানারি। তার অগুনতি পণ্ড হওয়া উদ্যোগের মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে দুঃখজনক। পাখিগুলোর বাচ্চা বেড়ে ওঠার পর বাচ্চাগুলোকে জোড়ায় জোড়ায় ছেড়ে দিত আমারান্তা উরসুলা আর মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো যেত গ্রাম ছেড়ে। প্রথম সংস্কারের সময়ে উরসুলার তৈরি খাঁচাগুলোর প্রতি পাখিগুলোর ভালোবাসা জাগিয়ে তোলার তার প্রচেষ্টাও বিফল হয়। বিফলে পর্যবসিত হয় আলমন্ড গাছে এস্পারাতো ঘাসের তৈরি বাসাগুলো, বাড়ির ছাদে ছাদে ওদের খাবার জন্য ঘাসের বীজ ছড়িয়ে রাখা, খাঁচায় বন্দী পাখিগুলোকে উত্তেজিত করা, যাতে ওদের গান শুনে মুক্ত পাখিগুলো পালিয়ে যাওয়া থেকে নিরস্ত হয়। ওগুলো প্রথম সুযোগেই আকাশে এক পাক ঘুরে সৌভাগ্যবানদের দ্বীপপুঞ্জের দিকনির্ণয়ের সঙ্গে সঙ্গে উড়ে পালাতো।

যদিও ফিরে আসার এক বছর পার করেও আমারান্তা উরসুলা কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারে না, পারে না কোনো পার্টি দিতে, তার পরও সে বিশ্বাস করত যে দুর্ভাগ্য কর্তৃক বেছে নেওয়া এই সমাজটাকে উদ্ধার করা সম্ভব। ওর স্বামী গাস্তন বউয়ের মতের উল্টো মত দেওয়ার ব্যাপারে সাবধান থাকত, যদিও সেই হতচ্ছাড়া মধ্যাহ্নে ট্রেন থেকে নামার পরই সে বুঝে যায় যে তার বউয়ের এই সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে স্মৃতিকাতরতার মরীচিকা। বউকে বাস্তবতার কাছে পরাজিত হতেই হবে, এই স্থির বিশ্বাসে সে এমনকি ভেলসিপেদোটাও জোড়া লাগায় না, তার বদলে রাজমিস্ত্রিরা যেসব মাকড়সার জাল সরিয়ে ফেলছে, তার ভেতর থেকে সবচেয়ে ভালো ভালো ডিম খুঁজে নখ দিয়ে সেগুলো খুলে আতশ কাচ দিয়ে ওগুলোর মধ্য থেকে বের হওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাকড়ের দিকে তাকিয়ে থাকার পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটায়। আরও পরে, যদিও সে আকাশযান নিয়ে লেখাপড়া করেছে, তার পরও আমারান্তা উরসুলা হার না মেনে সংস্কারকাজ চালিয়ে যাবে, এই বিশ্বাসে সে এমন এক ভেলসিপেদো বানায়, যেটার সামনের চাকা ছিল পেছনেরটার চাইতে অনেক বড় আর নিজেকে উৎসর্গ করে আশপাশে থেকে পোকামাকড় ধরে শুকিয়ে ব্যবহৃত জ্যামের ছোট ছোট বয়ামে পুরে তার লিয়েহা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক ইতিহাসের প্রাক্তন শিক্ষকের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার কাজে, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে সে উচ্চতর পড়াশোনা করেছিল। যখন সে ভেলসিপেদো চালাত, তখন পরনে থাকত দড়াবাজদের আঁটো প্যান্ট, পাইপারদের মোজা, ডিটেক্টিভদের টুপি কিন্তু যখন পায়ে হাঁটত, তখন পরত ভাঁজহীন প্রাকৃতিক লিলেনের স্যুট, পায়ে সাদা জুতো, গলায় রেশমের বো টাই, মাথায় চ্যাপ্টা খড়ের টুপি আর সেই সঙ্গে হাতে উইলো কাঠের ছড়ি। ওর পাণ্ডুর দুটো চোখ ও কাঠবিড়ালির লোমের মতো গোঁফ আরও ফুটিয়ে তুলত চেহারায় নাবিক নাবিক ভাবটা। যদিও সে বউয়ের চাইতে অন্ততপক্ষে পনেরো বছরের বড় ছিল, তবু তার যুবকদের মতো পছন্দ, বউকে সুখে রাখার সংকল্প, ভালো প্রেমিকের গুণাবলি, ঘুচিয়ে দিয়েছে এই পার্থক্যটাকে। সত্যি বলতে কি, সতর্ক চালচলনের অধিকারী, গলায় রেশমের রশি ও সার্কাসের সাইকেল চালানো এই চল্লিশোর্ধ্ব লোকটিকে দেখলে কেউ মনেই করবে না যে সে তার যুবতী বউয়ের সঙ্গে লাগামহীন ভালোবাসার চুক্তিতে আবদ্ধ, ভাববেই না যে তারা দুজনেই পরস্পরকে উৎসর্গ করছে তাড়নার এক অভাবনীয় স্থানে, যেগুলো অবাক করে দেয় অনুপ্রেরণাকেও, যেমনটি করেছে তারা পরিচিতির শুরু থেকেই আর সময় পরিস্থিতির সঙ্গে এক আবেগ প্রতিনিয়তই সমৃদ্ধ হচ্ছে আরও গভীরতায় পৌঁছে। গাস্তন যে শুধু এক অন্তহীন কল্পনা ও বুদ্ধিসম্পন্ন আগ্রাসী প্রেমিক ছিল, তা-ই নয়, সেই সঙ্গে সম্ভবত মানব প্রজাতির ইতিহাসে সেই ছিল প্রথম নমুনা যে ভায়োলেট ক্ষেতে বিমানের জরুরি অবতরণ ঘটিয়ে প্রায় প্রেমিকাসহ নিজেকে মেরেই ফেলছিল আর সেটা করেছিল শুধু ভায়োলেট ক্ষেতে মিলনের উদ্দেশ্যে।

বিয়ের তিন বছর আগে দেখা হয়েছিল ওদের যখন গাস্তন ওর স্পোর্টস বাইপ্লেনটা নিয়ে আমারান্তা উরসুলার স্কুলের ওপর দিয়ে খেলা দেখাতে গিয়ে পতাকার খুঁটি এড়াতে এক কৌশল খাটাতে যায়। ফলে ক্যানভাস আর অ্যালুমিনিয়ামের আদিম কাঠামোর লেজের দিকটা ঝুলতে থাকে বৈদ্যুতিক তারে আটকে গিয়ে। সেই থেকে স্পি-টার বাঁধা পা’টাকে পাত্তা না দিয়ে সে প্রতি সপ্তাহান্তে আমরারাস্তা উরসুলাকে স্থানীয় স্পোর্টস ক্লাবে নেওয়ার জন্য ওর ধর্মীয় স্কুলে যেত, যে স্কুলের নিয়মকানুন ফের্নান্দার পছন্দানুযায়ী কড়া ছিল না। ওরা মিলতে শুরু করে মাটি থেকে পাঁচশত মিটার ওপর রোববারের বাতাসে বিস্তীর্ণ পতিত জমিগুলোর ওপর আর পৃথিবীর লোকজন যতই ছোট হয়ে আসত, ওরা ততই অনুভব করত মিলনের উত্তেজনা। আমারান্তা উরসুলা মাকন্দকে বর্ণনা করত পৃথিবীর সবচেয়ে উজ্জ্বল, সবচেয়ে আনন্দময় গ্রাম হিসেবে, যে গ্রামে রয়েছে এক বিশাল বাড়ি অরোগানো দিয়ে সুবাসিত, যেখানে সে এক বিশ্বস্ত স্বামীর সঙ্গে দুই সামর্থ্য ছেলে ও একটি মেয়ে নিয়ে বৃদ্ধা বয়স পর্যন্ত বাস করবে, যে ছেলেদের ডাকা হবে রদ্রিগো ও গনসালো নামে, কখনোই আউরেলিয়ানো ও হোসে আর্কাদিও নয় আর মেয়েটিকে ডাকা হবে বিরহিনিয়া নামে, কখনোই রেমেদিওস নামে নয়। স্মৃতিকাতরতার তাড়নায় গ্রামটা সম্বন্ধে তার তীব্র আকাঙ্ক্ষা এমনভাবে তুলে ধরে যে গাস্তন বুঝে গিয়েছিল যে মাকন্দে তাকে নিয়ে না গেলে আমারান্তা উরসুলা তাকে বিয়ে করবে না। সে একমত হয়ে যায় যেমনটি একমত হয় রেশমের রশির ব্যাপারেও, কারণ সে ভেবেছিল এটি হচ্ছে সাময়িক আবদার আর সময়কে ধোঁকা দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মাকন্দে যখন দুবছর কেটে যায় আর আমারান্তা উরসুলা প্রথম দিনের মতোই সুখী থেকে যায়, তখন তার টনক নড়তে শুরু করে। তত দিনে সে এলাকায় যত পোকামাকড় শুকানো সম্ভব ছিল, সবগুলোকেই সে শুকিয়ে ফেলেছে, এসপ্যানঞল বলছে স্থানীয়দের মতো, আর ডাকযোগে আসা সব ম্যাগাজিনের শব্দজটের সমাধান করে ফেলেছে। আবহাওয়া সম্বন্ধে তার এমন কোনো অনুযোগ ছিল না যেটাকে অজুহাত করে তারা ফিরে যেতে পারে, কারণ প্রকৃতি তাকে এমন এক ঔপনিবেশিক যকৃৎ উপহার দিয়েছে যে সে সিয়েস্তার ঝিমুনি ছাড়াই দিব্যি আছে আর এমনকি কীটভরা পানিও তার কিছু করতে পারে নি। স্থানীয় রান্না তার এতই পছন্দের ছিল যে সে একবার বসাতে বিরাশিটা ইগুয়ানার ডিমেভরা এক ঝুড়ি সাবাড় করে দেয়। অন্যদিকে আমারান্তা উরসুলা ট্রেনে করে আনাত বরফ দেওয়া বাক্সে মাছ ও সামুদ্রিক খাবার, ক্যানে ভরা মাংস ও সংরক্ষিত ফল, কারণ সে শুধু ওগুলোই খেতে পারত আর সে ইউরোপীয় কেতায় পোশাক ডিজাইন পেত ডাক মারফত, যদিও তার কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না বা কেউ ছিল না, যার সঙ্গে দেখা করতে বেরোতে পারে, এমনকি তার স্বামীও যখন তার খাটো পোশাক, বাঁকা টুপি বা সাতনরি হারের প্রশংসা করার উৎসাহ পেত না, তখন তার মনে হতো আনন্দে থাকার গোপন কথা হচ্ছে সব সময়ই কিছু একটা খুঁজে পেতে ব্যস্ত থাকা। সমাধান করত এমন সব গৃহস্থালি সমস্যার, যা সে নিজেই সৃষ্টি করেছিল, এমন কিছু ভুল কাজ সে করত, যা শোধরাত পরের দিনই আর সেগুলো সে এমন বিধ্বংসী অধ্যবসায়ের সঙ্গে করত যে মনে পড়ে যেত ফের্নান্দার কথা, যার কাছ থেকে সে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে এই বদভ্যাস। তার পার্টির আনন্দ গ্রহণে প্রতিভাটা তখনো এমন জাগ্রত ছিল যে যখন সে নতুন কোনো রেকর্ড পেত, গাস্তনকে আমন্ত্রণ করত বৈঠকখানায় অনেক রাত পর্যন্ত নাচার মকশো করার জন্য যে নাচগুলো তার স্কুলের বন্ধুরা বর্ণনা করে পাঠাত কাগজে এঁকে আর সে পর্বের শেষ হতো ভিয়েনার দোল চেয়ারের ওপর বা উদাম মেঝের ওপর মিলনের মাধ্যমে। সম্পূর্ণ সুখী হওয়ার জন্য আমারান্তা উরসুলার একমাত্র যা দরকার ছিল তা হলো ছেলেমেয়েদের জন্ম কিন্তু বিয়ের পাঁচ বছর পর্যন্ত বাচ্চা না নেওয়ার গাস্তনের সঙ্গে করা চুক্তির প্রতি সে বিশ্বস্ত থাকে।

অবসর সময়ে কিছু করে কাটানোর জন্য গাস্তন সকালটা কাটাত মেলকিয়াদেসের ঘরে লাজুক আউরেলিয়ানোর সঙ্গে। ওর সঙ্গে দুনিয়ার গোপনীয় সমস্ত কোনাঘুপচি উন্মোচন করাকে উপভোগ করতে শুরু করে সে যে কোনাঘুপচিগুলো আউরেলিয়ানো এমনভাবে চিনতে যেন সে ওখানে অনেক দিন ছিল। গাস্তন যখন প্রশ্ন করে যে সব তথ্য বিশ্বকোষে নেই, তা সে কীভাবে পেল, তখন হোসে আর্কাদিওর মতো একই জবাব পেল: ‘সবই জানা যায়।’ সংস্কৃত ছাড়াও আউরেলিয়ানো শিখেছিল ইংরেজি, ফরাসি। অল্পবিস্তর লাতিন ও গ্রিক। এ সময়ে যেহেতু সে প্রতি বিকেলে বাইরে বেরোত ও আমারান্তা উরসুলা প্রতি সপ্তাহে হাতখরচের জন্য নির্দিষ্ট একটা অঙ্কের টাকা ওকে দিত, ফলে ওর ঘরটাকে মনে হতো জ্ঞানী কাতালিয়নোর বইয়ের দোকানের এক শাখা। প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত পড়ত সে, যদিও পড়াশোনা সম্বন্ধে সে যেভাবে আলাপ করত, তাতে করে গাস্তনের মনে হতো শেখার জন্য নয়, বরং সে যা জানে, সেগুলোর সত্যতা প্রমাণের জন্যই সে বইগুলো কেনে আর পার্চমেন্টগুলো যেভাবে তাকে আকৃষ্ট করত, অন্য কোনো কিছুই ততটা করত না আর সকালের বেশির ভাগ সময় সে উৎসর্গ করত পার্চমেন্টগুলোর পেছনে। যেমন গাস্তন, তেমনি তার স্ত্রী তাকে পারিবারিক জীবনে জড়াতে চাইলেও আউরেলিয়ানো ছিল রহস্যাবৃত মানুষ, যার চারদিকে ঘেরা রহস্যের মেঘ প্রতিনিয়তই আরও ঘনীভূত হচ্ছিল। পরিস্থিতিটা এমনই দুর্লঙ্ঘ হয়ে পড়ে যে সময় কাটানোর জন্য গাস্তন অন্য পন্থা খুঁজে নিতে বাধ্য হয়। ওই সময়টাতেই বিমান ডাক চালুর চিন্তাটা তার মাথায় আসে।

প্রকল্পটা নতুন কিছু ছিল না। সত্যি বলতে কি, যখন তার আমারান্তা উরসুলার সঙ্গে পরিচয় হয়, তখন থেকেই কাজটা অনেক দূর এগিয়ে রাখা হয়েছিল, তবে সেটা মাকন্দের জন্য নয়, বরং বেলজীয় কঙ্গোর জন্য, যেখানে তার পরিবারের টাকা বিনিয়োগ করা আছে পাম অয়েলের ব্যবসাতে। বিয়ে আর বউকে খুশি করতে মাকন্দে কয়েক মাস থাকার সিদ্ধান্ত সেটাকে স্থগিত রাখতে বাধ্য করে। কিন্তু যখন দেখতে পায় জনগণের উন্নতির জন্য আমারান্তা উরসুলা এক মিটিংয়ের আয়োজনে ব্যস্ত আর ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনার ব্যাপারে ইঙ্গিত করাতে তা হেসে উড়িয়ে দেয়, তখন সে বুঝে যায়, এটা অনেক দূর পর্যন্ত গড়াবে আর সে কোনো প্রকল্পের পুরোধা হলে সেটা আফ্রিকায়ই হোক বা ক্যারিবীয় অঞ্চলেই হোক, সেটা একই কথা, এই চিন্তা করে ব্রাসেলসের এক বিস্মৃত অংশীদার বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করে। ব্যবসার কাগজপত্র তৈরি হওয়ার পাশাপাশি, সেই প্রাচীন জাদুময়ী বিস্তীর্ণ এলাকা, বর্তমানে যা পাথরে ভর্তি ফাটল ধরা সমভূমি, সেখানে এক অবতরণ ক্ষেত্র তৈরি করে আর গবেষণা করে বায়ুর প্রতি গতিবিধির ওপর, উপকূলীয় এলাকাটার ভৌগোলিক অবস্থা আর আকাশপথে চলাচলের সেরা পথগুলো। কিন্তু তার অজান্তেই এই গবেষণা চালাতে থাকে, যেটি ছিল হেবারট সাহেবের গবেষণার সঙ্গে এতই মিল যে গ্রামের লোকের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করে যে সে বিমান যাতায়াতের সময়সূচি নিয়ে কাজ করছে না, সে পরিকল্পনা করছে কলা লাগানোর।

এই প্রকল্পটা যে তার মাকন্দে থেকে যাওয়াটাকে অর্থবহ করে তুলতে পারে, এ কথা বুঝতে পেরে সে কয়েকবার প্রাদেশিক রাজধানীতে গিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবসার জন্য অনুমতিপত্র ও বিমান ডাকের নিরঙ্কুশ স্বত্বাধিকার পাওয়ার কাগজপত্র বানায়। অন্যদিকে ফের্নান্দার অদৃশ্য চিকিৎসকদের সঙ্গে পত্রবিনিময়ের মতো একইভাবে ব্রাসেলসের অংশীদারদের যোগাযোগ চালিয়ে তাদের সন্তুষ্টি অর্জন করে এক দক্ষ কারিগরের সঙ্গে প্রথম বিমানটা জাহাজযোগে নিকটতম বন্দরে পাঠিয়ে দেওয়ার, যে কারিগর বিমানটা জোড়া লাগিয়ে নিজেই উড়িয়ে নিয়ে আসবে মাকন্দে। আবহাওয়া সম্বন্ধে হিসাব-নিকাশ আরম্ভের এক বছর পর সে অংশীদারদের অঙ্গিকারে বিশ্বাস করে কখন বিমানটা উদয় হবে, এই আশায় আকাশের দিকে চোখ রেখে, বাতাসের শব্দে কান পেতে রাস্তায় পায়চারি করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।

যদিও আমারান্তা উরসুলা বুঝতে পারে নি, তবু তার প্রত্যাবর্তন আউরেলিয়ানোর জীবনে এক আমূল পরিবর্তনের সৃষ্টি করে। হোসে আর্কাদিওর মৃত্যুর পর সে কাতালিয়নোর দোকানের এক বাঁধা খদ্দের হয়ে গিয়েছিল। তা ছাড়া যে স্বাধীনতা তখন সে উপভোগ করত ও যে সময় সে ব্যায় করত, তাতে গ্রামটা সম্বন্ধে কৌতূহলের উদ্রেক হয় তার ভেতর আর গ্রামটার সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে বিস্ময়বোধহীনভাবে। ধুলোমলিন, নির্জন রাস্তাগুলো ধরে সে ঘুরে বেড়াত বৈজ্ঞানিকের আগ্রহ নিয়ে, পোড়োবাড়িগুলোর জানালার মরিচা ধরা শিকগুলো, মৃতপ্রায় পাখিগুলো ও স্মৃতির ভারে নত বাসিন্দাদের পরীক্ষা করতে। কল্পনা দিয়ে পুনরায় গড়ে তোলার চেষ্টা করত ধ্বংসপ্রাপ্ত জৌলুশে ভরা কলা কোম্পানির শহরটাকে, যার শুকনো চৌবাচ্চা তখন কানায় কানায় ভরা ছিল পুরুষদের জুতো ও মহিলাদের পচা চপ্পলে। সে শহরটার রাই ঘাসের কারণে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়িগুলোতে পায় এক জার্মান কুকুরের কঙ্কাল, তখনো লোহার শেকল দিয়ে বাঁধা, এক টেলিফোন বাজছে, বাজছে আর বেজেই চলছে যতক্ষণ পর্যন্ত না সে সেটা কানে লাগায় আর বুঝতে পারে এক দূরবর্তী দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মহিলা ইংরেজিতে প্রশ্ন করছে আর ও উত্তর দেয়, হ্যাঁ, ধর্মঘট শেষ হয়েছে, আর তিন হাজার মৃতদেহ ছুড়ে ফেলা হয়েছে সাগরে, কলা কোম্পানি চলে গিয়েছে, অবশেষে মাকন্দে অনেক বছর পর শান্তি ফিরে এসেছে। এই ঘোরাফেরাই ওকে নিয়ে যায় নিষিদ্ধ এলাকায়, যেখানে অন্য সময়ে টাকার তোড়া ওড়ানো হতো কুম্বিয়া নাচের আসরের মদদ জোগাতে। যখন রাস্তাগুলো ছিল অন্য সব রাস্তা থেকে করুণ, দুর্দশাগ্রস্ত গোলকধাঁধা, কিছু কিছু লালবাতি তখনো জ্বলছে, যেখানে পরিত্যক্ত নাচঘরগুলো নষ্ট ফুলের মালা দিয়ে সাজানো, যেখানে কখনোই বিয়ে করে নি এমন হাড়গিলে ও স্থূলকায় বিধবারা, ফরাসি রমণীদের পরদাদিরা তখনো অপেক্ষা করছে গ্রামোফোনের পাশে। সেখানে আউরেলিয়ানো এমন কাউকে পায় না, যার মনে আছে নিজের পরিবারের কথা, এমনকি কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার কথা, কেবল যার মনে আছে সে হচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বপ্রাচীন এক কালো বৃদ্ধের, যার তুলোভর্তি মাথা দেখলে ছবির নেগেটিভের কথা মনে পড়ে, যে বাড়ির সদর দরজায় বসে সূর্যাস্তের বেদনাবিধুর স্তব গেয়ে যাচ্ছে। আউরেলিয়ানো ওর সঙ্গে কথা বলত অল্প কয়েক সপ্তায় শেখা পাপিয়ামেন্তো ভাষায় আর মাঝেমধ্যে আউরেলিয়ানোকে ভাগ দিত তার নাতির মেয়ের হাতে রান্না করা মুরগির মাথার স্যুপের, যে মেয়েটা ছিল বিশালদেহী, কৃষ্ণকায়, শক্ত হাড়গোড়ওয়ালা, যার ঘোটকীর মতো পাছা, জ্যান্ত তরমুজের মতো স্তন, নিখুঁত গোল মাথাটা তারের মতো চুলের আবরণে ঘেরা, দেখলে মনে হয় মধ্যযুগের যোদ্ধাদের শিরস্ত্রাণ। ওর নাম নিগ্রোমান্তা। তখন আউরেলিয়ানো ছুরি, কাঁটাচামচ, মোমবাতি ও অন্য টুকিটাকি জিনিসপত্র বিক্রি করে বেঁচে আছে। যখন তার কাছে ফুটো পয়সাটাও থাকত না, যে রকমটি প্রায়ই ঘটত, সে বাজারের পেছনে চলে যেত, যেখানে ওকে মাগনা দিত আবর্জনায় ফেলার জন্য রাখা মুরগির মাথা, আর ও সেটা নিয়ে নিগ্রোমান্তাকে দিত, যাতে নোনতা শাক মিশিয়ে সেটাকে পরিমাণে বাড়ানো যায় ও পুঁদিনাপাতা মিশিয়ে সুবাসিত করা যায়। পরদাদার মৃত্যুর পর আউরেলিয়ানো ওখানে যাওয়া বন্ধ করে দিলেও প্লাজার কালো আলমন্ডের নিচে নিগ্রোমান্তাকে পেত, যেখানে মেয়েটা পাহাড়ি জন্তু আকৃষ্ট করার শিস বাজিয়ে বিরল নিশাচর প্রাণী ডেকে আনত। অনেকবারই তার সঙ্গী হতো সে, মুরগির মাথার স্যুপ ও অন্য দরিদ্রদের প্রিয় খাবার নিয়ে পাপিয়ামেন্তো ভাষায় কথা বলত আর সে হয়তো এভাবেই ওর সঙ্গে দেখা করত যদি না নিগ্রোমান্তা তাকে জানাত যে তার সাহচর্য খদ্দের তাড়িয়ে দেয়। প্রায়ই তার মনে কামভাব জাগে আর যদিও স্বয়ং নিগ্রোমান্তাকেই মনে হতে পারত তাদের ভাগ করে নেওয়া এক স্মৃতিকাতরতার স্বাভাবিক পরিণতি বলে, তার পরও সে তার সঙ্গে শুত না। ফলে আউরেলিয়ানো কুমারই থেকে যায় যখন আমারান্তা উরসুলা মাকন্দে ফিরে এসে ভগ্নিসুলভ আলিঙ্গন করে, যাতে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। যতবারই আমারান্তা উরসুলাকে দেখত, বিশেষ করে যখন তাকে হালফ্যাশনের নাচের পদক্ষেপ শিখাত, তখন সে হাড়ের মজ্জার মধ্যে অসহায়ত্বের আঁশ অনুভব করত, যেমনটি অনুভব করেছিল তার প্রপিতামহের বাবা গুদামের ভেতর পিলার তেরনেবার তাসের অজুহাতের সময়। এই যন্ত্রণাকে গলাটিপে মারার জন্য সে পার্চমেন্টগুলোর আরও গভীরে ডুব দেয়, আর এড়িয়ে যায় তার সেই খালার নির্দোষ তোষামোদ, যে খালা বিষিয়ে দিয়েছিল তার রাতগুলোকে দুর্দশার বাষ্প দিয়ে, আর যতই সে এড়িয়ে যেত, ততই আরও বেশি উৎকণ্ঠার সঙ্গে অপেক্ষা করত তার যন্ত্রণাময় হাসির জন্য, তার সুখী বিড়ালের ডাক আর তার কৃতজ্ঞতাময় গানের জন্য, অপেক্ষা করত প্রণয়জ্বরে খাবি খেতে খেতে যেকোনো সময় বাড়ির অসম্ভব অসম্ভব জায়গায়। এক রাতে ওর বিছানা থেকে দশ মিটার দূরত্বে রৌপ্যশালায় উন্মত্ত তলপেটের অধিকারী দম্পতিটি বোতলের আলমারি তছনছ করে শেষ পর্যন্ত মিউরেটিক অ্যাসিডের ছোট্ট পুকুরের মধ্যে প্রণয়ে লিপ্ত হয়। আউরেলিয়ানো শুধু যে এক মিনিটও ঘুমাতে পারে নি তা-ই নয়, পরের দিনটি তার কাটে জ্বরে ভুগে, প্রচণ্ড ক্রোধে ফোঁপাতে ফোঁপাতে। তার কাছে অনন্তকাল মনে হয় সেই রাত আসার অপেক্ষাটাকে, যে রাতে প্রথমবারের মতো সে অপেক্ষা করে আলমন্ড গাছের নিচে নিগ্রোমান্তার জন্য, অনিশ্চয়তার শীতল কাঁটায় বিদ্ধ হয়ে মুঠির মধ্যে আমারাত্তা উরসুলার কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া এক পেসো পঞ্চাশ সেন্ট চেপে ধরে আর পয়সাটা সে নিয়েছিল প্রয়োজনের খাতিরে নয়, বরং ব্যাপারটাকে জটিল করতে, আমারাস্তা উরসুলাকে জড়াতে, ওকে হীন করতে, তার অভিযানের সঙ্গে কোনোভাবে সঙ্গী করতে। নিগ্রোমান্তা ওকে নকল মোমবাতি দিয়ে আলোকিত ঘরে ভাঁজ করা খাটে নিয়ে যায়, যে খাটের বিছানা, খারাপ ভালোবাসার দ্বারা নোংরা আর নিয়ে যায় তার বুনো কুকুরীর অনুভূতিশূন্য আত্মাবিহীন শরীরটার মধ্যে, যেটা তৈরি হয়ে ছিল আতঙ্কগ্রস্ত এক শিশুকে বুঝ দিয়ে বিদায় করতে, কিন্তু খুব দ্রুতই সে আবিষ্কার করে এক পুরুষকে যার প্রচণ্ড শক্তির দাবিতে তার দরকার হয় অস্ত্রের মধ্যে এক ভূমিকম্পনজনিত পুনর্বিন্যাস।

প্রণয়ে বাঁধা পড়ে ওরা। আউরেলিয়ানো সকালটা কাটাত পার্চমেন্টের অর্থোদ্ধারে আর দুপুরে সিয়েস্তার সময় চলে যেত নিদ্রা-উদ্রেককারী ঘরে, যেখানে নিগ্রোমান্তা অপেক্ষা করত কী করে কেঁচোর মতো, পরে শামুকের মতো আর সর্বশেষে কাঁকড়ার মতো করে করতে হয় তা শেখাতে, যতক্ষণ না আউরেলিয়ানোকে ত্যাগ করতে হতো অন্যদের হারানো প্রণয়ের খোরাক হতে। ওর কোমরে চারদিকে চিকন এক বন্ধনী ছিল যেটাকে চেলোর (বাদ্যযন্ত্র) তার দিয়ে তৈরি বলে মনে হলেও সেটা ছিল ইস্পাতের মতো শক্ত আর যেটার কোনো আগা বা মাথা ছিল না, কারণ, সে ওটা নিয়েই জন্মেছে ও বড় হয়েছে আর এটাকে আবিষ্কার করতে আউরেলিয়ানোর কয়েক সপ্তাহ লেগে যায়। প্রায় সব সময়ই সংগম ও সংগমের মাঝে দমবন্ধ গরমে, দস্তার চালে মরিচার কারণে জ্বলজ্বল করা দিবাকালীন নক্ষত্রের নিচে ওরা খেত বিছানায় বসে। এই প্রথমবার নিগ্রোমান্তা পায় এক বাঁধা মানুষ, এক হাড়গোড় পিষে ফেলার লোক। দমফাটানো হাসিতে ফেটে পড়তে পড়তে সে বলেছিল, এমনকি সে স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছিল ওকে নিয়ে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে শোনে আমারান্তা উরসুলার ব্যাপার আউরেলিয়ানোর অবদমিত প্রবল আসক্তির স্বীকারোক্তি; আসক্তিমুক্তির উপায় হিসেবে আউরেলিয়ানো তার কাছে এসেছিল আর তার প্রণয় অভিজ্ঞতার দিগন্ত প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই যন্ত্রণা তার ভেতরে বেড়েই চলছে আর তখন নিগ্রোমান্তা ওকে আগের মতোই গ্রহণ করত কিন্তু তার কাছ থেকে এতই কড়াকড়িভাবে পারিশ্রমিক গ্রহণ করত যে আউরেলিয়ানোর কাছে পয়সা না থাকলে সেটাকে সে অঙ্কে লিখে রাখার বদলে বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে দরজার পেছনে এক দাগ কেটে তার হিসাব রাখত। রাতে সে যখন প্লাজার ছায়ার মধ্যে ভেসে বেড়াত, আউরেলিয়ানো তখন এক অপরিচিত লোকের মতো বারান্দা থেকে শুভেচ্ছা বিনিময় করত আমারান্তা উরসুলা ও গাস্তনের সঙ্গে, যারা সচরাচর বাড়িতেই রাতের খাবার খেত, আর নিজেকে ঘরবন্দী করে ফেলত কিন্তু সে কিছুই পড়তে, লিখতে এমনকি চিন্তাও করতে পারত না ব্যাকুলতার কারণে, যে ব্যাকুলতা আসত রাতকে গ্রাস করে ফেলা হাসি, ফিসফিসানি, প্রথম দিকের উত্তেজনার হুটোপুটি, পরে প্রণয়কাতর সুখের বিস্ফোরণ থেকে। গাস্তন উড়োজাহাজের জন্য অপেক্ষা আরম্ভ করার পূর্বের দুই বছর যাবৎ এটাই ছিল তার জীবন আর এভাবেই চলতে থাকত যদি না সে একদিন, যেদিন সে কাতালিয়নোর দোকানে গিয়ে চারটি বাগাড়ম্বর ছেলেকে পায়, যারা তর্ক করছে, উত্তপ্ত বিতর্কে লিপ্ত হয়েছে মধ্যযুগে কীভাবে আরশোলা মারা হতো, এই নিয়ে। বৃদ্ধ বইবিক্রেতা আউরেলিয়ানো যে শুধু আসক্তির কারণে বেদা এন ভেনেরাবলে ‘(মধ্যযুগীয় ৬৭৩-৭৩৫ সালের এক সাধু পুরুষের লিখিত বই) পড়ে সে কথা জানা থাকায় একরকম পিতৃসুলভ বিদ্বেষ থেকে তাকে জোর করে আলোচনায় ঢোকার জন্য, আর সে এমনকি নিশ্বাসও নেয় না বলার জন্য যে আরশোলা দুনিয়ার প্রাচীনতম ডানাওয়ালা পতঙ্গ, সেই ওল্ড টেস্টামেন্টের সময় থেকে চটিজুতোর আক্রমণের শিকার হতো, কিন্তু যেহেতু প্রজাতিটি যেকোনো ধরনের নিধনের প্রচেষ্টা রোধক, সেহেতু সোহাগামাখা টমেটোর টুকরো থেকে শুরু করে ময়দার সঙ্গে চিনির মতো মানবজাতির জন্য লগ্ন থেকে করা নির্দয় ক্ষমাহীন এক হাজার ছয়শত তিনটি বিভিন্ন প্রচেষ্টা সাফল্যের সঙ্গে রুখে দিয়েছে, আর এমনকি যেমন বলা যায় যে বংশবৃদ্ধি হচ্ছে মানবজাতির বৈশিষ্ট্য, তেমনি আর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আরশোলা মারার প্রবৃত্তি, আর মানুষের এই হিংস্রতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কারণেই ওরা আশ্রয় নিয়েছিল ছায়ান্ধকারে, যেখানে অন্ধকার সম্বন্ধে মানুষের জন্মগত ভীতিই ওগুলোকে করেছিল অবধ্য। কিন্তু অন্যদিকে সংবেদনশীল হয়ে পরে মধ্যদিনে রোদের ব্যাপারে আর ‘এদাদ মেদিয়া’ (EDAD MEDIA—পৃথিবীর প্রাচীনতম বই যখন হরফের প্রচলন ছিল না) বই অনুযায়ী শতাব্দীর পর শতাব্দী আরশোলা নিধনের একমাত্র সফল পদ্ধতি হচ্ছে প্রখর সূর্যালোক।

এই বিশ্বকোষীয় কাকতালীয় ঘটনটা হয়েছিল এক বিরাট বন্ধুত্বের সূত্রপাত। আউরেলিয়ানো প্রতি বিকেলে চার তর্কবাগীশের সঙ্গে দেখা করতে থাকে, যাদের নাম ছিল আলভারো, হেরমান, আলফনসো আর গাব্রিয়েল আর ওরাই ছিল তার জীবনের প্রথম ও শেষ বন্ধু। এক লিখিত বাস্তবতায় বন্দী ওর মতো পুরুষের জন্য বিকেল ছটায় বইয়ের দোকানে শুরু হয়ে, ভোর রাত্রিতে বেশ্যালয়ে শেষ হওয়া দিনগুলো ছিল এক নতুন উন্মোচন। মানুষকে ঠাট্টা করার জন্য সবচেয়ে ভালো আবিষ্কৃত খেলনা হচ্ছে সাহিত্য, এ কথাটা কখনোই তার চিন্তায় আসে নি। জ্ঞানী কাতালিয়নোর উদাহরণগুলোর উৎস ছিল খামখেয়ালিতে ভরা, যে নাকি মনে করত যদি কোনো জ্ঞান ছোলা রান্না করার কাজে না লাগে, তাহলে সে জ্ঞানের কোনো দামই নেই আর এ ব্যাপারটা আবিষ্কার করতে আউরেলিয়ানোর বেশ কিছু সময় লাগবে।

যে বিকেলে আউরেলিয়ানো আরশোলা সম্বন্ধে বলেছিল, সেদিন বিতর্কটা শেষ হয় সেই মেয়েদের বাড়িতে যারা পেটের দায়ে শুত, শেষ হয় এক মাকন্দের প্রান্তে এক মিথ্যের বেশ্যালয়ে। মালকিন ছিল হাসিখুশি মামাসান্তা, যার দরজা খোলা ও বন্ধের বাতিক আছে। মনে হয় তার সার্বক্ষণিক হাসিটার উৎস হচ্ছে খদ্দেরদের বিশ্বাসপ্রবণতা আর এমন এক স্থাপনাকে তারা বাস্তব বলে স্বীকার করেছে, যার অস্তিত্ব কল্পনা ব্যতিরেকে অন্য কোথাও নেই: বসার সঙ্গে সঙ্গে আসবাবপত্র ধসে পড়ত, ভাঙাচোরা গ্রামোফোনের মধ্যে এক মুরগি ডিমে তা দিত, বাগানের ফুলগুলো ছিল কাগজের, দিনপঞ্জিগুলো ছিল কলা কোম্পানির আসারও আগেকার, কেটে বাঁধাই করা প্রিন্টগুলো নেওয়া ছিল অপ্রকাশিত সাময়িকী থেকে। এমনকি আশপাশের পাড়াগুলো থেকে মালকিনের ডাক পেয়ে আসা লাজুক কমবয়সী বেশ্যারা পর্যন্ত ছিল কল্পনাপ্রসূত। ওরা হাজির হতো কোনো সম্ভাষণ ছাড়া, পাঁচ বছর আগেকার ছোট ফুলতোলা পোশাক পরে আর সেই পোশাক তারা খুলে ফেলত সেই রকমের সরলতা নিয়ে, যে সরলতা নিয়ে তারা ওগুলো পরেছিল আর যৌন উত্তেজনার চরম মুহূর্তে আশ্চর্য হয়ে চিৎকার করে উঠত, দেখো ছাদটা কীভাবে ভেঙে পড়ছে বলে আর যখনই পাওনা এক পেসো পঞ্চাশ সেন্ট পেয়ে যেত, সেটা খরচ করে ফেলত রুটি ও একটুকরো পনিরের পেছনে, যা বিক্রি করত মালকিন নিজেই এ পর্যন্ত হাসাহাসির মধ্যে সব থেকে ভালো হাসিটা উপহার দিয়ে, কারণ একমাত্র সেই জানত যে এমনকি এই খাবারটাও বাস্তব নয়। আউরেলিয়ানো, যার দুনিয়াটা তখন শুরু হতো মেলকিয়াদেসের পার্চমেন্ট দিয়ে আর শেষ হতো নিগ্রোমান্তার বিছানায়, সে এই কাল্পনিক বেশ্যালয়ে পেয়ে যায় তার ভীরুতা মোচনের উপায়। গোড়ার দিকে কিছুতেই ব্যাপারটাকে বাগে আনতে পারত না; কোনো কোনো কক্ষে মালকিন সংগমের চরম মুহূর্তে ঢুকে পড়ে অংশগ্রহণকারীদের লজ্জাজনক বিষয়গুলো নিয়ে সব ধরনের মন্তব্য করত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে জগতের ওই সব বিপত্তির ব্যাপারে এতই পটু হয়ে ওঠে যে অন্যান্য রাতের চেয়ে বেশি বিশৃঙ্খল এক রাতে বৈঠকখানায় নগ্ন হয় আর তার ধারণাতীত পুরুষাঙ্গের ওপর বিয়ারের বোতল বসিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে করতে বাড়ি ঘুরে আসে এসব উচ্ছৃঙ্খল খামখেয়ালি ব্যাপারগুলোকে ফ্যাশানে পরিণত করে সে-ই আর মালকিনও তার চিরন্তন হাসিসহকারে ওগুলো বিশ্বাস না করেও কোনো আপত্তি না করে উপভোগ করে চলে আর যখন হেরমান বাড়িটার অস্তিত্ব নাই, তা প্রমাণ করতে বাড়িটা পুড়িয়ে ফেলতে চেষ্টা করে বা আলফনস যখন টিয়ার ঘাড় মটকে কেবল বলগ দিতে শুরু করা মুরগির সানকচোর (স্যুপ) মধ্যে ফেলে দেয়, তখনো সে সবকিছু একইভাবে উপভোগ করে।

আউরেলিয়ানো যদিও একই রকমের প্রীতি ও ঐক্যের বন্ধনে চারজনের সঙ্গে বাধা মনে করে আর সেটা এমন বন্ধন যে যেন সবাই মিলে একজন, তার পরও গাব্রিয়েলই ছিল ওদের মধ্যে তার সব থেকে কাছের জন। এই ঘনিষ্ঠতাটা তৈরি হয় যেদিন কাকতালীয়ভাবে সে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার কথা উল্লেখ করে আর তখন একমাত্র গাব্রিয়েলই মনে করে যে সে কাউকে নিয়ে ঠাট্টা করছে না। এমনকি মালকিন, যে নাকি ওদের আলোচনায় বাগড়া দিত না, সে পর্যন্ত এক রাগান্বিত দাইয়ের উত্তেজনা নিয়ে বলে যে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া, যার কথা সত্যিই একবার সে শুনেছিল, যে ছিল উদারপন্থীদের মারার ছুতো হিসেবে বানানো সরকারের এক চরিত্র। অন্যদিকে গাব্রিয়েল কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার ঘটনার বাস্তবতা সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ প্রকাশ করে না, কারণ তার প্রপিতামহের বাবা কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস ছিল তার অবিচ্ছেদ্য বন্ধু ও সহযোদ্ধা। ওই সব স্মৃতির অস্থিরমতি চালচলনের ফলে শ্রমিক হত্যার প্রসঙ্গে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ে। যতবারই আউরেলিয়ানো প্রসঙ্গটা ওঠাত, ততবারই শুধু মালকিনই নয়, যারা তার চেয়েও বেশি বয়সী, যারা স্টেশনে ঘেরাও শ্রমিক হত্যার মতো বানোয়াট ঘটনার নিন্দা করত, নিন্দা করত দুই শ ওয়াগন ভর্তি মৃতের কথা, এমনকি তারাও জোর দিয়ে বলে যে সবকিছুই বৈধ কাগজপত্র ও প্রাইমারি স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে লেখা আছে: কখনোই কলা কোম্পানির কোনো অস্তিত্বই ছিল না। ফলে আউরেলিয়ানোর মধ্যে তার সঙ্গে যোগসাজশ তৈরি হয় এমন এক বাস্তবতার ভিত্তির ওপর যেটাকে কেউ বিশ্বাস করত না। আর ব্যাপারটা ওদের জীবনকে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে দুজনেই নিজেদের আবিষ্কার করে পথভ্রষ্ট এক হারানো পৃথিবীতে, যে পৃথিবীর অস্তিত্ব রয়েছে শুধু স্মৃতিকাতরতায়। যেখানেই ঘুম আসত, গাব্রিয়েল ঘুমিয়ে যেত সেখানেই। আউরেলিয়ানো ওকে বেশ কয়েকবার রৌপ্যশালায় বিছানা করে দেয়, কিন্তু শোবার ঘরগুলোতে মৃতদের পায়চারির জ্বালায় অস্থির হয়ে সে রাতগুলো জেগেই কাটাত। এরপর ওর ভার ছেড়ে দেয় নিগ্রোমান্তার ওপর, যে দরজার পেছনে নখ দিয়ে খাড়া খাড়া দাগ দিয়ে তার দেনার হিসাব রাখত, সামান্য যতটুকু জায়গা বাকি ছিল আউরেলিয়ানোর দেনার পাশে।

যদিও জীবন ছিল তখন অসংলগ্ন, তার পরও কাতালানিয়োর প্রেরণায় স্থায়ী কিছু একটা করতে চাইত। ও-ই ছিল সেই লোক, যার মধ্যে প্রাচীন ধ্রুপদি সাহিত্যের অধ্যাপকের অভিজ্ঞতা ও তার বিরল বইয়ের ভান্ডার ওদের বাধ্য করেছিল গোটা এক রাত ধরে সাঁইত্রিশতম নাটকীয় অবস্থার খোঁজ করতে এমন এক গ্রামে, যে গ্রামের কারোরই প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর উৎসাহ বা সম্ভাবনা কিছুই ছিল না। বন্ধুত্বের ব্যাপারটাতে সম্মোহিত ও ফের্নান্দার হীনতার নিষিদ্ধ জগতের জাদুতে আবিষ্ট আউরেলিয়ানো পার্চমেন্ট নিয়ে গবেষণা ছেড়ে দেয়, ঠিক সেই সময়ে যখন নিজেকে আবিষ্কার করছিল পদ্যের চরণে লেখা সাংকেতিক ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে। কিন্তু পরে যখন বুঝতে পারে বেশ্যালয় ত্যাগ না করেও সবকিছুর জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়, তখন মেলকিয়াদেসের কামরায় ফিরে আসার উৎসাহ পায় আর সিদ্ধান্ত নেয় শেষ সূত্র আবিষ্কার করা পর্যন্ত খেটে যাওয়ার। তখন ছিল সেই সময় যখন গাস্তন বিমানের আসার অপেক্ষা শুরু করে আর আমারান্তা উরসুলা এতই নিঃসঙ্গ বোধ করতে থাকে যে এক সকালে হাজির হয় কামরাটাতে।

‘এই মানুষখেকো’, বলে ওকে, ‘আবার গুহায় ফিরেছিস।’

নিজ হাতে ডিজাইন করে তৈরি করা পোশাক ও সাবালো মাছের মেরুদণ্ডের কাটা দিয়ে বানানো লম্বা গলার হার ওকে করে তুলেছিল অপ্রতিরোধ্য। স্বামীর বিশ্বস্ততায় নিঃসন্দেহ হয়ে রশি ত্যাগ করেছে সে আর মনে হয় ফেরার পর এই প্রথমবারের মতো একটু স্বস্তিবোধ করছে। তার উপস্থিতি টের পেতে আউরেলিয়ানোকে তাকাতে হয় না। কাজের টেবিলের ওপর কনুই রেখে সে এতই ঘনিষ্ঠ, এতই প্রতিরোধবিহীনভাবে দাঁড়ায় যে আউরেলিয়ানো তার অন্তস্তলের হাড়ের শব্দ পর্যন্ত অনুভব করে আর আমারান্তা উরসুলা পার্চমেন্টের ব্যাপারে উৎসাহ দেখায়। আউরেলিয়ানো নিজের অস্বস্তিকে জয় করতে, পালিয়ে যেতে প্রস্তুত স্বরকে পাকড়াও করে, পাকড়াও করে পরানটাকে যখন সেটা চলে যেতে চাচ্ছিল, আঁকড়ে ধরে স্মৃতিকে, যা পরিণত হচ্ছিল পচা জেলি ফিশে, আর কথা বলে সংস্কৃত ভাষার যাজকীয় পরিণতি নিয়ে সময়ের স্বচ্ছতার ভেতর দিয়ে ভবিষ্যৎ দেখার বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা নিয়ে, যেমনটি পড়া যায় আলোর সামনে কাগজ ধরলে, কথা বলে যায়, ভবিষ্যদ্বাণীগুলো যাতে নিজেরাই নিজেদের কাছে পরাজিত না হয়, তার জন্য ওগুলোর অর্থোদ্ধারে প্রয়োজনীয়তা নিয়ে, নস্ত্রাদামুসের শতাব্দী নামের বইগুলো ও সাধু মিয়্যান করা ভবিষ্যদ্বাণী মোতাবেক কান্তাব্রিয়ার ধ্বংস নিয়ে। হঠাৎ করেই জন্মলগ্ন থেকে ওর ভেতরে থাকা ঘুমন্ত কামনার ধাক্কায় ও নড়ে ওঠে, কথা বলায় কোনো বিরতি না দিয়ে আউরেলিয়ানো ওর হাতে হাত রাখে এই বিশ্বাসে যে তার চূড়ান্ত এই সিদ্ধান্তটা সমস্ত দুশ্চিন্তার অবসান ঘটাবে। আমারান্তা উরসুলা অবশ্য শৈশবে যেমনটি করত, তেমনি সারল্যে ভরা স্নেহ নিয়ে ওর তর্জনীটা ধরে আর ধরে রাখে যতক্ষণ পর্যন্ত আউরেলিয়ানো ওর প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিল। ওভাবেই থাকে তারা বরফশীতল তর্জনীর বন্ধনে বাঁধা পড়ে যে বন্ধনী কোনো অনুভূতির আদান-প্রদান করে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমারান্তা উরসুলা তার মুহূর্তকালীন স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠে আর নিজের কপালে চাপড় মারে। ‘পিঁপড়া’ আঁতকে ওঠে বলে। তার ফলে সে ভুলে যায় পাণ্ডুলিপির কথা, পরে নাচের ছন্দে এক পা ফেলে দরজার কাছ থেকে আঙুলের ডগা দিয়ে আউরেলিয়ানোর দিকে চুমো ছুড়ে দেয় যেমনটি ওর বাবা দিয়েছিল ব্রাসেলসে যাওয়ার বিকেলে।

‘ওসব আমাকে পরে বলিস’, বলে, ‘আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে আজ হচ্ছে পিঁপড়ের বাসায় চুন দেওয়ার দিন।’

যখন তার স্বামী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আকাশ দেখায় ব্যস্ত আর ওদিকটাতে তার কিছু করার থাকত, তখন মাঝেমধ্যে ঘরটাতে ঢুকত সে, থাকত অল্প সময়ের জন্য। অন্যদিকে এই পরিবর্তনে আশাবাদী আউরেলিয়ানো পরিবারের সঙ্গে খাওয়ার জন্য থেকে যেতে শুরু করে, যেমনটি আমারান্তা উরসুলার ফেরার প্রথম মাসগুলোতে সে খেত না। গাস্তন খুশি হয় এতে। খাবার টেবিলের কথাবার্তায়, যা নাকি এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলত, গাস্তন আক্ষেপ করে যে তার অংশীদাররা তাকে ধোঁকা দিচ্ছে। ওরা তাকে জানিয়েছে এমন এক জাহাজের নাম, যেটাতে বিমানটাকে তুলে দিয়েছে কিন্তু এসে পৌঁছাচ্ছে না আর যদিও তার শিপিং এজেন্ট জোর দিয়ে জানিয়েছে যে জাহাজটা কোনো দিনও পৌঁছাবে না, কারণ ক্যারিবীয় জাহাজের তালিকাতে নামটা নেই, তবু অংশীদাররা নিশ্চিত করে জানাচ্ছে যে জাহাজীকরণে কোনো ভুল নেই, এমনকি ইঙ্গিতেও গাস্তনের চিঠিতে মিথ্যের সম্ভাবনার কথাও জানিয়েছে। এই চিঠি চালাচালির পারস্পরিক সন্দেহের এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে গাস্তন ঠিক করে আর চিঠি না লিখতে আর ভাবতে শুরু করে শিগগিরই ব্রাসেলসে গিয়ে ব্যাপারটার ফয়সালা করে বিমান নিয়ে ফেরার সম্ভাবনার কথা। অবশ্য আমারান্তা উরসুলা যখন জানায় যে সে স্বামী খোয়াতেও রাজি কিন্তু মাকন্দ ছেড়ে কোথাও যাবে না, তখন এই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। প্রথম দিকে অন্যদের মতোই গাস্তনকে ভেলোসিপিদোর ওপরে সওয়ার এক গাধা বলে ভাবত আউরেলিয়ানো আর এ ব্যাপারটাতে ওর প্রতি সামান্য একধরনের করুণারও জন্ম নেয়। পরে বেশ্যালয়ে গিয়ে পুরুষমানুষের চরিত্র সম্বন্ধে যখন আরও গভীর জ্ঞান লাভ করে, তখন মনে করে গাস্তনের এই গাধামির মূলে রয়েছে বন্য কামাবেগ। কিন্তু যখন তাকে ভালো করে চিনতে পারে, তখন উপলব্ধি করে যে তার সত্যিকার চরিত্র হচ্ছে তার বাধ্যগত আচার-আচরণের উল্টো আর তার মনে এক বিদ্বেষপ্রসূত সন্দেহ জাগে যে হয়তোবা, এমনকি এ উড়োজাহাজের জন্য অপেক্ষাটাও হয়তোবা মিথ্যে ভান। ফলে ভাবে, গাস্তন অত বোকা নয়, যেমনটি বাহ্যিকভাবে তাকে দেখা যায়, বরং তার উল্টো, সে হচ্ছে একনিষ্ঠ অসীম সক্ষমতা ও ধৈর্যশীল এক ব্যক্তি যে নাকি নিজের স্ত্রীকে বশ করতে চায় সব সময়ই তাকে সন্তুষ্টি দিয়ে, কখনোই নেতিবাচক কিছু না বলে, অন্তহীন আত্মসন্তুষ্টির ভান করে নিজের বানানো জালে নিজেকেই জড়িয়ে পড়তে দিয়ে, সেই দিন পর্যন্ত যেদিন সে নিজেই নিজের মোহের একঘেয়েমিকে আর সহ্য না করতে পেরে নিজেই বাক্সপেটরা বাঁধবে ইউরোপে ফেরার জন্য। আউরেলিয়ানোর পূর্বেকার করুণা রূপান্তরিত হয় এক হিংস্র বিদ্রোহে। গাস্তনের পদ্ধতিটা একই সঙ্গে তার কাছে এতই বিকৃত ও কার্যকরী বলে মনে হয় যে, আমারান্তা উরসুলাকে সাবধান করার মতো সাহস দেখায় সে। আমারান্তা উরসুলা অবশ্য তার ভেতরের ভালোবাসার মর্মজ্বালার ভার, অনিশ্চয়তা বা ঈর্ষার কথা খেয়াল না করে ওর সন্দেহ নিয়ে ব্যঙ্গ করে। ওর মাথায় কখনোই আসে না যে আউরেলিয়ানোর মধ্যে ভ্রাতৃপ্রতিম ভালোবাসার চেয়েও বেশি কিছুর কারণ হয়েছে, সে যত দিন পর্যন্ত না একবার পিচ ফলের ক্যান খুলতে গিয়ে খোঁচা খেয়ে আঙুলে রক্ত বেরোলে সেটা চুষে নেওয়ার জন্য যে দ্রুততার আগ্রহ ও অনুরক্তির সঙ্গে আউরেলিয়ানো ওর দিকে এগোয় যে এতে করে ওর গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যায়।

‘আউরেলিয়ানো’ অনিশ্চয়তার হাসি হাসে, ‘ভালো এক বাদুড় হওয়ার জন্য তুই খুবই দুষ্ট।’

আউরেলিয়ানোর সমস্ত আবেগ উপচে পড়ে তখন। ওর হাতের তালুতে ছোট ছোট চুমু দিয়ে হৃদয়ের নিভৃততম কক্ষের আগল খুলে দেয় আর বের করে আনে এক অসীম ক্ষতবিক্ষত অন্ত্রকে আর সেই ভয়ংকর পরজীবী জন্তুটাকে, যেটাকে লালন করেছে সে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে। আমারান্তা উরসুলাকে বলে কীভাবে সে সান্ত্বনাহীন কান্নার জন্য জেগে উঠত মাঝরাতে, আর সেই রাগ ঢালত তার শুকোতে দেওয়া অন্তর্বাসের ওপর। তাকে বলে কত উৎকণ্ঠা নিয়ে সে নিগ্রোমান্তাকে বলত বিড়ালের মতো শীৎকার করতে আর তার কানে গাস্তন, গাস্তন, গাস্তন বলে ফোঁপাতে আর কতটুকু চালাকি করে সে আমারান্তা উরসুলার সুগন্ধি বোতল তছনছ করে, যাতে করে পেটের দায়ে শোয়া ছোট মেয়েদের ঘাড়ে সে ওই গন্ধ পায়। এই উগরে দেওয়া আবেগে ভয় পেয়ে আমারান্তা উরসুলা আঙুল গোটাতে শুরু করে, গোটাতে থাকে শামুকের মতো যতক্ষণ পর্যন্ত না তার হাতব্যথা ও সব রকমের করুণা মুক্ত হয়ে পান্না, পোখরাজ ও পাথুরে হাড়ের এক অনুভূতিশূন্য এক পিণ্ড হয়ে ওঠে

‘গাধা’, যেন থুতু ছিটাচ্ছে এমনভাবে বলে’, প্রথম জাহাজেই বেলজিয়াম যাচ্ছি আমি।’

এ রকম এক বিকেলে, বিজ্ঞ কাতালিয়নোর বইয়ের দোকানে আসে আলভারো তার সাম্প্রতিক আবিষ্কারের কথা চিৎকার করতে করতে, ‘এক চিড়িয়াখানার বেশ্যাপাড়া’, ওটার নাম ছিল স্বর্ণালি শিশু আর ওটা ছিল উন্মুক্ত বিশাল কক্ষ, যার ভেতর দিয়ে কমপক্ষে দুই শ বক উড়তে উড়তে সময় ঘোষণা করে কান ঝালাপালা করা কক কক শব্দে। নাচের মঞ্চ ঘিরে থাকা তারের খোঁয়াড়ের ও আমাজনীয় কামেলিয়ার মাঝে ছিল রংবেরঙের সারস, তেলতেলে শূকরের মতো বিশাল কুমির, লেজে বারোটি বলয়সহ র‍্যাটল স্নেক আর সোনালি খোলসের এক কচ্ছপ, যেটা ছোট্ট এক মহাসাগরে ডুব দিত। ছিল এক পোষমানা কথা শোনা বিশাল এক ধবল কুকুর, যেটা প্রজননের কাজ করত, যাতে ওটাকে খাবার দেওয়া হয়। পরিবেশটায় ছিল এক নিবিড় সরলতা, যেন সদ্য তৈরি হয়েছে সেটা আর রক্তলাল ফুলের পাপড়ি ও সেকেলে গ্রামোফোনের মাঝে ভরসাহীন অপেক্ষায় থাকা সুন্দরী মুলাতো মেয়েরা সংগমের এমন সব কায়দা জানত, যা লোকে ভুলে ফেলে এসেছে পার্থিব স্বর্গে। দলটা প্রথম রাতে যখন মোহময় গ্রিনহাউসে হাজির হয়, যে বিশাল মিতভাষিণী মহিলা বেতের দোলচেয়ারে বসে প্রবেশপথ পাহারা দিচ্ছিল, তার কাছে মনে হয়, সময় উল্টো ঘুরে ফিরে গিয়েছে তার উৎসমূলে, কারণ যখন যে পাঁচজন এগিয়ে আসছিল, তার মধ্যে সে দেখতে পায় এক হালকা-পাতলা তাতারদের মতো হুনু বের হওয়া পাণ্ডুর লোককে, যাকে চিরদিনের জন্য মেরে দেওয়া হয়েছে নিঃসঙ্গতার ছাপ সেই পৃথিবীর শুরুর মুহূর্ত থেকে।

‘এই’, দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘আউরেলিয়ানো।’

নতুন করে সে আবার দেখছিল কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে, যেমনটি দেখেছিল এক কুপির আলোয় যুদ্ধের অনেক আগে ছায়াচ্ছন্ন গৌরবের ও মোহভঙ্গের নির্বাসনের ও অনেক আগে দুরবর্তী সেই ভোরে, যে ভোরে সে এসেছিল তার শোবার ঘরে তাকে জীবনের প্রথম হুকুম দিতে। ওকে ভালোবাসা দেওয়ার হুকুম। সে ছিল পিলার তেরনেরা। অনেক বছর আগে যখন পূর্ণ করেছে একশত পঁয়তাল্লিশ বছর, নিজের বয়সের হিসাব রাখার বদভ্যাস অব্যাহতি দিয়েছে সে আর বাস করতে শুরু করেছে এক স্থবির সময়ে, স্মৃতির প্রান্তে এক সম্পূর্ণ উন্মোচিত স্থায়ী ভবিষ্যতে আর তাসের ছলনাময়ী ফাঁদ ও অনিশ্চিত জাদুকরি ভবিষ্যতের নাগালের বাইরে।

সেই দিন থেকেই আউরেলিয়ানো আশ্রয় নেয় অচেনা প্রপিতামহীর কোমলতা ও বোধের মধ্যে। বেতের চেয়ারে বসে সে বর্ণনা করত অতীত, বুনে যেত বংশটার বিশালত্ব ও দুর্ভাগ্য আর অপসৃত মাকন্দের দীপ্তি, যখন আলভারো তার অট্টহাসি দিয়ে চমকে দিত কুমিরগুলোকে আর আলফনস বানাত আগের সপ্তাহে দুর্ব্যবহার করা চার খদ্দেরের চোখ খুবলে নেওয়ার কাহিনি আর গাব্রিয়েল বসে থাকত সেই চিন্তিতা মুলাতো মেয়েটার ঘরে, যে ভালোবাসার বদলে টাকা নিত না, চিঠি লিখিয়ে নিত তার চোরাকারবারি ওরিনোকর জেলে থাকা প্রেমিকের জন্য, যাকে সীমান্তরক্ষীরা ধরে মলত্যাগপাত্রে বসিয়ে দিলে সেটা মল ও হিরে দিয়ে ভরে গিয়েছিল। মাতৃসম মালকিনের সেই বাস্তব বেশ্যালয়ই ছিল সেই জগৎ, যেটার স্বপ্ন দেখেছিল আউরেলিয়ানো ওর সুদীর্ঘ বন্দিদশায়। তখন সে এতই ভালো বোধ করছিল নির্ভেজাল সঙ্গীদের, এতই কাছাকাছি ছিল যে সেই বিকেলে যখন আমারাস্তা উরসুলা তার বিভ্রান্তি ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়, তখন সে অন্য কোনো আশ্রয়ের কথা ভাবে না, কথার মধ্য দিয়ে নিজেকে উজাড় করার জন্য প্রস্তুত ছিল সে, যাতে হৃদয়টাকে চেপে ধরে রাখা গিঁটগুলো খুলে দেয়, কিন্তু সে শুধু পিলার তেরনেরার কোলের ওপর ঝরিয়ে দেয় নয়ন থেকে বেরোনো উষ্ণ তরল, সান্ত্বনাদায়ক বারি। পিলার আঙুল দিয়ে ওর মাথার চুলে বিলি দিয়ে ওকে শেষ করতে দেয়, আর মুখে ও যে ভালোবাসার জন্য কাঁদছে, সেটা না বললেও মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন এই কান্নাকে সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পারে। ‘ঠিক আছে, বাছা’, সান্ত্বনা দেয়, এবার বল কে সে।’

যখন আউরেলিয়ানো তাকে নামটা বলে, পিলার তেরনেরা এক গভীর হাসিতে ফেটে পড়ে, সেই প্রাচীন হাসিতে যেটা পরিণত হতো ঘুঘু পাখির ডাকে। বুয়েন্দিয়াদের বুকে এমন কোনো গোপন কথা লুকোনো নেই, যা তার কাছে ছিল অভেদ্য, কারণ এক শতাব্দী যাবৎ তাসেরা ও অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে যে এই বংশের ইতিহাস হচ্ছে এক ঘূর্ণমান চাকা, যেটার ক্রমবর্ধমান অবক্ষয় ও নষ্ট অক্ষ না থাকলে সেটা ঘুরতেই থাকত অনন্তকালজুড়ে।

‘কিছুই চিন্তা করিস না’, হাসে সে, ‘সে যেখানেই থাকুক না কেন, তোর জন্য অপেক্ষা করছে।’

তখন ছিল বিকেল সাড়ে চারটে, যখন আমারাস্তা উরসুলা গোসল সেরে বেরোয়। আউরেলিয়ানো ওকে দেখে নিজের ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে। তার পরনে ছিল ছোট কোমল ভাঁজের আঙরাখা আর তোয়ালেটা পাগড়ির মতো করে মাথায় বাঁধা ছিল। প্ৰায় পা টিপে টিপে ওর পিছু নেয় আউরেলিয়ানো, নেশার ঘোরে টলতে টলতে ঢুকে পড়ে দয়িতাদের শোবার ঘরে, যখন আমারান্তা উরসুলা আঙরাখাটার সামনেটা ফাঁক করে আবার দ্রুত বন্ধ করে চমকে গিয়ে। নিঃশব্দে ইঙ্গিত করে পাশের ঘরের আধখোলা দরজার দিকে আর আউরেলিয়ানো জানত গাস্তন ওখানে চিঠি লিখতে শুরু করেছে। ‘ভাগ’, শব্দ না করে বলে।

আউরেলিয়ানো হাসে, দুহাত দিয়ে কোমর ধরে উঁচু করে ওকে বেগোনিয়ার টবের মতো, আর চিত করে ছুড়ে দেয় বিছানার ওপর। বাধা দেওয়ার আগেই এক জান্তব টানে খুলে ফেলে স্নানের পোশাক আর উপস্থিত হয় এক সদ্যোস্নাত নগ্নতার সামনে, যে নগ্নতার ওপর এমন কোন রঙের আভা ছিল না, এমন কোনো মিহি রোমের রেখা ছিল না, এমন কোনো গোপন তিল ছিল না, যা নাকি অন্য ঘরের ছায়ান্ধকারের মধ্যে কল্পনা করা হয় নি। আন্তরিকভাবেই আমারান্তা উরসুলা ওকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে বিচক্ষণ রমণীর সমস্ত কৌশল খাটিয়ে তার ভেজা, পিচ্ছিল, নমনীয় বেজির মতো শরীর বাঁকাচোরা করে, একই সঙ্গে হাঁটু দিয়ে তার বৃক্ক লক্ষ্য করে গুঁতো দিতে, নখ দিয়ে মুখ খামচে দিতে, কিন্তু না ওর, না আউরেলিয়ানোর মুখ থেকে বেরোয় এমন এক দীর্ঘশ্বাস, যেটা খোলা জানালা দিয়ে দেখা এপ্রিলের পরিষ্কার ছিমছাম সূর্যাস্ত দেখার ফলে বেরিয়েছে বলে মনে করে কেউ ভুল করতে পারে। ওটা ছিল এক ভয়ংকর যুদ্ধ, জীবন-মরণের যুদ্ধ, কিন্তু মনে হচ্ছিল তাতে হিংস্রতার লেশমাত্রও নেই, কারণ ওটা ছিল ধীর সাবধানী, শান্ত এলোপাতাড়ি এমন সব ভৌতিক আক্রমণ যে একটি আক্রমণ ও অপরটির মধ্যে সময় ছিল অপরাজিতা ফুল ফোটার, আর পাশের ঘরে গাস্তনের বৈমানিকের স্বপ্ন ভুলে যাওয়ার। ওদের ভাবখানা ছিল দুই শত্রু প্রেমিক স্ফটিক স্বচ্ছ সরোবরের তলায় নিজেদের ঝগড়া মিটিয়ে নিতে চেষ্টা করছে। সেই ভয়ানক বিক্ষুব্ধতা ও আনুষ্ঠানিক জোরাজুরির মধ্যে আমারাত্তা উরসুলা বুঝতে পারে যে অতি সতর্কতার এই নীরবতা এতই অযৌক্তিক যে এই ধস্তাধস্তিতে যে শব্দ হচ্ছে, তা এড়াতে চাওয়া শব্দের চেয়ে আরও প্রকট ও সেটা তার স্বামীর আরও সন্দেহের কারণ হতে পারে। ফলে সে ঠোঁট বন্ধ অবস্থায় হাসতে শুরু করে রণে ভঙ্গ না দিয়ে আর সে চালিয়ে যাচ্ছিল তার কপট কামড় ও শরীরটাকে বাঁকাচোরা করছিল খুব ধীরে ধীরে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা দুজনে বুঝে যায় যে একই সঙ্গে তারা শত্রু ও মিত্র আর ধস্তাধস্তিটা গতানুগতিক হুটোপুটির রূপ নেয় আর আক্রমণগুলো পরিবর্তিত হয় আদরে। হঠাৎ করে প্রায় খেলাচ্ছলে, যেন এটা আরেক দুষ্টুমি, আমারান্তা উরসুলা প্রতিরোধে অসতর্ক হয় আর পুনরায় যখন ওর দ্বারা যা সম্ভব হয়েছে তা বুঝতে পেরে ভয় পেয়ে আবার প্রতিরোধ স্থাপন করতে চায়, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। প্রবল এক ধাক্কা ওকে নিশ্চল করে দেয় ওর ভরকেন্দ্রে, বীজ বপন করে ওর এলাকায়, আর বাধা দেওয়ার ইচ্ছাটা উবে যায় মৃত্যুর কমলা রঙের শিষ ও অদৃশ্য বেলুনগুলোকে আবিষ্কারের দুর্দমনীয় উৎকণ্ঠায়। বেরোনোর জন্য তোড়জোড় করা বিড়াল-শীৎকারের পথরোধ করতে সে কোনো রকমে চোখ বুজে হাতড়িয়ে এক তোয়ালে নিয়ে গুঁজে দেয় দাঁতের ফাঁকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *