নিঃসঙ্গতার একশ বছর – ১২

১২

চোখধাঁধানো এত সব ও এত আশ্চর্যজনক আবিষ্কারে, মাকন্দের মানুষ বুঝতে পারছিল না তারা কোন দিক থেকে তাজ্জব হতে শুরু করবে। ট্রেনের দ্বিতীয় যাত্রায় আউরেলিয়ানো ত্রিস্তের নিয়ে যাওয়া প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ দিয়ে জ্বলা পাণ্ডুর বাল্বগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে রাত কাবার করে দেয় ওরা, আর ট্রেনটার টুমটুম শব্দে অভ্যস্ত হতে সময় লাগে ও কষ্ট করতে হয় ওদের। সফল ব্যবসায়ী ব্রুনো ক্রেসপি যখন সিংহের মাথাওয়ালা টিকিট কাটার ঘরওলা থিয়েটারে, মৃত্যুবরণ করার পর দাফন করা এক চরিত্রের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি দেখায় এক ছবিতে, যার দুঃখে সমব্যথী হয়ে চোখের জল ফেলে দর্শকেরা; সেই একই প্রতিচ্ছবি যখন পরের ছবিতে আবির্ভূত হয় এক আরবে পরিবর্তিত হয়ে, জীবন্ত অবস্থায়, তখন তারা ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। চরিত্রগুলোর জীবনের উত্থান-পতনের সাথি হতে যে জনসাধারণ দুই সেন্ট করে দিত, তারা এই ধরনের অভূতশ্রুত বিদ্রূপ সহ্য করতে না পেরে আসনগুলো ভেঙে ফেলে। ব্রুনো ক্রেসপির অনুরোধে এক বিশেষ ঘোষণার মাধ্যমে মেয়র সবাইকে জানিয়ে দেয় যে, সিনেমা হচ্ছে এক মরীচিকা সৃষ্টিকারী যন্ত্র, যা নাকি দর্শকদের আবেগতাড়িত হওয়ার মতো উপযুক্ততা রাখে না। এই হতাশাজনক ব্যাখ্যার পর অনেক দর্শকই মনে করে আবার তারা জিপসিদের নতুন ও তাক লাগানো কোনো কিছুর শিকার হয়েছে। আর তারা ভাবে তাদের নিজেদের জীবনেই কাঁদার মতো এত দুর্দশা আছে যে কাল্পনিক মানুষের মিথ্যে দেখার ইচ্ছা আর তাদের নেই, ফলে তারা আর সিনেমায় যায় না। প্রায় একই রকম অবস্থা ঘটে চোঙা লাগানো গ্রামোফোনের ব্যাপারে, যেগুলো নিয়ে গিয়েছিল হাস্যময়ী ফ্রান্সের নারীরা, যা নাকি প্রাচীন ব্যারেল অর্গানের জায়গা দখল করে আর বাদকদের জীবিকার ওপর কিছু সময়ের জন্য ভালো প্রভাব ফেলে। প্রথম দিকে নিষিদ্ধ রাস্তার খরিদ্দারদের সংখ্যা কয়েক গুণ হয়ে যায় কৌতূহলের কারণে, এমনকি জানা যায় যে সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলারা পর্যন্ত নষ্টলোকের ছদ্মবেশ নিয়ে, কাছ থেকে গ্রামোফোনের অভিনবত্ব দেখতে যায়, আর সেটা এত কাছ থেকে বহুবার দেখার ফলে ওরা সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে সবাই যেমনটি ভেবেছিল বা ফ্রান্সের মহিলারা যেমনটি বলেছিল, সে রকম কোনো জাদুকরি জাঁতাকল নয় ওটা, বরং এটা শুধুই এক কারিগরি চাতুরী, যেটাকে নাকি কোনোভাবেই সামনাসামনি বাদকদলের মতো এত মর্মস্পর্শী, এত মানবিক ও দৈনন্দিন সত্য দিয়ে ভরা কিছুর সঙ্গে তুলনা করা সম্ভব নয়। ব্যাপারটা এতই হতাশাপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় যে যখন গ্রামোফোন এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে প্ৰায় স্থান পেয়েছে প্রতিটি ঘরে তখনো পর্যন্ত সেটা গণ্য হতো ছোটদের খেলনার বস্তু, যেটাকে বাচ্চারা বিভিন্ন অংশে খুলে ফেলতে পারে, আর যেটা কোনোভাবেই বড়দের বিনোদনের বস্তু নয়। অন্যদিকে যখন গ্রামের কারও পক্ষে রেলস্টেশনের সঙ্গে লাগানো টেলিফোন যন্ত্রটার সত্যিকার ব্যবহার প্রমাণ করার সুযোগ ঘটে, টেলিফোনের হাতলটাকে মনে করা হয় গ্রামোফোনের প্রাচীন সংস্করণ আর সবচেয়ে অবিশ্বাসীরা পর্যন্ত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। যেন ঈশ্বর মাকন্দবাসীর সমস্ত আশ্চর্য হওয়ার ক্ষমতাটাকে পরীক্ষা করার আর তাদের চিরকালের জন্য আনন্দ ও বেদনার, সন্দেহ ও সত্যের মধ্যে রাখতে চান, যাতে নিশ্চিতভাবে কখনোই জানা যাবে না সত্যের সীমা। ওটা ছিল সত্য ও মরীচিকার মধ্যে এমন এক বিভ্রান্তিকর অবস্থা, যাতে চেস্টনাটের নিচের হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার অশরীরী আত্মা পর্যন্ত ধৈর্য হারিয়ে বিক্ষুব্ধ হতে বাধ্য হয়, সারা বাড়িজুড়ে হেঁটে বেড়াতে, এমনকি প্রকাশ্য দিনের বেলাতেও। যেদিন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে রেললাইনটাকে উদ্বোধন করা হয়; আর প্রতি বুধবার বেলা এগারোটায় মাকন্দে আসতে থাকে, তখন থেকেই একটি টেবিল, একখানা টেলিফোন, টিকিট বেচার জন্য ছোট্ট এক জানালাসহ অফিস বসানো হয় আর মাকন্দের রাস্তায় এমন সব পুরুষ ও মহিলাদের দেখা যেতে থাকে, যাদের স্বাভাবিক আচার-আচরণ সত্ত্বেও সত্যিকার অর্থে তারা ছিল সার্কাসের লোকজনের মতো। যে গ্রাম জিপসিদের সব রকম চতুরতায় অভ্যস্ত, সেখানে ভ্রাম্যমাণ হকাররা, যারা শিস দেওয়া কেটলি বিক্রির মতো একইভাবে সপ্তম দিনে আত্মার মুক্তির বিধান বিক্রি করে, সেখানে তাদের সফলতা অর্জনের কোনো সম্ভাবনা ছিল না, কিন্তু ক্লান্ত আর সব সময়ই যারা অসতর্ক, সে সমস্ত লোকের বিশ্বাস অর্জন করতে পারে আর প্রচুর অর্থ রোজগার করে। এই ধরনের থিয়েটারের প্রাণীদের মধ্যেই এতগুলো বুধবারের একটিতে ঘোড়ায় চড়ার প্যান্ট ও লেগিং, খড়ের টুপি, লোহার ফ্রেমের ছোট চশমা, পোখরাজের মতো চোখ ও উঁচু স্তরের লড়াইয়ের মোরগের মতো ত্বক নিয়ে মাকন্দে হাজির হয় ভরাট চেহারার হাসিখুশি মিস্টার হেরবের্ট আর দুপুরের খাবার সারে বাড়িতে।

কলার প্রথম ছড়াটা খাওয়ার আগ পর্যন্ত ওকে কেউই খেয়াল করে না। ঘটনাক্রমে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ওকে পায়, যখন হোটেল জ্যাকবে কামরা খালি না থাকায় সে ভাঙা স্প্যানিশে তর্ক করছিল, আর প্রায়ই যেমনটি করত অন্য বিদেশিদের ক্ষেত্রে, তেমনিভাবে তাকে নিয়ে আসে বাড়িতে। ওর ছিল দড়িতে বাঁধা বেলুন ওড়ানোর ব্যবসা, যে ব্যবসার সূত্রে অর্ধেক দুনিয়া ঘুরে প্রচুর অর্থ উপার্জন করলেও মাকন্দের কাউকে ওড়াতে পারে নি সে, কারণ তারা জিপসিদের উড়ন্ত কার্পেট দেখে ওতে ওঠার অভিজ্ঞতা অর্জন করার পর বেলুনে চড়াটাকে তারা মনে করে সেকেলে ব্যাপার। তার পরিকল্পনা ছিল পরের ট্রেনে ফিরে যাওয়ার। সব সময়ই ডোরাকাটা কলাগুলো খাবার ঘরে ঝুলিয়ে রাখা হতো আর ওখান থেকেই এক ছড়া কলা দুপুরে খাওয়ার সময় তার সামনে নিয়ে যাওয়া হলে সে খুব একটা উৎসাহ না নিয়ে প্রথম কলাটা ছিঁড়ে। কিন্তু কথা বলতে বলতে স্বাদ নিতে নিতে, চিবুতে চিবুতে খেয়েই চলে, ভালো করে বলতে গেলে ভোজনরসিকের চেয়েও এক অভিজ্ঞ লোকের মজা নিয়ে। আর প্রথম ছড়াটা শেষ হলে অনুরোধ করে আরেক ছড়া নিয়ে আসতে। তখন সে বের করে তার সর্বক্ষণের সঙ্গী অপ্টিক্যাল যন্ত্রপাতির এক ছোট্ট বাক্স। হিরে ক্রেতার মতো সন্দিগ্ধ মনোযোগ নিয়ে বিশেষ এক ছুরি দিয়ে ছোট ছোট করে কেটে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে, ফার্মেসিতে ব্যবহৃত দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে আর অস্ত্র কারবারিদের ব্যবহৃত ক্যালিপার দিয়ে আয়তন হিসাব করে। পরে বাক্স থেকে বের করে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ও মাপে তাপমাত্রা, বাতাসের আর্দ্রতা ও আলোর তীব্রতা। ঘটনাটা এমনই কৌতূহলজনক হয়ে ওঠে যে মিস্টার হেরবের্টের মুখ থেকে শেষমেশ এক চূড়ান্ত ও রহস্য উন্মোচন করার মতো ফলাফলের অপেক্ষায় থেকে কারোরই ঠিকমতো খাওয়া হয় না। কিন্তু সে এমন কিছুই বলে না যাতে করে তারা তার পরিকল্পনা বুঝতে পারে।

পরের দিনগুলোতে তাকে দেখা যায় একটা জাল ও ঝুড়ি নিয়ে গ্রামের চারপাশে প্রজাপতি ধরতে। বুধবারে হাজির হয় একদল ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, পানিবিজ্ঞানী, ভূ- জরিপকারী ও ভূ-সংস্থানবিদ। যারা পরের বেশ কয়েক সপ্তাহ যাবৎ অনুসন্ধান চালায়, যেখানে মিস্টার হেরবের্ট প্রজাপতি শিকার করেছিল। আরও পরে আসে হলুদ ট্রেনের লেজের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া সম্পূর্ণ রুপার পাতে মোড়া, নীল কাচ দিয়ে বানানো চাঁদওয়ালা, মখমল দিয়ে মোড়া যাজকদের চেয়ারসমেত বিশেষ ওয়াগনে মিস্টার ব্রাউন। ওই একই ওয়াগনে মিস্টার ব্রাউনের চারপাশে থাকে ভাবগম্ভীর কালো পোশাক পরিহিত তোষামোদকারী উকিলের দল, যারা অন্য সময় সর্বত্রই অনুসরণ করত কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে। তার ফলে মনে হয় দড়ি লাগানো বেলুনের মিস্টার হেরবের্টের ও তার রঙিন প্রজাপতির মতো ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, পানিবিজ্ঞানী, ভূ-জরিপকারী ও ভূ-সংস্থানবিদ, তার চারপাশে ঘুরে বেড়ানো তোষামোদকারী দল, ও তার হিংস্র জার্মান কুকুরদের সঙ্গে যুদ্ধের একটা সম্পর্ক আছে। কিন্তু এ নিয়ে বেশি কিছু ভাববার মতো সময় থাকে না কারোরই, কারণ যখন মাকন্দবাসী কেবল জিজ্ঞেস করতে শুরু করে কী ছাই মাথা ঘটে চলছে, ততক্ষণে গ্রামটা রূপান্তরিত হয় দস্তার চালওয়ালা কাঠের বাড়ির এক শিবিরে, যেখানে বাস করতে আরম্ভ করে ট্রেনভর্তি অর্ধেক দুনিয়ার বিদেশিরা। তারা আসে শুধু আসনগুলো ও পাদানিতে প্রবেশপথের সিঁড়িতে বসেই নয়, এমনকি ওয়াগনের ছাদ ভর্তি করেও। রেললাইনের অপর পারে পামগাছ দিয়ে ঘেরা রাস্তা, লোহার গ্রিল করা জানালা, উঠানে সাদা ছোট ছোট টেবিল, সিলিং থেকে ঝোলানো পাখা ও বিশাল লনে ঘুরে বেড়ানো ময়ূর ও তিতিরসমেত বাড়ি দিয়ে আলাদা একটি গ্রাম তৈরি হয়। ‘গ্রিংগোরা (আমেরিকান) নিয়ে আসে মসলিনের কাপড় পরিহিত ও শিফনের টুপি মাথায় দেওয়া তাদের স্ত্রীদের। এক বিশাল মুরগির খামারের মতো সারাটা এলাকা ঘেরা ছিল লোহার বিদ্যুতায়িত জাল দিয়ে। গ্রীষ্মের শীতল সকালগুলোতে ঝলসানো সোয়ালো পাখি দিয়ে ভরে কালো হয়ে যেত জালটা। তখনো কেউ বুঝত না ওরা কী খুঁজছে, অথবা সত্যিই ওরা শুধুই কি লোকহিতৈষী। ইতিমধ্যেই ওরা বিশাল বিশৃঙ্খলা ঘটিয়ে ফেলে, প্রাচীন জিপসিদের চেয়ে অনেক বেশি বিরক্তিকর কিন্তু এরা হয় মাকন্দে অনেক বেশি স্থায়ী ও এদের কাজ হয় অনেক কম বোধগম্য। অন্য সময়ে যা শুধু ঐশ্বরিক শক্তির জন্য সংরক্ষিত ছিল, হাতে পেয়ে তারা এলাকার বৃষ্টির ধরন বদলে দেয়, ফসল ফলানোর সময়টাকে বাড়িয়ে দেয়, নদীকে সরিয়ে ফেলে ওটার সাদা পাথর ও বরফশীতল স্রোতসুদ্ধ। যেখানে সব সময় ওটা ছিল, সেখান থেকেও সরিয়ে বসিয়ে দেয় গ্রামের অন্য প্রান্তে গোরস্থানের পেছনে। ওই সময়টাতেই ওরা হোসে আর্কাদিওর কবরের ওপর কংক্রিট দিয়ে এক শক্ত আবরণ সৃষ্টি করে, যাতে লাশ থেকে বের হওয়া বারুদের গন্ধ নদীর পানিকে দূষিত না করতে পারে। যেসব বিদেশিরা দয়িতাবিহীন একাকী চলে এসেছে তাদের জন্য ফ্রান্সের মমতাময়ী রমণীদের রাস্তাটাকে পরিণত করে ওদের নিজের গ্রামের চেয়েও বড় করে, আর এক স্বর্গীয় বুধবারে ট্রেন ভর্তি করে নিয়ে আসে অবিশ্বাস্য বিভিন্ন ধরনের খানকিদের, সেসব ব্যাবিলনীয় নারী প্রাচীন সব কলাকৌশলে পটু, যারা সঙ্গে নিয়ে আসে সব ধরনের মলম, নির্জীবকে উত্তেজিত করার জন্য, ভিতুকে জাগিয়ে তোলার জন্য, অতিলোভীদের তৃপ্ত করতে, লজ্জাশীলদের জাগিয়ে তুলতে, বারবার যারা আসে, তাদের শিক্ষা দিতে ও নিঃসঙ্গদের ভুল শুধরে দিতে। পুরোনো রংবেরঙের বাজারওয়ালা তুর্কদের রাস্তা রূপান্তরিত হয় দেশ-বিদেশের জিনিসপত্রে ঠাসা উজ্জ্বল সব দোকানে, যেখানে শনিবারের রাতগুলো উপচে পড়ে হঠকারী লোকদের ভিড়ে, যারা হোঁচট খেত ভাগ্য ও সুযোগের জুয়ার টেবিলগুলোতে। ভিড় হয় শুটিং টেবিলগুলোতে, যেখানে ভবিষ্যৎ স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেওয়া হতো সেই গলিতে, ভাজাভুজি ও পানীয়ের দোকানে, যেখানে রোববার সকালে মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকত মাঝেমধ্যে সুখী মাতালদের দেহ, কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই দেহগুলো হচ্ছে গুলি খাওয়া, ঘুষি খাওয়া, ছোরায় আহত অথবা ভাঙা বোতলে আঘাতপ্রাপ্ত লোকদের কাতর দেহ। এটা ছিল এমন এক দিগ্‌ বিদিকশূন্য পরিকল্পনাহীন আগ্রাসন, যে প্রথম দিকে রাস্তাগুলোতে পরে থাকা আসবাবপত্র ও তোরঙ্গের আধিক্যে কারও অনুমতির ধার না ধেরে হুড়হুড়ি করে বানানো বাড়িগুলোর ছুতোরের কার্যক্রমে ছাউনির নিচে আলমন্ড গাছগুলোতে দোলবিছানা বেঁধে প্রণয়রত যুগলের শীৎকারের মধ্যে রাস্তাগুলোতে হাঁটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। গ্রামের প্রান্তে একমাত্র শান্তির জায়গাটা ছিল শান্তিপ্রিয় ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান নিগ্রোদের দ্বারা বানানো, যারা গ্রামের সীমানায় এক রাস্তা বানিয়ে, খুঁটির ওপর কাঠের ঘর বানিয়ে, বিকেলের দিকে দরজায় বসে অবোধ্য উচ্চারণে পাপিয়ামেন্ত (স্প্যানিশ, ডাচ, ইংরেজি ইত্যাদি ভাষার সমন্বয়ে গড়া এক ভাষা, যা নাকি আরুবাসহ অন্যান্য জায়গায় প্রচলিত) ভাষায় ধর্মসংগীত গাইত। এত অল্প সময়ে এত বড় পরিবর্তন ঘটে যায় যে, মিস্টার হেরবের্টের আগমনের আট মাস পর মাকন্দবাসী প্রতি সকালে জেগে উঠত নিজেদের গ্রামকে চেনার জন্য।

‘শুধু এক গ্রিংগোকে কলা খাওয়ার নিমন্ত্রণ করে’ মাঝেমধ্যে বলত কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া, ‘দেখো আমরা কি আপদেই না জড়িয়েছি।’

অন্যদিকে আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর আনন্দের সীমা থাকে না বিদেশিদের এই আকস্মিক ঢলে। অতি সত্বর বাড়িটা ভরে যায় অচেনা সব অতিথিদের দিয়ে, বেপরোয়া পার্টি, পার্টিপ্রিয় দুনিয়াজোড়া লোকজনে, আর ফলে উঠানে যোগ করতে হয় কিছু শোবার ঘরের, বাড়াতে হয় রান্নাঘরটাকে আর প্রাচীন খাবার টেবিলটা বদলে বসাতে হয় ষোলো জন বসার মতো এক টেবিল, নতুন বাসনকোসন আর তার পরও সবার একসঙ্গে জায়গা না হওয়ায় পালা করে দুপুরের খাবার খেতে হয়। নিয়মনিষ্ঠতার কথা ভুলে গিয়ে সবচেয়ে বিকৃত রুচির লোকটাকেও রাজার মতো করে আপ্যায়ন করতে বাধ্য হয় ফের্নান্দা। ওরা উঠোনটা বুটজুতো দিয়ে কাদায় মাখামাখি করত, বাগানে পেশাব করত, দুপুরে ঘুমাত যেকোনো জায়গায়, মাদুর বিছাত আর ভদ্রলোকদের নিয়মনিষ্ঠার ধার না ধেরে মেয়েদের স্পর্শকাতরতার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে মুখে যা কিছু আসত, তা-ই বলত। আমারান্তা এই আগ্রাসনে এতই মর্মাহত হয় যে আগের দিনের মতো আবার রন্ধনশালায় গিয়ে খেতে আরম্ভ করে। কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মনে স্থির বিশ্বাস জন্মে যে যারা তাকে অভিবাদন জানাতে আসে, তাদের মধ্যে বেশির ভাগই আসে এক ঐতিহাসিক পুরাদর্শনের কৌতূহল থেকে, জাদুঘরের এক ফসিল দেখতে, তার প্রতি সহানুভূতি বা সম্মান দেখাতে নয় আর সে নিজেকে বন্দী করে ফেলে দরজা বন্ধ করে আর পরে দুই-একটা বিরল সময়ে যখন সে রাস্তার পাশের দরজায় এসে বসত, সেই সময়টা ছাড়া তাকে দেখাই যেত না। অন্যদিকে উরসুলা যদিও ওই সময়ে পা টেনে টেনে দেয়াল ধরে ধরে হাঁটত, তখনো সে রেল আসার সময় হলে অনুভব করত এক শিশুসুলভ আনন্দ। ‘মাংস ও মাছ রাধতে হবে’, নির্দেশ দিত চারজন পাচককে। ওরা সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদের নির্বিকার তদারকিতে সাধ্যানুযায়ী কাজ করে যেত। ‘সবকিছুই বানাতে হবে’, জোর করত, কারণ কেউ জানে না বিদেশিরা কী খেতে চাইবে। রেল চলে আসত দিনের সবচেয়ে উত্তপ্ত সময়ে। দুপুরের খাবার সময়ে বাড়ি কাঁপত হাটবাজারের মতো হট্টগোলে, বাড়ি ভরে যেত অতিথিদের ঘামে, এমনকি ওরা জানত না নিমন্ত্রণকর্তার পরিচয়, আর দল বেঁধে ছুট লাগাত টেবিলের ভালো জায়গাটা দখলের জন্য, আর সে সময় পাচকেরা হোঁচট খেত বিশাল আকৃতির স্যুপের পাত্র হাতে, মাংসের গামলা নিয়ে অথবা ভাতের পাত্র নিয়ে, আর বড় বড় চামচ দিয়ে পরিবেশন করত লেমনেড পিপে থেকে। ব্যাপারটা ছিল এতই বিশৃঙ্খলার যে ফের্নান্দা রেগে যেত অনেকেই দুবার খেত এই ভেবে, ও অতিথিদের মধ্যে কেউ কেউ ভুল করে তার কাছে খাবারের বিল চাওয়ায়। সে রাগটা উগরে দিতে গিয়েছিল সবজিওয়ালাদের মতো খিস্তি করে। তখন মিস্টার হেরবের্টের আসার এক বছর পার হয়ে গেছে। আর একমাত্র যা জানা যায় তা হচ্ছে, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ও তার সঙ্গীরা বড় বড় আবিষ্কারের উৎপত্তিস্থলের খোঁজে পাহাড় অতিক্রম করা মায়াবী জায়গাটাতে গ্রিংগোরা কলা চাষের চিন্তা করছে। কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার অপর দুই ছেলে কপালে ছাইয়ের ক্রস নিয়ে হাজির হয় সেই উদ্‌গরণরত আগ্নেয়গিরির আকর্ষণে আর তাদের আসার স্থির সংকল্পের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে একটিমাত্র বাক্য দিয়ে, যেটা খুব সম্ভবত ব্যাখ্যা করবে অন্য সবারই আসার কারণ।

‘এসেছি’, ওরা বলে, ‘কারণ সারা পৃথিবীই আসছে।’

রেমেদিওস লা বেইয়্যাই ছিল কলা মহামারি থেকে বিমুক্ত। সে থিতু হয় অপূর্ব এক বয়ঃসন্ধিতে, প্রতিক্ষণই লৌকিকতার দ্বারা আরও অস্পর্শ, খারাপ কাজ বা সন্দেহবাতিক থেকে আরও দুরে নিজের জগতে সাধারণ বাস্তবতার সুখী জীবনে। সে বুঝতে পারত না কেন মেয়েরা তাদের জীবনকে জটিলতায় ভরে ফেলে বক্ষবন্ধনী ও পেটিকোট দিয়ে, আর সে নিজের জন্য সেলাই করে ক্যানভাসের কাপড় দিয়ে তৈরি এক বালান্দ্রা (হাতা ছাড়া মোটা কাপড়ের তৈরি হাঁটু পর্যন্ত নেমে আসা আলখাল্লার মতো পোশাক), যেটার মধ্য দিয়ে সে মাথা গলিয়ে দিয়ে বস্ত্র ধারণের সমস্যাটার সমাধান করত নিরাবরণ থাকার অনুভূতিটাকে বিসর্জন না দিয়ে, তার মতে, ওটাই ছিল ভব্যভাবে বাড়িতে থাকার একমাত্র উপায়। বৃষ্টির মতো চুল (লাতিন আমেরিকায় ঘন লম্বা চুলকে বৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করা হয়) গোড়ালি পর্যন্ত নেমে আসায় তাকে এতই বিরক্ত করা হয় হেঁটে ছোট করে চিরুনি আর ফিতে দিয়ে চুল বাঁধতে, আর রংবেরঙের ফিতে দিয়ে বেণি করতে যে স্রেফ নেড়ে করে ফেলে। মাথাটা কামিয়ে, আর কাটা চুলগুলো দিয়ে সেন্টদের মতো পরচুলা বানায়। ওর এই সরলভাবে থাকার সহজাত প্রবৃত্তির মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হচ্ছে যতই হালফ্যাশনকে বাদ দিয়ে সে স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে ও যতই সে স্বতঃস্ফূর্ততার কাছে বাধ্য হয়ে গতানুগতিকতাকে বর্জন করে তার চালচলন ততই উদ্বেগপূর্ণ হয়ে ওঠে তার অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যে ততই পুরুষদের জন্য হয়ে ওঠে সে উত্তেজক।

যখন কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার ছেলেরা প্রথমবারের মতো মাকন্দে আসে, উরসুলার মনে পড়ে ওদের শরীরেও বইছে পর নাতনির মতো একই রক্ত আর সে শিউরে ওঠে এক বিসৃত আতঙ্কে। ‘চোখ কান খোলা রাখো, ওকে সাবধান করে, ‘ওদের যে কারোর সঙ্গে করলে তোর সন্তান শুয়োরের লেজ নিয়ে জন্মাবে।’ রেমেদিওস লা বেইয়্যা সাবধানবাণীকে তোয়াক্কা না করে পুরুষদের পোশাক পরে বালুতে গড়াগড়ি করে তেল মাখানো খুঁটিতে ওঠার জন্য। আর এই অসহনীয় দৃশ্যে উন্মাদ হয়ে যাওয়ায় আরেকটু হলেই সে তার সতেরো জন জ্ঞাতিভাইয়ের মধ্যে সে এক বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটিয়ে ফেলছিল। আর সেই কারণেই ভাইয়েরা যখন গ্রামে আসত, তখন বাড়িতে ঘুমুত না তারা আর যে চারজন গ্রামে থাকত, তারা উরসুলার নির্দেশে ভাড়া ঘরে থাকত। অবশ্য যদি রেমেদিওস লা বেইয়্যা জানতে পারত এই সাবধানতার কথা, সে হেসেই খুন হয়ে যেত। পৃথিবীতে বাসের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে জানত না তার বিঘ্ন সৃষ্টিকারী অবশ্যম্ভাবী নারী নিয়তি প্রতিদিনই কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল নিত্যনতুন অনাসৃষ্টির। উরসুলার আদেশ অমান্য করে খাবার ঘরে ওর উপস্থিতি প্রতিবারই বিদেশিদের মধ্যে এক অজানা আতঙ্কের সৃষ্টি করত। এটা স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান যে, এই কর্কশ কাপড়ের নিচে সে ছিল সম্পূর্ণ নগ্ন, আর কেউ বুঝতে পারত না যে তার নিখুঁত কামানো মাথার খুলিটা আগ্রহোদ্দীপক কোনো আহ্বান নয়, অথবা গরম দূর করার জন্য তার লজ্জাহীন ঊরুযুগলকে উন্মুক্ত করা বা হাত দিয়ে খাবার পর যে মজা করে আঙুল চুষত, সেগুলো কোনো অপরাধমূলক প্ররোচনা নয়। যে ব্যাপারটা পরিবারের কেউ কখনোই জানতে পারে নি আর বিদেশিদেরও তা বুঝে উঠতে দেরি হয় না, তা হচ্ছে রেমেদিওস লা বেইয়্যা ছড়িয়ে দিত শান্তিহরণকারী প্রশ্বাস, ঝড়ের এক দমকা হাওয়া, আর সেটা টের পাওয়া যেত সে চলে যাওয়ার পরও কয়েক ঘণ্টাব্যাপী, প্রেমের বিভ্রান্তিতে অভিজ্ঞ পুরুষেরা, সারা পৃথিবী ঘুরে প্রেমের স্বাদ নেওয়া পুরুষেরা দৃঢ়তার সঙ্গে জানাত যে রেমেদিওস লা বেইয়্যার শরীরের স্বাভাবিক গন্ধ যেভাবে তাদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করত, এমনটি তাদের মধ্যে কখনোই হয় নি। বেগোনিয়া ভরা বারান্দায়, বৈঠকখানায় অথবা বাড়ির যেকোনো জায়গায়, ওরা দেখিয়ে দিতে পারত ঠিক কোনখানে সে ছিল আর সে স্থান ত্যাগ করার পর কতক্ষণ সময় পার হয়েছে। তার গন্ধ চিহ্নটা সুনিশ্চিত ও নির্ভুল হলেও বাড়ির লোকদের কেউই পার্থক্য নির্ণয় করতে পারত না, কারণ অনেক দিন আগে থেকেই গন্ধটা দৈনন্দিন সব গন্ধের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। কিন্তু বাইরের লোকেরা সেটা ধরতে পারত সঙ্গে সঙ্গেই। এই কারণে শুধু ওরাই বুঝতে পারত যুবক রক্ষীদলের কমান্ডারের ভালোবাসার জন্য মৃত্যু ও অন্য জায়গা থেকে আসা এক ভদ্রলোকের হতাশায় নিমজ্জিত হওয়ার কারণ। যে অস্থির পরিবেশে সে ঘোরাফেরা করত, তার পদচারণ যে অসহ্য প্রণয়ঘটিত বিপর্যয়ের অবস্থা তৈরি করত, সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল রেমেদিওস লা বেইয়্যার, আর পুরুষদের সঙ্গে তার ব্যবহার ছিল সম্পূর্ণরূপে বিদ্বেষহীন, আর তার নিষ্পাপ আনন্দ ওদের উন্মাদ করে ছাড়ত। বাইরের লোকেরা যাতে দেখতে না পায়, সেই উদ্দেশ্যে উরসুলা যখন তাকে আমারান্তার সঙ্গে রান্নাঘরে খেতে বাধ্য করতে সক্ষম হয়, তখন সে ভালো বোধ করে, কারণ এতে করে সে সব নিয়মশৃঙ্খলার নাগালের বাইরে চলে যায়। সত্যিকার অর্থে ওর কাছে যেকোনো জায়গায় খাওয়াই ছিল একই ব্যাপার, আর কোনো সময় ধরে নয়, সে খায় খিদের ইচ্ছানুযায়ী। মাঝেমধ্যে খেতে উঠত ভোর তিনটার সময় ও ঘুমোত সারা দিন, আর এভাবেই কাটিতে দিত সময় উল্টো করে কয়েক মাস যাবৎ যতক্ষণ পর্যন্ত না কোনো আকস্মিক ঘটনা তাকে ফিরিয়ে আনত স্বাভাবিক নিয়মে। যখন সব ভালোভাবে স্বাভাবিক নিয়মে চলত, তখন সে ঘুম থেকে বেলা এগারোটার সময় উঠে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় দুই ঘণ্টার জন্য নিজেকে আবদ্ধ করত গোসলখানায় আর লম্বা গভীর ঘুমের রেশ কাটাতে কাঁকড়া-বিছে মারত। পরে সে স্কোয়াশের খোল দিয়ে বানানো পাত্র দিয়ে জলাধার থেকে গায়ে পানি ঢালত। ব্যাপারটা ঘটাত সে এতই প্রলম্বিত সময় নিয়ে, এতই নিখুঁতভাবে, এতই আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে যে যারা তাকে চিনত না, তাদের কাছে মনে হবে যে সংগত কারণেই সে নিজের শরীরের বন্দনা করছে। ওর জন্য সে নিভৃত আচার ছিল সম্পূর্ণভাবে ইন্দ্রিয়তার বহির্ভূত, আর ব্যাপারটা ছিল ক্ষুধা না পাওয়া পর্যন্ত সময় কাটানোর উপায় মাত্র। একদিন, যখন কেবল গোসল আরম্ভ করছে, এক বহিরাগত ছাদের এক টালি সরিয়ে ফেলে আর সেই দুর্দান্ত নগ্নতার দৃশ্যের সামনে নিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। রেমেদিওস লা বেইয়্যা ওর চোখ দুটো দেখতে পায় ভাঙা টালির ভেতর দিয়ে, কিন্তু তাতে লজ্জাজনক কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না তার, বরং উদ্বিগ্ন হয়।

‘সাবধান’, চেঁচিয়ে ওঠে, ‘পড়ে যাবে তো।’

‘শুধু তোমাকে দেখতে চাই’, বিড়বিড় করে লোকটা।

‘ও আচ্ছা’, বলে সে, ‘কিন্তু সাবধান, টালিগুলো সব পচে গিয়েছে।’

বহিরাগতের মুখে ছিল বেদনার অভিব্যক্তি যেন সে তার আদিম প্রবৃত্তির সঙ্গে নিঃশব্দে লড়াই করছে, যাতে এই মরীচিকা মিলিয়ে না যায়। রেমেদিওস লা বেইয়্যা ভাবে, টালি ভাঙার সম্ভাবনায় লোকটা ভয় পেয়েছে, আর যাতে লোকটাকে এই বিপজ্জনক অবস্থায় বেশিক্ষণ না থাকতে হয়, সে অন্যান্য দিনের চেয়ে দ্রুত পানি ঢালতে শুরু করে। জলাধার থেকে পানি ঢালতে ঢালতে মন্তব্য করে যে ছাদের এই অবস্থা হচ্ছে এক সমস্যা আর বৃষ্টিভেজা পচা পাতার স্তরের জন্যই গোসলখানাটা ভরে গিয়েছে কাঁকড়া-বিছেয়। বহিরাগত লোকটা ভুল বোঝে, মনে করে এই ধরনের টুকরো আলাপ তার আনন্দকে আড়াল করারই চেষ্টা, ফলে যখন সে সাবান মাখতে শুরু করে, আর এক পা এগিয়ে যাওয়ার লোভ জাগে তার।

‘তোমাকে সাবান মাখাতে দাও, বিড়বিড় করে।

‘তোমার সদিচ্ছাকে ধন্যবাদ’, বলে সে, ‘কিন্তু এর জন্য আমার দুই হাতই যথেষ্ট।’ ‘শুধু অন্তত পিঠটাতে লাগাতে দাও’, আকুতি করে আগন্তুক।

‘ওটা হবে এক উদ্দেশ্যহীন কাজ’, বলে সে, ‘পিঠে সাবান মাখাতে আজ পর্যন্ত কাউকে দেখা যায় নি।’

পরে যখন গা মুছতে শুরু করে চোখে জল নিয়ে আগন্তুক মিনতি করে তাকে বিয়ে করার জন্য। সে আন্তরিকতার সঙ্গে উত্তর দেয় যে লোক এতই সরল যে একজন নারীর গোসলের দৃশ্য দেখার জন্য প্রায় এক ঘণ্টা নষ্ট করেছে আর এমনকি প্রায় দুপুরের খাবারটাও না খেয়ে থাকছে, এমন কাউকে সে কখনোই বিয়ে করবে না। পরিশেষে যখন সে বালাদ্রানটা গায়ে চরায়, তখন লোকটা আর সহ্য করতে পারে না যে সবাই যেমনটি ভেবেছে ঠিক তেমনি, নিচে সে কিছুই পরে না, আর যেন সেটা রেখে যায় তার গায়ে স্থায়ী এক গরম লোহার ছ্যাকার ছাপ। সে আরও দুটো টালি খুলে ফেলে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে গোসলখানার ভেতরে নামার জন্য।

‘এটা খুবই উঁচু’, সতর্ক করে সে ভয় পেয়ে, ‘তুমি মারা যাবে।’

পচা টালিগুলো দুর্ঘটনার ভীষণ শব্দ তুলে ভেঙে পড়ে, লোকটা কোনোভাবে শুধু এক ভয়ার্ত চিৎকারের সময় পায়, মাথা ভেঙে ফেলে, আর সিমেন্টের মেঝের ওপর মারা যায় মৃত্যুযন্ত্রণা ছাড়াই। আগন্তুকেরা খাবার ঘর থেকে ছাদ ভাঙার শব্দ পেয়ে দ্রুত লাশ সরানোর ব্যবস্থা করে আর লাশের গায়ে পায় রেমেদিওস লা বেইয়্যার দম বন্ধ করা গায়ের সুবাস। সেটা শরীরে এত গভীর পর্যন্ত ঢুকে আছে যে ফাটা খুলির ফাঁকগুলো দিয়ে রক্ত না বেরিয়ে আসে লালচে হলুদ রঙের সেই গোপন সুবাস মাখা তেল, আর ওরা বুঝতে পারে রেমেদিওস লা বেইয়্যার সুবাস মৃত্যুর পরও উৎপীড়ন করে চলবে হাড়গুলো ধুলো হওয়া পর্যন্ত। তার পরও এই ভয়ংকর দুর্ঘটনাকে রেমেদিওস লা বেইয়্যার কারণে মৃত অন্য দুজনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করে না কেউ। রেমেদিওস লা বেইয়্যা যে ভালোবাসার নিশ্বাস ফেলে না, ছড়ায় মৃত্যুর স্রোত, এই কথাটা বিদেশিদের মধ্যে, অনেক মাকন্দের প্রাচীন বাসিন্দাদের মধ্যে কিংবদন্তিতে পরিণত হওয়ার জন্য আরও একজন লোককে দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার প্রয়োজন পড়ে। সেই প্রমাণযুক্ত ঘটনাটা ঘটে আরও কয়েক মাস পর, যখন রেমেদিওস লা বেইয়্যা একদল বান্ধবী নিয়ে নতুন লাগানো কলার আবাদ দেখতে যায়। মাকন্দবাসীর জন্য এই ভেজা, অন্তহীন সারি সারি কলাগাছের অ্যাভিনিউর মধ্য দিয়ে হাঁটা ছিল এক নতুন চিত্তবিনোদক ব্যাপার, যেখানে নৈঃশব্দ্যতাকে নিয়ে আসা হয়েছে অন্য জায়গা থেকে আর এখনো তা ব্যবহৃত হয় নি, আর ফলে যেখানে শব্দ করা ছিল এক উদ্ভট ব্যাপার। মাঝেমধ্যে আধা মিটার দূর থেকে বলা কথা বোঝা যেত না কিন্তু প্ল্যানটেশনের অপর প্রান্ত থেকে তা শোনা যেত পরিষ্কারভাবে। মাকন্দের মেয়েদের জন্য ব্যাপারটা ছিল এক নতুন খেলা, যা নিয়ে আসত, হাসি, লাফালাফি চমক ও বিদ্রূপের, আর রাতের বেলা সেই বেড়ানো নিয়ে ওরা এমনভাবে আলাপ করত যেন সেটা হচ্ছে এক স্বপ্নে ঘটা অভিজ্ঞতা। সেই নৈঃশব্দ্য ছিল এমনই সম্ভ্রমের ব্যাপার যে উরসুলার রেমেদিওস লা বেইয়্যাকে এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত করার মতো মন ছিল না। এক বিকেলে তাকে যেতে অনুমতি দেয় টুপি ও যথাযথ পোশাক পরার শর্তে।

বান্ধবীদলসহ প্ল্যানটেশনে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে বাতাস ভরে ওঠে মরণ সুবাতাসে। গর্তে কাজ করতে থাকা পুরুষেরা অনুভব করে এক বিরল সম্মোহন, বোধ করে এক অদৃশ্য বিপদের হুমকি, আর অনেকে নিজেকে অর্পণ করে এক অদম্য কান্নার ইচ্ছার কাছে। এক হিংস্র পুরুষদল ওদের আক্রমণ করায় ভয়ার্ত রেমেদিওস লা বেইয়্যা ও বান্ধবীরা নিকটস্থ এক বাড়িতে আশ্রয় নেয়। চার আউরেলিয়ানো কিছুক্ষণ পর উদ্ধার করে ওদের। আউরেলিয়ানোদের কপালের ক্রস পবিত্র এক সমীহের সৃষ্টি করে, যেন দাগগুলো একধরনের বিশেষ সামাজিক স্তরের চিহ্ন, দুর্দমতার ছাপ। যে কথাটা রেমেদিওস লা বেইয়্যা কাউকে বলে নি তা হচ্ছে, বিশৃঙ্খলার সুযোগে এক লোক ইগলের থাবা দিয়ে শৈলশিরার প্রান্ত আঁকড়ে ধরার মতো হাত দিয়ে তার পেট খামচে ধরে। সে আক্রমণকারীর মোকাবিলা করে একধরনের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া উজ্জ্বল চকিত চাহনি দিয়ে আর তা দেখে এক হতভাগ্যের দুটি চোখ, যে দৃশ্য তার মনে গেঁথে যায় এক করুণার অঙ্গারের মতো। সেই রাতে এক ঘোড়ার লাথিতে বুক বিদীর্ণ হওয়ার কয়েক মিনিট পূর্বে, তুর্কদের রাস্তায় লোকটা তার সাহস ও সৌভাগ্য নিয়ে বড়াই করে, আর বহিরাগতদের এক দঙ্গল লোক দেখে কীভাবে রাস্তার মাঝে রক্তবমি করতে করতে সে মৃত্যুযন্ত্রণায় ভোগে।

রেমেদিওস লা বেইয়্যা যে মরণক্ষমতা ধারণ করে ধারণাটা এই চারটে অখণ্ডনীয় ঘটনার দ্বারা প্রমাণিত হয় তখন, যদিও কিছু বাচাল লোক বলে আনন্দ পায় যে এমন এক কামোদ্দীপক এই রমণীর সঙ্গে এক রাত শোয়ার বদলে জীবনটাও দিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে কেউই সে রকমের কোনো চেষ্টা করে না। হয়তোবা শুধু তাকে বাগে আনার জন্য নয়, তার থেকে আসা বিপদগুলো এড়ানোর জন্য যা প্রয়োজন তা হচ্ছে, ভালোবাসার মতো এক আদিম ও মামুলি অনুভূতি কিন্তু একমাত্র এই কথাটাই কারও চিন্তায় আসে না। উরসুলা আর ওকে নিয়ে ভাবনা করে না। অন্য দিকে তখনো ওকে জাগতিক বিষয়ে কাজে লাগানোর চিন্তায় অব্যাহতি দেয় নি। ওকে সংসারের মৌলিক ব্যাপারগুলোতে উৎসাহী করার চেষ্টা করে। ‘তুই যা চিন্তা করিস, পুরুষেরা তার চেয়েও বেশি কিছু চায়’, রহস্যভরা কণ্ঠে বলে, ‘রান্নার চেয়েও আরও বেশি কিছু, ঝাড় দেওয়ার চেয়েও বেশি কিছু, ছোটখাটো ব্যাপারগুলো নিয়ে ভোগান্তি, বা তুই যা বিশ্বাস করিস, তার চেয়েও বেশি কিছু।’ আসলে মনের গভীরে সে নিজেকেই ব্যঙ্গ করছিল। রেমেদিওসকে গৃহস্থালি আনন্দের ব্যাপারে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে, কারণ সে নিশ্চিত ছিল যে একবার প্রণয়ে তৃপ্ত হওয়ার পর পৃথিবীতে এমন একজন লোকও নেই যে নাকি এক দিনের জন্য হলেও, এমনকি বোধের অগম্য হলেও কোনো ধরনের অবহেলা সহ্য করতে পারবে। সর্বশেষ হোসে আর্কাদিওর জন্ম, ওকে পোপ বানানোর শিক্ষা দেওয়ার অদম্য ইচ্ছা তাকে পরনাতনির ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করা থেকে অব্যাহতি দেয়। ওকে ভাগ্যের হাতে অর্পণ করে এই ভেবে যে আজ হোক, কাল হোক, কোনো এক অলৌকিক ঘটনা ঘটবে আর এই দুনিয়ায় যেখানে সবই আছে, সেখানে অবশ্যই এমন এক আলসে পুরুষ থাকবে, যে নাকি ওর ভার নিতে পারবে। আমারান্তা অনেক আগেই ইস্তফা দিয়েছে ওকে গৃহস্থালি ব্যাপারে কর্মী মহিলা বানানোর চেষ্টায়। সেই বিস্মৃত সেলাইয়ের বিকেলগুলোতে, যখন সেলাইকলের হাতল ঘোরানোর ব্যাপারে কোনো আগ্রহই দেখে না, তখনই বুঝে ফেলে মেয়েটা হচ্ছে জড়বুদ্ধির। ‘তোকে লটারিতে তুলতে হবে’, পুরুষদের ব্যাপারে ওর অনুৎসাহ দেখে বলে। পরে যখন উরসুলা স্বচ্ছ কাপড়ের শাল দিয়ে মুখ ঢেকে ওকে উপাসনাসভায় পাঠায়, আমারান্তা তখন ভাবে, এই রহস্যময় ব্যাপারটা এত উত্তেজক হয়ে দাঁড়াবে যে খুব শিগগির এমন এক ধৈর্যসম্পন্ন লোকের আবির্ভাব ঘটবে যে সে ওর হৃদয়ের কোমল জায়গাটা খুঁজে পাবে। কিন্তু যখন দেখে কীভাবে সেই লোকটাকে অবহেলা করে যে ছিল সবদিক থেকে রাজপুত্রের চাইতেও বেশি গ্রহণযোগ্য, তখনই সে সব আশা ত্যাগ করে। ফের্নান্দা এমনকি ওকে বোঝার কোনো চেষ্টাও করে না। যেদিন রক্তাক্ত সেই কার্নিভালে রেমেদিওস লা বেইয়্যাকে রানির সাজে দেখেছিল, তখন ওকে তার অলৌকিক এক মেয়ে বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু যখন ওকে দুই হাত দিয়ে খেতে দেখে, দেখে যে এমনকি একটি সাধারণ প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারে না, তখন আর ওকে সারল্যের বিস্ময়কর প্রতিমূর্তি বলে মনে হয় না। আর একমাত্র ব্যাপারে তার খেদ হয় যে পরিবারের হাবা মানুষেরাই সবচেয়ে বেশি আয়ু পায়, যদিও কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া বিশ্বাস করত ও সব সময়ই বলত, সত্যিকার অর্থে রেমেদিওস লা বেইয়্যা হচ্ছে এ পর্যন্ত তার পরিচিত লোকদের মাঝে সবচেয়ে স্বচ্ছ, আর আর তাকে প্রতি মুহূর্তেই সবাইকে অবহেলা করার ক্ষমতা দিয়ে তাই প্রমাণ করত। তারপর সবাই ওকে ঈশ্বরের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেয়। ওই দিন পর্যন্ত রেমেদিওস লা বেইয়্যা ঘুরে বেড়ায় নিঃসঙ্গতার মরুতে, কোনো বিবেকদংশন ছাড়া, দুঃস্বপ্নহীন ঘুমিয়ে, তার অন্তহীন গোসল দিয়ে, তার অনিয়মিত খাবার নিয়ে, তার গভীর ও প্রলম্বিত স্মৃতিবিহীন নৈঃশব্দ্য নিয়ে, যেদিন মার্চের এক বিকেলে ফের্নান্দা বাগানে তার কর্ড কাপড়ের বিছানার চাদর ভাঁজ করার জন্য বাড়ির মেয়েদের কাছে সাহায্য চায়। ওরা কেবল কাজটা আরম্ভ করেছে, এমন সময় আমারান্তার চোখে পড়ে রেমেদিওস লা বেইয়্যার প্রচণ্ড পাণ্ডুর মুখ।

‘তোর কি খারাপ লাগছে’, প্রশ্ন করে।

রেমেদিওস লা বেইয়্যার হাতে চাদরের অপর প্রান্ত ধরা ছিল, সে ক্লিষ্ট এক হাসি ছড়ায় মুখে।

‘উল্টো’, বলে, ‘কখনোই এমন ভালো বোধ করি নি।

বলা শেষ করা মাত্র ফের্নান্দা অনুভব করে, আলোর এক পেলব হলকা তার হাত থেকে চাদরটাকে ছিনিয়ে নিয়ে শূন্যে মেলে ধরেছে। আমারান্তা স্কার্টের ঝালরে অনুভব করে এক রহস্যময় কাঁপুনি আর পতন ঠেকাতে চাদরটি আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করে, যখন রেমেদিওস লা বেইয়্যা শূন্যে উঠে যেতে শুরু করে। একমাত্র প্রায় অন্ধ উরসুলাই এ অসংশোধনীয় বাতাসের প্রকৃতি বোঝার মতো শান্ত অবস্থায় ছিল, সে চাদরকে আলোর দয়ার ওপর ছেড়ে দেয়, দেখতে পায় রেমেদিওস লা বেইয়্যা হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে। ওরই সঙ্গে উঠে উড়তে থাকা পতপতরত আলোকোজ্জ্বল চাদরগুলোর ভেতর থেকে, ওর সঙ্গে বিদায় নিচ্ছে গুবরে পোকা ও ডালিয়ার সুবাস, উঠে যাচ্ছে বাতাস কেটে যেখানে বিকেল চারটে বাজা শেষ হয়েছে, আর ওরই সঙ্গে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় সুউচ্চ বাতাসে, যেখানটা স্মৃতির সবচেয়ে ঊর্ধ্বগামী পাখিদেরও নাগাল পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

বহিরাগতেরা অবশ্য মনে করে রেমেদিওস লা বেইয়্যা শেষ পর্যন্ত তার রানি মৌমাছি হওয়ার অলঙ্ঘনীয় নিয়তি বরণ করেছে আর ইজ্জত রক্ষা করতে পরিবারের সবাই ঊর্ধ্বগমনের গল্প ফেঁদেছে। ফের্নান্দা ঈর্ষায় জ্বললেও অলৌকিক ব্যাপারটাকে মেনে নিতে বাধ্য হয় আর অনেক দিন পর্যন্ত ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে চাদরগুলোকে ফেরত দেওয়ার জন্য। বেশির ভাগ লোকই অলৌকিক ব্যাপারটা বিশ্বাস করে, এমনকি তারা মোমবাতি জ্বালে ও নয় দিনের প্রার্থনা শেষ করে। হয়তোবা অনেক দিন যাবৎ লোকের মুখে এই ব্যাপারটা ছাড়া অন্য কিছু শোনা যেত না, যদি না আউরেলিয়ানোদের বর্বর হত্যাকাণ্ডের আতঙ্ক এই বিস্ময়কে সরিয়ে সে জায়গা দখল না করত। কোনো পূর্ববোধ না হলেও কোনোভাবে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া তার ছেলেদের করুণ শেষ পরিণতির কথা বুঝতে পারে। যখন আউরেলিয়ানো সেররাদর ও আউরেলিয়ানো আর্কাইয়া বিশৃঙ্খলার সময় চলে আসে ও মাকন্দে থাকতে ইচ্ছা প্রকাশ করে, ওদের বাবা তাতে নিরস্ত করতে চেষ্টা করে। সে বুঝতে পারছিল না রাতারাতি বিপজ্জনক হয়ে ওঠা গ্রামে ওরা কী করতে পারবে। কিন্তু আউরেলিয়ানো সেনতেনো ও আউরেলিয়ানো ত্রিস্তে, আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর অনুমতি নিয়ে ওদের ব্যবসার কাজ দেয়। তখন পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্তে সায় দেওয়ার ব্যাপারে বিভ্রান্তি ছিল কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার। যেদিন থেকে সে মিস্টার ব্রাউনকে মাকন্দে আসা প্রথম গাড়িতে চড়ে আসতে দেখে, যে কমলা রঙের কনভার্টিবেলের ভেঁপুর শব্দে কুকুরগুলো চমকে উঠত ঘেউ ঘেউ শব্দে, বৃদ্ধ যোদ্ধা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে লোকজনের আদিখ্যেতা দেখে; আর সে বুঝতে পারে বউ-ছেলেকে ফেলে রেখে বন্দুক কাঁধে যুদ্ধে যাওয়ার সময় থেকে লোকজনের প্রকৃতিতে কোনো একটা বড় পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। নির্লান্দার যুদ্ধবিরতির পর স্থানীয় সরকার বলতে ছিল উদ্যমহীন মেয়র ও শান্তিপ্রিয় ক্লান্ত মাকন্দবাসী রক্ষণশীলদের মধ্য থেকে বেছে নেওয়া কিছু লোকদেখানো বিচারক

‘এটা হচ্ছে এক নচ্ছারদের এলাকা’, খালি পায়ে কাঠের লাঠি হাতে পুলিশদের যেতে দেখলে মন্তব্য করত কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া, ‘এতগুলো যুদ্ধ করেছি শুধু যাতে করে আমাদের বাড়িগুলো নীল রং না করা হয়।’ অবশ্য কলা কোম্পানি আসার পর স্থানীয় সরকারের বদলে আসে বহিরাগত স্বৈরাচারী, যাদের মিস্টার ব্রাউন নিয়ে যায় বৈদ্যুতিক জাল দিয়ে ঘেরা মুরগির খামারে বাস করতে, তার কথানুযায়ী যাতে তারা নিজ নিজ পদানুযায়ী সম্মানের সঙ্গে জীবনকে ভোগ করে, যাতে তাদের গরম না লাগে, মশা বা গ্রামের অগুনতি অসুবিধা যাতে তাদের পোহাতে না হয়। পুরোনো পুলিশদের জায়গায় আসে মাচেতে হাতে ভাড়াটে খুনির দল। কর্মশালায় আবদ্ধ কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে তার নিঃশব্দ নিঃসঙ্গতার বছরগুলোতে এই প্রথমবারের মতো এক স্থির বিশ্বাস জ্বালিয়ে মারে যে যুদ্ধটা শেষ ফলাফল দেখা পর্যন্ত চালিয়ে না যাওয়াটা বড় এক ভুল হয়েছে। ওই দিনগুলোর মধ্যে একদিন বিস্মৃত কর্নেল ম্যাগনিফিকো ভিসবালের ভাই তার সাত বছর বয়সের নাতিকে নিয়ে প্লাজার ঠেলাগাড়ির কাছে যায় ঠান্ডা পানীয় পান করাতে, আর বাচ্চাটা দুর্ঘটনাবশত পুলিশের করপোরালের সঙ্গে হোঁচট খাওয়ায় পানীয় ছলকে পুলিশের ইউনিফর্মে পড়ে, আর বর্বর পুলিশ বাচ্চাটাকে মাচেতে দিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে আর দাদা বাধা দিতে গেলে এক কোপে তার মাথাটা নামিয়ে দেয় সে। সারা গ্রাম দেখতে পায় যখন একদল লোক মাথাবিহীন ধড়টা আর এক মহিলা টুকরো টুকরো করা বাচ্চার লাশ থলেতে ভরে, কাটা মাথার চুল ধরে ছেঁচড়িয়ে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়।

কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার কাছে সেটা ছিল প্রায়শ্চিত্তভোগের চরম সীমা, যৌবনে পাগলা কুকুরে কামড়েছিল বলে পিটিয়ে মেরে ফেলা মহিলার লাশের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে যে রকম ক্রুদ্ধ হয়েছিল, সেই একই রকমের ক্রুদ্ধতা অনুভব করে সে। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু কৌতূহলী মানুষ দেখে নিজের ওপর গভীর ঘৃণার ফলে তার ভারী গলা পুনরুদ্ধার করে ঘৃণার সমস্ত ভার উগরে দেয় ওদের ওপর, যে ভার সে নিজে আর বইতে পারছিল না।

‘এরই মধ্যে একদিন’, চিৎকার করে, ‘এই গুখেকো গ্রিংগোদের শেষ করতে আমার ছেলেদের হাতে অস্ত্র তুলে দেব।’

ওই সপ্তাহের মধ্যেই উপকূলে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় তার সতেরো জন ছেলেকে শিকার করা হয় খরগোশ শিকারের মতো করে। অদৃশ্য আততায়ীরা ওদের ছাইয়ের ক্রসের মাঝখানে গুলি করে। আউরেলিয়ানো ত্রিস্তে তার মার বাড়ি থেকে বেরোচ্ছিল রাত সাতটার সময়, যখন অন্ধকার থেকে আসা এক বুলেট ওর কপাল ভেদ করে। আউরেলিয়ানো সেন্তেনোকে পাওয়া যায় কারখানায়, দোলবিছানায় যেখানে সব সময় সে শুত আর বরফকুচি করার সুচালো যন্ত্রটা হাতল পর্যন্ত ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তার দুই ভুরুর মাঝখানে। সিনেমা শেষে বান্ধবীকে বাপের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তুর্কদের উজ্জ্বল রাস্তা ধরে ফিরছিল আউরেলিয়ানো সেররাদর, ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন রিভলবার দিয়ে গুলি করে ফুটতে থাকা শুয়োরের চর্বির কড়াইয়ের মধ্যে ফেলে আর সে আততায়ীর পরিচয় কখনোই পাওয়া যায় নি। কয়েক মিনিট পর কেউ আউরেলিয়ানো আরকাইয়ার দরজা ধাক্কা দেয়, যেখানে সে একটি মেয়ে নিয়ে ছিল আর চিৎকার করে ‘তাড়াতাড়ি কর, তোর ভাইদের মেরে ফেলছে।’ যে মেয়েটার সঙ্গে সে ছিল তার কথানুযায়ী আউরেলিয়ানো আরকাইয়া লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুললে অপেক্ষারত এক মাউজারের গুলিতে তার খুলি চুরমার হয়ে যায়। সেই মরণরাতে বাড়িটা যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল চারটে লাশের শোক পালনের, ফের্নান্দা তখন পাগলের মতো গ্রামময় খুঁজে বেড়ায় আউরেলিয়ানো সেগুন্দোকে, যাকে পেত্রা কতেস কর্নেলের নামের একই নামের সবাইকে খুন করা হবে এই বিশ্বাসে কাপড়-জামা রাখার দেয়াল কুঠরিতে আবদ্ধ করে রাখে। চতুর্থ দিনের আগে তাকে বেরোতে দেয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত না উপকূলের ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে আসা টেলিগ্রাম পরিষ্কার করে দেয় যে অদৃশ্য শত্রুর আক্রোশ ছিল ছাইয়ের ক্রস দাগা ভাইদের ওপর। আমারান্তা হিসাবের খাতাটা খুঁজে বের করে, যেটাতে ভাইপোদের বিবরণ লিখে রাখা হয়েছিল আর টেলিগ্রাফ আসার ক্রম অনুযায়ী এক এক করে নামগুলো কেটে দিতে থাকে যতক্ষণ না শুধু বাকি থাকে সবচেয়ে বড় জন। তার বড় বড় সবুজ চোখের সঙ্গে গাঢ় চামড়ার বৈপরীত্যের কারণে সবাই ওকে মনে রেখেছিল। ছুতোর ছিল সে, তার নাম ছিল আউরেলিয়ানো আমাদর আর বাস করত পাহাড়ের পাদদেশে এক নিভৃত গ্রামে। ওর মৃত্যুর খবর নিয়ে আসা টেলিগ্রামের জন্য দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ওকে সতর্ক করে দেওয়ার জন্য এক দূত পাঠায়। সে ভেবেছিল, জানের ওপর এই হুমকির কথা ওর অজানা। আউরেলিয়ানো আমাদর নিরাপদেই আছে, এই খবর নিয়ে ফিরে আসে দূত। সেই করাল রাতে দুই লোক তাকে বাড়িতে খুঁজতে গিয়ে ওর ওপর রিভলবার খালি করলেও ছাইয়ের ক্রুশে লাগাতে ব্যর্থ হয়। আউরেলিয়ানো আমাদর লাফিয়ে উঠানের বেড়া পার হয়ে পাহাড়ের গোলকধাঁধার মধ্যে হারিয়ে যায় যে জায়গাটা তার হাতের তালুর মতোই চেনা; ধন্যবাদ আদিবাসীদের সঙ্গে ওর বন্ধুত্বকে, যাদের সঙ্গে সে ব্যবসা করত। সেদিন থেকে ওকে আর কখনই দেখা যায় নি।

কালো দিন ছিল ওই সময়টা কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার জন্য। সমব্যথা জানিয়ে প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট এক টেলিগ্রাম পাঠিয়ে ব্যাপক তদন্তের প্রতিশ্রুতি দেন আর মৃতদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। তার আদেশে চারটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার করোনা (ফুলের গোলাকৃতি মালা) নিয়ে আসে কফিনে দেওয়ার জন্য কিন্তু কর্নেল তাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখে। লাশ দাফনের পর প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্যে এক অগ্নিবর্ষী টেলিগ্রাম লিখে নিজ হাতে নিয়ে গেলে টেলিগ্রাম প্রেরণকারী লোকটা পাঠাতে রাজি হয় না। ফলে আরও আক্রমণাত্মক অনেক শব্দ কাগজটার সঙ্গে যোগ করে সেটাকে ডাকে ফেলে। যেমনটি ঘটেছিল তার স্ত্রীর মৃত্যুতে, ঘটেছিল যুদ্ধের সময় অনেকবার তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মৃত্যুতে, সে কোনো শোক অনুভব করে না, অনুভব করে দিগ্‌ বিদিকহীন অন্ধ ক্রোধের ও অসহায় অক্ষমতার স্পষ্ট অনুভূতি, এমনকি ফাদার অ্যান্তনিও ইসাবেলকে অভিযুক্ত করে শত্রুদের চিনিয়ে দেওয়ার জন্য তার ছেলেদের অমোচনীয় ছাই দিয়ে চিহ্নিত করার কারণে। জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ যাজক যে আর গুছিয়ে চিন্তা করতে পারেন না, আর যার বেদি থেকে দেওয়া উদ্ভট ব্যাখ্যা শুনে যাজকপল্লির লোকজন ভয় পেতে আরম্ভ করছে, সেই বৃদ্ধ এক বিকেলে বাড়িতে আসে পাত্র নিয়ে, যেটাতে সে ছাইয়ের বুধবারে ছাই প্রস্তুত করে আর সেগুলো পরিবারের সবার কপালে মেখে প্ৰমাণ করার চেষ্টা করেন যে ওগুলো ধুলেই চলে যায়। কিন্তু এই দুর্ভাগ্যের আতঙ্ক সবার মধ্যে এমন গভীরে প্রথিত হয়েছিল যে এমনকি ফের্নান্দা পর্যন্ত তার ওপর এই পরীক্ষা চালাতে অস্বীকার করে আর কখনোই বুয়েন্দিয়াদের কাউকে ছাইয়ের বুধবারে বেদির সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে দেখা যায় নি।

শান্ত অবস্থাটা ফিরে পেতে অনেক দিন লেগে যায় কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার। সে ত্যাগ করে সোনার মাছ বানানো। কোনো রকমে খাওয়াদাওয়া সেরে কম্বল টানতে টানতে নিজের ক্রোধটাকে নীরবে বিশ্লেষণ করতে করতে বাড়িময় ঘুরে বেড়াত স্বপ্নাচরের মতো। তিন মাসে তার সমস্ত চুল সাদা হয়ে যায়, ঠোঁটের ওপর ঝুলে থাকা মোম দেওয়া সুচালো গোঁফগুলো ঝুলে পড়ে কিন্তু তার চোখগুলো অঙ্গারের মতো জ্বলে আগেকার দিনগুলোর মতো, যে চোখ দেখে জন্মের সময় ভয় পেয়েছিল লোকে আর অন্য সময় যে চোখ শুধু দৃষ্টি দিয়ে চেয়ার নড়াতে পারত। সেই ক্রোধের তাণ্ডবলীলার মধ্যে নিষ্ফলভাবে জাগিয়ে তুলতে চাইত অতীতের সেই পূর্ববোধ, যেগুলো যৌবনে শত বিপদের মধ্যেও তাকে পথ দেখিয়েছে গৌরবের উর্বর ভূমি পর্যন্ত। হারিয়ে গিয়েছিল সে তখন, পথ হারিয়েছিল এমন এক অচেনা বাড়িতে যেখানে কোনো কিছুই অথবা কেউই তার ভেতরে ভালোবাসার সামান্য কণাটুকুও জাগাতে পারে নি।

যুদ্ধের আগেকার অতীতের চিহ্ন খুঁজতে একবার মেলকিয়াদেসের ঘরটা খোলে আর শুধু পায় জঞ্জাল, এত বছর পরিত্যক্ত থাকার কারণে জমা আবর্জনার স্তূপ। যে বইগুলো আর কেউই পড়ে নি তারই মধ্যে স্যাঁতসেঁতে পুরোনো পার্চমেন্টে ফুটে ছিল এক বিবর্ণ ফুল আর সারা বাড়ির মধ্যে ভেসে থাকা সবচেয়ে পরিশুদ্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল পচে যাওয়া স্মৃতির এক অসহ্য গন্ধ। এক সকালে সে উরসুলাকে চেস্টনাটের নিচে মৃত স্বামীর কাছে কাঁদতে দেখে। বাড়ির সব বাসিন্দাই অর্ধশতক ধরে এই বিধ্বস্ত শক্তিশালী বৃদ্ধকে খোলা হাওয়ায় দেখতে পেত আর কর্নেল আউরেলিয়ানো ছিল তার একমাত্র ব্যতিক্রম। ‘বাবাকে অভিবাদন জানাও’, ওকে বলে উরসুলা। সে চেস্টনাটের সামনে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায়। আর অনুভব করে সামনের ফাঁকা জায়গাও তার মধ্যে কোনো ভালোবাসার উদ্রেক করে না। ‘কী বলছে’, জিজ্ঞেস করে করে।

‘সে খুব বিষণ্ণ’, উত্তর দেয় উরসুলা, ‘কারণ, সে বিশ্বাস করে, তুই মারা যাচ্ছিস।’

‘ওকে বল’, হাসে কর্নেল, ‘যখন মরা উচিত, তখন কেউ মরে না, মরে যখন মরতে পারে।’

মৃত বাবার পূর্ববোধ তার হৃদয়ের মধ্যের অবশিষ্ট অহংকার জাগিয়ে তুললেও সে এটাকে ভুল বোঝে শক্তির এক দমকা হাওয়া ভেবে। ফলে সে উরসুলার কাছে জানতে চায় প্লাস্টারের সেন্ট যোসেফের মূর্তির ভেতরকার স্বর্ণমুদ্রার লুকিয়ে রাখার জায়গার হদিস। ‘কখনোই জানতে পারবি না’, অতীতে পাওয়া এক শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ উরসুলা দৃঢ়তার সঙ্গে বলে। ‘কোনো একদিন’ যোগ করে, ‘এই সম্পদের মালিকের আবির্ভাব ঘটবে আর শুধু সে-ই মাটির নিচ থেকে ওগুলো বের করবে।’ কেউই জানতে পারে না যে তার মতো উদার মানুষ হঠাৎ কেন টাকার জন্য এত নির্লজ্জ হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে, আর সেটা কোনো জরুরি প্রয়োজন মেটানোর মতো কোনো মোটামুটি অঙ্কের টাকা নয়, সে যে বিশাল সম্পদের প্রয়োজনের কথা সে উল্লেখ করে, তার অঙ্ক শুনেই আশ্চর্যের সাগরে ডুবে যায় আউরেলিয়ানো সেগুন্দো। পুরোনো দিনে যারা ওকে অর্থসম্পদ দিয়ে সাহায্য করেছিল, তাদের কাছে নতুন করে সাহায্য চাইলে তারা ওর সঙ্গে দেখা না করার জন্য লুকিয়ে পড়ে। ওই সময়ই তাকে বলতে শোনা যায়, ‘উদারপন্থী ও রক্ষণশীলদের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে উদারপন্থীরা উপাসনাসভায় যায় পাঁচটার সময় আর রক্ষণশীলরা যায় আটটায়।’ তার পরও সে এতই অধ্যবসায়ের সঙ্গে চেষ্টা করে, এমনভাবে মিনতি করে, তার আত্মমর্যাদাকে এমনভাবে নিচু করে যে এখান- ওখান থেকে কিছু কিছু করে সব জায়গায় নিঃশব্দে খেটে, প্রচণ্ড অধ্যবসায়ের সঙ্গে আট মাসের মধ্যে উরসুলা পুঁতে রাখা সম্পদেরও বেশি সম্পদ জড়ো করে ফেলে, পরে দেখা করে অসুস্থ কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসের সঙ্গে, যাতে সে তাকে সাহায্য করে এক সম্পূর্ণ যুদ্ধে।

কোনো এক সময়, সত্যিকার অর্থে একমাত্র কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসই পারত এমনকি তার পক্ষাঘাতগ্রস্ত চেয়ার থেকেও, মরচে পড়া বিদ্রোহের সুতো ধরে টান দিতে নিরলান্দিয়ার সন্ধির পর যখন কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া ছোট ছোট মাছের কাছে আশ্রয় নিয়েছে, সে-ই তখন শেষ পরাজয়ের আগ পর্যন্ত বিশ্বস্ত অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। ওদের সঙ্গেই সে শুরু করেছিল নিত্যদিনের করুণ, অপমানজনক, অনুনয়-বিনয়ের, আবেদনপত্রের, আগামীকাল আসুন, প্রায় হয়ে এল, যথাযথ মনোযোগসহকারে আপনাদের কেসটা আমরা দেখছি, আপনার একান্ত বিশ্বস্ত সেবকদের বিরুদ্ধে সেই নিষ্ফল যুদ্ধের, যেখানে আজীবন পেনশন দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু কখনোই দেওয়া হয় নি। অন্য যুদ্ধ, রক্তাক্ত সেই বিশ বছরেও এতটা ক্ষতি হয় নি যতটা হয়েছে এই অন্তহীন ক্ষয়কারী স্থগিত রাখার যুদ্ধটায়, এমনকি প্রাণের ওপর তিন-তিনটে হামলা থেকে পালিয়ে যাওয়া, পাঁচবার আহত হওয়ার পর সেরে ওঠা, অসংখ্য যুদ্ধ থেকে অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে যাওয়া কর্নেল হেরিনালদো মার্কেস পর্যন্ত ভয়ংকরতার কাছে পরাজয় বরণ করে ডুবে যায় ভাড়া করা বাড়িতে, খোপ খোপ আলোর ভেতর আমারান্তার কথা ভাবতে ভাবতে। খবরের কাগজে ছাপা প্রতিচ্ছবির মাধ্যমে সর্বশেষ যে অবসরপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের কথা সে জানতে পারে, মর্যাদাহীন মুখ নিয়ে প্রজাতন্ত্রের এক আড্ডাতে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ছিল তারা আর প্রেসিডেন্ট তাদের নিজের ছবি খোদাই করা বোতাম দিচ্ছিল কোর্টের গলার পাশে লাগানোর জন্য, আর ফেরত দিচ্ছিল কফিনের ওপর রাখার জন্য রক্ত ও বারুদ দিয়ে নোংরা হওয়া এক পতাকা। অন্যেরা, সবচেয়ে বেশি মর্যাদা সম্পন্নরা, তখনো জনসাধারণের দাক্ষিণ্যের চিঠির আশায়, খিদেয় মুমূর্ষু, প্রচণ্ড রাগে ক্ষুব্ধ, কোনো রকমে বেঁচে ছিল অতীতের গৌরবময় মলের মধ্যে ধুঁকতে ধুঁকতে। কাজেই যখন কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া সমস্ত দুর্নীতিবাজ ও বিদেশি দখলদারের জঘন্য নিষ্ঠুরতার শেষ দেখার জন্য এক মরণযুদ্ধের আহ্বান করে কর্নেল হেরিনালদো মার্কেস চেপে রাখতে পারে না তার সহানুভূতির শিহরণ।

‘হায়’ আউরেলিয়ানো দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘জানতাম যে বৃদ্ধ হয়েছিস কিন্তু এখন বুঝতে পারছি। যতটুক ভেবেছিলাম তার চেয়েও অনেক বুড়িয়ে গেছিস তুই।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *