নিঃসঙ্গতার একশ বছর – ৪

কবুতরের মতো সাদা বাড়িটার উদ্বোধন করা হলো এক নাচের আয়োজনের মাধ্যমে। উরসুলার মনে ধারণাটা এসেছিল সেই বিকেলে, যেদিন ওদের দেখেছিল বয়ঃসন্ধিতে প্রবেশ করতে, আর প্রায় বলতে গেলে বাড়িটা সে বানিয়েছিল, যাতে মেয়েরা সম্মানজনক একটা জায়গায় অতিথিদের আপ্যায়ন করতে পারে। উৎসবে যাতে জাঁকজমকের কমতি না পড়ে, তার জন্য বাড়ি তৈরি শেষ হওয়ার আগেই সে খেটে যায় ক্রীতদাসের মতো। ফলে ফরমাশ দিয়ে দেয় ঘর সাজানোর জিনিসপত্র, বাসনকোসন আর গ্রামে আলোড়ন সৃষ্টিকারী, যৌবনের আনন্দ ও এক আজব আবিষ্কার; পিয়ানোলার (পিয়ানো আর টেপরেকর্ডারের সম্মিলিত এক যন্ত্র, আধুনিক MP3-র ১৯০০-এর সংস্করণ)। ওটাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিভিন্ন অংশে ভাগ করে আলাদা বাক্সে ভরে। ওগুলোকে নামানো হয়েছিল ভিয়েনার আসবাবপত্র, বোহেমিয়ার হাতে কাঁটাকাচের সামগ্রী, ওয়েস্টইন্ডিজ কোম্পানির বাসনকোসন, হল্যান্ডের টেবিল ক্লথ, ভালো ভালো সব ঝাড়বাতি, মোমবাতি, ফুলদানি আর ঘর সাজানোর কারুকার্যের সঙ্গে। পিয়ানোলায় বিশেষজ্ঞ পিয়েত্র ক্রেসপি নামের এক ইতালীয়কে পাঠানো হয় অংশগুলো জোড়া দিয়ে, সুর বেঁধে, আর ছয় রোলে ছাপা, আধুনিক বাজনার সঙ্গে কীভাবে নাচতে হয়, তা শিখিয়ে দিতে।

পিয়েত্র ক্রেসপি ছিল সোনালি চুলওয়ালা মাকন্দে দেখা সবচেয়ে সুন্দর আর শিক্ষিত যুবক। পোশাকের ব্যাপারে সে ছিল এতই রীতিসচেতন যে দম আটকানো গরমের মধ্যেও এমব্রয়ডারি করা গেঞ্জি আর গায়ে মোটা কাপড়ের কোট পরে কাজ করত। ঘামে ভিজে, বাড়ির মালিকদের সঙ্গে সম্ভ্রমপূর্ণ দূরত্ব বজায় রেখে কয়েক সপ্তাহ কাটিয়ে দেয় বৈঠকঘরের বদ্ধ অবস্থায়, যা নাকি একমাত্র আউরেলিয়ানোর রৌপ্যকর্মের আত্মনিয়োগের সঙ্গেই তুলনা করা চলে।

এক সকালে দরজা না খুলে আশ্চর্য ব্যাপারটার সাক্ষী হতে কাউকে না ডেকেই লাগিয়ে দেয় কাগজের প্রথম রোলটাকে পিয়ানোলার সঙ্গে। আর যন্ত্রণাদায়ক হাতুড়ি ও কাঠচেরাইয়ের নিরবচ্ছিন্ন গোলযোগ বিস্ময়করভাবে বন্ধ হয়ে যায় সুরের শৃঙ্খলা আর পবিত্রতায়। সবাই ছুটে আসে বৈঠকঘরে, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় সুরের মাধুর্যে নয়, বরং পিয়ানোলার রিডগুলোকে নিজে নিজেই বাজতে দেখে। সে অদৃশ্য বাদকের প্রতিচ্ছবির দাগেরোটাইপ করার আশায় মেলকিয়াদেসের ক্যামেরাটিকে বসিয়ে দেয় বৈঠকখানায়। সেদিন ওদের সঙ্গে খাবার খায় ইতালীয়। রেবেকা আর আমারান্তা খাবার পরিবেশনের সময় বিস্মিত হয় স্বর্গীয় দূতের মতো মানুষটার আংটিবিহীন পাণ্ডুর হাতে ছুরি ও কাঁটাচামচের স্বচ্ছন্দ ব্যবহারে। বৈঠকঘর-সংলগ্ন থাকার ঘরে ওদের নাচতে শেখায় পিয়ে ক্রেসপি। নাচের পদক্ষেপগুলোর নির্দেশনা দিচ্ছিল ওদের স্পর্শ না করেই। এক মেট্রোনমের (Metronome-নির্দিষ্ট লয়ে সংগীতের তাল মাপার যন্ত্র) মাধ্যমে তালকে বুঝিয়ে দেয় উরসুলার স্নেহপূর্ণ পাহারার মধ্যে, যে নাকি বৈঠক ছেড়ে এক পা-ও নড়েনি, যতক্ষণ ওরা শিখে নিচ্ছিল। এসব দিনে পিয়েত্র ক্রেসপির পরনে থাকত আঁটসাঁট নরম কাপড়ের এক বিশেষ ধরনের প্যান্ট আর বিশেষ ধরনের চপ্পল।

‘তোমার এত দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই’, বলে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, ‘লোকটা হচ্ছে হিজড়া।’ কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত নাচ শেখা শেষ না হয় আর লোকটা মাকন্দ থেকে চলে না যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত সে তার পাহারায় যতি টানে না। তখন আরম্ভ হয় উৎসবের প্রস্তুতি। উরসুলা তৈরি করে নিমন্ত্রিতদের এক কড়াকড়ি তালিকা যেখানে শুধু বাছাই করা হয় মাকন্দ পত্তনকারীদের আর তাদের বংশধরদের। ব্যতিক্রম ছিল শুধু অজ্ঞাত পিতাদের দ্বারা আরও দুই সন্তানের জন্ম দেওয়া পিলার তেরনেরার পরিবার। সত্যিকার অর্থে সমাজের এক বিশেষ স্তরই শুধু আমন্ত্রিত হয়েছিল। আর শুধু বন্ধুত্বের মনোবৃত্তির ওপর নির্ভর করেই তাদের নির্বাচন করা হয়েছিল। কারণ, সৌভাগ্যবানেরা শুধু মাকন্দ পত্তন অভিযানের আগে থেকে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার যে সুহৃদ তা-ই নয়, বরং তাদের ছেলেরা ছিল আউরেলিয়ানো আর আর্কাদিওর শৈশবের নিত্যসঙ্গী। একমাত্র ওদের মেয়েরাই বাড়িতে আসত রেবেকা আর আমারান্তার সঙ্গে, এমব্রয়ডারি করতে।

দয়াশীল শাসক দন আপলিনার মসকতের ক্ষমতা সীমিত ছিল ওর অন্ন সংস্থানে ও দুই লাঠিধারী পুলিশের ভরণপোষণে, যা ছিল নিছকই লোক দেখানো। বাড়ির খরচ মেটানোর জন্য তার মেয়েরা এক সেলাইয়ের দোকান খোলে। যেখানে সেলাই করা হতো ফেল্টের ফুল। পাশাপাশি করা হতো পেয়ারার তৈরি মিষ্টি অথবা চাহিদা অনুযায়ী প্রেম নিবেদনপত্র। কিন্তু বিনয়ী, পরিশ্রমী, গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী আর নতুন ধরনের নাচে সবচেয়ে দক্ষ হলেও উৎসবের আমন্ত্রণ ওরা সংগ্রহ করতে পারে না।

যখন উরসুলা আর মেয়েরা আসবাবপত্রের মোড়ক খুলছে, ধুলা ঝাড়ছে থালা-বাসনের, টাঙাচ্ছে নৌকাভরা গোলাপসহ কুমারী মেয়েদের ছবি, যা কিনা রাজমিস্ত্রিদের বানানো নতুন খালি জায়গায় জীবনের প্রাণস্পন্দন এনে দিচ্ছে, তখন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি খোঁজার ব্যাপারে ইস্তফা দেয়, আর ঈশ্বরের অনস্তিত্বে নিশ্চিত হয়ে পিয়ানোলাটা বিভিন্ন অংশে খুলে ফেলে ওটার ভেতরের জাদুকরি গোপন ব্যাপারটা উন্মোচনের জন্য। উৎসবের দুই দিন আগে ঠিক জায়গামতো লাগাতে না পারা পিন আর পিয়ানোলার হাতুড়ির মধ্যে ডুবে, একদিক থেকে খুলে ফেলা জট অন্যদিকে পেঁচিয়ে যাওয়ার সমস্যায় হাবুডুবু খেয়ে, কোনো রকমে সে একসঙ্গে লাগায় পিয়ানোলাটা। ওই সময়ের তুলনাহীন ব্যস্ততা আর দৌড়াদৌড়ির মধ্যেও পিচের বাতিগুলো আগে থেকে নির্দিষ্ট করা দিন এবং ঘণ্টায় জ্বালানো হয়। বাড়িটা খোলা হয় যখন, তখনো সেখান থেকে ভেজা চুন আর রজনের গন্ধ বের হচ্ছিল। পত্তনকারীদের ছেলেরা আর নাতিরা পরিচিত হয় ফার্ন আর বেগোনিয়ার বারান্দার সঙ্গে, নিঃশব্দ ঘরগুলোর সঙ্গে আর বাগানভর্তি গোলাপের সুবাসের সঙ্গে আর ওরা সমবেত হয় বসার ঘরে, সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা এক অজ্ঞাত আবিষ্কারের সামনে। যারা জলাভূমির অন্যান্য লোকবসতিতে জনপ্রিয় পিয়ানোলা যন্ত্রটার সঙ্গে পরিচিত ছিল, তারা সামান্য হতাশ হয়। তিক্ত মোহভঙ্গ ঘটে উরসুলার যখন আমারান্তা আর রেবেকার নৃত্যপর্বের শুরু করার জন্য প্রথম রোলটা লাগানো হয়, আর দেখা যায় যন্ত্রটা কাজ করছে না। প্রায় অন্ধ, বয়সের ভারে ভগ্ন মেলকিয়াদেস তার প্রাচীন শৈল্পিক বিজ্ঞতা দিয়ে যন্ত্রটাকে সারতে চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ভুলবশত আটকে থাকা একটা যন্ত্রাংশ নাড়িয়ে দেওয়ার পর প্রথমে সুর বেরিয়ে আসে বিস্ফোরণের মতো। পরে সব কটি জটিল গোলমেলে স্বরের ঝরনারূপে, কোনো কনসার্টের শৃঙ্খলা ছাড়াই তারগুলোতে বেপরোয়া আঘাত হাতুড়িগুলোকে পাগল করে তোলে। কিন্তু সমুদ্রের খোঁজে পাহাড় ডিঙিয়ে পশ্চিম দিক থেকে আসা এক শ জন একগুঁয়ে লোকের বংশধরেরা সুরের জগাখিচুড়ির বাধাকে অগ্রাহ্য করে, আর ওদের নাচ প্রলম্বিত হয় ভোর পর্যন্ত।

পিয়ানোলা সারানোর জন্য ফিরে আসে পিয়েত্র ক্রেসপি। রেবেকা আর আমারান্তা সাহায্য করে তারগুলোকে ঠিক জায়গায় বসাতে আর উচ্চহাস্যে ফেটে পড়ে গোলমেলে ওয়ালটজের সুরে। এসব ঘটে এতই স্বাভাবিক আর মাধুর্য নিয়ে যে উরসুলা পাহারা দেওয়া বাদ দেয়। যাওয়ার এক দিন আগে সারিয়ে ফেলা পিয়ানোলাটা দিয়ে এক বিদায় নাচের আয়োজন করে পিয়েত্র আর নৈপুণ্যসহ রেবেকাকে প্রদর্শন করে আধুনিক নাচ। আর্কাদিও আর আমারান্তা একই রকম আনন্দ আর নৈপুণ্যসহকারে যোগ দেয়, কিন্তু নাচে বিঘ্ন ঘটে যখন কৌতূহলীদের সঙ্গে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা পিলার তেরনেরা এক মেয়েকে বলতে শোনে, ‘যুবক আর্কাদিওর নিতম্ব মেয়ে মানুষের মতো’, আর সে তার সঙ্গে কামড়াকামড়ি, চুলোচুলি বাধায়। মধ্যরাত্রে পিয়েত্র ক্রেসপি বিদায় নেয় এক আবেগপূর্ণ আলাপের মাধ্যমে, খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। রেবেকা ওকে সঙ্গ দেয় দরজা পর্যন্ত আর বাড়ির সব দরজা বন্ধ এবং বাতি নেভানোর পর সে ঘরে ঢোকে কান্নার জন্য। সে ছিল এক অসান্ত্বনাদায়ক কান্না, যা গড়িয়েছিল অনেক দিন পর্যন্ত, এর কারণ কেউ জানত না, এমনকি আমারান্তাও নয়। ওর এই গোপনীয়তা কোনো নতুন ব্যাপার ছিল না। যদিও তাকে মনে হতো খোলামেলা আর আন্তরিক কিন্তু তার ছিল এক নিঃসঙ্গতায় ভরা চরিত্র আর দুর্ভেদ্য মন। সে ছিল লম্বা আর শক্ত হাড়ের চমৎকার এক কিশোরী, কিন্তু নিজের সঙ্গে নিয়ে আসা, বারবার মেরামত করার পরও হাতলবিহীন কাঠের দোলচেয়ারটাকে ব্যবহারের ব্যাপারে সে ছিল অনড়। কেউই জানত না যে এই বয়সেও সে বজায় রেখেছিল আঙুল চোষার অভ্যাসটা। এ কারণে সে বাথরুমে নিজেকে বন্দী করার সুযোগটা হাতছাড়া করত না আর একই সময় দেয়ালের দিকে মুখ করে ঘুমানোর অভ্যাসটাও সে আয়ত্ত করে ফেলে।

বৃষ্টিভেজা বিকেলগুলোতে যখন বেগোনিয়া-ঢাকা বারান্দায় একদল বান্ধবীর সঙ্গে সে এমব্রয়ডারি করত, তখন তার আলাপের সুতো ছিঁড়ে গেলে তাকিয়ে দেখত ভেজা মাটির স্তূপগুলো আর স্মৃতিকাতর একফোঁটা জল এসে ভিজিয়ে দিত ওর চোখ ও জিব। তখন সে কাঁদতে আরম্ভ করত আর অন্য সময়ে কমলা ও রেউচিনির কাছে হেরে যাওয়া নিভৃত ভালো লাগাগুলো অদম্য বাসনা নিয়ে আঘাত করত ওকে। তখন আবার মাটি খেতে আরম্ভ করে সে। প্রথমবার খায় শুধু কৌতূহলবশত, নিশ্চিত হয় যে মাটির খারাপ স্বাদই প্রলোভনের সবচেয়ে ভালো প্রতিষেধক হবে, আর সত্যিই মুখের ভেতর মাটি সে সহ্য করতে পারছিল না। কিন্তু ক্রমবর্ধিষ্ণু উৎকণ্ঠার তাড়নায় নিজেকে জোর করে বারবার আর আস্তে আস্তে উদ্ধার পায় তার বংশগত ক্ষুধা, মৌল খনিজগুলোর প্রতি ভালো লাগা, আদি খাবারের অভিন্ন পরিতৃপ্তি। মুঠি মুঠি মাটি পকেটে ভরার পর একটু একটু করে খেত সবার আড়ালে। খেত ভালো লাগা আর উগ্র রোষের সম্মিলিত এক বিভ্রান্তিকর মনোভাব নিয়ে। কাজটা সে করত বান্ধবীদের সেলাইয়ের সবচেয়ে কঠিন ফোঁড় শিখিয়ে দিতে দিতে আর অন্য পুরুষ মানুষ সম্বন্ধে আলাপ করতে করতে, যে পুরুষেরা চুন খাওয়ার মতো ত্যাগ স্বীকারের পাত্র নয়। মুঠি মুঠি মাটি ওকে নিয়ে যেত তার আরও কাছে, ওকে করে তুলত আরও নিশ্চিত যে এই অধঃপতনের মতো ত্যাগ স্বীকারের যোগ্য পৃথিবীতে একজন লোকই আছে, যার পরিশীলিত চামড়ার বুট পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে প্রেরণ করছে রেবেকাকে তার ভার ও রক্তের উত্তাপ এক খনিজ স্বাদের মাধ্যমে, যে স্বাদ মেয়েটার মুখে রেখে যেত এক খসখসে তিক্ততা আর হৃদয়ে রেখে যেত শান্তির পলি।

কোনো কারণ ছাড়াই এক বিকেলে আমপারো মসকতে বাড়িটার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার অনুমতি চায়। এই আকস্মিক আগমনে অপ্রস্তুত আমারান্তা ও রেবেকা কঠোর লৌকিকতার সঙ্গে ওদের আপ্যায়ন করে। তাদের সংস্কার করা ভবনটা ঘুরিয়ে দেখায়, বাজিয়ে শোনায় পিয়ানোলাটা আর পরিবেশন করে বিস্কুটের সঙ্গে কমলার শরবত। যে অল্পক্ষণ উরসুলা ওদের সঙ্গে ছিল, সে সময়ের মধ্যেই সম্ভ্রম, চরিত্রের মাধুর্য আর শিষ্টাচার দিয়ে আমপারো তাকে মুগ্ধ করে। ঘণ্টা দুয়েক পরে যখন আলাপচারিতা নিস্তেজ হওয়ার পথে, তখন আমারান্তার অসতর্কতার সুযোগে রেবেকাকে দেয় এক চিঠি। ও শুধু দেখতে পেল ‘সম্মানিতা সেনঞরিতা রেবেকা বুয়েন্দিয়া’ লেখা নামটা, অক্ষরের সেই একই বিন্যাসে লেখা, একই সবুজ কালি আর একইরকম সূক্ষ্মতার সঙ্গে সাজানো শব্দগুলো, যেভাবে লেখা রয়েছে পিয়ানোলাটাকে চালানোর নিয়মকানুন। আঙুলের ডগা দিয়ে ভাঁজ করে চিঠিটা আর আমপারো মসকতেকে আমৃত্যু নিঃশর্ত সহযোগিতা ও কৃতজ্ঞতার প্রতিশ্রুতিদায়ক অভিব্যক্তির চাহনি সহকারে লুকিয়ে ফেলে সেটা বডিসের ভেতর।

আমপারো মসকতে ও রেবেকা বুয়েন্দিয়ার এই আকস্মিক বন্ধুত্ব আউরেলিয়ানোর মনে আশা জাগিয়ে তোলে। ছোট রেমেদিওসের স্মৃতিযন্ত্রণা রেহাই দেয়নি ওকে কিন্তু রেমেদিওসকে দেখার মতো কোনো সুযোগও হয় নি তার। ম্যাগনিফিকো ভিসবাল ও হেরিনেলদো মার্কেস, গ্রাম পত্তনকারীদের ছেলে, যাদের নাম ছিল বাপের মতো একই নামে নাম, তারা ছিল আউরেলিয়ানোর নিকটতম বন্ধু। যখন ওদের সঙ্গে আউরেলিয়ানো গ্রামের পথে বেড়াত, তখন ওকে উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে খুঁজে বেড়াত সেলাইয়ের দোকানে, কিন্তু শুধুই দেখা যেত বড় দুই বোনকে। আমপারো মসকতের এই বাড়িতে উপস্থিতিটা ছিল যেন একটা কিছুর পূর্বাভাস। ‘ওর সঙ্গে তাকে আসতেই হবে’—এই কথাটা প্রবল বিশ্বাসের সঙ্গে এতবার সে পুনরাবৃত্তি করে, যে এক বিকেলে যখন সে ছোট একটা সোনার মাছ বানাচ্ছিল, তখন নিশ্চিত হয় যে সে তার ডাকে সাড়া দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর সত্যি সত্যিই শুনতে পায় বালিকাদের গলা, আর ভয়ে জমে যাওয়া হৃদয় নিয়ে দৃষ্টি তুলতেই দেখে গোলাপি রঙের অর্ধস্বচ্ছ কাপড় দিয়ে বানানো জামা আর সাদা জুতা পরিহিত বালিকাটিকে।

‘ওখানে ঢুকো না’, বলে বারান্দা থেকে আমপারো মসকতে—’ওরা ওখানে কাজ করছে।’ কিন্তু আউরেলিয়ানো ওই কথায় সাড়া দেওয়ার সময় ওকে দেয় না। মাছের মুখ থেকে বের হওয়া চেইন ধরে সোনার মাছটা টেনে ধরে তুলে বলে, ‘ভেতরে এসো। ‘ রেমেদিওস কাছে এসে মাছটি সম্বন্ধে কিছু প্রশ্ন করে তাকে কিন্তু হঠাৎ এসে পড়া হাঁপানি আউরেলিয়ানোকে উত্তর দিতে বাধা দেয়। অনন্তকালের জন্য থাকতেই ইচ্ছা হয় তার এই লিলি ফুলের মতো মুখের সঙ্গে, এই পান্নাসবুজ চোখের সঙ্গে, প্রতিবার নিজের বাবাকে সম্মান দিয়ে যেভাবে স্যার বলে, সেই একই সম্মান দিয়ে যে গলার স্বরটা আউরেলিয়ানোকে ডাকছিল ‘স্যার’ বলে, সেই স্বরের খুব কাছাকাছি থাকতে। মেলকিয়াদেস বসা ছিল কোনার টেবিলে আর আঁকিবুকি করছিল অর্থ উদ্ধারে অসম্ভব সংকেত লিপি নিয়ে। আউরেলিয়ানো ওকে ঘৃণা করে ওই মুহূর্তে। রেমেদিওসকে মাছটা উপহার দেবে, এটা বলা ছাড়া সে আর কিছুই করতে পারে না, আর এই নৈবেদ্যের আকস্মিকতায় মেয়েটা এতই ভয় পায় যে দ্রুত কর্মস্থল ত্যাগ করে সে। যে গোপন ধৈর্য নিয়ে আউরেলিয়ানো ওকে দেখতে পাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, ওই বিকেলে সে তা হারিয়ে ফেলে। কাজে অন্যমনস্ক হয় সে। মরিয়া হয়ে সব শক্তি কেন্দ্রীভূত করে অনেকবার তাকে ডেকে যায় আপন মনে কিন্তু রেমেদিওস তাতে সাড়া দেয় না। ওকে খুঁজে বেড়ায় ওর বোনদের কাজের জায়গায়, ওদের বাড়ির জানালার পর্দার পেছনে, ওর বাবার অফিসে, কিন্তু একমাত্র পায় ওর নিজস্বতায় জমে ওঠা ভয়ংকর একাকিত্বের প্রতিচ্ছবি। সে পার করে দিত ঘণ্টার পর ঘণ্টা খাবার ঘরে রেবেকার সঙ্গে পিয়ানোলায় ওয়ালটজ শুনে। রেবেকা শুনত কারণ ওটা ছিল সেই গান, যার সঙ্গে পিয়েত্র ক্রেসপি নাচতে শিখিয়েছিল ওকে, আউরেলিয়ানো শুনত কারণ সবকিছুই, এমনকি বাজনাও তাকে মনে করিয়ে দিত রেমেদিওসের কথা।

ভালোবাসায় ভরে ওঠে বাড়িটা। আউরেলিয়ানো তা প্রকাশ করে পদ্যের মাধ্যমে, যার কোনো আরম্ভ ছিল না এমনকি ছিল না শেষও। ওগুলোকে লিখত সে মেলকিয়াদেস থেকে উপহার পাওয়া খসখসে পার্চমেন্ট কাগজে, গোসলখানার দেয়ালে, নিজের বাহুর চামড়ায়, আর সব কটি পদ্যেই উপস্থিত হতো রূপান্তরিত রেমেদিওস; বেলা দুটোর নিদ্রা উদ্রেককারী বাতাসে রেমেদিওস, গোলাপের নীরব নিশ্বাসে রেমেদিওস, প্রজাপতির কাচ, ঘড়ির গোপনীয়তায় রেমেদিওস, রেমেদিওস ভোরের রুটিতে ওঠা ভাপে, রেমেদিওস সব জায়গায় আর রেমেদিওস অনন্তকালের জন্য। বিকেল চারটার সময় এমব্রয়ডারি করতে করতে জানালার পাশে ভালোবাসার অপেক্ষা করত রেবেকা। ও জানত যে ডাক বওয়া খচ্চরটা প্রতি পনেরো দিনে আসে একবার, কিন্তু সে অপেক্ষা করত সব সময়; ভুল করে কোনো একদিন চলে আসবে, এই স্থির বিশ্বাসে। কিন্তু ঘটে তার ঠিক উল্টোটা; একবার খচ্চরটা এল না নির্দিষ্ট দিনে আর হতাশায় পাগল হয়ে মধ্যরাত্রিতে বাগানে গিয়ে মুঠি মুঠি মাটি খেল, আত্মহত্যার উদগ্র ইচ্ছায়, ক্রোধ আর কষ্ট নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে, নরম কেঁচো চিবোতে চিবোতে আর শামুকের খোলসের ঘায়ে মাড়ি ক্ষতবিক্ষত করতে করতে। ভোর পর্যন্ত বমি করে চলে সে। ডুবে যায় এক অবসন্নতার চরমে, বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলে, আর ওর হৃদয় খুলে যায় অশালীন প্রলাপবিকারে। এতে মর্মঘাতী হয়ে উরসুলা তোরঙ্গের তালা ভেঙে একেবারে তলায় পায় গোলাপি ফিতা দিয়ে বাঁধা সুবাসিত ষোলোটি চিঠি, প্রাচীন বইয়ের মধ্যে রাখা গাছের পাতা আর ফুলের পাপড়ির কঙ্কাল আর শুকিয়ে যাওয়া প্রজাপতি যা ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গুঁড়ো হয়ে ধুলোয় পরিণত হয়। একমাত্র আউরেলিয়ানোরই ক্ষমতা ছিল ওর এই শোকাহত অবস্থাকে বুঝতে পারার। সেই বিকেলে, উরসুলা যখন রেবেকাকে তার উদ্ভ্রান্ত অবস্থা থেকে উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে, আউরেলিয়ানো তখন ম্যাগনিফিকো ভিসবাল ও হেরিনেলদো মার্কেসের সঙ্গে কাতরিনার দোকানে যায়। জায়গাটাকে বাড়ানো হয়েছিল এক কাঠের ঘর দিয়ে যেখানে নিঃসঙ্গ মেয়েরা থাকে মৃত ফুলের গন্ধ নিয়ে। অ্যাকোরডিয়ান আর বোলসহ একটি দল ফ্রান্সিসকো এল অমরের গান গেয়ে চলে কারণ ফ্রান্সিসকো বেশ কয়েক বছর হলো মাকন্দ থেকে উধাও হয়ে গেছে। তিন বন্ধু গাঁজানো গুয়ারাপো (আখের রস দিয়ে বানানো পানীয়) পান করে। ম্যাগনিফিকো আর হেরিনেলদো হচ্ছে আউরেলিয়ানোরই সমসাময়িক কিন্তু দুনিয়ার হালহকিকতে তারা অনেক বেশি ওয়াকিবহাল। ওরা সেখানে নিয়মমাফিক মেয়েদের কোলে বসিয়ে পান করে যায়। চিমসে যাওয়া সোনার দাঁতওয়ালা ওদেরই একজন কুৎসিতভাবে আদর করে আউরেলিয়ানোকে আর সে তাকে প্রত্যাখ্যান করে। সে বুঝতে পারে যতই পান করছে, ততই মনে পড়ে যাচ্ছে রেমেদিওসের কথা, কিন্তু তেমনই আরও বেশি অসহ্য হচ্ছে তার স্মৃতির যন্ত্রণা। সে বুঝতেও পারল না কখন সে ভাসতে শুরু করেছে। দেখতে পায় তার বন্ধুরা আর মেয়েরা উজ্জ্বল আলোর প্রতিবিম্বে ভেসে বেড়াচ্ছে, ওজনবিহীন, আয়তনবিহীন, বলা কথাগুলো ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরোচ্ছে না, আর ওরা এমন সব ইঙ্গিত করছে যা তাদের মুখভঙ্গির সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। কাতরিনা ওর পিঠে হাত রেখে বলে, ‘এগারোটা বাজতে যাচ্ছে।’ আউরেলিয়ানো মাথা ঘুরিয়ে কানে গোঁজা ফেল্টের ফুলসহ বিশাল বিকৃত মুখটা দেখে আর তখনই স্মৃতিবিলোপ ঘটে তার, যেমনটা ঘটত বিস্মরণের সময়। তার স্মৃতির পুনরুদ্ধার হয় এক অদ্ভুত ভোরে; এক কামরায়, যেটা ছিল সম্পূর্ণই অপরিচিত। তার সঙ্গে সংযুক্ত হয় খালি পায়ে, উষ্কখুষ্ক চুলসহ পিলার তেরনেরা, তাকে দেখছে এক বাতির আলোয় আলোকিত করে অবিশ্বাস্য চোখে।

‘আউরেলিয়ানো!’

নিজের পায়ে স্থির হয়ে মাথা তোলে আউরেলিয়ানো। সে জানত না কীভাবে এখানে এসেছে, কিন্তু জানত আসার উদ্দেশ্য। কারণ শৈশব থেকে তা গোপনে বহন করছিল হৃদয়ের অলঙ্ঘ্য দুর্ভেদ্য অংশে। ‘আপনার সঙ্গে শুতে এসেছি’ বলে। কাদা আর বমিতে মাখামাখি ছিল ওর পরনের জামাকাপড়। পিলার তেরনেরা তখন বাস করত শুধু নাবালক দুই ছেলেদের নিয়ে, সে তাকে কোনো প্রশ্নই করে না। ঘরে নিয়ে ওকে মুখটা মুছে দেয় এক ভেজা স্পঞ্জ দিয়ে, খুলে ফেলে তার পরিহিত বস্ত্র; পরে নিজে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে মশারি নামিয়ে দেয়, যাতে ছেলেরা জেগে উঠলে দেখতে না পায়। যে লোকটার আসার কথা ছিল, যে লোকগুলো চলে গিয়েছে, তাদের অনিশ্চয়তাময় আচরণে বিভ্রান্ত হয়ে অগণিত যে লোকগুলো তার বাড়ির পথ খুঁজে পায় নি, তাদের আগমনের আশায় থেকে থেকে সে ক্লান্ত হয়ে গেছে। এই দীর্ঘ অপেক্ষায় ভাঁজ পড়েছে ওর চামড়ায়, স্তনগুলো হয়ে গেছে খালি, আর নিভে গেছে হৃদয়ের অঙ্গার। অন্ধকারে আউরেলিয়ানোকে খুঁজে নিয়ে পেটের ওপর হাত রেখে গলায় চুমু খায় মাতৃসুলভ কোমলতা নিয়ে। ‘অভাগা ছেলে আমার’ বিড়বিড় করে সে। কেঁপে ওঠে আউরেলিয়ানো। এক প্রশান্ত দক্ষতায় বিন্দুমাত্র ভুল না করে পেছনে সরিয়ে দেয় তার পর্বতপ্রমাণ কষ্ট আর রেমেদিওস হয়ে পড়ে ছোট জন্তু আর সদ্য ইস্তিরি করা জামার গন্ধে ভরা সীমানাবিহীন জলাভূমি। যখন স্বাভাবিক হলো, তখন সে কাঁদছে। গোড়াতে কান্নাটা ছিল নিজের অজান্তেই থেকে থেকে ফুঁপিয়ে ওঠা কান্না, পরে খালি করে দেয় এক বাঁধনহীন ঝরনাধারা, যেন ওর ভেতরে স্ফীত যন্ত্রণাদায়ক কিছু একটা বিস্ফোরিত হয়েছে। পিলার অপেক্ষা করে আঙুলের ডগা মাথায় বুলিয়ে দিতে দিতে, যতক্ষণ পর্যন্ত না আউরেলিয়ানোর শরীর ছেড়ে যায় সেই কালো পদার্থ, যা তাকে বাঁচতে দিচ্ছিল না। তখন পিলার তেরনেরা জিজ্ঞেস করে, ‘কে সে’, আর আউরেলিয়ানো বলে তার কথা। পিলার হেসে ফেলে সেই হাসি, যে হাসি শুনে অন্য সময় ঘুঘুরা চমকে যেত, কিন্তু এবার এমনকি বাচ্চারাও ঘুম থেকে জাগে না সেই হাসিতে। ‘প্রথমে তাকে লালন করা শেষ করতে হবে তোকে’, ব্যঙ্গ করে সে। কিন্তু এই ব্যঙ্গের আড়ালে আউরেলিয়ানো খুঁজে পায় এক সহানুভূতির স্থির জলাধার। যখন সে ঘর থেকে বের হয়, তখন শুধু যে তার পুরুষত্ব সম্বন্ধে অনিশ্চয়তা ত্যাগ করে তা-ই নয়, এতগুলো মাস ধরে তার হৃদয়ভরা তিক্ততার ভারও ফেলে রেখে আসে পেছনে। হঠাৎ করেই পিলার তেরনেরা অঙ্গীকার করে বসে, ‘বালিকাটির সঙ্গে আমি কথা বলব’, ওকে বলে, ‘আর দেখে নিস, ওকে আমি তোর থালায় এনে পরিবেশন করব।’ অঙ্গীকার পূরণ করে সে, কিন্তু এক খারাপ সময়ে, কারণ বাড়িটা এখন হারিয়ে ফেলেছে সেই অন্য দিনগুলোর শান্তি।

রেবেকার চিৎকারের কারণ গোপন রাখা সম্ভব না হওয়ায় সবাই ওর আসক্তির কথা জেনে যায়, আর এদিকে আমারান্তা ভোগে প্রচণ্ড জ্বরে, যেন নিঃসঙ্গ প্রণয়ের কণ্টক ফুটেছে ওর মধ্যেও। গোসলখানার দরজা বন্ধ করে প্রণয়ের ঝড় উজাড় করত আশাহীন আবেগতপ্ত চিঠি লিখে আর সন্তুষ্ট হতো তোরঙ্গের তলায় ওগুলোকে লুকিয়ে রেখে। উরসুলা কোনো রকমে দুজন রোগীর দেখাশোনা করার সময় করে উঠতে পারে। অনেক সময় ধরে গোপন জেরা করার পরও আমারান্তার এই অবস্থার কারণের স্বীকারোক্তি আদায় করা যায় না। পরিশেষে এক ক্ষণিক খেয়ালবশে তোরঙ্গের তালা ভেঙে পাওয়া যায় গোলাপি ফিতা বাঁধা তাজা লিলি ফুলে স্ফীত, আর চোখের জলে ভেজা চিঠিগুলো; যেগুলো পিয়েত্র ক্রেসপিকে উদ্দেশ করে লেখা আর কখনো সেগুলো তাকে পাঠানো হয় নি। সে রাগে কাঁদতে কাঁদতে শাপান্ত করে সেই সময়টাকে, যখন তার ইচ্ছা হয়েছিল পিয়ানোলাটাকে কেনার, আর বন্ধ করে দেয় এব্রয়ডারির ক্লাস। যদিও কেউ মারা যায়নি; তবু ঘোষণা করে একধরনের শোকাবস্থার, যেটা নাকি চলতে থাকবে যত দিন না মেয়েরা পিয়েত্রর আশা ত্যাগ করছে। এ ক্ষেত্রে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার মধ্যস্থতা বৃথাই গেল, কারণ সে পিয়েত্র ক্রেসপির বাদ্যযন্ত্রের ওপর দক্ষতা দেখে তার সম্পর্কের পূর্বধারণা বদলে ফেলেছিল। ফলে যখন পিলার তেরনেরা আউরেলিয়ানোকে বলে যে রেমেদিওস তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন সে বুঝতে পারে যে খবরটা তার বাবা-মাকে যন্ত্রণার শেষ অবস্থায় নিয়ে যাবে। কিন্তু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কাজটা করতে হয় তার। অতিথিদের বসার ঘরে এক আনুষ্ঠানিক আলোচনায় আমন্ত্রিত হয়ে ছেলের সাহসী ঘোষণা শোনে তারা, যদিও দয়িতার নাম শুনে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া অপমানে লাল হয়ে যায়। বজ্রাহতের মতো হয়ে বলে, ‘প্রেম হচ্ছে মহামারি। এত সুন্দরী আর ভদ্র মেয়ে থাকতে একমাত্র তোর বিয়ে করার ইচ্ছা হল শত্রুর মেয়েকে!’ কিন্তু উরসুলা একমত হয় ওর এই পছন্দের সঙ্গে। স্বীকার করে যে সত্যিই মসকতের সাত বোনই সৌন্দর্য, কর্তব্যপরায়ণতা, সহবৎ, উত্তম শিক্ষার দিক থেকে উল্লেখযোগ্য আর ছেলের সিদ্ধান্তে খুশি হয় সে। স্ত্রীর এই উৎসাহের কাছে হার মেনে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া এক শর্ত জারি করে-’পিয়েত্র ক্রেসপি রেবেকাকেই ভালোবেসেছে এবং সে-ই বিয়ে করবে পিয়েত্র ক্রেসপিকে। যখন হাতে সময় হবে উরসুলা নিয়ে যাবে আমারান্তাকে প্রাদেশিক রাজধানীতে, যাতে বিভিন্ন লোকজনের সংস্পর্শে এসে সে এই হতাশা থেকে আরোগ্য লাভ করে।’ এই সিদ্ধান্ত জানার পরপরই রেবেকা সুস্থ হয়ে ওঠে; আর দয়িতের কাছে বাবা-মা তাদের বিয়েতে মত দিয়েছে, এই জানিয়ে এক উল্লসিত চিঠি লেখে। অন্য কারও সাহায্য না নিয়ে নিজেই ওটাকে ডাকে ফেলে আসে। আমারাত্তা সিদ্ধান্তটা মেনে নেওয়ার অভিনয় করে, আস্তে আস্তে তার জ্বর ভালো হয়ে যায় কিন্তু সে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করে যে একমাত্র তার মরা লাশকে ডিঙিয়েই রেবেকা বিয়ে করতে পারবে। পরের শনিবার আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া কালো কাপড়ের সেলুলয়েডের কলারসহ স্যুট, বাড়ি উদ্বোধনের দিন প্রথম পরা পশমি চামড়ার বুট পরে রেমেদিওস মসকতের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়। ম্যাজিস্ট্রেট আর তার স্ত্রী একই সঙ্গে আনন্দ আর দুশ্চিন্তা নিয়ে তাকে আপ্যায়ন করে কারণ এই অকস্মাৎ সফরের অর্থ তাদের ছিল অজানা, আর পরে ওরা ভাবে, তারা দয়িতার নাম গুলিয়ে ফেলেছে। ওর ভুল ভাঙাতে রেমেদিওসের মা তাকে ঘুম থেকে তুলে বাহু ধরে বসার ঘরে নিয়ে যায় যখন, তখনো তার চোখে ঘুম লেগে ছিল। সত্যিই সে বিয়ে করতে রাজি কি না, এই প্রশ্ন তাকে করায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে বলে যে সে শুধু চায় যে তাকে ঘুমাতে দেওয়া হোক। মসকতেদের এই বিভ্রান্তিকর অবস্থা বুঝতে পেরে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ব্যাপারটা খোলাসা করার জন্য আউরেলিয়ানোর কাছে যায়। যখন ফিরে আসে, ততক্ষণে মসকতে দম্পতি আনুষ্ঠানিক পোশাক পরে, আসবাবপত্রের অবস্থান বদলে, ফুলদানিগুলোতে নতুন ফুল সাজিয়ে, ওদের বড় মেয়েদের নিয়ে অপেক্ষা করছিল। ঘটনাটার অসামঞ্জস্য আর শক্ত কলারের অস্বস্তিতে পর্যুদস্ত হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ওদের নিশ্চিত করে যে রেমেদিওসই হচ্ছে পছন্দের পাত্রী।

‘এর কোনো মানেই নেই’, হতাশা নিয়ে বলে দন আপলিনার মসকতে, ‘আমাদের আরও ছয়টি মেয়ে আছে, সবাই অবিবাহিতা আর সবারই বিয়ের বয়স হয়েছে। যারা কিনা আপনার ছেলের মতো নিষ্ঠাবান আর পরিশ্রমী লোকের বউ হতে পারলে আনন্দিত আর সম্মানিত হতো। আর কিনা আউরেলিয়ানোর চোখ পড়ল একমাত্র তার ওপর, যে নাকি এখনো বিছানায় প্রস্রাব করে।’ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী তার স্ত্রী বেদনাক্লিষ্ট আঁখিপল্লব ও মুখভঙ্গি নিয়ে মসকতের ভুলের জন্য তিরস্কার করে। ফল বাটা শরবত পান শেষ করে আউরেলিয়ানোর সিদ্ধান্তে আনন্দের সঙ্গেই সম্মত হয় ওরা। শুধু সিনোরা (মিসেস) মসকতে একাকী উরসুলার সঙ্গে একবার আলাপের জন্য অনুনয় করে। পুরুষদের ব্যাপারে জড়ানোর জন্য আপত্তি জানালেও কৌতূহলী উরসুলা বাস্তবিক অর্থেই আবেগের কাছে হেরে পরদিন দেখা করতে যায়। আধ ঘণ্টা আলাপ করার পর এই সংবাদ নিয়ে ফেরে যে রেমেদিওসের তখনো যৌনলোম গজায়নি। আউরেলিয়ানো এটাকে কোনো একটা বড় বাধা হিসেবে গণ্য করে না। এত দিন অপেক্ষা করেছে, আরও যত দিন প্রয়োজন সে অপেক্ষা করবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না দয়িতার গর্ভধারণের বয়স হয়।

সম্পর্কের নতুন এই ঐকতান বাধাগ্রস্ত হয় মেলকিয়াদেসের মৃত্যুতে। যদিও ব্যাপারটা আগে থেকে জানা ছিল তবু পরিস্থিতিটা সুনির্দিষ্ট ছিল না। ফিরে আসার কিছুদিন পর থেকেই খুব দ্রুত সংকটজনকভাবে বুড়িয়ে যাওয়ার এক প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে সে আর কিছুদিনের মধ্যেই হয়ে পড়ে সেসব অকর্মা প্রপিতামহদের একজন, যারা ছায়ার মতো ঘুরে ঘুরে বেড়ায় পা টেনে টেনে; শোবার ঘরগুলোতে উচ্চ স্বরে জীবনের মধুর সময়গুলোর স্মৃতিচারণা করতে করতে; যাদের কেউ দেখাশোনা করে না; সত্যিকারভাবে তাদের কথা কারও মনেও পড়ে না, যতক্ষণ না তাদের বিছানায় পাওয়া যায় মৃত অবস্থায়। গোড়ার দিকে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ওর কার্যকলাপে সাহায্য করত দাগেরোটাইপের নতুনত্ব আর নস্ত্রাদামুসের ভবিষ্যদ্বাণীতে উৎসাহী হয়ে। কিন্তু ক্রমেই ওকে একাকিত্বের কাছে পরিত্যাগ করে, কারণ প্রতিবারই তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়ে উঠেছিল দুরূহ, সে হারিয়ে ফেলছিল তার দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি। মনে হতো যেন কথা বলছে সে মানবসভ্যতার আদিম অবস্থায় তার সঙ্গে পরিচিত কোনো মানুষের সঙ্গে। বাতাস হাতড়ে হাঁটত সে জিনিসপত্রের মধ্য দিয়ে এক অবিশ্বাস্য সাবলীলতার সঙ্গে। তার এই চলাফেরা যেন ইঙ্গিত করত সহজাত প্রবৃত্তির মাঝে থাকা তাৎক্ষণিক পূর্বধারণা দিয়ে তার দিকনিদর্শন করার ক্ষমতা। একদিন সে ভুলে যায় নকল দাঁতটা পরতে। সাধারণত রাতের বেলা বিছানার পাশে পানির মধ্যে রেখে দিত সেটা। সেদিন থেকে সেটাকে আর কখনো পরেনি সে। উরসুলা যখন বাড়িটা বানায়, তখন আউরেলিয়ানোর কর্মশালার পাশেই একটা বিশেষ কামরা তৈরি করায়, যেটা ছিল সব গার্হস্থ্য তৎপরতা আর হট্টগোল থেকে দূরে। ঘরটা জানালা দিয়ে আসা আলোয় ডুবে যেত আর সেখানে উরসুলা নিজেই ধুলো আর পোকার কারণে প্রায় নষ্ট হওয়া, ভেঙে পড়া কাগজ আর অবোধ্য চিহ্নে ঠাসা বইগুলোকে সাজিয়ে দিয়েছিল। আরও রেখেছিল বইগুলোর সঙ্গে নকল দাঁতগুলো, যেগুলোতে গজিয়েছিল একধরনের জলীয় গুল্ম আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হলুদ বর্ণের ফুল। খুব সম্ভবত নতুন জায়গাটা ভালো লেগেছিল মেলকিয়াদেসের। কারণ, তারপর তাকে আর কোথাও দেখা যেত না, এমনকি রান্নাঘরেও না। শুধু আউরেলিয়ানোর কর্মশালায় গিয়ে ঘণ্টা পর ঘণ্টা সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া পার্চমেন্ট কাগজে রহস্যময় সাহিত্যের হিজিবিজি আঁকত, যেগুলোকে দেখে মনে হতো এসব বানানো হয়েছে বালুর মতো কোনো এক কাঁচামাল দিয়ে, পেস্ট্রির মতো করে, যা ছোয়ামাত্রই ভেঙে যাবে। ওখানেই দিনে দুবার খাবার নিয়ে যেত ভিসিতাসিওন, যদিও শেষের দিকে তার ক্ষুধা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল আর শুধু খেত শাকসবজি। এতে খুব দ্রুতই নিরামিষভোজীদের অসহায়ত্ব ধারণ করে সে। তার চামড়া ঢেকে গিয়েছিল একধরনের নরম শৈবালে। একইভাবে তার মান্ধাতার আমলের পরনের জ্যাকেটটাও ঢাকা ছিল শৈবালে, যেটা সে কখনো খুলত না। আর তার নিশ্বাসের সঙ্গে বের হতো ঘুমন্ত পশুর দুর্গন্ধ। কবিতা লেখায় তন্ময় থাকায় আউরেলিয়ানো ওর কথা ভুলেই যায়, যদিও মাঝেমধ্যে এই একঘেয়ে গুনগুন করে বলা কথাগুলো সে বুঝতে পারছে মনে করে কান পাতত। সত্যি বলতে কি, তার এই টুকরো টুকরো কথাগুলো থেকে আলাদা করতে পেরেছিল হাতুড়ি পেটানোর মতো একটানা উচ্চারিত বিষুব বিষুব আর আলেক্সান্দার বন অমবোল্ট (বিজ্ঞানী ও ফিলসফার) এই শব্দ দুটো। আর্কাদিও কিছুটা বেশি ঘনিষ্ঠ হয়েছিল ওর সঙ্গে, যখন সে এসেছিল আউরেলিয়ানোকে রৌপ্যকর্মে সাহায্য করতে। মেলকিয়াদেস এই যোগাযোগের প্রচেষ্টায় সাড়া দিতে আর্কাদিও আর আউরেলিয়ানোর দিকে মাঝেমধ্যে নিক্ষেপ করত কিছু কাসতেইয়ানো শব্দ, যা ছিল সম্পূর্ণই বাস্তবতাবর্জিত। শুধু এক বিকেলে হঠাৎ আবেগে তাকে উজ্জ্বল হতে দেখা যায়, যেন যোগাযোগটা সে করতে পেরেছে। অনেক বছর পর ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখোমুখি আর্কাদিওর মনে পড়ে যাবে মেলকিয়াদেসের সেই কাঁপা কাঁপা স্বরে তার দুর্বোধ্য রচনা থেকে পড়া কয়েক পৃষ্ঠার কথা। বলাই বাহুল্য, সে কিছুই বোঝেনি আর এই উচ্চ স্বরে পঠিত বাক্যগুলো ছিল গির্জায় গাওয়া গানের মতো। তারপর বহুদিনের মধ্যে এই প্রথমবার হেসে কাসতেইয়ানোতে (স্প্যানিশ) বলে, ‘আমি মারা যাওয়ার পর তিন দিন আমার ঘরে পারদ পোড়াবে।’ ঘটনাটা হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াকে জানালে সে আরও বিশদ ব্যাখ্যা জানার চেষ্টা চালায়। এতে করে একমাত্র উত্তর পায়, ‘আমি অমরত্ব খুঁজে পেয়েছি।’

মেলকিয়াদেসের শ্বাসপ্রশ্বাসে দুর্গন্ধ বের হতে শুরু হলে আর্কাদিও বৃহস্পতিবার বিকেলে গোসল করানোর জন্য নদীতে নিয়ে যেত। তাতে মনে হতো, অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। সে উলঙ্গ হতো আর পানিতে নামত অন্য ছেলেদের সঙ্গে। রহস্যময় দিকনির্দেশক ক্ষমতাটা তাকে সাহায্য করত নদীর গভীর আর বিপজ্জনক জায়গাগুলো এড়িয়ে যেতে। ‘আমরা পানি দিয়ে তৈরি।’ একবার সে বলেছিল। এভাবেই কাটে অনেক দিন যে দিনগুলোতে ঘরের কেউ ওকে দেখে নি, শুধু যেদিন সে পিয়ানোলা সারানোর চেষ্টা করে সেই রাতটা আর যখন আর্কাদিওর সঙ্গে নদীতে যেত, বগলতলায় তোয়ালে দিয়ে মোড়া তোতুমোর খোলে তালের সাবান নিয়ে, সেই সময়গুলো ছাড়া। এক বৃহস্পতিবার নদীতে নেওয়ার ডাকের আগে আউরেলিয়ানো ওকে বলতে শোনে, ‘আমার মৃত্যু হয়েছে জ্বরে, সিঙ্গাপুরের বালিয়াড়িতে।’

ওই দিন পানিতে নামে এক খারাপ জায়গা দিয়ে; আর এর ফলে পরদিন সকাল পর্যন্ত তাকে পাওয়া যায় নি। কয়েক মাইল ভাটিতে এক তীক্ষ্ণ আলোকিত বাঁকে পাওয়া যায় তাকে, আর তার পেটের ওপর বসে ছিল এক নিঃসঙ্গ শকুন। উরসুলা শোকে প্রচুর কাঁদে, যতটুকু সে কাঁদে নি নিজের বাবার মৃত্যুর সময়ও। তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ সত্ত্বেও হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া লাশটাকে দাফন করার বিরোধিতা করে, ‘সে হচ্ছে অমর!’ বলে, ‘সে পুনর্জীবন লাভের সূত্রগুলো জানিয়ে গেছে।’

কার্যোপযোগী করে তোলা বিস্তৃত সাইফন আর এক কড়াইতে পারদ ফোটাতে শুরু করে তারা আস্তে আস্তে নীলচে বুদে ভরে যাওয়া মৃতদেহের পাশে। দন আপলিনার মসকতে সাহস করে মনে করিয়ে দেয় যে ডুবে মরা, কবর না দেওয়া লাশ, জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক। ‘ওসব কিছুই হবে না। কারণ, এখনো সে জীবিত’, উত্তর দেয় হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, আর এর পরের বাহাত্তর ঘণ্টা কাটায় পারদের গন্ধে ভরা ধোঁয়ার ভেতর। ততক্ষণে মৃতদেহ থেকে ওঠা নীলাভ লাল রঙের বুদ্বুদগুলো ফেটে যেতে আরম্ভ করেছে আর সারা বাড়ি আচ্ছন্ন গেছে ও থেকে উদ্ভূত মৃদু শিস ও দুর্গন্ধযুক্ত বাষ্পে আর একমাত্র তখনই আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া অনুমতি দেয় লাশ দাফনের, কিন্তু যেমন তেমনভাবে নয়, সম্মানের সঙ্গে, যেমনটি হওয়া উচিত মাকন্দের সবচেয়ে উপকারী লোকটার বেলায়। ওটাই ছিল মাকন্দের প্রথম দাফন আর সে দাফনের সময় মাকন্দে সবচেয়ে বেশি লোক জমায়েত হয় তখন। একমাত্র এক শ বছর পর বড় মায়ের শেষকৃত্য উৎসবেই এর চেয়ে বেশি লোক হয়েছিল। কবরস্থানের জন্য নির্বাচিত হয় এক জায়গা; আর তার কেন্দ্রে দাফন করা হয় তাকে। পাথরের এক স্মৃতিস্মারকে লেখা হয়, শুধু যা জানা গিয়েছিল তার সম্বন্ধে: মেলকিয়াদেস। পালন করা হয় নয়টি শোকরাত্রি। একবার আমারান্তা তার প্রেম নিবেদনের জন্য পিয়েত্র ক্রেসপিকে পায় কফি পান, কৌতুক করা আর তাস খেলার জন্য উঠানে জড়ো হওয়া হট্টগোলের মধ্যে, অন্য সময়ে আরবীয়রা গুয়াকামাইয়ার সঙ্গে তাস বদলের কারণে যে রাস্তাটাকে লোকজনকে তুর্কদের রাস্তা নামে নামকরণ করে, গ্রামের সেই অংশে। তখন পিয়েত্র ক্রেসপি একটি বাদ্যযন্ত্রের আর গুদামঘরসহ দোকান দিয়েছে, আর কয়েক সপ্তাহ আগে রেবেকার সঙ্গে তার বিয়ের প্রতিশ্রুতি আনুষ্ঠানিকভাবে পাকাপাকি করে ফেলেছে। যাকে দেখলে মেয়েদের পক্ষে দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে, সেই মাথাভরা উজ্জ্বল কোঁকড়া চুলওয়ালা ইতালীয় লোকটা আমারান্তার প্রস্তাব এক ছোট মেয়ের জিদ হিসেবে নেয়, যাকে পাত্তা দেওয়ার খুব একটা কারণ নেই বলে মনে করে সে। ‘আমার এক ছোট ভাই আছে’, ওকে বলে, ‘আমাকে দোকানে সাহায্য করতে আসছে।’

অপমানিত আমারান্তা বিদ্বেষপূর্ণ ঘৃণা নিয়ে বলে, তার এই বোনের বিয়ে বরবাদের জন্য যদি লাশ হয়ে দরজায় শুয়ে থাকতে হয়, তবে তার জন্যও সে প্রস্তুত। এই নাটকীয় হুমকি ইতালীয়কে এত বেশি প্রভাবিত করে যে সে রেবেকাকে ব্যাপারটা জানায়। এভাবেই উরসুলার ব্যস্ততার কারণে বারবার পিছিয়ে দেওয়া আমারান্তার ভ্রমণের প্রস্তুতি এক সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন হয়। আমারান্তা অমত করে না এতে, কিন্তু রেবেকাকে বিদায় চুম্বনের সময় কানে কানে বলে, ‘অলীক স্বপ্ন দেখিস না, যদি আমাকে পৃথিবীর অন্য প্রান্তেও নিয়ে যাওয়া হয়, তবু তোর এই বিয়ে ভাঙার জন্য একটা উপায় আমি বের করে ফেলবই। যদি এতে তোকে খুনও করতে হয়, তাহলে তা-ই করব।’

উরসুলার অনুপস্থিতি আর মেলকিয়াদেসের ঘরগুলোয় চুপিসারে পায়চারি করা উপস্থিতির ফলে বাড়িটাকে মনে হতো বিশাল ও শূন্যতায় ভরা। আদিবাসী মেয়েটা নিয়েছিল বেকারির দায়িত্ব, আর রেবেকা নেয় সংসারের যাবতীয় ভার। রাত হওয়ার সময় ল্যাভেন্ডারের সুগন্ধ ছড়িয়ে সব সময় হাতে খেলনা নিয়ে যখন পিয়েত্র ক্রেসপি উদয় হতো, তখন তার দয়িত তাকে আপ্যায়ন করত মূল বসার ঘরটাতে সব দরজা-জানালা সম্পূর্ণ খোলা রেখে, যাতে কারও মনে কোনো সন্দেহ না জাগে। এটা ছিল এক অপ্রয়োজনীয় সতর্কতা। কারণ, ইতালীয় লোকটা এমনকি সেই মেয়েটার হাতও স্পর্শ করত না যে নাকি এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তার স্ত্রী হতে যাচ্ছে। এসব আগমনের কারণে বাড়িটা ভরে যাচ্ছিল আশ্চর্যজনক সব খেলনা দিয়ে। দড়ি দিয়ে চালিত নৃত্যরতা মেয়ে, মিউজিক্যাল বক্স, দড়াবাজ বাঁদর, টাট্টু ঘোড়া, আর ঢোল বাজিয়ে ভাঁড়ের মতো বিস্ময়কর খেলনার সম্ভার ভুলিয়ে দেয় মেলকিয়াদেসের জন্য হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার শোকভার; আর ফিরিয়ে নিয়ে যায় তাকে সেই প্রাচীন আলকেমির সময়ে। তখন সে বাস করত এক নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলা জীবজন্তুর স্বর্গরাজ্যে, যেখানে দোলকের বিরতিহীন সূত্রের ওপর ভিত্তি করে বানানো যন্ত্রপাতি দিয়ে দোলকের সঞ্চারণকে নিখুঁত করার চেষ্টা করছে সে, আর অন্যদিকে আউরেলিয়ানো কর্মশালাকে অবহেলা করে ছোট রেমেদিওসকে পড়তে আর লিখতে শেখাচ্ছে। গোড়ার দিকে বালিকাটি তার খেলনা পুতুলগুলোকে গোসল করিয়ে কাপড় পরানোর খেলা থেকে বিরত হয়ে প্রতিদিন বিকেলে মানুষটাকে বৈঠকখানায় বসে আপ্যায়ন করার কারণে মানুষটার চেয়ে পুতুলগুলোকেই বেশি পছন্দ করত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আউরেলিয়ানোর ধৈর্য আর নিষ্ঠার ফলে আকৃষ্ট হয়ে সে এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিত বর্ণাক্ষর পড়ে, আর এক খাতায় রঙিন পেনসিল দিয়ে খামারে গোয়ালঘরসহ গরু আর হলুদ পেনসিল দিয়ে পাহাড়ের পেছনে অস্তগামী গোলাকার সূর্য এঁকে।

শুধু রেবেকাই ছিল অসুখী, আমারান্তার হুমকির কারণে। সে ভালোভাবেই পরিচিত ছিল বোনের চরিত্রের সঙ্গে, তার দুর্বিনীত মনের সঙ্গে, আর ভয় পেত তার ঈর্ষাপূর্ণ বিদ্বেষের তীব্রতাকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিত স্নানঘরে আঙুল চুষে, প্রাণান্তকর ইচ্ছাশক্তির বলে মাটি না খেয়ে। একবার এই উৎকণ্ঠা থেকে নিষ্কৃতি পেতে সে ডেকে নিয়ে আসে পিলার তেরনেরাকে ভবিষ্যৎ পড়ার জন্য। প্রচলিত বিভিন্ন অস্পষ্ট ভাষায় আবোলতাবোল বকার পর পিলার তেরনেরা ভবিষ্যদ্বাণী করে, ‘তুই কখনো সুখী হবি না, যত দিন না তোর বাবা-মা কবরস্থ না হবে।’

শিউরে ওঠে রেবেকা। এক স্বপ্নের স্মৃতির মতো নিজেকে দেখতে পায় খুব বালিকা বয়সে একটা তোরঙ্গ, কাঠের দোলচেয়ার আর এক থলে হাতে এই বাড়িতে ঢুকতে, যে থলের ভেতরের জিনিস সম্বন্ধে তার কোনো ধারণাই ছিল না। তার মনে পড়ে টাকমাথা, সোনার বোতায় দিয়ে গলাবন্ধ লিলেনের শার্ট পরা ভদ্রলোকের কথা, যার সঙ্গে তাসের কাপের (লাতিন অঞ্চলের তাস) রাজার কোনো সম্পর্কই ছিল না। মনে পড়ে যায় এক অতি সুন্দরী আর যুবতী মেয়ের কথা যার হাত দুটি ছিল উষ্ণ আর সুগন্ধিযুক্ত যে হাতের সঙ্গে বাতগ্রস্ত তাসের সোনার জোকারের কোনো মিলই ছিল না। ‘বুঝতে পারছি না’, বলল পিলার তেরনেরা বিচলিত হয়ে, ‘আমিও না, কিন্তু তাসগুলো এটাই বলেছে।’

এই প্রহেলিকায় রেবেকা এতই উদ্বিগ্ন হয় যে ব্যাপারটা জানায় হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াকে আর সে তাসের ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বাস করায় ভর্ৎসনা করলেও কাউকে কিছু না জানিয়ে, তোরঙ্গে আর আলমারিতে, আসবাবপত্র সরিয়ে, বিছানাপত্র উল্টে হাড়গোড়ের থলেটা খুঁজতে থাকে। মনে পড়ে যে বাড়ি সংস্কারের সময় থেকে ওটাকে দেখে নি সে। গোপনে রাজমিস্ত্রিদের ডাকে আর ওদের একজন জানায় যে কাজে বিরক্তি সৃষ্টি করে বলে থলেটা কোনো এক শোবার ঘরের দেয়ালের মধ্যে রেখে দেয়াল গেঁথে ফেলেছে। অনেক দিন দেয়ালে কান পেতে সতর্কতার সঙ্গে শোনার পর দেয়ালের গভীর থেকে ক্লক ক্লক শব্দটা শুনতে পায়। দেয়ালে গর্ত করে সে আর সেখানেই ছিল হাড়গোড়সহ থলেটা অক্ষত অবস্থায়। ওই একই দিনে ওগুলোকে গোর দেওয়া হয় মেলকিয়াদেসের পাশে একটা কবরে; পাথরের কোনো স্মৃতি স্মারক ছাড়াই। আর এতে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া মুক্তি পায় প্রুদেনসিও আগিলারের স্মৃতির অনুরূপ আরেকটি বিবেক দংশন থেকে। রান্নাঘরের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় সে রেবেকার কপালে চুমু খায়, ‘মাথা থেকে সব দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেল’ বলে, ‘তুই সুখী হবি।’ আর্কাদিওর জন্মের পর থেকে উরসুলার দ্বারা বন্ধ হওয়া এ বাড়ির দরজা নতুন করে খুলে দেয় তেরনেরার সঙ্গে রেবেকার বন্ধুত্ব। ছাগলের পালের মতো দিনের যেকোনো সময় বাড়িতে ঢুকে পড়ত সে, আর এসেই সব কর্মশক্তি প্রয়োগ করত সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোতে। মাঝেমধ্যে ঢুকে পড়ত কর্মশালায় আর আর্কাদিওকে দক্ষতার সঙ্গে সাহায্য করত দাগেরোটাইপ পাতগুলোকে আলোকসংবেদী করতে, আর এটা করত সে এতটাই মমতার সঙ্গে যে ছেলেটা তাতে ওর সম্পর্কে ভুল বুঝত। হতবুদ্ধি করে দিত মেয়েটা ওকে। ওর রোদে পোড়া গা, ওর শরীরের ধোঁয়াটে গন্ধ, হাসির অসামঞ্জস্য অন্ধকার ঘরটাতে তার মনোযোগে আলোড়ন সৃষ্টি করত, ফলে হোঁচট খেত সে জিনিসপত্রের সঙ্গে।

মাঝেমধ্যে আউরেলিয়ানো থাকত ওখানে রুপার কাজ করতে আর একবার পিলার তেরনেরা টেবিলে ভর দেয় ওর ধৈর্যশীল কাজের প্রশংসা করতে। তখনই ঘটে ব্যাপারটা। আউরেলিয়ানো নিশ্চিত হয় আর্কাদিওর অন্ধকার ঘরে থাকার ব্যাপারে, আর চোখ তুলে পিলার তেরনেরার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ার আগেই পড়তে পারে ওর চিন্তাধারা কারণ তা ছিল মধ্যদিনের আলোর মতোই উজ্জ্বল।

বলে আউরেলিয়ানো, ‘বল কী বলতে চাস।’

পিলার তেরনেরা এক করুণ হাসির সঙ্গে ঠোঁট দুটো কামড়ে ধরে। ‘যুদ্ধ করার জন্য তুমি খুবই ভালো’, বলে, ‘যেখানে দৃষ্টি ফেলো, সেখানেই বুলেট ঢোকাও’ (একেবারে সফল হওয়ার অর্থ বহন করে এই প্রবাদ)। ইঙ্গিতটার সত্যতার প্রমাণ পেয়ে হাঁপ ছাড়ে আউরেলিয়ানো। আবার কাজে মন বসায়, যেন কিছুই ঘটে নি আর তার গলার স্বর ফিরে পায় স্বাভাবিক দৃঢ়তা।

‘স্বীকার করছি’, বলে, ‘আমার নামেই নাম হবে ওর।’

হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া শেষ পর্যন্ত পেয়ে যায় যা খুঁজছিল; ঘড়ির যন্ত্রপাতির সঙ্গে এক দড়ির নর্তকীর সংযোগ ঘটিয়ে ফেলে, আর তাতে খেলনাটা নিজস্ব সুর আর ছন্দের সঙ্গে একটানা তিন দিন নেচে যায়। এই আবিষ্কারটা তার উদ্ভাবিত অন্য যেকোনো খ্যাপাটে প্রচেষ্টার চেয়ে বেশি সফলকাম হবে মনে করে, খাওয়া ছেড়ে দেয় আবার। ঘুমও দেয় ছেড়ে। উরসুলার সার্বক্ষণিক পাহারা আর সাবধানতা না থাকায় তার অলীক কল্পনা এমন এক মানসিক অপ্রকৃতিস্থতার দিকে নিয়ে যায় তাকে, যে কখনোই সে তার আগেকার অবস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারবে না। উচ্চ স্বরে চিন্তা করতে করতে রাত কাটিয়ে দিত ঘরময় পায়চারি করে; আর খুঁজে বেড়াত দোলনের সূত্রটাকে, বলদটানা গাড়ির সঙ্গে মই বা অন্য যেকোনো কিছুর গতির সংযোগের সম্ভাবনাকে। অনিদ্রার জ্বর তাকে এতই অবসন্ন করে ফেলে যে এক প্রভাতে দেখা সাদা চুলের মাথার বৃদ্ধটাকে চিনতে পারে না, আর সে তার শোবার ঘরে ঢুকেছে কি না, সে ব্যাপারেও ছিল অনিশ্চিত। সে ছিল প্রুদেনসিও আগিলার, শেষ পর্যন্ত যখন চিনতে পারে, মৃতরাও বার্ধক্য বরণ করে দেখে আশ্চর্যান্বিত হয় আর স্মৃতিকাতরতা নাড়া দিয়ে যায় হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াকে। ‘প্রুদেনসিও’, কাতর কণ্ঠে বলে সে, ‘কীভাবে এত দূর থেকে এসেছ!’ মৃত্যুর এত বছর পর জীবিতদের প্রতি তীব্র টান, গুরুত্বপূর্ণ একজন সঙ্গীর প্রয়োজন আর নিকটবর্তী মৃত্যুর ভেতরের আর এক মরণ এতই ভয়ংকর ছিল যে প্রুদেনসিও আগিলার শেষ পর্যন্ত ভালোবেসে ফেলে তার সবচেয়ে বড় শত্রুকেও। তাকে অনেক বছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছে সে। রিওয়াচার মৃতদের কাছে শুধিয়েছে সে, শুধিয়েছে ওপরে উপত্যকার থেকে আসা মৃতদের, যারা আসত জলাভূমি থেকে, তাদেরও। কেউই দিতে পারে নি ঠিকানা, কারণ মৃত মেলকিয়াদেসের আসা পর্যন্ত মৃতদের কাছে মাকন্দ ছিল অজ্ঞাত এক গ্রাম আর মেলকিয়াদেস দেখিয়ে দেয় গ্রামটাকে, মৃতদের বহুরঙা মানচিত্রে কালো একটি ছোট ফোঁটা এঁকে। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া গল্প করে সকাল পর্যন্ত প্রুদেনসিও আগিলারের সঙ্গে। অল্প কয়েক ঘণ্টা পর নিদ্রাহীনতায় পরাস্ত হয়ে আউরেলিয়ানোর কর্মশালায় ঢুকে জিজ্ঞেস করে, ‘আজ কী বার’ আউরেলিয়ানো উত্তর দেয়, ‘মঙ্গলবার।’ ‘আমিও তা-ই ভেবেছিলাম’, বলে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, ‘কিন্তু শিগগিরই বুঝতে পারি যে আজও গতকালের মতোই সোমবার, আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখো, দেখো, দেয়ালগুলোকে আর বেগোনিয়াদের, কিছুই বদলায়নি। সুতরাং আজও হচ্ছে সোমবার।’ আউরেলিয়ানো তাকে গুরুত্ব দেয় না। পরের দিন বুধবারে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া আবার হাজির হয় কর্মশালায়। ‘এটা হচ্ছে এক দুর্বিপাক’, বলে, ‘আকাশের দিকে দেখো, শোনো সূর্যের গুঞ্জরন, গতকাল আর গত পরশুর মতোই। সুতরাং আজও সোমবার।’ সেই রাত্রে পিয়েত্র ক্রেসপি ওকে পায় বারান্দায়; কাঁদছে; ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, বৃদ্ধদের মতো কোনো আলোড়ন সৃষ্টি না করে। কাঁদছে প্রুদেনসিও আগিলারের জন্য, মেলকিয়াদেসের জন্য, রেবেকার মা-বাবার জন্য, ওর নিজের মা-বাবার জন্য, যাদের কথা মনে করতে পারছে তাদের জন্য, আর যারা ছিল মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গ তাদের জন্য। পিয়েত্র ক্রেসপি তাকে উপহার দেয় এক দড়ির ভালুক, যেটা এক তারের মাধ্যমে দুই পায়ের ওপর হাঁটতে পারে কিন্তু আচ্ছন্নতা থেকে তার মনোযোগ সরাতে সক্ষম হয় না। ওকে জিজ্ঞেস করে একটা পেন্ডুলামের মেশিন বানানোর সম্ভাবনার কথা, যেটা মানুষকে উড়তে সাহায্য করবে আর ওর কাছ থেকে জবাব আসে: এটা অসম্ভব, কারণ পেন্ডুলাম যেকোনো কিছুই শূন্যে উত্তোলন করতে পারে কিন্তু নিজেই নিজেকে উত্তোলিত করতে পারে না। বৃহস্পতিবার আবার গিয়ে হাজির হয় কর্মশালায়, ছারখার হয়ে যাওয়া জমির মতো যন্ত্রণাক্লিষ্ট চেহারা নিয়ে। ‘সময় মেশিনটা নষ্ট হয়ে গেছে’, প্ৰায় ফুঁপিয়ে উঠল, ‘আর উরসুলা ও আমারান্তা কত দূরে।’ আউরেলিয়ানো ওকে ভর্ৎসনা করে বাচ্চাদের মতো আর সে বিনীতভাবে তা মেনে নেয়। আগের দিনের সঙ্গে একটি পার্থক্য নির্ণয়ের জন্য জিনিসপত্রগুলো পরীক্ষা করে ছয় ঘণ্টা ধরে সময়ের সঙ্গে যদি কোনো পরিবর্তন ঘটে, তা বের করার অপেক্ষায়, সারা রাত বিছানায় কাটায় চোখ খোলা অবস্থায়। প্রুদেনসিও আগিলারকে, মেলকিয়াদেসকে, আর সব মৃতকে ডাকাডাকি করে, যাতে তারা তার এই অস্বস্তিকর অবস্থার ভাগ নিতে পারে। কিন্তু কেউ আসে না। শুক্রবার সবাই ঘুম থেকে জাগার আগেই সে আবার প্রকৃতির অবস্থা পরীক্ষা করে আর তাতে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না যে তখনো সোমবারই চলছে। সুতরাং দরজার এক হুড়কো নিয়ে, শয়তানে ভর করা মানুষের মতো অনর্গল আর সম্পূর্ণরূপে দুর্বোধ্য অশ্লীল ভাষায় চিৎকার করতে করতে তার প্রচণ্ড শক্তির বুনো হিংস্রতায় ভেঙে ধ্বংস করে চলে আলকেমির যন্ত্রপাতি, দাগেরোটাইপের আলমারি, রুপার কর্মশালা যতক্ষণ পর্যন্ত না ওগুলো ধুলায় পরিণত হয়। এরপর বাড়িটার অবশিষ্টাংশও ভাঙার উপক্রম করলে আউরেলিয়ানো, প্রতিবেশীদের সাহায্য নেয়। দশজন লোকের প্রয়োজন হয় তাকে ধরাশায়ী করতে আর বিশজন লাগে উঠানের চেস্টনাটগাছটা পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে, যেখানে তাকে বেঁধে রাখে ওরা মুখ দিয়ে সবুজ গেঁজলা বেরোনো অদ্ভুত ভাষায় ঘেউ ঘেউরত অবস্থায়। যখন উরসুলা আর আমারাস্তা ফিরে আসে তখনো সে চেস্টনাটের গুঁড়ির সঙ্গে হাত- পা বাঁধা অবস্থায় বৃষ্টিতে ভিজে চেহারায় সম্পূর্ণ এক সারল্য নিয়ে বসে আছে। কিছু বলা হলে ওদের দিকে দৃষ্টি ফেলে চিনতে না পেরে দুর্বোধ্য কিছু কথা বলে। দড়ির ক্ষতের কারণে উরসুলা কবজি আর গোড়ালি মুক্ত করে দেয়। একমাত্র বাঁধা থাকে কোমরের সঙ্গে। পরে রোদ আর বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য তালপাতার এক ছাউনি তুলে দেয় ওখানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *