১০
বহু বছর পর মৃত্যুশয্যায় আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর মনে পড়ে যাবে জুন মাসের সেই বৃষ্টি ঝরা বিকেলের কথা, যখন সে শোবার ঘরে ঢুকেছিল তার প্রথম পুত্রসন্তানের মুখ দেখতে। যদিও ছেলেটা ছিল দুর্বল আর শুধুই কাঁদছিল আর চেহারায় বুয়েন্দিয়াদের কোনো বৈশিষ্ট্যই ছিল না, তবু তার নাম রাখার জন্য দ্বিতীয়বার ভাবতে হয় নি তাকে। ‘ওর নাম হবে হোসে আর্কাদিও’, বলে।
এক বছর আগে ফের্নান্দা দেল কার্পিও নামের যে সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়, সেও একমত হয় এতে। অন্যদিকে এতে নিজের মৃদু উদ্বেগের আবছা অনুভূতি সে লুকাতে পারে নি। পরিবারের দীর্ঘ ইতিহাসে নামগুলোর গোঁ ধরা পুনরাবৃত্তি তাকে আপাতদৃষ্টিতে অভ্রান্ত উপসংহার টানতে সাহায্য করে। যখন আউরেলিয়ানোরা হচ্ছে নিরাসক্ত ও নির্মল, হোসে আর্কাদিওরা তখন হচ্ছে মাথা গরম, দুঃসাহসী, কিন্তু ওরা চিহ্নিত ছিল হৃদয়বিদারক ঘটনার দ্বারা। শুধু হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো আর আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর ব্যাপারটাকেই একই শ্রেণিতে ফেলা অসম্ভব হয়। শৈশবে দুজনের চেহারায় এতই মিল ছিল আর ওরা এতই দুরন্ত ছিল যে এমনকি সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদের পক্ষেও ওদের আলাদা করে চেনা সম্ভব হতো না। ব্যাপটাইজের দিনে ওদের হাতে নামাঙ্কিত ব্রেসলেট লাগিয়ে, নামের আদ্যাক্ষরসহ ভিন্ন রঙের কাপড় পরিয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু যখন স্কুলে যেতে আরম্ভ করে তখন নিজেরাই ঠিক করে নিজেদের ভেতরে কাপড় বদলাতে, ব্রেসলেট বদলাতে আর একে অন্যকে উল্টো নাম ধরে ডাকতে। সবুজ জামায় হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোকে দেখতে অভ্যস্ত শিক্ষক মেলচোর এস্কালোনা খেই হারিয়ে ফেলে যখন আবিষ্কার করে যে সে আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর ব্রেসলেট পরে আছে, আর তার নাম হচ্ছে অন্য আর অন্যদিকে যদিও আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর গায়ে সাদা জামা পরা ছিল, তবু সে পরেছিল হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোর নামাঙ্কিত ব্রেসলেট। তখন থেকে কার নাম যে কি তা কেউই নিশ্চিত করতে সক্ষম হয় না। ওরা যখন বেড়ে ওঠে, জীবন ওদের আলাদা করে ফেলে, এমনকি তখনো উরসুলা নিজেকেই প্রশ্ন করত ওরা কোনো সময়ে ভুল করে বিভ্রান্তির কোনো জটিল খেলায় নিজেরাই চিরতরে বদলে গিয়েছে কি না। বয়ঃসন্ধির প্রারম্ভ পর্যন্ত ওরা ছিল যুগপৎ বয়ে চলা যন্ত্র বিশেষ। একই সময় ঘুম থেকে জাগত, একই সঙ্গে ওদের পায়খানার বেগ পেত, স্বাস্থ্যজনিত সমস্যাগুলো হতো একই রকমের, এমনকি দুজনেই দেখত একই স্বপ্ন। বাড়ির সবাই যখন ভাবত ওরা একই সঙ্গে কাজগুলো করে শুধুই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য, তখন সত্যিকার অর্থে কেউই বুঝতে পারে না আসল ব্যাপারটা যতক্ষণ পর্যন্ত না একদিন সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ ওদের একজনকে লেবুর শরবত দেওয়ায় সে কেবল চেখে দেখতেই অন্যজন বলে ওঠে, চিনি নেই শরবতে। সত্যিকার অর্থেই চিনি দিতে ভুলে গিয়েছিল সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ, আর ঘটনাটা উরসুলাকে বলে সে। ‘এ রকমই সবাই’, আশ্চর্য না হয়ে বলে সে, ‘জন্ম থেকেই ওরা উন্মাদ।’ সময়ই এই বিশৃঙ্খল অবস্থার ইতি টানতে থাকে। বিভ্রান্তির খেলায় যে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো নাম নিয়ে থাকে, সে হয়ে ওঠে পিতামহের মতো বিশাল বপুধারী, আর যে ছিল হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো, হয়ে ওঠে কর্নেলের মতো চওড়া হাড়ের অধিকারী। শুধু একটিমাত্র মিলই ওদের অবশিষ্ট থাকে, সেটা হচ্ছে বংশগত নিঃসঙ্গতা। খুব সম্ভবত দৈহিক উচ্চতা, নিজেদের ভেতরে নাম, আর চরিত্রের অদলবদলের কারণেই উরসুলার মনে সন্দেহ জাগে যে শৈশব থেকেই তাসের মতো ওরা ওলটপালট হয়ে গেছে।
চরম পার্থক্যটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যুদ্ধের মধ্যে যখন হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসকে অনুরোধ করে মৃত্যুদণ্ড দেখাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। উরসুলার আপত্তি সত্ত্বেও তার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা হয়, আর অন্যদিকে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো শুধু মৃত্যুদণ্ডের সময় উপস্থিত থাকার কথা কল্পনা করেই কাঁপতে থাকে। বাড়িতে থাকাটাই বেশি পছন্দ ছিল তার, বারো বছর বয়সে উরসুলাকে সে জিজ্ঞেস করে নিষিদ্ধ বদ্ধ ঘরটাতে কী আছে। ‘কাগজপত্র’, ওকে উত্তর দেয় উরসুলা, ‘ওগুলো হচ্ছে মেলকিয়াদেসের বইপত্র, আর শেষের বছরগুলোতে যেসব অস্বাভাবিক জিনিসপত্র লিখত, তা-ই।’ এই উত্তর ওকে শান্ত করার বদলে বাড়িয়ে দেয় ঔৎসুক্য। ফলে সে এত বেশি পীড়াপীড়ি করে আর প্রতিজ্ঞা করে কোনো জিনিস নষ্ট না করার, যে উরসুলা ঘরের চাবি দিয়ে দেয় ওকে। মেলকিয়াদেসের শবদেহ বের করার পর ওই ঘরে কেউই আর ঢোকে নি, আর যে তালা তাতে দেওয়া হয় তার বিভিন্ন অংশ মরিচা ধরে একটার সঙ্গে আর একটা জোড়া লেগে যায়। কিন্তু যখন আউরেলিয়ানো সেগুন্দো জানালাগুলো খোলে তখন এমন এক পরিচিত আলো ঢোকে যে মনে হচ্ছিল প্রতিদিনই সেটা ঢুকে ঘরটাকে আলোকিত করতে অভ্যস্ত, ছিল না ধুলাবালু বা মাকড়সার ন্যূনতম কোনো চিহ্ন বরং ছিল ঝাড় দেওয়া পরিচ্ছন্নতা। ওর লাশ দাফনের দিনের চেয়েও বেশি ঝাঁট দেওয়া, বেশি পরিচ্ছন্ন, কালির দোয়াতের কালিও শুকিয়ে যায় নি, মরিচা পড়ে ধাতব পদার্থের উজ্জ্বলতা নষ্ট করে নি, এমনকি হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া যেখানে পারদ গরম করত সেই অঙ্গার পর্যন্ত নেভে নি। তাকগুলোতে বইপত্র বাঁধানো ছিল একধরনের কাডবোর্ড জাতীয় জিনিস দিয়ে যার রং ছিল রোদে পোড়া মানুষের ত্বকের মতো পাণ্ডুর। আর পাণ্ডুলিপিগুলো ছিল অক্ষত। সবই এতই সাম্প্রতিক ছিল যে কয়েক সপ্তাহ পর যখন উরসুলা এক বালতি পানি আর এক ঝাড়ু নিয়ে মেঝে ধোয়ার জন্য ঢোকে, তখন তাকে কিছুই করতে হয় না। একটা বইয়ের লেখাগুলোর মধ্যে ডুবে ছিল আউরেলিয়ানো সেগুন্দো। বইটার কোনো বাঁধাই ছিল না, এমনকি নামও লেখা ছিল না কোথাও, কিন্তু শিশুটা উপভোগ করছিল এক মেয়ের গল্প, যে নাকি টেবিলে বসে শুধু আলপিন দিয়ে বিঁধিয়ে ভাতের দানা খেত আর সেই গল্প করত, যেখানে ছেলে তার প্রতিবেশীর কাছে জালে বাঁধার জন্য সিসা ধার চায় আর পরে প্রতিদান হিসেবে দেওয়া মাছটার পেটে ছিল হিরকখণ্ড। আর যখন সাধ পূরণ করা চেরাগ ও উড়ন্ত গালিচার গল্প বিস্ময়াভূত হয়ে উরসুলাকে প্রশ্ন করে ওগুলোর সবই সত্য কি না আর উরসুলা ইতিবাচক উত্তর দেয় আর বলে জিপসিরা অনেক বছর আগে মাকন্দে নিয়ে যেত আশ্চর্য প্রদীপ ও উড়ন্ত গালিচা।
‘আসল ব্যাপার হচ্ছে’, দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘ধীরে ধীরে পৃথিবীটা শেষ হয়ে যাচ্ছে, ফলে ওই সব জিনিস আর আমাদের এখানে আসে না।’
যখন বইটা শেষ করে, তখন অনেক গল্পই অসমাপ্ত থেকে যায় কারণ বইটার সব পৃষ্ঠা ছিল না, আর আউরেলিয়ানো সেগুন্দো পাণ্ডুলিপির অর্থোদ্ধারের চেষ্টা করে। অসম্ভব হয়ে পড়েসেটা। অক্ষরগুলো দেখতে ছিল দড়ির ওপর শুকাতে দেওয়া কাপড়ের মতো, আর সেগুলোর সাহিত্যের অক্ষরের চেয়ে সংগীতের স্বরলিপির সঙ্গেই ছিল বেশি মিল। এক জ্বলন্ত দুপুরে, যখন সে পাণ্ডুলিপিটাকে পরীক্ষা করছিল, তখন ওর মনে হলো ঘরের মধ্যে সে একা নেই। জানালা দিয়ে আসা প্রতিফলনের উল্টো দিকে, হাঁটুর ওপর হাত রেখে বসা, সে ছিল মেলকিয়াদেস। বয়স চল্লিশের বেশি ছিল না ওর, পরনে ছিল তার সেই মান্ধাতা আমলের কুর্তা, আর কাকের পাখার টুপি, আর গরমে তার কপাল থেকে ঝরে পড়ছিল চুল বেয়ে গলে পরা তেল, যে রূপটি ছেলেবেলায় দেখেছিল আউরেলিয়ানো ও হোসে আর্কাদিও। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ওকে চিনতে পারে সঙ্গে সঙ্গেই কারণ এই স্মৃতি ওর কাছে এসেছে বংশপরম্পরায়, আর এসেছে ওর দাদার স্মৃতি থেকে। ‘সালুদ (হ্যালো)’, আউরেলিয়ানো সেগুন্দো বলে। ‘সালুদ (হে) যুবক’, মেলকিয়াদেস বলে।
তখন থেকে পরের অনেক বছর, ওদের দেখা হয়েছে প্রায় প্রতি বিকেলেই। মেলকিয়াদেস ওকে পৃথিবীর কথা বলত, চেষ্টা করত ওর ভেতরে তার প্রাচীন প্রজ্ঞা রোপণের, কিন্তু পাণ্ডুলিপি অনুবাদ করতে সে অনীহা প্রকাশ করে। ‘এক শ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত এটার অর্থ জানা উচিত নয়’, ব্যাখ্যা দেয়। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো চিরকালই গোপন রাখে ওই সাক্ষাৎগুলো। একবার প্রায় তার ব্যক্তিগত বিশ্বটা ধূলিসাৎ হওয়ার উপক্রম হয়, যখন উরসুলা ঘরে ঢোকে, মেলকিয়াদেস তখন ওখানেই ছিল। কিন্তু উরসুলা তাকে দেখতে পায় না।
‘কার সঙ্গে কথা বলছিস’, ওকে জিজ্ঞেস করে।
‘কারও সঙ্গেই না’, বলে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো।
‘এমনটিই ছিল তোর প্রপিতামহ’, বলে উরসুলা, ‘সেও একা একা কথা বলত।’
এই সময়েই হোসে আর্কাদিওর গুলিবিদ্ধ করে মৃত্যুদণ্ড দেখার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। সারা জীবনভর সে মনে রাখবে ছয়টি একসঙ্গে করা গুলির নীলচে বিচ্ছুরণ, পাহাড়ের সঙ্গে ওগুলোর প্রতিধ্বনির খান খান হয়ে ভেঙে পরা, মুখের করুণ হাসি, দণ্ডিত ব্যক্তির হতভম্ব চোখ রক্তে ভিজে যাওয়ার পরও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, আর খুঁটি থেকে বাঁধন খুলে এক চুনের বাক্সে ঢোকানোর সময়ও তার মুখে লেগে থাকা হাসি। ‘ও জ্যান্ত’, ভাবছিল সে, ‘ওকে জ্যান্ত কবর দেবে ওরা।’ ব্যাপারটা তাকে এতই বিহ্বল করে ফেলে যে তখন থেকে ঘৃণা করতে শুরু করে যুদ্ধ আর মিলিটারি কার্যক্রম, অবশ্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ব্যাপারটার জন্য নয়, বরং জ্যান্ত কবর দেওয়ার মতো ভীতিকর প্রথাটার জন্য, তারপর থেকে কেউই জানত না ফাদার এল কাচোররোর উত্তরাধিকারী ফাদার অ্যান্তোনিও ইসাবেলকে কোন মুহূর্ত থেকে উপাসনায় সাহায্যের লক্ষ্যে ও গির্জার ঘণ্টা বাজাতে ও ফাদারের বাড়ির উঠানের লড়াইয়ের মোরগগুলোর যত্ন নিতে আরম্ভ করে। যখন কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস জানতে পেরে ওকে কঠিনভাবে ভর্ৎসনা করে উদারপন্থীদের নিষিদ্ধ কাজগুলো শেখার জন্য। ‘ব্যাপারটা হচ্ছে’, জবাব দেয় সে, ‘মনে হচ্ছে আমি রক্ষণশীল হয়েই জন্মেছি’, সে বিশ্বাস করত ব্যাপারটা যেন অদৃষ্টের লিখন। মর্মাহত কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস উরসুলাকে বলে ব্যাপারটা।
‘সেই ভালো, সমর্থন করে উরসুলা। ও যেন পাদরি হওয়ার চেষ্টা করে যাতে শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর এই বাড়িতে ঢোকে।
অনতি বিলম্বেই জানা যায় যে, ফাদার অ্যান্তোনিও ইসাবেল ওকে প্রথম কমিউনিয়নের (ব্যাপটাইজের পর ক্যাথলিকদের পালিত প্রথম ধর্মপ্রথা যাতে ছেলে মেয়েরা খ্রিষ্টধর্মকে শরীর ও মনে ধারণ করে) জন্য প্রস্তুত করছে আর মোরগের গলার ফোঁড় চেঁছে ফেলার সময় তাকে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষা দিচ্ছে। ‘ওম দেওয়া মুরগি খোপে ঢোকানোর সময়’, সরল উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিত কীভাবে সৃষ্টির দ্বিতীয় দিনে ঈশ্বরের মাথায় খেলে যে ডিমে মুরগির বাচ্চা তৈরি হবে। তখন থেকেই তার ভীমরতি ধরা পাগলামির প্রথম চিহ্ন ফুটে ওঠে, যে কয়েক বছর পরে বলবে, ‘খুব সম্ভবত শয়তান ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে জিতে গিয়ে স্বর্গের সিংহাসনে বসে আছে, আর সরল লোকদের ফাঁদে ফেলার জন্য তার সত্যিকারের আত্মপরিচয় ফাঁস করছে না।’ তার শিক্ষকের নির্ভীক দীক্ষায় দীক্ষিত হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো কয়েক মাসের মধ্যে শয়তানকে বিভ্রান্ত করার ব্যাপারে ঐশ্বরিক মারপ্যাচ যতটা আয়ত্ত করে, ততটাই আয়ত্ত করে মোরগলড়াইয়ের সব কৌশল। আমারান্তা ওকে বানিয়ে দেয় এক কলার টাইসহ লিলেনের কোট, কিনে দেয় একজোড়া সাদা জুতা আর সোনালি অক্ষর দিয়ে সিরিওর (গির্জার সবচেয়ে বড় মোমবাতি) ফিতার ওপর লিখে দেয় ওর নাম।
প্রথম কমিউনিয়নের দুই রাত আগে ফাদার অ্যান্তোনিও ইসাবেল ওকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের বন্ধ করেন গির্জার পোশাক বদলানোর ঘরে এক পাপের অভিধান নিয়ে। তালিকাটা ছিল এতই দীর্ঘ যে সন্ধ্যা ছয়টায় ঘুমাতে অভ্যস্ত প্রৌঢ় ফাদার তালিকা শেষ হওয়ার আগেই চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েন। এই জেরাটা হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার জন্য হয়ে ওঠে ব্যাপারটার এক বিস্ময়কর উন্মোচন। ফাদারের করা, মেয়েদের সঙ্গে খারাপ কিছু করেছে কি না, এ প্রশ্ন তাকে আশ্চর্যান্বিত করে না, আর আন্তরিকতার সঙ্গে সে নেতিবাচক উত্তর দেয়। কিন্তু পশুদের সঙ্গে করেছে কি না, প্রশ্ন করা হলে সে বিপর্যস্ত হয়ে পরে। মে’র প্রথম শুক্রবার কৌতূহলে জর্জরিত হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো প্রথম কমিউনিয়ন গ্রহণ করে। আরও পরে অসুস্থ পেত্রনিওকে, (পাথরের ঘরের বাসিন্দা গির্জার চূড়ায় বাস করত বলে নাম ছিল) যে বাস করত গির্জার চূড়ায়, আর সবাই মনে করত সে বাদুড় খেয়ে বাঁচে, তাকে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো ব্যাপারটা নিয়ে প্রশ্ন করে, আর পেত্রনিও উত্তর দেয় ‘কিছু পাপী খ্রিষ্টান আছে, যারা মাদি গাধার সঙ্গে ব্যাপারটা করে।’ হোসে আর্কাদিও প্রচণ্ড কৌতূহল দেখিয়ে এতই ব্যাখ্যা চায় যে পেত্রনিওর ধৈর্যচ্যুতি ঘটে।
‘আমি মঙ্গলবার রাতে যাই’, স্বীকার করে, ‘যদি কাউকে কিছু না বলার প্রতিজ্ঞা করিস তাহলে পরের মঙ্গলবার তোকে নিয়ে যাব।’
সত্যিই সত্যিই পরের মঙ্গলবার চূড়া থেকে এক কাঠের টুল নিয়ে নামে সে, সেটা যে কি কাজে লাগে তখন পর্যন্ত কারোরই তা জানা ছিল না। আর হোসে আর্কাদিওকে সঙ্গে করে নিয়ে যায় নিকটবর্তী এক খামারে। সেই নৈশচারণে ছেলেটা এতই উৎসাহী হয় যে সে কাতরিনার দোকানে যাওয়ার আগে অনেক সময় ব্যয় করে এই নৈশ অভিযানে। সে হয়ে ওঠে মোরগলড়াইয়ে পুরুষ। ‘এই সব জীবগুলো অন্য জায়গায় নিয়ে যাবি।’ প্রথমবার উঁচু স্তরের এই লড়াইয়ে জীবগুলোসহ ওকে ঢুকতে দেখে বলে উরসুলা, ‘মোরগ এই বাড়িতে যথেষ্ট তিক্ততা নিয়ে এসেছে, তোকে আর আনতে হবে না।’ কোনো বিতর্কে না গিয়ে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো সেগুলো নিয়ে যায় তার দাদি পিলার তেরনেরার কাছে আর পালন করতে থাকে ওখানে। দাদি ওকে বাড়িতে পাওয়ার জন্য ওর যখন যা কিছু দরকার, তা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। শিগগিরই ফাদার অ্যান্তোনিও ইসাবেল থেকে পাওয়া প্রজ্ঞা দিয়ে সে মোরগলড়াইয়ে এতই ভালো করে যে সেটা থেকে আয় হওয়া অর্থ শুধু যে মোরগের দল বৃদ্ধি করতে যথেষ্ট পরিমাণে ব্যয় করে তা-ই নয়, পুরুষ হিসেবেও তার যথেষ্ট সন্তুষ্টি আসে। উরসুলা ওকে তার যমজ ভাইয়ের সঙ্গে তুলনা করে বুঝতে পারত না কীভাবে দুই যমজ ভাই যারা ছোটবেলা সবকিছু করত একটিমাত্র মানুষের মতো তা কী করে শেষ পর্যন্ত এত ভিন্ন হয়ে পরে। কিন্তু তার এই বিহ্বলতা বেশি দিন থাকে না, কারণ অল্প সময়ের মধ্যেই আউরেলিয়ানো সেগুন্দো আলস্য আর উচ্ছৃঙ্খলতার নিদর্শন দিতে থাকে। যত দিন সে মেলকিয়াদেসের সঙ্গে ছিল, তত দিন সে ছিল আত্মমগ্ন, যেমনটি ছিল আউরেলিয়ানো যুবক অবস্থায়, কিন্তু নির্লান্দার চুক্তির কিছু আগে এক আকস্মিক ঘটনা তাকে আত্মমগ্নতা থেকে বের করে আনে আর সে পৃথিবীর সত্যতার মুখোমুখি হয়। এক যুবতী মেয়ে যখন একটা অ্যাকর্ডিয়ান বিক্রির লটারির টিকিট বিক্রি করছিল, তখন খুব পরিচিত লোকের মতো অভিবাদন জানায়। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো অবাক হয় না কারণ তার ভাইয়ের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলায় প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটত। আউরেলিয়ানো তার ভুল ভাঙায় না, এমনকি যখন সে কান্নাকাটি করে তার মনকে নরম করানোর চেষ্টা করছে তখনো নয়, আর শেষমেশ নিয়ে যায় নিজের ঘরে। প্রথম সাক্ষাতের দিন থেকে ওকে এতই ভালো লাগে মেয়েটার যে সে আউরেলিয়ানোকে অ্যাকর্ডিয়ানটা জেতানোর জন্য কারসাজি করে, দুই সপ্তাহ পর আউরেলিয়ানো সেগুন্দো বুঝতে পারে যে একই ব্যক্তি মনে করে মেয়েটা তার সঙ্গে আর তার ভাইয়ের সঙ্গে পালা করে শুচ্ছে, আর তার এই ভুল ভাঙানোর বদলে ঘটনাটা তাকে আরও বেশি আনন্দ দেয়। ব্যাপারটাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য আর মেলকিয়াদেসের ঘরে ফিরে যায় না সে। সেই সময়ে বাড়িতে দুটি শোকপর্ব থাকায় উরসুলার আপত্তি সত্ত্বেও বিকেলটা কাটিয়ে দিত সে শুনে শুনে অ্যাকর্ডিয়ান বাজানো শেখে, আর তখন উরসুলার কাছে অ্যাকর্ডিয়ান ছিল ফ্রান্সিসকো এল অমব্রের মতো নিচু স্তরের ভবঘুরের জন্য মানানসই বাদ্যযন্ত্র। তা সত্ত্বেও আউরেলিয়ানো সেগুন্দো হয়ে ওঠে অ্যাকর্ডিয়ান বাদনে ভীষণভাবে পটু, বিয়ে করে ছেলেমেয়ে হওয়ার পরও বাজাতে থাকে সে ওটা, আর ভবিষ্যতে হয়ে ওঠে মাকন্দে সম্মানিত লোকদের মধ্যে একজন।
দুই মাস তার ভাইয়ের সঙ্গে ভাগ করে ভোগ করা যুবতীকে সে নজর রাখত চলাফেরায়, ওদের পরিকল্পনা ভঙ্গ করায়, যখন নিশ্চিত হতো যে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো সেই রাতে দুজনের রক্ষিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করছে না, তখন সে ওর সঙ্গে শুতে যেত। এক সকালে সে বুঝতে পারে যে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। দুই দিন পরে ভাইকে সে পায় ঘামে ভিজে গোসলখানার থাম ধরে অঝোরে কান্নারত অবস্থায়, আর সে বুঝতে পারে ব্যাপারটা। ভাই স্বীকার করে যে মেয়েটা তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে কারণ সে বয়ে বেড়াচ্ছে, মেয়েটার ভাষায়, খারাপ জীবনযাপনের এক অসুখ। পিলার তেরনেরা রোগ সারানোর যে ব্যবস্থাটা দিয়েছে, তা-ও বলে দেয় সে আউরেলিয়ানো সেগুন্দোকে। আউরেলিয়ানো নিজেকে লুকিয়ে লুকিয়ে ডোবায় গা জ্বালিয়ে দেওয়া পারম্যাঙ্গানেট ও মূত্রবর্ধক পানির ভেতরে, আর তিন মাস পর আলাদাভাবে দুজনেই গোপনে সেরে ওঠে। হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো কখনোই আর মেয়েটার কাছে ফেরে না, আর আউরেলিয়ানো সেগুন্দো মেয়েটার ক্ষমা পেয়ে ওর সঙ্গেই আমৃত্যু থেকে যায়।
ওর নাম ছিল পেত্রা কতেস। মাকন্দে এসেছিল ঘোর যুদ্ধের মাসে ঘটনাচক্রে, বিবাহিতা; এক লটারি করে জীবন চালানো স্বামীর সঙ্গে, আর স্বামী মারা গেলে সে চালিয়ে যায় ব্যবসাটা। সে ছিল পরিচ্ছন্ন এবং কম বয়সী এক মুলাতো, যার হলুদ রঙের বাদামের মতো চোখ দুটো তার মুখে এনে দিত এক প্যান্থারের হিংস্রতা, কিন্তু মনটা ছিল তার উদার আর বিছানায় ছিল সে অসাধারণ পটু। যখন উরসুলা জানতে পারে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো মোরগলড়াই করে বেড়ায় আর আউরেলিয়ানো সেগুন্দো তার রক্ষিতার কোলাহলপূর্ণ পার্টিগুলোতে অ্যাকর্ডিয়ান বাজায়, তখন তার বিশৃঙ্খলায় পাগল হওয়ার জোগাড়। যেন ওদের দুজনের মধ্যেই বংশগত সব দোষ এসে জমা হয়েছে, যেন বংশের কোনো গুণই তারা পায় নি। ফলে ঠিক করে কেউই আর ওদের আউরেলিয়ানো ও হোসে আর্কাদিও বলে ডাকবে না। কিন্তু যখন আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর প্রথম পুত্রসন্তান জন্ম নেয়, তখন সে তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচরণ করতে সাহস পায় না।
‘ঠিক আছে’, বলে উরসুলা, ‘কিন্তু এক শর্তে, আমি ওকে লালন করে বড় করব।’
যদিও বয়স শতবর্ষে পড়েছে, ছানি পড়ে চোখ প্রায় অন্ধ তবু শারীরিক সক্রিয়তা, চারিত্রিক দৃঢ়তা আর মানসিক ভারসাম্য ছিল তার অটুট। তার মতো কেউই ছিল না, যে নাকি সদ্গুণসম্পন্ন সেই লোককে গড়ে তুলতে পারবে, যে নাকি কখনোই যুদ্ধের কথা শোনে নি, শোনে নি মোরগ লড়াইয়ের কথা, মন্দ মেয়েমানুষের কথা, বেপরোয়া অভিযানের কথা যে চারটে সমস্যা উরসুলার মতে ডেকে এনেছে বংশের অধঃপতন, আর সেই লোকটাই আবার ফিরিয়ে আনবে বংশের হারানো সম্মান। ‘ও হবে পাদরি’, গাম্ভীর্য নিয়ে প্রতিজ্ঞা করে,
‘যদি ঈশ্বর আমাকে আয়ু দান করেন, তাহলে ও হবে পোপ।’ সবাই হেসে ওঠে ওর কথা শুনে, শুধু যারা শোবার ঘরে ছিল, তারাই নয় বরং সারা বাড়িতেই, যেখানে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো জুটেছিল হল্লাবাজ বন্ধুদের সঙ্গে, বিলিয়ে দেওয়া যুদ্ধটার খারাপ স্মৃতিকে শ্যাম্পেনের ছিপির সঙ্গে ক্ষণস্থায়ীভাবে স্মরণ করার জন্য।
‘পোপের সুস্বাস্থ্য কামনায়’, টোস্ট করে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো।
আমন্ত্রিতরাও টোস্ট করে একই সঙ্গে। পরে বাড়ির মালিক বাজায় অ্যাকর্ডিয়ান, পোড়ে বাজি আর সারা গ্রামে আনন্দোৎসবের জন্য তাম্বোরের (ঢোল জাতীয় বাদ্যযন্ত্র) ফরমাশ দেওয়া হয়। ভোররাতে শ্যাম্পেনে ভিজে জবজবে আমন্ত্রিতরা ছয়টি গরু জবাই করে রাস্তায় ভিড় করা লোকের জন্য রেখে দেয়। কেউই মর্মাহত হয় না এতে। যেদিন থেকে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো বাড়ির ভার নেয়, পোপের জন্মগ্রহণের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা না থাকলেও, এই ধরনের পার্টি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। কয়েক বছরের মধ্যে বিনা প্রচেষ্টায়, শুধু অন্য গুণে, জলাধারের সবচেয়ে বেশি সম্পদের মালিক বনে যায় সে তার পালিত জীবজন্তুগুলোর অলৌকিকভাবে সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে। ওর ঘোটকী জন্ম দেয় তিনটি বাচ্চা একই সময়ে, মুরগিগুলো ডিম দেয় দিনে দুবার, শূকরগুলো মোটাতাজা হয়ে ওঠে বেপরোয়াভাবে আর কেউ বুঝতে পারে না এই অস্বাভাবিক বংশবৃদ্ধির কারণ। যেন কোনো জাদুবলে ঘটে চলেছে। ‘এখনই জমাতে থাক’, উরসুলা বলে তার অপরিণামদর্শী নাতির ছেলেকে, ‘এই সৌভাগ্য তোর সব সময়ের জন্য থাকবে না।’ কিন্তু আউরেলিয়ানো তার কথায় কান দেয় না। বন্ধুদের গলা ভেজানোর জন্য সে যতই শ্যাম্পেনের ছিপি খুলত, ততই পাগলের মতো বাচ্চা দিত তার জন্তুগুলো, আর ততই তার বিশ্বাস দৃঢ় হতো যে কাজকর্মের সঙ্গে এই সৌভাগ্যের কোনো সম্পর্ক নেই বরং এসবের পেছনে কাজ করছে তার রক্ষিতা পেত্রা কতেসের প্রেম, যা কিনা প্রাকৃতিক ক্ষমতাকে উত্তেজিত করে তোলে। তার এই সম্পদের উৎসের ব্যাপারে সে এতই নিশ্চিত ছিল যে কখনো পেত্রা কতেসকে জীবজন্তুর থেকে দূরে সরাত না, এমনকি বিয়ের পর সন্তান জন্মের পরও ফের্নান্দার সম্মতি নিয়ে তার সঙ্গে বাস করতে থাকে। দাদা পরদাদাদের মতো শক্ত-সমর্থ বিশাল শরীরের অধিকারী আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর ছিল জীবনকে ভোগ করার প্রচণ্ড ক্ষমতা ও এক অপ্রতিরোধ্য সৌহার্দ্য, যা নাকি আর কারও ছিল না। কিন্তু সে পালিত পশুপাখির দেখাশোনার জন্য সময় পেত না বললেই চলে। শুধু পেত্রা কতেসকে পশুপাখিদের কাছে নিয়ে ঘোড়ায় চড়িয়ে খামারজুড়ে বেড়াত, যাতে তার মার্কাওয়ালা লোহার ছাপ মারা সব জানোয়ারই এক নীরারোগ্য সংখ্যাবৃদ্ধি রোগে আক্রান্ত হয়।
তার দীর্ঘ জীবনে যেমনটি ঘটেছিল অন্য সব শুভ ঘটনার বেলায়, তেমনি এই বিশাল সৌভাগ্যেরও সূত্রপাত ঘটে হঠাৎ করেই। যুদ্ধ শেষের দিন পর্যন্ত পেত্রা কতেসের জীবিকা ছিল লটারি আর আউরেলিয়ানো সেগুন্দো মাঝে মাঝে উরসুলার সঞ্চয় হাতিয়ে নিত। আমুদে এক জুটি ছিল ওরা, যারা প্রতি রাতে বিছানায় যাওয়া ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করত না। এমনকি পেত্রা কতেসের নিষিদ্ধ দিনগুলোতেও বিছানায় হুটোপুটি করত ওরা সকাল পর্যন্ত। ‘এই মেয়েটাই তোকে শেষ করে দিচ্ছে’, উরসুলা চিৎকার করত নাতির ছেলের উদ্দেশে, যখন ঘুমের মধ্যে হাঁটা লোকদের মতো তাকে বাড়ি ঢুকতে দেখত, ‘তোকে এমনভাবে বশ করেছে যে একদিন দেখবি পেটের মধ্যে এক ব্যাঙ নিয়ে পেটের ব্যথায় কাতরাচ্ছিস।’ তার স্থান পূরণের জন্য যে একজন কেউ আছে, তা বুঝতে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোর অনেক সময় লেগে যায় কিন্তু সে বুঝতে পারে না তার ভাইয়ের প্রবল কামাসক্তির ব্যাপারটা। তার মনে হতো পেত্রা কতেস হচ্ছে অন্য সব সাধারণ মেয়ের মতোই, সে ভালো করে বলতে গেলে বিছানায় একেবারেই নিরুত্তাপ, আর ভালোবাসার ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে অনভিজ্ঞ। উরসুলার চেঁচামেচিতে বধির, আর ভাইয়ের উপহাসের তোয়াক্কা না করা আউরেলিয়ানো শুধু ভাবত একটা কিছু বের করার, যাতে পেত্রা কতেসের সঙ্গে ঘর বেঁধে তার ভরণপোষণের ব্যবস্থা হয়, আর ভাবত সে মরতে পারে পেত্রার সঙ্গে, মরতে পারে তার ওপরে, তার নিচে, এক জ্বরতপ্ত তাণ্ডবময় রাতে। এক শান্তিময়ী শেষ জীবনের প্রতি আকৃষ্ট কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া যখন আবার রৌপ্যশালাটা খোলে, আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ভাবে সোনার ছোট ছোট মাছ তৈরি করাটা হবে ভালো এক ব্যবসা। ধাতুর শক্ত পাত, কোনো রকম ছাঁট না দেওয়া অকল্পনীয় ধৈর্যের সঙ্গে কর্নেল কীভাবে ধীরে ধীরে সোনালি আঁশটেতে পরিণত করে তা দেখে গরম ছোট ঘরটিতে কাটিয়ে দেয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে। কাজটাকে তার মনে হয় ভীষণ কষ্টকর, প্রচণ্ড যত্নের প্রয়োজন, আর পেত্রা কতেসের আকর্ষণ তার কাছে ছিল এতই লোভনীয় যে তিন সপ্তাহের পর রৌপ্যশালা থেকে উধাও হয়ে যায়। ব্যাপারটা ঘটেছিল যখন পেত্রা কতেস খরগোশ লটারি করছিল। খরখোশগুলো এত দ্রুত প্রজননক্ষম হতো আর এত দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধি হতো ওদের, প্রথম দিকে কোনো রকমে লটারির টিকিট বিক্রির সময়ে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো এই ভীতিপ্রদ বংশবৃদ্ধির ব্যাপারটা খেয়াল করে নি। কিন্তু এক রাতে যখন গ্রামের কেউই আর খরগোশের লটারির কথা শুনতে রাজি নয়, তখন উঠানের দেয়ালে এক গর্জন অনুভব করে। ‘ভয় পেয়ো না’, বলে পেত্রা কতেস, ‘ওগুলো হচ্ছে খরগোশ।’ জন্তুদের শোরগোলে সে রাতে ঘুম হয় না তাদের, আর ভোর হলে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো দরজা খুলে দেখতে পায় উঠানে গিজগিজ করছে প্রভাতের উজ্জ্বলতায় নীলাভ খরগোশ। হাসতে হাসতে মারা যাওয়ার জোগাড় পেত্রা কতেসের, ওর সঙ্গে রসিকতা করার লোভ সামলাতে পারে না।
‘সবগুলোই জন্ম নিয়েছে গত রাতে’, বলে।
‘কী ভয়ংকর’, বলে সে, ‘গরু দিয়ে চেষ্টা করিস না কেন?’
কিছুদিন পর পেত্রা কতেস উঠানটা খানিক খালি করার উদ্দেশ্যে খরগোশগুলোর বদলে এক গরু আনে, যেটা দুই মাস পর একসঙ্গে তিনটি বাচ্চা দেয়। এভাবেই শুরু হয় সব। রাতারাতিই আউরেলিয়ানো সেগুন্দো মালিক হয়ে যায় প্রচুর জমাজমির ও গবাদিপশুর, আর ওগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোনো রকমে সময় করে উঠতে পারে উপচে পড়া আস্তাবল ও শূকরের খোঁয়াড়গুলোকে বড় করার। উন্মত্ততাপূর্ণ এই সৌভাগ্যটা একই সঙ্গে তার জন্য হাসিরও উদ্রেক করত আর এই আনন্দের ভার নামাতে লাগামছাড়া আচরণে বাধ্য হতো সে। ‘অ্যাই গরুর পাল ভাগ, জীবন বড়ই ছোট’, চিৎকার করত। উরসুলা নিজেকে প্রশ্ন করত সে কিসের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সে কি চুরি করছে, নাকি গরু চোর বনে গেছে। আর যখন প্রতিবার ফেনা মাথায় ঢেলে মজা পাওয়ার উদ্দেশ্যে শ্যাম্পেনের ছিপি খুলত, তখন সে চিৎকার করত এই অপচয়ের জন্য। ব্যাপারটা আউরেলিয়ানো সেগুন্দোকে এতই বিরক্ত করত যে একদিন খোশমেজাজে ঘুম থেকে উঠে এক বাক্স টাকা, এক ক্যান আঠা ও একটা বুরুশ নিয়ে সে বাড়িতে হাজির হয় আর ফ্রান্সিসকো এল অমব্রের পুরোনো গানগুলো গলা ছেড়ে গাইতে গাইতে বাড়িটা মুড়ে দেয় ভেতর-বাহির, ওপর-নিচ, আগাপাছতলা এক পেসোর নোট দিয়ে। পিয়ানোলাটা বাড়িতে ঢোকানোর সময়ের সেই প্রাচীন সাদা রং করা ম্যানশনটা রহস্যময় মসজিদের রূপ ধারণ করে। এই অপচয়ের মহিমা দেখতে পরিবারের সবার হইচইয়ের মধ্যে উরসুলার চেঁচামেচির মধ্যে সারা গ্রাম ভেঙে পড়া আনন্দোচ্ছ্বাসপূর্ণ লোক দিয়ে উপচে পরে রাস্তা, আর এরই মধ্যে আউরেলিয়ানো শেষ করে প্রবেশপথ থেকে গোসলখানা ও শোবার ঘরসহ উঠান পর্যন্ত টাকা লাগানো, আর পরে উঠোনে ছুড়ে দেয় বাড়তি টাকাগুলো।
‘এখন’, শেষমেষ বলে, ‘আশা করি এ বাড়ির কেউই আর আমাকে টাকা নিয়ে কথা বলবে না।’
এ রকমই ঘটে। উরসুলা চুনকামের বড় বড় চাপড়ার সঙ্গে সেঁটে থাকা নোটগুলোকে খুলে নিয়ে আবার সাদা রং করায় বাড়িটা। ‘হায় ঈশ্বর’, অনুনয় করে, ‘আমাদের আবার গরিব করে দে, যেমনটি ছিলাম মাকন্দ পত্তনের সময় যাতে অন্য জীবনে আমাদের এই অপচয়ের মাশুল না গুনতে হয়।’ ওর অনুনয় শোনা হয় উল্টোভাবে। নোটগুলো আলাদা করতে থাকা মজুরদের একজন অসাবধানতাবশত হোঁচট খায় সেন্ট যোসেফের প্লাস্টার দিয়ে বানানো এক পেল-ায় মূর্তির সঙ্গে, যেটাকে কেউ যুদ্ধের শেষের বছরগুলোতে রেখে গিয়েছিল, আর মেঝেতে পড়ে ফাঁপা মূর্তিটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়। সেটা ছিল সোনার মোহর দিয়ে ঠাসা আর বিশাল এই মূর্তিটা যে কে নিয়ে এসেছিল, তা কেউই মনে করতে পারে না। ‘তিনজন লোক নিয়ে এসেছে এটাকে’, বর্ণনা দেয় আমারান্তা, ‘ওরা আমাকে বলে বৃষ্টি থামা পর্যন্ত রক্ষণ করতে আর আমি বলেছিলাম ওইখানে রাখতে, কোনাটাতে, যেখানে কেউই হোঁচট খাবে না ওটার সঙ্গে। সাবধানতার সঙ্গে ওখানেই রাখে তারা আর তখন থেকেই ওখানেই থাকে কারণ ওটা নিতে কখনোই তারা ফেরেনি।’ শেষের দিকে উরসুলা মোমবাতি জ্বালিয়ে হাঁটু মুড়ে আরাধনা করত সেখানে কিন্তু কখনোই সন্দেহ করে নি যে সেন্টের বদলে সে বন্দনা করছে দুই শ কিলোগ্রাম স্বর্ণকে। অনিচ্ছাকৃত মূর্তিপূজা তার মনস্তাপকে করে আরও গভীর। থুতু দেয় স্বর্ণমুদ্রার ওই দর্শনীয় স্তূপের ওপর, আগে অথবা পরে ওই তিন লোক ফিরে আসবে দাবি করতে, এই ভেবে ক্যানভাসের তিনটি বস্তার মধ্যে সেগুলো ঢুকিয়ে গোপন এক জায়গায় পুঁতে ফেলে। অনেক দিন পর তার বার্ধক্যের কঠিন দিনগুলোতে বাড়ির সামনে দিয়ে যাতায়াত করা ভ্রমণকারীদের আলাপে বাগড়া দিয়ে সে জিজ্ঞেস করত, যে যুদ্ধের সময় প্লাস্টার দিয়ে বানানো এক মূর্তি তারা বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় জমা রেখেছিল কি না
এসব ব্যাপার, যেগুলো উরসুলাকে হতাশ করত, তখনকার দিনে এগুলো ছিল একেবারেই সাধারণ ব্যাপার। মাকন্দ ডুবে ছিল এক অলৌকিক বৈভবে। পত্তনকারীদের কাদা আর গোল পাতার ছাউনিগুলোর বদলে তখন এসেছে ইটের দালান, কাঠের জানালার পর্দা আর সিমেন্টের মেঝে, যা কিনা বেলা দুটোর গরমকে করত আরও সহনীয়, হোসে আর্কাদিওর সেই প্রাচীন গ্রামের শুধু অবশিষ্ট ছিল, ধুলো ভরা দৃঢ়তম অবস্থায়ও টিকে থাকার নিয়তি নিয়ে জন্মানো সেই আলমন্ডগাছগুলো, আর স্ফটিক জলের সেই নদী, যেটার প্রাগৈতিহাসিক পাথরগুলো ধুলো হয়ে যায় হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোর উন্মত্ত হাতুড়ির আঘাতে, যখন সে একটা নৌপথ স্থাপনের চেষ্টা করে। সেটা ছিল তার পরদাদার স্বপ্নের মতোই এক অলীক স্বপ্ন, কারণ নিচের পাথুরে তলদেশ আর স্রোতের অসংখ্য বাধাগুলোর ফলে সমুদ্র পর্যন্ত নৌ চালনা ছিল অসম্ভব। কিন্তু অদৃষ্টপূর্ব অপরিণামদর্শিতার তাড়ায় হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো একগুঁয়ের মতো লেগে থাকে পরিকল্পনাটাতে। তার আগ পর্যন্ত সে এ ধরনের কোনো কল্পনার বিন্দুমাত্র লক্ষণও দেখায়নি। পেত্রা কতেসের সঙ্গে তার অনিশ্চিত রোমাঞ্চকর সম্পর্কটা ছাড়া সে আর কোনো মেয়ের সঙ্গেই পরিচিত হয় নি। উরসুলা ওকে মনে করত এ পর্যন্ত বংশের ইতিহাসে সবচেয়ে শান্তশিষ্ট ব্যক্তির জ্বলন্ত উদাহরণ হিসেবে, যে নাকি এমনকি মোরগের লড়াইয়ের মতো ব্যাপারেও নাম করতে সক্ষম হয় নি। কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া ওকে সমুদ্র থেকে বারো কিলোমিটার দূরের আটকে পড়া স্প্যানীয় জাহাজের গল্প বলে যেটার কয়লায় পরিণত হওয়াটা সে নিজেই দেখেছিল যুদ্ধের সময়। সেই গল্পটা, যেটা বহু মানুষের কাছে অনেক দিন ধরে ছিল কল্পনাপ্রসূত, সেটাই ছিল হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোর কাছে বিরাট এক উদ্ঘাটন।
সবচেয়ে বেশি দাম হাঁকানো ক্রেতার কাছে নিলামে মোরগগুলো বিক্রি করে সে, লোক নিয়োগ করে, যন্ত্রপাতি কিনে সে লেগে যায় পাথর ভাঙা ও খাল কাটার সব বাধা পরিষ্কারে, এমনকি জলপ্রপাত সমতল করার মতো বিশাল অভিযানে। ‘এর সবকিছুই আমার মাথার মধ্যে গেঁথে আছে’, চিৎকার করত উরসুলা, ‘সময় যেন গোল হয়ে আবার ফিরে এসেছে প্রারম্ভে।’ যখন সে মনে করে নদীটা নৌ চালানোর উপযুক্ত, তখন হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো তার অভিযানের কথাটা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জানায়, আর অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা দেয় আউরেলিয়ানো সেগুন্দো। উধাও হয়ে যায় সে বহুদিনের জন্য। যখন সবাই বলাবলি করে যে জাহাজ কেনার পরিকল্পনাটা আসলে ভাইয়ের জমানো টাকা হাতিয়ে নেবার ফন্দি ছাড়া কিছুই নয় তখনই গ্রামের দিকে এগিয়ে আসা এক অদ্ভুত জাহাজের কথা শোনা যায়। হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোর পরিকল্পনার কথা ভুলে যাওয়া মাকন্দবাসী নদীপাড়ে ছুটে গিয়ে অবিশ্বাসভরে হতবাক হয়ে দেখে মাকন্দে ভেড়া প্রথম আর শেষ জাহাজটাকে। ওটা আসলে বিশজন লোক গুন টেনে চালানো গাছের গুঁড়ি দিয়ে বানানো ভেলা ছাড়া আর কিছুই ছিল না, ভেলার সামনের দিকে দাঁড়িয়ে চোখে এক সন্তুষ্টির উজ্জ্বলতা নিয়ে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো সেই ব্যয়বহুল কাজের তদারক করছে। তার সঙ্গে ছিল চোখধাঁধানো একদল সম্ভ্রান্ত মহিলা যারা রোদ প্রতিরোধ করতে মাথায় চড়িয়েছে মনোহর টুপি, তাদের স্কন্ধে ছিল দামি সিল্কের ওড়না, মুখে রংচঙে ক্রিম, চুলে প্রাকৃতিক ফুল, হাতে সোনার সর্পাকৃতির বাজুবন্ধ আর ছিল হিরে দিয়ে বাঁধানো দাঁত। গাছের গুঁড়ির ভেলাটাই ছিল একমাত্র যানবাহন, যেটাকে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো মাকন্দ পর্যন্ত নিতে পারে, আর সফল হয় শুধু একবারই, কিন্তু কখনোই সে তার অভিযানের ব্যর্থতা স্বীকার করে নি বরং উল্টো অভিযানটাকে তার অভিপ্রায়ের বিজয়ের প্রমাণ হিসেবে ঘোষণা করে। ভাইয়ের কাছে সব বিস্তারিত হিসাব বুঝিয়ে দিয়ে শিগগিরই আবার মোরগলড়াইয়ের গৎবাঁধা জীবনে ডুবে যায়। একমাত্র যেটা বেঁচে থাকে, সেই দুর্ভাগ্যজনক উদ্যোগ থেকে, তা হচ্ছে ফ্রান্সের মহিলাদের মাকন্দে নিয়ে আসা একঝলক পরিবর্তনের হাওয়া, যাদের অসাধারণ শিল্পকৌশল পাল্টে দেয় প্রণয়ের গতানুগতিক ধারা, যাদের সমাজে ভালোভাবে বাঁচার অনুভূতি কাতারিনার প্রাচীন দোকানটাকে শেষ করে দিয়ে রাস্তাটাকে রূপান্তর করে জাপানি লন্ঠন আর স্মৃতিকাতর ছোট ছোট অর্গানের বাজারে। ওরাই ছিল মাকন্দে রক্তক্ষয়ী সেই উৎসবের উদ্যোক্তা, যেটাতে মাকন্দ ডুবে ছিল তিন দিনব্যাপী এক উন্মত্ততায় আর যার একমাত্র দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব হচ্ছে আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর সঙ্গে ফের্নান্দা দেল কার্পিওর পরিচয়ের সুযোগ।
রেমেদিওস লা বেইয়্যাকে ঘোষণা করা হয় (উৎসবের) রানি হিসেবে। ওর উদ্বিগ্ন করার মতো সৌন্দর্যে ভীত উরসুলা, নাতির মেয়ের রানি নির্বাচনে বাধা দিতে পারে না। তখন পর্যন্ত সে সফল হয়েছিল, যাতে রেমেদিওস রাস্তায় না বেরোয়। আমারান্তার সঙ্গে মাস্-এ যেতে বাধা দিতে না পেরে ওকে বাধ্য করে কালো এক কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকতে। ধর্মে অল্প নিষ্ঠ লোকেরা, যারা যাজকের ছদ্মবেশে কাতরিনার দোকানে ধর্মবিরুদ্ধ মাস গাইত, তারা গির্জায় যেত যদি শুধু এক পলকের জন্যও রেমেদিওস লা বেইয়্যার, যার কিংবদন্তির মতো রূপের কথা জলভূমিজুড়ে আলোচিত হতো আবেগতপ্ততা নিয়ে, তার মুখ যদি একপলকের জন্যও দেখা যায়, সেই আশায়। অনেক দিন পার হওয়ার পর তারা শেষ পর্যন্ত সেটা দেখতে পায়, যদিও ওদের জন্য এই দেখাটা না হওয়াই ভালো ছিল কারণ ওদের মধ্যে অধিকাংশই আর কখনোই শান্তিপূর্ণ ঘুমকে পুনরুদ্ধার করতে পারে নি। যে এই দেখাটাকে সম্ভব করে সে ছিল এক ভিনদেশি, যে সব সময়ের জন্য হারিয়ে ফেলে তার মানসিক স্থিরতা, যে জড়িয়ে যায় দুর্দশা আর হতাশার জালে, আর অনেক বছর পর এক রাতের ট্রেনের নিচে পড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, যখন সে রেললাইনের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে। সবুজ কর্ডের জামা ও এমব্রয়ডারিযুক্ত জ্যাকেট পড়া যুবককে যে মুহূর্তে গির্জায় প্রথম দেখা যায়, কারও মনে কোনো সন্দেহ ছিল না যে সে এসেছে অনেক দূর থেকে, হয়তোবা বাইরের কোনো বিক্ষিপ্ত শহর থেকে, রেমেদিওস লা বেইয়্যার জাদুকরি মোহে আকৃষ্ট হয়ে। সে ছিল এতই সুন্দর এতই মার্জিত ও শান্তশিষ্ট যে ভালোভাবে তুলনা করা হলে পিয়েত্র ক্রেসপিকে মনে হবে নেহাত এক অকালপরিণত, আর অনেক মেয়েই ঈর্ষাজনিত ফিসফিসায় যে আসলে যুবকটারই মুখ কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা উচিত ছিল। সে মাকন্দের কারও সঙ্গেই বাকবিনিময় করত না। রোববার ভোরে রুপার রেকাব আর মখমলের কম্বল চড়ানো এক ঘোড়ায় চড়ে রূপকথার রাজকুমারের মতো সে আবির্ভূত হতো আর মাস শেষ হলেই গ্রাম পরিত্যাগ করত।
তার উপস্থিতির এতই ক্ষমতা ছিল যে যখন প্রথমবার তাকে গির্জায় দেখা যায় সবাই ধরে নেয় যে ওর এবং রেমেদিওস লা বেইয়্যার মধ্যে স্থাপিত হলো এক নীরব উত্তেজনাপূর্ণ দ্বৈরথের, এক অপ্রত্যাহার্য প্রতিযোগিতার, যার চূড়ান্ত পরিণতি হবে শুধু হয় ভালোবাসা নয়তোবা মৃত্যুতে। আবির্ভূত হওয়ার ষষ্ঠ রোববারে যুবকটি হাজির হয় এক হলুদ গোলাপ হাতে নিয়ে। সব সময়ের মতোই দাঁড়িয়ে মাস শুনে শেষ হওয়ার পর রেমেদিওস লা বেইয়্যার পথ আগলায়, আর নিঃসঙ্গ গোলাপটাকে অর্পণ করে। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গোলাপটা নেয় রেমেদিওস, যেন এই স্তুতির জন্য সে প্রস্তুত হয়েই ছিল আর মুহূর্তের জন্য নেকাব সরিয়ে মৃদু হাসির সঙ্গে ধন্যবাদ দেয়। ওটুকুই ছিল সব ঘটনা। কিন্তু শুধু যুবকের জন্যই নয়, যেসব পুরুষদের এই দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতার সুযোগ হয়েছিল, তাদের জন্য সেটা ছিল এক অনন্ত মুহূর্ত।
তখন থেকেই সেই যুবক রেমেদিওস লা বেইয়্যার জানালার কাছে এক গানের দল নিয়ে সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত বাজিয়ে যেত। আউরেলিয়ানো সেগুন্দোই ছিল একমাত্র ব্যক্তি, যে নাকি ওর জন্য আন্তরিক সহানুভূতি অনুভব করে, আর তার এই উপর্যুপরি প্রচেষ্টাতে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা চালায়। ‘আর সময় নষ্ট কোরো না’, এক রাতে ওকে বলে, ‘এ বাড়ির মেয়েগুলো খচ্চরের (হাবা অর্থে) চেয়েও অধম।’ ওকে বন্ধুত্বের আমন্ত্রণ জানায় শ্যাম্পেন দিয়ে গোসলের, তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে এ পরিবারের মেয়েদের রয়েছে পাথর দিয়ে বানানো হৃদয়, কিন্তু সে তার একগুঁয়েমিতে চিড় ধরাতে বিফল হয়। অন্তহীন রাতগুলোর গান বাজনায় উত্তেজিত হয়ে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া পিস্তল দিয়ে তার এই মনস্তাপ সমাপ্তি ঘটানোর হুমকি দেয়। লোকটাকে বিরত করতে পারে না সে, শুধু নিজের দুঃখজনক মনোবলহীনতা রক্ষা করে কোনোমতে। মার্জিত-ত্রুটিহীন লোকটা হয়ে ওঠে কুৎসিত জরাজীর্ণ এক মানুষে। গুজব ছিল সে ত্যাগ করে এসেছে ক্ষমতা আর সম্পদের পাহাড়, যদিও কেউই কখনোই তার আবাসস্থল সম্বন্ধে জানতে পারে নি। সে হয়ে পরে ঝগড়াটে, মারামারি করে পানশালায়, আর ভোরবেলা জেগে ওঠে কাতারিনার দোকানে নিজের করা নোংরা দিয়ে মাখামাখি অবস্থায়, আর তার নাটকের সবচেয়ে করুণ ব্যাপারটা হচ্ছে রেমেদিওস লা বেইয়্যা ওর দিকে মুখ তুলেও তাকায় নি, এমনকি সে যখন রাজকুমারের বেশে গির্জায় গিয়ে হাজির হতো তখনো না। রেমেদিওস গোলাপটা গ্রহণ করেছিল কোনো খারাপ মনোভাব না নিয়েই, ভালো করে বলতে গেলে ব্যাপারটার আতিশয্যে আনন্দ পেয়ে, আর নেকাবটা সরায় যুবককে ভালো করে দেখতে, নিজেরটাকে দেখাতে নয়।
সত্যিকার অর্থে রেমেদিওস লা বেইয়্যা এই বিশ্বের কেউ ছিল না। বয়ঃসন্ধির অনেক পরেও সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদকে ওর গোসলের এবং কাপড় পরানোর মতো কাজ করতে হতো, এমনকি যখন নিজে নিজেই কাজগুলো করতে পারত, তখন তাকে পাহারা দিতে হতো যেন নিজের মলমাখানো কাঠি দিয়ে দেয়ালে জীবজন্তু আঁকতে না পারে। বিশ বছরে পা দেয় সে পড়তে ও লিখতে না শিখে, খাবার টেবিল ছুরি কাঁটাচামচ ব্যবহার না করে নগ্ন অবস্থায় সারা বাড়িতে ঘোরে কারণ তার প্রকৃতিই ছিল যেকোনো ধরনের গতানুগতিকতার বাইরে। যখন যুবক কমান্ডার ওকে প্রেম নিবেদন করে, সরলতার সঙ্গে সে প্রত্যাখ্যান করে কারণ সে তার ছেলেমানুষি দেখে আশ্চর্য হয়। আমারান্তাকে বলে, ‘দেখো, লোকটা বলে যে আমার কারণে সে মারা যাচ্ছে, যেন আমি তার পেটের ব্যথা।’ যখন সত্যিই সত্যিই তাকে জানালার পাশে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় রেমেদিওস লা বেইয়্যা নিশ্চিত হয় লোকটিকে নিয়ে তার প্রথম ধারনার ব্যাপারে।
‘দেখলে’, মন্তব্য করে, ‘সে ছিল সত্যিই বোকা।
মনে হতো যেন যেকোনো গতানুগতিকতার বাইরের বাস্তবতাকে দেখার ক্ষমতা ছিল তার। অন্তত কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া তা-ই মনে করত। ওর কাছে রেমেদিওস লা বেইয়্যা কোনো মানসিক প্রতিবন্ধী ছিল না, সে বিশ্বাস করত ঠিক তার উল্টো, ‘এটা যেন ও বিশ বছরের যুদ্ধ শেষে ফিরেছে’, কর্নেল বলত। এদিকে উরসুলা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিত পরিবারে ওর মতো অনন্যসাধারণ খাঁটি একজন মানুষকে পুরস্কারস্বরূপ পাঠানোর জন্য, আবার একই সঙ্গে ওর সৌন্দর্য করত তাকে চিন্তিত, এটাকে তার মনে হতো পরস্পরবিরোধী গুণ, যা কিনা সারল্যের কেন্দ্রবিন্দুতে এক শয়তানি ফাঁদ। এই কারণেই সে ওকে পুরো পৃথিবী থেকে আড়ালে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, রক্ষা করতে চায় যেকোনো জাগতিক প্রলোভন থেকে। কিন্তু তার জানা ছিল না যে মাতৃগর্ভ থেকেই রেমেদিওস লা বেইয়্যা মুক্ত ছিল যেকোনো ধরনের সংক্রমণ থেকে, উরসুলার চিন্তাভাবনার আশপাশ দিয়েও যায়নি যে কার্নিভালের মতো তুলকালাম কাণ্ডে তাকে রানি মনোনীত করা। কিন্তু বাঘের ছদ্মবেশ নেওয়ার মতো উদ্ভট চিন্তায় উত্তেজিত আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ফাদার অ্যান্তোনিও ইসাবেলকে বাড়িতে নিয়ে যায় উরসুলাকে বোঝাতে যে যেমন উরসুলা বলে কার্নিভাল কোনো মূর্তিপূজকদের উৎসব নয় বরং এটা একটা ক্যাথলিক প্রথা। শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুকুট পরানোর অনুমতি দেয়।
রেমেদিওস বুয়েন্দিয়ার রানি হওয়ার খবর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই জলাভূমির সীমানা পার হয়ে এমন সব জায়গায় পৌঁছায়, যেখানে তখন পর্যন্ত তার প্রচণ্ড রূপের কথা কেউ জানত না। কিন্তু তার নামের পদবিটাকে তারা মনে করত বিধ্বংসীমূলক কার্যক্রমের প্রতীক আর তারা এ কারণে অস্বস্তি বোধ করে। কিন্তু অস্বস্তিটা ছিল অমূলক। সেই সময় নিরীহ ব্যক্তি বলে যদি কাউকে বোঝাত, সে ছিল বৃদ্ধ মোহভ্রষ্ট কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া, যে নাকি ক্রমে ক্রমে জাতির বাস্তবতার সঙ্গে সব সম্পর্ক হারিয়ে ফেলছে। রৌপ্যশালায় আবদ্ধ থেকে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তার একমাত্র সংযোগ ছিল সোনার মাছগুলোর ব্যবসা। শান্তি স্থাপনের প্রথম দিকটায় তার বাড়ির পাহারাদার এক সৈন্য জলাভূমির গ্রামগুলোতে চলে যেত আর ফিরে আসত অর্থ আর খাবারের বোঝা নিয়ে। সে বলত রক্ষণশীল সরকার উদারপন্থী দলের সমর্থন নিয়ে এমন এক আইন বানাচ্ছে, যেখানে প্রতি প্রেসিডেন্ট এক শ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারবে। বলত, শেষ পর্যন্ত পবিত্র সি-র চুক্তিটা স্বাক্ষরিত হয়েছে, রোম থেকে হিরের মুকুটখচিত খাঁটি সোনা দিয়ে বানানো সিংহাসন নিয়ে এক কার্ডিনাল এসেছেন, আর উদারপন্থী মন্ত্রীরা হাঁটু গেড়ে অঙ্গুলীয় চুম্বনের ছবি তুলেছে তার সঙ্গে। বলত যে এক স্প্যানীয় কোম্পানির মূল মহিলা শিল্পীকে রাজধানীতে অনুষ্ঠানের সময় একদল মুখোশধারী ব্যক্তি তার ড্রেসিং রুম থেকে অপহরণ করে, আর পরের রোববারে তাকে নগ্ন অবস্থায় নাচতে দেখা যায় প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টের গ্রীষ্মকালীন বাড়িতে। ‘রাজনীতির কথা আর আমাকে বলিসনে’, ওকে বলত কর্নেল, ‘আমাদের কাজ হচ্ছে মাছ বিক্রি।’ সে কর্মশালায় কাজ করে ধনী বনে যাচ্ছে বলে দেশের ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চায় না, এই গুজব উরসুলার কানে এলে সেটা তার হাসির উদ্রেক করে। তার প্রখর বাস্তব বুদ্ধি দিয়েও সে কর্নেলের ব্যবসাটাকে বুঝতে পারত না, কারণ সোনার মাছগুলোর বিনিময় হতো স্বর্ণমুদ্রাগুলোর বদলে, পরে স্বর্ণমুদ্রাগুলোকে রূপান্তর করত কর্নেল ছোট ছোট সোনার মাছে, আর এভাবেই যত বেশি সে বিক্রি করত, তাকে তত বেশি কাজ করতে হতো এক ক্লান্তিকর দুষ্টচক্রকে সন্তুষ্ট করতে। সত্যি বলতে কি, যে ব্যাপারটা তাকে অকৃষ্ট করত, তা ব্যবসাটা নয়, তা হচ্ছে কাজ। আঁশগুলোকে জোড়া দিতে, চোখগুলোতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রুবি লাগাতে, কানকো বানাতে আর ডানা লাগাতে এত মনোযোগের প্রয়োজন পড়ত যে সে এক মুহূর্ত সময় পেত না যুদ্ধের মোহভঙ্গ নিয়ে চিন্তা করার। হাতের কাজটার সূক্ষ্মতার প্রয়োজনে এতই মনোযোগের প্রয়োজন হতো যে অল্প সময়ের মধ্যেই যুদ্ধের সব সময়ের চেয়েও বেশি বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিল একনাগাড়ে একই ভঙ্গিতে বসে থাকার ফলে, তার শিরদাঁড়া বাঁকা হয়ে গিয়েছিল আর সূক্ষ্ম কাজের ফলে তার চোখের জ্যোতি গিয়েছিল কমে। কিন্তু গভীর মনঃসংযোগ তাকে উপহার দিয়েছিল আত্মার শান্তি। শেষবার তাকে যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কিছু করতে দেখা গিয়েছিল যখন দুই দলেরই পুরাতন যোদ্ধারা সব সময় আশ্বাস দেওয়া আজীবন অবসর-ভাতা না পেয়ে তার সমর্থন চাইতে যায়। ‘ভুলে যান আপনারা এগুলো’, ওদের বলে সে, ‘দেখছেন যে আজীবন ওটার জন্য অপেক্ষা করার চাইতে আমি পেনশন প্রত্যাখ্যান করেছি।’ প্রথম দিকে কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস বিকেলের দিকে ওর সঙ্গে কথা বলতে যেত আর স্মৃতিচারণা করতে দুজনেই রাস্তার কাছের দরজায় বসত। কিন্তু ক্লান্ত সেই লোক, যার টাক তার অকাল বার্ধক্য দ্রুততর করছে, সে যে স্মৃতির উদ্রেক করত আমারান্তা তা সহ্য করতে না পেরে জ্বালাতন করত তিরস্কারের মাধ্যমে, যত দিন পর্যন্ত না এক বিশেষ দিনে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে সম্পূর্ণরূপে উধাও হয়ে যায় লোকটা। অল্পভাষী নীরব নতুন জীবনের বাতাসের ঝাপটা লাগা বাড়ির ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ না করা কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া শুধু বুঝতে পারে যে একটা চমৎকার বার্ধক্যের গূঢ় রহস্য হচ্ছে নিঃসঙ্গতার সঙ্গে এক সম্মানজনক চুক্তি করা ওটা ছাড়া আর কিছুই নয়। একটা হালকা ঘুম দেওয়ার পর ভোর পাঁচটায় উঠে রান্নাঘরে তার চিরাচরিত তেতো কফি পান করে নিজেকে সে আবদ্ধ করত কামারশালায়, আর বিকেল চারটের সময় বারান্দা দিয়ে একটা টুল টেনে প্রজ্বলিত গোলাপগুলোর দিকে এক পলকও না তাকিয়ে, এমনকি দিনের উজ্জ্বলতার দিকেও না তাকিয়ে অথবা আমারান্তার অনুভূতিহীন অবস্থার দিকে না তাকিয়ে, যে নিরাবেগ বিষণ্নতার পাত্রে বাষ্প বের হওয়ার মতো শব্দ করত, আর সন্ধ্যাবেলা সেটা পরিষ্কার বোঝা যেত, সেদিকেও মনোযোগ না দিয়ে কর্নেল রাস্তার পাশের দরজাটায় বসে থাকত, যতক্ষণ মশারা অনুমতি দিত। মাঝে মাঝে কেউ কেউ তার নিঃসঙ্গতাকে বিরক্ত করার সাহস পেত
‘কর্নেল কেমন আছেন’, যেতে যেতে বলত।
‘এই তো আছি’, উত্তর দিত সে, ‘অপেক্ষা করছি আমার শবযাত্রার জন্য।’
ফলে রেমেদিওস লা বেইয়্যার রানি হওয়া নিয়ে যে অস্বস্তির সৃষ্টি হয়েছিল, তার সত্যিকার কোনো ভিত্তি ছিল না। কিন্তু অনেকেই এমনটি বিশ্বাস করে না। আসন্ন মর্মান্তিক অবস্থার কথা টের না পেয়ে সারা গ্রাম ভেঙে পড়ে প্লাজার ওপর, আনন্দের এক কোলাহলমুখর বিস্ফোরণে।
কার্নিভাল তার উন্মত্ততার চূড়ান্তে পৌঁছায়, আর শেষ পর্যন্ত বাঘের ছদ্মবেশ নেওয়ার স্বপ্ন পূরণ হওয়ায় যখন প্রচণ্ড চিৎকারে গলা ভেঙে যায় তখন বল্গাহীন ভিড়ের মধ্যে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো দেখে জলাভূমির রাস্তা ধরে বহন করা যায় এমন সোনালি চেয়ারে বসিয়ে তার কল্পনার সবচেয়ে মোহনীয় রমণীকে নিয়ে অগণিত লোকের মিছিলকে এগিয়ে আসতে। কয়েক মুহূর্তের জন্য মাকন্দের শান্তিপূর্ণ বাসিন্দারা নিজেদের মুখোশ খোলে, পান্নার মুকুট, এরমিনের (বেজির মতো প্রাণী) শাল পরিহিত চোখধাঁধানো সৃষ্টিকে দেখতে, আর তাদের মনে হয় যে তার রাজত্ব শুধু ঢেউখেলানো পাতলা কাগজ ও জড়ি দিয়ে গড়া নয়, বরং তার রয়েছে সত্যিকার কর্তৃত্ব। অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে এর ভেতরে একটা উসকানিমূলক ঘটনার সন্দেহ করার মতো লোকের অভাব ছিল না ওখানে। কিন্তু আউরেলিয়ানো সেগুন্দো তার বিহ্বলতা ঝেড়ে ফেলে তাদেরকে নিজের সম্মানীয় অতিথি বলে ঘোষণা করে, আর রাজা সোলায়মানের মতো বুদ্ধি দিয়ে রেমেদিওস লা বেইয়্যা ও অনুপ্রবেশকারী রানিকে একই মঞ্চে বসিয়ে দেয়। মধ্যরাত পর্যন্ত বেদুইনের ছদ্মবেশধারী বিদেশিরা উন্মত্ততায় মেতে থাকে, এমনকি তাক লাগানো আতশবাজি আর ধড়িবাজি নানা কসরত দেখিয়ে জিপসিদের কথা মনে করিয়ে দেয়। ঠিক ওই সময়, উন্মত্ততার মাঝে কেউ একজন উৎসবের সূক্ষ্ম ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়।
‘উদারপন্থী দল দীর্ঘজীবী হোক’, চিৎকার করে, ‘কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া দীর্ঘজীবী হোক।’
রাইফেলের গুলি ডুবিয়ে দেয় আতশবাজির জেল্লা। ভয়ার্ত চিৎকারে চাপা পড়ে বাজনার শব্দ, আর আনন্দের আসর রূপান্তরিত হয় আতঙ্কের আসরে। অনেক বছর পর পর্যন্ত লোকে নিশ্চিত করে বলবে যে অনুপ্রবেশকারী রাজার রাজকীয় রক্ষীদের মধ্যে ছিল এক স্কোয়াড্রন সামরিক বাহিনী আর তাদের দামি আলখাল্লার নিচে লুকানো ছিল সরকার প্রদত্ত রাইফেল। সরকার এক বিশেষ ইশতেহারে সব অভিযোগ অস্বীকার করে, অঙ্গীকার করে এই রক্তাক্ত ঘটনার চূড়ান্ত তদন্তের। কিন্তু সত্য ঘটনা কখনোই উদ্ঘাটিত হয় না। কিন্তু সব সময়ই যা রটনা হিসেবে রয়ে যায়, তা হচ্ছে রাজরক্ষীর একটি দল কোনো রকমের উসকানি ছাড়াই তাদের কমান্ডারের ইঙ্গিতে যুদ্ধের পজিশন নেয় এবং দয়ামায়া ছাড়াই ভিড়ের ওপর গুলি চালায়। পরিস্থিতি শান্ত হলে যখন মিথ্যা বেদুইনের একজনকেও গ্রামে দেখা যায় না, তখন প্লাজায় হতাহতদের মধ্যে পড়ে থাকে নয়জন, তার চারজন কলম্বিনা (কলম্বিয়ার মহিলা), সতেরোজন তাসের রাজা, এক শয়তান, তিনজন যন্ত্রশিল্পী, দুই জোড়া ফ্রান্সিয়া (নৃত্যনাট্যের চরিত্র), আর তিন জাপানি সম্রাজ্ঞী। আতঙ্কের সেই বিশৃঙ্খলার মধ্যে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো রেমেদিওস লা বেইয়্যাকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যায়, আর আউরেলিয়ানো সেগুন্দো অনুপ্রবেশকারী সম্রাজ্ঞীকে ছেঁড়া পোশাকে রক্তে রাঙানো এরমিনের শালসহ কোলে তুলে বাড়িতে নিয়ে যায়। ওর নাম ছিল ফেরনান্দা দেল কার্পিও। সারা দেশের পাঁচ হাজার সেরা সুন্দরীর মধ্যে একজন ছিল সে, আর তাকে মাকন্দে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মাদাগাস্কারের রানি বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে। উরসুলা ওর পরিচর্যার ভার নেয় নিজের মেয়ের মতো করে। গ্রামে কেউ তার সরলতাকে সন্দেহের চোখে দেখে না বরং করুণা করে। বীভৎস এই হত্যাকাণ্ডের ছয় মাস পরে যখন সব আহত সেরে উঠেছে, গণকবরের শেষ ফুল যখন শুকিয়ে এসেছে, তখন আউরেলিয়ানো ওর খোঁজে যায় সেই দূর শহরে, যেখানে ওর বাবা বাস করত, আর বিশ দিনব্যাপী হট্টগোলপূর্ণ উৎসবের মধ্য দিয়ে ওকে বিয়ে করে মাকন্দে।