নিঃসঙ্গতার একশ বছর – ১৭

১৭

উরসুলাকে প্রচণ্ড কষ্ট করতে হয় বৃষ্টি থামার পর মারা যাওয়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে। বৃষ্টির সময় তার সাময়িক মানসিক স্বচ্ছতা ছিল বিরল, আগস্টে সেটা আরও ঘন ঘন ঘটতে থাকে; যখন দমবন্ধ করা গরম বাতাস বইতে শুরু করেছিল গোলাপের ঝাড়গুলোর ওপর দিয়ে, আর পাথর বানিয়ে ফেলছিল জলাভূমিকে, তখন ছড়িয়ে দিচ্ছিল মাকন্দের ওপর প্রজ্বলিত ধুলোবালি, যা নাকি চিরকালের জন্য ঢেকে ফেলে দস্তার মরিচা ধরা চাল ও শতাব্দীপুরোনো আলমন্ড গাছগুলোকে। উরসুলা দুঃখে কেঁদে ফেলে যখন বুঝতে পারে তিন বছরের বেশি সময় ধরে সে খেলার বস্তু হিসেবে ছিল। ধুয়ে ফেলে সে রং করা মুখটা, খুলে ফেলে রংবেরঙের কাপড়ের তেনা, খসায় শুকনো গিরগিটি ও ব্যাঙ, জপমালা, প্রাচীন আরবদের গলার হার, যেগুলো ঝুলছিল তার সারা শরীরে, আর আমারাত্তা মারা যাওয়ার পর এই প্রথমবারের মতো কারও সাহায্য না নিয়েই বিছানা থেকে উঠে পড়ে নতুন করে সাংসারিক জীবনে নিজেকে জড়ানোর জন্য। তার অজেয় মানসিক শক্তিই তাকে ছায়ান্ধকারে দৃষ্টি জোগায়, ওর টলতে টলতে চলা যাদের নজরে পড়ে বা মাথা বরাবর দেবদূতের মতো উঁচু হাতের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে, তাদের মনে হয় শরীরটাকে নিয়ে আর সে পেরে উঠছে না, কিন্তু তখনো পর্যন্ত কেউ বিশ্বাস করতে পারে না যে সে অন্ধ। প্রথমবার পুনর্নির্মাণের সময় এত যত্ন করে লাগানো ফুলের কেয়ারিগুলো, যেগুলো বৃষ্টিতে ও আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর খোঁড়াখুঁড়িতে ধ্বংস হয়ে গেছে আর মেঝেতে ধরেছে ফাটল, একই কারণে বিবর্ণ আসবাবপত্র হয়ে গেছে প্রায় ভেঙে পড়ার মতো আর দরজাগুলো খুলে গেছে কবজা থেকে, যা তার সময়ে যা দুঃস্বপ্নেও ভাবা যেত না আর সংসারটা পড়েছে এক হতাশাজনিত হুমকির মুখে; এসব বুঝতে তার দৃষ্টির প্রয়োজন পড়ে না। খালি শোবার ঘরগুলোর মধ্য দিয়ে পথ হাতড়ে হাঁটার সময় সে টের পেত উইপোকার সার্বক্ষণিক কাঠ ফুটো করার কুটকুট শব্দ, দেয়াল-কুঠরিতে কাপড় কাটা আর মহাপ্লাবনের সময় বৃদ্ধি পাওয়া বিশাল বিশাল লাল পিঁপড়েগুলোর গর্ত খুঁড়ে বাড়ির ভিত ধসিয়ে দেওয়া। একদিন সেন্টগুলো রাখা তোরঙ্গ খুললে এরই মধ্যে কাপড়গুলো ধুলো করে ফেলার জন্য দায়ী হওয়া তেলাপোকাগুলো শরীর থেকে সরাতে সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদের সাহায্য নিতে হয়। ‘এ ধরনের অবহেলার মধ্যে বাঁচা সম্ভব নয়’, বলে। তখন থেকেই আর অবসর নেওয়ার বিন্দুমাত্র সময় পায় না সে। সে ভোর হওয়ার আগেই উঠে পড়ত, যাকে হাতের কাছে পেত, তাকেই কাজে লাগিয়ে দিত, এমনকি শিশুদেরও। তখনো ব্যবহারযোগ্য গুটিকয়েক কাপড়-জামা রোদে বের করে, কীটনাশকের অকস্মাৎ হামলায় ভয় পাইয়ে দেয় তেলাপোকাগুলোকে, দরজা-জানালায় উইয়ে কাটা খালগুলো ঘষে উঠিয়ে ফেলে আর নিজেদের বাসার মধ্যেই জ্যান্ত অবস্থায় শ্বাসরোধ করে মারে পিঁপড়েগুলোকে, পুনর্নির্মাণের জ্বর তাকে নিয়ে যায় ভুলে যাওয়া কামরাগুলোতে। পরশপাথর খুঁজতে গিয়ে যে কামরায় হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল, সেখান থেকে সমস্ত আবর্জনা ও মাকড়সা পরিষ্কার করায়, সৈন্যদের দ্বারা তছনছ করে ফেলা রৌপ্যশালাকে নতুন করে গোছগাছ করে, আর সবশেষে মেলকিয়াদেসের ঘরটা দেখার জন্য চায় চাবি। নিজের মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ওই ঘরে কাউকে ঢুকতে না দেওয়ার যে নিষেধাজ্ঞা হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো করেছিল, তাতে বিশ্বস্ত সান্তা সোফিয়া লা পিয়েদাদ সব ধরনের ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয় উরসুলাকে ভোলাতে। কিন্তু বাড়ির দূরতম ও অব্যবহারযোগ্য কোনাটিকেও পোকামাকড়ের হাতে ছেড়ে দিতে নারাজ উরসুলার প্রতিজ্ঞা ছিল যে সে সামনে আসা সমস্ত বাধাকেই অতিক্রম করবে, আর তিন দিনের পীড়াপীড়ির পর সে দরজা খোলাতে সক্ষম হয়। দুর্গন্ধের ধাক্কা যাতে ফেলে না দেয়, তার জন্য দরজার হাতল ধরতে হয় তাকে। কিন্তু এ ঘরেই যে স্কুলছাত্রীদের বাহাত্তরটি মলত্যাগপাত্র রয়েছে, আর বৃষ্টির সময়ের প্রথম দিককার এক রাতে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোকে খুঁজতে এসে বাড়ি তল্লাশি করে খুঁজে না পাওয়ার কথা মনে করতে দুই সেকেন্ডের বেশি সময় লাগে না তার। ‘হায় খোদা’, কাতর হয়ে বলে, যেন সে সবই দেখতে পাচ্ছে, ‘তোকে ভালো সহবত শেখাতে এত চেষ্টা করা হলো আর শেষতক বাস করছিস এক শুয়োরের মতো।’

হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো বারবার পড়ে যাচ্ছিল পার্চমেন্টগুলো। তার চুলের জটের মধ্য থেকে একমাত্র যা দেখা যাচ্ছিল তা হচ্ছে সবুজ শেওলার ছোপ লাগা দাঁত ও স্থির দুটো চোখ। প্রমাতামহীর গলার স্বর চিনতে পারায় দরজার দিকে মাথা ঘুরিয়ে হাসার চেষ্টা করে, আর নিজের অজান্তেই উরসুলার এক পুরোনো কথার পুনরাবৃত্তি করে, ‘কী আশা করছিলি’, বিড়বিড় করে, ‘সময় বয়ে চলে।’ ‘সত্যিই তাই’, বলে উরসুলা, ‘কিন্তু এত দ্রুত নয়।’

বলার সঙ্গে সঙ্গেই উরসুলার বোধোদয় হয় যে সে দিচ্ছে সেই একই কথার প্রতিধ্বনি, যে কথা সে শুনেছিল মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অবস্থায় কারাগারে থাকাকালীন কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মুখে, তখন সে আর একবার শিহরিত হয় প্রমাণ পেয়ে যে, সময় এগোয় না; যেমনটি সে কেবল স্বীকার করেছে, আসলে সময় ঘোরে, বৃত্তের মতো। কিন্তু তাতে করে হতাশাকে বাড়ার কোনো সুযোগ দেয় না সে। হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোকে বকা দেয় যেন সে এক বাচ্চা ছেলে, আর তাকে বলে গোসল করে দাড়ি কামিয়ে বাড়ি পুনর্নির্মাণের কাজে হাত লাগাতে। যে কামরাটা তাকে শান্তি দিয়েছিল, সেটা ছেড়ে দেওয়ার মতো সাধারণ কথাটা ভাবতেই আঁতকে ওঠে হোসে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো। চেঁচিয়ে ওঠে, বলে যে কোনো মানুষের সাধ্য নেই যে তাকে বাধ্য করবে এ ঘর থেকে বেরোতে, কারণ সে সেই ট্রেনটা দেখতে চায় না যে ট্রেন দুই শ ওয়াগনভর্তি লাশ নিয়ে প্রতি বিকেলে মাকন্দ থেকে যায় সাগরের দিকে। ‘যারা স্টেশনে ছিল তারা সবাই, চিৎকার করে, ‘তিন হাজার চার শ আট।’ উরসুলা একমাত্র তখনই বুঝতে পারে যে তার চেয়েও অধিক অভেদ্য এক অন্ধকার জগতে আছে ও, যে জগৎ ওর পরদাদার জগতের মতোই, অগম্য ও নিঃসঙ্গ। পুনর্বার তালাটা না লাগিয়ে প্রতিদিন ঘরটাকে পরিষ্কারের ব্যবস্থা করে সে, একটি ছাড়া বাকি সব কটি মলত্যাগপাত্র আবর্জনার স্তূপে ফেলে দিতে বাধ্য করে, আর ওকে সেই কামরাতেই রেখে দেয়, যেখানে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোকে ওরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে, যেমনটি রেখেছিল ওর পরদাদাকে তার চেস্টনাট গাছের নিচে বন্দিদশায়। প্রথম দিকে এ সমস্ত তোড়জোড়কে বুড়ো বয়সের ভীমরতি বলে ধরে নেয় ফের্নান্দা আর খুব কষ্ট করে নিজের বিরক্তি চাপিয়ে রাখে। কিন্তু সেই সময়ে হোসে আর্কাদিওর পাদরি হওয়ার শেষ শপথের আগে রোম থেকে মাকন্দে ফেরার ঘোষণায় উৎসাহিত হলে রাতারাতিই তাকে দেখা যায় দিনে চারবার ফুলগাছগুলোতে পানি দিতে, যাতে করে ছেলে বাড়ি সম্বন্ধে কোনো খারাপ ধারণা না নেয়। একই কারণে অদৃশ্য চিকিৎসকদের সঙ্গে তার পত্র যোগাযোগ বাড়িয়ে দেয় আর ক্রোধোন্মত্ত আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর ধ্বংসের ব্যাপারটা উরসুলা টের পাওয়ার আগেই বারান্দার ফার্ন, অরেগানো ও বেগোনিয়ার জন্য নতুন টব আনায়। আরও পরে রুপোর বাসনকোসন বিক্রি করে কেনে সিরামিকের থালা, মেলামাইনের স্যুপের বাটি ও বড় চামচ, আলপাকার টেবিল ক্লথ, আর সেই সঙ্গে রিক্ত করে দেয় ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানির চিনামাটির ও বোহেমিয়ান ক্রিস্টালে অভ্যস্ত আলমারিগুলোকে। উরসুলা সব সময়ই এক ধাপ এগিয়ে থাকার চেষ্টা করত। ‘দরজা-জানালা সব খুলে দেওয়া হোক, চিৎকার করত সে। ‘মাংস ও মাছ রান্না হোক, সবচেয়ে বড় কাছিম কেনা হোক, বিদেশিরা আসুক কোনায় কোনায় মাদুর পাততে ও গোলাপের ঝাড়ে পেশাব করতে, খেতে বসুক টেবিলে আর যতবার খুশি খাক, ঢেকুর তুলুক, গলাবাজি করুক, ওদের সব বুটজুতো দিয়ে নোংরা করুক, করুক যা খুশি তা-ই, কারণ এটাই একমাত্র ফকির হয়ে যাওয়ার থেকে বাঁচার পথ।’ কিন্তু সেটা ছিল শুধুই মিথ্যে মায়া। তখন সে প্রচণ্ডভাবে বয়োবৃদ্ধা, বেঁচে আছে একরকম ধার করা সময় নিয়ে, যখন মিছরির জন্তু বানানোর অলৌকিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর সামর্থ্য আর তার নেই আর তার উত্তরপুরুষদের মধ্যেও কারোরই এ ঘটনা ঘটানোর মতো প্রাণশক্তি নেই। ফের্নান্দার নির্দেশানুযায়ী বন্ধ থাকে বাড়ির দরজা।

আউরেলিয়ানো সেগুন্দো বাড়ি থেকে তোরঙ্গগুলো পেত্রা কতেসের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আর সে বাড়ির জন্য যা করত, তাতে কোনো রকমে খেয়ে বেঁচে থাকতে পারত, খচ্চরের লটারি থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে। পেত্রা কতেস ও সে কিনেছিল অন্যান্য জন্তু- জানোয়ার, যা দিয়ে দাঁড় করাতে পেরেছিল কোনো রকমের এক লটারির ব্যবসা। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য বাড়ি বাড়ি যেত নিজ হাতে রঙিন কালি দিয়ে আঁকা আকর্ষণীয় লটারির টিকিটগুলো বিক্রি করতে, আর সে খেয়ালই করত না যে অনেকেই সেগুলো কিনত কৃতজ্ঞতাবশে আর বেশির ভাগই কিনত করুণাবশে। তার পরও সবচেয়ে দয়াশীল ক্রেতাও সুযোগ পেত বিশ সেন্ট দিয়ে এক শূকর বা বত্রিশ সেন্ট দিয়ে বাছুর কেনার, আর তারা আশা করে আর এতই উৎসাহিত হয় যে মঙ্গলবার রাতগুলোতে পেত্রা কতেসের উঠান উপচে পড়া লোকজন অপেক্ষা করত কখন এক বাচ্চা ছেলে কিছু না দেখে এক ব্যাগ থেকে পুরস্কার পাওয়া টিকিট তুলবে। এই অবস্থা এক সাপ্তাহিক উৎসবে পরিণত হতে খুব বেশি দেরি হয় না, কারণ পড়ন্ত বিকেল থেকেই ভাজাভুজি ও পানীয়ের দোকানগুলো বসে যেত উঠানে, আর ভাগ্যবানদের অনেকেই জীবিত জন্তুটাকে ওখানেই জবাই দিত এই শর্তে যে অন্যেরা ব্যবস্থা করবে বাজনা ও মদের। ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আউরেলিয়ানো সেগুন্দো নিজেকে আবিষ্কার করে আবার অ্যাকর্ডিয়ান বাজানো অবস্থায় আর ভোজন প্রতিযোগিতাতে। আগেকার দিনের উৎসবের ছোট এই সংস্করণ আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর নিজের কাছেই প্রমাণ করে যে তার উৎসাহ কতটা কমে গিয়েছে, কতটা শুকিয়ে গিয়েছে তার আনন্দবাজ হিসেবে নতুন নতুন বুদ্ধি আবিষ্কারের দক্ষতা, সে বদলে গেছে অন্য এক মানুষে। হস্তিনীর সঙ্গে প্রতিযোগিতার সময়ে যে এক শ বিশ কেজি ওজন ধারণ করেছিল, তা কমে গিয়ে হয়েছে আটষট্টি; ফোলা কাছিমের মুখটা শুকিয়ে ফিরে গিয়েছে ইগুয়ানার মুখে, আর সব সময়ই একঘেয়েমি ও ক্লান্তি ছিল তার নিত্যসাথি। পেত্রা কতেসের কাছে অবশ্য ওই সময়ের মতো ভালো স্বামী সে কখনোই ছিল না, কারণ হয়তোবা তার করুণাকে ভুল করে ভালোবাসা মনে করত আর হয়তোবা এই বিপর্যয় ওদের মধ্যে এনে দিয়েছে এক পারস্পরিক নির্ভরতা। ভেঙে যাওয়া বিছানাটা উন্মত্ততার স্থল হওয়া থেকে রেহাই পেয়ে পরিণত হয়েছে এক অন্তরঙ্গ আশ্রয়ে; আর লটারির জন্তু কেনার জন্য বিক্রি করে দেওয়া ও একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি দেখানোর আয়নাগুলো থেকে, খচ্চরের খাওয়া দামাস্কাসের কাপড় ও মখমলের কাপড় থেকে মুক্তি পেয়ে দুজনে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকত নির্ঘুম বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সরলতা নিয়ে, আর সেই সুযোগে হিসাব করে জমা করত সেই পয়সা, যে পয়সা আগে তারা অপচয় করত শুধুই অপচয়ের জন্য। মাঝেমধ্যে আশ্চর্য করে দিত ভোরের প্রথম ডাকা মোরগগুলোকে রাতব্যাপী পয়সার ঢিবি বারবার ভেঙে ও গড়ে, এক ঢিবি থেকে কিছু কমিয়ে সেগুলো অন্য ঢিবিতে রেখে, যাতে করে ফের্নান্দাকে খুশি করা যায়। আর ওই ঢিবিটা আমারান্তা উরসুলার জুতোর জন্য, অপরটা সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদের জন্য, যে নাকি বহু যুগ যাবৎ কোনো নতুন জামা চোখে দেখে নি, এটা হচ্ছে উরসুলার কফিনের জন্য, যদি সে মারা যায়, এটা হচ্ছে কফির জন্য যার দাম তিন মাস অন্তর অন্তর পাউন্ডপ্রতি এক সেন্ট করে বাড়ে, এটা চিনির জন্য, যার স্বাদ প্রতিবারই আরও কম মিষ্টি, এটা লাকড়ি কেনার জন্য, যা নাকি এখনো বৃষ্টির কারণে ভেজা, আর অন্যটা লটারির টিকিট বানানোর জন্য কালি ও কাগজের জন্য। আর বেঁচে থাকা অন্যটা হচ্ছে এপ্রিলে বাছুরটার বিজয়ীকে দেওয়ার জন্য একাংশ, যে সমস্যা থেকে তারা রক্ষা পেয়েছিল অলৌকিকভাবে, কারণ প্রায় সব কটি টিকিট বিক্রি হওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়ে বাছুরটা অ্যানথ্রাক্স রোগে। দারিদ্র্যের সেই আচার-অনুষ্ঠান এতই নিষ্পাপ ছিল যে সব সময় সবচেয়ে বড় অংশটা রেখে দেওয়া হতো ফের্নান্দার জন্য আর কখনোই সেটা তারা করত না অনুশোচনা বা করুণা থেকে, বরং করত এই কারণে যে ওদের কাছে ফের্নান্দার ভালো থাকাটা নিজেদের ভালো থাকার চাইতেও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আসলে যা ঘটেছিল, দুজনের কেউই টের পায় নি তা হচ্ছে দুজনেই চিন্তা করত ফের্নান্দার কথা, যে নাকি জন্ম দিয়েছিল সেই কন্যাসন্তানের, যে কন্যা ছিল তাদের দুজনেরই কাম্য, কিন্তু কখনোই তারা এতে সফল হয় নি; আর তাকে খুশি রাখতে তারা এমন পর্যায়ে পৌঁছাত যে একবার ফের্নান্দা যাতে ওলন্দাজ টেবিল ক্লথ কিনতে পারে, তার জন্য তারা তিন দিন ভুট্টোর ছাতুটাও খায় না। কিন্তু তারা দুজনেই যতই খাটুনি করে করে মরত, যতই বিভিন্ন চালাকি করে টাকাপয়সা জমানোর চেষ্টা করত, ততই ওদের রক্ষাকারী ফেরেশতা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ত, আর ওরা তখন বাড়াত-কমাত পয়সার ঢিবিগুলোকে, কোনো রকমে বেঁচে থাকার চেষ্টায়। নির্ঘুম রাতগুলোতে যখন তারা দেখে হিসাব মিলছে না টাকাপয়সার অপর্যাপ্ততার কারণে, তখন তারা প্রশ্ন করত, পৃথিবীতে কী এমন ঘটেছে যে জন্তু-জানোয়াররা আর আগের মতো বিয়োয় না, টাকাপয়সা কীভাবে হাতের ভেতর ভেঙেচুরে ধ্বংস হয় (হাত থেকে উধাও হওয়াকে লাতিন অঞ্চলে এভাবে বলা হয়), কেন যেসব লোকজন কিছুদিন আগেও পার্টিতে নোটের তোড়া পোড়াত, তারাই কীভাবে ছয়টি মুরগির লটারির জন্য বারো সেন্টের লটারি টিকিটকে রীতিমতো ডাকাতি বলে চিন্তা করে। মুখ খুলে না বললেও আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ভাবত, আসলে পৃথিবীটা খারাপ হয়ে যায় নি, বদলে গেছে পেত্রা কতেসের রহস্যময় হৃদয়ের কোনো এক গোপন জায়গা, যেখানে বন্যার সময় এমন কিছু ঘটেছে যে জানোয়ারগুলো বন্ধ্যা হয়ে গেছে ও টাকাপয়সা হয়েছে বিরল। এই ধারণার চক্রান্তে পড়ে সে তার মনের ভেতরে স্বার্থ খুঁজতে গিয়ে এমনভাবে খুঁড়ে দেখে যে স্বার্থের বদলে পেয়ে যায় ভালোবাসা, কারণ সে পেত্রা কতেসকে ভালোবাসতে বাধ্য করতে যায়, তার ফলে নিজেই তাকে ভালোবেসে ফেলে। এদিকে পেত্রা কতেস যতই তার নিজের প্রতি আদর বৃদ্ধি পেতে দেখে, সেই একইভাবে আরও বেশি ভালোবাসতে থাকে তাকে আর এভাবেই ভর শরতে যৌবনের সেই কুসংস্কারটা পুনরায় বিশ্বাস করে, যেটা হচ্ছে দারিদ্র্য হচ্ছে ভালোবাসার চাকর। ফলে দুজনেই খারাপ চোখে দেখত উন্মত্ত পার্টিগুলোকে, চোখধাঁধানো সম্পদকে, লাগামছাড়া মিলনকে, আর আফসোস করে নিঃসঙ্গতার স্বর্গকে খুঁজে পেত জীবনের এতখানি নিঃশেষ করে ফেলায়। বন্ধ্যাত্বের জটিলতায় এতগুলো বছর কাটিয়ে অলৌকিকভাবে মিলনকে উপভোগ করতে থাকে, যেমনটি খাবার টেবিলে, তেমনি বিছানায় আর এতে তারা এতই সুখ পায় যে দুই বুড়োবুড়ি যখন ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছে, তখনো তারা খরগোশের মতো হুটোপুটি করছে ও কামড়াকামড়ি করছে কুকুরের মতো।

লটারি কখনোই খুব বেশি কাজে লাগে না। প্রথম দিকে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো আগেকার খামারবাড়িতে কাটাত সপ্তাহে তিন দিন টিকিটের পর টিকিট রং করে; কিছুটা দক্ষতার সঙ্গেই সে আঁকত এক লাল গাভি, এক সবুজ শূকরছানা, অথবা একদল নীল মুরগি, যে জানোয়ার লটারি করা হবে সেই অনুযায়ী; আর তার সঙ্গে সুন্দর করে নকল করে ফেলত ছাপার অক্ষরে সেই নামটা, যেটাকে ব্যবসার জন্য ভালো লেগেছিল পেত্রা কতেসের ঐশ্বরিক লটারি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সপ্তাহে এমনকি দুই হাজার লটারি টিকিট বানিয়ে সে এতই ক্লান্তি অনুভব করতে থাকে যে সে জানোয়ারগুলোর নামের ও সংখ্যার জন্য রাবারের স্ট্যাম্প বানিয়ে নেয় আর ফলে কাজ বলতে বাকি থাকে শুধু সেগুলো বিভিন্ন রঙের প্যাডে ভেজানো। জীবনের শেষের বছরগুলোতে তার মাথায় আসে সংখ্যার বদলে ধাঁধার ব্যবহারের কথা, যাতে করে যারা ধাঁধার উত্তর বের করতে পারবে, তারাও যেন পুরস্কারের অংশ পায়; কিন্তু ব্যাপারটা এতই জটিল ও এতই সন্দেহজনক হয়ে ওঠে যে দ্বিতীয় চেষ্টা পরই সেটা বাতিল করে দিতে বাধ্য হয়।

লটারির মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল আউরেলিয়ানো সেগুন্দো যে বাচ্চাদের দেওয়ার জন্য খুব কমই সময় পেত সে, ফের্নান্দা আমারান্তা উরসুলাকে এক ব্যক্তিমালিকানাধীন কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করে দেয়, যেখানে ছয়জনের বেশি ছাত্রছাত্রী নেওয়া হতো না, কিন্তু আউরেলিয়ানোকে সরকারি স্কুলে পাঠাতে অমত করে সে, কারণ তার মতে ওকে ঘর থেকে বেরোতে দেওয়াটাই হয়েছে যথেষ্ট, আর সে যুগে স্কুলগুলোতে শুধু ক্যাথলিক মতে বিবাহিত বৈধ পিতামাতার সন্তানদেরই গ্রহণ করা হতো আর আউরেলিয়ানোকে নানের সঙ্গে পাঠানোর সময় জামায় সাঁটা জন্মসনদে তাকে কুড়িয়ে পাওয়া শিশু হিসেবে রেজিস্ট্রি করা ছিল। ফলে সে সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদের আদরমাখা নজরদারি ও উরসুলার মানসিক খামখেয়ালির কাছে বন্দী হয়ে থাকে, যেখানে গৃহের ছোট্ট পরিসরের পৃথিবীতে, মাতামহীরা (এ ক্ষেত্রে মাতামহী ও প্রমাতামহী) যা বলত, তাই শিখত। সে ছিল হালকা-পাতলা গোছানো স্বভাবের আর তার বড়দের অবাক করে দেওয়ার মতো কৌতূহল থাকলেও কর্নেল এই বয়সে যে জিজ্ঞাসু ও মাঝেমধ্যে দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন দৃষ্টি ছিল, সে ছিল তার সম্পূর্ণ উল্টো; সে মিটমিটিয়ে তাকাত আর তার দৃষ্টি ছিল কিছুটা বিক্ষিপ্ত। আমারান্তা উরসুলা যখন কিন্ডারগার্টেনে পড়ত, সে তখন কেঁচো শিকার করত ও বাগানে কীটপতঙ্গদের অত্যাচার করত। কিন্তু একবার উরসুলার তোশকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য এক কাঁকড়া-বিছে বাক্সে ঢোকানোর সময় ফের্নান্দা তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলে ও তাকে মেমের পুরোনো শোবার ঘরে আটকে রাখে, যেখানে সে নিঃসঙ্গতার সময়গুলোতে ব্যস্ত থাকে বারবার বিশ্বকোষের পাতাগুলো উল্টে। ওখানে এক বিকেলে উরসুলা ওকে দেখতে পায় আর যদিও ওর সঙ্গে সে অনেকবার অনেক সময় থেকেছে, তবু জিজ্ঞেস করে ওর পরিচয়।

‘আমি আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া’, বলে ও।

‘সত্যিই তাই’, উত্তর দেয়, ‘সময় হয়েছে তোর রুপোর কাজ শেখার।’

নিজের ছেলে মনে করে ভুল করে সে, কারণ অতিবৃষ্টির পরের সাময়িক যে উষ্ণ বাতাস ওর মাথায় যে স্বাভাবিক বুদ্ধির ঝলক এনেছিল, তা সামান্য আগে কেটে গিয়েছে। আর কখনোই সে স্বাভাবিক বুদ্ধি ফিরে পায় না; যখন শোবার ঘরে ঢুকত, ওখানে পেয়ে যেত পেত্রনিলা ইগুয়ারানকে অসহ্য রকমের ফোলানো ঘাঘরা আর পুঁতির কাজ করা জ্যাকেট পরা অবস্থায়, দাদি ত্রাংকিলিনা মারিয়া মিনিয়াতা আল্কোকে বুয়েন্দিয়াকে ময়ূরের পেখম দিয়ে বানানো পাখা দিয়ে শারীরিক প্রতিবন্দিদের দোল চেয়ারে বসে বাতাস নেওয়া অবস্থায়, ওখানে থাকত রাজপ্রতিনিধিদের রক্ষীদের অনুকরণে তৈরি জ্যাকেট পরিহিত তার প্রপিতামহ আউরেলিয়ানো আরকাদিও বুয়েন্দিয়া, পেয়ে যেত বাবা আউরেলিয়ানো ইগুয়ারানকে, যিনি গরুর গা থেকে কীট শুঁটকি করে ফেলে দেওয়ার প্রার্থনা আবিষ্কার করেছিলেন, আরও থাকত তার ভিতু মা ও শুয়োরের লেজসহ জ্ঞাতিভাইকে, সে পায় আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তার মৃত ছেলেদের সঙ্গে, সবাই থাকত দেয়ালে হেলান দিয়ে বসা অবস্থায়, যেন তারা বেড়াতে আসে নি, এসেছে মৃতদের শোকপালনে। দূরদূরান্তের বিভিন্ন স্থানের ও সমন্বয়বিহীন কালের আবোলতাবোল কথার বুনুনি গেঁথে চলত সে, ফলে আমারান্তা যখন স্কুল থেকে ফিরে আসত ও আউরেলিয়ানো যখন বিশ্বকোষ দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়ত, তখন তারা দেখতে পেত বিছানায় বসে আছে সে, আপন মনে কথা বলে চলছে মৃতজনের গোলক ধাঁধায় হারিয়ে গিয়ে। ‘আগুন’, আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে একবার, আর সঙ্গে সঙ্গে সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্কের বীজ, কিন্তু আসলে সে যে আস্তাবলে আগুন লাগার ঘোষণা দিচ্ছিল, তখন তার বয়স ছিল চার। সবশেষে অতীতের সঙ্গে বর্তমানকে সে এমনভাবে গুলিয়ে ফেলে যে মৃত্যুর আগে যখন দু-তিনবার ক্ষণিক সুস্থতার বিচ্ছুরণ ঘটে, তখন কেউই বলতে পারে না সত্যি সত্যিই সে নিজে যা অনুভব করছে, তাই বলছে, নাকি বলছে যা মনে করতে পারছে, তাই। ধীরে ধীরে আকারে ছোট হয়ে আসছিল সে, ভ্রূণের মতো, যেন জীবদ্দশাতেই পরিণত হচ্ছে মমিতে এমনভাবে, যেন ঢোলা গাউনের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া এক শুকনো চেরির কিশমিশ, আর সব সময় উঁচু করে রাখা হাতটা পরিণত হয়েছিল এক মারিমন্ডা (একধরনের বানরের মুখোশ) বানরের পায়ে। মাঝেমধ্যে এমনভাবে অনড় হয়ে থাকত দিন কতেকের জন্য যে গায়ে সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদকে ধাক্কা দিয়ে বুঝতে হতো সে বেঁচে আছে কি না; আর সে তাকে কোলের ওপর বসিয়ে খাওয়াত কয়েক চামচ শরবত। সদ্যোজাত এক বৃদ্ধার মতো মনে হতো তাকে। আমারান্তা উরসুলা ও আউরেলিয়ানো শোবার ঘর থেকে বের করত তাকে, আবার ঢোকাত, বেদির ওপর শোয়াত শিশু যিশুর চেয়ে বড় কি না, তা দেখতে, আর এক বিকেলে তারা ওকে লুকিয়ে রাখে এক দেয়ালকুঠরির ভেতর, যেখানে সহজেই সে ইঁদুরের খাদ্যে পরিণত হতে পারত। এক পাম রোববারে ওরা যখন শোবার ঘরে ঢোকে, তখন ফের্নান্দা ছিল গির্জার মাসে, আর ঘাড় ও গোড়ালি ধরে উঁচু করে বের করে তারা সেখান থেকে।

‘বেচারি বড় দাদি’, বলে আমারান্তা উরসুলা, ‘মারা গেল বার্ধক্যের কারণে।’

আঁতকে ওঠে উরসুলা, ‘আমি বেঁচে আছি!’, বলে।

‘দেখো দেখো’, হাসি চেপে বলে আমারান্তা উরসুলা, ‘এমনকি নিশ্বাস ও ফেলে না।’

‘আমি কথা বলছি’, চিৎকার করে উরসুলা।

‘এমনকি কথাও বলে না’, বলে আউরেলিয়ানো, ‘মারা গেল এক ছোট্ট ঝিঁঝি পোকার মতো।’

এরপর হার মেনে প্রমাণ দেওয়া ক্ষান্ত দেয় উরসুলা, ‘হায় খোদা’, কাতর হয়ে নিচু স্বরে বলে।

‘এটাই তাহলে মৃত্যু।’

তাড়াহুড়ো করে এক অন্তহীন, গভীর প্রার্থনা শুরু করে উরসুলা, যা দীর্ঘায়িত হয় দুদিনের বেশি সময় যাবৎ। আর মঙ্গলবার সমস্ত অনুনয় নেমে আসে জাগতিক পর্যায়ে, লাল পিঁপড়ে যেন বাড়ি ধসিয়ে না দেয়, রেমেদিওসের দাগেরোটাইপের সামনের বাতিটা যেন কখনোই নেভাতে না দেওয়া হয়, ঈশ্বর যাতে কোনো বুয়েন্দিয়াকেই একই রক্তের কাউকে বিয়ে করতে না দেয়, কারণ তাহলে ছেলেমেয়েরা শুয়োরের লেজ নিয়ে জন্মাবে। তার এই বিকারগ্রস্ততার সুযোগ ব্যবহার করে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো জানতে চেষ্টা করে সোনা পুঁতে রাখার জায়গাটা, কিন্তু আবার বিফল হয় তার সব অনুনয়। ‘যখন আসল মালিকের আবির্ভাব হবে’, বলে উরসুলা, ‘ঈশ্বর তাকে আলোকিত করবে, যাতে সে সেটা খুঁজে পায়।’ সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদের মনে স্থির বিশ্বাস জন্মায় যে তাকে যেকোনো সময় মৃত পাওয়া যাবে, কারণ সেই সময়ে প্রকৃতিতে এক বিশেষ ধরনের আলোড়ন লক্ষ করে, গোলাপগুলো বথুয়ার গন্ধ ছড়ায়, লাউয়ের খোল থেকে ছোলা পড়ে গিয়ে সাগরের তারা মাছের মতো নিখুঁত জ্যামিতিক আকার নেয়। এক রাতে এক সারি কমলা রঙের চাকতি চলে যেতে দেখে আকাশের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত।

পবিত্র বৃহস্পতিবার (গুড থার্সডে) সকালে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে। শেষবার, কলা কোম্পানির সময়ে যখন তাকে বয়স হিসাব করতে সাহায্য করা হয়েছিল, তখন তার বয়স হিসাব করা হয়েছিল একশত পনেরো ও একশত বাইশের মাঝামাঝি। যে ছোট্ট বাক্সে তাকে গোর দেওয়া হয়, তা ছিল আউরেলিয়ানোকে নিয়ে আসা ঝুড়ি থেকে সামান্য একটু বড় আর খুব কম লোকই যোগ দিয়েছিল তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়, আর তার একটি কারণ হচ্ছে খুব কম লোকই মনে রেখেছিল তার কথা, আর অন্য কারণ হচ্ছে দুপুরে সেদিন এত গরম পড়ে যে পাখিগুলো দিগ্‌বদিক হারিয়ে সিসার গুলির মতো আছড়ে পড়ে দেয়ালের গায়, শোবার ঘরের ভেতরে ঢুকে মারা যাওয়ার জন্য আর জানালায় লাগানো লোহার জালে ধাক্কা খেয়ে ছিঁড়ে ফেলে জালগুলো।

প্রথমে সবাই ভেবেছিল এটা এক মড়ক। গৃহবধূরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে মরা পাখি ঝাড় দিতে দিতে, বিশেষ করে সিয়েস্তার সময়, আর পুরুষেরা ওগুলো নদীতে ফেলত ঠেলাগাড়ি ভরে। পুনরুত্থানের রোববারে (ইস্টার সানডে) শতবর্ষীয়ান ফাদার অ্যান্তনিও ইসাবেল বেদিতে দাঁড়িয়ে সবাইকে নিশ্চিত করে বলে যে এক ভ্রাম্যমাণ ইহুদির খারাপ প্রভাবের কারণ হচ্ছে এই পাখির মড়ক ও আগ রাতে সে নিজেই তাকে দেখেছে। তাকে বর্ণনা করে পাঁঠা ও এক নারী ধর্মদ্বেষীর সংকর হিসেবে, এক নারকীয় জানোয়ারের মতো যার নিশ্বাস পুড়িয়ে ফেলে বাতাস ও যার সঙ্গে দেখা হলে নববিবাহিতরা গর্ভে দানব ধারণ করে। যারা তার এই রহস্যোদ্ঘাটনমূলক পৃথিবীর ধ্বংসের সময়ের কথাবার্তায় কান দেয়, তার সংখ্যা খুব বেশি ছিল না, কারণ প্রায় তারা নিশ্চিত ছিল যে বয়সজনিত কারণে ফাদার প্রলাপ বকছে। কিন্তু এক মহিলা বুধবার ভোরবেলায় সবাইকে ডেকে তোলে সে দ্বিধাবিভক্ত খুরওলা এক জন্তুর পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছে বলে। ছাপগুলো এতই বাস্তব ও নির্ভুল ছিল যে যারা দেখতে গিয়েছিল, তাদের কোনো সন্দেহ থাকে না পাদরি বর্ণিত সেই ভয়ংকর জন্তুর অস্তিত্বে, আর তারা একজোট হয় জন্তুটাকে ধরার জন্য উঠানে ফাঁদ পাততে। আর এভাবেই ওটাকে ধরা সম্ভব হয়। উরসুলা গত হওয়ার দুসপ্তাহ পর আশপাশ থেকে আসা এক অসাধারণ বাছুরের কান্নার শব্দে ঘুম থেকে চমকে জেগে ওঠে পেত্রা কতেস ও আউরেলিয়ানো সেগুন্দো। জেগে ওঠে দেখতে পায় একদল লোক শুকনো পাতা দিয়ে ঢাকা গর্তের মধ্যে চোখা ধারালো শিক লাগানো ফাঁদের মধ্যে পড়া জন্তুটিকে শিক থেকে ছাড়াচ্ছে, যেটা ততক্ষণে চিৎকারে ক্ষান্ত দিয়েছে। উচ্চতায় এক বাছুরের চেয়ে বেশি না হলেও ওটার ওজন ছিল এক বলদের মতো, যেটার ক্ষত থেকে বেরোচ্ছিল সবুজ তেলতেলে রক্ত। খসখসে লোমে ঢাকা ছিল ওটার গা আর ছিল অসংখ্য এঁটেল পোকায় ভর্তি ও চামড়া ছিল চোষক মাছের চামড়ার মতো শক্ত, যদিও ফাদারের বর্ণনার ঠিক উল্টো, ওটার মানুষের মানবিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর মিল বরং মানুষের চেয়েও বেশি মিল ছিল শীর্ণ দেবদূতের সঙ্গে, কারণ হাতগুলো ছিল উজ্জ্বল ও ক্ষিপ্র, চোখ ছিল বড় বড় ও ম্লান আর পিঠে ছিল শক্ত দুটো ডানা কেটে ফেলার শুকনো ক্ষতচিহ্ন, যেগুলোকে নিশ্চিতভাবেই কেটে ফেলা হয়েছে চাষির কুঠার দিয়ে। প্লাজার এক আলমন্ড গাছে গোড়ালি বেঁধে ঝোলানো হয় ওটাকে, যাতে এমন কোনো লোক না থাকে, যে ওটাকে দেখতে পায় নি। আর যখন পচতে শুরু করে, তখন ওটাকে পোড়ানো হয় বিশাল আগুন জ্বালিয়ে, কারণ তারা স্থির করতে পারছিল না, কারণ ওটার জারজ স্বভাবটা জন্তুর মতো ছিল কি না, যাতে নদীতে ফেলে দেওয়া যায় বা মানুষের মতো ছিল কি না, যাতে খ্রিষ্টানের মতো সমাধি দেওয়া যায়। কখনোই নিশ্চিত করা যায় নি সত্যি সত্যি ওটার কারণেই পাখিগুলো মরেছিল কি না, কিন্তু সদ্য বিবাহিতারা ঘোষণাকৃত দানবসন্তানের জন্ম দেয় না বা গরমের তীব্রতাও কমে না।

রেবেকা মারা যায় ওই বছরের শেষের দিকে। তার আজীবনের চাকরানি আরহেনিদা কর্তৃপক্ষের কাছে সাহায্য চায় শোবার ঘরের দরজা ভাঙার, যেখানে তিন দিন ঘরবন্দী হয়ে আছে তার মালকিন আর তাকে পাওয়া যায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় বিছানায়, চিংড়ি মাছের মতো শরীর কুঁকড়ে আছে, দাদের কারণে মাথা ন্যাড়া আর বুড়ো আঙুলটা মুখে পোরা। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ভার নেয় শেষকৃত্যের আর চেষ্টা করে বিক্রির জন্য বাড়িটা মেরামত করার, কিন্তু অবক্ষয় এমনভাবে সেটার মজ্জায় ঢুকে গিয়েছে যে নতুন করে রং করার সঙ্গে সঙ্গে চলটা উঠে যাচ্ছিল, আর তেমন মোটা করে চুন-সুড়কিও লাগানো যাচ্ছিল না, যাতে করে আগাছার ফলে মেঝেতে ফাটল ধরা রোধ করা যায় বা খুঁটিতে পচন ধরানো থেকে বিরত করা যায় আইভি লতাগুলোকে।

মহাপ্লাবনের সময় থেকে এভাবেই চলছিল সব। লোকজনের আলসেমি হার মানায় বিস্মৃতির গোগ্রাসকেও, যা নাকি ধীরে ধীরে দয়াহীনভাবে খেয়ে ফেলছিল স্মৃতিগুলোকে, আর এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল সেই সময়ে নিরলান্দিয়ার চুক্তির এক নতুন বার্ষিকীতে মাকন্দে আসে প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টের কয়েকজন দূত কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার বহুবার ফিরিয়ে দেওয়া পদকটা পৌঁছে দেওয়ার জন্য, আর তাদের সারা বিকেল লেগে যায় কর্নেলের একজন উত্তরসূরির সন্ধান পেতে। পদকটা নিরেট সোনায় তৈরি ভেবে আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর নেওয়ার ইচ্ছা হয় কিন্তু পেত্রা কতেস তাকে বুঝিয়ে নিবৃত্ত করে অমর্যাদাকর কাজটা থেকে, যখন দূতেরা অনুষ্ঠানের জন্য সমস্ত ঘোষণা ও বক্তৃতা প্রস্তুত করছে। ওই সময়ই আবার ফিরে আসে মেলকিয়াদেসের বিজ্ঞানের উত্তরসূরি জিপসিরা আর গ্রামটাকে পায় এমন এক পর্যুদস্ত অবস্থায়, অবশিষ্ট দুনিয়া থেকে এমন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় যে তারা আবার বাড়ি বাড়ি ঢুকে পড়ে চুম্বকে পরিণত করা লোহা টেনে টেনে, যেন সেটা সত্যিই সত্যিই ব্যাবিলনিয়ার জ্ঞানী ব্যক্তিদের সর্বশেষ আবিষ্কার আর বিশাল আতশ কাচ দিয়ে সূর্যরশ্মি আবার তারা কেন্দ্রীভূত করে আর মুখ হাঁ করে চুম্বকের টানে বাসনকোসন ও হাঁড়িপাতিল গড়াগড়ি খেতে দেখার লোকের অভাব হয় না, আর এক সেন্ট দিয়ে জিপসি রমণীর নকল দাঁত খোলার ও পুনরায় লাগানোর খেলা লোকেরও কমতি ঘটে না। এক ভাঙাচোরা হলুদ ট্রেন ছিল, যেটা কাউকে নিয়ে আসত না অথবা নিয়ে যেত না, আর যে ট্রেনটা টেনে নিয়ে যেত মি. ব্রাউনের কাচের ছাদ ও যাজকীয় আরামকেদারাওলা কোচ, যেটা টানত ফলভর্তি এক শ বিশটা ওয়াগন আর পার করত সারা বিকেল গ্রাম পেরোতে, শুধু সেই ট্রেনেই অবশিষ্ট বলতে ছিল এটি। পাখিদের অদ্ভুত মৃত্যু ও ভ্রাম্যমাণ ইহুদির বলির ব্যাপারে তদন্ত করতে রোম থেকে পাঠানো গির্জার প্রতিনিধিদল পাদরি অ্যান্তনিও ইসাবেলকে পায় বাচ্চাদের সঙ্গে কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলারত অবস্থায়, আর খবরটাকে তারা গণ্য করে বার্ধক্যজনিত মতিবিভ্রম বলে আর তাকে পাঠিয়ে দেয় এক আশ্রমে। কিছুদিন পর পাঠায় নবপ্রজন্মের ধর্মযোদ্ধা ফাদার আগুস্তো আনহেলকে যে ছিল আপসহীন উদ্ধত ও সাহসী, যে লোকজনের উদ্দীপনা ঝিমিয়ে যাওয়া রোধ করতে দিনের মধ্যে কয়েকবার নিজেই ঘণ্টা বাজায়, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘুমন্ত লোকদের জাগিয়ে তোলে মাসে যাওয়ার জন্য। কিন্তু এক বছর পার হওয়ার আগেই পরাজিত হয় বাতাসে ভেসে থাকা অবহেলাকে নিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে, যে ধুলো সবকিছুকে করে বৃদ্ধ, আটকে দেয় সব গতি সেই ধুলোর কাছে, আর হেরে যায় দুপুরে খাবার সময় ঢুলুনি নিয়ে আসা মাংসের কাবারের কাছে সিয়েস্তার সময়ের অসহ্য গরমে।

উরসুলার মৃত্যুর পর আবার অবহেলার কবলে পড়ে বাড়িটা আর তা থেকে রক্ষা করতে পারে না, এমনকি যে নাকি অনেক বছর পর সংস্কারমুক্ত সুখী, আধুনিক মেয়েতে পরিণত হয়, সেই আমারান্তা উরসুলার স্থির সংকল্প ও দৃঢ়তা। নিজের পায়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে খুলে দেয় দরজা-জানালাগুলো। সব হারানো থেকে রক্ষা পেতে বাগানটাকে ফিরিয়ে আনে আগের অবস্থায়, নিধন করে প্রকাশ্য দিনের বেলায় বারান্দায় হেঁটে চলা লাল পিঁপড়েগুলোকে, আর ব্যর্থ প্রয়াস চালায় বিস্মৃত আতিথেয়তার উদ্যমকে জাগ্রত করার। ফের্নান্দার সবকিছু বন্ধ করে রাখার দৃঢ়তা তৈরি করে এক দুর্ভেদ্য বাঁধ, উরসুলার শত বছরের উদ্দামের বিরুদ্ধে। লু হাওয়া বয়ে যাওয়ার সময় শুধু যে দরজা খুলতে অস্বীকার করে, তা-ই নয়, জীবন্ত বাপ-মায়ের রীতি মেনে জীবন্ত সমাধিস্থ হওয়ার জন্য জানালাগুলোকে কাঠ ও পেরেক দিয়ে তেরছা-তেরছিভাবে আটকে দেয়। অদৃশ্য চিকিৎসকদের সঙ্গে পত্র যোগাযোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। হরেকবার মুলতবি রাখার পর পূর্বনির্ধারিত এক বিচূর্ণ ও সময়ে সে নিজেই শোবার ঘরে দরজা বন্ধ করে দিয়ে উত্তর দিকে মাথা দিয়ে শুধু একটি সাদা চাদর দিয়ে নিজেকে ঢাকে আর ভোর একটার সময়ে অনুভব করে মুখের ওপর এক বরফঠান্ডা রুমাল। যখন জেগে ওঠে, তখন জানালায় উজ্জ্বল সূর্য ঝলমল করছে আর অনুভব করে দুই পায়ের মাঝখান থেকে আরম্ভ হয়ে বুকের মাঝখান পর্যন্ত এক ধনুক আকৃতির জঘন্য রকমের সেলাই। কিন্তু পূর্বনির্ধারিত বিশ্রামের সময় শেষ হওয়ার আগেই অদৃশ্য চিকিৎসকদের কাছ থেকে এক উদ্বেগপূর্ণ চিঠি আসে, যেখানে তারা ছয় ঘণ্টা যাবৎ তাকে পরীক্ষা করেও বহুবার পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করা উপসর্গগুলোর একটিও না পাওয়ার কথা লিখেছে। সত্যিকার অর্থে, একটি জিনিসকে ওটার সঠিক নামে না ডাকার বদভ্যাসের কারণ সৃষ্টি করে নতুন এক বিভ্রান্তি আর টেলিপ্যাথিক চিকিৎসকেরা একমাত্র যা খুঁজে পায় তা হচ্ছে সামান্য একটু দেবে যাওয়া জরায়ু, যা নাকি শুধু এক পট্টি বাঁধলেই ঠিক হয়ে যেত। হতাশাগ্রস্ত ফেনান্দা চেষ্টা করে আরও নিখুঁত তথ্য পাওয়ার কিন্তু চিকিৎসকেরা তার চিঠির আর কোনো জবাব দেয় না। সে এমন বিপর্যস্ত বোধ করে যে ঠিক করে সমস্ত লজ্জাশরম ঝেড়ে ফেলে পট্টি শব্দটার অর্থ জিজ্ঞেস করার আর শুধু তখনই জানতে পারে যে তিন মাস আগে ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছে ফরাসি ডাক্তার আর সারা গ্রামের মতের বিরুদ্ধে তাকে কবর দেয় কর্নের আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার এক যুদ্ধসঙ্গী। ফলে সে পুত্র হোসে আর্কাদিওর দ্বারস্থ হয়, আর সে রোম থেকে পট্টি কিনে পাঠিয়ে দেয় সেটার ব্যবহারবিধিসহ আর ফের্নান্দা মুখস্থ করে ধ্বংস করে ফেলে কাগজটা, কারণ যাতে কেউ তার সমস্যার কথা জানতে না পারে। কিন্তু সেটা ছিল এক অহেতুক সতর্কতা, কারণ তখন বাড়িতে যারা বাস করত, তারা ওর দিকে প্রায় নজরই দিত না। সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ তখন এক নিঃসঙ্গ বার্ধক্য নিয়ে ঘুরে বেড়াত, রান্না করত শুধু যা খেত, তা-ই আর সম্পূর্ণভাবে নিজেকে ঢেলে দিয়েছিল হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোর যত্ন-আত্তির পেছনে।

উত্তরাধিকারসূত্রে রেমেদিওস থেকে কিছুটা মনোহারিত্ব পাওয়া আমারান্তা উরসুলা আগে যে সময়টা উরসুলাকে অতিষ্ঠ করে ব্যয় করত, তা এখন স্কুল থেকে দেওয়া বাড়ির কাজে লাগায় আর তার চমৎকার বিচারবুদ্ধি ও লেখাপড়ার একনিষ্ঠতা মেমের জন্য যে আশার আলো জ্বেলে ছিল, সেই একই আলো জ্বালায় আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর মধ্যে। কলা কোম্পানির সময়কার হালফ্যাশন অনুযায়ী সে মেয়েকে লেখাপড়া শেষ করতে ব্রাসেলসে পাঠানোর কথা দিয়ে ছিল আর সেই একই মোহের কবলে পড়েই সে পুনর্জীবিত করার চেষ্টা করে মহাপ্লাবনে ধ্বংস হয়ে যাওয়া জমিগুলো। খুব কম সময়েই তাকে বাড়িতে দেখা যেত আর সে-ও আমারান্তা উরসুলার জন্য, কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফের্নান্দার কাছে সে পরিণত হয়েছে এক অচেনা লোকে আর ছোট্ট আউরেলিয়ানো যতই বয়ঃসন্ধির দিকে এগোচ্ছে, ততই গুটিয়ে যাচ্ছে নিজের মধ্যে। আউরেলিয়ানোর বিশ্বাস ছিল যে বার্ধক্য ফের্নান্দার মনকে করবে নরম, যাতে করে বাচ্চাটা এমন এক গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে জড়িত হবে, যেখানে নিশ্চিতভাবেই কেউ ছেলেটার জন্মপরিচয় নিয়ে অনুমানভিত্তিক কোনো সন্দেহ করার কষ্ট করবে না। কিন্তু মনে হচ্ছে আউরেলিয়ানো নিজেই পছন্দ করে ঘরে বন্দিত্ব ও নিঃসঙ্গতা আর বাইরের পৃথিবীটা জানার আগ্রহ তার বিন্দুমাত্র ছিল না, যেটার শুরু বাড়ির সদর দরজা থেকে। উরসুলা যখন মেলকিয়াদেসের ঘরটা খুলতে বাধ্য করে, তখন সে ওটার আশপাশে ঘুরঘুর করত ও কৌতূহলবশত আধখোলা দরজা দিয়ে উঁকি দিত। আর কেউই জানত না কেমন করে সে এক হয়ে গিয়েছিল হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোর সঙ্গে পারস্পরিক ভালোবাসার টানে। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো এটাকে আবিষ্কার করে আরম্ভ হওয়ার অনেক পরে, যখন স্টেশনের হত্যাযজ্ঞের কথা বলতে শোনে বাচ্চাটার মুখে। ঘটেছিল, যখন কেউ একজন প্রায় খালি খাবার টেবিলে কলা কোম্পানি মাকন্দ ত্যাগ করার পর গ্রামটার এই ডুবন্ত অবস্থা ঘটেছে এই বলে অনুযোগ করে, তখনই আউরেলিয়ানো এক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দক্ষতা নিয়ে প্রতিবাদ করে। সে সাধারণ মানুষের ঠিক উল্টো মত প্রকাশ করে। সেটা হলো মাকন্দ ছিল এক সমৃদ্ধ গ্রাম, যেটা সঠিক পথেই চলছিল যত দিন পর্যন্ত না কলা কোম্পানি এসে সব তছনছ করেছিল, করেছিল নীতিভ্রষ্ট, নিংড়ে চুপসে ফেলার পর প্রকৌশলীরা শ্রমিকদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি এড়াতে মহাপ্লাবনকে প্ররোচিত করেছিল। সে এমন দৃঢ়তার সঙ্গে কথা বলে যে ফের্নান্দার কাছে মনে হয় জ্ঞানী লোকদের মধ্যে যিশু যেমন ছিলেন, ঠিক তার উল্টো, ব্যঙ্গাত্মক সংস্করণ, আর বাচ্চাটা বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে সমস্ত খুঁটিনাটিসহ বর্ণনা করে কীভাবে সৈন্যরা ঘিরে রাখা তিন হাজারের বেশি শ্রমিককে মেশিনগান দিয়ে হত্যা করে, আর কীভাবে লাশগুলোকে দুই শ ওয়াগনের এক ট্রেনে তোলে আর ছুড়ে ফেলে সাগরে। যেহেতু অন্য সব সাধারণ মানুষের মতোই ফের্নান্দাও কিছুই ঘটে নি-কর্তৃপক্ষের এই ভাষ্যে বিশ্বাসী ছিল, সেহেতু সে শিহরিত হয় এই ভেবে যে ছেলেটা উত্তরাধিকারসূত্রে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার নৈরাজ্যবাদী প্রবৃত্তি পেয়ে গেছে আর চুপ করতে আদেশ করে। অন্যদিকে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো যমজ ভাইয়ের বলা কথা চিনতে পারে এই বর্ণনায়। সত্যিকার অর্থে সারা বিশ্ব পাগল ঠাওরালেও সেই সময় হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোই ছিল বাড়িতে বসবাসকারীদের মধ্যে সবচেয়ে সুস্থ ব্যক্তি। সে আউরেলিয়ানোকে পড়তে ও লিখতে শেখায় আর আরম্ভ করে পার্চমেন্টের পাঠোদ্ধারের, আর ওর মধ্যে বপন করে মাকন্দে কলা কোম্পানি কী অর্থ বহন করেছে, সে সম্পর্কে এমন এক ব্যক্তিগত মতামত, যে বহু বছর পর আউরেলিয়ানো যখন পৃথিবীর অংশ হবে, সবার মনে হবে অলীক এক ভাষ্য দিচ্ছে সে, কারণ সেটা পবিত্রভাবে স্কুলের বইয়ে লেখা ঐতিহাসিকদের ভাষ্য থেকে উল্টো, মূলগতভাবে মিথ্যে। বিচ্ছিন্ন সেই ছোট্ট ঘরটিতে, যেখানে গরম বাতাস কখনোই পৌঁছায়নি, ঢোকে নি এমনকি কোনো ধুলো বা তাপ, দুজনেই সেখানে স্মরণ করতে জানালার দিকে পিঠ দিয়ে বসে কাকের ডানার মতো হ্যাট মাথায় এক বৃদ্ধের কথা, যে দুনিয়ার কথা বলত ওদের জন্মেরও বহু বছর আগে থেকে। দুজনেই একই সঙ্গে আবিষ্কার করে যে তখন সব সময়ই ছিল মার্চ মাস, বার ছিল সোমবার আর ফলে বুঝতে পারে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ততটা পাগল ছিল না, যেমন পরিবারের সবাই বলত, বরং সেই ছিল যথেষ্ট সুস্থ একমাত্র মানুষ যে নাকি বুঝতে পারত যে সত্যিকার অর্থেই সময়ও হোঁচট খায় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে, যার ফলে টুকরো টুকরো হয়ে এক ভগ্নাংশ রেখে যেতে পারে ছোট এক ঘরের মধ্যে অনন্তকালের জন্য। তখন হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো পার্চমেন্টগুলোর সুপ্ত লেখাগুলোর শ্রেণিবিন্যাস করতে সক্ষম হয়েছিল। সে নিশ্চিত ছিল যে ওগুলো সাতচল্লিশ থেকে তিপ্পান্ন, যেগুলো বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে মনে হয় ছোট মাকড় ও আঠালিপোকার মতো, যেগুলো ছিল একটি আড়ের ওপর শুকোতে দেওয়া কাপড়ের মতো মেলকিয়াদেসের লেখা প্রাথমিক আঁকিবুকি। আউরেলিয়ানোর মনে পড়ে যায় একই রকমের ছক ইংরেজি বিশ্বকোষে দেখার কথা আর বিশ্বকোষটি নিয়ে যায় ঘরে, হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোর কাছে একসঙ্গে দুজনে তুলনা করার জন্য। সত্যি সত্যি দুটো ছিল একই রকম।

হেঁয়ালির লটারির সময়টাতে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ঘুম থেকে জেগে উঠত গলায় এক গিট্টুর অনুভূতি নিয়ে, যেন কান্নার একটা ইচ্ছা চেপে রাখছে সে। পেত্রা কতেস সেটাকে ধরে নেয় খারাপ অবস্থায় ঘটে যাওয়া অসংখ্য অঘটনেরই আরেকটি আর এক বছরের বেশি সময় ধরে প্রতি সকালে তার টাকরায় কিউ-টিপ দিয়ে মধু ছুইয়ে মুলার সিরাপ খাওয়ায়। যখন গলার গিট্টুটা এতই প্রকট হয়ে পড়ে যে শ্বাস নেওয়াই কষ্টকর হয়ে পড়ে, তখন আউরেলিয়ানো সেগুন্দো যায় পিলার তেরনেরার কাছে যদিবা সে কোনো লতাগুল্মের সন্ধান জানে এটা সারানোর জন্য, এই আশায়। দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী পিতামহী যে শত বছরে পা দিয়েছে এক গুপ্ত বেশ্যালয় চালিয়ে, সে ভেষজ কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না, বরং সে তাসের সঙ্গে পরামর্শ করে। দেখতে পায় সোনার ঘোড়ার গলা ইস্কাপনের গোলামের তলোয়ারের আঘাতে ক্ষত আর বুঝে নেয় যে ফের্নান্দা স্বামীকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার জন্য আউরেলিয়ানোর ছবিতে পিন ফোটানোর কুখ্যাত পদ্ধতি ব্যবহার করেছে, কিন্তু আনাড়ি হাতে পদ্ধতিটা ব্যবহারের কারণে গলার ভেতরে এক টিউমার গজিয়ে গেছে। যেহেতু আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর বিয়ের ছবি ছাড়া অন্য কোনো ছবি ছিল না, আর যেহেতু তার সব কটি কপি পারিবারিক অ্যালবামে অক্ষত অবস্থায় ছিল, সেহেতু স্ত্রীর চোখ এড়িয়ে ছবির খোঁজে তল্লাশি চালায় সারা বাড়ির আর শেষমেশ ওয়ার্ডরোবের তলায় পেয়ে যায় আসল বাক্সসহ আধডজন পট্টি। লাল রঙের ছোট্ট ছোট্ট রিংগুলোকে জাদুটোনার সরঞ্জাম মনে করে সেগুলোকে এক থলেতে ভরে পরখ করানোর জন্য পিলার তেরনেরার কাছে নিয়ে যায়। সে বুঝতে পারে না ওগুলোর ব্যবহার কিন্তু সন্দেহ হওয়াতে অর্ধেক ডজনই ওখানে এক আগুনের কুণ্ড জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। ফের্নান্দার জাদুকে অকেজো করতে আউরেলিয়ানো সেগুন্দোকে নির্দেশ দেয় ওমে বসা এক মুরগি ধরে পানিতে ভিজিয়ে চেস্টনাট গাছের নিচে জ্যান্ত পুঁতে ফেলতে আর সে কাজটা এতই বিশ্বাসের সঙ্গে করে যে সরানো মাটির চিহ্ন মুছে ফেলতে শুকনো পাতা দিয়ে জায়গাটা ঢেকে ফেলার পরই তার মনে হয় যেন আগের চেয়ে একটু ভালোভাবে নিশ্বাস নিতে পারছে। আর অন্যদিকে পট্টিগুলোর অন্তর্ধানের ব্যাপারটাকে অদৃশ্য চিকিৎসকদের প্রতিশোধ হিসেবে ধরে নিয়ে আলখাল্লার ভেতরের দিকের হেমের সঙ্গে সেলাই করে ছোট্ট এক থলে বানিয়ে পুনরায় ছেলের কাছ থেকে পাঠানো পট্টিগুলো রেখে দেয়।

মুরগি পোঁতার ছয় মাস পর আউরেলিয়ানো সেগুন্দো এক মধ্যরাতে জেগে ওঠে অতিরিক্ত কাশ নিয়ে আর সে বোধ করছিল যেন এক কাঁকড়ার দাড়া ভেতর থেকে গলা টিপে ধরছে। আর শুধু তখনই বুঝতে পারে, যত জাদুর পট্টি ধ্বংস করা হোক বা যত মুরগিই ভেজানো হোক না কেন, একমাত্র দুঃখজনক সত্যি হচ্ছে, সে মারা যাচ্ছে। কাউকে কিছু বলে না সে। আমারান্তা উরসুলাকে ব্রাসেলসে পাঠানোর আগেই মারা যাওয়ার ভয়ে অস্থির হয়ে কাজ করে, যেমনটি সে কখনোই করে নি, আর একটার বদলে প্রতি সপ্তাহে তিনটে লটারি শেষ করে। খুব সকাল থেকেই তাকে দেখা যেত গ্রামময় দৌড়াদৌড়ি করতে, এমনকি যেত সবচেয়ে গরিব দূরবর্তী গ্রামগুলোতেও। এমন উদ্বিগ্নতার সঙ্গে টিকিট বিক্রি করতে, যা শুধু এক মুমূর্ষু লোকের ক্ষেত্রেই চিন্তা করা যায়। ‘এসে গেছে স্বর্গীয় বিধানের লটারি’, চিৎকার করত, ‘এটাকে হাতছাড়া কোরো না, কারণ এগুলো আসে শুধু এক শ বছরে একবার।’ নিজেকে হাসি-খুশি, সহানুভূতিশীল, বাকপটু হিসেবে জাহির করার প্রচণ্ড চেষ্টা করলেও শুধু মলিন মুখ ও ঘর্মাক্ত কলেবরই বোঝার জন্য যথেষ্ট ছিল যে এই জীবনটাকে আর সে বইতে পারছে না। মাঝেমধ্যে ফাঁকা জমিতে চলে যেত সে সবার নজর এড়িয়ে আর একটু অবসর নেওয়ার জন্য বসে পড়ত, যে দাড়াগুলো তার ভেতরটাকে ছিঁড়ে ফেলছে, সেগুলো থেকে এক মুহূর্তের জন্য রেহাই পেতে। এমনকি মাঝরাতেও চলে যেত নিষিদ্ধপলি-তে, গ্রামোফোনের পাশে বসে কাঁদতে থাকা রমণীদের ভালো ভাগ্য দিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। ‘এই নম্বরটা চার মাস হলো বের হয় নি’, বলত লটারির টিকিটগুলো দেখিয়ে, ‘এটাকে হাতছাড়া করিসনে, জীবনটা যতটা ভাবিস, তার থেকেও ছোট।’ শেষ পর্যন্ত লোকজন ওর ওপর শ্রদ্ধা হারায়, ব্যঙ্গ করে ওকে নিয়ে, এমনকি ওর মুখের ওপর বলতে আরম্ভ করে জনাব ঐশ্বরিক বিধান। ওর গলার স্বর ভরে যেতে থাকে ভুল সুরে ধীরে ধীরে বেসুরো হতে হতে হয়ে দাঁড়ায় কুকুরের গলার গড়গড়ের। কিন্তু তার পরও যাতে করে পেত্রা কতেসের উঠোনে পুরস্কার পাওয়ার কারণে যে আশার আলো তৈরি হতো, তাতে যেন কমতি না থাকে, তার জন্য উদ্যমের কোনো অভাব তার ভেতর দেখা দেয় না। অবশ্য ক্রমশই তার গলার স্বর নষ্ট হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে বুঝতে পারে যে স্বল্প সময়ের মধ্যেই ব্যথাটা আর সহ্য করতে পারবে না, আর বুঝতে পারছিল যে নিলাম করা শুয়োর ও ছাগলগুলো মেয়েকে ব্রাসেলসে পাঠাতে পারবে না আর ফলে তার মাথায় আসে মহাপ্লাবনে ধ্বংস হয়ে যাওয়া জমিগুলো লটারির মতো অসাধারণ বুদ্ধি, যেগুলো কেউ কিছু টাকা বিনিয়োগ করে সহজেই আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারবে। বুদ্ধিটা এমনই চমৎকার ছিল যে স্বয়ং মেয়র এক ঘোষণার মাধ্যমে ব্যাপারটা জানিয়ে দেয় আর টিকিট কেনার জন্য বিভিন্ন দল তৈরি হয় এক শ পেসোর একেকটি টিকিট কেনার জন্য আর এক সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে সব টিকিট ফুরিয়ে যায়। লটারির দিনটাতে বিজয়ীরা এক অতুলনীয় উৎসবের আয়োজন করে, যেটাকে তুলনা করা চলে শুধু কলা কোম্পানির ভালো দিনগুলোর উৎসবের সঙ্গে, আর শেষবারের মতো আউরেলিয়ানো সেগুন্দো অ্যাকর্ডিয়ানে বাজায় ভুলে যাওয়া ফ্রান্সিস এল অমব্রের গানগুলো, কিন্তু বাজনার সঙ্গে সে গাইতে পারে না।

দুই মাস পর আমারান্ত উরসুলা ব্রাসেলস যায়। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো যে শুধু এই অসাধারণ লটারির টাকা তাকে দেয় তা-ই নয়, বরং আগের মাসগুলোতে যা জমাতে পেরেছিল, তা-ও; আর তার সঙ্গে পিয়ানোলা, ক্লাভিকর্ড ও ব্যবহারের অযোগ্য অন্য জিনিসপত্র বিক্রি করে সামান্য যা কিছু পেয়েছিল, তা-ও। ওর হিসাব অনুযায়ী এই টাকা দিয়ে লেখাপড়ার সমস্ত খরচ কুলিয়ে যাবে আর শুধু বাড়ি ফেরার টিকিটের খরচটা বাকি থাকবে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই যাত্রার বিপক্ষে ছিল ফের্নান্দা, ব্রাসেলসে অবস্থিতি হচ্ছে প্যারিসের ভয়ংকর নিয়তির খুব কাছে এই চিন্তা করে। কিন্তু ফাদার আনহেল যুবতী ক্যাথলিক রমণীদের কাছে এক চিঠি পাঠালে সে শান্ত হয়, যারা ধর্মীয় সংগঠন চালাত আর আমারান্তা উরসুলা প্রতিজ্ঞা করে পড়াশোনা শেষ করা পর্যন্ত সেখানে বাস করার। শুধু তা-ই নয়, সেখানকার পাদরি, তলেদো যাত্রী কজন ফ্রান্সিসকান সন্ন্যাসিনীর তত্ত্বাবধানে তার যাত্রার ব্যবস্থা করে দেয়, আর তারা আশা করছিল বেলজিয়াম পর্যন্ত সঙ্গ দেওয়ার জন্য নির্ভরযোগ্য কাউকে পাওয়ার। এই সব সমন্বয়ের জন্য পত্র যোগাযোগের সময়টাতে পেত্রা কতেসের সাহায্য নেয় আউরেলিয়ানো সেগুন্দো আর ভার নেয় আমারান্তা উরসুলার তোরঙ্গ গোছানোর। যে রাতে তারা ফের্নান্দার বিয়ের এক তোরঙ্গ গোছায়, জিনিসপত্রগুলো তারা এমনভাবে রাখে যে স্কুলছাত্রীটি স্মৃতির থেকেই জানত আটলান্টিক পাড়ি দেওয়ার সময় কোন স্যুট ও কোন কর্ডের চপ্পল পরবে, আর জাহাজ থেকে নামার সময় তামার বোতামের কোন কোট পরে পায়ে দেবে কোন করডোভার জুতো। সে আরও জানত যাতে পড়ে না যায়, তার জন্য কী করে হাঁটতে হবে প্ল্যাটফর্মের কিনার দিয়ে ওপরে ওঠার সময় বা কখনো সন্ন্যাসিনীদের সঙ্গ ত্যাগ করা যাবে না বা খাবার জন্যও কেবিন থেকে বের হওয়া যাবে না বা কোনো অবস্থাতেই স্ত্রী হোক বা পুরুষ হোক, ভর সমুদ্রে কোনো অপরিচিত লোকের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে না। সমুদ্রপীড়ার জন্য নিয়েছিল ফোঁটায় ফোঁটায় পানীয় ওষুধ আর ঝড় এড়াতে নিয়েছিল ফাদার আনহেলের নিজ হাতে লেখা ছয়টি দোয়ার এক নোট। ফের্নান্দা টাকাপয়সা রাখার জন্য দেয় এক ক্যানভাসের কোমরবন্ধনী আর শিখিয়ে দেয় কী করে শরীরের সঙ্গে এক্কেবারে লাগিয়ে পরার জন্য, যাতে করে ঘুমানোর সময়ও খুলতে না হয়। ব্লিচিং পাউডার ও অ্যালকোহল দিয়ে জীবাণুমুক্ত করার পর সোনার মলত্যাগপাত্রটাও ওকে উপহার হিসেবে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু স্কুলের বন্ধুরা ওকে নিয়ে হাসাহাসি করবে বলে আমারাত্তা উরসুলা নিতে রাজি হয় না।

অল্প কয়েক মাস পর মৃত্যুশয্যায় শোয়া আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর মনে পড়বে ওকে শেষবারের জন্য যেভাবে দেখেছে, ফের্নান্দার শেষ উপদেশ শোনার জন্য দ্বিতীয় শ্রেণির ওয়াগনের কাচের জানালা নামানোর বৃথা চেষ্টা করতে। পরনে ছিল বাম কাঁধে কাঁটা দিয়ে নকল পানসি ফুলের তোড়া লাগানো এক গোলাপি সিল্কের স্যুট; খাটো হিলসহ বক্লেসওলা করডোভার জুতো, হাঁটু পর্যন্ত ইলাস্টিকের ফিতা আটা শার্টিনের মোজা। ছোটখাটো পরনের লম্বা খোলা চুলের বড় বড় জীবন্ত চোখের মেয়েটা ছিল উরসুলা, ওই বয়সে যেমনটি ছিল, তেমনি আর না হেসে যেভাবে কান্নাকাটি ছাড়া বিদায় নিয়েছিল, সেটাও উরসুলার মতো, যা নাকি সেই একই দৃঢ়তা প্রকাশ করে। মেয়েটা যখন আঙুলের ওপর ডগা দিয়ে উড়ন্ত চুমু ছুড়ে দিচ্ছে, ধীরে ধীরে গতি বাড়তে থাকা ওয়াগনের সঙ্গে ছুটতে থাকা আউরেলিয়ানো সেগুন্দো যাতে পড়ে না যায়, এর জন্য ধরেছিল ফের্নান্দার বাহু আর ওই অবস্থাতেই কোনো রকমে হাত দুলিয়ে জানিয়েছিল বিদায় সম্ভাষণ। প্রখর রোদের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল স্বামী-স্ত্রী কীভাবে ট্রেনটা দিগন্তে হারিয়ে যেতে যেতে এক কালো বিন্দুতে পরিণত হয়, তা দেখতে দেখতে আর বিয়ের পর এই প্রথমবারের মতো ছিল তারা হাত-ধরাধরি করে।

ব্রাসেলস থেকে আসা প্রথম চিঠি পাওয়ার আগে আগস্টের নয় তারিখে মেলকিয়াদেসের ঘরে বসে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো কথা বলছিল আউরেলিয়ানোর সঙ্গে আর কী বলছে, তা না বুঝেই বলে ওঠে: ‘সব সময়ই মনে রাখবি, ওরা তিন হাজারে বেশি ছিল আর সব কটি ছুড়ে ফেলা হয়েছে সাগরে।’

তারপরই সে মুখ থুবড়ে পড়ে পার্চমেন্টের ওপর, মারা যায়, চোখ দুটো খোলা রেখে। ওই সময়ে ফের্নান্দার বিছানায় শোয়া তার যমজ ভাই পৌঁছে গিয়েছে তার প্রলম্বিত সময়ের শেষ পর্যায়ে, যখন ইস্পাতের কাঁকড়ার ভয়ংকর দাড়াগুলো গলার ভেতরটা ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলছে। স্ত্রীর পাশে মৃত্যুবরণের প্রতিজ্ঞা পালন করতে এক সপ্তাহ আগে বাড়ি ফিরেছে সে, কণ্ঠ রুদ্ধ শরীরে শুধু হাড়, সঙ্গে ভ্রাম্যমাণ তোরঙ্গ ও অবহেলিত অ্যাকর্ডিয়ানটা নিয়ে আর তখন তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। পেত্রা কতেস কাপড়চোপড় গোছাতে সাহায্য করেছিল কিন্তু ভুলে গিয়েছিল কফিনে সঙ্গে দেওয়ার জন্য পাকা চামড়ার জুতোজোড়া দিতে। ফলে মৃত্যুসংবাদ শুনে কালো পোশাক পরে একটি খবরের কাগজে বুট জোড়া মুড়ে ফের্নান্দার কাছে অনুমতি চায় লাশটাকে দেখার। ফের্নান্দা দরজা পার হতে দেয় না তাকে।

‘আমার জায়গায় নিজেকে ভাবো’, অনুনয় করে পেত্রা, ‘কতটুকু ভালোবাসলে কেউ এই অপমান সহ্য করতে আসে।’ ‘এমন কোনো অপমান নেই, যা কোনো রক্ষিতার প্রাপ্য নয়’, উত্তর দেয় ফের্নান্দা, ‘কাজেই অপেক্ষা করতে থাকো অনেকের মতো তোমার অন্য এক পুরুষ মারা যাওয়ার, যাতে বুট জোড়া দিতে পারো।’

দেওয়া কথা রাখতে রান্নাঘরের ছুরি দিয়ে সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ হোসে আকাদিও সেগুন্দোর লাশের গলা কাটে, যাতে তাকে জ্যান্ত কবর না দেওয়া হয়। লাশগুলো একই রকমের কফিনের রাখা হয়, আর সেখানেই দেখা যায় মরার পর আবার তারা একই রকমের দেখতে হয়েছে যেমনটি ছিল বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত। আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর পানোৎসবের পুরোনো বন্ধুরা ওর কফিনের ওপর রাখে ফুলের এক করোনা, যাতে বেগুনি ফিতের ওপর লেখা ছিল, ‘দূর হও গরুর পাল, জীবন খুবই ছোট্ট।’ ফের্নান্দা এতে এতই অপমানিত হয় যে করোনাটাকে আবর্জনার স্তূপে ছুড়ে ফেলার জন্য আদেশ দেয়। শেষ ঘণ্টার দঙ্গলের মধ্যে মনমরা মাতালের দল কফিনগুলো বাড়ি থেকে বের করে আর গোর দেয় কফিন দুটো গুলিয়ে ফেলে, ভুল করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *