অনুবাদকের নিবেদন
কোনোদিন অনুবাদ করব এমন পরিকল্পনা আমার কখনোই ছিল না। লেখালেখি বা অনুবাদের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজে জড়িয়ে পড়ার কোনো ভাবনা আমার মাথায় আসে নি কখনো। আমি মূলত পাঠক–সবচেয়ে নিরাপদ ও ঝুঁকিহীন অভ্যাসের অনুসারী। পাঠক হওয়ার জন্য কোনো জবাবদিহিতা বা দায়িত্ববোধের বালাই নেই। কিন্তু তবুও শেষ পর্যন্ত কেন ‘পাঠক’-এর নিরাপদ উন্মুক্ত প্রান্তর থেকে ‘অনুবাদক’-এর মতো ঝুঁকিপূর্ণ খাঁচায় প্রবেশ করলাম তার কৈফিয়ত দেওয়া উচিৎ।
মার্কেসের এই উপন্যাসটি আমি প্রথমে খানিকটা পড়েছিলাম জি এইচ হাবীবের বাংলা অনুবাদে। সন্দেহ নেই যে অনুবাদটি পড়ে আমি আনন্দিত হয়েছিলাম। অনুবাদককে আমি সে কথা জানিয়েওছিলাম। কিন্তু যেহেতু স্প্যানিশভাষী একটি দেশে বহুবছর থাকার কারণে ওই ভাষায় আমার কিঞ্চিত ধারণা জন্মেছে, তাই কৌতূহলবশত বইটি মূলে পড়তে শুরু করি। পড়তে গিয়ে মনে হলো মার্কেসের কোনো কোনো বাক্যের অভিব্যক্তি এবং বাক্যরীতি ও শৈলী বাংলায় ঠিক সেভাবে আসে নি যেমনটা মূলে পাওয়া যায়। আমি জানি হাবীব অনুবাদটি মূল থেকে করেন নি, করেছেন গ্রেগরি রাবাসার ইংরেজি অনুবাদের ভিত্তিতে। হাবীবের অনুবাদটি ইংরেজির খুবই বিশ্বস্ত অনুবাদ। আমি এও জানি, রাবাসার অনুবাদটিও খুবই প্রশংসিত, এমনকি স্বয়ং মার্কেসও এর প্রশংসা করেছেন। কিন্তু তবুও, রাবাসার অনুবাদটিতে আমি তৃপ্ত হতে পারি নি সেখানকার সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার কারণে। হাবীবের সুন্দর একটি অনুবাদ থাকা সত্ত্বেও এটি মূল থেকে অনুবাদ করার ইচ্ছার পেছনে এই সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতাই হলো মূল কারণ। উৎসাহী পাঠক যদি আমার অনুবাদটি কখনো মিলিয়ে দেখার আগ্রহ বোধ করেন তাহলে দুজনের অনুবাদের পার্থক্য সহজেই তাদের চোখে পড়বে। আমি চেষ্টা করছি মূলের স্বাদ ও বাচনিক শৈলী অক্ষুণ্ণ রেখে যতটা মূলানুগ থাকা যায়। মার্কেস যাঁরা মূলে পড়েছেন, এমনকি ইংরেজিতেও যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা স্বীকার করবেন, গদ্য হলেও তা কখনো কখনো কবিতার ইঙ্গিতময়তা, চেতন ও অবচেতন স্তরের মিশ্র অভিব্যক্তির প্রচ্ছন্ন ব্যঞ্জনার কারণে প্রায়শই ভাষিক অবগুণ্ঠনে অপরূপ, কিন্তু অনুবাদকের জন্য তা ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। পড়তে তা উপভোগ্য মনে হলেও, অনুবাকদের জন্য তা ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যাই হোক, ভোগান্তি হলেও তা মর্ষকামীর মতোই উপভোগ্য ছিল বলেই তা শেষ করা গেল।
জানি না শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে। পাঠকই হচ্ছেন চূড়ান্ত বিচারক। আমার এই চেষ্টা যদি পাঠকদের ভালো লাগে তাহলে নিজেকে পুরস্কৃত মনে করব।
সবশেষে কৃতজ্ঞতার পালা। অনুবাদটি বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম-এর আর্টস বিভাগে শ্রদ্ধেয় কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার তত্ত্বাবধানে ধারাবাহিক প্রকাশিত হওয়াটা ছিল আমার জন্য খুবই সৌভাগ্যের ও মর্যাদার। অনুবাদটি ধারাবাহিক প্রকাশ করার জন্য আমার প্রিয় এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় এই নিউজ পোর্টালের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী এবং কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই।
আমার অনুরোধে লাতিন আমেরিকান সাহিত্য ও বোর্হেস বিশেষজ্ঞ রাজু আলাউদ্দিন এই গ্রন্থের জন্য একটি ভূমিকা লিখেছেন। তাঁর এই লেখাটি বইটির মর্যাদা অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে বলে কৃতজ্ঞতা জানাই তাঁকেও।
সবশেষে কৃতজ্ঞতা জানাই অন্যপ্রকাশ-এর প্রধান নির্বাহী রুচিশীল প্রকাশক শ্রদ্ধাভাজন মাজহারুল ইসলামকে মার্কেসের বইটি আগ্রহ নিয়ে প্রকাশ করার জন্য। কৃতজ্ঞতা জানাই এ প্রকাশনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে।
বিনীত