নিঃসঙ্গতার একশ বছর জাদুবাস্তবতার চেয়ে বেশি কিছু – রাজু আলাউদ্দিন
আজ তিনি এতই পরিচিত যে, শুধু ‘মার্কেস’ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের সামনে হুড়মুড় করে এসে জড়ো হয় অসংখ্য বিশেষণ: কলোম্বিয় লেখক, বিশ শতকের সেরা ঔপন্যাসিকদের একজন, যাদুবাস্তবতার সফল প্রয়োগকারী, লিখে যিনি রাতারাতি বিপুল বিত্তের অধিকারী—এরকম আরও বহু বিশেষণের পাশেই রয়েছে লোভনীয় ‘জনপ্রিয়’ শব্দটিও।
এসব বিশেষণের জন্য তাঁকে মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় নি, জীবদ্দশাতেই তিনি এসব অধিকার করে কিংবদন্তী হয়ে উঠেছিলেন। গোটা স্প্যানিশ সাহিত্যে কোনো কালেই আর কোনো লেখকই এই অসামান্য জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠতে পারেন নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, লেখক, সমালোচক, বুদ্ধিদীপ্ত পাঠকের পাশাপাশি নির্বোধ পাঠকদের কাছেও তিনি ছিলেন ঈর্ষণীয় রকমের জনপ্রিয়। অসংখ্য ভাষায় তিনি অনুবাদের মাধ্যমে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছিলেন পৃথিবীর কোটি কোটি পাঠকের মধ্যে। শুধু পাঠকই নয়, পৃথিবীর অসংখ্য ভাষার বহু লেখককে তিনি প্রভাবিত করেছিলেন যাদুবাস্তবতা নামক শিল্পরীতির সম্মোহনী শক্তি দিয়ে। বিশ্বসাহিত্যে কোনো কালেই কোনো ভাষাতেই এমনটা মার্কেসের আগে আর ঘটতে দেখা যায় নি। সেই কবে, টাইম ম্যাগাজিন-এর এক সাহিত্যসমালোচক নিঃসঙ্গতার একশ বছর-কে এমন এক বই হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন ‘যার সম্পর্কে সবাই কথা বলেন তবে সবাই সেটি পড়েন নি।’ ( A book about which everyone talks but not everyone reads. Jose Donoso, The boom in Spanish American Literature: A Personal History, Columbia University Press, 1977, p-62)
নিঃসঙ্গতার একশ বছর-এর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই লাতিন আমেরিকার অগ্রগণ্য বিশ্বখ্যাত কবি পাবলো নেরুদা মার্কেসকে অভিহিত করেছিলেন ‘স্প্যানিশ ভাষায় দ্বিতীয় সের্বান্তেস’ হিসেবে। এমনকি যে ঘনিষ্ঠ বন্ধু পরবর্তীকালে চিরশত্রু হয়ে ওঠেন সেই মারিও বার্গাস যোসাও এই অসামান্য ঔপন্যাসিককে ১৯৭১ সালে বরণ করে নিয়েছিলেন ৬৬৭ পৃষ্ঠার এক বিশাল বই লিখে। শুধু স্প্যানিশ ভাষাতেই নয়, ইংরেজি, ফরাসি ও ইতালীয় ভাষায় অনুবাদের ফলে আমেরিকা ও ইউরোপের প্রধান ভাষায় তিনি রাতারাতি সাহিত্যের আলোচিত ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। মার্কেসের ক্ষেত্রে এসবই ঘটেছিল ১৯৬৭ সালে মূলে এবং মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে ইংরেজি অনুবাদে নিঃসঙ্গতার একশ বছর প্রকাশের পরপরই।
বাংলা ভাষায় আমরা মার্কেসের নাম ১৯৮২ সালে তাঁর নোবেলপ্রাপ্তির একটু আগে থেকে জানলেও, তাঁর রচনার অনুবাদ শুরু হয় সম্ভবত নোবেল পুরস্কারের পরপরই। আজ হিসেব করলে দেখা যাবে বাংলাদেশে বা বাংলাভাষায় তাঁর প্রায় সব প্রধান রচনাই অনূদিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশে বা পশ্চিমবঙ্গে তাঁকে নিয়ে প্রচুর লেখা হয়েছে। কিন্তু দু-একজন বাদে কারোর লেখাতেই মার্কেস নিয়ে কোনো সুগভীর ও স্মরণীয় আলোচনা আজও আমাদের নজরে পড়ে নি। আমরা স্রেফ হুজুগের বশে মার্কেসের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেও তাঁর জনপ্রিয়তার আড়ালে সত্যিকারের শিল্পীসত্তাটিকে খুঁজে বের করার কোনো চেষ্টাই করি নি এখনো পর্যন্ত। আমরা এখনো পর্যন্ত ধরে নিয়েছি নিঃসঙ্গতার একশ বছর-এর মূল পরিচয় তার যাদুবাস্তবতা, যেন এসব কুহকী গুণাবলী স্প্যানিশ সাহিত্যে আগে কখনো ছিল না। আমরা এভাবে চিহ্নিত করতে গিয়ে সাহিত্যে তার পূর্বসূরী কার্পেন্তিয়েরকে অজ্ঞতার যাদুতে গুম করে দেই। যদি ধরেও নেই যে কার্পেন্তিয়ের বলে কেউ ছিলেন না, তাই বলে এই যাদুবাস্তবতাই কি নিঃসঙ্গতার একশ বছর-এর একমাত্র দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিচয়? আমরা মার্কেসের ভোজবাজিতে এতটাই অন্ধ হয়ে পড়েছি যে নিঃসঙ্গতার একশ বছর-এর অন্তর্নিহিত বহু সূক্ষ্ম গুণ ও বৈশিষ্ট্যের উপরিতলে ভাসমান কুহকের চোখধাঁধানো রূপটিকেই এর প্রধান এবং প্রায় একমাত্র গুণ হিসেবে দেখতে শুরু করেছি। নিঃসঙ্গতার একশ বছর-এর কেবল এই আকর্ষণীয় ও চটুল গুণে মুগ্ধ হয়ে আজকাল আমাদের কোনো কোনো জীবিত ও প্রয়াত লেখকের মধ্যেও এই বৈশিষ্ট্য যে আগেই ছিল তা প্রমাণ করার জন্য রীতিমতো গবেষণাও শুরু করে দিয়েছেন অনেকে। তাই শহীদুল জহীরকে আমরা যাদুবাস্তবতার লেখক হিসেবে প্রমাণ করতে পেরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। আমি শহীদুল জহীরকে খাটো করার জন্য একথা বলছি না, বলছি আমরা পাঠক ও সমালোচক হিসেবে মার্কেসের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত চটুল ও গৌণ জিনিসটাকেই যে প্রধান বিষয় ধরে এগুচ্ছি তার খানিকটা ইঙ্গিত দেওয়ার জন্যই এই প্রসঙ্গটা এল। যেন এই যাদুবাস্তবতা ব্যাপারটা আমরা ঠিক ঠিক ধরতে পেরে সাহিত্যের বিপুল উন্নতি সাধন করে ফেলেছি।
অথচ সাহিত্যের গুণবিচারী পাঠকমাত্রই জানেন নিঃসঙ্গতার একশ বছর-এর বড় গুণ এই যাদুবাস্তবতায় ততটা নয়, যতটা এর সামগ্রিক ও বহুস্তরী নির্মাণকৌশলের মধ্যে নিহিত। যাদুবাস্তবতা একে বাড়তি রং দিয়েছে বটে, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে এটা হচ্ছে রংচংয়ে সংয়ের মূল কৌশলগুলো আড়ালে রাখার এক সুপরিকল্পিত মুখোশ মাত্র। পশ্চিমের কোনো কোনো সমালোচকের প্রচারণায় মার্কেস তাঁর মুখোশ দিয়ে পরিচিত হলেও মারিও বার্গাস যোসা কিংবা কার্লোস ফুয়েন্তেস তাঁর মূল শক্তি ও বৈশিষ্ট্যকে চিনতে এবং চেনাতে ভুল করেন নি মোটেও। নিঃসঙ্গতার একশ বছর বেরুনোর পরপরই এই বইটি নিয়ে ফুয়েন্তেসের লা নুয়েবা নবেলা ইসপানোআমেরিকানা (লাতিন আমেরিকার নতুন উপন্যাস) গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধটির নাম ছিল ‘গার্সিয়া মার্কেস: সেগুন্দা লেকতুরা’, মানে ‘গার্সিয়া মার্কেস: দ্বিতীয় পাঠ’। শিরোনাম থেকেই বুঝা যাচ্ছে ‘যাদুকরী’ অনুষঙ্গ এই আলোচনায় প্রধান বিষয় নয়। এমনকি নিঃসঙ্গতার একশ বছর নিয়ে তার আরও একটি আলোচনারও শিরোনাম ছিল ‘গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ও আমেরিকা আবিষ্কার’ (Gabriel Garcia Marquez and Invention of America)—এই দ্বিতীয় শিরোনামের প্রবন্ধটি পাঠ করলেই আমরা বুঝতে পারব মার্কেস আসলে কী বিস্ময়কর কাণ্ড ঘটিয়েছেন। কাণ্ডটা অবশ্যই যাদুকরী, কিন্তু এই কাণ্ডকারখানায় যাদুবাস্তবতা মূল আলোচ্য বিষয় ছিল না। এর কারণ যাদুবাস্তবতার চেয়ে তার অন্যসব অর্জন ছিল এতই বিশাল যে তা নিয়ে আলোচনাটাই ছিল মার্কেসের সাহিত্যের শক্তিকে চিহ্নিত করার সঠিক সিদ্ধান্ত। কীভাবে একটি উপন্যাস গোটা মহাদেশের ইতিহাসকে বয়ান করতে পারে কল্পনার স্বাধীনতাকে মান্য করে, অথচ তার শরীরে তথাকথিত ‘ঐতিহাসিক’ উপন্যাসের কোনো তকমা লাগবে না, কীভাবে এই একই উপন্যাসকে আবার বাইবেলের এক সংস্করণ হিসেবে পড়া যাবে, আবার একে স্রেফ একটি নিখাদ আখ্যান হিসেবেও পড়া যাবে—এই শিল্পকৌশল রীতিমতো বিস্ময়কর। আমরা এই বিস্ময়কর অর্জনের পরিমাপ না করে কেবল যাদুবাস্তবতার মতো সবচেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য ও ভোজবাজিতে শিশুর মতো মুগ্ধতায় বিবশ হয়ে আছি।
গোটা মহাদেশের ইতিহাস বয়ানের কথা বলছিলাম। ইতিহাসের কথা আসে এই জন্যে যে এই উপন্যাসের কাহিনি ও ঘটনার পরম্পরার মধ্যে প্রবাহমান রয়েছে ঔপনিবেশিক আকাঙ্ক্ষার পেছনে ইউরোপীয় মনের প্রস্তুতি ও পরবর্তীকালে আমেরিকায় তা প্রয়োগের এক প্রচ্ছন্ন ইতিহাস। ‘মেলকিয়াদেস’ নামক ইউরোপ ও ‘হোসে আর্কাদিও’ নামক আমেরিকার মুখোমুখি হওয়া এবং ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞানে মুগ্ধ ও তৃষ্ণার্ত আর্কাদিও তা কীভাবে আত্তীকরণের চেষ্টা করছে তা দেখবার মতো এক বিষয়। ফুয়েন্তেস একে বলতে চেয়েছেন ‘ইতিহাসতা’ বা ‘হিস্টরিসিটি’, আবার এর ভেতরেই সহাবস্থান করছে বাইবেলীয় সেই পুরানের ইঙ্গিতও। নির্বাসনের শাস্তিপ্রাপ্ত আদম ও হাওয়ার প্রতিরূপ হয়ে উঠেছেন এই উপন্যাসের প্রধান দুই চরিত্র হোসে আর্কাদিও এবং উরসুলা, কারণ তারাও পাপের শাস্তি হিসেবে আদি বাসস্থান ত্যাগ করে আস্তানা গাড়ে মাকন্দ নামক এক অজানা পৃথিবীতে।
ইতিহাস, পুরান ও আখ্যান এই উপন্যাসে এমনভাবে রয়েছে যার তুলনা আগে আর কখনোই দেখা যায় নি। আর কেবল এতেই যদি এই উপন্যাসের অর্জন থেমে যেত তাতেও এর উচ্চতা ও অনন্যতাকে অতুলনীয় বলতে কারোরই কোনো আপত্তি থাকত না। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এর সঙ্গে রয়েছে জ্ঞানতাত্ত্বিক কিছু মৌলিক অনুষঙ্গও। মনোযোগী পাঠকদের মনে পড়বে যে মাকন্দয় প্রথম পদার্পণের পর আর্কাদিও সবকিছুকে আঙুল দিয়ে দেখাতে শুরু করল কারণ সে এগুলোর নাম জানত না, পরে সে এগুলোর নাম দিতে শুরু করল। আবার একসময় বিস্মৃতির রোগে আক্রান্ত হয়ে সবকিছুর নাম ভুলেও যায় তারা, ফলে আবার নতুন করে এগুলোর নতুন নামকরণ শুরু হলো। নিজেদের মতো করে তৈরি করতে হলো একটা নির্দেশনা ধরনের অভিধান। পুরো ব্যাপারটাকে হাস্যকর আর কমিক্যাল মনে হলেও প্লেটোর ক্র্যাটিলাস (Cratylus) -এ আমরা সক্রেটিস এবং তার বন্ধুদের মধ্যে এই নামকরণের ব্যাপারটি নিয়ে প্রবল বিতর্ক করতে দেখি। সেই বিতর্কের ঘোলা জলে না নেমেই আমরা হাইডেগারের সেই উক্তিটিকেই স্মরণ করলে এই বিষয়ে সত্যিকারের উপলদ্ধিটা পেয়ে যাব। তিনি বলেছিলেন ‘নামকরণই হচ্ছে কবিত্ব’। হোসে আর্কাদিও এই নামকরণের সূত্রে কবির ভূমিকাটিকে আমাদের সামনে যেমন তুলে ধরছেন, তেমনি আভাসে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন প্রাককলম্বিয় পৃথিবীর সঙ্গে কনকিস্তাদোরদের সাক্ষাত যারা নতুন পৃথিবীর নতুন সব জিনিস দেখে নতুন নামে ডাকতে শুরু করলেন। অর্থাৎ, এই মার্কেস একই সঙ্গে কবির মাধ্যমে জ্ঞানতাত্ত্বিক দিকটিকে যেমন উন্মোচন করছেন, তেমনি এর আরেক পিঠে এঁকে রেখেছেন ঔপনিবেশিক যুগের প্রচ্ছন্ন ইতিহাস।
শুধু আর্কাদিও-ই নয়, এই উপন্যাসের কোনো কোনো চরিত্র, কখনো কখনো একই চরিত্র এক এক ঘটনার সূত্রে যে আচরণ করে সেই আচরণের মাধ্যমে কখনো কখনো সে হয়ে ওঠে ঐতিহাসিক বা জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রপঞ্চের একাধিক প্ৰতীক।
এই উপন্যাসে স্বপ্ন, অভ্যাস, রীতিনীতি, ঘটনা, পুরান, কুসংস্কার ইত্যাদি মিলেমিশে সংস্কৃতি সম্পর্কে যে যুগপৎ ও সামগ্রিক ধারণা আমাদের সামনে তুলে ধরে তা আমাদের মনে করিয়ে দেয় বার্গাস য়্যোসা কথিত ‘সামগ্রিক উপন্যাস’ (Novela total)-এর ধারণাকে। তাঁর মতে, ‘শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা, সর্বোপরি এক সামগ্রিক উপন্যাস কারণ এটি সামগ্রিক বাস্তবতাকে তুলে ধরার লক্ষ্যে, এর অভিব্যক্তি ও নেতির ভাবমূর্তির সাথে প্রকৃত বাস্তবতার মোকাবেলা করার জন্যে ঈশ্বরের সবকিছু দখলের ইউটোপীয় পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করে। সামগ্রিকতার এই ধারণা এতই পিচ্ছিল ও জটিল কিন্তু তা সত্ত্বেও ঔপন্যাসিকের কাজের সাথে এটি আবার এতই অবিচ্ছেদ্য যে এ কেবল নিঃসঙ্গতার একশ বছর-এর বিশালত্বকেই সংজ্ঞায়িত করে না, একই সঙ্গে এটি হয়ে ওঠে এক চাবিকাঠিও। বিষয়গত দিক থেকে এটি একটি সামগ্রিক উপন্যাস, সেটা এই অর্থে যে এখানে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এক রুদ্ধ জগত ও এর সাথে জড়িত সবকিছুর বর্ণনা দিয়েছে, যেমন ব্যক্তি ও যৌথ, কিংবদন্তী ও ইতিহাস, দৈনন্দিন ও পৌরাণিক। আর এর আকৃতির মধ্যে বিষয়বস্তুর মতোই এর রচনা ও কাঠামোর আছে অনন্য স্বাভাবিকতা যা একই সঙ্গে অভাবনীয় ও স্বয়ংসম্পূর্ণ।’
Cien Años de soledad es una novela total sobre todo porque pone en practica el utopico designio de todo suplantador de Dios: describir una realidad total, enfrentar a la realidad real una imagen que es su expresion y negacion. Esta nocion de totalidad, tan escurridiza y compleja, pero tan inseparble de la vocacion del novelista, no solo define la grandeza de Cien Años de soledad: da tambien su clave. Se trata de una novela total por su materia, en la medida en que describe un mundo cerrado, desde su nacimiento hasta su muerte y en todos los ordenes que lo componen-el individual y el colectivo, el legendario, el historico, el cotidiano y el mitico-, y por su forma, ya que la escritura y la esctructura tienen, como la meteria que cuaja en ellas, una naturaleza exclusiva, irrepetible y autosuficiente. (Gabriel Garcia Marquez, Cien Años de Soledad, edicion commemorativa, Alfaguara, 6 de marzo 20007, P-xxvi)
যদি লেডি মুরাসাকির গেঞ্জি উপাখ্যান-এর কথা বাদ দেই তাহলে সবাই মনে করেন উপন্যাসের সূচনা ইউরোপে মিগেল দে সের্বান্তেসের দন কিহোতের মাধ্যমে এবং তা স্প্যানিশ ভাষায়, যে-ভাষায় মার্কেস জন্ম দিয়েছিলেন এই অসামান্য উপন্যাসটির। কিন্তু এই ভাষায় উপন্যাস নামক শিল্পকাঠামোর জন্ম হলেও উপন্যাসের নেতৃত্ব দিয়েছে কয়েক শ বছর যাবত ইউরোপের অন্যসব দেশের ভাষা, বিশেষ করে, জার্মান, ফরাসি আর ইংরেজি। এইসব ভাষার উপন্যাসের মধ্যে ইউরোপীয় মনোগঠন ও নন্দনতত্ত্বের একটা মোটাদাগের চেহারা আমরা ফুটে উঠতে দেখি। নানান প্রবণতা ও কলাকৌশলের সন্নিবেশে ইউরোপীয় উপন্যাসের আত্মার মধ্যে কখনোই সংস্কৃতির নানামুখী প্রবণতা ও রূপগুলো সহাবস্থান করে নি। উপন্যাসের অনেক ধরনের অর্জন থাকলেও সে কখনো যাদু-টোনা, পুরান, ইতিহাস, কুসংস্কার এই সবকিছুকে সে একই মনের নানান অভিব্যক্তিসম্পন্ন এক সমগ্র ব্যক্তির বলে ভাবতে পারে নি। বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের ধারণার মূল ভরকেন্দ্রে রাজত্ব করেছে মূলত যুক্তিবোধ। এই অর্থেও নিঃসঙ্গতার একশ বছর আমাদের সামনে উপন্যাসের ক্ষেত্রে ইউরোকেন্দ্রিকতার সীমাবদ্ধতাকেই স্পষ্ট করে দিয়েছে। মার্কেস তার নিঃসঙ্গতার একশ বছর দিয়ে কেবল লাতিন আমেরিকার বাস্তবসম্পর্কিত ধারণারই পরিবর্তন ঘটান নি, একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন পশ্চিমের যুক্তিনির্ভর গোটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিও।
নিঃসঙ্গতার একশ বছর-এর আগে কিংবা পরেও পশ্চিমের কোনো ঔপন্যাসিকই একইসঙ্গে এতগুলো দিককে একটি মাত্র উপন্যাসে এত শৈল্পিক দক্ষতায় কখনো তুলে ধরতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।
সত্যি বলতে কি, এ পর্যন্ত যা বলা হলো তা এই উপন্যাস সম্পর্কে একেবারেই সংক্ষিপ্ত একটি পর্যবেক্ষণ বা উপলব্ধি মাত্র। এই উপন্যাসের সামগ্রিক অর্জন সম্পর্কে বলতে গেলে তা নিঃসন্দেহে কয়েক শ পৃষ্ঠার একটি কিতাব হয়ে উঠবে। কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণ থেকে আশা করি এটা আমাদের কাছে পরিষ্কার হওয়ার কথা যে মার্কেসের এই অর্জনগুলো সম্পর্কে আমরা যদি সজাগ না হই তাহলে আমাদের কাছে যাদুবাস্তবতা নামক এক সস্তা, অগভীর ও চটুল ধারার উদ্দীপক লেখক হিসেবে তিনি অচিরেই বিস্মৃত হয়ে যাবেন। কিন্তু তা হবেন না এই উপন্যাসের শৈল্পিক উচ্চতাই সেটা প্রমাণ করে। মার্কেস মৃত্যুর পরও ভার্জিলের মতো পথ দেখাবেন আমাদের অনাগত সেইসব দান্তেকে যারা তার সত্যিকারের শক্তি ও কলাকৌশলের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাবেন সাহিত্যের স্বর্গে।