নিঃসঙ্গতার একশ বছর – ১১

১১

দুমাসের মধ্যেই ভেঙে যাওয়ার জোগাড় হয় ওদের বিয়েটা। উপহারস্বরূপ পেত্রা কতেসকে খুশি করার চেষ্টায় আউরেলিয়ানো সেগুন্দো তাকে মাদাগাস্কারের রানির পোশাক পরিয়ে এক ছবি তোলে। ফের্নান্দা জানতে পেরে বিয়ের তোরঙ্গ গুছিয়ে কারও কাছ থেকে বিদায় না নিয়ে মাকন্দ ত্যাগ করে। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো তার নাগাল পায় জলাভূমির পথে। অনেক অনুনয় ও ভালো হয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে পারে তাকে। আর ত্যাগ করে রক্ষিতাকে।

নিজের অবস্থান সমন্ধে সজাগ পেত্রা কতেসের মধ্যে দুশ্চিন্তার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। সে-ই লোকটাকে পুরুষমানুষ বানিয়েছে। যখন ওকে মেলকিয়াদেসের ঘর থেকে বের করে, সে ছিল তখনো শিশু, যার মাথা ভরা ছিল বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কহীন আজগুবি ধারণা। প্রকৃতি ওকে বানিয়েছিল স্বল্পভাষী ও লাজুক, যার নিঃসঙ্গ ধ্যানমগ্নতার প্রবণতা ছিল আর পেত্রা কতেস ওকে গড়ে তুলেছিল সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের; প্রাণপ্রাচুর্য ভরা অকপট খোলামেলা আর ওর ভেতর পুঁতে দিয়েছিল বেঁচে থাকার আনন্দ, টাকা ঢালা ও পার্টি করার সুখ। যে লোককে ভেতর-বাহির সব দিক থেকেই সে গড়ে তুলেছে তার স্বপ্নপুরুষে, যেভাবে সে স্বপ্ন দেখত তার বয়ঃসন্ধিকাল থেকে, তারও আগে বা পরে, যেভাবে পুত্রসন্তানরা বিয়ে করে সেই সব লোকাচার করেই বিয়ে করেছিল আউরেলিয়ানো সেগুন্দো। খবরটা পেত্রা কতেসকে জানাতে সাহস পায় না সে। যেন পেত্রা কতেসই ভাঙনটার সূচনা ঘটিয়েছে, এমন অবস্থা খুঁজে পেতে সে এক ছেলেমানুষি ব্যবহার শুরু করে, যেটা ছিল মিথ্যে রাগ আর কাল্পনিক তিক্ততার অভিনয়। একদিন আউরেলিয়ানো সেগুন্দো অনুচিতভাবে তিরস্কার করে ওকে আর পেত্রা সে ফাঁদটাকে এড়িয়ে সত্য কথাটা প্রকাশ করে।

‘আসল ব্যাপার হচ্ছে’, বলে, ‘তুই রানিকে বিয়ে করতে চাস।’

আউরেলিয়ানো সেগুন্দো লজ্জা পায়, সত্য কথা প্রকাশ পাওয়ায় অভিনয় করে রাগে উন্মত্ত হওয়ার। ওকে বলে, ভুল বুঝেছ এবং অপমান করেছ তাকে, আর পেত্রা কতেসের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দেয়। পেত্রা কতেস এক মুহূর্তের জন্যও তার ভেতরের বিশ্রামরত হিংস জন্তুটার ওপর নিয়ন্ত্রণ না হারিয়ে বিয়ের বাদ্য শোনে, শোনে হাউইবাজির আওয়াজ, আর দেখে উৎসবের উন্মত্ত হট্টগোল যেন এ সবই আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর নতুন এক দুষ্টুমি। ওর দুর্ভাগ্যে সমব্যথীদের সে হেসে আশ্বস্ত করে। ‘তোমরা দুশ্চিন্তা কোরো না’, ওদের বলে, ‘রানিরা চাকর-বাকরের মতো আমার কাজ করে দেয়।’ এক প্রতিবেশিনী মোমবাতি নিয়ে যায়, যাতে করে হারানো প্রেমিকের ছবির সঙ্গে সেটা জ্বালাতে পারে। তাকে সে এক রহস্যময় নিশ্চয়তা দিয়ে বলে, ‘একটি মোমবাতি, যেটা ওকে আসতে বাধ্য করবে, সেটা সব সময়ই প্রজ্বলিত।’

যেমনটি সে অনুমান করেছিল, মধুচন্দ্রিমা পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ফিরে যায় ওর বাড়িতে। সঙ্গে নিয়ে যায় তার সব সময়ের বন্ধুদের এক ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফারকে আর কোট ও শুকনো রক্তমাখা শাল, যেগুলোকে ফের্নান্দা ব্যবহার করেছিল কার্নিভালে। ওই বিকেলে জ্বলে ওঠা উৎসবের আগুনের উত্তাপে পেত্রা কতেসকে ওগুলো পরানো হয়, তাকে মাদাগাস্কারের নিরঙ্কুশ আজীবন সম্রাজ্ঞীর আসনে বসিয়ে মুকুট পরিয়ে ফটো তুলে বন্ধুদের মধ্যে ছবির কপি বিলিয়ে দেয়। পেত্রা কতেস এ খেলাটায় শুধু অংশগ্রহণ করে তা-ই নয়, পুনর্মিলনের এই ব্যয়বহুল উৎসবের আয়োজনে ভয় পাওয়ার সম্ভাবনায় আন্তরিকভাবে সহমর্মিতা প্রকাশ করে। রাত সাতটায় তখনো রানির বেশে সে, আর ওই বেশেই বিছানায় বরণ করে আউরেলিয়ানো সেগুন্দোকে। ওদের বিয়ের মাত্র দুমাস হয়েছে কিন্তু পেত্রা কতেস সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারে যে, ওদের মধুচন্দ্রিমার বিছানার ব্যাপারগুলো ভালো যাচ্ছে না, তার ফলে জমে থাকা প্রতিশোধের চমৎকার আনন্দ ভোগ করে সে। দুদিন পর সে আবার না এসে যখন এক মধস্থতাকারীকে পাঠায় পৃথক হওয়ার শর্তাবলি নির্ধারণের জন্য, তখন সে বুঝতে পারে, যেমনটি ভেবেছিল, তার চেয়েও বেশি ধৈর্য ধরতে হবে তাকে, কারণ আউরেলিয়ানো সেগুন্দো সমাজে নিজের অবস্থান ঠিক রাখার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবে বলে ঠিক করেছে। তখনো সে সাবধান হয় না। সবাই যা ধারণা করে সে নিজেও তা সহজভাবে মেনে নেয় যে সে এক হতভাগা মেয়ে আর আউরেলিয়ানোর স্মৃতি হিসেবে যা থাকে, তা হচ্ছে একজোড়া চামড়ার বুট, যেটা নিয়ে আউরেলিয়ানো বলত যে জুতো জোড়া পরেই সে কফিনে ঢুকবে। তোরঙ্গের তলায় ন্যাকড়ায় মুড়ে রেখে দেয় সে জুতো জোড়া, তারপর সে তৈরি হয় মনে সামান্য বেদনা নিয়ে হতাশাবিহীন অপেক্ষার জন্য। ‘আজ হোক কাল হোক, ওকে আসতেই হবে’, নিজেকে বলে, ‘শুধু বুট জোড়ার জন্য হলেও।’ যেমন ভেবেছিল তত লম্বা সময় ওকে অপেক্ষা করতে হয় না। বিয়ের রাত থেকেই আউরেলিয়ানো সেগুন্দো বুঝতে পারে যে চামড়ার বুট জোড়া প্রয়োজন হওয়ার অনেক আগেই তাকে পেত্রা কতেসের বাড়িতে ফিরতে হবে; ফের্নান্দা ছিল এই পৃথিবীর জন্য অচল এক মেয়ে। সাগর থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে ওর জন্ম আর সেখানেই বড় হয়েছে সে বিষণ্ণ এক শহরে, যার পাথুরে গলি ধরে ভয়ার্ত রাতগুলোতে এখনো খটখট শব্দ তোলে রাজপ্রতিনিধিদের শকট। বত্রিশ জন ঘণ্টাবাদক সন্ধ্যা ছটায় ঘণ্টা বাজায় মৃত্যুকে উদ্দেশ্য করে। সমাধিশিল্প অনুসরণ করে খোদাই পাথর দিয়ে বানানো বনেদি বাড়ি থেকে কখনোই সূর্য দেখা যায় না। উঠানের সাইপ্রাস গাছে, শোবার ঘরের পাণ্ডুর ঝোলানো কারুসজ্জায় রজনীগন্ধার বাগান থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় বের হওয়া খিলানে মরে পড়ে আছে বাতাস। বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত ফের্নান্দা প্রতিবেশীদের কোনো এক বাড়িতে করা পিয়ানোর বিষণ্ণ অনুশীলন শোনা ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো খবরই রাখত না, আর এদিকে অনুশীলনকারী বছরের পর বছর দুপুরের ঘুমটাকে না ঘুমানোর সংকল্প করেছে। ওর অসুস্থ মায়ের ঘরে জানালার কাচের শার্সি দিয়ে আসা সবুজ ও হলুদ ধুলোময় আলোর নিচে সে নিয়মমাফিক সুবিন্যস্ত একঘেয়ে করুণ সুর শুনতে শুনতে ভাবত যে এগুলো এ পৃথিবীরই সংগীত আর সে বানাত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় দেওয়ার জন্য পাম (তাল) গাছের পাতার করোনা (গোলাকৃতি ফুলের বিড়ে) পাঁচটার জ্বরের কারণে ঘামতে থাকা তার মা ওকে বলত জাঁকজমকপূর্ণ অতীতের কথা। ছোটবেলা এক জোছনা রাতে সাদা পোশাক পরা এক খুব সুন্দরী মহিলাকে বাগান পার হয়ে উপাসনালয়ের দিকে যেতে দেখে ফের্নান্দা। সেই ক্ষণস্থায়ী দৃশ্যের ভেতর যা তাকে সবচেয়ে বিচলিত করে তা হচ্ছে যে মহিলাকে অনুভব করে যেন সে নিজেই নিজেকে দেখছে বিশ বছর আগে। ‘সে হচ্ছে তোর পরদাদি; রানি’, কাশতে কাশতে বলে ওর মা। ‘রজনীগন্ধা কাঁটার সময় এক ঝাপটা অশুভ বাতাস গায়ে লাগায় মারা যায় সে।’ অনেক বছর পর যখন সে নিজেকে পরদাদির মতো মনে করতে শুরু করে তখন ফের্নান্দার ছোটবেলার সে দৃশ্য নিয়ে সন্দেহ জন্মালে ওর মা তিরস্কার করেন এই অবিশ্বাসের কারণে। ‘আমরা খুবই ধনী এবং ক্ষমতাবান’, ওকে বলে, ‘একদিন তুই রানি হবি।’

যদিও শুধু পানি দিয়ে বানানো এক কাপ চকলেট আর একটা মিষ্টি রুটি খাবার জন্য তারা লিলেন দিয়ে ঢাকা লম্বা খাবার টেবিল আর রুপোর তৈরি থালাবাসন ব্যবহার করত, তবু কথাটা বিশ্বাস করে সে। এমনকি তার বাবা দন ফের্নান্দকে তার বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে বাড়ি বন্ধক রাখতে হয়, তবু বিয়ের দিন পর্যন্ত সে স্বপ্ন দেখে এক কিংবদন্তির সাম্রাজ্যের। ওটা কোনো সারল্য বা জাঁকজমকের বিকার নয়। ওভাবেই তাকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। তার মনে পড়ে, জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই সে পারিবারিক চিহ্ন খোদাই করা সোনার পাত্রে সে মলত্যাগ করত। বারো বছর বয়সে যখন প্রথমবার বাড়ি থেকে বের হয়, তখন শুধু দুই ব্লক পরের কনভেন্টে যাওয়ার জন্য তাকে ঘোড়ায় টানা গাড়ি ব্যবহার করতে হয়েছিল। তার ক্লাসের সহপাঠীরা অবাক হয় তাকে আলাদা জায়গায় উঁচু পিঠওয়ালা চেয়ারে বসতে দেওয়ায়, এমনকি টিফিনের সময়ও সে ওদের সঙ্গে মেশে না। ‘ও হচ্ছে সবার থেকে আলাদা’ ব্যাখ্যা করত নানরা, ‘রানি হবে ও।’ ওর সাথিরা বিশ্বাস করে, কারণ, তখনই সে সবচেয়ে সুন্দরী কুমারী, সবার থেকে আলাদা আর তখন পর্যন্ত দেখা সবচেয়ে বিবেচক ছিল। আট বছরের মাথায় যখন করোনা বানানোর জন্য বাড়িতে ফেরে, তখন সে ল্যাটিনে পদ্য লিখতে শিখেছে। বাজাতে শিখেছে ক্লাভকর্ড, শিখেছে ভদ্রলোকদের সঙ্গে বাজপাখি ওড়ানো নিয়ে কথা বলা ও আর্চবিশপদের সঙ্গে দোষকুণ্ঠিত কথাবার্তা, বিদেশি গভর্নমেন্টের লোকদের সঙ্গে দেশের ব্যাপার আর পোপের সঙ্গে ধর্মসংক্রান্ত ব্যাপারে কথাবার্তা চালানো। বাড়ি ফিরে দেখে তাদের সমস্ত জিনিসপত্র যেন লুট করা হয়েছে। শুধু রয়েছে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র—রুপার মোমদান ও থালাবাসন, ওর পড়াশোনার খরচ জোগাতে একের পর এক বিক্রি করতে হয়েছে। ওর মা পাঁচটার জ্বরের কাছে হার মেনে মারা যায়। বুকের ওপর আড়াআড়ি করে পরা সোনার চেইন ঘড়ি, ধাতু দিয়ে শক্ত করা কলারসহ কালো পোশাক পরিহিত ওর বাবা সংসার খরচ বাবদ ওকে একটা রুপোর পয়সা দিত আর আগের সপ্তাহে বানানো করোনাগুলো নিয়ে যেত। বাবা দিনের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়ে দিত নিজের অফিসে আর অল্প কোনো সময় রাস্তায় বেরোলে সন্ধে ছটার আগেই ফিরে আসত ফের্নান্দার সঙ্গে জপমালা নিয়ে প্রার্থনা করতে। কখনোই কারও সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয় নি। যে যুদ্ধ দেশের সব রক্ত প্রায় শেষ করে ফেলেছে, সেই যুদ্ধের কথা কেউ কোনো দিন ফের্নান্দার মুখে শোনে নি। বেলা তিনটায় পিয়ানোর মহড়া শোনা সে কখনোই বাদ দেয় নি। একদিন এমনকি রানি হওয়ার মোহও প্রায় হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয় তার, যখন উচ্চস্বরে জরুরি ভঙ্গিতে দুবার ফটকে কড়া নাড়ার আওয়াজ হয় ও দরজা খুলে বুকে পদকসহ গালে কাটা দাগসহ কেতাদুরস্ত এক অফিসারকে পায়। বাবার সঙ্গে অফিসার দরজা বন্ধ করে ঢুকে অফিসঘরে। দুই ঘণ্টা পর ওর বাবা ওকে খুঁজতে যায় সেলাইঘরে। ‘জিনিসপত্র গুছিয়ে নে’, ওকে বলে, ‘লম্বা সফরে যেতে হবে তোকে।’ এভাবেই ওকে নিয়ে যাওয়া হয় মাকন্দে। শুধু একদিন এক নিষ্ঠুর থাবার আঘাতে জীবন ওর ওপর চাপিয়ে দেয় বহু বছর যাবৎ ওর বাবা-মার লুকিয়ে রাখা বাস্তবতার বোঝা। বাড়ি ফিরে কান্নার জন্য দরজা বন্ধ করে আর এত দিনের উপহাসের পোড়াক্ষত মুছে দিতে দন ফের্নান্দার অনুনয়-বিনয় ওকে স্পর্শ করে না। সে প্রতিজ্ঞা করে আমৃত্যু শোবার ঘর না ছাড়ার, যখন আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ওকে খুঁজতে আসে। শুধু ভাগ্যের জোরেই ব্যাপারটা সম্ভব হয়। কারণ অবমাননার জ্বালায় ও লজ্জায় ক্রোধোন্মত্ত হয়ে সে তার সত্যিকার পরিচয় সমন্ধে মিথ্যে বলে আউরেলিয়ানো সেগুন্দোকে। একমাত্র বাস্তব সূত্রে ছিল তার কথায় নির্ভুল পাহাড়ি টান আর তালপাতা দিয়ে করোনা বানানোর কাজ। সমস্ত শক্তি দিয়ে আউরেলিয়ানো খোঁজে তাকে। যে রকম বেপরোয়াহীন হয়ে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া পাহাড় ডিঙিয়েছিল মাকন্দ পত্তনের উদ্দেশ্যে, যে অন্ধ অহংকার দিয়ে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া তার নিষ্ফল যুদ্ধগুলো চালিয়ে গিয়েছিল নির্বোধ একগুঁয়েমি নিয়ে, উরসুলা যেভাবে বংশটার অস্তিত্ব নিশ্চিত করে, সেই একইভাবে এক মুহূর্তের জন্যও উদ্যম না হারিয়ে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো খোঁজে তাকে। সে যখন প্রশ্ন করে তালপাতার করোনা কোথায় বানানো হয়, তখন ওকে নিয়ে যাওয়া হয় এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে, যাতে সে পছন্দমতো যেকোনো একটা নিতে পারে। কোথায় বাস করে পৃথিবীতে এ পর্যন্ত জন্মানো শ্রেষ্ঠ মেয়ে, এ প্রশ্ন করার পর সব মা-ই নিজের মেয়েকে নিয়ে আসে তার সামনে। সে হারিয়ে যায় কুয়াশার সংকীর্ণ পার্বত্যপথে। বিস্মৃতির জন্য সংরক্ষিত সময়ে হতাশার গোলকধাঁধায়। এমন এক বিস্তীর্ণ হলুদ উচ্চভূমি পাড়ি দেয় সে, যেখানে চিন্তাভাবনা সৃষ্টি করে প্রতিধ্বনির আর উৎকণ্ঠা তৈরি করে মরীচিকার সতর্কবাণী। নিষ্ফল সপ্তাহের পর সপ্তাহ শেষে এক অচেনা শহরে চলে আসে সে, যেখানে সমস্ত ঘণ্টাই বাজায় মৃত্যুধ্বনি, যদিও সে কখনোই দেখে নি বা কেউ তাকে বলে নি, তবু দেখামাত্র চিনতে পারে হাড় নিঃসৃত চুনে খাওয়া দেয়াল, ছত্রাক ছাওয়া কাঠের ব্যালকনি আর বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া অস্পষ্ট পৃথিবীর বিষণ্নতম ফটকে পেরেক আটা সাইনবোর্ডটা: এখানে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য তালপাতার করোনা বিক্রি হয়। সেই তখন থেকে হিমশীতল সকাল পর্যন্ত যখন প্রধান নানের তত্ত্বাবধানে ফের্নান্দা বাড়ি ত্যাগ করে। তখন ওদের কোনোরকম সময় হয় বিয়ের পোশাক সেলাইয়ের ছয়টি তোরঙ্গে মোমদান ও থালা বাসন ভরার, সোনার চেম্বার পট আর এক ধ্বংসপ্রাপ্ত পরিবারের দুই শতক যাবৎ অব্যবহৃত অগুনতি আর অব্যবহার্য জিনিসপত্র ভরার। দন ফের্নান্দা তাকে সঙ্গ দেওয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করে না। তার সমস্ত দায়িত্ব শেষ করে পরে কখনো যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যখন মেয়েকে আশীর্বাদ করে, তখন থেকে আবার নিজের অফিসে দরজা বন্ধ করে—তার ও মেয়ের ভেতরে সারা জীবনে ঘটা প্রথম মানবিক সম্পর্ক লিখতে, যেখানে লেখে তার পরিবারের কুলচিহ্ন যুক্ত বংশলতিকা ও তার শোকার্ত রূপরেখা ওই দিনই হয়েছিল ফের্নান্দার সত্যিকারের জন্ম। আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর জন্য ওই দিনই ছিল প্রায় একই সঙ্গে ওর সুখের আরম্ভ আর সমাপ্তি।

ফের্নান্দার কাছে ছিল সোনালি চাবিওয়ালা এক অমূল্য দিনপঞ্জি, যেটাকে তার আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা মিলনের জন্য নিষিদ্ধ দিনগুলো বেগুনি কালি দিয়ে চিহ্নিত করে দিয়েছে। পবিত্র সপ্তাহটা বাদ দিয়ে, রোববারগুলো, উৎসবের পবিত্র দিনগুলো, মাসের প্রথম শুক্রবার, সাময়িক নিভৃতবাস, আত্মত্যাগের দিন আর ঋতুর দিনগুলো বাদ দেওয়ার পর দিনপঞ্জি হয়ে দাঁড়ায় কাটা চিহ্ন দেওয়া আঁকিবুকি। সময়ই এই বিরূপ অবস্থাকে দূর করবে এই বিশ্বাস নিয়ে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো বিবাহ উৎসবকে দীর্ঘতর করে। ব্রান্ডি আর শ্যাম্পেনের বোতলগুলোকে আবর্জনার স্তূপে পাঠাতে পাঠাতে ক্লান্ত উরসুলা আতশবাজির, গরু জবাইয়ের আর বাজনার মাঝে সদ্য বিবাহিতদের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আলাদা ঘরে শুতে দেখে কৌতূহলী হয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করে যে ফের্নান্দারও তার মতো সতীত্ব রক্ষার জন্য কোমরবন্ধনী আছে কি না, যেটা নাকি শিগগিরই সারা গ্রামের তামাশার কারণ হয়ে উঠবে আর আরেক করুণ ঘটনার সূত্রপাত হবে। কিন্তু ফের্নান্দা শুধু বলে যে স্বামীর সঙ্গে প্রথম মিলনের আগে সে দুসপ্তাহ সময় নিচ্ছে। সময়টা পার হলে সত্যিই তার শোবার ঘরের দরজা খোলে আত্মসমর্পণকারীর মতো, যেমনটি করত যেকোনো প্রায়শ্চিত্তকারী। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো দেখতে পায় সন্ত্রস্ত জন্তুর মতো মহিমাময় চোখ ও বালিশে ছড়ানো তাম্রবর্ণ দীর্ঘ কেশরাশি নিয়ে অপেক্ষারত পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে। দৃষ্টি নিয়ে সে এতই ঘোরের মধ্যে ছিল যে তার বুঝতে সময় লাগে ফের্নান্দা গোড়ালি ও হাতের কবজি পর্যন্ত লম্বা হাতার রাত্রিবাস পরে আছে, যেটার তলপেটের কাছাকাছি গোল বড় এক বোতামঘর যত্নের সঙ্গে বানানো আছে। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো দমকা হাসি চেপে রাখতে পারে না।

‘এটাই হচ্ছে আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে অশোভন বস্তু’, সারা বাড়ি কাঁপানো এক হাসির সঙ্গে বলে সে, ‘আমার বিয়ে হয়েছে এক সিস্টারের সঙ্গে।’

এক মাস পর বউকে দিয়ে লম্বা রাত্রিবাসটা খোলাতে না পেরে সে পেত্রা কতেসকে রানি সাজিয়ে ছবি তুলতে যায়। পরে ফের্নান্দা ওকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে পারার পর পুনর্মিলনের জ্বরতপ্ত রাত্রিবাসটা খুললেও যে শান্তির স্বপ্নে আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর বত্রিশটি ঘণ্টা ঘরের শহর পর্যন্ত গিয়েছিল, তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয় না। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ওর মধ্যে শুধু খুঁজে পায় একাকিত্বের গভীর এক অনুভূতি। এক রাতে প্রথম ছেলে জন্মানোর সামান্য কিছুদিন আগে ফের্নান্দা বুঝতে পারে যে সে গোপনে পেত্রা কতেসের বিছানায় ফিরে গিয়েছে।

‘ঠিক তা-ই’, স্বীকার করে সে। পরে হার মেনে বশ্যতার সুরে বলে, ‘আমি করতে বাধ্য হয়েছি, যাতে করে জন্তুগুলো বাচ্চা দেওয়া না থামায়।’

এত আশ্চর্যজনক ব্যাপারটা বিশ্বাস করাতে কিছু সময় লেগে যায়। কিন্তু বিভিন্ন অখণ্ডনীয় প্রমাণ দিয়ে শেষ পর্যন্ত যখন সে বিশ্বাস করাতে পারে ফের্নান্দা একমাত্র যে প্রতিজ্ঞা করায় তা হচ্ছে, সে যেন রক্ষিতার বিছানায় মারা গিয়ে ফের্নান্দাকে আশ্চর্যান্বিত না করে। এইভাবেই তিনজন বসবাস করতে থাকে একে অপরের অসুবিধার সৃষ্টি না করে। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো দুজনের সঙ্গেই নিয়মনিষ্ঠ ও দুজনের প্রতিই অনুরক্ত। পেত্রা কতেস এই পুনর্মিলনের খুশিতে আনন্দে ভরপুর আর ফের্নান্দা ভান করে সত্যকে না জানার।

এই আপস অবশ্য ফের্নান্দাকে পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করতে পারে না। উরসুলা শুধু শুধুই চেষ্টা করে প্রণয়ের পর ব্যবহৃত উলের গলাবন্ধ ফেলে দিতে, কারণ তা প্রতিবেশীদের মধ্যে কানকথার সৃষ্টি করে। সোনার মলত্যাগপাত্রটাও ছোট ছোট সোনার মাছ বানানোর জন্য কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার কাছে বিক্রি করে সাধারণ পায়খানা বা রাতের পায়খানা ব্যবহার করাতে ব্যর্থ হয় সে। আমারান্তা তার আঞ্চলিক টান নকল করে ও প্রতিটি শব্দই সোজাসুজি না বলে ঘুরিয়ে নরম করে বলায় অস্বস্তি বোধ করে আর ওর সামনে সব সময় দুর্বোধ্য শব্দ বলে।

‘এসফেতাফা’ বলত, ‘এসফে দেফে লাসফা কেফে লেসকে তিক্ষিত্র ফেনেনফে আসফা কফা আফাফু প্রফপিকিয়াফা মিফিয়ের ফেদাফা।’

একদিন বিদ্রুপবাণে তিতিবিরক্ত হয়ে ফের্নান্দা জানতে চায় আমারান্তার কথার অর্থ আর আমারান্তা সঠিক উত্তর দেয় না।

‘বলছিলাম তুই এমন একজন মানুষ যে কুলো (পোঁদ) ও কুলোর (উপবাসের দিন) মধ্যে পার্থক্য বুঝিস না।’

সেই দিন থেকে দুজনেই কথা বলা বন্ধ করে দেয়। যখন পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করত যোগাযোগ করতে তখন তারা চিরকুট পাঠাত বা সরাসরি না বলে ভাববাচ্যে বলত। পরিবারের প্রকাশ্য বিরোধিতা সত্ত্বেও ফেনাদা বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত প্রথা প্রচলনের ইচ্ছাটায় ইস্তফা দেয় না। খিদে পাওয়ায় ইচ্ছেমতো রান্নাঘরে খাবার অভ্যেসটা রদ করে সবার ক্ষেত্রে। খাবার ঘরের লিলেনের টেবিল ক্লথ দিয়ে ঢাকা বড় টেবিলে মোমদান জ্বালিয়ে। রুপোর বাসনকোসনে নির্দিষ্ট সময়ে সবাইকে খেতে বাধ্য করে সে। উরসুলা যে কাজটিকে প্রাত্যহিক জীবনের সবচেয়ে সাধারণ ব্যাপার বলে মনে করত, তা এমন গুরুগম্ভীর ব্যাপারে পরিণত হওয়ায় সবার আগে বিদ্রোহ ঘোষণা করে সে হচ্ছে ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো ছাড়া আর কেউ নয়। তার পরও প্রথাটা চলতে থাকে একইভাবে, চলে রাতের খাওয়ার আগে জপমালা নিয়ে প্রার্থনার প্রথাটাও। ব্যাপারগুলো এমনিভাবে প্রতিবেশীদের মনোযোগ আকর্ষণ করে যে শিগগিরই কানাঘুষার সৃষ্টি হয় যে বুয়েন্দিয়ারা অন্য সব মরণশীলদের মতো খাওয়ার টেবিলে খেতে বসে না, বরং খাবার ব্যাপারকে ওরা রূপায়ণ করেছে এক বড় মাস্-এ (উপসনাসভা)। চিরাচরিত রীতির বাইরে পরিস্থিতি অনুযায়ী বানানো উরসুলার কুসংস্কারগুলোর সঙ্গে সংঘাত বাধে ফের্নান্দার বাবার কাছ থেকে পাওয়া প্রতিটি উপলক্ষের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রথাগুলোর। যত দিন পর্যন্ত উরসুলা তার সমস্ত মানসিক ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করে, তত দিন প্রাচীন কিছু রীতিনীতি নতুন প্রবর্তিত প্রথার সঙ্গে একই সঙ্গে পালিত হয় আর পরিবারে খানিকটা হলেও তার প্রভাব বজায় থাকে, কিন্তু যখন সে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে, বয়সের ভার তাকে ঠেলে দেয় এক কোনায়। আসার পর থেকেই তার আরম্ভ করা বা ফের্নান্দার কঠোর বৃত্তটা পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয় আর সে ছাড়া আর কেউই পরিবারের গন্তব্য নির্ধারণ করে না। উরসুলার ইচ্ছায় সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ চালিত পেস্ট্রি বানানোর বেকারি আর মিছরি দিয়ে ছোট ছোট প্রাণী বানানোর ব্যবসা দুটি ফের্নান্দার বিচারে অমর্যাদাকর পেশা, আর ফলে সেগুলো বন্ধ করে দিতে দেরি করে না সে। ভোর থেকে শোবার সময় পর্যন্ত হাট করে খুলে রাখা দরজাগুলো দুপুরে ঘুমানোর সময় রোদ শোবার ঘর গরম করে ফেলে, এই অজুহাতে বন্ধ করে দেওয়া হয় আর শেষমেশ বন্ধ করা হয় চিরদিনের জন্য। মাকন্দ পত্তনের সময় থেকে ঝোলানো ঘৃতকুমারীর ডাল আর পাউরুটির স্থান দখল করে হৃদয় বের করা যিশুখ্রিষ্টের মূর্তি। এসব পরিবর্তন চোখে পড়ে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার আর সে বুঝতে পারে এর পরিণতি। ‘আমরা পরিবর্তিত হচ্ছি ভদ্রলোকে’, সে প্রতিবাদ করত, ‘এমনভাবে চলতে থাকলে শিগগিরই আবার আমাদের রক্ষণশীলদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে এক রাজাকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য’, অতি কৌশলে ও সতর্কতার সঙ্গে ফের্নান্দাকে যাতে তার মুখোমুখি না হতে হয়, সেই ব্যবস্থা করে সে। কর্নেল আউরেলিয়ানোর স্বাধীন সত্তা ও সব ধরনের সামাজিক কঠোরতার প্রতি বিরোধিতা গভীরভাবে পীড়া দিত তাকে। পাঁচটার সময় বড় কয়েক কাপ কফি পান, রৌপ্যশালার বিশৃঙ্খলতা, তার জীর্ণ কম্বল, বিকেল হলে তার রাস্তাসংলগ্ন দরজায় বসার অভ্যেস, এ সবকিছুই ক্রোধান্বিত করত ফের্নান্দাকে। কিন্তু পারিবারিক যন্ত্রের এই অংশটাকে আলগা রাখতে বাধ্য হয় সে। কারণ, সে নিশ্চিত ছিল যে কাল ও হতাশার কাছে বশ মানা এই বৃদ্ধ কর্নেল এমন এক জানোয়ার যে তার এই জরাগ্রস্ত বিদ্রোহ দিয়েও যেকোনো মুহূর্তে এই বাড়ি ভিতসহ উপরে ফেলতে পারে। যখন তার স্বামী পরদাদার নামে প্রথম ছেলের নাম রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, ফের্নান্দা বিরোধিতা করার সাহস পায় না, কারণ সে এসেছে মাত্র এক বছরকাল, কিন্তু যখন প্রথম কন্যাসন্তান জন্মায়, মেয়ের নাম ওর মায়ের নামে ‘রেনাতা’ রাখার ব্যাপারে অটল থাকে। উরসুলা মেয়েটার নাম রেমেদিওস রাখবে বলে ঠিক করেছিল। এক উত্তেজনাকর বিরোধের শেষে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো উপভোগ্য মধ্যস্থতা করে। রেনাতা রেমেদিওস নামে মেয়েটাকে ব্যাপটাইজ করলেও ফের্নান্দা ওকে শুধু রেনাতা বলে ডাকে আর অন্য সবাই ডাকে রেমেদিওসের সংক্ষিপ্ত রূপ মেমে বলে।

প্রথম দিকে ফের্নান্দা নিজের পরিবারের কথা কিছুই বলত না কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের বাবাকে এক আদর্শ মানুষ হিসেবে তুলে ধরতে লাগল। খাবার টেবিলে বাবার কথা বলতে গিয়ে বলত, সে ছিল এমন এক ব্যতিক্রমী মানুষ যে নাকি সব ধরনের বিলাসিতা ত্যাগ করে এক সাধুর পর্যায়ে উন্নীত হচ্ছে। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো আশ্চর্য হতো শ্বশুরের ব্যাপারে বউয়ের এ ধরনের অকারণে বাড়িয়ে বলায়, আর তার আড়ালে মাঝেমধ্যে বিদ্রূপ করার লোভ সংবরণ করতে পারে না। এমনকি উরসুলা পর্যন্ত, যে নাকি পারিবারিক ঐক্য বজায় রাখার ব্যাপারে ভীষণ যত্নবান ছিল ও পারিবারিক কলহের কারণে গোপন কষ্টে ভুগত, সে-ও মাঝেমধ্যে বলে ফেলত, তার নাতির ঘরের নাতির স্বর্গ নিশ্চিত, কারণ সে হচ্ছে ‘সেন্টের নাতি, রানি ও পশু চোরের ছেলে। এই ধরনের হাস্যকর ষড়যন্ত্রের পরও ছেলেমেয়েরা তাদের নানাকে কিংবদন্তিতুল্য মানুষ বলে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, যে নানা তাদের ভক্তিপূর্ণ পদ্য ও প্রতি বড়দিনে উপহারভর্তি এক বাক্স পাঠিয়ে দিত। সত্যিকার অর্থে সেগুলো ছিল তাদের রাজসিক অবক্ষয়ের অবশিষ্টাংশ। সেগুলো দিয়ে বাচ্চাদের শোবার ঘরে প্রমাণ আকৃতির এক সেন্টের প্রতিমূর্তিসহ এক বেদি তৈরি করা হয়, যার কাচের চোখ ছিল অস্বস্তিকর রকমের জীবন্ত ও যার পরনের কাপড় ছিল এত শিল্পসম্মতরূপে তৈরি করা যে সে রকম কাপড় কখনোই মাকন্দের কেউ পরে নি। ধীরে ধীরে সেই বরফশীতল প্রাচীন শোকবিধুর ম্যানশনে রূপান্তরিত হতে থাকে বুয়েন্দিয়াদের আলোকোজ্জ্বল বাড়ি। ‘এর মধ্যেই পারিবারিক সমাধিস্থলের সবটাই পাঠিয়ে দিয়েছে’, একবার মন্তব্য করে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো। ‘শুধু বাকি আছে উইলো গাছ ও স্মৃতিস্তম্ভগুলো।’ যদিও বাক্সগুলোতে বাচ্চাদের খেলার মতো কিছুই থাকত না, তবু ওরা ডিসেম্বর আসার অপেক্ষায় থাকত, কারণ শেষমেশ অভাবনীয় প্রাচীন জিনিসগুলো বাড়িতে নতুনত্বের সৃষ্টি করত। দশম বড়দিনে যখন ছোট হোসে আর্কাদিও যাজকদের স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে, তখন অন্যান্য বছরের চেয়েও অনেক আগেভাগে নানার পাঠানো সব সময়ের মতোই সঠিক অক্ষরে লেখা ঠিকানাসংবলিত এক বাক্স এসে হাজির হয়, যেটা ছিল ভালোভাবে তারকাঁটা মারা ও আলকাতরা মাখানো, যেটা পাঠানো হয়েছে সম্মানিতা মিসেস ফের্নান্দা দেল কার্পিও দেল বুয়েন্দিয়াকে। যখন ফের্নান্দা শোবার ঘরে চিঠি পড়ছিল, বাচ্চারা ছোটে বাক্স খোলার জন্য। বরাবরের মতোই আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর সাহায্য নিয়ে ওরা বাক্সের গা থেকে আলকাতরা চেঁছে ফেলে বাক্সের মুখ থেকে তারকাঁটা খোলে, যাতে নষ্ট না হওয়ার জন্য জন্য দেওয়া কাঠের গুঁড়ো সরানোর পর দেখতে পায় আটটি স্ক্রু বোল্ট দিয়ে লাগানো লম্বা এক সিসার সিন্দুক। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো কৌতূহলে অস্থির শিশুদের সামনে আটটি স্ক্রু খুলে ঢাকনি সরানোর পর বাচ্চাদের এক দিকে সরিয়ে দেওয়ার আগে কোনো রকমে সময় পায় এক চিৎকার করার। ঢাকনা সরানোর পরই সে দেখতে পায় কালো পোশাক পরিহিত বুকে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মূর্তি নিয়ে শোয়া দন ফের্নান্দোকে যার চামড়া ফেটে বিশ্রী রকম ক্ষতে ফেটে গিয়েছে আর ধীর আঁচে স্যুপের মতো সিদ্ধ হচ্ছে জ্যান্ত মুক্তোর মতো বুদ্বুদ তুলে।

নিরলান্দা সন্ধির এক নতুন বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে, ফের্নান্দার কন্যাসন্তান জন্মের অল্প কিছুদিন পর কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার পঞ্চাশ বছর পূর্তির এক অপ্রত্যাশিত আদেশ আসে সরকার পক্ষ থেকে। সরকারি নীতির সঙ্গে এটা এতই অসংগত ছিল যে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়ে প্রস্তাবিত শ্রদ্ধার্ঘ বর্জন করে। ‘এই প্রথমবার শুনছি পঞ্চাশ বছর পূর্তি শব্দটা’, বলে সে। ‘ওরা যা-ই বলুক না কেন, এটা এক বিদ্রূপ ছাড়া কিছুই না।’ ছোট্ট রৌপ্যশালা ভরে যায় দূতদের দিয়ে। অন্য সময়ে যে কালো কোট পরা উকিলরা কর্নেলের চারপাশে কাকের মতো ডানা ঝাপটাত, তারাই ফিরে আসে আবার আরও অনেক বৃদ্ধ ও গম্ভীর হয়ে। যুদ্ধকে ডুবিয়ে দিতে যেমন অন্য সময়ে আসত, তেমনি ওদের উদয় হতে দেখে ওদের ভান করা স্তুতি তার সহ্য হয় না। ওদের আদেশ করে তাকে যেন শান্তিতে থাকতে দেওয়া হয়। জোর দিয়ে তাদের বলে যে রকমটি ওরা বলছে সে রকমভাবে সে জাতির কোনো বীর সন্তান নয়, বরং স্মৃতিবিহীন এক কারিগর মাত্র, যার একমাত্র স্বপ্ন হচ্ছে ক্লান্ত হয়ে মৃত্যুবরণের পর বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যাওয়া। যা তাকে সবচেয়ে বেশি ক্রুদ্ধ করে তোলে তা হচ্ছে, খোদ প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টকে মাকন্দে এসে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তাকে অর্ডার অব মেরিট পরিয়ে দেওয়ার সংবাদটা। আক্ষরিকভাবেই প্রেসিডেন্টকে বলতে পাঠায় যে সত্যিকার আগ্রহের সঙ্গে সে দেরি করে হলেও উপযুক্ত উপলক্ষের জন্য অপেক্ষা করছে তাকে গুলি করার জন্য, কিন্তু সেটা তার স্বেচ্ছাচারী ও মান্ধাতা আমলের কাজকর্মের জন্য নয়, বরং এক নিরীহ বৃদ্ধের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানোর জন্য। সে এমন তীব্রতা নিয়ে হুমকিটা ঘোষণা করে যে প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট শেষ মুহূর্তে মাকন্দে আসা বাতিল করে আর পদকটা পাঠায় এক ব্যক্তিগত প্রতিনিধির হাত দিয়ে। সব রকমের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস বিছানা ত্যাগ করে তার প্রাচীন সহযোদ্ধাকে রাজি করাতে। চারজন লোক বহনকৃত দোলখাটিয়ায়, যৌবনকাল থেকে জয়- পরাজয়ের সাথিকে বসে থাকতে দেখে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না যে সে কষ্ট করে এই প্রচেষ্টা করেছে তার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের জন্য, কিন্তু যখন তার আসার আসল কারণ জানতে পারে, তখন তাকে কর্মশালা থেকে বের করে দেয়।

‘বহু দেরিতে বুঝলাম’, তাকে বলে, ‘গুলি করে মেরে ফেলতে দিলেই তোর বড় এক উপকার করতাম।’

এভাবেই পরিবারের কোনো সদস্যের উপস্থিতি ছাড়াই পঞ্চাশ বর্ষপূর্তি উৎসব পালিত হয়। ঘটনাক্রমে সেটা ছিল কার্নিভালের সপ্তাহ আর কেউই কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মাথা থেকে সরাতে পারে না যে এই কাকতালীয় ব্যাপারটাও সরকারের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী করা হয়েছে, বিদ্রূপটার নিষ্ঠুরতাকে আরও তীব্র করার জন্য। নিঃসঙ্গ কর্মশালা থেকে সে শোনে মার্চের সংগীত, গোলন্দাজদের কামানধ্বনি। তার চোখ ভিজে আসে অক্ষমতার প্রচণ্ড ক্রোধে আর পরাজয়ের পর এই প্রথমবার তাকে পীড়া দেয় যে তার আর রক্ষণশীল সরকারের শেষ পদচিহ্নটুকু মুছে ফেলার জন্য যুদ্ধ বাধানোর মতো যৌবনের সেই তেজটা আর নেই। শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অনুষ্ঠানের প্রতিধ্বনি তখন নিভে যায় নি যখন উরসুলা কর্মশালার দরজা থেকে ডাকে।

‘আমায় বিরক্ত কোরো না’, বলে সে, ‘আমি ব্যস্ত।’

‘দরজা খোলো’ জোর করে উরসুলা তার স্বাভাবিক স্বরে, ‘এর সঙ্গে উৎসবের কোনো সম্পর্ক নেই।’

দরজার আগল খোলে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া আর দেখে দরজায় দাঁড়িয়ে যত রকমের ভিন্ন চেহারার মানুষ হতে পারে, তেমনি বিভিন্ন চেহারার সতেরো জন লোক সব ধরনের, সব বর্ণের, কিন্তু সবার চেহারাতেই লেগে আছে এক নিঃসঙ্গতার বাতাস, যা দিয়ে পৃথিবীর যেকোনো জায়গাতেই তাদের পরিচয় জানার জন্য যথেষ্ট। সবাই ছিল তার ছেলে। কেউই আগে থেকে একমত না হয়ে একে অপরকে না চিনে পঞ্চাশ বছর পূর্তির কথা শুনে উপকূলের দূরতম প্রান্ত থেকে চলে এসেছে। সবাই আউরেলিয়ানো নামের গৌরব ও মায়ের পদবি গর্বের সঙ্গে ধারণ করছে। উরসুলা পরিতৃপ্তি আর ফের্নান্দার ক্ষুব্ধতার কারণ হয়ে যে তিন দিন ওরা বাড়িতে ছিল, সে কয়দিন ওরা যুদ্ধের বিশৃঙ্খলা তৈরি করে বাড়িজুড়ে। আমারান্তা পুরোনো কাগজপত্রের মধ্য থেকে খুঁজে বের করে খাতাটা, যেটায় উরসুলা লিখে রেখেছিল সবার নাম, জন্মতারিখ, ব্যাপটাইজ করার তারিখ আর সে প্রত্যেক নামের সামনে নির্দিষ্ট জায়গায় লিখে রাখে সবার বর্তমান ঠিকানা। বিশ বছরব্যাপী যুদ্ধের সারমর্ম হতে পারত তালিকাটা। একুশ জন লোককে নেতৃত্ব দিয়ে ভোরে এক অবাস্তব বিদ্রোহের জন্য মাকন্দ ত্যাগ করে শুকনো রক্তে শক্ত হয়ে যাওয়া কম্বল মুড়ি দিয়ে শেষবার ফিরে আসা পর্যন্ত কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার ভ্রমণসূচি তৈরি করা যেত তালিকাটা থেকে। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো জ্ঞাতিভাইদের আগমন উপলক্ষে শ্যাম্পেন আর অ্যাকর্ডিয়ান দিয়ে এক কোলাহলপূর্ণ উৎসব করার সুযোগ নষ্ট করে না আর সেটাকে সে ব্যাখ্যা করে পঞ্চাশ বছর পূর্তি উৎসবের কারণে নিষ্প্রভ কার্নিভালের বিলম্বিত অভিযোজন হিসেবে। অর্ধেক বাসনকোসন ভেঙে ফেলে ওরা এক ষাঁড়কে বাগে আনতে, তাড়া করে ধ্বংস করে গোলাপের ঝাড়, গুলি করে মারে মুরগিগুলো। আমারান্তাকে বাধ্য করে পিয়েত্র ক্রেসপির বিষণ্ণ ওয়ালটজ নাচতে, রেমেদিওস লা বেইয়্যাকে পুরুষদের প্যান্ট পরিয়ে তেল মাখানো খুঁটি বেয়ে উঠতে আর রান্নাঘরে ছেড়ে দেয় চর্বিমাখা এক শূকর, যেটা ফের্নান্দাকে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়ায় কিন্তু কেউই অনাসৃষ্টি নিয়ে অনুশোচনা করে না, কারণ বাড়ি কেঁপে ওঠে ভালো স্বাস্থ্যের ভূমিকম্পে। কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া প্রথম দিকে ওদের অবিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করলেও, কারও কারও সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহ করলেও ওদের উন্মত্ততা উপভোগ করে আর ওরা ফিরে যাওয়ার আগে প্রত্যেককে একটি করে সোনার ছোট মাছ উপহার দেয়। এমনকি শান্তশিষ্ট হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো পর্যন্ত এক মোরগ লড়াইয়ের বিকেলের প্রস্তাব করে আর ব্যাপারটা করুণ পরিণতি নিয়ে শেষ হওয়ার উপক্রম হয়, কারণ আউরেলিয়ানোদের মধ্যে অনেকেই মোরগ লড়াইয়ের বিষয়ে এতই অভিজ্ঞ যে প্রথমবারই ফাদার অ্যান্তনিও ইসাবেলের চাতুরী ধরে ফেলে। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো এই আত্মীয়তার মধ্যে দেখতে পায় পার্টি করার অসীম সম্ভাবনা আর ঠিক করে সবাই তার সঙ্গে কাজ করতে থেকে যাবে। একমাত্র যে রাজি হয়, সে হচ্ছে দাদার মতো অভিযানপ্রিয় বিশালদেহী মুলাতো আউরেলিয়ানো ত্রিস্তে, যে নাকি এরই মধ্যে অর্ধেক পৃথিবীতে ভাগ্য পরীক্ষা করে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে যেকোনো জায়গাই তার কাছে সমান। অন্য সবাই কুমার থাকা সত্ত্বেও মনে করত তাদের ভাগ্য সমন্ধে তারা সজ্ঞান। সবাই ছিল দক্ষ কারিগর, বাড়ির প্রতি টান থাকা শান্তিপ্রিয় লোক। উপকূলে উধাও হওয়ার আগেই ‘ছাইয়ের বুধবার (খ্রিষ্টধর্মীয় পবিত্র দিন) ওদের রোববারের পোশাক পরিয়ে গির্জায় নিয়ে যেতে সমর্থ হয়। ধর্মীয় বিশ্বাসের চাইতেও বেশি মজা পেয়ে তাদের বেদির রেলিং পর্যন্ত নিয়ে যেতে দেয়, যেখানে ফাদার অ্যান্তনিও ইসাবেল ওদের কপালে ছাইয়ের ক্রসচিহ্ন একে দেয়। বাড়িতে ফেরার পর যখন ওদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট জন কপালের চিহ্ন পরিষ্কার করতে যায়, তখন দেখতে পায়, জায়গাটা মোছার অযোগ্য, যা তার অন্য সব ভাইয়ের বেলায়ও ঘটে একই রকম। ওরা চেষ্টা করে সাবান ও পানি দিয়ে, মাটি ও ছোবা দিয়ে শেষ পর্যন্ত ঝামা পাথর ও ক্ষার দিয়ে, কিন্তু কপালের দাগ মুছতে পারে না। অন্যদিকে আমারান্তাসহ অন্যরা কোনো সমস্যা ছাড়াই দাগ মুছে ফেলতে পারে। ‘এভাবে ফেরাই মঙ্গলকর’, বলে বিদায় দেয় উরসুলা। ‘এখন থেকে ভবিষ্যতে আর কারোরই তাদের পরিচিতি সমন্ধে সন্দেহ থাকবে না।’ দল বেঁধে যায় ওরা পেছনে অনুসরণকৃত বাদকদল নিয়ে। পোড়ে বাজি আর গ্রামে এমন এক ধারণা রেখে যায় যে বুয়েন্দিয়া দলের বীজ অনেক শতাব্দী পর্যন্ত টিকে থাকবে। কপালে ছাইয়ের ক্রসচিহ্নওয়ালা আউরেলিয়ানো ত্রিস্তে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার উদ্ভাবকের বিকারগ্রস্ত অবস্থায় স্বপ্নে দেখা বরফকল স্থাপন করে গ্রামের বাইরে।

অনেক মাস পর যখন সে সবার কাছেই পরিচিত ও সমাদৃত আউরেলিয়ানো ত্রিস্তে ও তার মা এবং এক কুমারী বোনকে (যে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মেয়ে না) মাকন্দে নিয়ে যেতে বাড়ি খুঁজতে থাকে আর প্লাজার কোনায় পরিত্যক্ত বলে মনে হয়, এমন এক জরাজীর্ণ বাড়ির প্রতি আকৃষ্ট হয়। মালিক সম্বন্ধে খোঁজ নেয়। কেউ একজন বলে বাড়িটা কারোরই না, সেখানে অন্য সময়ে মাটি আর দেয়ালের চুন খাওয়া এক নিঃসঙ্গ বিধবা বাস করত, যাকে শেষের বছরগুলোতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ফুল দিয়ে বানানো টুপি মাথায় প্রাচীন রুপোর জুতো পায়ে শুধু দুবার দেখা যায় প্লাজা পার হয়ে বিশপের কাছে চিঠি পাঠানোর জন্য পোস্ট অফিস পর্যন্ত যেতে। ওকে বলা হলো যে তার একমাত্র সঙ্গী ছিল নিষ্ঠুর এক পরিচারিকা, যে বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলত কুকুর-বিড়াল অথবা কোনো জন্তু-জানোয়ার আর মৃত প্রাণী ফেলে রাখত রাস্তার মাঝখানে পচা দুর্গন্ধে গ্রামের লোকদের অতিষ্ঠ করার জন্য। সূর্যের তাপে সর্বশেষ প্রাণীটার চামড়া শুকিয়ে জমিতে পরিণত হওয়ার পর এত দীর্ঘ সময় কেটে গেছে যে সবাই ধরে নিয়েছে বাড়ির মালিক ও পরিচারিকা যুদ্ধ শেষ হওয়ার অনেক আগেই মারা গিয়েছে আর বাড়িটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে, কারণ ইদানীংকার বছরগুলোতে আর এমন তীব্র শীত বা কোনো বিধ্বংসী বাতাস বয়ে যায় নি। মরিচায় টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া কবজাগুলো দরজাগুলোকে কোনো রকমে ধরে রেখেছে। এত দিনের জমে থাকা মাকড়সার জাল জানালাগুলো ঝালাই করে দিয়েছে। ভেজা আবহাওয়া বন্য ফুল আর ঘাসে চিড় ধরেছে মেঝে আর যে মেঝের ফাটলে বাসা বেঁধেছে গিরগিটি ও রাজ্যের সব কীটপতঙ্গ, যা নাকি নিশ্চিত করে ওখানে অন্তত পক্ষে গত পঞ্চাশ বছর কোনো মানুষ বাস করে নি।

আবেগতাড়িত আউরেলিয়ানো ত্রিস্তের ভেতরে প্রবেশের জন্য এত সব প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে না। কাঁধ দিয়ে সদর দরজা ঠেলা দিলে কাঠের ফুটোওয়ালা কাঠামোটা ভেঙে পড়ে নিঃশব্দে আর সৃষ্টি করে উইপোকার বাসার মাটি ও ধুলোর এক মহাপ্রলয়। আউরেলিয়ানো ত্রিস্তে ধুলোর মেঘ পরিষ্কার হওয়ার অপেক্ষায় দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকে আর দেখতে পায় বসার ঘরের কেন্দ্রে তখনো গত শতাব্দীর পোশাক পরিহিতা নোংরা এক মহিলাকে, যার চুলহীন মাথায় গুটিকয়েক হলুদ সুতো, বড় বড় চোখগুলো এখনো সুন্দর, যেগুলোর মধ্যে নিভে গিয়েছে আশার শেষ নক্ষত্রগুলো, আর মুখের চামড়ায় ফাটল ধরেছে নিঃসঙ্গতার উষ্ণতা। অন্য জগতের দৃশ্যে স্তম্ভিত আউরেলিয়ানো ত্রিস্তে কোনো রকমে খেয়াল করে যে মহিলা তার দিকে তাক করে আছে এক সেকেলে মিলিটারি পিস্তল।

‘দুঃখিত’, ফিসফিসায়।

মহিলা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে টুকিটাকি জিনিসপত্রে ভরা বসার ঘরের কেন্দ্রে আর পরখ করে চওড়া কাঁধ ও কপালে উল্কি আঁকা দৈত্যটাকেও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আর ধুলোর তমসার মধ্য দিয়ে দেখতে পায় অন্য সময়ের কাউকে কুয়াশার ভেতর দিয়ে দোনলা এক শটগান কাঁধের ওপর ফেলে হাতে একজোড়া খরগোশ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে, ‘ঈশ্বরের দোহাই’, অনুচ্চ স্বরে আকুতি করে, ‘এই সময়ে আমাকে এই স্মৃতি মনে করিয়ে দেওয়া একেবারেই অনুচিত।

‘বাড়িটা ভাড়া নিতে চাই’, বলে আউরেলিয়ানো ত্রিস্তে। মহিলা পিস্তলটা উঠিয়ে ছাইয়ের ক্রসের ওপর দৃঢ় হাতে তাক করে ট্রিগারের ওপর আঙুল রাখে এক অটল সংকল্প নিয়ে।

‘বেরিয়ে যা’, আদেশ দেয়।

ওই রাতে রাতের খাবারের টেবিলে ঘটনাটা খুলে বলে আউরেলিয়ানো ত্রিস্তে আর উরসুলা কেঁদে ফেলে হতাশায়। ‘ঈশ্বর’ -দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে ‘এখনো সে বেঁচে আছে!’ সময়, যুদ্ধ, নিত্যনৈমিত্তিক অগুনতি দুর্ঘটনা তাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল রেবেকার কথা, একমাত্র যে নাকি তার বিবেকের মাঝে জীবন্ত ও শুয়োপোকার মধ্যে পচতে থাকা রেবেকাকে এক মুহূর্তের জন্যও সরাতে পারে নি, সে হচ্ছে আমারান্তা। ঘুম থেকে জেগেই তার কথা ভাবত আমারান্তা। ভাবত নিঃসঙ্গ বিছানায় বুকের মাঝে বরফ নিয়ে জেগে ওঠে, ভাবত তুবড়ানো স্তনগুলোতে যখন সাবান মাখাত, মাখাত শীর্ণ পেটে। যখন লিলেনের স্কার্ট ও কাঁচুলি পরত, আর ভাবত, যখন হাত থেকে বদলাত নিদারুণ প্রায়শ্চিত্তের কালো ব্যান্ডেজ। সর্বক্ষণ, প্রতি মুহূর্তে। ঘুমন্ত বা জাগ্রত অবস্থায়, জীবন তার হৃদয়ে যে স্মৃতিকাতরতার এক দঙ্গল আবর্জনা জমিয়ে তুলেছে, তার সবগুলো পুড়িয়ে ফেলে শুধু সবচেয়ে তিক্তটাকে বেছে নিয়ে, শুদ্ধ করে মহিমান্বিত ও শাশ্বত করে তুলেছে। ওর কারণেই রেমেদিওস লা বেইয়্যা রেবেকার অস্তিত্বের কথা জানত। প্রতিবারই যখন ওরা জরাজীর্ণ বাড়িটার পাশ দিয়ে যেত, ওকে বলত অপ্রীতিকর ঘটনাটা, বলত এক লজ্জাজনক গল্প, চেষ্টা করত ভাইজির সঙ্গে তার জমা হয়ে থাকা বিদ্বেষটাকে এভাবেই ভাগাভাগি করে নিতে, যাতে মৃত্যুর পরও বিদ্বেষটা বেঁচে থাকে। কিন্তু তার ইচ্ছা পূরণ হয় না। কারণ রেমেদিওস ছিল সব ধরনের আবেগ থেকে বিমুক্ত আর সে আবেগ অন্যের হলে তো কথাই নেই। আর অন্যদিকে উরসুলা যে যন্ত্রণা ভোগ করেছে, তা আমারান্তার সম্পূর্ণ উল্টো, তার ভেতরে রেবেকার স্মৃতি মলিনতাহীন পরিষ্কার: বাবা মায়ের হাড়গোড়ের থলেসহ যে দুঃখী মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল। এই প্রতিচ্ছবি ম্লান করে দিয়েছে সেই অপরাধের প্রতিচ্ছবিকে যে অপরাধের ফলে রেবেকাকে আর বংশের একজন হিসেবে গ্রহণ করা হয় নি। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো মনে করে, তাকে বাড়িতে নিয়ে এসে দেখাশোনা করা উচিত কিন্তু তার এই সদিচ্ছা ব্যর্থ হয় রেবেকার অনমনীয় আপসবিমুখ ব্যবহারে। বহু বছরের দুর্ভাগ্য আর দুঃখ-কষ্টে ভোগার বদলে সে নিঃসঙ্গতার বিশেষ সুবিধেগুলো জয় করতে পেরেছে, আর সে কোনোভাবেই এই সুবিধেগুলো ত্যাগ করতে রাজি নয় বদান্যতার মিথ্যে আকর্ষণের এক বিশৃঙ্খল বার্ধক্যের বদলে।

ফেব্রুয়ারিতে, তখনো কপালে ছাইয়ের ক্রস নিয়ে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার ষোলো জন ছেলে আবার ফিরে আসে, আউরেলিয়ানো ত্রিস্তে উৎসবের হইচইয়ের মধ্যে রেবেকার কথা বলে আর সবাই মিলে অর্ধেক দিনের মধ্যেই বাড়ির চেহারা ফিরিয়ে দেয় দরজা-জানালা বদলে সামনেরটায় আনন্দদায়ক উজ্জ্বল রং লাগিয়ে, দেয়ালগুলো ঠিক করে মেঝেতে নতুন সিমেন্ট ঢেলে। কিন্তু বাড়ির ভেতরটা পুনর্নির্মাণ করার অনুমতি পায় না তারা। রেবেকা এমনকি দরজার কাছেও ঘেঁষে না। সে এই পাগলাটে পুনর্নির্মাণ করাটা শেষ করতে দেয়, পরে খরচের একটা হিসেব করে অঙ্কটা তখন পর্যন্ত তাকে সঙ্গ দেওয়া পুরোনো পরিচারিকা আরহেনিদার হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেয়, মুঠোভর্তি মুদ্রাগুলো যেগুলো শেষ যুদ্ধের সময় থেকে বাতিল করা হয়েছিল, যদিও রেবেকা বিশ্বাস করত, তখন পর্যন্ত সেগুলো চালুই আছে, আর একমাত্র তখনই বোঝা যায় যে বিশ্বসংসারের সঙ্গে তার এই বিচ্ছেদ কোন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। আরও বুঝতে পারে যে জীবনের শেষনিশ্বাস থাকা পর্যন্ত তাকে এই একগুঁয়েমি থেকে মুক্ত করা অসম্ভব।

মাকন্দে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার ছেলেরা দ্বিতীয়বার ফিরে আসার সময় ওদের মধ্যে আরেকজন আউরেলিয়ানো থেকে যায় আউরেলিয়ানো ত্রিস্তের সঙ্গে কাজ করার জন্য, সে ছিল ব্যাপটাইজ করতে আসার সময়ের প্রথম দিককার একজন, আর উরসুলা ও আমারান্তা ওর কথা ভালোভাবেই মনে রেখেছে, কারণ কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হাতের কাছে পাওয়া সবকিছু সে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। সময় তার প্রথম দিককার বেড়ে ওঠার আবেগকে বাগে এনেছে। সে ছিল মুখে বসন্তের দাগওয়ালা মাঝারি উচ্চতার মানুষ কিন্তু ধ্বংস করার আশ্চর্য ক্ষমতাটা তার হাতে অটুটই রয়ে গিয়েছে। সে এত বাসনকোসন ভাঙে, এমনকি না ছুঁয়েও যে ফের্নান্দা ঠিক করে তার মূল্যবান বাসনগুলো ভেঙে ফেলার আগেই তাকে এক সেট টিনের বাসনকোসন কিনে দিতে হবে, যদিও শেষ পর্যন্ত ওই ধাতব শক্ত সেটটাও অল্প কদিনের মধ্যে ট্যাপ খেয়ে বাঁকাচোরা হয়ে পড়ে। কিন্তু অনারোগ্য সেই ধ্বংস করার ক্ষমতা যেটা ছিল, তার নিজের কাছেও অবসাদগ্রস্ত, তার বদলে ছেলেটার ছিল প্রচণ্ড আন্তরিকতায় তাৎক্ষণিকভাবে মানুষের ভরসা অর্জনের ও কাজ করার প্রচণ্ড ক্ষমতা। অল্প সময়ের মধ্যে বরফের উৎপাদন এমনভাবে বেড়ে যায় যে তা স্থানীয় বাজারের চাহিদা মেটানোর পরও উদ্বৃত্ত থাকে, ফলে আউরেলিয়ানো ত্রিস্তের জলাভূমির অন্যান্য লোকবসতিতেও ব্যবসার প্রসার ঘটানোর সম্ভাবনার কথা ভাবতে হয়। ওই সময়ই সে পদক্ষেপ নেয় শুধু তার কারখানা আধুনিকীকরণের জন্যই নয়, বরং গ্রামটাকে পৃথিবীর অন্য অংশের সঙ্গে জুড়ে দিতে।

‘রেলপথ নিয়ে আসতে হবে’, বলে।

শব্দটা মাকন্দে এই প্রথম শোনা যায়। টেবিলের ওপর আউরেলিয়ানো ত্রিস্তে যে নকশা আঁকে, সেটা ছিল হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার সৌরযুদ্ধের প্রকল্পের জন্য আঁকা নকশার প্রত্যক্ষ উত্তরসূরি আর তাই দেখে উরসুলা নিশ্চিত হয় যে সময়টা বৃত্তাকারে ঘুরছে। কিন্তু দাদার উল্টো, আউরেলিয়ানো ত্রিস্তের ঘুমের ইচ্ছা নষ্ট হয় না, এমনকি খাবার ইচ্ছাও নয়; সে মেজাজ খারাপ করে কাউকে উত্ত্যক্তও করে না, বরং পরিষ্কার দেখতে পায়, সেটাকে তাৎক্ষণিক ফলদায়ক এক প্রকল্পের সম্ভাবনা হিসেবে আর বাস্তব বুদ্ধি দিয়ে সময় ও খরচের হিসাব করে আর সেগুলো বাস্তবায়ন করে এর মাঝে কোনো উত্তেজনার অবকাশ না রেখে। পরদাদার কাছ থেকে পাওয়া, যেটা কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মধ্যে অভাব ছিল, সেটা ছিল অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে সে ছিল প্রচণ্ড আগ্রহী। ফলে অবলীলায় সে অর্থ নিয়োগ করে রেলপথের ব্যাপারে যেমনটি করেছিল ভাইয়ের উদ্ভট নৌপথ কোম্পানির জন্য। আউরেলিয়ানো ত্রিস্তে দিনপঞ্জী দেখে রওনা হয় বুধবার দিন, বৃষ্টির মৌসুম পার করে ফিরে আসার ইচ্ছা নিয়ে। ওর আর কোনো খবর পাওয়া যায় না। কারখানার পর্যাপ্ত উন্নতিতে অভিভূত আউরেলিয়ানো সেন্তেনো পানির বদলে ফলের রসকে মূল উপকরণ বানিয়ে বরফ বানানোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা আরম্ভ করে দেয়, আর নিজের অজান্তেই এমনকি কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই পেয়ে যায় আইসক্রিম উদ্ভাবনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলসূত্র। সে ভাবছিল, এভাবেই কারখানাটাকে বহুমুখী করা যাবে। সে কারখানাটা তার বলেই ধরে নেয়, কারণ বৃষ্টির মৌসুম পার হয়ে গেলেও ভাইয়ের ফেরার কোনো লক্ষণ ছিল না, এমনকি এক সম্পূর্ণ গ্রীষ্ম পার হয় খবরবিহীন। আরেক শীতের প্রারম্ভে যখন দিনের সবচেয়ে গরমের সময় এক মেয়ে নদীতে কাপড় কাচছিল, হঠাৎ করে ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করে সদর রাস্তা পার হয়। –’ওই আসছে’, কোনোভাবে বলতে পারে, ‘ভয়ানক রান্নাঘরের মতো কিছু একটা গোটা এক গ্রামকেই টেনে নিয়ে আসছে।’

এই সময় জনবসতি কেঁপে ওঠে এক ভয়ংকর শিস ও প্রচণ্ড হাঁপানির শব্দের শ্বাসপ্রশ্বাসের প্রতিধ্বনিতে। আগের সপ্তাহগুলোতে দেখা যাচ্ছিল একদল লোককে রেললাইন ও স্লিপার পাততে কিন্তু কেউ তাতে আমল দেয়নি, কারণ ভেবেছিল এটি হচ্ছে জিপসিদের নতুন কোনো কারসাজি, যেখানে ওরা শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে ফিরে আসবে, আর ‘দে-রে-দে’ শিস ও ঝুমঝুমি বাজাতে বাজাতে ঘোষণা করবে অভূতপূর্ব সমস্ত জিনিসপত্রের আর কেই-বা জানবে কোন গাধা জেরুজালেমের প্রতিভাবান ব্যক্তি ‘হারাপেয়্যিনসোস’, (গ্যাব্রিয়েলের আবিষ্কৃত শব্দ) সেটা বানিয়েছে। কিন্তু যখন ট্রেনের সিটির ও বাষ্পের আওয়াজ সামলে ওঠে সমস্ত বাসিন্দা রাস্তায় নেমে আসে, দেখতে পায় আউরেলিয়ানো ত্রিস্তে বাষ্পীয় ইঞ্জিন থেকে হাত নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছে আর দেখা যায় পরিকল্পনা থেকে আট মাস পিছিয়ে আসা ফুল দিয়ে ঢাকা মাকন্দে আসা প্রথম ট্রেনটাকে। সেই নিষ্পাপ হলুদ ট্রেনটা যেটা মাকন্দে নিয়ে আসবে কত না অনিশ্চয়তা ও স্বচ্ছতা, কত না আনন্দ ও বেদনা, কত না পরিবর্তন, বিপর্যয় ও স্মৃতিকাতরতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *