১৮
দীর্ঘদিন মেলকিয়াদেসের ঘর থেকে বেরোয় না আউরেলিয়ানো। খুলে খসে যাওয়া পাতার উদ্ভট কিংবদন্তির বইগুলো মুখস্থ করে ফেলে সে, মুখস্থ করে এল তুয়্যিদো (El tullido) নামক এরমান—(IBermann Von Rachenau – 1013-1054)-এর গবেষণা পুস্তকের সারমর্ম, ব্ল্যাক আর্টের ওপর লেখা টীকা-টিপ্পনী, পরশপাথর বানানোর চাবিকাঠি, নস্ত্রাদামুসের শতাব্দী ও তার প্লেগের ওপর গবেষণা, ফলে সে সমকালের কিছুই না জেনে পৌঁছে যায় বয়ঃসন্ধিতে কিন্তু তার আয়ত্তে আসে মধ্যযুগের এক বয়স্ক মানুষের সমান জ্ঞান। সান্তা সেফিয়া দেলা পিয়েদাদ যেকোনো সময় ঘরে ঢুকলেই পড়ায় নিমগ্ন অবস্থায় দেখতে পেত ওকে। সকালে ওর জন্য নিয়ে যেত আউরেলিয়ানো সেগুন্দো মারা যাওয়ার পর একমাত্র যা খেত চিনি ছাড়া এক কাপ কফি আর মধ্যবেলায় কলার টুকরো ভাজা দিয়ে এক থালা ভাত।
সান্তা সোফিয়া দেলা পিয়েদাদ সব সময় নজর রাখত ওর চুল কাটা ও মাথার উকুন নিয়ে, আর ওকে এনে দিত তোরঙ্গের তলায় বিস্মৃত কাপড়চোপড়, পুরোনো জামা, আর গোঁফ উঠতে শুরু করলে এনে দিত ক্ষুর ও কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার ব্যবহৃত লাউয়ের খোলের মগ ফেনা ওঠানোর জন্য। ওর সঙ্গে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার যতটা মিল ছিল, ততটা তার নিজের দুই ছেলেদেরও ছিল না, বিশেষ করে চোখের নিচের প্রকট হয়ে ওঠা হনু, মুখে দৃঢ়তার রেখা ও খানিকটা নিষ্ঠুরতা মাখানো ঠোঁটজোড়া। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো যখন পড়ত, তখন উরসুলার বেলায় যা ঘটেছিল, একই রকম ঘটে সান্তা সোফিয়া দেলা পিয়েদাদের বেলায়। সে মনে করে, আউরেলিয়ানো আপন মনে কথা বলছে। আসলে সে আলাপ করছিল মেলকিয়াদেসের সঙ্গে। প্রচণ্ড গরমের এক দুপুরে, যমজ দুভাইয়ের মৃত্যুর পরপর আউরেলিয়ানো দেখতে পায় কাকের ডানার মতো টুপিসহ বৃদ্ধ লোকটিকে জানালার আলোর প্রতিফলনে, যেমনটি ওর স্মৃতিতে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল ওর জন্মেরও বহু আগে থেকে। তত দিনে আউরেলিয়ানো পার্চমেন্টের বর্ণমালার শ্রেণিবিন্যাস শেষ করেছে। ফলে মেলকিয়াদেস কোন ভাষায় ওগুলো লেখা জানতে পেরেছে কি না, জিজ্ঞেস করলে ও উত্তর দিতে দেরি করে না। ‘সংস্কৃতে’, বলে।
মেলকিয়াদেস ওকে খুলে বলে যে তার এই ঘরে ফিরে আসার সুযোগ হাতে গোনা। কিন্তু সে নিশ্চিন্তে পরম মৃত্যুর চারণভূমিতে যাবে, কারণ পার্চমেন্টের শত বছর পূর্ণ হতে যে সময় বাকি আছে, তার মধ্যেই আউরেলিয়ানোর পক্ষে সংস্কৃত শেখা সম্ভব হবে ও ওটার পাঠোদ্ধার করতে পারবে।
মেলকিয়াদেসই ওকে বলে দেয় যে গলির মুখে নদীটা শেষ হয়েছে, যেখানে কলা কোম্পানির সময়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা হতো ও স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিত সেখানের জ্ঞানী কাতালিয়নোর বইয়ের দোকানে আছে সংস্কৃতের প্রথম পাঠ নামে এক বই, যেটা দ্রুত না কিনে নিলে ছয় বছরের মধ্যেই পোকার পেটে চলে যাবে। সান্তা সোফিয়ার দীর্ঘ জীবনে প্রথমবারের মতো চেহারায় এক অনুভূতি ফুটে ওঠে, যেটা ছিল বিস্ময়ের, যখন আউরেলিয়ানো তাকে বইয়ের তাকগুলোর একবারে ডান দিকের দ্বিতীয় সারিতে রাখা মুক্ত জেরুজালেম ও মিল্টনের কবিতার বইয়ের মাঝখানের বইটা নিয়ে আসতে বলে। যেহেতু সে পড়তে জানত না, সেহেতু আউরেলিয়ানোর কথাগুলো মুখস্থ করে নেয় আর রৌপ্যশালায় তখনো অবশিষ্ট সতেরোটি সোনার ছোট মাছের একটি বিক্রি করে টাকা জোগাড় করে যে মাছগুলোর অবস্থানের খবর বাড়িতে সৈন্যদের তল্লাশির সময় থেকে শুধু আউরেলিয়ানো ও সে জানত।
সংস্কৃত পাঠে এগিয়ে চলে আউরেলিয়ানো আর মেলকিয়াদেসের আসা-যাওয়া ক্রমশই কমতে কমতে প্রতিবারের মাঝের দূরত্ব বাড়তে বাড়তে মিলিয়ে যায় মধ্যদিনের উজ্জ্বল আলোয়। শেষ যেবার আউরেলিয়ানো ওর অস্তিত্ব অনুভব করে, তখন তার উপস্থিতি ছিল প্রায় অদৃশ্য, যেখান থেকে বিড়বিড়িয়ে বলছিল, ‘জ্বরে আক্রান্ত হয়ে সিঙ্গাপুরের বেলাভূমিতে মৃত্যু হয়েছে আমার।’ ফলে ঘরটি ধুলোবালি, নরম, উইপোকা, লাল পিঁপড়ের আক্রমণের সামনে দুর্বল হয়ে পড়ে, যার ফলে পার্চমেন্টের ও বইগুলোর জ্ঞানকে মথপোকাগুলো কাঠের ভুষিতে পরিণত করবে।
বাড়িতে খাবারের অভাব ছিল না। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো মারা যাওয়ার পরদিন এক বন্ধু, যে কিনা উপেক্ষাসহকারে করোনা (ফুলের শক্ত মালা) নিয়ে গিয়েছিল, সে ফের্নান্দাকে তার স্বামীর কাছ থেকে ধার বাবদ নেওয়া কিছু টাকা ফেরত দেয়। সে সময় থেকে এক বাহক ছেলে প্রতি বুধবার এক ঝুড়ি খাবার পৌঁছে দিত, যা দিয়ে এক সপ্তাহ চলে যেত। যে তাকে অপমান করেছিল, তাকে নিরন্তর অপমান করার একধরনের উপায় মনে করে পেত্রা কতেস এই খাদ্যসম্ভার পাঠাত আর কেউই জানত না কে এসব পাঠাত। তা সত্ত্বেও বিদ্বেষটা মিলিয়ে যায় সে যা আশা করছিল, তার অনেক আগেই, আর ফলে খাদ্য পাঠাতে থাকে এক অহংকার থেকে আর শেষমেশ সহানুভূতির কারণে। অনেকবারই যখন লটারি করার মতো উৎসাহ থাকত না বা লোকজন হারিয়ে ফেলে লটারির প্রতি আগ্রহ; সে না খেয়ে থাকত, যাতে করে ফের্নান্দা খেতে পায় আর এভাবেই ফের্নান্দার শবযাত্রা দেখার আগ পর্যন্ত সে এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে চলে।
বাড়িতে এই লোকসংখ্যা কমে যাওয়াটা দাঁড়ায় আধা শতাব্দী কাজ করার পর এক বিশ্রামের মতো। এই নিঃশব্দসঞ্চারী দুর্ভেদ্য মহিলা, যে নাকি এই পরিবারে রেমেদিওসের মতো ঐশ্বরিক ও হোসে আকার্দিও সেগুন্দোর মতো রহস্যময় ব্যক্তিত্বের বীজ বপন করেছিল; যে গোটা জীবন কাটিয়েছে নিঃসঙ্গ, যে নিঃশব্দে নিজেকে উৎসর্গ করেছিল বাচ্চাদের মানুষ করার কাজে, যাদের সে তার নিজের ছেলেমেয়ে কি না বা তার নাতি- নাতনি কি না, তা কোনো রকমে মনে করতে পারত, যে কিনা আউরেলিয়ানোকে লালন করেছিল নিজের গর্ভের সন্তানের মতো, সে যে তার নানার মা তা না জেনেই, আর সেই মহিলা কোনো দিন কোনো কাজে আপত্তি তুলে টু শব্দটিও করে নি। শুধু তার পক্ষেই সম্ভব ছিল এক বাড়িতে ভাঁড়ার ঘরের মেঝেতে, ইঁদুরের হইহল্লার মাঝে মাদুর পেতে ঘুমানো। এক রাতে অন্ধকারে কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে এই অনুভূতি নিয়ে জেগে উঠে দেখে যে এক বিষধর সাপ তার পেটের ওপর দিয়ে পিছলে যাচ্ছে, যে কথা সে কাউকেই বলে নি। সে জানত, যদি কথাটা উরসুলাকে বলে, তাহলে উরসুলা তাকে নিজের বিছানায় শুতে বাধ্য করত, আর তখন এমন সময় ছিল যে বারান্দায় চিৎকার করে না বললে কেউই কোনো কিছু জানতে পারত না, কারণ বেকারি চালানোর হট্টগোল, যুদ্ধের ত্রাস ও বাচ্চাকাচ্চা দেখাশোনার কাজ কাউকে অন্যের সুখ-শান্তি নিয়ে ভাবার জন্য কোনো সময় দিত না, যাকে সে কোনো দিনই দেখে নি সেই পেত্রা কতেসই ছিল একমাত্র মানুষ যে তাকে মনে রেখেছিল। সব সময়ই যে খেয়াল রাখত যাতে করে বাইরে বের হওয়ার জন্য তার একজোড়া ভালো জুতো থাকে, যাতে করে কখনোই এক সেট স্যুটের অভাব না হয়, এমনকি যখন লটারির টাকা দিয়ে সম্পূর্ণ ভেলকি দেখানোর মতো অসম্ভবকে সম্ভব করতে হতো। যখন ফের্নান্দা এ বাড়িতে আসে, তখন সে যে এক চিরস্থায়ী দাসী, তা ভাবার যথেষ্ট কারণ ছিল, যদিও অনেকবারই তার কানে গিয়েছে যে সে হচ্ছে তার স্বামীর মা আর ব্যাপারটা এতই অবিশ্বাস্য ছিল যে কথাটা ভুলে যাওয়ার চাইতে বরং আরও বেশি সময় লাগত কথাটা শোনার জন্য। এই হীন অবস্থানের জন্য সান্তা সোফিয়া দেলা পিয়েদাদ যে বিরক্ত হয়েছে, তা কখনোই মনে হয় নি। বরং উল্টো মনে হতো তার ভালো লাগে বাড়ির কোনা ঘুপচিতে ঘুরে বেড়াতে, কোনো রকমের অভিযোগ না তুলে, কোনো উচ্চবাচ্য না করে, বিশাল বাড়িটাকে সাফসুতরো করে গুছিয়ে রাখতে। যে বাড়িতে তার বয়ঃসন্ধি কেটেছে, বিশেষ করে যে বাড়িটাকে কলা কোম্পানির সময়ে বাড়ির চেয়েও মনে হতো সেনাছাউনি বলে। কিন্তু উরসুলার মৃত্যুর পর তার এই অতিমানবিক ও অসাধারণ কাজ করার ক্ষমতায় ভাঙন ধরে। শুধু ক্লান্ত ও বুড়ো হয়ে যাওয়ার কারণে নয়, বরং গোটা বাড়িটাই যেন রাতারাতি পড়ে গেছে বার্ধক্যের সংকটে। কোমল শেওলা জমে ওঠে দেয়ালের গায়ে, উঠানে আর যখন খালি জায়গা থাকে না, তখন বারান্দার সিমেন্টকে কাচের মতো ভেঙে গুঁড়িয়ে তার ফাটল থেকে বেরিয়ে আসে প্রায় একই রকমের ছোট ছোট হলুদ ফুল, যা উরসুলা এক শতাব্দী আগে দেখেছিল গ্লাসের ভেজানো মেলকিয়াদেসের নকল দাঁতের গায়ে। সময় ও সামর্থ্য না থাকায় সারা দিন কাটায় সে ভয় দেখিয়ে, টিকটিকি দেখিয়ে, যেগুলো মাত্র রাত্রি হলেই আবার ভেতরে ঢুকবে। এক সকালে দেখতে পায় লাল পিঁপড়েগুলো ধসে পড়া সিমেন্ট ত্যাগ করে, বাগান পেরিয়ে যেখানে বেগোনিয়া ফুলগুলো মেটে বর্ণ পেয়েছে, সেই রেলিংয়ের ওপর দিয়ে বাড়ির একেবারে ভেতরে গিয়ে ঢুকছে। প্রথমে ওগুলোকে মারার চেষ্টা করে ঝাড়ু দিয়ে, পরে কীটনাশক ও শেষমেশ চুন দিয়ে। কিন্তু পরের দিন ওগুলোকে আবার দেখা যায় একই জায়গায়, একই নাছোড় ভঙ্গিতে অজেয় পিঁপড়েগুলোকে চলতে। ছেলেমেয়েদের কাছে চিঠি লেখায় ক্লান্ত ফের্নান্দা এই অদম্য ধ্বংসাত্মক আক্রমণের ব্যাপারে কিছুই জানতে পায় না। শান্তা সোফিয়া দেলা পিয়েদাদ লড়ে চলে একাকী, যাতে করে আগাছা ঢুকতে না পারে রান্না ঘরে, ছিঁড়ে ফেলে মাকড়সার জালের সুতোগুলো, যেগুলো কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার তৈরি হয়ে যায়। ঘষে তুলে ফেলে উইপোকার বাসাগুলো। কিন্তু যখন দেখতে পায়, এমনকি দিনে তিনবার ঝাড়মোছা করার পরও মেলকিয়াদেসের ঘর পর্যন্ত ধুলো ও মাকড়সার জালে ভর্তি হয়ে যায়, প্রচণ্ড ঘষামাজার পরও যেটা আবর্জনা ও করুণ অবস্থায় হুমকির সম্মুখীন, যা শুধু কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া আর যুবক অফিসারটিরই চোখে পড়ে ছিল অনেক আগে, তখন সে বুঝতে পারে যে তার হার হয়েছে। ফলে সে গায়ে চড়ায় জীর্ণ রোববারের পোশাক, পায়ে দেয় উরসুলার একজোড়া পুরোনো জুতো ও আমারাত্তা উরসুলার উপহার দেওয়া একজোড়া লম্বা মোজা আর তার কাছ থেকেই পাওয়া অবশিষ্ট দু-তিনটি কাপড় দিয়ে পোঁটলা বাঁধে। ‘হার মানছি, বলে আউরেলিয়ানোকে, ‘আমার এই বুড়ো হাড়ের তুলনায় বাড়িটা বড্ড বড়।’
আউরেলিয়ানো যখন জিজ্ঞেস করে কোথায় যাচ্ছে, তখন সে শুধু আবছা এক অভিব্যক্তি প্রকাশ করে, যাতে মনে হয় যে তার গন্তব্যের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। ঠিকমতো বলার চেষ্টা করে পরে; রিওয়াচায় বাস করে, এমন এক জ্ঞাতিভাইয়ের সঙ্গে কাটাবে সে জীবনের শেষের বছরগুলো। যদিও সে ব্যাখ্যা খুব একটা গ্রহণযোগ্য হয় না। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর গ্রামের কারও সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল না তার, কোথাও থেকে কোনো চিঠি বা সংবাদ পায় নি সে কোনো দিন বা কেউ কোনো দিন তার মুখ থেকে শুনতে পায় নি কোনো আত্মীয়স্বজনের কথা। আউরেলিয়ানো ওকে দেয় চৌদ্দটা সোনার ছোট মাছ, কারণ সে প্রস্তুত ছিল একমাত্র তার কাছে যা ছিল তা-ই নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য; এক পেসো পঁচিশ সেন্ট। ঘরের জানালা থেকে আউরেলিয়ানো দেখতে পায় তাকে, পা টেনে টেনে বয়সের ভারে নুয়ে পড়ে পোঁটলাটা নিয়ে পার হচ্ছে উঠানটা, দেখতে পায় বেরিয়ে যাওয়ার পর দরজার হুড়কোটা লাগানোর জন্য গর্ত দিয়ে হাত গলিয়ে দিতে। এর পর থেকে কখনোই তার কথা আর শোনা যায় নি।
এই লাপাত্তার খবর শুনে সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ কিছু নিয়ে পালাল কি না, তা নিশ্চিত করতে তোরঙ্গ জামাকাপড় দেয়াল কুঠরি, জিনিসের পর জিনিস তন্ন তন্ন করে খুঁজতে খুঁজতে ফের্নান্দা পুরো এক দিন লাফালাফি করে কাটায়। জীবনে প্রথমবারের জন্য আগুন জ্বালাতে গিয়ে এক আঙুল পুড়িয়ে ফেলে সে, আর কীভাবে কফি বানাতে হয়, তা শেখার জন্য আউরেলিয়ানোর সাহায্য চাইতে হয় তার। আউরেলিয়ানোকে কিছুদিন পরই রান্নাঘরের দায়িত্ব নিতে হয়। ঘুম থেকে জেগেই ফের্নান্দা পেয়ে যেত পরিবেশন করা নাশতা আর সে শুধু লিলেনের টেবিল ক্লথ ও মোমবাতির মধ্যে খাবার জন্য পনেরোটি নিঃসঙ্গ খালি চেয়ারের সর্বশেষ প্রান্তের চেয়ারে বসে, দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য শোবার ঘর ত্যাগ করত, যে খাবার আউরেলিয়ানো জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর ঢেকে রাখত। এমনকি এ ধরনের পরিস্থিতিতেও আউরেলিয়ানো ও ফের্নান্দা নিঃসঙ্গতায় অংশগ্রহণ করত না, বরং বাস করতে নিজের নিজের মতো করে, আলাদাভাবে যার যার ঘর পরিষ্কার করে, যখন মাকড়সার জাল তুষারপাতের মতো ছেয়ে ফেলত গোলাপঝাড়, ঢেকে দিত কড়িকাঠ ও গদির মতো আস্তর ফেলত দেয়ালগুলোতে। তখনকার দিকেই ফের্নান্দার মনে হতো বাড়িটা ভরে গেছে বেঁটে ভূতে। জিনিসপত্র, বিশেষ করে প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত হতো সেগুলোর, যেন নিজে থেকেই জায়গা বদলানোর এক ক্ষমতা জন্মেছে। ফের্নান্দা যে কেঁচিটা বিছানার ওপর রেখেছে, এ বিষয়ে নিশ্চিত, সেটা খুঁজতে গিয়ে সব ওলট-পালট করার পর সেটাকে পায় রান্নাঘরে তাকের ওপর, যেখানে সে গত চার দিন যায় নি বলে ভেবেছিল। হঠাৎ করেই থালাবাসনের সিন্দুকে পাওয়া যায় না একটি কাঁটাচামচ, আবার পেয়ে যায় ছয়টা বেদির ওপর ও তিনটে বাসনপত্র মাঝার জায়গায়। এই হাঁটাহাঁটির ব্যাপারটা আরও অসহ্য হয়ে পড়ত, যখন সে লিখতে বসত, কালির যে দোয়াতটা রাখত ডান দিকে, সেটা উদয় হতো বাম দিকে, চোষকাগজটা যেত হারিয়ে, যেটাকে পাওয়া যেত দুদিন পর বালিশের নিচে, হোসে আর্কাদিওকে লেখা পৃষ্ঠাগুলো আমারান্তা উরসুলার সঙ্গে এলোমেলো হয়ে যেত, আর সব সময়ই ভুগত চিঠিগুলো ভুল খামে ঢুকিয়ে ফেলেছে বলে মনে করে, যেমনটি ঘটত প্ৰায় প্রায়ই। একবার হারিয়ে ফেলে ঝরনা কলম। পনেরো দিন পর সেটাকে ফেরত দেয় ডাকপিয়ন নিজের পকেটে আবিষ্কার করে, যেটির মালিকের খোঁজে তাকে ঘুরতে হয়েছিল বাড়ি বাড়ি। প্রথম দিকে সে মনে করে কাজগুলোতে অদৃশ্য চিকিৎসকদের হাত আছে, যেমনটি ছিল পট্টিগুলো অদৃশ্য হওয়ার ব্যাপারে, এমনকি তাদের কাছে অনুনয় করে চিঠিও লিখতে আরম্ভ করেছিল, যাতে তাকে শান্তিতে থাকতে দেয়। কিন্তু তাতে বাধা পড়ে যখন কিছু একটা করতে সে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে আর ফিরে এসে শুধু যে শুরু করা চিঠিটা খুঁজে পায় না তা-ই নয়, এমনকি ভুলে যায় চিঠি লেখার উদ্দেশ্যটাও। একসময় তার মনে হয়, কাজটা বুঝি আউরেলিয়ানোর। নজর রাখতে শুরু করে ওর ওপর তার চলার পথে জিনিসপত্র রেখে সেগুলো সরানোর সময় হাতেনাতে ধরে ফেলতে। কিন্তু শিগগিরই সে বুঝে ফেলে যে আউরেলিয়ানো রান্নাঘর বা পায়খানায় যাওয়া ছাড়া মেলকিয়াদেসের ঘর ছেড়ে বেরোয় না, আর তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করার মতো লোক সে নয়। ফলে শেষ পর্যন্ত তার বিশ্বাস জন্মে যে এগুলো হচ্ছে বেঁটে ভূতগুলোর দুষ্টুমি আর যে জিনিসটা নিশ্চিতভাবে যেখানে ব্যবহার করবে, সেখানেই রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। কলম ও চোষকাগজ বাঁধে টেবিলের পায়ার সঙ্গে, কালির দোয়াত আঠা দিয়ে লাগায় তক্তার সঙ্গে, যেখানে লিখত, তার ডান দিকে। রাতারাতিই সমস্যার সমাধান হয় না, কারণ সুতো দিয়ে কেঁচি বাঁধার অল্প কয়েক ঘণ্টা পরই দেখা যায় সুতোটা কাটার নাগাল পাওয়ার মতো যথেষ্ট লম্বা নয়, যেন বেঁটে ভূতগুলো ওটাকে খাটো করে দিয়েছে। এ রকম ঘটত কলম বাঁধা সুতোটার বেলায়ও, এমনকি তার নিজের বাহু নিয়েও। কারণ দেখা যেত কিছুক্ষণ লেখার পর ওটা আর কালির দোয়াতের নাগাল পাচ্ছে না। ব্রাসেলসে বসবাসরত আমারান্তা উরসুলা বা রোমে থাকা হোসে আর্কাদিও এই সব তুচ্ছ ব্যাপার সম্বন্ধে জানতে পায় না। ফের্নান্দা ওদের জানাত যে সে আনন্দেই আছে আর সত্যিকার অর্থেই তা-ই ছিল, কারণ নিজেকে তার মুক্ত মনে হতো সব রকমের দায়িত্ব থেকে যেন জীবন তাকে আবার টেনে নিয়ে গেছে ওর বাবা-মার থাকা পৃথিবীতে, যেখানে দৈনন্দিন সমস্যাগুলো ভোগান্তির সৃষ্টির করে না, কারণ আগেভাগেই সেগুলোর সমাধান হয়ে আছে কল্পনায়। সেই অন্তহীন চিঠি লেখালেখি লুপ্ত করে তার সময়জ্ঞান, বিশেষ করে সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ চলে যাওয়ার পর থেকে। সে ছেলেমেয়েদের আসার সময়গুলোকে নির্দেশক হিসেবে ধরে নিয়ে দিন, মাস ও বছরের হিসাব রাখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যখন ওরা বারবার আসার পরিকল্পনা বদল করে, তখন তারিখগুলো গোলমেলে হয়ে যায়, মুহূর্তগুলো হারিয়ে যায় আর সময়গুলো এমনভাবে একটা অন্য একটার মতো হয়ে যায়, যে দিন যে কাটছে তাই অনুভব করা যায় না। ধৈর্য হারানোর বদলে এক আনন্দের ঢেউ বোধ করে এই বিলম্বের কারণে। হোসে আর্কাদিও তার শেষ শপথ নেওয়ার আগের দিনের কথা ঘোষণা করার পর অনেক বছর পেরিয়ে গেলেও যে বলে যাচ্ছে যে সে কূটনীতিবিদ্যা শেখার জন্য উচ্চতর থিওলজি শেষ করার অপেক্ষায় আছে, এতেও সে বিচলিত হয় না, কারণ সে বুঝত যে সেন্ট পিটারের আসনে ওঠার শম্বুকগতির সিঁড়িটা কত উঁচু ও বাধা-বিঘ্ন দিয়ে ভরা। অপর দিকে অন্যের কাছে মূল্যহীন খবর, যেমন ছেলে পোপের দর্শন লাভ করেছে, এমন খবরে তার হৃদয় আনন্দে উথলে উঠত। একই রকমের সুখ উপভোগ করে যখন আমারান্তা উরসুলা চিঠিতে জানায় আরও হিসাব করা সময়ের চাইতে বেশি সময় লাগবে তার লেখাপড়া শেষ করতে, কারণ তার করা দুর্দান্ত ফলাফল তাকে এমন কিছু সুযোগ এনে দিয়েছে, যা তার বাবা গোনার মধ্যে ধরে নি।
তিন বছরের বেশি সময় কেটে গিয়েছে, শান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ ব্যাকরণের বইটি এনে দেওয়ার পর যখন আউরেলিয়ানো প্রথম পাতাটা অনুবাদ করতে পারে। কিন্তু তার এই শ্রম বৃথা যায় নি, কারণ সে দিতে পেরেছে সেই পথে তার প্রথম পদক্ষেপ, যে পথের দৈর্ঘ্য আগেভাগে জানা অসম্ভব, কারণ স্প্যানিশে করা অনূদিত শব্দগুলোর কোনো মানেই হয় না: লাইনগুলো লেখা ছিল সাংকেতিকভাবে। লেখাগুলোর অর্থ বোঝার মতো যথেষ্ট তত্ত্ব আউরেলিয়ানোর ছিল না আর যেহেতু মেলকিয়াদেস বলেছিল যে পার্চমেন্টের মর্মোদ্ধার করার জন্য প্রয়োজনীয় বই জ্ঞানী কাতালিয়নোর দোকানে আছে, সেহেতু সে ফের্নান্দার সঙ্গে কথা বলবে বলে ঠিক করে, যাতে সে তাকে ওগুলো খোঁজার জন্য যেতে অনুমতি দেয়। ভেঙে পড়া চুন-সুড়কিভরা আর সেগুলোর অরোধ্য বৃদ্ধির কাছে হেরে যাওয়া ঘরটায় বসে সে ভাবে কথাটা ফের্নান্দাকে পাওয়ার মোক্ষম উপায়ের কথা, ভেবে দেখছিল বিভিন্ন পরিস্থিতি, হিসাব করেছিল সবচেয়ে উপযুক্ত সময়ের, কিন্তু যখন ফের্নান্দা খাবার তুলে নিচ্ছিল জ্বলন্ত অঙ্গার থেকে আর যেটা ছিল তাকে বলার একমাত্র সুযোগ, তখন পূর্বপরিকল্পিত আর্জিটা সে গিলতে বাধ্য হয়, কারণ তার মুখ দিয়ে কোনো স্বর ফোটে না। তখন থেকেই সে ফের্নান্দার ওপর নজর রাখতে শুরু করে, সে কান পেতে থাকত শোবার ঘরে তার পায়ের শব্দ শোনার জন্য, শুনতে পেত ছেলেমেয়ের চিঠি নিতে ও নিজেরটা ডাকপিয়নকে দিতে দরজা পর্যন্ত যাওয়ার পদশব্দ, শুনতে পেত গভীর রাত পর্যন্ত কাগজের ওপর আবেগময় কলমের শব্দ, সুইচ নেভানো ও পরক্ষণে বিড়বিড়িয়ে প্রার্থনা করার শব্দ শোবার আগ পর্যন্ত। একমাত্র তখনই সে ঘুমাতে যেত এই আশায় যে পরের দিন প্রতীক্ষিত সুযোগটা এসে যাবে। অনুমতি যে পাওয়া যাবে, এই আশায় সে এতই উদ্দীপ্ত হয় যে এক সকালে ঘাড় পর্যন্ত নেমে আসা চুল ছেঁটে ফেলে, ছাঁটে জটে ধরা দাড়ি, পরে আঁটসাঁট একজোড়া প্যান্ট আর পায়ে চড়ায় কৃত্রিম কলারের এক শার্ট, সেটা যে কার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে, তা না জেনেই, আর রান্নাঘরে ফের্নান্দার নাশতার জন্য যাওয়ার অপেক্ষায় থাকে। প্রতিদিন মাথা উঁচু করে দৃঢ় পায়ে হাঁটা মহিলা আসে না সেদিন, আসে এরমিনের (ermine-বজির মতো একধরনের প্রাণী) চামড়ার এক হাতা ছাড়া কোট পরা, অতিপ্রাকৃত সৌন্দর্যের অধিকারী এক বৃদ্ধা মাথায় সোনালি কার্ডবোর্ডের মুকুট পরে আর এমন এক বিষণ্ণ চেহারা নিয়ে যেন গোপনে কেঁদেছে সে। সত্যি বলতে, আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর তোরঙ্গে পাওয়ার পর থেকে এই পোকায় কাটা রানির পোশাক ফের্নান্দা অনেকবারই পরেছে। যে কেউ তাকে নিজস্ব রাজকীয় অঙ্গভঙ্গিসহ আয়নার সামনে দেখলে মনে করত পাগল হয়ে গেছে সে। কিন্তু আসলে সে পাগল ছিল না। শুধু রাজপোশাকটা পরিণত হয়েছে তার স্মৃতি ফিরে পাওয়ার উপায়ের এক মেশিনে। প্রথমবার জামাটা গায়ে পরানোর পর অনেক চেষ্টা করেও বুকের ভেতর এক দলা পাকানো চোখ ভরে পানি আসা এড়াতে পারে নি সে, কারণ সেই মুহূর্তে সে গন্ধ পায় সেই মিলিটারি অফিসারের বুটের যে গন্ধ তাকে রানি বানাতে খুঁজতে গিয়েছিল তাদের বাড়ি, আর তখন তার হৃদয় ভরে ওঠে স্মৃতিকাতরতা ও হারানো স্বপ্ন দিয়ে। নিজেকে তার এতই বৃদ্ধা, এতই জরাজীর্ণ বলে মনে হয়, জীবনের সেরা দিনগুলো থেকে এতই দূরবর্তী মনে হয় যে তখনকার সবচেয়ে খারাপ জিনিসগুলোর জন্যও মনটা হাহাকার করে ওঠে, আর একমাত্র তখনই সে আবিষ্কার করে বারান্দার অরোগানো থেকে আসা সুগন্ধের ব্যাপারটা বিকেলে গোলাপের সুবাসের ভাপ, এমনকি ভুঁইফোড় লোকদের পশুসুলভ আচরণের অভাব, তার চাপ ধরা ছাই দিয়ে গড়া যে হৃদয় দৈনন্দিন জীবনের সবচেয়ে কঠোর আঘাতেও ভেঙে না পড়ে সহ্য করে গেছে, সেই হৃদয়টাই টুকরো টুকরো হয়ে যায় স্মৃতিকাতরতার প্রথম আঘাতে। বছর গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তার বিষণ্নতাবোধের প্রয়োজনীয়তা এক খারাপ অভ্যাসে পরিণত হচ্ছিল। নিঃসঙ্গতার মধ্যে সে মানবিক হয়ে ওঠে। তার পরও সকালে যখন রান্নাঘরে ঢোকে আর দেখে এক পাণ্ডুর কৃশকায় বালক উজ্জ্বল মায়াময় চোখে তাকে এক কাপ কফি দেয়, উপহাসের থাবা তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলে। তার অনুরোধটা যে শুধু নাকচ করে দেয়, তা-ই নয়, তখন থেকে বাড়ির চাবিগুলো বহন করে চলে, যে পকেটে বহন করত কোনো সময় ব্যবহার না করা জন্মনিরোধক আচ্ছাদন। এটা ছিল এক অপ্রয়োজনীয় সাবধানতা, কারণ আউরেলিয়ানো ইচ্ছা করলেই পালাতে তো পারতই, এমনকি চোখ এড়িয়ে আবার বাড়ি ফিরতেও পারত। কিন্তু দীর্ঘ বন্দিদশা, জগতের অনিশ্চয়তা, বাধ্যতার অভ্যস্ততা শুকিয়ে ফেলেছিল তার ভেতরের বিদ্রোহের বীজ। ফলে পুনরায় সে ফিরে যায় বন্দিদশায়, বারবার পড়ে চলে পার্চমেন্টগুলো আর শুনতে থাকে গভীর রাত পর্যন্ত ফের্নান্দার শোবার ঘর থেকে আসা ফোঁপানোর শব্দ। এক সকালে অভ্যেসমতো আগুন জ্বালাতে গেলে দেখতে পায় ফের্নান্দার জন্য আগের দিনের রেখে দেওয়া খাবার পড়ে আছে নেভা ছাইয়ের ওপর। ফলে সে উঁকি দেয় শোবার ঘরে আর দেখতে পায় বিছানায় শোয়া এতকালের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী, এরমিনের জামা দিয়ে ঢাকা আর চামড়া শুকিয়ে হাতির দাঁতের আবরণে পরিণত হয়েছে। চার মাস পর যখন হোসে আর্কাদিও ফিরে আসে, তাকে পায় একই অবস্থায়।
মায়ের সঙ্গে এত মিলের কথা কোনো মানুষের ক্ষেত্রে ভাবাও অসম্ভব। মলিন রেশমি কোট ছিল তার পরনে, গায়ে ছিল গোল গলার শক্ত কলারের জামা, চিকন রেশমি ফিতে দিয়ে বাঁধা বো ছিল নেকটাইয়ের পরিবর্তে। পাণ্ডুর চেহারায় ছিল এক অবসন্নতা, চোখে ছিল বিস্ময়াভিভূত দৃষ্টি ও ঠোঁটজোড়া দুর্বল। কালো চকচকে মসৃণ চুলগুলোকে চাঁদির মাঝখানটায় দুভাগ করে ফেলেছে সরল ও ক্লান্ত এক রেখা, যেটা এনে দিয়েছে সেন্টদের কৃত্রিম চুলের মতো একই ভাব। ভালো করে কামানো দাড়ির ছায়াটা মোম দিয়ে তৈরি মুখের মতো, যেন বিবেকের এক ছাপ পড়েছে। হাত দুটো তার পাণ্ডুর, তাতে সবুজ শিরা, আঙুলগুলো পরজীবীর মতো, আর বাম হাতের তর্জনীতে নিরেট সোনার আংটিতে ওপালের গোল সূর্যমুখী পাথর বসানো। দরজা খোলার পর আগন্তুক যে এসেছে অনেক দূর হতে, এটা বুঝতে আউরেলিয়ানোর অনুমান করার প্রয়োজন পড়ে না। আগন্তুকের পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে ঘর ভরে ওঠে ফুলের সুগন্ধিতে, ছোট্টবেলায় উরসুলা যা তার মাথায় দিত ছায়ান্ধকারে খুঁজে পাওয়ার জন্য। এতগুলো বছরের অনুপস্থিতির পরও কেন যে হোসে আর্কাদিও প্রচণ্ড বিষণ্ন ও নিঃসঙ্গ শরৎ-শিশুই রয়ে গেছে, তা বের করা অসম্ভব। সে সোজা ঢুকে পড়ে মায়ের শোবার ঘরে, যেখানে আউরেলিয়ানো মেলকিয়াদেসের সূত্র অনুযায়ী পারদের বাষ্প বানাচ্ছিল বিগত চার মাস ধরে মরদেহ বিকৃতির হাত থেকে রক্ষার জন্য। হোসে আর্কাদিও কোনো প্রশ্ন করে না। শবের কপালে এক চুমু দিয়ে জামার নিচ থেকে এক জালের ছোট্ট ব্যাগ বের করে যেখানে তখনো অব্যবহৃত তিনটি জন্মনিরোধক আচ্ছাদনের সঙ্গে ওয়ার্ডরোবের চাবিটা ছিল। সমস্ত শিষ্টাচার সে সারে দ্বিধাহীন স্থির সংকল্পের সঙ্গে, যা তার চেহারার সঙ্গে মানায় না। ওয়ার্ডরোব থেকে বের করে কুলচিহ্ন বসানো দামাস্কাসের বাক্স, যার ভেতর সে পায় চন্দন-সুবাসিত এক লম্বা চিঠি, যে চিঠিতে ফের্নান্দা হৃদয় উজাড় করে গোপন করা সবকিছু লিখে রেখে গেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আগ্রহের সঙ্গে কিন্তু উৎকণ্ঠা ব্যতিরেকে চিঠিটা পড়ে আর তৃতীয় পাতায় এসে থমকে যায় আর দ্বিতীয়বার চেনার মতো এক দৃষ্টি দিয়ে আউরেলিয়ানোকে পরখ করে।
‘আচ্ছা’, বলে সে এমন যাতে ছিল ক্ষুরের ধার, ‘তুই-ই হচ্ছিস জারজটা।’
‘আমি আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া।’
‘তোর ঘরে যা’, বলে হোসে আর্কাদিও।
আউরেলিয়ানো চলে যায়, আর এমনকি যখন লোকহীন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কানাঘুষা শোনে তখনো কৌতূহলবশত বের হয় না। রান্নাঘর থেকে কোনো কোনো সময় দেখতে পেত উৎকণ্ঠাভরা নিশ্বাসে নিজেরই দমবন্ধ হওয়ার অবস্থায় হোসে আর্কাদিওকে ঘরময় পায়চারি করতে, আর শুনতে পেত মধ্যরাতের পর প্রায় ধ্বংস হওয়া শোবার ঘরগুলোতে ওর পায়চারির শব্দ। অনেক মাস যাবৎ ওর গলার স্বর শুনতে পায় না সে, তা যে শুধু হোসে আর্কাদিও তার উদ্দেশ্য করে কোনো বাক্য ছুড়ে দিত না, তার জন্য নয়, বরং ওর সঙ্গে কথা বলার কোনো আকাঙ্ক্ষাও তার ছিল না আর তা ছাড়া পার্চমেন্টগুলো ছাড়া অন্যকিছু ভাবার সময়ও তার ছিল না। ফের্নান্দার মৃত্যুর পর শেষ মাছ দুটোর একটি বের করে আর যে বইগুলোর প্রয়োজন, সেগুলোর খোঁজে বিজ্ঞ কাতালিয়নোর দোকানে যায়। পথে যা দেখতে পায়, তার কোনো কিছুতেই তার আকর্ষণ জন্মায় না, হয়তোবা ওগুলোর সঙ্গে তুলনা করার মতো যথেষ্ট তথ্য তার স্মৃতিতে ছিল না আর লোকহীন রাস্তাঘাট ও নির্জন বাড়িঘরগুলো ঠিক সে যেভাবে কোনো একসময় কল্পনা করেছিল সে রকমই ছিল, যখন সে ওগুলো দেখার জন্য নিজের জানটাও দিয়ে দিতে পারত। যে অনুমতি চেয়ে সে ফের্নান্দার কাছে নেতিবাচক উত্তর পেয়েছে, সে নিজেই নিজেকে সেই অনুমতি দেয় আর শুধু একবারই, শুধু একটিমাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে, ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সময় লাগিয়ে, একবারও না থেমে পার হয় তাদের বাড়ি ও যে গলিতে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করা হতো সেই গলির মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করা এগারো ব্লক, আর হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে ঢোকে অগোছালো অন্ধকার এক দোকানে, যেখানে কোনো রকমে হাঁটাচলা করা যায়। বইয়ের দোকানের চাইতেও সেটা ছিল পুরোনো বইয়ের আস্তাকুঁড়, কারণ উইয়ে খাওয়া বইগুলো ছিল অগোছালো, কোনায় কোনায় ছিল মাকড়সার ঝুল, এমনকি যেখানে চলাফেরা করার জায়গা থাকার কথা, সেখানে ভর্তি ছিল বইয়ে। এক লম্বা টেবিলে, সেটাও আজেবাজে জিনিসপত্রের ভিড়ে হাঁসফাঁস করছে, সেখানে দোকানের মালিক বেগুনি রঙের কালি দিয়ে একটু অদ্ভুত রকমের অক্ষরে স্কুলের খাতার আলগা পাতায় গদ্য লিখে চলছে ক্লান্তিহীন। তার মাথায় ছিল কপালে নেমে আসা কাকাতুয়ার পুচ্ছের মতো রুপোলি অদ্ভুত সুন্দর চুল, আর তার জীবন্ত টানা নীল চোখগুলো জানিয়ে দিচ্ছিল এই অমায়িক মানুষটার সব বই-ই পড়া হয়ে গেছে। ঘামে সপসপে ভিজে জাঙ্গিয়া পরা অবস্থায় কে যে এল, তা দেখার জন্যও সে কলম থামায় না। কিন্তু সেই অসম্ভব রকমের বিশৃঙ্খলার মধ্য থেকেও প্রয়োজনীয় পাঁচটি বই উদ্ধার করতে আউরেলিয়ানোর কোনো কষ্টই হয় না, কারণ মেলকিয়াদেসের নির্দেশানুযায়ী যে জায়গায় বইগুলো থাকার কথা, সেগুলো সেখানেই ছিল। একটি কথাও না বলে সে সোনার মাছটাসহ বইগুলো বিজ্ঞ কাতালিয়নোকে দিলে সে সবকিছু পরখ করে তার দুচোখের পাতা বুজে আসে ঝিনুকের মতো, ‘পাগল হয়েছিস’ কাঁধ উঁচিয়ে নিজস্ব ভাষায় বলে আর আউরেলিয়ানোর হাতে ফেরত দেয় বইগুলোসহ সোনার ছোট্ট মাছটি।
‘নিয়ে যা’, স্প্যানিশ ভাষায় বলে, ‘শেষ যে লোক বইগুলো পড়েছিল, সম্ভবত সে হলো অন্ধ আইজাক, কাজেই চিন্তা করে দেখ কী করবি।’
মেমের শোবার ঘরটা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনে হোসে আর্কাদিও, পরিষ্কার করতে ও মখমলের পর্দাগুলোসহ রাজকীয় বিছানার চাঁদোয়া সাড়াতে আদেশ করে, পুনরায় পরিত্যক্ত স্নানঘর ব্যবহারের উপযোগী করে, যেটার সিমেন্টের চৌবাচ্চাটা ছিল আঁশটে, খসখসে, আর কালো হয়ে গিয়েছিল। এই দুই জায়গাতেই সে সীমিত রাখে দৈন্যভরা রাজত্ব নকল সুগন্ধি ও সস্তা পাথর দিয়ে। সারা বাড়িতে একমাত্র যা তাকে বিরক্ত করে তা হচ্ছে, বেদির ওপরের সেন্টদের গৃহে মূর্তিগুলো আর এক বিকেলে সেগুলো পুড়িয়ে ছাই করে উঠানে আগুন জ্বালিয়ে। ঘুমোত সে বেলা এগারোটা পার হওয়া পর্যন্ত। সোনালি ড্রাগন আঁকা এক জীর্ণ গাউন ও হলুদ ঝালরের একজোড়া চপ্পল পরে স্নানঘরে ঢুকে সেখানে সে এমন আচার- অনুষ্ঠান করত, যার নিষ্ঠা ও লম্বা সময় মনে করিয়ে দিত রেমেদিওস লা বেইয়্যাকে। স্নানের আগে শ্বেতস্ফটিকের তৈরি তিনটি বয়ামে করে নিয়ে আসা লবণ দিয়ে সুরভিত করত চৌবাচ্চাটা। লাউয়ের খোল দিয়ে সে মাথায় পানি ঢালার বদলে সুরভিত পানিতে, চিত হয়ে ভাসত দুঘণ্টা যাবৎ শীতলতা ও আমারান্তার স্মৃতিভরা ঝিমুনির মাঝে। আসার অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ত্যাগ করে চেলি-কাপড়ের স্যুট, যেটা একে তো গ্রামের পক্ষে ছিল প্রচণ্ড গরম, তা ছাড়া ওটা ছাড়া তার অন্য কোনো স্যুটও ছিল না। বদলে পরে চাপা প্যান্ট, যেগুলো ছিল প্রায় পিয়ত্র ক্রেসপির নাচের ক্লাসের সময়ে পরা প্যান্টের মতো ও প্রাকৃতিক রেশমি সুতোয় বোনা ও তাতে বুকের ওপর নামের আদ্যাক্ষর লেখা শার্ট। সপ্তাহে দুবার সেসব জামাকাপড় ধুয়ে নিত চৌবাচ্চায় আর তখন পরে থাকত শুধু গাউনটা। কারণ, গায়ে দেওয়ার মতো অন্য কিছু ছিল না তার। বাড়িতে কখনোই খেত না। সিয়েস্তার সময়ের গরম কমে এলে রাস্তায় বেরোত সে আর বেশ রাত হওয়ার আগ পর্যন্ত ফিরত না। ফলে চালিয়ে যেত বিড়ালের মতো হাঁসফাঁস করতে করতে আর আমারান্তার ভাবতে ভাবতে তার উৎকণ্ঠাময় পায়চারি। আমারাস্তা ও রাতের বাতির আলোর বিচ্ছুরণে সেন্টদের ভয়ংকর দৃষ্টি বাড়ির শুধু এ দুটো স্মৃতিই আগলে রেখেছিল মনের মধ্যে। অনেকবারই বিভ্রমসৃষ্টিকারী রোমের আগস্টে আধা স্বপ্নের মাঝে চোখ মেলে দেখতে পেত লেসের ফ্রক পরিহিতা হাতে বাঁধা পট্টি নিয়ে নির্বাসনে উদ্বিগ্ন আমারান্তা উঠে আসছে কারুকাজ করা মার্বেলের চৌবাচ্চা থেকে। যেখানে আউরেলিয়ানো হোসে এই প্রতিচ্ছবিটাকে চেষ্টা করত যুদ্ধের রক্তভরা পুকুরে ডুবিয়ে মারতে, সেখানে হোসে আর্কাদিও বাঁচিয়ে রাখতে চাইত প্রচণ্ড কামনার নোংরা জলে, যখন অন্যদিকে সবাইকে তুষ্ট রাখত যাজকীয় লেখাপড়া না শেষ হওয়ার মতো বানানো গল্প দিয়ে। আর ফের্নান্দার বা কারোরই মনে হয় নি যে তারা আসলে দিবাস্বপ্নের বিনিময় করছে। রোমে পৌছেই সে সেমিনারি ত্যাগ করে আর মায়ের বিকারগ্রস্ত চিঠিতে লেখা উত্তরাধিকারপ্রাপ্তির সম্ভাবনাকে হুমকির মুখে না ফেলার জন্য ঈশ্বরতত্ত্ব ও বাইবেল- বর্ণিত আইনকানুন চিঠির মধ্য দিয়ে পরিবেশন করে, যে উত্তরাধিকার তাকে উদ্ধার করবে ত্রাস্তিভিয়ার অঞ্চলে দুই বন্ধুর সঙ্গে চিলেকোঠায় কাটানো অপরিসীম দুর্দশা ও জঘন্য জীবন থেকে। আসন্ন মৃত্যুর পূর্বাভাস পেয়ে ফের্নান্দার লেখা যখন সে হাতে পায়, তখন এক স্যুটকেসে তার মিথ্যে জাঁকজমকের অবশিষ্ট যা ছিল, তা ভরে আর মহাসাগর পাড়ি দেয় এক জাহাজের খোলের ভেতর, যেখানে অভিবাসীরা গাদাগাদি করত কসাইখানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য গরুর পালের মতো, শুধু ঠান্ডা ম্যাকরনি ও পোকাধরা পনির খেয়ে। যে উইলটা ছিল তার দুর্ভাগ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিস্তারিত বর্ণনা ছাড়া আর কিছু ছিল না, ফের্নান্দার সেই উইল পড়ার আগেই ভাঙাচোরা আসবাবপত্র ও বারান্দার আগাছা তাকে বলে দেয় যে সে এমন ফাঁদে পা দিয়েছে, যেখান থেকে কখনোই মুক্তি পাবে না, চিরদিনের জন্যই সে নির্বাসিত হয়েছে জীবনের দ্যুতি ও রোমের চিরবসন্তের হাওয়া থেকে। যে বাড়ি ও উরসুলার বৃদ্ধাবস্থার নিরর্থক প্রলাপ তার মনে পৃথিবী সম্বন্ধে আতঙ্কের বীজ বপন করেছিল, সেই অন্ধকার বাড়িতে হাঁপানিজনিত ক্লান্তিকর অনিদ্রায় বারবার মাপজোখ করত, তার দুর্ভাগ্যের গভীরতা। ছায়ান্ধকারে হারিয়ে না ফেলার জন্য সে তাকে যে শোবার ঘরটি দেওয়া হয়েছিল, সেই কোনার ঘরটিতেই সে একমাত্র নিরাপদ থাকত বিকেল থেকে বাড়িময় ঘুরে বেড়ানো মৃতদের হাত থেকে। ‘যদি খারাপ কিছু করিস’, বলত উরসুলা, ‘তাহলে সেন্টরা কিন্তু আমাকে বলে দেবে।’ শৈশবের আতঙ্কময় রাতগুলো এই কোনায় এসে ঠেকে, যেখানে এক টুলের ওপর ভয়ে ঘামতে ঘামতে অনড় বসে থাকত, চুকলিখোর সেন্টদের পাহারাদার হিমশীতল চোখের সামনে শুতে যাওয়ার সময়ের আগ পর্যন্ত। তাকে এই যন্ত্রণা দেওয়াটা ছিল অনর্থক, কারণ সেই সময়ে ওর আতঙ্ক ছিল চারপাশে যা ছিল সবকিছু নিয়েই আর তৈরি হয়ে থাকত জীবনে যা কিছু আসত, তা নিয়েই ভয় পাওয়ার জন্য: রাস্তার মহিলাদের, কারণ তারা তার রক্ত বিষিয়ে দেয়; বাড়ির মহিলাদের, কারণ তারা শূকরের লেজওলা শিশুর জন্ম দেয়; লড়িয়ে মোরগদের, কারণ তারা মৃত্যু ঘটায় ও সারা জীবনের তরে অনুশোচনা নিয়ে আসে; যুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে, যা ছোড়ামাত্র কুড়ি বছরব্যাপী যুদ্ধের শাস্তি দেয়; অনিশ্চিত অভিযান, যা মোহমুক্তি ও পাগলামির জন্ম দেয়; আর সবকিছু সংক্ষেপে বলতে গেলে ঈশ্বর অসীম দয়াবশত যা তৈরি করেছেন আর শয়তান যে সমস্ত জিনিস বিকৃত করেছে, তার সবকিছুই ছিল তার আতঙ্কের কারণ। দুঃস্বপ্নের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হওয়ার পর যখন সে জেগে উঠত, তখন জানালার আলো চৌবাচ্চায় আমারাস্তার আদর ও দুপায়ের মাঝখানে লাগানোর জন্য রেশমের কাপড়ের পুঁটলি তাকে মুক্তি দিত আতঙ্ক থেকে। এমনকি বাগানের উজ্জ্বল আলোয় উরসুলা পর্যন্ত অন্য রকম ছিল, কারণ সে ওখানে ভয়ংকর কথাগুলো বলত না। বরং তার দাঁত মেজে দিত কয়লার গুঁড়ো দিয়ে, যাতে পোপের মতো উজ্জ্বল হাসির অধিকারী হতে পারে; তার নখ কেটে ও পালিশ করে দিত, যাতে সারা পৃথিবী থেকে যখন তীর্থযাত্রীরা রোমে আসবে, তখন আশীর্বাদের সময় যেন তারা পোপের হাত দেখে হতবাক হয়; তার চুল আঁচড়ে দিত পোপের মতো করে আর সুগন্ধি জল ছিটিয়ে দিত, যাতে তার শরীর ও কাপড়-জামা থেকে পোপের মতোই সুবাস ছড়ায়। একবার ‘কাঁসতেল গানদোলফো’র (পোপের বাসস্থান) এক ব্যালকনিতে সে দেখেছিল পোপকে একদল তীর্থযাত্রীর উদ্দেশে একই ভাষণ সাত ভাষায় দিতে, তখন শুধু তার মনোযোগ কাড়ে পোপের হাতের শুভ্রতা যেন ব্লিচ দেওয়া পানিতে ভিজিয়ে সাদা করা হয়েছে ও দুটিকে, মনোযোগ কাড়ে গ্রীষ্মকালীন পোশাকের চোখধাঁধানো উজ্জ্বলতা ও তার কোলনের গোপন সুবাস।
পেটের দায়ে বাড়ি ফেরার প্রায় এক বছর পর সে বিক্রি করে রুপোর মোমবাতি দান ও পারিবারিক কুলচিহ্নধারী সোনার মলত্যাগপাত্রটা, যদিও বিক্রির সময় দেখা যায় যে আসলে সেটার কুলচিহ্নটাই শুধু সোনার ছিল। আর হোসে আর্কাদিওর একমাত্র বিনোদন ছিল গ্রাম থেকে শিশুদের বাড়িতে নিয়ে আসা, যাতে তারা খেলতে পারে। সিয়েস্তার সময় হাজির হতো ওদের নিয়ে। ওদের দিয়ে দড়ি লাফ দেওয়াত, বারান্দায় গান গাওয়াত আর বসার ঘরের আসবাবের ওপর ডিগবাজি খাওয়াত, আর ছোট্ট ছোট্ট দলে ভাগ করে সহবত শেখাত। তখন তার সে আঁটসাঁট প্যান্ট ও রেশমি শার্ট ছেড়ে আরবদের দোকান থেকে কেনা সাধারণ জামাকাপড় ধরলেও চেহারায় ধরে রাখে পোপের মতো মর্যাদাবোধ ও ভাবভঙ্গি। মেমের স্কুলের বান্ধবীরা যেমনটি করেছিল, এই শিশুর দলও সেই একই রকমভাবে নেয় বাড়িটাকে। অনেক রাত পর্যন্ত শোনা যেত ওদের গল্প, শোনা যেত গানের ও ট্যাপ নাচের শব্দ, যাতে মনে হতো যে বাড়িটা হচ্ছে নিয়মবিহীন এক বোর্ডিং স্কুল। মেলকিয়াদেসের ঘরে ঢুকে ওকে বিরক্ত না করা পর্যন্ত আউরেলিয়ানো বাচ্চাদের এই অভিবাসনকে পাত্তা দেয় না। এক সকালে দুটি ছেলে দরজা ধাক্কা দিলে ভেতরে লম্বা চুলের এক নোংরা লোককে পার্চমেন্টের পাঠোদ্ধারে ব্যস্ত দেখে ভয় পেয়ে যায়। ভেতরে ঢোকার সাহস না পেলেও ওরা ঘুরঘুর করে ঘরের আশপাশে। ফিসফিস করতে করতে ওরা ফোকর দিয়ে উঁকি দিয়ে, বরগার ফাঁক দিয়ে জ্যান্ত পোকামাকড় ঢুকিয়ে দিত। আর একবার তো পেরেক দিয়ে দরজা ও জানালা বাইরে দিয়ে বন্ধ করে দেয় আর ওগুলো ঠেলে খুলতে অর্ধেক দিন লেগে যায় আউরেলিয়ানোর। দুষ্টুমির শাস্তি না পাওয়ায় সাহস বেড়ে যায় ওদের আর এক সকালে চারটি ছেলে ঢুকে পড়ে তার ঘরে পার্চমেন্টগুলো ধ্বংস করার জন্য। কিন্তু প্রায় হলুদ হয়ে যাওয়া পাতাগুলোতে ওরা হাত রাখতেই এক দৈবশক্তি ওদের মেঝে থেকে শূন্যে তুলে ঝুলিয়ে রাখে আউরেলিয়ানো ফিরে এসে পার্চমেন্টগুলো কেড়ে না নেওয়া পর্যন্ত। এর পর থেকে আর কখনো ওরা বিরক্ত করে নি তাকে।
যদিও প্রায় বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছে গেছে ওদের মধ্যেকার সবচেয়ে বড় ছেলে চারটি, তার পরও খাটো প্যান্ট পরত ওরা, যারা ভার নিয়েছিল হোসে আর্কাদিওর সাজপোশাকের। ওরা এসে পৌঁছাত অন্যদের আগে আর সকালটা ব্যয় করত তার দাড়ি কামাতে, গরম তোয়ালে দিয়ে শরীর ম্যাসাজ করতে, হাত-পায়ের নখ কেটে পালিশ করতে আর ফুল-সুগন্ধি জল গায়ে মাখাতে। অনেকবারই ওরা চৌবাচ্চায় নেমে পড়ত আর পা থেকে মাথা পর্যন্ত সাবান মাখাত, যখন সে চিত হয়ে ভাসতে ভাসতে আমারান্তার কথা ভাবছে। পরে ওকে চৌবাচ্চা থেকে বের করে গায়ে পাউডার লাগিয়ে পোশাক পরাত। বড়দের মধ্যে একটি কোঁকড়া সোনালি চুলের ছেলে, যার চোখগুলো ছিল খরগোশের চোখের মতো গোলাপি কাচের, সে ঘুমুত বাড়িতেই। ওদের সম্পর্ক এতই দৃঢ় ছিল যে যখন হোসে আর্কাদিও হাঁপানির তোড়ে ঘরময় পায়চারি করত, তখন ছেলেটা অন্ধকারে ওকে বাকহীন সঙ্গ দিত। এক রাতে যে ঘরে উরসুলা ঘুমুত, সে ঘরের ফেটে যাওয়া ভিতের ফাঁক দিয়ে এক হলুদ আলোর দ্যুতি দেখতে পায় যেন ভূগর্ভের সূর্য ঘরের মেঝেকে এক নকশি কাচে পরিণত করেছে। আলো জ্বালার প্রয়োজন পড়ে না ওদের। যে কোনায় উরসুলার বিছানা ছিল, সেখানের কয়েক চাপ সিমেন্ট সরানোই যথেষ্ট ছিল, যেখানে আলোর দ্যুতি উজ্জ্বল ছিল, সেখানে আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর পাগল হয়ে খুঁজে বেড়ানো গোপন কুঠরিটা দেখতে পাওয়ার জন্য। ওখানেই ছিল তামার তার দিয়ে মুখ বন্ধ করা তিনটি ছালার মধ্যে সাত হাজার দুই শ চৌদ্দটি স্পেনীয় মুদ্রা, যেগুলো অন্ধকারে জ্বলছিল অঙ্গারের মতো।
এই গুপ্তধন পাওয়া ছিল যেন নিভে যাওয়া আগুনের দপ করে জ্বলে ওঠা। দীনহীন দশার মধ্যে দেখা স্বপ্নানুযায়ী এই হঠাৎ করে পাওয়া সম্পদ নিয়ে রোমে ফিরে যাওয়ার বদলে হোসে আর্কাদিও বাড়িটাকেই বানিয়ে ফেলে এক ক্ষয়িষ্ণু স্বর্গ। জানালার পর্দার ও শোবার ঘরের চাঁদোয়া বদলে লাগায় নতুন মখমলের কাপড়, স্নানঘরের মেঝে ও দেয়ালগুলোতে লাগায় টাইলস। খাবার ঘরের আলমারি ভরে যায় শুকনো ফল, জ্যাম ও লবণ দিয়ে রাখা বিভিন্ন খাদ্যে আর অব্যবহৃত ভাড়ার ঘরটা আবার খোলা হয়, হোসে আর্কাদিও নিজে রেলস্টেশন থেকে নিয়ে আসা ওর নাম লেখা মদ ও অন্যান্য অ্যালকোহল- জাতীয় পানীয় ভর্তি বাক্সগুলো রাখার জন্য। এক রাতে বড় ছেলে চারটি এক উৎসবের আয়োজন করে, যেটা চলে ভোর পর্যন্ত। ভোর ছয়টায় ওরা শোবার ঘর থেকে নগ্ন গায়ে বের হয়ে চৌবাচ্চাটা খালি করে সেটাকে ভর্তি করে শ্যাম্পেন দিয়ে। দল বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরায় সুবাসিত বুদে আকাশ সোনালি হলে পাখিরা যেভাবে উড়ে বেড়াত তাদের মতো আর তখন উৎসবের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছাল হোসে আর্কাদিও চিত হয়ে ভেসে চোখ খোলা অবস্থাতেই আমারান্তার স্মৃতিচারণা করে, যতক্ষণ পর্যন্ত না ছেলেগুলো ক্লান্ত হয়ে দল বেঁধে শোবার ঘরে গিয়ে মখমলের পর্দাগুলো পা মোছার জন্য ছিঁড়ে, আর হুড়োহুড়ি করে দল বেঁধে শুতে গিয়ে ভাঙে ক্রিস্টাল পাথরের আয়না, লন্ডভন্ড করে চাঁদোয়াটা আর ততক্ষণ পর্যন্ত হোসে আর্কাদিও ভুল করা সুখের ও তিক্ততার ভাবনায় মগ্ন হয়ে থাকে। যখন সে স্নানঘর থেকে বেরোয়, ওদের পায় বিশৃঙ্খল ঘরটায় নগ্ন হয়ে সব কটিকে একসঙ্গে বলের মতো একটার ওপর আরেকটাকে শুয়ে থাকা অবস্থায়। রাগে জ্বলে ওঠে সে, যতটা না এই ক্ষতির কারণে, তার চেয়েও নিজের ওপর যে ঘেন্না ও করুণাবোধ জন্মে, এই উদ্দাম হুল্লোড়ের শূন্যতায় সেই বোধে, আর মনস্তাপ ও প্রায়শ্চিত্তের জন্য কাঁটাওলা বেল্ট অন্য লোহার সামগ্রীর সঙ্গে রাখা যাজকীয় চাবুকটাকে বের করে তোরঙ্গের তলা থেকে, আর পাগলের মতো দয়ামায়াহীন এমনভাবে ওদের চাবকায়, যে রকমটি কেউ কোনো শেয়ালের দলকেও পেটাবে না আর তাড়িয়ে দেয় বাড়ি থেকে। ক্লান্তিতে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে আর ফলে এক হাঁপানির আক্রমণে অনেক দিন ভুগে চেহারা হয়ে যায় মুমূর্ষু রোগীর মতো। চাবকানোর তৃতীয় দিনে শ্বাসকষ্টের কাছে হার মেনে আউরেলিয়ানোর ঘরে যায় নিকটবর্তী এক জড়িবুটির দোকান থেকে নাক দিয়ে নেওয়ার মতো পাউডার কিনে দেওয়ার অনুরোধ করতে। আর এভাবেই দ্বিতীয়বারের মতো বাড়ির বাইরে যায় আউরেলিয়ানো। ধুলোয় ভরা জানালা ও লাতিন ভাষায় লেখা লেবেল লাগানো সিরামিকের বোতলে ভরা দোকানটাতে পৌঁছাতে তার শুধু সোজা দুটো ব্লক পেরোতে হয় আর নীল নদের সাপের মতো গোপন সৌন্দর্যে ভরপুর এক মেয়ে সেই ওষুধটি বের করে দেয়, যেটার নাম হোসে আর্কাদিও লিখে দিয়েছিল এক কাগজে। রাস্তার বাতির হলদেটে আলোয় কোনো রকমে আলোকিত নির্জন শহরটাকে দেখে ওর মনে প্রথমবারের চেয়ে বেশি কৌতূহল জাগে না। হোসে আর্কাদিও যখন ভাবতে যাচ্ছিল যে সে পালিয়ে গেছে, তখন তাকে ঘরবন্দী হয়ে নড়াচড়া না করার ফলে দুর্বল ও আড়ষ্ট পা দুটোকে টেনে টেনে দ্রুত হাঁটার কারণে হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে আসতে দেখে। জগতের ওপর তার নিস্পৃহতা এমন পর্যায়ে পৌছায় যে কিছুদিন পর হোসে আর্কাদিও তার মায়ের সঙ্গে করা প্রতিজ্ঞা ভেঙে তাকে মুক্ত করে, যেখানে খুশি যাওয়ার অনুমতি দিলে সে বলে, ‘রাস্তায় করার মতো আমার কিছুই নেই।’
ধীরে ধীরে পাঠোদ্ধার করতে থাকা পার্চমেন্টগুলোর মধ্যেই ডুবে ঘরবন্দী হয়ে থাকে সে, যদিও ওগুলোর অনুবাদ করতে পারে না। হোসে আর্কাদিও ওর জন্য নিয়ে যেত হ্যামের চার ভাগের এক ফালি, মুখে বসন্তে রেশ রেখে যাওয়া মিষ্টি, চিনির শিরায় ভেজানো শুকনো ফুল আর দুবার বিশেষ উপলক্ষে নিয়ে আসে এক গ্লাস ভালো মদ। পার্চমেন্টের ব্যাপারে কোনো উৎসাহ জাগে না তার। তার কাছে ওটা ছিল সময় কাটানোর জন্য এক সর্বজন-অবোধ্য উপায়, তবে দৃষ্টি কাড়ে তার এই নিঃসঙ্গ স্বজনটির বিরল প্রজ্ঞা ও জগৎ সম্বন্ধে ব্যাখ্যার অতীত জ্ঞান। বুঝতে পারে যে আউরেলিয়ানো ইংরেজি বুঝতে পারে। পার্চমেন্টগুলো পড়ার মাঝে সময় বের করে ছয়টি বিশ্বকোষের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সে উপন্যাসের মতো পড়ে ফেলেছে। আর ফলে বুঝে নেয় যে এভাবেই সে রোম সম্বন্ধে এমনভাবে কথা বলতে পারে যেন অনেক দিন ওখানে থেকেছে; কিন্তু খুব শিগগির সে বুঝতে পারে যে তার জ্ঞান বিশ্বকোষজনিত নয়, যেমন জিনিসপত্রের দাম। ‘সবই জানা যায়’-এসব তথ্য পাওয়ার ব্যাপারে তাকে প্রশ্ন করায় শুধু এই উত্তর পায়। অন্যদিকে আউরেলিয়ানো অবাক হয়ে যায় যখন আবিষ্কার করে হোসে আর্কাদিওর বাড়িময় পায়চারি করে বেড়ানোর সময়ে তার যে চেহারা সে কল্পনা করেছিল, তার থেকে অন্য রকম লাগে সামনাসামনি দেখলে। সে হাসতে জানত, বাড়িটার অতীত নিয়ে স্মৃতিকাতরতায় ভুগতে পারত আর মেলকিয়াদেসের ঘরের দৈন্যতায় উদ্বিগ্নও হতে পারত। একই রক্তের দুই নিঃসঙ্গ মানুষের এই নিকটবর্তিতা ছিল বন্ধুত্ব থেকে অনেক দূরে কিন্তু এটাই উভয়কে একই সঙ্গে আলাদা ও একত্র করে দেওয়া তলহীন নিঃসঙ্গতাটাকে সহ্য করতে সাহায্য করে। ফলে হোসে আর্কাদিও ওকে নাকাল করা কিছু গৃহস্থালি সমস্যা নিয়ে আউরেলিয়ানোর শরণাপন্ন হতে পারে আর একইভাবে আউরেলিয়ানো বারান্দায় গিয়ে বই পড়ার, নিয়মিত আসা আমারান্তা উরসুলার চিঠিগুলো এলে সেগুলো নেওয়ার ও স্নানঘর ব্যবহারের অনুমতি পায় যে স্নানঘরের ব্যবহার থেকে ওকে বঞ্চিত করেছিল হোসে আর্কাদিও ফেরার পর থেকেই।
এক গরম ভোরে দুজনেই আঁতকে জেগে ওঠে সদর দরজায় মুহুর্মুহু করাঘাতে। লোকটা ছিল এক কৃষ্ণবর্ণ বৃদ্ধ, যার সবুজরঙা বড় চোখ দুটো তার চেহারায় এনেছিল এক ভৌতিক অনুপ্রভা আর তার কপালে ছিল এক ছাইয়ের ক্রস। তার জামাকাপড় ছিল ছেঁড়াফাঁড়া, জুতো ক্ষয়ে যাওয়া আর মালপত্র বলতে ছিল কাঁধে ঝোলানো পুরোনো ব্যাগটা আর দেখতে ভিক্ষুকের মতো হলেও সম্ভ্রমজাগানো এমন হাবভাব ছিল তার, যেটা ছিল বাহ্যিক অবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত। এমনকি বৈঠকখানার ছায়ান্ধকারের মধ্যেও একবারের দৃষ্টি দেওয়াই বোঝার জন্য যথেষ্ট ছিল যে আত্মরক্ষার তাগিদ নয়, বরং গোপন মজ্জাগত এক ভীতির শক্তিই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সে ছিল আউরেলিয়ানো আমাদর, কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার সতেরো জন ছেলের মধ্যে একমাত্র জীবিত আর সে তার লম্বা বিড়ম্বনাপূর্ণ ফেরারি জীবনের সঙ্গে আপস করতে চাইছে। নিজের পরিচয় দিয়ে অনুনয় করে বলে আশ্রয় দিতে, কারণ তার নেড়িকুত্তার মতো কাটানো রাতগুলো তাকে জানিয়েছে যে এই বাড়িটাই হচ্ছে তার অবশিষ্ট জীবনের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু হোসে আর্কাদিও ও আউরেলিয়ানো ওকে মনে করতে পারে না। ভবঘুরে মনে করে ওরা তাকে রাস্তায় বের করে দেয়। আর দুজনেই দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে পায় এক নাটকের শেষ দৃশ্য, যে নাটকের শুরু ছিল হোসে আর্কাদিওর বোধবুদ্ধি হওয়ারও আগে। বছরের পর বছর অর্ধেক দুনিয়াজুড়ে ডালকুত্তার মতো তাড়া করে ফেরা দুই পুলিশের এজেন্ট উদয় হয় বাড়ির উল্টো দিকের আলমন্ড গাছগুলোর মধ্য দিয়ে আর মাউজার দিয়ে করা গুলি দুটো নিখুঁতভাবে সেঁধিয়ে যায় ছাইয়ের ক্রসের মধ্য দিয়ে।
সত্যিকার অর্থে বাচ্চাগুলোকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর হোসে আর্কাদিও বড়দিনের আগে নেপলসগামী এক আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেওয়া এক জাহাজের খবরের অপেক্ষায় ছিল। আউরেলিয়ানোকে আগেই কথাটা জানিয়ে রেখেছে সে আর এমনকি আউরেলিয়ানোর জীবনযাপনের জন্য একটা ব্যবসা আরম্ভ করে দেওয়ার কথাও ভেবেছে, কারণ ফের্নান্দার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর আর খাবার ভরা ঝুড়িগুলো আর আসে না, অবশ্য তার শেষ স্বপ্ন পূরণ হতে তখনো বাকি ছিল। এক সেপ্টেম্বরের সকালে পাকঘরে আউরেলিয়ানোর সঙ্গে কফি পানের পর হোসে আর্কাদিও তার দৈনন্দিন স্নান সারছিল, যখন চালের টালি সরিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে সেই চারটে ছেলে, যাদের সে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। ওকে আত্মরক্ষার কোনো সুযোগ না দিয়ে পোশাক পরা অবস্থাতেই চৌবাস্তায় ঢুকে তার চুল ধরে মাথাটা পানির নিচে ডুবিয়ে রাখে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার মুমূর্ষু অবস্থার বুদ্বুদগুলো মিলিয়ে যায় আর নিস্পন্দ পাণ্ডুর ডলফিন শরীরটা তলিয়ে যায় সুগন্ধি পানির তলদেশে। পরে ওরা তিন বস্তা সোনা নিয়ে যায়, যেটার অবস্থান ওরা ও ওদের শিকারই শুধু জানত। এটা ছিল এমন এক অকস্মাৎ, সুশৃঙ্খল ও পাশবিক হামলা, যা ছিল একেবারে সামরিক অভিযানের মতো। ঘরবন্ধ আউরেলিয়ানো এসবের কিছুই জানতে পারে না। সেই বিকেলে পাকঘরে ওকে না পাওয়ায় সারা বাড়ি ওকে খুঁজে সে আর পায় ওকে চৌবাচ্চার সুগন্ধি আয়নার ওপর ভেসে থাকা অবস্থায়; বিশাল ফুলে ওঠা শরীরে তখনো ভাবছে আমারান্তার কথা। একমাত্র তখনই উপলব্ধি করে কতটুকু ভালোবাসতে শুরু করেছিল সে হোসে আর্কাদিওকে।