নিঃসঙ্গতার একশ বছর – ২

যখন জলদস্যু ফ্রান্সিস দ্রেক ষোড়শ শতকে রিওয়াচা আক্রমণ করে, তখন উরসুলা ইগুয়ারানের পরদাদি বিপদঘণ্টা আর কামানের গোলার শব্দে দিশা হারিয়ে জ্বলন্ত উনুনের ওপর বসে পড়েছিল। সেই আগুনের ক্ষত তাকে করে দিয়েছিল সারা জীবনের জন্য এক অকর্মা বউ। সম্পূর্ণভাবে বসতে পারত না সে, বসত এক পাশে ভর করে, বালিশের সাহায্যে। তার হাঁটাচলায় অজ্ঞাত কিছু একটা ছিল, যে কারণে সে আর কখনোই জনসমক্ষে হাঁটেনি। গা থেকে পোড়া গন্ধ বের হয়, এমন বদ্ধমূল ধারণা থাকায় সব ধরনের সামাজিক কাজ থেকে সে বিরত থাকত। নির্ঘুম ভোর, আঙিনায় তাকে চমকে দিত। কারণ সে দুঃস্বপ্ন দেখত যে ইংরেজরা তাদের হিংস্র কুকুরসহ জানালা দিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে উত্তপ্ত লাল লোহা তার ভেতর লজ্জাজনকভাবে ঢুকিয়ে অত্যাচার করছে। স্প্যানিশ ব্যবসায়ী যে স্বামীর ঔরসে তার দুই সন্তান রয়েছে, সে ওষুধপথ্য আর আনন্দফুর্তির পেছনে দোকানের অর্ধেকটা ফতুর করে ফেলে স্ত্রীর ভয় কাটানোর জন্য। সবশেষে ব্যবসা লাটে তুলে তাকে নিয়ে যায় সমুদ্র থেকে দূরে পাহাড়ের পাদদেশে এক নিরীহ আদিবাসীদের লোকালয়ে, যেখানে বানায় স্ত্রীর জন্য এক শোবার ঘর। ওটাতে কোনো জানালা ছিল না, যা দিয়ে তার দুঃস্বপ্নের জলদস্যুরা ঢুকতে পারে।

সেই গোপন লোকালয়ে অনেক আগে থেকে বাস করত দন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া নামের এক আদিবাসী তামাকচাষি, যার সঙ্গে উরসুলার দাদির বাবা এমন এক লাভজনক অংশীদারি ব্যবসা গড়ে তোলে যে কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের ভাগ্য ফেরে। কয়েক শতাব্দী পর সেই আদিবাসীর নাতির নাতি বিয়ে করে স্প্যানিশ নাতনির নাতনিকে। এর ফলে, প্রতিবার যখন স্বামীর পাগলামি উরসুলাকে ক্ষিপ্ত করত, তখন সে তিন শ বছরের ঘটনাচক্রের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত, শাপান্ত করত ফ্রান্সিস দ্রেকের রিওয়াচা আক্রমণের সময়টিকে। এটা ছিল শুধুই মনের ভার লাঘবের একটা উপায়, কারণ আসল কথা হচ্ছে ওরা ছিল আমৃত্যু ভালোবাসার চেয়েও শক্ত, অভিন্ন এক বিবেকদংশনে বাঁধা। ওরা ছিল জ্ঞাতিভাইবোন। ওদের পূর্বপুরুষদের শ্রম আর প্রথা একসঙ্গে বেড়ে ওঠা প্রাচীন লোকালয়কে প্রদেশের সবচেয়ে ভালো গ্রামগুলোর একটিতে পরিণত করেছিল। যদিও যখন ওরা এই পৃথিবীতে আসে, তখন থেকেই ওদের বিয়ে ছিল পূর্বনির্ধারিত। কিন্তু যখন ওরা পরস্পরকে বিয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করে, তখন ওদের নিজেদের আত্মীয়রাই তাতে বাধা দেয়। ভয় ছিল যে দুই বংশের এই স্বাস্থ্যবান জুটি বংশপরম্পরায় নিজেদের মধ্যে উপর্যুপরি সংকরের ফলে ইগুয়ানার (গিরগিটি) মতো সন্তান জন্ম দিয়ে লজ্জা পেতে পারে। এ রকম একটা ভয়ংকর উদাহরণ আগে থেকেই ছিল। উরসুলার এক খালার বিয়ে হয়েছিল হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার এক চাচার সঙ্গে, জন্ম দিয়েছিল এমন এক ছেলের যে সারা জীবন ফোলানো ও ঢিলে প্যান্ট পরত, সে মারা গিয়েছিল বিয়াল্লিশ বছর বয়সে রক্তপাত হয়ে চিরকুমার অবস্থায়। কারণ জন্ম নিয়েছিল আর বেড়ে উঠেছিল মদের বোতলের ছিপি খোলার যন্ত্রের মতো কোমল স্থির এক কুণ্ডলী পাকানো লেজ নিয়ে, যার ডগায় ছিল বুরুশসদৃশ একগোছা চুল। যেটা ছিল শূকরের লেজ, যা কিনা কখনোই কোনো মেয়েকে সে দেখতে দেয়নি। আর এই লেজের জন্য নিজের জীবন দিতে হয়েছিল যখন এক কসাই বন্ধু অনুগ্রহ করে হাড় কাটার কুঠার দিয়ে কেটে দিয়েছিল সেটি। লঘুমনস্ক উনিশ বছরের হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া এই সমস্যার সমাধান করে দেয় একটিমাত্র বাক্যে—’শুয়োরের ছানা হলেও কিছু আসে যায় না, যদি নাকি শুধু কথা বলতে পারে।’ এভাবেই ওরা বিয়ে করে তিন দিনব্যাপী গানবাজনা আর আতশবাজিপূর্ণ উৎসবের মধ্য দিয়ে। উরসুলার মা যদি সব সময় ওদের অনাগত সন্তানের ব্যাপারে অশুভ ভবিষ্যদ্বাণী না করত, এমনকি ওদের সহবাস না করার উপদেশ দেওয়ার মতো চরম পর্যায়ে না যেত, তাহলে ওরা সুখেই থাকত। শক্ত সমর্থ, স্বেচ্ছাচারী স্বামী ঘুমের মাঝে ধর্ষণ করতে পারে, এই ভয়ে উরসুলা শোবার সময় ওর মার হাতে তৈরি প্রাচীনকালের প্যান্ট পরত, যেটাকে মজবুত করা হয়েছিল একধরনের ফিতে ও আড়াআড়ি তার জুড়ে দিয়ে, যেটা বন্ধ করা যেত সামনের দিক থেকে খুব মোটা লোহার বক্লেস দিয়ে। এভাবেই কাটায় ওরা কয়েক মাস। দিনের বেলাটা কাটত লড়াইয়ের মোরগগুলো দেখাশোনা করে আর মায়ের সঙ্গে ফ্রেমে এমব্রয়ডারি করে। আর রাতের বেলা কাটাত ঘণ্টা কয়েক ব্যগ্র, তীব্র উত্তেজনাময় জোরাজুরি করে যেন সেটা ছিল যৌনমিলনের বিকল্প। এই অবস্থা চলতে থাকে যতক্ষণ না জনপ্রিয় স্বজ্ঞা গন্ধ পেয়ে যায় যে অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটছে আর গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে বিয়ের এক বছর পরও উরসুলা হচ্ছে কুমারী, কারণ তার স্বামী একটা নপুংসক। গুজবটা সর্বশেষ যে ব্যক্তির কানে গিয়ে পৌঁছায় সে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া।

‘দেখছিস উরসুলা, লোকজন কী বলছে,’ স্ত্রীকে বলে খুব শান্তভাবে।

‘ওদেরকে বলতে দাও’, উত্তর দিল, ‘আমরা জানি ওটা সত্য নয়।’

অবস্থাটা এ রকম থাকে আরও ছয় মাস, অবশেষে এক করুণ রোববারে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, প্রুদেনসিও আগিলারের সঙ্গে এক মোরগলড়াই-এ জেতে। ক্রোধোন্মত্ত পাশবিক উত্তেজনায় সে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার কাছ থেকে খানিকটা দূরে সরিয়ে নেয় নিজেকে, যাতে তা গ্যালারির সকলে শুনতে পারে, যা সে বলতে চায়।

‘তোকে অভিনন্দন’–চিৎকার করে, ‘দেখা যাক শেষ পর্যন্ত এই মোরগ তোর বউয়ের কাজে লাগে কি না।’ শান্ত হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া নিজের মোরগটা তুলে নেয়। ‘এখনই ফিরে আসছি’, সবাইকে উদ্দেশ করে বলে। পরে প্রুদেনসিও আগিলারকে লক্ষ্য করে বলে, ‘আর তুইও বাড়ি যা, অস্ত্র নিয়ে তৈরি হ, কারণ তোকে মেরে ফেলব।’ মিনিট দশেক পর দাদার ধারালো বল্লম নিয়ে সে ফিরে আসে। মোরগলড়াইয়ের জায়গাটায়, যেখানে গ্রামের অর্ধেক লোক জড়ো হয়েছিল, আর প্রুদেনসিও আগিলার সেখানেই অপেক্ষা করছিল। আত্মরক্ষার সময়ও পায় না সে, প্রথম আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া যে নিশানা দিয়ে এলাকার বাঘগুলোকে শেষ করেছিল ঠিক সেই রকম নিশানা আর ষাঁড়ের মতো শক্তি দিয়ে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বল্লমটাকে এমনভাবে ছোড়ে যে তা গলা ভেদ করে বেরিয়ে যায় প্রুদেনসিওর। সেই রাতে যখন মোরগলড়াইয়ের জায়গায় লাশটার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হচ্ছে, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ঢুকে শোবার ঘরে, ওর বউ তখন শাস্তির প্যান্টটি পরছে। ‘ওটা খোলো’, আদেশ করে। উরসুলা স্বামীর সিদ্ধান্তে কোনো সন্দেহ প্রকাশ করে না। ‘যা ঘটবে তার জন্য তুমি দায়ী থাকবে’-ফিসফিস করে। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বল্লমটা মাটিতে পোঁতে।

‘যদি ইগুয়ানারই জন্ম দাও, ইগুয়ানাই লালন করব, কিন্তু তোমার দোষে এই গ্রামে আর কেউ মারা যাবে না।’

এটা ছিল জুনের এক সুন্দর চাঁদে ভরা ঠান্ডা রাত, ওরা জেগেছিল সকাল হওয়া পর্যন্ত বিছানায় লুটোপুটি করে আর অন্যদিকে যে বাতাস বয়ে যাচ্ছিল শোবার ঘরের ভেতর দিয়ে, তা ছিল প্রুদেনসিও আগিলারের আত্মীয়দের কান্নায় ভারী।

ঘটনাটা বিবেচিত হয়েছিল সম্মান রক্ষার দ্বন্দ্বযুদ্ধ হিসেবে, কিন্তু তা নিয়ে ওদের বিবেকের মধ্যে একটা অস্বস্তি থেকেই যায়। এক রাতে ঘুমাতে না পেরে, উরসুলা উঠানে পানি পান করতে গেলে দেখতে পায় প্রুদেনসিও আগিলারকে, কলসির পাশে। ওকে পাণ্ডুর দেখাচ্ছিল, অভিব্যক্তি ছিল খুবই করুণ, গলার গর্তটাকে এস্পারাতো (একধরনের ঘাস) খড় দিয়ে বন্ধ করার চেষ্টা করছে। ওকে দেখে উরসুলার মনে ভয়ের বদলে করুণারই সৃষ্টি হয়। ঘরে ঢুকে স্বামীকে বলে যা দেখেছে, কিন্তু সে পাত্তা দেয় না, ‘মৃতরা বেরিয়ে আসে না’, বলে, ‘ঘটনা হলো আমরা বিবেকের দংশন সহ্য করতে পারছি না।’ দুই রাত পরে উরসুলা আবার দেখতে পায় প্রুদেনসিও আগিলারকে স্নান ঘরে; গলায় জমাট বাঁধা রক্ত পরিষ্কার করছে খড় দিয়ে। আরেক রাতে দেখে বৃষ্টির মধ্যে সে হেঁটে বেড়াচ্ছে। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বউয়ের অলীক দর্শনে উত্ত্যক্ত হয়ে বল্লম নিয়ে উঠানে বের হয় আর ওখানেই ছিল প্রুদেনসিও আগিলার তার করুণ অভিব্যক্তি নিয়ে।

‘জাহান্নামে যা’, চিৎকার করে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, ‘যতবার ফিরে আসবি, ততবারই তোকে মেরে ফেলব।’

প্রুদেনসিও আগিলারও চলে যায় না, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াও বল্লম ছোড়ার দুঃসাহস করে না। সেই থেকে সে ভালোমতো ঘুমাতে পারত না। বৃষ্টির ভেতর প্রচণ্ড বিষাদগ্রস্ত দৃষ্টিতে মৃত লোকটার তাকানো, জীবিত মানুষের জন্য তার গভীর স্মৃতিকাতরতা, আর পাশাপাশি এস্পারতো ঘাসের ছিপি ভেজানোর জন্য পানির খোঁজে উদ্বেগ নিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াতে দেখে ও বিচলিত হয়ে পড়ে। ‘ওর খুব কষ্ট হচ্ছে মনে হয়’ উরসুলা বলে ওকে, ‘দেখে মনে হয় ও খুবই একা।’ উরসুলা এতই উত্তেজিত হয়ে পড়ে যে যখন মৃত ব্যক্তিটিকে পরেরবার চুলার মুখ খুলতে দেখে তখন সে বুঝে যায় লোকটি কী খুঁজছিল। আর তখন থেকেই সারা বাড়িতে পানিভর্তি গামলা বসিয়ে রাখে। এক রাতে যখন ওকে নিজের ঘরে ক্ষত পরিষ্কার করতে দেখে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া আর সহ্য করতে পারে না।

‘ঠিক আছে প্রুদেনসিও’, ওকে বলল, ‘আমরা এই গ্রাম থেকে চলে যাব, যত দূর পারি, আর কখনোই ফিরে আসব না। এবার শান্তিতে ফিরে যা।’

এভাবেই পাহাড় পাড়ি দেয় ওরা, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার কিছু বন্ধুর মতো যুবক, বিপৎসংকুল অভিযানে উত্তেজিত, নিজেদের ঘরগুলো খুলে ফেলে বউ আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে রওনা হয় এমন এক জায়গার দিকে, যার প্রতিশ্রুতি কেউ তাদের দেয়নি। যাত্রার আগে, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বল্লমটাকে উঠানে পুঁতে, আর লড়াইয়ের অসামান্য মোরগগুলোর গলা একে একে কেটে ফেলে এই বিশ্বাসে যে এতে প্রুদেনসিও আগিলার একটু হলেও শান্তি পাবে। উরসুলা শুধু নেয় ওর সদ্য বিয়ের সময়কার কাপড়ে ভর্তি এক সুটকেস, কিছু ব্যবহার্য থালা-বাসন আর বাপের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সোনার টুকরো ভরা একটি ছোট সিন্দুক। ওরা নির্দিষ্ট কোনো ভ্রমণপথ বেছে নেয় নি। শুধু চেষ্টা করছিল রিওয়াচার উল্টো দিক ধরে এগিয়ে যেতে, যাতে কোনো পদচিহ্ন না থাকে বা কোনো পরিচিত লোকের সঙ্গে দেখা না হয়। ওটা ছিল এক অর্থহীন অভিযাত্রা। চৌদ্দ মাসের মাথায়, বানরের মাংস আর সাপের স্যুপে খারাপ হয়ে যাওয়া পেট নিয়ে উরসুলা জন্ম দেয় মানুষের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গসহ এক ছেলের। দুজন লোক এক লম্বা লাঠিতে দোলখাটিয়ায় ঝুলিয়ে অর্ধেক রাস্তা ওকে বহন করেছে, কারণ তার পা ফুলে বিকৃত হয়ে গিয়েছিল আর পায়ের শিরাগুলো বুদের মতো ফুলে উঠেছিল। যদিও বাচ্চাদের শুকিয়ে যাওয়া পেট আর দুর্বল চোখ দেখে করুণা হতো, কিন্তু বাচ্চারাই এই সফরটাকে সহ্য করেছিল বড়দের চেয়ে বেশি, বেশির ভাগ সময়ই এটা ছিল ওদের কাছে আনন্দময়। এক সকালে, প্রায় দুই বছর পর, ওরাই ছিল প্রথম মানুষ, যারা দেখতে পায় পাহাড়ের পশ্চিম ঢালু। মেঘাচ্ছন্ন চূড়া থেকে অনুমান করা যাচ্ছিল বিশাল সমতল জলপ্লাবিত এলাকা, যা পৃথিবীর অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু কখনোই ওরা সমুদ্র খুঁজে পায় না। এক রাতে, জলাভূমিতে অনেক মাস হারিয়ে যাওয়ার পর, সর্বশেষ দেখা আদিবাসী থেকে অনেক দূরে ছাউনি ফেলে এক পাথুরে নদীর পাড়ে, যার পানি ছিল ঠান্ডা কাচের মতো। অনেক বছর পর, দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধের সময় কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া এই একই রাস্তা ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছিল রিওয়াচাকে চমকে দিয়ে দখলের জন্য আর ছয় দিন ভ্রমণের পর বুঝতে পারে যে সেটা ছিল একটা পাগলামি। আর অন্যদিকে যে রাতে ওর বাবা নদীতীরে ছাউনি ফেলেছিল, তার পদাতিক বাহিনীর অবস্থা ছিল পালানোর সুযোগবিহীন জাহাজডুবির মতো, কিন্তু যাত্রাপথে তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে আর সবাই প্রস্তুত ছিল (আর সফলও হয়) বৃদ্ধাবস্থায় মরার জন্য। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ওই রাতে স্বপ্ন দেখে যে ওই জায়গায় তৈরি হচ্ছে এক কোলাহলমুখর শহর, যার বাড়িগুলো তৈরি কাচের দেয়াল দিয়ে। জিজ্ঞেস করে কোন শহর ওটা, আর উত্তর আসে এমন একটা নামের, যা কখনোই সে শোনেনি, যার কোনো অর্থও ছিল না, কিন্তু স্বপ্নে পেল এক অতিপ্রাকৃত প্রতিধ্বনি ‘মাকন্দ।’ পরের দিন সে ওর লোকদের বিশ্বাস করাতে পারে যে সাগর কখনোই খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওদের নির্দেশ দেয় গাছ সরিয়ে নদীর পাশে এক ফাঁকা জায়গা তৈরি করতে, নদীর কিনারার সবচেয়ে ঠান্ডা জায়গায়, আর সেখানে পত্তন করে গ্রামটির।

হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া স্বপ্নের ঘরের কাচের দেয়ালগুলোর রহস্য উন্মোচন করতে সমর্থ হয় সেদিন, যেদিন সে বরফের সঙ্গে পরিচিত হয়। সুতরাং বিশ্বাস করে যে সে বুঝতে পেরেছে স্বপ্নের গভীর অর্থ। ভাবে খুব নিকট ভবিষ্যতেই বিরাট অঙ্কের বরফের ব্লক বানাতে পারবে, যা তৈরি হয় পানির মতো এক দৈনন্দিন উপাদান দিয়ে, আর তা দিয়ে তৈরি হবে গ্রামের নতুন বাড়িগুলো। মাকন্দ আর গা-পোড়ানো এক গ্রাম থাকবে না, যেখানে কলকবজা আর কড়া নাড়ার লোহাগুলো গরমে বেঁকে যায়, বরং পরিণত হবে এক শীতকালীন শহরে। সে যদি তখন একটা বরফের কারখানা বানানোর জন্য গোঁ ধরে না থাকে, তার কারণ হচ্ছে তখন ও সত্যিকার অর্থেই উৎসাহী হয়ে পড়েছিল ছেলেদের শিক্ষা দেওয়ায়, বিশেষ করে আউরেলিয়ানোর ব্যাপারে যার নাকি প্রথম থেকেই আলকেমির প্রতি এক স্বজ্ঞাবোধ রয়েছে। ধুলো ঝেড়ে পরীক্ষাগারটা পরিষ্কার করা হয়। মেলকিয়াদেসের টিকাগুলো পর্যালোচনা করা হয়, এবার ঠান্ডা মাথায়, নতুনের উত্তেজনা নিয়ে নয়, দীর্ঘ সময় আর ধৈর্য নিয়ে ধাপে ধাপে চেষ্টা করে পাত্রের তলা থেকে উরসুলার স্বর্ণ টুকরোগুলোকে আলাদা করার। কিশোর হোসে আর্কাদিও প্রক্রিয়াটায় নামে মাত্র অংশগ্রহণ করে। যখন ওর বাবার দেহ ও মন ছিল শুধু পরীক্ষাগারের পানির নলে নিমগ্ন, তখন সাহায্যে আগ্রহী প্রথম সন্তান বেড়ে উঠছিল বয়সের তুলনায় অনেক বেশি, পরিবর্তিত হয়েছিল এক প্রমাণাকৃতির দশাসই কিশোরে। তার গলার স্বর গিয়েছিল বদলে। বয়ঃসন্ধিতে লোম গজানোর জায়গাগুলো ভরে উঠেছিল কোমল সদ্য গজানো পশমে। এক রাতে উরসুলা প্রবেশ করে ওর ঘরে, যখন সে ঘুমাতে যাওয়ার জন্য কাপড় খুলছে, আর অনুভব করে লজ্জা আর দয়ার মাঝে এক বিভ্রান্তিকর মনোভাবের। স্বামীর পর ওটাই ছিল তার প্রথম নগ্ন পুরুষ দেখা, জীবনযাপনের জন্য ওকে এতটাই পরিপূর্ণ দেখাচ্ছিল যে উরসুলার কাছে তা অস্বাভাবিক মনে হলো। তৃতীয়বারের মতো পোয়াতি উরসুলার মধ্যে সদ্য বিবাহের ভয়গুলো আবার নতুন করে জেগে ওঠে।

ওই সময় ওদের বাড়িতে যেত আনন্দোচ্ছল, ঠোঁটকাটা স্বভাবের ও উদ্দীপক ধরনের এক মেয়ে যে গৃহস্থালি কাজে সাহায্য করত আর তাস দেখে বলতে পারত ভবিষ্যদ্বাণী। উরসুলা ছেলের কথা জানায় ওকে, সে ভেবেছিল এই অপ্রাকৃতিক অসামঞ্জস্য, জ্ঞাতিভাইয়ের শূকরের লেজের মতোই একটা ব্যাপার। শুনে উচ্চকণ্ঠে মেয়েটা এমন হাসি হাসে, যার প্রতিধ্বনি বাজে সারা ঘরময়, যেন কাচগুলো ভেঙেচুরে পড়বে। ‘ঠিক এর উল্টো বলল। ‘ও খুব সুখী হবে।’ ওর কথার সত্যতা প্রমাণের জন্য দিন কয়েকের মধ্যেই ওদের বাড়িতে নিয়ে যায় তাস, আর পাকঘরের পাশে শস্যের গুদামঘরে হোসে আর্কাদিওকে নিয়ে ঘর বন্ধ করে সুতোরদের বেঞ্চের ওপর তাসগুলো মেলে ধরে শান্তভাবে। মেয়েটা যখন যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছিল, তখন ওর কাছে বসে থাকা কিশোরটি যতটা না আচ্ছন্ন, তার চেয়ে ছিল বেশি বিরক্ত। মেয়েটা হঠাৎ করেই হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করে ওকে। ‘ওরে বাপ’, সত্যিকার অর্থেই মেয়েটি চমকে উঠে বলে, আর ওটুকুই ছিল তার বলা সবকিছু। হোসে আর্কাদিও অনুভব করে সব হাড় ফেনায় ভরে উঠছে। পা অবশ করা এক ভয় আর প্রচণ্ড কেঁদে ফেলার ইচ্ছা পেয়ে বসে তাকে। মেয়েটি কোনো রকমের ইঙ্গিতই করে নি। কিন্তু হোসে আর্কাদিও সারা রাত খুঁজে বেড়ায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেঁটে থাকা ওর বগলতলার ধোঁয়াটে গন্ধ। ওর সঙ্গে থাকতে চাইছিল সর্বক্ষণ। মনে হচ্ছিল মেয়েটা যদি ওর মা হতো বা কখনোই গুদামঘর ছেড়ে না যেত, আর আবার স্পর্শ করে বলত; ওরে বাপ। একদিন আর সহ্য করতে না পেরে ওকে খুঁজতে যায় ওর বাড়ি। এই দেখা করাটা ছিল সাদামাটা কিন্তু অবোধ্য, আর বসার ঘরে বসেছিল একটি কথাও না বলে। এই সময় ওকে সে কামনা করে নি। ওকে পায় সে অন্যভাবে। যে গন্ধ তার মধ্যে এই মেয়েটার ব্যাপারে একটা ছবির জন্ম দিয়েছে, তা থেকে অনেক দূরে মনে হয় যেন সে অন্য এক মেয়ে। কফি খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে বিষণ্ন মনে। সেই রাতে নির্ঘুম ভয়ংকর মুহূর্তগুলোয় ওকে আবার কামনা করে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা নিয়ে, কিন্তু তখন ওকে চাইছিল যেমনটি দেখেছিল বিকেলে, গুদামঘরে দেখা অবস্থায় নয়।

কয়েক দিন পর হঠাৎ করেই মেয়েটা ওকে ডেকে নিয়ে যায় ওদের বাড়িতে। যেখানে শুধু ছিল মেয়েটার মা আর তাসের একটা হাতসাফাই শেখানোর অছিলায় নিয়ে যায় ওকে শোবার ঘরে। সুতরাং বাধামুক্ত হয়ে এমনভাবে ওকে স্পর্শ করে যে প্রাথমিক শিহরণ কেটে যাওয়ার পর সে হয়ে পড়ে হতাশাচ্ছন্ন আর আনন্দের চেয়ে ভয়ই পায় বেশি। মেয়েটা ওকে বলে সেই রাতে ওর কাছে যেতে। ও রাজি হয় শুধু ওখান থেকে বেরোনোর জন্য, কারণ জানত যাওয়ার সাধ্য তার ছিল না। কিন্তু সেই রাতে, জ্বলন্ত বিছানায় বুঝতে পারে যে তার যেতেই হবে, যদিও তার যাওয়ার সাধ্য নেই। অন্ধকারে ভাইয়ের শান্ত শ্বাস-প্রশ্বাস, পাশের ঘরে বাবার শুকনো কাশি, উঠানের মুরগিগুলোর হাঁসফাঁস, মশার গুনগুনানি, নিজের বুকের ধড়ফড়ানি এর আগে কখনোই শোনে নি পৃথিবীর এমন নানা রকমের শব্দের মাঝে হাতড়ে পোশাক পরে বের হয় সে ঘুমন্ত রাস্তায়। সে সব সত্তা দিয়ে চাইছিল, যেমনটি সে কথা দিয়েছিল, তেমনিভাবে যেন শুধু ভেজানো নয়, দরজাটা যেন ভালোভাবে হুড়কো লাগানো থাকে। কিন্তু ওটা ছিল খোলা। ওটাকে ধাক্কা দেয় সে আঙুলের ডগা দিয়ে আর কড়াগুলো বিশ্রীভাবে ক্যাতরিয়ে ওঠে আর তার প্রতিধ্বনি ওর অন্ত্রের মধ্যে এক হিমশীতল অনুভূতি জাগায়। তেরছাভাবে কোনো রকম শব্দ না করে যেই মুহূর্তে ঢোকে, তখন থেকেই পায় সে গন্ধটা। তখনো সে ছিল সেই বসার ঘরে যেখানে মেয়েটার তিন ভাই দোলবিছানা ঝোলাত, যার অবস্থান আর দিক ছিল তার কাছে অজানা। অন্ধকারের মাঝে তা বোঝা ছিল অসম্ভব, সুতরাং একমাত্র উপায় ছিল ঘরটা হাতড়ে পার হওয়া আর শোবার ঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়ে কোনো ভুল না করে সঠিক বিছানার কাছে নিজেকে নিয়ে যাওয়া। ধাক্কা খায় সে দোলবিছানার দড়িগুলোর সঙ্গে, যেগুলোর অবস্থান ছিল যেমনটি সে ভেবেছিল তার থেকেও নিচে, আর নাকডাকা এক লোক সেই মুহূর্তে স্বপ্নটাকে গুলিয়ে ফেলে একধরনের বিভ্রমের মাঝে আর বলে ওঠে, ‘ওটা ছিল বুধবার।’ যখন শোবার ঘরে দরজা ধাক্কা দেয়, তখন মেঝের ঢেউখেলানো তলের সঙ্গে দরজার ঘষা এড়াতে পারে না। নিকষ অন্ধকারে, হঠাৎ করেই প্রতিকারহীন এক স্মৃতিকাতরতার সঙ্গে বুঝতে পারে যে সে পুরোপুরি দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। অপরিসর সেই ঘরে ঘুমাত ওর মা, স্বামীসহ অন্য একটি মেয়ে তাদের দুই শিশু ছেলেকে নিয়ে, আর সেই মেয়েটি যে হয়তো অপেক্ষা করছিল না। গন্ধটা ওকে হয়তো পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারত, যদি-না তা সারা বাড়িময় ছড়িয়ে থাকত। এমন বিভ্রান্তিকর আর একই সঙ্গে এমন ধ্রুব ছিল সেই গন্ধ যে তা লেগেছিল সব সময় তার নিজের সত্তার সঙ্গে। স্থির হয়ে ছিল দীর্ঘক্ষণ, আশ্চর্য হয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করছিল কীভাবে এসে পড়েছে সে এই বিপুল অসহায়তার মধ্যে আর তখনই প্রসারিত আঙুলসহ একটা হাত অন্ধকার হাতড়ে এসে ওর মুখের সঙ্গে ধাক্কা খায়। বিস্মিত হয় না সে, কারণ নিজের অজান্তেই সে অপেক্ষা করছিল হাতটার জন্য।

সুতরাং আস্থা রাখে হাতটির ওপর আর প্রচণ্ড অবসাদে ভেঙে পড়ে হাতটাকে নিয়ে যেতে দেয় এমন জায়গায় যেখানে ওকে কাপড় খুলে ঝাঁকানো হয় এপাশ-ওপাশ করে, সোজাভাবে আবার উল্টো করে আলুর বস্তার মতো। ব্যাপারটা ঘটে এক রহস্যময় অন্ধকারে, যে অন্ধকারে হাতের কোনো অভাব ছিল না, যেখানে সে আর মহিলার গন্ধ নয়, বরং অ্যামোনিয়ার গন্ধ পায়, যেখানে সে চেষ্টা করছিল মনে করতে মেয়েটার মুখ, কিন্তু খুঁজে পেল শুধু উরসুলার মুখ, যেখানে বিভ্রান্ত সচেতন অবস্থায় এমন কিছু করছিল, যা অনেক আগে থেকেই কামনা করছিল করতে পারার, কিন্তু কখনোই কল্পনা করে নি যে বাস্তবে সে তা করতে পারবে। সে যা করছিল তা না জেনেই করছিল, কারণ জানত না কোথায় রয়েছে তার পা, মাথা অথবা কার পা বা কার মাথা। টের পাচ্ছিল আর বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারবে না বৃক্ক আর অন্ত্রের বাতাসের হিমশীতল ফিসফিসানি আর ভয়। ইচ্ছা করছিল দিগ্‌বিদিক চিন্তা না করে পালাতে আর একই সঙ্গে সব সময়ের জন্য থেকে যেতে সেই নীরব উত্তেজনায়, সেই ভয়ংকর নিঃসঙ্গতায়।

ওর নাম ছিল পিলার তেরনেরা, মাকন্দ পত্তনের সময়ে গ্রামত্যাগীদের একজন। ওর পরিবারের লোকজন ওকে জোর করে নিয়ে আসে সেই লোকটার কাছ থেকে যে ওকে চৌদ্দ বছর বয়সে ধর্ষণ করেছিল আর সে তাকে ভালোবেসেছিল বাইশ বছর বয়স পর্যন্ত, কিন্তু কখনোই জনসমক্ষে তা প্রকাশ করে নি, কারণ লোকটা ছিল অচেনা। লোকটা প্রতিজ্ঞা করেছিল যে দুনিয়ার শেষ পর্যন্ত হলেও অনুসরণ করবে ওকে, তবে তখনই নয়, আরও পরে যখন সবকিছু গোছগাছ করতে পারবে। তাসগুলোর প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী স্থলপথ বা জলপথে, তিন দিন, তিন মাস বা তিন বছরব্যাপী অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে লম্বা, বেঁটে, তামাটে ও শ্যামলা রঙের সব পুরুষদের মধ্যেই মেয়েটা দেখতে পেত লোকটাকে। অপেক্ষায় থেকে থেকে সে হারিয়ে ফেলেছে ঊরু আর স্তনের দৃঢ়তা, মনের কোমলতা কিন্তু হৃদয়ের উন্মত্ততা অটুট ছিল পুরোপুরি। সেই আশ্চর্য খেলনায় উন্মত্ত হয়ে হোসে আর্কাদিও খুঁজে বেড়ায় ওর মুখ, প্রতি রাতে ঘরগুলোর গোলকধাঁধায়। এক বিশেষ মুহূর্তে সে দরজটা বন্ধ অবস্থায় পায়, বারবার টোকা দিতে থাকে এটা জেনে যে একবার সাহসী হয়ে প্রথমবার টোকা দিলে শেষ পর্যন্ত টোকা তাকে দিয়েই যেতে হবে। অনন্ত অপেক্ষার পর মেয়েটা দরজা খুলে দিত। দিনের বেলা ঘুমকাতুরে বিধ্বস্ত সে উপভোগ করত গত রাতের স্মৃতিগুলো। কিন্তু উচ্ছল, উদাসীন ও প্রগলভ মেয়েটা যখন ঘরে ঢুকত, সে তখন নিজের উত্তেজনা আড়াল করার কোনো চেষ্টাই করত না, কারণ যে মহিলার অট্টহাস্যে কবুতরগুলো ভয়ে শিউরে উঠত, যেন সেই অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই ছিল না। যে অদৃশ্য শক্তি তাকে শিখিয়েছিল ভেতরের দিকে নিশ্বাস নিতে আর হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি নিয়ন্ত্রণ করতে শেখাতে, আর বুঝতে শিখিয়েছিল মানুষ কেন মরণকে ভয় পায়। সে এতে এতই মগ্ন ছিল যে ওর বাবা আর ভাইয়েরা যখন সব বাধা ভেদ করে ধাতব পাত্রের থেকে উরসুলার সোনা পৃথক করার সাফল্যে সারা বাড়িতে আনন্দের ঝড় তুলে দেয়, সে সেই আনন্দের কারণও বুঝতে পারে না।

আসলে প্রচণ্ড জটিলতা আর ক্রমাগত চেষ্টার ফলেই সফল হয়েছিল ওরা। আনন্দিত হয়েছিল উরসুলা, এমনকি আলকেমি সৃষ্টির কারণে সে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়েছিল। অন্যদিকে গ্রামের লোকজন জড় হয়ে পরীক্ষাগারটাকে পিষে ফেলছিল। ওদের তারা খেতে দিয়েছিল বিস্কুটের সঙ্গে পেয়ারার তৈরি মিষ্টি, আশ্চর্যজনক এই ব্যাপারটা উদ্‌যাপন করতে। আর হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া দেখাচ্ছিল সোনাসহ গলানোর পাত্রটাকে, যেন সে এইমাত্র ওটা আবিষ্কার করেছে।

এভাবে দেখাতে দেখাতে সে শেষে বড় ছেলের সামনে আসে, যে কিনা শেষের দিকে খুব কম সময়ই পরীক্ষাগারে উঁকি দিত। শুকানো, হলদে, আঠালো পদার্থটাকে তার সামনে রেখে প্রশ্ন করে, ‘এটা দেখে কি মনে হয়’ হোসে আর্কাদিও আন্তরিকতার সঙ্গেই জবাব দেয়, ‘কুত্তার গু।’

ওর বাবা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ওর মুখে কষে এমনভাবে একটা চড় মারে যে রক্ত আর চোখে পানি চলে আসে ওর। সেই রাতে পিলার তেরনেরা অন্ধকার হাতড়ে বোতল আর তুলো খুঁজে ফুলো জায়গায় আর্নিকা লাগিয়ে দেয় আর ও যাতে বিরক্ত না হয় এমনভাবে তাকে ভালোবাসে, একটুও ব্যথা না দিয়ে। ওরা মিলনে এমন অবস্থায় পৌঁছায় মুহূর্তের মধ্যে নিজেদের অজান্তেই ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করে—

‘কেবল তোর সঙ্গে থাকতে চাই’, সে বলে, ‘শিগগিরই একদিন পৃথিবীর সবাইকে জানিয়ে দেব আর শেষ হবে এই লুকোচুরি।’

ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে না—

‘ভালোই হবে’, বলে পিলার, ‘যদি আমরা একসঙ্গে থাকি, তাহলে ভালো করে দেখার জন্য বাতি জ্বালিয়ে রাখব আর আমি যত খুশি শিৎকার করতে পারব, কেউ তাতে বাগড়া দিতে আসবে না। আর তুই আমার কানে কানে বললি দুনিয়ার যত যৌনখিস্তি।’ এই আলাপচারিতা বাপের বিরুদ্ধে হুল ফোটানো তিক্ততা, অত্যাসন্ন লাগামহীন মিলনের সম্ভাবনা ওকে এনে দেয় এক দুঃসাহসী অনুপ্রেরণা। হঠাৎ করেই কোনো প্রস্তুতি না নিয়েই ওর ভাইকে সে সব বলে দেয়।

প্রথম দিকে ছোট্ট আউরেলিয়ানো বুঝতে পারত ব্যাপারটার ঝুঁকি আর ভাইয়ের এই দুঃসাহসিক কাজে বিপদের সমূহ সম্ভাবনার কথা, কিন্তু বুঝে উঠতে পারত না ব্যাপারটার সম্মোহনী শক্তি। একটু একটু করে ওকেও কলুষিত করে উদ্বেগ। ভাইকে বাধ্য করত সে অভিযানের খুঁটিনাটি বর্ণনা করতে, নিজেকে একাত্ম করে ফেলত ভোগান্তি আর ভোগানন্দের সঙ্গে, অনুভব করত ভয় আর সুখ। জেগে থেকে অপেক্ষা করত সকাল হওয়া পর্যন্ত। নিঃসঙ্গ বিছানা যেন ছিল জ্বলন্ত অঙ্গারে মোড়া মাদুর। দুজনে কথা বলে যেত বিছানা ছেড়ে ওঠা পর্যন্ত আর ফলে শিগগিরই দুজনকেই পেয়ে বসে নিদ্রাহীনতায়। অনুভব করে আলকেমি আর বাবার প্রজ্ঞার ওপর একই রকম অনীহা, আর আশ্রয় নেয় নিঃসঙ্গতার। ‘এই ছেলেগুলো নির্জীব হয়ে পড়েছে’ বলে উরসুলা, ‘সম্ভবত কৃমি হয়েছে।’ ওদের জন্য বানায় পাইকো (ক্রিমি মারার ভেষজ) গাছ পিষে অরুচিকর এক তরল ওষুধ। দুজনেই তা পান করে অপ্রত্যাশিত সহিষ্ণুতা নিয়ে। আর দুজনেই একই সঙ্গে যার যার মলত্যাগপাত্রে বসে একই দিনে এগারোবার আর বের করে দেয় একধরনের গোলাপি রঙের কৃমি আর প্রচণ্ড আনন্দের সঙ্গে তা দেখায় সবাইকে। এই ব্যাপারটাই উরসুলাকে ওদের অমনোযোগী আর সবকিছুতে অনীহার মূল কারণ নির্ধারণে বিভ্রান্ত করতে সাহায্য করে। তত দিনে আউরেলিয়ানো যে শুধু বুঝতে পারত তা-ই নয়, যেন ভাইয়ের অভিজ্ঞতাগুলো ছিল ওর নিজেরই জীবনের অংশ। কারণ, একসময় যখন ভালোবাসার বিবরণ দিয়ে যাচ্ছিল পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে, তখন সে বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী রকম লাগে?’ হোসে আর্কাদিও তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল, ‘এটা হচ্ছে ভূমিকম্পের মতো।’

জানুয়ারির এক বৃহস্পতিবার, ভোর দুটোর সময় জন্মায় আমারান্তা। কেউ ঘরে ঢোকার আগেই উরসুলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে ওকে। বাচ্চাটা ছিল খুবই হালকা আর গিরগিটির মতো স্বচ্ছ; কিন্তু তার সব অঙ্গ ছিল মানুষের। যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষজনে ঘর ভরে গিয়েছে, আউরেলিয়ানো নতুন এই খবরটা টেরই পায় নি। সংশয়ে আচ্ছন্ন হয়ে বিশৃঙ্খলার সুযোগে সে ভাইকে খুঁজতে বেরোয়, যে নাকি এগারোটা থেকেই বিছানায় নেই। খুঁজতে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা এতটাই ঝোঁকের বশে সে নিয়েছে যে পিলার তেরনেরার শোবার ঘর থেকে ভাইকে কীভাবে বের করে আনবে, এ নিয়ে নিজেকে সে কোনো প্রশ্নই করার সময় পায় নি। সংকেতপূর্ণ শিস দিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে বাড়ি চক্কর দেয়; শেষ পর্যন্ত ভোরের আগমনী ইঙ্গিত ওকে বাড়ি ফিরতে বাধ্য করে আর মায়ের ঘরে নবজাতক বোনের সঙ্গে এক নিষ্পাপ মুখে খেলারত অবস্থায় পায় হোসে আর্কাদিওকে।

উরসুলা কেবল চল্লিশ দিনের বিশ্রাম নেওয়া শেষ করেছে, এমন সময় ফিরে আসে জিপসিরা। ওরা একই দড়াবাজ আর ভেলকিবাজ, যারা বরফ নিয়ে এসেছিল। মেলকিয়াদেসের দল থেকে এরা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা, কারণ অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝিয়ে দেয় যে ওরা প্রগতির অগ্রদূত নয়, বরং আনন্দের ফেরিওয়ালা। এমনকি যখন তারা বরফ নিয়ে এসেছিল, তখনো বলে নি মানুষের জীবনে ওটা কীভাবে কাজে লাগে, বরং দেখিয়েছে সার্কাসের এক দুর্লভ বস্তু হিসেবে। এবার অনেকগুলো যন্ত্র কৌশলের মধ্যে নিয়ে এসেছিল এক উড়ন্ত গালিচা। কিন্তু সেটাকে যানবাহনের এক নতুন উদ্ভাবন হিসেবে না দেখিয়ে, দেখিয়েছিল এক চিত্তবিনোদনের বস্তু হিসেবে। লোকজন, অবশ্য মাটি খুঁড়ে বের করে আনে ওদের শেষ স্বর্ণের অংশটুকু, গ্রামের ঘরগুলোর ওপর দিয়ে একঝলক উড়ে আসার জন্য। সব বিশৃঙ্খলার একত্রীকরণের মধ্যে হোসে আর্কাদিও আর পিলার পায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুক্তির আনন্দ। ভিড়ের মধ্যে দুই প্রেমিক প্রেমিকা সুখী, ওদের এমনও মনে হয় যে প্রেম হচ্ছে, শুধু রাতের গোপন ক্ষণিক মিলনের চেয়েও অনেক সনাতন, গভীর আর সীমাহীন সুখের ব্যাপার। এ অবস্থায় ওর মোহ ভেঙে দেয় পিলার। যে রকম উৎসাহের সঙ্গে হোসে আর্কাদিও ওর সঙ্গ উপভোগ করছিল, স্থান কাল ভুলে এক ধাক্কায় সারা পৃথিবীটাকে ওর ওপর ছুড়ে দিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, এখন তুই সত্যিকার পুরুষ।’ যেহেতু সে বুঝতে পারছিল না পিলার কি বলতে চাচ্ছে, তাই ওকে বর্ণনা করে পিলার অক্ষরে অক্ষরে, ‘তোর ছেলে হতে যাচ্ছে।’

কয়েক দিন বাড়ি থেকে বেরোতে সাহস পায় না হোসে আর্কাদিও। রান্নাঘর থেকে আসা পিলারের উত্তেজনাময় অট্টহাসি শোনাই হোসে আর্কাদিওর পক্ষে যথেষ্ট ছিল দৌড়ে পরীক্ষাগারে আশ্রয় নেওয়ার জন্য, যে পরীক্ষাগারে আলকেমির কার্যকলাপগুলো পুনর্জীবিত হয়েছে উরসুলার কৃপায়। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া বেপথু ছেলেকে বরণ করে নেয় আনন্দের সঙ্গে আর ইতিমধ্যে শুরু করা পরশপাথরের সন্ধানে লাগিয়ে দেয় ওকে। এক বিকেলে ছেলেরা উৎসাহিত হয় পরীক্ষাগারের জানালার সমান উচ্চতায় জিপসি চালককে নিয়ে উড়ন্ত গালিচার দ্রুত উড়ে যাওয়ায় আর গ্রামের কিছু ছেলে হাত নেড়ে তাদের শুভেচ্ছা জানালে, হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া চোখ তুলেও দ্যাখে না। ‘ওদের স্বপ্ন দেখতে দাও’, বলে সে, ‘ওদের তুচ্ছ উড়ন্ত বিছানার চেয়ে আমরা অনেক বেশি ভালো উড়ব আরও বড় বিজ্ঞানের বদৌলতে।’ তার লোক দেখানো আগ্রহ সত্ত্বেও হোসে আর্কাদিও কখনোই পরশপাথরের ক্ষমতার কথা বুঝতে পারে না, ওর কাছে মনে হয়েছিল খারাপভাবে বানানো একটা বোতল মাত্র। দুশ্চিন্তা থেকে ও মুক্তি পায় নি। খিদে আর ঘুম হারিয়ে ফেলে, অভিযানে ব্যর্থ হওয়ার পর ওর বাবার যেমন অবস্থা হতো, তেমনি বশীভূত হলো সে বদমেজাজের কাছে, তার বিভ্রান্তি এমন অবস্থায় পৌঁছাল যে স্বয়ং হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তাকে পরীক্ষাগারের কর্তব্য থেকে রেহাই দেয় এই মনে করে যে সে পরীক্ষাগারের কাজটা খুব গুরুত্বসহকারে নিয়েছে। অবশ্যই আউরেলিয়ানো বুঝতে পারে যে ভাইয়ের মানসিক যন্ত্রণার সঙ্গে পরশপাথর খোঁজার কোনো সম্পর্কই নেই। কিন্তু সে তার ভাইয়ের আস্থা অর্জন করতে পারছিল না। হোসে আর্কাদিও হারিয়ে ফেলেছে আগের সেই স্বতঃস্ফূর্ততা। সহযোগী আর আলাপপ্রিয় অবস্থা থেকে সে পরিবর্তিত হয়েছে বৈরী ভাবাপন্ন আর আত্মমুখী ব্যক্তিতে। একাকিত্বের উদ্বেগ আর পৃথিবীর সবার বিরুদ্ধে মারাত্মক তিক্ততার কামড়ে, এক রাতে অভ্যাসমতো বিছানা ত্যাগ করে সে, কিন্তু পিলার তেরনেরার বাড়িতে যায় না, যায় মেলার ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যেতে। সব ধরনের কুশলী যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ঘোরাফেরার পর, একটির প্রতিও আকৃষ্ট না হয়ে, ওর চোখ পড়ে এমন কিছুর ওপর, যা কোনো প্রদর্শনীর অন্তর্গত ছিল না-পুঁতির মালার ভারে নুয়ে পড়া কম বয়সী এক জিপসি যুবতী; হোসে আর্কাদিওর কাছে সারা জীবনে দেখা সব থেকে সুন্দরী মেয়ে। মেয়েটা ভিড়ের মধ্যে অন্যদের সঙ্গে দেখছিল বাবা-মায়ের অবাধ্যতার ফলে মানুষের সাপে পরিণত হওয়ার এক করুণ প্রদর্শনী।

হোসে আর্কাদিও ওদিকে মনোযোগ দেয় না। যে সময়ে সর্পমানবকে করুণ জেরা করা হচ্ছিল, তখন ভিড় ঠেলে জায়গা করে সে চলে এসে দাঁড়ায় জিপসি মেয়েটার পেছনে, প্রথম সারিতে। মেয়েটার পিঠে সে চাপ দেয় শরীর দিয়ে। মেয়েটা সরে যেতে চেষ্টা করে কিন্তু হোসে আর্কাদিও আরও শক্তি দিয়ে চাপ দেয় ওর পেছন দিকে। তখনই মেয়েটা অনুভব করে ওর পুরুষত্ব। যা ঘটছে তা বিশ্বাস করতে না পেরে, বিস্ময় আর ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটা ওর সঙ্গে। সবশেষে মাথা ঘুরিয়ে ভীরু হাসি নিয়ে ওর দিকে তাকায়। ঠিক সেই মুহূর্তে দুই জিপসি সর্পমানবকে খাঁচায় ঢুকিয়ে নিয়ে যায় তাঁবুর ভেতরে। যে জিপসি প্রদর্শনী পরিচালনা করছিল, সে ঘোষণা করে, ‘এবং এখন, ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গণ, আপনাদের দেখাব সেই মেয়েকে, যার যা দেখা উচিত নয়, তা দেখে ফেলার শাস্তিস্বরূপ গলা কাটা হবে প্রতি রাতে এই সময়, যা দেড় শ বছর ধরে চলে আসছে।’

হোসে আর্কাদিও আর মেয়েটা গলা কাটার খেলা দেখে না। চলে যায় মেয়েটার তাঁবুতে, যেখানে ওরা কাপড় খুলতে খুলতে চুমো খাচ্ছিল এক ব্যাকুল উন্মত্ততা নিয়ে। উপড়ে পড়া অন্তর্বাস, অনেক পরতের কাপড় দিয়ে বানানো মাড় দেওয়া ঘাগড়া, তার দিয়ে বানানো নিষ্ফল নিতম্ববন্ধনী, পুঁতির বোঝা, সব খুলে ফেলার পর মেয়েটা পরিবর্তিত হয় অদৃশ্যে। পা দুটো এতই চিকন যে হোসে আর্কাদিওর বাহুও তার থেকে পুরু, আর সদ্য ওঠা বুক নিয়ে সে যেন এক দুর্বল ব্যাঙাচি, চিকন দুটো পা, যা হোসে আর্কাদিওর বাহুর সঙ্গেও সে পেরে উঠবে না, অবশ্য তার দৃঢ়তা আর তীব্র কামনা পুষিয়ে দেয় তার ভঙ্গুর শরীরকে। কিন্তু হোসে আর্কাদিও ঠিকমতো সাড়া দিতে পারছিল না, কারণ তাঁবুটাও ছিল একরকম বারোয়ারি তাঁবু, যেখান দিয়ে জিপসিরা যাতায়াত করে ওদের সার্কাসের জিনিসপত্র নিয়ে, সমাধান করে বিভিন্ন সমস্যার, এমনকি বিছানার পাশে তারা দাঁড়িয়ে বিরতি নিচ্ছিল একদান ছক্কা খেলার জন্য। বাতিটা ঝোলানো ছিল মাঝের খুঁটিটায় আর তাতে আলোকিত ছিল পুরো তাঁবু। আদরের এক বিরতির পর, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া নগ্ন হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায় আর মেয়েটা চেষ্টা করে ওকে সাহস দেওয়ার। অপূর্ব শরীরের অধিকারী এক জিপসি যুবতী একটু পরেই তাঁবুতে ঢোকে তার সঙ্গীকে নিয়ে, যারা ওই থিয়েটারের দলের অংশ ছিল না, এমনকি গ্রামেরও কেউ নয়। আর উভয়ই বিছানার সামনে উপভোগে রত হয়। পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই যুবতী হোসে আর্কাদিওর দিকে তাকায় আর একধরনের করুণ আবেগতপ্ত দৃষ্টি নিয়ে ওর রাজকীয় জন্তুটাকে বিশ্রামরত অবস্থায় দেখতে পায়। ‘এই ছেলে’ বিস্মিত হয়ে বলে, ‘খোদা যেন ওটাকে এভাবেই সংরক্ষণ করে।’ হোসে আর্কাদিওর সঙ্গিনী ওদের শান্তিতে থাকতে দিতে বলে, ফলে ওরা বিছানার খুব কাছেই মেঝেতে শুয়ে পড়ে। অন্যদের রতিক্রিয়া হোসে আর্কাদিওকে জাগিয়ে তোলে। প্রথম মিলনের ধাক্কায়, মেয়েটার হাড়গুলো যেন দোমিনো গুটির মতো মড়মড় করে খুলে পড়ে, তার চামড়া থেকে ঝরে পড়ে পাণ্ডুর ঘাম, চোখ ওঠে জ্বলে, সমস্ত শরীর থেকে বের হয় এক নিরানন্দ অনুশোচনা আর আবছা কাদার গন্ধ। কিন্তু ধাক্কাটা সহ্য করে নেয় দৃঢ়তা আর প্রশংসনীয় সাহসের সঙ্গে। হোসে আর্কাদিও অনুভব করে সে অকস্মাৎ উঠে গেছে এক স্বর্গীয় অনুপ্রেরণার স্তরে, যেখানে তার বিধ্বস্ত হৃদয়াবেগ বেরিয়ে আসছে আদরে আর কুৎসিত যৌনালাপের মাধ্যমে আর তা মেয়েটার কান দিয়ে প্রবেশ করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে তার নিজস্ব ভাষায়। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। মাথায় এক লাল কাপড় বেঁধে হোসে আর্কাদিও চলে যায় জিপসিদের সঙ্গে।

যখন উরসুলা টের পায় তার অনুপস্থিতি, গ্রামময় তাকে খুঁজে বেড়ায়। জিপসিদের ভেঙে দেওয়া ছাউনির জায়গায় সদ্য নিভিয়ে ফেলা চুল্লির ধোঁয়া, ছাই আর যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা বর্জ্য পদার্থ ছাড়া কিছুই ছিল না তখন। কেউ একজন আবর্জনার মধ্যে পুঁতির দানা খুঁজে বেড়াচ্ছিল, বলে উরসুলাকে যে গত রাতে সে থিয়েটারের ভিড়ের মধ্যে তার ছেলেকে দেখেছে, সর্পমানবের খাঁচা বওয়া গাড়ি ঠেলছে। ‘ও জিপসির দলে ভিড়েছে’, উরসুলা চিৎকার করে স্বামীর উদ্দেশে, যে কিনা ওর উধাও হওয়ায় বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন ছিল না।

‘সত্যিই যেন তা-ই হয়’, বলল হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া হাজারবার গুঁড়ো করা এক বস্তু, গরম করে আবারও হামানদিস্তায় গুঁড়ো করতে করতে, ‘এভাবেই সে পুরুষ হতে শিখবে।’

উরসুলা জিজ্ঞেস করে জিপসিরা কোন দিক দিয়ে গিয়েছে। বিভিন্নজনকে জিজ্ঞেস করে পথ ধরে এগোতে থাকে এই বিশ্বাসে যে এখনো সময় আছে তাদের নাগাল পাওয়ার। গ্রাম থেকে সরে যেতে থাকে আরও দূরে, যখন বুঝতে পারে সে এতই দূরে চলে এসেছে যে আর ফিরে যাওয়ার চিন্তা করে না। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তার স্ত্রীর অভাব অনুভব করে না রাত আটটা পর্যন্ত, যখন সে গুঁড়া করা জিনিসগুলোকে আবার গরম করতে দিয়েছে এক পরত ঘসির আগুনে আর দেখতে গিয়েছে কী হয়েছে ছোট আমারান্তার, যে কাঁদতে কাঁদতে গলা ভেঙে ফেলেছে। অল্প কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সে জড়ো করে কিছু লোককে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ, আমারান্তাকে দেয় এক মহিলার হাতে কারণ সে আমারান্তাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর প্রস্তাব করেছিল, আর সে উধাও হয় উরসুলার খোঁজে অদৃশ্য পথ ধরে। আউরেলিয়ানো ওদের সঙ্গ নেয়। প্রত্যুষে কিছু আদিবাসী জেলে, যাদের ভাষা ছিল তাদের অজানা ওরা আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয় যে কাউকে এদিক দিয়ে তারা যেতে দেখে নি। তিন দিনের বৃথা খোঁজাখুঁজির পর গ্রামে ফিরে যায় ওরা।

পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ হতাশায় ভেঙে পড়ে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া। সে ছোট আমারান্তার মায়ের স্থান দখল করে। ওকে গোসল করাত আর তার কাপড় বদলাত, তাকে নিয়ে যেত দিনে চারবার বুকের দুধ খাওয়াতে, এমনকি রাতে এমন সব গান শোনাত, যেসব গান উরসুলা কখনোই গাইতে জানে নি। একবার পিলার তেরনেরা উরসুলা ফিরে আসা পর্যন্ত বাড়ির কাজ করে দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করে। আউরেলিয়ানো, যার রহস্যময় স্বজ্ঞা এই দুর্ভাগ্যের কারণে আরও প্রখর হয়ে উঠছে, সে পিলারকে ঢুকতে দেখে এক দিব্যদৃষ্টি অনুভব করে। সুতরাং বুঝে কোনো এক ব্যাখ্যাতীত কারণে ওর ভাইয়ের পালানো আর পরবর্তী সময়ে মায়ের অদৃশ্য হওয়ার জন্য এই মেয়েটাই দায়ী আর ওকে এক নিঃশব্দ, নির্দয়তার সঙ্গে এমনভাবে অপমান করে যে সে আর কখনোই ওই বাড়িতে ঢোকে না।

সময় সবকিছুই ঠিক করে দেয়। হোসে আর্কাদিও আর তার ছেলে বুঝতে পারে না কখন তারা পরীক্ষাগারে ধুলো ঝাড়ছে, গরম পানির সাইফনে আগুন জ্বালিয়ে, ঘসির চুল্লির পরতের ওপর কয়েক মাস ধরে শুয়ে থাকা বস্তুটাকে বশে আনার কাজে ধৈর্যসহকারে লেগে পড়েছে। এমনকি আমারান্তা উইলো ডাল দিয়ে বানানো ঝুড়িতে শুয়ে আগ্রহসহকারে পর্যবেক্ষণ করে বাবা আর তার ভাইয়ের ছোট ঘরে পারদের বাষ্পে ভরে থাকা বাতাসে একাগ্রচিত্তে করা কাজ। একবার উরসুলা চলে যাওয়ার অনেক মাস পর, অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে শুরু করে। একটা খালি পাত্র অনেক দিন ধরে বিস্মৃত অবস্থায় আলমারিতে রাখা ছিল, সেটা এতই ভারী হয়েছিল যে সেটাকে নড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। টেবিলে রাখা এক পানিভর্তি কড়াই আধঘণ্টা ধরে ফুটে কোনো আগুন ছাড়াই, যতক্ষণ না তার সব পানি বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। আর্কাদিও আর ওর ছেলে ওই সব আজব ঘটনাগুলো একধরনের ভয় পাওয়া আনন্দের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করত, কিন্তু ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা না করতে পেরে মনে করে এগুলো হচ্ছে ওই পদার্থেরই (পরশপাথর) ঘোষণা। একদিন আমারান্তাসহ ঝুড়িটা নিজস্ব শক্তিতে নড়তে শুরু করে আর সম্পূর্ণ এক পাক খায় ঘরের মধ্যে আউরেলিয়ানোকে হতবুদ্ধি করে দিয়ে। আউরেলিয়ানো দ্রুত থামাতে যায়, কিন্তু ওর বাবা বিচলিত হয় না। ঝুড়িটাকে জায়গামতো রেখে টেবিলের এক পায়ের সঙ্গে বেঁধে রাখে এই বিশ্বাসে যে প্রত্যাশিত ঘটনাটা অত্যাসন্ন। এক দিন আউরেলিয়ানো ওকে বলতে শোনে, ‘যদি খোদাকে ভয় না-ও করো, ভয় করো ধাতব পদার্থগুলোকে।’

উধাও হওয়ার প্রায় পাঁচ মাস পর ফিরে আসে উরসুলা। ফিরে আসে উল্লসিত, পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত, গ্রামের অপরিচিত ধরনের নতুন জামাকাপড় পরে। হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া কোনো রকমে ঘটনাটার ধাক্কা সহ্য করে নেয়। ‘এটাই তাহলে আসল ব্যাপার’, চিৎকার করছিল, ‘আমি জানতাম যে এটাই ঘটতে যাচ্ছে।’ আর সত্যিই তা বিশ্বাস করত কারণ তার দীর্ঘ সময়ের বন্দিদশায় জিনিসটাকে রূপান্তরের সময় সে সব হৃদয় দিয়ে গভীরভাবে চাইছিল যে অলৌকিক ব্যাপারটা যেন পরশপাথর আবিষ্কার অথবা সব ধাতব পদার্থের জ্যান্ত হয়ে ওঠা সেই ফুঁয়ের আবিষ্কার বা বাইরের তালা আর কক্ষগুলোকে সোনায় পরিণত করার ক্ষমতা না হয়ে যেন হয় উরসুলার ফিরে আসা। কিন্তু উরসুলা এই আনন্দে অংশগ্রহণ করে না। যেন এক ঘণ্টার বেশি অনুপস্থিত থাকেনি, এমন সাধারণ একটা চুমু খেয়ে বলে, ‘দরজার পাশে এসো।’ যখন রাস্তায় বেরোয় আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া হতভম্বভাবটা কাটতে ওর দীর্ঘ সময় লাগে আর দেখতে পায় ভিড়টা। ওরা জিপসি ছিল না, ছিল ওদের মতোই পুরুষ ও মহিলা, সোজা চুল, প্রগাঢ় চামড়া একই ভাষায় কথা বলে আর যারা একই রকম সাধারণ দুঃখ-বেদনা নিয়ে অনুতাপ করে।

খচ্চরের পিঠভর্তি খাদ্যদ্রব্য, বলদের গাড়িভর্তি আসবাব আর ঘরোয়া তৈজসপত্র, চুরুট আর ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক ছাড়া বিক্রির জন্য দৈনন্দিন জীবনের জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে তারা। মাত্র দুই দিনের ভ্রমণে জলাভূমির ওপার থেকে এসেছে ওরা যেখানকার গ্রামগুলোতে প্রতি মাসেই চিঠিপত্র আসে। ভালো থাকার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সঙ্গে তারা পরিচিত। উরসুলা জিপসিদের নাগাল পায় নি, কিন্তু পেয়েছিল সেই রাস্তা, যা তার স্বামী বড় বড় হতাশাপূর্ণ অভিযানের দ্বারা খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *