নিঃসঙ্গতার একশ বছর – ১৫

১৫

যে সমস্ত ঘটনা মাকন্দের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে দেখা দেবে, সেগুলো শুরু হওয়ার সময়ই বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় মেমে বুয়েন্দিয়ার ছেলেকে। সামাজিক পরিস্থিতি তখন ছিল এতই অনিশ্চিত যে কারোরই মানসিক অবস্থা ছিল না ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কেলেঙ্কারি সৃষ্টির, আর ফলে ফের্নান্দা বাচ্চাটাকে অস্তিত্বহীনভাবে লুকিয়ে রাখার অনুকূল পরিস্থিতি পেয়ে যায়। এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে ফের্নান্দার পক্ষে শিশুটিকে প্রত্যাখ্যান করার কোনোই উপায় থাকে না, আর ওকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। বাকি জীবনের জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওকে সহ্য করতেও বাধ্য হয় সে, কারণ তার গোপন সংকল্প, বাচ্চাটাকে গোসলখানায় ডুবিয়ে মারার ইচ্ছা পূরণের শেষ মুহূর্তে তার সাহসের অভাব হয়ে পড়ে। বাচ্চাটাকে তালাবদ্ধ করে সে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার পুরোনো কামারশালায়, সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয় যে বাচ্চাটাকে এক ঝুড়িতে ভাসমান অবস্থায় পেয়েছে সে। উরসুলা ছেলেটার জন্মবৃত্তান্ত না জেনেই মারা যাবে। একবার ফের্নান্দা ছেলেটাকে খাবার দেওয়ার সময় ছোট্ট আমারান্তা উরসুলা কামারশালায় ঢুকে পড়ে আর সে-ও ভাসমান ঝুড়ির গল্প বিশ্বাস করে। মেমের ব্যাপারটাকে এ রকম অযৌক্তিক করুণ পরিণতি ঘটানোর কারণে চিরদিনের জন্য দূরত্ব রচনা করা আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ওর কথা জানতেই পারে না বাড়িতে নেওয়ার তিন বছর পর্যন্ত, যেদিন একবার ফের্নান্দার অসতর্কতায় বন্দিদশা থেকে পালিয়ে মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্য ও উঁকি দেয় বারান্দায় নগ্ন অবস্থায়, মাথায় জটধরা চুল ও বিশালাকারের তিতিরের ঝুঁটির মতো পুরুষাঙ্গ নিয়ে, যেন সে কোনো মানবশিশু নয়, বরং বিশ্বকোষের বর্ণিত নরখাদক।

এই ধরনের হঠাৎ ঘটে যাওয়া বিশ্রী ব্যাপারটা আর তার অমোচনীয় পরিণতির কথা ফের্নান্দার হিসাবের মধ্যে ছিল না। যে লজ্জাটাকে চিরকালের জন্য নির্বাসন দিয়েছে বলে ভেবেছিল সে, শিশুটি ছিল সেই লজ্জারই প্রত্যাবর্তনস্বরূপ। ভগ্ন মেরুদণ্ডসহ, মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়াকে বাড়ি থেকে সরিয়ে নেওয়া মাত্রই ফের্নান্দা এই লজ্জাজনক ঘটনার সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলার এক সুনিপুণ পরিকল্পনা আঁটে। স্বামীর সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করেই পরের দিন বাক্স-পেটরা গোছায়, ওগুলোর ভেতর মেয়ের জন্য দরকার হবে বলে তিন প্রস্থ জামাকাপড় ভরে আর ট্রেন আসার আধঘণ্টা আগে মেয়ের শোবার ঘরে যায় ওকে নিয়ে আসতে। ‘চল রেনাতা’, বলে ওকে।

মেমেকে বিস্তারিত কিছুই জানায় না। ওদিকে মেমেও ওরকম কিছুর অপেক্ষা করে নি বা চায় নি। কোথায় যে যাচ্ছে, তা যে শুধু সে অবজ্ঞা করে তা-ই নয়, এমনকি ওকে বধ্যভূমিতে নিয়ে গেলেও সেটা ওর জন্য ছিল একই কথা। পেছনে উঠানে গুলির শব্দ ও একই সঙ্গে মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়ার যন্ত্রণায় আর্তনাদ শোনার সময় থেকেই ফের্নান্দার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে সে, আর জীবনে কোনো দিন বলবেও না। মা যখন তাকে শোবার ঘর থেকে বেরোতে বলে, সে চুলও বাঁধে না, মুখও ধোয় না, আর ট্রেনে চড়ে নিদ্রাচ্ছন্নের মতো, এমনকি ওর সহচরী হলুদ প্রজাপতিগুলোকেও লক্ষ না করে। ওর এই পাথরসম নীরবতার কারণ ইচ্ছাকৃত, নাকি করুণ সেই ঘটনার আঘাতের ফলেই সে নির্বাক হয়েছে, তা ফের্নান্দা কখনোই জানে নি বা জানার কোনো চেষ্টাও করে নি। প্রাচীন মনোমুগ্ধকর জায়গাটা পার হওয়ার সময়ই প্রথমবারের মতো মেমে লক্ষ করে, তাদের এই ভ্রমণের ব্যাপারটা। লাইনের দুপাশ ধরে ছায়াঘন অন্তহীন কলাবাগানগুলো সে লক্ষও করে না, দেখে না গ্রিংগোদের সাদা বাড়ি বা ধুলো ও রৌদ্রতাপে দগ্ধ বাগানগুলো, চোখে পড়ে না খাটো প্যান্ট পরিহিত রমণীদের, যারা ডোরাকাটা শার্ট পরে চাতালগুলোয় তাস খেলছিল। সে দেখে না ধুলোময় পথ ধরে চলা কলার ছড়া বোঝাই বলদটানা গাড়িগুলো। তার চোখে পড়ে না নদীর স্বচ্ছ জলে ‘সাবালো’ মাছের মতো লাফিয়ে পরা কুমারী মেয়েদের, যাদের সুডৌল স্তন ট্রেনের যাত্রীদের মন তিক্ততায় ভরিয়ে দিচ্ছিল, চোখে পড়ে না মজুরদের রংবেরঙের জীর্ণ কুটির, যেখানে মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়ার হলুদ প্রজাপতিগুলো ডানা ঝাপটাচ্ছিল, পড়ে না চোখে কুটিরগুলোর দরজায় যার যার মলত্যাগপাত্রে বসা শীর্ণ সবুজ রঙের শিশুরা যেখানে গর্ভবতীরা গাল দিচ্ছিল চলন্ত ট্রেন দেখে। যখন সে পাঠস্থান থেকে ফিরত, তখন ওই চলমান দৃশ্য ছিল মেমের কাছে উৎসবের মতো, যা কিনা আজ তার হৃদয়ে কোনো অনুরণন জাগায় না। সে জানালা দিয়ে তাকায় না, এমনকি দেখেও না কখন শেষ হয়েছে প্ল্যান্টেশনের গায়ে জ্বালা ধরানো স্যাঁতসেঁতে ভাব আর ট্রেন পার হয় আফিম চাষের বিস্তীর্ণ প্রান্ত, যেখানে তখনো পড়ে ছিল অঙ্গারে পরিণত হওয়া স্পেনের জাহাজটি, যেখান থেকে বেরিয়ে এসেছিল সেই একই স্ফটিকশুদ্ধ বাতাস, একই ফেনাময় নোংরা সমুদ্র আর যেখানে প্রায় এক শত বর্ষ আগে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার সমস্ত স্বপ্ন পর্যবসিত হয় ধুলোয়।

বিকেল পাঁচটায় জলাভূমির শেষ স্টেশনে এসে মেমে নেমে পড়ে, কারণ নামে ফের্নান্দা। হাঁপানিতে ভোগা এক ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে, যেটা দেখতে ছিল বিশাল এক বাদুড়ের মতো, পাড়ি দেয় জনশূন্য শহর, যেটার রাস্তা ছিল অন্তহীন শোরার কারণে ফাটল ধরা, যেখানে পিয়ানো অনুশীলনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, যেমনটি ফের্নান্দা শুনতে পেত বয়ঃসন্ধিকালে সিয়েস্তার সময়। পরে ওরা চড়ে বসে নদীতে চলা এক জাহাজে, যেটার কাঠের চাকা যুদ্ধের শব্দ তুলত, যেটার মরিচা ধরা লোহার পাতগুলো আওয়াজ করছিল এক চুল্লি মুখের মতো। কেবিনের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে মেমে দিনে দুইবার ফের্নান্দা ওর বিছানার পাশে খাবার রাখত আর দিনে দুবার অস্পর্শ অবস্থায় নিয়ে যেত ওগুলো। মেমে যে না খেয়ে মরতে চায়, সে জন্য নয়, বরং খাবারের গন্ধ তার কাছে অসহ্য লাগছিল, তার পাকস্থলী এমনকি পানিও সহ্য না করতে পেরে উগরে দিচ্ছিল। এমনকি সে নিজেও জানত না যে তার উর্বরতা শক্তি নির্বোধ বানিয়েছে সর্ষের ভাপগুলোকে, যেমনটি ফের্নান্দাও জানত না প্রায় এক বছর যাবৎ যতক্ষণ পর্যন্ত না বাচ্চাটাকে তার কাছে নিয়ে আসা হয়েছিল। দমবন্ধ করা কেবিনের ভেতর লোহার পাতের কাঁপুনিতেও জাহাজের চাকার ঘূর্ণনে তোলপাড় করা কাদায় অসহ্য গন্ধে পাগল হয়ে যাওয়া মেমে ভুলে যায় দিনক্ষণের হিসাব। যখন সে দেখতে পায় শেষ হলুদ প্রজাপতিকে ফ্যানের পাখায় লেগে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হতে, তখন অনেক সময় পার হয়েছে আর তখন সে অমোচনীয় সত্য হিসেবে ধরে নেয় মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়ার মৃত্যুকে। কিন্তু সে হতাশার কাছে নিজেকে হার মানতে দেয় না। পৃথিবীতে এযাবৎ জন্ম নেওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরীর খোঁজে, যেখানে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো হারিয়ে গিয়েছিল সেই অলীক মালভূমিতে, খচ্চরের পিঠে পার হওয়ার সময়, ইন্ডিয়ানদের চলার পথ ধরে পর্বতশ্রেণি পার হওয়ার সময়, বত্রিশটি গির্জায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্রোঞ্জের ঘণ্টা বাজানো পাথুরে গলির সেই বিষণ্ণ নগরীতে ঢোকার সময়ও সে চিন্তা করে চলে মাউরিসিও ব্যাবিলনীয়ার কথা। সেই রাতে ওরা ঘুমায় এক পরিত্যক্ত ঔপনিবেশিক ম্যানশনে ফের্নান্দার পেতে দেওয়া তক্তায়, আগাছা দ্বারা আগ্রাসিত মেঝেতে। জানালার থেকে টেনে ছিঁড়ে নামানো ছেঁড়া পর্দা গায়ে জড়িয়ে, যেটা শরীরের প্রতিটি গড়াগড়ির সঙ্গেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। মেমে জানতে পারে সে কোথায় এসেছে, কারণ অনিদ্রার আতঙ্কের মধ্যে দেখতে পায় কালো পোশাক পরিহিত সেই ভদ্রলোককে, যাকে অনেক আগে বড়দিনের কিছু আগে এক সিসের কফিনে ভরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বাড়িতে। পরের দিন, ফের্নান্দা তাকে নিয়ে যায় এক ছায়াঘন দালানে, যেটাকে মেমে একনজরেই চিনতে পারে, কারণ যে কনভেন্টে তাকে রানি হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, তার কথা অনেক গল্প করেছে তার মা, আর সে বুঝতে পারে তাদের ভ্রমণের সমাপ্তিতে এসে পড়েছে ওরা। ওর মা যখন পাশের অফিসে কোনো একজনের সঙ্গে কথা বলছিল, মেমে তখন অপেক্ষা করছিল দাবার কোর্টের মতো সাদা-কালো মেঝের ঔপনিবেশিক আর্চবিশপদের বড় বড় তৈলচিত্র ভরা বৈঠকখানায়, শীতে কাঁপতে কাঁপতে, কারণ তখনো তার পরনে ছিল কালো ফুল তোলা সুতির পোশাক আর পায়ে ছিল মালভূমির বরফে শক্ত হয়ে ফুলে ওঠা উঁচু জুতো। বৈঠকখানার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল সে ঘষা-কাচের মধ্য দিয়ে আসা হলুদ আলোর নিচে মাউরিসিও ব্যাবিলনীয়ার কথা চিন্তা করতে করতে, যখন বেরিয়ে আসে এক নবদীক্ষিতা নান যে বহন করছিল তার তিন প্রস্থ কাপড়সহ তোরঙ্গটি। মেমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় না থেমেই হাত বাড়িয়ে দেয় সে। ‘চল রেনাতা’, ওকে বলে।

মেমে হাতটি ধরে, আর ওকে নিয়ে যেতে দেয়। শেষবার ফের্নান্দা যখন তাকে দেখে, তখনো নবদীক্ষিতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটার চেষ্টা চালাচ্ছিল সে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার পেছনে লোহার গরাদ বন্ধ হয়ে যায়। তখনো সে ভাবছিল মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়ার কথা, ওর তেলের গন্ধের কথা, প্রজাপতি বেষ্টনীর কথা, আর সে ওকে ভাবতে থাকবে সারা জীবন, যত দিন না এক সুদূর শারদ সকালে মারা যাবে বৃদ্ধাবস্থায় ক্রাকোভিয়ার এক অন্ধকার হাসপাতালে, কখনো একটিও কথা না বলে, আর যখন তার নাম বদলে দেওয়া হয়েছে।

ফের্নান্দা মাকন্দে ফিরে আসে অস্ত্রধারী পুলিশ প্রহরাধীন এক ট্রেনে করে। ভ্রমণের সময় তার চোখে পড়ে যাত্রীদের মাঝে উত্তেজনা, রেললাইনের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে সামরিক কড়াকড়ি, আর বাতাসে ভেসে বেড়ানো বিরল, ভয়ংকর কিছু ঘটার নিশ্চয়তা। কিন্তু মাকন্দে পৌছানোর আগ পর্যন্ত ঠিকমতো কিছু জানতে পারে না। আর পৌঁছানো মাত্র তাকে বলা হয় যে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো কলা কোম্পানির শ্রমিকদের ধর্মঘটের জন্য উসকানি দিচ্ছে ‘একমাত্র এটাই বাকি ছিল’, আপনমনে বলে ফের্নান্দা। পরিবারের মধ্যে এক নৈরাজ্যবাদী ধর্মঘট পালিত হয় দুসপ্তাহ পর নাটকীয় এমন কিছুই ঘটে না যেমনটি সে আশঙ্কা করেছিল। শ্রমিকদের দাবি ছিল তাদের যেন রোববারে কলা কাটা এবং তা পরিবহনে বাধ্য না করা হয়, আর এই দাবিকে এতই ন্যায্য বলে মনে হয় যে এমনকি ফাদার অ্যান্তনিও ইসাবেল পর্যন্ত ওদের পক্ষ নিয়ে ওকালতি করে, কারণ দাবিটা ঈশ্বরের আইন অনুযায়ী করা হয়েছে। এই ব্যাপারটার সফলতা ও পরের মাসগুলোতে হাতে নেওয়া অন্যান্য বিভিন্ন কার্যক্রমে সফলতা হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোকে বের করে আনে তার দুর্নামজড়িত পূর্বপরিচিতি থেকে, তার সমন্ধে বলা হতো যে শুধু ফরাসি বেশ্যা এনে গ্রাম ভর্তি করা ছাড়া আর কিছুই সে জানে না। যে ঝোঁকের বশবর্তী হয়ে সে তার লড়িয়ে মোরগগুলো নিলামে তুলে পাগলাটে জাহাজ ব্যবসায় নামে, সেই একইভাবে সে পদত্যাগ করে কলা কোম্পানির ফোরম্যানের চাকরি, আর যোগ দেয় শ্রমিকদের পার্টিতে। শিগগিরই তাকে চিহ্নিত করা হয় সামাজিক স্থিতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী আন্তর্জাতিক চর হিসেবে। বিভিন্ন গুজবে অন্ধকার হয়ে আসা একটি সপ্তাহের এক রাতে গোপন এক সমাবেশ থেকে বের হওয়ার সময় তার উদ্দেশ্যে ছোড়া রিভলবারের চারটি গুলির হাত থেকে অলৌকিকভাবে পালাতে সক্ষম হয় সে। পরের মাসগুলোতে পরিস্থিতি এতই উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে পড়ে যে এমনকি উরসুলা পর্যন্ত তার অন্ধকার কোণ থেকে তা বুঝতে পারে আর তার মনে হয় আবার সে বাস করছে নতুন করে সেই ঘটনাবহুল সময়ে, যখন তার ছেলে আউরেলিয়ানো পকেটে ধ্বংসের হোমিওপ্যাথিক গুলি নিয়ে বেড়াচ্ছে। এই ঘটনা জানানোর জন্য হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে কিন্তু আউরেলিয়ানো সেগুন্দো জানায় যে হামলার রাতের পর থেকে তার অবস্থানের কথা কেউ জানে না, ঠিক আউরেলিয়ানোর মতো বিস্ময়পূর্ণ কণ্ঠে বলে ‘উরসুলা’, পৃথিবীটা যেন ঘুরছে।’

এই সমস্ত দিনের অনিশ্চয়তা ফের্নান্দাকে স্পর্শ করে না। স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ না করেই মেমের নির্বাসনের কারণে তুমুল ঝগড়া হয় তাদের মধ্যে। তার পর থেকে বাইরের জগতের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকে না তার। মেয়েকে উদ্ধারের জন্য প্রস্তুত ছিল আউরেলিয়ানো সেগুন্দো, এমনকি পুলিশ ব্যবহার করে হলেও, কিন্তু ফের্নান্দা তাকে কাগজপত্রে দেখায় যে মেমে নিজের ইচ্ছাতেই মঠে যোগ দিয়েছে। সত্যিই মেমে লোহার গরাদের অন্য পাশ থেকে কাগজে সই করে আর করে সেই একই রকমের তাচ্ছিল্য নিয়ে, যে রকম তাচ্ছিল্যের কারণে সে তাকে নির্বাসনে পাঠাতে দিয়েছে। অন্তরের অন্তস্তলে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ওই প্রমাণের বৈধতায় বিশ্বাস করে নি, যেমনটি কখনোই বিশ্বাস করে নি যে মাউরিসিও ব্যাবিলনিয়া মুরগি চুরি করতে উঠানে ঢুকেছিল, কিন্তু দুটো ব্যাপার একীভূত হয়ে তার বিবেককে শান্ত রাখতে সাহায্যে করে আর ফলে কোনো বিবেকদংশন ছাড়াই পেত্রা কত্রেসের ছায়াতলে ফিরতে পারে সে, যেখানে আবার আরম্ভ করে কোলাহলপূর্ণ পার্টি ও লাগামহীন ভোজনের। শহরের উত্তেজনা থেকে দূরে থেকে উরসুলার ভয়ংকর ভবিষ্যদ্বাণীতে কান না দিয়ে ফের্নান্দা তার পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনার শেষ প্যাচ কষে। কেবল ছোটখাটো কাজ পেতে আরম্ভ করা ছেলে হোসে আর্কাদিওকে এক বিস্তারিত চিঠি লিখে জানায় যে তার বোন রেনাতো কালো বমি করে মারা গেছে। পরে আমারান্তা উরসুলার দেখাশোনার ভার সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদের হাতে দিয়ে অদৃশ্য ডাক্তারদের সঙ্গে পত্রবিনিময়ের কাজে নিজেকে নিয়োগ করে, যা নাকি মেমের ব্যাপারটার কারণে ওলট-পালট হয়ে গিয়েছিল। প্রথমেই যা করে তা হচ্ছে মুলতবি রাখা টেলিপ্যাথিক অপারেশনের জন্য নির্দিষ্ট দিন ঠিক করা। কিন্তু অদৃষ্ট চিকিৎসকেরা উত্তর দেয় যে মাকন্দের সামাজিক অবস্থার এ রকম টালমাটাল অবস্থায় এটা করা উচিত হবে না। অপারেশনটা তার জন্য এতই জরুরি ছিল আর সে এতই কম খবর রাখত যে আরেক চিঠিতে সে জানায় যে সে রকম কোনো আলোড়ন মাকন্দে বিরাজ করছে না আর এসবই হচ্ছে তার দেবরের পাগলামির ফল, যে এখন শ্রমিক সংঘের ঘূর্ণি বাতাস নিয়ে মত্ত, যেমনটি অন্য সময়ে মত্ত ছিল মোরগ লড়াই ও জাহাজ ব্যবসা নিয়ে। দুপক্ষ এ ব্যাপার নিয়ে একমত হওয়ার আগেই এক উত্তপ্ত বুধবারে এক বর্ষীয়ানী নান দরজা থেকে ডাকে যার বাহুতে ঝোলানো ছিল এক ঝুড়ি। দরজা খুলে সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ উপহার মনে করে সুন্দর লেসের কাজ করা মোটা কাপড় দিয়ে ঢাকা ঝুড়িটি নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু নান বাধা দেয়। কারণ তার প্রতি নির্দেশ ছিল ব্যক্তিগতভাবে, কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে সেটাকে দোনঞা (মিসেস) ফের্নান্দা দেল কার্পিও দে বুয়েন্দিয়ার হাতে দিতে। ঝুড়ির ভেতর ছিল মেমের ছেলে। ফের্নান্দার আগেকার আধ্যাত্মিক শিক্ষক একটি চিঠিতে খোলাসা করে লিখে দিয়েছে যে ছেলেটার জন্ম হয়েছে দুমাস আগে আর ব্যাপটাইজের সময় নানার নামে নাম রাখা হয়েছে আউরেলিয়ানো, কারণ ছেলের মা তার ইচ্ছা জানাতে দুঠোঁট আলাদা করে নি। নিয়তির প্রতি প্রচণ্ড রাগ অনুভব করলেও নানের সামনে তা গোপন করতে সমর্থ হয় ফের্নান্দা। ‘সবাইকে আমরা বলব ঝুড়িসহ ভাসমান অবস্থায় ওকে পেয়েছি আমরা’, হেসে বলে। ‘আপনাকে কেউই বিশ্বাস করবে না’, বলে নান। ‘বাইবেলে বর্ণিত একই গল্পে লোকে বিশ্বাস করতে পারলে’, উত্তর দেয় ফের্নান্দা, ‘আমার কথা বিশ্বাস না করার কোনো কারণ দেখছি না।’

বাড়িতেই দুপুরের খাবার সারে নান, ফেরার ট্রেন ধরার অপেক্ষায় আর গোপনীয়তার কঠোর নির্দেশ মান্য করে বাচ্চাটি সম্বন্ধে আর কোনো কথা না উচ্চারণ করলেও ফের্নান্দা তাকে লজ্জার এক সাক্ষী হিসেবে গণ্য করে, আর তার আফসোস হয় লোকে মধ্যযুগীয় ফাঁসির রীতি বর্জন করেছে বলে, আর খারাপ খবর নিয়ে আসা এই দূতকে না ঝোলাতে পারায়। আর তখনই সিদ্ধান্ত নেয় নান ফিরে যাওয়ামাত্রই শিশুটিকে গোসলের টাবে ডুবিয়ে মারার। কিন্তু মন অতটুকু শক্ত হতে না পারায় অসীম কৃপাময় ঈশ্বর তাকে এই অন্তরায় থেকে মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করাই সমীচীন মনে করে।

যখন নতুন আউরেলিয়ানোর বয়স এক বছর পূর্ণ হয়, তখন কোনো আগাম ঘোষণা ছাড়াই জনসাধারণের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো ও অন্যান্য সিন্ডিকেটের নেতারা এত দিন আত্মগোপন করে থাকা জায়গা থেকে, এক সপ্তাহান্তে হঠাৎ করেই উদয় হয় আর কলা অঞ্চলের শহরগুলোতে মিছিল করে। পুলিশ শুধু নাগরিক নিরাপত্তা রক্ষা করেই সন্তুষ্ট থাকে। কিন্তু সোমবার রাতে নেতাদের বাড়ি থেকে বের করে পাঁচ কিলোর বেড়ি পায়ে পরিয়ে, পায়ে হাঁটিয়ে প্রাদেশিক রাজধানীর জেলে পাঠানো হয়। ওদের মধ্যে ছিল হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো ও লরেন্স গাবিলান, মাকন্দে নির্বাসিত মেহিকানো বিপ্লবের এক কর্নেল, যার কথানুযায়ী সে তার কম্পাদে আরতেমিও ক্রুজের বীরত্বের চাক্ষুস সাক্ষী। যদিও তিন মাসের মধ্যেই ওরা ছাড়া পেয়ে যায় কারণ সরকার ও কলা কোম্পানি একমত হতে পারছিল না কাকে জেলে ঢোকাবে এ ব্যাপারে। এসব কর্মচারীর ক্ষোভের ভিত্তি ছিল অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাসস্থান, চিকিৎসার সুবিধা প্রদানের ব্যাপারে প্রতারণা, আর কর্মস্থলের শোচনীয় পরিবেশ। এ ছাড়া তারা জোর করে বলে যে তারা নগদ টাকায় বেতন না দিয়ে জিনিসপত্র কেনা যায়, এমন টিকিট দেয়, যার বিনিময়ে কমিসারি থেকে ভার্জিনিয়া হ্যাম ছাড়া আর কিছুই কেনা যায় না। হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোকে জেলে পোরা হয়, কারণ সে-ই ফাঁস করে দিয়েছিল যে টিকিট দিয়ে বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা আসলে ফলের জাহাজগুলোর জন্য টাকা জোগানোর ব্যবস্থা, কারণ, তা না হলে জাহাজগুলোকে খালি ফিরতে হতো কলা ওঠানোর ডক থেকে নিউ আরলিন্স পর্যন্ত। অন্য অভিযোগগুলো ছিল সর্বজনবিদিত কোম্পানির ডাক্তাররা রোগীদের পরীক্ষা করত না, তার বদলে রোগীদের ডিসপেনসারির সামনে লম্বা লাইনে দাঁড় করিয়ে এক নার্সকে দিয়ে তাদের জিবের ওপর কপার সালফেটের রঙের বড়ি দেওয়াত। তা ম্যালেরিয়া, গনোরিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য যে রোগই হোক না কেন, সব রোগের বেলাতেই ছিল একই চিকিৎসা। চিকিৎসাটা এমন সাধারণভাবে করা হতো যে বাচ্চারা বারবার লাইনে দাঁড়িয়ে বড়ি না গিলে বাড়ি নিয়ে যেত লটারি খেলার গুটি হিসেবে ব্যবহারের জন্য। কোম্পানির কর্মচারীরা ছোট্ট ঘরে গাদাগাদি করে থাকত। কোম্পানির ইঞ্জিনিয়াররা শৌচাগার না বসিয়ে বড়দিনের সময় ভ্রাম্যমাণ টয়লেট ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে প্রতি পঞ্চাশ জন লোকের জন্য একটি করে দিয়ে, কীভাবে সেটি ব্যবহার করলে দীর্ঘদিন সেটা টিকে থাকবে, তার প্রদর্শনী করত। কালো পোশাক পরিহিত জরায় আক্রান্ত অন্য সময়ে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে ঘিরে থাকা উকিলরা ছিল কলা কোম্পানির আইনগত প্রতিনিধি, আর তারা এই সব দাবি এমন সব যুক্তির সঙ্গে বাতিল করে দিত যে সেটাকে মনে হতো জাদুর খেলা। যখন শ্রমিকেরা এক সর্বসম্মত দাবির তালিকা দাঁড় করায়, সেটাকে কলা কোম্পানির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে প্রচুর সময় লেগে যায়। এই সর্বসম্মত দাবির কথা জানার সঙ্গে সঙ্গেই সেনঞর ব্রাউন তার কাচের ওয়াগনটা ট্রেনের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে আরও কিছু কোম্পানির বহুল পরিচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে একসঙ্গে মাকন্দ থেকে উধাও হয়। অবশ্য পরের শনিবার কয়েকজন শ্রমিক বেশ্যালয়ে গিয়ে এক মেয়েকে দিয়ে ফাঁদে ফেলে উলঙ্গ অবস্থায় তাকে দিয়ে দাবির কাগজটায় সই করিয়ে নেয়। বিষণ্ন উকিলের দল বিচারকের কাছে প্রমাণ করে যে সই করেছে তার সঙ্গে কোম্পানির কোনো সম্পর্কই নেই আর যাতে কোনো সন্দেহ সৃষ্টি না হয়, তার জন্য তাকে প্রতারক হিসেবে জেলে ভরা হয়। পরে ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণিতে বেনামে ভ্রমণকৃত সেনঞর ব্রাউন ধরা পড়ে যায় শ্রমিকদের কাছে আর তাকে দিয়ে আবার দাবির অন্য এক অনুলিপিতে স্বাক্ষর করানো হয়। সে পরের দিন বিচারকদের সম্মুখে হাজির হয় চুলে কালো কলপ লাগিয়ে ও নিখুঁত কাস্তেইঞানো (স্প্যানিশ) বলে। উকিলরা প্রমাণ করে যে সেই লোক আলাবামার গ্যাটাভিলে জন্মগ্রহণকারী কলা কোম্পানির সুপারিনটেনডেন্ট নয়, বরং মাকন্দে জন্মগ্রহণকারী এক নিরীহ ভেষজ গাছগাছড়ার বিক্রেতা, যাকে ব্যাপটাইজ করা হয়েছিল দাগোবের্ত ফনসেকা নামে। কিছুদিন পর শ্রমিকদের নতুন এক প্রচেষ্টার ফলে উকিলরা জনসমক্ষে প্রদর্শন করে কনসাল ও বিদেশ মন্ত্রীকৃত সত্যায়িত সেনঞর ব্রাউনের মৃত্যুসনদ, যেটা অনুযায়ী সে মারা গেছে গত জুনের নয় তারিখে শিকাগোতে দমকল বাহিনীর গাড়ি চাপা পড়ে। এই সব বাজে প্রলাপে ক্লান্ত হয়ে শ্রমিকেরা মাকন্দের কর্তৃপক্ষকে বাতিল করে দিয়ে উচ্চতর আদালতে তাদের দাবি তুলে ধরে। সেখানেই আইনের জাদুকরেরা প্রমাণ করে এই সমস্ত দাবির কোনো সত্যিকার ভিত্তি নেই, কারণ কলা কোম্পানির কখনো কোনো শ্রমিক নেই, কোনো দিন ছিলও না এবং ভবিষ্যতেও থাকবে না। বরং যারা সেখানে কাজ করে, তারা সবাই অস্থায়ী কর্মী, ফলে ভার্জিনিয়া হ্যামের কথা, জাদুকরি বড়ির কথা, বড়দিনের পবিত্র শৌচাগারের কথা—সবই ভিত্তিহীন হয়ে পড়ে আর আদালতের হুকুমে সেটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় আর প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমিকদের অস্তিত্বহীনতার কথা।

আরম্ভ হয় মহা ধর্মঘট। চাষবাস পড়ে থাকে অসমাপ্ত, ফল পচতে থাকে গাছে আর এক শ বিশ ওয়াগনের ট্রেন পড়ে থাকে রেললাইনের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায়। বেকার শ্রমিকে উপচে পড়ে শহরটা। তুর্কদের রাস্তায় সম্মিলিত চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয়। অনেক দিনের মধ্যে এক শনিবারে আর হোটেল জ্যাকবের বিলিয়ার্ড রুমগুলোতে চব্বিশ ঘণ্টার শিফট চালু করা হয়। যেদিন ঘোষণা করা হয় জনসাধারণের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব সামরিক বাহিনীর হাতে দেওয়া হয়েছে, সেদিন হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো ওখানেই ছিল, যদিও সে পূর্ববোধ অনুভবের মানুষ নয়, তবু ওর জন্য সেটা যেন ছিল মৃত্যুর ঘোষণা, যার জন্য সে অপেক্ষায় ছিল সুদূর অতীতের সেই সকাল থেকে যে সকালে কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস ওকে মৃত্যুদণ্ড দেখানোর সুযোগ দিয়েছিল। অবশ্য এই অশুভ সংকেতটা তার গাম্ভীর্যে কোনো পরিবর্তন আনে না। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ীই সে নির্ভুলভাবে বিলিয়ার্ডের কিউ বলটাকে খেলে। খানিক পর ড্রামের শব্দ, বিউগলের তীব্র আওয়াজ, লোকজনের চিৎকার ও অনেক লোকের দৌড়াদৌড়ির শব্দ ওকে জানায় যে শুধু বিলিয়ার্ড খেলাই যে শেষ হয়েছে তা নয়, নিঃশব্দে একাকী যে খেলাটা সে খেলে আসছিল, মৃত্যুদণ্ডের উষা থেকে সেটারও শেষ পর্যন্ত সমাপ্তি ঘটেছে। সর্বমোট তিন রেজিমেন্ট ছিল ওরা আর গ্যালি ড্রামের শব্দের সঙ্গে করা মার্চ মাটি কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। ওদের অসংখ্য ড্রাগনের নাক থেকে বের হওয়া বিশ্রী গন্ধের বাষ্প দুপুরের নির্মলতাকে ভরিয়ে দিয়েছিল। ওরা ছিল ছোটখাটো, গাট্টাগোট্টা, রূঢ়। ঘোড়ার মতো ঘামত ওরা, রোদে পোড়া বলে একধরনের শুকনো চামড়ার গন্ধ বের হতো গা থেকে আর ওদের ছিল পাহাড়ি লোকের মৌনতা ও অভেদ্য অধ্যবসায়। যদিও জায়গাটা পার হতে ওদের এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগে, তবু মনে হতে পারত যে সামান্য কিছু স্কোয়ার্ড বৃত্তাকারে মার্চ করছে, কারণ ওরা ছিল সবাই একই রকম। একই মায়ের গর্ভে জন্ম আর সবাই একই রকমের বুদ্ধতা নিয়ে বয়ে চলেছে হ্যাভারস্যাক, ক্যানটিন বেয়নেটসমেত বন্দুকের লজ্জা, অন্ধ বশ্যতার অস্বস্তি ও সম্মানবোধ। উরসুলা ওদের শুনতে পায় ওর ছায়ান্ধকার বিছানা থেকে আর হাত তোলে ক্রস আঁকতে। সদ্য ইস্তিরি করা নকশা করা খাবার টেবিলের চাদরে ভর দিয়ে ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়ায় সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ আর ভাবে ছেলে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোর কথা যে তখন হোটেল জ্যাকবের সামনে দিয়ে শেষ সৈন্যটিকে চলে যেতে দেখছে।

সামরিক আইন এই বিরোধে মধ্যস্থতা করার সুযোগ করে দেয় সেনাবাহিনীকে। কিন্তু ওরা সমঝোতা ঘটানোর কোনো চেষ্টাই করে না দুপক্ষের মাঝে। মাকন্দে মুখ দেখানো মাত্রই বন্দুক একপাশে সরিয়ে রেখে কলা কেটে বোঝাই করে ট্রেন চালিয়ে দেয়। শ্রমিকেরা, যারা এযাবৎ অপেক্ষা করেই সন্তুষ্ট ছিল। তারা নিজেদের একমাত্র কাজের হাতিয়ার মাচেতে (বড় কাস্তে) নিয়ে টিলায় ঢুকে অন্তর্ঘাতের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতে নেমে পড়ে। আগুন জ্বালিয়ে দেয় কলাবাগানে ও রসদের দোকানে, ধ্বংস করে রেলপথ, বাধা সৃষ্টি করে সেই সব রেল চলায়, যে রেলগুলো মেশিনগানের গুলি ছুড়ে পথ করে নেওয়া শুরু করেছিল, আর কেটে দেয় টেলিফোন ও টেলিগ্রাফের তার। সেচের খালগুলো রক্তে লাল হয়ে ওঠে। বিদ্যুতায়িত মুরগির খোঁয়াড়ের ভেতরে তখনো জীবিত সেনঞর ব্রাউনকে তার অন্যসব সঙ্গী, পরিবারসহ মাকন্দ থেকে সরিয়ে ফেলা হয় নিরাপদ জায়গায় সামরিক বাহিনীর প্রহরাধীনে। পরিস্থিতি যখন এক অসম রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে, তখন কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের মাকন্দে জড়ো হতে আহ্বান করে। সেখানে ঘোষণা করা হয় সামরিক ও বেসামরিক প্রাদেশিক নেতারা বিরোধে মধ্যস্থতা করতে পরের শুক্রবারে এসে পৌঁছাবে।

শুক্রবার ভোর হতে রেলস্টেশনে জড়ো হওয়া ভিড়ের মধ্যে ছিল হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো। আগেই সে অংশগ্রহণ করেছিল ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে এক বিশেষ আলোচনায়, আর কর্নেল গ্যাভিলান ও তার দায়িত্ব ছিল ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে অবস্থানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার। খুব একটা ভালো বোধ করছিল না সে আর আঠালো কিছু দলা অনুভব করতে শুরু করেছিল তার টাকরার ওপর, যখন থেকে সে দেখতে পায় ছোট্ট প্লাজার চারদিকে মেশিনগান বসানো হয়েছে ও কলা কোম্পানির তার ঘেরা শহর সুরক্ষিত করা হয়েছে গোলন্দাজ বাহিনীর অস্ত্র দিয়ে তখন থেকেই। বারোটা বাজতে চলেছে, না আসা রেলের জন্য অপেক্ষা করছে তিন হাজারের বেশি লোক, যাদের মধ্যে ছিল শ্রমিক, মহিলা ও শিশু, যাদের দ্বারা রেলস্টেশনের সামনের খালি জায়গাটা ভরে উপচে পড়েছে পার্শ্ববর্তী রাস্তায় সারি বেঁধে রাখা সামরিক বাহিনীর মেশিনগানধারীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। অভ্যর্থনা জানানোর অপেক্ষারত ভিড়ের চেয়ে, তাদের মনে হচ্ছিল আনন্দমুখর এক মেলা। তুর্কদের রাস্তা থেকে ভাজাভুজি ও পানীয়ের ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলো স্থানান্তরিত হয়েছে ওদের মাঝে আর লোকেরা প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে সহ্য করছিল অপেক্ষা ও গা জ্বলানো রোদের যন্ত্রণা। তিনটে বাজার কিছু আগে গুজব ওঠে, সরকারি রেলটা পরের দিনের আগে আসছে না। ক্লান্ত ভিড় ফেলে এক হতাশার দীর্ঘশ্বাস। এই সময় ভিড়ের দিকে তাক করা চারটে মেশিনগান বসানো স্টেশনের ছাদের ওপর ওঠে সেনাবাহিনীর এক লেফটেন্যান্ট আর মুহূর্তের জন্য নেমে আসে নীরবতা। হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোর পাশে ছিল চার ও সাত বছরের শিশুসহ খালি পায়ে দাঁড়ানো এক ভীষণ মোটা মহিলা, যে ওকে না চিনলেও ছোট ছেলেটাকে কোলে তুলে নিয়ে অন্যটাকে উঁচু করে তুলে ধরতে বলে মহিলা হোসে আর্কাদিওকে যাতে ভালো করে শুনতে পারে যা বলা হবে, আর ছেলেটাকে কাঁধে তুলে নেয় হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো। অনেক বছর পর সেই শিশু, যদিও কেউ বিশ্বাস করবে না, তবু গল্প করবে যে লেফটেন্যান্টকে সে গ্রামোফোনের মধ্য দিয়ে প্রাদেশিক সামরিক ও বেসামরিক ৪ নম্বর ডিক্রি পড়তে শুনেছে। ওটা সই করা ছিল জেনারেল কার্লোস কর্তেস ভারগাস ও তার সেক্রেটারি মেজর এনরিকে গার্সিয়া ইসায়ার দ্বারা আর আশি শব্দের তিন ধারায় ধর্মঘটীদের দুষ্কৃতকারী দল বলে ঘোষণা করা হয় এবং সেনাবাহিনীকে গুলি করে মারার ক্ষমতা দেওয়া হয়।

কানে তালা লাগানো শিসের মধ্য দিয়ে ডিক্রিটা পড়া শেষ হলে স্টেশনের ছাদে লেফটেন্যান্টের জায়গা দখল করে ক্যাপ্টেন ও গ্রামোফোনের চোঙা দিয়ে ইশারা করে যে সে কিছু বলতে চায়। নিঃশব্দ হয়ে যায় জনতা। ‘ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ’, বলে ক্যাপ্টেন খানিকটা ক্লান্ত নিচু স্বরে, ধীরে ধীরে, ‘জায়গা ত্যাগ করার জন্য পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া হচ্ছে।’

শিস ও দ্বিগুণ চিৎকারে চাপা পড়ে যায় নির্ধারিত সময় আরম্ভের বিউগলের আওয়াজ। কেউ নড়ে না। ‘পাঁচ মিনিট পার হয়ে গেছে’, একই স্বরে বলে ক্যাপ্টেন, ‘আর এক মিনিট, তারপরই গুলি শুরু হবে।’ বরফশীতল ঘাম নিয়ে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো শিশুটিকে কাঁধ থেকে নামিয়ে মহিলাকে দেয়। ‘বেজন্মারা গুলি চালাতেও পারে’, বিড়বিড় করে মহিলা। কথা বলার সময় পায় না হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো, কারণ একই সময় মহিলার বলা কথার প্রতিধ্বনি তুলে চিৎকার করে বলা কর্নেল গ্যাভিলানের কর্কশ কণ্ঠস্বর মুহূর্তেই চিনতে পারে সে। টানটান উত্তেজনার আশ্চর্য নৈঃশব্দ্যের গভীরতায় মদির হওয়া আর মৃত্যুর আকর্ষণে সম্মোহিত এই জনতাকে কিছুই নড়াতে পারবে না এই বিশ্বাসে নিশ্চিত হয়ে, হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো তার সামনের মাথাগুলোর ওপর উঁচু হয়ে জীবনের প্রথমবারের মতো গলা চড়ায়, ‘বেজন্মার দল’, চিৎকার করে, ‘তোদের উপহার দিচ্ছি বাকি মিনিটটা।’

ওর চিৎকারে এমন কিছু ঘটে, যা কিনা আতঙ্কের সৃষ্টি করে না, বরং সৃষ্টি করে বিভ্রমের। ক্যাপ্টেন গুলির আদেশ দেয় আর চৌদ্দটি মেশিনগান তাদের নীড় থেকে সাড়া দেয় সেই আদেশের। কিন্তু সবকিছুকেই মনে হচ্ছিল প্রহসনের মতো। যেন মেশিনগানগুলো ছিল আতশবাজির খেলা দেখানোর জন্য মিথ্যা গুলি ভরা। কারণ, শোনা যাচ্ছিল ওগুলোর ঘর্ঘর শব্দ, দেখা যাচ্ছিল ওগুলোর জ্বলন্ত উদ্‌গার কিন্তু সামান্যতম প্রতিক্রিয়াও লক্ষণীয় ছিল না ভিড়ের মধ্যে, একটি শব্দও নয়, এমনকি কোনো দীর্ঘশ্বাসও নয়, যেটাকে মনে হচ্ছিল তাৎক্ষণিক অভেদ্যতায় জমে যাওয়া কঠিন কিছু। হঠাৎ করেই স্টেশনের পাশ থেকে এক মরণচিৎকার ভেঙে দেয় সেই সম্মোহন ‘হায় হায় রে, আমার মা’; এক ভূমিকম্পের শক্তি, এক আগ্নেয়গিরির নিশ্বাস, এক বিপর্যয়ের গর্জন, ভিড়ের কেন্দ্র থেকে প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। কোনো রকমে শিশুটিকে তুলে নেওয়ার সময় পায় হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো, যখন তার মা অন্যটিকে নিয়ে আতঙ্কে ঘুরপাক খাওয়া জনতার মধ্যে মিলিয়ে যায়।

অনেক বছর পর শিশুটি গল্প করবে, যে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো ওকে মাথার ওপর তুলে যেন জনতার আতঙ্কের বাতাসের ওপর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল লাগোয়া রাস্তায়, যদিও প্রতিবেশী শ্রোতারা তাকে বলবে খ্যাপাটে বুড়ো। সুবিধেজনক অবস্থানে থাকার কারণে শিশুটি দেখতে পেয়েছিল সে। যখন উন্মত্ত জনতা কোনার দিকে যেতে শুরু করেছে, তখনই মেশিনগান গুলি আরম্ভ করে। অনেকগুলো স্বর একসঙ্গে চিৎকার করে, ‘মাটিতে শুয়ে পড়।’

প্রথম সারির মানুষগুলো এরই মধ্যে শুয়ে পড়েছে মেশিনগানের গুলির আঘাতে। জীবিতরা শুয়ে পড়ার বদলে ছোট প্লাজায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলে আতঙ্ক এক ড্রাগনের লেজের আকার ধারণ করে, আর ভিড়ের এক নিরেট ঢেউ উল্টো দিক থেকে আসা বিপরীত দিকের রাস্তার অন্য ড্রাগনের লেজের ওপর ধাক্কা খেয়ে ফেরা এক নিরেট ঢেউয়ের ওপর আছড়ে পড়ে আর সেখানেও বিরামহীন গুলি ছুড়ছিল মেশিনগানগুলো। ওদের ঘিরে ফেলা হয়েছিল। ওরা ঘুরছিল বিশাল এক ঘূর্ণিঝড়ের মতো, যেটাকে ধীরে ধীরে কেন্দ্রের দিকে ছোট পরিধিতে খাটো হয়ে আসছিল, কারণ নিয়মবদ্ধভাবে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর প্রান্তসীমাগুলো ছেঁটে গোলাকৃতি দেওয়া হচ্ছিল মেশিনগান নামক ক্ষুধার্ত কাঁচি দিয়ে। শিশুটা দেখতে পায়, এক খালি জায়গায় বাহু দুটো ক্রসের মতো করে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা এক মহিলাকে আর রহস্যজনকভাবে জনতার ঢেউ তাকে না মাড়িয়ে, এড়িয়ে যাচ্ছে,। সেখানেই হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো ওকে নামায় রক্তমাখা মুখ, থুবড়ে মাটিতে পড়ার আগ মুহূর্তে। বিশাল সেই সৈন্যদল মহিলাসহ, খরার সুউচ্চ আকাশের আলোসহ, উরসুলা ইগুয়ারান যেখানে এত ছোট ছোট মিছরির জন্তুজানোয়ার বিক্রি করেছে সেই বেবুশ্যে পৃথিবীসহ, খালি জায়গাটাকে ঝেঁটিয়ে পরিষ্কারের আগে।

যখন হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো জ্ঞান ফিরে পায়, তখন অন্ধকারে চিত হয়ে শুয়েছিল সে। টের পায় যে যাচ্ছে সে এক নিঃশব্দ অন্তহীন ট্রেনে, আর শুকনো রক্তে চুলগুলো তার শক্ত হয়ে আছে, ব্যথা করছে সারা শরীর। অদম্য এক ঘুমের ইচ্ছা জাগে তার। আতঙ্ক ও সন্ত্রাস থেকে দূরে অনেক ঘণ্টা ঘুমানোর ইচ্ছায়, শরীরের যেদিকটায় কম ব্যথা, সেদিকে পাশ ফিরে সে, আর কেবল তখনই বুঝতে পারে, সে শুয়ে আছে মৃতদেহের ওপর। মাঝের করিডর ছাড়া ওয়াগনটায় বিন্দুমাত্র জায়গা খালি ছিল না। নৃশংস হত্যার পর নিশ্চয়ই অনেক ঘণ্টা পার হয়েছে, কারণ মৃতদেহের গায়ে ছিল শরৎকালের পলেস্তারার মতো তাপমাত্রা, আর

একই রকম জমে যাওয়া ফোমের মতো শক্ত, আর যারা লাশগুলো ওয়াগনে তুলেছিল, তারা সময় পেয়েছিল সেগুলোকে কলার ছড়া চালান করার মতো করে একই রকমে সাজানোর। এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেতে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো এক ওয়াগন থেকে অন্যটায় নিজেকে টেনে নিয়ে যায়, যেদিকে ট্রেন ছুটছিল সেই দিকে, আর কাঠের ফালির ফাঁক দিয়ে ঘুমন্ত শহরগুলো পার হওয়ার সময় বিদ্যুচ্চমকের মতো ঝলকে আসা আলোয় দেখতে পায় মৃত পুরুষ, মৃত মহিলা, মৃত শিশু—যাদের পচে যাওয়া কলার মতো ছুড়ে ফেলা হবে সমুদ্রে। একমাত্র চিনতে পারে প্লাজায় পানীয় বিক্রি করা এক মহিলা ও কর্নেল গ্যাভিলানকে, যার হাতে তখনো জড়ানো মোরেলিয়ার রুপোর বক্লেসওলা বেল্টটা, যেটার সাহায্যে আতঙ্কের সময় সে পথ করে নিতে চেষ্টা করেছিল। যখন প্রথম ওয়াগনটাতে আসে সে, তখন ঝাঁপ দেয় অন্ধকারের মধ্যে আর পড়ে থাকে এক গর্তের মধ্যে ট্রেনটা চলে যাওয়া পর্যন্ত। এত লম্বা ট্রেন সে কখনোই দেখে নি, যেটাতে ছিল প্রায় দুই শত মালগাড়ি, যেটার দুই প্রান্তে দুই ইঞ্জিন ও মাঝখানে আরেকটা, যেটাতে কোনো আলোই ছিল না, এমনকি অবস্থান জানানোর লাল, সবুজ বাতিগুলোও নয়, যেটা পিছলে যাচ্ছিল, নৈশ রহস্যময় গতিতে। শুধু অন্ধকারে মেশিনগানধারী সৈন্যদের কালো কাঠামো দেখা যাচ্ছিল ওয়াগনের মাথায়।

মধ্যরাতের পর শুরু হয় মুষলধারে ঝড়বৃষ্টি। হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো জানত না কোথায় সে লাফ দিয়ে নেমেছে, কিন্তু জানত যে ট্রেনের গতিপথের উল্টো দিকে হাঁটলে মাকন্দে গিয়ে পৌঁছাবে। তিন ঘণ্টা হাঁটার শেষে হাড় অব্দি ভিজে প্রচণ্ড মাথাব্যথা নিয়ে ঊষার আলোয় প্রথম বাড়িগুলো চোখে পড়ে তার। কফির গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ঢুকে পড়ে এক রান্নাঘরে, যেখানে শিশু কোলে এক মহিলা উনুনের দিকে ঝুঁকে আছে। ‘সুপ্রভাত’, শান্ত স্বরে বলে, ‘আমি হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো বুয়েন্দিয়া।’ উচ্চারণ করে পুরো নামটা অক্ষরের পর অক্ষর, সে যে বেঁচে আছে, তা বোঝানোর জন্য। কাজটা সে ঠিকই করে, কারণ দরজায় রক্তমাখা মাথা ও পোশাক নিয়ে, মৃত্যুর গাম্ভীর্যের স্পর্শ নিয়ে ছায়ার মতো ঢুকতে দেখে মহিলা ওকে অপচ্ছায়া বলে ভেবেছিল। ওরা নিজেদের আগে থেকেই চিনত। মেয়েটা ওকে গায়ে জড়ানোর জন্য কম্বল এনে দেয়, যাতে করে তার কাপড়চোপড় আগুনে শুকোতে পারে। পানি গরম করে ক্ষতস্থান ধোয়ার জন্য, যেটা ছিল শুধু চামড়া ছিঁড়ে যাওয়া, আর একটা পরিষ্কার রুমাল এনে দেয় মাথায় পট্টি বাঁধার জন্য। পরে চিনি ছাড়া এক ভাঁড় কফি এনে দেয়, তার জানামতে বুয়েন্দিয়ারা যেভাবে পান করে, সেভাবে আর কাপড় ছড়িয়ে দেয় আগুনের পাশে। কফি পান শেষের আগে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো কোনো কথা বলে না। ‘তিন হাজারের মতো হবে’, বিড়বিড় করে।

‘কী?’

‘মৃতদেহ’, খোলাসা করে বলে, ‘যারা স্টেশনে ছিল তাদের সবারই।’

মহিলা করুণ দৃষ্টিতে পরখ করে ওকে। ‘এখানে কেউই মারা যায় নি’, বলে, ‘তোর কাকা কর্নেলের আমল থেকেই মাকন্দে কিছু ঘটে নি।’ বাড়ি পৌঁছানোর আগে তিনটে রান্নাঘরে থামে সে আর সবাই একই কথা বলে তাকে, ‘কেউ মারা যায় নি।’ স্টেশনের ছোট্ট প্লাজার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পায় ভাজাভুজি বিক্রির টেবিলগুলো স্তূপ করা আছে একটার ওপর আরেকটা, আর সেখানেও সে দেখতে পায় না গণহত্যার কোনো নিশানা। অঝোর ধারায় পড়া বৃষ্টির মাঝে রাস্তাগুলো মরুভূমির মতো, ভেতরে প্রাণের কোনো চিহ্ন ছাড়াই বাড়িগুলো ছিল বন্ধ। একমাত্র প্রাণের চিহ্ন ছিল মাস আরম্ভ হওয়ার প্রথম গির্জার ঘণ্টায়। কর্নেল গ্যাভিলানের বাড়িতে গিয়ে টোকা দেয় সে। এক পোয়াতি মহিলা, যাকে সে অনেকবারই দেখেছে, তার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে। ‘সে চলে গেছে’, আতঙ্কিত স্বরে বলে। ‘ফিরে গেছে নিজের দেশে।’ তার দিয়ে ঘেরা মুরগির খোঁয়াড়টার প্রধান ফটক যথারীতি দুই স্থানীয় পুলিশের প্রহরাবাড়ি ছিল, যাদের রেইনকোট ও রাবারের হেলমেটসহ মনে হচ্ছিল বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের মূর্তি। শহরের প্রান্তের গলিতে কালো ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা গাইছিল শনিবারের সমবেত প্রার্থনাসংগীত। হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো লাফিয়ে ওঠানোর বেড়া পার হয়ে রান্নাঘর দিয়ে বাড়িতে ঢোকে। সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদের কোনো রকমে গলার স্বর বের হয়, ‘তোকে যেন ফের্নান্দা না দেখে’, বলে, ‘কিছুক্ষণ আগে ঘুম থেকে উঠেছে।’ যেন গূঢ় কোনো চুক্তি মোতাবেক কাজ করছে, তেমনিভাবে ছেলেকে সে নিয়ে যায় মলত্যাগপাত্রের ঘরে, বিছানা পাতে মেলকিয়াদেসের জীর্ণ চৌকিটাতে, আর দুটোয় ফের্নান্দার সিয়েস্তার সময় জানালা দিয়ে গলিয়ে দেয় এক থালা খাবার।

আউরেলিয়ানো সেগুন্দো বাড়িতে ঘুমিয়েছিল, কারণ সে আসার পর হঠাৎ করে বৃষ্টি আরম্ভ হয় আর বেলা তিনটের সময়ও সে অপেক্ষায় ছিল বৃষ্টি ধরে যাওয়ার। সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদের কাছে গোপনে খবর পেয়ে ওই সময় ভাইকে দেখতে যায় মেলকিয়াদেসের ঘরে। সে-ও বিশ্বাস করে না গণহত্যার ও লাশভরা ট্রেনের সমুদ্রের দিকে যাওয়ার দুঃস্বপ্নটাকে। আগের রাতে সে এক বিশেষ সংবাদদাতার জাতীয় খবরে পড়ে, যেখানে জানানো হচ্ছে, শ্রমিকেরা স্টেশন ত্যাগ করার আদেশ মেনে নিয়েছে আর শান্তভাবে দলে দলে যার যার বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে। খবরে আরও জানানো হয়েছে যে ইউনিয়নের নেতারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমস্ত দাবি দুটোতে কমিয়ে এনেছে: চিকিৎসাব্যবস্থার সংস্কার ও কোয়ার্টারগুলোতে শৌচাগার নির্মাণের। জানানো হয় যে সামরিক কর্তৃপক্ষ যখন শ্রমিকদের সঙ্গে একমত হয়, তখন তারা ছুটে যায় সেটা সেনর ব্রাউনকে জানানোর জন্য আর সে সেটাকে শুধু যে মেনে নেয় তা-ই নয়, সেই সঙ্গে এই বিরোধের সমাপ্তি উদযাপনের জন্য দিনের আনন্দ উৎসবের খরচ দেওয়ার প্রস্তাব করে। শুধু যখন সামরিক কর্তৃপক্ষ তাকে জিজ্ঞেস করে, তবে তারা চুক্তি স্বাক্ষরের ঘোষণা করবে, সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বিদ্যুচ্চমকে দাগাঙ্কিত আকাশের দিকে তাকিয়ে এক গভীর অনিশ্চয়তার ভঙ্গি করে। ‘বৃষ্টি থামলে’, বলে, ‘যত দিন বৃষ্টি থাকবে, তত দিন সব কাজকর্ম স্থগিত থাকবে।’

তিন মাস ধরে বৃষ্টি হয় নি, চলছিল খরা। কিন্তু সেনর ব্রাউন তার সিদ্ধান্ত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত কলা অঞ্চলে মুষলধারে ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়। যা নাকি মাকন্দের দিকে ফেরার পথে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোকে অবাক করে। এক সপ্তাহ পরও বৃষ্টি চলছিল। হাজারবার পুনরাবৃত্ত সরকারি ভাষ্য, সরকারের হাতে আছে এমন সমস্ত মাধ্যমে, সারা দেশজুড়ে চর্বিত : কেউ মারা যায় নি, সন্তুষ্ট শ্রমিক নিজ নিজ পরিবারের কাছে ফিরে গিয়েছে, আর কলা কোম্পানি বৃষ্টির কারণে সমস্ত কার্যকলাপ স্থগিত রেখেছে। অন্তহীন বৃষ্টিতে জনসাধারণকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্দেশ্যে সামরিক আইন বজায় রাখা হলেও সৈন্যরা ব্যারাকেই থাকে। হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গুটিয়ে দিনের বেলা তারা প্রবল বৃষ্টিতে রাস্তার শিশুদের সঙ্গে জাহাজডুবির খেলা খেলত। রাতের বেলা কারফিউ আরম্ভের পর রাইফেলের কুঁদোর ঘায়ে দরজা ভেঙে সন্দেহভাজনদের বিছানা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যেত একমুখী যাত্রায়। তখনো চলতে থাকে দৃষ্কৃতকারী, খুনি, অগ্নিসংযোগকারী ও চার নম্বর ডিক্রির বিরোধিতাকারীদের খুঁজে বের করে শেষ করে দেওয়া, কিন্তু নিগৃহীতদের আত্মীয়রা খবরের আশায় কমান্ড্যান্টের অফিসে ভিড় করলে সামরিক কর্তৃপক্ষ সবকিছু অস্বীকার করত। ‘নিশ্চয় স্বপ্ন দেখেছ তোমরা’, জোর দিয়ে বলত তারা। ‘মাকন্দে কিছুই ঘটে নি, কিছুই ঘটছে না, কখনো ঘটবেও না। এটা এক সুখী শহর।’ এভাবেই ইউনিয়নের সমস্ত নেতাকে শেষ করা হয়।

একমাত্র জীবিত থাকে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো। ফেব্রুয়ারির এক রাতে দরজার শোনা যায় রাইফেলের কুঁদোর আঘাতের নির্ভুল আওয়াজ। বৃষ্টি থামার অপেক্ষারত আউরেলিয়ানো সেগুন্দো দরজা খুলে দেয় এক কমান্ডারের অধীনে ছয় সৈন্যকে। জবজবে বৃষ্টিভেজা সৈন্যরা একটিও শব্দ উচ্চারণ না করে বৈঠকখানা থেকে ভাড়ার ঘর পর্যন্ত প্রতিটি ঘর, প্রতিটি দেয়াল ও আলমিরা খুঁজে দেখে। উরসুলা জেগে ওঠে ঘরে আলো জ্বালাতে আর তল্লাশির সময়টাতে সে একটি নিশ্বাসও ত্যাগ করে না কিন্তু আঙুলে ধরে রাখে ক্রসচিহ্ন, সৈন্যরা যে দিকে যায়, সেই দিকেই ক্রসটাকে সে নির্দেশ করে। সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ, মেলকিয়াদেসের ঘরে ঘুমানো হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোকে সতর্ক করে দিতে পারলেও সে বুঝতে পারে, পালানোর চেষ্টার জন্য তখন যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। কাজেই সান্তা সোফিয়া আবার দরজা বন্ধ করলে সে জামা-জুতো পরে বিছানায় বসে ওদের আসার অপেক্ষায়। সেই সময় ওরা তল্লাশি চালাচ্ছিল রৌপ্যশালায়। অফিসার তালা খুলতে বাধ্য করে তাদের আর দ্রুত লন্ঠনটা একদিক থেকে অপর দিকে দোলাতেই তার চোখে পড়ে কাজের বেঞ্চ, অ্যাসিডের বোতলসহ আলমারি, সমস্ত কাজের যন্ত্রপাতি, সবকিছুই একই জায়গাতে রয়েছে, যেভাবে ওগুলোর মালিক রেখে গিয়েছেন আর সে বুঝতে পারে, ওই ঘরে কেউ বাস করে না। তবু চতুরতার সঙ্গে আউরেলিয়ানো সেগুন্দোকে প্রশ্ন করে সে রৌপ্যকার কি না; আর সে উত্তর দেয় যে ওটা হচ্ছে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার রৌপ্যশালা। ‘আচ্ছা’, বলে অফিসার আর বাতি জ্বালিয়ে নির্দেশ দেয় তন্ন তন্ন করে তল্লাশি চালানোর, যাতে করে তখন পর্যন্ত না গলানো, বোতলগুলোর পেছনে মাটির ভারের মধ্যে আঠারোটি সোনার মাছ তাদের নজর না এড়ায়। কাজের বেঞ্চির ওপর একটি একটি করে সবগুলোকে পরীক্ষার পর তার মন নরম হয়ে পড়ে। ‘এগুলোর একটি নিয়ে যেতে চাই আমি তোমার অনুমতি পেলে’, বলে। ‘একসময় এগুলো ছিল নাশকতার চাবিকাঠি কিন্তু এখন এগুলো স্মারক হয়ে গিয়েছে।’ সে ছিল যুবক, প্ৰায় বয়ঃসন্ধিকালের কাছাকাছি বয়স তার, কিন্তু চেহারায় ভয়ের কোনো চিহ্ন ছিল না তার। আর ছিল এক স্বভাবগত ভালমানুষি চেহারা, যেটা নাকি এর আগ পর্যন্ত নজরে পড়ে নি। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো সোনার ছোট্ট মাছটি তাকে উপহার দেয়। অফিসার ওটাকে জামার পকেটে রাখে এক শিশুসুলভ দীপ্তি চোখে নিয়ে আর বাকিগুলোকে রেখে দেয় মাটির ভাঁড়ে, যেখানে ছিল সেখানেই, ‘এটা এক অমূল্য স্মৃতিচিহ্ন’, বলে, ‘কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া ছিল আমাদের সমাজের সেরা মানুষদের একজন

যদিও তার এই মানবিক উচ্ছ্বাস তার পেশাগত আচরণে কোনো পরিবর্তন ঘটায় না। মেলকিয়াদেসের ঘরের সামনে যেটা আবার তালামারা ছিল, সেখানে সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ শেষ চেষ্টা করে। ‘প্রায় এক শ বছর যাবৎ এ ঘরে কেউ বাস করে না’, বলে। অফিসার ওকে তালা খুলতে বাধ্য করে, লণ্ঠনের আলো ফেলে ভেতরে আর আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ও সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ দেখতে পায় হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোর আরবীয় চোখ, যখন আলোর দ্যুতি তার মুখ বুলিয়ে যায়। আর বুঝতে পারে, এটাই হচ্ছে সমস্ত উৎকণ্ঠার অবসান আর অন্য একটির প্রারম্ভে, যেটার নিরসন হবে একমাত্র ভাগ্যের হাতে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে। কিন্তু অফিসার বাতি দিয়ে ঘরটা পরীক্ষা করে যেতে থাকে আর আলমারিতে স্তূপ করে রাখা বাহাত্তরটি মলত্যাগপাত্র আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত তার মধ্যে কোনো কৌতূহলের লক্ষণ দেখা যায় না। তখন বাতি জ্বালায় সে। হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো বসা ছিল বিছানার কিনারায়, বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে, আরও গাম্ভীর্য নিয়ে, সবচেয়ে বেশি চিন্তিত অবস্থায়। ভেতর দিকে ছিল ছেঁড়া বইয়ের তাক ও পার্চমেন্ট কাগজের রোল। আর কাজ করার টেবিলটা পরিষ্কার, পরিপাটি যেখানে কালির দোয়াতের কালি ছিল নতুন। বাতাসে ছিল একই রকমের নির্মলতা, একই রকমের স্বচ্ছতা, ধুলাবালি ও ধ্বংসের বিরুদ্ধে একই রকমের প্রতিরক্ষা, যেটাকে আউরেলিয়ানো লক্ষ করেছিল তার শৈশবে আর যেটাকে একমাত্র কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াই একমাত্র কখনো অনুভব করে নি। কিন্তু মলত্যাগপাত্রগুলো ছাড়া অফিসারের অন্য কিছুতে কৌতূহল জাগে না, ‘কজন বাস করে বাড়িতে?’ জিজ্ঞেস করে, ‘পাঁচজন।’

অফিসার স্পষ্টতই কিছুই বোঝে না। দৃষ্টি স্থির রাখে যেখানে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ও সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ, হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোকে দেখছিল, আর হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো বুঝে যায়, সৈন্যটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে কিন্তু তাকে দেখছে না। পরে অফিসার বাতি নিভিয়ে দরজা ভিড়িয়ে দেয়। যখন অফিসার সৈন্যদের সঙ্গে কথা বলে তখন আউরেলিয়ানো সেগুন্দো বুঝতে পারে যে যুবক অফিসারটি ঘরটিকে দেখেছে সেই একই চোখ দিয়ে, যে দৃষ্টি দিয়ে দেখেছিল কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া। ‘সত্যিই এই ঘরে কম করে হলেও শত বছর কেউ বাস করে নি’, বলে অফিসার সৈন্যদের, ‘সাপখোপ ও থাকতে পারে ওখানে।’

দরজা বন্ধের পর হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো নিশ্চিত হয় যে তার যুদ্ধ শেষ হয়েছে। বছর কয়েক আগে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া ওকে বলেছিল যুদ্ধের প্রতি আকর্ষণ সম্বন্ধে, নিজের অভিজ্ঞতার অসংখ্য উদাহরণ টেনে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিল তা। সে বিশ্বাস করেছিল ওর কথা, কিন্তু রাতে যখন ও ভাবছিল গত কয়েক মাসের উৎকণ্ঠার কথা, জেলের দুর্দশার, স্টেশনে আতঙ্কের কথা, লাশভর্তি ট্রেনের কথা, তখন অফিসার ওর দিকে তাকিয়ে থেকেও যখন ওকে দেখে না, তখন ও সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া ঠকবাজ বা নির্বোধ ছাড়া তার বেশি কিছু ছিল না। সে বুঝতে পারে না যুদ্ধের সময়ের অনুভূতি বোঝাতে কেন এত কথার প্রয়োজন ছিল, যা শুধু একটি শব্দেই সে সব প্রকাশ করতে পারত: ভয়। অন্যদিকে মেলকিয়াদেসের কামরায় অতিপ্রাকৃত আলো, বৃষ্টির শব্দ, অদৃশ্য থাকার অনুভূতি, নিরাপত্তা- এসবের মাঝে সে পায় এমন এক প্রশান্তি, যা আগের সারা জীবনে এক মুহূর্তের জন্যও পায় নি, আর ওর একমাত্র ভয় ছিল যে ওকে না জ্যান্ত কবর দেওয়া হয়। প্রতিদিন খাবার নিয়ে যাওয়া সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদকে সে কথাটা জানায়। আর সে প্রতিজ্ঞা করে নিজের ক্ষমতার অতীত চেষ্টা করবে বেঁচে থাকতে, যাতে তাকে জ্যান্ত কবর দেওয়া না হয়। সব ভয়মুক্ত হয়ে সে নিজেকে নিয়োগ করে বারবার মেলকিয়াদেসের পার্চমেন্টগুলোকে পড়াতে আর ওগুলো সে যত কম বুঝত, তত বেশি আনন্দ পেত। বৃষ্টির শব্দে অভ্যস্ত হয়ে দুমাসের মাথায় সে রূপান্তরিত হয় অন্য ধরনের নীরবতায় আর একমাত্র যা তার নিঃসঙ্গতাকে উত্ত্যক্ত করে তা হচ্ছে সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদের আসা-যাওয়া। যার জন্য সে অনুরোধ করে খাবারটা জানালার চৌকাঠের নিচের কাঠের ওপর রেখে দিতে এবং দরজায় তালা লাগাতে। পরিবারের অন্য সবাই তাকে ভুলে যায়, এমনকি ফের্নান্দাও, যে নাকি সৈন্যরা তার দিকে তাকিয়েও তাকে চিনতে পারে নি জেনে, তার সেখানে থাকার ব্যাপারে প্রায় আপত্তি করে নি। ছয় মাস আবদ্ধ থাকার পর, সৈন্যরা যখন মাকন্দ ছেড়ে চলে গিয়েছে, আউরেলিয়ানো সেগুন্দো দরজার তালা খোলে বৃষ্টি ধরে যাওয়ার অপেক্ষার সময়টাতে কারও সঙ্গে গল্প করার ইচ্ছায়। দরজা খুলে সে শিকার হয় মেঝেতে নামানো অনেকগুলো মলত্যাগপাত্র থেকে আসা দুর্গন্ধের, যেগুলো অসংখ্যবার ব্যবহৃত হয়েছে। আর এদিকে চুলপড়া রোগে আক্রান্ত মাথা নিয়ে, বমি উদ্রেককারী বাষ্পে কটু হয়ে যাওয়া বাতাসের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো বারবার পড়েই চলছে অবোধ্য পার্চমেন্টগুলো। ঐশ্বরীয় আলোয় উদ্ভাসিত ছিল সে। দরজা খোলার অনুভূতি পেয়ে শুধু ক্ষণিকের জন্য চোখ তোলে, কিন্তু তার ভাইয়ের জন্য ওই ক্ষণিক দৃষ্টি যথেষ্ট ছিল বুঝে নেওয়ার জন্য যে এ হচ্ছে তার পরদাদার নিয়তির অমোচনীয় পুনরাবৃত্তি। ‘ওরা তিন হাজারের বেশি ছিল’, শুধু এইটুকুই বলে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো, ‘এখন আমি নিশ্চিত যে স্টেশনে যারা ছিল, তারা সবাই ছিল ওখানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *