নিঃসঙ্গতার একশ বছর – ১৩

১৩

শেষের ক’বছর মানসিক মন্থরতার কারণে উরসুলা, হোসে আর্কাদিওর পোপ হওয়াসম্পর্কিত পড়াশোনা আর দেখাশোনার সুযোগ খুব কম পেত; যখন হোসে আর্কাদিওকে ধর্মীয় স্কুলে দেওয়ার জন্য তার প্রস্তুত করার সময়। ওর বোন মেমে পূর্বনির্ধারিত বয়সে সন্ন্যাসিনীদের স্কুলে ভর্তি হয় ফের্নান্দার কঠোরতা আর আমারান্তার তিক্ততার মধ্যে বড় হয়ে, আর সে স্কুলে ক্লাভিকর্ড বাজানোয় হয়ে ওঠে পটু। যেসব উপায় অবলম্বন করে উরসুলা শিক্ষানবিশ ভবিষ্যৎ পোপের দুর্বল সত্তাকে গড়ে তোলার চেষ্টা করে, তার কার্যকারিতা সম্বন্ধে ঘোর সন্দেহ বোধ করে মনঃকষ্টে ভোগে নিজেই, কিন্তু এর জন্য নিজের প্রচণ্ড বার্ধক্যকে বা জিনিসপত্রের চারপাশে ঢেকে রাখা কালো মেঘ, যেটা তাকে কোনো রকমে দেখতে দেয়, সেগুলোকে দোষী না করে দোষে এমন কিছুকে যা কিনা সে নিজেই চেনে না, যাকে সে মনে করে ক্রমবর্ধমান সময়ের আগ্রাসন বলে। ‘এখন আর বছরগুলো আগের মতো আসে না’, বলত মাঝেমধ্যে, যখন দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা তার হাত থেকে ফসকে যেত। আগে তার মনে হতো শিশুদের বড় হতে অনেক সময় লাগে। অত সময় ব্যয় করে চিন্তাভাবনা না করে শুধু, সবচেয়ে বড়, হোসে আর্কাদিওর জিপসিদের সঙ্গে চলে যাওয়ার কথা, সাপের মতো উল্কি গায়ে ফিরে এসে জ্যোতির্বিদদের মতো কথা বলার পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর কথা, আমারান্তা ও আর্কাদিওর আদিবাসীদের ভাষা ভুলে কাস্তেয়্যানো (স্প্যানিশ ভাষা) শেখার পূর্বে যত সব ঘটেছে বাড়িতে, সেগুলোর কথা মনে করলেই তা ভালোভাবে বোঝা যায়। বোঝা যায় যখন মনে আসে চেস্টনাটের নিচে কত রোদ-বৃষ্টি সহ্য করতে হয়েছে অভাগা হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াকে, এত সব যুদ্ধের পর মুমূর্ষু কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে বাড়িতে নিয়ে আসার আগে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার মৃত্যুতে কত শোক পালন করতে হয়েছে, আর তখনো কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হয় নি। অন্য সময়ে সারা দিন মিছরির জীবজন্তু বানানোর পরও সময় বেঁচে থাকত বাচ্চাদের দেখাশোনা করার, ওদের চোখের সাদা অংশ দেখে রেড়ির তেল খাওয়ানো দরকার কি না, তা বোঝার। আর অন্যদিকে এখন, যখন কিছুই করার নেই, শুধু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হোসে আর্কাদিওকে পিঠে চড়িয়ে ঘোড়ায় চড়ার খেলা ছাড়া, তার পরও, এই দুঃসময়টা কাজ অর্ধসমাপ্ত করে ফেলে রাখতে বাধ্য করে তাকে। সত্যি বলতে উরসুলা নিজের বয়সের হিসাব হারিয়ে ফেললেও বার্ধক্যে বুড়িয়ে যাওয়াকে প্রতিরোধ করে চলত, আর বিরক্ত করত সবাইকে সব দিক থেকেই, সবকিছুতেই নাক গলানোর চেষ্টা চালাত, আর যুদ্ধের সময় বৃষ্টি ধরে আসার অপেক্ষায় প্লাস্টার দিয়ে বানানো এক সেন্ট জোসেফের মূর্তি জামানত রেখে গিয়েছিল কি না, এই প্রশ্ন করে বহিরাগতদের উত্ত্যক্ত করত। কখন থেকে যে সে দৃষ্টিশক্তি হারাতে শুরু করেছে, তা কেউই জানে না। এমনকি জীবনের শেষের ক’বছরে যখন সে বিছানা থেকে উঠতে পারত না, তখনো মনে হতো যে সে শুধু জরার কাছেই হার মেনেছে, কিন্তু কেউই বুঝতে পারে নি যে সে দেখতে পেত না। হোসে আর্কাদিওর জন্মের আগে নিজেই সে খেয়াল করেছিল ব্যাপারটা। প্রথম দিকে তার মনে হতো, এটা হচ্ছে সাময়িক দুর্বলতা আর গোপনে মজ্জার সিরাপ খেত ও চোখে মধু লাগাত, কিন্তু খুব শিগগির সে হার মানে অদম্য অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে অন্ধত্বের কাছে। এমনকি বৈদ্যুতিক আলোর আবিষ্কার সম্পর্কেও পরিষ্কার কোনো ধারণা পায় নি সে, কারণ যখন প্রথম বাল্বগুলো লাগানো হয়, সে শুধু অনুভব করেছিল এক আলোর দ্যুতি। কাউকেই বলে নি কথাটা, কারণ সেটা হতো তার কর্মক্ষমহীনতার এক প্রকাশ্য স্বীকৃতি। সে নিঃশব্দে নিজেকে সঁপে দেয় বস্তুদের মধ্যের দূরত্ব ও মানুষের গলার স্বর শেখার মধ্যে, যাতে করে স্মৃতির দ্বারা দেখতে সক্ষম হয়, সেই সময় যখন চোখের ছানির ছায়ারা তাকে দেখতে দেবে না। আরও পরে সে জানতে পারবে ঘ্রাণশক্তির সাহায্যের কথা যা কিনা আঁধারের মাঝে বস্তুর কলেবর রঙের চাইতেও অনেক কার্যকর আর যেটা তাকে সবকিছু থেকে পদত্যাগের হাত থেকে রক্ষা করে। ঘরের অন্ধকারের মাঝেও সে সুচে সুতো পরিয়ে বোতাম লাগাতে পারত, জানত কখন দুধ প্রায় বলগ দেওয়ার উপক্রম। প্রতিটি জিনিসের অবস্থান এমন নির্দিষ্ট করে জানত যে মাঝেমধ্যে সে নিজেই ভুলে যেত তার অন্ধত্ব। একবার ফের্নান্দা বিয়ের আংটি হারিয়ে ফেলায় বাড়ি তোলপাড় করে ফেলে আর উরসুলা খুঁজে দেয় সেটা, বাচ্চাদের শোবার ঘরের এক তাক থেকে। মোদ্দা কথা, অন্যরা যখন চলাফেরা করত অসতর্কতার সঙ্গে, সে তখন তার চার ইন্দ্রিয় দিয়ে সবাইকে অনুসরণ করত, যাতে করে তাকে কেউই অসতর্কতার সুযোগে বিব্রত করতে না পারে, আর কিছুদিনের মধ্যেই আবিষ্কার করে বাড়ির প্রতিটি সদস্য নিজের অজান্তেই প্রতিদিন একই জায়গা দিয়ে চলাফেরা করে, একই কাজ করে, এমনকি প্রায় একই সময় একই কথার পুনরাবৃত্তি করে। আর শুধু তখনই যখন এই সুচারু নিয়মের বাইরে বেরোয়, কোনো কিছু হারানোর ঝুঁকি থাকে। কাজেই যখন সে শোনে ফের্নান্দার আংটি হারিয়ে দিশেহারা অবস্থার কথা, তখন তার মনে পড়ে যে একমাত্র ব্যতিক্রমী যে কাজটা ফের্নান্দা করেছিল, তা হচ্ছে মেমের মাদুরে এক ছারপোকা পাওয়া যাওয়ায় মাদুরটা রোদে শুকাতে দেওয়া, যেহেতু বাচ্চারা পরিষ্কার করায় সাহায্যের হাত লাগিয়েছিল, উরসুলা ভাবে, একমাত্র যেখানে বাচ্চাদের নাগালের বাইরে ফের্নান্দা আংটিটা রাখতে পারে তা হলো ওই তাক। অন্যদিকে ফের্নান্দার দৈনন্দিন জীবনের অভ্যাসই হারিয়ে যাওয়া জিনিস খোঁজার পথে বাধা সৃষ্টি করে, আর সে তা না জেনেই একমাত্র খুঁজে বেড়ায় ওর দৈনন্দিন চলাচলের জায়গাগুলোতে, আর একই কারণে জিনিসপত্র হারিয়ে গেলে তা খুঁজে পেতে সবারই এত কষ্ট হয়।

হোসে আর্কাদিওর লালনপালনের কাজই বাড়ির সামান্যতম পরিবর্তনগুলোর খবর রাখার মতো প্রাণান্তকর ব্যাপারে খুব সাহায্যে আসে। যখন সে বুঝতে পারত আমারান্তা শোবার ঘরের সেন্টদের কাপড় পরাচ্ছে, সে তখন ভান করত হোসে আর্কাদিওকে বিভিন্ন রঙের পার্থক্য শেখানোর।

‘বলো তো’, বলত ছেলেটাকে, ‘সেন্ট রাফায়েল আরকানহেলের (দেবদূত শ্রেষ্ঠ) পোশাকটা কী রঙের?’

এভাবেই ছেলেটা ওকে তথ্য দিত যে তথ্যগুলো দিতে তার চোখ অস্বীকার করে, আর এভাবেই ছেলেটা ধর্মীয় স্কুলে যাওয়ার অনেক আগেই সে সেন্টদের কাপড়ের বুনুনি থেকেই রঙের পার্থক্য বুঝতে পারত। মাঝেমধ্যে ঘটে যেত অভাবনীয় দুর্ঘটনা। এক বিকেলে আমারান্তা যখন বেগোনিয়ার বারান্দায় এমব্রয়ডারি করছে, সে হোঁচট খায় আমারান্তার সঙ্গে। ‘ঈশ্বরের দোহাই’, প্রতিবাদ করে আমারাস্তা, ‘দেখে পথ চলুন। ‘

‘তোরই দোষ’, বলে উরসুলা, ‘তুই বসে আছিস, যেখানে তোর বসার কথা নয়।’

ওর জন্য ব্যাপারটা ছিল সত্য। কিন্তু সে সেদিনই এমন একটা কিছু বুঝতে শুরু করে যা কিনা এর আগে কেউই আবিষ্কার করে নি। সেটা হচ্ছে বর্ষপরিক্রমার সঙ্গে সঙ্গে সূক্ষ্মভাবে সূর্য তার স্থান পরিবর্তন করে, আর যারা বারান্দায় বসে তাদেরও স্থান পরিবর্তন করতে হয় ধীরে ধীরে, আগাম কোনো আভাস না দিয়েই। তখন থেকেই উরসুলাকে তারিখ খেয়াল রাখতে হতো আমারান্তা ঠিক কোথায় বসেছে, তা জানার জন্য। যদিও তার হাতের কাঁপুনি প্রতিদিনই বেশি করে নজরে পড়ে, আর পায়ের ভরও সে আর সইতে পারছিল না, তবু তার ছোটখাটো শরীরটা এত জায়গায় একই সময়ে আগে কখনোই দেখা যায় নি। সারা বাড়ির দায়িত্ব যখন তার ওপর ছিল, সেই একই রকমের পরিশ্রমী সে এই বয়সেও। কিন্তু বার্ধক্যের অভেদ্য নিঃসঙ্গতা তাকে পরিবারের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখার এমনই এক দিব্যদৃষ্টি দিয়েছে যে প্রথমবারের মতো সে সত্যগুলো এত পরিষ্কারভাবে দেখে যে তার অন্য সময়ের ব্যস্ততা তাকে এমনভাবে দেখতে বাধার সৃষ্টি করত। ওই সময় যখন হোসে আর্কাদিওকে তৈরি করছিল সেমিনারিতে (ধর্মস্কুল) পাঠানোর; মাকন্দ পত্তনের পর থেকে তখন পর্যন্ত জীবনের সব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনাগুলো স্মরণ করে সে আর তাতে করে উত্তরসূরিদের সম্বন্ধে তার ধারণা আমূল বদলে যায়। সে বুঝতে পারে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া যুদ্ধের কারণে মন শক্ত হয়ে যাওয়ায় পরিবারের প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে নি, বরং সে কখনোই কাউকে ভালোবাসে নি, এমনকি তার স্ত্রী রেমেদিওসকে বা এক রাতের জন্য তার জীবনে আসা অগুনতি রমণীদেরও নয়, আর তার ছেলেদের তো নয়ই। বুঝতে পারে যে এত সব যুদ্ধ সে আদর্শের জন্য করে নি, যেমনটি দুনিয়ার সবাই ভেবেছিল। পায়ে দলেনি অবসাদের কারণে আসন্ন বিজয়, বরং তার বিজয় এবং পরাজয় এসেছে একই কারণে, নিখাদ পাপে ভরা অহংবোধের কারণে। সার কথা হচ্ছে সে ভাবে, যে সন্তানের জন্য সে নিজের প্রাণও দিতে পারত, সে শুধুই ভালোবাসতে অক্ষম এক মানুষ। এক রাতে ও যখন পেটে, তখন উরসুলা ওর কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। কান্নার শব্দ এতই স্পষ্ট ছিল যে পাশে থেকে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া জেগে ওঠে আনন্দিত হয় এই ভেবে যে শিশুটি হরবোলা হবে। অন্যেরা বলে যে ও ভবিষ্যৎ বক্তা হবে। অন্যদিকে উরসুলা এটাকে নিশ্চিতভাবে শুয়োরের লেজসহ ভয়ংকর বাচ্চার প্রথম ইঙ্গিত ধরে নিয়ে শিহরিত হয় আর ঈশ্বরের কাছে অনুনয় করে বাচ্চাটা যেন পেটে থাকতেই মারা যায়। কিন্তু বার্ধক্যের কারণে প্রাপ্ত স্বচ্ছতা তাকে বুঝতে সাহায্য করে যে যে ছেলে পেটে থাকতে কাঁদে, সে হরবোলা বা ভবিষ্যদ্বক্তার কোনো ঘোষণা নয়, সেটা হচ্ছে ভালোবাসতে না পারার এক নির্ভুল ইঙ্গিত আর কথাটা সে অনেকবারই বলে বেড়ায়। নিজের ছেলের এই অবমূল্যায়িত প্ৰতিমূৰ্তি এক ধাক্কায় ভরে দেয় ছেলের প্রতি উরসুলার সমস্ত অনুকম্পার ভান্ডার। অন্যদিকে আমারান্তা, যার হৃদয়ের কঠোরতা চমকে দেয়, যার পুঞ্জীভূত তিক্ততা, মনকে তিতিবিরক্ত করে তোলে, শেষ পরীক্ষায় সে উত্তীর্ণ হয়, এ পর্যন্ত আবির্ভূত মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে দয়াশীল হিসেবে, এক করুণাঘন স্বচ্ছতা নিয়ে বুঝতে পারে যে পিয়েত্র ক্রেসপিকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দিয়েছে, সেটা কোনো প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা দ্বারা চালিত নয়, এমনকি কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস, যে জীবনের প্রলম্বিত আঘাতে ভোগে, তার তিক্ততাভরা বিদ্বেষের কারণে, যেমনটি সবাই ভেবেছিল, তা নয়, বরং দুটো ঘটনাই ছিল অসীম ভালোবাসা ও এক অজেয় কাপুরুষতার মধ্যে আমরণ সংঘর্ষ, আর শেষ পর্যন্ত তাতে জয়ী হয় অযৌক্তিক ভয়টাই, যেটাকে আমারান্তা নিজের বিক্ষুব্ধ হৃদয়ে সর্বক্ষণ ধারণ করেছিল। ওই সময়ই, যখন উরসুলা রেবেকার নাম উচ্চারণ করতে আরম্ভ করে, এবং দেরিতে আসা অনুতাপের ফলে পুরোনো ভালোবাসা উথলে ওঠে, মাঝেমধ্যে সম্ভ্রমের সঙ্গে, যা শুধু একমাত্র সেই বুঝতে পারে। রেবেকা, যে নাকি কখনোই তার বুকের দুধ থেকে আহার গ্রহণ করে নি, করেছে মাটি থেকে, দেয়ালের চুন থেকে, যে উরসুলার শিরা থেকে রক্ত নেয় নি, যার শিরায় বইছে অজ্ঞাতপরিচয় মানুষের রক্ত, যাদের হাড়গোড় এখনো কবরে ক্লক ক্লক শব্দ করে, রেবেকা, সেই অস্থির মেয়েটিই, সেই কামুক মেয়েটিই, একমাত্র তারই ছিল অদম্য সাহস আর উরসুলার কাছে তখন সে-ই ছিল নিজের বংশে আকাঙ্ক্ষিত জন।

‘রেবেকা’, দেয়াল হাতড়াতে হাতড়াতে বলত, ‘কী অবিচারই না আমরা করেছি তোর সঙ্গে।’

বাড়িতে সবাই তাকে ভাবত বুঝিবা আবোলতাবোল বকছেন, যখন থেকে দেবদূত শ্ৰেষ্ঠ জিবরাইলের মতো ডান হাতটা উঁচু করে হাঁটতে শুরু করে, তখন থেকে এই ভাবনাটার শুরু হয়। অবশ্য ফের্নান্দা বুঝতে পারে, এই আবোলতাবোলের ছায়ার ভেতরেই লুকিয়ে আছে সূর্যের আলোর মতো স্বচ্ছতা, কারণ কোনো রকমের ইতস্তত না করেই উরসুলা বলে দিতে পারত গত বছরে বাড়িতে কত টাকা ব্যয় হয়েছে। একদিন আমারান্তারও একই রকমের ধারণা হয়, যখন ওর মা রান্নাঘরে এক স্যুপের পাত্রে নাড়া দিচ্ছিল, ওর কথা কেউ শুনছে কি না শুনছে, তা না জেনেই হঠাৎ বলে ওঠে যে প্রথম আসা জিপসিদের কাছ থেকে যে ভুট্টা পেষার যন্ত্রটা কিনেছিল, যেটা হোসে আর্কাদিওর পঁয়ষট্টিবার পৃথিবী প্রদক্ষিণের আগেই বাড়ি থেকে উধাও হয়, সেটা পিলার তেরনেরার বাড়িতেই আছে। পিলার তেরনেরা, বয়স যার প্রায় একশত, কিন্তু এখনো শক্ত-সমর্থ, যার অস্বাভাবিক মোটা দেহ দেখে শিশুরা ভয় পায়, আগে হাসির শব্দে যে রকম ভয়ে কবুতরগুলো ভয় পেত, যে এই রকম স্থুল দেহ নিয়েও চটপটে, সে কিন্তু উরসুলার এই কথায় অবাক হয় না, কারণ তার নিজের অভিজ্ঞতাই তাকে শেখাতে শুরু করেছে যে সজাগ সচেতন বার্ধক্য, তাসের গণনার চাইতে অধিকতর সঠিকভাবে ভবিষ্যৎ গণনা করতে পারে।

অবশ্য উরসুলা যখন বুঝতে পারে যে, হোসে আর্কাদিওকে পোপ বানানোর জন্য যথেষ্ট সময় সে হাতে পাবে না, তখন আতঙ্কে অস্থির হয়ে পড়ে। ভুল করতে শুরু করে সে, চোখ দিয়ে দেখতে চেষ্টা করে যা কিনা সে স্বজ্ঞা দিয়ে আরও স্বচ্ছতার সঙ্গে দেখতে পেত। এক সকালে বাচ্চাটার মাথায় ফুলের সুগন্ধি জল মনে করে এক দোয়াত কালি ঢেলে দেয়। সবকিছুতে নাক গলাতে গিয়ে সে বারবার হোঁচট খায়, ফলে বারবার মন খারাপ হয়ে অস্থির হয়ে পড়ে, আর চেষ্টা চালায় অন্ধকারের মাকড়সার জালটাকে খুলে ফেলতে, যেটা তাকে আলখাল্লার মতো জড়িয়ে ধরেছিল। ওই সময়ই তার মনে হয় যে তার এই ভুল করা, বার্ধক্যের ও অন্ধত্বের প্রথম বিজয় নয়, এটা হচ্ছে সময়ের এক গলদ। সে ভাবত যখন ঈশ্বর তুর্করা এক গজ কাপড় মাপতে যেমন ফাঁকি দেয় তেমনি ফাঁকিভরা মাস আর বছর বানাত, তখন সবকিছুই ছিল অন্য রকম। এই যে রেমেদিওস লা বেইয়্যা সশরীরে স্বর্গে উঠে গিয়েছে, তার রেশ না কাটতেই অবিবেচক ফের্নান্দা বাড়ির কোনায় কোনায় গজগজ করছে। আউরেলিয়ানোদের শরীর কবরে শীতল হওয়ার আগেই আউরেলিয়ানো সেগুন্দো আবার বাড়িটাকে জ্বালিয়ে রেখেছে মাতালদের বাজানো অ্যাকর্ডিয়ানের শব্দ দিয়ে, শ্যাম্পেন দিয়ে গোসল করে, যেন কোনো খ্রিষ্টান মারা যায় নি, মরেছে কিছু কুকুর আর যেন এই উন্মত্ত বাড়িটা যেটার জন্য এত মাথাব্যথা সহ্য করতে হয়েছে, যেটাকে বানাতে এত মিছরির জানোয়ার খরচ হয়েছে, সেটা যেন আগে থেকেই ঠিক করা ছিল ময়লার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার জন্য। হোসে আর্কাদিওর তোরঙ্গ গোছাতে গোছাতে এগুলোই মনে পড়ে উরসুলার; নিজেকে প্রশ্ন করে সে, একবারে সটান কফিনে গিয়ে শুয়ে পড়াই কি ভালো নয়, যাতে তার ওপর মাটিচাপা দেয়। আর কোনো ভয়ডর ছাড়াই প্রশ্ন করে ঈশ্বরকে যে সত্যিই ঈশ্বর বিশ্বাস করে কি না যে মানুষকে লোহা দিয়ে বানানো হয়েছে, এত সব লজ্জা, যন্ত্রণা সহ্য করার জন্য; আর জিজ্ঞেস করতে করতে নিজেই খুঁচিয়ে তুলছিল নিজের অজ্ঞতাকে, অনুভব করছিল শেষতক বিদ্রোহের সঙ্গে যা মনে আসে তা-ই নিজের ইচ্ছেমতো গলা ফাটিয়ে বলার দুর্দমনীয় ইচ্ছা, যা করার জন্য এতবার তার প্রবল ইচ্ছা জেগেছে আর প্রতিবারই সে ইচ্ছাটা দমিয়ে রেখেছে নীতি-আদর্শ ইত্যাদি চিন্তা করে, ইচ্ছা করে এসব নীতির ওপর বিষ্ঠা ঢেলে দিয়ে হৃৎপিণ্ডের ভেতর থেকে অকথ্য শব্দের অসীম পাহাড়গুলো বের করে আনতে, যেগুলো শতাব্দীজুড়ে গলাধঃকরণ করতে হয়েছিল আপস রক্ষার জন্য।

‘জাহান্নামে যাক’, চিৎকার করে।

আমারান্তা তোরঙ্গে কাপড় ঢোকাচ্ছিল, মনে করে কাঁকড়া-বিছে কামড়েছে।

‘কোথায় ওটা’, ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করে।

‘কী’?

‘কীটটা’, পরিষ্কার করে আমারান্তা। উরসুলা হৃৎপিণ্ডের ওপর এক আঙুল রাখে, ‘এখানে’ বলে।

এক বৃহস্পতিবার বেলা দুইটার সময় হোসে আর্কাদিও সেমিনারিতে যায়। তার বিদায়ের দৃশ্যটা কখনোই ভুলতে পারবে না উরসুলা, তামার বোতামসহ সবুজ কাপড়ের কোট পরে, মাড় দেওয়া টাই গলায় পরে, গরমে সেদ্ধ হতে হতে, উরসুলার শিক্ষামাফিক এক ফোঁটাও অশ্রু বিসর্জন না করে, ছিপছিপে গম্ভীর ছেলেটা বিদায় নেয়। খাবার ঘরটাকে ফুলের সুগন্ধি জলের সুবাস দিয়ে ভরপুর করে যায়, যা নাকি উরসুলা ওর মাথায় দিয়েছিল, যাতে করে বাড়িতে তার পদচারণ অনুসরণ করা যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত দুপুরে বিদায়ের ভোজ চলছিল, আনন্দের মধ্য দিয়ে তারা ঢেকে রাখে নিজেদের অস্বস্তি আর ফাদার ইসাবেল অ্যান্তনিওর ভাবনাচিন্তাগুলো নিয়ে অসম্ভব রকমের বাড়াবাড়ি করে। কিন্তু যখন কোনাগুলো রুপার পাত দিয়ে ও মখমলের কাপড়ে মোড়া তোরঙ্গটা নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল যেন বের করছে এক কফিন। এই বিদায় উৎসবে একমাত্র যে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে, সে হচ্ছে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া।

‘শেষতক একমাত্র ওটারই দরকার আমাদের’, গজগজায় সে, ‘এক পোপ।’

তিন মাস পর যখন আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ও ফের্নান্দা মেমেকে স্কুলে নিয়ে যায় আর ফিরে আসে এক ক্লাভিকর্ড নিয়ে, যেটা পিয়ানোলার জায়গা দখল করে। এই সময়ই আমারান্তা নিজের লাশে পরানোর কাপড়টা সেলাই করতে শুরু করে।

কলা নিয়ে মাতামাতির ঝড় ঠান্ডা হয়ে যায় এরই মধ্যে। আগন্তুকেরা মাকন্দের আদিবাসীদের কোণঠাসা করে ফেলে, কারণ তারা নিজেদের আদিকালের জীবিকাগুলোকেই আঁকড়ে ধরে রেখে এক ভরাডুবি থেকে রক্ষা পেয়েছে ভেবে সন্তুষ্ট হয়। বাড়িতে দুপুরের খাবারে অতিথি আপ্যায়নের প্রথা চালু থাকলেও কয়েক বছর পর কলা কোম্পানি চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সত্যিকার অর্থে আগেকার নিয়ম আর চালু হয় না। অবশ্য আতিথেয়তার প্রাচীন ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটে, কারণ তখন ফের্নান্দাই প্রবর্তন করত আইনের। উরসুলা অন্ধকারে আশ্রয় নেওয়ায়, আমারান্তা শবাচ্ছাদন বস্ত্র সেলাইয়ে ব্যস্ত থাকায় অতীতের শিক্ষানবিশ রানি স্বাধীনতা পায় অতিথি বাছাই করার ও বাবা-মার থেকে পাওয়া কঠোর রীতিনীতি আরোপ করার। বহিরাগতদের সহজে কামানো, অশ্লীল কাজে ওড়ানো টাকাপয়সায় যে গ্রামের উত্থান হচ্ছে, সেই গ্রামে ফের্নান্দার কঠোরতা বাড়িটাকে বানিয়ে ফেলে জরাজীর্ণ রীতিনীতির শক্ত ঘাঁটি। কোনো রকমের ব্যতিক্রম ছাড়া, ওর কাছে ভালো লোক হচ্ছে যাদের সঙ্গে কলা কোম্পানির কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি ওর দেবর হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো পর্যন্ত তার এই হিংসাত্মক পক্ষপাতের শিকার হয়, কারণ সে এই উত্তেজনাপূর্ণ দিনগুলোতে তার ভালো ভালো লড়াইয়ের মোরগগুলো নিলামে বিক্রি করে, কলা কোম্পানির ফোরম্যানের চাকরি নেয়।

‘এই বাড়িতে ও আর পা ফেলতে পারবে না’, বলে ফের্নান্দা, ‘যত দিন পর্যন্ত ওর গায়ে বিদেশি পাঁচড়া থাকবে।

বাড়ির কড়াকড়ি এমন পর্যায়ে পৌছায় যে সুনিশ্চিতভাবেই আউরেলিয়ানো সেগুন্দো পেত্রা কতেসের বাড়িতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। প্রথমে স্ত্রীর ওপর থেকে ভার কমানোর ছুতোয় পার্টিগুলোকে পেত্রার বাড়িতে সরায়। পরে জন্তুগুলোর উর্বরতা কমে যাওয়ার ছুতোয় খামার ও আস্তাবলও স্থানান্তর করে। শেষে রক্ষিতার বাড়ি অপেক্ষাকৃত শীতল—এই ছুতোয় ছোট্ট অফিসটি স্থানান্তর করে যেখান থেকে সে ব্যবসা চালাত। যখন ফের্নান্দা বুঝতে পারে যে স্বামী মারা না গেলেও সে বিধবা হয়ে গেছে, তত দিনে অবস্থা আগের জায়গায় ফেরানোর জন্য অনেক দেরি হয়ে গেছে। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো বাড়িতে প্রায় খেত না বললেই চলে আর একমাত্র যেসব কারণে সে বাড়িতে আসত, যেমন স্ত্রীর সঙ্গে শোবার জন্য, তাতে কাউকে বোঝানো অসম্ভব হয় যে কোনো পরিবর্তন হয় নি। এক রাতে অসাবধানতার ফলে পেত্রা কতেসের বিছানাতেই রাত ভোর হলে ধরা পড়ে যায় আউরেলিয়ানো সেগুন্দো। যা আশা করেছিল তার উল্টো, ফের্নান্দা কোনো রাগ করে না, এমনকি সামান্য অপমানকর দীর্ঘশ্বাসও ফেলে না সে, কিন্তু ওই একই দিনে তার কাপড়সহ দুটি তোরঙ্গ পাঠিয়ে দেয় রক্ষিতার বাড়িতে। প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তার মধ্য দিয়ে ওগুলো বয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেয়, যাতে সবাই দেখতে পারে তার বিপথগামী স্বামী এই লজ্জা সহ্য না করতে পেরে মাথা নিচু করে বাড়িতে ফেরে। কিন্তু এই বীরোচিত কাজটা আর একবার প্রমাণ করে ফের্নান্দা শুধু যে তার স্বামীর চরিত্রই নয়, বরং এই সমাজের চরিত্র সম্বন্ধেও কী পরিমাণ অজ্ঞ, যে সমাজ তার বাপ- মায়ের সমাজ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ যারা তোরঙ্গগুলো নিয়ে যেতে দেখে, তারা সবাই মন্তব্য করে যে শেষ পর্যন্ত এটাই হচ্ছে এই ধরনের ঘটনার চূড়ান্ত পরিণতি যে ঘটনার আদ্যোপান্ত সবারই জানা, আর আউরেলিয়ানো সেগুন্দো তার উপহারস্বরূপ পাওয়া মুক্তি উদযাপন করে তিন দিনব্যাপী পার্টি দিয়ে। তার স্ত্রীর জন্য আরও প্রতিকূল অবস্থা হচ্ছে যখন সে শুরু করেছে লম্বা পোশাক, তার সাবেক কালের পদক ও অসময়োচিত গর্ব নিয়ে এক করুণ প্রাধান্য, তখন তার রক্ষিতা ফেটে পড়ছে যেন তার দ্বিতীয় যৌবন নিয়ে, প্রাকৃতিক রেশমের কাপড়-জামা ও স্বীকৃতি পাওয়ার ফলে চোখে ডোরাকাটা ঝিকমিক দীপ্তি নিয়ে। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো নিজেকে সমর্পণ করে তার কাছে বয়ঃসন্ধির যৌনকামনা নিয়ে। আগের মতো যখন পেত্রা কতেস ওকে চাইত না, বরং আসত ওর যমজ ভাই বলে ভুল করে, যখন পেত্রা কতেস দুজনের সঙ্গেই বিছানায় যেত আর ভাবত, ঈশ্বর ওকে কী সৌভাগ্যই না দিয়েছে, সে বিছানায় যাচ্ছে এমন একজনের সঙ্গে, যে সহবাস করে ভিন্ন ভিন্ন দুজনের মতো। ওদের পুনরায় আসা কামনা এতই তীব্র ছিল যে একবার খেতে বসে একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে কেউ কাউকে কোনো কথা না বলে ঢাকনা দিয়ে খাবার ঢেকে শোবার ঘরে যায় প্রণয় করতে; খিদেয় মরার জন্য। ফ্রান্সের রমণীদের কাছে গোপনে বিভিন্নবার যাওয়ার অভিজ্ঞতায় আউরেলিয়ানো সেগুন্দো পেত্রা কতেসের জন্য কেনে এক যাজকীয় চাঁদোয়াসহ বিছানা, জানালায় লাগায় মখমলের পর্দা, আর সিলিং ও দেয়াল মুড়ে দেয় ক্রিস্টাল পাথরের আয়না দিয়ে। এই সময় সে ছিল সবচেয়ে বেশি পার্টি ও পানাহারে মত্ত। প্রতিদিন বেলা এগারোটায় আসা ট্রেন থেকে সে বুঝে নিত কেসের পর কেস শ্যাম্পেন ও ব্র্যান্ডি। ট্রেন স্টেশন থেকে ফেরার পথে কুম্বিয়া নাচের আসরে টেনে আনে পথে দেখা হওয়া সব মানুষকে, স্থানীয় বা বহিরাগতকে, পরিচিত বা অপরিচিতকে, কোনো রকমের ভেদাভেদ না করেই, এমনকি মিস্টার ব্রাউন, যে নাকি অন্য ভাষার সঙ্গে নিজেকে খুব একটা জড়াত না, সে-ও আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর আকার-ইঙ্গিতে প্রলুব্ধ হয়ে অনেকবারই পেত্রা কতেসের বাড়িতে বেদম মাতাল হতো, এমনকি তার সর্বক্ষণের সঙ্গী হিংস্র জার্মান শেফার্ড কুকুরগুলোকে পর্যন্ত অ্যাকর্ডিয়ানের সুরে যেনতেনভাবে গাওয়া টেক্সাসের সংগীতের সঙ্গে নাচাত।

‘দূর হও গরুর পাল’, পার্টি তুঙ্গে উঠলে চিৎকার করত আউরেলিয়ানো সেগুন্দো, ‘ভাগো, কারণ জীবন বড়ই ছোট।’

এত ভালো মেজাজে ওকে কখনোই দেখা যায় নি, ওকে কেউ এত ভালো কখনোই বাসে নি, আর জন্তুগুলোও সৃষ্টিছাড়াভাবে কখনোই এত বিয়োয় নি। তখন এত গরু শুয়োর, মুরগি জবাই করা হয় যে অন্তহীন পার্টিগুলোর জন্য যে রক্ত জমে পচে, তাতে উঠানের মাটি কালো কাদায় পরিণত হয়। উঠানটা হয়ে ওঠে ছড়ানো-ছিটানো উচ্ছিষ্ট হাড়গোড় ও নাড়িভুঁড়ির ভাগাড়, যেখানে সব সময়ই পোড়াতে হতো ডিনামাইট, যাতে শকুনের দল অতিথিদের চোখ খুবলে না নেয়। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো হয়ে পড়ে মোটা, গায়ের রং হয় লালচে বেগুনি, আকৃতি হয় কচ্ছপের মতো, হোসে আর্কাদিও সারা পৃথিবী ঘুরে যে ক্ষুধা নিয়ে এসেছিল, সেই রকম ক্ষুধা নিয়ে খাবার ফলে। তার অসীম খিদের অপরিমিত খরচের ক্ষমতা, অভূতপূর্ব আতিথেয়তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে জলাভূমি ছাড়িয়ে আর আকৃষ্ট করে উপকূলের সেরা ভোজনরসিকদের। সব জায়গা থেকে এসে হাজির হতো দুর্দান্ত সব পেটুকের দল কাণ্ডজ্ঞানহীন খাবারের ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য, যেগুলো আয়োজিত হতো পেত্রা কতেসের বাড়িতে। আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ছিল অপরাজিত ভোজনরসিক, যত দিন পর্যন্ত না এক দুর্ভাগ্যজনক শনিবারে এসে হাজির হয় সারা দেশজুড়ে হস্তিনী নামে ভালোভাবে পরিচিত কামিলা সাগাম্ভ্রমে নামী এক টোটেম (আদিবাসী) মহিলা। মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত চলে সেই প্রতিযোগিতা। প্রথম চব্বিশ ঘণ্টায় পরিবেশন করা হয় এক কচি গরুর সঙ্গে ইউকা, (একধরনের আলুর মতো খাদ্য) রোস্ট করা কাঁচা কলা, আর তার সঙ্গে দেড় বাক্স শ্যাম্পেন, আর আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর জয়ের ব্যাপারটায় ছিল নিশ্চিত। প্রতিদ্বন্দ্বীর নির্বিকার হুমকির মুখে তাকে দেখা যায় বেশি উৎসাহী ও প্রাণশক্তিসম্পন্ন, যেখানে অপর পক্ষ ছিল শান্ত আর অবশ্যই অনেক পেশাদারি ভাবসম্পন্ন, আর এই কারণেই বাড়ি উপচে পড়া দর্শকদের কাছে ছিল কম আকর্ষণীয়। যখন আউরেলিয়ানো প্রতিযোগিতায় জেতার উৎকণ্ঠায় বড় বড় কামড়ে ও গোগ্রাসে খেয়ে চলছে, হস্তিনী তখন একজন সার্জনের নিপুণতা নিয়ে মাংস কেটে কোনো তাড়া ছাড়াই খেয়ে চলে, এমনকি একধরনের আনন্দের সঙ্গেই।

দানবসম শক্তপোক্ত ছিল সেই মহিলা, কিন্তু তা সত্ত্বেও তার সেই বিশালায়তনের মধ্যে ছড়িয়ে ছিল এক নারীত্বের কমনীয়তা, তার মুখটা ছিল এতই সুন্দর আর হাত দুটো ছিল এতই চমৎকার ও যত্ন করা যে তার সঙ্গে যোগকৃত অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তিগত আকর্ষণে উদ্বেলিত আউরেলিয়ানো সেগুন্দো বাড়িতে ঢুকতে দেখে নিচু গলায় মন্তব্য করে যে দ্বৈরথটা খাবার টেবিলে না হয়ে বিছানায় হওয়াটাই সে বেশি পছন্দ করত। আরও পরে যখন দেখে ভোজের কেতাকানুনের একটিও না ভেঙে কচি বাছুরের পেছনের সম্পূর্ণ অংশ খেয়ে ফেলে, তখন আন্তরিকভাবেই মন্তব্য করে যে, রুচিমান, আকর্ষণীয়, অতিলোভী শুঁড়ওলা মানুষটা একদিক থেকে একজন আদর্শ নারী, আর কথাটা সে ভুল বলে নি। হস্তিনী নামের পূর্বে হাড়ভাঙানি নামে তার যে খ্যাতি ছিল, তার ভিত্তির অভাব ছিল। লোকে যেমন বলত, তেমন সে বলদ খেয়ে শেষ করত না অথবা গ্রিক সার্কাসের কোনো দাড়িওয়ালা রমণীও ছিল না, সে ছিল এক সংগীত স্কুলের নির্দেশিকা। পরিবারের সম্মানশীল মা হয়েও বাচ্চাদের ভালোভাবে খাওয়ানোর পন্থা খুঁজতে খুঁজতে সে আয়ত্ত করে খাবার বিদ্যেটা, যেটা ছিল কোনো কৃত্রিম ক্ষুধাবর্ধকের সাহায্যে নয়, বরং আত্মার পরম প্রশান্তির মাধ্যমে। এ সম্পর্কে তার প্রমাণিত তত্ত্ব যে, যে লোকের সমস্ত নীতিবোধ নিখুঁত, সে ক্লান্তিবোধ করা পর্যন্ত কোনো বাধা ছাড়াই খেয়ে যেতে পারবে। এভাবেই খেলোয়াড়ি মনোভাব থেকে নয়, বরং নৈতিক কারণে স্কুলের দেখাশোনায় ক্ষান্ত দিয়ে সারা দেশজুড়ে প্রবল ভোজনরসিক নামে খ্যাত নীতিবিহীন লোকটির বাড়ি আসে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য। প্রথমবারের সাক্ষাতেই সে বুঝতে পারে যে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো পাকস্থলীটা খোয়াবে না, খোয়াবে তার চরিত্র। প্রথম রাত শেষে যখন হস্তিনী খেয়ে চলছে বিরতিহীনভাবে, আউরেলিয়ানো সেগুন্দো তখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে প্রচুর কথা বলে আর হাসে। চার ঘণ্টা ঘুমায় ওরা, জেগে উঠে পান করে পঞ্চাশটি কমলালেবুর রস, আট লিটার কফি আর ত্রিশটি কাঁচা ডিম। দ্বিতীয় সকালে অনেক ঘণ্টা নির্ঘুম কাটিয়ে, দুটি শূকর, এক ছড়া কলা ও চার বাক্স শ্যাম্পেন পেটে চালিয়ে হস্তিনী সন্দেহ করে যে নিজের অজান্তেই আউরেলিয়ানো সেগুন্দো ওর ফরমুলাটা আবিষ্কার করে ফেলেছে চরম দায়িত্বহীনতার উদ্ভট উপায়ে। সে আসলে অনেক বেশি বিপজ্জনক, যতটা সে ভেবেছিল, তার চেয়েও। কিন্তু যখন পেত্রা কতেস দুটো রোস্ট করা তিতির টেবিলে নিয়ে যায় আউরেলিয়ানো সেগুন্দো সম্পূর্ণভাবে ভরপেট হওয়ার এক পা দূরে।

‘যদি না পারো, আর খেয়ো না’, বলে হস্তিনী, ‘আমরা ড্র করলাম।

কথাটা সে বলে মন থেকেই, প্রতিদ্বন্দ্বীকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করানোর অনুশোচনায় নিজে আর এক গ্রাসও মুখে তুলতে পারবে না জেনে। কিন্তু আউরেলিয়ানো সেগুন্দো সেটাকে ধরে নেয় নতুন এক শক্তি পরীক্ষার আহ্বান হিসেবে আর তার অবিশ্বাস্য ক্ষমতার বাইরে গিয়ে গিলে ফেলে তিতিরের রোস্টটাকে, অজ্ঞান হয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে। কুকুরের মতো মুখে ফেনা তুলতে তুলতে মুখ থুবড়ে পড়ে হাড়সহ থালার ওপর আর যন্ত্রণায় গোঙাতে থাকে। নিজেকে অনুভব করে অন্ধকারের মাঝে, কেউ যেন তাকে ছুড়ে ফেলছে সুউচ্চ চূড়া থেকে তলহীন পাতালে আর চেতনার সর্বশেষ আলোয় সে বুঝতে পারে অশেষ পতনের প্রান্তে মৃত্যু অপেক্ষা করছে তার জন্য।

‘আমাকে ফের্নান্দার কাছে নিয়ে যাও’, কোনো রকমে বলতে পারে।

যে বন্ধুরা ওকে বাড়িতে নিয়ে আসে, তারা মনে করে এর মাধ্যমে সে রক্ষিতার বাড়িতে না মরার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারল। পেত্রা কতেস যে বুট জোড়া পরে কফিনে ঢুকতে চেয়েছিল, সেগুলোকে পালিশ করে আর যখন লোক খুঁজতে থাকে পাঠানোর জন্য, তখন লোকে বলতে যায় তাকে যে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো বিপদ কাটিয়ে উঠেছে। এক সপ্তা পার হওয়ার আগেই সত্যি সে সেরে ওঠে আর এই রক্ষা পাওয়াটাকে উদযাপন করে এক অভূতপূর্ব পার্টির মধ্য দিয়ে। পেত্রা কতেসের বাড়িতেই বাস করতে থাকে সে কিন্তু প্রতিদিন দেখতে যেত ফের্নান্দাকে আর মাঝেমধ্যে থেকে যেত, পরিবারের সবার সঙ্গে খেত, যেন নিয়তির ফেড়ে অবস্থা উল্টে গিয়ে সে রক্ষিতার স্বামী হয়ে গিয়েছে আর স্ত্রীর প্রেমিকে পরিণত হয়েছে।

ফের্নান্দার জন্য এটা হয় এক বিশ্রাম। পরিত্যক্ত হওয়ার সেই একঘেয়ে দিনগুলোতে তার একমাত্র সময় কাটানোর উপায় ছিল সিয়েস্তার সময়ে ক্লাভিকর্ডের অনুশীলন ও ছেলেমেয়েদের কাছে চিঠি লেখা। চিঠিগুলোতে পনেরো দিন পরপর বিস্তারিত যা কিছু সে ওদের কাছে লিখে, তার একটি লাইনেও সত্য কথা থাকে না। সে তার লজ্জা গোপন রাখত। আলোকিত বেগোনিয়া থাকা সত্ত্বেও, বেলা দুইটার দমবন্ধ করা অবস্থা সত্ত্বেও, রাস্তা থেকে অনবরত আনন্দোৎসবের ঢেউ আসা সত্ত্বেও যে বাড়িটা ক্রমশই তার বাবা-মার বাড়ির মতো এক ঔপনিবেশিক ম্যানশন হয়ে উঠছে, সে বাড়ির বিষণ্ণতা সে গোপন রাখে ওদের কাছে। ফের্নান্দা বসবাস করত তিন জ্যান্ত প্রেতাত্মা ও মৃত হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার প্রেতাত্মার সঙ্গে, যে নাকি মাঝেমধ্যে বৈঠকখানার আলো-আঁধারির মধ্যে কৌতূহলী মনোযোগ নিয়ে ক্লাভিকর্ডের সামনে গিয়ে বসত তার বাজানোর সময়। কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া ছিল এক ছায়ামাত্র। সে শেষবারের মতো বাড়ির বাইরে বের হয়েছিল কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেসকে সম্ভাবনাহীন এক যুদ্ধের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য, আর এখন শুধু কর্মশালা থেকে বের হয় চেস্টনাটের নিচে প্রস্রাব করার জন্য। প্রতি তিন সপ্তাহে একবার ছাড়া আর কারও সঙ্গে দেখা করত না সে। দিনে একবার উরসুলা যা নিয়ে যেত, তাই দিয়ে আহার সারত আর যদিও সোনার ছোট্ট ছোট্ট মাছগুলোকে সে বানিয়ে চলছিল, তবু বিক্রি বর্জন করে যেদিন থেকে লোকেরা সেগুলোকে আর অলংকার হিসেবে না কিনে ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে কেনা শুরু করে। বিয়ের দিন থেকে শোবার ঘরে সাজানো রেমেদিওসের পুতুলগুলো একবার উঠোনে জ্বালিয়ে দেয়। চোখে চোখে রাখার ফলে উরসুলা ব্যাপারটা টের পেলেও ওকে নিবৃত্ত করতে পারে না। ‘তোর মনটা পাথরের তৈরি’, ওকে বলে।

‘ব্যাপারটা মনের নয়’, কর্নেল বলে, ‘ঘরটা পোকায় ভরে যাচ্ছে।’

আমারান্তা সেলাই করে চলে ওর শবাচ্ছাদন। ফের্নান্দা বুঝতে পারে না কেন আমারান্তা মাঝেমধ্যে মেয়েকে চিঠি লিখে, এমনকি উপহারও পাঠায়, অথচ হোসে আর্কাদিওর নাম পর্যন্ত শুনতে পারে না। ‘কারণটা না জেনেই মারা যাবে ও’, উত্তর দেয় আমারান্তা যখন উরসুলার মাধ্যমে প্রশ্ন করে ফের্নান্দা, আর এই উত্তর ওর মনে এমন এক রহস্যের সৃষ্টি করে, যা তার কাছে কখনোই খোলাসা হয় না। লম্বা, চওড়া কাঁধবিশিষ্ট সব সময়ই অনেকগুলো লেসের পেটিকোট পরিহিত অহংকারী আমারান্তার এক স্বাতন্ত্র্য ছিল ওর বয়স ও খারাপ স্মৃতিগুলোকে ঠেকিয়ে রাখার, আর মনে হতো যেন কপালে ধারণ করে আছে এক কুমারীত্বের ছাই আঁকা ক্রস। সত্যিকার অর্থে ক্রসটা ছিল তার হাতে কালো ব্যান্ডেজটাতে যেটাকে সে রাতে ঘুমানোর সময়ও খুলত না, যেটাকে নিজ হাতে ধুয়ে ইস্তিরি করত। শবাচ্ছাদন বস্ত্ৰটি এমব্রয়ডারি করতে করতে জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছিল তার। এভাবেও বলা যায় যে দিনে যা বুনত, রাতে সে তা খুলে ফেলত, নিঃসঙ্গতাকে পরাজিত করার আশায় নয়, বরং তার উল্টো, নিঃসঙ্গতাকে জিইয়ে রাখতে।

পরিত্যক্তার দিনগুলোতে ফের্নান্দার সবচেয়ে বড় উৎকণ্ঠার ব্যাপার ছিল প্রথমবারের মতো বাড়িতে ছুটি কাটাতে এসে মেমে, আউরেলিয়ানো সেগুন্দোকে বাড়িতে পাবে না। উৎকণ্ঠাটাকে দূর করে দেয় আউরেলিয়ানো সেগুন্দোর এই পেটভর খেয়ে মৃত্যুদশার অবস্থা। বাবা, মা দুজনেই মেমে ফিরে আসার আগেই এই চুক্তিতে পৌঁছায় যে ফিরে এসে যেন দেখে আউরেলিয়ানো সেগুন্দো শুধু যে ভালো একজন গৃহকর্তা তা-ই নয়, তার কাছে যেন বাড়ির বিষণ্ণতাটাও ধরা না পড়ে। প্রতিবারই দুমাসের জন্য আউরেলিয়ানো সেগুন্দো আদর্শ স্বামীর ভূমিকা পালন করে আইসক্রিম ও ছোট বিস্কুটের উৎসবের আয়োজন করে, যেগুলোকে সেই আনন্দোচ্ছল মেয়েটা ক্লাভিকর্ডটার সাহায্যে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। ওই সময় থেকেই বোঝা যায় সে মায়ের চরিত্রের খুব কমই পেয়েছে উত্তরাধিকারসূত্রে। তার চেয়ে বরং সে ছিল আমারান্তার দ্বিতীয় সংস্করণ, যখন আমারান্তা তিক্ততার সঙ্গে পরিচিত ছিল না আর সারা বাড়ি মাতাতো তার নাচের পদতালে, যখন বয়স ছিল তার বারো-চৌদ্দ, পিয়েত্রের প্রতি গোপন আসক্তি তার মনের গতিবিধি চিরকালের জন্য বদলে দেওয়ারও আগে। কিন্তু আমারান্তার উল্টো, এমনকি বাড়ির সবার উল্টো মেমে নিঃসঙ্গতার কোনো নিদর্শনই তুলে ধরে না, এমনকি যখন বেলা দুইটার সময় অলঙ্ঘনীয় নিয়মের মধ্যে ক্লাভিকর্ডের অনুশীলনের জন্য বৈঠকখানার দরজা বন্ধ করত, তখনো না। স্পষ্ট বোঝা যায় যে বাড়িটাকে ওর ভালো লাগে ও সারা বছর স্বপ্ন দেখে তার আগমনে বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের মধ্যে যে আলোড়নের সৃষ্টি হয়, সেগুলোর। আর বাপের পার্টি দেওয়া ও আতিথেয়তার স্বভাব থেকেও সে খুব একটা পিছিয়ে নেই। এই উত্তরাধিকারের প্রথম নিদর্শন হচ্ছে যখন সে তৃতীয় ছুটির সময় নিজের উদ্যোগে কাউকে কিছু না জানিয়ে চারজন নান ও আটষট্টি জন সহপাঠিনী নিয়ে বাড়িতে হাজির হয়।

‘কী কাণ্ড’, বিলাপ করে ফের্নান্দা, ‘এ দেখছি বাপের মতোই বর্বর।’

প্রতিবেশীদের কাছে বিছানা, দোলবিছানা ধার করতে হয়, নয়টি খাবার পালা নির্দিষ্ট করতে হয়, বেঁধে দিতে হয় গোসলের সময় ও ধার করে জোগাড় করতে হয় চল্লিশটি টুল, যাতে করে নীল ইউনিফর্ম ও ছেলেদের মতো লম্বা বুট পরিহিত মেয়েরা বাড়ির এক মাথা থেকে অন্য মাথা দৌড়ে না বেড়ায়। আমন্ত্রণটা মাঠে মারা যায়, কারণ হইচই করা ছাত্রীরা সকালের নাশতা শেষ করতে না করতেই দুপুরের খাবারের সময় হয়ে পড়ে আর দুপুরেরটা শেষের পর রাতের, আর সারা সপ্তাহে শুধু একবার প্ল্যান্টেশনে বেড়ানোর সুযোগ পায় ওরা। রাত হওয়ার সঙ্গে নানরা ক্লান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে, নড়াচড়া করতে ব্যর্থ হয় আর যখন তাদের এমনকি একটা হুকুম দেওয়ারও ক্ষমতা থাকে না, তখনো ক্লান্তিহীন উঠানে গেয়ে চলছে ওরা স্কুলের বেসুরো সংগীত। উরসুলা, যে নাকি কাজ করতে গিয়ে সব সময় অকাজ করে ফেলে, তাকে একদিন ওরা প্রায় মাড়িয়েই ফেলছিল। অন্যদিন নানেরা এক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে, কারণ উঠানে ছাত্রীদের উপস্থিতিকে পাত্তা না দিয়ে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া চেস্টনাটের নিচে প্রস্রাব করে। আরেকবার আমারান্তা প্রায় আতঙ্কের সৃষ্টি করে, যখন সে স্যুপে লবণ দেওয়ার সময় এক নান ঢুকে পড়ে আর একমাত্র যে প্রশ্ন তার মনে উদয় হয় তা হচ্ছে, ওই মুঠিভরা সাদা গুঁড়োগুলো কী।

‘আর্সেনিক’, বলে আমারান্তা।

ছাত্রীদের আসার রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে পায়খানায় যাওয়ার চেষ্টায় ওরা এমন গোলযোগের সৃষ্টি করে যে ভোর একটার সময়, তখনো শেষের ক’জন পায়খানায় ঢুকছে। ফলে ফের্নান্দা বাহাত্তরটি মলমূত্র ত্যাগের পাত্র কেনে কিন্তু এতে শুধু রাতের সমস্যাটা বদলে গিয়ে দিনের সমস্যার রূপ নেয়, কারণ ভোর হতেই পাত্র হাতে ছাত্রীদের লম্বা লাইন লেগে যায় ওগুলো ধোয়ার জন্য। যদিও কেউ কেউ জ্বরে ভোগে ও মশার কামড়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, তবু অধিকাংশই প্রচণ্ড সমস্যার মুখে অনমনীয় প্রতিরোধের পরিচয় দেয় আর দিনের সবচেয়ে উত্তপ্ত সময়ও দৌড়াদৌড়ি করে বাগানে। অবশেষে ওরা যখন বিদেয় হয় বাগানের ফুল পায়ে দলে শেষ করে দিয়ে, তখন আসবাবগুলো সব ভেঙে ফেলা হয়েছে, দেয়ালজুড়ে করা হয়েছে বিভিন্ন আঁকিবুকি ও লেখালেখি। তবু ফের্নান্দা ওদের ক্ষমা করে দেয় শুধু ওদের বিদায়ের স্বস্তিতে। সে ধার করা বিছানা ও টুলগুলো ফেরত দিয়ে বাহাত্তরটি মলত্যাগপাত্র মেলকিয়াদেসের ঘরে ঢুকিয়ে রাখে। সেই নিষিদ্ধ ঘরটা, যাকে কেন্দ্র করে বাড়ির আধ্যাত্মিক জীবন আবর্তিত হতো, তখন থেকে সেই ঘরকেই সবাই চেনে মলত্যাগপাত্রের ঘর হিসেবে। কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার জন্য ওটাই ছিল মোক্ষম নামকরণ, কারণ পরিবারের অন্য সবাই মেলকিয়াদেসের জিনিসপত্রগুলো ধুলাবালি ও ধ্বংস হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পাচ্ছে মনে করে আশ্চর্য হলেও সে মনে করত, ওটা পরিণত হয়েছে এক শুয়োরের খোঁয়াড়ে। কার কথায় যুক্তি আছে তার কোনো গুরুত্বই ছিল না কর্নেলের কাছে, সে ব্যাপারটা জানতে পারে, কারণ ফের্নান্দা মলত্যাগপাত্রগুলো রাখার জন্য সারাটা বিকেলজুড়ে বারবার ওর কর্মশালার সামনে দিয়ে গিয়ে ওকে বিরক্ত করছিল।

ওই দিনগুলোতে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোর পুনরাবির্ভাব ঘটে বাড়িতে। সে বারান্দা দিয়ে চলে যেত কাউকে কোনো অভিবাদন না জানিয়ে, আর কর্নেলের সঙ্গে আলোচনার জন্য কর্মশালায় ঢুকে দরজা বন্ধ করত। যদিও চোখে দেখতে পেত না, তবু উরসুলা বিশ্লেষণ করত সুপারভাইজারের বুটের শব্দ আর অবাক হয়ে যেত পরিবারের অন্যদের সঙ্গে ওর অমোচনীয় দূরত্ব দেখে, যেটা ওকে অন্যদের থেকে করে ফেলেছে আলাদা, এমনকি ওর যমজ ভাইয়ের থেকেও, যে ভাইয়ের সঙ্গে ছেলেবেলায় সে খেলত অন্যদের বিভ্রান্ত করার অসাধারণ সব খেলা, আর যার আজ তার সঙ্গে কোনো মিলই নেই। ও ছিল ঋজু, গম্ভীর, সব সময় যেন কিছু চিন্তা করছে। সারাসিনদের (সিরিয়া, মিসর এলাকার বেদুইন) মতো বেদনাক্লিষ্ট শরত্রঙা মুখটাতে ছিল এক বিষাদের আলোর ছটা, চেহারার মিল সবচেয়ে তার বেশি ছিল মা সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদের সঙ্গে। যদিও পরিবার প্রসঙ্গে কথা বলার সময় ওর অস্তিত্বের কথা ভুলে যাওয়ায় নিজের ওপরই রাগ হতো উরসুলার, তবু পুনরায় ওর বাড়িতে আসা ও কর্মশালায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কর্নেলকে তার উপস্থিতি মেনে নিতে দেখে উরসুলা আবার পুরোনো স্মৃতি পরখ করে, আর তার মনে বদ্ধমূল ধারণা হয় যে শৈশবের কোনো এক সময়ে ও যমজ ভাইয়ের সঙ্গে অদল-বদল হয়ে গিয়েছে, আসলে ওরই নাম হওয়া উচিত ছিল আউরেলিয়ানো, অন্যজনের নয়। ওর জীবনের বিশদ ব্যাপারগুলো বাড়ির সবারই অজানা। একসময় জানা গিয়েছিল, থাকার নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই ওর, পিলার তেরনেরার বাড়িতে লড়াইয়ে মোরগ পালন করছে, মাঝেমধ্যে রাতে সে ঘুমাতে থেকে যেত ওখানেই, তবে বেশির ভাগ রাতই কাটাত ফ্রান্সের মোহনীয় রমণীদের সঙ্গে। সেই ভালোবাসাহীন জীবনের প্রতি বেপরোয়া হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো যেন উরসুলার গ্রহমণ্ডলে এক পথভ্রষ্ট নক্ষত্র।

সত্যিকার অর্থে হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো এ পরিবারের কোনো সদস্য ছিল না সেই সুদূর ভোরে যখন কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস ওকে নিয়ে গিয়েছিল ব্যারাকে, গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দৃশ্য দেখতে নয়, বরং যেন সে দণ্ডিতের বিষণ্ন উপহাসপূর্ণ হাসিমুখ সারা জীবনের জন্য ভুলতে না পারে, তার জন্য, তখন থেকেই সে আর কোনো পরিবারেরই সদস্য হবে না। ওটা শুধু তার মনের সবচেয়ে প্রাচীন স্মৃতি নয়, একমাত্র স্মৃতি। আর এক স্মৃতি সেকেলে জ্যাকেট ও কাকের ডানার ন্যায় টুপি পরা এক প্রৌঢ়, যে আলোকিত জানালার সামনে বসে অবাক করা সব গল্প বলে যেত আর তা যে কোন যুগের, সেটা সে ঠিক করতে পারে না। সেটা ছিল এক অনিশ্চিত স্মৃতি, সম্পূর্ণরূপেই অভিজ্ঞতা বা স্মৃতিকাতরতা-বহির্ভূত মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের স্মৃতি থেকে উল্টো, কারণ মৃত্যুদণ্ডের স্মৃতিটা তার জীবনের দিক নির্ধারণ করে দিয়েছিল, যেটা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্ষণেই আরও উজ্জ্বল হতে থাকে, যেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটা আরও কাছে চলে আসছে। হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোর এই আগমনকে কাজে লাগিয়ে উরসুলা চেষ্টা করে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াকে এই আবদ্ধ অবস্থা থেকে বের করে আনতে। ‘ওকে সম্মত করার চেষ্টা করো, যাতে সিনেমায় যায়’, বলে। ‘সিনেমা ভালো না লাগলেও অন্তত একবারের জন্য হলেও বিশুদ্ধ বাতাস নিতে পারবে ফুসফুসে’, কিন্তু তার বুঝে উঠতে বেশি সময় লাগে না যে কর্নেলের মতো আর্কাদিও সেগুন্দোও কোনো অনুরোধ বা ভালোবাসার প্রতি অনুভূতিহীন। যদিও অন্য সবার মতোই উরসুলা কখনোই জানতে পারে না কর্মশালায় আবদ্ধ হয়ে এত লম্বা সময় ধরে কী আলাপ করে, কিন্তু বুঝতে পারে পরিবারে ওরা দুজনই শুধু যেন রক্তের টানে একত্র হয়।

সত্যি কথা হচ্ছে এমনকি হোসে আর্কাদিও সেগুন্দোও কর্নেলকে আবদ্ধ অবস্থা থেকে বের করে আনতে পারত না। স্কুলের ছাত্রীদের জবরদখল তার ধৈর্যের সীমাকে অতিক্রম করে গিয়েছে। রেমেদিওসের মোহনীয় পুতুলগুলো ধ্বংস করে ফেলার পরও তাদের বৈবাহিক ঘরটা মথদের দখলে চলে গিয়েছে, এই ছুতোয় সে কর্মশালায় এক দোলবিছানা টাঙায় আর এর পর থেকে শুধু পায়খানা প্রস্রাব করার প্রয়োজন ছাড়া উঠানেও পা দেয় না। উরসুলা, এমনকি মামুলি কোনো আলাপও করতে পারে না ওর সঙ্গে। সে জানত যে কর্নেল খাবারের পাত্রের দিকে অকায় না, তার বদলে ছোট একটি মাছ তৈরি শেষ না করা পর্যন্ত বেঞ্চের এক কোনায় রেখে দিত সেটা, আর স্যুপ ঠান্ডা হয়ে সর পড়লেও বা মাংস ঠান্ডা হয়ে গেলেও তার কিছু এসে যেত না। যেদিন কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস ভীমরতিপ্রসূত এক যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করে, সেদিন থেকেই সে আরও কঠোর হয়ে পড়ে। নিজেকে সে বদ্ধ করে নিজের মধ্যেই আর পরিবারের সবাই তাকে মৃত বলে ধরে নেয়। তার ভেতরে মানবিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না, যত দিন পর্যন্ত না এক অক্টোবরের এগারো তারিখে রাস্তার দরজায় বের হয় সার্কাসের লোকদের মিছিল দেখার জন্য। শেষের অন্য বছরগুলোর অভ্যেসমতোই এই দিনেও দরজায় বেরোয় সে মিছিল দেখতে। ভোর পাঁচটার সময় দেয়ালের অপর দিকে ব্যাঙের ও ঝিঁঝি পোকার ডাক তাকে জাগিয়ে তোলে। শনিবার থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ঝরে চলছিল আর বাগানের পাতাগুলোর ভেতর থেকে মৃদু ফিসফিসানি শোনার কোনো প্রয়োজন ওর ছিল না, কারণ মজ্জায় বাসা বাঁধা শীতের মধ্যেই সে সেটা অনুভব করছিল। বরাবরের মতোই ওর গায়ে ছিল পশমের চাদর। আর সুতির লম্বা জাঙ্গিয়া পরা ছিল আরামদায়ক বলে; যদিও ধুলোবালি মাখা অন্তর্বাসটা মান্ধাতা আমলের বলে সে সেটাকে বলত গথিক জাঙ্গিয়া, টাইট প্যান্ট পরেছিল সে, কিন্তু জিপার বন্ধ না করে, এমনকি সব সময়ের মতো শার্টের কলারে সোনার বোতামও লাগায় না গোসল করবে বলে। চাদরটা দিয়ে মাথা ঢাকে হুডের মতো করে, পরে তেল চোয়ানো গোঁফ আঙুল দিয়ে ঠিক করে উঠানে যায় প্রস্রাব করতে। রোদ বের হতে এত সময় নিচ্ছিল যে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া তখনো বৃষ্টিতে পচে যাওয়া তালপাতার ছাউনির নিচে ঘুমুচ্ছিল। সে তা দেখতে পায় না, কখনোই যেমন দেখে নি, এমনকি শুনতেও পায় না যখন ওর বাবার অপচ্ছায়ার জুতোয় গরম মুতের ছিটা লেগে লাফ দিয়ে হেসে উঠে অবোধ্য ভাষায় ওকে কিছু বলে। গোসলটাকে আপাতত স্থগিত করে, শীত ও স্যাঁতসেঁতে ভাবের জন্য নয়, অক্টোবরের ঘন কুয়াশার কারণে। কামারশালায় ফেরার পথে সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদের জ্বালানো তুলোর পলতের গন্ধ পায় আর রান্নাঘরে অপেক্ষা করে বলগ দেওয়া কফিভরা কাপ চিনি ছাড়া নিয়ে যাওয়ার জন্য। অন্য সব দিনের মতোই সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ প্রশ্ন করে সেদিন সপ্তাহের কী বার আর সে জবাব দেয় মঙ্গলবার, এগারোই অক্টোবর। আগুনের আভায় সোনালি মেয়েটাকে দেখতে দেখতে সে ভাবে যে মেয়েটার অস্তিত্ব তখন কেন, জীবনের অন্য কোনো সময়ই তার সম্পূর্ণ অস্তিত্ব ছিল না আর ভাবতে ভাবতে তার মনে পড়ে যায় যে ঘোর যুদ্ধের সময় এক এগারোই অক্টোবরে, সে এক নির্দয় নিশ্চয়তা নিয়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠে, যে মেয়েটার সঙ্গে ঘুমিয়েছিল, সে মারা গেছে। সত্যিই মারা গিয়েছিল মেয়েটা, আর দিনটির কথা কখনোই সে ভোলে নি কারণ তার এক ঘণ্টা আগে মেয়েটি জিজ্ঞেস করেছিল সেদিন কয় তারিখ। এই স্মৃতি জেগে ওঠার পরও তার পূর্ববোধগুলো তাকে কতটা ত্যাগ করেছে, তা বিশ্লেষণ করার ইচ্ছা তার হয় না, আর যতক্ষণ কফি গরম হচ্ছিল, ততক্ষণ সে ভাবছিল শুধু কৌতূহলবশত কোনো রকম স্মৃতিকাতরতার সূক্ষ্মতম ঝুঁকি ছাড়াই, ভাবছিল সে সেই রমণীর কথা, যার নাম সে কখনোই জানে নি, আর যার মুখও জীবিতাবস্থায় সে কখনোই দেখে নি, কারণ অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে সে তার দোলবিছানার কাছে পৌঁছেছিল। তা সত্ত্বেও তার জীবনে একইভাবে আসা অসংখ্য রমণীর শূন্যতার মাঝে তার মনে পড়ে না যে এই মেয়েটিই প্রথম সান্নিধ্যের উন্মত্ততার মাঝে যখন নিজের চোখের জলে ডুবে খাবি খাচ্ছিল তখন, মৃত্যুর এক ঘণ্টা আগে, দিব্যি দেয় তাকে আমরণ ভালোবাসার। সে আর ওর কথা ভাবে না, এমনকি অন্য কোনো মেয়ের কথাও নয়, যখন ধূমায়িত কাপ নিয়ে কামারশালায় ঢোকে, বাতি জ্বালায় টিনের পাত্রের মধ্যে রাখা ছোট ছোট সোনার মাছগুলো গোনার জন্য। সতেরোটি ছিল, যখন থেকে বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন থেকেই দিনে দুটি করে মাছ বানাতে থাকে আর পঁচিশটি হয়ে গেলে গলন পাত্রে ঢুকিয়ে ওগুলোকে গলিয়ে ফের বানাতে শুরু করে। সারা সকাল কাজ করে নিমগ্ন হয়ে, কোনো কিছুই চিন্তা না করে, টের না পেয়ে যে বেলা দশটার সময় বৃষ্টির তোড় বেড়ে যায় আর কেউ তার কামারশালার সামনে দিয়ে যেতে যেতে চিৎকার করে দরজাগুলো বন্ধ করতে বলে, যাতে বৃষ্টির পানি ঢুকে বাড়ি না ডুবিয়ে দেয়; এমনকি টেরও পায় না কখন উরসুলা দুপুরের খাবার ঘরে ঢুকে আলো নিভিয়ে দেয়।

‘কী বৃষ্টি’, বলে উরসুলা।

‘অক্টোবর’, বলে সে।

বলার সময় দিনের প্রথম মাছটি থেকে দৃষ্টি সরায় না, কারণ সে মাছের চোখগুলোতে রুবি বসাচ্ছিল। শেষ করার পরই শুধু মাছটাকে পাত্রের অন্যগুলোর সঙ্গে রেখে স্যুপ পান করতে আরম্ভ করে। পরে সে খাবার খায়, খুবই ধীরে ধীরে, খাবারটা ছিল পেঁয়াজ দিয়ে রান্না করা মাংসের টুকরো, সঙ্গে সাদা ভাত ও কলাভাজি-সবই পরিবেশন করা ছিল একই পাত্রে। সুসময় বা দুঃসময় কখনোই ওর ক্ষুধার কোনো পরিবর্তন ঘটত না। খাবার শেষ করার পর সে আলস্যজনিত উদ্বেগ অনুভব করে। কোনো এক ধরনের বৈজ্ঞানিক কুসংস্কারবশত হজম করার প্রথম দুঘণ্টা সে কোনো কাজ করত না, কোনো বই পড়ত না বা গোসল করত না, এমনকি সহবাসও করত না, আর এটা এমনই এক গভীর বিশ্বাস ছিল যে অনেকবারই সৈন্যরা যাতে বদহজমের শিকার না হয়, তার জন্য সামরিক অপারেশন পিছিয়ে দিয়েছে। কাজেই সে দোলবিছানায় শুয়ে ছোট ছুরি দিয়ে কানের ময়লা বের করতে থাকে আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে। স্বপ্ন দেখে এক সাদা দেয়ালের খালি বাড়িতে ঢুকছে আর সেখানে প্রথম মানব হিসেবে ঢোকার কারণে সে বিষণ্ণ বোধ করে। স্বপ্নের মধ্যেই তার মনে পড়ে যে একই স্বপ্ন সে আগের রাতেও দেখেছে। বিগত বছরগুলোর অনেক রাতের মতোই আর জানতে পারে যে জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই এই স্বপ্ন তার স্মৃতি থেকে মুছে যাবে, কারণ এই পৌনঃপুনিক স্বপ্নের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বপ্নের মধ্যে ছাড়া সেটাকে অন্য কোনো সময় মনে করতে পারা যাবে না। সত্যিই কিছুক্ষণ পর যখন নাপিত এসে কামারশালার দরজা থেকে ডাক দেয়, তখন কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া অনিচ্ছা সত্ত্বেও অল্প কয়েক মুহূর্ত ঘুমিয়ে পড়ার অনুভূতি নিয়ে জেগে ওঠে আর মনে হয় স্বপ্ন দেখার মতো কোনো সময় পায় নি ঘুমের সময়। ‘আজকে নয়’, বলে নাপিতকে, ‘শুক্রবারে দেখা হচ্ছে।’

গালে তখন তার তিন দিনের দাড়ি ছিল, সাদা ছোপ ছিল তাতে, কিন্তু চুল কাটার সময় একই সঙ্গে দাড়ি কামানোর প্রয়োজন মনে করে না সে। বগলতলায় গলদ্রিনার ক্ষতগুলোতে অনাকাঙ্ক্ষিত সিয়েস্তার (দুপুরের ঘুম) চটচটে ঘাম জেগে ওঠে। বৃষ্টি পরিষ্কার হয়ে এলেও সূর্য দেখা যায় না। কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া টাকরায় স্যুপ খাওয়ার টক স্বাদ নিয়ে সশব্দ ঢেকুর তোলে। আর সেটা তার দেহে হুকুমের মতো কাজ করায় কাঁধে চাদর ফেলে পায়খানায় যায় সে। প্রয়োজনের চেয়েও বেশি সময় কাটায় সে ওখানে, যেখানে কাঠের বাক্সটাতে ঘন গাঁজানোর কাজ চলছিল আর বেরিয়ে আসছিল গাঁজলা। তার ওপর আসনপিঁড়ি অবস্থায় বসে থাকে যতক্ষণ না অভ্যেস তাকে আবার কাজ শুরু করার সময় বলে দেয়। অপেক্ষার সময়টাতে মনে পড়ে সেদিন ছিল মঙ্গলবার, আর হোসে আর্কাদিও সেগুন্দো কর্মশালায় আসে নি, কারণ মঙ্গলবার হচ্ছে কলা কোম্পানির বেতন দেওয়ার দিন। বিগত কয়েক বছরের মতোই এই স্মৃতি তাকে নিয়ে যায় যুদ্ধের স্মৃতিতে নিজের অজান্তেই। মনে পড়ে কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস কথা দিয়েছিল কপালে সাদা তারাওয়ালা এক ঘোড়া জোগাড় করে দেওয়ার, কিন্তু এ সম্বন্ধে দ্বিতীয়বার আর কিছু বলে নি সে, পরে বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনার দিকে নিয়ে যায় তার স্মৃতি। কিন্তু সেগুলো সে স্মরণ করে কোনো রকমের কোনো বিশ্লেষণ ছাড়াই, কারণ অন্য কিছু চিন্তা করার অপারগতার ফলে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে শিখেছে সে, যাতে করে অনিবার্য স্মৃতিগুলো যেন তার অনুভূতির কোনো ক্ষতি না করতে পারে। কর্মশালায় ফিরে আসার পর আবহাওয়া শুকিয়ে আসছে দেখে মনে হয় এটাই গোসল করার উত্তম সময়; কিন্তু তার আগেই আমারান্তা গোসল আরম্ভ করে দিয়েছে। ফলে আরম্ভ করে দেয় দিনের দ্বিতীয় সোনার মাছ তৈরির। লেজটা বসানোর সময় রৌদ্র ওঠে এমন তেজ নিয়ে যে ইয়টের মতো ক্যাঁচকেঁচিয়ে ওঠে আলো। তিন দিনের গুঁড়ি বৃষ্টিতে ধোয়া বাতাস ভরে যায় উড়ন্ত পিপীলিকায়। তখনই টের পায় পেশাবের বেগ, আর যেটাকে সে আটকে রাখছিল দ্বিতীয় মাছটা বানানোর জন্য। বেলা চারটে দশে উঠানের দিকে যাচ্ছিল যখন কানে আসে দূর থেকে ভেসে আসা কাঁসা আর ড্রামের শব্দ, শিশুর দলের কোলাহল, আর যৌবনের পর এই প্রথমবারের মতো জেনেশুনে পা দেয় স্মৃতিকাতরতার ফাঁদে আর জাগিয়ে তোলে জিপসিদের সেই বিস্ময়কর বিকেলটিকে, যেদিন ওর বাবা ওকে বরফ চেনাতে নিয়ে গিয়েছিল। রান্নাঘর থেকে রান্না ফেলে সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদ দরজার দিকে দৌড় লাগায়।

‘সার্কাস এসেছে’, চিৎকার করে।

চেস্টনাটের দিকে যাওয়ার বদলে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়াও রাস্তার দরজার দিকে গিয়ে মিশে যায় শোভাযাত্রা দেখতে আসা কৌতূহলী লোকদের সঙ্গে। দেখতে পায় হাতির পিঠে বসে থাকা সোনালি পোশাক পরা এক মেয়েকে, দেখে বিষণ্ণ এক উট। দেখে ওলন্দাজ মেয়ে পোশাক পরা ভালুককে বড় এক চামচ ও কড়াই দিয়ে বাজনার তাল দিতে, শোভাযাত্রার লেজের দিকে ভাঁড়কে ডিগবাজি খেতে আর সবাই চলে যাওয়ার পর পুনরায় দেখতে পায় নিজের নিঃসঙ্গতার করুণ চেহারা আর তখন রাস্তায় আলোকিত শূন্যতা ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। বাতাস ভরে ওঠে উড়ন্ত পিপীলিকায় আর শুধু থাকে গভীর অনিশ্চয়তার চূড়া থেকে উঁকি দেওয়া কিছু কৌতূহলী লোক। তখন সার্কাসের কথা চিন্তা করতে করতে যায় চেস্টনাটের নিচে, আর যতক্ষণ পেশাব করে, চিন্তা করার চেষ্টা করে সার্কাসের, কিন্তু স্মৃতিটাকে সে আর খুঁজে পায় না। মুরগির ছানার মতো ঘাড়ের মধ্যে গুঁজে দেয় মাথাটাকে আর চেস্টনাটের গুঁড়িতে কপাল ঠেস দিয়ে পড়ে থাকে নিশ্চল। পরদিন, সকাল এগারোটার সময়, বাড়ির পেছনে ময়লা ফেলার সময় সান্তা সোফিয়া দে লা পিয়েদাদের মনোযোগ কাড়ে শকুনের দল আর ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবারের কেউই খবরটা জানতে পারে নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *