৮
নির্মল পালিত বাবার কাছেই বৈষয়িক শিক্ষা পেয়েছে। একদিন কলকাতার ধর্মাধিকরণে যে নতুন শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর আমদানি হয়েছিল অষ্টাদশ শতকের শেষে, নির্মল পালিত তাদেরই বংশধর। নির্মল পালিতরা জানে প্রপার্টি যার আছে, তাকে খাতির করতে হয়। প্রপার্টিহীন মানুষ আর প্রাণহীন মানুষে কোনও তফাৎ নেই তাদের কাছে। প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের ঘোষ-বংশ এমনি একটা পরিবার। বিশেষ করে এ-পরিবারের মালিক মেয়েমানুষ। মেয়েমানুষের প্রপার্টি থাকলে নির্মল পালিতরা তাদের কাছে গিয়ে জোটে। তাদের পরামর্শ দেয়, উপদেশ দেয়। তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠে।—
নির্মল পালিতই মা-মণিকে বলেছিল—এটা আপনার ভুল হলো মা-মণি—একেই বলে ব্লান্ডার—
মা-মণি বুঝতে পারলেন না। বলেছিলেন—কেন বাবা? কী ভুল করলাম—
নির্মল পালিত বলেছিল—আপনার পুত্রবধূও তো একটা প্রপার্টি—
—তার মানে?
—মানে, বাবা তো সব দিক কনসিডার করেই এমন সম্বন্ধ করেছিলেন। বাবা তো আপনার ভালর জন্যেই এমন পুত্রবধূ এনে দিয়েছিলেন। দেখুন না, এ-প্রপার্টির জন্যে আপনাকে ক্যাপিটাল ঢালতে হলো না, ইনভেস্টমেন্ট করতে হলো না, অথচ সমস্ত বেনিফিট পেয়ে গেলেন—মানে সমস্ত প্রফিট প্লাস ক্যাপিটাল পেয়ে গেলেন। বলতে গেলে সেন্ট্-পারসেন্ট লাভ—
মা-মণি বললেন—কিন্তু আমার সোনা? তার পেছনেও তো আমার খরচ হয়েছে। তার খাওয়া-দাওয়া, তার লেখা-পড়ার জন্যে তো আমার খরচ হয়েছে প্রচুর
নির্মল পালিত উত্তরে বলেছিল—কিন্তু তার ডবল তো আপনি উশুল করে নিয়েছেন ছেলের বিয়ে দিয়ে—
মা-মণি বলেছিলেন—কী যে বলো বাবা, তোমার বাবার জন্যে আমি যা ঠকেছি, কী আর বলবো। ভেবে এখনও আঙুল কামড়াই—
এমনি করেই প্রতিদিন বৈষয়িক-সূত্রে কথা হয়েছে সনাতনবাবুর স্ত্রীকে নিয়ে। পুত্রবধূকে নিয়ে যে মা-মণির কী রকম জ্বালা তা নির্মল পালিত আগে থেকেই জানতো। কিন্তু সেদিন ঘটনাটা স্বচক্ষে দেখলে সে। স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করলে। নির্মল পালিত বুঝলে এই ঘোষ-বংশের রন্ধ্রের মধ্যে যদি শনি হয়ে সে ঢুকতে চায় তো এই তার ছিদ্র। এই ছিদ্র দিয়েই তাকে নাক গলাতে হবে এ-সংসারে!
সেদিন যখন দীপঙ্কর চলে এল, যখন লক্ষ্মীদিও চলে এল, নির্মল পালিত তখনও দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে। চাকর-বাকর-ঝি-ঠাকুর-দরোয়ান, সবাই যখন দেখছে তারই বা দেখতে দোষ কী! কেমন যেন একটা নিষ্ঠুর আনন্দ পাচ্ছিল নির্মল। কিন্তু হঠাৎ সেখানে দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে তার মনে হলো সনাতনবাবুর স্ত্রী যেন থরথর করে কাঁপছে। ফরসা টকটকে রং। রোদের আভা লেগে আর লজ্জা আর অপমানের হতাশায় সমস্ত শরীরটা যেন আগুন হয়ে উঠেছে।
নির্মল আর দাঁড়াতে পারলো না সেখানে! আস্তে আস্তে নিজের ঘরে এসে আবার নিজের চেয়ারটায় বসলো।
বাইরে মা-মণির গলা শোনা গেল—দারোয়ান—
দারোয়ানের গলার আওয়াজ এল—হুজুর—
—তুমি এইখানে পাহারা দাও, যদি বৌদি একটু নড়ে তো আমায় খবর দেবে, আমি ব্যারিস্টারবাবুর সঙ্গে কথা বলছি—
বলে মা-মণি আবার ঘরে এসে ঢুকলেন। ঢুকে নিজের চেয়ারে বসলেন। তাঁর চেহারায় যেন কোনও বিকার নেই, কোনও বৈলক্ষণ্য নেই। তিনি নির্বিকার শান্ত। বললেন—দেখলে তো, তুমি নিজের চোখেই তো সব দেখলে বাবা—
নির্মল পালিতের মুখ দিয়ে কিছু কথা বেরোল না।
মা-মণি বলতে লাগলেন—তোমার বাবাই হলেন এর মূল। তিনি ভালো করে না- দেখে-শুনে কেন এমন সম্বন্ধ করলেন বলো তো? কেন আমার এই সর্বনাশটা করলেন? আমি কি ক্ষতি করেছিলুম তাঁর?
নির্মল পালিত তবু কোনও উত্তর দিলে না।
মা-মণি বলতে লাগলেন—আমার নিজের মেয়ে হয়নি, আমি ভেবেছিলাম ছেলের বিয়ে দিয়ে আমি মেয়ে পাবো। আমার বড় সাধ ছিল জানো? আমি এক-ছেলের পর বিধবা হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম ওই এক ছেলেই আমার ঘর ভরিয়ে তুলবে। আমার ভাবনা কী? আমার টাকার অভাব নেই, আমার কিছুরই অভাব নেই সংসারে। স্বামী যদি না-ই থাকে, ছেলে তো আছে! ছেলেই আমার সব দুঃখ ঘোচাবে! পাঁচটা নয়, দশটা নয়, একটা ছেলে—সেই একটা ছেলেই আমায় যে এমন করে জ্বালাবে কে জানতো?
নির্মল এবারও কোনও কথা বললে না।
মা-মণি আবার বলতে লাগলেন—কে জানতো সেই এই এক ছেলের বিয়ে দিয়েই আমি আষ্টে-পৃষ্ঠে জ্বলে পুড়ে মরবো! রাত্রে আমার ঘুম হয় না জানো বাবা! তোমাকে সব কথাই আমি খুলে বলছি। এই বউ আসার পর থেকে আমার মনে একতিল শান্তি নেই! তুমি বলো কী? আমার নিজের পেটের ছেলে, যে- ছেলেকে আমি এই এতটুকু বেলা থেকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছি, তার গায়ে কোনওদিন একটু আঁচ লাগতে দিইনি, সেই ছেলেকেও কি না দেখতে পারে না আমার বউ? সে কী দোষ করলে বলো তো! সে এমন কী দোষ করলে সে তার সঙ্গে এক ঘরে এক বিছানায় পর্যন্ত শোবে না—
নির্মল বলে—সে কী? বউ স্বামীর কাছে শোয় না?
—তবে আর বলছি কী বাবা! আমার এ-দুঃখের কথা কার কাছেই বা বলি, আর কে-ই বা বিশ্বাস করবে? মা হয়ে দিনের পর দিন আমাকে এই সহ্য করতে হয়েছে।
বলতে বলতে মা-মণির বোধ হয় গলাটা বুজে আসবার যোগাড় হয়। বলেন—তুমি তো আমাকে এতদিন দেখছো বাবা, আমাকে এমন করে কখনও কথা বলতে শুনেছো? কাউকে কষ্ট দিলে আমার মনে যে কী কষ্ট হয় বাবা, সে কী বলবো!
নির্মল পালিত বললে—কিন্তু আপনি আর কী করবেন! আপনাকে সবই সহ্য করতে হবে!
মা-মণি বললেন—কেন বাবা? আমি কী এমন দোষ করেছি যে আমাকে সব মুখ বুজে সহ্য করতে হবে?
—তা সহ্য না করলে তো আপনারই লস্
—কেন?
—লস্ নয়? এত টাকা আপনার বউএর, সে-টাকার জন্যে অন্তত আপনাকে সহ্য করতে হবে।
—তুমি কি ভাবছো আমি টাকার পরোয়া করি বাবা? তুমি কি ভাবছো আমি বৌমার টাকা নিয়ে বড়লোক হবো! তেমন বংশে আমার জন্ম নয় বাবা, তেমন টাকার আমার দরকার নেই! আমি উপোস করবো তাও ভালো, তবু সে-টাকায় আমার দরকার নেই—
হঠাৎ কথায় ছেদ পড়লো।
—মা!
সনাতনবাবু শশব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকেছেন। ছেলের মুখের চেহারা দেখে মা অবাক হয়ে গেলেন। এমন উত্তেজিত তো হয় না কখনও খোকা। বললেন—কী বাবা?
—মা, তোমার বৌমা পড়ে যাবে!
—পড়ে যাবে?
সনাতনবাবু বললেন—হ্যাঁ পড়ে যাবে, থর থর করে কাঁপছে! ঘরে গিয়ে শুতে বলবো?
মা-মণি বললেন—না!
সনাতনবাবু বললেন—কিন্তু যদি একটা অসুখ-বিসুখ হয়ে যায় তখন? গায়ে হাত দিয়ে দেখলুম জ্বর এসেছে।
মা-মণি বললেন—তোমাকে ও-সব কথা ভাবতে হবে না, যা-ভাববার আমি ভাববো—তুমি কেন গায়ে হাত দিতে গেলে আমাকে না বলে?
—কিন্তু জ্বর হলে যে কষ্ট হবে খুব?
মা-মণি বলেন—তুমি থামো দিকিনি! সব-কথায় তোমার থাকবার দরকার কী?
কিন্তু সনাতনবাবু সেদিন থামলেন না। অনেক থেমে এসেছেন তিনি। অনেক সহ্য করে এসেছেন। বললেন—কিন্তু এ-রকম অত্যাচার করা কি তোমার ভাল? কাউকে কষ্ট দেওয়া কি উচিত? তাতে কি ভাল হয় কখনও?
মা-মণি বিরক্ত হলেন এবার। বললেন—তুমি আবার কথা বলছো?
সনাতনবাবুকে মা’র সঙ্গে এমন করে কথা বলতে নির্মল পালিত দেখেনি। বাড়ির কেউই দেখেনি। দারোয়ান চাকর ঝি ড্রাইভার কেউই এই ধীর-স্থির মানুষটাকে এমন উত্তেজিত হতে দেখেনি কখনও। সনাতনবাবু যেন উত্তেজিত হয়ে কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। খানিক থেমে বললেন—তুমি ওকে ঘরে গিয়ে শুতে বলো!
—কী বললে?
সনাতনবাবু আবার স্পষ্ট করে বললেন—তুমি ওকে কেন মাথায় জুতো নিতে বললে? কী করেছে ও?
মা-মণি বললেন—তুমি জানো না কী করেছে?
সনাতনবাবু বললেন-না, আমি জানি না—
—না জানো তো তুমি তোমার নিজের ঘরে গিয়ে বই নিয়ে পড়ো গে! তোমার জানবার দরকার নেই। সংসারের ব্যাপারে তোমায় মাথা ঘামাতে হবে না আমি বার বার বলেছি না তোমায়? মেয়েদের ব্যাপারে তুমি কখনও থাকবে না!
সনাতনবাবু বললেন—তা তুমিই তো ডাকলে আমাকে, আমি তো ঘরে বসে পড়ছিলুম—
মা-মণি বললেন—তোমায় আমিই তখন ডেকেছিলুম, এখন আমিই আবার যেতে বলছি—তুমি যাও এখান থেকে—
—কিন্তু তোমার বৌমার কী হবে? ও কি সারাদিন এমনি করে দাঁড়িয়ে থাকবে?
মা-মণি বললেন—হ্যাঁ থাকবে—
সনাতনবাবু বললেন—না, থাকবে না—
নির্মল পালিত এবার উঠে দাঁড়াল। এর পর তার আর নিষ্ক্রিয় থাকা চলে না। বললে —মিস্টার ঘোষ, আপনি থামুন, মাদারের ওপর কথা বলতে নেই।
মা-মণি বললেন—দেখলে তো বাবা, দেখলে তো তুমি, নিজের পেটের ছেলে আমার সঙ্গে কী রকম করে কথা বললে!
নির্মল পালিত বললে—আপনি দুঃখ করবেন না মা-মণি, মিস্টার ঘোষ একটু উত্তেজিত হয়ে গেছেন, হাজার হোক, নিজের ওয়াইফ্ তো!
সনাতনবাবু বললেন—আপনি আমাদের মধ্যে কথা বলতে আসছেন কেন? আপনি কেন ইন্টারফিয়ার করছেন আমাদের ব্যাপারে? আপনি কে? শুধু ওয়াইফ্ বলে নয়, কারোর ওপরেই টরচার করা উচিত নয় সংসারে। এও তো টরচার এক-রকম! মা তো বকতে পারতো, দরজা বন্ধ করে বন্দী করে রাখতে পারতো, আমি কিছু বলতুম না, কিন্তু এ তো আউটরেজ—আমি এর প্রতিবাদ করছি—
নির্মল পালিত বললে—আপনি এক্সাইটেড হয়ে উঠেছেন মিস্টার ঘোষ, আপনি মাথাটা একটু ঠান্ডা করুন—
সনাতনবাবু তখন থর থর করে কাঁপছেন। তাঁর ফরসা চেহারা লাল টকটকে হয়ে উঠেছে। তিনি কখনও যা করেন নি হঠাৎ তাই করলেন—বললেন—শাট্ আপ্—
—খোকা!
মা-মণির গলার আওয়াজও সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ ফেটে পড়লো। বললেন—তুমি কার সঙ্গে কী-কথা বলতে হয় জানো না—
সনাতনবাবু বললেন-আমি যার সঙ্গে কথা বলছি ভেবে-চিন্তেই বলছি—
তারপর হঠাৎ বাইরের দিকে মুখ ফিরিয়ে ডাকলেন—দারোয়ান
বাড়িসুদ্ধ লোক হতভম্ব হয়ে গেল এই মানুষটির ব্যবহারে। মা-মণিও সনাতনবাবুর মুখের দিকে চেয়ে নিজের ছেলেকে যেন চিনতে পারলেন না। যেন এক নিমেষে তাঁর সমস্ত হিসেব, সমস্ত অঙ্ক গোলমাল হয়ে গেল। এতদিন নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে যে-সংসার নিখুঁতভাবে চালিয়ে এসেছিলেন আজ এতদিন পরে এখানে এসে সব যেন গন্ডগোল হয়ে গেল। শিরীষ ঘোষের কুললক্ষ্মী তিনি। তাঁর একটা দায়িত্ব আছে। এ-সংসারের সুনাম- দুর্নামে তাঁরও একটা বিরাট অংশ আছে। বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের শেষ অঙ্কে এসে তাঁর এতদিনকার নিয়মনিষ্ঠা সব যেন জলে চলে গেল। তিনি কিছুক্ষণ কোনও কথা বলতে পারলেন না।
সমস্ত বাড়িতে তখন সাড়া পড়ে গেছে। যারা উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিল, তারাও এই কান্ড দেখে আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। বাতাসীর মা, শম্ভু, দারোয়ান, ড্রাইভার, কৈলাস তারাও যেন ভয়ে আঁতকে উঠেছে।
সনাতনবাবু আবার ডাকলেন—দারোয়ান —
মা-মণি একবারে কাছে এলেন। বললেন—দারোয়ানকে ডাকছো কেন?
দারোয়ানও সেই সময়ে কাছে এসে দাঁড়াল।—হুজুর!
সমস্ত আবহাওয়াটা যেন থম্থম্ করছে তখন।
মা-মণি বললেন-দারোয়ান, তোমাকে আমি যা করতে বলেছি তাই করো—কারো হুকুম শুনতে হবে না—
সনাতনবাবু কী করতেন বলা যায় না, ততক্ষণে ওদিকে আর এক কাণ্ড ঘটে গেল।
—ইস—স্-স্—
সকলের মুখ দিয়ে একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে নিঃশব্দে হাওয়ায় ভেসে গেল। সতী সেই মার্বেল পাথরের মেঝের ওপর অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়লো হঠাৎ।
.
—তারপর?
নির্মল পালিত একটা সিগারেট ধরালো। নির্মল পালিতের বাবার অফিস ঘরেই নির্মল পালিতের অফিস। নির্মল পালিতের কুকুরটা বাইরের বারান্দায় এতক্ষণ স্থির হয়ে চোখ বুজে পড়েছিল। হঠাৎ সতীর দেহ লুটিয়ে পড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সে-ও যেন একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলো।
দীপঙ্কর উদ্গ্রীব হয়ে শুনছিল। বললে—তারপর?
নির্মল বললে—কিন্তু তোর এত আগ্রহ কেন ওবাড়ির ব্যাপারে? তুই কেন ইন্টারেস্টেড?
দীপঙ্কর বললে— সে-কথা পরে বলবো, তারপরে কী হলো, বলো?
নির্মল পালিত বললে—তারপর আর কী হবে, আমি চলে এলুম-
দীপঙ্করের মনে হলো এখনি যেন সে ছুটে চলে যায় প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে! এখনি যেন সে গিয়ে সনাতনবাবুর সঙ্গে দেখা করে।
—বাবা এসেছে কিনা জানো?
—কার বাবা?
—সতীর বাবা। মিসেস্ ঘোষের বাবা। তাঁকে আমি টেলিগ্রাম করে দিয়েছি, সেইদিনই।
নির্মল বললে—তুই কেন টেলিগ্রাম করতে গেলি? মিসেস্ ঘোষ তোর কে?
দীপঙ্করের তখন আর দেরি সইছে না। বললে—ভুবনেশ্বরবাবু এসেছেন কি না তাই আগে তুমি বলো?
নির্মল বললে—মিস্টার মিত্রকে তুই চিনিস? খুব রীচ্, না? কীসের ব্যবসা রে! শুনেছি নাকি টিম্বার মার্চেন্ট? আচ্ছা, এত প্রপার্টি তাঁর কে খাবে বল্ তো? মেয়ে তো ওই একটা? না দুটো? নো সন্! তাহলে? তাহলে তো প্রপার্টি পাবে ওই বুড়ী! নয়নরঞ্জিনী দাসী!
দীপঙ্কর তখন অন্য কথা ভাবছে। কী আশ্চর্য! সেই দিন এত কান্ড ঘটে গেছে ও- বাড়িতে। এতদিন মাথায় আসেনি বলেই নির্মলের কাছে আসা হয়নি। নির্মল পালিতের কাছে আর কিছুদিন আগে এলেই সব জানা যেত। অন্তত জানলে কিছু প্রতিকার করবার চেষ্টাও করতো।
নির্মল পালিত বলতে লাগলো—আমি বার বার বললাম বুড়ীকে যে দিস্ ইজ্ রং। এভাবে নিজের ছেলের বউকে অত্যাচার করা অন্যায়। বিশেষ করে যখন মেয়ের বাপ অত রীচ্। বড়লোকের মেয়ে। গরিব হলে আমি কিছু বলতাম না। তাকে তুমি মেরে ফেল কেটে ফেল আমি কিছু বলতে যেতাম না। কিন্তু এর পর যদি ছেলের শ্বশুর লিগ্যাল স্টেপ্ নেয়, তখন?
—দীপঙ্কর বললে—কিছু লিগ্যাল স্টেপ্ নেওয়া যায়?
—আলবাৎ নেওয়া যায়! হিন্দু ম্যারেজ য়্যাক্টে তার প্রভিসনস্ আছে!
—কে মামলা করবে?
নির্মল পালিত বললে—কেন, মেয়ের বাবা করবে। আমি ব্রী নিতে রাজী আছি। আমি তো বুড়ীকে তাই বুঝিয়ে এলাম। শেষকালে আপনি দুকূল হারাবেন। আপনার বউকেও হারাবেন, আর বউএর প্রপার্টি হারাবেন! মেয়েমানুষের বুদ্ধি তো! ভাবছে এই করেই বুঝি ছেলের শ্বশুরের কাছ থেকে কিছু আদায় করতে পারবে! তা যদি পারতো তো আমরা আছি কী করতে? ঘাস কাটতে? একটা চাইনিজ্ প্রোভার্ব আছে—Going to law is losing a cow for the sake of a cat—কিন্তু এ-কথাটা কে বুঝবে বল্?
দীপঙ্কর বললে-আচ্ছা আমি এখন উঠি—
—কোথায় যাবি? অফিসে?
সে-কথার উত্তর না দিয়ে দীপঙ্কর বললে—আমি আবার একদিন আসবো তোমার কাছে। যদি কোনও খবর থাকে তো আমাকে শুনিও।
—কীসের খবর?
দীপঙ্কর বললে—ওই প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়ির খবর। ও-বাড়িতে তুমি রোজই যাও?
নির্মল পালিত বললে—রোজ নয়, তবে প্রায়ই যাই। যাই আমার নিজের ইন্টারেস্টে! অনেকগুলো টাকা আইড্ল্ পড়ে আছে বুড়ীর হাতে। কিছু ক্যালকাটা-প্রপার্টি কিনিয়েছি। কিন্তু বুড়ী ভাড়াটেদের নিয়ে ঝঞ্ঝাটে পড়েছে বড়। বলছে বাড়িগুলো বেচে লিকুইড্ ক্যাশ করে ফেলবে। তা আমি ভেবেছি কিছু শেয়ার কেনাবো বুড়ীকে দিয়ে। বলেছি, এতে কোনও ঝঞ্ঝাট নেই, বসে বসে ডিভিডেন্ড খাবেন—তা নিমরাজি করিয়েছি কোনও রকমে-—
দীপঙ্কর আবার বললে—তারপর আর যাওনি ওদের বাড়িতে! শোননি কিছু ও- সম্বন্ধে?
নির্মল পালিত বললে—শুনেছি বৈ কি! এই তো আজকেই গিয়েছিলাম। শুনলাম সনাতনবাবুর খুব অসুখ—
—সনাতনবাবুর অসুখ?
দীপঙ্কর যেন আকাশ থেকে পড়লো। বললে—কেন, হঠাৎ অসুখ হলো কেন?
নির্মল পালিত বললে—কেন আবার? ওই ব্যাপারের পর মনে তো শান্তি নেই ফ্যামিলিতে। বুড়ীটাও যেন কেমন হয়ে গেছে। অনেকগুলো শেয়ারের প্রপোজাল্ নিয়ে গিয়েছিলুম, কিন্তু কিছু কথা হলো না। বুড়ীর মন ভাল নেই। নাকি ছেলের খুব জ্বর! শুধু গল্প করে তো আর সময় কাটানো যায় না। তাড়াতাড়ি চেম্বার থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, বুড়ীর কিছু খসাবো, তা হলো না। শেষকালে চলে এলাম।
—আর সতী? সনাতনবাবুর স্ত্রী! সে কোথায়?
হঠাৎ টেবিলের ওপর টেলিফোনটা বেজে উঠলো। নির্মল পালিত রিসিভারটা তুলে নিলে।
দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি রাস্তায় এসে গাড়িতে উঠলো। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আপিসে ফিরে যেতে হবে। মিস্টার ঘোষাল অপেক্ষা করবে তার জন্যে। গাড়িতে উঠেই বললে—প্রিয়নাথ মল্লিক রোড—
গাড়িটা আবার ঘুরলো। বিকেল হয়ে এসেছে হাজরা রোডের মোড়ে। সকাল-সকাল আজকাল সবাই বাড়ি ফেরে। ব্ল্যাক-আউট্-এর রাত কলকাতার। সন্ধ্যের কলকাতার চেহারা একেবারে বদলে গেছে। যে ভিড় নেই। রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায় রাত বাড়বার আগেই। গাড়িটা হাজরা রোড় দিয়ে বাঁ দিকে ঘুরলো। সনাতনবাবুর অসুখ। একবার গিয়ে দেখে আসবে। নির্মল বলেছে—বড় অশান্তিতে কাটছে ওদের। মনে শান্তি নেই। অথচ শান্তির জন্যে যা-যা দরকার পৃথিবীতে সবই তো আছে। অর্থ আছে, স্বাস্থ্য আছে, গাড়ি, বাড়ি, বংশমর্যাদা, সবই তো আছে ওদের। সতীর শাশুড়ীও যেন কেমন হয়ে গেছে। সনাতনবাবুর অসুখ। হয়ত সতী সেবা করছে প্রাণপণে! এই সময়ে যদি ভুবনেশ্বরবাবু এসে পড়েন!
গাড়িটা যাবার আগেই দীপঙ্কর প্রশ্নগুলো মনে মনে ভেবে নিলে। হয়ত মুখোমুখি সতীর শাশুড়ীর সঙ্গেই প্রথমেই দেখা করতে হবে। প্রথমে দেখা হবার সঙ্গে সঙ্গে পায়ের ধুলো নিতে হবে। জিজ্ঞেস করতে হবে—কেমন আছেন? সনাতনবাবুর অসুখ শুনলাম, তিনিই বা কেমন আছেন? তারপর সতীর কথা। সতী তো প্রায়শ্চিত্ত করেছে, সতী তো সব শাস্তি মাথা পেতে নিয়েছে। যেমন শাস্তি দিয়েছে, সেই শাস্তিই মুখ বুজে স্বীকার করেছে। এবার তো আর কোন অভিযোগ নেই! এবার তো আর কোনও অপরাধ নেই।
—দাদাবাবু!
শম্ভু পেছন থেকে ডাকলে হঠাৎ। চেনা গলা। দীপঙ্কর পেছন ফিরে দেখলে। গাড়িটা থামাতে বললে ড্রাইভারকে।
—আমি তো আপনার বাড়ি থেকেই আসছি। একজন বুড়োমতন লোক বললে আপনি একটু আগেই বেরিয়ে গেছেন। এদিকে সব্বনাশ হয়ে গেছে দাদাবাবু, বৌদিমণি নেই।
—সে কী? কবে? কখন?
শম্ভু হাঁফাচ্ছিল। বললে—ভাবলাম আপনার বাড়িতে গেছে। কিন্তু শুনলাম সেখানেও নেই। এদিকে খবরটা জানার পর থেকেই বাড়িতে বড় অশান্তি হয়েছে। দাদাবাবুর সঙ্গে মা-মণির খুব কথা কাটাকাটি চলেছে ক’দিন ধরে। জানেন, মা-মণি কেঁদেছিল?
— কেঁদেছিল?
যেন মা-মণির চোখে কান্নাটা এক অভাবনীয় ব্যাপার। ঘোষ-বাড়ির বিধবা গৃহিণী বরাবর বকতেই জানে, এইটেই সকলেরই জানা ছিল। কিন্তু তিনি কি আবার কাঁদতেও জানেন!
ভূতির মা হাঁফাতে হাঁফাতে এসে খবর দিলে বাতাসীর মা’কে। সব শুনে বাতাসীর মা মাথা নেড়ে উঠলো।
—মরণ আর কি! মাগীর ঢং দেখে আর বাঁচিনে! এমন অনেক মড়াকান্না শুনেছি লা অমন অনেক মড়াকান্না শুনেছি! মেয়ে তো হয়নি মাগীর, মেয়ের বউ-এর মর্ম কী বুঝবে শুনি?
ভূতির মা বললে—হ্যাঁ গা, সত্যি বলছি, মা-মণি কাঁদছে, চোখে আঁচল দিয়ে চোখ মুচছে—দেখে এলাম—
বাতাসীর মা ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো। বললে—তুই আর হাসাস্ নে লা, হাসাস্ নে, সেই যে কথায় আছে না—
বেটা বিয়লাম বউকে দিলাম,
ঝি বিয়লাম জামাইকে দিলাম
আপনি হলাম বাঁদী
পা ছড়িয়ে কাঁদি—
অমন অনেক দেখেছি—
কৈলাস কাছে ছিল। বললে—কেন গা ভূতির মা, কাঁদছে কেন মা-মণি?
বাতাসীর মা’র তখনও ঝাঁজ কমেনি। বললে—ওলো, এমন কান্না আমরাও কানতে পারি। বলে—নাচতে কি আর জানিনে, মাজার ব্যাথায় পারিনে–
ঘোষ-বাড়িতে সেদিন বিপ্লবই ঘটে গেল সতীকে কেন্দ্র করে। ডাক্তারবাবু এল। মা- মণির ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু সনাতনবাবুই দারোয়ানকে দিয়ে ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনালেন। বরফ এল মাথায় দেবার জন্যে। সতী সেই মার্বেল পাথরের মেঝের ওপর অজ্ঞান-অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল। ডাক্তারবাবু পরীক্ষা করলেন। করে প্রেস্কৃপশন লিখে দিলেন। সনাতনবাবু মুখের কাছে মুখ নিয়ে এসে বারকয়েক দেখলেন।
পাড়ার ডাক্তারবাবু। বললেন—এখন একটু বিশ্রাম দরকার, নার্ভ শ্যাটার্ড হয়ে গেছে—
তারপর একটু থেমে আর একবার পরীক্ষা করে বললেন—কোন ছেলেমেয়ে আছে এঁর?
সনাতনবাবু বললেন—না—
—কখনও হয়েছিল?
সনাতনবাবু বললেন—হ্যাঁ, কিন্তু সে তো বাঁচেনি—
ডাক্তারবাবু বললেন–মনটাকে সব সময়ে খুশী রাখতে হবে, সারাদিন হাসিখুশির মধ্যে কাটানো চাই—একটু সকলকে বলে দেবেন এঁর মনকে আঘাত দিয়ে কেউ যেন কথা না বলে—-তাহলেই দু’দিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।
সতীকে তখন ঘরে নিয়ে শোওয়ানো হয়েছে। সনাতনবাবুও পাশে আছেন।
কৈলাস এসে ডাকলো— দাদাবাবু মা-মণি ডাকছেন—
সনাতনবাবু বললেন—বল্, এখন যেতে পারবো না—
এ-রকম ঘটনা সচরাচর ঘটে না। মা-মণি নিজে এলেন শেষ পর্যন্ত। বললেন- খোকা, আমি তোমায় ডাকছি না? কথা শোন না কেন?
সনাতনবাবু বললেন—একটু পরে যাবো মা,–
—না, আমি ডাকছি তোমাকে, এখনি এসো একবার এ-ঘরে!
সনাতনবাবু আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে কাছে এলেন। গলা নামিয়ে বললেন—মা, চেঁচিয়ে কথা বোল না, নার্ভ একেবারে দুর্বল হয়ে গেছে তোমার বৌমার—মনের ওপর আঘাত যেন না-লাগে, খুব বিশ্রাম দরকার—ডাক্তারবাবু খুব সাবধান করে দিয়ে গেলেন—
—আমার বিশ্রামের কথা কে ভাবে তার ঠিক নেই, বৌমার বিশ্রামের কথাই তুমি ভাবছো? কেন, তোমার পড়াশোনা কী হলো? এখানে বৌমার মুখে মুখ দিয়ে পড়ে থাকলেই চলবে? সংসারে আর কিছু কাজ নেই তোমার?
সনাতনবাবু এ-কথার উত্তর না দিয়ে বললেন—তুমি ও-ঘরে যাও, আমি একটু পরে যাচ্ছি—
মা-মণি বললেন—খোকা, তুমি আমায় এই কথা বললে? তোমার মুখ থেকে আমায় এই কথা শুনতে হলো আজ?
সনাতনবাবু বললেন—তোমার যদি কিছু বলবার থাকে তো বলো না আমাকে- আমি তো শুনছি–
মা-মণির গলাটা অপমানে বুজে এল যেন। বললেন—তোমার মুখে আজ এই ভাষা?
সনাতনবাবু যেন একটু বিরক্ত হলেন। বললেন—তুমি একটু আস্তে কথা বলো মা, তখন থেকে বলছি চেঁচিও না।
মা-মণি বললেন—তুমি আমার মুখের ওপর কথা বলছো? এত সাহস তোমার?
সনাতনবাবু বললেন—তোমার মুখের ওপর কখন কথা বললুম?
—বলছি তোমাকে, তুমি উঠে এসো। অসুখ হলে মানুষ মরে না, ও-রকম অসুখ আমাদেরও হয়, তাহলে আমরা কবে মরে যেতুম। ওঠো, উঠে এসো—
সনাতনবাবু বললেন—কেন উঠে আসতে বলছো আমাকে?
—তোমার কাছে তার কৈফিয়ৎ দিতে হবে নাকি? তুমি উঠবে কি না বলো?
সনাতনবাবু এতক্ষণে বিছানা ছেড়ে উঠে এলেন মা-মণির সামনে। মা-মণি বললেন—বলি, তুমি কি নিজের মাথাটা খেয়ে বসে আছো? কার হুকুমে আমার কথা অগ্রাহ্যি করলে? আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে ডাক্তার ডাকবার আগে? আমি তোমাকে অনুমতি দিয়েছি?
—মা তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তুমি একটু আস্তে কথা বলো!
—কেন আস্তে কথা বলবো? কী অপরাধ করেছি আমি? আমি তো কারোর কাছে ধার করে খাইনি যে ভয় করবো, ভয় পেয়ে গলা নিচু করবো! আমি ন্যায্য কথা বলবো তাতে ভয় কীসের শুনি? আমি কি চুরি করেছি? না ডাকাতি করেছি? আজ যে বাড়িসুদ্ধ চাকর-বাকর সকলের সামনে আমায় তুমি বে-ইজ্জৎ করলে, কই, তার জন্যে তোমার তো লজ্জা হচ্ছে না খোকা! তার জন্যে তো আমার কাছে একবারও ক্ষমা চাইলে না! এখন বৌমার কথাটাই তোমার কাছে এত বড় হলো! আমি কেউ না?
সনাতনবাবু যেন একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। বললেন—আমি তো ঠিক বুঝতে পারিনি—
—তা বুঝবে কেন? আর বৌমার অসুখের বেলায় তো ঠিক বুঝেছ, তার জন্যে ডাক্তার ডাকবার কথা তো ঠিক মনে পড়েছে? তার সেবা করতে তো ভুলে যাওনি?
বলে নিজের কপাল চাপড়ালেন ডান হাত দিয়ে। বললেন—তোমাকে এত লেখাপড়া শেখানোর এই ফল হলো-—
কথাটা বলে থান কাপড়ের আঁচল দিয়ে নিজের চোখ মুছলেন। তারপর নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। সনাতনবাবুও সঙ্গে সঙ্গে মা-মণির ঘরে এলেন। বললেন-মা, তুমি ঠিক বুঝতে পারছো না—
মা-মণি তখন নিজের বিছানায় বসে পড়ে চোখ ঢেকে আছেন।
সনাতনবাবু আবার বললেন—মা, আমার কথাটা শোন—
মা-মণি বললেন—খুব শুনেছি খোকা, আমার খুব শিক্ষা হয়েছে, এতদিন ধরে শরীরের রক্ত জল করে তোমার জন্যে ভেবে-ভেবে মরেছি, তার উপযুক্ত শিক্ষাই আমাকে তুমি দিয়েছ—তুমি যাও বাবা, বৌমার কাছে গিয়ে বোস-বৌমার কষ্ট হচ্ছে, তার সেবা করো গে—
সনাতনবাবু আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলেন মা’র কাছে। বললেন—তুমি এসব কথা বলছো কেন মা মিছিমিছি?
—হ্যাঁ, মিছিমিছিই আমি তোমাকে এত কথা শোনাচ্ছি। আমি ঘাট মাছি তোমার কাছে বাবা, আমারই হাজার দোষ, বৌমার কোনও দোষ নেই—বৌমা ভাল, আমিই মন্দ–
বলতে বলতে মা-মণি সেখানেই যেন ভেঙে পড়লেন।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—তারপর?
শম্ভু বললে—তারপর ক’দিন ধরে এমনিই চললো। বাড়ির মধ্যে এমন অশান্তি আগে কখনও হয়নি। রোজ রোজ মা-ছেলেতে ঝগড়া।
—আর বৌদিমণি?
শম্ভু বললে–বৌদিমণি কারোর সঙ্গেই কথা বলতো না। নিজের ঘরে শুয়ে থাকতো। আমরা ভাবলুম একটা মিট্-মাট্ হয়ে যাবে বুঝি। কিন্তু শাশুড়ী মাগী কি কম দজ্জাল দাদাবাবু। ডাক্তার এসেছিল প্রথম দিন। তারপর আর এল না।
মা-মণি বললেন—কই, তুমি আমার কাছে বসে আছো কেন, যাও, বৌমার কাছে যাও?
রাত হচ্ছে তখন। সনাতনবাবু কিছু উত্তর দিলেন না।
মা-মণি বললেন—আমি আর জেগে থাকতে পারছি নে, কোথায় শোবে তুমি? আমার ঘরে না বৌমার ঘরে? কোথায় শোবে ঠিক করে বলো!
তারপর থেকেই প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের ঘোষ-বাড়ির অভ্যন্তরে চরম বিপর্যয় নেমে আসতে লাগলো আস্তে আস্তে। একদিন সতী সমস্ত সহ্য করে, সব অপমান মাথা পেতে নিতে তৈরিই হয়েছিল, কিন্তু বিপর্যয় এল আর এক ছিদ্র দিয়ে। প্রতিদিনের বিড়ম্বনা, প্রতি মুহূর্তের অত্যাচার, তাকে আর এক মহা অমঙ্গলের দিকে ঠেলে নিয়ে গেল। কলকাতার নগর-জীবনের ব্ল্যাক-আউটের মত তার জীবনেও ব্ল্যাক-আউট নেমে এল। অন্ধকার রাত্রিগুলোতে দেয়ালের ঘড়িটা টিক্-টিক্ শব্দ করতো আর সতীর মনে হতো ও যেন তার হৃদ্স্পন্দনের আর্তনাদ! সমস্ত দিন-রাত যেন মুখর হয়ে থাকতো সে- আর্তনাদে। অনেক রাত্রে কোথায় কত দূরে একটা কামান গর্জে উঠলো, একটা এরাপ্লেন বাড়ির ছাদের ওপর দিয়ে গর্জন করতে করতে উড়ে গেল, সতীর মনে হতো ও যেন তার নিজেরই অন্তরাত্মার মুখরতা ছাড়া আর কিছু নয়।
সতী বলতো—সে ক’দিন যে আমার কেমন করে কেটেছে, তুমি বুঝতে পারবে না দীপু—
বুঝতে অবশ্য পারতো দীপঙ্কর। শেষের দিকে সমস্তই বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু তখন আর কিছু বলবার ছিল না দীপঙ্করের। তখন চরম সর্বনাশ ঘনিয়ে এসেছে সতীর জীবনে। একে একে সেই সর্বনাশের দিকেই পা বাড়িয়ে চলেছে তখন সতী!
এক-একদিন দীপঙ্কর আর সতী তখন মুখোমুখি বসে থাকতো ঘন্টার পর ঘন্টা! অন্ধকার বাড়িটাতে কেউ নেই। সমস্ত পৃথিবীও তখন থেমে গেছে। রাত্রের শেষ ট্রেনটাও তখন মাটি কাঁপাতে কাঁপাতে চলে গেছে গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং পার হয়ে। বাইরে ঝিঁ-ঝিঁ ডাকটা আরো তীক্ষ্ম, আরো প্রকট হয়ে উঠেছে।
দীপঙ্কর এক সময় উঠতো। উঠে দাঁড়াতো খানিক। তারপর বলতো—অনেক রাত হয়ে গেছে আমি যাই—
সতী বলতো—অনেক রাত করিয়ে দিলাম তোমাকে—
দীপঙ্কর বলতো—তা হোক্—
সতী দরজার কাছে এসে দাঁড়াতো। দরজা বন্ধ করবার আগে জিজ্ঞেস করতো—কালকে আসছো তো?
দীপঙ্কর বলতো—না এসে কোথায় যাবো?
সতী বলতো—হ্যাঁ এসো কিন্তু ঠিক, তুমি না এলে বড় খারাপ লাগে আমার-
তারপর অন্ধকারের মধ্যে যতক্ষণ দীপঙ্করকে দেখা যেত, ততক্ষণ দরজাটা সেইভাবে খুলে দাঁড়িয়ে থাকতো সতী!
একে একে দিন আসতো, রাত আসতো, জীবন আসতো, মৃত্যু আসতো। দীপঙ্করের সমস্ত জীবনের তখন শেষ অধ্যায়। চাকরি জীবনেরও হয়ত শেষ অধ্যায়। তখন মাথার ওপরে মা নেই, চোখের ওপর চাকরির ভ্রূকুটিও নেই। সেইসব দিনগুলোর যে এমন মর্মান্তিক পরিণতি হবে কে জানতো।
কিন্তু সে অনেক বছর পরের কথা সব। প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের মুখের কাছে দাঁড়িয়ে, শম্ভুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে-সব কথার কল্পনা করাও তখন অন্যায় যেন। দীপঙ্করের জীবনে তখন শেষ অঙ্কের শেষ পরিচ্ছেদ শুরু হয়েছে।
শম্ভু বলেছিল—হঠাৎ আজকে সকাল বেলা আবার শোরগোল পড়ে গেল বাড়িতে—
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করেছিল—কেন?
শম্ভু বলেছিল—সেই জন্যেই তো আপনার বাড়িতে গিয়েছিলুম এখন
—কী জন্যে?
বৌদিমণিকে তখন থেকে আর পাওয়া যাচ্ছে না! সবাই বলছে আপনাদের বাড়িতে গেছে, সেই সেবারও গিয়েছিল কিনা—। বাতাসীর মা বললে আমাকে দেখে আসতে—
দীপঙ্কর বললে—কিন্তু আমি তো এই এখুনি আসছি বাড়ি থেকে, আমার বাড়িতে তো বৌদিমণি যায় নি। গেলে আমি জানতে পারতুম।
শম্ভু বললে—তাহলে কোথায় গেল বুঝতে পারছি না তো—
—কখন বেরিয়েছে?
—এই খাওয়া-দাওয়ার পর, সবাই যখন বাড়ির ভেতর জিরোচ্ছে। মা-মণি নিজের ঘরে, দাদাবাবুও লাইব্রেরী-ঘরে। দারোয়ানও টের পায়নি। আগেকার মতন গেটে তো আর তালা লাগানো থাকতো না।
দীপঙ্কর আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলো। কোথায় গেল আবার? কোথায় যেতে পারে? কে আছে সতীর কলকাতায়? লক্ষ্মীদির বাড়ি? লক্ষ্মীদির বাড়ি চিনবে কী করে? আর চিনলেই বা যাবে কেন সেখানে?
—কিন্তু এখুনি আমি তোমাদের ব্যারিস্টারবাবুর বাড়িতে গিয়েছিলুম, তিনি তো কিছু বললেন না।
শম্ভু বললে—তিনি তো বেলায় এসেছিলেন, মা-মণি আজকে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বসেন নি মোটে। মা-মণি যেন এ ক’দিন অন্যরকম হয়ে গেছেন। ছেলের সঙ্গে মন- কষাকষি হবার পর থেকেই তিনি আর তেমন কথা বলেন না। গলার ঝাঁজও কমে গেছে তাঁর—
—আর বৌদিমণির বাবা এ ক’দিনের মধ্যে কি এসেছিলেন, কিছু জানো?
শম্ভু বললে—তিনি তো বিদেশে হুজুর, সাত সমুদ্দুর তের নদী পারে, তিনি কি আর এত-শত খবর রাখেন! তিনি কী করে টের পাবেন?
—কিন্তু আমি যে তাঁকে টেলিগ্রাম করে দিয়েছি।
শম্ভু বললে—তা জানিনে হুজুর, সব কথা তো আমরা জানতে পারিনে। বৌদিমণি চলে যাবার পর থেকেই দাদাবাবুও আবার বড় মুষড়ে পড়েছেন—মাথার যন্ত্রণা নিয়ে ঘরে ছট্ফট্ করছেন, ডাক্তারবাবুকে ডেকে এনেছিলুম আমি, তিনি এসে ওষুধ দিয়ে গেলেন, তারপর আমি বেরোলুম—
—কিন্তু তোমার দাদাবাবুর তো অসুখ করে না বড় একটা।
শম্ভু বললে—তা করে না, কিন্তু ধকলটা কেমন গেল বলুন? মানুষটা কথা বলেন না তো বেশি, মনে মনে তো সব বোঝেন, লেখাপড়া জানা লোক, সমস্ত বুঝতে পারেন। এতদিন মা’র মুখের ওপর কথা বলেন নি, কিন্তু কতদিন আর সহ্য করবেন? আজকে বৌদিমণি চলে যাবার পর দাদাবাবু আর চুপ করে থাকতে পারেন নি। খুব বলেছেন যা- তা—
—কাকে?
—মা-মণিকে। মা-মণি ছেলের কথা শুনে খুব কেঁদেছেন। আর দাদাবও মাথার যন্ত্রণায় ছট্ট্ করছেন তারপর থেকে—সেই যে দুপুর থেকে মাথার যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করছেন, সে আর থামেনি। মা-মণি ঘরে এসেছিলেন দেখতে—
মা-মণি জিজ্ঞেস করলেন—কেমন আছো সোনা—
সনাতনবাবু চিৎকার করে উঠেছেন—তোমার এ-ঘরে আসতে হবে না, তুমি এখান থেকে যাও—তুমি চলে যাও এখান থেকে—চলে যাও—
সনাতনবাবুর সেই চিৎকার একতলায় রান্নাঘর থেকেও সবাই স্পষ্ট শুনতে পেলে। শিরীষ ঘোষের বংশ-গৌরব, বংশ-মর্যাদায় প্রথম আঘাত লাগলো এইবারই। এইবারই প্রথম ফাটল ধরলো ঘোষ-বংশের প্রেস্টিজের কংক্রিটে। সতী চলে যাওয়াতে যা হয়নি, তাই-ই হলো সনাতনবাবুর অপমানে। সনাতনবাবুর সেই চিৎকার বাড়িটার প্রত্যেকটা হঁটে এসে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। প্রত্যেকটা ইঁট যেন চিৎকার করে বলতে লাগলো—তুমি চলে যাও এখান থেকে, চলে যাও তুমি—চলে যাও—যাও—
আর হরিশ মুখার্জি রোডের ব্যারিস্টার পালিতের ছেলে নির্মল পালিত তো এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ওঁত পেতে বসে ছিল এতদিন!
.
মিস্টার ঘোষালের চেম্বার থেকে দকা আওয়াজ বেরিয়ে এল—গেট্ আউট্, গেট্ আউট—
হঠাৎ মিস্টার ঘোষালের মেজাজ আবার বিগড়ে গেছে। কয়েকজন বাইরের মার্চেন্ট্ ওয়াগন্ সম্বন্ধে কথা বলতে এসেছিল। এমন প্রতিদিন সবাই এসেও থাকে। লেনদেনের কারবার আছে তাদের সকলের সঙ্গে। দ্বিজপদ জানে। রবিনসন সাহেবের পুরোনো চাপরাসী দ্বিজপদ। এতদিন রবিনসন সাহেবের সঙ্গে কাজ করেছে। হাসিমুখেই কাজ করেছে। এখন এসেছে ঘোষাল-সাহেব।
বলে—শুয়োরের বাচ্চা—
—কে-জি-দাশবাবু বলে—অমন কথা বোল না দ্বিজপদ, কোনদিন তোমার চাকরি চলে যাবে—
দ্বিজপদ বলে—চাকরি যাক্ গে বড়বাবু, এর চেয়ে ভিক্ষে মেঙে খাওয়া ভাল–এ শুয়োরের বাচ্চার কাছে কাজ করার চেয়ে রাস্তায় ভিক্ষে করে খাওয়াও ভাল—
দ্বিজপদর চোখের সামনেই ঘটনাগুলো ঘটে। বড় বড় গাড়ি এসে দাঁড়ায় গেটের বাইরে। মারোয়াড়ী, গুজরাটী, বাঙালী, ভাটিয়া, সিন্ধী কেউই বাদ নেই। যুদ্ধও যত পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে, তাদের ভিড়ও তত বাড়ে। এক-একদিন গাড়ির ভিড়ে জমজমাট্ হয়ে যায় সামনেটা। প্রথমে পোল্যান্ড, তারপর বেলজিয়াম, হল্যান্ড, নরওয়ে আর ডেনমার্ক। জার্মান ব্লিৎক্রীগ্-এর পাল্লায় ফ্রান্সের সেডানে ভাঙন ধরলো। ইংরেজরা পেছিয়ে এল ডানকার্কে। ফ্রান্স পড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ইংলন্ডের বিপদ ঘনিয়ে এল একেবারে বুকের ওপর। লন্ডনের মাথার ওপর ব্লিৎসক্রীগের চাপে উনিশ হাজার লোক মরে গেছে তখন, আর সাতাশ হাজার লোক হাসপাতালে শুয়ে রয়েছে।
কলকাতার মাঠে মাঠে, পাড়ায় পাড়ায় এ-আর-পি শেল্টার তৈরি হয়েছে। স্লিট্ ট্রেঞ্চ তৈরি হয়েছে। লম্বা জিগ্ জ্যাগ্ গর্ত। যদি বোমা পড়ে তখন তার ভেতরে গিয়ে লুকোবে সবাই। সিভিক গার্ড, এ-আর-পি’র দলে ভর্তি হচ্ছে পাড়ার বখাটে ছেলের দল। এতদিন বিড়ি খেয়ে রাস্তায় ঘাটে আড্ডা দিয়ে বেড়াতো। এবার হিল্লে হয়ে গেল সবার। কলকাতা সরগরম।
দ্বিজপদ সঙ্গে সঙ্গে পেছন-পেছন যায়। বলে—হুজুর, সেলাম—
ঘোষাল সাহেবের ঘর থেকে বেরোলেই তাদের মুখের হাব-ভাব দেখে দ্বিজপদ বুঝতে পারে। একেবারে সত্তরখানা ওয়াগন পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হওয়া চেহারা। বড় বড় পার্টি সব রেলওয়ের। বাইরের রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়িগুলোর চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, কী-দরের মাল সব। দ্বিজপদ সকলকে চেনে। ঘোষাল-সাহেব রবিনসন সাহেবের চেয়ারে বসবার পর থেকেই তার অবস্থা ফিরে গেছে। বড় বড় ভাটিয়া পার্টি মাথায় পাগড়ি পরে বাইরে গট্-গট্ করে হেঁটে নিজেদের গাড়িতে গিয়ে ওঠে। দ্বিজপদও পেছন- পেছন যায়। বলে—হুজুর, সেলাম—
গাড়িতে ওঠবার মুখে হঠাৎ নজরে পড়ে তাদের। এতক্ষণে তাদের খেয়াল হয়। পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দেয় দ্বিজপদর দিকে।
দ্বিজপদ সেটা ঝপ্ করে পকেটে পুরেই চারদিকে একবার দেখে নেয়। তারপর সামনে মাথাটা ঝুঁকিয়ে বলে—সেলাম হুজুর, সেলাম—
কিন্তু দ্বিজপদর সেলাম নেবার দিকে তখন তাদের আগ্রহ নেই আর। নাকে ধোঁয়া উড়িয়ে তখন গাড়িটা উধাও হয়ে গেছে।
আবার নিজের টুলে গিয়ে বসে দ্বিজপদ। আবার হা-পিত্যেশ করে চেয়ে থাকে সদর গেটের দিকে। আবার কোনও পার্টি আসছে কিনা। আবার কোনও মওকা আসছে কিনা ওঁত পেতে দেখে!
কিন্তু বেশিক্ষণ ওঁত পাততে হয় না। বাইরে একটা গাড়ি এলে দাঁড়ায় আবার। বিরাট ঝুঁক্ক-ঝকে তক্-তকে গাড়ি। ভারি ভারি চেহারার তিন-চারজন মারোয়াড়ী নামে গাড়ি থেকে। চেহারা দেখে কি বুঝতে পারে দ্বিজপদ।
—সেলাম হুজুর, সেলাম—
সবাই ভেতরে ঢুকে যায় গট গট্ করে। দ্বিজপদ পকেটে হাত দিয়ে দেখে। টাকাগুলো অনুভব করে। এক-একনি কুড়ি টাকা, পঁচিশ টাকা, তিরিশ, চল্লিশ পর্যন্ত ওঠে। ঘোষাল সাহেবের চাপরাসীর দাম পাঁচ টাকার নিচে কখনও নামেনি। পাঁচ টাকার নিচে নামলে আর মান-মর্যাদা থাকে না দ্বিজপদর।
দ্বিজপদ বলে—বাঙালীবাবুদেরই বড় হাতটান্, কিছুতে টাকা গলে না হাত দিয়ে— সেদিন সুইং-ডোরটা খুলে বেরোতেই দ্বিজপদ আপাদ-মস্তক দেখে নিলে কে লোকটা। কোট্-প্যান্ট পরা লোক। গলায় নেক্টাই। হাতে সিগারেটের টি আর দেশলাই। চক্চকে জুতো।
লোকটা গট গট্ করতে করতে বাইরের গাড়িত গিয়ে উঠলো। দ্বিজপদ একেবারে গাড়ির জানালার কাছে গিয়ে মুখ নামিয়ে আবার বললে—সেলাম, হুজুর সেলাম—
ভদ্রলোক যেন দেখেও দেখলে না। টিন্ থেকে একটা সিগারেট বার করে ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়লে।
দ্বিজপদ আবার বললে—সেলাম হুজুর, সেলাম—
এতক্ষণে যেন লোকটা দেখতে পেলে। পকেটে হাত দিয়ে অনেক কষ্টে খুঁজে পেতে একটা টাকা বার করে দ্বিজপদর দিকে বাড়িয়ে ধরলে। দ্বিজপদ নিলে টাকাটা, কিন্তু ঘেন্নায় যেন হাতটা শিঁটিয়ে এল। একটা টাকা! নিতেও ঘেন্না হলো তার। এক টাকার ফোতো বাবু আবার টিনের সিগারেট খায়! ছোঃ—
গাড়িটা তখন চলতে আরম্ভ করেছে। দ্বিজপদ টাকাটা হাতের মুঠোয় পাকিয়ে গুলি করে গাড়ির মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিলে। ঘোষাল সাহেবের চাপরাসী এক-টাকার অপমান যেন আর সহ্য করতে পারলে না।
তারপর থেকেই দ্বিজপদ বলতো—দূর, বাঙালীরা আবার বাবু, ওদের আর সেলাম করবো না, দূর দূর—শুধু হাত নষ্ট।
ঘোষাল সাহেবের ঘরের মধ্যে বিরাট একটা টেবিল। খাঁটি বার্মা টিক্-উডের তৈরি সাইজ্ আঠারো বাই বারো। গ্লাস-টপ। চারপাশে টিক-উডের কেন্-চেয়ার। রবিনসন্ সাহেবের চলে যাবার পর নতুন ফার্নিচার তৈরি হয়ে এসেছে। দেয়ালে ডায়াগ্রাম। ওয়ার ট্র্যাফিকের ডায়াগ্রাম। ঘোষাল সাহেবের চোখের সামনে সব থাকা চাই। সব হ্যান্ডি। সব রেডি মেড্। নইলে সর্বনাশ হয়ে যাবে রেলওয়ের, ট্র্যাফিক বন্ধ হয়ে যাবে গভর্নমেন্টের। ক্লার্কদের টেবিল ছোট হলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু অফিসারদের বড় টেবিল চাই, বড় চেম্বার। বেশি মাথার কাজ করতে হয়, বেশি দায়িত্বের কাজ, বেশি রেসপন্সিবিলিটির।
দ্বিজপদ ঘরে ঢুকে বলে—হুজুর মেমসাব —
—মেসাব? কৌন মেম্সাব?
তারপর সুইং-ডোর ঠেলে একেবারে সসম্মানে দাঁড়িয়ে উঠেছে ঘোষাল-সাহেব।
—আসুন, আসুন, কী সৌভাগ্য আমার, আপনাকে কী চমৎকর দেখাচ্ছে, ইউ লুক্ সো নাইস্, সো বিউটিফুল–আসুন, আসুন —
বলে সামনে হাত বাড়িয়ে দিলে মিস্টার ঘোষাল।
দ্বিজপদ দরজাটা বন্ধ করে আবার এসে টুলের ওপর বসলো। আজকে সকাল থেকে পঁচিশ টাকা হয়েছে মাত্র। এখন তিনটে। বেলা তিনটে। হাতে আরো তিন-চার ঘন্টা সময় রয়েছে। তেমন তেমন পার্টি এলে চাই-কি আরো পঁচিশ টাকা মবলক্ হাতে এসে যোতে পারে! আর যদি ভাগ্যে থাকে তো দু’টো মারোয়াড়ী পার্টি এলেই পুষিয়ে যাবে মেহনত্। জয় বাবা জগন্নাথ। জয় বাবা বলরাম! আর কোন গাড়ি আসছে কিনা দেখবার জন্য রাস্তার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল দ্বিজপদ।