কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০

১০

এই উপন্যাস যাঁরা পড়ে আসছেন, তাঁরা জানেন প্রত্যেক মানুষের মানসলোকে যে চিরন্তনী সব সময় আনন্দে বেদনায়, আশায়, আশঙ্কায় ধ্রুব হয়ে বিরাজ করে, যে- চিরন্তনী তাকে নিদ্রায়-জাগরণে সর্বক্ষণ সচেতন রাখে, কখনও বা সজ্ঞানে, আবার কখনও বা অজ্ঞানে তাকে অনুসরণ করে, আনন্দের দিনে না হলেও দুঃখের দিনে সেই তার কাছে গিয়েই আশ্রয় চায় দীপঙ্কর। তখন মনে হয় তার চেয়ে অন্তরতম বুঝি আর কেউ নেই। সেই চিরন্তনীকে বড় সহজ করে নিয়েছিল দীপঙ্কর। তাই বাইরের লোকের চোখে কখনও সে শিশু, কখনও সে ভীরু, কখনও সে সাহসী, কখনও কঠোর, আবার কখনও বা স্বার্থপর। দীপঙ্করের কাছে সবটাই ছিল সহজ। আনন্দের সময়ও সে সহজ হতে পারতো, দুঃখের সময়ও সহজ হতে পারতো। সহজকে তাই সে অত সহজে হারিয়ে ফেলতো। হারিয়ে ফেলতো কেবল তাকে খুঁজে বার করবে বলেই। হঠাৎ যখন হারিয়ে ফেলতো, তখন একেবারে দিশেহারা হয়ে যেত। বলতো—কই, কই তুমি? আবার তখনই নিজেই বলে উঠতো—এই তো তুমি, এই তো রয়েছ। এই আমার মনের মনে, এই আমার বুকের বুকে। দিক্-বিদিক জ্ঞানহারা হয়ে সারা পৃথিবী ঘুরে এসে একেবারে নিজের ভেতরেই পাওয়া যেত তাকে। সহজ আবার সহজ হয়ে আসতো। দীপঙ্কর আবার সেই পুরোন দীপঙ্কর হয়ে উঠতো।

এই যেমন মায়ের মৃত্যু!

আর একদিনের কথাও মনে পড়ে। খবরের কাগজে যে-বক্তৃতা ছাপা হয়েছিল সেদিন, তা পড়েও সবাই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। সবাই বলেছিল—ঠিক কথা বলেছে হিলার—খুব ঠিক কথা—

—পড়েছেন মশাই হিটলারের লেকচার?

—এবার জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে সবাইকে, ইংরেজ বাছাধনদের আর মাথা তুলতে হবে না।

পাড়ায়-পাড়ায় সিভিক-গার্ড আর এ-আর-পি দের কাজ নেই কিছু। খাকি ইউনিফর্ম পরে, বিড়ি খায় সিগারেট খায়, ইংরেজদের টাকাও খায়, আবার ইংরেজদের গালাগালিও দেয়।

সেদিন খবরের কাগজ খুলে সবাই তিন-কাপ করে গরম চা খেয়ে ফেললে। এত গরম বক্তৃতা এর আগে আর বেরোয়নি কখনও খবরের কাগজে। গরম দিয়ে গরম ভাঙল।

হিটলার বলেছে—In fact, it is a struggle between two worlds. 46 million English rule a territory of 40,000,000 square Kilometers in this world. 85 million Germans have a living space of hardly 600,000 square Kilometers. This earth, however, was not distributed by Almighty God. All my life I have been a have-not. Now again I enter the fight as the representative of the have-nots. These people have the possibility of pocketing up to 160 per cent dividend from the ammunition industry. They say that if these German methods prove victorious all this will stop. They are right. I believe 6 per cent suffi- cient. Two worlds are in conflict, two philosophies of life. They say we should help to keep up the gold standard—of course, for they have the gold and we have not.

আবার আর একদিনে কথা। দীপঙ্করের আপিসের সামনেই প্রতিদিন ঘটনাটা ঘটতো। সে বোধ হয় উনিশ শো চল্লিশ সালের কথা। ডালহৌসী স্কোয়ারের মোড়ে রাস্তার ওপর অন্ধকূপ-হত্যার স্তম্ভটাকে দিনের পর দিন সবাই দেখে আসছে। নবাব সিরাজউদ্দৌলার মিথ্যে কলঙ্ক চিরস্থায়ী করবার জন্যে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট নিজেদের কলঙ্ককে পাথর চাপা দিয়ে মনুমেন্ট গড়েছে। এ-পাড়ার রাইটার্স বিল্ডিং-এ, রেলওয়ে আপিসে, মার্চেন্ট ফার্মে যারা প্রতিদিন ট্রামে-বাসে চড়ে আপিসে এসেছে গেছে, তারাও কেউ মাথা ঘামায়নি ওটা নিয়ে। লোকে বলতো হওয়েল মনুমেন্ট। ওইখানেই নাকি অন্ধকূপ হত্যা হয়েছিল। সত্য-মিথ্যে ভগবান জানে। কিন্তু টনক্ নড়লো প্রথম সুভাষ বোসের। সুভাষ বোস বললে—এখানে এটা রাখা চলবে না—

আপিসের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতো সবাই। দলে দলে ভলান্টিয়ার আসছে হাতুড়ি নিয়ে আর স্তম্ভটার গায়ে ঘা দেবার চেষ্টা করছে। পুলিসের দল লাঠি নিয়ে তাড়া করতো। তারপর পুলিসের ভ্যানে তুলে নিয়ে পুরতো জেলে।

এমনি রোজ।

সে এক কান্ড চললো কদিন ধরে। কোত্থেকে যে পিল পিল্‌ করে এত ভলান্টিয়ার আসে, কে যে তারা, কেউ জানতো না। সারা শহরে সিভিক গার্ড হয়েছে, এ-আর-পি হয়েছে, তারাও লুকিয়ে লুকিয়ে নাম ভাঁড়িয়ে দলে জুটতো। বলতো—শালা, ইংরেজদের টাকা নিয়ে ইংরেজদেরই সর্বনাশ করবো—

সমস্ত আপিস পাড়ায় তখন ওই এক আলোচনা। ওই এক কথা। দীপঙ্করেরও কানে গিয়েছিল। কিন্তু কোনও দিন বাহারে রাস্তায় এসে দেখেনি দৃশ্যটা। যেদিন সুভাষ বোসকে জেলে ধরে নিয়ে গেল, সেদিনও হৈ চৈ করেনি কলকাতার অন্য লোকদের মত। আবার যেদিন জেলখানার মধ্যে হাঙ্গার-স্ট্রাইক করবার জন্যে ছেড়ে দিলে সেদিন ও আনন্দে লাফিয়ে ওঠেনি। দীপঙ্করের মনে হয়েছিল—এই সমস্ত ঘটনার মধ্যে সমস্ত কোলাহলের মধ্যে কোথায় নে একটা সত্যের আশ্রয় পেয়েছে সে। একটি প্রশ্নের আশ্রয়। একটি প্রশ্নের সন্ধানেই যেন তাকে জীবন দিতে হবে। কী সে প্রশ্ন? কীই বা সে উত্তর, তা-ও সে জানতো না, তবু সন্ধান যেন তার জীবনে শেষ হবে না।

মনে আছে আশুতোষ কলেজের প্রফেসর অমলবাবুও তাকে সেই কথাই বলেছিলেন। ভাল লোকেরা কেন কষ্ট পায়? ভক্তের কেন এত দুঃখ? তবে কি সক্রেটিস্ মিথ্যা কথা বলেছেন—To a good man whether alive or dead, no evil can happen.

আর সতী?

সতীও সে-সব দিনের কথা মনে করিয়ে দিত। লক্ষ্মীদিও মনে করিয়ে দিত! কিন্তু দীপঙ্করকে কিছুই মনে করিয়ে দেবার দরকার ছিল না। দীপঙ্করের সব মনে ছিল। সব মনে থাকে। সব মনে আছে।

মনে আছে মা’র মৃত্যুর দিনের কথাগুলো।

ক্ষীরোদা বোধ হয় ডাবের জল খাওয়াতে গিয়েছিল। তার আগে সন্তোষ-কাকা যা- নয় তাই বলেছে। আহা, গ্রামের লোক সন্তোষ-কাকা। সহজ সরল বিশ্বাসের মানুষ। শহরের মুখোশ পরা ভদ্রতার ধার ধারে না। যা মনে আসে মুখে বলে যায়। সাদাকে সাদা বলে, কালোকে কালো বলে।

ক্ষিরি বলতো—তুমি একটু চুপ করো না বাবা—

সন্তোষ-কাকা বলতো—চুপ করবো কেন শুনি? চুপ করতে যাবো কেন? ক্ষিদে পেলে খেতে দিতে বলবো না? খেতে চাইলেও দোষ?

ক্ষিরি বলতো—তা আমি কি চুপ করে বসে আছি?

সন্তোষ-কাকা বলতো—তা তোর ভাত রাঁধতে এত দেরি? জানিস যে মাথায় জল পড়লেই আমার ক্ষিদে পায়—

ক্ষিরি বলতো—কিন্তু আমার তো একটা হাত—আমি ক’দিক দেখবো। সকাল থেকে জ্যাঠাইমাকে ওষুধ দিয়েছি, পথ্যি দিয়েছি, তারপর আপিসের ভাত দিয়েছি এর ওপর তুমি যদি আবার বিরক্ত করো, তাহলে কখন কী করি?

সন্তোষ-কাকা বলে—তা সেটা আগে বললেই পারতিস, আমি আর সাত-তাড়াতাড়ি চান্ করতুম না—

ক্ষিরি বলে—তা একটু বোস, আমি ভাতটা চড়াচ্ছি, আলো-চালের ভাত এখুনি হয়ে যাবে—

—কেন? আলো চাল কেন? আলো চাল আমি খাই?

সন্তোষ-কাকার সামান্য ব্যাপারেই এমনি তিরি িমেজাজ। এমনি মেজাজ নিয়েই এসেছিল পৃথিবীতে। এমনি মেজাজ নিয়েই সকলের ওপর তম্বি করে এসেছে চিরকাল। আপন-পর জ্ঞান করেনি কোনওদিন। পৃথিবীর সবাই যেন তার আপন, সবাই যেন তার পর, আপন-পরের ভেদাভেদ ভুলে সন্তোষ-কাকা সকলের হয়ে গিয়েছিল।

সেদিন সন্তোষ-কাকা আর মাথার ঠিক রাখতে পারেনি বুঝি। দীপঙ্কর চলে যাবার পর যা-ইচ্ছে তাই বলেছিল দীপঙ্করের মা’কে। বলেছিল—আমাকে তুমি চেনোনি বৌদি, আমি রসুলপুরের দত্ত, আমাকে যত ক্ষ্যাপাটে ভাবো, আমি তত ক্ষ্যাপাটে নই, আমি বোকা হলে কী হবে, আমি সব বুঝতে পারি—

একটু থেমে আবার বলতে লাগলো—তুমি ভেবেছ, তুমি ছেলের বিয়ে দিয়ে মোটা টাকা পাবে, তাই আর উচ্চবাচ্য করছো না, কিন্তু জানো, আমি মামলা করে খ্যাসারত আদায় করতে পারি? আমার মেয়ের খোর-পোষ আদায় করতে পারি—

বলতে বলতে সন্তোষ-কাকা সপ্তমে গলা চড়িয়ে দিলে। বললে—কথা বলছো না কেন শুনি? কথা বলছো না কেন? জবাব দাও?

তবু বৌদি জবাব দেয় না। যেমন চুপ করে শুয়ে ছিল, তেমনি চুপ করে শুয়ে রইল।

–বলি, কথার জবাব দিচ্ছ না কেন? জবাব দাও? জবাব না-দিয়ে পার পাবে ভেবেছ? দাও জবাব?

তারপর হঠাৎ কী যেন সন্দেহ হলো। ভালো করে মুখ নিচু করে দেখলে।

ক্ষিরি এসেছিল বাবাকে ভাত খেতে ডাকতে।

সন্তোষ-কাকা বললে—ওরে ক্ষিরি, বৌদি যে কথা বলছে না রে, কী হলো? মরে গেল নাকি?

তারপর মুখটা আরো নিচু করলে, আরো নিচু। তারপর গায়ে হাত দিতেই একেবারে শিউরে উঠলো।

ততক্ষণে ক্ষিরির হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠেছে। সন্তোষ-কাকার কান্না যেন ক্ষিরির কান্নাকেও ছাপিয়ে গেল। পুরুষ মানুষ যে অমন কান্না কাঁদতে পারে এর আগে তাও কেউ জানতো না। সন্তোষ-কাকার কান্না এপাড়া থেকে ওপাড়া পর্যন্ত সমস্ত সচকিত করে দিলে। তখন বিকেল বেলা। অফিসের পুরুষ-মানুষরা তখনও কেউ বাড়ি আসেনি। বাড়ির মেয়েরা কেউ তখন ঘুমিয়ে উঠেছে, কেউ কাঁথা সেলাই করছে, কেউ শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে। বলতে গেলে কলকাতার শহরতলীতে তখন অলস-অপরাহ্ন। সেই সময় একজন পুরুষ মানুষের কাঠফাটা কান্নার শব্দে সমস্ত অঞ্চলটা একেবারে সরগরম হয়ে উঠলো। কাশী বারান্দায় শুয়ে শুয়ে গড়াচ্ছিল। কান্নাটা তার কানে যেতেই, সে ওপরে গিয়ে কান্ড দেখে অবাক।

সন্তোষ-কাকা কাশীকে দেখে আরো হাউ-মাউ করে উঠলো, বললে—ওরে, আমিই বৌদিকে মেরে ফেললাম রে, ওরে কাশী আমারই মতিচ্ছন্ন হয়েছিল রে—

কাশী আর দাঁড়াল না। পাশের বাড়িতে গিয়ে বাড়িওয়ালাকে বললে—আমার বাবুর আপিসে একবার টেলিফোন করে দিন না–মা, আমার মা আর নেই—

বলেই আবার দৌড়ে নিজের বাড়িতে চলে এসেছিল—

এই-ই হলো সেদিনকার ইতিহাস। কিন্তু আশ্চর্য, মায়ের মৃত্যুটা যতখানি অসহ্য হবে মনে হয়েছিল দীপঙ্করের, ততখানি তো হলো না। বলতে গেলে সন্তোষ-কাকার তুলনায় কিছুই হলো না। একটা মানুষ এই পৃথিবীতে তাকে এনেছিল, তাকে লালন- পালন করেছিল, তার ভাল-মন্দের ভাবনা ভেবেছিল, তার সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিজের সুখ- দুঃখ জড়িয়ে নিয়েছিল। আর শুধু তাই নয়, তার জন্মের পর থেকে যে তার অস্তিত্বের সঙ্গে নিবিড় হয়ে বিরাজ করছিল, সে আর রইল না। সে আগুনে ধোঁয়ায় ধুলোয় একাকার হয়ে মিলিয়ে গেল, অথচ কোনও বিপর্যয় ঘটলো না দীপঙ্করের জীবনে। এর চেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা দীপঙ্করের জীবনে যেন আর কখনও ঘটেনি!

জীবন দিয়ে যাকে জানি, মৃত্যু দিয়েও যে তাকে জানা উচিত এই সত্যটাই যেন সেদিন দীপঙ্করের মনে বদ্ধমূল হয়ে গেল। অঘোরদাদুর মৃত্যুও সে দেখেছে, কিরণের বাবার মৃত্যুও দেখেছে। বিন্তীদির মৃত্যু, মিস্ মাইকেলের মৃত্যু, কোনও মৃত্যুই দীপঙ্করকে উপলব্ধির এত গভীরে পৌঁছে দেয়নি। এই উপলব্ধির গিরিচূড়ায় উঠে বিস্ময়ে, বিহ্বলতায়, বিমূঢ়তায় দীপঙ্কর তার নিজের শোকও ভুলে গেল। এই মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই দীপঙ্কর যেন সেদিন নিজের স্বরূপকে স্পষ্ট করে বুঝতে পেরেছিল। দীপঙ্কর যে এই জগতের সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন, সমস্ত কিছু থেকে বিভিন্ন, তার নিজেরও যে একটা স্বকীয় অস্তিত্ব আছে, মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে যেন মা তাকে এই শিক্ষাটাই দিয়ে গিয়েছিল সেদিন।

বেশি চিৎকার করেছিল সন্তোষ-কাকা। স্টেশন রোড থেকে শ্মশান পর্যন্ত সন্তোষ – কাকার গলাই সেদিন সকলকে ছাপিয়ে উঁচুতে উঠেছিল। এক-একবার চিৎকার করে—বলহরি—

আর সকলে সমবেত স্বরে বলেছিল—হরিবোল—

খবর পেয়ে ছিটে-ফোঁটাও এসেছিল। একদিন কিরণের বাবার মৃত্যুর সময় যখন কেউ এসে সাহায্য করবার ছিল না, সেদিনও ওরাই এগিয়ে এসেছিল। আজও এলো ছিটে-ফোঁটা। কাছেই বাড়ি। তবু খবরটা পেয়েই গাড়ি চড়ে চলে এসেছে। নতুন গাড়ি। বেশ ভব্যিযুক্তভাবে গম্ভীর মুখে দীপঙ্করের কাছে এল। কেমন করে মারা গেলেন দিদি, কী হয়েছিল, কোন্ ডাক্তার দেখছিল। যা যা প্রশ্ন করা উচিত, সেই সব প্রশ্নই করলে। তারপর খানিকটা সান্ত্বনাও দিলে। যেমন সান্ত্বনা দেওয়া উচিত। সেদিন আর অন্য প্ৰসঙ্গ তুললে না। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে তদারক করলে গম্ভীর হয়ে এদিক-ওদিক দেখলে, তারপর এক সময়ে চলেও গেল। তারা যেন অনেক গম্ভীর হয়ে গেছে। তারা যেন সমাজের একজন হয়েছে। কিন্তু তারা জানতে পারেনি যে দীপঙ্করের সেদিন কোন সহানুভূতি, কোন সাহায্য, কোনও চোখের জলেরই প্রয়োজন ছিল না। আশ্চর্য, মায়ের মৃত্যু যে সে এমন করে সহ্য করতে পারবে, তা কি সে নিজেও আগে জানতো?

নির্জন ঘরের দরজা-আঁটা নিরিবিলিতে দীপঙ্কর সেই কদিন যেন আপন সত্তার বড় মুখোমুখি হয়ে পড়েছিল। মনে হয়েছিল এতদিনের জীবনে কী তার হয়েছে, আর কী তার হয়নি! কী পেয়েছে আর কী-ই বা সে পায়নি! আর পাওয়ার কথার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হয়েছিল চেয়েছিলই বা সে কী? কোন্ চাওয়াকেই চরম চাওয়া বলে ভেবেছিল সে?

—বাবু!

যখন একেবারে নিঃসঙ্গ একেবারে নিরাসক্ত হয়ে দীপঙ্কর নিজেকে নিয়ে উন্মত্ত হয়ে ওঠে, ঠিক তখনই কাশীর কথা মনে পড়ে। কাশীই যেন মার মৃত্যুতে বেশি শোক পেয়েছে। দীপঙ্করের চেয়েও বেশি। কত বকতো মা, কত শাসন করতো কাশীকে। তবু কাশী বুঝতো এ-সংসারে এই একটি লোকের কাছেই তার মান-অভিমান-অত্যাচার- আবদার সব কিছু খাটে। একটা বেড়াল-কুকুর পর্যন্ত তা বুঝতে পারে আর কাশী বুঝবে না! কাশীও তো দীপঙ্করের মতই। কাশীও হয়ত দীপঙ্করের মত সমস্ত কিছু অনুভব করে, শুধু দীপঙ্করের মতই বলতে পারে না মুখ ফুটে। এ-সংসারে চেয়ে নিতে না জানলে যে কিছু পাওয়া যায় না, কাশী বোধহয় তা বোঝে না।

—খাওয়া হয়েছে তোর কাশী?

কাশী বলে—হ্যাঁ—

—পেট ভরেছে তো? কী খেলি?

কাশীর পেট ভরেছে। কী কী খেয়েছে তারও তালিকা দেয়। দীপঙ্কর বলে—পেট না-ভরলে দিদিমণিকে বলবি, বুঝলি? এখন তো আর মা নেই! আর পেট না-ভরলে আমাকেও বলতে পারিস।

কাশী বললে—চার আনা পয়সা দেবেন বাবু, —

—পয়সা কী করবি?

আর কথা বলে না। আর কোনও উত্তর নেই মুখে। একেবারে মুখ বন্ধ।

পয়সা কী করবি বল্ না? কিছু খাবি? ক্ষিদে পেয়েছে?

কাশী বললে—না—

—তবে?

কাশী বললে-সন্তোষ-কাকা চেয়েছে—

এতক্ষণ সন্তোষ-কাকা কোথায় ছিল কে জানে। হয়ত লুকিয়ে-লুকিয়ে সব শুনছিল। একেবারে ঘরের মধ্যে ঢুকে কাশীকে এই মারে তো সেই মারে—। বলে—আমি চেয়েছি পয়সা? পয়সা আমি চেয়েছি? মিছে কথা বলবার আর জায়গা পাওনি তুমি?

বলে কাশীকে প্রায় মারবার যোগাড়। দীপঙ্কর থামিয়ে দিলে। বললে—আপনার পয়সার দরকার থাকলে, আমার কাছেই চাইতে পারতেন। আর চাইবার দরকারই বা কী! আমার পয়সা-কড়ি কোথায় থাকে তা তো জানেন, যা-দরকার নিয়ে নিলেই পারেন—

সন্তোষ-কাকা তখনও হৈ-চৈ করছে। বললে—কথা তো তা নয়, তোমার পয়সা আর আমার পয়সা কি আলাদা? কিন্তু বেটা মিথ্যে-কথা বলবে কেন? ও কে?

—যাক্ যাক্ ওকে আর বকবেন না আপনি। আপনার যা দরকার হয়, আপনি আমার কাছে বলবেন, আমি দিয়ে দেব।

সন্তোষ-কাকা বললে—না বাবাজী, হয়েছে কী তবে শোন—

দীপঙ্কর বললে—যাক্, কাকাবাবু আর বলতে হবে না, আমি বুঝেছি,

সন্তোষ-কাকা বললে—তুমি ছাই বুঝেছ, বুঝলে আমার এই নরক-যন্ত্রণা! আমি মেয়ের বিয়ে নিয়ে পাগল হয়ে আছি, আমার মাথার ঠিক নেই, বুঝলে বাবাজী, মাথার ঠিক নেই আমার! পাড়ার সব লোকে জিজ্ঞেস করে, কই, এবার তো আপনার বৌদি মারা গেল দত্তমশাই, এবার কবে বিয়ে হচ্ছে আপনার মেয়ের! তা আমি আর কী বলবো বলো? আমার কি বলবার মুখ আছে? বৌদি থাকলে তবু জোর করতে পারতুম, এখন তুমি কি আর আমার কথা শুনবে? তুমি বড় মাইনের চাকরি করো, তুমি আমার ক্ষিরিকে বিয়ে করবে কেন? এখন আমাদের যাবার বন্দোবস্ত করে দাও—আমরা রসুলপুরে চলে যাই—

আজকাল সন্তোষ-কাকা এই বুলি ধরেছে। বলে—তুমি ক্ষিরিকে বিয়েও করবে না, আবার রসুলপুরে যেতেও দেবে না, এ তো মহা জ্বালা হলো দেখছি আমার—

রাস্তায় চেনা লোকের সঙ্গে কথা হলেই বলে—চললুম, বুঝলেন বাঁড়ুজ্জে মশাই। এবার চললুম কলকাতা ছেড়ে, আপনাদের কলকাতা শহর খুব দেখা হলো—যথেষ্ট শিক্ষা হলো আমার, হয়রানি যা হলো তা আর কহতব্য নয়—

তারা বলে—সে কি, মেয়ের বিয়ে দেবেন না? মেয়ের বিয়ে দিতেই তো এসেছিলেন এখানে—

সন্তোষ-কাকা বলে—না মশাই, কলকাতার লোকদের আমার খুব চেনা হয়ে গেছে, কলকাতা শহরে আমার মেয়ের বিয়ে দেব না—গরীবের মেয়ে বলে কি ফ্যানা নাকি?

—কেন? কী হলো? মেয়ে পছন্দ হলো না?

সন্তোষ-কাকা রেগে যায়। বলে—মেয়ে পছন্দ হলো না মানে? আমারই জামাই পছন্দ হলো না মশাই। এদিকে আমিও বিয়ে দেব না, ওদিকে ছেলেও ধরে বসেছে এই মেয়েকেই বিয়ে করবে! আমি বলেছি—না, ছেলের শ্বশুর-শাশুড়ী নেই, এখানে বিয়ে দেব না আমার মেয়ের। এখন এই দো-টানার মধ্যে পড়ে মুশকিল হয়েছে যত আমার —

শেষকালে অবস্থা আরো চরমে উঠলো। সন্তোষ-কাকাকে দেখলেই রাস্তার ছেলেরা ক্ষেপায়।

বলে—এই বুড়ো, পান্তুয়া খাবি?

প্রথম-প্রথম গা করতো না সন্তোষ-কাকা। বলতো—দে না পান্তুয়া, দে না কটা পান্তুয়া দিবি দে, খাচ্ছি—

ছেলেরা দূর থেকে সে-কথার উত্তর না দিয়ে শুধু বলতো—এই বুড়ো পান্তুয়া খাবি? শেষের দিকে তেড়ে তেড়ে যেত সন্তোষ-কাকা। ছেলেগুলো সন্তোষ-কাকার তাড়া খেয়ে পাঁই পাঁই শব্দে দৌড়ে পালাতো।

সন্তোষ-কাকা দূর থেকে সেই দিকে চেয়ে চেয়ে বলতো—আমাকে পাগল পেয়েছিস নাকি? আমি পাগল? আমার সঙ্গে ইয়ারকি? বাপের সঙ্গে ইয়ারকি দিতে পারিস না? যত সব পাগলের ডিম্ কোথাকার—

.

মিস্টার ঘোষালের কাছে এসে এস্টাবলিশমেন্ট ক্লার্ক ফাইল নিয়ে দাঁড়ায়। বলে— স্যার, মিস্ মাইকেলের ভেকেন্সিটা খালি পড়ে রয়েছে অনেক দিন—ওটার কী করলেন?

মিস্টার ঘোষালের কাজের অন্ত নেই। বললেন—এখন না, পরে হবে—

ক্লার্কটা বলে—কবে আসবো স্যার—

মিস্টার ঘোষাল রেগে গেলেন। বললেন—নট্‌ নাউ—আমি পরে দেখবো—

তারপর হঠাৎ মুখ তুলে বললেন-হোয়েন ইজ্ মিস্টার সেন ডিউ? মিস্টার সেন কবে জয়েন করছে?

ক্লার্ক বললে—টুয়েনটি সেভেন্‌থ্—

—অল্-রাইট্, আই শ্যাল্ সী টু ইট্‌—

আজকাল বিকেল হতে-না-হতেই মিস্টার ঘোষাল বড় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। আগে ছ’টা সাতটা পর্যন্ত কাজ করেও কুলিয়ে উঠতে পারতো না। পার্টির ভিড় লেগেই থাকতো সারাদিন। একদলের পর আর একল ঢুকছে। দল-দল লোক। বড়-বড় গাড়ি এসে দরজার সামনে দাঁড়াতো। আর সব গিয়ে ঢুকতো ঘোষাল সাহেবের ঘরে।

দ্বিজপদ সেলাম করতে করতে মাথা বেঁকিয়ে ফেলতো। বলতো-সেলাম হুজুর- কিন্তু ইদানীং মিস্টার ঘোষাল পাঁচটা বাজতে না বাজতেই উঠে পড়ে। লোক এসে ফিরে যায়। হায়-হায় করে দ্বিজপদ। এত লোকজন এত লোকসান সহ্য হয় না দ্বিজপদর। বলে শুয়োরের বাচ্চা—

বলে—শুয়োরের বাচ্চা নিজেরও লোকসান করছে, আমারও লোকসান করছে- শালা আমার লোকসানেরই বরাত কেবল—

কিন্তু সেদিন দ্বিজপদও থর-থর করে কাঁপতে লাগলো। ভেতরে সাহেব টেলিফোনে যেন কার সঙ্গে খুব জোরে-জোরে কথা বলছে। টেলিফোনটা নিয়ে যেন যুদ্ধ করছে ঘোষাল সাহেব। দ্বিজপদ উঁকি মেরে দেখতে লাগলো ভেতরে। ইংরিজী কথা, কিছুছু বোঝা যায় না এক বর্ণ। ইংরিজীতে যেন কার সঙ্গে ঝগড়া করছে। এক মিনিট দুমিনিট নয়, অনেকক্ষণ ধরে।

একজন পার্টি এসেছিল। দ্বিজপদ বললে—সেলাম হুজুর—

অনেকবার বকশিশ দিয়েছে দ্বিজপদকে। এর অনেক নুন খেয়েছে দ্বিজপদ আগে। বললে—একটু দাঁড়ান হুজুর, সাহেব টেলিফোনে বাত করছে—

দেখতে-দেখতে আর একটা পার্টি এসে হাজির হলো। আর একজন পার্টি। দ্বিজপদ সকলকেই সেলাম করলে। বললে—একটু সবুর করুন হুজুর, সাহেব টেলিফোনে জরুরী বাত করছে—

কিন্তু ঘোষাল সাহেবের জরুরী বাত আর শেষ হতে চায় না। ঘোষাল সাহেবের হাউ-হাউ চিৎকার বাইরে থেকেও শোনা যাচ্ছে। হৈ-চৈ পড়ে গেল আপিসে। সবাই বুঝলে ঘোষাল সাহেব রেগে গেছে কার ওপর। রেগে রেগে কার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলছে।

তারপরেই দড়াম করে রিসিভারটা ফেলে দিলে ছুঁড়ে। রাগে তখন ঘোষাল সাহেব দিক্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি গায়ে পরে নিলে কোটটা। চুরোটটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ডাকলে—চাপরাসী—

দ্বিজপদ দৌড়ে ভেতরে ঢুকলো।—হুজুর —

—আবি যাতা হ্যায় —

—ঠিক আছে হুজুর।

তার মানে আজ আর কোনও কাজ হবে না। আজকে লোকসানের বরাত। শালা, শুয়োরের বাচ্চা। নিজেরও লোকসান করছে, চাপরসীরও লোকসান করছে—শালা লোকসানেরই বরাত কেবল! ঘোষাল সাহেব সুইং-ডোরটা ঠেলে গট গট্ করে বেরিয়ে গেল সদর রাস্তার দিকে।

পার্টিরা যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তারা প্রাণের দায়ে এগিযে গেল।

—গুড মর্নিং স্যার—

ঘোষাল সাহেব দেখেও দেখলে না। সামনের দিকে সোজা চলতে চলতে চুরোটের ধোঁয়া ছাড়লে। দাঁতের ফাঁক দিয়ে শুধু বললে—নট্‌ নাউ—

তারপর গাড়ির ভেতরে উঠতেই দ্বিজপদ দৌড়ে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল। বললে—সেলাম হুজুর—

ঘোষাল সাহেব ড্রাইভারকে বললে—ঘর চলো, জলদি—

ঘর-ঘর আওয়াজ করে গাড়িটা ছেড়ে দিল। দ্বিজপদ খানিকক্ষণ সেইখানে দাঁড়িয়েই সাহেবের মুন্ডপাত করতে লাগলো। সারাদিনে মাত্র কুড়িটা টাকা রোজগার, আর ঘন্টা দুই সাহেব থাকলেই আরো কুড়ি টাকা রোজগার হয়ে যেত! শালা শুয়োরের বাচ্চা, শালা হারামির বাচ্চা….

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *