কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫

সেদিনও আপিসের মধ্যে নিজের কাজের মধ্যে ডুবে ছিল দীপঙ্কর। মধু এসে বললে—মাইকেল মেমসাব—

মিস্ মাইকেল হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকলো। বললে—হাউ ডু ইউ ডু মিস্টার সেন?

বলে গাউনটা গুটিয়ে একটা চেয়ারে বসলো। দীপঙ্কর চেয়ে দেখলে মিস্ মাইকেলের দিকে। বললে—তোমাকে আর চেনা যাচ্ছে না মিস্ মাইকেল, তুমি একেবারে বদলে গিয়েছ—

সত্যিই বদলে গিয়েছিল মেমসাহেব। চুলগুলো কুঁকড়িয়ে ফেলেছে। কোঁকড়ানো চুলগুলো ফুলে ফুলে মাথার চারদিকে কেমন ফুলের মত ফুটে রয়েছে। ম্যাসাজ করে করে ফিগারটাকেও অন্য রকম করে ফেলেছে। যেন আরো মিষ্টি হয়েছে, আরো নরম হয়েছে, আরো বয়স কমিয়ে ফেলেছে। আরো সুন্দরী হয়েছে। গাল দুটো নতুন কসমেটিকস্ মেখে আপেলের মত রঙ্গিন করে ফেলেছে। মৌসুমী ফুলের মত বাহার নিয়ে ঘরে ঢুকেছে মিস্ মাইকেল।

—মেনি থ্যাঙ্কস্ মিস্টার সেন। আমি চেক্ ক্যাশ্ করে ফেলেছি।

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—কোনও অসুবিধে হয়নি তো?

—না, কোনও অসুবিধে হয়নি। প্রভিডেন্ট ফান্ডে আমার জমেছিল টোট্যাল পনেরো হাজার টাকা। আর আমার কাছে ক্যাশ আছে তিন শো—এই আমার ক্যাপিটাল।

দীপঙ্কর বললে—তোমার জাহাজ ভাড়াও তো লাগবে অনেক—

মিস্ মাইকেল বললে—তা যা লাগবে তা তো লাগবেই, তারপর ভিভিয়ান্ আছে, দরকার হলে সে-ই দেবে। তার তো অনেক টাকা। তার টাকার শেষ নেই এখন—

দীপঙ্কর বললে—তোমার যদি কিছু টাকার দরকার থাকে তো আমি তোমাকে কিছু সাহায্য করতে পারি—

মিস্ মাইকেল ধন্যবাদ দিয়ে বললে—নো থ্যাঙ্কস্ মিস্টার সেন, আই শ্যাল্ রিমেমবার ইউ, তোমাকে চিরকাল আমি মনে রাখবো, আমি জীবনে যদি কাউকে মনে রাখি তো সে তোমাকে মিস্টার সেন—যখন হলিউডে গিয়ে ফিল্ম-ডম এর মধ্যে সব

স্মৃতি মুছে যাবে, তখনও তোমাকে ভুলবো না আমি—

দীপঙ্কর বললে—মিস্টার ঘোষালের সঙ্গে দেখা করে এসেছ?

মিস্ মাইকেল বললে—হ্যাঁ, আমার জায়গায় এখনও কাউকে অ্যাপয়েন্ট করেনি। দীপঙ্কর বললে—তোমার জায়গায় আবার কে আসবে জানি না, হয়ত এমন মেয়ে আসবে যার সঙ্গে ঠিক তোমার মত বনিবনা হবে না। সেই প্রথম যখন চাকরিতে ঢুকি, তখনই তোমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সে-সব দিনের কথা আমারও চিরকাল মনে থাকবে—! তুমি তোমার ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়েছিলে আমাকে, সে-সব কথা কখনও ভুলবো না—

—তাহলে আসি মিস্টার সেন?

দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে উঠলো। গাঙ্গুলীবাবু কাশ্মীর চরে গেল। মিস্ মাইকেলও চলে যাচ্ছে। গাঙ্গুলীবাবু তবু ফিরবে। কিন্তু মিস্ মাইকেল আর ফিরবে না। সাত সমুদ্র তের নদীর ব্যবধান অতিক্রম করে একেবারে সুদূর হয়ে যাবে। একেবারে সূদূর। আর ইন্ডিয়ার কথা ভাববে না। ইন্ডিয়ার নামও ভুলে যাবে হয়ত। যতই মুখে বলুক, সেখানে একবার গেলে কেউ কি ইন্ডিার কথা মনে রাখে? তখন আর টাইপিস্ট-গিরি করতে হবে না, তখন আর চাকরির জন্যে সকাল ন’টার মধ্যে আপিসে আসার জন্যে দৌড়তে হবে না! আহা, ভালো হোক। শুধু মিস্ মাইকেলের নয়, সকলেরই ভালো হোক। সুখী হোক মিস্ মাইকেল। সকলের ভালো হলেই যেন দীপঙ্করের ভালো হবে!

—হাউ ইজ্ ইওর মাদার? তোমার মা কেমন আছে?

দীপঙ্কর বললে—সেই রকমই, মা’কে নিয়ে বড় ভাবনায় পড়েছি—কী যে করি—

মিস্ মাইকেল সান্ত্বনা দিলে। বললে—কিছু ভেবো না মিস্টার সেন, গড় উইল্ লুক্ আফ্‌টার হার—

তারপর আস্তে আস্তে মিস্ মাইকেল ঘরের বাইরে চলে গেল। যাবার সময় বললে—তোমাকে চিঠি দেব, জাহাজ থেকেই চিঠি দেব—অলরাইট্—ও কে—

মিস্ মাইকেলের চলে যাবার পর কিছুক্ষণ দীপঙ্কর কিছুই কাজ করতে পারেনি। তার মনে হলো একটা-একটা করে সমস্ত দরজাগুলো যেন তার খুলে যাচ্ছে। সন্ধ্যেবেলা পর্যন্ত কোনও দিকে কোনও হিসেব রইল না তার। ফাইলের পর ফাইল যেন হাওয়ায় উড়ে চললো। কাজগুলোর যেন পাখা আছে। ঘরের বাইরে মিস্ত্রি খাটছে সমস্ত দিন- রাত। তাদের খট-খট্ শব্দ হচ্ছে ব্যা-ওয়াল্ তৈরি হচ্ছে চারদিকে। সারা পৃথিবীতে যুদ্ধের তোড়-জোড় চলছে।

.

মিস্ মাইকেলের ঘরে তখন সন্ধ্যে উতরে গেছে। বহু দূরে যাত্রা! আর বেশি দেরি করা চলবে না। এখন তো সবে যুদ্ধ আরম্ভ। শেষকালে অ্যালান্টিক ওস্যান্ বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। শেষকালে যদি ইটালি যুদ্ধে নামে তখন আরো ভয়ানক কান্ড হয়ে যাবে! হিটলার তার বইতে লিখেছে—

He who wants to live should fight and he who does not want to battle in this world of eternal struggle does not deserve to be alive. In eternal warfare mankind have become great in eternal peace mankind would be ruined.

রাস্তায় ট্রামে বাসে লোকে আলোচনা করে—এবার মশাই ইংরেজরা জব্দ হবে—বড় বাড় বেড়েছিল শালাদের—

ওপাশের কোণ থেকে একজন গলা বাড়িয়ে বলে—কলকাতার একটা ইঁট পর্যন্ত আস্ত থাকবে না, দেখে নেবেন, গুঁড়ো হয়ে যাবে সমস্ত শহর, এই বলে রাখলুম—

—যদি পারেন তো কিছু চাল কিনে ঘরে স্টক্ করে রাখুন মশায়, শেষকালে খেতে পাবেন না এমন দিন আসছে—

দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার পড়ে গেছে—গুজবে কান দিবেন না।

দুনিকাকার আড্ডায় পঞ্চারা আবার জটলা পাকায়। একখানা খবরের কাগজ নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। কাগজখানা খুলেই চিৎকার করে ওঠে।

—ওরে বাব্বা, এবার হিটলার লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে ছাড়বে রে বাবা!

বলে এক মনে কাগজের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। নিঃশ্বাস ফেলবার সময় নেই কারো। কংগ্রেস মিনিস্ট্রি ছেড়ে দিয়েছে আটটার মধ্যে সাতটা প্রভিন্সে। সবাই হাঁ করে চেয়ে আছে মহাত্মা গান্ধীর দিকে। সুভাষ বোসের দিকে। কারো আর টু শব্দটি করবার ক্ষমতা থাকবে না। চারদিকে স্পাই ঘুরে বেড়াচ্ছে মশাই। আস্তে আস্তে কথা বলুন। দুনিকাকা বলে—না, তোদের জ্বালায় দেখছি আমার চাকরিটা যাবে—

বলে আড্ডা ছেড়ে বাড়ি পালিয়ে যায়।

দিল্লীতে স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস সাহেব এসে গেছে। ওদিকে লড়াই চলছে লাফিয়ে লাফিয়ে। আপিস থেকে লোকেরা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যায় সব। সকলেই ভয় পেয়ে গেছে। এবার জোর করে সব লড়াইতে নিয়ে গিয়ে গরুর মাংস খেতে দেবে, শুয়োরের মাংস খেতে দেবে। তখন?

প্রথমে স্টেশনারী দোকান থেকে কিছু প্রভিশন কিনে নিয়েছিল মিস্ মাইকেল। টফি লজেঞ্জ, ওয়াইন। আরো অনেক টুকি-টাকি। নিউ মার্কেটের ফ্রুটস্। বোম্বে মেলের কামরায় বসে খেতে খেতে যাবে। প্রায় আড়াই দিন ট্রেনে কাটবে। তারপর বোম্বের ভি-টিতে পৌঁছে সেখান থেকে জাহাজ। হিল্ তোলা কিড়-সু। সবাই তার চেনা। জীবন কেটে গেল এই পাড়ায়। শেষবারের মত দেখে নিলে চারদিকে চেয়ে। ওইটে গ্রোসারি। ওই দোকান থেকে কতদিন কত জিনিস কিনেছে মিস্ মাইকেল।

—মেমসাব!

দোকানের ভেতর থেকে গণি মিয়া ডাকলে। মিস্ মাইকেল হাসতে হাসতে কাছে গেল।

গণি মিয়া বলেন—কিছু গস্ত করবেন না মেমসাব?

মিস্ মাইকেল হাসলো। বললে—আই অ্যাম গোইং গণি—গোইং হোম্‌—

গণি মিয়া বুঝতে পারলে না। বললে—হোম্‌ মানে?

—হলিউড! আমেরিকা। আমার ফ্রেন্ড, ভিভিয়ান লে সেখানে থাকে, ফেমাস ফিল্‌ম্‌ স্টার, সে চিঠি লিখেছে—

—আবার কবে আসবেন মেমসাব?

মিস্ মাইকেল বলে—আর আসবো না গণি, আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি, এবার ফিল্‌ম্ স্টার হবো–তোমার সব লোন্ তো ক্লিয়ার্ড—

সকলের সব দেনা ক্লিয়ার করে দিয়েছে মিস্ মাইকেল। নিউ মার্কেট থেকে কিছু কেক্ পেস্ট্রি কিনে নিলে। আজ যেন সকলকে ভাল লাগতে লাগলো। হাউ সুইট্, হাউ নাইস্ দিজ্‌ পিপল্‌।

—চললুম মূলজী—

মূলজী মুখ তুলতেই মেমসাহেবকে দেখে ডাকলে—আইয়ে মেমসাব, আইয়ে—

হাতে একদাগা প্যাকেট। ভ্যানিটি ব্যাগ। সামনে এগিয়ে গিয়ে মিস্ মাইকেল বললে—চললুম মূলজী, হাম যাতা হ্যায় —

—কোথায় যাচ্ছেন মেমসাব!

তুমি জানো না? আমেরিকায় যাচ্ছি যে, হলিউডে, দি গ্রেট্‌ হলিউড্। আমার ফ্রেন্ড্ ভিভিয়ান লে, ফিল্‌ম স্টার, সে-ই আমাকে চিঠি দিয়েছে—এই দ্যাখ, চিঠি দেখ—

বলে পকেট থেকে ভিভিয়ানের চিঠিটা বার করলে। যেন চিঠি না-দেখালে বিশ্বাস হবে না কারো। ইংরিজী চিঠি, মূলজীর বুঝতে পারার কথা নয়। দূর থেকে দেখে হাসলো শুধু। আনন্দের হাসি, অভিনন্দনের হাসি। মিস্ মাইকেল চলে যেতে যেতে বললে—আমি তোমাদের ভুলবো না মূলজী, আই উইল্ রিমেম্বার ইউ অল্—তোমরা সবাই এত ভাল—

মেমসাহেব চলে গেল। মূলজী পাশের লোককে বললে-মাগীটা খুব মদ খেতে পারতো ভাই, খুব দিল-দরিয়া ছিল, দিনরাত ছোকরাদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করেছে এককালে—

পাশের লোকটা বললে—আরে ভাই ও-বেটীদের কথা ছেড়ে দাও, ওরা হলো রাজার জাত, ওরা আমেরিকায় যাবে না তো যাবে কারা?

শুধু গণি মিয়া নয়। শুধু মূলজী নয়। মাটওয়ালা, ভেজিটেব্লওয়ালা, বাটারওয়ালা সকলের কাছে গিয়ে গিয়ে দেখা করে এল মিস্ মাইকেল। কাল থেকে আর কারো সঙ্গে দেখা হবে না। কাল ইন্ডিয়া ছেড়ে যাওয়া। এতদিনের সব পরিচয়। এতদিন অহঙ্কারের কারোর সঙ্গে ভালো করে কথা বলেনি। আজ যেন সবাইকে জানিয়ে যেতে ইচ্ছে হলো। তার আনন্দের খবরটা কাউকে না জানালে যেন তৃপ্তি হচ্ছে না। তার নিজের আনন্দটা সকলের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ভোগ করতে ইচ্ছে করছে।

আর দেখা হবে না তোমার সঙ্গে হুকুমালী!

—কেন মেমসাব।

—ও, তুমি জানো না বুঝি? আমি তো আমেরিকায় যাচ্ছি, হলিউড্। হলিউডের নাম শুনেছ? যেখানে ফিল্‌ম্ বানায়?

—খুব শুনেছি মেমবাস

—আমি সেইখানে যাচ্ছি। ভিভিয়ান লে’র নাম শুনেছ তো? সেই ভিভিয়ান আমায় চিঠি দিয়েছে, এই দেখ চিঠি? সে আমার খুব ইন্টিমেট্ ফ্রেন্ড্—

হুকুমালী এ-পাড়ার নাম করা টেলার। মাস্টার টেলার। মেমসাহেবদের হরেক ডিজাইনের গাউন তৈরিতে পাকা হাত।

বললে—তাহলে আর আসছেন না মেমসাহেব?

—আর কী করতে আসবো বলো? আর তো আসবার দরকার নেই আমার। তবে আসবো বৈ কি। একেবারে পালিয়ে যাবো না। মাঝে মাঝে আসবো—

হুকুমালী বললে—মাঝে মাঝে এলে দেখা করবেন মেমসাহেব, আমি গাউন তৈরি করে দেব—

মিস্ মাইকেল খিল্‌ খিল্‌ করে হেসে ফেললে। বললে—তুমি রসিকতা বুঝলে না হুকুমালী, মাঝে-মাঝে আসবো বলে কি আর সত্যিই আসবো? আসবো এই গ্লোব- সিনেমায়, আসবো এলফিনস্টোনে, আসবো প্লাজায়! তোমরা টিকিট কাটলে আমাকে দেখতে পাবে! আমার সঙ্গে লিলিয়ান গিকে দেখতে পাবে, জেনেট গেইনরকে দেখতে পাবে! কারা বো’কে দেখতে পাবে—সবাই যে আমরা একসঙ্গে কাজ করবো—।

তারপরে একটু থেমে বললে—এই দেখ না, আপিস থেকে আজ প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলে নিয়ে এলুম—সারা জীবন চাকরি করে যা জমেছে সব

সকলের সঙ্গেই শেষবারের মত দেখা করা হয়ে গিয়েছে। বাড়ি আসার পথে হঠাৎ খেয়াল হলো একটা ভিখিরি রাস্তায় বসে বসে ভিক্ষে করছে। রোজই ওখানে বসে থাকে বেগারটা। ময়লা একটা ন্যাকড়া পেতে বসে থাকে। যার খুশি পয়সা ফেলে দিয়ে যায় ন্যাকড়ার ওপর। ভিখিরিটা অবাক হয়ে চেয়ে দেখলে মুখ তুলে।

—টুম্ লেও, টুম রুপেয়া লেও—

ভিখিরিটার তখন কৃতজ্ঞতায় বিগলিত অবস্থা। বললে–আপ্ রানী হোগা মেমসাব—

মিস্ মাইকেলের হাসি এল। বললে—রানী নেহি, ফিল্‌ম্ স্টার। ফিম্ স্টার জান্তা? ভিভিয়ান লে’কা নাম শুনা হ্যায়?

রাস্তার নিঃসম্বল ভিখিরি কোনও খবরই রাখে না, এ পেটের খবর ছাড়া! মিস্ মাইকেল চলে যেতে যেতে বললে—তোমার আচ্ছা হোগা, গড ব্লেস্ ইউ পুওর সোল্ —

ভিখিরিটা জানতেও পারলে না, কোন্ ঘটনার সূত্রে আজ তার ছেঁড়া ন্যাকড়ার ওপর এমন ভাগ্যোদয় হলো। এমন ঘটনা তার জীবনে কখনও ঘটেনি! আর কার জীবনেই বা ঘটেছে! কজনই বা রেলের চাকরি ছেড়ে ভিভিয়ান লে হতে পারে? ভিভিয়াই ইতিহাসে প্রথম। তার পরেই মিস্ মাইকেল! কিড্‌-সু টক্‌টক্ শব্দ করতে করতে গিয়ে উঠলো নিজের ফ্ল্যাটের কাঠের সিঁড়িতে।

—ট্রা-লা-লা-লা-লা—

কিড্‌-সু শিস দিতে দিতে গান গাইতে গাইতে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে লাগলো সিঁড়ি দিয়ে। ওপর থেকে অন্য ফ্ল্যাটের মেয়েরা নামছে। বেয়ারা, খানসামা, আয়া, দালাল—সকলেই ব্যস্ত। প্রত্যেক দিনের মত আরম্ভ হয়েছে সন্ধ্যেবেলার ব্যবসা। পিয়ানোর আওয়াজ ভেসে আসছে অন্য কার ফ্ল্যাট থেকে।

—হ্যাল্লো জেনি!

মিস্ মাইকেল দেখেই হেসে উঠলো। তিনতলার মেয়ে ডরোথি।

—গেটিং রেডি?

মিস্ মাইকেল বললে—এভরিথিং কমপ্লিট্। কেনা-কাটা শেষ। এখন খালি রেস্ট। এখন ব্যাস্‌ আর ব্যাগেজ গুছোতে হবে।

ডরোথি বললে—কাল কটার সময় ট্রেন?

—এইট্‌ থার্টি!

ডরোথি কী যেন ভাবলে। বললে—আমারও এ-লাইফ আর ভালো লাগে না জেনি। আই অ্যাম্ ডগ্‌টায়ার্ড। আমাকেও তুমি নিয়ে চলো জেনি। আই অ্যাম টায়ার্ড অব্ ক্যালকাটা।

—মিস্ মাইকেল বললে—বাট্ লেট মি গো ফার্স্ট। আমি আগে যাই—আমি সেখানে গিয়ে আগে সেল করি, তারপরে তোমাকে চিঠি লিখবো—

—ভুলে যাবে না তো?

মিস্ মাইকেল বললে—ভুলে যাবো কেন? আই উইল রাইট টু ইউ—আমি কথা দিচ্ছি চিঠি লিখবো―!

হঠাৎ নিচেয় খুব জোরে কে যেন শিস দিয়ে উঠলো। ডরোথি শুনেই বললে—সো লং জেনি, সো লং—

বলে লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে নিচেয় নামলো। ডরোথির বয়-ফ্রেন্ডরা তখন মোটর বাইক নিয়ে এসে হাজির হয়েছে। মিস্ মাইকেল নিজের দরজার চাবি খুললে। আয়াকে ছাড়িয়ে দিয়েছে আগেই। দরজাটা খুলতেই একটা ড্যাম্প হাওয়া নাকে এসে লাগলো। তবু শীতের মধ্যে থেকে ঘরে এসে আরাম হলো একটু। হলিউড্ আরো কোল্ড। ঘরে ঢুকে আলো জ্বাললে। জ্বেলে দরজাটা বন্ধ করে দিলে। তারপর আড্রেস করতে লাগলো। একটা গুন্ গুন্ করা সুর বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে। তারপর মুখে চোখে সাবান দিয়ে আয়নার সামনে এসে চুলটা ঠিক করতে লাগলো। কাল এতক্ষণে ট্রেনে। সেকেন্ড্ কাস কম্পার্টমেন্টে নিরিবিলি বার্থ। লেডিজ্ কামরা। এতক্ষণ ট্রেন ছেড়েছে। গুড্‌ নাইট্, গুড্‌ নাইট্ ইন্ডিয়া!

ব্যাগ থেকে টাকাগুলো আবার বার করলে। কাল এক্সচেঞ্জ করে নিতে হবে ব্যাঙ্কে গিয়ে পনেরো হাজার টাকা! হান্ড্রেড্ রুপীর নোট আর হাজার টাকার নোট! আর স্মল্ কয়েনস্ কিছু। ট্রেনে লাগবে, জাহাজে লাগবে টিপ্‌স্‌ দিতে। টাকাগুলো একে একে গুনতে লাগলো। আসলে কত টাকা সঙ্গে রইল জেনে রাখা ভাল।

—খুট্!

—হুজ্ দ্যাট্? কে?

দরজায় কে যেন নক্ করলে। আবার জিজ্ঞেস করলে—কে?

মনে হলো আয়াটা আবার এসেছে। বহুদিনের আয়া। যাবার আগে আর একবার দেখা করতে চায়।

মিস্ মাইকেল টাকাগুলো আড়াল করে দরজাটা একটু খুলল। না কেউ নয়। মনের ভুল। মিস্ মাইকেল আবার সুর ধরলো—ট্রা-ল্লা-লা-লা—! সেই চিঠিগুলো বার করলে। ফাইভ হান্ড্রেড্ থার্টিন লাভ লেটার্স। সিল্কের রুমালে জড়ানো। দামী সেন্টের গন্ধ ভাসছে বাতাসে। বেঁচে থেকে সুখ আছে পৃথিবীতে। ট্রা-লা-লা-লা। তারপর? তারপর গুড নাইট্, গুড্‌ নাইট্ ইন্ডিয়া—গুড্‌ নাইট—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *