কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১

আবার সেই আপিস। আবার সেই জীবন। নতুন চেয়ারে বসেও পুরোন আপিসের গন্ধটা যেন বিষিয়ে দেয় মনটাকে। মিস্টার ঘোষালের ঘরে বসেও দীপঙ্কর যেন পুরোন দিনগুলোর কথা ভুলতে পারে না। সকাল বেলার আবহাওয়াটা সমস্ত মনটাকে আচ্ছন্ন করে রেখে দিয়েছে। কখন ফাইলগুলো এসে জমা হয়েছে টেবিলের ওপর আবার কখন সেগুলো চলে গিয়েছে টেবিল থেকে যন্ত্রের মত। যন্ত্রের মত কাজ করে যায় দীপঙ্কর। যন্ত্রের মত আপিসের রেলগাড়ি গড়িয়ে গড়িয়ে যেন শুধু চলতেই জানে। থামতে জানে না। ট্রেনের তবু ড্রাইভার বদল হয়, ইঞ্জিন বদল হয়, গার্ড বদল হয়। ট্রেনের তবু বৈচিত্র্য আছে যাত্রায়। এ ডিস্ট্রিক্ট থেকে আর এক ডিস্ট্রিক্টে। এক ঋতু থেকে আর এক ঋতুতে। রোড-সাইড থেকে জংশনে, জংশন থেকে ব্র্যাঞ্চে। কিন্তু আপিসের যেন আর ঋতু বদল নেই। চেয়ার বদলালেও যেন আবহাওয়া বদলায় না।

ফাইলের মধ্যে চোখ নিবিষ্ট রেখেও যেন মন উড়ে যায় অন্য জায়গায়। যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে দৃশ্যটা। সতী যেন আপিসের ফাইলের ভিড়ের মধ্যেও উঁকি মারে। সতীর সেই মূর্তিটা ভেসে ওঠে চোখের ওপর। সতীর চোখে জল নেই। সতীর শরীরে প্রাণ নেই। সতী যেন কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখানেও। সতী যেন আকাশে বাতাসে অন্তরীক্ষে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। সতী যেন বলছে—আমি সব সহ্য করবো, আমি সকলকে ভুলে যাবো—আমার নিজের শিক্ষা, নিজের অস্তিত্ব কোনও কিছুরই দরকার নেই, সব আমি জলাঞ্জলি দেবো—আমি আত্মাঘাতী হবো—

জার্নাল সেকশ্যানের কে-জি-দাশবাবু চায়ের গেলাস থেকে মুখ তুলে নিয়ে বললে—ছোটবেলায় বইতে পড়েছি অতি বাড় ভাল নয় ঝড়ে পড়ে যাবে—কথাটা মিথ্যে নয় হে

রমেশবাবু জিজ্ঞেস করলে—কেন বড়বাবু, কী হলো?

—আরে, এই সেন-সাহেবের কথা ভাবছি। ওই যে, যে-চেয়ারটায় আপনি বসেছেন, ওই চেয়ারে একদিন বসেছে সেন-সাহেব। এই এনামেলের গেলাসে চা খেয়েছে, আর এখন সে-ই আমাদের সেন-সাহেব! একেই বলে বরাত—

রমেশবাবু জিজ্ঞেস করলে—খুব অহঙ্কার দেখলেন বুঝি?

—অহঙ্কার বলে অহঙ্কার। আগে তবু দেখা হলে হেসে কথা বলতো, আজকে একেবারে চিনতেই পারলে না হে! রবিনসন সাহেবের কুকুরকে বিস্কুট খাইয়ে হাতে একেবারে স্বর্গ পেয়ে গেছে। ফাইলটা নিয়ে ঘরে গেলুম, বললে—এখন নয় পরে—! এরই নাম টাকা! টাকার মহিমাই এমনি—

যোগেনবাবু বললে—কিন্তু লাটা খুব ভাল বড়বাবু! স্রেফ লাক্—

—লাক্ নয় যোগেনবাবু, লাক্ নয়, আমিও যদি অমন করে সাহেবের পায়ে তেল দিতে পারতুম তো আমারও লাক্ ফিরে যেত! তা যে কুষ্ঠিতে নেই আমার—

গাঙ্গুলীবাবু হঠাৎ ঘরে ঢুকতেই সব আলোচনা বন্ধ হয়ে গেল। গাঙ্গুলীবাবুর সঙ্গে সেন-সাহেবের ঘনিষ্ঠতার কথাটা কারোর অজানা নয়! কিন্তু শুধু জার্নাল-সেক্‌শ্যানই নয়। ট্র্যাফিক আপিসেও একই আলোচনা চলছে। রামলিঙ্গবাবু সেন-সাহেবের ঘর থেকে ফিরে এল মুখ কাঁচুমাচু করে।

রঞ্জিতবাবু জিজ্ঞেস করলে—কী হলো বড়বাবু, সিগনেচার দিলে সাহেব?

রামলিঙ্গম্বাবু বললে—নেহি, বোলা আবি নেহি, পিছে—

রঞ্জিতবাবু বললে—যে-যায় লঙ্কায় সে-ই হয়ে যায় বারণ! অথচ সেদিন পর্যন্ত অত ভাল লোক ছিল, আজকেই এমন হয়ে গেল! ও সেন-সাহেবের দোষ নয় বড়বাবু, ও চেয়ারেরই দোষ—

শুধু ট্র্যাফিক আপিসেই নয়। এস্টাব্লিশমেন্ট সেক্‌শানেও ওই আলোচনা চলছে। যারা পুরোন লোক তারা সেন-সাহেবকে একদিন ক্লার্ক হয়ে ঢুকতে দেখেছে এই আপিসে। ওই হৃদয় চাপরাসীকে নাকি জিজ্ঞেস করলেই টের পাওয়া যাবে। হৃদয় চাপরাসী কত পরটা পাঁঠার ঘুনি আর মাংসের চপ্ খাইয়েছে। ট্র্যাফিক আপিসের সুপারিন্টেন্ডেন্ট নৃপেনবাবুর লোক। যারা নতুন, তারা সব হাঁ করে গল্প শুনছে। ভাগ্য মশাই, সবই ভাগ্য! অথচ দেখুন না, আপিসে এক-একটা ক্লার্ক জন্ম কাটিয়ে দিলে এ- বি গ্রেডে। কেউ তাদের কথা ভাবেই না। কোথায় রইল আপনাদের এস্টাব্লিশমেন্ট ম্যানুয়েল্ আর কোথায় রইল কোল। কুকুরকে বিস্কুট খাওয়ানোর কথাটা বোগাস্! আসল হলো কুষ্ঠি। একাদশে বৃহস্পতি থাকলে অমন হয় সকলেরই!

আরে জানেন মশাই, আমি নিজের মুখে শুনেছি সেন-সাহেব ঝি-এর ছেলে। কালিঘাটের এক বামুনের বাড়িতে রাঁধুনীগিরি করতো ওর মা!

—কী বলছেন যা-তা, তাই কখনও হয়?

—হয় হয়, এ-দুনিয়ায় সবই হয় মশাই! জানে, মুসোলিনী মুচির ছেলে! বাপ জুতো সেলাই করতো রাস্তার ধারে বসে। আর জার্মানীর হিটলারই বা কী ছিল বলুন! ভিক্ষে করেছে এককালে! আরে, এ-খবর বিশ্বাস না হয় নৃপেনবাবু তো এখনও বেঁচে আছেন যান্ না, ছ’ পয়সা ট্রামের টিকিট কিনে দেখা করে জিজ্ঞেস করে আসুন না।

একে একে অনেকেই কনগ্র্যাচুলে করে গেছে সকাল থেকে। ইঞ্জিনীয়ারিং আপিস থেকে শুরু করে অডিট্ আপিস, সি-এম-ও আপিস, কন্ট্রোলার অব্ স্টোরস্। দূর থেকে শুধু চেনা-জানা। তবু দীপঙ্কর তাদের জাতে উঠেছে। দীপঙ্করের এখন থেকে অন্য মর্যাদা। এখন থেকে দীপঙ্কর আপিসের জগতে ব্রাহ্মণ। হ্যাভ্-নদের দল থেকে প্রমোশন পেয়ে হ্যাদের দলে উঠেছে। সমস্ত ক্লার্কদের স্বপ্নের মানুষ। এখন থেকে অন্য ক্লার্কদের উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে বিরাজ করবে। সবাই আঙুল দিয়ে দেখাবে তার দিকে। বলবেন—দেখ কী ব্রিলিয়ান্ট বয়! তোমরাও ভাল করে মন দিয়ে কাজ করলে একদিন সেন-সাহেব হতে পারবে! তোমরাও লেট্‌আওয়ার্স পর্যন্ত আপিসে কাজ করলে এই রকম প্রমোশন পাবে একদিন! কিন্তু দীপঙ্করের মনে হলো আসলে এত বড় ধাপ্পা হয়ত নেই। সমস্ত স্টাকে খাটিয়ে নেবার পক্ষে এত বড় ধাপ্পাবাজি হয়ত আর নেই। আপিসের য়্যাডমিনিস্ট্রেশন তাকে প্রমোশন দিয়ে একেবারে সোনার হরিণ বানিয়ে তুললে। সেই সোনার হরিনের প্রলোভনে কত রঘুবংশ ধ্বংস হবে কে জানে! নিজের ঘরের মধ্যে সোনার হরিণ সেজে দীপঙ্কর আত্মধিক্কারে আঁতকে উঠতে লাগলো বারবার! বাইরে বেরোতেও লজ্জা করতে লাগলো তার। আপিসের দেয়ালগুলোও যেন ওঁত পেতে আছে তাকে দেখবার জন্যে! গেটের দরোয়ান থেকে শুরু করে মেথর ঝাড়ুদার চাপরাসী পিওন—সকলের মুখে মুখে তার নাম। গেটের পাশে বিশিষ্টদের তালিকায় তার নামও আজ যোগ হয়েছে। রবিনসন সাহেবের নাম মুছে সেখানে লেখা হয়েছে মিস্টার ঘোষালের নাম। মিস্টার ঘোষালের জায়গায় তার। অথচ ভাবলেও অবাক হতে হয় কেমন করে কোন্ যোগ্যতার বাহন হয়ে সে এখানে এসে চেয়ার জুড়ে বসলো। কোথায় তার কৃতিত্ব! সে কি বেশি কাজের? সে কি বেশি পরিশ্রমী! সে কি বেশি লেখা-পড়া জানে! সে কি যোগ্যতম ব্যক্তি বলেই এই পোস্ট পেয়েছে, না উঁচু পোস্ট পেয়ে সে যোগ্য হয়েছে! তাহলে কি সংসারের সব পদ-মর্যাদার মূলেই এই? এই ধাপ্পাবাজি? আপিসের স্টাফ্ আজ কনগ্র্যাচুলে করছে কাকে? তাকে না তার চেয়ারকে? কিন্তু এমন তো একদিন আসবে যেদিন এই চেয়ার থেকে তাকে সরে দাঁড়াতে হবে। সেদিন?

সেই নৃপেনবাবু! সেই ট্র্যাফিক আপিসের সুপারিনটেন্ডেন্ট নৃপেনবাবু! পাড়ায় ধুতি কামিজ পরেন। গামছা নিয়ে ময়লা ধূতি পরে গঙ্গায় স্নান করতে যান। কালিঘাটের মন্দিরে গিয়ে মা-মা বলে চিৎকার করে মন্দির মাত করে দেন। কিন্তু ক্বচিৎ আপিসে এলে সেই আগেকার কোট-প্যান্ট্ আবার বেরোয়। সেই আগেকার মতন চুরোট চিবোতে চিবোতে গট্-গট্ করে এসে আপিসে ঢোকেন। ভাবেন আগেকার মতই বুঝি সবাই সেলাম করবে, খাতির করবে, ভয় করবে। কিন্তু তাঁর নিজেরই চাপরাসী হরনাথ এখন আর আগেকার মত দাঁড়িয়ে উঠে সেলাম করে না। তাঁকে আসতে দেখেও হরনাথ টুলের ওপর বসে থাকে। তাঁর সামনেই টুলে বসে বিড়ি খায়। বিড়ির ধোঁয়া ছাড়ে।

বলে—কেমন আছেন নেপেনবাবু?

সেকশ্যানে সেকশ্যানে গিয়ে বসেন। সবাই কাজে ব্যস্ত। তাদের সঙ্গে গল্প ফাঁদবার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের আর খাতির করবার দরকার নেই তাঁকে।

বলেন—কী খবর গো রামলিঙ্গম্‌বাবু?

কিন্তু রামলিঙ্গম্বাবুর তখন গল্প করে নষ্ট করবার মত সময় নেই। অনেকক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরে আবার এক সময়ে বাড়ি চলে যান। কেউ ফিরেও চায় না তাঁর দিকে। কারোর হাত খালি দেখলেই কাছে বসেন। যেচে যেচে কথা বলেন। জিজ্ঞেস করেন—তোমাদের নতুন সাহেব কেমন কাজ করছে গো?

—কে? কোন্ সাহেবের কথা বলছেন!

—ওই যে নতুন ছোকরা! তোমাদের সেন-সাহেব গো! আমিই তো চাকরি করে দিয়েছিলুম একদিন। ওর মা এসে কেঁদে পড়লো। হাতে পায়ে ধরলো—ভাবলুম গরীবের ছেলে। দিলুম ঢুকিয়ে। যাক্, তা হাতে ধরে ইংরিজী ড্রাফ্ট শিখিয়েছি কত, কত ইংরিজী কেটেছি, ছোক্রা শুনতো মন দিয়ে বুঝলে, বরাবর কাজ শেখবার ঝোঁক ছিল, উন্নতি করবার ইচ্ছেটা ছিল। তা ছোকরা আমাকে এখনও খাতির করে ভায়া, অকৃতজ্ঞ নয়। সংসারের আজকাল কে-কার বলো না! তবু যা হোক্ উপকারটা মনে রেখেছে বটে!

কথা বলতে বলতে দেখেন সবাই যে-যার কাজে মন দিয়েছে। উঠে দাঁড়ান। বলেন—যাই, উঠি—তোমাদের দেখছি আজকাল কাজের খুব আঠা—ভাল, ভাল—

তারপর দীপঙ্করের ঘরের দরজার সামনে এসে মধুকে বলেন—কী রে, কেমন আছিস বাবা মধু? চিনতে পারিস?

বলে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকছিলেন। মধু বললে-ঢুকবেন না বাবু, সাহেব রাগ করবে—

—রাগ করবে মানে! জানিস সাহেবকে কে চাকরিতে ঢুকিয়েছে?

—তা হোক বাবু, না-বলে ঢুকলে আমার চাকরি চলে যাবে। এখন সাহেব ব্যস্ত!

নৃপেনবাবু রেগে যান। বলেন—জানিস আমি কে?

—আপনি যে-ই হোন বাবু, আমি সাহেবের চাকর, আমি ঢুকতে দেব না। আগে আপনি শ্লিপ্ দিন!

—শ্লিপ্ দিন্‌ মানে!

বলতে বলতে মুখে কথা আটকে যায় নৃপেনবাবুর। তারপর এদিক ওদিক চেয়ে দেখেন। হাতের কাছে যাকে দেখেন তাকেই ডাকেন। বলেন—ও গোবিন্দ, এই দ্যাখ, তোমাদের আপিসের চাপরাসীর কাণ্ড দ্যাখ। ঢুকছিলাম সেন-সাহেবের ঘরে, জানো তো সেন-সাহেবকে আমিই ঢুকিয়ে দিয়েছি—তা বলে কি না শিপ দিতে হবে। এতবড় আস্পর্ধা তোমাদের চাপরাসীদের আজকাল। আমার সময়ে এই কথা বললে সঙ্গে সঙ্গে বরখাস্ত করে দিতাম।—আমি জীবনে কখনও কারো বেয়াদপি সহ্য করিনি হে, আমার সঙ্গে চালাকি—

গোবিন্দবাবু কিছুই বলেন না।

নৃপেনবাবু বলেন—তোমাদের এস্টাব্লিশমেন্টের কর্তা আজকাল কে হে?

গোবিন্দবাবু বলেন— সুধীরবাবু!

—কে? সুধীর? সে আবার বড়বাবু হয়ে গেছে? তা যাচ্ছি আমি, সুধীরকে গিয়ে বলছি—

বলে হন্ হন্ করে বারান্দা পার হয়ে এস্টাব্লিশমেন্ট সেকশ্যানের দিকে চলে যান। গিয়ে দেখেন নতুন নতুন ক্লার্ক। কাউকেই চিনতে পারেন না। সুধীরবাবুও চেয়ারে নেই, হয়ত সাহেবের ঘরে গেছেন। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন সেখানে। তবু সুধীরের দেখা পান্ না। কেউ যেন তাঁকে চেনেই না। কি-রকম যেন বোকা-বোকা দৃষ্টি দিয়ে দেখেন সকলের দিকে। তারপর আবার চুরোট টানতে টানতে চলে যান বাইরে। বাইরে গিয়ে রাস্তার ট্রামে গিয়ে উঠে পড়েন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *