কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৩

১৩

দীপঙ্করের মনে আছে সেদিন মিস্টার ঘোষালের চিৎকারে শুধু হেসেছিল সে। শুধু হাসি পেয়েছিল দীপঙ্করের। সত্যি, সে কতদিন আগেকার কথা। কতদিন আগের সেই সব ঘটনা। ঘটনার নিবিড় জালে জড়িয়ে গিয়েছিল তখন দীপঙ্কর। সেই সনাতনবাবু! সেই নয়নরঞ্জিনী দাসী! সেই নিৰ্মল পালিত! সেই লক্ষ্মীদি!

প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের ঘোষ-বাড়ির ভেতরেও তখন অনেক অদল-বদল হয়েছে। মা-মণি তখন ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছেন একেবারে। ড্রাইভার ছাড়িয়ে দিয়েছেন, গাড়ি বেচে দিয়েছেন। চাকর-বাকরও ছাড়িয়ে দেবার মতলব করেছেন। বউবাজারের বাড়ি, শ্যামবাজারের তিনখানা বাড়িও বেচে দেবার তোড়জোড় করছেন।

নির্মল পালিত বলে—কিন্তু টাকা বাঁচিয়ে আপনার লাভ কী মা-মণি?

মা-মণি বলেন—না বাবা, আমি ছেলের জন্যে কিছুছু রেখে যাবো না, আমার গাড়ি আমার বাড়ি আমি যা খুশি করবো, তাতে কারো কিছু বলবার নেই—

নির্মল পালিত বলতো—কিন্তু ক্যাশ টাকা নিয়েই বা আপনি কী করবেন?

মা-মণি বলতেন—আমি খরচ করবো—

—কীসে খরচ করবেন?

মা-মণি বলতেন—আমি কলকাতা ছেড়ে কাশীবাস করবো, শ্রীক্ষেত্রে গিয়ে থাকবো, আমার কীসের দরকার কলকাতায় থাকার, আমার কে আছে? আমি কার ওপর ভরসা করবো—?

—কেন? আপনার টাকা আছে, আপনার ভাবনা কীসের? টাকা থাকলেই তো সব থাকা হলো, টাকা থাকাই তো সব থাকা। আপনি কেন এত ভাবছেন? আর তাছাড়া, আমি তো আছি—আপনার টাকা-কড়ির ব্যাপারটা, আপনার প্রপার্টির ব্যাপারটা আমার হাতে ছেড়ে দিয়ে আপনি চুপ করে বসে থাকুন না—

—কিন্তু বাবা, আমি চাই না যে বুড়ো বয়েসে ছেলে আমাকে লাথি-ঝাঁটা মারবে! সারা জীবন সব কিছু নিজে চালিয়ে আমি বুড়ো বয়েসে পরের মুখ-নাড়া সইতে পারবো না—

নির্মল পালিত বলতো—সেই জন্যেই তো বলছি আপনি ট্রাস্ট করে যান, আমি সেই ট্রাস্টের ভার নিচ্ছি

—সে ট্রাস্টে কী হবে?

—তাতে আপনি সারা-জীবন, যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন নিজের মাথা উঁচু করে বুক ফুলিয়ে বেড়াতে পারবেন!

মা-মণি বলতেন—কিন্তু আমি মেয়েমানুষ, কাউকেই যে আমার বিশ্বাস হয় না বাবা, আমার যে ভয় করে—

নির্মল পালিত বলতো—কিন্তু আমাকে? আমাকেও আপনি বিশ্বাস করেন না?

—না বাবা, তোমার কথা আলাদা! কিন্তু সবাই তো আর তোমার মত নয়!

নির্মল পালিত বলতো-তা আমিই তো চালাবো—আমি তো এত শিগির মারা যাচ্ছি না—

—তা কী করতে হবে?

নির্মল পালিত বলতো—কিছুই করতে হবে না আপনাকে, এইখানে একটা সই করতে হবে শুধু —

মা-মণি একটু দ্বিধা করতেন। নির্মল পালিত বলতো—এখনি সই করতে হবে না, পরে ধীরে সুস্থে বিচার-বিবেচনা করে সই করলেও হবে—সই করবার আগে একবার সনাতনবাবুকে জিজ্ঞেস করে নেবেন—হাজার হোক ছেলে তো—একমাত্র সন্তান—

—ছেলে?

ছেলের নাম শুনেই মা-মণি জ্বলে উঠতেন। বলতেন—তুমি আমার ছেলের নাম মুখে এনো না বাবা, ছেলে আমার শত্রু—খবরদার বলছি, তার নাম মুখে আনতে পারবে না তুমি —

নির্মল পালিত বোঝাতো। বলতো—এখন মুখে বলছেন ওই কথা, কিন্তু নিজের ছেলে তো হাজার হোক, দু’দিন পরে সব মিটে যাবে আপনাদের—তখন আমাকেই দোষ দেবেন আপনারা—

—তুমি থামো দিকিনি, ও ছেলের মুখদর্শন আমি আর করবো না প্রতিজ্ঞা করেছি— তা জানো তুমি?

নির্মল পালিত তাতেও দমলো না। বললে—না মা-মণি, তাহলেও আমিও তো আপনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি, এতগুলো টাকার ব্যাপার—একটা-দুটো নয়, লক্ষ-লক্ষ টাকার ব্যাপার-আমারও তো লোভ হতে পারে। কিছুই বলা যায় না— তাই বলছিলুম একবার সনাতনবাবুর সঙ্গে পরামর্শ করে আপনার সই করাই ভাল—

মা-মণির আর তর্ সইল না। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন—তুমি আমাকে দাও তো কাগজখানা—দাও—

নির্মল আস্তে আস্তে ডীড় খানা বাড়িয়ে ধরলে। বললে—না মা-মণি, আমার তবু সন্দেহ যাচ্ছে না, আমার মনে হচ্ছে আমি যেন ঠকিয়ে নিচ্ছি আপনার কাছ থেকে

মা-মণি ততক্ষণে কাগজের ওপর সই করে দিয়েছেন। মোটা-মোটা অক্ষরে লিখে দিয়েছেন—শ্রীমতী নয়নরঞ্জিনী দাসী!

.

আর ঠিক সেই মুহূর্তে পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন রং লাগানো শুরু হয়ে গেল। নেপোলিয়নের পর পৃথিবীর আর কোনও ডেস্পট এমন করে মানচিত্রের মূল ধরে নাড়া দিতে পারেনি। নরওয়ে থেকে স্পেন পর্যন্ত যত পোর্ট যত সী-কোস্ট আছে সব বেহাত হয়ে গেল একে-একে। ইটালী মেডিটারেনীয়ান-এর রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। লিবিয়া আর ইথিওপিয়ার ইটালীয়ানরা ঈজিপ্ট দখল করবার তোড়জোড় করছে। ঈজিপ্ট দখল করে সুয়েজ নেবে। সুয়েজের পর নেবে এডেন। তারপর নেবে টিউনিস্, তারপর ফ্রেঞ্চ মরোক্কা। সেই মুহূর্তেই মাথায় হাত দিয়ে বসেছে ব্রিটিশ। লন্ডন সাদাম্ প্ট লিভারপুল গ্লাসগোর খাবার-দাবার আনার পথ বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড়। হল্যান্ড ফ্রান্স নর্থ আফ্রিকা থেকেই আসতো লোহা আর কাগজ, মাখন আর ডিম—সব বন্ধ হয়ে গেল। কী হবে তাহলে? তাহলে কী হবে? চার সপ্তাহে গেছে পোল্যান্ড। তিরিশ মিলিয়ান লোকের দেশ। আর সব জড়িয়ে ষাট মিলিয়ন লোকের দেশ নরওয়ে, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস্, বেলজিয়াম আর ফ্রান্স—তা যেতে সময় লেগেছে মোটে আট সপ্তাহ। আর কতদিন টিঁকে থাকবে গ্রেট ব্রিটেন? আর ঠিক সেই মুহূর্তে স্যার উইনস্টন চার্চিল এসে গ্রেট ব্রিটেনের হাল ধরে বসলেন। আর রক্ষে নেই। আর বিশ্বাস নেই কাউকে। বাঁচতেই হবে। নয়নরঞ্জিনী দাসীকে বাঁচতেই হবে। দরকার হলে নির্মল পালিতকে আঁকড়ে ধরেও বাঁচতে হবে। তিনি মোটা-মোটা অক্ষরে নিজের হাতে নিজের নাম সই করে দিলেন। লিখে দিলেন নিজের দাসখৎ।

আর সেই মুহূর্তেই নিজের ঘরের বিছানায় সনাতনবাবু যন্ত্রণায় কাতর শব্দ করে উঠলেন—মা মাগো —

আর সেই মুহূর্তেই মিস্টার ঘোষাল এসে ঢুকলো সতীর ফ্ল্যাটের ভেতরে। রেগে আগুনের মত এসে ফেটে পড়লেন। বললেন—কেন এসো তুমি এখানে? হু দি হেল্‌ টোল্ড ইউ টু কাম্ হিয়ার? হু?

দীপঙ্কর বসে ছিল সোফাটার ওপর। মিস্টার ঘোষাল ঘরে এসে ঢুকতেই দাঁড়িয়ে উঠলো।

বললে—আমি নিজেই এসেছি এখানে, সতী আমাকে ডাকেনি—

—কিন্তু কেন? কেন? হোয়াই? আন্ডার হুজ অথরিটি?

দীপঙ্কর বললে—আপনি বসুন, আমি সমস্ত খুলে বলছি—

মিস্টার ঘোষাল বসলো না। বললে-আমি সমস্ত কিছু জানতে চাই না। মিসেস ঘোষের সঙ্গে তোমার কিসের সম্পর্ক আমি সেইটে জানতে চাই। মিসেস ঘোষের লাইফ ইজ্ ইন ডেন্‌জার, মিসেস ঘোষের প্রেস্টিজ্ ইজ য়্যাট স্টেক, আমি মিসেস ঘোষের কাছ থোকসব ঘটনা শুনেছি। মিসেস ঘোষের কোনও দোষ নেই—সি ইজ্ এ চেস্ট্ লেডী। তাকে এ-রকমভাবে অপমান করবার কী রাইট্ আছে তোমাদের? জানো, আমি তোমার নামে ট্রেসপাসের চার্জ আনতে পারি? তোমাকে মিসেস ঘোষের মডেস্টি আউরেজের চার্জে প্রসিকিউট্ করতে পারি?

—কিন্তু সে তো মিথ্যে কথা!

মিস্টার ঘোষাল গর্জে উঠলো! বললে—কে বললে মিথ্যে কথা? জানো, টাকা খরচ করলে মিথ্যেকে সত্যি করা যায় মডার্ন ওয়ার্ল্ডে? আমার টাকা আছে, আমি টাকার জোরে তোমাকে মিথ্যেবাদী লায়ার প্রমাণ করতে পারি? সে-রকম য়্যাডভোকেট্ আছে কলকাতা শহরে—টাকার জোরে সাক্ষী ল’য়্যার, প্রসিকিউশন সব পাওয়া যায়—তা জানো? আই ক্যান বাই জাস্টিস—বিচার কেনা যায় তা জানো তুমি?

দীপঙ্কর চুপ করে রইল।

মিস্টার ঘোষাল বললে—যদি ভাল চাও তো চলে যাও—অ্যান্ড ডু নেভার কাম হিয়ার। আর কখনও এসো না।

দীপঙ্কর তবু নড়লো না। যেমন দাঁড়িয়ে ছিল, তেমনিই দাঁড়িয়ে রইল।

—ডু ইউ হিয়ার মী অর নট্? বেরিয়ে যাও এখান থেকে, বেরিয়ে যাও—আর এক

মিনিট তুমি এখানে থাকতে পাবে না—

দীপঙ্কর তবু নড়লো না।

—তুমি জানো আই পজেস্ এ রিভলবার? আমার রিভলবার আছে তা তুমি জানো? বিফোর আই ইউজ দ্যাট, আই ওয়ান্ট ইউ টু লীভ দি রুম! আদারওয়াইজ আমি পুলিস ডাকবো! আমি তোমাকে য়্যারেস্ট করাবো! আমি তোমার চাকরি খতম করতে পারি তা জানো?

মিস্টার ঘোষাল যেন বাঘের মত ঘরের ভেতর ছুটোছুটি করতে লাগলো। অস্থির হয়ে পায়চারি করতে লাগলো। যেন দীপঙ্করকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে খাবে। আঁচড়ে কামড়ে নিঃশেষ করে ফেলবে।

তবু দীপঙ্কর ধীর স্থির হয়ে পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইল সেইখানে।

ঘোষাল চিৎকার করে বললে—এখনও যাবে না? তুবু যাবে না তুমি?

এতক্ষণে দীপঙ্করের মুখে কথা ফুটলো। গম্ভীর গলায় বললে–নো, আই ওন্ট্—

আর সঙ্গে সঙ্গে যেন বজ্রপাত হলো ঘরের ভেতর। মিস্টার ঘোষালের মুখের ওপর এমন করে কথা বলার সাহস রেলের অফিসের ইতিহাসে কখনও হয়নি। মিস্টার ঘোষাল যেন একটা প্রচন্ড নাড়া খেয়ে আত্মসংবিৎ ফিরে পেলে। তারপর বললে—অল্ রাই—

বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আর তারপর এক মুহূর্তের মধ্যেই আবার ফিরলো। হাতে তখন তার খোলা রিভলবার। দীপঙ্করের দিকে মুখ ঠিক করে চিৎকার করে উঠলো—গেট্ আউট্—গেট্ আউট্—

দীপঙ্কর সেই দিকে শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে উত্তর দিলে–নো, আই ওন্ট—

আর সঙ্গে সঙ্গে কী ঘটতো বলা যায় না।

— দীপু —

হঠাৎ সতী আর থাকতে পারলো না। একেবারে দীপঙ্করের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো হঠাৎ। বললে—তুমি করছো কী দীপু—তুমি করছো কী—তুমি যাও এখান থেকে— যাও—

দীপঙ্কর সতীর মুখের দিকে চাইলে একবার। তারপর বললে—না—

সতী দীপঙ্করের হাত ধরে টানতে লাগলো। দীপঙ্করকে টেনে বাইরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলে। বললে—পাগলামি কোর না দীপু, তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? তুমি যাও না, চলে যাও—

দীপঙ্কর তবু বলতে লাগলো-না, আমি যাবো না—

ততক্ষণে দীপঙ্করকে ঠেলে বাইরে নিয়ে এসেছে সতী। ঘরের বাইরে। বারান্দায়।

—তুমি চলে যাও এখান থেকে। কী পাগলামি করছো, বলো তো!

দীপঙ্কর বললে—পাগলামি আমি করছি না তুমি করছো?

—বেশ, তোমার কথাই সই, আমিই পাগলামি করছি, কিন্তু তোমার পায়ে পড়ি তুমি চলে যাও দীপু, এখন আর কথা বাড়িও না চলে যাও—

দীপঙ্কর সতীর মুখের দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলে। বললে—কিন্তু তোমাকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে কী করে চলে যাই তাই বলো?

সতী তখনও ঠেলছে দীপঙ্করকে। বললে—তুমি আর কথা বাড়িও না দীপু, তুমি চলে যাও—

দীপঙ্কর বললে—যেতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু মিস্টার ঘোষাল ভাববে আমি ওর রিভলবার দেখে ভয় পেয়েছি—

সতী বললে—ওসব কথা থাক, তুমি যাও, এখন চলে যাও—দেখছো না ও একটা জানোয়ার, একটা পশু ও—ও সব করতে পারে—

দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। বললে—কিন্তু তুমি? ওই জানোয়ারের কাছেই তো থাকবে তুমি!

সতী বললে—আমার কথা ছেড়ে দাও দীপু। এই-ই আমার কপাল—আমার কথা তুমি ভেবো না। আমার যা হয় হোক, কিন্তু তুমি চলে যাও—চলে যাও তুমি—আর কখনও এসো না—

বলে দীপঙ্করকে ঠেলে একেবারে বারান্দার শেষ প্রান্তে নিয়ে গেল। তারপর হঠাৎ দীপঙ্করকে রেখে নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজায় খিল লাগিয়ে দিলে।

দীপঙ্কর সেইখানে দাঁড়িয়ে অন্ধকার বারান্দার দিকে চেয়ে হতবুদ্ধি হলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *